চতুর্থ শতকে ইলমে হাদীস
হিজরীর চতুর্থ শতকে ইলমে হাদীস পূর্ণ পরিণতি লাভ করে। তৃতীয় শতকে ইলমে হাদীসের যে চর্চা ও উন্নয়ন সাধিত হয়, তাহা অতীত সকল কাজকে অতিক্রম করিয়া যায়। এই শতকেই অনেক বড় বড় মুহাদ্দিস, হাদীসের হাফেজ ও হাদীস বিজ্ঞানের ইমাম আবির্ভূত হন। বিশ্ব-বিশ্রুত ছয়খানি সহীহ হাদীস গ্রন্হেও এই শতকেই গ্রন্হাবদ্ধ হয় এবং সহীহ হাদীসসমূহ প্রায় সবই এই গ্রন্হাবলীতে সন্নিবদ্ধ হয়। প্রত্যেক হাদীসের সনদ, সনদে উল্লিখিত প্রত্যেক বর্ণনাকারীর জীবন-ইতিহাস ও চরিত্র সম্পর্কে বিস্তারিত ও পুংখানুপুংখ আলোচনা সম্বলিত বহু সংখ্যক গ্রন্হ এই শতকেই বিরচিত হয়। ফলে ইলমে হাদীস সর্বোতভাবে এক স্বয়ংসম্পুর্ণ বিজ্ঞান হিসাবে গড়িয়া উঠে।
চতুর্থ শতকে পূর্ব শতকেরই কাজ কর্মেরই জের চলিতে থাকে। তবে হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নে এই শতকে স্বতন্ত্রভাবে কোন কাজই সম্পাদিত হয় নাই এমন নহে। এই পর্যায়ে যাহা কিছু হইয়াছে তাহা প্রায় সবই পূর্ববর্তী হাদীসবিদদের নিকট হইতে প্রাপ্ত ও সংরক্ষিত হাদীসসমূহের ভিত্তিতে নূতন হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করা মাত্র। উপরন্তু তাহাতে সহীহ ও যয়ীফ হাদীসের মধ্যে পার্থক্য করার কাজও বিশেষ সতর্কতা সহকারে সম্পাদিত হয়।
এই শতকের অনেক মুহাদ্দিসই পূর্ববর্তীদের গ্রন্হাবলীতে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে রক্ষিত হাদীসসমূহ সংগ্রহ করেন। উহাতে দীর্ঘ সনদ-সূত্রসমূহকে সংক্ষিপ্ত করা হয়। উহার সজ্জায়ন ও সংযোজনের কাজ পূর্ণ দক্ষতার সহিত সম্পন্ন করা হয়। তাঁহাদের প্রায় সকলেরই কাজ পূর্বগামী মুহাদ্দিসের কাজের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু তবুও এই শতকে এমন কয়েকজন বড়বড় মুহাদ্দিসের আবির্ভাব ঘটে, যাঁহারা স্বাধীনভাবে পূর্বগামীদের রীতি অনুযায়ী স্বতন্ত্র হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। হাদীস বর্ণনা ও সনদ-সূত্র সন্ধানে তাঁহাদের গভীর পাণ্ডিত্য বর্তমান ছিল।[********************] তাঁহাদের সম্পর্কে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা যাইতেছেঃ
মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী (র)
মুহাদ্দিস হাকেম নিশাপুরী চতুর্থ হিজরী শতকের একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ। তিনি প্রধানত ইমাম বুখারী ও মুসলিমের গ্রন্হ প্রণয়নের পর অবশিষ্ট সহীহ হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও উহার ভিত্তিতে স্বতন্ত্র একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। উহার নাম হইতেছে ‘আল মুস্তাদরাক’।
ইহা সর্বজনবিদিত যে, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম যে দুইখানি হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, ইলমে হাদীসের জগতে তাহাই সর্বাধিক সহীহ। কিন্তু তাঁহার অর্থ এই নয় যে, সমস্ত সহীহ হাদীসই এই গ্রন্হদ্বয়ে সন্নিবেশিত হইয়াছে, উহার বাহিরে আর কোন সহীহ হাদীস থাকিয়া যায় নাই। বস্তুত উক্ত গ্রন্হদ্বয়ের উল্লিখিত হাদীসসমূহ সহীহ, কিন্তু উহার বাহিরেও বহু হাদীস এমন রহিয়া গিয়াছে যাহা গ্রন্হদ্বয়ের অন্তর্ভুক্ত হাদীসসমূহের সমান পর্যায়ের সহীহ। উপরোক্ত ইমামদ্বয় কোন হাদীসকে সহিহ বলিয়া গ্রহণ করার জন্য যে শর্ত আরোপ করিয়াছিলেন এবং সহীহ হাদীস বাছিয়া লইবার জন্য যে মানদণ্ড স্থাপন করিয়াছিলেন সেই শর্ত ও মানদণ্ডে উত্তীর্ণ আরো বহু হাদীস বাহিরে থাকিয়া গিয়াছিল। যাহা শুধু গ্রন্হদ্বয়ের আকার অসম্ভব রকমে বিরাট হইয়া যাওয়ার আশংকায় তাহাতে শামিল করা হয় নাই। ইমাম হাকেম এই ধরনের হাদীসসমূহ অনুসন্ধান করিয়া ও তুলাদণ্ডে ওজন করিয়া উহার সমন্বয়ে ‘মুস্তাদরাক’ নামে আলোচ্য গ্রন্হখানি প্রণয়ন করেন।[********************]
ইমাম হাকেম এতদ্ব্যতীত হাদীসের আরো কয়েকখানি মূল্যবান গ্রন্হ রচনা করেন। তাঁহার গ্রন্হাবলীর মোট খণ্ড হইতেছে এক হাজার পাঁচশত। তিনি হাদীসের সন্ধানে ইরাক ও হিজাযে দুইবার সফর করেন। এই সফরে তিনি বহু হাদীস সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করিয়াছেন। তিনি ৪০৫ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]
ইমাম দারে কুতনী (র)
দারে কুতনীর পূর্ণ নাম হইতেছে আলী ইবনে উমর ইবনে আহমদ। তিনি হাদীসের একজন যুগশ্রেষ্ঠ হাফেজ ও ইমাম। তিনি বহু সংখ্যক উস্তাদের নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করেন এবং তিনি উহার ভিত্তিতে তিনি বহু সংখ্যক উন্নতমানের গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। বিশেষত হাদীস যাচাই-পরীক্ষা করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অসাধারণ দক্ষতার অধিকারী। তাঁহার গ্রন্হ ‘আল-ইলজামাত’ মুস্তাদরাক- এর মতই এক অনবদ্য হাদীস গ্রন্হ। তাঁহার আর একখানি কিতাবের নাম ‘কিতাবুস সুনান’।
তিনি ৩০৬ হিজরী সনে বাগদাদের প্রখ্যাত ‘দারেকুতন’ মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি বাগদাদের সকল মহাদ্দিসের নিকট উপস্থিত হইয়াছেন এবং পরে এই উদ্দেশ্যেই তিনি কূফা, বসরা, সিরিয়া, ওয়াসিত, মিসর ও অন্যান্য হাদীস কেন্দ্রসমূহ পরিভ্রমন করেন। তিনি শৈশবকাল হইতেই অসাধারণ স্মরণশক্তি ও অনুধাবন শক্তিতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন। তিনি ৩৮৫ হিজরী সনে বাগদাদেই ইন্তেকাল করেন।[********************]
ইবনে হাব্বান (র)
তাঁহার পূর্ণ নাম হইতেছে মুহাম্মদ ইবনে হাব্বান আহমদ ইবনে হাব্বান আবূ হাতেম আল-বসতী। তিনি হাদীসের বড় হাফেজ ছিলেন। হাদীসের তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্থানসমূহ তিনি সফর করেন ও বহু সংখ্যক মুহাদ্দিসের নিকট হাদীস শ্রবণ করেন। ঐতিহাসিক ইবনে সাময়ানী বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আবূ হাতেম ইবনে হাব্বান ছিলেন হাদীস-জ্ঞানে যুগশ্রেষ্ঠ। তিনি হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শাশ হইতে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত সুদূল পথ সফর করেন।[********************]
খতীব বাগদাদী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। তাঁহার বহুসংখ্যক হাদীস গ্রন্হও রহিয়াছে।[]
তাঁহার হাদীস সংগ্রহ অভিযান সম্পর্কে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি শাশ হইতে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ পথ সফর করিয়া সম্ভবত এক হাজার উস্তাদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও সংগ্রহ করিয়াছি।[********************]
এই শতকের প্রায় সকল মুহাদ্দিসের মত এই যে, বুখারী ও মুসলিমের পর যাঁহারা প্রকৃত সহীহ হাদীসের সমন্বয়ে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে প্রথমে যদি ইবনে খুযাইমার নাম উল্লেখ করিতে হয়, তবে তাঁহার পরই উল্লেখ করিতে হয় ইবনে হাব্বানকে।[ ক. ********************]
ইবনে হাব্বান ৩৫৪ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন।[********************]
ইমাম তাবারানী (র)
ইমাম তাবারানীর পূর্ণ নাম হইতেছে আবূল কাসেম সুলাইমান ইবনে আহমদ আত-তাবারানী। তিনি তিনভাগে ‘আল-মু’জিম’ নামে হাদীসগ্রন্হ সংকলন করেন। প্রতি ভাগের নাম যথাক্রমেঃ
১. ********************
২. ********************
৩. ********************
প্রথম ভাগে তিনি হযরত আবূ হুরায়রা ব্যতীত অপরাপর সাহাবীদের সনদ সূত্রে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত করিয়াছেন। হযরত আবূ হুরায়রা মুসনাদসমূহ তিনি স্বতন্ত্র এক খণ্ডে একত্রিত করেন। মু’জি-এর এই খণ্ডে তিনি প্রায় বিশ হাজার ও পাঁচশত হাদীস (মুসনাদ) একত্রিক করিয়াছেন। ইহাতে তিনি সাহাবীদের নামের আক্ষরিক ক্রমিকতা অবলম্বন করিয়াছেন।
তৃতীয় ভাগের গ্রন্হে তিনি তাঁহার প্রায় দুই হাজার উস্তাদের নিকট হইতে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ প্রত্যেক উস্তাদের নামের সনদে একত্রিত করিয়াছেন। বলা হয় যে, ইহাতে প্রায় ত্রিশ হাজার সনদে বর্ণিত হাদীস রহিয়াছে এবং তাহা ছয়টি স্বতন্ত্র খণ্ডে বিভক্ত।
দ্বিতীয় ভাগের গ্রন্হখানি একখণ্ডে সম্পূর্ণ। উহাতে এক হাজার উস্তাদের নিকট হইতে গৃহীত প্রায় পনেরো শত হাদীস একত্রিত করা হইয়াছে।[********************]
ইমাম তাহাভী (র)
ইমাম তাহাভীর পূর্ণ নাম আবূ জা’ফর আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আত-তাহাভী। তিনি এই শতকের একজন অন্যতম মুহাদ্দিস। তিনি ২২৮ হিজরী সনে মিসরে ‘তাহা’ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[********************] এই সময় কিছু ধর্মবিমুখ লোক ইসলামের হুকুম আহকাম সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিতে থাকে। তাহারা অভিযোগ করে যে, ইসলামের আদেশ নিষেধসমূহ পরস্পর বিরোধী। এই কারণে ইমাম তাহাভীর বন্ধু-বান্ধবগণ তাঁহাকে হাদীসের এমন একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করিবার জন্য অনুরোধ করেন, যাহা হইতে ইসলামের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও ব্যবহারিক বিধান অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইবে। অতঃপর ইমাম তাহাভী হাদীসের এক অনন্য সাধারণ গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]
তিনি ৩২১ হিজরী সনে আশি বৎসরাধিক বয়সে ইন্তেকাল করেন।[********************]
এই শতকের অন্যান্য মুহাদ্দিসীন
তাঁহাদের ব্যতীত এই শতকে আরো কায়েকজন শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহাদের মধ্যে কাসেম ইবনে আসবাগ (মৃঃ৩৪০ হিঃ) এবং ইবনুস-সাকান (মৃঃ ৩৫৩ হিঃ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহারা উভয়েই ‘সহীহ আলমুনতাকা’ নামে দুইখানি হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।[********************]