১.২. মিথ্যা ও ওহীর নামে মিথ্যা
১.২.১. মিথ্যার সংজ্ঞা
প্রসিদ্ধ ও পরিজ্ঞাত বিষয় সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। মিথ্যার সংজ্ঞা কি? সত্যের বিপরীতই মিথ্যা। যা সত্য নয় তাই মিথ্যা। এমন কিছু বলা, যা প্রকৃতপক্ষে ঠিক নয় বা সত্য নয় তাই মিথ্যা।
১.২.১.১. ইচ্ছাকৃত বনাম অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা
বিষয়টি স্পষ্ট। তবে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার বিষয়ে মুসলিম আলিমদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে। মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের আলেমগণ মনে করতেন যে, ভুল বশত যদি কেউ কিছু বলেন যা প্রকৃত অবস্থার বিপরীত তবে তা শরীয়তের পরিভাষায় মিথ্যা বলে গণ্য হবেনা। শুধুমাত্র জেনেশুনে মিথ্যা বললেই তা মিথ্যা বলে গণ্য হবে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলিমগণ এই ধারণার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁদের মতে না জেনে বা ভুলে মিথ্যা বললেও তা শরীয়তের পরিভাষায় মিথ্যা বলে গণ্য হবে।
ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-নাবাবী(৬৭৬হি) বলেনঃ “হক্ক পন্থী আলেমদের মত হলো, ইচ্ছাকৃতভাবে, অনিচ্ছায়, ভুলে বা অজ্ঞতার কারণে প্রকৃত অবস্থার বিপরীত কোনো কথা বলাই মিথ্যা।” [নাবাবী, ইয়াহইয়া ইবনে শারাফ(৬৭৬ হি) শারহু সাহীহি মুসলিম ১/৯৪]
তিনি আরো বলেনঃ “আমাদের আহলুস সুন্নাহ-পন্থী আলিমগণের মতে মিথ্যা হলো প্রকৃত অবস্থার বিপরীত কোনো কথা বলা, তা ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা ভুলে হোক। মু্‘তাযিলাগণের মতে শুধু ইচ্ছাকৃত মিথ্যাই মিথ্যা বলে গণ্য হবে।” (নাবাবী, শারহু সাহীহি মুসলিম ১/৬৯)।
১.২.১.২. হাদীসের আলোকে অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা
হাদীসের ব্যবহার থেকে আমরা নিশ্চিত হই যে, ইচ্ছাকৃতভাবে, অনিচ্ছাকৃতভাবে, অজ্ঞতার কারণে বা যে কোনো কারণে বাস্তবের বিপরীত যে কোনো কথা বলাই মিথ্যা বলে গণ্য।
১. জাবির ইবনু আবদুল্লাহ(রা) বলেনঃ আরবী(******)
-হাতিব ইবনু আবী বালতা‘আ(রা) এর একজন দাস রাসূল(স) এর নিকট আগমন করে বলেঃ হে আল্লাহর রাসূল!নিশ্চয় হাতিব জাহান্নামে প্রবেশ করবেন। তখন রাসূলুল্লাহ(স) বলেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছ। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা; কারণ সে বদর ও হুদাইবিয়ায় উপস্থিত ছিল। (মুসলিম, আস সহীহ ৪/১৯৪২)।
এখানে রাসূলুল্লাহ(স) হাতিবের এই দাসের কথাকে মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন। সে অতীতের কোনো বিষয়ে ইচ্ছাকৃত কোনো মিথ্যা বলেনি। মূলত সে ভবিষ্যতের বিষয়ে তার একটি ধারণা বলেছে। সে যা বিশ্বাস করেছে তাই বলেছে। তবে যেহেতু তার ভবিষ্যদ্বাণীটি বাস্তবের বিপরীত সেজন্য আল্লাহর রাসূল(স) তাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন। এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, অতীত বা ভবিষ্যতের যে কোনো সংবাদ যদি বাস্তবের বিপরীত হয় তাহলে তা মিথ্যা বলে গণ্য হবে। সংবাদদাতার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, অজ্ঞতা বা অন্য কোনো বিষয় এখানে ধর্তব্য নয়। তবে মিথ্যার পাপ বা অপরাধ ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত।
২. তাবেয়ী সালিম ইবনু আবদুল্লাহ বলেন, আমার পিতা আবদুল্লাহ ইবনু উমারকে(রা) বলতে শুনেছিঃ আরবী(*****)
-এই হলো তোমাদের বাইদা প্রান্তর, যে প্রান্তরের বিষয়ে তোমরা রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বল(তিনি এই স্থান হতে হজ্জের ইহরাম শুরু করেছিলেন বলে তোমরা বল।) অথচ রাসূলুল্লাহ(স) যুল হুলাইফা প্রান্তরে মসজিদের নিকট হতে হজ্জের ইহরাম বেঁধেছিলেন। (মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৪৩)।
স্বভাবতই ইবনু উমার(রা)এসকল সাহাবী তাবেয়ীগণকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলার অভিযোগ করছেননা। রাসূলুল্লাহ(স) বিদায় হজ্জের সময় লক্ষাধিক সাহাবীকে নিয়ে হজ্জ করেন। তিনি মদীনা থেকে বের হয়ে ‘যুল হুলাইফা’ প্রান্তরে রাত্রি যাপন করেন এবং পরদিন সকালে সেখান থেকে হজ্জের এহরাম করেন। যুল হুলাইফা প্রান্তরের সংলগ্ন ‘বাইদা’ প্রান্তর। যে সকল সাহাবী কিছু দূরে ছিলেন তাঁরা তাঁকে যুল হুলাইফা থেকে এহরাম বলতে শুনেননি, বরং বাইদিয়া প্রান্তরে তাঁকে তালবীয়া পাঠ করতে শুনেন। তাঁরা মনে করেন যে, তিনি বাইদা থেকেই এহরাম শুরু করেন। একারণে অনেকের মধ্যে প্রচারিত ছিল যে, রাসূলুল্লাহ(স) বাইদা প্রান্তর থেকে এহরাম শুরু করেন। আবদুল্লাহ ইবনে উমার যেহেতু কাছেই ছিলেন, সেহেতু তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, বাইদা থেকে এহরাম করার তথ্যটি ছিল অনিচ্ছাকৃত ভুল। যারা তথ্যটি প্রদান করেছেন তারা তাদের জ্ঞাতসারে সত্যই বলেছেন। কিন্তু তথ্যটি যেহেতু বাস্তবের বিপরীত এজন্য ইবনু উমার তাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন।
১.২.১.৩. মিথ্যা বনাম ‘মাউদূ’(মাউযূ) ও ‘বাতিল’
(মূল আরবী উচ্চারণে আমরা মাউদূ বলতেই অভ্যস্ত। পক্ষান্তরে ফার্সী ও উর্দূ প্রভাবিত বাংলা ব্যবহারে আমরা মাউযূ বলে থাকি)।
হাদীসের পরিভাষায় ও প্রথম শতকে সাহাবী-তাবেয়ীগণের পরিভাষায় রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কথিত মিথ্যা কথাকে ‘মিথ্যা হাদীস’ বলে অভিহিত করা হতো। আবু উমামাহ(রা), বলেন রাসূলুল্লাহ(স) বলেনঃ আরবী(*******)
-যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার নামে ‘মিথ্যা হাদীস’ বলবে তাকে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।(তাবারানী, সুলাইমান ইবনু আহমদ(৩৬০ হি), আল-মু’জামুল কাবীর ৮/১২২)
যে কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেননি তা তাঁর নামে বলা হলেও সাহাবীগণ বলতেনঃ এই হাদীসটি মিথ্যা, মিথ্যা হাদীস বা অনুরূপ শব্দ ব্যবহার করতেন। এই ধরনের মানুষদের সম্পর্কে ‘মিথ্যাবাদী’, ‘সে মিথ্যা বলে’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করতেন। [ইবনু আবু হাতিম, আবদুর রাহমান ইবনু মুহাম্মাদ(৩২৭ হি), আল-জারহু ওয়াত তা’দীল ১/৩৪৯, ৩৫০, ৩৫১, ৩/৪০৭, ৬/২১২, ৮/১৬, ৫২, ৩২৫; যাহাবী, মুহাম্মদ ইবনু আহমাদ(৭৪৮ হি) মীযানুল ই‘তিদাল ১/২৭১, ২৮৫, ২/৮০, ১০৯, ১২২, ২৪১, ৩/৪, ৫০, ৩৭৫, ৪৬৭, ৪৭৫, ৪/৩১, ৯১, ১৭৮, ১৯১, ৪২০, ৪২৮, ৪৩৭, ৫/৩, ২৯, ৫২, ৫৪, ৮৮, ১২৮, ১৬৯, ২০৭, ২২০, ৬/২৪, ৫৫, ১৩৮,২৪৬, ২৪৯, ৫৩৪, ৫৪৫, ৫৬৬, ৭/২১৯, ৩৪১, ৩৯৩, ৮/১৬২, ১৮২, ১৯৬; ইবনু হাজার আসকালানী, আহমাদ ইবনু আলী(৮৫২ হি), ফাতহুল বারী, ১৩/১১৩; আল-মুনাবী, মুহাম্মদ আবদুর রাউফ(১০৩১ হি), ফাইদুল কাদীর ১/৫৪০, ৩/২১৯, ৫/৩০০, ৬/১৫, ২১৬, ২২১, ৩৫৩।]
দ্বিতীয় হিজরী শতক হতে হাদীসের নামে মিথ্যার প্রসারের সাথে সাথে এ সকল মিথ্যাবাদীদের চিহ্নিত করতে মুহাদ্দিসগণ মিথ্যার সমার্থক আরেকটি শব্দ ব্যবহার করতে থাকেন। শব্দটি (আরবী*****)। শব্দটির মূল অর্থ নামানো, ফেলে দেওয়া, জন্ম দেওয়া। বানোয়াট অর্থে ও শব্দটি ব্যবহৃত হয়। [ইবনু দুরাইদ, মুহাম্মদ ইবনুল হাসান(৩২১হি), জামহারাতুল লাগহ ৩/৯৫; জাওহারী, ইসমাঈল ইবনে মুহাম্মাদ(৩৯৩ হি), আস-সিহাহ ৩/১২৯৯; ইবনু ফারিস, আহমদ(৩৯৫হি), মু‘জাম মাকাঈসুল লুগাহ ৬/১১৭-১১৮; ইবনুল আসীর, মুহাম্মদ ইবনুল মুবারক(৬০৬হি), আন-নিহাইয়াহ ৫/১৯৭, ১৯৮; ইবনূ মানযূর, মুহাম্মাদ ইবনুল মাকরাম(৭১১ হি), লিসানুল আরাব ৮/৩৯৬-৩৯৭; ফাল্লাতা, উমার ইবনু হাসান, আল ওয়াদউ ফিল হাদীস ১/১০৮]
ইংরেজীতেঃ To lay, lay Off, lay down, put down, set up…give birth, produce,…humiliate, to be low, humble(Hans Wehr, A Dictionary of Modern Written Arabic. P1076).
পরবর্তী যুগে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় এই শব্দের ব্যবহারই ব্যাপকতা লাভ করে। তাঁদের পরিভাষায় হাদীসের নামে মিথ্যা বলাকে ‘ওয়াদউ’ এবং এ ধরনের মিথ্যা হাদীসকে ‘মাউদূ’ বলা হয়। ফার্সী উর্দূ প্রভাবিত বাংলা উচ্চারণে আমরা সাধারণত বলি ‘মাউযূ’।
অনেক মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বা ভুল উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেননি। উভয় প্রকার মিথ্যা হাদীসকেই তাঁরা মাউদূ হাদীস বলে অভিহিত করেছেন। বাংলায় আমরা মাউদূ অর্থ জাল বা বানোয়াট বলতে পারি।
মুহাদ্দিসগণ মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন দুইভাবে; অনেক মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেন : “বানোয়াট জাল হাদীসকে মাউযূ হাদীস বলা হয়।” এখানে তাঁরা হাদীসের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
অন্যান্য মুহাদ্দিস মাউযূ হাদীসের সংজ্ঞায় বলেছেনঃ “যে হাদীস শুধুমাত্র কোনো মিথ্যাবাদী রাবী বর্ণনা করেছে তা মাউযূ হাদীস।” এখানে তাঁরা মাউযূ বা জাল হাদীসের সাধারণ পরিচয়ের দিকে লক্ষ্য করেছেন। আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, মুহাদ্দিসগণ মূলত তুলনামূলক নিরীক্ষার (Cross Examine) মাধ্যমে রাবীর সত্য মিথ্যা যাচাই করতেন।
কোনো কোনো মুহাদ্দিস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁরা অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাকে ‘বাতিল’ ও ইচ্ছাকৃত মিথ্যাকে ‘মাউযূ’ বা ‘মাউদূ’ বলে উল্লেখ করেছেন। মুহাদ্দিসগণের তুলনামূলক নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের মাধ্যমে যদি প্রমাণ হয় যে, এই বাক্যটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেননি, কিন্তু ভুল করে তাঁর নামে বলা হয়েছে, তাহলে তাঁরা সেই হাদীসটিকে ‘বাতিল’ বলে অভিহিত করেন। আর যদি নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা যায় যে, বর্ণনাকারী ইচ্ছাপূর্বক বা জ্ঞাতসারে এই কথাটি রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে নামে বলেছে, তাহলে তাঁরা একে মাউযূ হাদীস নামে আখ্যায়িত করেন।
মিথ্যা হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ প্রথম পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন। তাঁরা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার মিথ্যাকেই মাউযূ বলে গণ্য করেছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য হলো যে কথা রাসূলে করীম(স) বলেননি বা যে কর্ম তিনি করেননি, অথচ তাঁর নামে কথিত বা প্রচারিত হয়েছে, সেগুলি চিহ্নিত করে ওহীর নামে জালিয়াতি রোধ করা। বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাটি বলেছেন, নাকি ভুলবশত তা বলেছেন সে বিষয় তাঁদের বিবেচ্য বিষয় নয়। এ বিষয় বিবেচনার জন্য রিজাল ও জারহ ওয়াত্ তাদীল শাস্ত্রে পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। (আল মা’লামী, মুকাদ্দিমাতুল ফাওয়াইদ, পৃ ৫৭)।
১.২.২. মিথ্যার বিধান
ওহী বা হাদীসের নামে মিথ্যা বলার বিধান আলোচনার আগে আমরা সাধারণভাবে মিথ্যা বলার বিধান আলোচনা করতে চাই। মিথ্যাকে ঘৃণা করা মানুষের সহজাত প্রবৃতির একটা অংশ। এজন্য সকল মানব সমাজে মিথ্যাকে পাপ, অন্যায় ও ঘৃণিত মনে করা হয়। কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে মিথ্যাকে অত্যন্ত কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতে মুমিনদিগকে সর্বাবস্থায় সত্যপরায়ণ হতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাথে সাথে মিথ্যাকে ঘৃণিত পাপ ও কঠিন শাস্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সার্বক্ষণিক সত্যবাদিতার নির্দেশ দিয়ে এরশাদ হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ [٩:١١٩]
-হে মু’মিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভূক্ত হও।(সূরা তাওবাঃ ১১৯)
মিথ্যার ভয়ানক শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছেঃ
فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ [٢:١٠]
-তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাচারী। (সূরা বাকারাঃ ১০)
অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছেঃ
فَأَعْقَبَهُمْ نِفَاقًا فِي قُلُوبِهِمْ إِلَىٰ يَوْمِ يَلْقَوْنَهُ بِمَا أَخْلَفُوا اللَّهَ مَا وَعَدُوهُ وَبِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ [٩:٧٧]
-পরিণামে তিনি(আল্লাহ) তাদের অন্তরে কপটতা স্থির করলেন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাৎ-দিবস পর্য্ন্ত, কারণ তারা আল্লাহর নিকট যে অঙ্গীকার করেছিল তা ভংগ করেছিল এবং তারা ছিল মিথ্যাচারী।(সূরা তাওবাঃ ৭৭)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ [٤٠:٢٨]
-আল্লাহ সীমালংঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সৎপথে পরিচালিত করেননা (সূরা মুমিনঃ ২৮)।
অগণিত হাদীসে মিথ্যাকে ভয়ংকর পাপ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এক হাদীসে আবুদল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(********)
-সত্য পূণ্য। সত্য পূণ্যের দিকে পরিচালিত করে এবং পূণ্য জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে। যে মানুষ সদা সর্বদা সত্য বলতে সচেষ্ট থাকেন তিনি এক পর্যায়ে আল্লাহর নিকট ‘সিদ্দীক’ বা মহা সত্যবাদী বলে লিপিবদ্ধ হন। আর মিথ্যা পাপ। মিথ্যা পাপের দিকে পরিচালিত করে আর পাপ জাহান্নামের দিকে পারিচালিত করে। যে মানুষটি মিথ্যা বলে বা মিথ্যা বলতে সচেষ্ট থাকে সে এক পর্যায়ে মহা মিথ্যাবাদী বলে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। [বুখারী, মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল (২৫৬ হি), আস-সহীহ ৫/২২৬১, মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২৬২ হি), আস-সহীহ ৪/২০১২, ২০১৩]।
হাদীস শরীফে মিথ্যা বলাকে মুনাফিকীর অন্যতম চিহ্ন বলে গণ্য করা হয়েছে। এমনকি বলা হয়েছে যে, মুমিন অনেক অন্যায় করতে পারে, কিন্তু কথনো মিথ্যা কথা বলতে পারেনা। সা’দ ইবনু আবু ওয়াক্কাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী (*******)
-মুমিনের প্রকৃতিতে সব অভ্যাস থাকতে পারে, কিন্তু খিয়ানত ও মিথ্যা থাকতে পারেনা। [বাযযার, আবু বাকর আহমদ ইবনু আমর (২৯২ হি), আল মুসনাদ ৩/৩৪১, হাইসামী, আলী ইবনু আবী বাকর (৮০৭ হি), মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৯২]
১.২.৩. ওহীর নামে মিথ্যা
মিথ্যা সর্বদা ঘৃণিত। তবে তা যদি ওহীর নামে হয় তাহলে তা আরো বেশি ঘৃণিত ও ক্ষতিকর। সাধারণভাবে মিথ্যা ব্যক্তিমানূষের বা মানবসমাজের জন্য জাগতিক ক্ষতি বয়ে আনে। আর ওহীর নামে মিথ্যা মানব সমাজের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক স্থায়ী ক্ষতি ও ধ্বংস করে। মানুষ তখন ধর্মের নামে মানবীয় বুদ্ধি প্রসূত বিভিন্ন কর্মে লিপ্ত হয়ে জাগতিক ও পারলৌকিক ধ্বংসের মধ্যে নিপতিত হয়।
পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর দিকে তাকালে আমরা বিষয়টি স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। আমরা আগেই বলেছি যে, মানবীয় জ্ঞান প্রসূত কথাকে ওহীর নামে চালানোই ধর্মের বিকৃতি ও বিলুপ্তির কারণ। সাধারণভাবে এ সকল ধর্মের প্রাজ্ঞ পন্ডিতগণ ধর্মের কল্যাণেই এ সকল কথা ওহীর নামে চালিয়েছেন। তারা মনে করেছেন যে, তাদের এ সকল কথা, ব্যাখ্যা, মতামত ওহীর নামে চালালে মানুষের মধ্যে ‘ধার্মিকতা’, ‘ভক্তি’ ইত্যাদি বাড়বে এবং আল্লাহ খুশি হবেন। আর এভাবে তারা তাদের ধর্মকে বিকৃত ও ধর্মাবল্বীদেরকে বিভ্রান্ত করেছেন। কিন্তু তারা বুঝেননি যে, মানুষ যদি মানবীয় প্রজ্ঞায় এ সকল বিষয় বুঝতে পারতো তাহলে ওহীর প্রয়োজন হতোনা।
এর অত্যন্ত পরিচিত উদাহরণ খৃস্টধর্ম। প্রচলিত বিকৃত বাইবেলের বিবরণ অনুযায়ী ‘যীশুখৃস্ট’ তাঁর অনুসারীদেরকে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে, ইহুদী ধর্মের ১০ মূলনীতি পালন করতে, খাতনা করতে, তাওরাতের সকল বিধান পালন করতে, শূকরের মাংস ভক্ষণ থেকে বিরত থাকতে ও অনুরূপ অন্যান্য কর্মের নির্দেশ প্রদান করেন। মিথ্যাবাদী শৌল পৌল নাম ধারণ করে ‘খৃস্টধর্মের প্রচার ও মানুষের মধ্যে ভক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে’ প্রচার করতে থাকেন যে, শুধুমাত্র ‘যীশুখৃস্টকে’ বিশ্বাস ও ভক্তি করলেই চলবে, এ সকল কর্ম না করলেও চলবে। তিনি বলতেন, আমি প্রত্যেক জাতির কাছে আমার পছন্দ মত মিথ্যা বলি, যেন ঈশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
এভাবে তিনি মানবতার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করেন। ক্রমান্বয়ে এই পৌলীয় কর্মহীন ভক্তিধর্মই খৃস্টানদের মধ্যে প্রসার লাভ করে। ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানব সন্তান শিরক-কুফর ও পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু বিশ্বাসেই স্বর্গ, সেহেতু কোনোভাবেই ধর্মোপদেশ দিয়ে খৃস্টান সমাজগুলি থেকে মানবতা বিধ্বংসী পাপ, অনাচার ও অপরাধ কমানো যায়না।
ওহীর নামে মিথ্যা সবচেয়ে কঠিন মিথ্যা হওয়ার কারণে কুরআন কারীমে ও হাদীস শরীফে ওহীর নামে বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলতে, সন্দেহজনক কিছু বলতে বা আন্দাজে কিছু বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর অবতীর্ণ উভয় প্রকার ওহী যেন কেয়ামত পর্য্ন্ত সকল মানুষের জন্য অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত থাকে সেজন্য সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
১.২.৪. মিথ্যা থেকে ওহী রক্ষার কুরআনী নির্দেশনা
‘ওহী’র নামে মিথ্যা বা অনুমান-নির্ভর কথা প্রচারের দুটি পর্যায়ঃ প্রথমত, নিজে ওহীর নামে মিথ্যা বলা ও দ্বিতীয়ত, অন্যের বলা মিথ্যা গ্রহণ ও প্রচার করা। উভয় পথ রুদ্ধ করার জন্যে কুরআন কারীমে একদিকে আল্লাহর নামে মিথ্যা বা অনুমান নির্ভর কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। অপরদিকে কারো প্রচারিত কোনো তথ্য বিচার ও যাচাই ছাড়া গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।
১.২.৪.১. আল্লাহর নামে মিথ্যা ও অনুমান নির্ভর কথা বলার নিষেধাজ্ঞা
কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বারংবার আল্লাহর নামে মিথ্যা বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। অনুরূপভাবে না জেনে, আন্দাজে, ধারণা বা অনুমানের উপর নির্ভর করে আল্লাহর নামে কিছু বলতে কঠিনভাবে নিষেধ করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলার অর্থ আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা। কারণ রাসূলুল্লাহ(স) আল্লাহর পক্ষ থেকেই কথা বলেন। কুরআনের মত হাদীসও আল্লাহর ওহী। কুরআন ও হাদীস, উভয় প্রকারের ওহীই একমাত্র রাসূলুল্লাহ(স) এর মাধ্যমে বিশ্ববাসী পেয়েছে। কাজেই রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কোনো প্রকার মিথ্যা, বানোয়াট, আন্দাজ বা অনুমাননির্ভর কথা বলার অর্থই আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা বা না-জেনে আল্লাহর নামে কিছু বলা। কুরআন কারীমে এ বিষয়ে বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে কয়েকটি বাণী উল্লেখ করছি।
১. কুরআন কারীমে বারংবার এরশাদ করা হয়েছেঃ
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا
-আল্লাহর নামে বা আল্লাহর সম্পর্কে যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে? (সূরা আল আনআমঃ ২১, ৯৩, ১৪৪; সূরা আরাফঃ ৩৭ সূরা ইউনূস ১৭)।
২. এরশাদ করা হয়েছেঃ
قَالَ لَهُم مُّوسَىٰ وَيْلَكُمْ لَا تَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا فَيُسْحِتَكُم بِعَذَابٍ ۖ وَقَدْ خَابَ مَنِ افْتَرَىٰ [٢٠:٦١]
-দূর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করোনা। করলে, তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করবেন। যে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে সেই ব্যর্থ হয়েছে। (সূরা তাহাঃ৬১)
৩. কুরআন কারীমে বারংবার না জেনে, আন্দাজে বা অনুমান নির্ভর করে আল্লাহ, আল্লাহর দ্বীন, বিধান ইত্যাদি সম্পর্কে কোনো কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন একস্থানে এরশাদ হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ [٢:١٦٨]
إِنَّمَا يَأْمُرُكُم بِالسُّوءِ وَالْفَحْشَاءِ وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ [٢:١٦٩]
-হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো কেবল তোমাদেরকে মন্দ ও অশ্লীল কার্যের এবং আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা যা জাননা এমন সব বিষয় বলার নির্দেশ দেয়। (সূরা আল বাকারাহঃ ১৬৮-১৬৯)
৪. অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছেঃ
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ [٧:٣٣]
-“বল, আমার প্রতিপালক নিষিদ্ধ করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ এবং অসংগত বিরোধিতা এবং কোনো কিছুকে আল্লাহর শরীক করা –যার কোনো সনদ তিনি প্রেরণ করেননি এবং আল্লাহর সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে সম্বন্ধে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই।” (সূরা আল আরাফঃ৩৩)
এভাবে কুরআনে ওহীর জ্ঞানকে সকল ভেজাল ও মিথ্যা থেকে রক্ষার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মহিমাময় আল্লাহ, তাঁর মহান রাসূলুল্লাহ(স), তাঁর দ্বীন, তাঁরা বিধান ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা, বানোয়াট, আন্দাজ বা অনুমান নির্ভর কথা বলা কঠিণভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
১.২.৪.২. যে কোনো তথ্য গ্রহণের পূর্বে যাচাইয়ের নির্দেশ
নিজে আল্লাহ বা তাঁর রাসূল(স)এর নামে মিথ্যা বলা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি অন্যের কোনো অনির্ভরযোগ্য, মিথ্যা বা অনুমান নির্ভর বর্ণনা বা বক্তব্য গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ। যে কোনো সংবাদ বা বক্তব্য গ্রহণে মুসলিম উম্মাহকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছে কুরআন কারীম। এরশাদ করা হয়েছেঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِن جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَن تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ [٤٩:٦]
-“হে মুমিনগণ, যদি কোনো পাপী তোমাদের নিকট কোনো বার্তা আনয়ন করে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত না কর, এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।” (সূরা আল হুজুরাতঃ ৬)।
এই নির্দেশের আলোকে কেউ কোনো সাক্ষ্য বা তথ্য প্রদান করলে তা গ্রহণের পূর্বে সে জাতির ব্যক্তিগত সততা ও তথ্য প্রদানে তার নির্ভূলতা যাচাই করা মুসলিমের জন্য ফরয। জাগতিক সকল বিষয়ের চেয়েও বেশি সতর্কতা ও পরীক্ষা করা প্রয়োজন রাসূলুল্লাহ(স) বিষয়ক বার্তা বা বাণী গ্রহণের ক্ষেত্রে। কারণ জাগতিক বিষয়ে ভুল তথ্য বা সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করলে মানুষের সম্পদ, সম্ভ্রম বা জীবনের ক্ষতি হতে পারে। আর রাসূলুল্লাহ(স) এর হাদীস বা ওহীর জ্ঞানের বিষয়ে অসতর্কতার পরিণতি ঈমানের ক্ষতি ও আখিরাতের অনন্ত জীবনের ধ্বংস। এজন্য মুসলিম উম্মাহ সর্বদা সকল তথ্য, হাদীস ও বর্ণনা পরীক্ষা করে গ্রহণ করেছেন।
১.২.৫. মিথ্যা থেকে ওহী রক্ষায় হাদীসের নির্দেশনা
ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত সকল প্রকার বিকৃতি, ভুল বা মিথ্যা থেকে তাঁর বাণী বা হাদীসকে রক্ষা করার জন্য রাসূলুল্লাহ(স) তাঁর উম্মতকে বিভিন্ন প্রকার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলির মধ্যে রয়েছেঃ
১.২.৫.১. বিশুদ্ধরূপে হাদীস মুখস্ত রাখার ও প্রচারের নির্দেশনা
বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ(স) তাঁর হাদীস বা বাণী হুবহু বিশুদ্ধরূপে মুখস্ত করে তা প্রচার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। জুবাইর ইবনু মুতয়িম(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(*****)
-“মহান আল্লাহ সমুজ্জল করুন সেই ব্যক্তির চেহারা যে আমার কোনো কথা শুনল, অতঃপর তা পূর্ণরূপে আয়ত্ত্ব করল ও মুখস্ত করল এবং যে তা শুনেনি তার কাছে পৌছে দিল।” [তিরমিযী, মুহাম্মদ ইবনু ঈসা(২৭৯ হি), আস-সুনান ৫/৩৩-৩৪; আবু দাউদ, সুলাইমান ইবনে আশ‘আস(২৭৫ হি)]
এই অর্থে আরো অনেক হাদীস অন্যান্য অনেক সাহাবী থেকে বর্ণিত ও সংকলিত হয়েছে।
১.২.৫.২. রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলার নিষেধাজ্ঞা
অপরদিকে কোনো মানবীয় কথা যেন তাঁর নামে প্রচারিত হতে না পারে সেজন্য তিনি তাঁদেরকে তাঁর নামে মিথ্যা বা অতিরিক্ত কথা বলতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। হযরত আলী (রা) বলেন, রাসূলে করীম(স) বলেছেনঃ আরবী(*****)
-তোমরা আমার নামে মিথ্যা বলবেনা, কারণ যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। [বুখারী, মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল(২৫৬ হি), আস-সহীহ ১/৫২, ফাতহুল বারী১/১৯৯]।
যুবাইর ইবনুল আউয়াম(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(******)
-যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা বলবে তার আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। (বুখারী, আস-সহীস ১/৫২)
সালামাহ ইবনে আকওয়া(রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(******)
-আমি যা বলিনি সে কথা যে আমার নামে বলবে তার আবাসস্থল হবে জাহান্নাম। (বুখারী, আস-সহীস ১/৫২)
এভাবে ‘আশারায়ে মুবাশশারাহ’ সহ প্রায় ১০০ জন সাহাবী এই মর্মে রাসূলুল্লাহ(স) এর সাবধান বাণী বর্ণনা করেছেন। আর কোনো হাদীস এত বেশি সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়নি।[নববী, ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ(৬৭৬ হি), শারহু সহীহ মুসলিম ১/৬৮, ইউনুল জাউযী, আল মাউযূ’আত]
১.২.৫.৩. বেশি হাদীস বলা ও মুখস্ত ছাড়া হাদীস বলার নিষেধাজ্ঞা
বেশি হাদীস বলতে গেলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ(স)। বিশুদ্ধ মুখস্ত ও নির্ভূলতা সম্পর্কে পরিপূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কোনো হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন। আবু কাতাদাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) মিম্বরের উপরে দাঁড়িয়ে বলেনঃ আরবী(*****)
-খবরদার! তোমরা আমার নামে বেশি বেশি হাদীস বলা হতে বিরত থাকবে। যে আমার নামে কিছু বলে, সে যেন সঠিক কথা বলে। আর যে আমার এমন কিছু বলে যা আমি বলিনি তাকে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে। [ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১৪; আলবানী, মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন, সহীহ সুনানি ইবনে মাজাহ ১/২৯, আল মুসতাদরাক ১/১৯৪]।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(********)
“তোমরা আমার থেকে হাদীস বর্ণনা পরিহার করবে, শুধুমাত্র যা তোমরা জান তা ছাড়া।”(তিরমিযী, আস-সুনান ৫/১৮৩)।
আবু মূসা মালিক ইবনু উবাদাহ আল গাফিকী(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) আমাদেরকে সর্বশেষ ওহীহত ও নির্দেশ প্রদান করে বলেনঃ আরবী(******)
-“তোমরা আল্লাহর কিতাব সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে ও অনুসরণ করবে। আর অচিরেই তোমরা এমন সম্প্রদায়ের নিকট গমন করবে যারা আমার নামে হাদীস বলতে ভালবাসবে। যদি কারো কোনো কিছু মুখস্ত থাকে তাহলে সে তা বলতে পারে। আর যে ব্যক্তি আমার নামে এমন কিছু বলবে যা আমি বলিনি তাকে জাহান্নামে তার আবাসস্থল গ্রহণ করতে হবে।” (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১২)
এভাবে বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ(স) তাঁর উম্মাততে তাঁর হাদীস হুবহু ও নির্ভূলভাবে মুখস্ত রাখতে ও এইরূপ মুখস্ত হাদীস প্রচার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে পরিপূর্ণ মুখস্ত না থাকলে বা সামান্য দ্বিধা থাকলে সে হাদীস বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন। কারণ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, তিনি যা বলেননি সে কথা তাঁর নামে বলা নিষিদ্ধ ও কঠিনতম পাপ। ভুলক্রমেও যাতে তাঁর হাদীসের মধ্যে হেরফের না হয় এজন্য তিনি পরিপূর্ণ মুখস্ত ছাড়া হাদীস বলতে নিষেধ করেছেন। আমরা দেখতে পাব যে, সাহাবীগণ এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন।
১.২.৫.৪. মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীদের থেকে সতর্ক করা
নিজের পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি অন্যের বানানো মিথ্যা গ্রহণ করাও নিষিদ্ধ। মুসলিম উম্মাহর ভিতরে মিথ্যাবাদী হাদীস বর্ণনাকারী ব্যক্তিবর্গের উদ্ভব হবে বলে তিনি উম্মাতকে সতর্ক করেছেন। আবু হুরাইরা(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আরবী(******)
-শেষ যুগে আমার উম্মাতের কিছু মানুষ তোমাদেরকে এমন সব হাদীস বলবে যা তোমরা বা তোমাদের পিতা-পিতামহগণ কখনো শুননি। খবরদার! তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে, তাদের থেকে দূরে থাকবে। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১২)।
ওয়াসিলাহ ইবনুল আসকাহ(রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(*****)
-কেয়ামতের পূর্বেই শয়তান বাজারে-সমাবেশে ঘুরে ঘুরে হাদীস বর্ণনা করে বলবে: আমাকে অমুকের ছেলে অমুক এই এই বিষয়ে এই হাদীস বলেছে। (ইবনু আদী, আহমদ, আল-কামিল ফী দুআফাইর রিজাল ১/১১৫)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ(রা) বলেনঃ আরবী(******)
-শয়তান মানুষের রূপ ধারণ করে মানুষদের মধ্যে আগমন করে এবং তাদেরকে মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করে। এরপর মিথ্যা হাদীস শুনে সমবেত মানুষগুলো সমাবেশ ভেঙ্গে চলে যায়। অতঃপর তারা সে সকল হাদীস বর্ণনা করে বলে : আমি এক ব্যক্তিকে হাদীসটি বলতে শুনেছি যার চেহারা আমি চিনি তবে তার নাম জানিনা। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/১২)
১.২.৫.৫. সন্দেহযুক্ত বা অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা
রাসূলুল্লাহ(স) যাচাই না করে কোনো হাদীস গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। যদি কেউ যাচাই না করে যা শুনে তাই হাদীস বলে গ্রহণ করে ও বর্ণনা করে তাহলে হাদীস যাচাইয়ে তার অবহেলার জন্য সে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হবে। ইচ্ছাকৃত মিথ্যা হাদীস বানানোর জন্য নয়, শুধুমাত্র সত্য মিথ্যা যাচাই না করে হাদীস গ্রহণ করাই তার মিথ্যাবাদী বানানোর জন্য যথেষ্ট বলে হাদীসে বলা হয়েছে। উপরন্তু, যদি কোনো হাদীসের বিশুদ্ধতা ও নির্ভূলতা সম্বন্ধে দ্বিধা বা সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি সে হাদীস বর্ণনা করে তাহলে সেও মিথ্যাবাদী বলে গণ্য হবেও মিথ্যা হাদীস বলার পাপে পাপী হবে।
আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(*******)
-একজন মানুষের পাপী হওয়ার জন্য এতটুকেই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বর্ণনা করবে।(মুসলিম আস-সহীহ ১/১০)।
সামুরাহ ইবনে জুনদুব(রা) ও মুগীরাহ ইবনু শু’বা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ(স) বলেছেনঃ আরবী(****)
-যে ব্যক্তি আমার নামে কোনো হাদীস বলবে এবং তার মনে সন্দেহ হবে যে, হাদীসটি মিথ্যা, সেও একজন মিথ্যাবাদী। (মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯)।
১.২.৬. হাদীসের নামে মিথ্যা বলার বিধান
১.২.৬.১. হাদীসের নামে মিথ্যা বলা কঠিনতম কবীরা গোনাহ
উপরে উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসের আলোকে আমরা অতি সহজেই বুঝতে পারি যে, হাদীসের নামে মিথ্যা বলা ও মানুষের কথাকে হাদীস বলে চালানো জঘন্যতম পাপ ও অপরাধ। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোনোরূপ দ্বিধা বা সংশয় নেই। আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর সাহাবীগণ সামান্যতম অনিচ্ছাকৃত বা অসাবধানতামূলক ভুলের ভয়ে হাদীস বলা হতে বিরত থাকতেন। অনিচ্ছাকৃত ভুলকেও তাঁরা ভয়ানক পাপ মনে করে সতর্কতার সাথে পরিহার করতেন। এছাড়া অন্যের বানানো মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করাকেও তাঁরা মিথ্যা হাদীস বানানোর মত অপরাধ বলে গণ্য করতেন।
উপরে উল্লেখিত হাদীসগুলির আলোচনা প্রসঙ্গে ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ আন-নাবাবী (৬৭৬ হি) বলেনঃ এ সকল হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলা কঠিনতম হারাম, ভয়ন্করতম কবীরা গোনাহ এবং তা জঘন্যতম ও ধ্বংসাত্মক অপরাধ। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ একমত। তবে অধিকাংশ আলিমের মতে এই অপরাধের জন্য কাউকে কাফির বলা যাবেনা। যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে কোনো মিথ্যা বলবে সে যদি তার এই মিথ্যা বলাকে হালাল মনে না করে তাহলে তাকে কাফির বলা যাবেনা। সে পাপী মুসলিম। আর যদি সে এই কঠিনতম পাপকে হালাল মনে করে তাহলে সে কাফির বলে গণ্য হবে। তবে মুহাম্মদ আল জুআইনী ও অন্যান্য কতিপয় ইমাম এই অপরাধকে কুফরী বলে গণ্য্ করেছেন। জুআ্ইনী বলতেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে মিথ্যা বলবে সে কাফির বলে গণ্য হবে এবং তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে হবে।
এ সকল হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ(স) এর নামে যে কোনো মিথ্যাই সমভাবে হারাম, তা যে কোনো বিষয়েই হোক। শরীয়তের বিধিভিধান, ফযীলত, নেককাজে উৎসাহ প্রদান, পাপের ভীতি বা অন্য যে কোনো বিষয়ে তাঁর নামে কোনো মিথ্যা বলা কঠিনতম হারাম ও ভয়ঙ্করতম কবীরা গোনাহ। এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত রয়েছে। যাঁরা মতামত প্রকাশ করতে পারেন এবং যাঁদের মতামত গ্রহণ করা যায় তাঁরা সকলেই এই বিষয়ে একমত। (নববী, শারহু সহীহ মুসলিম ১/৬৯)।
১.২.৬.২. মাউযূ হাদীস উল্লেখ বা প্রচার করাও কঠিনতম হারাম
ইমাম নববী আরো বলেনঃ জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বানোয়াট হাদীস বর্ণনা করাও হারাম, তা যে অর্থেই হোকনা কেন। তবে মিথ্যা হাদীসকে মিথ্যা হিসেবে জানানোর জন্য তার বর্ণনা জায়েয। (নববী, তাকরীব, তাদরীবুর রাবী সহ ১/২৭৪)।
অন্যত্র, তিনি বলেনঃ যদি কেউ জানতে পারেন যে, হাদীসটি মাউযূ অর্থাৎ মিথ্যা বা জাল, অথবা তার মনে জোরালো ধারণা হয় যে, হাদীসটি জাল তাহলে তা বর্ণনা করা তার জন্য হারাম। যদি কেউ জানতে পারেন যে, হাদীসটি মিথ্যা এবং তারপরও তিনি সেই হাদীসটি বর্ণনা করেন, কিন্তু হাদীসটির বানোয়াট হওয়ার বিষয় উল্লেখ না করেন, তবে তিনিও হাদীস বানোয়াটকারী বলে গণ্য হবেন এবং এ সকল হাদীসে উল্লেখিত ভয়ানক শাস্তির অন্তর্ভূক্ত হবেন। (নববী, শারহু সহীহ মুসলিম ১/৭১)।
ইমাম যাইনুদ্দীন আব্দুর রাহীম ইবনুল হুসাইন আল-ইরাকী(৮০৬ হি) বলেনঃ মাউযূ বা জাল হাদীস যে বিষয়ে বা যে অর্থেই হোক, তা বলা হারাম। আহকাম, গল্প-কাহিনী, ফযীলত, নেককর্মে উৎসাহ, পাপ থেকে ভীতি প্রদর্শন বা অন্য যে কোনো বিষয়েই হোকনা কেন, যে ব্যক্তি তাকে মাউযূ বলে জানতে পারবে তার জন্য তা বর্ণনা করা, প্রচার করা, তার দ্বারা দলীল দেওয়া বা তার দ্বারা ওয়ায করা জায়েয নয়। তবে হাদীসটি যে জাল বা বানোয়াট সে কথা উল্লেখ করে তা বলা যায়। (ইরাকী, ফাতহুল মুগীস, পৃ. ১২০-১২১)।
১.২.৬.৩. হাদীস বানোয়াটকারীর তওবার বিধান
হাদীসের নামে মিথ্যা বলা ও অন্যান্য বিষয়ে মিথ্যা বলার মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য হলো, হাদীসের নামে মিথ্যাবাদীর তাওবা মুহাদ্দিসগণেল নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। যদি কোনো ব্যক্তির বিষয়ে প্রমাণিত হয় যে, তিনি কোনো কথাকে মিথ্যাভাবে রাসূলুল্লাহ(স) এর কথা বলে উল্লেখ করেছেন বা প্রচার করেছেন এবং এরপর তিনি তাওবা, তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করতেও পারেন, তবে মুহাদ্দিসগণের নিকট তিনি তাওবার কারণে গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাবেননা। মুহাদ্দিসগণ কখনোই ঐ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস সত্য ও নির্ভরযোগ্য বলে মনে করবেননা।
পঞ্চম শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ আহমদ ইবনু সাবিত খাতীব বাগদাদী(৪৬৩ হি) বলেনঃ যে ব্যক্তি মানুষের সাথে মিথ্যা বলে তার হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়। তবে সে যদি তাওবা করে এবং তার সততা প্রমাণিত হয় তাহলে তার হাদীস গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে বলে ইমাম মালিক উল্লেখ করেছেন। আর যদি কেউ হাদীস জাল করে, হাদীসের মধ্যে কোনো মিথ্যা বলে বা যা শুনেনি তা শুনেছে বলে দাবি করে তাহলে তার বর্ণিত হাদীস সত্য বা সঠিক বলে গণ্য করা যাবেনা। আলিমগণ উল্লেখ করেছেন যে, সে যদি পরে তাওবা করে তাহলেও তার বর্ণিত কোনো হাদীস সত্য বলে গণ্য করা যাবেনা। ইমাম আহমদ(২৪১ হি) কে প্রশ্ন করা হয়: একব্যক্তি একটিমাত্র হাদীসের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলেছিল, তারপর সে তাওবা করেছে এবং মিথ্যা বলা পরিত্যাগ করেছে, তার বিষয়ে কী করণীয়? তিনি বলেনঃ তার তাওবা তার ও আল্লাহর মাঝে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে কবুল করতে পারেন। তবে তার বর্ণিত কোনো হাদীস আর কখনোই সঠিক বলে গ্রহণ করা যাবেনা বা কখনোই তার বর্ণনার উপর নির্ভর করা যাবেনা। ইমাম সুফিয়ান সাওরী(১৬১ হি), আবদুল্লাহ ইবনু মুবারক(১৮১ হি)ও অন্যান্য ইমামও অনুরূপ কথা বলেছেন।
ইমাম বুখারীর অন্যতম ওস্তাদ আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর আল-হুমাইদী(২১৯ হি) বলেন, যদি কেউ হাদীস বর্ণনা করতে যেয়ে বলেঃ আমি অমুকের কাছে হাদীসটি শুনেছি, এরপর প্রমাণিত হয় যে, সে উক্ত ব্যক্তি হতে হাদীসটি শুনেনি, বা অন্য কোনোভাবে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তার মিথ্যা ধরা পড়ে তবে তার বর্ণিত কোনো হাদীসই আর সঠিক বা নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা যাবেনা। খতীব বাগদাদী বলেন, ইচ্ছাকৃত মিথ্যা ধরা পড়লে সেক্ষেত্রে এই বিধান। [খতীব বাগদাদী, আহমাদ ইবনু আলী ইবনু সাবিত(৪৬৩ হি), আল কিফাইয়াতু ফী ইলমুর রিওয়াইয়া, পৃ. ১১৭-১১৮]।
শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলবী(১০৫২ হি) বলেনঃ যদি কোনো ব্যক্তির বিষয়ে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে জীবনে একবারও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলার কথা প্রমাণিত হয় তবে তার বর্ণিতে কোনো হাদীস সঠিক বা নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য হবেনা, যদিও সে তাওবা করে। (আব্দুল হক দেহলবী, মুকাদ্দিমাহ ফী উসূলিল হাদীস, পৃ. ৬৩-৬৪)।
১.২.৭. হাদীসের নামে মিথ্যা বলার উন্মেষ
আমরা জানি যে, সকল সমাজ, জাতি ও ধর্মে মিথ্যা ও মিথ্যাবাদী ঘৃণিত। সত্যবাদীতা সর্বদা ও সর্বত্র প্রশংসিত ও নিন্দিত। এজন্যই আরবের জাহেলী সমাজেও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অতুলনীয় সত্যবাদিতা প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ‘আল-আমীন’ ও ‘আস-সাদিক’: বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদী বলে আখ্যায়িত হয়েছেন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহচর সাহাবীগণকে অনুপম অতুলনীয় সত্যবাদিতার উপর গড়ে তুলেছেন। তাঁদের সত্যবাদিতা ছিল আপোষহীন। কোনো কষ্ট বা বিপদের কারণেই তাঁরা সত্যকে বাদ দিয়ে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। উপরন্তু তিনি ওহীর নামে ও হাদীসের নামে মিথ্যা বলতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছেন এবং এর কঠিন শাস্তির কথা বারংবার বলেছেন।
আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখতে পাব যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে ইচ্ছাকৃত কোনো মিথ্যা তো দূরের কথা, সামান্যতম অনিচ্ছাকৃত ভুল বা বিকৃতিকেও তাঁরা কঠিনতম পাপ বলে গণ্য করে তা পরিহার করতেন।
এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় বা তাঁর ইন্তিকালের পরে তাঁর সাহাবীগণের মধ্যে কখনোই কোনো অবস্থায় তাঁর নামে মিথ্যা বলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ সাহাবী অনিচ্ছাকৃত ভুলে ভয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে কোনো হাদীসই বলতেননা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় মদীনার সমাজে কতিপয় মুনাফিক বাস করত। এদের মধ্যে মিথ্যা বলার প্রচলন ছিল। তবে এরা সংখ্যায় ছিল অতি সামান্য এবং সমাজে এদের মিথ্যাবাদিতা জ্ঞাত ছিল। এজন্য তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিলনা। তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করতোনা এবং তারাও কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামে মিথ্যা বলার সাহস বা সুযোগ পাননি।
একটি ঘটনায় বর্ণিত হয় যে, এক যুবক এক যুবতীর পানিপ্রার্থী হয়। যুবতীর আত্মীয়গণ তার কাছে তাদের মেয়ে বিবাহ দিতে অসম্মত হয়। পরবর্তী সময়ে ঐ যুবক তাদের কাছে গমন করে বলে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে তোমাদের বংশের যে কোনো মেয়ে বেছে নিয়ে বিবাহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যুবকটি সেখানে অবস্থান করে। ইত্যবসরে তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তিনি বলেন, যুবকটি মিথ্যা বলেছে। তোমরা তাকে জীবিত পেলে মৃত্যুদন্ড প্রদান করবে। ….তবে তাকে জীবিত পাবে বলে মনে হয়না। …..তারা ফিরে গিয়ে দেখেন যে, সাপের কামড়ে যুবকটির মৃত্যু হয়েছে।……..
এই বর্ণনাটি নির্ভরযোগ্য হলে এ থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় তাঁর নামে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলার একটি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু এই বর্ণনাটির সনদ অত্যন্ত দূর্বল। কয়েকজন মিথ্যায় অভিযুক্ত ও অত্যন্ত দূর্বল রাবীর মাধ্যমে ঘটনাটি বর্ণিত। (যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/৪০১-৪০২; ইবনু আদী, আল-কামিল ৪/৫৪)।
সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পরে যতদিন মুসলিম সমাজে সাহাবীগণের আধিক্য ছিল ততদিন তাঁর নামে মিথ্যা বলার কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সময়ের আবর্তনে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। প্রথম হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এ সময়ে অনেক সাহাবী মৃত্যুবরণ করেন। অগণিত নও মুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যা বলার উন্মেষ ঘটে। ক্রমান্বয়ে তা প্রসার লাভ করতে থাকে।
২৩ হিজরী সালে যুন্নুরাইন উসমান ইবনু আফফান(রা) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৩৫ হিজরী পর্য্ন্ত প্রায় ১২ বৎসর তিনি খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে ইসলামী বিজয়ের সাথে সাথে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইসলামের প্রসার ঘটে। অগণিত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মদীনা থেকে বহুদূরে মিশর, কাইরোয়ান, কুফা, বাসরা, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, খোরাসান ইত্যাদি এলাকায় বসবাস করতেন। সাহাবীগণের সাহচর্য্ থেকেও তারা বঞ্চিত ছিলেন।
তাঁদের অনেকের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী বিশ্বাস, চরিত্র ও কর্মের পূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারেন। এদের অজ্ঞতা, পূর্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, ইসলাম ধর্ম বা আরবদের প্রতি আক্রোশ ইত্যাদির ফলে এদের মধ্যে বিভিন্ন মিথ্যা ও অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইসলামের অনেক শত্রু সামরিক ময়দানে ইসলামের পরাজয় ঘটাতে ব্যর্থ হয়ে মিথ্যা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে ইসলামের ধ্বংসের চেষ্টা করতে থাকে। আর সবচেয়ে কঠিন ও স্থায়ী মিথ্যা যে মিথ্যা ওহী বা হাদীসের নামে প্রচারিত হয়। ইসলামের শত্রুরা সে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে।
এ সময় এসকল মানুষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বংশধরদের মর্যাদা, ক্ষমতা, বিশেষত আলী ইবনু আবী তালিব(রা) এর মর্যাদা, বিশেষ জ্ঞান, বিশেষ ক্ষমতা, অলৌকিকত্ব, তাকে ক্ষমতায় বসানোর প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে ও উসমান ইবনু আফফান(রা) এর নিন্দায় অগণিত কথা বলতে থাকে। এ সব বিষয়ে অধিকাংশ কথা তারা বলতো যুক্তি তর্কের মাধ্যমে। আবার কিছু কথা তারা আকারে ইঙ্গিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামেও বানিয়ে বলতে থাকে। যদিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে সরাসরি মিথ্যা বলার দুঃসাহস এ সকল পাপাত্মাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। তখনো অগণিত সাহাবী জীবিত রয়েছেন। মিথ্যা ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। তবে মিথ্যার প্রবণতা গড়ে উঠতে থাকে।
৩য়-৪র্থ হিজরী শতকের অন্যতম ফকীহ, মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনী জারীর তাবারী(৩১০ হি) ৩৫ হিজরীর ঘটনা আলোচনা কালে বলেন, আবদুল্লাহ ইবনু সাবা ইয়ামানের ইহুদী ছিল। উসমান(রা) এর সময়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর বিভিন্ন শহরে ও জনপদে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিভ্রান্তিমূলক কথা প্রচার করতে থাকে। হিজাজ, বসরা, কূফা ও সিরিয়ায় তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তখন সে মিশরে গমন করে। সে প্রচার করতে থাকে: অবাক লাগে তার কথা ভাবতে যে ঈসা(আ) পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবে বলে বিশ্বাস করে, অথচ মুহাম্মাদ(স) পুনরায় পৃথিবীতে আগমন করবেন বলে বিশ্বাস করেনা। ঈসার পুণরাগমনের কথা সে সত্য বলে মানে, আর মুহাম্মদ(স) এর পুনরাগমনের কথা বলতে তা মিথ্যা বলে মনে করে।…….. হাজারো নবী চলে গিয়েছেন। প্রত্যেক নবী তাঁর উম্মতের একজনকে ওসীয়তের মাধ্যমে দায়িত্ব প্রদান করে গিয়েছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রদত্ত ওহীয়ত ও দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি আলী ইবনু আবী তালিব। …….. মুহাম্মাদ(স) শেষ নবী এবং আলী শেষ ওসীয়ত প্রাপ্ত দায়িত্বশীল। ……যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওসীয়ত ও দায়িত্ব প্রদানকে মেনে নিলনা, বরং নিজেই ক্ষমতা নিয়ে নিল, তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে।……..[তাবারী, মুহাম্মাদ ইবনু জারীর(৩১০ হি), তারীখুল উমামি ওয়াল মুলুক ২/৬৪৭]।
এখানে আমরা দেখছি যে, আবদুল্লাহ ইবনু সাবা নিজের বিভ্রান্তিগুলিকে যুক্তির আবরণে পেশ করার পাশাপাশি কিছু কথা পরোক্ষভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে বলেছে। আলী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাকে দায়িত্ব প্রদান না করা জুলুম ইত্যাদি কথা সে বলেছে।
আমরা পরবর্তী আলোচনায় দেখবো যে, এই সময় মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে সত্যপরায়ণতার ক্ষেত্রে এই ধরণের দূর্বলতা দেখা দেওয়ায় সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসের নামে মিথ্যা বলা প্রতিরোধের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেন।
প্রথম হিজরী শতকের শেষদিকে নিজ নিজ বিভ্রান্ত মত প্রমাণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে বানোয়াট হাদীস তৈরি করার প্রবণতা বাড়তে থাকে। সাহাবীদের নামেও মিথ্যা বলার প্রবণতা বাড়তে থাকে। পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মুখতার ইবনু আবু উবাইদ সাকাফী(১-৬৭ হি) সাহাবীগণের সমসাময়িক একজন তাবিয়ী। ৬০ হিজরীতে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন(রা) এর শাহাদাতের পরে তিনি ৬৪-৬৫ হিজরীতে মক্কার শাসক আবুদল্লাহ ইবনু যুবাইরের(১- ৭৩ হি)পক্ষ হতে কুফায় গমন করেন। কুফায় তিনি ইমাম হুসাইনের হত্যায় জড়িতদের ধরে হত্যা করতে থাকেন। এরপর তিনি আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইরের আনুগত্য অস্বীকার করে নিজেকে আলীর পুত্র মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফিয়্যার প্রতিনিধি বলে দাবি করেন। এরপর তিনি নিজেকে ওহীর ইলহামপ্রাপ্ত, রাসূলুল্লাহ(স) এর বিশেষ প্রতিনিধি, খলীফা ইত্যাদি দাবি করতে থাকেন। অবশেষে ৬৭ হিজরীতে আবদুল্লাহ ইবনু যুবাইরের বাহিনীর কাছে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।
তার এ সকল দাবীদাওয়ার সত্যতা প্রমাণের জন্য তিনি একাধিক ব্যক্তিকে তার পক্ষে মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলার জন্য আদেশ, অনুরোধ ও উৎসাহ প্রদান করেন।
আবু আনার হাররানী বলেন, মুখতার ইবনু আবু উবাইদ সাকাফী একজন হাদীস বর্ণনাকারীকে বলেন, আপনি আমার পক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে একটি হাদীস তৈরী করুন, যাতে থাকবে যে, আমি তাঁর পরে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে আগমন করব এবং তাঁর সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করব। এজন্য আমি আপনাকে দশহাজার দিরহাম, যানবাহন, ক্রীতদাস ও পোশাক পরিচ্ছদ উপঢৌকন প্রদান করব। ঐ হাদীস বর্ণনাকারী বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে হাদীস বানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কোনো একজন সাহাবীর নামে কোনো কথা বানানো যেতে পারে। এজন্য আপনি আপনার উপঢৌকন ইচ্ছামত কম করে দিতে পারেন। মুখতার বলেঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে কিছু হলে তার গুরুত্ব বেশি হবে। ঐ ব্যক্তি বলেনঃ তার শাস্তিও বেশি কঠিন হবে। (ইবনুল জাওযী, আল মাউদূ’আত ১/১৬-১৭)।
মুখতার অনেককেই এভাবে অনুরোধ করে। প্রয়োজনে ভীতি প্রদর্শন বা হত্যা ও করেছেন। সালামাহ ইবনু কাসীর বলেন, ইবনু রাব’য়া খুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগ পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমি একবার কূফায় গমন করি। আমাকে মুখতার সাকাফীর নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমার সাথে একাকী বসে বলেন, জনাব, আপনিতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগ পেয়েছেন। আপনি যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে কোনো কথা বলেন তা মানুষেরা বিশ্বাস করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে একটি হাদীস বলে আমার শক্তি বৃদ্ধি করুন। এই ৭০০ স্বর্ণমুদ্রা আপনার জন্য। আমি বললামঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নামে মিথ্যা বলার পরিণতি নিশ্চিত জাহান্নাম। আমি তা বলতে পারবোনা। [বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল (২৫৬ হি), আত-তারীখূল কাবীর ৮/৪৩৮; আত-তারীখুস সাবীর ১/১৪৭]।
সাহাবী আম্মার ইবনু ইয়াসীরের(রা) পুত্র মুহাম্মাদ ইবনু আম্মারকেও মুখতার তার পক্ষে তাঁর পিতা আম্মারের সূত্রে হাদীস বানিয়ে প্রচার করতে নির্দেশ দেয়। তিনি অস্বীকার করলে মুখতার তাকে হত্যা করে। [বুখারী, আত-তারীখুস সাগীর ১/১৪৭, আল জারহু ওয়াত তা’দীল ৮/৪৩]।
প্রথম হিজরী শতকের শেষ দিক থেকে প্রখ্যাত সাহাবীগণের নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা দেয়। বিশেষত আলী ইবনু আবু তালিব(রা) এর নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা তাঁর কিছু অনুসারীর মধ্যে দেখা দেয়। তিনি আবু বাকর(রা) ও উমার(রা) কে মনে মনে অপছন্দ করতেন বা নিন্দা করতেন, তিনি অলৌকিক সব কাজ করতেন, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের বানোয়াট কথা তারা বলতে শুরু করে।
প্রখ্যাত তাবেয়ী ইবনু আবু মুলাইকা আবদুল্লাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ(১১৭ হি) বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাসের (৬৮ হি)নিকট পত্র লিখে অনুরোধ করি যে, তিনি যেন আমাকে কিছু নির্বাচিত প্রয়োজনীয় বিষয় লিখে দেন। তখন তিনি বলেঃ আরবী(********)
-বিশ্বস্ত ও কল্যাণকামী যুবক। আমি তার জন্য কিছু বিষয় বিশেষ করে পছন্দ করে লিখব এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দিব। তখন তিনি আলী(রা) এর বিচারের লিখিত পান্ডুলিপি চেয়ে নেন। তিনি তা থেকে কিছু বিষয় লিখেন। আর কিছু কিছু বিষয় পড়ে তিনি বলেনঃ আল্লাহর কসম, আলী এই বিচার কখনোই করতে পারেননা। বিভ্রান্ত না হলে কেউ এই বিচার করতে পারেনা।(মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩)।
অর্থাৎ আলীর কিছু অতি উৎসাহী ও অতি ভক্ত সহচর তাঁর নামে এমন কিছু মিথ্যা কথা এসব পান্ডুলিপির মধ্যে লিখেছে যা তাঁর মর্যাদাকে ভুলুন্ঠিত করেছে, যদিও তারা তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই এগুলো বাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে অন্য তাবেয়ী তাঊস ইবনু কাইসার (১০৬ হি) বলেনঃ আরবী(********)
-ইবনু আব্বাস(রা) এর নিকট আলী(রা) এর বিচারের পান্ডুলিপি আনয়ন করা হয়। তিনি এক হাত পরিমাণ বাদে সেই পান্ডুলিপির সব কিছু মুছে ফেলেন। (মুসিলম, আস-সহীহ ১/১৩)।
প্রখ্যাত তাবেয়ী আবু ইসহাক আস সাবীয়ী(১২৯ হি) বলেন, যখন আলী(রা) এর এ সকল অতিভক্ত অনুসারী তাঁর ইন্তেকালের পরে এসকল নতুন বানোয়াট কথার উদ্ভাবন ঘটালো তখন আলী(রা) এর অনুসারীদের মধ্যে এক ব্যক্তি বলেনঃ আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন। কত বড় ইলম এরা নষ্ট করল! (মুসিলম, আস-সহীহ ১/১৩)।
তাবিয়ী মুগীরাহ ইবনু মিকসাম আদ-দাব্বী(১৩৬ হি) বলেনঃ আরবী(******)
-[আলী(রা) এর অনুসারীদের মধ্যে মিথ্যাচার এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে] আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ এর সাহচর্য্ লাভ করেছে এমন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ আলী(রা) হতে হাদীস বর্ণনা করলে তা সঠিক ও নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করা হতোনা। (মুসিলম, আস-সহীহ ১/১৩)।
এভাবে আমরা দেখেছি যে, প্রথম হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে ক্রমান্বয়ে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থে ও উদ্দেশ্যে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার প্রবণতা দেখা দেয। যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে এই প্রবণতা বাড়তে থাকে। হিজরী দ্বিতীয় শতক থেকে ক্রমেই মিথ্যাবাদীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং মিথ্যার প্রকার ও পদ্ধতিও বাড়তে থাকে। আমরা পরবর্তী পরিচ্ছেদে মিথ্যাবাদী জালিয়াতদের পরিচয়, শ্রেণীবিভাগ ও জালিয়াতির কারণসমূহ আলোচনা করব। তবে তার আগেই আমরা মিথ্যা প্রতিরোধে মুসলিম উম্মাহর কর্মপন্থা আলোচনা করতে চাই।
সাহাবীগণ ও তাঁদের পরবর্তী যুগগুলোর মুসলিম মনীষীগণ সকল প্রকার মিথ্যা থেকে বিশুদ্ধ হাদীসকে পৃথক রাখতে অত্যন্ত কার্য্কর ও বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করেছেন। আমরা এখানে তাঁদের কর্মধারা আলোচনা করতে চাই।