হাদীস সংগ্রহের অভিযান
হাদীস শিক্ষালাভ এবং হাদীস সংগ্রহ-সংকলনের জন্য নিজেদের ঘরবাড়ি ও সাংসারিক উন্নতি-অগ্রগতির সমস্ত চিন্তা-ভাবনা পরিহার করিয়া দেশে বিদেশে দূর-দূরান্তরের দুর্গম ও পর্বতসংকুল পথ অতিক্রম করা মুসলিম মনীষীদের অনেকেরই এক পবিত্র ব্রত ছিল। কুরআন ও হাদীসে এই কাজের জন্য বিশেষ উৎসাহ দান করা হইয়াছে। এই কাজের অপরিসীম সওয়াবের কথাও সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষিত হইয়াছে। দ্বীন সম্পর্কীয় জ্ঞান আহরণের জন্য বিদেশ যাত্রা এবং তথা হইতে জ্ঞান সম্পদ অর্জন করিয়া নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করা ও নিজ দেশের জনগণকে ইসলামী জীবনাদর্শ গ্রহণের দাওয়াত দেওয়া বস্তুতই মুসলিম জাতির এক মহান পবিত্র দায়িত্ব। এই পর্যায়ে সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন ওতৎপরবর্তীকালের জ্ঞান আহরণকারীদের অবিশ্রানত্ সাধনার বিস্ময়কর কাহিনী পাঠ করিলে মনে হয়, এক পবিত্র অপরিহার্য ব্রত ও দায়িত্ব মনে করিয়াই তাঁহারা এই কাজে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলেন। কুরআন মজীদ একদিকে হযরত মূসা নবীর জ্ঞান আহরণ উদ্দেশ্যে ‘মাজমাউল বাহরাইন’ (দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থল) পর্যন্ত সফর করার ইতিবৃত্ত প্রচার করিয়াছে, অপরদিকে দ্বীনী জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরের জন্য নিম্নলিখিত রূপ তাকীদ পেশ করিয়াছেনঃ
******************************************************
সকল মু’মিনকেই একসঙ্গে ঘর হইতে বহির হইয়া পড়িতে হইবে না বটে; কিন্তু তাহা হইলেও তাহাদের প্রত্যেক দল ও সমাজ হইতে কিছু কিছু লোক দ্বীন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভের জন্য কেন ঘর হইতে বহির্গত হইবে না- এই উদ্দেশ্যে যে, তাহারা নিজেদের জাতির লোকদের নিকট ফিরিয়া আসিয়া তাহাদিগকে আল্লাহ সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করিবে? তাহা হইলেই এই আশা করা যায় যে, তাহারা সতর্ক হইবে ও ভয় করিয়া চলিতে শুরু করিবে।[সূরা তওবা, ১৫ রুকু, ১২২ আয়াত।]
কুরআনের এই সুস্পষ্ট নির্দেশের সমর্থন বেশ কিছু সংখ্যক হাদীসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই পর্যায়ে সর্বপ্রথম হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত নিম্নোদ্ধৃত হাদীস উল্লেখযোগ্য।
রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
যে ব্যক্তি জ্ঞান-অন্বেষণের উদ্দেশ্যে কিছু পথও অতিক্রম করিবে আল্লাহ ইহার বিনিময়ে জান্নাতে যাওয়ার পথ তাহার জন্য সুগম করিয়া দিবেন।[বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬।]
হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
যে ব্যক্তি ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে ঘর হইতে বাহির হইবে, তাহার ঘরে ফিরিয়া আসা পর্যন্ত তাহার এই সফর আল্লাহর পথের সফর হইবে।[তিরমিযী, ******************** সুনানে দারেমী।]
বলা বাহুল্য, এই পর্যায়ের যাবতীয় হাদীসে যে ইসলাম শিক্ষার উদ্দেশ্যে বাহির হইবার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হইয়াছে, তাহা কুরআন- হাদীস সম্পর্কিত ইলম। বিশেষভাবে হাদীসের ইলমও হইতে পারে।
(ক)
সাহাবীদের যুগ
নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশাইতেই আরব দেশের বিভিন্ন গোত্র দূর-দূরান্ত হইতে তাঁহার দরবারে আসিয়া জমায়েত হইত ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান-তথ্য সংগ্রহ করিয়া নিজ নিজ দেশে চলিয়া যাইত। ব্যক্তিগতভাবে নিকট দূরের সাহাবীদের সম্পর্কেও এই কথাই সত্য।
হযরত আকাবা ইবনুল হারেস (রা) তাঁহার নিজের বিাবহ সম্পর্কীয় একটি মাসলার রায় জানিবার উদ্দেশ্যে দূরবর্তী কোন স্থান হইতে মদীনায় আগমন করেন। আসিয়া হযরতের নিকট হইতে শরীয়াতের ফয়সালা জানিয়া লইয়া নিজের বাড়ির দিকে চলিয়া যান এবং সেই ফয়সালা অনুযায়ী স্ত্রীরূপে গৃহীত স্বীয় দুধমাকে পরিত্যাগ করেন।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯।] ইসলামের প্রথম যুগের ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনার কোন সীমা সংখ্যা নাই। কেননা তখন ইসলামকে জানিবার জন্য দূরবর্তী মুসলিমদের পক্ষে আর কোন উপায়ই ছিল না।
অবশ্য সুফফার অধিবাসিগণ স্থায়ীভাবে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা সময়ই রাসূলের সন্নিকটে অবস্থান করিতেন এবং রাসূল (স)-এর নিকট হইতে জ্ঞানলাভ করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট ও উন্মুখ হইয়া থকিতেন। নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর তাঁহার সাহাবিগণের অনেকেই মুসলিম জাহানের বিভিন্ন কেন্দ্রে বিছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়েন। এই কারণে হাদীস-সম্পদ সংগ্রহের জন্য বিদেশ সফর ও দেশ-দেশান্তরে আঁতিপাতি করিয়া খুঁজিয়া বেড়াইবার প্রয়োজন দেখা দেয়। সাহাবীদের যুগ হইতে পরবর্তীকালের মুসলিমগণকে এক-একটি হাদীসের জন্য বিদেশ সফরের অপরিসীম কষ্ট ভোগ করিতে হইয়াছে। এই স্থান হাদীস শিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।[********************]
বুখারী শরীফে উল্লেখ করা হইয়াছে, হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসের নিকট হইতে একটি হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে একামাস দূরত্বের পথ অতিক্রম করিয়া গিয়াছিলেন। তিনি সংবাদ জানিতে পারিয়াছিলেন যে, সুদূর সিরিয়ায় অবস্থানকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস (রা) রাসূলে করীমের একটি হাদীস জানেন, যাহা অপর কাহারো নিকট রক্ষিত নাই। সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি উষ্ট্র ক্রয় করিয়া সিরিয়ার পথে রওয়ানা হইয়া যান। একমাস কালের পথ অতিক্রম করিয়া সিরিয়ার গ্রামাঞ্চলের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছিয়া তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইসের সাক্ষাত লাভ করেন। তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ
******************************************************
তোমার নিকট হইতে আমার কাছে একটি হাদীস পৌঁছিয়াছে, যাহা তুমি রাসূলের নিকট হইতে শুনিয়াছ। আমার ভয় হইল যে, তোমার নিজের নিকট হইতে উহা নিজ কর্ণে শ্রবণ করার পূর্বেই হয়ত আমি মরিয়া যাইব (এই ভয়ে আমি অনতিবিলম্বে তোমার নিকট হাযির হইয়াছি)।[********************]
অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস (রা) জিজ্ঞাসিত হাদীসটি মুখস্থ পাঠ করিয়া শোনাইলেন। হাদীসটি নিম্নরূপঃ
******************************************************
আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, আল্লাহ তা’আলা বান্দাদিগকে হাশরের ময়দানে একত্রিত করিবেন এবং তাহাদিগকে এমন এক আওয়াচে সম্বোধন করিবেন, যাহা নিকট ও দূরে অবস্থিত লোকেরা সমানভাবে শুনিতে পাইবে। আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করিবেনঃ আমিই মালিক, আমিই বাদশাহ, আমিই অনুগ্রহকারী।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড- *************************** পৃষ্ঠা ১১১৪। তাযকিরাতুল হুফফায গ্রন্হে এই পর্যায়ে কিসাস সম্পর্কিত একটি হাদীসের উল্লেখ করা হইয়াছে, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩।]
হযরত মুসলিমা ইবনে মাখলাধ (রা) যখন মিসরে অবস্থান করিতেছিলেন, তখন ‘কিসাস’ সম্পর্কিত একটি হাদীস জানিবার জন্য হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বহু কষ্ট স্বীকারপূর্বক তাঁহার নিকট উপস্থিত হন এবং বলেনঃ ‘এই একটি হাদীস শিখিবার ঐকান্তিক আগ্রহ লইয়াই আমি আপনার নিকট আসিয়াছি এবং আমাদের একজনের মৃত্যুর পূর্বে আমি হাদীসটি জানিয়া লইতে চাহি।[********************]
হযরত ফুজলা ইবনে উবাইদ (রা)-এর নিকট মিসরে একজন সাহাবী দূরবর্তী স্থান হইতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। ফুজালা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাইলেন। তিনি বলিলেনঃ আমি আপনার নিকট কেবল সাক্ষাত লাভের উদ্দেশ্যে আসি নাই। আসিয়াছি বিশেষ একটি উদ্দেশ্য লইয়া। আমি ও আপনি একত্রে রাসূলে করীমের নিকট হইতে একটি হাদীস শ্রবণ করিয়াছিলাম, সম্ভবত আপনার তাহা খুব ভালরূপে স্মরণ থাকিবে, আপনার নিকট হইতে তাহা নূতন করিয়া শুনিবার জন্যেই আমি এখানে উপস্থিত হইয়াছি।
অতঃপর ফুজালা প্রার্থিত হাদীসটি পেশ করেন এবং হাদীসটি জানিয়া লইয়া উক্ত সাহাবী নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।[দারেমী, আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমদ, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২।]
হযরত মুয়াবিয়ার শাসন আমলে হযরত আবূ আইয়ূব আনসারী (রা) শুধুমাত্র একটি হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে মদীনা হইতে মিসরের নিভৃত পল্লীতে অবস্থানকারী হযরত আকাবা ইবনে আমের জুহানী (রা)-র নিকট উপস্থিত হন। আকাবা সংবাদ পাইয়া বাহিরে আসিলেন ও হযরত আইয়ূব (রা)-কে বক্ষে জড়াইয়া ধরিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
আবূ আইয়ূব! আপনি কি কারণে এত দূরে (আমার নিকট) আসিয়াছেন? তখন হযরত আবূ আইয়ূব (রা) বলিলেনঃ
******************************************************
মু’মিন ব্যক্তির ‘সতর’ (বিশেষ জিনিস গোপন রাখা) সম্পর্কে একটি হাদীস আম রাসূলের নিকট শুনিয়াছিলাম, কিন্তু এখন তোমার ও আমার ছাড়া উহার শ্রবণকারী আর কেহ দুনিয়ায় বাঁচিয়া নাই। (তাহাই তোমার নিকট হইতে নূতন করিয়া শ্রবণের বাসনা লইয়া আমি এত দূর আসিয়াছি)।
তখন হযরত আকাবা নিম্নলিখিত ভাষায় হাদীসটি বলিলেনঃ
******************************************************
যে ব্যক্তি এই দুনিয়ায় কোন মু’মিন লোকের কোন লজ্জাকর, অপমানকর কাজ গোপন রাখিবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাহার গুনাহকে গোপন (মাফ) করিয়া দিবেন।
হযরত আবূ আইয়ূব বাঞ্চিত হাদীসটি শ্রবণ করিয়া বলিলেনঃ ******************** তুমি ‘ঠিকই বলিয়াছ, সত্যই বলিয়াছ’। অতঃপর তিনি উষ্ট্রযানে সওয়ার হইয়া মদীনার দিকে এমন দ্রুততা সহকারে রওয়ানা হইয়া গেলেন যে, মিসরের তদানীন্তন শাসনকর্তা মুসলিমা ইবনে মাখলাদ তাঁহাকে প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন দেওয়ার আয়োজন করিয়াও তাহা তাঁহাকে দিতে পারিলেন না, সেজন্য তিনি একটু সময়ও বিলম্ব করিতে প্রস্তুত হইলেন না।[বায়হাকী, ইবনে মাজাহ, জামে বায়ানুল ইলম, মুসনাদে আহমদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ******************** আল- হাদীস আল মুহাদ্দীসুন, পৃষ্ঠা ১১০।]
একদা নবী করীম (স) একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তখন দরবারে উপস্থিত হযরত সায়েব ইবনে খাল্লাদ এবং হযরত আকাবা ইবনে আমেরও উহা শ্রবণ করেন। উত্তরকালে হাদীসটি সম্পর্কে হযরত সায়েবের মনে কিছুটা বিস্মৃতি ঘটে, উহার ভাষা সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কিন্তু হাদীস সম্পর্কে একবিন্দু সন্দেহ মনের মধ্যে পোষণ করা কিছুতেই উচিত নয় মনে করিয়া তিনি মিসরে অবস্থানকারী হযরত আকাবার নিকট উপস্থিত হইয়া হাদীসটি শ্রবণ ও স্বীয় ভ্রম ও সন্দেহের অপনোদন করার জন্য উদ্যোগী হইলেন। প্রথমে তিনি মিসরের শাসনকর্তা মুসলিম ইবনে মাখলাদের নিকট উপস্থিত হইলেন। ইবনে মাখলাদ তাঁহাকে অতিথি হিসাবে পাইয়া বিশেষে সন্তুষ্টি সহকারে অভ্যর্থনা জানাইলেন। কিন্তু হযরত সায়েচ বলিলেনঃ আমি কোথাও বিলম্ব ‘করিতে প্রস্তত নহি, অনতিবিলম্বে আকাবার সহিত সাক্ষাত করা আবশ্যক। পরে তিনি আকাবার নিকট উপস্থিত হন এবং রক্ষিত হাদীসের সাহিত উহার তুলনা করিয়া লইলেন। অতঃপর উহার সঠিক সত্যতা ও ও যথার্থতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হইয়া সান্ত্বনা লাভ করিলেন।[********************]
কুরআন মজীদের কোন আয়াতের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য সম্পর্কে সাহাবীদের মধ্যে মতভেদ হইলে বিশেষজ্ঞের নিকট হইতে উহার মীমাংসা লাভ করিবার উদ্দেশ্যেও দূরদেশে সফর করিতেন। হযরত সায়ীদ ইবনে যুবাইর (রা) বলেনঃ
******************************************************
কুরআনের আয়াতঃ ‘যে লোক কোন মু’মিনকে ইচ্ছাপূর্বক হত্যা করিবে, জাহান্নামই তাহার পরিণতি হইবে’- সম্পর্কে কূফাবাসীদের মতভেদ হয়। তাই আমি ইবনে আব্বাসের নিকট চলিয়া গেলাম ও তাঁহাকে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেনঃ ইহা সর্বশেষ নাযিল হওয়া আয়াত । কোন জিনিসই ইহাকে রদ বা বাতিল করিতে পারে নাই।[********************]
হযরত আবুদ-দরদ (রা) বলেনঃ
******************************************************
কুরআনের কোন আয়াত আমার নিকট দুর্বোধ্য হইলে ইহার ব্যাখ্যার জন্য যদি মক্কা হইতে পাঁচ রাত্রি পথ দূরে অবস্থিত এক ব্যক্তির নিকট যাইতে হইতে তবুও আমি তথায় যাইতাম।[********************]
সাহাবায়ে কিরামের একজন দূরবর্তী স্থানে অবস্থানকারী অপর এক সাহাবীর নিকট হইতে পত্রালাপের মাধ্যমেও রাসূলের হাদীস জানিতে ও সংগ্রহ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন।
হযরত মুয়াবিয়া দামেশক হইতে হযরত মুগীরার নিকট কূফা নগরে এক পত্র প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাহাতে লিখিয়াছিলেনঃ
******************************************************
আপনি রাসূলের নিকট যাহা কিছু শুনিতে পাইয়াছেন, তাহা আমাকে লিখিয়া পাঠান।
তখন হযরত মুগীরা লিখিয়া পাঠাইলেনঃ নবী করীম (স) নিম্নোক্ত দোয়া প্রত্যেক নামাযান্তে পড়িতেনঃ
******************************************************
আল্লাহ ছাড়া কেহ মা’বুদ নাই, তিনি এক ও একক। মালিকানা ও বাদশাহী কেবল তাঁহারই, তাঁহারই জন্য সমগ্র প্রশংসা, তিনি সর্বশক্তিমান। হে আল্লাহ ! তুমি যাহা দাও, তাহা কেহ দিতে পারে না। নিছক চেষ্টা করিয়া ইহার বিপরীত কিছু করা সম্ভব নয়। এই সঙ্গে তিনি ইহাও লিখিয়া পাঠাইলেনঃ
******************************************************
নবী করীম (স) অপ্রয়োজনীয় ও অর্থনীন তর্কবিতর্ক করিতে বারবার ও বেশী বেশী প্রশ্ন করিতে ও ধন-সম্পদ বিনষ্ট করিতে নিষেধ করিতেন। তিনি মায়ের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ বা খারাপ ব্যবহার করা এবং কন্যা সন্তানদের গোপনে হত্যা করা হইতেও নিষেধ করিতেন।[এই সমস্ত বিবরণ বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, ১০৮৩ ও ৭ম খণ্ড, ৯৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হইয়াছে।]
খুলাফায়ে রাশেদুন নিজ নিজ খিলাফত আমলে খিলাফতের দায়িত্ব পালন হিসাবে বিভিন্ন স্থানের দায়িত্বশীল লোকদের নিকট প্রয়োজনীয় হাদীস লিখিয়া পাঠাইতেন।
আবূ উসমান বলেনঃ
******************************************************
আমরা উৎবা ইবনে ফারকাদ সেনাপতির সাথে (আজারবাইজান) অবস্থান করিতেছিলাম। তখন হযরত উমর ফারুকের চিঠি আমাদের নিকট (উৎবার নামে) আসিয়া পৌঁছিল। তাহাতে লিখিত ছিলঃ নবী করীম (স) বলিয়াছেন যে, রেশমী কাপড় সেই পুরুষই পড়িতে পারে, যাহার ভাগে পরকালে কিছু নাই।[বুখারী শরীফ, ২ূ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮৬৭। ********************]
সাহাবায়ে কিরাম প্রয়োজনের সময় একজন অপরজনকে নিজ হইতেই রাসূল (স)-এর হাদীস লিখিয়া পাঠাইয়া দিতেন। উমর ইবনে উবায়দুল্লাহ যখন হারুরীয়া গমন করেন, তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা (রা) তাঁহাকে লিখিয়া পাঠানঃ
******************************************************
রাসূলে করীম (স) তাঁহার জীবনে কোন একদিন শক্রদলের সহিত মুকাবিলা হওয়ার অপেক্ষায় উদগ্রীব হইয়া বসিয়াছিলেন। শেষ পর্যন্ত সূর্য যখন ঢলিয়া পড়িল, তখন তিনি সংগের লোকদের সম্মুখে দণ্ডয়মান হইলেন। বলিলেনঃ হে লোকগণ ! তোমরা শক্রর সাথে মুকাবিলা ও সাক্ষাতের কামনা করিও না, বরং আল্লাহর নিকট শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া কর। তাহার পরও শক্রর সহিত সাক্ষাত ঘটিলে অপরিসীম ধৈর্য সহকারে সংগ্রাম চালাইয়া যাও। জানিয়া রাখিও, ‘বেহেশত তলোয়ারের ছায়ার তলে অবস্থিত। অতঃপর নবী করীম (স) দাঁড়াইয়া নিম্নোক্ত দোয়া করিলেনঃ
হে আল্লাহ ! কিতাব নাযিলকারী, মেঘ পরিচালনাকারী, শক্র বাহিনীকে পরাজয়দানকারী! তুমি তাহাদিগকে পরাজিত ও পর্যুদস্ত কর এবং আমাদিগকে তাহাদের উপর জয়ী করিয়া দাও।[মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, ******************** পৃষ্ঠা ৮৪।]
সাহাবায়ে কিরাম (রা) একজন অপরজনের নিকট হইতে হাদীস জিজ্ঞাসা করিয়া উহার সত্যতা যাচাই করিয়া লইতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) একবার হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় আগমন করেন। তখন তাঁহার নিকট হইতে আয়েশা (রা)-র নিকট পৌঁছায়। পরের বারে হযরত আবদুল্লাহ আবার যখন হজ্জ করিতে আসেন, তখন হযরত আয়েশা (রা) তাঁহার বোন-পুত্র উরওয়াকে বলিলেনঃ
******************************************************
হে বোন-পুত্র! তুমি আবদুল্লাহর নিকট চলিয়া যাও এবং আমার নিকট তুমি তাঁহার নিকট হইতে যে বর্ণনা করিয়াছিলে, আমার জন্য উহা সত্যতা যাচাই করিয়া আস।
উরওয়া বলেন, আমি হযরত আবদুল্লাহর নিকট উপস্থিত হইয়া সেই হাদীসটি পুনরায় শুনিবার ইচ্ছা প্রকাশ করি। তিনি উক্ত হাদীসটি বিগত বৎসর যেইভাবে বর্ণনা করিয়াছিলেন, এইবারও ঠিক সেইরূপেই বর্ণনা করিলেন। আমি হযরত আয়েশার নিকট আসিয়া উহা প্রকাশ করিলে তিনি খুবই আশ্চর্যান্বিত হইয়া যান এবং বলেনঃ
******************************************************
আল্লাহর কসম আবদুল্লাহ ইবনে আমর সঠিকরূপে স্মরণ করিয়া রাখিয়াছেন।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৮৬।]
সাহাবায়ে কিরাম যে হাদীসের জন্য বিদেশ সফর করিতনে এবং উহা শিক্ষালাভ করার জন্য বহু কষ্ট স্বীকার ও তিতিক্ষা অবলম্বন করিতেন, তাহা হযরত ইবনে আব্বাসের নিম্নোক্ত উত্তি হইতেও সুস্পষ্টরূপে জানা যায়। তিনি বলেনঃ
******************************************************
আমাদের নিকট যখন অপর কোন ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস পৌঁছিত, তখন যদি তাহার নিকট লোক পাঠাইয়া তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইতে চাহিতাম যে সে আসিয়া আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করিবে, তবে তাহা আমি অনায়াসেই করিতে পারিতাম। কিন্তু তাহা না করিয়া আমি নিজেই তাঁহার নিকট যাইতাম ও তাঁহার ঘরের সম্মুখে শুইয়া পড়িতাম। সে যখন ঘর হইতে বাহির হইত, তখন সে আমার নিকট উক্ত হাদীস বর্ণনা করিত।[********************]
ইহা হইতে জানা যায় যে, সাহাবায়ে কিরাম (রা) অপর কোন সাহাবীর বর্ণিত হাদীস লোকমুখে শুনিয়াই সন্তুষ্ট হইতেন না ও সঙ্গে সঙ্গেই উহা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করিয়া লইতেন না। বরং উহা সরাসরি মূল হাদীস বর্ণনাকারীর নিকট হইতেই শ্রবণ করিবার জন্য চেষ্টা করিতেন। এইজন্য তাঁহারা বর্ণনাকারীর ঘরের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইতেন। কিন্তু তাঁহাকে ঘর হইতে ডাকিয়া বাহিরে আনা পছন্দ করিতেন না, বরং তিনি কখন নিজে ঘর হইতে বাহির হইবেন, সেইজন্য অপেক্ষা করিতেন। এই প্রতীক্ষা কত দীর্ঘ হইত তাহার অনুমান ইহা হইতে করা যায় যে, অপেক্ষমান লোকেরা প্রতীক্ষায় থাকিয়া থাকিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িতেন ও ঘরের সম্মুখে ক্লান্ত-শ্রান্ত হইয়া শুইয়া পড়িতেন। হাদীস সঠিকরূপে লাভ করার উদ্দেশ্যে সাহাবায়ে কিরামরে এই তিতিক্ষা সত্যই বিস্ময়কর।
(খ)
তাবেয়ীদের যুগ
সাহাবীদের যুগে হাদীস সংগ্রহ অভিযানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপরে পেশ করা ইহল। এই যুগে হাদীস সংগ্রহ পর্যায়ের যত কাজই সম্পাদিত হয়, উপরিউক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা হইতে সে সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা অতি সহজেই করা যাইতে পারে। এক কথায় বলা যায় সাহাবীদের যুগে হাদীস সংগ্রহ অভিযান কেবল আরম্ভ করা হইয়াছে, তাবেয়ীদের যুগে এই কাজ অধিকতর উন্নত ও ব্যাপক ভিত্তিতে সাধিত হয়। বিশেষত, তাবেয়ী যুগের হাদীস বর্ণনাকারিগণ কেবল একজনের নিকট কিংবা নিজ শহরে অবস্থানকারী সাহাবীদের নিকট হাদীস শুনিয়াই ক্ষান্ত হইতেন না। এইজন্য তাঁহারা নিকট ও দূরে অবস্থিত বহু শহর-নগর-গ্রম সফর করিতে বাধ্য হইয়াছেণ। ইহাতে তাঁহারা একই হাদীস বহু সংখ্যক মূল বর্ণনাকারীর নিকট হইতে শুনিবার এবং বহু বর্ণনাকারীর নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস শুনিবার ও সংগ্রহ করিবার সুযোগ পাইয়াছেন। ইহার ফলে তাঁহাদের মনে হাদীসের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিত।[********************]
নিম্নে প্রদত্ত বিবরণ হইতে এই যুগের কাজ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইংগিত পাওয়া যাইতে পারে।
সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যিব বলেনঃ
******************************************************
কেবল একটি হাদীস লাভ করার উদ্দেশ্যে আমি একাদিক্রমে কয়েকদিন ও কয়েক রাত্রের পথ সফর করিতাম।[********************]
কূফা নগরে অবস্থানরত শ’বী তাবেয়ী একবার সন্তান ও দাস-দাসীকে ইলম শিক্ষাদান ও চরিত্রবান করিয়া তোলার সওয়াব সম্পর্কে এক দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেন। হাদীসটির বর্ণনা শেষ করিয়া তাঁহার ছাত্রদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেনঃ
******************************************************
এই হাদীসটি ভালভাবে গ্রহণ কর, ইহার বিনিময়ে তোমাদের কিছুই দিতে হইবে না, (কোন কষ্ট স্বীকার করিতে হইল না)। যদিও এমন এক সময় ছিল, যখন এক এক ব্যক্তিকে এতদপেক্ষাও অল্প কথার জন্য (ফা হইতে) মদীনা পর্যন্ত সফর করিতে হইত।[******************** মূল হাদীসটি বুখারীর ১ম খণ্ড কিতাবুল ইলম-এ উদ্ধৃত হইয়াছে।]
বুসর ইবনে আবদুল্লাহ হযরামী বলেনঃ
******************************************************
একটি হাদীসের জন্য বিভিন্ন শহর ঘুরিয়া বেড়াইবার প্রয়োজন হইলেও আমরা তাহাই করিতাম।[********************]
এখানে কয়েকজন প্রসিদ্ধ তাবেয়ীর হাদীস সংগ্রহ সাধনার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা যাইতেছেঃ
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী উবায়দুল্লাহ ইবনে আদী জানিতে পারিলেন যে, হযরত আলী (রা)-এর নিকট এমন একটি হাদীস রহিয়াছে, যাহা তিনি নিজে আজ পর্যন্ত খোঁজ করিয়া কোথাও কাহারো নিকট হইতে জানিতে পারেন নাই। তখন তিনি চিন্তা করিলেন যে, অনতিবিলম্বে তাহা জানিয়া না লইলে ও সাধারণ্যে প্রচার না করিলে ইহা হইতে গোটা উম্মতের বঞ্চিত হইয়া যাওয়ার আশংকা রহিয়াছে। এইজন্য তিনি অতি সত্ত্বর হযতর আলী (রা)-এর সহিত সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে ইরাক যাত্রা করিলেন।[********************]
কাসীর ইবনে কায়াস তাবেয়ী বলেনঃ আমরা হযরত আবূদদারদা (রা)-এর সহিত দামেশকের জামে মসজিদে বসিয়াছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি তাঁহার সম্মখে উপস্থিত হইয়া বলিলেনঃ হে আবূদদারদা! আমি শুনিয়াছি, আপনি রাসূলের সূত্রে বিশেষ একটি হাদীস বর্ণনা করিয়া থাকেন। আম মদীনা শরীফ হইতে কেবল সেই হাদীটি শ্রবণের উদ্দেশ্যে এই দূর পথ সফর করিয়া আসিয়াছি। হযরত আবূদদারদা (রা) তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ আপনি অন্য কোন উদ্দেশ্যে, কোন ব্যবসায়-বাণিজ্যের কাজের জন্য এখানে আসেন নাই তো? বহিরাগত লোকটি বলিলেন, না অন্য কোন উদ্দেশ্যেই আমার এই আগমন হয় নাই। তখন হযরত আবূদদারদা (রা) নিম্নলিখিত হাদীসটি তাঁহার নিকট বর্ণনা করেনঃ
******************************************************
আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, যে ব্যক্তি ইলমের সন্ধানে কোন পথ চলিবে, আল্লাহ তাহার জন্য বেহেশতের অসংখ্য পথের কোন একটি পথ সুগম ও সহজতর করিয়া দিবেন। বস্তুত ফেরেশতাগণ জ্ঞানানুসন্ধানীর সন্তুষ্টির জন্য তাঁহাদের পক্ষ বিছাইয়া দেন এবং জ্ঞান-সন্ধানীর জন্য আসমান যমীনের সবকিছু- এমন কি পানির তলার মাছও আল্লাহর নিকট গুনাহ মাফের দোয়া করিয়া থাকে। পরন্তু আবিদ অপেক্ষা আলিমের মর্যাদা এত বেশী, যেমন চন্দ্রের প্রাধান্য সমগ্র নক্ষত্রের উপর। আলিমদের মধ্যে হইতেই নবীদের উত্তরাধিকারী হইয়া থাকেন। নবীগণ কখনো টাকা-পয়সা মিরাসী সম্পদ হিসাবে রাখিয়া যান না। তাঁহারা কেবল ইলম ও জ্ঞানই রাখিয়া যান। অতএব যে তাহা গ্রহণ করিবেন। সে তাহার অংশ লাভ করিবে কিংবা (বলিয়াছেন) সে পূর্ণ ও বিপূল অংশ পাইবে।[হাদীসটি মুসনাদে আহমদ, আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ প্রভৃতি সহীহ গ্রন্হে উল্লিখিত হইয়াছে। যদিও উহাদের শব্দ ও ভাষায় পারস্পরিক পার্থক্য রহিয়াছে। এখানে সুনানে দারেমীর বর্ণিত ভাষা উদ্ধৃত করা হইয়াছে।]
বসর ইবনে উবায়দুল্লাহর একটি কথা এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেনঃ ‘আমি কেবল একটি হাদীসের জন্য অসংখ্য শহর ও নগর আতিঁপাতি করিয়া খুঁজিয়া বেড়াইয়াছি।[দারেমী পৃষ্ঠা ৭৪।]
আবূল আলীয়া তবেয়ী বলেনঃ
******************************************************
আমরা (বসরায় থাকিয়া) মদীনায় অবস্থিত সাহাবীদের বর্ণিত হাদীস (লোক মারফত) শুনিতে পাইতাম; কিন্তু মদীনায় অব্স্থানকারী হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর নিজ মুখে উহা শুনিয়া লওয়ার পূর্বে আমরা কিছুতেই সান্তনা পাইতাম না (এবং অপরের নিকট তাহা বর্ণনা ও করিতাম না)।[দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৪।]
আবূ কালাবা (আবদুল্লাহ ইবনে যায়দ আল জুরামী আল বসরী) বলেনঃ
******************************************************
আমি মদীনায় তিন (দিন বা মাস বা বৎসর) অবস্থান করিয়াছি কেবল এই অপেক্ষায় যে, একজন লোকের নিকট একটি হাদীস রহিয়াছে। সে আসিবে ও তাহার নিকট হইতে আমি তাহা শুনিব।[********************]
তাবেয়ী মুহাদ্দিস মকহুল (আবূ আবদুল্লাহ ইবনে আবূ মুসলিম) একটি হাদীসের জন্য মিসর হইতে হিজাজ, হিজাজ হইতে ইরাক, ইরাক হইতে সিরিয়া সফর করেন এব সেখানেই তিনি প্রার্থীত হাদীসটি শুনিতে পান।[********************]
মোটকথা, তাবেয়ী যুগের হাদীস-সন্ধানীদের সাধনা, পারস্পরিক সাক্ষাত ও হাদীস সংগ্রহের জন্য অবিশ্রান্ত দেশ ভ্রমণের ফলে বিপুল সংখ্যক হাদীসের প্রচার ও প্রসার লাভ সম্ভব হয়। সাহাবাগণ মুসলিম জাহানের বিভিন্ন শহরে ও বিভিন্ন স্থানের বিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন, তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে থাকিয়া হাদীসের প্রচার ও শিক্ষাদান করিতেন। তাঁহাদেরই ছাত্র তাবেয়িগন হাদীস সংগ্রহর উদ্দেশ্যে শঞর হইতে শহরান্তরে, দেশ হইতে দেশান্তরে যাতায়াত করিতেন এবং বিভিন্ন সাহাবীর নিকট হইতে বিভিন্ন হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিতেন; কিংবা একই হাদীস বিভিন্ন সাহাবীর নিকট হইতে শ্রবণ করিতেন। ফলে হাদীস সম্পদ সামগ্রিকভাবে বিরাট ও বিপুল আকার ধারণ করে।
দৃষ্টান্তরূপে বলা যায়, হযরত আমর ইবনুল আস (রা) মিসরে অবস্থান করিতেন এবং সেখানকার লোকদের নিকটই তিনি রাসূলের কথা, কাজও সমর্থনের বিবরণ পেশ করিতেন। রাসূলে করীম ও খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলের আদালতী বিচার ফয়সালা সমূহের বর্ণনা করিতেন। ফলে ইসলামী জ্ঞানের এই সব অমূল্য সম্পদ কেবল স্থানীয় লোকগণই লাভ করিতে পারিতেন। কিন্তু তাবেয়ী যুগে যখন মিসরের এই লোকগণই দামেখক, কূফা, বসরা, মদীনা ও অন্যান্য হাদীসকেন্দ্র ও সাহাবীদের আবাসস্থালে পৌঁছিয়া হাদীস সংগ্রহ করিতে শুরু করিলেন, তখন তাঁহাদের হাদীস-জ্ঞান অত্যন্ত ব্যাপক ও প্রশস্ত হইয়া পড়ে। যেসব তাবেয়ী পূর্বে একটি হাদীস কেবল একই সাহাবীর সূত্রে বর্ণনা করিতেন, এক্ষণে তাহাই তাঁহারা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করিতে সক্ষম হন। ইলমে হাদীসের দৃষ্টিতে তাবেয়ীদের এই দেশ-বিদেশ ভ্রমণের পর্যালোচনা করিলে ইহার গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। বস্তুত তাবেয়ীদের যুগে এই হাদীস-সংগ্রহ অভিযান সম্পাদিত না হইলে বহু হাদীসই যে বিস্মৃতির অতল গভীরে বিলুপ্ত হইয়া যাইত এবং সাধারণের জ্ঞান পরিধির বাহিরেই পড়িয়া থাকিত তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই।
প্রসংগত উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, তাবেয়ীদের এই হাদীস সংগ্রহ অভিযানের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হইয়াছে পরবর্তীকালের হাদীসগ্রন্হ সংকলনের উপর। কেননা, যেসব হাদীস গ্রন্হ সংকলক কেবল নিজ শহরে প্রচারিত হাদীসেরই সংকলন করিয়াছেন, অন্যান্য হাদীসকেন্দ্রে গমন করিয়া- দেশ-দেশান্তর ভ্রমণ করিয়া হাদীস সংগ্রহ করেন নাই, তাঁহাদের সংকলনের কোনই মূল্য জনসমাজে স্বীকৃত হয় নাই। উপরন্তু তাঁহাদিগকে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
সে প্রকৃত হিদায়াতের পথ-ভ্রান্ত এবং হিদায়ত ও সত্যতার পথের যৌক্তিকতা প্রমাণে সে ব্যর্থ-অসমর্থ।[********************]
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইয়াইয়া ইবনে মুয়ীন বলিয়াছেনঃ
******************************************************
চারজন লোকের নিকট হইতে প্রকৃত হিদায়াতের আশা করা যায় না। তাহারা হইলঃ সূক্ষ্ণ শিল্প দক্ষতার পাহারাদার, বিচারকের ঘোষণাকারী, বিদয়াতীর পুত্র এবং যে ব্যক্তি হাদীসের সন্ধানে বিদেশ সফর করেন না, কেবল নিজ শহরে পাওয়া হাদীসই সংকলন করে।[********************]
অথচ ঐ যুগের যানবাহন ও যাতায়াত পথ ছিল অত্যন্ত দুষ্কর, দূরধিগম্য এবং বিপদসংকুল। অশ্ব কিংবা উষ্ট্রের পৃষ্ঠা আরোহণ করিয়া তাঁহাদিকে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি পর্বতসংকুল ও দূরধিগম্য অরণ্য পথ অতিক্রম করিতে হইত এবং তাঁহাদের এই ভ্রমন চলিত রাতের পর রাত, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর ধরিয়া। এই পরিশ্রম যে কতদূর কষ্টসাধ্য ছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এই কষ্ট ও দুঃখ তাঁহাদের নিকট চিল একান্তই নগণ্য। এতদূর অমানুষিক কষ্ট স্বীকার করার পর তাঁহারা যে হাদীস সম্পদ লাভ করিতেন, তাহাই তাঁহাদের হৃদয়ে নির্মল আনন্দের বন্যা প্রবাহিত করিয়া দিত, আর তাঁহাদের জীবন ইহাতেই সার্থক ও সাফল্যমণ্ডিত হইত। প্রকৃতপক্ষে ইহা ছিল বিশ্ব মুসলিমের প্রতি তাঁহাদের এক অপূর্ব কল্যাণময় অবদান। বিশ্বের মুসলমান তাঁহাদের এই অবদান কোনদিনই বিস্মৃত হইতে পারে না।
(গ)
তাবে-তাবেয়ীদের যুগ
তাবেয়ী যুগে হাদীস সংগ্রহের যে অভিযান আরম্ভ হয়, তাহা পরবর্তী দুই-তিন শতাব্দী পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে চলিতে থাকে। তাবে-তাবেয়ীনের যুগে ইহার প্রয়োজন যেমন কিছুমাত্র হ্রাস পায় নাই, তেমনি এই অভিযান কিছু মাত্র ক্ষীণ ও ব্যাহতও হয় নাই। বরং আমরা দেখিতে পাই, তাবে-তাবেয়ীনের পর্যায়ে এই অভিযান পূর্বপেক্ষাও ব্যাপকতর রূপ লাভ করে। তাবেয়ীনের পর তাঁহাদেরই লালিত ও তৈরী করা তাবে-তাবেয়ীদের জামাআত এই মহন ব্রত পূর্ণ মাত্রায় নিজেদের স্কন্ধে গ্রহণ করেন এবং নিজেদের সময়ের অবস্থা ও প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া এই কঠিন দয়িত্ব পালনে ব্রতী হন। এই পথে পূর্ববর্তীদের ন্যায় তাঁহাদেরও অপরিসীম দুঃখ ও কষ্ট স্বীকার করিতে হইয়াছে।
তাবে-তাবেয়ীনের যুগে সন-তারিখের দৃষ্টিতে নির্ধারণ করা কঠিন, যেমন কঠিন তাবেয়ীনের যুগ নির্ধারণ। ঠিক কখন, কত সনে তাঁহাদের যুগের সূচনা এবং কবে তাহার সমাপ্তি, তাহা সুস্পষ্ট করিয়া বলা বাস্তবিকই সম্ভব নয়। কোন কোন ঘটনা ও নিদর্শনের আলোকে বলা যায় যে, নবী করীম (স)-এর যুগেই তাবেয়ীনের যুগ সূচিত হইয়াছিল। কেননা এই যুগে এমন কিছু মহান লোকের সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁহারা নিজেদের চক্ষে রাসূলে করীমের চেহারা মুবারক দর্শন করিতে না পারিলেও ইসলামের দাওয়াত যখনই তাঁহাদের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছে, তখনই তাঁহারা অকৃত্রিম আন্তরিকতা সহকারে তাহা কবুল করিয়াছেন। ওয়ায়েস করনী ও আবিসিনিয়ার বাদশাহ আসহামার নাম এই পর্যায়ে উল্লেখ করা যায়। ফলে একথা বলা যায় যে, প্রায় এক শতাব্দী কাল পর্যন্ত সাহাবাদের যুগ ও তাবেয়ীদের যুগ একই সঙ্গে পাশাপাশি অতিবাহিত হইয়াছে। কিন্তু প্রথম হিজরী শতকের সমাপ্তিতে এই যুগেরও সমাপ্তি হইয়া যায়। তখন তখনই তাবেয়ীদের লালিত, দীক্ষিত ও তৈরী করা লোকদের অর্থাৎ তাবে-তাবেয়ীনের যুগ আরম্ভ হইয়া যায়। কিন্তু তাবেয়ীনের যুগ তখনও শেষ হইয়া যায় নাই। বরং তাবে-তাবেয়ীনের যুগের সঙ্গে সঙ্গে তাহাও চলিতে থাকে এবং প্রায় তিন-চতুর্থাংশ শতাব্দীকাল পর্যন্ত একই সঙ্গে অতিবাহিত হইতে থাকে।
অনুরূপভাবে তাবে-তাবেয়ীনের যুগ ঠিক কখন শুরু হইল এবং কখন শেষ হইয়া গেল, সন-তারিখের ভিত্তিতে তাহা বলা কঠিন। কিন্তু কোন কোন তাবে-তাবেয়ীর জন্ম তারিখ ও কোন কোন তাবেয়ীর মৃত্যু সনের ভিত্তিতে বলা যায় যে, প্রথম হিজরী শতকের শেষভাগ হইতেই এই যুগের সূচনা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ইমাম শো’বা’র জন্ম হয় ৮০ হিজরী সনে, ইমাম আবূ হানীফাও এই সনেই জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু সকল জীবনী রচয়িতাই ইমাম শো’বাকে তাবে-তাবেয়ীন ও ইমাম আবূ হানীফাকে তাবেয়ীনের মধ্যে গণ্য করিয়া থাকেন। এতদসত্ত্বেও প্রকৃত কথা এই যে, তাবে-তাবেয়ীনের আসল যুগ দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম চতুর্থাংশে সূচিত হইয়া তৃতীয় শতকের প্রথম চতুর্থাংশ পর্যন্ত শেষ হইয়া যায়। কেননা অনেক তাবেয়ী’ই ১৬৪ হিজরী হইতে ১৭৪ সনে ইন্তেকাল করেন। অন্য কথায় বলা যায়, উমাইয়া বংশের খলীফা দ্বিতীয় ওলীদের সময় হইতে আব্বাসী বংশের দশম খলীফা মুতাওয়াক্কিলের সময় পর্যন্ত তাবে-তাবেয়ীনের যুগ বর্তমান ছিল।
পূর্বেই বলিয়াছি, এই যুগের হাদীসের চর্চা, প্রচার ও সংগ্রহ পূর্বাপেক্ষাও অধিক ব্যাপক ও গভীরভাবে চলে। এই যুগে যাঁহারা ইলমে হাদীসে সর্বাধিক বুৎপত্তি এবং খ্যাতি অর্জন করেন, তাঁহাদের মধ্যে নিম্নোক্ত লোকগণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ
(১) ইমাম আবূ হানীফা (২) ইমাম মালিক (৩) ইমাম আবূ ইউসুফ (৪) ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী (৫) ইমাম আওযায়ী (৬) ইমাম ইবনে জুরাইজ (৭) ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় (৮) ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (৯) আবদুল্লাহ ইবেন মুবারক (১০) ইমাম শু’বা (১১) মুসয়ের ইবনে কুদাম (১২) আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব (১৩) ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (১৪) আলী ইবনে মাদানী (১৫) ইমাম লাইস ইবনে সায়াদ (১৬) হযরত ফুযাইল ইবনে আয়াজ এবং (১৭) ইয়াহইয়া ইবনে আদাম (র)।
আমরা এখানে তাঁহাদের মধ্যে প্রধান কয়েকজনের হাদীস সাধনা ও সংগ্রহ অভিযান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করিব।
ইমাম আবূ হানীফা (র)
ইমাম আবূ হানীফা (র) তাবেয়ী ছিলেন, কি তাবে-তাবেয়ী তাহা লইয়া যথেষ্ট মতভেদের সৃষ্টি হইয়াছে। ইমাম আবূ হানীফা যেহেতু কোন সাহাবী হইতেই হাদীস বর্ণনা করেন নাই- বর্ণনা করিয়াছেন বলিয়া যে সব হাদীসের কথা কোন কোন মহল হইতে প্রচার করা হইয়াছে তাহা যেহেতু অপ্রমাণিত এবং ইলমে হাদীসের কষ্টিপাথরে তাহা অনুত্তীর্ণ- এই কারণে কোন কোন ঐতিহাসিক তাঁহাকে ‘তাবেয়ী’ মানিয়া লইতেও অস্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু অকাট্য ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে একথা জোর করিয়া বলা যায় যে, ইমাম আবূ হানীফা (র) সাহাবাদের দর্শন লাভ করিয়াছেন। কেননা ইমাম আবূ হানিফা ৮০ হিজরী সনে কূফা নগরে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। [********************] এই সময় তথায় রাসূলের সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা (রা) জীবিত ছিলেন। তিনি ৮১ হিজরী কিংবা উহার পরে ইন্তেকাল করেন। ইবনে আবদুল বার-এর বর্ণনাতে তিনি ইন্তেকাল করিয়াছেন ৮৭ হিজরী সনে। [********************] ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদ লিখিয়াছেনঃ ইমাম আবূ হানীফা (র) হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা)-কে দেখিয়াছেন। কেননা তিনি বসরা নগরে ৯১ হিজরী সনে, আর ইবনে আবদুল বার-এর মতে ৯৯ হিজরী সনে ইন্তেকাল করিয়াছেন।[********************]
এতদ্ব্যতীত হযরত সহল ইবনে সায়াদ সায়েদী মদীনায় এবং হযরত আবুত্তোফাইল, আমের ইবনে ওয়াসিল মক্কানগরে বসবার করিতেছিলেন। সুতরাং ইমাম আবূ হানীফার পক্ষে কোন সাহাবীর দর্শন লাভ করা অসম্ভব বলা যায় না।[********************]
মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা লেখক আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী প্রদত্ত ফতোয়ার ভিত্তিতে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা (র) সাহাবাদের এক জামাআতকে দেখিতে পাইয়াছেন, যাঁহারা কূফা নগরে থাকিতেন, যখন তিনি ৮০ হিজরী সনে তথায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তাহার সহযোগী সিরিয়ার আওযায়ী, বসরার হাম্মাদ ইবনে সালমা ও হাম্মাদ ইবনে যায়দ, কূফার সুফিয়ান সওরী, মদীনার মালিক এবং মিসরের লাইস ইবনে সায়াদ প্রমুখ ইমাম এই মর্যাদা লাভ করেন নাই। (তাঁহাদের কেহই তাবেয়ী নহেন)।[********************]
ইবনে হাজার মক্কী মিশকাতের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আ’জম আবূ হানীফা আটজন সাহাবীর সাক্ষাত পাইয়াছেন। তন্মধ্যে হযরত আনাস ইবনে মালিক, আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা, সহল ইবনে সায়াদ এবং আবূত্তোফাইল (রা) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[********************]
আল্লামা আলাউদ্দীন ‘দূররুল মুখতার’ গ্রন্হের ভূমিকায় লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
বয়সের হিসাবে তিনি প্রায় বিশজন সাহাবীকে পাইয়াছেন।[********************]
‘মুনিয়াতুল মুফতী’ গ্রন্হর উদ্ধৃতি দিয়া তিনি আরো লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা সাতজন সাহাবীর নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন ইহা প্রমাণিত সত্য।[********************]
এই সব উদ্ধৃতির ভিত্তিতে বলা যায়, ইমাম আবূ হানীফা (র) তাবেয়ী ছিলেন।
আল্লামা ইবনে আবেদীন লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
সবদিকেরই বিচারে ইমাম আবূ হানীফা তাবেয়ী ছিলেন। মুহাদ্দিস যাহবী ও মুহাদ্দিস আসকালানী ইহা দৃঢ়তা সহকারেই ঘোষণা করিয়াছিলেন।[********************]
অবশ্য একালের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা শাহ আনওয়ার কাশ্মীরী (র) ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি সাক্ষাত লাভের দিক দিয়া তাবেয়ী ছিলেন এবং তাবে-তাবেয়ীন ছিলেন হাদীস বর্ণনার দিক দিয়া।[********************]
ইমাম আবূ হানীফা যখন হাদীস শিক্ষার জন্য উদ্যোগী হন, তখন সমগ্র মুসলিম জাহান হাদীস চর্চায় মুখরিত ছিল। প্রত্যেক শহর ও জনপদে হাদীস বর্ণনার বড় বড় দরবার কায়েম হইয়াছিল। প্রায় দশ হাজার সাহাবী সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন এবং তাঁহাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কয়েক লক্ষ পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল। যেসব শহরে সাহাবী কিংবা তাবেয়ী অবস্থান করিতেন, উহাকে ‘দারুল-উলুম’ (বিদ্যালয়) বলিয়া অভিহিত করা হইত।[********************]
এই সময় ইমাম আবূ হানীফা (র) প্রথমে কূফা নগরে বড় তাবেয়ী হাদীসবিদদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করেন। ইমাম শাফেয়ী লিখিয়াছেনঃ ‘ইমাম আবূ হানীফা কূফা নগরের ৯৩ জন মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিখিয়াছেন। আর ইমাম যাহরীর বর্ণনা হইতে জানা যায় যে, কুফা নগরে ইমাম আবূ হানীফার হাদীসের ওস্তাদ ছিলেন ২৯ জন। তাঁহাদের অধিকাংশই ছিলেন বড় বড় তাবেয়ী। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম শা’বী, সালমা ইবনে কুহাইল, মুহারিব ইবনে দিসার, আবূ ইসহাক সাবয়ী, আওন ইবনে আবদুল্লাহ, সামাক ইবনে হারব, আমর ইবনে মুবরা, মনসুর ইবনে মা’মর, আ’মশ ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মদ, আদী ইবনে মারসাদ প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহাদের নিকট হইতে ইমাম আবূ হানীফা (র) বিপুল সংখ্যক হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন।
অতঃপর তিনি আরো হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বসরা গমন করেন। এই সময় ইমাম হাসান বসরী, শু’বা, কাতাদাহ প্রমুখ বড় বড় তাবেয়ী মুহাদ্দিসের প্রচারিত হাদীসের জ্ঞানে বসরা নগরী কানায় কানায় ভরপুর ছিল।
ইহার পর তিনি মক্কা ও মদীনা গমন করেন। এখানে তখন হাদীসের শিক্ষা ব্যাপকভাবে চলিতেছিল। সাহাবীদের সংস্পর্শে ও লক্ষ্য-যত্নে লালিত ও শিক্ষাপ্রাপ্ত কয়েকজন বড় বড় তাবেয়ী স্বতন্ত্রভাবে বহু সংখ্যক হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করিয়াছিলেন। আতা ইবনে আবূ রিবাহ ও ইকারামা প্রমুখ তাহাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনীষী। এই পর্যায়ে মুহাদ্দিস যাহবী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা মক্কা শরীফে আতা ইবনে আবূ রিবাহ’র নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও শিক্ষা করেন।[********************]
মদীনায় ইমাম বাকের তখন অবস্থান করিতেছিলেন। ইমাম আবূ হানীফা (র) তাঁহার দারবারেও কেবল হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যেই উপস্থিত হইয়াছিলেন।
মোটকথা ইমাম আবূ হানীফা (র) তদানীন্তন বিশাল মুসলিম জাহানের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত হাদীস-কেন্দ্রসমূহের সর্বমোট প্রায় চার সহস্র মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছেন, আবূ হাফস কবীর এই কথা দাবি করিয়াছেন। ইলমে হাদীসের কষ্টিপাথরে তাঁহার এই দাবি উত্তীর্ণ ও সম্পূর্ণ নির্ভূল প্রমাণিত না হইলেও একথা জোর করিয়াই বলা যায় যে, তাঁহার হাদীস শিক্ষার ওস্তাদের সংখ্যা ছিল বিপুল। ‘তাযকিরাতুল হুফফায’ গ্রন্হে ইমাম যাহবী ইমাম আবূ হানীফার ওস্তাদের নাম উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ত্রতদ্ব্যতীত আরো বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দীসই তাঁহার ওস্তাদ ছিলেন।
হাফেয মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ সালেহী শাফেয়ী বলেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা হাদীসের বড় বড় হাফেয ও গুরুদের মদ্যে গণ্য। তিনি যদি হাদীসের প্রতি খুব বেশী মনোযোগী না হইতেন ও ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন না হইতেন, তাহা হইলে ফিকাহর মাসালা মাসায়েল বাহির করা তাঁহার পক্ষে কখনই সম্ভব হইত না।[********************]
শায়খুল ইসলাম ইয়াজীদ ইবনে হারুন বলেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ হানীফা অত্যন্ত মুত্তাকী, পবিত্র-পরিচ্ছন্ন গুণসম্পন্ন সাধক, আলিম, সত্যবাদী ও সমসাময়িককালের সকলের অপেক্ষা হাদীসের বড় হাফেয ছিলেন।[********************এই গ্রন্হের পাণ্ডুলিপি করাচী ‘মজলিসে ইলমী’ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।]
ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতান বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আল্লাহর শপথ, আবূ হানীফা বর্তমান মুসলিম উম্মতের মধ্যে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীস ও সুন্নত সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বেশী বিজ্ঞ ও জ্ঞানী।[********************]
মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীনকে যখনই ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হইত, তখনই তিনি বলিতেনঃ
******************************************************
তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, ভূল-ভ্রান্তিমূক্ত। হাদীসের ব্যপারে কেহ তাঁহাকে ‘দুর্বল’ বা অগ্রহণযোগ্য বলিয়াছেন বলিয়া আমি শুনি নাই।[********************]
তিনি আরো বলিতেনঃ
******************************************************
আবূ হানীফা দ্বীনদার, বিশ্বস্ত , সত্যবাদী ও নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ছিলেন। কেহ তাঁহাকে মিথ্যা বর্ণনা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন নাই। তিনি আল্লাহর দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন এবং হাদীস বর্ণনায় পূর্ণ সত্যবাদী ছিলেন।[********************]
বলখের ইমাম ইবনে আইয়ূব সত্যই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
প্রকৃত ইলম আল্লাহর নিকট হইতে মুহাম্মদ (স)-এর নিকট পৌঁছিয়াছে। তাঁহার পর তাঁহার সাহাবিগণ উহা লাভ করিয়াছেন। সাহাবীদের নিকট হইতে পাইয়াছেন তাবেয়িগণ। আর তাবেয়িগণের নিকট হইতে উহা কেন্দ্রীভূত ও পরিণত হইয়াছে ইমাম আবূ হানীফাতে।[********************]
হাফেয আবূ নয়ীম ইসফাহানী ইয়াহইয়া ইবনে নসর ইবনে হাজেব- এর সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি আবূ হানীফার নিকট একটা ঘরে উপস্থিত হইলাম, যাহা কিতাবে ভর্তি হইয়াছিল। জিজ্ঞাসা করিলামঃ এই কিতাবগুলি কিসের? বলিলেনঃ এই সবই হাদীসের কিতাব। ইহার সামান্য অংশই আমি বর্ণনা করিয়াছি মাত্র, যাহা হইতে লোকেরা যথেষ্ট উপকৃত হইতেছে।[********************]
ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীনের আর একটি কথাও উল্লেখযোগ্য। বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আবূ হানিফা খুবই নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি নিজের মুখস্থ ও সুরক্ষিত হাদীসই বর্ণনা করিতেন। যাহা তাঁহার মুখস্থ নাই, তাহা তিনি কখনো বর্ণনা করিতেন না।[********************]
দ্বিতীয় এই যে, হাদীসের বিরাট সম্পদ বক্ষে ধারণ করার পর উহার শাব্দিক বর্ণনা তিনি কম করিয়াছেন, কেবল হাদীস শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে মজলিস অনুষ্ঠান তিনি বড় একটা করেন নাই, বরং তিনি হাদীসের নিগূঢ় অর্থ উদঘাটন ও উহা হএত মুসলমানদের ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়েজনীয় মাসলা-মাসায়েল বাহির করার কাজেই সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন।[********************]
কিন্তু তাই বলিয়া তিনি হাদীস সন্ধান ও সংগ্রহের কাজ বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন তাহাও নয়। বরং নিত্য নূতন হাদীসের সন্ধান লাভ করিয়া অধিকতর সমৃদ্ধ হইবার জন্য তিনি সবসময়ই চেষ্টিত ও যত্ববান হইয়াছিলেন। ইমাম নযর ইবনে মুহাম্মদ মারওয়াজী ইমাম আবূ হানীফার একজন বিশিষ্ট ও প্রখ্যাত ছাত্র। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি ইমাম আবূ হানীফার অধিক কাহাকেও হাদীস সন্ধানে উৎসাহী ও মনোযোগী দেখিতে পাই নাই। একবার ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল আনসারী, হিশাম ইবনে উরওয়া ও সায়ীদ ইবনে আবূ আরুবা আগমন করিলেন। তখন ইমাম আবূ হানীফা আমাদিগকে বলিলেনঃ যাইয়া দেখ, এই লোকদের নিকট হাদীসের এমন কোন সম্পদ আছে কিনা, যাহা আমি তাঁহাদের নিকট হইতে শুনিয়া লইতে পারি।[********************]
ইমাম আজমের অপর এক শাগরিদ হইতেছেন মুহাদ্দিস আবদুল আযীয ইবনে আবূ রাজামা। তিনিও প্রায় এই রূপ কথাই বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
একজন মুহাদ্দিস কূফায় আগমন করিলে ইমাম আবূ হানীফা তাঁহার ছাত্র-সঙ্গীদের বলিলেনঃ তোমরা তাঁহার নিকট যাইয়া দেখ, আমাদের নিকট নাই এমন কোন হাদীস তাঁহার নিকট আছে নাকি?
আবদুল আজীজ বলেনঃ আরো একবার একজন মুহাদ্দিস আসিলে ইমাম আবূ হানীফা তাঁহার ছাত্রদিগকে এইরূপ বলিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।[********************]
উপরিউক্ত বর্ণনা দুইটি হইতে ইমাম আবূ হানীফার হাদীস সন্ধানপ্রিয়তা স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। তাই হাদীসের ব্যাপারে তিনি অমনোযোগী ছিলেন, এরূপ কথা অর্বাচীনই বলিতে পারে।
তিনি হাদীস পরিত্যাগ করিয়া কেবল কিয়াস ও বুদ্ধি প্রয়োগের সাহায্যেই মাসালার রায় দিতেন বলিয়া যে অভিযোগ করা হইয়াছে, তাহা সর্বৈব মিথ্যা। মাসালার রায় দেওয়ার ব্যাপারে তাঁহার নীতি কি ছিল, তাহা তাঁহার নিম্নোক্ত উক্তি হইতেই সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। তিনি নিজেই নিজের সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি প্রথমে আল্লাহর কিতাবকেই ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করি, যখন তাহাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফয়সালা পাই, তখন সেই অনুযায়ীই রায় দেই। তাহাতে যদি না পাই, তবে অতঃপর রাসূলের সুন্নাত ও বিশুদ্ধ কার্যবিবরণী- যাহা নির্ভরযোগ্য লোকদের মারফতে প্রচারিত হইয়াছে- গ্রহণ করি। কিন্তু আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতেও যদি তাহা না পাই, তবে তখন কাহারো কথা ছাড়িয়া দেই।[********************]
কিয়াস ও সাধারণ বুদ্ধির বিপরীত হইলেও তিনি যে হাদীসকেই গ্রহণ করিতেন এবং প্রমাণিত হাদীস অনুযায়ী আমলন করিতেন, তাহার প্রমাণ এই যে, কুরয়া দ্বারা কর্তব্য নির্ধারণ করাকে তিনি জায়েয মনে করিতেন, যদিও বাহ্যদৃষ্টিতে উহা জুয়ার সমান।
তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
কিয়াস অনুযায়ী কুরয়া জায়েয হওয়া উচিত নয়, কিন্তু উহার জায়েয হওয়া সম্পর্কে যে হাদীস ও সুন্নাত প্রমাণিত হইয়াছে, কিয়াস ত্যাগ করিয়া আমি তাহাই মানিয়া লইতেছি।[********************]
তিনি হাদীস গ্রহণে যে কঠোর শর্ত ও কড়াকড়ি আরোপ করিয়াছেন ইহা আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বস্তুতই অপরিহার্য ছিল। কেননা ইমাম আবূ হানীফার যুগে বিভিন্ন প্রকারের ভ্রান্ত আকীদা ও এক শ্রেণীর মানুষের মনগড়াভাবে রচিত মিথ্যা হাদীস ব্যাপকভাবে প্রচারিত হইয়াছিল। এই সময় তিনি যদি বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন না করিতেন, যদি হাদসি নামে কথিত ভূল-শুদ্ধ নির্বিচারে সব কথাই মানিয়া লইতেন, তাহা হইলে আল্লাহর দ্বীন নির্ভূলভাবে রক্ষিত হইতে পারিত না। প্রকৃতপক্ষে ইহা তাঁহার অপরিসীস তাকওয়া ও দ্বীনের প্রতি ঐকান্তিক অকৃত্রিম বিশ্বাস ও ভালবাসারই ফল, ইহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।[********************]
হাদীস গ্রহণে ইমাম আবূ হানীফার শর্ত
ইমাম আবূ হানীফা (র) হাদীস গ্রহণে যেসব শর্ত আরোপ করিয়াছেন, তাহার অধিকাংশই সাধারণ মুহাদ্দিস র্তৃক আরোপিত শর্ত। কিন্তু কতকগুলি শর্ত তিনি নিজে বিশেষভাবে ও বিশেষ বিশেষ কারণে অতিরিক্ত আরোপ করিয়াছেন। এখানে তন্মধ্যে কয়েকটি শর্তের উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১. কোন হাদীস বর্ণনা করার পর বর্ণনাকারী যদি তাহা ভুলিয়া যায়, তবে সাধারণ মুহাদ্দিসদের নিকট তাহা গ্রহণীয় হইলেও ইমাম আবূ হানীফা এবং তাঁহার শাগরিদগণ তাহা গ্রহণ করিতে রাযী নহেন।[********************]
২. কেবল সেই হাদীসই গ্রহণযোগ্য, যাহ বর্ণনাকারী স্বীয় স্মরণ ও স্মৃতিশক্তি অনুসারে বর্ণনা করিবেন।[ঐ]
৩. যেসব প্রখ্যাত মুহাদ্দিসের মজলিসে বিপুল সংখ্যক শ্রবণকারীর সমাবেশ হওয়ার কারণে উচ্চ শব্দকারী লোক নিয়োগ করা হয় এবং তাহাদের নিকট শ্রুত হাদীসকে আসল মুহাদ্দিসের নিকট শ্রুত হাদীস বলিয়া বর্ণনা করা হয়, ইমাম আবূ হানীফার নিকট সেই হাদীস গ্রহণযোগ্য নহে। হাফেয আবূ নয়ীম, ফযল ইবনে আকীন, ইবনে কুদামাহ প্রমুখ প্রখ্যাত মুহাদ্দিসও এই মত পোষণ করেন। হাফেয ইবনে হাজার মক্কীর মতে ইহা বিবেকসম্মত কথা হইলেও সাধারণ মুহাদ্দিসের মতই সহজসাধ্য।[********************]
৪. যে বর্ণনাকারী নিজের খাতায় লিখিত পাইয়া কোন হাদীস বর্ণনা করেন, কিন্তু তাহা তাহার কোন উস্তাদ মুহাদ্দিসের নিকট হইতে শুনিয়াছেন বলিয়া স্মরণে পড়ে না, ইমাম আবূ হানীফা এই ধরনের হাদীস সমর্থন করেন না। অপরাপর মুহাদ্দিসের মতে ইহাতে কোন দোষ নাই।[********************]
কূফাবাসী মুহাদ্দিসগণ হাদীসের মূল বক্তব্যকে নিজ ভাষায় বর্ণনা (********************) করা জায়েয মনে করিতেন। আর ইহাই ছিল তখন সাধারণভাবে প্রচলিত রীতি। হাদীসের মূল শব্দ বর্ণনাকারীদের সংখ্যা বেশী ছিল না। ফলে হাদীসের বর্ণনায় পার্থক্য ও রদ-বদল হইয়া যাওয়ার আশংকা পূর্ণমাত্রায় বর্তমান ছিল। ইমাম আবূ হানীফা ইহার ফলে হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে কঠোর কড়াকড়ি নীতি অবলম্বন করিতে বাধ্য হন। এতসব সতর্কতার পর তিনি যে হাদীসের গ্রন্হ সংকলন করিয়াছিলেন, তাহা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ আল খাওয়ারিজমী ইমাম আবূ হানীফার পনেরখানা মুসনাদ (সংকলিত হাদীস গ্রন্হ ) সংগ্রহ করিয়াছিলেন।[********************]
ইমাম মালিক ইবনে আনাস (র)
ইমাম মালিক মদীনাতুর-রাসূলের সর্বাপেক্ষা বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি ৯৩ হিজরী সনে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। [******************** কিন্তু ঐতিহাসিক ইয়াফিয়ী ‘তোবকাতুল ফুকাহা’ গ্রন্হে জন্ম সন ৯৪ হিজরী বলা হইয়াছে।] এই সময় মদীনার সমগ্র শহরটি হাদীস চর্চা ও হাদীস শিক্ষার সুমিষ্ট আওয়াজে মুখরিত ছিল। নবী করীম (স)-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কিরাম যদিও দূর দূরান্তরে অবস্থিত স্থানে ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন; কিন্তু স্বর্ণের খনি হইতে স্বর্ণ উত্তোলনের পরও তাহা স্বর্ণের খনিই থাকিয়া যায় এবং তখনো সেখানে যাহা অবশিষ্ট থাকিয়া যায়, তাহার পরিমাণ কিছুমাত্র নগণ্য হইতে পারে না। সমস্ত বড় বড় সাহাবী এই শহরেই বসবাস করিতেন। নবী করীমের জীবদ্দশায় এবং তাহার পরে ২৪/২৫ বৎসর পর্যন্ত এই শহরেই ছিল ইসলামী হুকুমতের কেন্দ্র। এইখানেই ইসলামের যাবতীয় আইন-কানুন চর্চা, প্রচার ও কার্যকর হইত এবং তাহার পরই তাহা মুসলিম জাহানের অপরাপর কেন্দ্রে প্রচারিত হইত। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক, উমর ফারূক, হযরত আয়েশা, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর, হযরত ইবনে আব্বাস, হযরত আবূ হুরায়রা, হযতর যায়দ ইবনে সাবিত প্রমুখ মহান সাহাবীর হাদীদ শিক্ষাদানের কেন্দ্র এই শহরেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। ফলে এই শহরের শত সহস্র ব্যক্তি ওহী ও সুন্নাতের ইলমে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করিতে সমর্থ হন এবং উত্তরকালে তাঁহারাই উহার প্রকৃত উত্তরাধিকারী হন।
ইমাম মালিক যখন হাদীস শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হন, তখন ইলমে হাদীসের বড় বড় ‘বাদশাহ’ মদীনায় অবস্থান করিতেছিলেন। হযরত আয়েশার বড় বড় ছাত্রগণ, তাঁহার ভ্রাতস্পুত্র কাসেম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর, তাঁহার বোনপুত্র উরওয়া ইবনে যুবায়র, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমারের ছাত্র নাফে ও আবদুল্লাহ ইবিনে দীনার, তাঁহার দুই গোলাম ও সালেম ইবনে আবদুল্লাহ প্রমুখ তাবেয়ী তখনো সেখানে বর্তমান ছিলেন। হযরত যায়দ ইবনে সাবিত মদীনার বাহিরে চলিয়া গেলেও তাঁহার পুত্র খারেজাহ ইবনে যায়দ তাহার ইলমে হাদীসের ওয়ারিশ হইয়াছিলেন এবং তিনি মদীনাতেই বসবাস করিতেন। হযরত আবূ হুরায়ারার বিরাট হাদীস জ্ঞানের মহাসমুদ্র আকণ্ঠ পান করিয়াছিলেন তাঁহার জামাতা সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব। তিনিও এই মদীনাতেই বাস করিতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস যদিও তাহার হাদীস জ্ঞান প্রধানত মদীনার বাহিরে মক্কা কূফা ও বসরায় প্রচার করিয়াছিলেন, কিন্তু মদীনায় অবস্থানকারী তাবেয়ী সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব তাঁহার নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস আয়ত্ত করিয়া লইয়াছিলেন।
এতদ্ব্যতীত আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকজন তাবেয়ী এই সময় মদীনায় অবস্থান করিতেন। তাঁহারা হইতেছেন হিশাম ইবনে উরউয়া, মুহাম্মদ ইবনুল মুনকাদির, উবায়দুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ, মুহাম্মদ ইবনে শিহাব যুহহরী, আমের ইবনে আবদুল্লাহ জাফর সাদিক, রবীয়া রায়ী, আবূ সুহাইল ও সুলায়মান ইবনে ইয়াসার। তাঁহারা এমন তাবেয়ী ছিলেন, যাঁহাদের ক্রোড়ে হাদীস ও তাফসীরের জ্ঞান লালিত-পালিত ও ক্রমবিকশিত হইয়াছিল।
ইমাম মালিকের পিতামহ, চাচা পিতা সকলেই বড় বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। ইহা হইতে বলা যায়, ইমাম নিজস্ব ঘর ও পরিবারে গোটা পরিবেশই ইলমে হাদীসের গুঞ্জনে মুখরিত ছিল। এই কারণে তিনি বাল্য জীবনেই হাদীস শিক্ষা লাভ করিতে শুরু করেন। তিনি সম্ভবত সর্বপ্রথম তাঁহার চাচা আবূ সুহাইলের নিকট হাদীস শিক্ষা করিতে শুরু করেন। পরে নাফে’র নিকট হাদীস শিক্ষা করিতে যান। নাফে যতদিন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন ইমাম মালিক তাঁহার নিকটই হাদীস শিক্ষার জন্য যাইতেন। অতঃপর তিনি মদীনার উপরোল্লিখিত প্রায় সকল হাদীসবিদ তাবেয়ীর নিকট হইতেই হাদীস শিক্ষা করিয়াছেন। তাঁহার উস্তাদের মোট সংখ্যা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর মতে ৭৫ জন। অপর এক বর্ণনায় ৯৪ জন উল্লেখ করা হইয়াছে।[********************]
কিন্তু আল্লামা জালালুদ্দীন সয়ূতী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম মালিক নয়শত মুহাদ্দিসের নিকটি হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন। তন্মধ্যে তিনশত হইতেছে তাবেয়ী ও ছয়শ হইতেছেন তাবে-তাবেয়ী।[********************]
এই সকল উস্তাদকেই তিনি মদীনা শরীফে পাইয়াছিলেন। এই কারণে হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মদীনার বাহিরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নাই।
ইমাম মালিক সকল প্রকারের হাদীস বর্ণনাকারীর নিকট হইতেই হাদীস গ্রহণ করিতেন না। তিনি হাদীসের উস্তাদ হিসাবে কাহাকে গ্রহন করিবেন, তাহা তিনি গভীর সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চিন্তা করিয়া ছাঁটাই-বাছাই করিয়া লইতেন। এই সম্পর্কে তাহার প্রিয় ছাত্র হাবীবের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি নিজেই বলিয়াছিলেনঃ
******************************************************
হে হাবীব ! এই মসজিদেই (মসজিদে নববী) আমি সত্তর জন এমন মুহাদ্দিস পাইয়াছি, যাঁহারা রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবীরে সাক্ষাত ও সংস্পর্শ লাভ করিয়াছিলেন এবং তাবেয়ীদের হইতেও হাদীস বর্ণনা করিতেন। (আমি তাঁহাদের নিকট হইতেই হাদীস শিক্ষা ও গ্রগণ করিয়াছি।) এবং হাদীসকে উহার উপযুক্ত লোকদের নিকট হইতেই গ্রহণ করিয়াছি, অনুপযুক্ত ব্যক্তির নিকট হইতে কখনো গ্রহণ করি নাই।[********************]
তাঁহার উস্তাদ কোন ধরনের লোক ছিলেন এবং কাহাদের নিকট হইতে তিনি হাদীস গ্রহণ করেন নাই, তাহা নিম্নোক্ত বর্ণনা হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
তাঁহার হাদীস শিক্ষার উস্তাদ যাঁহারা ছিলেন, তাঁহাদের সকলকেই ইমাম মালিক ছাঁটাই-বাছাই করিয়া লইয়াছিলেন, তাঁহাদের দ্বীনদারী, বুঝশক্তি ও ফিকাহ-জ্ঞান এবং হাদীস বর্ণনার হক ও শর্ত আদায় করার দিক দিয়া তাঁহাদিগকে তিনি পছন্দ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সম্পর্কে তাঁহার অন্তরে ঐকান্তিক বিশ্বাস ও নিশ্চিন্ততা বিরাজমান ছিল। এতদ্ব্যতীত তিনি বহু দ্বীনদার ও কল্যাণময় ব্যক্তির নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করেন নাই। কেননা তাঁহারা হাদীস বর্ণনার সুষ্ঠু নিয়ম সঠিক ভাবে জানিতেন না।[********************]
ইমাম মালিক (র) যে কত বড় মুহাদ্দিস ছিলেন, তাহা তাঁহার সম্পর্কে কথিত অপরাপর শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদের নিম্নোল্লিখিত উক্তিসমূহ হইতে স্পষ্টরূপে বুঝিতে পারা যায়।
ইমাম শাফিয়ী (র) তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম মালিক তাবেয়ীদের পরবর্তী যুগের লোকদের জন্য আল্লাহর এক অকাট্য দলীল বিশেষ।[********************]
মুহাদ্দিস নাসায়ী বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমার দৃষ্টিতে তাবেয়ীনের পরবর্তী যুগে মালিক অপেক্ষা বড় বিজ্ঞ ব্যক্তি আর কেহ নাই।[********************]
ইমাম আবূ ইউসূফ (র)
ইমাম আবূ ইউসূফ (র) যদিও ইলমে ফিকাহর একজন প্রসিদ্ধ বিশেষজ্ঞ ও ইমাম হিসাবেই প্রখ্যাত; কিন্তু হাদীস-জ্ঞানের দিক দিয়াও তিনি অপর কাহারো অপেক্ষা কিছুমাত্র পশ্চাদপদ ছিলেন না। আল্লাহ তাঁহাকে অনন্যসাধারণ স্মরণশক্তি দান করিয়াছিলেন। তিনি যখনই হাদীসের উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিতে থাকিতেন, তখনই তাঁহার হাদীস মুখস্থ হইয়া যাইত। এমন কি, একই বৈঠকে পঞ্চাশ-ষাটটি হাদীস পূর্ণ সনদসহ শ্রবণ করিয়া একবারেই তিনি মুখস্থ বলিতে পারিতেন। ইমাম যাহবী তাঁহাকে হাদীসের বড় বড় হাফেযদের মধ্যে গণ্য করিয়াছেন। হাফেয ইবনে হাজার আল-আসকালানী উল্লেখ করিয়াছেন যে, একবার তিনি অসুস্থ ও রোগাক্রান্ত হইয়া পড়েন। এই অবস্থায় শ্রেষ্ঠ হাফেযে হাদীস সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা তাঁহাকে চল্লিশটি হাদীস শোনান। এই হাদীসসমূহ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার মুখস্থ হইয়া যায় এবং সুফিয়ানের চলিয়া যাওয়ার পর তিনি তাহা সবই তাঁহার নিকট উপস্থিত অন্যান্য লোকদিগকে মুখস্থ পড়িয়া শোনাইয়া দেন। ইহাতে উপস্থিত সকল লোকই স্তম্ভিত ও বিস্মিত হয়।
হাদীষ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি জন্মস্থান কূফা নগরের মুহাদ্দিসীনের নিকট শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া মদীনা যাত্রা করেন এবং তথায় ইমাম মালিকের ছাত্র আসাদ ইবনে ফুরাত সাকালবীর নিকট হইতে ইমাম মালিক সংকলিত ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ আদ্যোপান্ত শ্রবণ করেন।
ইমাম আবূ ইউসূফ হাদীস শিক্ষার জন্য উস্তাদের নিকট শ্রুত হাদীস কখনো লিখিয়া লইতেন না; বরং একবার শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তাহা সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইতেন। কিন্তু তাঁহার সহপাঠিগণ বারবার শ্রুত হাদীসসমূহ লিখিয়া লইতেন। শুধু তাহাই নয়, লিখিত হাদীসকে অনেক সময়ই তাঁহাদিগকে ইমাম আবূ ইউসূফের জবানীতে শুনিয়া শুদ্ধ ও সংশোধন করিয়া লইতে হইত।
হাদীস ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য জ্ঞানে তিনি ছিলেন একজন ইমাম।
হাদীস শিক্ষার জন্য তাঁহার আগ্রহ, উৎসাহ ও উদ্যম এতই তীব্র ছিল যে, একদিকে তিনি ইমাম আবূ হানীফার দরবারে উপস্থিত থাকিয়া ফিকাহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করিতেন; আর সেখান হইতে উঠিয়াই তিনি মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস শিক্ষা করার উদ্দেশ্যে চলিয়া যাইতেন। এইভাবে অপরিসীম সাধনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেই তিনি ইলমে হাদীসে বিরাট বিশেষজ্ঞ হইতে পারিয়াছিলেন।[এই আলোচনা মাওলানা মুজীবুল্লাহ নদভী লিখিত ******************** গ্রন্হ হইতে সংগৃহীত।]
ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী (র)
ইমাম মুহাম্মদ শায়বানী ইমাম আবূ হানীফার দ্বিতীয় প্রধান ছাত্র। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আবূ ইউসূফের সংস্পর্শে আসার ফলে তাঁহার মনে হাদীস শিক্ষার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইরাক অন্তর্গত ‘ওয়াসিত’ (জন্মস্থান) হইতে কয়েকশত মাইল দূরে অবস্থিত মদীনায় উপস্থিত হইলেন এবং তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ ইমাম মালিকের নিকট হাযির হইলেন। তিনি একাদিক্রমে তিন বৎসরকাল পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন ও নিয়মিতভাবে ইমাম মালিকের হাদীস শিক্ষারদানের মজলিসে উপস্থিত হইত থাকেন। তিনি এই মজলিসৈ অন্ততঃ সাতশত হাদীস শ্রবণ করেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি ইমাম মালিকের দরবারে তিন বৎসর কি ততোধিক সময় অবস্থান করিয়াছি এবং তাঁহার নিকট হইতে সাতশত হাদীস শিক্ষালাভ করিয়াছি।[********************]
ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম আবূ ইউসূফ ও ইমাম মালিকের ন্যায় জগদ্বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদের নিকট হাদীস শিক্ষা করার পর অপর কোন হাদীসবিদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করার কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ইমাম মুহাম্মদের মনে হাদীস শিক্ষার জন্য যে উদগ্র পিপাসা জাগ্রহ হইয়াছিল, তাহা নিবৃত্ত করার জন্য তিনি সেকালের অন্যান্য বড় বড় হাদীসবিদের মজলিসে উপস্থিত না হইয়া ও তাঁহাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা না করিয়া কিছুতেই ক্ষান্ত ও শান্ত হইতে পারিলেন না।
আল্লামা জাহেদুল কাওসারী ইমাম মুহাম্মদের হাদীস শিক্ষার উস্তাদ সত্তর জন বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।[********************] এই উস্তাদগণ কূফা, মদীনা, মক্কা, বসরা, ওয়াসিত, সিরিয়া, খোরাসান ও ইয়ামামা প্রভৃতি দেশে ছড়াইয়াছিলেন।
তাঁহার স্মরণশক্তি এত তীক্ষ্ম ছিল যে, ইমাম আবূ হানীফার আদেশে তিনি কুরআন মজীদ হেফজ করিতে শুরু করেন এবং মাত্র এক সপ্তাহ কালের মধ্যেই সম্পূর্ণ কুরআন হেফয করিয়া ফেলেন। [ঐ] তিনি ইলমে হাদীসের কত বড় মনীষী ছিলেন, তাহা হইতে সহজেই অনুমান করা যায়। কেননা এইরূপ তীক্ষ্ম স্মরণশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি যখন হাদীস শিখিতে যান, তখন তিনি উস্তাদের নিকট হইতে যে হাদীসই শ্রবণ করিবেন, তাহা তাঁহার মানসপটে চিরতরে মুদ্রিত হইয়া যাইবে, ইহাই স্বাভাবিক।
ইমাম আওযায়ী (র)
ইমাম আওযায়ী তাবে-তাবেয়ীদের যুগের একজন বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি প্রথমে ইয়ামামায় অবস্থানকারী মুহাদ্দিস ইহায়ইয়া ইবনে কাসীরের নিকট হাদীস শিক্ষা করেন। অতঃপর সুদূর বসরা নগরের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে সীরিন ও হাসান বসরীর নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে তথায় গমন করেন। কিন্তু এই দীর্ঘ ও দূরধিগম্য পথ অতিক্রম করিয়া তিনি যখন বসরায় পৌঁছিলেন তখন জানিতে পারিলেন যে, ইমাম হাসান বসরীর ইন্তেকাল হইয়াছে ও ইমাম ইবনে সিরীন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। ইহাতে তাঁহার মনে যে ব্যর্থতার আঘাত লাগিয়াছিল, তাহা সহজেই অনুমেয়।
ইমাম আওযায়ী বিপুল সংখ্যক তাবেয়ীর নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছে।
ঐতিহাসিক হাফেয ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি বহু সংখ্যক তাবেয়ী লোকেরই সাক্ষাত সাহচর্য লাভ করিয়াছিলেন।[********************]
জীবনী লেখকগণ উল্লেখ করিয়াছেন যে, ইমাম আওযায়ী নিম্নোক্ত তাবেয়ী ও তাবেয়ীদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছেনঃ
(১) আতা ইবনে আবূ রিবাহ (২) কাতাদাহ (৩) নাফে মাওলা ইবনে উমর (৪) ইমাম যুহরী (৫) মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম (৬) শাদ্দাস ইবনে আবূ উমারাহ (৭) কাসিম ইবনে মুখাইমিরাহ ও (৮) রবীয়া ইবনে ইয়াযীদ প্রমুখ।
আওযায়ী নিজেই বলিয়াছেনঃ ইমাম যুহরী ও ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর উভয়ের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ সমাপ্ত হইলে তাঁহাদের নিজস্ব সংকলিত হাদীস সংকলন আমাকে দান করেন এবং বলেনঃ
********************
এই হাদীসসমূহ তুমি আমার নিকট হইতে ও আমার সূত্রে অন্যদের নিকট বর্ণনা কর।[********************]
ইমাম ইবনে জুরাইজ (র)
ইবনে জুরাইজ যখন জন্মগ্রহণ করেন (৮০ হিজরী), তখন বহু সংখ্যক সাহাবী জীবতি ছিলেন। প্রথম হইতেই তাঁহাদের সংস্পর্শে আসিতে পারিলে তিনি তাবেয়ীদের মধ্যে গণ্য হইতেন। কিন্তু তাঁহাদের নিকট হইতে তিনি ‘ইলম’ হাসিল করিতে পারেন নাই। এই কারণে তিনি তাবে-তাবেয়ীদের মধ্যে গণ্য হন।
এই সময় মক্কা নগরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)-এর বিশিষ্ট ছাত্র আতা ইবনে আবূ রিবাহ হাদীস শিক্ষাদানে নিযুক্ত ছিলেন। প্রাথমিক প্রয়োজনীয় শিক্ষা অর্জনের পর একাদিক্রমে সতেরো বৎসর পর্যন্ত তাঁহার সংস্পর্শে থাকিয়া হাদীস শিক্ষা করেন।
অতঃপর মুসলিম জাহানের প্রায় সকল প্রখ্যাত ইমামে হাদীস-এর নিকট হইতে তিনি হাদীস শিক্ষা করেন। আতা ইবনে আবূ রিবাহর ন্যায় আমর ইবনে দীনারের খিদমতেও তিনি দীর্ঘদিন থাকিয়া হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। এই সব কারণে ইমাম ইবনে জুরাইজ হাদীস জ্ঞানে এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হন। তাঁহার বর্ণিত হাদীস হাদীসের বড় বড় মনীষীর নিকট গ্রহণযোগ্য হইয়াছে। তাঁহার সংগ্রহীত হাদীসসম্পদ লিখিত আকারে তাহার নিকট বর্তমান ছিল।
সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (র)
সুফিয়ান ইলমে হাদীসের একজন যুগশ্রেষ্ঠ মনীষী ছিলেন। শৈশব কাল হইতেই তাঁহার তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি স্বতস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটিয়াছিল। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি কখনও কিছু লিখি নাই, কিন্তু যখনই যাহাই লিখিয়া লইয়াছি, তাহাই আমার মুখস্থ হইয়া গিয়াছে।[********************]
তিনি বহু শত তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীর নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। তাঁহার হাদীস শিক্ষার উস্তাদদের মধ্যে আশি জনেরও অধিক ছিলেন তাবেয়ী। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম যুহরী, ইমাম শু’বা , মুসায়েব ইবন কুদাম, আমর ইবনে দীসার, আবূ ইসহাক সাবীয়ী, মুহাম্মদ ইবনে আকাবা, হুমাইদ, জিয়াদ ইবনে আলাকা, সালেহ ইবনে কাইসান প্রমুখ মণীষী উল্লেখযোগ্য।[********************] হাদীস শিক্ষার জন্য তিনি কূফা, মক্কা, মদীনা ও অন্যন্য জ্ঞানকেন্দ্রসমূহ সফর করেন।
প্রসিদ্ধ হাদীসবিদ আলী ইবনে মদীনী তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম যুহরীর ছাত্রদের মধ্যে ইবনে উয়াইনা অপেক্ষা অধিক নির্ভরযোগ্য আর কহ নাই।[********************]
আমাশ, সওরী, ইবনে জুরাইজ, শু’বা, আকী, ইবনে মুবারক, সায়ীদুল কাতান, শাফেয়ী ও আহমদ ইবনে হাম্বল প্রমুখ মুহাদ্দিস তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি হিজরী ১০৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন ও ১৯৮ সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]
আবদুল্লাহ ইবেন মুবারক (র)
ইবনে মুবারক প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর হাদীস শিক্ষার জন্য বিদেশ সফরে বহির্গত হন। এই উদ্দেশ্যে তিনি সিরিয়া, হিজাজ, ইয়ামেন, মিসর, কূফা ও বসরার বিভিন্ন শহর ও নগর পরিভ্রমণ করেন এবং যেখানেই ও যাহার নিকটই তিনি হাদীস শিক্ষার সুযোগ পাইয়া্ছেন, যেখানেই এবং তাঁহার নিকট হইতেই হাদীস শিক্ষা করিয়াছেন। হাদীস সন্ধান করার উদ্দেশ্যে তিনি যে একজন বড় পর্যটক ছিলেন, তাহা সকলেই স্বীকার করিয়াছেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল-এর মতে সেকালে হাদীসের জন্য এত দূর-দূরান্তরে সফরকারী আর একজনও ছিল না।[********************]
আবূ উসামা বলিয়াছেনঃ
******************************************************
ইবনে মুবারক অপেক্ষা দেশ-দেশান্তরের হাদীস অন্বেষণকারী অন্য কোন ব্যক্তিকে আমি দেখি নাই।[********************]
মনে রাখা আবশ্যক যে, সেকালে বিদেশে সফর যুগের ন্যায় কিছুমাত্র সহজসাধ্য ছিল না। পায়ে হাঁটিয়া কিংবা উষ্ট্র বা গাধার পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া মাসের পর মাস চলিয়াই এক স্থান হইতে অন্য এক স্থানে পৌঁছিতে হইত। তখনকার সময়ে পথ চলা কতদূর কষ্টসাধ্য ছিল, তাহা এখন ধারণা করাও সম্ভব নয়।
ইবনে মুবারক কতজন উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছেন তাহা তাঁহার নিম্নোক্ত উক্তি হইতেই বুঝিতে পারা যায়। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি চার হাজার উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছি এবং তন্মধ্যে এক হাজার উস্তাদের বর্ণিত হাদীস আমি অন্যদের নিকট বর্ণনা করিয়াছি।[********************]
এক কঠিন পরিশ্রমলব্ধ বিরাট হাদীসসম্পদ তিনি নিজেই বিপুল সংখ্যক লোককে শিক্ষা দিয়াছেন। ইমাম যাহবী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইসলামী জাহানের এত লোক তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছে যে, তাহাদের সংখ্যা নির্ধারণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়।[********************]
ইলমে হাদীসে তিনি একজন বড় ইমামের মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। হাদীস চর্চা ছিল তাঁহার চব্বিশ ঘন্টার ব্রত। তাঁহাহ মতে যখন হাদীস আলোচনা করা হয়, তখন যেন ঠিক রাসূল করীম (স)-এর সংস্পর্শে ও সাহচর্য লাভ হয়। ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন প্রমুখ বড় বড় মনীষী বলিয়াছেনঃ ইবনে মুবারকের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা বিশ-একুশ হাজার হইবে।[********************]
ইমাম শু’বা (র)
ইমাম শু’বা হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) ও হযরত আমর ইবনে মুসলিম (রা) এই দুইজন সাহাবীকে দেখিতে পাইয়াছেন। এই কারণে তিনি তাবেয়ী পর্যায়ের হইলেও জীবনী লেখকগণ তাঁহাকে তাবে-তাবেয়ী মধ্যে গণ্য করিয়াছেন। তিনি ‘ওয়াসিত’ নামক কূফা ও বসরার মধ্যবর্তী এক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষালাভ করার পরই তিনি ইলমে হাদীস শিখিবার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। উত্তরকালে তিনি হইতে চরম মাত্রায় বুৎপত্তি লাভ করেন। তৎকালীন প্রায় সকল বড় বড় হাদীসবিদের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছেন। সাধারণ জীবনী লেখকগণ লিখিয়াছেন যে, তাঁহার হাদীসের উস্তাদের মধ্যে প্রায় চারিশত তাবেয়ী রহিয়াছেন। হাফেয ইবেন হাজার আল আসকালানী লিখিয়াছেন যে, কূফা নগরের তিনশত হাদীসবিদের নিকট হইতে তিনি হাদীস শ্রবণ ও বর্ণনা করিয়াছেন।
এই উস্তাদগণ দুই একটি শহরেই অবস্থান করিতেন না; বরং তাঁহারা মুসলিম জাহানের লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল বিস্তীর্ণ এলাকায় বিক্ষিপ্ত ছিলেন। তদুপরি রহিয়াছে এই কালের চলার পথের দুর্গমতা ও দূরতিক্রম্য অবস্থা। অনেক সময় কেবল একটি হাদীসের জন্য সহস্র মাইল পথ পায়ে হাঁটিয়া কিংবা উষ্ট্র বা ঘোড়ায় চড়িয়া অতিক্রম করতে হইত। এই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হইতেছে তাঁহার অনন্যসাধারণ তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির। তিনি হাদীস শ্রবণ করিয়া তাহা বড় একটা লিখিয়া লইতেন না; বরং লম্বা লম্বা হাদীস সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ করিয়া ফেলিতেন।[********************] ইহার দুরুন তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক হাদীস স্বীয় স্মৃতিপটে মুদ্রিত ও সুরক্ষিত করিয়া রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
সমসাময়িক ও তাঁহার পরবর্তীকালের বড় বড় হাদীসবিদ তাঁহার ইলমে হাদীসৈর অনন্যসাধারণ জ্ঞানের কথা অকপটে স্বীকার করিয়াছেন।[********************]
ইমাম লাইস ইবনে সায়াদ (র) (জন্ম ৯৪ হিজরী মৃত্যু ১৬৫ হিঃ)[********************]
ইমাম লাইস তাবে-তাবেয়ীন ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করিয়াই তিনি হাদীস শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন। তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের বিশেষভাবে লালিত ও শিক্ষাপ্রদত্ত প্রসিদ্ধ তাবেয়ী নাফের নিকট হাদীস শিক্ষার জন্য উপস্থিত হন। তাঁহার নিকট হইতে তিনি যত হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছিলেন তাহার সব একটি সংকলনে লিপিবদ্ধ করিয়া লইয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত তিনি ইমাম যুহরী, সায়ীদুল মুকবেরী, আবদুল্লাহ ইবনে আবূ মূলাইকা, ইয়াহইয়া আল-আনসারী ও আবূ যুবায়র প্রমুখ তাবেয়ীর নিকট হইতেও হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। ইমাম নববী ইমাম লাইসের কয়েকজন বিশিষ্ট উস্তাদের নাম উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহাদের ছাড়া তিনি আরো এত বিপুল সংখ্যক ইমামে হাদীসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও শ্রবণ করিয়াছেন যাহাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।[********************]
ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) (জন্ম ৯৭ হিজরী, মৃত্যু ১৬১ হিজরী)[********************]
সুফিয়ান সওরী ছিলেন তাবে-তাবেয়ী যুগের হাদীস-জ্ঞানের একজন শ্রেষ্ঠ মনীষী। প্রাথমিক শিক্ষা পিতার নিকট লাভ করেন। অতঃপর কূফা নগরের সকল মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করেন। এই সময় কূফা নগরে আ’মাশ ও আবূ ইসহাক প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসের রীতিমত দারস দেওয়ার একটা প্রতিষ্ঠান কায়েম করিয়াছিলেন।
ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন বলিয়াছেনঃ
******************************************************
সুফিয়ান আ’মাশ বর্ণিত হাদীসসমূহ অন্যান্য সকল লোক অপেক্ষা অধিক জানেন।[********************]
এই সময় হাদীস যেহেতু সাধারণের জন্য গ্রন্হবদ্ধ হয় নাই, হাদীস সমূহের বিরাট অংশ ছিল মুহাদ্দিসদের স্মৃতিপটে মুদ্রিত এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রক্ষিত। এইজন্য হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে শিক্ষার্থীকে দূরদূর দেশে সফর করিতে হইত। সুফিয়ানকেও হাদীস শিক্ষার জন্য দূরদেশে পরিভ্রমণ করিতে হইয়াছে ও এইজন্য শত-সহস্র মাইল পথ অতিক্রম করিতে হইয়াছে।
কূফায় উস্তাদদের নিকট হাদীস শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া তিনি বসরা ও হিজাজ গমন করেন। এই দুই শহরে বিপুল সংখ্যক মুহাদ্দিসের নিকট হইতে তিনি হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। তাঁহার কূফা, বসরা ও হিজাজের প্রখ্যাত উস্তাদের নাম উল্লেখের পর হাফেয ইবনে হাজার লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
কূফার বহুসংখ্যক উস্তাদের নিকট হইতে তিনি হাদীস শিক্ষা করেন। এইভাবে বসরারও বহু সংখ্যক উস্তদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করেন এবং হিজাজের বিভিন্ন হাদীস শিক্ষার বৈঠক হইতেও তিনি যথেষ্ট ফায়দা গ্রহণ করেন।[********************]
আবদুর রহমান ইবনে মাহদী ইমামে হাদীস। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি সুফিয়ান সওরী অপেক্ষা অধিক হাদীস মুখস্থকারী আর এক জন লোকও দেখি নাই।[********************]
হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীসের বিক্ষিপ্ত সম্পদ যখন গ্রন্হাকারে সুসংবদ্ধ হইয়াছিল, তখন লক্ষ লক্ষ সনদসহ মুখস্থ করা খুবই সহজ ছিল, কিন্তু পূর্বে ইহা যখন বিক্ষিপ্ত ছিল, তখন দুই চার হাজার হাদীস স্বীয় বক্ষে ধারণ করা ও উহাকে সুরক্ষিত করিয়া রাখা বড়ই কঠিন ব্যাপার ছিল। এই কারণে তাবে-তাবেয়ীন যুগের কোন হাদীসের ইমামের পক্ষে দশ সহস্রের অধিক হাদীস মুখস্থ করিয়া রাখার দৃষ্টান্ত কুত্রাপি পরিদৃষ্ট হয় না। এইদিক দিয়াও সুফিয়ান সওরীর কৃতিত্ব বিশেষত্ব উল্লেখযোগ্য। তাঁহার বর্ণিত যেসব হাদীস তাঁহার স্মৃতিপটে রক্ষিত ছিল তাহার সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার।[********************] আবূ আসেম বলিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম সওরী ইলমে হাদীসের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা।[********************]
মোটকথা, এই যুগে ইলমে হাদীস সুসংবদ্ধ ছিল না। বরং উহা মুসলিম জাহানের প্রায় সর্বত্রই বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। ইহার কারণ- যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে- এই ছিল যে, সাহাবায়ে কিরামই ছিলেন হাদীসের প্রাথমিক ধারক ও বাহক। তাঁহারা মসজিদ বা খানকার নিভৃত কোণে জীবন অতিবাহিত করেন নাই। বরং তাঁহারা প্রকৃত মুজাহিদের ন্যায় জীবন যাপন করিয়াছেন। জিহাদ, ইসলামী দাওয়াতের জন্য ও অন্যান্য দ্বীনি দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে তাঁহারা মুসলিম অধ্যুষিত দুনিয়ার প্রায় সকল দেশে ও ক্ষেত্রেই ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহারা যেখানেই পৌঁছিতেন, সেখানকার অধিবাসিগণ তাঁহাদের নিকট হইতে ইসলামী জ্ঞান তথা ইলমে হাদীস শিক্ষা করিতেন। নবী করীম (স)-এর কথা, কাজ ও চরিত্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করিয়া তাহা তাঁহারা নিজেদের স্মৃতিপটে সুরক্ষিত করিয়া রাখিতেন। এক্ষণে কেবল ইসলামী যিন্দিগী যাপন করাই যাহাদের উদ্দেশ্যে হইত তাহাদের পক্ষে ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান লাভ এবং কোন একটন সাহাবীর বাস্তব জীনব অনুসরণ করাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সাহাবীদের পরে যেসব মহান ব্যক্তি রাসূল-জ্ঞানের বিক্ষিপ্ত মণিমুক্তা সংগ্রহ ও সংকলন করার কঠিন ব্রত অবলম্বন করিয়াছিলেন এবং যাঁহারা ইসলামী ইলমের এই মহামূল্য সম্পদকে ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করার দায়িত্ব লইয়াছিলেন, তাঁহাদের পক্ষে দেশের পর দেশ, বিরাট বিরাট উপমহাদেশ, বিশাল সমুদ্র, সীমাহীন উত্তপ্ত মরু প্রান্তর, নিবিড় দুর্গম অরণ্য পর্বত সমাকীর্ণ পথ অতিক্রম করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। উপরন্তু এ যুগের হাদীস সংগ্রহকারী সাধকদের নিকট ইহা ছিল অত্যন্ত প্রিয় কাজ।
বলখ শহরের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস খালফ ইবন আইয়ূবকে এক ব্যক্তি একটি জরুরী বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে। তিনি বলিলেনঃ ইহা আমার অজ্ঞাত, তবে কূফা নগরের বাসিন্দা হাসান ইবনে জিয়াদের নিকট হইতে ইহার সঠিক জওয়াব জানা যাইতে পারে। প্রশ্নকারী কূফা শহরের নাম শুনিয়া বলিলঃ…………….. কূফা! সে তো বহু দূরে ! ইহা শুনিয়া খালফ ইবনে আউয়ুব বলিলেনঃ
******************************************************
দ্বীনের চিন্তা যাহাকে পাইয়া বসিয়াছে, কূফার ন্যায় বহু দূরবর্তী শহরও তাহার নিকট অতি নিকটবর্তী বিবেচিত হইবে।[********************]
এই কারণেই সেকালের কোন লোক যদি জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘ পথ সফর করিতে অক্ষমতা প্রকাল করিত তবে সমাজক্ষেত্রে সে নিদারুণ লাঞ্ছনা ও ভৎসনার সম্মুখীন হইতে বাধ্য হইত। হাদীস বিশেষজ্ঞ ও হাদীস শাস্ত্রের প্রখ্যাত সমালোচক ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন বলেনঃ
যে মুহাদ্দিস কেবল নিট শহরে বসিয়াই হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিবেন, সেজন্য বিদেশ সফরের কষ্ট স্বীকার করিতে প্রস্তুত হইবেন না, তোমরা তাঁহার নিকট হইতে কোন কল্যাণের আশা করিতে পার না।[********************]
হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরের যে কল্যাণ নিহিত রহিয়াছে, উহার বৈষয়িক মূল্য ও উপেক্ষা করা যায় না। ইবরাহিম ইবনে আদহামের নিম্নোক্ত উক্তি হইতে উহার গুরুত্ব অনুধাবণ করা যায়। তিন বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হাদীস শিক্ষার্থী ও সংগ্রহকারীদের এই উদ্দেশ্যে দেশ-বিদেশে সফরের বরকতে আল্লাহ এই জাতিকে অনেক বিপদ-মুসিবত হইতে রক্ষা করেন।[********************]
বস্তুত সাহাবীদের যুগ হইতে তাবে-তাবেয়ীন ও তৎপরবর্তী মুহাদ্দিসদের যুগ পর্যন্ত আমরা হাদীস সংগ্রহ অভিযানের যে ব্যাপকতা ও তীব্রতা দেখিতে পাই তাহাতে এই বিদেশ সফরের গুরুত্ব সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হইয়া পড়ে এবং যেসব মহান ব্যক্তি এই অভিযান বাস্তব ক্ষেত্রে চালাইয়াছেন, তাঁহাদের প্রতি আমাদের মনে জাগে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। তাঁহারা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও দ্বীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুনিয়াদ হাদীস সংরক্ষণে এইরূপ প্রাণপণ সংকল্প লইয়া ময়দানে ঝাঁপাইয়া রা পড়িতেন তাহা হইলে আজ মুসলিম জাতি রাসূলে করীম (স)-এর সুন্নাতের বিরাট অংশ হইতে চিরদিনের তরে বঞ্চিত হইয়া যাইত, তাহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।