সনদ ও মতন
হাদীসের মূল কথাটুকু যে সূত্রে ও যে বর্ণনা পরস্পরা ধারায় গ্রন্হ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌছিঁয়াছে, উহাকে ইলমে হাদীসের পরিভাষায় বলা হয় ‘সনদ’। উহাতে হাদীসের বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে। এইজন্য বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
মূল হাদীস পৌছিঁবার পরস্পরা সূত্রই হইতেছে সনদ।[মুকাদ্দামা আল-হাদীস আল-মুহাদ্দিসূন, ২,৩,৪ পৃষ্ঠা।]
বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
হাদীসের সূত্র- উহার বর্ণনাকারী ব্যক্তিগণের পরস্পরাকে সনদ বলে।
******************************************************
হাদীসের মূল কথা ও উহার শব্দসমূহ হইতেছে ‘মতন’।
শায়খ আবদুল হক লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
সনদ সূত্র যে পর্যন্ত পৌছিঁয়াছে উহার পরবর্তী অংশকেই ‘মতন’ বলা হয়।
সনদ বা বর্ণনাকারীদের গুণগত পার্থক্যের দিক দিয়া হাদীসকে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম ভাগে সেই সব হাদীস, যাহা ‘হাফেযে মুতকিন’ (নির্ভূলভাবে স্মরণ রাখিতে সক্ষম হাদীসের এমন হাফেয) লোকদের মাধ্যমে বর্ণিত হইয়াছে। দ্বিতীয় সেই সব হাদীস, যাহার বর্ণনাকারী অপ্রসিদ্ধ এবং স্মরণ ও সতর্কতার মধ্যম মানের লোক। আর তৃতীয় হইতেছে সে সব হাদীস, যাহা বর্ণনা করিয়াছে দুর্বল ও গ্রহণ অযোগ্য এবং অগ্রাহ্য লোকেরা। [৪৬*****************]
হাদীসসমূহের সনদভিত্তিক বিভাগ
হাদীসের সনদ- বর্ণনা পরম্পরা ধারা যে স্তর পর্যন্ত পৌছিয়াছে ও তাহা যেভাবে পৌছিঁয়াছে, এই দৃষ্টিতে হাদীসকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করা হইয়াছে এব উহার প্রত্যেকটি ভাগেরে এক একটি পারিভাষিক নাম দেওয়া হইয়াছে। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা যাইতেছেঃ
১। মারফূঃ যেসব হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা রাসূল (স) পর্যন্ত পৌছিঁয়াছে, যে সূত্রৈ মাধ্যমে স্বয়ং রাসূলের কোন কথা, কোন কাজ করার বিবরণ কিংবা কোন বিষয়ের অনুমোদন বর্ণিত হইয়াছে, যে সনদের ধারাবাহিকতা রাসূলে করীম (স) হইতে হাদীস গ্রন্হ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত হইয়াছে এবং মাঝখান হইতে একজন বর্ণনাকারীও উহ্য হইয়া যায় নাই তাহা ‘হাদীসে মারফূ’حديث نرفوع নামে পরিচিত।
ইমাম নববী উহার সংজ্ঞা দিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ
******************************************************
‘মারফূ’ সেই হাদীস, যাহা বিশেষভাবে রাসূলের কথা-তিনি ছাড়া অপর কাহারো কথা নয়-বলিয়া বর্ণিত’।[৪৭********]
ইবনে সালাহ লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
যে কথা রাসূলের, অপর কাহারো নয়-কোন সাহাবীরও নয়, তাহাই ‘হাদীসে মারফূ’ নামে পরিচিত।[৪৮********]
দৃষ্টান্ত দ্বারা ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইবে। যেমন কোন সাহাবী বলিলেনঃ
******************************************************
রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি রাসূলে করীম (স)-কে এইরূপ বলিতে শুনিয়াছি-
এইরূপ বর্ণনাসূত্রে বর্ণিত হাদীসসমূহ ‘হাদীস মারফূ কাওলী’ নামে পরিচিত।
কিংবা কোন সাহাবী বলিলেনঃ
******************************************************
আমি রাসূলে করীম (স)-কে এইরূপ করিতে দেখিয়াছি।
ইহা ‘হাদীসে ‘মারফূ ফে’লী’ নামে পরিচিত। কেননা ইহা সাহাবীর বর্ণনাতে নবী করীমের কোন কাজের বিবরণ পেশ করে।
বা কোন সাহাবী বলিলেনঃ
******************************************************
আমি রাসূলে করীম (স)-এর উপস্থিতিতে এইরূপ কাজ করিয়াছি কিন্তু তিনি ইহার প্রতিবাদ করেন নাই।
ইহা ‘হাদীসে মারফূ ‘তাকরীরী’ নামে পরিচিত। নবী করীমের সামনে কোন কাজ করার এবং তাঁহার নিষেধ না করার কথা বলা হইয়াছে এই হাদীসে।
২। যে সব হাদীসের বর্ণনাসূত্র (সনদ) ঊর্ধ্বদিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌছিয়েঁছে-কোন সাহাবীর কথা কিংবা কাজ বা অনুমোদন যেসব সনদসূত্রে বর্ণিত হইয়াছে, তাহা ‘হাদীসে মওকুফ’ নামে অভিহিত। ইমাম নববী ইহার সংজ্ঞা দিয়াছেন এই ভাষায়ঃ
******************************************************
যাহাতে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ কিংবা অনুরূপ কিছু বর্ণিত হয়- তাহা পরপর মিলিত বর্ণনাকারীদের দ্বারা বর্ণিত হউক কিংবা মাঝখানে কোন বর্ণনাকারীর অনুপস্থিতি ঘটুক- তাহা ‘মওকুফ হাদীস’।
৩। যে সনদসূত্রে কোন তাবেয়ী’র কথা, কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়, তাহা ‘হাদীসে মকতু’ নামে পরিচিত। ইমাম নববী বলিয়াছেন **************** তাবেয়ী পর্যন্ত যাহার সূত্র পৌছিঁয়াছে, তাহাই ‘হাদীসে মকতু’।[৪৯**********]
৪। যেসব হাদীসের সনদে উপর হইতে নিচ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা পূর্ণরূপে রক্ষিত হইয়াছে, কোন স্তরেই কোন বর্ণনাকারী উহ্য হয় নাই, উহাকে ‘হাদীসে মুত্তাসিল’ ********** বলা হয়।
৫। যেসব হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় নাই, মাঝখানের কোন বর্ণনাকারী যদি উহ্য বা লুপ্ত হইয়া থাকে, তাহাকে ‘হাদীসে মুনকাতা’حديث منقطع বলা হয়। [৫০************]
হাদীস বর্ণনাকারীদের নিজস্ব গুণ-পার্থক্যের দৃষ্টিতেও হাদীসের কতকগুলো বিভাগ হইয়া থাকে এবং উহাদের প্রত্যেকটিরই এক-একটি পারিভাষিক নাম দেওয়া হয়। যথাঃ
১। যে হাদীসের বর্ণনাসূত্র ধারাবাহিক রহিয়াছে, সনদের প্রত্যেক স্তারের বর্ণনাকারীর নাম সঠিকরুপে উল্লিখিত হইয়াছে, বর্ণনাকারিগণ সর্বতোভাবে বিশ্বস্ত- সিকাহ, যাহাদের স্মরণ শক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং যাঁহাদের সংখ্যা কোন স্তরেই মাত্র একজন হয় নাই, এইরূপ হাদীসকে পরিভাষায় ‘হাদীসে সহীহ’ ********* বলা হয়।
ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
যে হাদীসের সনদ নির্ভরযোগ্য ও সঠিকরূপে সংরক্ষণকারী বর্ণনাকরীদের সংযোজনে পরম্পরাপূর্ণ ও যাহাতে বিরল ও ক্রটিযুক্ত বর্ণনাকারী একজনও নাই, তাহাই ‘হাদীসে সহীহ’।[৫১********]
২। উপরিউক্ত সকল গুণ বর্তমান থাকার পর বর্ণনাকারীদের স্মরণ-শক্তি যদি কিছুটা দুর্বল প্রমাণিত হয়, তবে সেই হাদীসের পারিভাষিক নাম ‘হাদীসে হাসান’ (********)।
ইহার সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে ইমাম নববী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
যে হাদীসের উৎস সর্বজনজ্ঞাত ও যাহার বর্ণনাকারীগণ প্রখ্যাত, তাহাই হাদীসে হাসান।[৫২**********]
৩। উপরিউক্ত সবরকমের গুণই যদি বণনাকারিদের মধ্যে কম মাত্রায় পাওয়া যায়, তবে তাহাদের বর্ণিত হাদীসকে ‘হাদীসে যয়ীফ’ *********** বলা হয়।
ইমাম নববী বলিয়াছেনঃ
******************************************************
যাহাতে সহীহ্ ও হাসান হাদীসের শর্তসমূহ পাওয়া যায় না তাহাই ‘যয়ীফ হাদসী’।[৫৪*******]
বর্ণনাকারীদের সংখ্যাভিত্তিক হাদীস বিভাগ
হাদীসের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা সকল ক্ষেত্রে একই রূপ হয় নাই। বিভিন্ন হাদীসে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা বিভিন্ন হইয়াছে। এই দিক দিয়া হাদীসের কয়েকটি বিভাগ এবং প্রত্যেকটি বিভাগের এক একটি পারিভাষিক নাম রহিয়াছে। এইখানে এই বিভাগগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ উল্লেখ করা যাইতেছে।
১। মুতাওয়াতির (*****) যে হাদীসের সনদের সকল স্তরেই বর্ণনাকারীদের সংখ্যা এত বেশী যে, তাঁহাদের সকলের একত্রিত হইয়া মিথ্যা কথা রচনা বা বলা স্বভাবতই অসম্ভব বলিয়া মনে হয়, এইরূপ হাদীসকে ‘হাদীসে মুতাওয়াতির’ বলা হয়। যেমন হাদীস ******************** সকল আমলের মূল্যায়ন নিয়ত অনুযায়ীই হয়। এই হাদীসটি সাত শতেরও অধিক সনদসূত্রে বর্ণিত হইয়াছে।[ ৩-شرح النخبة ص মুহাদ্দিসগণ সাধারণত ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসকে এই পারিভাষিক নামে অভিহিত করেন না। কেননা কোন হাদীসের ‘মুতাওয়াতির’ হওয়াটা সনদের আলোচনা পর্যায়ে গণ্য হয় না। তাহার কারণ এই যে, সনদশাস্ত্রে সাধারণত হাদীসের ‘সহীহ’ বা ‘যয়ীফ’ হওয়ার ব্যাপারটিই আলোচ্য- যেন হয় তদনুযায়ী আমল করা যায়, না হয় যেন উহা ত্যাগ করা যায়। উপরন্তু মুতাওয়াতির হাদীসের বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয় না। তদনুযায়ী আমল করা আলোচনা ব্যতিরেকেই ওয়াজিব। علوم الحديث ومصطله وشرح النخبة ج-3 ص- 150 ]
২। খবরে ওয়াহিদ (***********) যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের সংখ্যা ও সনদ ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস অপেক্ষা কিছুটা কম, তাহা ‘খবরে ওয়াহিদ’। এই ধরনের হাদীস তিন প্রকারের হইয়া থাকেঃ
ক. সাহাবীদের পরবর্তী স্তরসমূহের কোন স্তরে বর্ণনাকারীদের সংখ্যা যদি তিনজন হইতে কম না হয়, তবে তাহা ‘হাদীসে মশহুর’ (*************)।
খ. কোন স্তরেই যদি বর্ণনাকারীদের সংখ্যা দুইজনের কম না হয়, তবে তাহা ‘হাদীসে আযীয’ (**********)।
গ. কোন স্তরে যদি বর্ণনাকারীদের সংখ্যা মাত্র একজন হয়, তবে সেই হাদীস ‘ হাদীসে গরীব’ (*************) নামে পরিচিত।