২.৬. তাবেয়ীগণ বিষয়ক
তাবেয়ী ও পরবর্তী যুগের বুযুর্গগণের বিষয়ে অগণিত বানোয়াট কথা প্রচলিত। তন্মধ্যে কয়েকটি প্রসিদ্ধ বিষয় উল্লেখ করছি।
১. উয়াইস করনী(রাহ)
রাসূলুল্লাহ(সা) এর জীবদ্দশায় ইয়ামানের কারণ গোত্রের উয়াইস ইবনু আমির নামক এক ব্যক্তির কথা সাহাবীগণকে বলেন এবং তাঁর ইন্তিকালের পরে উমারের(রা) সাক্ষাতের কথা সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী যুগে হযরত উয়াইসকে কেন্দ্র করে অনেক আজগুবী মিথ্যা কথা বানানো হয়েছে। অনেক বক্তা শ্রোতাগণকে বিমুগ্ধ করার জন্য আজগুবি কথা বানিয়েছেন। অনেক সরলপ্রাণ দরবেশ যা শুনেছেন তাই বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে কিছু আছে উয়াইস কেন্দ্রিক। আর কিছু কথা বানানো হয়েছে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে। এগুলি নিঃসন্দেহে খুব ভয়ঙ্কর ও কঠিনতম গোনাহের কারণ।
হযরত উয়াইস ইবনু আমির আল কারনী(রা) সম্পর্কে সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত সহীহ হাদীসে যতটুকু বর্ণিত হয়েছে তার সার সংক্ষেপ হলোঃ হযরত উমার(রা) যখন খলীফা ছিলেন(১৩-২৩ হি) তখন তাঁর কাছে ইয়ামেনের সৈন্যদল আগমন করলে জিজ্ঞাসা করতেন, আপনাদের মধ্যে কি উয়াইস ইবনু আমির নামে কেউ আছেন? এভাবে একবার তিনি উয়াইসকে পেয়ে যান। তিনি বললেনঃ আপনি উয়াইস? উয়াইস বলেনঃ হ্যা। উমার বলেনঃ আপনি কারন গোত্রের শাখা মুরাদ গোত্রের মানুষ? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। উমার বলেনঃ আপনার শরীরে কুষ্ঠরোগ ছিল এবং শুধুমাত্র নাভীর কাছে একটি দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া বাকি সব আল্লাহ তাআলা ভাল করে দিয়েছেন? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ। উমার বলেনঃ আপনার আম্মা আছেন? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ। তখন উমার বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ(সা) কে বলতে শুনেছিঃ “ইয়ামানের সৈন্যদলের সাথে উয়াইস ইবনু আমির তোমাদের নিকট আগমন করবেন। তিনি কারনে গোত্রের শাখা মুরাদ গোত্রের মানুষ। তাঁর শরীরে কুষ্ঠ রোগ ছিল। আল্লাহ এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া বাকী সব ভাল করে দিয়েছেন। তাঁর আম্মা আছেন। তিনি তাঁর আম্মার সেবা করেন। তিনি যদি আল্লাহর কাছে কসম করে কিছু বলেন তবে আল্লাহ তাঁর কথা রাখবেন। যদি তুমি তার কাছে তোমার গোনাহ মাফের জন্য দোয়া চাইতে পার তবে চাইবে।” অন্য বর্ণনায়, “তাবেয়ীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন একব্যক্তি যার নাম উয়াইস।….তোমরা তাকে বলবে তোমাদের জন্য ক্ষমা চাইতে।”
একথা বলে হযরত উমার(রা)বলেনঃ আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তখন উয়াইস আল্লাহর কাছে উমারের গোনাহের ক্ষমার জন্য দোয়া করেন। উমার তাঁকে বলেনঃ আপনি কোথায় যাবেন? তিনি বলেনঃ আমি কুফায় যাব। উমার বলেনঃ তাহলে আমি আপনার জন্য কুফার গভর্ণরের কাছে চিঠি লিখে দিই? উয়াইস বলেনঃ অতি সাধারণ মানুষদের মধ্যে মিশে থাকাই আমার বেশি পছন্দ। পরের বছর কুফার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হজ্জ্বে গমন করেন। তিনি খলীফা উমারের(সা) সাথে দেখা করলে তিনি তাকে উয়াইস সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বলেনঃ তাকে তো একটি অতি ভগ্ন বাড়িতে অতি দরিদ্র অবস্থায় দেখে এসেছি। তখন উমার(রা) রাসূলুল্লাহ(সা) এর উপরের হাদীসটি তাকে বলেন। তখন ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কুফায় ফিরে উয়াইসের নিকট গমন করে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য অনুরোধ করেন। উয়াইস বলেনঃ আপনি তো হজ্জের নেক সফর হতে ফিরে আসলেন, আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আপনি কি উমারের(রা) এর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন উয়ায়েস তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফের জন্য ক্ষমা চান। এই ঘটনার পর মানুষেরা উয়ায়েস সম্পর্কে জেনে যায়। ফলে তাঁর কাছে মানুষ আসা যাওয়া করতে থাকে। তখন উয়াইস লোকচক্ষুর আড়ালে কোথাও চলে যান।
পরবর্তী প্রায় দুই দশক হযরত উয়াইস কারনী লোকচক্ষুর আড়ালে সমাজের অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন ধারণ করেছিলেন। যে এলাকায় যখন বসবাস করতেন সেখানের মসজিদে সাধারণ মুসল্লী হিসেবে নিয়মিত নামাযে ও ওয়ায আলোচনায় বসতেন। কখনো নিজেও কিছু বলতেন। মসজিদে বসে কয়েকজন কুরআন তিলাওয়াত করতেন বলেও জানা যায়। এভাবেই তিনি বিভিন্ন জিহাদে শরীক হতেন বলে জানা যায়। ৩৭ হিজরীতে হযরত আলী(রা) ও হযরত মু’আবিয়ার(রা) মধ্যে সিফফীনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে হযরত উয়াইস কারনী হযরত আলীর(রা) সেনাদলে ছিলেন। তিনি হযরত আলীর পক্ষে যুদ্ধ করতে করতে একসময় শহীদ হয়ে যান। (মুসলিম, আস-সহীহ, ৪/১৯৬৮-১৯৬৯; আহমদ, আল মুসনাদ ৩/৪৮০; হাকিম, আল মুসতাদরাক, ৩/৪৫৫-৪৬১)।
এই হলো তাঁর সম্পর্কে সহীহ বর্ণনা। তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত। তিনি নাকি তাঁর আম্মাকে বহন করতেন। তিনি নাকি উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ(সা) এর পবিত্র দাঁত আহত হওয়ার সংবাদে নিজের সকল দাঁত ভেঙ্গে ফেলেছিলেন, ইত্যাদি। এ সকল কথার কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় না। বলা হয়, হযরত উমার(রা) ও আলী(রা) নাকি তাঁর কাছে গিয়ে দেখা করেন বা দোয়া চান। এগুলি সবই মিথ্যা কথা। উপরের সহীহ হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ(সা) এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে উয়াইসই উমারের(রা) দরবারে এসেছিলেন।
তবে আরো মারাত্মক হলো তাঁকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে বানোয়াট কথা। যেমন বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ(সা) তাঁর ওফাতের পূর্বে তাঁর মোবারক পিরহান বা পোশাক উয়াইস কারনীর(রাহ) জন্য রেখে যান এবং হযরত উমার(রা) ও হযরত আলী(রা) তাঁকে সেই পোশাক পৌছে দেন। কথাগুলি সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। ইবনু দাহিয়া, ইবনুস সালাহ, ইবনু হাজার আসকালানী, সাখাবী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একমত যে, এগুলি সবই বাতিল ও বানোয়াট কথা। (ইবনুল জাওযী, আল মাউদূয়াত, ১/৩৫০; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৪৯; ইবনু ইরাক, তানযীহ ২/৩২-৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৮১)।
২. হযরত হাসান বসরী(রাহ)
হযরত হাসান বসরী (রাহ)(২২-১০৯ হি) একজন প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট কথা সমাজে প্রচলিত। যেমনঃ হাসান বসরী ও রাবেয়া বসরী দুইজনের কথাবার্তা, আলোচনা ইত্যাদি আমাদের সমাজে অতি প্রচলিত। অথচ দুইজন সমবয়সী বা সমসাময়িক ছিলেন না। রাবেয়া বসরী ১০০ হিজরী বা তার কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮০/১৮১ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। হাসান বসরী যখন ইন্তিকাল করেন তখন রাবেয়া বসরীর বয়স মাত্র ১০/১১ বৎসর। এ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এই দুইজনকে নিয়ে প্রচলিত গল্পকাহিনীগুলো সবই বানোয়াট। তবে সবচেয়ে মারাত্মক হলো, তাঁকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ(সা) এর নামে মিথ্যা কথা বলা। যেমন, প্রচলিত আছে যে-হাসান বসরী আলীর(রা) মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ(সা) হতে তরীকত গ্রহণ করেন বা চিশতিয়া তরীকতের খিরকা, লাঠি ইত্যাদি গ্রহণ করেন। এই বাক্যটি ভিত্তিহীন।
হযরত হাসান বসরী(রা) তাবেয়ীগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজাহিদ, ওয়ায়িজ ও সংসারত্যাগী বুজুর্গ ছিলেন। তিনি হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা দানের পাশাপাশি জাগতিক লোভ লালসার বিরুদ্ধে এবং জীবনের আরাম আয়েশ ত্যাগ করে পরকাল কেন্দ্রিক করার জন্য ওয়ায করতেন, আখিরাতের কথা স্মরণ করে আল্লাহর প্রেমে ও আল্লাহর ভয়ে কান্নাকাটি করতেন। তাঁর এসকল মজলিসের বিশেষ প্রভাব ছিল তৎকালীন যুগের মানুষদের মাঝে। পরবর্তী যুগের অধিকাংশ সূফী দরবেশ তাঁর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর থেকে শিক্ষা নিয়েছেন।
হযরত হাসান বসরীর(রাহ) যুগে তাসাউফ, সূফী ইত্যাদি শব্দ অপরিচিত ছিল। এছাড়া প্রচলিত অর্থে তরীকতও অপরিচিত ছিল। তাঁরা মূলত কুরআন ও হাদীসের আলোকে আল্লাহর মহব্বত ও আখিরাতের আলোচনা করতেন এবং বেশি বেশি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতেন। তরীকতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মানুষের কাছে গমনের রীতিও তখন ছিল না। বিভিন্ন সাহাবী ও তাবেয়ীর সামগ্রিক সাহচর্যে মানুষ হৃদয়ের পূর্ণতা লাভ করত। প্রায় ৫০০ শত বৎসর পরে যখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বিচ্ছিন্নতা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ও তাতারদের ভয়াবহ হামলায় ছিন্নভিন্ন, তখন হিজরী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে তরীকাগুলি প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করে।
কাদেরীয়া তরীকার সম্পর্ক হযরত আব্দুল কাদির জিলানীর(রাহ)(মৃত্যু ৫৬১ হি/১১৬৬ খৃ.) সাথে। তবে তিনি প্রচলিত কাদেরীয়া তরীকা প্রতিষ্ঠা বা প্রচলন করে যান নি। তাঁর অনেক পরে তা প্রচলিত হয়েছে। রিফায়ী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা আহমদ ইবনু আলী রিফায়ী (রাহ)(মৃত্যু ৫৭৮ হি)। সোহরাওয়ার্দী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী(রাহ)(মৃত্যু ৬৩২ হি)। হযরত মঈনুদ্দীন চিশতী (রাহ) চিশতিয়া তরীকার মূল প্রচারক। তিনি ৬৩৩ হিজরীতে(১২৩৬ খৃ.) ইন্তিকাল করেন। আলী ইবনু আব্দুল্লাহ শাযলী (রাহ)(৬৫৬ হি/১২৫৮ খৃ.) শাযলীয়া তারীকা প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ বুখারী বাহাউদ্দীন নকশাবন্দ(রাহ)(মৃ. ৭৯১ হি) নকশাবন্দীয়া তরীকার প্রতিষ্ঠা করেন। এঁরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে মাসনূন ইবাদতগুলি বেছে তার আলোকে মুসলিমগণের আধ্যাত্মিক উন্নয়েনের প্রচেষ্টা করেন। প্রকৃতপক্ষে সেই অন্ধকার ও কষ্টকর দিনগুলিতে তাঁরাই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তী যুগের একটি প্রচলিত একটি কথা হলো, চিশতীয়া তরীকা ও অন্য কিছু তরীকা হাসান বসরী(রাহ) হযরত আলীর(রা) মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ(সা) থেকে লাভ করেছেন। তিনি হযরত আলী(রা) হতে খিরকা ও খিলাফত লাভ করেছেন ও তরীকতের সাজ্জাদ-নশীন হয়েছেন। কথাটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
হাসান বসরী(রাহ) ২২ হিজরীতে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর বয়স যখন ১৩ বৎসর তখন ৩৫ হিজরীতে আলী(রা) খলীফা নিযুক্ত হন এবং খিলাফতের কেন্দ্র বা রাজধানী মদীনা হতে কুফায় স্থানা্ন্তরিত করেন। এরপর আর হাসান বসরী(রা) আলীকে (রা) দেখেন নি। তিনি আলী(রা) এর দরবারে বসে শিক্ষা গ্রহণেরই সুযোগ পান নি। ৪০ হিজরীতে হযরত আলী(রা) শহীদ হন। আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, হযরত আলী(রা) তাঁর যোগ্যতম সন্তানগণ, অগণিত নেতৃস্থানীয় ভক্ত, ছাত্র ও সহচরদের বাদ দিয়ে ১৩ বছরের কিশোরকে খিরকা ও খিলাফত দিয়ে যান নি বা সাজ্জাদ-নশীন করেন নি। ইবনু দাহিয়া, ইবনুস সালাহ, যাহাবী, ইবনু হাজার, সাখাবী, মুল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এগুলি সব ভিত্তিহীন ও বাতিল কথা। (সাখাবী, আল মাকাসিদ, পৃ. ৩৩৫; মুল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ১৮১)।