হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস সংকলন
উমর ইবনে আবদুল আযীয ১০১ হিজরীর ২৫শে রজব ইন্তেকাল করেন। তাঁহার খিলাফতের মেয়াদ ছিল দুই বৎসর পাঁচ মাস। ইমাম শা’বী ইমাম যুহরী, ইমাম মকহুল দেমাশকী ও কাযী আবূ বকর ইবনে হাযমের সংকলিত হাদীস গ্রন্হাবলী তাঁহারই খিলাফতকালের অমর অবদান। প্রথম হিজরী শতকের মধ্যেই এই গ্রন্হাবলীর সংকলন কার্য সম্পূর্ণতা লাভ করিয়াছিল।
প্রথম হিজরী শতকে এই পর্যায়ে যতটুকু কাজ সম্পন্ন হইয়াছিল, পরিমাণে ও আকারে তাহা বিরাট কিছু না হইলেও উহার ফলে যে হাদীস গ্রন্হ-সংকলনের দ্বার উন্মুক্ত হইয়াছিল, তাহা অনস্বীকার্য। ফলে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম হইতেই এই কাজ যথোপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে সম্পন্ন হইতে শুরু করে। এই পর্যায়ে কেবলমাত্র রাসূল (স)- এর কথা ও কাজ সম্পর্কিত হাদীসই নহে, সাহাবায়ে কিরামের কথা, ফতোয়া, তাবেয়ীদের কুরআন-হাদীসভিত্তিক বিভিন্ন ফতোয়া এবং দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তাঁহাদের কথাবার্তা ও নসীহতের বাণী পর্যন্ত এই যুগের হাদীস গ্রন্হাবলীতে সন্নিবেশিত হইবার সুযোগ লাভ করে।
কিতাবুল আ’সর
তাবেয়ী যুগের মুহাদ্দিসদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হাবলী স্বীয় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লইয়া পরবর্তীকালের হাদীসানুধ্যায়ীদের নিকট পৌঁছায় নাই। এই দিক দিয়া আমাদের নিকট বিরাজমান কেবলমাত্র একখানি গ্রন্হেরই নাম করা যাইতে পারে এবং তাহা হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার। ইমাম আবূ হানীফা (র) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর সময়ে প্রতিষ্ঠিত [********************] কূফার জামে মসজিদের প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান শিক্ষাগুরু নিযুক্ত হইয়া একদিকে যেমন ‘ইলমে ফিকাহ’র ভিত্তি স্থাপন করেন, অপরদিকে সেই সঙ্গেই তিনি রাসূল (স)-এর আদেশ-নিষেধমূলক হাদীসসমূহের ও একটি সংকলন নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংকলিত হাদীস সমূহের সমন্বয়ে রচনা করেন। এই গ্রন্হেরই নাম হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার’। দুনিয়ার মুসলিম জাতির নিকট ইহা অপেক্ষা প্রাচীনতম হাদীস গ্রন্হ সম্ভবত আর একখানিও বর্তমান নাই। অথবা বলা যায়, মুসলিম উম্মতের নিকট মওজুদ হাদীস গ্রন্হাবলীর মধ্যে ইহাই সর্বাধিক প্রাচীন হাদীস-গ্রন্হ। ইমাম আবূ হানীফার পূর্বে হাদীস সংগ্রহকারিগণ কর্তৃক যেন-তেনভাবে হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও সংকলন করার কাজই হইয়াছিল। ঠিক গ্রন্হ প্রণয়নের ধারায় হাদীসের কোন গ্রন্হই বিরচিত হয় নাই। ইমাম শা’বী একই বিষয়ের হাদীস একস্থানে একত্র করিয়া একখানি গ্রন্হের রূপ দিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাহা মাত্র কয়েকটি অধ্যায় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, ইহার বেশী কিছু করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। এই কাজ অতঃপর আর অগ্রসরও হইতে পারে নাই। এই কারণে হাদীসসমূহকে পরিচ্ছেদ (কিতাব) ও অধ্যায় (বাব) হিসাবে, গ্রন্হ প্রণয়নের ধারা ও পদ্ধতি অনুসারে সুসংকলিত করার কাজ তখন পর্যন্তও অসম্পন্নই রহিয়া গিয়াছিল। ইমাম আবূ হানীফা (র) ‘কিতাবুল আ’সার’ প্রণয়ন করিয়া এই দায়িত্ব বিশেষ যোগ্যতা ও বিজ্ঞতা সহকারেই পালন করিয়াছিলেন। হাফেজ সুয়ূতী ইমাম আবূ হানীফা (র) সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা (র) বিশেষ একটি কীর্তি-যাহাতে তিনি একক, তাহা এই যে, তিনিই সর্বপ্রথম ইলমে শরীয়াতকে সুসংবদ্ধ করিয়াছেন এবং উহাকে অধ্যায় হিসাবে সংকলিত করিয়াছেন। ইমাম মলিক (র) ‘মুয়াত্তা’ প্রণয়নে তাহারই অনুসরণ করিয়াছেন। কিন্তু এইরূপ গ্রন্হ প্রণয়নের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র)-কে সময়ের দিক দিয়া কেহই অতিক্রম করিয়া যাইতে পারেন নাই।[********************]
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা (র) বর্ণিত স্বতন্ত্র হাদীস-গ্রন্হ বর্তমান। আর তাহা হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার’; ইহা তাঁদের নিকট হইতে মুহাম্মদ ইবনে হাসান বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]
ইমাম আলাউদ্দিন ‘কাশানী’ এই কিতাবের উল্লেখ করিয়াছেন ******************** ইমাম আবূ হানীফা (র) সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বলিয়া।[********************]
‘কিতাবুল আ’সার’ নামক হাদীসগ্রন্হখানি প্রণয়নের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র) ব্যাপকভাবে হাদীস সংগ্রহ ও ছাঁটাই-বাছাই করিয়াছেন। সদরুল আয়িম্মা মুয়াফফিক ইবনে আহমদ মক্কী তাঁহার গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা (র) চল্লিশ সহস্র হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া ‘কিতাবুল আ’সার’-এর এই গ্রন্হখানি প্রণয়ন করেন।[******************** এখানে হাদীসের যে সংখ্যা বলা হইয়াছে, তাহা হাদীসের আলাদা আলাদা সংখ্যা নহে; বরং হাদীসের সূত্র মাও এবং এক-একটি হাদীসের বহু সংখ্যক সূত্র হইতে পারে।]
হাদীস চয়ন ও হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে তাঁহার এই অসামান্য সতর্কতার কথা সকল হাদীস-পারদর্শী ব্যক্তিই স্বীকার করিয়াছেন। ইমাম ওকী (র) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র) কর্তৃক যেরূপ সতর্কতা অবলম্বিত হইয়াছে, তদ্রুপ আর কাহারও দ্বারা অবলম্বিত হয় নাই।[ঐ, এখানে উল্লেখ্য, হাদীসের ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতান হাদীস যাচাই, পরখ ও বাছাই-ছাঁটাই শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
****************************************************** আল্লাহর নামের শপথ, মুসলিম উম্মত বা জাতির নিকট আল্লাহ ও রাসূলের নিকট হইতে পাওয়া সমস্ত ইলম-এর ক্ষেত্রে অধিক বড় আলিমরূপে স্বীকৃত।]
ঠিক এই কারণেই মনে হয় মুহাদ্দিমগণ ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সমালোচনা করিতে গিয়া তাঁহাকে ******************** ‘হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত কঠোর ও কড়া লোক’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন এবং এই কারণেই তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুব বেশী হইতে পারে নাই। ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে খালদুন ইহার কারণ বর্ণনা প্রসংগে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণ এই যে, তিনি হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনার ব্যাপারে কঠোর নৈতিক শর্ত আরোপ করিতেন।[********************]
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সংগ্রহীত হাদীসের বিপুলতা ও উহা সামান্য পরিমাণ বর্ণনা করা সম্পর্কে স্বয়ং ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর হইতে একটি উক্তি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমার নিকট কয়েক সিন্দুক ভর্তি লিখিত হাদীস-সম্পদ মজুদ রহিয়াছে। কিন্তু আমি তাহা হইতে অতি অর্প সংখ্যকই প্রকাশ ও বর্ণনা করিয়াছি, যাহা লোকদের ব্যবহারিক জীবনের উপকার দিবে।[********************]
অন্যান্য হাদীস গ্রন্হের ন্যায় ‘কিতাবুল আ’সার’-এর ‘নুসখা’ (অনুলিপি) রহিয়াছে। এই কারণে তাহা এক-একজন ছাত্রের নামেই প্রখ্যাত হইয়াছে। অন্যথায় মূল গ্রন্হ ইমাম আবূ হানীফারই সংকলিত একখানি মাত্র হাদীসগ্রন্হ। এই ‘নুসখা’ প্রকাশকারীদের মধ্যে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখযোগ্যঃ
১. ইমাম যুফার ইবনুল হুযাইলঃ এই সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
******************************************************
আহমদ ইবনে বকর যুফার ইবনুল হুযাইলের ছাত্র আবূ ওহাবের নিকট হইতে আবূ হানীফা (র)- এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]
২. ইমাম আবূ ইউসুফ ইবনে আবূ ইউসুফঃ তাঁহার সম্পর্কে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে তাঁহার সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ তাঁহার পিতার সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। উহা একখানি বিরাট আকারের গ্রন্হ।[কাজী আতহার মূবারকপুরী (বো’ই হইতে প্রকাশিত ‘আল বালাগ’ পত্রিাকর সম্পাদক) লিখিয়াছেনঃ ইমাম আবূ হানীফার ‘কিতাবুল আ’সার’ তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার ছাত্ররা অন্য লোকদের নিকট বর্ণনা করিয়াছেন এবং বর্ণনা করার সময় তাঁহারা নিজেরাও ইহাতে অনেক হাদীস সংযোজিত করিয়াছেন। এই কারণে মূল গ্রন্হখানি বিভিন্ন ছাত্রের নামে জনগণের মধ্যে পরিচিত হইয়াছে। অন্যথায় মুলগ্রন্হ ইমাম আবূ হানিফা (র)-এর সংকলিত হাদীস গ্রন্হ।********************]
৩. ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীঃ তাঁহার তৈরী করা সংকলনটিই প্রসিদ্ধ এবং ইহাই বর্তমান ভূলক্রমে ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বলিয়া পরিচিত।
৪. ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ লু’লুয়ীঃ ইবনে হাজার আসাকালানী (র) ইহার সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবেন ইবরাহীমের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ‘কিতাবুল আ’সার’ মুহাম্মদ ইবনে শুজা তাহার ওস্তাদ হাসান ইবনে যিয়াদের সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]
মুয়াত্তা ইমাম মালিক
ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’-এর পরে পরেই সংকলিত হাদীস গ্রন্হ হিসাবে আমরা দেখিতে পাই ইমাম মালিক (র)-এর সংকলিত ‘মুয়াত্তা’।
কিতাবুল আ’সার ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র)-এর মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্ত গ্রন্হে হিজায, ইরাক, সিরিয়াও মুসলিম জাহানের অন্যান্য হাদীস-বর্ণনাকারী লোকদের বর্ণিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে; কিন্তু ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’-এ রহিয়াছে কেবলমাত্র মদীনায় অবস্থানকারী মুহাদ্দিসদের বর্ণিত হাদীস। কেননা ইমাম মালিক (র) সম্পর্কে পূর্ববর্তী আলোচনা হইতে আমরা দেখিয়াছি যে, তিনি হাদীস সংগ্রহের জন্য মদীনার বাহিরে কখনো সফরে গমন করেন নাই।
‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের ধারা এইভাবে সাজানো হইয়াছে যে, প্রথমে রাসূলে করীম (স)-এর হাদীস- কথা বা কাজের বিবরণ উল্লেখ করা হইয়াছে। তাহার পর উহাতে সাহাবায়ে কিরামের কথা এবং তাবেয়ীদের কুরআন-হাদীস ভিত্তিক ফতোয়াসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে।[********************]
ইমাম মালিক (র) হাদীসের এই গ্রন্হখানি সংকলন করেন আব্বাসী খলীফা আল- মনসুর –এর আদেশক্রমে। মুহাম্মদ আবূ যাহু নামক এ যুগের একজন মিসরীয় গ্রন্হ-প্রণেতা লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
আব্বাসী খলীফা আবূ জাফর আল-মনসূর ইমাম মালিক (র)- কে ডাকিয়া বলিলেনঃ তিনি যেন তাঁহার নিজের নিকট প্রমাণিত ও সহীহরূপে সাব্যস্ত হাদীসসমূহ সংকলন ও একখানি গ্রন্হাকারে তাহা প্রণয়ন করেন এবং উহাকে যেন তিনি লোকদের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করার জন্য নির্দিষ্ট করেন। অতঃপর তিনি তাঁহার এই গ্রন্হ প্রণয়ন করেন এবং উহার নাম নির্দিষ্ট করেন- ‘আল-মুয়াত্তা’।[********************]
ইমমা মালিক (র) এই গ্রন্হখানি প্রণয়নের অপরিসীম শ্রম-মেহনত ও অমলিন ধৈর্য ও অধ্যবসায় নিয়োগ করিয়াছিলেন। ইমাম সুয়ূতী ইবনুল হুবাব-এর সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম মালিক (র) প্রথমে একলক্ষ বর্ণনা করেন। তাহা হইতে দশ হাজার হাদীসের সমন্বয়ে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ সংকলন করেন। অতঃপর তিনি উহাকে কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যাঁচাই করিতে থাকেন। সাহাবীদের আ’সার ও অন্যান্য খবর-এর ভিত্তিতেও উহার পরীক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত উহাতে মাত্র পাঁচশত হাদীস সন্নিবেশিত করেন।[********************]
ইমাম সুয়ূতী আতীক ইবনে ইয়াকুবের সুত্রে নিম্নোক্ত বর্ণনাও উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম মালিক প্রায় দশ সহস্র হাদীসের সমন্বয়ে ‘মুয়াত্তা’ রচনা করেন। অতঃপর তিনি উহার প্রত্যেক বৎসর দৃষ্টি দিতে ও যাঁচাই করিতে এবং উহা হইতে হাদীস প্রত্যাহার করিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত বর্তমান আকারে উহা পূর্ণ পরিণীত লাভ করে।[********************]
এই গ্রন্হ প্রণয়ন চূড়ান্তভাবে সম্পূর্ণ করিতে ইমাম মালিকের পূর্ণ চল্লিশটি বৎসর সময় লাগিয়াছে। এ সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেন, ইমাম মালিক এই গ্রন্হখানি প্রণয়নে পূর্ণ চল্লিশটি বৎসর অতিবাহিত করিয়াছেন। এই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি উহাকে যাঁচাই ও ছাঁটাই করিতেছিলেন এবং উহাকে সুসংবদ্ধরূপে সজ্জিত, নির্ভূল ও শৃংখলিত করিতে ব্যস্ত ছিলেন।[********************]
এই গ্রন্হের নামকরণ সম্পর্কে ইমাম মালিক নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমার এই কিতাবখানা আমি মদীনায় বসবাসকারী সত্তর জন ফিকাহবিদ-এর সম্মুখে পেশ করিয়াছি। তাঁহারা প্রত্যেকেই উহার জন্য আমাকে উপদেশ দিয়াছেন। এই কারণে আমি উহার নাম রাখিয়াছি ‘মুয়াত্তা’।[********************]
উপরে ইবনুল হুবাবের সূত্রে উল্লেখিত ইমাম সুয়ূতীর উদ্ধতি হইতে জানা গিয়াছে যে, ইমাম মালিক দশ হাজার হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া মাত্র পাঁচশত হাদীস তাঁহার গ্রন্হে রাখিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হে মোট কতটি হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে, তাহা এই উদ্ধৃতি হইতে জানা যায় না। এই সম্পর্কে ইমাম সয়ূতীর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি হইয়াছে, তাহা এই উদ্ধৃতি হইতে জানা নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়। তিনি আবূ বকর আল- আবরাহীর সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ
******************************************************
মুয়াত্তা গ্রন্হে রাসূলে করীম (স), সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীন হইতে বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে এক হাজার সাতশত বিশটি।[********************]
ইহার মধ্যে সঠিকরূপে সনদযুক্ত হাদীস হইতেছে মাত্র তিনশত, ‘মুরসাল’ হাদীস হইতেছে ২২২টি, ‘মওকুফ’ হইতেছে ৬১৬টি এবং তাবেয়ীদের উক্তি হইতেছে ২৮৫টি। [********************] ইমাম হাযম (র) বলেনঃ
******************************************************
আমি ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের হাদীসসমূহ গণনা করিয়াছি। ফলে উহাতে আমি পাইয়াছি ‘মুসনাদ’ হাদীস পাঁচশতের কিছু বেশী প্রায় তিনশত হাদীস ‘মরসাল’। এতদ্ব্যতীত উহাতে প্রায় সত্তরটি হাদীস এমনও আছে, যাহার অনুসরণ করা ইমাম মালিক (র) পরিহার করিয়াছিলেন।[********************]
‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের নোসখা অসংখ্য। তন্মধ্যে তিনশত ‘নোসখা’ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এই নোসখাসমূহে সন্নিবেশিত হাদীসের সংখ্যায় যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান- কোনটিতে অপেক্ষাকৃত বেশী, আর কোনটিতে কম হাদীস রহিয়াছে। ইমাম সুয়ুতী ইহার তিনটি নোসখার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। নোসখা তিনটি এইঃ
১. ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া লাইসী আন্দালুসীকৃত নোসখাঃ তিনি ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হইতে সরাসরিভাবে শেষ তিনটি অধ্যায় বাদে সম্পূর্ণ ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ শবণ করিয়াছিলেন।
২. আবূ মুসয়িব আহমদ ইবনে আবূ বকর আল কাসিম কৃতঃ তিনি মদীনার বিচারপতি ছিলেন এবং তাঁহার তৈরী করা নোসখাই ইমাম মালিক (র)-কে সর্বশেষে শুনানো হয়। ইহাতে অপর নোসখার তুলনায় প্রায় একশতটি হাদীস বেশী রহিয়াছে।
৩. ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান শায়বানী কৃতঃ তিনি যেমন ইমাম আবু হানীফা (র)-এর নিকট ইলমে ফিকাহ শিক্ষা করিয়াছেন, অনুরুপভাবে ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হাইতে তিনি হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করিয়াছেন।[********************]
ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হইতে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ শ্রবণ করিয়া প্রায় এক হাজার ব্যক্তি উহার বর্ণনা করিয়াছেন।[********************] ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, তদানীন্তন ইসলামী সমাজে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ যথাযথ মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। জনগণ উহাকে সাদরে গ্রহন করিয়াছিল এবং মদীনার অধিবাসী ইমাম মালিক (র)-এর নিকট সরাসরিভাবে উহা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করার উদ্দেশ্যে গোটা মুসলিম জাহানের জনতা ভীড় জমাইয়াছিল। বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস এই কারণেই মনে করেন যে, তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত নবী করীম (স)-এর নিম্নোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী ইমাম মালিক (র) সম্পর্কেই সত্য প্রমাণিত হইয়াছে। হাদীসটি এই- নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
সেই সময় খুব দূরে নয়, যখন জনগণ ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে উষ্ট্রপৃষ্ঠে সাওয়ার হইয়া দূর দূর দেশ সফর করিবে; কিন্তু তাহারা মদীনায় অবস্থানকারী ‘আলেম’ অপেক্ষা অধিক বিজ্ঞ অন্য কাহাকেও কোথাও পাইবে না।[********************]
ইবনে উয়াইনা ও আবদুর রাযযাক প্রমুখ বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে বলিয়াছেন যে, এই হাদীসে উক্ত ‘আলেম’ হইতেছেন ইমাম মালিক (র)।[তিরমিযী, হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণিত।]
‘মুয়াত্তা’ ইমাম মালিক (র) সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র) অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেন ও ইহাকে এক অনন্য সাধারণ গ্রন্হ মনে করিতেন। তাঁহার এই সম্পর্কিত নিম্নোদ্ধৃত উক্তি সর্বজনবিদিত। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আল্লাহর কিতাবের পর ইমাম মালিক (র) সংকলিত হাদীসের কিতাব অপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ গ্রন্হ দুনিয়ার বুকে আর একখানিও নাই।[********************]
তাঁহার এই কথাটি নিম্নোক্ত ভাষায়ও বর্ণিত হইয়াছেঃ
******************************************************
কুরআনের অধিকতর নিকটবর্তী কিতাব ইমাম মালিক (র)-এর কিতাব অপেক্ষা আর একখানিও পৃথিবীর বুকে রচিত হয় নাই।[********************]
পরবর্তীকালের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ জারয়া মুয়াত্তা মালিক (র) সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
এতখানি আস্থা ও নির্ভরতা অপর কোন কিতাবের উপর স্থাপিত হয় নাই।[********************]
ইমাম মালিক সংকলিত এই হাদীস গ্রন্হ এতই জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিল যে, তদানীন্তন আব্বাসীয় বাদশাহ আল-মনসুর হ্জ্জ উপলক্ষে মদীনায় গমন করিলে তিনি ইমাম মালিক (র)-কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ
******************************************************
আমি সংকল্প করিয়াছি যে, আপনার সংকলিত হাদীস গ্রন্হখনির অসংখ্য অনুলিপি তৈয়ার করাইয়া প্রত্যেক মুসলিম শহরেও নগরে এক-একখানি করিয়া পাঠাইয়া দিব ও সেই অনুযায়ী আমল করার জন্য সকলকে আদেশ করিব। এবং উহাকে ছাড়িয়া অপর কোন গ্রন্হের দিকে মনোযোগ না দিতে বলিব।
এই কথা শ্রবণের পর ইমাম মালিক (র)-এর মনে আনন্দ ও স্ফূর্তির বন্যা প্রবাহিত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ইমাম মালিক (র)-ইহা মোটেই পছন্দ করিতে ও মানিয়া লইতে পারিলেন না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলিলেনঃ
******************************************************
আপনি এইরূপ কাজ করিবেন না। কেননা লোকরেদ নিকট পূর্বেই শরীয়াতের বহু কথা পৌঁছিয়া গিয়াছে। তাহারা বহু হাদীস শ্রবণ করিয়াছে, বহু হাদীস তাহারা বর্ণনা ও করিয়াছে এবং লোকেরা প্রথমেই যাহা কিছু পাইয়াছে, তাহাই তাহারা গ্রহণ করিয়া লইয়াছে, তদানুযায়ী তাহারা আমল শুরু করিয়া দিয়াছে। অতএব প্রত্যেক শহর ও অঞ্চলের লোকেরা নিজেদের জন্য যাহাই গ্রহণ করিয়াছে তদানুযায়ীই তাহাদিগকে আমল করিতে দিন।[********************]
অতঃপর বাদশাহ হারুন-অর-রশীদও ‘মুয়াত্তা’ মালিক (র) সম্পর্কে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে চাহিয়াছিলেন। তিনি উহাকে কা’বা ঘরের সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখার ও তদানুযায়ী আমল করার জন্য জনগণকে নির্দেশ দেওয়ার সংকল্প করিয়াছিলেন। কিন্তু ইমাম মালিক (র)-এর নিকট ইহার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে তিনি বলিলেনঃ
******************************************************
না, আপনি এইরূপ করিবেন না। কেননা রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে খুঁটিনাটি ব্যাপারে মত-পার্থক্য রহিয়াছে, তাঁহারা বিভিন্ন শহরে ও অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়িয়াছেন। আর তাহারা সকলেই সঠিক পথে পরিচালিত।[********************]
ইসলামের বিরাট ও ব্যাপক জীবন-ব্যবস্থার খুঁটিনাটি ব্যাপারে মতভেদ হওয়া অতি স্বাভাবিক। ইহার পথ বন্ধ করিয়া দিয়া সকল মানুষকে বিশেষ ও নির্দিষ্ট একটি মতের অনুসারী করিতে চেষ্টা করা ও সেজন্য রাজ-ক্ষমতার ব্যবহার করা কিছুতেই সমীচীন হইতে পারে না। বরং ইসলামী বিধানভিত্তিক সকল (খুঁটিনাটি) মতকেই- তাহা বাহ্যত যতই পরস্পর-বিরোধী মনে হউক না কেন, সত্য ও সঠিক বলিয়া স্বীকার করাই হইতেছে ইসলামের নীতি। ইমাম মালিক (র)-এর উপরোক্ত উক্তি হইতেও এই কথা প্রমাণিত হয়। ইমাম মালিক (র)-এর এই নীতি যে অত্যন্ত যুক্তিসংগত ও ইনসাফপূর্ণ ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইমাম ইবনে আবদুল বার (র) এই নীতির প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছেনঃ
******************************************************
সমঝদার লোকদের জন্য ইহা এক অতি ইনসাফপূর্ণ নীতি, সন্দেহ নাই।[********************]
ফিকাহর খুঁটিনাটি মাসলা লইয়া যাঁহারা সীমালংঘনকারী গোঁড়ামীতে লিপ্ত রহিয়াছেন ও খুঁটিনাটি ব্যাপারে নিজস্ব একটি বিশেষ মতকে জোরপূর্বক অন্যান্য মানুষের মাথায় চাপাইয়া দিবার জন্য অনমনীয়, ইমাম মালিক (র)- এর উপরোক্ত ভূমিকায় তাঁহাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা নিহিত রহিয়াছে।
জামে সুফিয়ান সওরী (র)
ঠিক এই সময়ই ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হ ‘আল-জামে’ নামে প্রণয়ন করেন। সুফিয়ান সওরী (র) ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর অনুষ্ঠিত দারসের মজলিসে রীতিমত হাযির থাকিতেন এবং তাঁহার সূত্রে হাদীস বর্ণনা করিতেন। কিন্তু ফিকাহ তিনি গ্রহণ করিয়াছেন ইমাম আবূ হানীফার বিশিষ্ট ছাত্র আলী ইবনে মসহর-এর নিকট হইতে। আলী ইবনে মসহর ছিলেন ফিকাহ ও হাদীস উভয়েরই বিশিষ্ট সুদক্ষ আলিম। তাঁহার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি হাদীস ও ফিকাহ- উভয়েরই পরদর্শী ছিলেন।[********************]
ইমাম সাওরী তাঁহারই সাহায্য ও সহযোগীতা লইয়া তাঁহার জামে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইমাম ইয়াযীদ ইবনে হারূন বলিয়াছেনঃ
******************************************************
সুফিয়ান সওরী ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ফিকাহ গ্রহণ করিতেন আলী ইবনে মসহর-এর নিকট হইতে এবং তাঁহারই সাহায্য এবং তাঁহার সহিত আলাপ-আলোচনা করিয়াই তিনি তাঁহার ‘জামে’ নামক হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]
এককালে সুফিয়ান সওরীর এই ‘আল-জামে’ কিতাখানি হাদীসবিদদের নিকট বড়ই প্রিয় ও বহুল পঠিত হওয়ার মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। ইমাম বুখারী (র) সর্বপ্রথম যেসব হাদীস-গ্রন্হ অধ্যয়ন করিয়াছেন, তন্মধ্যে এই ‘আল-জামে’ গ্রন্হ অন্যতম।
ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় (র)-এর নিকট প্রশ্ন করা হইয়াছিলঃ
******************************************************
গ্রন্হদ্বয়ের মদ্যে কোনখানি অধিকতর উত্তম, ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ না সুফিয়ান সওরীর ‘আল-জামে’?
তিনি অবশ্য জওয়াবে ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’কে উত্তম কিতাব বলিয়াছিলেন।[********************] কিন্তু ইমাম আবূ দাউদ সিজিস্তানী (সুনান প্রণেতা) ইহা হইতে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
এই পর্যায়ে লোকেরা যত গ্রন্হই প্রণয়ন করিয়াছেন, সুফিয়ান সওরীর ‘আল-জামে’ তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম গ্রন্হ।[********************]
উপরে এই সময় পর্যন্ত সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহের মধ্যে কেবলমাত্র উল্লেখযোগ্য কয়েকখানির সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেশ কর হইয়াছে, কিন্তু এই শতকের বিস্তারিত ইতিহাস প্রমাণ যে, এই সময়ে কেবলমাত্র এই কয়েকখানি গ্রন্হই সংকলিত হয় নাই। বরং এতদ্ব্যতীত আরো কয়েকখানি হাদীস-গ্রন্হ সংকলিত হইয়াছে। কিন্তু সেই গ্রন্হসমূহ উপরোল্লিখিত গ্রন্হ কয়খানি হইতে সরাসরি ও বিশেষ সাহায্য গ্রহণের মারফতেই সংকলিত হইয়াছে বলিয়া উহাদের সবিশেষ উল্লেখ করা হয় না।
এই সময় দুইজন গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ মুহাদ্দিসের আবির্ভব ঘটে। উল্লেখযোগ্য যে, তাঁহাদের দুইজনেরই নাম আবূ হাফস এবং তাঁহারা হইতেছেন পিতা ও পুত্র। পিতা-পুত্রের একই নাম হওয়ার কারণে তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য করার উদ্দেশ্যে পিতাকে আবূ হাফস কবীর (বড়) এবং পুত্রকে আবূ হাফস সগীর (ছোট) বলিয়া সম্ভোধন করা হয়। এইযুগে ইলমে হাদীসের প্রচার ও প্রসারকার্যে এই দুইজনের অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁহারা বুখারার প্রদান মুহাদ্দিসদের মধ্যে গন্য এবং তাঁহাদের প্রচেষ্টায়ই বুখারার সমস্ত এলাকায় ইলমে হাদীস ব্যাপক প্রচার লাভ করে, ঘরে ঘরে উহার চর্চা, শিক্ষা ও আলোচনা শুরু হয়। হাফেজ সাময়নী আূ হাফস কবীর সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার নিকট হইতে এত লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাহার সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব নয়।[********************]
বস্তুত বুখারার প্রতিটি গ্রামে তাঁহার ছাত্রগণ ছড়াইয়াছিল। খাইজাখীজ নামক গ্রামেও তাঁহার অসংখ্য ছাত্র ইলমে হাদীসের চর্চায় নিযুক্ত ছিল।[********************]
ইমাম আবূ হাফস ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের নিকট হইতে ইলমে হাদীস ও ফিকাহ শিক্ষা করেন। হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হাফস কবীর ইমাম মুহাম্মদের প্রধান ছাত্রদের মধ্যে গণ্য ছিলেন এবং বুখারার হানাফী আলিমদের নের্তৃত্বের তিনিই ছিলেন শেষ স্তম্ভ।[********************]
ইসলামের ইতিহাসে ইহা এমন এক পর্যায়ে, যখন তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ ও ইতিহাস-ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাপকভাবে গ্রন্হ-প্রণয়নের কাজ সম্পাদিত হয়। ঐতিহাসিক সুয়ূতী লিখিয়াছেনঃ এই সময় ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মালিকের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত ও দীক্ষিত অসংখ্য লোক ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল সম্ভার বক্ষে ধারণ করিয়া মুসলিম জাহানের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র স্থাপন করিয়া উহার ব্যাপাক শিক্ষাদান ও প্রচারকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম আবূ হানীফার ছাত্রদের প্রকৃত সংখ্যা কত হাফেয আবদুল কাদের কুরায়শীর নিম্নোদ্ধৃত বর্ণনা হইতে এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে প্রায় চার সহস্র ব্যক্তি হাদীস ও ফিকাহ সম্পর্কীয় তাঁহার মত বর্ণনা ওপ্রচার করিয়াছেন।[********************]
ইমাম হাজেজুদ্দীন ইবনুল বাযযায কুরদারী ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর বিপুল সংখ্যক ও মুসলিম জাহানের সর্বত্র বিক্ষিপ্ত ছাত্রদের এক দীর্ঘ তালিকা পেশ করিয়াছেন। উহার শিরোনামায় নিম্নোদ্ধৃত কথা লিখিত হইয়াছেঃ
******************************************************
পূর্ব ও পশ্চিম এলাকার শহরে-শহরে বিক্ষিপ্ত ঐসব লোক, যাঁহারা ইমাম আবূ হানীফার নিকট হইতে হাদীস ও ফিকাহ বর্ণনা করিয়াছেন।
অতঃপর তিনি তদানীন্তন মুসলিম জাহানের প্রায় সব কয়টি উল্লেখযোগ্য প্রদেশ, শহর, নগর, ও গ্রামের নাম লিখিয়া তথায় ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর কোন কোন ছাত্র হাদীস ও ফিকাহ প্রচারে নিযুক্ত ছিলেন, তাহার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করিয়াছেন।[********************]
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে হাদীস ও ফিকাহর শিক্ষা লাভের পর যেসব মনীষী স্বাধীন ও নিজস্বভাবে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, তাঁহদের সম্পর্কে ইমাম তাহাভী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর যেসব ছাত্র গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন, তাঁহারা হইতেছেন, চল্লিশজন। তাঁহাদের প্রথম পর্যায়ের দশজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনঃ ইমাম আবূ ইউসুফ, ইযুফার, ইমাম দাউদ-আত্তায়ী, ইমাম আসাদ ইবনে আমর, ইমাম ইউসুফ ইবন খালিদ সিমতী, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া ইবেন আবূ যায়েদা। আর এই শেষোক্ত ব্যক্তি তো ত্রিশ বৎসর পর্যন্ত প্রথমোক্ত ব্যক্তিদের লেখক হইয়া কাজ করিয়াছেন।[********************]
তাঁহারা সকলেই খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ছিলেন। ইমাম হাসান ইবেন যিয়াদও এই পর্যায়েরই একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ। তিনি ইবনে জুরাইজ-এর নিকট হইতে হাদীস সংগ্রহ করিয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি ইবনে জুরইজের নিকট হইতে বারো হাজার হাদীস লিখিয়া লইয়াছিলাম। এই হাদীসসমূহ ফিকাহবিদদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।[********************]
মোটকথা, ইমাম যুহরীর অব্যবহিত পর হইতেই হাদীস সংকলন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের এক দুই কূলপ্লাবী সয়লাব প্রবাহিত হয়। মুসলিম জাহানের প্রায় প্রত্যেকটি শহরেই এই কাজ আরম্ভ হইয়া যায়। এই সময়কার অন্যান্য গ্রন্হ প্রণেতা হইতেছেনঃ
মক্কায় এবনে জুরইজ (১৫০ হিঃ); ইবনে ইসহাক (১৫২ হিঃ); মদীনায় সায়ীদ ইবনে আবূ আরুজা (১৫৬ হিঃ); রুবাই ইবনে দুবাই (১৬০ হিঃ) ও মালিক ইবনে আনাস (১৭৯ হিঃ) বসরায় হাম্মাদ ইবনে সালামাহ (১৭৬ হিঃ) ও ইবনে আরূবা; কুফায় সুফিয়ান সওরী (১৬১ হিঃ) সিরিয়ায় আবূ আমর আওযায়ী (১৫৬ হিঃ) ওয়াসতে হুশাইম (১৮৮ হিঃ); লাইস ও ইবনে লাহইয়া’ খুরাসানে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (১৮১ হিঃ) ইয়ামেনে মা’মর (১৫৩ হিঃ) রায় শহরে জরীর ইবনে আবদুল হামিদ (১৮৮ হিঃ) তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।[********************]
তাঁহারা সকলেই প্রায় একই যুগের লোক এবং সমমাময়িক; দ্বিতীয় হিজরী শতকের তাঁহারা শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ।[********************] আর তাঁহাদেরই অবিশ্রান্ত সাধনা ও আন্তরিক গভীর নিষ্ঠাপূর্ণ গবেষণা ও যাচাই পরীক্ষা চালনার ফলেই হানাফী মাযহাবের দৃষ্টিতে ইলমে ফিকাহদের বিরাট প্রাসাদ রচিত হয়।
অনুরূপভাবে ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রগণও মুসলিত জাহানের প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে ছড়াইয়া পড়েন। তাঁহার নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছেন ও উহার প্রচার এবং শিক্ষাদানে নিযুক্ত হইয়াছেন এমন লোকের সংখ্যা কত? খতীব বাগদাদী বর্ণনাকারীদের সংখ্যা বলিয়াছেন ৯৩; কিন্তু হাফেয কাযী ইয়ায লিখিয়াছেনঃ এক হাজার তিন শতেরও অধিক।[********************]
ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব (মৃঃ ১৯৫ হিঃ); আবদুর রহমান ইবনুল কাসেম (মৃঃ ১৯১ হিঃ) ও আশহুব (মৃঃ ২০৪ হিঃ) সুদক্ষ ওউচ্চমানের গ্রন্হ রচয়িতা ছিলেন। হাফেজ যাহবী বলিয়াছেন, ইবনে ওহাব এক লক্ষ হাদীস মুখস্থ বর্ণনা করিতেন। আর তাঁহার সংকলিত গ্রন্হাবলীতে এক লক্ষ বিশ হাজার হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।[********************] ইবনুল কাসেমও হাদীসের হাফেজ ছিলেন এবং ইমাম মালিক (র)-এর ‘ফিকহ’ যাঁহারা বর্ণনা ও প্রচার করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে তিনি প্রধান ব্যক্তিরূপে গণ্য হইতেন।[********************]
উপরের এই দীর্ঘ আলোচনা হইতে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই হাদীসের অসংখ্য সংকলন তৈয়ার হইয়া সর্বত্র প্রচারিত হইয়াছিল। সেই সঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা (র) ও ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রগণ হাদীসের বিপুল জ্ঞান-সম্ভার বক্ষে ধারণ করিয়া গোটা মুসলিম জাহানের কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। উহার প্রচার ও শিক্ষাদানের ব্রতে আত্মনিয়েঅগ করিয়াছিলেন।