কুরআন ও হাদীসের পার্থক্য
কুরআন ও হাদীস উভয়ই ওহীর উৎস হইতে উৎসারিত হইলেও এতদুভয়ের মধ্যে নানা দিক দিয়া পার্থক্য বিদ্যমান। পূর্ববর্তী আলোচনায় এই সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হইয়াছে; কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে উহার বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা আবশ্যক।
কুরআন মজীদ এক অপূর্ব মু’জিযা। ইহা কেবল শব্দ, ভাষা ও সাহিত্যের দিক দিয়াই মু’জিযা নহে; ইহার বিষয়বস্তু, আলোচন্য বিষয়ের ব্যাপকতা, প্রসারতা, গভীরতা ও সূক্ষ্মতা এবং উহার উপস্থাপিত মানব কল্যাণকর পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থাও এক অপূর্ব ও চরম বিস্ময়কর মু’জিযা।
প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোত্তম কালাম হইতেছে কুরআন মজীদ, উহার অলৌকিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উহা কালজয়ী, সর্বপ্রকার পরিবর্তণ, পরিবর্ধন ও সংশোধন-সংযোজন হইতে চিরসুরক্ষিত, বিনা অযুত উহা স্পর্শ ও পাঠ করা হারাম। নামাযে উহা সুনির্দিষ্টভাবে পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য।
কিন্তু হাদীসসমূহ কুরআনের ন্যায় কোন মু’জিযা নহে। হাদীসৈর মূল কথাটিই শুধ ওহীর মাধ্যমে হযরতের স্বচ্ছ ও পবিত্র হৃদয়পটে প্রতিফলিত হইয়াছে, তিনি নিজ ভাষায় তাহা জনসমক্ষে পেশ করিয়াছেন। এজন্য উহার ভাষা’ মতলু’ নহে; উহার ভাষা ও শব্দের তিলাওয়ারত করা বাধ্যতামূল নহে, উহার মূল বক্তব্য ও ভাবধারা অনুসরণ করার জন্যই শরীয়াতে নির্দেশ দান করা্ হইয়াছে। এই কারণেই উহাকে ‘ওহীয়ে গায়ের মতলু’ নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু কুরআন মজীদের ভাব-শব্দ সব কিছুই আল্লাহর, আল্লাহর নিকট হইতে অবতীর্ণ।
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ওহীয়ে ‘মতলূ’ হইতেছে কুরআন মজীদ। অপর প্রকার ওহী রাসূলে করীম (স) হইতে (বর্ণনাকারীদের সূত্রে) বর্ণিত। [৯৬**************]
আল্লামা মুহাম্মদুরল মাদানী লিখিয়াছেনঃ কুরআন হাদীসের পারস্পরিক কার্থক্য ছয়টি দিক দিয়া বিবেচ্য। প্রথম, কুরআন অলৌকি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মু’জিযা’ হাদীস তাহা নহে। দ্বিতীয়, কুরআন পাঠ না হইলে নামায বিশুদ্ধ হয় না, হাদীস সেরূপ নহে। তৃতীয়, কুরআন ও উহার সামান্য অংশও কেহ অস্বীকার করিলে সে নিশ্চিত কায়ির হইয়া যায়, কিন্তু বিশেষ কারণের ভিত্তিতে বিশেষ কোন হাদীস মানিয়া লইতে অস্বিকৃত হইলে কাফির হইতে হয় না। চুতর্থ, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের মাঝখানে জিব্রাঈরের মধ্যস্থতা, অপরিহার্য।; হাদীসের জন্য ইহা জরুরী নয়। পঞ্চম, কুরআনের প্রতিটি শব্দ ও কথা আল্লাহর নিজস্ব, হাদীসের শব্দ ও ভায়া রাসূলের নিজের এবং ষষ্ঠ, কুরআন অযু ও পবিত্রতার সহিত স্পর্শ করা কর্তব্য, বিনা অযুতে স্পর্শ করা যায় না। হাদীস সম্পর্কে এরূপ কোন নির্দেশ নাই।[৯৭************]
অন্য কথায় চিঠি ও মৌখিক পয়গামের মধ্যে যে পার্থক্য, কুরআন ও হাদীসের মধ্যেও অনুরূপ পার্থক্য বলা যায়। লোক মারফত মৌখিক পয়গম প্রেরণের ক্ষেত্রে মূল কথাটিই মুখ্য, ভাষা বা শব্দের তারতম্যে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু চিঠির ব্যাপারটি এরূপ নহে। প্রথমত উহা চিঠি প্রেরকের নিজস্ব মর্জি অনুযায়ী রচিত হয় এবং দ্বিতীয়ত উহাতে নিজ মত ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী পূর্ণ ভাব প্রকাশক ভাষা ও শব্দ প্রয়োগ হইয়া থাকে। কিন্তু মৌখিক কথা প্রেরণ শব্দ ও ভাষার সেই বাধ্যবাধকতা থাকে না।
কুরআন ও হাদীরেস স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে যদিও এইরূপ পার্থক্য রহিয়াছে- কুরআনকে মনে করা যায় আল্লাহর নিজ লিখিত চিঠি আর হাদীস হইতেছে আল্লাহর মৌখিক পয়গাম; কিন্তু সেই সেঙ্গ এই কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহরর এই ‘চিঠি’ ও ‘মৌখিক পয়গাম’ উভয়েরই মুখপাত্র হইতেছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স)। এই কারণে তাঁহার নিকট হইতে আল্লাহর লিখিত চিঠি (কুরআন) গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার মৌখিক পয়গাম (হাদীস)- ও জানিয়া লওয়া একান্ত আবশ্যক। আল্লাহর প্রেরিত এই দুইটি জিনিসই পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়া অপরটি গ্রহণ করিলে মূল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হইতে বাধ্য।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি যখন কোন হাদীস বর্ণনা করি, তখন তোমাদের নিকট উহার কুরআন সমর্থিত হওয়ারই সংবাদ প্রকাশ করি।[৯৮***********]
ইবনে যুবায়র বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমার নিকট যে হাদীসই পৌছিঁয়াছে আমি আল্লাহর কিতাবে উহার সমর্থন ও উহার সত্যতার প্রমাণ পাইয়াছি। [৯৯**********]
শরীয়াতের ইমামগণের সর্বসম্মত মত হইলঃ
******************************************************
সমগ্র সুন্নাত ও হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যা।