হাদীসের উৎস
পূর্বের আলোচনা হইতে একথা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা’আলা বিশ্বনবীল প্রতি যে ওহী নাযিল করিয়াছেন, তাহাই হইতেছে হাদীসের মূল উৎস। আল্লাহর প্রেরিত ওহী প্রধানত দুই প্রকারেরঃ প্রথম প্রকারের ওহীকে বলা হয় ‘ওহী’য়ে মতলু’- সাধারণ পঠিতব্য ওহী’ ইহাকে ওহীয়ে জ্বলীও বলা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকারের ওহী ‘ওহীয়ে গায়র মতলূ; নামে পরিচিত। ইহা সাধারণত তিলাওয়াত করা হয় না। ইহার অপর এক নাম ‘ওহীয়ে খফী’–প্রচ্ছন্ন ওহী। ইহা হইতে জ্ঞান লাভ করার সূত্রে এবং এই সূত্রলব্ধ জ্ঞান উভয়ই বোঝানো হয়।
শরীয়াতের মূল ভিত্তি হিসাবে কুরআনের পরেই হাদীসের স্থান। আল্লাহর হেদায়েত ও নির্ভূল নির্ভরযোগ্য সত্য জ্ঞানের যে উৎস হইতে কুরআন মজীদ অবতীর্ণ, হাদীসেও ঠিক সেই উৎস হইতেই নিঃসৃত। কুরআন মজীদের ঘোষণা হইতেই এই কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
হে নবী! আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমাত নাযিল করিয়াছেন এবং তুমি যাহা জানিতেন না, তাহা তোমাকে শিক্ষা দিয়াছেন। [সূরা আন-নিসা, ১১৩ আয়াত।]
এই আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
আয়াতে উল্লিখিত আল-কিতাব অর্থ কুরআন মজীদ এবং হিকমত অর্থ সুন্নত বা হাদীসে রাসূল (এবং এই উভয় জিনিসই আল্লাহর নিকট হইতে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ।) [তাফসীরে ইবনে কাসীর।]
নবী করীম (স)- এর নিম্নোক্ত বাণীও প্রমাণ করে যে, কুরআন এবং হাদীস উভয়ই একই স্থান ও একই সূত্র হইতে প্রাপ্ত। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমাকে কুরআন দেওয়া হইয়াছে এবং সেই সঙ্গে উহারই মত আর একটি জিনিস।[কাঞ্জুল উম্মাল, -শায়ক আলাউদ্দীন; আবূ দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ।]
‘উহার মত আর একটি জিনিস’ কথাটির অর্থ হাদীস ছাড়া আরি কিছু হইতে পারে না। কেননা দুনিয়ার মানুষ রাসূলে করীম (স)-এর হইতে এই দুইটি জিনিসই লাভ করিয়াছেন।
হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রা) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
জিব্রাঈল (আ) হযরতের নিকট সুন্নাত বা হাদীস লইয়া নাযিল হইতেন, যেমন নাযিল হইতেন কুরআন লইয়া এবং তাঁহাকে সুন্নাতও শিক্ষা দিতেন, যেমন শিক্ষা দিতেন কুরআন।[৮৬**********]
হাসন ইবনে আতীয়াতা বলিয়াছেনঃ
******************************************************
রাসূলে করীম (স) –এর প্রতি ‘ওহী’ নাযিল হইত এবং হযরত জিব্রাঈল তাঁহা নিকট সুন্নাত লইয়া হাযির হইতেন, যাহা প্রথম প্রকার ওহী কুরআনের-ব্যাখ্যা দান করে। [৮৭***********]
কুরআনের আয়াত ছাড়া শুধু হাদীস লইয়াও হযরত জিব্রাঈল নবী করীমের নিকট উপস্থিত হইতেন, একথা মুসলিম শরীফের একটি হাদীস হইতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। কিতাবুল জিহাদ- এ উল্লেখিত—
******************************************************
হাদীসে আত্মোনিবেদিত নিষ্ঠাবান মুজাহিদের গুনাহ মাফ হওয়া সম্পর্কে এক লম্বা কথা বর্ণনা করার পর রাসূলে করীম (স) বলিলেনঃ
জিব্রাঈল (আ) নিজেই আমাকে এই কথা বলিয়া গেলেন।
এই কথাটি এই পর্যায়ে খুবই স্পষ্ট ও অকাট্য।
বস্তুত নবী করীম (স) দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে আল্লাহর নিকট হইতে নির্ভূল জ্ঞান লাভ করার পরই কথা বলিতেন। দ্বীন সম্পর্কিত কোন কথাই িতনি নিজস্ব আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে বলিতেন না। ইহা র বাস্তব প্রমাণ এই যে, তাঁহার নিকট দ্বীন-ইসলাম সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হইলে এবং সে বিষয়ে তাঁহার পূর্ব জ্ঞান না থাকিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই উহার কোন জওয়াব দিতেন না। বরং জিব্রাঈলের মারফতে আল্লাহর নিকট হইতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভের অপেক্ষায় থাকিতেন। তিনি এই উপায়ে যখন জানিতে পারিতেন, তখনই সেই জিজ্ঞাসার জওয়াব দান করিতেন। উহার দুইটি দৃষ্টান্ত পেশ করা যাইতেছেঃ
১। এক ইয়াহুদী পণ্ডিত নবী করীমের নিকট জিজ্ঞাসা করিলঃ পৃথিবীতে উত্তম স্থান কোনটি? ইহার সঠিক জওয়াব উপস্থিতভাবে নবী করীমের জানা ছিল না, সেই কারণে তিনি এই প্রশ্নের জওযাব সঙ্গে সঙ্গেই দিলেন না। পরে জিব্রাঈলেরে আগমন হইলে তিনি তাঁহার নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। জিব্রাঈল প্রথশত বলিলেনঃ ‘এই বিষয়ে প্রশ্নকারী ও যাহার নিকট প্রশ্ন করা হইয়াছে উভয়ই অজ্ঞ। এই বিষয়ে আল্লাহর নিকট হইতে জানিয়া জওয়াব দেওয়া যাইবে’। দ্বিতীয়বারে জিব্রাঈল আসিয়াবলিলেনঃ হে নবী, আমি এইবার আল্লাহর এতিই নিকটবর্তী হইয়াছি, যতটা আর কখনো হই নাই। আল্লাহ তা’আলা জিজ্ঞাসিত বিষয় সম্পর্কে ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
সর্বোপক্ষো নিকৃষ্ট হইতেছে হাট-বাজারের স্থান এবং সর্বাপেক্ষা উত্তম ও কল্যাণময় স্থান হইতেছে মসজিদসমূহ। [৮৯**************]
হযরত আবূ ইয়ালা একটন সাহাবী ‘ওহী’ কিভাবে নাযিল হয় এবং ‘ওহী’ নাযিল হওয়ার সময় রাসূলে করীমের অবস্থাটা কিরূপ হয় তাহা প্রত্যক্ষভাবে দেখিবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিদায় হজ্জের সফরে তাহা প্রত্যক্ষ করা অপূর্ব সুযোগ ঘটে। নবী করীম (স) এই সময় ‘জেয়ের রেনা’ নামক স্থানে অবস্থান করিতেছিলেন। তখন একজন সাহাবী রাসূলে করীমের নিকট জিজ্ঞাসা করেনঃ ‘সুগন্ধি মাখিয়া উমরা পালনের জন্য ইহরাম বাঁধা জায়েয কিনা? [আল্লামা শারকাভী লিখিয়াছেনঃ প্রশ্নকারীর ছিলেন- আতা ইবনে মুনিয়া, হযরত ইয়ালার ভাই।]নবী করীম (স) সঙ্গে সঙ্গেই ইহার জওয়াব প্রদান করেন নি। তিনি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকেন। অতঃপর রাসূল (স)-এর প্রতি ওহী নাযিল হয়। বুখারী শরীফে এই প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
তখন নবী করীম (স) নবী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। পরে তাঁহার প্রতি নাযিল হইল……………..।
এই সময় নবী করীম (স)- এর উপর কাপড় দ্বারা ছায়া করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। তখনই ইয়ালা উহার মধ্যে মাথা প্রবেশ করাইয়া দেখিলঃ
******************************************************
রাসূলের সমস্ত মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করিয়াছে এবং তিনি বিকট শব্দে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করিতেছেন। [বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড, কিতাবুল মানাসিক, ২০৮ পৃষ্ঠা এবং ঐ ২য় খন্ড, কিতাব ফাযায়েলুল কুরআন, ৭৪৫ পৃষ্ঠা।]
মুহাদ্দিসীনের মতে ওহী অবতরণের দুর্বহ ভারে এই সময় নবী করীমের ভীষণ শ্বাসকষ্ট হইতেছিল। আল্লামা শারাকাভী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
হাদীসে উল্লিখিত ‘গাতীত’ এমন এক প্রকারের বিকট শব্দ, যাহা ওহী নাযিল হওয়ার সময়ে উহার দুর্বহ ভারে অতি কষ্টে শ্বাস লওয়ার কারণে ধ্বনিত হইত। [ফতহুল মুবদী, ২য় খন্ড, ৮৯ পৃষ্ঠা।]
রাসূলে করীমের প্রতি ওহী নাযিল হওয়ার সময় এইরূপ কষ্ট অনুভূত হইত এবং সেইজন্য তাঁহার ভীষণ শ্বাস-কষ্ট হইত। পক্ষান্তরে এইরূপ শব্দ হইতে শুনিলে সকল সাহাবীই বুঝিতে পারিতেন যে, এখন রাসূলের প্রতি ওহী নাযিল হইতেছে।
বস্তুত কুরআন মজীদ জিব্রাঈলের মাধ্যমে ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ সত্য বিধান। কিন্তু এই ওহীর মাধ্যমে যত সত্য ও নির্ভুল তত্ত্বই লাভ হইয়াছে, তাহা সবই কুরআন মজীদে সন্নিবেশিত নহে। দ্বীন-ইসলামে এই ধরণের সত্য জ্ঞানের গুরুত্ব কুরআনের অব্যাবহতি পরেই, এই কারণে উহা কুরআনে সন্নিবেশিত না হইয়া ‘হাদীসে রাসূল’ হিসাবে সংরক্ষিত হইয়াছে। নবী-জীবনের ইতিহাসে এমন অসংখ্য ওহী নাযিল হওয়ার সন্ধান পাওয়া যায়, যাহা ত্রিশপারা কুরআন মজীদের কোথাও পরিদৃষ্ট হয় না। তবে উহা কি বিনষ্ট ও বিস্মৃতির অতল তলে নিমজ্জিত হইয়া গিয়াছে? উহা কি অপ্রয়োজনীয় ছিল? তাহা হইতে পারে না। বাস্তবিকই উহা বিনষ্ট হয় নাই। মানব জীবনের জন্য উহা একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল বলিয়াচিরদিনের জন্য স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে। মুসলিম জাতির জন্য ইহা এক চিরন্তন সম্পদ।
পরন্তু নবী করীম (স) গঠিত সমাজের লোকদের আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদের প্রতি যেমন ঈমান ও গুরুত্ব বোধ ছিল, ওহীর কুরআন-বহির্ভূত অংশ-হাদীসের প্রতিও ছিল অনুরূপ আগ্রহ ও লক্ষ্য। বরং রাসূলে ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে করিামের নিকট কুরআন মজীদ সম্পূর্ণ লিপিবদ্ধ ও সংকলিত অব্স্থায় বর্তমান ছিল বলিয়া উহার কোন অনুসন্ধান-তৎপরতা অবল’নের প্রয়োজন দেখা দেয় নাই। কিন্তু রাসূলের হাদীসের ব্যাপারে এই প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল। আর এইজন্য তাঁহাদের চেষ্টা ও সাধনার কোন অন্ত ছিল না। তাঁহারা রাসূলের অধিক নিকটবর্তী লোকদের নিকট এই পর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদও করিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ দুইটি ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারেঃ
******************************************************
কুরআনে সংকলিত ওহী ছাড়া ওহীর অপর কোন অংশ আপনার নিকট রক্ষিত আছে কি?[বুখারী শরীফ, প্রথম খন্ড, কিতাবুল জিহাদ, ৪২৮ পৃষ্ঠা।]
ইহার জাওয়াবে হযরত আলী কয়েকটি হাদীস পেশ করেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয়ঃ (ক) কুরআন ছাড়াও ওহী সুত্রে পাওয়া জ্ঞানের আরো অস্তিত্ব আছে। (খ) সব ওহীই কুরআন মজীদে সংকলিত বা উহার মধ্যে সামিল নয়। ওহীর আরো এমন অংশ রহিয়াছে, যাহা কুরআনের বাহিরে রহিয়াছে। তাহা আল্লাহর ‘কালাম’ না হইলেও আল্লাহর নিকট হইতেই জানিয়া লওযা জ্ঞান। (গ) কুরআন-বহির্ভূত ওহী রাসূলে করীমের মৌখিক কথা বাস্তবে করা কাজের বিবরণ হইতে জানা যায় এবং তাহাও ‘ওহী’– ওহীলব্ধ জ্ঞান, ইহা নিঃসন্দেহ। হযরত আবূ হুযায়ফা উহাকেও ‘ওহী’র মধ্যে গণ্য করিলেন, কিন্তু হযরত আলী (র) তাহাতে কোন রূপ আপত্তি করে নাই। তিনি বলেন নাই যে, সব ওহী- ওহীর মাধ্যমে পাওয়া সব জ্ঞানই- কুরআন মজীদে সংকলিত; উহার বাহিরে ওহীর কোন অংশ নাই।
কুরআন ও হাদীস বাহ্যত দুই জিনিস হইলেও মুলত উভয়ই ওহীর উৎস হইতে উৎসারিত। এই কারণে মৌলিকতা, যুক্তিভত্তিকতা, প্রামাণিকতা এবং অবশ্য অনুসরণীয় হওয়ার দিক দিয়া উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। কাজেই হাদীসের প্রতি কোন প্রকার উপেক্ষা প্রদর্শন করা এবং উহা রাসূলের কথা- আল্লাহর কথা নহে, অতএবং তাহা না মানিলেও চলিবে’ বলিয়া উহার গুরুত্ব হ্রাস করা কোন মুসলমানেরই নীতি হইতে পারেন না।
এই পর্যায়ে একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে। তাহা এই যে, নবী করীম (স) তাঁহার প্রতি অবতীর্ণ কুরআনের ভিত্তিতে অনেক সময় ইজতিহাদও করিয়াছেন। কুরআনের মৌলিক ও ইজমালী নীতির দৃষ্টিাতে দ্বীনে বিস্তারিত রূপ সম্পকেৃ স্বীয় চিন্তা ও বিবেচনার ভিত্তিকে জনগণকে দিয়াছেন অনেক আদেশ- উপদেশ। শরীয়াতের দৃষ্টিতে তাহাও হাদীস- ‘রাসূলের সুন্নাত পর্যায়ে গণ্য। এই সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ******************************************************
রাসূলে করীম (স) যাহা কিছু হুকুম দিয়াছেন তাহা সবই তাহাই, যাহা তিনি কুরআন হইতে বুঝিতে পারিয়াছেন। পরে কুরআন হইতে উহার সমর্থন বাহির করিয়াছেন।
মুল্লা আলী আলকারী লিখিয়াছেন, হাদীসকে নবী করীমের কথারূপে পরিচয় দেওয়া হয় এইজন্য যে,তিনিই উহা কুরআন হইতে বুঝিয়া লইয়াছেন।
******************************************************
এইজন্য যে, তিনি তাহা কুরআন হইতেই বুঝিয়া পাইয়াছেন এবং কুরআনের ভাবধারা হইতেই উহা বাহির করিয়াছেন।