হাদীস বর্ণনায় সতর্কতা
নবী করীম (স) তাঁহার হাদীস প্রচার ও অপর লোকদের নিকট উহা বর্ণনা করার সুস্পষ্ট নির্দেম দিয়াছেন। কিন্তু এই প্রচার ও বর্ণনাকে তিনি অবাধ, স্বাধীন ও নিরংকুশ করিয়া দেন নাই। বরং তিনি হাদীস বর্ণনা ও প্রচারের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতাবলম্বনের জন্য অত্যন্ত কড়া ভাষায় তাকীদ করিয়াছেন এবং তাঁহার নামে কোন মিথ্যা মনগড়া ও অসম্পূর্ণ কথা বর্ণনা ও প্রচার করিতে তীব্র ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন। এখানে এই প্রসঙ্গে রাসূলে করীম (স)-এর কয়েকটি বাণী উল্লেখ করা যাইতেছে।
হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) বলেনঃ
******************************************************
নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ
যে ব্যক্তি ইচ্ছা করিয়া আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন তাহার আশ্রয় জাহান্নামে খুজিঁয়া লয়।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ
******************************************************
যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলিবে, সে যেন জাহান্নাম তাহার আশ্রয় বানাইয়া লয়।
হযরত মুগীরা ইবন শু’বা বলেনঃ
******************************************************
আমি রাসূল (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, আমার সম্পর্কে কোন প্রকার মিথ্যা কথা বলা অন্য কাহারো সম্পর্কে মিথ্যা বলার সমান নয়। কাজেই আমার সম্পর্কে যে মিথ্যা কথা ইচ্ছা করিয়া বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় খুঁজিয়া লয়।[এই সব কয়টি হাদীস সহীহ মুসলিম ****************************১ম খণ্ড, ৭ম পৃষ্ঠা হইতে গৃহীত।]
বিভিন্ন সাহাবীর সামান্য শাব্দিক পার্থক্য সহকারে উল্লিখিত তিনটি হাদীসেরই মূল প্রতিপাদ্য কথা একই এবং তাহা এই যে, রাসূল (স) সম্পর্কে বা তাঁহার নামে কোনরূপ মিথ্যা কথা বলা কিংবা নিজের মনগড়া কথা রাসূলের নামে ও তাঁহার কথা বলিয়া চালাইয়া দেওয়া অত্যন্ত গুনাহের কাজ। নবী করীম (স) এইরূপ কাজ সম্পর্কে কঠোর নিষেধবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। হযরত মুগীরা (রা) বর্ণিত হাদীস হইতে জানা যায় যে, রাসূল (স) সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা অপর কাহারো সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলার সমান নয়। কেননা রাসূল ও রাসূলের কথা আল্লাহ ও আল্লাহর কালামরে পরে পরেই ইসলামী শরীয়াতের সনদ ও জ্ঞান-উৎস। কাজেই এইখানে কোনরূপ মিথ্যার অনুপ্রবেশ হইলে গোটা শরীয়াতের ভিত্তিই দুর্বল ও অবিশ্বাস্য হইয়া পড়ে। আর ইসলামী শরীয়াতের ভিত্তি দুর্বল হইলে অতঃপর মানুষের মুক্তির কোন পথই আর উন্মুক্ত থাকে না। ইরশাদুস সারী শরহে বুখারী গ্রন্হে এই হাদীসটি সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
এই হাদীসটি বিশুদ্ধতা ও সনদ শক্তির অকাট্যতার দিক দিয়া চূড়ান্ত ও অনস্বীকার্য। মুহাদ্দিসীনের এক বিরাট জামা’আত এই হাদীসটিকে ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।[*****************]
ইমামুল হারামাইন আবুল মায়ালীর পিতা শায়খ আবূ মুহাম্মদ আল-জুয়াইনী বলিয়াছেনঃ
******************************************************
নবী করীম (স) সম্পর্কে যে লোক ইচ্ছা করিয়া মিথ্যা বলিবে, সে কাফির হইয়া যাইবে।[ঐ]
বস্তুত হাদীস বর্ণনা সম্পর্কে রাসূলে করীমের এইসব কঠোর সাবধান বাণীর কারণে সাহাবায়ে কিরাম (রা) রাসূল সম্পর্কে কোন কথা বলিতে অত্যন্ত ভয় পাইতেন, বলিতে গেলে অতিমাত্রায় সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করিতেন এবং প্রত্যেকেই নিজের জানা ও বহুবার শোনা কথাকে অপর সাহাবীর নিকট পুনরায় শুনিয়া উহার সত্যতা ও যথার্থতা যাচাই করিয়া লইতেন। ভূল হইলে তাহা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন করিয়া লইতেও একবিন্দু ক্রটি করিতেন না। এমনটি রাসূল সম্পর্কে কোন মিথ্যা বলা হইয়া যাওয়ার আশংকায় অনেক সংখ্যক সাহাবীই হাদীস বণনা করিতে সাহস পাইতেন না। আর যখন বর্ণনা করিতেন, তখন তাঁহারা ভয়ে থর থর করিয়া কাপিতেঁন। অত্যন্ত দায়িত্ব ও চেতনাবোধ সহকারে প্রত্যেকটি হাদীস ও হাদীসের প্রত্যেকটি কথা উচ্চারণ করিতেন।
এই কারনে সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়িগণ নির্ভরযোগ্য অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও বর্ণনা পরম্পরা শৃঙ্খলের ধারাবাহিকতা অটুট ও অবিচ্ছিন্ন না হইলে কখনই কোন হাদীস কবুল করিতেন না। পরবর্তীকালের হাদীস সংগ্রহকারীদের নিকট নিম্নোক্ত নীতি সর্ববাদ সম্মতরূপে গৃহীতি হইয়াছেঃ
******************************************************
রাসূল সম্পর্কে একটি হাদীসও কাহারো ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলা প্রমাণ হইয়া গেলে সে ফাসিক সাব্যস্ত হইবে, তাহার বর্ণিত সমস্ত হাদীসই প্রত্যাহৃত হইবে এবং উহার কোনটিকেই শরীয়াতের দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যাইবে না।[************ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৮।]
হাদীস বর্ণনায় সতর্কতাবল’ন সম্পর্কে এই নীতিমূলক আলোচনার পর সাহাবায়ে কিরামের জীবনের কতিপয় বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করিয়া এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করা আবশ্যক। আমরা এখানে কয়েকজন সাহাবীর কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করিতেছি।
১। হযরত যুবায়র (রা) আদৌ কোন হাদীস বর্ণনা করিতেন না। একদিন হযরত আবদুল্লাহ (রা) তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ আপনি অন্যান্য সাহাবীদের মত হাদীস বর্ণনা করেন না কেন? তিনি বলিলেনঃ রাসূলের সাথে আমার যদিও বিশেষ সম্পর্ক ছিল, তবুও যেহেতু আমি রাসূলের নিকট শুনিয়াছি, তিনি বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার ঠিকানা বানাইয়া লয়। (এই ভয়ে হাদীস বর্ণনা করি না।)[আবূ দাউদ, কিতাবুল ইলম **********************]
২। বহু সংখ্যক সাহাবী একাদিক্রমে অনেক বৎসর পর্যন্ত ***************- ‘রাসূল (স) বলিয়াছেন’ এইরূপ উক্তি করিতেন না। ইমাম শা’বী বলেনঃ আমি এক বৎসর পর্যন্ত হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমরের নিকট অবস্থান করিয়াছি। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে তিনি কোন হাদীস বর্ণনা করেন নাই। হযরত সায়ের ইবন ইয়াযীদ (রা) বলেনঃ আমি হযরত তালহা ইবন আবদুল্লাহ হযরত সায়াদ, হযরত মিকদাদ ও আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা)- এর সংস্পর্শে বহুদিন অবস্থান করিয়াছি; কিন্তু কাহাকেও কোন হাদীস বর্ণনা করিতে দেখি নাই। তাবে হযরত তালহা কেবলমাত্র উহুদ যুদ্ধের দিন সম্পর্কে হাদীস বর্ণনা করিতেন।[সহীহ বুখারী, ১ম খণ্ড, কিতাবুল জিহাদ, পৃষ্ঠা ৩৯৬।]
৩। হযরত সায়ের ইবন ইয়াযীদ (রা) বলেনঃ আমি মদীনা হইতে মক্কা পর্যন্ত হযরত সায়াদ ইবনে মালিক (রা)- এর সহিত একত্রে সফর করিয়াছি; কিন্তু এই দীর্ঘ পথের মধ্যে তাঁহার মুখ হইতে একটি হাদীসও শুনিতে পই নাই।[সুনানে ইবনে মাজাহ***************************]
৪। অনেক লোক সাহাবায়ে কিরামরে নিকট হাদীস শ্রবণের ইচ্ছা প্রকাল করিতেন, কিন্তু অনেক সময় তাঁহারা হাদীসি বর্ণনা করিতে অস্বীকার করিয়া বসিতেন। একবার কিছু লোক হযরত যায়দ ইবন আরকাম (রা) কে বলিলেনঃ আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করুন- হাদীস বর্ণনা করিয়া আমাদিগকে শোনান। ইহার উত্তরে তিনি বলিলেনঃ আমরা বৃদ্ধ হইয়াছি, ভুলিয়া গিয়াছি; হাদীস বর্ণনা করা বড়ই কঠিন কাজ।
৫। হযরত আনাস ইবন মালিক (রা) কে একবার হাদীস বর্ণনা করিতে বলা হইলে তিনি জওয়াবে শুধু বলিলেন ‘ইনশা আল্লাহ’।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৪৬।]
অর্থাৎ তিনি হাদীস বর্ণনার দায়িত্ব এড়াইয়া যাইতে চাহিয়াছিলেন। (আর অনেক সাহাবীরই এইরূপ রীত ছিল।)। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
রাসূলের এই বানী-‘আমার সম্পর্কে যে মিথ্যা বলিতে ইচ্ছা করিবে সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় বানাইয়া লয়’–আমাকে তোমাদের নিকট অধিক হাদীস বর্ণনা করিতে নিষেধ করে।[বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১।]
ইহার অর্থ এই নয় যে, তিনি আদ্য কখনো হাদীস বর্ণনা করিতেন না। হাদীস বর্ণনা করিতেন; কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি যারপরনাই সতর্কতা অবলম্বন করিতেন।[****************] তাঁহার সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
হযরত আনাস (রা) হাদীস বয়ান কারা সময় অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িতেন- তাঁহার অন্তর কাঁপিয়া উঠিত। এই কারণে তিনি হাদীস বর্ণনা করার পর বলিতেনঃ রাসূলে করীম (স) এইরূপ বলিয়াছেন কিংবা ঠিক যেরূপ তিনি বলিয়াছেন।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৫ম খণ্ড পৃষ্ঠা ১৪০।]
যে সব হাদীসের মর্মোদ্ধারে ভূল হওয়ার আশংকা থাকিত, তাহা হযরত আনাস (রা) আদৌ বর্ণনা করিতেন না। এতদ্ব্যতীত রাসূলের নিকট হইতে সরাসরি শ্রুত হাদীসের মধ্যেও পার্থক্য করিতেন।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪০।]
৬। হযরত উবাই ইবন কায়াব (রা) হাদীস বয়ান করিতেন, কিন্তু এই কাজে তিনি অপরিসীম সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। তিনি যদিও রাসূলের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং জীবনের বেশীর ভাগ সময় তিনি রাসূলের সংস্পর্শেই অতিবাহিত করিতেন; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি রাসূলের খুব বেশী হাদীস বর্ণনা করেন নাই। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মাত্র ৬৪ টি। [****************]
৭। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা) ইলমে হাদীসে বিরাট দক্ষতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও হাদীস বয়ান করিয়াছেনঃ সাহাবীদের সমাজে হাদীস বয়ান করার ব্যাপারে হযরত ইবন উমর (রা) অপেক্ষা অধিক সতর্ক আর কেহ ছিলেন না। তিনি হাদীস কম বেশি করিয়া বর্ণনা করাকেও ভয় করিতেন।[তাযকিরাতুল হুফফায, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪।]
আবু জাফর তাবেয়ীও এই কথারই প্রতিধ্বনি করিয়াছেন।[মুস্তাদরাক হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬১।]
সায়ীদ তাঁহার পিতার জবানীতে বলিয়াছেনঃ হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ইবন উমর অপেক্ষা অধিক সতর্ক আমি আর কাহাকেও দেখি নাই।[*********************]
বস্তুত এই সতর্কতাবলম্বনের কারণেই তিনি সাধারণত হাদীস বর্ণনা করিতে রাযী হইতেন না।[***************]
৮। হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র (রা)-ও খুব কম এবং কদাচিৎ হাদীস বর্ণনা করিতেন। তিনি রাসূল (স) সম্পর্কে মিথ্যা বলা সম্পর্কিত হাদীস সম্মুখে রাখিয়াই এই নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিছু সংখ্যক লোক একবার তাঁহাকে বলেনঃ আপনাকে খুব কম হাদীস বর্ণনা করিতে দেখিতেছি, অথচ অমুক অমুক সাহাবী এবং হযরত ইবন মাসউদ (রা) যথেষ্ট সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেন। অন্য কথায় রাসূলের সংস্পর্শে আপনার বিশিষ্ট স্থান থাকা সত্ত্বেও হাদীস বর্ণনায় আপনি এতদূর পশ্চাদপদ কেন? ইহার জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ
******************************************************
শোন, ইসলাম কবুল করার পর আমি কখনো রাসূল (স)- এর নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া অবস্থান করি নাই। কিন্তু আমি রাসূল (স) কে বলিতে শুনিয়াছিঃ আমার সম্পর্কে যে মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় করিয়া লয়।[মুসনাদে ইমাম আবু হানীফা (উর্দূঅনবাদ), পৃষ্ঠা ৭৩, বুখারীশরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২১। বুখারীর বর্ণনায় আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদের নামের উল্লেখ নাই; কিন্তু ইবন মাজা’হর রেওয়ায়েতে তাঁহার উল্লেখ আছে।(****************) এবং ইসমাঈলীর বর্ণনা ********** ‘যখন হইতে আমি ইসলাম কবুল করিয়াছি’ কথাটির উল্লেখ আছে, বুখারীতে তাহা নাই।]
বস্তুত এই ভয়ই ছিল তাঁহার কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনার একমাত্র কারণ।