পরিশিষ্ট-২
উপমহাদেশে ইলমে হাদীস
উপমহাদেশে সাহাবীদের আগমন
এই উপমহাদেশের সহিত আরব দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক অতিশয় প্রাচীন। কাজেই ষষ্ট ঈসায়ী শতকে আরব সাগরের পশ্চিম উপকূলে- আরব দেশে- যে বিপ্লব সাধিত হইয়াছিল, পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এই উপমহাদেশে উহার প্রথম তরংগাভিঘাত আসিয়া পৌঁছা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। নির্ভরযোগ্য ইতিহাস হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী বিপ্লবের প্রথম কয়েক বৎসরে- নবূয়্যাত ও প্রথম খলীফার আমলে- না হইলেও দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ফারূক (রা)-এর খিলাফতকালে বিশ্ব নবীর সাহাবিগণের কেহ কেহ এই উপমহাদেশে আগমন করিয়াছেন। এই সময়ে যে কয়জন সাহাবীর ভারত আগমনের সন্ধান পাওয়া যায়, তাঁহারা হইতেছেন- (১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবান, (২) হযরত আসেম ইবনে আমর আততমীমী, (৩) হযরত সুহার ইবনে আল-আবদী, (৪) হযরত সুহাইব ইবনে আদী এবং (৫) হযরত আল-হাকেম ইবনে আবিল আস আসসাকাফী (রা)।[সিয়ারুস সাহাবা, ৬ষ্ঠ খণ্ড।]
অতঃপর হযরত উসমান, হযরত আলী ও আমীর মুয়াবিয়ার শাসনামলেও ভারতে সাহাবীদের আগমন অব্যাহত থাকে। কিন্তু এই যুগে ভারত আগমনকারী মাত্র তিনজন সাহাবীর সন্ধান পাওয়া যায়। হযরত উসমানের খিলাফতকালে যে দুইজন সাহাবী ভারতবর্ষে আগমন করেন, তাঁহারা হইতেছেন (১) হযরত উবাইদুল্লাহ ইবনে মা’মর আততামীমী ও (২) হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা ইবনে হাবীর ইবনে আবদে শামস। আর হযরত আমীর মুয়াবিয়ার যুগে আসেন হযরত সিনান ইবনে সালমাহ ইবনে আল মুহাব্বিক আল- হযালী। তদানীন্তন ইরাক শাসনকর্তা যিয়াদ তাঁকে ভারত সীমান্তের শাসনকর্তা নিযুক্ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন।
উপমহাদেশে তাবেয়ীদের আগমন
সাহাবাদের পর বহু সংখ্যক তাবেয়ী ভারতে আগমন করিয়াছেন, ইতিহাস হইতে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়। আমীর মুয়াবিয়ার যুগে সর্ব প্রথম যে তাবেয়ী ভারত আগমন করেন, তিনি হইতেছেন মূলহাব ইবনে আবূ সফরা। তিনি ৪৪ হিজরী সনে হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা সাহাবীল সঙ্গে একজন সেনাধ্যক্ষ হিসাবে এখানে পদার্পণ করেন। তিনি সিজিস্তান ও কাবুল সীমান্ত অতিক্রম করিয়া লাহোরে আসিয়া উপনীত হন।
উপমহাদেশে হাদীস প্রচার
সাহাবায়ে কিরামই ছিলেন ইলমে হাদীস প্রচারের সর্বপ্রথম বাহন। তাঁহারা ছিলেন দ্বীন-ইসলাম প্রচারের বাস্তব নমুনা ও অগ্রদূত। তাঁহারা যেখানেই গিয়াছেন, সেখানেই ইসলাম তখা কুরআন-হাদীস প্রচারে আত্মনিয়োগ করিয়াছেন। কাজেই এই দেশেও যে তাঁহারা কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসের প্রচারের কাজও করিয়াছেন তাহাতে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না। এই কারণে এই কথা বিশ্বাস করা যাইতে পারে যে, প্রথম হিজরী শতকের প্রথমার্ধে এই এলাকায় ইলমে হাদীসের কিরণ বিচ্ছুরিত হইয়াছে, যদিও তাহার বিস্তারিত ইতিহাস জানিবার কোন উপায় নাই।
সিন্দুদেশে ইলমে হাদীস
এই উপমহাদেশের সীমান্ত এলাকায় ক্রমাগত কয়েক বৎসর পর্যন্ত মুসলিম অভিসান পরিচালিত হয়। সিনান ইবনে সালমাহ ‘কুসদার’ দখল করেন। অতঃপর হুরী ইবনে হুরী বাহেলী এক ব্যাপক অভিযানের সাহায্যে সিন্ধুর অধিকাংশ এলাকার উপর ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন।[বালাযুরী, ৪৩৯ও ৪৪০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]
৯৩ হিজরী সনে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম সিন্ধু বিজয় সম্পূর্ণ করিয়া উহাকে ইসলামী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রদেশে পরিণত করেন। মূলতান, মনসুরা, আলোর, দেবল, সিন্দান, কুসদার ও কান্দাবীল প্রভৃুতি স্থানে আরবারা উপনিবেশে স্থাপন করেন। মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের সঙ্গে ৫০ সহস্র অশ্বারোহী সৈনিক স্থায়ীভাবে বর্তমান। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্যে এই সময় এদেশের বহু সংখ্যক আরব আগমন করেন। ফলে উল্লিখিত সকল স্থানেই ইসলামী শিক্ষার- কুরআন ও হাদীস শিক্ষাদানের- কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এই আরবদের মধ্যে ব হু হাফেজে কুরআন ও হাদীসের হাফেজ লোকও বর্তমান ছিলেন। তাঁহাদের চেষ্টা যত্নে এই এলাকায় কুরআন-হাদীসের শিক্ষা ব্যাপক প্রচার লাভ করে। তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা বিশেষভাবে হাদীস প্রচারের কাজ করিয়াছেন তাঁহাদের কয়েকজনের নাম পরিচয় এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১. মূসা ইবনে ইয়াকুব আসসাকাফী। তিনি সিন্ধুদেশে বিচারপতি (কাযী) হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। ইলমে হাদীসে তাঁহার বিশেষ পারদর্শিতা ছিল।
২. ইয়াযীদ ইবনে আবী কাবশী আদ-দেমাশকী (মৃঃ ৯৭ হিঃ)। তিনি ছিলেন তাবেয়ী, হযরত দারদা শারাহবীল ইবনে আওজ ও মারওয়ান ইবনে হাকাম প্রমুখ সাহাবীর নিকট হইতে তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবেও তিনি স্বীকৃত ছিলেন।
৩. মুফাযযল ইবনে মুহালাব ইবনে আবূ সাফরা (মৃঃ ১০২ হিঃ) তাবেয়ী। হাদীস বর্ণনায় তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অবলম্বন করেন। সাহাবী হযরত নুমান ইবনে বশীল হইতে তিনি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন এবং তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন (তাঁহার পুত্র) হাজিব, সা-বিতুল বানানী ও জরীর ইবনে হাযেম।
৪. আবূ মূসা ইসরাঈল ইবনে মূসা আল বসরী (মৃঃ ১৫৫ হিঃ) সিদ্ধী। তিনি বসরা হইতে ব্যবসার উপলক্ষে ভারতে আগমন করেন। তিনি ছিলেন বিশ্বস্ত হাদীস বর্ণনাকারী। সুফিয়ান সওরী (মৃঃ ১৬১ হিঃ), সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) ও ইয়াহইয়া ইবনে সায়াদুল কাত্তান (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) প্রভৃতি প্রখ্যাত হাদীস পারদর্শিগণ তাঁহার ছাত্র। ইলমে হাদীসে আবূ মূসার মর্যাদা যে কত উচ্চ, তাহা এই বিবরণ হইতেই সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। ইমাম বুখারী তাঁহার হাদীস গ্রন্হে আবূ মুসার সূত্রে বহু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
৫. আমর ইবনে মুসলিম আল বাহেলী, তিনি খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীযের অধীনে প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিসাবে সিন্ধু আগমন করেন। তিনি ইয়ালা ইবনে উবাইদ হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
৬. রবী ইবনে সবীহ আস-সায়দী আল-বসরী (মৃঃ ১৭০ হিঃ) তিনি বহু হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন; হাদীস গ্রন্হও তিনি সংকলন করিয়াছেন। ১৬০ হিজরীতে তিনি ভারত পদার্পণ করেন।
আরব উপনিবেশসমূহে হাদীস প্রচার
দেবল
আরব শাসনাধীন দেবল (সিন্ধু প্রদেশ) শহরে হাদীসের বিশেষ চর্চা ও প্রচার সাধিত হয়। ফলে এখানে কয়েকজন প্রখ্যাত হাদীস বর্ণনাকারীর উদ্ভব হয়। নিম্নে তাঁহাদের কয়েকজনের নাম পরিচয়ের উল্লেখ করা যাইতেছে-
১। আবূ জা’ফর দেবলী (মৃঃ ৩২২ হিঃ)। তিনি মূসা ইবনে হারূন বাজ্জাজ (মৃঃ ২৯৪ হিঃ) ও মুহাম্মদ ইবনে আলী আস সাইফ (মৃঃ ২৯১ হিঃ) হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
৩। আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ দবলী (মৃঃ ৩৪৬ হিঃ)। তিনি মুহাদ্দিস আবূ জা’ফরের ছাত্র। তিনি চতুর্থ শতকের বিপুল সংখ্যক হাদীস প্রচারকারীরূপে খ্যাত।
৪। মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ দেবলী (মৃঃ ৩৪৬ হিঃ)। তিনি খলীফা আবূ আল কাযীর (মৃঃ ৩০৫) নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। প্রখ্যাত মনীষী হাকিম নিশাপুরূ তাঁহার ছাত্র।
৫। আল হাসান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আসাদ দেবলী (মৃঃ ৩৫০ হিঃ)। ৩৪০ হিজরীতে তিনি দামেশকে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার হাদীস বর্ণনা সূত্রে সূচনা হয় হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) সাহাবী হইতে।
৬। খালফ ইবনে মুহাম্মদ দেবলী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ)। তিনি প্রথমে দেবলেই আলী ইবনে মূসা দেবলীর নিকট হাদীস শিক্ষালাভ করেন। পরে তিনি বাগদাদ গমন করেন ও তথায় হাদীসের দারস দিতে শুরু করেন।
৭। আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হারূন দেবলী (মৃঃ ৩৭০ হিঃ)। তিনি বাগদাদে জা’ফর ইবনে মুহাম্মদ ফারেয়াবীর নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। কূফা নগরে আহমদ ইবনে শরীফের নিকটও তিনি হাদীস অধ্যায়ন করেন।
৮। হাসান ইবনে হামীদ দেবলী (মৃঃ ৪০৭ হিঃ)। তিনি বড় ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ব্যবসায়ের সঙ্গে সঙ্গে হাদীস চর্চা করিয়া তাহাতেও যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সায়ীদ মুচেলী (মৃঃ ৩৫৯ হিঃ), দা’লাজ (মৃঃ ৩৫১ হিঃ), মুহাম্মদ নক্কশ (মৃঃ ৩৫১ হিঃ), এবং আবু আলী তুমারী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ) তাঁহার উস্তাদ ছিলেন। তিনি যখন হাদীস বর্ণনা করিতেন, তখন তাঁহার হৃদয় ভাবাবেগে এতই আর্দ্র উচ্ছ্বাসিত হইয়া উঠিত যে, তিনি কাঁদিয়া ফেলিতেন।
৯। আবূল কাসেম শুয়াইব ইবনে মুহাম্মদ দেবলী (মৃঃ ৪০০ হিঃ)। তিনি আবূ কাতান নামে পরিচিত। তিনি মিসরে গমন করেন এবং তথায় একটি সংঘ গঠন করিয়া হাদীস শিক্ষাদান করিতে থাকেন।
আল-মনসূরা
আল-মনসূরা বর্তমনা সিন্ধু-হায়দাবাদ হইতে উত্তর-পূর্বদিকে ৪৭ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। এই শহর প্রথম মুসলিম অধিকারের যুগ হইতেই ইসলামী ভাবধারায় পূর্ণ ছিল। ইহার অধিকাংশ অধিবাসীই হাদীসের অনুসারী ছিল। তাই এই শহরে হাদীস চর্চায় চরম উন্নতি লাভ ঘটে বলিয়া ধারণ করা চলে। বিভিন্ন মসজিদে হাদীসের অধ্যাপনা চলিত। বিশেষজ্ঞগণ হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁহাদের মধ্যে কাযী আবুল আব্বাস আল-মনসূরী হাদীসের শিক্ষাগুরু ও গ্রন্হ সংকলকরূপে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।
এই শহরে অপরাপর যেসব হাদীসবিদ ছিলেন, তাঁহাদের নাম পরিচয় নিম্নে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১। আহমদ আবুল আব্বাস আল-মনসুরী। ফারেসে আবুল আব্বাস ইবনে আসরামের (মৃঃ ৩৩৬ হিঃ) নিকট এবং বসরায় আহমদ হিজ্জানীর (আবূ রওক নামে খ্যাত, মৃঃ ৩৩২ হিঃ) নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন।
২। আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল-মনসূরী (মৃঃ ৩৮০ হিঃ)। তিনি ফারেসেও বসরায় হাদীস শিক্ষালাভ করেন। চতুর্থ শতকে তিনি মুহাদ্দিস হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।
৩। আবূ আবদুল্লাহ ইবনে জা’ফর মুররা আল-মনসূরী (মৃঃ ৩৯০ হিঃ)। তিন হাসান ইবনে আল মুকাররামের ছাত্র। আল হাকিম নিশাপুরীর উস্তাদ হিসাবে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
কাসদার
বর্তমান কালাত রাজ্যের খোশদার নাকম স্থানই সেকালে কাসদার নামে পরিচিত ছিল। হযরত সিনান ইবনে সালমাহম হুযালীর সমাধি এখানে অবস্থিত। আরব শাসন আমলে ইহা তুরান সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ইহা একটি ব্যবসায় কেন্ত্র হিসাবে সমাধিক গুরুত্ব লাভ করিয়াছিল। হাদীস চর্চায় এই শহরে বিশেষ স্থান অধিকার করে। এখানকার কয়েকজন হাদীসবিদের নাম এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১। জা’ফর ইবনে খাত্তাব কাসদারী (মৃঃ ৪৫০ হিঃ)। তিনি আবূ মুহাম্মদ নামে খ্যাত। উত্তরকালে তিনি বলখ শহরে বসবাস শুরু করেন। তিনি ‘সিকাহ’ হাদীস বর্ণনাকারীরূপে স্বীকৃত। আবুল ফুতুহ আবদুল গফুর কাশঘরী (মৃঃ ৪৭৪ হিঃ) ‘হাফেজে হাদীস’ তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিতেন। ৫ম শতকে তিনি মুহাদ্দিস হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।
২। সীবাওয়াইহ ইবনে ইসমাঈল কাসদারী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)। আস আবুল কাসেম আলী ইবনে মুহাম্মদ হুসাইনী, ইয়াহইয়া ইবনে ইবরাহীম ও রাজা ইবনে আবদুল ওয়াহিদ তাঁহার উস্তাদে হাদীস। তিনি মক্কায় গমন করেন ও তথায় হাদীস দারস দান শুরু করেন। আবুল ফিতাইয়ান আমর ইবনে হাসান রাওয়াসী (মৃঃ ৫০৩ হিঃ) তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
উত্তর ভারতে হাদীস চর্চা
দ্বিতীয় হিজরী শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সিন্ধুদেশ কেন্দ্রীয় আরব সরকারের অধীন ছিল। তাহার পর এ দেশের বিদ্রোহ, উচ্ছৃঙ্খলতা ও রাজনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয়। সেকালে গোটা প্রদেশ কতকগুলি ক্ষুদ্র দেশীয় স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হইয়া পড়ে। তৃতীয় শতকে এই রাজ্যগুলিও ধ্বংস হইয়া যায়। অতঃপর এতদঞ্চলে বাতেনী সম্প্রদায়ের প্রভাব বিস্তার লাভ করে। ফলে কিছু কালের জন্য উহার সহিত কেন্দ্রীয় মুসলিম শাসকের সম্পর্ক ছিন্ন হইয়া যায়।
৪১৩ হিজরী সনে সুলতান মাহমুদ গযনভী খাইবারের গিরিপথে পাঞ্জাব আক্রমণ করে লাহোর অধিকার করেন। ইহার ফলে পাক-ভারতের সহিত মুসলিমদের সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হয়। অতঃপর সপ্তম হিজরী শতকের মধ্যে গোটা উপমহাদেশের উপর মুসলিম আধিপত্য বিস্তৃত ও দৃঢ়তর হয়। দিল্লী মুসলিমদের রাজধানীরূপে নির্দিষ্ট হয়। ইহার পর খাইবার গিরিপথ হইতে এশিয়াটিক তুর্কিস্তান, খুরাসান ও আফগানিস্তান প্রভৃতি অঞ্চলের মুসলিমগণ দলে দলে ভারতে আগমন করিতে থাকে। প্রথমোক্ত দুইটি দেশ- এশিয়াটিক তুর্কিস্তান ও খুরাসান-হিজরী তৃতীয় শতকে ইলমে হাদীসের পাদপীঠে পরিণত হইয়াছিল। সিহাহ-সিত্তার গ্রন্হ প্রণেতাগণ এই অঞ্চলেরই অধিবাসী ছিলেন। এই দেশে হইতে বিপুল সংখ্যক লোকের আগমনের ফলে ভারতে ইসলামী শিক্ষা ও ইলমে হাদীসের ব্যাপক প্রচার শুরু হইয়া যায়। বিশেষত লাহোর এই সময় হাদীস শিক্ষার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।
লাহোরে ইলমে হাদীস
লাহোরে ইলমে হাদীস প্রচারের কথা বলিতে গেলে সর্বপ্রথম উল্লেক করিতে হয় শায়খ মুহাম্মদ ইসমাঈল লাহোরীর নাম (মৃঃ ৪৪৮ হিঃ)। তিনি বুখারা হইতে ৩৯৫ হিজরী সনে ভারতে আগমন করেন ও লাহোরে বসবাস করিতে শুরু করেন। এখানে তিনি ইসলামী আদর্শ প্রচার প্রসঙ্গে ইলমে হাদীসের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন ও উহার ব্যাপক প্রচারের কার্যকর পন্হা অবলম্বন করেন। ফলে পরবর্তী একশত বৎসরের মধ্যে লাহোরে অসংখ্য মুহাদ্দিস গড়িয়া উঠেন।
এই সময়কালের লাহোর বসবাসকারী কয়েকজন মুহাদ্দিসের নাম-পরিচয় এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১। সাইয়েদ মুরতাযা (মৃঃ ৫৮৯ হিঃ)। তিনি হাদীস-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন ও সুলতান শিহাব উদ্দীন ঘোরীর সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন।
২। আবুল হাসান আল ইবনে উমর লাহোরী (মৃঃ ৫২৯ হিঃ)। তিনি বড় মুহাদ্দিস ছিলেন, হাফেজে হাদীস আবুল মুযাফফর সায়ীদীর নিকট তিনি হাদীস শিক্ষা লাভ করেন।
৩। আবুল ফুতহ আবদুস সামাদ ইবনে আদুর রহমান লাহোরী (মৃঃ ৫৫০ হিঃ)। তিনি সমরকন্দে হাদীসের দারস দিতেন।
৪। আবুল কাসেম মুহাম্মদ ইবনে খালফ লাহোরী (মৃঃ ৫৪০ হিঃ)। তিনি পরে ‘ইসফ্রাইন’ চলিয়া যান। তিনি একজন উঁচুদরের হাদীসবিদ আলিম ছিলেন।
সপ্তম শতকের উপমহাদেশীয় মুহাদ্দিস
হিজরী সপ্তম শতকে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব মুহাদ্দিস জীবিত ছিলেন, এখানে তাঁহাদের কয়েকজনের নাম পরিচয় উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১. শায়খ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানী (মৃঃ ৬৬৬ হিঃ)। তিনি সাহাবী হাব্বান ইবনে আসওয়াদের বংশধর। মক্কা ও মদীনা হইতে তিনি হাদীস শিক্ষা ও তাহাতে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন।
২. কাজী মিহাজুস সিরাজ জুজানী (মৃঃ ৬৬৮ হিঃ)। তিনি বংগদেশের লক্ষণাবতি আগমন করেন।
৩. বুরহান উদ্দীন মাহমুদ ইবনে আবুল খায়ের আসাদ বলখী (মৃঃ ৬৮৭ হিঃ)। তিনি মুহাদ্দিস সাগানীর ছাত্র ছিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে ‘মাশায়ীকুল আনওয়ার’ হাদীস গ্রন্হ বর্ণনা করার সনদ লাভ করেন।
৪। কামালুদ্দীন জাহিদ (মৃঃ ৬৮৪ হিঃ)। তাঁহার আসল নাম মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে মুহাম্মদ। তিনি শায়খ নিজামুদ্দীন আউলিয়া উস্তাদে হাদীস হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন।
৫. রাযীউদ্দীন বদায়ূনী (মৃঃ ৭০০ হিঃ)। তিনি সমসাময়িকদের মধ্যে অতিশয় খ্যাতিসম্পন্ন মুহাদ্দিস ছিলেন।
৬. শরফূদ্দীন আবূ তাওয়ামা বুখারী হাম্বলী (মৃঃ ৭০০ হিঃ)। তিনি বুখারা হইতে সপ্তম শতকের শুরুতে দিল্লী আগমন করেন। তিনি বংগদেশের (ঢাকা জিলাধীন) সোনারগাঁয়ে চলিয়া আসেন এবং এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি বিশেষ মনোযোগ সহকারে ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। তাঁহার চেষ্টায় সোনার গাঁ অনতিবিলম্বে হাদীস শিক্ষার পাদপীঠে পরিণত হয়। দুঃখের বিষয়, সোনারগাঁয়ে ইলমে হাদীস চর্চার বিস্তারিত বিবরণ এখনো কজ্ঝটিকার অন্ধকারে নিমজ্জিত।
অষ্টম শতকে উপমহাদেশের হাদীস চর্চা
অষ্টম হিজরী শতকে পাক-ভারতে ইলমে হাদীসের ক্রমবিকাশের অধ্যায় সূটিত হয়। দাক্ষিণাত্যের বাহামুনী বাদশাহ মাহমুদ বাহামুনী (৭৮০-৭৯৯ হিঃ) ইলমে হাদীস প্রৃচারের দিকে বিশেষ লক্ষ্য আরোপ করেন। হাদীস শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি বৃত্তির ব্যবস্থা করেন।[ঐতিহাসিক ফিরিশতা] এই সময় ভারতের প্রায় সর্বত্র ফিকাহ, দর্শন ও তাসাউফ চর্চার প্রভাব পরিলক্ষিত হইলেও হাদীস শিক্ষা ব্যাপক কোন অংশে ব্যাহত হয় নাই। বরং বিশিষ্ট তাসাউফ পন্হিগণ ইলমে হাদীস প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সর্বোপরি চারজন প্রখ্যাত তাসাইফবাদীর নেতৃত্বে নিম্নলিখিত চারটি হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র গড়িয়া উঠে।
১. নিজামউদ্দীন আউলিয়ার নেতৃত্বে দিল্লীতে হাদীসের ব্যাপক শিক্ষাদান শুরু হয়।
২. শরফুদ্দীন আল-মুনীরীর নেতৃত্বে ও শিক্ষাদানের ফলে বিহার অঞ্চলে হাদীস শিক্ষার সূচনা হয়।
৩. আল-হামদানীর নেতৃত্বে কাশ্মীরে হাদীস শিক্ষা সূচিত হয়।
৪. যাকারিয়া মুলতানীর নেতৃত্বে মুলতানে ইলমে হাদীসের প্রচার হয়।
উল্লিখিত কেন্দ্রসমূহ হইতে বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস বহির্গত হন। কেন্দ্র ভিত্তিক কিছু সংখ্যক মুহাদ্দিসের নাম উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
নিজামুদ্দীন আউলিয়ার কেন্দ্র
১) শামসুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহইয়া উধী (মৃঃ ৭৪৭ হিঃ)
২) ফখরুদ্দীন জারুবাদী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)
৩) যিয়াউদ্দীন ইবনে মুয়াইয়েদুল মুলক বরনী
৪) মহীউদ্দীন ইবনে জালালউদ্দীন বিন কুতুব উদ্দীন কাশানী (মৃঃ ৭১৯ হিঃ)
৫) নিজামউদ্দীন আল্লানী জাফরাবাদী (মৃঃ ৭৩৫ হিঃ)
৬) শায়খ নসীর উদ্দীন চিরাগে দিল্লী (মৃঃ ৭৫৭ হিঃ)
৭) সাইয়েদ মুহাম্মদ গীসুদরাজ (মৃঃ ৮২৫ হিঃ)
৮) শায়খ অজীহ উদ্দীন
৯) কাজী শিহাব উদ্দীন দওলতাবাদী (মৃঃ ৮৪৯ হিঃ)
১০) মওলানা খাজেগী কুরাবী (মৃঃ ৮৭৮ হিঃ)
শরফুদ্দীন আল-মনীরী কেন্দ্র
১) শায়খ মুজাফফর বলখী (মৃঃ ৭৮৬ হিঃ)
২) হুসাইন ইবনে মুয়েজ বিহারী (মৃঃ ৮৪৫ হিঃ)
৩) আহমদ লংগরে দরিয়া ইবনে হাসান ইবনে মুজাফফর বিহারী (মৃঃ ৮৯১ হিঃ)
আলী হামদানীর কেন্দ্র
কাশ্মীরে আলী হামদানীই সর্বপ্রথম ইলমে হাদীস লইয়া আসেন। তিনি ৭৭৪ হিজরীতে এখানে পদার্পণ করেন। তিনি ও তাঁহার ছাত্রবৃন্দই এইদেশে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচার করেন। তিনি হাদীসের দুইখানি গ্রন্হও প্রণয়ন করেন। গ্রন্হ দুইটির নামঃ
ক) আস-সাবয়ীন ফী ফাযায়েলে আমীরিল মুমিনীন
খ) আরবায়ীনে আমিরীয়া
মুলতানে শায়খ যাকারিয়ার কেন্দ্র
শায়েখ বাহাউদ্দীন যাকারিয়া মুলতানে হাদীস শিক্ষা প্রচারের অগ্রদূত। এই কেন্ত্র হইতে জামাল উদ্দীন উলূচী ও মখদুমে জাহানীয়া সাইয়েদ জালাল উদ্দীন বুখারী মুহাদ্দিস হইয়া বাহির হন।
উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের রেনেসাঁ যুগ
নবম শতকে উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের রেনেসাঁ যুগ সূচিত হয়। গুজরাটের অধিপতি আহমদ শাহ আরব ও ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্য পথ নূতন করিয়া উম্মক্ত করেন। ফলে আরবদেশ হইতেবহু হাদীদবিদ ভারতবর্ষে আগমন করেন। প্রতিবেশী ইরান সরকার এই সময় শিয়া ধর্মমত গ্রহণ করেন। এই কারণে হাদীস-বিজ্ঞানে পারদর্শী একটি বিরাট জামা’আত সেখানে হইতে ভারতে হিজরত করিয়া আসিতে বাধ্য হন। সঙ্গে তাঁহারা বিপুল পরিমাণ হাদীস সম্পদ এখানে লইয়া আসেন। অপরদিকে মিসরেও এই সময় ইলমে হাদীসের প্লাবন সৃষ্টি হয় এবং তথা হইতে বড় বড় মুহাদ্দিস ভারত আগমন করেন। এই সময় যেসব মুহাদ্দিস ভারতে আসেন, তাঁহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত দুইজন মুহাদ্দিসের নাম সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্যঃ
১. বদরউদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আবী বকর দামায়নী (মৃঃ ৮২৭ হিঃ)। তিনি ইয়েমেনের জামে জাবীদ-এ হাদীসের অধ্যাপক ছিলেন। এখানে তিনি বুখারী শরীফের একখানি ভাষ্য (Commentary) রচনা করেন। উহার নাম ‘মাসাবীহুল জামে’ (*********************)। তিনি ৮২০ সনের শাবান মাসে ভারতের গুজরাটে আগমন করেন। এখানে নিম্নলিখিত তিনখানি গ্রন্হ রচনা করেনঃ (ক) তা’লীকুল ফরায়েয (*********************) (খ) ‘তুহফাতুল গরীব, শরহে আল-মুগনীউল লবীব’ এবং (গ) ‘আইনুল হায়াতফী খুলাসাতে হায়াতুল হাইয়ান’।
২। আবুল ফুতুহ নুরউদ্দীন আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ শিরাজী তয়ূসী (মৃঃ ৮৫০ হিঃ)।
তিনি সম্ভবত ৮১৪-৮৪৪ সনে গুজরাটে আসনে। তিনি মাজদুদ্দীন ফিরোজাবাদী, শামসউদ্দীন জাজারী, সাইয়েদ শরীফ জুরজানী ও বাবা ইউসুফ হারাভীর ছাত্র।
মিসরের ইবনে হাজার আসকালানী প্রতিষ্ঠিত হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র হইতে যাঁহারা ভারতে আসেন, তাঁহাদের মধ্যে নিম্নলিখিত দুইজন মুহাদ্দিস উল্লেখযোগ্যঃ
১. ইয়াহইয়া ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবুল খায়ের হাশেমী (মৃঃ ৮৪৩ হিঃ)
২. খাজা ইমাদ সাখাভী প্রতিষ্ঠিত হাদীস কেন্দ্র হইতে নিম্নলিখিত মুহাদ্দিসগণ ভারতে আসেনঃ
১) আবুল ফাতাহ আর-রাযী আল-মক্কী (মৃঃ ৮৮৬ হিঃ)
২) আহমদ ইবনে সালেহ মালভী
৩) উমর ইবনে মুহাম্মদ দামেশকী (মৃঃ ৯০০ হিঃ)
৪) আবদুল আযীয ইবনে মাহমুদ তুসী (মৃঃ ৯১০ হিঃ)
৫) অজীহুদ্দীন মুহাম্মদ মালাকী (মৃঃ ৯১৯ হিঃ)
৬) হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আওলিয়া কিরমানী (মৃঃ ৯৩০ হিঃ)
৭) জামালুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে উমর হাজরানী (মৃঃ ৯৩০ হিঃ)
৮) রফীউদ্দীন সাকাভী (মৃঃ ৯৫৪ হিঃ)
যাকারিয়া আল-আনসারী প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র হইতে আগত মুহাদ্দিসগণের নামঃ
১) আবদুল মু’তী হাজরানী ( মৃঃ ৯৮৯ হিঃ)
২) শিহাবুদ্দীন আব্বাসী (৯৩২ হিঃ)
ইবনে হাজার হায়সামী প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র হইতে আগত মুহাদ্দিসগণের নামঃ
১) শায়খ ইবেন আবদুল্লাহ আইদরুসী (মৃঃ ৯৯১ হিঃ)
২) আবূ সায়াদাত মুহাম্মদ আল ফকহী (মৃঃ ৯৯২ হিঃ)
৩) মীর মুরতাযা শরীফ শিরাজী (মৃঃ ৯৭৪ হিঃ)
৪) মীর কাঁলঅ মুহাদ্দিস আকবারাবাদী (মৃঃ ৯৮৩ হিঃ)
মিশকাত শরীফের প্রসিদ্ধ ভাষ্য ‘মিরকাত’- এর গ্রন্হকার মুল্লা আলী কারী এই কাঁলাই ছাত্র।
অতঃপর পাক-ভারতের নিম্নলিখিত স্থানসমূহে হাদীস শিক্ষার কেন্দ্র গড়িয়া উঠে।
১) দাক্ষিণাত্যে- এখানে বহু সংখ্যক মুহাদ্দিসের আগমন হয়। (২) গুজরাট (৩) মালওয়া (৪) খান্দেশ (৫) সিন্ধু- পাঁচ শত বৎসর পর দশম হিজরী শতকে এখানে নূতনভাবে ইলমে হাদীস শিকা ও প্রচারকার্য শুরু হয়। (৬) লাহোর- মওলানা মুহাম্মদের (মৃঃ ১০০০ হিঃ) নেতৃত্বে এই শহর হাদীস শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়। (৭) ঝাঁসী ও কালপী- সাইয়েদ মুহাম্মদ ইবরাহীম নামক এক বাগদাদী মুহাদ্দিস ১০ম হিজরী শতকে এখানে আগমন করেন ও হাদীস শিক্ষা দান শুরু করেন। (৮) আগ্রা- এখানে এক সঙ্গে তিনটি হাদীস কেন্দ্র স্থাপিত হয়ঃ ক. রফীউদ্দীন সাফাবীর মাদ্রাসা খ. হাজী ইবরাহীম মুহাদ্দিস আকবরাবাদীর (মৃঃ১০১০ হিঃ) মাদ্রাসা এবং গ) সাইয়েদ শাহমীর (মৃঃ ১০০০হিঃ) মাদ্রাসা (৯) লক্ষ্ণৌ- দশম শতকের শেষার্ধে এই শহর হাদীসশাস্ত্র আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়, যখন মদীনা হইতে শায়খ যিয়াউদ্দীন মুহাদ্দিস এখানে আসিয়া বসবাস ও হাদীস শিক্ষা দান শুরু করেন। (১০) জৌনপুরী-সম্ভবত ইমাম সাখাভীর ছাত্র মুহাযযহাব জৌনপুরীরর মাধ্যমে এখানে হাদীস প্রচার হয়। (১১) বিহার- অষ্টম শতকে শরফূদ্দীন মুনীরীর ছাত্র সাইয়েদ মিনহাজুদ্দীন রাস্তীর মাধ্যমে বিহারস্থ ফুলওয়ারী শরীফে ইলমে হাদীস পৌঁছায়। দশম শতকে ইহা বিকাশ ও উন্নতি লাভ করে।
হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে উপমহাদেশীয়দের বিদেশ সফর
৮২০ হিজরী হইতে ৯৯২ হিজরীর (ইং ১৪১৭- ১৫৮৪) মধ্যে উপমহাদেশে বিদেশী মুহাদ্দিসগণের আগমনে হাদীস শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নব জোয়ারের সূচনা হয় এবং তখন হইতেই এই দেশের বিদ্যোৎসাহী ও জ্ঞান পিপাসু ব্যক্তিগণ হাদীস শিক্ষার মহান উদ্দেশ্যে বিদেশ সফরে বহির্গত হইতে শুরু করেন। তাঁহাদের এই বিদেশ যাত্রা কেবল ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়া থাকে নাই- সুদূর মক্কা-মদীনা পর্যন্ত তাঁহারা ইলমে হাদীসে উচ্চ শিক্ষা লাভ করার উদ্দেশ্যে সফর করেন। এই যুগেও তাঁহারা উত্তাল তরঙ্গ মুখর সমুদ্র পরিক্রমার ঝুঁকি গ্রহণ করিতে এক বিন্দু কুণ্ঠিত বা ভীত হন নাই। এই যুগের মুহাদ্দিস আবদুল আউয়াল আল-হুসাইনী (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ) হইতে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (মৃঃ ১১৭২ হিঃ) পর্যন্ত প্রায় সকল হাদীসবিদই হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে এইরূপ সফর করিয়াছেন।
এই পর্যন্ত সর্বপ্রথম এই দুর্গম সফরে গমন করেন জামালুল্লাহ গুলবাগী। তিনি মক্কায় হাদীস শিক্ষা করেন। অতঃপর আরো বহু লোক হাদীস শিক্ষার উদ্দেশ্যে মক্কা ও মদীনা গমন করেন এবং এইরূপ সফর অব্যহতভাবে চলিতে থাকে। ভারতের প্রথম হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র দেওবন্দ ও সাহারানপুর মাদ্রাসা স্থাপিত হওয়ার সময় পর্যন্ত।
এই সময় নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ হাদীস-বিজ্ঞানে বিশেষ পারদশিতা লাভ করেনঃ
১. আবূ বকর ইবনে মুহাম্মদ আল-বহরুজী (মৃঃ ৯১৫ হিঃ)। তিনি আল-জাজারী সংকলিত ‘হিসনে হাসীন’ গ্রন্হের ফারসী অনুবাদ এবং উহার টীকা রচনা করেন। ‘আইনুল ওফা ফী তরজমায়ে শিফা’ নামে কাজী ইয়াযের গ্রন্হেরও তিনি ফরাসী অনুবাদ করেন।
২. মীর সাইয়েদ আবদুল আউয়াল আল-হুসাইনী গুজরাটী জৌনপুরী (মৃঃ ৯৮৬ হিঃ)। তিনি মুহাদ্দিস আবুল ফাতাহর সমসাময়িক। মক্কা মদীনায় হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি হাদীসের উচ্চলিক্ষা লাভের জন্য বিশেষ কষ্ট ও শ্রম স্বীকার করেন এবং ‘ফায়যুলবারী ফী শরহিল বুখারী’ ও ‘মুন্তাখাবে কিতাবে সাফরুস সায়াদাত’ নামে দুইখানি গ্রন্হ রচনা করেন। খান-খানান আকবরের আমলের প্রাথমিক যুগে তাঁহাকে গুজরাট হইতে দিল্লী আমন্ত্রণ করেন।
৩. খাজা মুবারক ইবনে মখদুম আর রাজানী বানারসী (মৃঃ ৯৮১ হিঃ)। তিনি ‘মাদরিজুল আখবার’ নামে একখানি হাদীসগ্রন্হ সংকলন করেন।
৪. শায়খ ভিকারী কাকুরী (৮৯০-৯৮১ হিঃ)। তাঁহার আসল নাম ছিল নিজামুদ্দীন ইবনে আরম সাইফুদ্দীন।তিনি খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি হাফেজ সাকাভীর নিকট হাদীস শ্রবণ ও অধ্যায়ন করেন। হাদীসের খেদমতে তিনি জীবন উৎসর্গ করেন। সহীহ বুখারী তাঁহার সম্পূর্ণ মুখস্থ ছিল।
৬. জামালুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে তাহের ইবনে আলী ফাত্তানী (মৃঃ ৯১৪ হিঃ)। তিনি ‘মালেকুল মুহাদ্দিসীন’ (মুহাদ্দিসদের বাদশাহ) নামে খ্যাত হইয়াছিলেন। মক্কা শরীফে আলী মুত্তাকীল হাদীস শিক্ষা কেন্দ্রে ৯৪৪ হিজরী সনে হাদীস শিক্ষার জন্য ভর্তি হন এবং দীর্ঘ ছয় বৎসর পর্যন্ত তথায় হাদীস অধ্যায়ন করেন। তিনি তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলীর কারণে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন।
ক) মাজমাউল বিহারুল আনওয়ার (********************)
খ) তাযকরিাতুল মওজুয়াত
গ) কানুনূল মওজুয়াত অজজয়ীফ
ঘ) আসমাউর-রিজাল
ঙ) আলমুগীনী ফী জাবতির রজাল
৭. শায়খ তাইয়েব সিন্ধী (মৃঃ ৯৯৯ হিঃ)। তিনি তা’লিকাতে মিশকাতুল মাসাবীহ’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন।
৮. শায়খ আবদুল্লাহ আনসারী সুলতানপুরী (মৃঃ৯৯০ হিঃ)। সম্রাট আকবরের আমলে তিনিই ভারতের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আলিম ছিলেন। তাঁহার উল্লেখযোগ্য দুইখানি গ্রন্হের নাম এইঃ
৯) শরহে আলা শামায়েলুন্নবী গাংগুহী (মৃঃ ৯৯০ হিঃ)। তিনি ইবনে হাজার হায়সামীর নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। আকবরের আমলে তিনি ইসলামের জন্য বিপ্লবাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেন।
হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ
ক) সুনানুল হুদা-ফী-মুতাবিয়াতিল মুস্তফা
খ) আযায়েফুল ইয়াওম আল্লাইল
১০. শায়খ অজীহুদ্দীণ আলাভী গুজরাটী (মৃঃ ৯৯০ হিঃ)। তিনি অন্যূন ২৩ খানা গ্রন্হ রচনা করেন। শরহে জামী, তাফসীরে বায়যায়ী, নুজহাতুন্নযার ফী শরহে মুখবাতুল ফিকর প্রভৃতি তাঁহার বিখ্যাত রচনা।
১১. শায়খ তাহের ইবনে ইউসুফ সিন্দী বুরহানপুরী (মৃঃ ১০০৪ হিঃ)। তাঁহার রচিত গ্রন্হের সংখ্যা চারঃ
ক) তালখীস শরহে আসমাউর-রিজাল আল-বুখারী কিরমানী
খ) মুলকাত জামেউল জাওয়ামি
গ) শরহুল বুখারী
ঘ) রিয়াযুস সালেকীন
১২. শায়খ ইবনে হাসান সায়ফী কাশ্মীরী (মৃঃ ১০০৩ হিঃ)। তিনি শায়খ আহমদ সরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানীর উস্তাদ। তাঁহার গ্রন্হাবলীর নামঃ
ক) শরহে সহীহুল বুখারী
খ) তফসীরুল কুরআন
গ) রিসালায়ে আযকার
ঘ) মাগাযীউন্নাবুয়্যাত।
১৩. হাজী মুহাম্মদ কাশ্মীরী (মৃঃ ১০০৬ হিঃ)। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নোক্ত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ
ক) শরহে শামায়েলুন্নবী
খ) শরহে মাশারিকুল আনওয়ার
গ) কিতাব খুলাসাতুল জামে ফী জামেউল হাদীস
ঘ) শরহে হিসনে হাসীন
১৫. শায়খ মুনাওয়ার ইবনে আবদুল মজীদ ইবনে আবদুস শকুর লাহোরী (মৃঃ ১০১০ হিঃ) তিনি আকবরের আমলে একজন বিপ্লবী আলিমের ভূমিকা অবলম্বন করেন। এইজন্য তিনি কারাবরণ করিতেও বাধ্য হন এবং কারাগারে থাকিয়া তিনি তাঁহার গ্রন্হ ‘দুরুন্নাজম ফী তরতীবিল আওয়ায়েলুস সুয়রুল করীম’ সম্পূর্ণ করেন ও কাজী শিহাবুদ্দীনের ‘আল বহরুল মাওয়াজ’ নামক তাফসীর মুখস্থ করেন। তিনি সাগানীর ‘মাশারিকুল আনওয়ার’ ও জাজারীর হিসনে হাসীনেরও ব্যাখ্যা লিখেনে।
১৬. মুহীউদ্দীন আবদুল কাদের ইবনে শায়খ ইবনে আবদুল্লাহ (মৃঃ ১০৩৭ হিঃ)। তিনি বহু গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার পাঁচখানি গ্রন্হ উল্লেখযোগ্যঃ
ক) আল মিনহুল বারী বি-খাতমে সহীহিল বুখারী
খ) ইকদুল লাইল ফী ফাযায়েলিল লায়াল
গ) রিসালা ফী মানাকিবিল বুখারী
ঘ) আল কাওলুল জামে ফী বয়ানে ইলমুন নাফে
ঙ) কিতাবুল আনফুসেল্লাতীফ ফী আহলি বদরিশ শরীফ।
১৭. আবদুন্নবী শাত্তারী (মৃঃ ১০৩৯ হিঃ)। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নোক্ত পাঁচখানি গ্রন্হ উল্লেখযোগ্যঃ
ক) জাহরিয়াতুন নাজাত ফী শারহীল মিশকাত (মিশকাত শরীফের ব্যাখ্যা)
খ) শরহে নুখবাতুল ফিকর
গ) শরহে হাদীস ********************
ঘ) শরহে হাদীস ********************
ঙ) লাউমীউল আনওয়ার ফী মানাকীবিস সায়াদাতিল আতহার।
মুজাদ্দিদে আলফেসানীর যুগ
মুজাদ্দিদে আলফেসানীর নাম শায়খ আহমদ ইবনে আবদুল আহাদ ফারুকী সরহিন্দী (মৃঃ ১০৩৪ হিঃ)। তিনি শায়খ ইয়াকুব সাইফীর নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করেন এবং বুখারী শরীফ, তাবরিজীর মিশকাত ও সুয়ূতীর জামেউস-সগীর শিক্ষা দেওয়ার অনুমতি লাভ করেন। কাযী বহলূল বদখাশানীর নিকট হইতে সিহাহ সিত্তাহ বর্ণনা করার অনুমতি লাভ করেন। তিনি হাদীস সম্পর্কে ‘হাদীসে আরবায়ীন’ গ্রন্হ ব্যতীত অপর কোন গ্রন্হ রাখিয়া যান নাই। তিনি কুরআন-হাদীসের ভিত্তিতে মুসলিম সমাজ সংস্কার ও সংশোধনের এক বিরাট আন্দোলন পরিচালনা করেন। তাঁহার ‘মকতুবাত’ গ্রন্হে কুরআন-হাদীস শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। ফলে বহু লোক ইলমে হাদীস শিক্ষা করিয়া উহাতে পারদর্শিতা লাভ করিতে উদ্বুদ্ধ ও আগ্রহান্বিত হন। এই সময়কার কয়েকজন মুহাদ্দিসের নাম উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১. শায়খ সায়ীদ ইবনে আহমদ সরহিন্দী (মৃঃ ১০৭০ হিঃ)
২. শায়খ সায়ীদের পুত্র ফরুখ শাহ (মৃঃ ১১১২ হিঃ)
৩. সিরাজ আহমদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৩০ হিঃ) । তাঁহার তিনখানি গ্রন্হ উল্লেখযোগ্যঃ
ক) মুসলিম শরীফের ফারসী তরজমা
খ) জামে তিরমিযীর ফারসী তরজমা
গ) খাদ্য ও পানীয় সম্পর্কিত হাদীসসমূহের সমষ্টি।
৪. শায়খ মা’সুম ইবনে আহমদ সরহিন্দী (মৃঃ ১০৮০ হিঃ)
৫. খাজা আজম ইবনে সায়ফুদ্দীন সরহিন্দী (মৃঃ ১১১৪ হিঃ)।
তিনি বাদশাহ আলমগীরের আমলে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন। ‘ফায়যুল বারী শারহে সহীহিল বুখারী’ নামে তিনি বুখারীর ব্যাখ্যা গ্রন্হ রচনা করেন।
৬. শাহ আবূ সায়ীদ ইবনে সাফিউল কাদর মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৫০)
৭. শাহ আবদুল গনী ইবনে সায়ীদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৯৬ হিঃ)
তিনি ‘ইনজাহুল হাজা শরহে ইবনে মাজাহ’ নামে ইবনে মাজা হাদীস গ্রন্হের রচনা করেন।
শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভীর যুগ
শায়খ আবদুল হক মক্কা শরীফে শায়খ আবদুল ওহাব মুত্তাকীর (মৃঃ ১০১০ হিঃ) নিকট হাদীস অধ্যায়ন করেন ও তাঁহার নিকট হইতে সিহাহ সিত্তা সম্পর্কে ‘অনুমতি’ লাভ করেন। হাদীস সম্পর্কে তাঁহা নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী চিরস্থায়ী ও মহামূল অবদানঃ
ক) ‘আততারীকুল কাভীম ফী শরহে সিরাতিল মুস্তাকীম। ‘সফরুস সায়াদাত’ গ্রন্হের ফারসী ব্যাখ্যা।
খ)আশরাতুল-লুময়াত ফিল মিশকাত (মিশাকত শরীফের ফারসী ব্যাখ্যা)।
গ) ‘লাময়াতুত-তানকীহ ফী শরহে মিশকাতিল মাসাবীহ’।
ঘ) আল-ইকামাল ফী আসমাইর রিজাল
ঙ) জামেউল বরাকাত মুনতাখাব শরহিল-মিশকাত
চ) ‘মা সাবাতা বিস সুন্নাহ ফী আইয়ামিস সানাহ
ছ) ‘আল-হাদীসুল আরবায়ীন’
জ) ‘তরজুমাতুল আহদীসিল আরবায়ীন’
ঝ) ‘দস্তুরে ফায়যুন নূর’
১০. ‘যিকরুল ইজাজাতিল হাদীস ফিল কাদীম আল-হাদীস’
শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী তাঁহার এই বিরাট হাদীস সাধনা এবং গ্রন্হজগতে তাঁহার এই অবিস্মরণীয় অবদানের ফলে এদেশের হাদীস শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হয়।
‘তারীখে উলামায়ে হিন্দ’ গ্রন্হ প্রণেতা তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ভারতে ইলমে হাদীসের বীজ তিনিই সর্বপ্রথম বপন করেন।
তিনি স্থায়ীভাবে হাদীসের দারস দানের কাজ করেন। তাঁহার বংশধরদের মধ্যে বহু ব্যাক্তি শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হিসাবে মর্যাদা পাইবার অধিকারী হন। এখানে তাঁহাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১. শায়খ নূরুল হক (মৃঃ ১০৭৩ হিঃ)। তিনি তাঁহার পিতার নিকটই ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। তাঁহার হাদীস সম্পর্কীয় গ্রন্হ দুইখানিঃ
ক) তাইসীরুল কারী ফি শরহে সহীহিল বুখারী
খ) শরহে শামায়েলুন্নবী
২. হাফেজ আবদুর সামাদ ফখরুদ্দীন ইবনে মুহিব্বুল্লাহ (মৃঃ ১১৬০ হিঃ)। তাঁহার গ্রন্হাবলী এইঃ
ক) মানবাউল ইলম ফী শারহে সহীহিল মুসলিম। মূলত ইহা তাঁহার পিতার লিখিত গ্রন্হ; তিনি ইহার সম্পাদনা করেন মাত্র।
খ) শরহে আইনুল ইলম
গ) শরহে হিসনে হাসীন
৩. শায়খুল ইসলাম ইবনে হাফেজ ফখরুদ্দীন (মৃঃ ১১৮০ হিঃ)। তাঁহার হাদীস গ্রন্হ তিনখানিঃ
ক) শরহে সহীহুল বুখারী
খ) রিসালা কাশফুল গিতা-আম্মা লাজিমা লিল মাওতা অল আহইয়া (মুয়াত্তা গ্রন্হের ব্যাখ্যা)।
রিসালা তরদুল আওহাম আন আসরিল ইমামূল হুমাম।
৪. সালামুল্লাহ ইবনে শায়খুল ইসলাম মুহাদ্দিস (মৃঃ ১২২৯ )। তিনি ‘মুহাদ্দীসে রামপুরী’ নামে খ্যাত। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্য
১) আল মুহাল্লাহ বি আসরারিল মুয়াত্তা।
২) তরজমায়ে ফারসী সহীহিল বুখারী
৩) তরজমায়ে ফারসী শামায়েলুন্নবী
৪) রিসালা ফী উসুলিল হাদীস
৫. শায়খ সাইফুল্লাহ ইবনে নূরুল্লাহ বিন নূরুল হক। তিন সম্রাট আলমগীরের আমলে ‘আশরাফুল অসায়েল ফী শারহিশ শামায়েল’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন।
শায়খ আবদুল হকের ছাত্রবৃন্দ
১) খাজা খারেন্দ মুয়ীনুদ্দীন (মৃঃ ১০৮৫ হিঃ), (২) খাজা হায়দার পাতলু (মৃঃ ১০৫৭ হিঃ), (৩) বাবা দায়ুদুল মিশতাকী কাশ্মীরী, (৪) শায়খ এনায়েতুল্লাহ মাহাদ্দিসে কাশ্মীরী (মৃঃ ১১৯৫ হিঃ),- ইনি ৩৬ বৎসর পর্যণ্ত হাদীসের দারস দিয়াছেন। (৫) মীর সাইয়েদ মুবারক বিলগিরামী (মৃঃ ১১১৫ হিঃ),- তিনি শামায়েলুন্নবী ও হিসনে হাসীনের ফারসী ব্যাখ্যা লিখেন। (৬) মীর আবদুল জলীল বিলগিরামী (মৃঃ ১১৩৮ হিঃ),- তিনি আসমাউল রিজাল বিষয়ে পারদর্শী মুহাদ্দিস ছিলেন, (৭) মীর আযাদ বিলগিরামী (মৃঃ ১২০০ হিঃ),- তাঁহার হাদীস সম্পর্কিত গ্রন্হাবলীর নামঃ
ক) আজ জুয়ুদ্দরারী শরহে সহীহিল বুখারী
খ) শামামাতুল আম্বর ফী মা আরাদা ফিলহিন্দে মিন সাইয়েদিল বাশার
গ) সুবহাতুল মুরজান ফী আসারে হিন্দুস্থান।
ঘ) মখদুম সায়াদ ফী হুসনে খাতিমাতুল সায়াদা।
নিম্নলিখিত মুহাদ্দিসগণ হিজরী একাদশ শতকের মধ্যভাগ হইতে দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত খ্যাতি লাভ করেনঃ
১) মুহাম্মদ সিদ্দীক ইবনে শরীফ (মৃঃ ১০৪০ হিঃ), ২) শায়ক হুসাইনুল হুসাইনী (মৃঃ ১০৪৩ হিঃ) ৩) সাইয়েদ জা’ফর বদরে আলম (মৃঃ ১০৮৫ হিঃ)- তিনি ‘আল ফায়জুততারী ফী শরহে সহীহিল বুখারী’ ও ‘রাওজাতুশ-শাহ’ নামে দুইখনি গ্রন্হ রচনা করেন, ৪) আবুল মাজদ মাহবুবে আলম (মৃঃ১১১১ হিঃ)- তিনি ‘ যীনাতুন নুকাত ফী শারহিল মিশকাত’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন, ৫) শায়খ ইয়াকুব বানানী লাহোরী (মৃঃ১০৯৮ হিঃ)- তিনি নিম্নলিখিত তিনখানি গ্রন্হ রচনা করেনঃ
ক) আল খায়রুল জারী ফী শরহে সহীহিল বুখারী
খ) আল মু’লিম ফী শরহে সহীহিল মুসলিম
গ) কিতাবুল মুসাফফা ফী শরহে মুয়াত্তা
৬) মওলানা নয়ীম সিদ্দীকী (মৃঃ ১১২০ হিঃ)- তিনি মিশকাতুল মাসাবীহর একখানি ব্যাখ্যাগ্রন্হ রচনা করেন, (৭) শায়খ মুহাম্মদ আকরাম ইবনে আবদুর রহমান (মৃঃ ১১৩০ হিঃ)। (৮) শায়খ ইয়াহইয়া ইবনে আমীর আল-আব্বাসী (মৃঃ ১১১৪ হিঃ)- ইনি (ক) ‘ইয়ানাতুল কারী শরহে মুলাসীয়াতে বুখারী (খ) আরবায়ীন (গ) তাযকিরাতুল আসহাব প্রভৃতি গ্রন্হ রচনা করেন, (৯) শায়খ মুহাম্মদ ফাখের ইলাহবাদী (মৃঃ ১১৬৪ হিঃ)- তিনি হাদীস বিষয় নিম্নলিখিত ৪ খানা গ্রন্হ রচনা করেনঃ ক) কুররাতুল আইন ফী ইসবাতে রাফয়ে ইয়াদাইন খ) রিসালায়ে নাজাতীয়া দর আকায়েদে হাদীসীয়া (গ) নজমে ইবরাতে সফরুস সায়াদ (ঘ) মসনভী দর তা’রীফে হাদীস। (১০) মওলানা আমীনুদ্দীন মুহাম্মদ উমারী (মৃঃ ১১৪৫ হিঃ), (১১) মওলানা নূরুদ্দীন ইবনে সালেহ আহমদাবাদী (মৃঃ ১১৫৫ হিঃ)- তিনি ‘নূরুল কারী শরহে সহীহিল বুখারী’ নামে বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা রচনা করেন, (১২) মীর্যা মুহাম্মদ ইবনে রুস্তাম বাদাখশী (মৃঃ ১১৯৫ হিঃ)। তাঁহার নিম্নলিখিত হাদীস গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ
ক) মিফতাহুন নাজা ফী মানকিবিল আবা
খ) তারাজিমুল হুফফাজ
গ) নুযুলুল আবরার বিমা সাহহা মিন মানাকিবে আহলিল বায়তিল আতহার
ঘ) তুহফাতুল মুহিব্বীন ফী মানাকিবে খুলাফায়ে রাশেদীন।
(১৩) মীর্যা জান জলন্ধরী বিরাকী (মৃঃ ১১০০ হিঃ)- তিনি ‘নজমুদ দরার অল মরজান’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন।
(১৪) মুহাম্মদ সিদ্দীক লাহোরী (মৃঃ১১৯৩ হিঃ)- তিনি ‘ইযালাতুল ফাসাদাত ফী শরহে মানাকিবিস সায়াদাত’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন।
(১৫) শায়খ হাশেম ইবনে আবদুল গফুর সিন্দী। তিনি সহীহ বুখারী শরীফকে সাহাবাদের ক্রমিক পর্যায় পরম্পরানুযায়ী নূতনভাবে সজ্জিত ও সুবিন্যাস্ত করেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর যুগ
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর যুগে উপমহাদেশে হাদীস শাস্ত্রের চরম বিকাশের অধ্যায় সূচিত হয়। এই সময়ই ইহা একটি উন্নত বিজ্ঞান হিসাবে মর্যাদা লাভ করে। ইহার পশ্চাতে যুগ-ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহর দান অপরিসীম ও অতুলনীয়। তিনি ১১১৪ হিজরী সনের ১৪ই শাওয়াল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার ইন্তেকাল হয় ১১৭৬ হিজরীতে। তিনি হাদীসে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য মক্কা ও মদীনায় গমন করেন। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী উল্লেখযোগ্যঃ
ক) হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা
খ) আরবায়ীন
গ) অসীকাতুল আখইয়ার
ঘ) আদদুররুস সামীন ফী মুবাশশরাতিন্নবীয়িল আমীন
ঙ) আল ফযলুল মুবীন ফিল মুসালসাল মিন হাদীসিন্নবীয়িল আমীন
চ) আল ইরশাদ ইলা মুহিম্মাতিল ইসনাদ
ছ) তারাজিমুল বুখারী
জ) শরহে তারাজীমে আবওয়াবিল বুখারী
ঝ) মুসাফফা শরহে মুয়াত্তা
ঞ) মুসাওয়া শরহে মুয়াত্তা
ট) আসারূল মুহাদ্দিসীন।
শাহ ওয়ালীউল্লাহর প্রভাবাধীন যেসব মুহাদ্দিসের আবির্ভাব হয়, তাঁহাদের নাম নিম্নে দেওয়া গেলঃ
১) কাযী সানাউল্লাহ পানিপতি (মৃঃ১২২৫ হিঃ)। তিনি ‘আল-লুবাব’ নামে একখানি হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।
২) শাহ আবদুল আযীয ইবনে ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (মৃঃ ১২৩৬ হিঃ)। তিনি প্রায় ষাট বৎসর পর্যন্ত হাদীস শিক্ষাদানে ব্যাপৃত থাকেন। ফলে তাঁহার অসংখ্য ছাত্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে হাদীস শিক্ষা ও প্রচারে নিযুক্ত হন। তাঁহাদের কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১) শাহ রফী উদ্দীন দেহলভী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ) (২), শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল শহীদ (শাহাদাতঃ ১২৪৬ হিঃ) (৩) শাহ মুহাম্মদ মকসুদুল্লাহ (মৃঃ ১২৭৩ হিঃ) (৪) মুন্সী সদরুদ্দীন দেহলভী (মৃঃ ১২৫৮ হিঃ) (৫) হাসান আলী মুহাদ্দিস লখনভী, (৬) হুসাইন আহমদ (মৃঃ ১২৭৫ হিঃ) (৭) শাহ রউফ আহমদ মুজাদ্দেদী (মৃঃ ১২৪৯ হিঃ) (৮) শাহ ফজলূর রহমান গঞ্জ মুরাদাবাদী (মৃঃ ১৩১৫ হিঃ), (৯) খুররম আলী বলহারী (মৃঃ ১২৭১ হিঃ) তিনি আসসাগীনার ‘মুশারিকুল আনওয়ার’ ও শাহ ওয়ালীউল্লাহর ‘আরবায়ীন’ গ্রন্হের উর্দূ অনুবাদ করেন। (১০) শাহ আবূ সায়ীদ (মৃঃ ১২৫০ হিঃ) (১১) মুহাম্মাদ শকুর (মৃঃ ১৩০০ হিঃ) (১২) শাহ যহুরুল হক ফুলওয়ারী, (১৩) আওলাদ হুসাইন, (১৪) করম উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (মৃঃ ১২৫৮ হিঃ) (১৫) আলামাতুল্লাহ বদায়ীনী।
শাহ আবদুল আযীযের হাদীস সম্পর্কীত গ্রন্হাবলী মাত্র দুইখানি। তাহা এইঃ
ক) বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন (ফার্সী), খ) উজালায়ে নাফেয়া।
৩) শাহ ইসহাক ইবনে আফযাল ফারূকী দেহলভী (মৃঃ ১২৬২)- তিনি ২০ বৎসর পর্যন্ত হাদীস শিক্ষাদানে নিযুক্ত থাকেন। সমগ্র ভারতে তাঁহার ছাত্রগণ ছড়াইয়া পড়েন। (৪) মাযহাব নানুতুবী (মৃঃ ১৩২০ )। (৫) আহমাদ আলী সাহারানপুরী (মৃঃ ১২৯৭)- তিনি মক্কা ও মদীনায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। তিনি তা’লীকাতে বুখারী, মুকাদ্দামায়ে বুখারী ও তিরমিযী শরীফের হাশিয়া (Marginal notes) ইত্যাদি রচনা্ করেন। (৬) মওলানা কাসেম নানুতুবী (মৃঃ ১২৯৭) (৭) মিয়া সাহেব সাইয়েদ নযীর হুসাইন (মৃঃ১৩২০)। (৮) মওলাবী নওয়াব মুহাম্মদ কুতুবুদ্দীন মুহাদ্দিস-ই দেহলভী- শাহ ইসাহক দেহলভীর নিকট তিনি ইলমে হাদীস শিক্ষা করেন। অতঃপর মক্কা ও মদীনায় গমন করিয়া হাদীসের উচ্চতর সনদ লাভ করেন। হাদীস সম্পর্কে তাঁহার নিম্নলিখিত গ্রন্হদ্বয় উল্লেখযোগ্যঃ
ক) মাজাহিরে হক- মিশকাত শরীফের উর্দূ অনুবাদ ও ভাষ্য খ) তরজমা হিসনে হাসীন।
শাহ ইসহাক সাহেবের পর হাদীস শিক্ষাদানের বিভিন্ন কেন্দ্র গড়িয়া উঠে। পূর্বোক্ত মনীষীগণেরই ছাত্রগণ পাক-ভারতের বিভিন্ন স্থানে নিজস্বভাবে ইলমে হাদীসের শিক্ষাদান ও প্রচারাকর্য শুরু করেন। শাহ আবূ সায়ীদ মুজাদ্দিসীর উত্তরাধিকারী শাহ আবদুল গনীর নিকট বহু লোক হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ হাদীস বিজ্ঞানের পারদর্শী মনীষীরূপে খ্যাতিলাভ করেন।
১) মওলানা আবদুল হাই লখনভী (মৃঃ ১৩০৪), মওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী, মওলানা কাসেম, মওলানা ইয়াকুব, মওলানা আবদুল হক ইলাহাবাদী, শায়খ হাবিবুর রহমান রুদোলভী, মওলানা মুহাম্মদ হুসাইন ইলাহাবাদী, শায়খ মুহাম্মদ মা’সুম মুজাদ্দিদি, মওলানা জাফরী, মওলানা আলীমুদ্দীন বলখী, শায়খ মঞ্জুর আহমদ হিন্দী।
মওলানা আবদুল হাই মরহুম ফিরিঙ্গী মহলে হাদীস শিক্ষাদান কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাঁহার নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত লোকেরা হাদীসশাস্ত্রে যথেষ্ট পারদর্শিতা লাভ করেন। এই পর্যায়ের কয়েকজন মুহাদ্দিসের নাম এখানে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
(১) মওলানা জহীর আহমদ ‘শওক’। তিনি আ-সা-রিস-সুনান (********************) নামে একখানি হাদীসগ্রন্হ প্রণয়ন করেন। (২) মওলানা আবদুল হাদী আজীমাবাদী (৩) মওলানিা মুহাম্মদ হুসাইন ইলাহাবাদী, (৪) হাফেজে হাদীস মাওলানা ইদরীস সাসরামী (৫) মওলানা আবদুল গফুর রমযানপুরী (৬) মওলানা আবদুল করীম পাঞ্জাবী (৭) শাহ সুলায়মান ফুলওয়ারী – তিনি এককালে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানা ছিলেন। (৮) মওলানা আবদুল হাই (৯) মওলানা আবদুল ওয়াহাব বিহারী (১০) মওলানা আবদুল বারী – তিনি ‘আ-সা-রিস-সুনান গ্রন্হের’ ব্যাখ্যা রচনা করেন।
মওলানা সাইয়েদ নজীর হুসাইন দেহলভীর (মৃঃ ১৩২০ হিঃ) মারফতে এই উপমহাদেশে ইলমে হাদীস ব্যাপক প্রচার লাভ করে। তিনি আহলে হাদীস জামায়াতের নেতা ছিলেন। শত সহস্র ছাত্র তাঁহার নিকট ইলমে হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়া উপমহাদেশের বিভিন্ন দিকে ছড়াইয়া পড়েন। এই পর্যায়ে মুহাদ্দিসগণের মধ্য হইতে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
(১) মওলানা শামসুল হক দাহানূভূ। তিনি ‘গায়াতুর মকসুদ’ নামে একখানি গ্রন্হ রচনা করেন। (২) মওলানা আশরাফ আলী। তিনি ‘আইনুল মা’বুদ নামে গ্রন্হ রচনা করেন। (৩) মওলানা আবদুর রহমান মুবারকাপুরী- তিনি ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ নামে তিরমিযী শরীফের একখানি বিরাট শরাহ কিতাব লিখেন। (৪) মওলানা সায়াদাত হুসাইন- তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার ইলমে হাদীসের অধ্যাপক ছিলেন। (৫) মওলানা আমীর আলী মলীহাবাদী- তিনি হিদায়া (ফিকাহ গ্রন্হের) টিকা রচনা করিয়াছেন। (৬) মওলানা জমীল আনাসারী- তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় হাদীসের দারস দিতেন। (৭) মওলানা আহমদুল্লাহ (মৃঃ ১৩৬২)- তিনি দিল্লীর রহমানিয়া মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস ছিলেন। (৮) মওলানা আলম আলী নগীনুভী, রামপুরে হাদীস শিক্ষাদানে সাইয়েদ আবূ মুহাম্মদ বরকত আলী শাহ, মওলানা হাসান শাহ, মওলানা মুনাওয়ার আলী এবং তাঁহার ছাত্র মাওলানা বেলায়েত হুসাইন প্রমুখ বড় বড় মুহাদ্দিস আবির্ভূত হন।
মওলানা শাহ আবদুল গনীর ছাত্র মওলানা মুহাম্মদ কাসেক ও মওলানা রশীদ আহমদ দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বিগত কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান হইতে কয়েক সহস্র মুহাদ্দিস পাক-ভারতের দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছেন। মওলানা খলীল আহমদ সাহেব এই পর্যায়ের বড় মুহাদ্দিস। তিনি ‘বযলুল মজহুদ’ নামে আবূ দাঊদ শরীফের এক উচ্চমানের জ্ঞানগর্ভ ব্যাখ্যা-গ্রন্হ রচনা করেন।
মওলানা মাহমুদুল হাসান (শায়খুল হিন্দ) দীর্ঘকাল পর্যন্ত দেওবন্দ মাদ্রাসার শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিস ছিলেন ও বহুশত লোক তাঁহার নিকট হলমে হাদীসের শিক্ষালাভ করেন। মওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস। তিনি বুখারী ও তিরমিযী শরীফ পড়াইবার সময় যে ভাষণ দিয়াছেন তাহা তাঁহার ছাত্রদের কর্তৃক লিপিবদ্ধ হইয়াছে এবং যথাক্রমে ‘ফয়যুলবারী’ শরহে বুখারী ও ‘আল-আরফুশ-শাযী শরহে তিরমিযী ‘ নাম প্রকাশিত হইয়াছে।
মওলানা আহমদ আলী সাহারানপুরীর নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করিয়া বহু লোক বাংলা-আসামে হাদীসের দারস দানে ব্যাপৃত হন। তাঁহার ছাত্রদের মধ্যে মুফতী আবদুল্লাহ টুংকী ও মওলানা নাজের হাসান দেওবন্দী সর্বাধিক খ্যাতিলাভ করেন। পূর্ব বাংলা ও আসাম এলাকায় তাঁহাদের ছাত্র এবং এই গ্রন্হকারের খাস উস্তাদ মওলানা মুহাম্মদ হুসাইন সিলহটী ও মওলানা মুমতাযদ্দীন সাহেবান বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেন।[এই পর্যায়ের আলোচনা সুসংবদ্ধভাবে খুব বেশমী সংখ্যক গ্রন্হে পাওয়া যায় না। এই আলোচনারঞ্জ যাবতীয় গ্রন্হ নিম্নলিখিত গ্রন্হাবলী হইতে গৃহীত। (1) জনাব ডাঃ ইসহাক সাহেবের গবেষণামূলক গ্রন্হ Indian’s Contribution to the Study of Hadith Literature, (২) মওলানা মুফতী আমীমুল ইহসান লিখিত ******************** (৩)******************** (৪)******************** মওলানা আবদুল গফফার হাসান সংকলিত ******************** এর ভূমিকা ইত্যাদি। ‘মানের-এর বিখ্যাত হাদীসবিদ শায়খ মাখদুমুল মূলক তাঁহার নিকট সুদীর্ঘ ২২ বৎসর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে ইলমে হাদীস ও অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন। (মানাকিবুল আসফিয়া) (Islamic Culture, vol-xxvll- No-1]
বঙ্গদেশে ইলমে হাদীস
গৌড় পাণ্ডুয়া
আলাউদ্দীন হুসাইন শাহ ইবনে সাইয়েদ আশরাফ মক্কী ৯০০ হিজরী হইতে ৯২৪ হিজরী পর্যন্ত বঙ্গদেশে রাজত্ব করেন। তিনি সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন করেন। শুধু তাহাই নহে, তাঁহার শাসনাধীন এলাকায় কুরআন ও হাদীস শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন করার ব্যাপারেও তাঁহার দান অবিস্মরণীয়। তিনি দূর ও নিকটবর্তী এলাকা হইতে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী লোকদিগকে তাঁহার রাজ্যে আসিবার ও এখানে বসবাস করিবার জন্য আহবান জানাইলেন। ৯০৭ হিজরী সনে (১৫০২ ইং) তিনি গৌড়স্থ গুরবায়ে শহীদ নামক স্থানে (বর্তমান মালদহ জিলার অন্তর্ভূক্ত) এখটি উন্নত ধরনের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। পাণ্ডুয়াতে একটি কালেজও তিনি স্থাপন করেন। এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইলমে হাদীসের শিক্ষাদান করা হইত। ৯১১ হিজরী সনে (১৫০৩ ইং) মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজদান বখশ (খাজেগীর শিরওয়ানী নামে খ্যাত) সহীহ বুখারীকে তিন খণ্ডে নকল করেন। ইহা বাকীপুরস্থ অরিয়েন্টাল লাইব্রেরীতে রক্ষিত আছে।
সোনারগাঁও
পূর্বেই উল্লেকিত হইয়াছে যে, মুহাদ্দিস শরফূদ্দীন আবূ তাওয়ামা বুখারী হাম্বলী (মৃঃ ৭০০ হিঃ) সপ্তম শতকে ঢাকা জিলাধীন সোনার গাঁও আগমন করেন এবং এখানে হাদীস শিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে ইহা ইলমে হাদীসের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁহার ইন্তেকালের পরও কিছুদিন পর্যন্ত এই অবস্থা অব্যাহত থাকে। এই সময় এতদঞ্চলে সায়াদাতের (৯০০-৯৪৫ হিঃ) রাজত্ব ছিল। পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসাবে সোনার গাঁয়ে বহু সংখ্যক হাদীস বিশারদ সমবেত হন এবং এই স্থানেও বহু লোক ইলমে হাদীস শিক্ষা করিয়া পারদর্শিতা লাভ করেন। এই যুগে এতদঞ্চলে হাদীস চর্চার এতই ব্যাপকতা ছিল যে, বহু মসজিদ ও বহু খানাকা এই উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করা হয়। প্রসিদ্ধ হাদীসবিজ্ঞ তকীউদ্দীন আইনুদ্দীন (৯২৯ হিঃ)- এর চেষ্টায় এখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন নুসরত ইবনে হুসাইন শাহ-এর রাজত্ব। কাজেই একথা বলিষ্ঠভাবেই বলা যাইতে পারে যে, সায়াদাতের শাসন আমলেই সোনার গাঁও হাদীস শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল। সম্ভবত পূর্ব বাংলার মুসলিম শাসনের শেষ পর্যায় পর্যন্তই উহার এই গৌরব অব্যাহত ও অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু পরবর্তী বৃটিশ শাসন আমলে সোনার গাঁওয়েল স্বর্ণকিরণ নিঃশেষে বিলীন হইয়া যায়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হইতে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক বড় বড় মাদ্রাসায় ইলমে হাদীসের উচ্চশিক্ষা দানের কাজ চালু হয়। ফলে প্রতি বৎসর যথেষ্ট সংখ্যক লোক হাদীসের শিক্ষা লাভ করিয়া দ্বীন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির সহিত পরিচিত হন। যদিও শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রটির দরুন তাহারা পূর্বকালের হাদীস শিক্ষার্থীদের ন্যায় উপকৃত হইতে ও অনুরূপ পারদর্শিতা লাভ করিতে সমর্থ হন নাই।
উপমহাদেশে হাদীস গ্রন্হ সংকলন
উপমহাদেশের আযাদী উত্তর যুগে ইলমে হাদীস চর্চাও ব্যাপক প্রচারের দিকে মনীষীদের বিশেষ লক্ষ্য আরোপিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। বিশেষত ইসলামের মূল উৎস ও ভিত্তির সহিত জনগণকে পরিচিত করার উদ্দেশ্যে কিছু কিছু চেষ্টাও শুরু হইয়াছে। নূতনভাবে হাদীসগ্রন্হ সংকলন এবং উর্দূ ও বাংলা ভাষায় হাদীসের তরজমা ও ব্যাখ্যা রচনার কাজও শুরু হইয়াছে। অদূর ভবিষ্যতে ইহা ব্যাপক রূপ লাভ করিবে বলিয়া আশা করা যায়।[ডঃ ইসহাক লিখিত Indian’s Contribution to the Study of Hadith Literatur অবলম্বনে লিখিত এবং তাহা হইতে সংগৃহীত।]
ইলমে হাদীস বনাম অমুসলিম মনীষীবৃন্দ
হাদীস মুসলমানদের নিকট অমূল্য সম্পদ। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় হইতেই ইহার প্রতি অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে এবং ইহার রক্ষণাবেক্ষণ, প্রচার ও শিক্ষাদানের উপযুক্ত ব্যবস্থা প্রথম হইতেই অব্যাহত রহিয়াছে। কুরআনের পরই হাদীসের এই মর্যাদার কথা মুসলিমগণ কোন দিনই বিস্মৃত হইতেপারে নাই। কিন্তু অমুসলিম মনীষীদের মনে হাদীস সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হইয়াছে। কোন কোন মনীষী ইহাকে উদার দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইহার গুরুত্ব অনুধাবন ও উহার অকপট স্বীকৃতি দানে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হন নাই।
কিন্তু কোন কোন ইউরোপীয় চিন্তাবিদ হাদীসের গুরুত্ব স্বীকার করিতে পারেন নাই। এমনকি অনেক লোক এমনও আছেন, যাঁহারা হাদীসের গুরুত্ব অস্বীকার সম্ভব নয় বলিয়াই উহার মধ্যে নানা প্রকার দোষক্রটি আবিস্খার করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছেন।
বর্তমান নিবন্ধে আমরা এই উভয় শ্রেণীর লোকদের কিছু কিছু উক্তি পেশ করিতে চাই। যাঁহারা কোন না কোন দিক দিয়া ইলমে হাদীস, উহার সংগ্রহ এবং মুহাদ্দিসণের হাদীস যাচাই বাছাই পদ্ধতির উপর কোনরূপ কটাক্ষ করিয়াছেন তাঁহাদের কথার উত্তরে আমাদের বক্তব্যও সেই সঙ্গে পেশ করা হইবে।
হাদীসের সমর্থনে ইউরোপীয় মনীষী
১. প্রখ্যাত ইউরোপীয় ঐতিহাসক এডওয়ার্ড গীবন লিখিয়াছেনঃ ‘প্রত্যেক জাতির প্রতিষ্ঠাতার জীবন-চরিত দ্বারা তাঁহার লিখিত জ্ঞানসম্পদ পরিপূর্ণতা লাভ করে। হযতর মুহাম্মদের হাদীসসমূহ প্রকৃত সর্ত কথার পূর্ণাঙ্গ উপদেশ, তাঁহার কাজকর্ম, সততা ও নেক কাজের বাস্তব প্রতীক’।(********************)
২. মিসরের ‘ওয়াতন’ পত্রিকায় জনৈক খৃষ্টান মনীষী লিখিয়াছেনঃ ‘মুসলিমগণ কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে গবেষণা করিলে তাহাদের ধর্মীয় ও বৈষয়িক প্রয়োজন পূরণের সুব্যবস্থা তাহাতে পাইতে পরিবে।
৩. প্রসিদ্ধ রুশ দার্শনিক টলষ্টয় স্বীয় দেশ ও জাতির নৈতিক সংশোধনের জন্য হাদীসসমূহের এক সংকলন নিজ ভাষায় প্রকাশ করিয়াছিলেন।
(******************************************************)
৪. মুসলিমদের মধ্যে হাদীসের সূত্রে যেসব নৈতিক নিয়ম-কানুন প্রচলিত রহিয়াছে, হাইটিংগার উহার এক লা’চওড়া তালিকা প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টিতে মানুষকে কার্যত নেক কাজের দিকে আকৃষ্ট করার এবং পাপ হইতে বিরত রাখার এতদপেক্ষা উত্তম কর্মপ্রণালী আর কিছুই হইতে পারে না।(********************)
৫. স্যার উহিলয়াম ম্যূর লিখিয়াছেনঃ
‘প্রাথমিক যুগে মুসলিমদের জন্য সর্বাপেক্ষা অধিক উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তার বিষয়বস্তু সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কথা ও কাজ ছাড়া আর কি হইতে পারে। …………. এই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিই এই বিশ্বজয়ী জাতির অস্তিত্ব ও উত্থান লাভের একমাত্র কারণ। তিনিই মুসলিমদের হস্তে ইহকাল ও পরকাল উভয়েরই কুঞ্জিকা সমর্পণ করিয়া দিয়াছিলেন। এই কারণে হযতর মুহাম্মদের অনুসারীদের মধ্যে বেশীর ভাগ কথাবার্তা তাঁহার সম্পর্কেই হইত। এইসব উপায় উপাদানের কারণে হাদীস বিজ্ঞান যথেষ্ট উন্নতি লাভ করিয়াছে। (Life of Muhammad)
রাসূলে করীমের কণ্ঠ নিঃসৃত বাণী, তাঁহার কার্যকলাপের বিবরণ এবং তাঁহার নিকট অনুমোদন প্রাপ্ত কোন কতা, কাজ বা আচরণকেই বলা হয় হাদীস। এই হাদীসের বিশ্বস্ততা ও অকাট্যতা স্বভাবতঃই নির্ভর করে সঠিক সময়ে ও নির্ভূল পদ্ধতিতে হাদীস সংকলিত হওয়ার উপর। আর অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে একথা সুস্পষ্ট ও অনস্বীকার্য হইয়া উঠিয়াছে যে, পৃকৃত পক্ষে হাদীস রাসূলের জীবদ্দশায়ই রাসূলের হিদায়ত অনুযায়ীই লিপিবদ্ধ হইতে শুরু হইয়াছিল। ইলমে হাদীসের ইতিহাস অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তিই ইহা অস্বীকার করিতে পারেন না। কিন্তু কোন কোন পাশ্চাত্য মনীষীর আচরণ এই ব্যাপারে নৈরাশ্যজনক। তাঁহারা হাদীসের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে সঠিকরূপে অবহিত না হইয়ই এমন সব উক্তি করিয়াছেন, যাহার ফলে হাদীসের সঠিক সময়ে ও নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ ও সুরক্ষিত হওয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ পাঠকদের মনে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হইতে পারে।
আলফ্রেড-এর সন্দেহ
এই প্রসঙ্গে আমরা Alfred Guillame-Fr Islam গ্রন্হ হইতে একটি উক্তি উদ্ধৃত করিতে চাই। তাঁহার উক্ত গ্রন্হের ৮৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখিয়াছেনঃ
Exactly when records of the deeds and words of the Prophet were first written down we do not know; indeed early tradition is at variance with itselt on this very point. Some say that the Prophet authorized the writing of his saying; others assert that the forbade it.
ঠিক কখন যে হযরতের বাণী ও কার্যাবলীর বিবরণ প্রথম লিখিত হয়, তাহা আমরা জানি না। বাস্তবিকপক্ষে প্রথম যুগের হাদীসসমূহ এই বিষয়টি সম্পর্কে স্ববিরোধী। কেহ কেহ বলেন, রাসূল তাহার বাণী লিপিবদ্ধ করার অনুমতি দিয়াছিলেন। আবার অন্যরা দাবি করেন যে, তিনি উহা নিষিদ্ধ করিয়াছেন।
উদ্ধৃত উক্তিতে একই সঙ্গে কয়েকটি আপত্তিকর ইঙ্গিত করা হইয়াছে। ‘হাদীস ঠিক কখন লিপিবদ্ধ করা হইয়াছিল তাহা আমাদের জানা নাই’ বলিয়া লোকদের মনে হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক করার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। দ্বিতীয়ত রাসূলের ‘নিষেধ’ ও “অনুমতির’ মধ্যে বাস্তত সামঞ্জস্য স্থাপন না করিয়া এক চরম দ্বিধা ও সংশয় জাগাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অথচ এই বিরাট গ্রন্হের এতদসংশ্লিষ্ট আলোচনা প্রমাণ করে যে, কুরআনের সহিত হাদীস মিলিয়া মিশিয়া গিয়া মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব করিতে না পারে কেবল এই উদ্দেশ্যেই ইসলামী দাওয়াতের একবারে প্রাথমিক স্তরে হাদীস লিখিতে নিষেধ করা হইয়াছিল। কিন্তু অনতিবিলম্বেই এই নিষেধ আদেশে পরিবর্তিত হয় এবং সাহাবিগণ দ্বিধাসংকোচহীন মনে হাদীস লিখিয়া রাখিতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে এই কথাও মনে রাখিতে হইবে যে, একেবারে প্রথম যুগে কুরআন লিখার সঙ্গে সঙ্গে হাদীস লিখিতে নিষেধ করার ফলে উহার লিপিবদ্ধকরণ বন্ধ হইলেও উহার মৌখিক বর্ণনা এবং পারস্পরিক চর্চা ও আলোচনা বিন্দুমাত্র বন্ধ হইয়া যায় নাই। কেননা লিখিতে নিষেধ করা হইয়াছিল মাত্র। পরস্পরের নিকট মৌখিত বর্ণনা করিতে নিষেধ করা হয় নাই।
এতদ্ব্যতীত Goldziher এবং Sprenger নামে দুইজন প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদও এই পর্যায়ে জনমেনে সন্দেহের সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করিয়াছেন। Goldziher তাঁহার রচিত Muhammadanische Studim নামক গ্রন্হের দ্বিতীয় খণ্ডে পৃষ্ঠা ২৪১-২৫০ বহু সংখ্যক দলীল দিয়া প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরুতে হাদীস সংকলিত হইয়াছে। যদিও তিনি এই গ্রন্হেরই প্রথম ভাগে পৃষ্ঠা ১০-১২ এমন কিছু কথাও লিখিয়াছেন, যাহা হইতে রাসূলের যুগেই কতিপয় হাদীস সংকলন-সহীফা-সংকলিত হওয়া সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু একটু পরেই তিনি এই সহীফাসমূহের সত্যতার প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাষ সৃষ্টিাকারী অনেক তত্ত্বই করিয়াছেন।
তাঁহার এই রূপ ভূমিকার পশ্চাতে দুইটি উদ্দেশ্য নিহিত রহিয়াছে। প্রথম উদ্দেশ্য হইল হাদীস ও সুন্নাতের শুধু মুখস্থ করিয়া রাখার কথা বলিয়া উহার প্রমাণা মর্যদাকে দুর্বল করিয়া তোলা এবং হাদীস দ্বিতীয় হিজরী শতকে লিপিবদ্ধ হইয়াছে বলিয়া জনগণকে এক মারাত্মক বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত করা। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হইল হাদীস সংকলনকারিগণ নিজেদের ধারণা ও অভিমতের সমর্থনে এবং নিজেদের ‘অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মতলবেঃ হাদীস রচনা করিয়াছেন বলিয়া গোটা হাদীস ও সুন্নাহকে অকেজো ও সমর্থন-অযোগ্য প্রমাণ করা। এই প্রাচ্যবিদ হাদীস সংকলনের ইতিহাস জানান উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় দলীলাদি সংগ্রহ করার জন্য কোন কষ্ট স্বীকার করার উদ্দেশ্যেই চিন্তা ও গবেষণা চালাইয়াছেন। আসলে এইরূপ কাজ নিতান্ত স্বার্থবাদী ও উদ্দেশ্যে প্রণোদিত ব্যক্তিদের দ্বারাই সম্ভব হইতে পারে।
স্প্রেংগান তাঁহার Dao Traditious wesen dei den Arabern 1856, 1-17 Dans নামক গ্রন্হে রাসূলের নিকট হইতে নিভূলভাবে হাদীস পৌঁছার কথাকে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা পাইয়াছেন। হাদীস সংকলন পর্যায়ে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করিয়াছেন যে, হাদীস রাসূলের জীবনকার নয়, দ্বিতীয় হিজরী শতকে সংকলিত হইয়াছে। মূলত এই প্রাচ্যবিদের উদ্দেশ্যও শুভ নহে।
অবশ্য ডোজী স্বীকার করিয়াছেন যে, রাসূলের বিপুল সংখ্যক হাদীস মুখস্থ রাখা হইয়াছে এবং তাহা হইতেই গ্রন্হাকারে সংকলিত হইয়াছে। তবে তাহাতে অনেক রচিত ও মিথ্যা ‘হাদীস’ও শামিল হইয়াছে। ডোজীর এইরূপ উক্তিতে অনেক লোকের মনেই হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হইতে পারে। অথচ তাঁহার এই উক্তির পশ্চাতে কোন সদিচ্ছা লুক্কায়িত নাই। বরং হাদীস ও সুন্নাতের ব্যাপারে লোকদের, বিশেষত যাহারা হাদীস সংকলনের নির্ভূল ইতিহাস জানে না তাহাদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করাই তাঁহার উদ্দেশ্য।
এই পর্যায়ে আমাদের বক্তব্য হইল, আমাদের অতীতকাল ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রাথমিক ইতিহাসের সত্যাসত্য প্রমাণের জন্য তথাকথিত প্রাচ্যবিদদের অসংলগ্ন উক্তি ও ভিত্তিহীন কথাবার্তার প্রতি আমরা মোটেই ভ্রূক্ষেপ করিতে রাযী নহি। রাসূলের জীবনে হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংগৃহীত হওয়ার কথা পশ্চিমা পণ্ডিতরা স্বীকার করুক আর না-ই করুক, তাহাতে মুসলমানদের কিছুই আসে যায় না। কেননা ‘ঘরের লোকেরাই ঘরের অবস্থা সম্পর্কে অধিক অবহিত’- নবী করীমের সামনেই হাদীস লিখিত হইয়াছে, সংকলিত হইয়াছে হাদীসের বিপুল সম্পদ- সহীফা আকারে, ব্যক্তিগত নোট বই হিসাবে, একথা অকাট্য প্রমাণসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্হাবলী হইতেই অনস্বীকার্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। সেকালের সংকলিত সমস্ত হাদীস সম্পদই যে উত্তরকালে গ্রন্হাকারে সংকলিত ও সংযোজিত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। দৃষ্টান্তসরূপ বলা যায়, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের ‘মুসনাদ’ গ্রন্হে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ’স ও হযরত আবূ হুরায়রার সংকলিত বিপুল হাদীস-সহীফা- পুরাপুরি অন্তভূক্ত হইয়াছে।
অরিয়েন্টালিস্টরা মনে করেন, হাদীস লিখন ও সংকলন কিংবা উহা হইতে নিষেধ করার যেসব বাণী ও উক্তি উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা সবই মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদদের এক ধরনের মত পোষণের ফলে বিরচিত হইয়াছে। তাঁহারা নাকি নিজ নিজ মত ও রায়ের সমর্থনে পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে হাদীস রচনা করিয়াছেন।
কিন্তু ইহা চরম মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর উক্তি। এই বিভ্রান্তির প্রধান হোতা হইলেন গোল্ডজেহের (Goldziher)। কেননা তাঁহার পূর্ববর্তী প্রাচ্যবিদ স্প্রেংগার খতীব বাগদাদী লিখিত ******************** গ্রন্হখানি ১৮৫৫ সনে আবিষ্কার করেন এবং লেখার মূল ও অগ্রগতি (origin and progress of writing) শীর্ষক এক প্রবন্ধ রচনা করেন।(Asiatic Sociaty of Bangal XXV, 303-329) এই প্রবন্ধে তিনি আরব সমাজে লেখা প্রচলন, তদসংক্রান্ত প্রমাণাদির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, রাসূলের যুগে বিপুল সংখ্যক হাদীস লিখিত ও সংকলিত হইয়া থাকিবে।অথচ গোল্ডজেহের এইসব বিবরণকেই অসত্য মনে করিয়া উড়াইয়া দিয়াছেন এবং উত্তরকালে পরস্পরবিরোধী লোকেরা এইসব কথা রচনা করিয়াছেন বলিয়া প্রচার করিয়াছেন।
মূলত নিতান্ত কুমতলবে ও ইসলামের সংস্কৃতি বিকাশের প্রতি বিদ্বেষ পোষণবশত এইরূপ মিথ্যা প্রচারণা চালানো হইয়াছে। নতুবা বাস্তব দৃষ্টিতে বিচার করিলে এই ধরনের উক্তির কোন হেতুই থাকিতে পারে না। বহু সংখ্যক সাহাবী নবী করীমের জীবদ্দশায়ই যে হাদীস লিখন ও সংকলনের কাজ বিশেস গুরুত্ব সহকারে করিয়াছেন, তাহা এক অকাট্য সত্য। এই ব্যাপারে যে কোনরূপ সন্দেহ পোষণের কোনই কারণ থাকিতে পারে না, তাহা বলাই বাহুল্য। তবে এই কথা সত্য যে, সেকালে লিখিত ও সংকলিত সহীফার সংখ্যা খুব বিরাট এবং বেশী কিছু ছিল না। কিন্তু হাদীস যে লিখিত ও সংকলিত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ করার কোনই হেতু নাই।
মিঃ ম্যূরের উক্তি
স্যার ইউলিয়াম ম্যূর তাঁহার গ্রন্হ Life of Muhammad- এ মুহাদ্দিসগণের হাদীস যাচাই পদ্ধতি সম্পর্কে একর্টি অমূলক উক্তি করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
মুহাদ্দিসগণ কি ধরনের হাদীস সমালোচনা ও যাচাই পরখ করিতেন তাহা সুস্পষ্ট। তাহা এতদুর কঠোর যে, গড়ে শতকরা নিরানব্বইটি হাদীসকেই গ্রহণ-অযোগ্য গণ্য করিয়াছেন।
বস্তুত মিঃ ম্যূরের এই কথাটিরও কোন মৌলিক ভিত্তি নাই। তিনি মুহাদ্দিসদের হাদীস-যাচাই-বাচাই পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিকরূপে অবহিত হইলে এইরূপ উক্তি কখনো করিতেন না। ইমাম বুখারী তাঁহার সংগৃহীত ছয় লক্ষ হাদীসের মধ্য হইতে অন্তত নয় হাজার হাদীস সম্বলিত হাদীস বুখারী প্রণয়ন করিয়াছেন, ঠিক ইহা হইতেই মিঃ ম্যূরের উপরোক্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে। কিন্তু ইমাম বুখারী তাঁহার গ্রন্হ সমাপ্ত করার পর বলিয়াছেন যে, বহু সহস্র সহীহ হাদীস এই গ্রন্হের অন্তর্ভূক্ত হইতে পারে নাই। ইহার সুস্পষ্ট অর্থ এই যে, তিনি যেসব হাদীস তাঁহার গ্রন্হে শামিল করেন নাই,তাহা অশুদ্ধ বা গ্রহণ অযোগ্য নহে এবং তাঁহার গ্রন্হে সন্নিবেশিত হাদীসসমূহ ছাড়াও আরো বহু সহস্র সহীহ হাদীস বর্তমান রহিয়াছে। মিঃ ম্যূর ইহা হইতে সন্দেহ করিয়া বসিয়াছেন যে, যেসব হাদীস বুখারী গ্রন্হে সন্নিবেশিত হয় নাই ইমাম বুখারী বুঝি সেই-সবকে ‘অশুদ্ধ’ ও ‘অগ্রহণযোগ্য; বলিয়াই মনে করেন। ইমাম বুখারীর অগৃহীত হাদীসসমূহের সবই যদি বাস্তবিক গ্রহণের অযোগ্য হইত, তাহা হইলে তিনি উহাদের মধ্যে ‘সহীহ হাদীস রহিয়া গেল’ এমন কিছুতেই বলিতেন না। বস্তুত প্রত্যেক গ্রন্হ প্রণেতাই স্বীয় গ্রন্হের উপযোগী তথ্য বিপুল পরিমাণে সংগ্রহ করিয়া থাকেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত উহার সবকিছুকেই গ্রন্হে সন্নিবেশিত না করিলে যে তাহা সবই ‘অশুদ্ধ’ হইয়া যাইবে এমন কোন কথাই হইতে পারে না। এই তত্ত্ব বোধ হয় ম্যূর সাহেবের অজ্ঞাত রহিয়াছে। তিনি বোধ হয় ইহাও জানিতেন না যে, একজন মুহাদ্দিস কোন সব কারণে একটি হাদীসকে গ্রহণ- অযোগ্য ঘোষণা করিয়া থাকেন। এক একটি হাদীস বহুসংখ্যক সূত্রের মারফতে গ্রন্হকার পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে, তিনি তাঁহার নিজস্ব মানদণ্ড অনুযায়ী উহাদের প্রত্যেকটি সূত্রেরই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। যেসব সূত্রকে তিনি নির্ভরযোগ্য পাইয়াছেন, সেই সূত্র তিনি উক্ত হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন, আর যেসব সূত্রের উপর তিনি নির্ভর করিতে পারেন নাই, অথবা যাহা প্রয়োজনাতিরিক্ত হইয়াছে তাহা তিনি পরিহান করিয়াছেন। কিন্তু ইহার দরুন বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত সেই মূল হাদীসটি কখনো অগ্রহণযোগ্য হইয়া যায় না। বস্তুত হাদীসের সংখ্যা গণনা করা হয় উহার মতন-এর দৃষ্টিতে নয়, বরং বর্ণনা পরম্পরাসূত্রের ত্মঃশুস্ফত্র হিসাবে। এই কারণে ইমাম বুখারীর নিকট সংগ্রহীত মূল হাদীস কত সংখ্যক ছিল এবং তাহা কত কত সূত্রের মারফতে তাঁহার নিকট পৌঁছিয়াছিল, তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না।
ডাঃ স্প্রেংগারের সমালোচনা
ডাঃ স্প্রেংগার বিশেষভাবে ইমাম বুখারীর হাদীস যাচাই পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করিয়াছেন। তিনি তাঁহার গ্রন্হ Life of Muhammad- এ লিখিয়াছেনঃ
‘তিনি (ইমাম বুখারী) যেসব নীতি পদ্ধতির অনুসরণ করিয়াছেন, তাহাকে ‘হাদীস-সমালোচনা’ বলিয়া অভিহিত করা যায় না। তিনি কেবল দেখিতেন, বর্ণনাকারীদের পরম্পরা সুত্রের ধারাবাহিকতা সুরক্ষিত আছে কিনা, কোথাও তাহা বিচ্ছিন্ন হইয়া যায় নাই তো! এতদ্ব্যতীত হাদীস বর্ণনাকারীদের চালচলন- তথা চরিত্রেরও তিনি বিচার করিতেন। যেহেতু তাঁহার নীতি ছিল এই যে, যে হাদীস তাঁহার ‘বিদ্বেষ দুষ্ট’ মতের অনুকূল নহে তাহা তিনি প্রত্যাখ্যান করিতেন। এইজন্য তাঁহার কোন হাদীস প্রত্যাখ্যান করার অথ্য কোন মতেই ইহা হইতে পারে না যে, সেই হাদীস আসলেও গ্রহণ অযোগ্য। কিন্তু তাঁহার ‘জামে’ গ্রন্হ অন্যান্য মুসনাদ গ্রন্হ হইতে এই দিক দিয়া পৃথক ছিল যে, তাহা বিশেষ কোন ফিকাহ মতের অনুসারী ছিল না; বরং বর্ণনাকারীদের সততার উপরই নির্ভরশীল ছিল’।
ডাঃ স্প্রেংগারের এই কথা যাচাই করিলে সুস্পস্টরূপে মনে হয় যে, তিনি যেমন হাদীসের পরিভাষাসমূহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নহেন, তেমনি মুহাদ্দিসদের কর্মনীতি অবস্থা সম্পর্কেও তাঁহার কোন অভিজ্ঞতা নাই। উপরন্তু ইলমে হাদীসের বিভিন্ন শর্ত সম্পর্কেও তাঁহার সুস্পষ্ট কোন ধারণা নাই।
মুহাদ্দিসগণ প্রথম ‘দেরায়াত’ নীতির মানদণ্ডে হাদীস যাচাই করেন। কুরআন হাদীস এবং সাহাবায়ে কিরামের আমলেও তাঁহার অনুসৃত কর্মপদ্ধতি হইতেই এই নীতি গৃহীত হইয়াছে। ইহা সকলের পক্ষে অনিবার্যরূপে অনুসরণীয়। ইহা যেহেতু সাধারণ ও প্রচলিত মূলনীতি বিশেষ, সেইজন্য ইহা প্রকাশ করা মুহাদ্দিসদের পক্ষে কোন প্রয়োজনীয় কজ নহে। যেহেতু সকলেরই একথা জানা আছে যে, মুহাদ্দিসগণ হাদীসসমূহকে এই সকল নীতির উপর অবশ্যই যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। এই যাচাই পরীক্ষার ব্যাপারে কাহারো কোন ভূল থাকিলে তাহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাপার। প্রত্যেক মুহাদ্দিসই নিজস্ব সংগ্রহীত হাদীসসমূহের বর্ণনাপরম্পরা ধারা সঠিক ও দোষমুক্ত রাখার জন্য যারপরই নাই গবেষণা ও চেষ্টা চালাইয়া থাকেন। ইহা ছাড়া তাঁহারা কোন হাদীসই গ্রহণ করিতে আদৌ প্রস্তুত হইতে পারে না। এই কারণে প্রত্যেক মুহাদ্দিসই হাদীস বর্ণনাকারীদের যাচাই পরীক্ষা ও নিরীক্সা করিয়া নিজস্ব একটি বর্ণনাপরম্পরা সূত্র স্থাপন করিয়া থাকেন এবং সেই সূত্র হইতে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করিয়া থাকেন।
মনে হয় সহীহ বুখারী শরীফ কি ধরনের গ্রন্হ ‘জামে’ না ‘মুসনাদ’, ডাঃ স্প্রেংগার তাহাও ঠিকতম জানেন না। কেননা তিনি তো বুখারী শরীফকে ‘মুসনাদ’ ধরনের গ্রন্হ মনে করিয়া লইয়াছেন।
ডাঃ স্প্রেংগার ইমাম বুখারীর উপর হিংসা বিদ্বেষের অভিযোগ করিয়াছেন। ইহা সম্পূর্ণ অমূলক কথা। ইমাম বুখারী হিংসা বিদ্বেষ-দুষ্ট ছিলেন, এমন মনে করার কোন কারণ নাই। আসলে তিনি ইহা হইতে সর্বতোভাবে পবিত্র ও মুক্ত ছিলেন। এইজন্যই দেখিতে পাই যে, তিনি শিয়া মতাবলম্বী না হইয়াও তাঁহার অদ্বিতীয় হাদীস গ্রন্হে শিয়া বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ ও উহার অন্তর্ভূক্ত করিয়াছেন। উপরন্তু তিনি ছিলেন শাফেয়ী মতাবলম্বী, কিন্তু তাঁহার সংকলিত গ্রন্হে শাফেয়ী মতের বিপরীত অনেক হাদীস গ্রহণ করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই। মনে হয় এই সব কথা ডাঃ স্প্রেংগারেরে একেবারেই অজ্ঞাত।
মিঃ ম্যূরের অপরাপর উক্তি
এই প্রসঙ্গে মিঃ ম্যূরের আরো কয়েকটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁহার Life of Muhammad গ্রন্হের এক স্থানে হাদীস যাচই পদ্ধতি সম্পর্কে কটাক্ষ করিয়া বলিয়াছেনঃ
মুহাদ্দিসদের নিকট কোন হাদীসের গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য সেই হাদীসের মূল কথাটির ******************** উল্লেক প্রয়োজনীয় বিবেটিত হইত না। কেবল হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম উল্লেখ করাই যথেষ্ট ছিল।
মিঃ ম্যূরের এই কথা হইতেও প্রমাণিত হয় যে, ইলমে হাদীসের পরিভাষা ও হাদীস যাচাইয়ের রীতিনীতি সম্পর্কে তিনি সবিশেষ অবিহিত নহেন। কেননা হাদীস যাচাই করার জন্য ‘রেওয়ায়েত’ ও ‘দেরায়েত’ এই দুইটি পদ্ধটিই হাদীস জগতে নির্ধারিত ও সর্বজন পরিচিত। হাদীস যাচাইয়ের ইহা অপেক্ষা উত্তম রীতিনীতি আর কিছুই হইতে পারে না। ‘রেওয়ায়েত’ পদ্ধতিতে হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা যাচাই করা হয় এবং তখন মূল হাদীস উল্লেখ করার কোন প্রয়োজনই হয় না। পক্ষান্তরে ‘দেরায়েত’ পদ্ধতিতে হাদীসের শুধু মূল বাণী ******************** টুকুর যথার্থতা যাচাই করা হয়, আর তখন- সেইসময়- বর্ণনাকারীদের অবস্থা যাচাই করা অবান্তর হইয়া দাঁড়ায়।
ম্যূর সাহেব আর একটি মারাত্মক ভূল উক্তি করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, মুহাদ্দিসগণের হাদীস অনুসন্ধান ও যাচাই পরখের নীতি এবং পদ্ধতি সম্পর্কে পরস্পরের প্রতি কোন আস্থা ও উদারতার ভাব বর্তমান ছিল না। এইজন্য প্রত্যেক মুহাদ্দিসই নিজম্ব পদ্ধতি অনুযায়ী হাদীস গ্রহণ এবং বর্জন করিয়াছেন। মুহাদ্দিসদের সম্পর্কে এই উক্তিটি অমূলক। এই ধরনের কথা একমাত্র সেই ব্যক্তিই বলিতে পারেন ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে যাঁহার বিন্দুমাত্র ধারণা বা শ্রদ্ধা নাই অথবা ইসলামের দুশমনী করা্ই যাঁহার স্থিরসংকল্প। ইজতিহাদ-নীতিও এই সম্পর্কীয় মত-পার্থক্যের ম্যূর সাহেব পারস্পরিক অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা বলিয়া অভিহিত করিতে চাহেন। কিন্তু প্রকৃপক্ষে ইহা কোন অনাস্তার ব্যাপার নহে। ইহা প্রত্যেকের ইজতিহাদ নীতি ও মত বা রায়ের পার্থক্য মাত্র। এই জন্যই দেখিতে পাই- ইমাম মুসলিম ইমাম বুখারীর কোন কোন মত বা পদ্ধতির সমালোচনা করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহাকে ‘সাইয়েদুল মুহাদ্দিসীন- শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস’ বলিয়া মান্য করিতে ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠত হইতেন না। বস্তুত মত-পার্থক্যের কারণেই হাদীসের সূত্র বা সনদসমূহ যাচাই করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
মুহাদ্দিসদের পারস্পরিক মত-পার্থক্যের দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ইমাম বুখারী ‘যে ব্যক্তি যাহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছে’ ******************** এতদুভয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষাত ও দীর্ঘদিন একত্র থাকার প্রয়োজনীয়তার উপর অত্যাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু ইমাম মুসলিম মনে করেন, উভয়ের সমসাময়িক ও একই যুগের হওয়াই যথেষ্ট। ইমাম বুখারী কেবল সেইসব বর্ণনাকারীর হাদীসই গ্রহণ করার পক্ষপাতী, যাঁহাদের ‘সিকাহ’‘বিশ্বস্ত’ ও ‘নির্ভরযোগ্য’ হওয়া সম্পর্কে সকলেই একমত। কিন্তু ইমাম নাসায়ী এমন লোকের বর্ণিত হাদীসও গ্রহণ করিতেন, যাহাদের ‘সিকাহ’ হওয়া সম্পর্কে সকলের একমত নহেন। বস্তুত পারস্পরিক আস্থাহীনতার কিংবা হিংসা-বিদ্বেষের কারণে এইরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় নাই, বরং ইহা নিছক মতবিরোধ- রায়- পার্থক্য মাত্র এব রায়- পার্থক্য ভিন্ন ইহা আর কিছুই নহে। পরবর্তিকালে মুহদ্দিসগণ যদি হাদীস বর্ণনাপরম্পরার নূতন কোন বিশ্বস্ত সূত্র পাইতেন, তবে ‘ছয়জন ইমামে হাদীসে’র মধ্য হইতে কোন একজনের নির্ধারিত মূল নীতি অনুযায়ী কোন হাদীস গ্রহণ করিতেন। ইহা ক্ষেত্র প্রশস্ততারই পরিচায়ক।
— সমাপ্ত —