তৃতীয় হিজরী শতকের কয়েকজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস
তৃতীয় শতকে সারা মুসলিম জাহানে সমাধিক খ্যাতিসম্পন্ন অগাধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ কয়েকজন মুহাদ্দিসের আবির্ভাব ঘটে। হাদীস সমৃদ্ধ ও স্থান ও শহরসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করার পর এই বিশিষ্ট হাদীসবিদদের সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা একান্তই আবশ্যক। অন্যথায় এই শতকের হাদীসের ব্যাপক প্রসারতা ও অপূর্ব উৎকর্ষতা লাভ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সম্যক ধারণা করা সম্ভব হইবে না। এই পর্যায়ে যে কয়জন মুহাদ্দিসের নাম বিশেষভাব উল্লেখযোগ্য, তাঁহারা হইতেছেনঃ (১) আলী ইবনুল মাদানী (২) ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (৩) আবূ জুরয়া-আর-রাযী (৪) আবূ হাতেম আর-রাযী (৫) মুহাম্মদ ইবনে জরীর আততাবারী (৬) ইবনে খুযাইমা (৭) মুহাম্মদ ইবনে সাআদ (৮) ইসহাজ ইবনে রাহওয়াই (৯) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)।
আলী ইবনুল মাদীনী (র)
আলী ইবনুল মাদীনী একজন বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। হাদীস শিক্ষায় যাঁহারা তাঁহার উস্তাদ ছিলেন, তাঁহাদের তালিকা দীর্ঘ। তাহা দেখিলে সহজেই ধারণা করা যায় যে, তিনি হাদীস শিক্ষায় অদম্য উৎসাহে দেশ-দেশান্তর পরিভ্রমণ করিয়াছেন।মক্কা, মদীনা, বাগদাদ, কূফা প্রভৃতি হাদীসকেন্দ্র ও হাদীস- সমৃদ্ধ শহরসমূহ ঘুরিয়া তিনি রাসূল (স)-এর হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছেন। ইয়েমেন শহরে তিনি এই উদ্দেশ্যেই একাধিক্রমে তিন বৎসর কাল অতিবাহিত করেন। কিন্তু ইয়েমেনে অবস্থানের সময় তিনি হাদীসের প্রাথমিক ছাত্র ছিলেন না, বরং ইহার পূর্বেই তিনি হাদীসের এক বিরাট সম্পদ স্বীয় বক্ষে ধারণা করিয়া লইয়াছিলেন।[********************] তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জাফর, হাম্মাদ ইবনে যায়দ, আবূ দাউদ তায়ালিসী ও সাঈদ ইবনে আমের প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন।
হাদীস গ্রহনের ব্যাপারে তিনি অতিশয় সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। তিনি উব্বাদ ইবনে সুহাইব নামক একজন বর্ণনাকারী সূত্রে ত্রিশ হাজার হাদীস সংগ্রহ করিয়াছিলেন; কিন্তু পরে তাঁহার সত্যবাদিতা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহের সৃষ্টি হওয়ায় তিনি উহা সবই প্রত্যাখ্যান ও আগ্রাহ্য করিলেন।[********************]
তিনি একজন দক্ষগ্রন্হ প্রণেতা ছিলেন, হাদীস সম্পর্কিত ইলমের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তিনি বহু সংখ্যক গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইতিপূর্বে অপর কোন মুহাদ্দিসই এইসব বিষয়ে কোন গ্রন্হ রচনা করেন নাই।[********************]
তিনি ১৬১ হিজরী সনে বসরা নগরে জন্মলাভ করেন এবং হিজরী ২৩৪ সনে ইন্তেকাল করন।[********************]
ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন (র)
ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন ইলমে হাদীসের এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পরই তিনি হাদীস শিক্ষার দিকে মনোযোগ দেন এবং সে জন্য তিনি স্বীয় জান ও মাল সবকিছু অকাতরে উৎসর্গ করেন। তাঁহার পিতার নিকট হইতে প্রাপ্ত এক লক্ষ মুদ্রা তিনি এই হাদীস শিক্ষার কাজে ব্যয় করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এতই দরিদ্র ও নিঃস্ব হইয়া পড়েন যে, পায়ের জুতা সংগ্রহ করাও তাঁহার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি নিম্নলিখিত শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়াছেনঃ (ক) আবদুস সালাম ইবনে হারব (খ) আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (গ) ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদুল কাত্তান (ঘ) অকী ইবনে জাররাহ (ঙ) আবদুর রহমান ইবন মাহদী (চ) সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (ছ) হিশাম ইবনে ইউসুফ এবং আরো অনেক।[********************]
ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন হাদীস শুধুমাত্র শ্রবণ করিয়াই ক্ষান্ত হইতেন না, সঙ্গে সঙ্গে উহা লিখিয়াও রাখিতেন। আলী ইবনে মাদানী বলেনঃ ইবনে মুয়ীন মত হাদীস লিখিয়া লইয়াছেন, তত আর কেহ লিখেন নাই। ইবনে মুয়ীন নিজেই বলিয়াছেনঃ
আমি নিজের হাতে লক্ষ লক্ষ হাদীস শ্রবণ করিয়া লিপিবদ্ধ করিয়াছি। তিনি যে কেবল লিখিয়া লইতেন তাহাই নয়, প্রত্যেকটি হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া সে সম্পর্কে গভীর চিন্তা ও গবেষণা করিতেন, উহার যথাথর্ততা যাচাই ও পরীক্ষা করিতেন।[********************]
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন যেটিকে হাদীস মনে করন না, তানা মূলত হাদীসই নহে।
তিনি ২৩৩ হিজরী সনে মদীনা শরীফে ইন্তেকাল করেন।[********************] হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞানে তাঁহার অপূর্ব অবদান সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হইবে।
আবূ জুরয়া আর-রাযী (র)
আবূ জুররা হাদসের একজন বিখ্যাত হাফেজ ছিলেন। ইমাম আবূ দাউদ ছাড়া সিহাহ-সিত্তার অপর পাঁচজন মুহাদ্দিসই তাঁহার ছাত্র। তাঁহার সম্পর্কে হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
আবূ জুরয়া স্মরণশক্তি, প্রতিভা ও মেধাশক্তি, ইসলামী ইলম, দ্বীন পালন ও সহীহ আমলের দিক দিয়া অতুলনীয় ছিলেন।[********************]
আবূ জুরয়া ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভের জন্য মক্কা, মদীনা, ইরাক, সিরিয়া, জযীরা, খোরাসান ও মিসর পরিভ্রমণ করিয়াছেন। তিনি একলক্ষ সনদের হাদীস লিখিয়াছিলেন। তাঁহার সম্পর্কে মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের সাক্ষ্য এইঃ
******************************************************
তিনি সাত লক্ষ হাদীস মুখস্ত রাখিতেন।[********************]
আবূ জুরয়া ২০০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৬৪ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]
আবূ হাতেম আর-রাযী (র)
ইমাম আবূ হাতেম আর-রাযী হাদীসের বিশেষ পারদর্শী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ইমাম বুখারীর সমপর্যায়ের মুহাদ্দিস। ১৯৫ হিজরী সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, ২০৯ হিজরীতেই তিনি হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরে বহির্গত হন। তিনি এই সফরে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করিয়াছিলেরন। তিনি বাহরাইন হইতে মিসর, মিসর হইতে রমলা, রমলা হইতে দামেশক, এবং সেখান হইতে তরসুম পদব্রজে সফর করিয়াছেন। অতঃপর হিমস প্রত্যাবর্তন করিয়া মক্কায় উপনীত হন। সেখান হইতে রওয়ানা হইয়া ইরাকে পৌঁছেন। এই দীর্ঘ সফর যখন তিনি সমাপ্ত করেন, তখন তাঁহার বয়স মাত্র ২০ বৎসর। তিনি তাঁহার পুত্র আবদুর রহমানকে একবার বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হে প্রিয় পুত্র! আমি হাদীসের সন্ধানে পায়ে হাটিয়া হাজার ফার্লং-এর বেশী পথ অতিক্রম করিয়াছি।[********************]
ইরাকে পৌঁছিয়া বসরা শহরে তিনি আটমাস পর্যন্ত অবস্থান করেন। এখানে নিদারুন অর্থাভাবে পতিত হওয়ার কারণে তিনি স্বীয় ব্যবহার্য পোশাক-পরিচ্ছদ পর্যন্ত বিক্রয় করিতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত উপবাস থাকিতে বাধ্য হন। কিন্তু এই কঠিন দারিদ্র ও নিদারুণ নিঃস্বতায় প্রপীড়িত হইয়াও তিনি হাদীস শিক্ষার কাজ অব্যাহতভাবে করিয়া গিয়াছেন। বস্তুত এইরূপ কষ্ট স্বীকার করিয়াই তিনি ইলমে হাদীস শিক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত হাদীসের এক প্রখ্যাত হাফেজ ও বিশেষ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ইমাম হওয়ার মর্যাদা লাভ করিতে সমর্থ হন।[********************]
মুহাম্মদ ইবনে জরীর আত-তাবারী (র)
ইবনে জরীর প্রসিদ্ধ হাদীসবিদ ও কুরআন মজীদের তাফসীর লেখক। তিনি ২২৪ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমাম তিরমিযী ও নাসায়ী পর্যায়ের মুহাদ্দিস রূপে গণ্য। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উস্তাদদের নিকট হইতে তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস শিক্ষা সংগ্রহ করেন। তাঁহার নিকট হইতেও বড় বড় মুহাদ্দিসগণ হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে আহমদ ইবনে কামেল, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ শাফেয়ী ও মাখলাদ ইবনে জাফর প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ উল্লেখযোগ্য। ইবনে জরীর তাফসীর, হাদীস ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বহু সংখ্যক মূল্যবান ও বিরাট বিরাট গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।তিনি হাদীস গ্রন্হ সংকলন করিয়াছেন বলিয়া ইবনে কাসীর উল্লেখ করিয়াছেন। হিজরী ৩১০ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন।[********************]
ইবনে খুযাইমা (র)
তাঁহার পূর্ণ নাম হইতেছে মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর ইবনে খুযাইমা নিশাপুরী। তিনি হাদীসের একজন বড় ইমাম ছিলেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি রায়, বাগদাদ, বসরা, কূফা, সিরিয়া, জযীয়া, মিসর ও ওয়াসত প্রভৃতি স্থানসমূহ সফর করেন এবং বহু সংখ্যক খ্যাতনামা হাদীসবিদদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করেন। তাঁহার ওস্তাদের মধ্যে ইসহাক ইবনে রাহওয়াই ও মুহাম্মদ ইবনে হুমাইদ আর-রাযী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
তিনি হাদীস শিক্ষার জন্য বিশেষ উৎসাহ ও সংকল্পপরায়ণ ছিলেন। ইমাম দারে কুতনী তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
ইবনে খুযাইমা হাদীসের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ইমাম ছিলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী। তাঁহার কোন তুলনা পাওয়া যায় না।
তিনি হাদীস ও দ্বীনি মাসয়ালা মাসায়েল সম্পর্কে বিপুল সংখ্যক গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। হিজরী ৩১১ সনে তাঁহার ইন্তেকাল হয়।[********************]
মুহাম্মদ ইবনে সায়াদ (র)
ইবনে সায়াদ একজন বড় ঐতিহাসিক ও জীবনীকার হিসাবে প্রসিদ্ধ হইলেও তিনি তৃতীয় হিজরী শতকের একজন বড় মুহাদ্দিসি ছিলেন। তিনি বসরা শহরে ১৬৮হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। বসরার বড় মুহাদ্দিসগণের নিকট হইতে তিনি হাদীস শ্রবণ করেন। অতঃপর কূফা, ওয়াসত, বাগদাদ, মক্কা-মদীনা, সিরিয়া, ইয়েমেন, মিসর ও মুসলিম জাহানের অন্যান্য বড় বড় শহর-নগর সফর করিয়া বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও শিক্ষা করেন। তাঁহার নিকট হইতেও বহু খ্যাতিমান মুহাদ্দিস হাদীস শিক্ষা ও বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
তিনি বিপুল ইলমের অধিকারী ছিলেন। বহু সংখ্যক গ্রন্হের প্রণেতা ছিলেন। তাঁহার গ্রন্হাবলী ছিল হাদীস, ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়ক।[********************]
ইবনে সায়াদ হাদীস বর্ণনাকারীদের নিকট বড়ই প্রিয় মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি তদানীন্তন সমাজের কোন ফিতনায় লিপ্ত হন নাই। ফলে তাঁহার পক্ষে ইলম বিস্তার ও প্রসারতার জন্য এবং পূর্ববর্তী ইলমকে পরবর্তীকালের মানব সমাজের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভবপর হইয়াছে।[********************]
ইসহাক ইবনে রাহওয়াই (র)
ইসহাক তাবে-তাবেয়ীন যুগের একজন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। তিনি সর্বপ্রথম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারকের নিকট হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে উপস্থিত হন। কিন্তু তাঁহার অল্প বয়স এই পথের প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়ায়। অতঃপর তিনি হাদীস শিক্ষার অন্যান্য কেন্দ্রের সন্ধানে বাহির হইয়া পড়েন। এই কেন্দ্রসমূহ একটি হইতে অন্যটি শতসহস্র মাইলি দূরে অবস্থিত ছিল। ইবনে রাহওয়াই এই দূরাতিক্রম্য পথে পর্যটন শুরু করেন এবং বড় বড় হাদীসবিদ মনীষীদের নিকট হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। মুসলিম জাহানের যেসব প্রদেশে এই হাদীস কেন্দ্রসমূহ অবস্থিত ছিল, তন্মধ্যে ইরাক, হিজায, ইয়েমেন, মক্কা ও সিরিয়া উল্লেখযোগ্য। ইহার এক-একটি শহরে শত শত হাদীস শিক্ষা কেন্দ্র বিরাজিত ছিল। ইমাম ইসহাক এই সবের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটি কেন্দ্রেই উপস্থিত হইয়াছেন এবং হাদীস সম্পদ শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছেন।
এই চেষ্টা-সাধনাকে দ্বিগুণ কার্যকর ও কল্যাণময় করিয়া দিয়াছিল তাঁহার অনন্যসাধারণ তীক্ষ্ম স্মরণশক্তি। অসংখ্য হাদীস তাঁহার মুখস্থ ছিল। কয়েক সহস্র হাদীস তিনি ছাত্রদিগকে মুখস্থ শুনাইতে ও তাহাদিগকে লিখাইয়া দিতেন। এইজন্য তাঁহাকে কখনো কিতাব দেখিতে হইত না। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি যাহা কিছু শুনি, তাহা সই মুখস্থ করিয়া লই এবং যাহা মুখস্থ করি, তাহা আর কখনো ভুলিয়া যাই না।
তিনি ১৬১ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন ও হিঃ ২৩৮ সনে নিশাপুরে ৭৭ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল কারেন।[********************]
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) ইলমে হাদীসে এক অনন্য সাধারণ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ও সুদক্ষ মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি ১৬৪ হিজরী সনে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি ইমাম আবূ ইউসুফের মজলিসে শরীক হইতে শুরু করেন। পরে হিঃ ১৮৭ সনে তিনি হাদীস শিক্ষায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মুসিলম জাহানের সবকয়টি শহর ও অঞ্চল সফর করিয়াছেন।
প্রথমে বাগদাদের মুহাদ্দিসদের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শিক্ষা করিতে শুর করেন। এই পর্যায়ে তাঁহার হাদীসের উস্তাদ হইতেছেন হুশাইম ইবনে বশীর ইবনে আবূ হাযেম (মৃঃ ১৮৩ হিঃ)। তাঁহার খিদমতে তিনি একদিক্রমে চার বৎসর পর্যন্ত অব্স্থান করেন- ১৬ বৎসর বয়স হইতে ২০ বৎসর পর্যন্ত, (১৭৯-১৮৩হিঃ)।[********************] এই সময়ে তিনি বাগদাদের অপর একজন মুহাদ্দিস উমাইর ইবনে আবদুল্লাহ ইবেন খালিদ হইতে যথেষ্ট সংখক হাদীস শ্রবণ করেন। আবদুর বহমান ইবনে মাহাদী ও আবূ বকর ইবনে আইয়াশ নামক অপর দুইজন মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিখিয়াছেন বলিয়া উল্লেক করা হইয়াছে।[********************]
১৮৬ হিঃ সনে তিনি হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণ শুরু করেন। প্রথমে বসরা গমন করেন,তারপর হিজায উপস্থিত হন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইয়েমেন ও কূফা শহরেও গমন করেন। বসরা শহরে তিনি পরপর পাঁচবার উপস্থিত হন। কোন কোন বার তখায় তিনি ক্রমাগতভাবে তিন মাস করিয়া অবস্থান করেন। হিজাযেএ তিনি পাচঁবার গমন করিয়াছেন। বিদেশে এইসব সফরের মূলে তাঁহার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করা। বস্তুতপক্ষে এই সময়কার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছেন।[********************]
ইমাম আহমদ হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের অভিযানে প্রথম হইতেই একটি নীতি পালন করিয়া চলিতেন। তাহা হইতেছে হাদীস শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে উহাকে লিখিয়া লওয়া। তিনি তাঁহার অসাধারণ স্মৃতিশক্তির উপর একান্তভাবে নির্ভর করিতেন না। বরং যাহাই শুনিতে পাইতেন তাহাই কাগজের উপর লিখিয়া লওয়া ছিল তাঁহার স্থায়ীভাবে অনুসৃত নীতি।[********************]
তাঁহার শ্রুত হাদীসসমূহ তাঁহার সম্পূর্ণ মুখস্থই থাকিত, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি কোন হাদীস স্বীয় পাণ্ডুলিপি না দেখিয়া কখনো বর্ণনা করিতেন না। কেহ কোন হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে- তাহা স্মরণ ও মুখস্থ থাকা সত্ত্বেও স্বীয় কিতাব খুলিয়া উহার সন্ধান করিতেন ও পরে তাহা সম্মুখে পড়িয়া শুনাইতেন। তিনি যখন কাহাকেও হাদীস লিখাইতেন তখন হাদীস লিখিত হওয়ার পর তাঁহাকে বলিতেনঃ যাহা লিখিয়াছ, তাহা পড়িয়া শুনাও। ইহার মূলে তাঁহার লক্ষ্য থাকিত যে, হাদীসের ভাষা ও শব্দে যেন কোনরূপ পার্থক্য হইতে না পারে।[********************]
এই যুগের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহাদের মধ্যে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম শাফেয়ী, আবদুর রাযযাক অকী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম শাফেয়ী হাদীসের সত্যতা নির্ণয়ের ব্যাপারে ইমাম আহমদের উপর পূর্ণমাত্রায় নির্ভর করিতেন। তাঁহাকে তিনি বলিয়াই রাখিয়াছেনঃ
******************************************************
হে আবূ আবদুল্লাহ ! আপনার দৃষ্টিতে যখনই কোন সহীহ হাদীস পৌঁছিবে আপনি তাহা আমাকে অবশ্যই জানাইবেন। আমি উহার ভিত্তিতে আমার ফিকাহর মাযহাব ঠিক করিব।[********************]
ইমাম আহমদ ২৩১ হিজরী সনে বাগদাদ নগরে ইন্তেকাল করেন।[********************]