ইলমে হাদীসের ছয়জন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি
ইমাম বুখারী (র)
ইমাম বুখারী (র)-এর পূর্ণ নাম আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম। তিনি মুসলিম অধ্যুীষত এবং ইসলাম সংস্কৃতি ও সভ্যতার লীলাকেন্দ্র বুখারা নগরে ১৯৪ হিজরীর ১৩ ই শওয়াল শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকালেই তাঁহার পিতা ইহলোক ত্যাগ করেন। মায়ের স্নেহময় ক্রোড়ে তিনি শৈশব লালিত পালিত হন। তিনি যখন মকতবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভে রত ছিলেন, সেই সময়েই তাঁহার মনে হাদীস শিক্ষালাভের উদগ্র বাসনা জাগ্রত হয়। এ্ই সম্পর্কে ইমাম বুখারী (র) নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
মতবের প্রাথমিক লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকার সময়ই হাদীস মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার মনে ইলহাম হয়।[********************]
এই সময় তাঁহার বয়স কত ছিল জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিয়াছেনঃ ‘দশ বৎসর কিংবা তাহারও কম।[********************]
একাদশ বৎসর বয়সে হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ইমাম বুখারীর বিস্ময়কর প্রতিভার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে। এই সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। এই সময় (******************** ) সুফিয়ান আবূয যুবাইর হইতে ও আবূয যুবাইর ইবরাহীম হইতে- এই বর্ণনা সূত্রে হাদীস জনসমক্ষে প্রচার করা হইতেছিল। তদানিন্তন মুহাদ্দিস দাখেলীর নিকট এই সূত্র শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলিয়া উঠিলেনঃ
এই সূত্র ঠিক নহে, কেননা -******************** – ‘আবূয যুবাইর ইবরাহীমের নিকট হইতে কোন হাদীস আদৌ বর্ণনা করেন নাই।
মুহাদ্দিস দাখেলী একাদশ বৎসরের এই বালকের স্পর্ধা দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তিনি বালককে ধমক দিলেন। তখন ইমাম বুখারী (র) বলিলেনঃ
******************************************************
আপনার নিকট মূল গ্রন্হ বর্তমান থাকিলে একবার তাহাই খুলিয়া দেখুন (ও আমার কথার সত্যতা যাচাই করুন)
# বুখারা নগর উজবেকিস্তান প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত। বর্তমানে এই নগরটি মধ্য এশিয়ার রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। মা- আরায়িন- নহর এলাকায় একটি প্রধান নগররূপে গণ্য- জীহুন নদীর তীরে। ইরানের সমরকন্দ হইতে ৩০০ কিলোমিটার দূরে।
ইমাম বুখারী বলিলেনঃ ‘এখানে এই সূত্রে ‘আবূয যুবাইর’ ভূল বলা হইতেছে, আসলে বর্ণনার সূত্র হইবে ‘যুবাইর ইবনে আদী ইবরাহীম হইতে- এইরূপ’।
অতঃপর মুহাদ্দিস দাখেলী মূল গ্রন্হ খুলিয়া দেখিলেন, বালক আবূ আবদুল্লাহর কথাই সত্য, মূল গ্রন্হে অনুরূপই লিখিত রহিয়াছে।[********************]
ইমাম বুখারী যখন ষোল বৎসর বয়স অতিক্রম করিয়াছিলেন তখন তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক ও ইমাম অকী’র সংকলিত হাদীসগ্রন্হ সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন।[********************]
ইহার পর ইমাম বুখারী তাঁহার মা ও ভাই সমাভিব্যাহারে হজ্জে গমন করেন। ইহার পূর্বে তিনি বুখারায় অবস্থানকারী সকল মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ সমাপ্ত করিয়াছিলেন। তাঁহার এই সফর অনুষ্ঠিত হয় ২১০ হিজরী সনে।[********************] হজ্জে আগমন করিয়া তিনি একাধারে ছয় বৎসর পর্যন্ত হিজাযে অবস্থান করেন। তখন তিনি একদিকে যেমন ব্যাপকভাবে হাদীস শিক্ষায় মনোযোগ দিয়াছিলেন, অনুরূপভাবে ইহার সঙ্গে সঙ্গেই তিন লেখনীও পরিচালনা করিয়াছিলেন পূর্ণমাত্রায়। ইমাম বুখারী তাঁহার এই সময়কার লেখন পরিচালনা ও গ্রন্হ প্রণয়ন সম্পর্কে নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি আঠারো বৎসর অতিক্রম করিতেছিলাম, তখন সাহাবী ও তাবেয়ীদের বিচার-ফয়সালা সম্পর্কে একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করি। অতঃপর আমি মদীনায়ী রাসূলে করীম (স)-এর কবরের নিকটে বসিয়া ‘আততারীখুল কবীর’ গ্রন্হ রচনা করি। আর চন্দ্রদীপ্ত রাত্রিতে এই লেখনীর কাজ চালাইতাম।[********************]
হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ইমাম বুখারী বহু দেশ ও শহর পরিভ্রমন করিয়াছেন। এক-একটি শহরে উপস্থিত হইয়া সম্ভাব্য সকল হাদীস তিনি আয়ত্ত করেন। তাঁহার পর তিনি অন্য শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এইভাবে বিশাল ইসলাম রাজ্যের উল্লেখযোগ্য কোন শহর এমন ছিল না, যেখানে তিনি উপস্থিত হইয়া হাদীস হাদীস সংগ্রহ করেন নাই। আল্লামা যাহবী এই প্রসঙ্গে বলেন, বাগদাদ, মক্কা, বসরা, কূফা, আসকালান, হিমস, দামেশক প্রভৃতি শহরের নাম উল্লেখ করিয়াছেন এবং কোন শহরের কোন মুহাদ্দিস হইতে ইমাম বুখারী হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাঁহার নামও লিখিয়া দিয়াছেন।[********************]
কিন্তু এই তালিকা সম্পূর্ণ নয় বলিয়াই মনে হয়। আল্লামা খতীব বাগদাদী ইমাম বুখারীর এই দেশ সফর সম্পর্কে এক কথায় বলিয়াছেনঃ
******************************************************
ইলমে হাদসের সন্ধানে সমগ্র শহরের সকল মুহাদ্দিসের নিকটই তিনি উপস্থিত হইয়াছেন।[********************]
তাঁহার এই পরিভ্রমন সম্পর্কে একটি ব্যাপক ধারণা দানের উদ্দেশ্যে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি সিরিয়া,মিসর ও জযীরায় দুই দইবার করিয়া উপস্থিত হইয়াছি। বসরা গিয়াছি চারবার। হিজাযে ক্রমাগত ছয় বৎসর পর্যন্ত অবস্থান করিয়াছি। আর কূফা ও বাগদাদে যে আমি কতবার গমন করিয়াছি ও মুহাদ্দিদের খিদমতে হাযির হইয়াছি, তাহা আমি গণনা করিতে পারিব না।[********************]
ইমাম বুখারী (র) একবার সমরকন্দে উপস্থিত হইলেন। তখন প্রায় চারশত মুহাদ্দিস তাঁহার সম্মুখে সমবেত হন। তাঁহারা ইমাম বুখারীর হাদীস সম্পর্কে গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের খ্যাতি পূর্বেই শুনিতে পাইয়াছিলেন। এই কারণে তাঁহারা ইমাম বুখারীকে পরীক্ষা করিতে ইচ্ছা করিলেন। তাঁহারা এই উদ্দেশ্যে কতকগুলি হাদীসের মূল বাক্যাংশ উহার সনদ সূত্র হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া অপর একটি হাদীসের সনদের সহিত জুড়িয়া দিলেন এবং সনদগুলিও উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া রাখিলেন। অতঃপর ইহা ইমাম বুখারী (র)-এর সম্মুখে পাঠ করেন এবং উহার সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করার জন্য তাঁহাকে অনুরোধ করেন। ইমাম বুখারী (র)-র নিকট এই সমস্ত হাদীসই ছিল দর্পণের মত উজ্জ্বল। কাজেই কোথায় মূলকথা ও উহার সনদে ওলট-পালট করা হইয়াছে, তাহা তাঁহার বুঝিতে এতটুকু অসুবিধা হইল না, এতটুকু সময়ও লাগিল না। তিনি এক একটি হাদীস পাঠ করিয়া উহার দোষক্রটি উল্লেখ করিতে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি হাদীসকে তিনি উহার আসল রূপে উহার নিজস্ব সনদসহ সজ্জিত করিয়া সমাগত মুহাদ্দিসগণের সম্মুখে পেশ করিলেন। মুহাদ্দিসগণ ইমাম বুখারী (র)-এর এই জওয়াবকে একান্তু সত্য বলিয়া গ্রহণ না করিয়া পারিলেন না। ঐতিহাসিকগণ লিখিয়াছেন, বাগদাদেও ইমাম বুখারীর প্রতি অনুরূপ প্রশ্ন করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত জবাব শুনিয়া মুহাদ্দিসগণ ইমাম বুখারী (র)-এর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিতে বাধ্য হন।[********************]
ইমাম বুখারীর তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির কথা উল্লেখ করিয়া বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
তিনি একবার মাত্র কিতাব পড়িতেন এবং একবার দেখিয়াই সমস্ত কিতাব মুখস্থ করিয়া ফেলিতেন।[********************]
হাদীসে তাঁহার যে কি বিপুল,ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান ছিল, তাহা দুনিয়ার মুহাদ্দিসদের অকপট স্বীকৃতি হইতেই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। এখানে কয়েকজনের উক্তি উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ
ইবনে খুযায়মা (র) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আসমানের তলে রাসূলের হাদীসের বড় আলিম এবং উহার বড় হাফেজ মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈলুল বুখারী অপেক্ষা আর কাহাকেও আমি দেখি নাই।[********************]
ইমাম মুসলিম একদিন ইমাম বুখারী (র)-এর নিকট উপস্থিত হইলেন ও তাঁহার কপোলে চুম্বন করিলেন। বলিলেনঃ
******************************************************
আমাকে আপনার পদযুগল চুম্বন করার অনুমতি দিন হে সমস্ত উস্তাদের উস্তাদ মুহাদ্দিসদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং হাদসের ‘রোগের চিকিৎসক’।[********************]
ইমাম বুখারী অত্যন্ত ভদ্র, বীর ও পবিত্র স্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। আত্মসম্মানবোধে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ ও নিতান্ত চেতনাসম্পন্ন। তিনি রাজা-বাদশাহর দরবারের ধারই ধারিতেন না, উহা হইতে বরং শত যোজন দূরে থাকিতেন চেষ্টা করিতেন প্রাণপণে।
এই সময় বুখারার শাসনকর্তা ছিলেন খালিদ ইবনে আহমদ আয-যাহলী। তিনি ইমাম বুখারী (র)-এর নিকট লোক মারফত নির্দেশ পাঠাইলেনঃ
******************************************************
আপনি আপনার সংকলিত হাদীস-গ্রন্হ ও ইতিহাস-গ্রন্হ লইয়া আমর নিকট আসুন, আমি আপনার নিকট হইতে উহার শ্রবণ করিতে চাহি।
ইমাম বুখারী (র) এই নির্দেশ মানিয়া লইতে সুস্পষ্ট ভাষায় অস্বীকার করিলেন এবং দূতকে বলিয়া পাঠাইলেনঃ
******************************************************
বাদশাহকে আমার এই কথা পৌঁছাইয়া দাও যে, আমি হাদীসকে অপমান করিতে ও উহাকে রাজা- বাদশাহদের দরবারে লাইয়া যাইতে পারিব না। তাঁহার এই জিনিসের প্রয়োজন হইলে তিনি যেন আমার নিকট মসিজিদে কিংবা আমর ঘরে উপস্থিত হন। আর আমর এই প্রস্তাব তাঁহার পছন্দ না হইলে কি করা যাইবে, তিনি তো বাদশাহ……….।
ইবনে হাজার আসকালানী বলিয়াছেনঃ
******************************************************
ইহাই ইমাম বুখারী ও বাদশাহর মধ্যে দূরত্ব ও মনোমালিন্য সৃষ্টির কারণ হইয়া দাঁড়ায়।[********************]
কিন্তু ইমাম হাকেম এই মনোমালিন্যের অন্য কারণ উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আবূ আবদুল্লাহ যে কারণে বুখারা শহর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যান, তাহা এই যে, বাদশাহ খালিদ ইবনে আহমদ তাঁহাকে বাদশাহর প্রাসাদে উপস্থিত হইয়া তাঁহার সন্তানাদিগকেক ইতিহাস ও হাদীস-গ্রন্হ পড়াইবার আদেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইমাম বুখারী এই আদেশ পালন করিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন এবং বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, এই কিতাব আমি বিশেষভাবে কিছু লোককে শুনাইব ও কিছু লোককে শুনাইব না, তাহা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না।[********************]
অতঃপর ইমাম বুখারী (র) সমরকন্দের নিকটে অবস্থিত খরতংক নামক শহরে চলিয়া যান এবং আল্লাহর নিকট দ্বীন-ইসলামের এই কঠিন বিপদ হইতে তাঁহাকে রক্ষা করার জন্য আকুল আবেদন করেন। এই সময় রাত্রিকালে নামাযান্তে তিনি যে দোয়া করিতেন, তাহাতে তিনি বলিতেনঃ
******************************************************
হে আল্লাহ! এই বিশাল পৃথিবী আমার প্রতি সংকীর্ণ হইয়ায গিয়াছে অতএব এখন তুমি আমাকে তোমার নিকট লইয়া যাও।[********************]
ইমাম বুখারী এই খরতংক শহরে ২৫৬ হিজরী সনের ৩০শে রজব ৬২ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]
ইমাম বুখারী (র) ইহজগত ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন; কিন্তু পশ্চাতে বিশ্ব-মুসলিমের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন ইসলামী জ্ঞানের মূল উৎস হিসাবে কয়েকখানি অমূল্য ও বিরাট গ্রন্হ। তাঁহার মহামূল্য গ্রন্হাবলীর মধ্যে দুইখানি বিখ্যাত ও শ্রেষ্ঠ। একখানি ‘সহীহুল বুখারী’- হাদীস সংকলন এবং অপরখানি ‘তারীখুল কবীর’।[********************]
ইমাম মুসলিম (র)
ইমাম মুসলিম (র)-এর পূর্ণ নাম আবূল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী আন-নিশাপুরী। তিনি ২০৪ হিজরী সনে খুরাসান অন্তঃপাতী নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি মুসলিম জাহানের সব কয়টি কেন্দ্রই গমন করেন। ইরাক, হিজায, সিরিয়া, মিসর প্রভৃতি শহরে উপস্থিত হইয়া তথায় অবস্থানকারী হাদীসের বড় বড় উস্তাদও মুহাদ্দিসদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন।
ইমাম বুখারী (র) যখন নিশাপুর উপস্থিত হন, তখন ইমাম মুসলিম (র) তাঁহার সঙ্গ ধারণ করেন। তাঁহার বিরাট হাদীস জ্ঞান হইতে তিনিও যথেষ্ট মাত্রায় অংশগ্রহন করেন। এই শহরে ইমাম বুখারী (র)-এর বিরুদ্ধে প্রবণ প্রচারণা চলিতে শুরু করিলে ইমাম মুসলিম ইহার প্রতিরোধ করিত চেষ্টিত হন। একদিন একটি ঘটনা ঘটিয়া যায়। তিনি তাঁহার হাদীসের উস্তাদ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া আযলীর মজলিসে অন্যান্য শিক্ষার্থীর সহিত উপস্থিত ছিলেন। মুহাদ্দিস যাহলী সহসা ঘোষণা করেনঃ
******************************************************
বিশেষ একটি মাসায়ালায় যে লোক ইমাম বুখারীর মত বিশ্বাস করে ও তাঁহার রায় কবুল করে, সে যেন আামার এই মজলিস হইতে উঠিয়া যায়।
ইহা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে ইমাম মুসলিম উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং নিজের ঘরে ফিরিয়া আসিয়া এই উস্তাদের নিকট হইতে শ্রুত ও গৃহীত হাদীসসমূহের লিখিত সম্পদ ফেরত পাঠাইয়া দিলেন। অতঃপর তিনি যাহলীর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করেন।[********************]
ইমাম মুসলিম হাদীস সম্পর্কে বিরাট ও বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি যে হাদীসের ইমাম ছিলেন। এ বিষয়ে হাদীসজ্ঞ ব্যক্তিগণ সম্পূর্ণ একমত।[********************] সেকালের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্সা ও গ্রহণ করিয়াছেন। এই পর্যায়ে আবূ হাতিম আর-রাযী, মূসা ইবনে হারুন, আহমদ ইবনে সালমা, ইয়াহইয়া ইবনে সায়েদ, মুহাম্মদ ইবনে মাখলাদ এবং ইমাম তিরমিযী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহারা ইমাম মুসলিমের বিরাটত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে একমত। হাদীসে ইমাম মুসলিমের অতি উচ্চ মর্যাদা ও স্থানের কথা তাঁহারা সকলেই স্বীকার করিয়াছেন। উপরস্তু ইমাম মুসলিম (র)-এর মহামূল্য গ্রন্হাবলী ও তাঁহার গভীর পাণ্ডিত্যের কথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। তন্মধ্যে তাঁহার সহীহ মুসলিম, আল-মুসনাদুল কবীর ও আল-জামেউল কবীর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইমাম মুসলিম ২৬১ হিজরী সনে ৫৭ বৎসর বয়সে নিশাপুরে ইন্তেকাল করেন।[********************]
ইমাম নাসায়ী (র)
ইমাম নাসায়ী (র)-এর পূর্ণ নাম আবদুর রহমান আমদ ইবনে শুয়াইব ইবনে আলী ইবনে বাহর ইবনে মান্নান ইবনে দীনার আন-নাসায়ী। খুরাসান অন্তঃপাতী নাসা নামক শহরে ২১৫ হিজরী সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।[********************]
ইমাম নাসায়ী (র) হাদীসরে বড় হাফেজ ছিলেন। হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি পনের বৎসর বয়সেই বিদেশ সফরে গমন করেন। প্রথমে তিনি কুতাইবা ইবনে সায়ীদুল বালখীর নিকট উপস্থিত হন এবং এক বৎসর দই মাস কাল তথায় অবস্থান করিয়া তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। অতঃপর তিনি মিসর গমন করেন। মিসরে তিনি দীর্ঘকাল অবস্থান করেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি কয়েকখানি গ্রন্হ প্রণয়ন সমাপ্ত করেন। এই গ্রন্হসমূহ জনগনের মধ্যে বিশেষ খ্যাতি লাভ করে। লোকেরা তাঁহার নিকট হইতে এই সময়ই হাদীস শ্রবণ করিতে শুরু করে।
মিসর হইতে বাহির হইয়া ৩০২ হিজরী সনে তিনি দামেশক উপস্থিত হন। এখানে তিনি হযরত আলী ও খান্দানের রাসুলের প্রশংসামূলক গ্রন্হ রচনা সমাপ্ত করেন। তিনি দেখিতে পাইয়াছিলেন যে, উমাইয়া বংশের শাসন-প্রভাবে জনগণ হযরত আলী (রা) ও রাসূল (স)-এর খান্দানের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করিতে শুরু করিয়াছেন। তিনি এই প্রবণতা দূরীভূতকরণ কিংবা উহার প্রচণ্ডতা হ্রাস করার উদ্দেশ্যে দামেখকের জামে মসজিদে তিনি উহা পাঠ করিতে শুরু করিলে এক ব্যক্তি উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলঃ আপনি মুয়াবিয়ার প্রশংসাসূচক কিছু লিখিয়াছেন কি? ইমাম নাসায়ী বলিলেনঃ ‘মুয়াবিয়া সমান সমানে নিষ্কৃতি পাইলেই তাঁহার পক্ষে যথেষ্ট। তাঁহার প্রশংসা করার কি আছে?
এই কথা বলা সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে হইতে আওয়াজ উঠিলঃ ‘এই লোক শিয়া, এই লোক শিয়া’। এই বলিয়া তাঁহাকে বেদম প্রহার করিতে থাকে। ইহাতে ইমাম নাসায়ী মারাত্মক আহত ও কাতর হইয়া পড়েন। তিনি বলিলেনঃ আমাকে তোমরা মক্কা শরীফ পৌঁছাইয়া দাও, যেন শেষ নিঃশ্বাস সেখানেই ত্যাগ করিতে পারি। তাঁহাকে মক্কায় পৌঁছানো হইলে তিনি তথায় হিঃ ৩০৩ সনে ৮৯ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন এবং সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে তাঁহাকে দাফন করা হয়।[********************]
ইমাম নাসায়ী হাদীস ও ইলমে হাদীস সম্পর্কিত বিষয়ে বহু মুল্যবান গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ‘সুনানে কুবরা’ ও ‘সুনানে সুগনা’- যাহাকে ‘আল মুজতাবা’ও বলা হয়- প্রভৃতি তাঁহার প্রসিদ্ধ গ্রন্হ।[********************]
ইমাম আবূ দাউদ (র)
ইমাম আবূ দাউদের পূর্ণ নাম সুলাইমান ইবনুল আশযাস ইবনে ইসহাক আল আসাদী আস-সিজিস্তানী। কান্দাহার ও চিশত-এর নিকটে সীস্তান নামক এক স্থানে তিনি ২০২ হিজরী সনে (৮১৯ খৃঃ) জন্মগ্রহণ করেন।[********************]
হাদীস শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে মিসর, সিরিয়া, হিজাজ, ইরাক ও খুরাসান প্রভৃতি প্রখ্যাত হাদীস-কেন্দ্রসমূহ পরিভ্রমন করেন এবং তদানীন্তন সুবিখ্যাত মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, উসমান ইবনে আবূ সাইবা, কুতাইবা ইবনে সায়ীদ প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসগণই হইতেছেন তাঁহার ইলমে হাদীসের উস্তাদ।[********************]
হাদীসে তাঁহার যে অসাধারণ জ্ঞান ও গভীর পারদর্শিতা ছিল, তাহা এ যুগের সকল মনীষীই উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করিয়াছেন এবং তাঁহার তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির প্রশংসা করিয়াছেন। সেই সঙ্গে তাঁহার গভীর তাকওয়া ও পরহেজগারীর কথাও সর্বজনস্বীকৃতি লাভ করিয়াছেন।
ইমাম হাকেম বলিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম আবূ দাঊদ তাঁহার যুগে হাদীসবিদদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁহার এই শ্রেষ্ঠত্ব ছিল নিরংকুশ ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি মিসর, হিজাজ, কূফা ও বসরা এবং খোরাসানে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন।[********************]
ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসায়ী হাদীসে তাঁহার ছাত্র। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল একদিকে ইমাম আবূ দাউদ (র)-এর উস্তাদ, অপর দিকে ইমাম আহমদ (র)-এর কোন কোন উস্তাদ ইমাম আবূ দাউদ হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আহমদ নিজেও কোন কোন হাদীস ইমাম আবূ দাউদ হইতে গ্রহণ ও বর্ণনা করিয়াছেন।
তিনি ২৭৫ হিজরী সনের ১৬ই শাওয়াল বসরা নগের ইন্তেকাল করেন।
ইমাম তিরমিযী (র)
ইমা তিরমিযীর পূর্ণ নাম আল-ইমামুল হাফেজ আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা ইবনে সওরাতা ইবনে মুসা ইবনে জাহকুস সুলামী আত-তিরমিযী। তিতি জীহুল নদীর বেলাভুমে অবস্থিত তিরমিযী নামক প্রাচীন শহরে ২০৯ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাদীসে অপরিসীম জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাঁহা বর্ণিত হাদীসসমূহ সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাস্য ও অকাট্য দলিল হিসাবে গণ্য। তিনি তাঁহার সময়কার বড় বড় হাদীসবিদদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও গ্রহণ করিয়াছেন। কুতাইবা ইবনে সায়ীদ, ইসহাক ইবনে মূসা, মাহমুদ ইবনে গালীন, সায়ীদ ইবনে আবদুর রহমান, মুহাম্মদ ইবন বিশ্বার, আলী ইবনে হাজার, আহমদ ইবনে মুনী, মুহাম্মদ ইবনুল মাসান্না, সুফিয়ান ইবন অকী এবং মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইলুল বুখারী প্রমুখ মুহাদ্দিস ইমাম তিরমিযীর উস্তাদ।[********************]
ইমাম বুখারী তাঁহার সম্পর্কে অনেক প্রশংসাসূচক কথা বলিয়াছেন। মুহাদ্দিসগণ তাঁহাকে ইমাম বুখারীর খলীফা বলিয়া উল্লেক করিয়াছেন। ইমাম বুখারী নিজেও তাঁহার নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনা করিয়াছেন।[********************]
ইমাম তিরমিযী মুসলিম জাহানের প্রখ্যাত হাদীস-কেন্দ্রসমূহ সফর করিয়া হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছেন। কূফা, বসরা, রাই, খুরাসান, ইরাকও হিজাযে হাদীস সংগ্রহের জন্য তিনি বছরের পর বছর পরিভ্রমন করিত থাকেন।
ইমম তিরমিযী তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন। একারব শুনিয়াই তিনি বহু সংখ্যক হাদীস মুখস্থ করিয়া লইতে সমর্থ হইতেন। জনৈক মুহাদ্দিসের বর্ণিত কয়েকটি হাদীসাংশ তিনি শ্রবণ করিয়াছিলেন; কিন্তু সেই মুহাদ্দিসের সহিত তাঁহার কোন দিন সাক্ষাৎ ছিল না, তাঁহার মুখেও তাহা শ্রবণ করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। ফলৈ তিনি মনে মনে সেই মুহাদ্দিসের সন্ধানে উদগ্রীব হইয়াছিলেন। একদিন পথিমধ্যে তাঁহার সাক্ষাৎ পাইয়া তাঁহার নিকট হইতে সম্পূর্ণ হাদীস শ্রবণের বাসনা প্রকাশ করিলেন। তিনি তাঁহার অনুরোধক্রমে সমস্ত হাদীস পথের মধ্যে দাঁড়াইয়া থাকা অবস্থায়ই মুখস্থ পাঠ করিলেন, ইহা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসসূহ ইমাম তিরমিযী এই হাদীসসমূহ ইতিপূর্ব কখনো শুনি তে পান নাই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই একবার মাত্র শ্রবণ করিয়া তাহা সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইলেন এবং তখনি একবার পাঠ করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান উস্তাদকে শুনাইয়া দিলেন। ইহাতে তাঁহার একটি শব্দেরও ভূল ছিল না।[********************]
ইমাম তিরমিযী বহু মূল্যবান গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। আল জামেউত তিরমিযী, কিতাবুল আসাম, আলকুনী, শামায়েলুত তিরমিযী, তাওয়ারীখ ও কিতাবুয যুহদ প্রভৃতি তাঁহার যুগান্তকারী গ্রন্হ।[********************]
শেষ জীবনে ইমাম তিরমিযীর দৃষ্টিশক্তি বিলুপ্ত হয়। তিরমিয শহরেই তিনি ২৭৯ হিজরী সনে সত্তর বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]
ইমাম ইবনে মাজাহ (র)
ইমাম ইবনে মাজাহর পূর্ণ নাম আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়যিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাজাহ আল কাজভীনী। হাদীস, তাফসীর ও ইতিহাস সম্পর্কে তিনি অতীব বড় আলিম ছিলেন।
তিনি ২০৯ হিজরী সনে (৮২৮ খৃঃ) ‘কাজভীন’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।[********************] এই শহর তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান (রা)-এর সময় বিজিত হওয়ার পর হইতেই ইসলামী জ্ঞানে-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে গণ্য। তৃতীয় হিজরী শতকের শুরু হইতেই ইহা ইলমে হাদীসের চর্চায় বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে; ফলে ইবনে মাজাহ বাল্যকাল হইতেই হাদীস শিক্ষার অপূর্ভ সুযোগ লাভ করেন। এই সময় কয়েকজন বড় বড় মুহাদ্দিস কাজভীন শহরে হাদীসের দারস দিতেন। তন্মধ্যে তিনি আলী ইবনে মুহাম্মদ আবুল হাসান তানাফেসী (মৃঃ ২৩৩ হিঃ), আমর ইবনে রাফে’ আবূ হাজার বিযলী (মৃঃ ২৩৮ হিঃ), ইসমাঈল ইবনে তওবা আবূ সাহল কাজভীনী (মৃঃ ২৪৭ হিঃ), হারুন ইবনে মূসা ইবনে হায়ান তামীমী (মৃঃ ২৮৮ হিঃ) এবং মুহাম্মদ ইবনে আবূ খালেদ আবূ বকর কাজভীনী প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করেন।
অতঃপর তিনি মদীনা, মক্কা, কূফা, বসরা, বাগদাদ, ওয়াসাত, দামেশক, হিমস, মিসর, তিন্নীস, ইসফাহান, নিশাপুর প্রভৃতি হাদীসের কেন্দ্র স্থানসমুহ সফর করিয়া হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন। তাঁহার হাদীসের উস্তাদ অগণিত। তাঁহার নিকট হইতেও বিপুল সংখ্যক হাদীস-শিক্ষাথী হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন।
তিনি বহু গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। হাদীসের ভিত্তিতে কুরআন মজীদের একখানি বিরাট তাফসীর গ্রন্হও তিনি রচনা করেন। ‘তারিখে মলীহ’ তাঁহার অপর একখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্হ। ইহাতে সাহাবাদের যুগ হইতে গ্রন্হাকারের সময় পর্যন্ত বিস্তারিত ইতিহাস আলোচিত হইয়াছে। হাদীসে তাঁহার গ্রন্হ ‘আস সুনান’ সুবিখ্যাত ও সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভূক্ত এক বিরাট কিতাব। তিনি ২৭৩ হিজরী সনে (৮৮৬ খৃঃ০ সোমবার ৬৪ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]