হাদীসের বিষয়বস্তু
হাদীসের বিষয়বস্তু কি? কি বিষয় লইয়া উহাতে প্রধানত আলোচনা হইয়াছে? এ বিষয়ে ইলমে হাদীসের বিশেষজ্ঞ সকল মনীষীই একমত হইয়া লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইলমে হাদীসের বিষয়ব্সুত বাআলোচ্য বিষয় হইল রাসূলে করীম (স)- এর মহান সত্তা এ হিসাবে যে, তিনি আল্লাহ তা’য়ালার রাসূল।[২৬ ********************]
অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ (স) আল্লাহ তা’য়ালার মনোনীত ও প্রেরীত ব্যক্তি-রাসূল হিসাবেও এই পদমর্যাদায় অীভষিক্ত থাকিয়া যাহা কিছু বলিয়াছেন, যাহা কিছু করিয়াছেন, যাহা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়াছেন, সমর্থন জানাইয়াছেন তাহা এবং এ সবের মাধ্যমে রাসূলে-করীমের যে মহান সত্তা বিকশিত ও উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে তাহাই ইলমে হাদীসের বিষয়বস্তু। হাদীসে এই সব বিষয়ই আলোচিত হইয়াছে এবং হাদীস পাঠ করিলে তাহা হইতে এব বিষয়ই জানিতে পারা যায়। রাসূলে করীমের জীবনব্যাপী বলা কথা, কাজ , সমর্থন এবং সাধনা সংগ্রামের বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য বিবরণও জানিবার একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য উপায় হইতেছে হাদীস।
বস্তুত হাদীস কোন সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ, একদেশদর্শী ও ক্ষুদ্র পরিসর সম্পদ নহে। ইহা মূলতই অত্যন্ত ব্যাপক ও বিপুল ভাবধারা সমন্বিত, বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (স) এর মহান নেতৃত্বে আরবভূমিতে যে বিরাট বিপ্লবী আন্দোলন উত্থিত হইয়াছিল তাহার সম্যক ও বিস্তারিত রূপ হাদীস হইতেই সুপরিস্ফুট হইয়া উঠে। রাসূল জীবনের পূর্ণাঙ্গ কাহিনী, তাঁহার ও সাহাবায়ে কিরামের বিপ্লবাত্মক কর্মতৎপরতা, তাদনীন্তন সমাজ সভ্যতা ও আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁহার ব্যাপক ও মৌলিক সংশোধনীর এবং সাধিত সংস্কারের বিবরণও হাদীসের মধ্যেই সামিল।
হাদীসের এ ব্যাপকতা অনস্বীকার্য, ইহার যথার্থতা হৃদয়ঙ্গম করাও কিছুমাত্র কঠিন নহে। পূর্বকালের মনীষিগণও হাদীসের এ ব্যাপক রূপ বুঝিতে পারিয়াছেন। ইমাম বুখারী সংকলিত হাদীসি গ্রন্হ বুখারী শরীফ নামে খ্যাত হইলেও উহার আসল ও পূর্ণাঙ্গ নাম হইলঃ
******************************************************
রাসূলে করীমের কার্যাবলী ও তাঁহার সমসাময়িক যুগের সমস্ত অবস্থা ও ব্যাপারসমূহের বিশুদ্ধ সনদযুক্ত বিবরণের ব্যাপক সংকলন। [২৭****************]
হাদীসের অধ্যয়নের উদ্দেশ্য ও সার্থকতা
হাদীস অধ্যয়নের উদ্দেশ্য কি? কি লক্ষ্য লইয়া হাদীস অধ্যয়ন করা কর্তব্য এবং উহার অধ্যয়নের সার্থকতাই বা কি, ইহাও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী প্রমুখ মনীষী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
উভয় কালের চরম কল্যাণ লাভই হইতেছে হাদীস অধ্যয়নের সার্থকতা।[২৮**********]
নওয়াব সিদ্দীক হাসান লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইহকাল ও পরকালের পরম কল্যাণ লাভই হইতেছে হাদীস অধ্যয়নের লক্ষ্য।[২৯**************]
আল্লামা কিরমানী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
******************************************************
‘কুরআনের পরে সকল প্রকার জ্ঞানের মধ্যে সর্বাধিক উন্নত, উত্তম এবং তথ্য ও তত্ত্বসমৃদ্ধ শ্রেষ্ঠ সম্পদ হইতেছে ইলমে হাদীস। ইহা এই কারণে যে উহার দ্বারাই আল্লাহর কালামের লক্ষ্য ও তাৎপর্য জানিতে পারা যায় এবং আল্লাহর যাবতীয় হুকুম-আহকামের উদ্দেশ্যও উহা হইতেই বুঝিতে পারা যায়। যেহেতু কুরআনের অধিকাংশই-এবং সবই-মোটামুটি ও নীতিকথা মাত্র. আর তাহা হইতে কেবল এজমালী কথাই জানিতে পারা যায়। [৩০]
মোটকথা হাদীষ হইল একটি সভ্যতার পতন এবং এক নবতর সভ্যতার অভ্যুদয়, উত্থান ও প্রতিষ্ঠালাভের ইতিহাস। এ দৃষ্টিতেই হাদীস অধ্যয়ন আবশ্যক।
হাদীসের সংজ্ঞাভিত্তিক শ্রেণীবিভাগ
হাদীসের উল্লিখিত সংজ্ঞা হইতে উহার তিনটি প্রাথমিক বিভাগ সুপরিস্ফুট হইয়া উঠে। তাহা হইতেছেঃ রাসূলের মুখ নিঃসৃত কথা, তাঁহার নিজের কাজ ও আচরণ এবং তাঁহার সম্মখে অনুমোদনপ্রাপ্ত কথা ও কাজের বিবরণ। সমস্ত হাদীসই এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত। কিন্তু উহার বাস্তব গুরুত্ব, প্রয়োগ ও ব্যবহারিক মূল্যের দৃষ্টিতে এই তিন পর্যায়ের হাদীসের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। সর্বপ্রথম স্থান হইল রাসূলের কথার-কোন বিষয়ে রাসূল যাহা নিজে বলিয়াছেন ইসলামী জীবন ব্যবস্থঅর ইহাই প্রথম উৎস। ইহাকে বলা হজয় রাসূলের ‘কাওলী হাদীস’–(*************) ‘কথামূলক হাদীস’, যাহাতে রাসূলের নিজের কোন কথা উদ্ধৃত হইয়াছে।
দ্বিতীয় ভাগে হযরতের নিজস্ব কাজ-কর্ম ও আচার-আচরণের বিবরণ। রাসূল (স) যে দ্বীন ইসলাম লইয়া আসিয়াছিলেন, বাস্তবিক পক্ষে তিনি তাহা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করিয়াছেন, সে অনুযায়ী প্রত্যেকটি কাজ আঞ্জাম দিয়াছেন। তাঁহার কাজ ও চরিত্রের ভিতর দিয়াই ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধান ও রীতিনীতি সুপরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহার একটি কাজও ইসলামী শরীয়াতের বিপরীত হইতে পারে নাই। এই কারণে তাঁহার প্রতিটি কাজই ইসলামী শরীয়াতের ভিত্তিরূপে গণ্য হইবার যোগ্য। আর যো হাদীসে রাসূলের রাসূল হিসাবে করা কোন কাজের বিবরণ উল্লিখিত হইয়াছে তাহাকে বলা হয় ‘ফে’লী হাদসী’ (*******)।
আর তৃতীয় হইল রাসূলে করীম (স) এর নিকট অনুমোদন ও সমর্থনপ্রাপ্ত (সাহাবাদের০ কথা ও কাজ। কেননা পূর্বেই বলা হইয়াছে, হযরতের সম্মুখে ইসলামী শরীয়াতের বিপরীত কোন কথা বলা হইলে বা কোন কাজ করা হইলে রাসূল (স) উহার প্রতিবাদ বা নিষেধ না করিয়া পারেন নাই। এই ধরনের কোন কথা বা কাজের বিবরণ হইতেও শরীয়াতেরে দৃষ্টিভঙ্গী নিঃসন্দেহে জানিতে পারা যায়। অতএব ইসলামী শরীয়াতের ইহাও একটি উৎস। যে হাদীসে এই ধরনের কোন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, তাহা হইতেছে ‘তাকরীরী হাদীস] (**********)।
এখানে বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য করিয়া তুলিবার উদ্দেশ্যে এই তিন পর্যায়ের তিনটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ
******************************************************
হযরত আনাস (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেন; হযরত রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ ফাসিক ব্যক্তির প্রশংসা ও স্তুতি করা হইলে আল্লাহ তা’য়ালা অসন্তুষ্ট ও ক্রুব্ধ হন এবং এই কারণে আল্লাহর আরধ কাঁপিয়া উঠে। (বায়হাকী)
ইহাতে রাসূলের একটি বিশেষ কথার উল্লেখ হওয়ার কারণে ইহাকে বলা হয় ‘কাওলী হাদীস’।
******************************************************
হযরত আবূ মূসা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমি রাসূলে করীম (স)- কে মোরগের গোশত খাইতে দেখিয়াছে। (বুখারী ও মুসলিম)
এই হাদীসে রাসূলের একটি কাজের বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। এজন্য ইহা ‘ফে’লী হাদীস’।
******************************************************
হযরত ইবনে আবূ আওফা (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ আমরা রাসূলে করীম (স)- এর সঙ্গে মিলিয়া সাতটি লড়াই করিয়াছি। আমরা তাঁহার সঙ্গে থাকিয়া জারাদ (ফড়িং জাতীয় চড়ই) খাইতাম। (বুখারী ও মুসলিম)
ইহা ‘তাকরীরী হাদীস’।