জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল সূত্র
জ্ঞান এবং বিদ্যার অর্থই হইতেছে অজানাকে জানা। যাহা অজ্ঞাত, যাহা মানুষের জ্ঞান-সীমার বহির্ভূত, তাহা জানিয়া লওয়া এবং উহার সকল দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়াকেই বলা হয় জ্ঞান। বস্তুর জ্ঞান ও বিদ্যা হইতেছে আলো। আলোর স্ফুরণেই অন্ধকারের অবসান। জ্ঞান ও বিদ্যা মানব-মনের অজ্ঞতার পুঞ্জীভূত অন্ধকার বিদূরিত করিয়া দেয়, অন্তঃকরণকে করে আলোকোজ্জ্বল, জ্ঞানের মহিমায় সুষমামণ্ডিত।
কিন্তু কতগুলি তত্ত্ব ও তথ্যের সমারোহই জ্ঞান নয়। নির্ভরযোগ্য ও সংশয়াতীত সূত্রে লব্ধ সত্য তত্ত্ব ও তথ্যই হইতেছে প্রকৃত জ্ঞান। যে তত্ত্ব ও তথ্য সত্যভিত্তিক নয় এবং যাহা নির্ভযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত নয়, তাহা সংশয়াপন্ মানসলোককে মেঘমুক্ত করিতে পারে না, তাহা যেমন মানুষের কোন কল্যাণ সাধন করিতে পারে না, তেমনি ‘জ্ঞান’ নামে অভিহিত হওয়ারও সম্পূর্ণ অযোগ্য। এইরূপ জ্ঞানের উপর নির্ভর করিয়াজীবন-পথে পদবিক্ষেপ করা এবং অকুন্ঠিত চিত্তে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় না। এই জন্য এমন জ্ঞান ও বিদ্যা মানুষের জন্য প্রয়োজন, যাহা সর্বতোভাবে সত্য ও নির্ভরযোগ্য, অকাট্য ও নিশ্চিত সূত্রে প্রাপ্ত। এইরূপ জ্ঞানই মানুষের মন ও মগজকে নিঃসংশয়, দৃঢ়-নিশ্চিত ও আলোকোদ্ভাসিত করিয়া তোলে। জীবন-পথের প্রতিটি বাঁক- প্রত্যেকটি চরাই-উতরাই পর্যন্ত দৃষ্টিপথে সমুদ্ভাসিত করিয়া দেয়। এইরূপ জ্ঞান ব্যতীত আমাদের না জৈব জীবন সঠিকরূপে চলিতে পারে, না মানুষ হিসাবে দুনিয়ায় বসবাস করা সম্ভব হয়।
কিন্তু এইরূপ জ্ঞান মানুষ কোথায় পাইবে? কোন সূত্রে এইরূপ জ্ঞান লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব? ইহা এক কঠিন প্রশ্ন। এই সম্পর্কে একটু গভীরভাবেই আমাদিগকে বিচার-বিবেচনা ও আলোচনা-পর্যালোচনা করিয়া দেখিতে হইবে।
নির্ভূল, অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞান-অর্জনের জন্য মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই যেসব উপায় ও সূত্র দান করা হইয়াছে, তন্মধ্যে বাহ্যিক ও প্রাথমিক সূত্র হইতেছে মানুষের পঞ্চেন্দ্রিয়। কিন্তু এই পঞ্চেন্দ্রিয় একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই মানুষের জন্য পরিধির সমাপ্তি। উহার বহির্ভূত কোন জ্ঞানই মানুষকে দেওয়া সাধ্যাতীত। উপরন্তু পঞ্চেন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞান যে সর্বতোভাবে নির্ভূল ও সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত, তাহা নিশ্চঢ করিয়া বলা সম্ভব নয়। ইহা মানুষকে অনেক সময় নিতান্ত ভূল তথ্য পরিবেশন করে, মানুষকে প্রতারিতও করে কখনো কখনো। মানুষ রোগাক্রান্ত হইলে তাহার রুচিবিকৃতি ঘটে, মুখ বিস্বাদ হইয়া যায়, মিষ্টি হইয়া যায় তিক্ত। দ্রুতগতিশীল রেলগাড়ীর আরোহীর দৃষ্টি প্রতারিত হয়, দুই পার্শ্বের স্থায়ীভাবে দণ্ডায়মান দৃশ্যাবলী বিপরীত দিকে দুরন্ত বেগে ধাবমান বলিয়া মনে হয়। চলমান জাহাজ মনে হয় স্থির, দণ্ডায়মান। এক বিন্দু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সরল ঋজু-পথে তীব্র গতিতে ছুটিয়া চলিলে উহা একটি একটানা জ্বলন্ত অগ্নিরেখা বলিয়া মনে হইবে, আর বৃত্তাকারে চলিলে মনে হইবে একটি অগ্নিবৃত্ত। দূর ঊর্ধ্বলোকরে বৃহদায়তন নক্ষত্ররাশিকে ক্ষুদ্রাকায় ও মিটমিট করা ক্ষীণ দ্বীপশিখা বলিয়া মনে হওয়া একটি সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু তাহা প্রকৃত পক্ষেও কি সেইরূপ?
মানুষের জ্ঞানার্জনের দ্বিতীয় সূত্র হইতেছে অন্তর্নিহিত বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, চিন্তা-গবেষণা, যুক্তির ভিত্তিতে বিচার-বিবেচনা। ইহা মূলত প্রথম পর্যায়ের জ্ঞান-সূত্র লব্ধ তথ্যের ভিত্তিতেই জ্ঞা পরিবেশন করে। সংগৃহীত তথ্যের উপর অজনা জ্ঞানের প্রাসাদ নির্মাণ করে। আয়ত্তাধীন তথ্যবস্তু জগত হইতে সংগৃহীত হইলে উহার ভিত্তিতে লব্ধ জ্ঞান অনেকটা সন্দেহ বিমুক্ত হইতে পারে। আর বস্তু বিজ্ঞানের (Physical Science) মূল ক্ষেত্রে ইহাই। কিন্তু বস্তু-অতীত তথ্যভিত্তিক জ্ঞান নিছক ধারণা অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। যাবতীয় মানব-রচিত মতাদর্শ ও দর্শন ইহারই উৎপাদন। ইহা যেমন সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত নয়, তেমনি ইহাতে মতবৈষম্য সৃষ্টিরও যথেষ্ট অবকাশ বিদ্যমান। আধুনিক দার্শনিক চিন্তাধারা ও মতাদর্শ এই কারণেই চরমভাবে দুর্দশাগ্রস্ত।
বসউতু জগতের সহিত সম্পর্কহীন যে জ্ঞান, তাহার স্থান ইহার পর। ইহা যদিও বস্তু-অতীত জ্ঞান, তথাপি ইহা বস্তুনিষ্ঠ মন ও মগজের সূক্ষ্ম দর্পণের উপরই প্রতিফলিত ও প্রতিবিম্বিত হয়। প্রথম পর্যায়ের জ্ঞান যেমন প্রত্যক্ষ্যভাবে বস্তু নির্ভর, এই দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্ঞানও তেমনি মানুষের মন ও আধ্যাত্মিক শক্তির সহিত সংশ্লিষ্ট।
এই শেষোক্ত জ্ঞানসূত্রের কয়েকটি স্তর রহিয়াছে- ফিরাসত, (Insight observation) হদস্, (Conjecture) কাশফ, ইলহাম ও ওহী। ফিরসাত অর্থ দূরদৃষ্টি অন্তদৃষ্টি- ইহা একটি স্বভাবজাত প্রতিভা। ইহার সাহায্যে যে সব কথাবার্তা বলা হয়, সাধারণ মানুষের মনে তাহা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ইহার পর ‘হদস’। ইহা একান্তুভাবে মানস চর্চা ও মননশীলতার ফল, যাকে আরা বলি প্রজ্ঞা। কাশফ অর্থ উদঘাটন, কোন অজ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে অন্তর্লোকে জ্ঞানের স্ফূরণ হওয়াই হইল ‘কাশফ’। ইহার উত্তম দৃষ্টান্ত স্বপ্ন। তবে পার্থক্য এই যে, স্বপ্ন নিদ্রার মধ্যে সম্ভব; কিন্তু ‘কাশফ’ হয় জাগ্রত ও সচেতন অবস্থায়। ‘ইলহাম’ অর্থ, মনে কোন জ্ঞানে সঞ্চার হওয়া। কোন চেষ্ট যত্ন ব্যতীতই মানসপটে জ্ঞানের আলো জ্বলিয়া উঠা। ‘ওহী’ এই পর্যায়ের সর্বোচ্চ জ্ঞানসূত্র। লোকচক্ষুর অন্তরালে অদৃশ্য উপায়ে ব্যক্তিকে বিশেষ কোন লোকাতীত ও সন্দেহমুক্ত জ্ঞান দানই হইতেছে ‘ওহী’। জ্ঞানলাভ ও তত্ত্ব পরিবেশনের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক উপায় এবং জ্ঞান সূত্রের নির্ভরযোগ্য সর্বশেষ সীমা ইহাই।