পরিশিষ্ট-১
উপরের পৃষ্ঠাসমূহে হাদীসের সংখ্যা ও হাদীস সংকলনের দীর্ঘ ইতিহাস সবিস্তারে আলোচিত হইয়াছে। ইতিহাসের বিভিন্ন স্তারে হাদীস সংরক্ষণ, হাদীস সংকলন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের বিরাট-মহান কর্মতৎপরতার সহিত পাঠকদের পরিচিত সংস্থাপিত হইয়াছে। পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা বিভিন্ন স্তরে রকম-বেরকমের হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নের সহিতও পরিচিত হইয়াছি। এখানে বিভিন্ন পদ্ধতি ও ধরনের হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে এক আলোচনা পেশ করা হইয়াছে।
হাদীসগ্রন্হ প্রণয়নের বিভিন্ন ধরণ ও পদ্ধতি (Technique) রহিয়াছে। এই বিভিন্ন ধরনের প্রণীত গ্রন্হের নামও বিভিন্ন। যথাঃ
১. ‘আলজামে’– যেসব হাদীসগ্রন্হ আকায়েদ (বিশ্বাস) আহকাম (আদেশ-নিষেধ ও শরীয়াতের ব্যবহারিক নিয়ম), দয়া-সহানুভূতি, পানাহারের আচার, বিদেশ-সফর ও একস্থানে অবস্থান, কুরআনের তাফসীর, ইতিহাস, যুদ্ধ-সন্ধি , শক্রদের মুকাবিলায় বাহিনী প্রেরণ, ফিতনা-বিপর্যয়, প্রশংসা ও মর্যাদা বর্ণনা প্রভৃতি সকল প্রকারের হাদীস বিভিন্ন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়, এই সব গ্রন্হকে আল-জামে বলা হয়।[********************] সিহাহ-সিত্তার মধ্যে নিম্নোক্ত গ্রন্হদ্বয় এই পর্যায়ে গণ্যঃ
(ক) আল-জামেউস সহীহুল বুখারী এবং (খ) আল-জামেউত তিরমিযী। সহীহ মুসলিম এই পর্যায়ে গণ নয়। কেননা উহাতে তাফসীল ও কিরাত সংক্রান্ত হাদীস সন্নিবেশিত হয় নাই।২[********************]
২. ‘আল-মুসনাদ’ (********************)- যে সব গ্রন্হে সাহাবীদের হইতে বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁহাদের নামের আক্ষরিক ক্রমিকতার ভিত্তিতে পর পর সংকলিত হয়; কিন্তু ফিকাহর প্রণয়ন পদ্ধতিতে সজ্জিত করা হয় না, সেই সব গ্রন্হ ‘আল-মুসনাদ’ বা ‘আল-মাসানীদ’ নামে পরিচিত। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীকের বর্ণিত সমস্ত হাদীস উহার বিষয়বস্তু নির্বিশেষে একত্রে লিপিবদ্ধ করা, তাঁহার পর অপর এক সাহাবীর বর্ণিত হাদীস একস্থানে একত্রিত করা।
ইহার সংকলন দুইভাবে হইতে পারেঃ আক্ষরিক ক্রমিকতা সহাকারে, যেমন প্রথমে হযরত আবূ বকরের বর্ণিত হাদীস, তাঁহার পর হযরত উসামা ইবনে যায়দ বর্ণিত হাদীস।
অথবা বর্ণনাকারী সাহাবীর পদমর্যাদার বা বংশ ম র্যঅদার ভিত্তিতেও হাদীসসমূহ সজ্জিত হইতে পারে। যেমন প্রথমে ক্রমিক ধারায় খুলাফায়ে রাশেদুন বর্ণিত হাদীসসমূহ, তাঁহাদের পরে অন্যান্য সাহাবীদের হাদীসসমূহ উল্লেখ করা।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল সংকলিত হাদীস গ্রন্হ এই পদ্ধতিতেই সজ্জিত বলিয়া উহাকে ‘আল-মুসনাদ’ বলা হয়।
৩. আস সুনান (********************)-যেসব হাদীস গ্রন্হে কেবলমাত্র শরীয়াতের হুকুম আহকাম এবং ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি ও আদেশ-নিষেধমূলক হাদীস একত্র করা হ য়, আর ফিকাহর কিতাবের অনুরূফ বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে সজ্জিত হয়, তাহাই ‘সুনান’ নামে পরিচিত। যেমন সুনানে আবূ দাঊদ, সুনানে নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজাহ। তরমিযী শরীফও এক হিসাবে ‘সুনান’ পর্যায়ভুক্ত।
৪. ‘আল-মু’জিম’ (********************)-যেসব হাদীস গ্রন্হে মুসনাদ পদ্ধতিতে এক একজন হাদীসের উস্তাদের নিকট হইতে প্রাপ্ত হাদীস পর্যায়ক্রমে সাজানো হয়, তাহা আল-মু’জিম গ্রন্হ। যেমন তাবারানী সংকলিত তিনখানি গ্রন্হ।
৫. ‘আল-জুয’ (********************)-যেসব হাদীসগ্রন্হে একজন বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হইবে, সেই ব্যক্তি সাহাবীই হউক, কি তাঁহার পরবর্তী কোন উস্তাদের হাদীস। যেমনঃ ****************************************************** ।[********************]
কিন্তু অপর কতিপয় হাদীস-বিজ্ঞানীর মতে ইহাকে ভ্রৎপ্ট বরা বলা হয় না, বলা হয় ‘আল-মুফরাদ’। তাঁহারেদ মতে ******************** বলা হয় এমন সব গ্রন্হকে যাহাতে একই বিষয় সংক্রান্ত হাদীসসমূহ একত্রিত করা হয়। যেমনঃ ইমাম বুখারীকৃত ******************** ও ******************** ।[********************]
৬. ‘আল-গরীবা’ (********************)-হাদীসের কোন উস্তাদ যদি তাঁহার বহু সংখ্যক ছাত্রের মধ্য হইতে মাত্র একজনকে বিশেষ কিছু হাদীস লখাইয়া দেন এবং অপর কাহাকেও তাহা না দেন, তবে এইসব হাদীসের সংকলনকে ‘আল-গরীবা’ বলা হইবে।[********************]
৭. আল মুস্তাখরাজাত (********************)- যে কিতাবে উল্লিখিত হাদীসসমূহ (কিংবা উহার অংশ বিশেষ) সংকলিত হয় এবং উহার ‘মতন’ মূল হাদীস ও নিজস্ব সনদ উল্লিখিত হয়, তাহাকে আল-মুস্তাখরাজ বলা হয়। এইরূপ বহু গ্রন্হ বিরচিত হইয়াছে। সহীহ বুখারীর হাদীসসমূ এইভাবে ও এই পদ্ধতিতে অনেকেই আলাদা আলাদা গ্রন্হে সংকলিত করিয়াছেন। তন্মধ্যে ইসমাঈলী, বরকানী, ইবনে আহমদ আল-গাতরিফী, আবূ আবদুল্লাহ ইবনে আবূ যাহল ও আবূ বকর ইবনে মুরদুইয়া প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। [********************] অনুরূপভাবে সহীহ মুসলিমের হাদীসসমূহকেও সংকলন করা হইয়াছে। যাঁহারা করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে হাফেজ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক আল-ইসফারায়েনী, আবূ জা’ফর ইবনে হামদান, আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে রাজা নিশাপুরী, আবূ বকর আল-জাওকী, আবূ হামেদ শায়েকী, আবুল অলীদ হাসান ইবনে মুহাম্মদ আল কারাশী প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ প্রধাণ।
আর আবূ নয়ীম ইসফাহানী, আবূ আবদুল্লাহ ইবনুল আহজাম, আবূ যার আল-হারভী, আবূ মুহাম্মদ আল-খালাল প্রমুক মুহাদ্দিসগণ বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হের হাদীসসমূহকে একত্রে সংকলন করিয়াছেন।
তবে উপরে যে হাফেজ ইয়াকুবের ‘আল-মুস্তাখরাজ’ গ্রন্হের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহা যেমন সম্পূর্ণ, তেমনি বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য। ইহা জার্মানীর গ্রন্হাগারে এই সেদিন পর্যন্তও মজুদ ছিল।[********************]
৮. ‘আল-মুস্তাদরাক’ (********************)।যেসব হাদীস বিশেষ কোন হাদীস গ্রন্হে শামিল করা হয় নাই অথচ তাহা সেই গ্রন্হাকারের অনুসৃত শর্তে পূর্ণমাত্রায় উত্তীর্ণ হয়, তাহা যে গ্রন্হে একত্র করা হয়, তাহাকে ‘আল-মুস্তাদরাক’ বলা হয়। যেমন ইমাম হাফেজ সংকলিত ‘আল-মুস্তাদরাক’[********************]
ইমাম হাকেম বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করিয়া স্বতন্ত্র দুই খণ্ডবিশিষ্ট গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। তাঁহার বিশ্বাস বা ধারণা এই যে, এই সমস্ত হাদীসই ইমাম বুখারীর হাদীস গ্রহণের শর্তে পূর্ণামাত্রায় উত্তীর্ণ এবং সহীহ কিন্তু বুখারী শরীফে তাহা করা হয় নাই। যদিও হাদীস-বিজ্ঞানীদের মতে ইহাতে বহু যয়ীফ ও মনগড়া (********************) হাদীসও রহিয়াছে।[********************]
এতদ্ব্যতীত বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হকারের শর্তের ভিত্তিতে হাদীস সংগ্রহ করিয়া আর একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন হাফেজ আবূ যায় আবদ ইবনে হুমাইদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (মৃঃ ৪৩৩ হিঃ)।[********************]
৯. ‘কিতাবুল-ইলাল’ (********************)।দোষমুক্ত হাদীসসমূহ এক গ্রন্হে সংকলিত করা হইল ও সেই সঙ্গে হাদীসসমূহের দোষ বা ক্রটিও বর্ণনা করা হইলে উহাকে ‘কিতাবুল-ইলাল’ বলা হয়। ইমাম মুসলিম (র) ও ইমাম হাফেজ আবূ ইয়াহইয়া(র) এই ধরণের গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইমাম যাহবী উল্লেখ করিয়াছেন যে, মুহাদ্দিস শাজীও এই পর্যায়ে এক গুরুত্বপূর্ণূ কিতাব রচনা করিয়াছেন।[********************]
১০. ‘কিতাবুল আতরাফ’ (********************)-হাদীসসমূহের এমন কোন অংশের উল্লেখ করা, যাহা হইতে অবশিষ্ট অংশও বুঝা যায়। এইরূপ গ্রন্হকে ‘কিতাবুল আতরাফ’ বলা হয়। ইহাতে হাদীসের সনদ সম্পূর্ণ উল্লেখ করা হয়। এই পর্যায়েও বহু সংখ্যক গ্রন্হ প্রণয়ন করা হইয়াছে। তন্মধ্যে পরবর্তী পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত গ্রন্হদ্বয় উল্লেখযোগ্যঃ
১. ‘আল-আশরাফ আলিা তুহফাতিল আতরাফ’।
২. তুহফাতুল আশরাফ বি-মা’রিফাতিল আতরাফ।[********************]
হাদীস গ্রন্হসমূহের পর্যায় বিভাগ
ইসলামী শরীয়াতের নিয়ম-বিধান ও ইসলামের আদেশ-নিষেধ সবিস্তারে জানিবার একমাত্র উপায় হইতেছে রাসূলের হাদীস। আর রাসূলের হাদীস জানিবারও একমাত্র উপায় হইতেছে রাসূল হইতে শুরু হওয়া বর্ণনাসমূহ যাচাই-বাছাই করা- তাহা স্বয়ং রাসূল হইতে সূচিত কিংবা কোন সাহাবী বা কোন তাবেয়ী হইতে সূচিত হউক না কেন। তবে বর্ণনা ধারার বিশুদ্ধতা, নির্ভূলতা ও অকাট্যতার প্রতি পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি অবশ্যই রাখিতে হইবে। আর রাসূলের হাদীসসমূহের বর্ণনা ধারা অনুসন্ধান করা এবং সে সবের যাচাই-বাছাই করার ও বর্তমানকালে সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহ পর্যালোচনা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় থাকিতে পারে না। কেননা বর্তমনা কালে রাসূলের এমন কোন হাদীসের সন্ধান লাভ ও উহার সনদ সুরক্ষিত ও নির্ভরযোগ্যভাবে পাওয়া= যাহা ইতিপূর্বৈ কোন হাদীষ গ্রন্হেই সংকলিত হয় নাই- একেবারে অসম্ভব ব্যাপার।[********************]
অতঃপর সকল প্রকার হাদীস এবং সে সবের সনদ লাভ করার জন্য একালের সমস্ত মানুষকেই কেবলমাত্র সংকলিত ও সুরক্ষিত হাদীস গ্রন্হসমূহেরই আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে, একান্তভাবে উহারই উপর নির্ভর করিতে হইবে। আর এইজন্য। হাদীসগ্রন্হসমূহ সম্পর্কে আমাদিগকে বিস্তারিত ও সম্যক ধারনা হাসিল করিতে হইবে। জানিতে হইবে সে সবের শ্রেণী, স্থান ও মর্যাদা।
হাদীস গ্রন্হসমূহ প্রসিদ্ধ ও বিশুদ্ধতার দিক দিয়া চারটি শ্রেণীতে পর্যায়িত। কেননা হাদীসসমূহই বিভিন্ন পর্যায়ের। সর্বোচ্চ পর্যায়ের হইতেছে সেই সব হাদীস, যাহা বর্ণনা পরম্পরায় পূর্ণ ধারাবাহিকতা সহকারে বর্ণিত (********************) এবং যাহা কবুল করা ও তদানুযায়ী আমল করার ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মত সম্পূর্ণ একমত।
অতঃপর সেই সব হাদীস, যাহা বিভিন্ন সূত্র হইতে বর্ণিত ও প্রাপ্ত, যাহাতে কোন প্রকার সন্দেহ বা সংশয়ের স্পর্শ পর্যন্ত লাগে নাই এবং যাহাকে ভিত্তি করিয়া সমগ্র ফিকাহবিদ আমল করিয়াছেন। অন্তত মক্কা-মদীনার হাদীসবিদগণ যেসব হাদীস সম্পর্কে কোনরূপ মতভেদ প্রকাশ করেন নাই। কেননা এই স্থানদ্বয় খুলাফায়ে রাশেদুনের জীবন যাপন ও কর্মকেন্দ্র, হাদীসের সকল দেশীয় আলিমগণের ইহা মিলনকেন্দ্র- সব সময়ই তাঁহাদের যাতায়াত রিহয়াছে, এক শ্রেণীর পর পরবর্তী শ্রেণীর মুহাদ্দিসদের অবিচ্ছিন্ন যাতায়াত রহিয়াছে এই কেন্দ্রদ্বয়ে। এই কারণে হাদীসে কোন প্রকার বাহ্যিক দোষ বা ভূল রহিয়াছে বলিয়া কিছুতেই ধারণা করা যায় না। আর সেই হাদীস বিরাট মুসলিম জাহানে প্রখ্যাত ও অনুসৃত হইয়া রহিয়াছে সব সময়ই এবং সাহাবী ও তাবেয়ী পর্যায়েল বিপুল সংখ্যক লোক হইতে তাহা বর্ণিতও হইয়াছে।
ইহার পর হইতেছে সেই সব হাদীসের স্থান, যাহা বিশুদ্ধ প্রমাণিত, যাহার সনদ উত্তম-নির্দোষ, হাদীসবিদগণ সেই সব হাদীস সম্পর্কে এই সাক্ষ্যই দিয়াছেন। উহা পরিত্যক্তও হয় নাই। বরং উহা গ্রন্হে সংকলিত হওয়ার পূর্ব ও পরে সব সময়ই কার্যত অনুসৃত হইয়াছে। হাদীসের ইমামগণ পূর্ব হইতেই উহার বর্ণনা শুরু করিয়াছেন। ফিকাহবিদগণ উহার ভিত্তিতে ফিকাহ রচনা করিয়াছেন, উহার উপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করিয়াছেন।
প্রথম পর্যায়ের গ্রন্হ
যেসব হাদীস গ্রন্হ এই দুই ধরণের গুণ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হইবে, তাহা প্রথম পর্যায়ের গ্রন্হ। এইভাবেই পর পর হাদীষ গ্রন্হসমূহের মর্যাদা নির্ধারিত হইবে।
এই দৃষ্টিতে হাদীস গ্রন্হসমূহ যাচাই-পরীক্ষা করিয়া দেখিলে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সমস্ত হাদীস গ্রন্হের মধ্যে মাত্র তিনখানি কিতাব এই পর্যায়ে গণ্য হইতে পারে। তাহা যথাক্রমে এইঃ (ক) মুয়াত্তা ইমাম মালিক (খ) সহীহ বুখারী ও (গ) সহীহ মুসলিম।[এই সমস্ত কথাই ******************** হইতে গৃহীত।]
এই গ্রন্হত্রয়ে উদ্ধৃত হাদীসসমূহে দুই-তৃতীয়াংশ বর্ণনাকারী (********************) প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত। এই হাদীসসমূহ আইন ও ব্যবহারিক বিষয়াদির সহিত সম্পর্কশীল। আর এক-তৃতীয়াংশ হাদীস হইতেছে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণিত। চতুর্থ পর্যায়ের কোন বর্ণনাকারীর বর্ণিত কোন হাদীসই এই গ্রন্হত্রয়ে স্থান পায় নাই। সর্বাধিক বিশুদ্ধ, ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন সনদ সম্বলিত হাদীস এ গ্রন্হত্রয়েই সন্নিবেশিত হইয়াছে। মুসলিম জাহানের আলিমগণ এই গ্রন্হত্রয়ের প্রতি যত বেশী ঔৎসুক্য ও শ্রদ্ধা-ভক্তি পোষণ করেন, তত আর কোন গ্রন্হের প্রতিই নহে।[********************]
দ্বিতয় পর্যায়ের গ্রন্হ
এই পর্যায়ে এমন সব গ্রন্হ গণ্য যাহা উপরোল্লিখিত গুণ-বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া মুয়াত্তা ও বুখারীর মুসলিমের সমমর্যাদার নহে। কিন্তু উহার কাছাকাছি নিশ্চয়ই। সে সবের গ্রন্হকারগণ নির্ভরযোগ্য অকাট্যতা, বিশ্বাস-পরায়ণতা, স্মরণশক্তি ও যথাযথভাবে হাদীস বর্ণনা করা এবং হাদীস-বিজ্ঞান সম্পর্কিত সকল সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম জ্ঞানে পূর্ণ পারদর্শিতার দিক দিয়া বিশেষ খ্যাত। তাঁহপাদের গ্রন্হাবলীতে তাঁহারাপ এক বিন্দু উপেক্ষা বা গাফলতির প্রশ্রয় দেন নাই। হাদীস গ্রহণের জন্য যে শর্ত তাঁহারা নিজেরা নির্ধারণ করিয়াছিলেন, প্রত্যেকটি হাদীসকে উহারই সূক্ষ্ম নিক্তিতে ওজন করিয়া করিয়া গ্রহণ ও গ্রন্হাবদ্ধ করিয়াছেন। অতঃপর প্রত্যেক পর্যায়ের মুহাদ্দিস ও ফিকাহবিদগণ উহার যথাযথ গুরুত্ব স্বীকার করিয়াছেন এবং মুসলিম জনগণের মধ্যে উহা ব্যাপক প্রচারও লাভ করিয়াছেন। আলিমগণ উহাদের ব্যাখ্যা করিয়া গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন।
এই পর্যায়ে সুনানে আবূ দাঊদ, জামে তিরমিযী ও সুনানে নাসায়ী- এই গ্রন্হত্রয় গণ্য। ইমাম রুজাইন তাঁহার ‘তাজরিদুস সিহাহ’ এবং ইমাম ইবনুল আমীর তাঁহার ‘জামেউল উসূল’ গ্রন্হে এই হাদীসসমূহ সংকলন করিয়াছেন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল সংকলিত ‘মুসনাদ’ গ্রন্হও এই পর্যায়ে গণ্য বলিয়া মহাদ্দিসগণ উল্লেখ করিয়াছেন।[********************]
প্রথমোক্ত তিনখানি গ্রন্হে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস হইতেছে প্রায় অর্ধেক। অবশিষ্ট অর্ধেকের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ হইতেছে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের লোকদের বর্ণিত হাদীস। আর এক-তৃতীয়াংশ হইতেছে চতুর্থ পর্যায়েল বর্ণনাকারীদের বর্ণিত। অবশিষ্ট কিতাবসমূহে তৃতীয় পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস অর্ধেকেরও বেশী।
তৃতীয় পর্যায়ের গ্রন্হ
তৃতীয় পর্যায়ের হাদীসের সেইসব গ্রন্হ গণ্য, যাহা বুখারী মুসলিম সংকলিত হওয়ার পূর্বৈ, সমকালে ও পরবর্তী সময়ে গ্রন্হাবদ্ধ হইয়াছে। ইহাতে সহীহ, হাসান, যয়ীফ প্রভৃতি সকল প্রকারের হাদীসই সন্নিবেশিত হইয়াছে। এইসব হাদীস যদিও একেবারে অপরিচিত থাকিয়া যায় নাই; কিন্তু তবুও আলিমদের নিকট তাহা খুবই বেশি খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে নাই। ফিকাহ রচনাকারিগণ সেসব হাদীসের প্রতি খুব বেশী ভ্রূক্ষেপ করেন নাই। মুহাদ্দিসগণও উহার দোষ-ক্রটি সম্পর্কে আলোচনা করার বিশেষ কোন প্রয়োজন বোধ করেন নাই। এই পর্যায়ে এমন সব গ্রন্হ রহিয়াছে, যাহার দুর্বোধ্য ভাষা বা শব্দের দুর্বোধ্যতা বিদূরণের জন্য বিশেষ কোন কাজ করা হয় নাই। কোন ফিকাহবিদ উহাতে সংকলিত হাদীসসমূহকে পূর্ববর্তী ইমামদের মতামতের সহিত মিলাইয়া দেখিবারও প্রয়োজন মনে করেন নাই। কোন হাদীস বিজ্ঞানী উহার অসানঞ্জস্যতা বর্ণনা ও প্রকাশ করার চেষ্টা করেন নাই। কোন ঐতিহাসিক এই হাদীসসমূহের বর্ণনাকারীদের জীবন সম্পর্কে কোন আলোকপাতও করেন নাই। এখানে অবশ্য শেষ যুগের ঐতিহাসিকদের কথা বলা হইতেছে না, বলা হইতেছে প্রাথমিক যুগের ঐতিহাসিকদের কথা। ফলে এই ধরনের গ্রন্হাবলী অপ্রকাশিত ও জনগণে অগোচরীভূত হইয়াই রহিয়া গিয়াছে।
নিমোক্ত হাদীস গ্রন্হাবলী এই পর্যায়ে গণ্যঃ
১) মুসনাদে আবূ আলী ২) মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৩) মুসান্নাফ বকর ইবনে শাইবা ৪) মুসনাদ আবদ ইবনে হুমাইদ ৫) মুসনাদে তায়ালিসী ৬) ইমাম বায়হাকীল গ্রন্হাবলী ৭) ইমাম তাহাভীর গ্রন্হাবলী ৮) ইমাম তাবারানীর গ্রন্হাবলী।
এই গ্রন্হকারদের গ্রন্হ প্রণয়নের মূল একমাত্র উদ্দেশ্যে ছিল তাঁহাদের প্রাপ্ত হাদীসসমূহ শুধু সংগ্রহ করা। উহাকে সুসংবদ্ধ কিংবা সুষ্ঠুরূপে সজ্জিতকরণ অথবা ব্যবহারোপযোগী করিয়া তোলা তাঁহাদের লক্ষ্য ছিল না।[********************]
এই গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হাদীসসমূহের এক-তৃতীয়াংশেরও অধিক বর্ণনাকারী হইতেছেন তৃতীয় পর্যায়ের এবং এক-তৃতীয়াংশ বর্ণনাকারী চতুর্থ পর্যায়ের। এই গ্রন্হাবলীর মধ্যে কোন কোন কিতাব অপরাপর কিতাব হইতে অপেক্ষাকৃত দুঢ়মূল ও মজবুত বলিয়া মুহাদ্দিসগণের নিকট স্বীকৃত।
চতুর্থ পর্যায়ের গ্রন্হ
এই পর্যায়ের সেই সব হাদীস গ্রন্হ গণ্য, যে সবের গ্রন্হকারগণ দীর্ঘকাল পর এমন হাদীস সংকলন করিয়াছেন, যাহা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়েল গ্রন্হাবলীতে সন্নিবেশিত হয় নাই। বরং তাহা অপ্রখ্যাত ও অজ্ঞাতনামা গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়া পড়িয়াছিল। উত্তরকালে এই পর্যায়েল গ্রন্হকারগণ এই হাদীসসমূহের মূল্য স্বীকার করিয়াছেন। ইহা এমন সব লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হইত, যাহাদের নিকট হইতে পূর্বকালের মুহাদ্দিস ও হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নকারিগণ তাহা গ্রহণ করিতে ও নিজেদের গ্রন্হে সন্নিবেশিত করিতে প্রস্তুত হন নাই। কিংবা তাহা উচ্ছৃঙ্খল কি দুর্বল বর্ণনাকারীদের কর্তৃক বর্ণিত হইত, অথবা তাহা সাহাবী কিংবা তাবেয়ীদের উক্তি ছিল; কিংবা তাহা ছিল বনী-ইসরাঈলের কিসসা-কাহিনী, দার্শনিক কিংবা ওয়ায়েজদের কথা, যাহাকে পরবর্তীকালের বর্ণনাকারিগণ ভ্রান্তিবশত রাসূলের হাদীসের সহিত সংমিশ্রিত করিয়া ফেলিয়াছিলেন।
ইবনে হাব্বান ও কামেল ইবনে আদী প্রণীত ‘কিতাবুল যুয়াফা’ খতীব আবূ নয়ীম, ঞ্জইবনে আসাকির, ইবনে নাজ্জার ও দায়লামী রচিত গ্রন্হাবলী এই পর্যায়ে গণ্য। মুসনাদে খাওয়ারিজিমীও এই পর্যায়ের গ্রন্হ বলিয়া মনে হয়।[********************]
পঞ্চম পর্যায়ের গ্রন্হ
এই গ্রন্হাবলীর একটি পঞ্চম পর্যায়ও রহিয়াছে। এই পর্যায়ে সেই সব হাদীস গণ্য যাহা ফিকাহবিদ সূফী ও ঐতিহাসিক প্রমুখদের মুখে মুখে প্রচারিত হইয়াছে। উপরোক্ত চার পর্যায়ের হাদীসের সহিত ইহার কোন সামঞ্জস্য নাই।
বে-দ্বীন, বাক-চতুর লোকদের মনগড়া হাদীসও এই পর্যায়ে গণ্য। ইহারা সেই সব হাদীসের সহিত এমন সনদ বা বর্ণনাসূত্র যোগ করিয়া দিয়াছে যাহাতে কোন প্রকার আপত্তি উত্থাপিত হইতে না পারে। আর এমন সুন্দরভাবে কথাগুলি সাজাইয়া পেশ করিয়াছে যে, রাসূলে করীম (স) এই কথা বলেন নাই তাহা বাহ্যত জোর করিয়া বলা শক্ত।
বস্তুত এই লোকেরাই ইসলামের এক কঠিন বিপদের সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও এই বিপদের ঘনঘটা ইসলামের সাংস্কৃতিক আকাশকে বেশী দিন অন্ধকারাচ্ছন্ন করিয়া রাখিতে পারে নাই। হাদীস বিজ্ঞানিগণ সমালোচনার কষ্টিপাথরে এই হাদীসসমূহের যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন, রাসূলের অনুরূপ ভাবধারার হাদীসসমূহের সহিত উহা মিলিয়া দেখিয়াছেন এবং উহার ‘মনগড়া’ হওয়া রহস্য অকাট্যভাবে উদঘাটন করিয়াছেন। ফলে কোন মনগড়া হাদীসই হাদীস পর্যায়ে গণ্য হইবার সুযোগ পাইতে সমর্থ হয় নাই।[********************]
উপরোক্ত আলোচনায় দুইখানি প্রখ্যাত হাদীসগ্রন্হের জন্য কোন পর্যায় উল্লেখ বা নির্ধারণ করা হয় নাই। গ্রন্হদ্বয় হইলঃ (ক) ইবনে মাজাহ (খ) সুনানে দারেমী। এই গ্রন্হদ্বয় কোন পর্যায়ে গণ্য তাহা আলোচনা সাপেক্ষ।
মুহাদ্দিস আবূ হাসান সনদী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
মোটকথা ইবনে মাজাহ মর্যাদার দিক দিয়া প্রধান পাঁচখানি গ্রন্হের পরে ও নিম্নে অবস্থিত।[********************]
আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইয়ামানী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
সুনানে ইবনে মাজাহ আবূ দাঊদ ও সুনানে নাসায়ীর পরবর্তী পর্যায়ের গ্রন্হ। উহার হাদীসসমূহ পর্যালোচনা ও পরীক্ষা করা আবশ্যক। কেননা উহাতে ফযীলত সংক্রান্ত অধ্যায়ে একটি মওযু হাদীস রহিয়াছে।[********************]
এই সব উদ্ধৃতি হইতে প্রমাণিত হয় যে, ইবনে মাজাহ তৃতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্হ।
সুনানে দারেমী সম্পর্কেও হাদীস বিজ্ঞানিগণ এই মতই প্রকাশ করিয়াছেন। শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলবী (র উহাকে এই তৃতীয় পর্যায়েল গ্রন্হাবলীর মধ্যে গণ্য করিয়াছেন। শাহ ওলীউল্লাহ দেহল্বী (র)-রও এই মত।[********************]
হাদীস বর্ণনায় রাসূল (স)-এর নৈকট্য
হাদীস গ্রন্হ-প্রণেতাগণ সাধারণত হাদীষ বর্ণনার এমন সব সূত্রের অনুসন্ধান করিয়াছেন, যাহার মাধ্যমে রাসূলের সহিত নিকটতর সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব। অর্থাৎ হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নকারী মুহাদ্দিসগণ রাসূলের নিকট হইতে যত কম সংখ্যক বর্ণনাকারীর মাধ্যমে হাদীস লাভ করিতে পারিতেন তাহার জন্য তাঁহারা বিশেষভাবে চেষ্টা করিতেন। ফলে যে হাদীস যত কম সংখ্যক বর্ণনাকারীর মাধ্যমে গ্রন্হকার পর্যন্ত পৌঁছিত, মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে উহার গুরুত্ব ও মর্যাদা ততই বেশি হইত, ততই তাহা নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হইত। কেননা হাদীস বর্ণনার সূত্রে মধ্যবর্তী লোক যতই কম হয়, হাদীস গ্রন্হ সংকলনকারীর পক্ষে রাসূলে করীমের ততই নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়।
দ্বিতীয়ত, হাদীস বর্ণনা পরম্পরা (********************) যতই সংক্ষিপ্ত ও অপেক্ষাকৃত অল্প সংখ্যক বর্ণনাকারী সম্বলিত হয়, তাঁহাদের অবস্থান যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করা ততই সহজসাধ্য হয়। হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ভূল-ভ্রান্তিও ততই কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই দিক দিয়া সমস্ত হাদীস গ্রন্হ প্রণেতার মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর স্থান সর্বোচ্চ। ইহার কারণ এই যে, তিনি অন্তত চারজন সাহাবীল সরাসরি সাক্ষাৎ পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলেন।
হাদীষ বর্ণনা সূত্রে দীর্ঘতা ও স্বল্পতার দিক দিয়া কয়েকটি পরিভাষার উদ্ভব হইয়াছে। এখানে উহাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১. যেসব হাদীস রাসূলে করীম (স) হইতে গ্রন্হ প্রণয়নকারী পর্যন্ত মাত্র একজন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে পৌঁছিয়াছে, সেইসব হাদীসকে বলা হয় ‘ওয়াহদানীয়াত’ (********************) ‘এক বর্ণনাকারী সম্বলিত হাদীস’।
ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত হাদীস গ্রন্হ এই ধরণের কয়েকটি হাদীসই উদ্ধৃত হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে একটি হাদীস উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
******************************************************
আবূ হানীফা বলিয়াছেন, আমি আয়েশা বিনতে আজরাদকে বলিতে শুনিয়াছিঃ নবী (স) বলিয়াছেনঃ আল্লাহর সবচেয়ে অধিক সংখ্যক সৈন্য হইতেছে জুরাদ-(বিশেষ জাতীয় ফড়িং), আমি নিজে উহা খাই না, আর উহাকে হারামও বলি না।[ এই হাদীসটি মুসনাদ আবূ হানীফা ******************** গ্রন্হে উদ্ধৃত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীনের ইতিহাস গ্রন্হেও ইহা উদ্ধৃত হইয়াছে ।*******************
উদ্ধৃত হাদীসটি রাসূলের নিকট হইতে আবূ হানীফা পর্যন্ত মাত্র একজন বর্ণনাকারীর মাধ্যমে পৌঁছিয়াছে। তিনি হইতেছেন হযরত আয়েশা বিনতে আজরাদ নামের একজন মহিলা সাহাবী। এই কারণে এই হাদীসটি ‘ওয়াহদানীয়াত’- এক ব্যক্তির মধ্যস্ততাসম্পন্ন হাদীসের পর্যায়ভুক্ত।
বহু সংখ্যক হাদীস এমন রহিয়াছে, যাহা মাত্র দুই পর্যায়ের বর্ণনাকারীর মাধ্যমেই আবূ হানীফা (র) পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে। তিনি নিজে অপর তাবেয়ীদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন। তাবেয়ী উহা শ্রবণ করিয়াছেন সাহাবীদের নিকট হইতে। হাদীস গ্রন্হ সংকলনকারী পর্যন্ত রাসূলের নিকট হইতে এই হাদীসটি পৌঁছিতে মাত্র দুই স্তরের বর্ণনাকারীর মাধ্যম রহিয়াছে। অতএব পরিভাষার এই হাদীসসমূহে বলা হয় ‘সুনায়ীয়াত (********************)- দুই স্তরের বর্ণনকারী সম্বলিত হাদীস। ইমাম আবূ হানীফা সংকলিত ‘কিতাবুল আ-সা-র’ গ্রন্হে এই ধরনের বহু হাদীসই উদ্ধৃত হইয়াছে। এখানে মাত্র দুইটি হাদীসের সনদ উল্লেখ করা হইয়াছে।
(১)
******************************************************
আবূ হানীফা বলেনঃ আমার নিকট আবূয-যুবাইর, তিনি জাবির ইবনে আবদুল্লাহ হইতে, তিনি রাসূলে করীম (স) হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।………….
এই সনদে বর্ণিত হাদীসটিতে ইমাম আবূ হানীফা ও রাসূলে করীমের মাঝখানে ‘আবুয-যুবাইর তাবেয়ী ও জাবির ইবনে আবদুল্লাহ সাহাবীর মধ্যস্থতা রহিয়াছে।
(২)
******************************************************
আবু হানীফা বলিয়াছেনঃ নাফে আমাদের নিকট ইবনে উমর হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, রাসূলে করীম (স) নিষেধ করিয়াছেন।………..
এই সনদে ইমাম আবূ হানীফা পর্যন্ত রাসূলের হাদীস পৌঁছিতে তাবেয়ী নাফে ও সাহাবী ইবন উমর – এই দুই স্তরের বর্ণনাকারীর মাধ্যমে রহিয়াছে মাত্র।
ইমাম মালিক যেহেতু তাবেয়ী নহেন, তিনি হইতেছেন তাবেয়ীদের পরবর্তী স্তরের লোক- তাবে-তাবেয়ী, সেই কারণে তাঁহার সংকলিত হাদীসসমূহের অধিকাংশই এই ‘সুনায়িয়াত পর্যায়ভুক্ত। ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম ইবনে হাম্বল কোন তাবেয়ীরও সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারেন নাই। এই কারণে তাঁহাদের সংকলিত হাদীস প্রায়ই সুলাসীয়াত- তিন স্তরের বর্ণনাকারী সম্বলিত হাদীসের পর্যায়ভুক্ত। সুনানে দারেমী গ্রন্হে পনেরটি হাদীস এমন রহিয়াছে, যাহা তিনি রাসূলের পর তিন স্তরের বর্ণনাকারীর মাধ্যমে শুনিতে পাইয়াছিলেন।[********************]
সিহাহ-সিত্তা প্রণেতাগণের মধ্যে ইমাম বুখারী, ইমাম ইবনে মাজাহ, ইমাম আবূ দাউদ এবং ইমাম তিরমিযীও কোন কোন তাবেয়ীর সাক্ষাৎ পাইয়াছেন; তাঁহাদের নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা, সংগ্রহ ও বর্ণনা করিয়াছেন। এই কারণে সনদের উচ্চতার দিক দিয়া তাঁহারাও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সামন স্তরে রহিয়াছেন। যদিও ইমাম শাফেয়ীর ইন্তেকালের সময়ে (মৃঃ ২০৪ হিঃ) ইমাম বুখারীর বয়স হইয়াছিল মাত্র দশ বৎসর, ইমাম আবূ দাঊদের ছিল মাত্র দুই বৎসর, ইমাম ইবনে মাজাহ তো তখন পর্যন্ত জন্মগ্রহণ করেন নাই।[********************] ইহাদের গ্রন্হাবলীতে উপরোক্ত তিন স্তরের বর্ণনাকারী সম্বলিত হাদীসের সনদের সংখ্যা নিম্নরূপঃ
১) সহীহ বুখারী শরীফে ২২টি, ২).সুনানে ইবনে মাজাহ ৫টি, ৩) সুনানে আবূ দাঊদ ১টি ৪) জামে তিরমিযী ১টি।
ইমাম মুসলিম ও ইমাম নাসায়ী সরাসরি কোন তাবেয়ী হইতে হাদীস বর্ণনা করেন নাই। এইজন্য তাঁহাদের বর্ণিত সমস্ত হাদীসই চার স্তরের বর্ণনাকারী সম্বলিত।
হাদীস জালকরণ ও উহার কারণ
হাদীস সংকলনের যে দীর্ঘ ইতিহাস ইতিপূর্বে পাঠকদের সম্মুখে পেশ করা হইয়াছে তাহা হইতে এই কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হইয়াছে যে, হাদীসের উৎপত্তিকাল হইতে গ্রন্হকারে সংকলিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি স্তরে উহা সংরক্ষণের জন্য সকল প্রকার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হইয়াছে। রাসুলের হাদীস যাহাতে সর্বোত্তমভাবে সংরক্ষিত থাকে, উহাতে কোন প্রকার সংমিশ্রণ না ঘটে এবং উহা বিলীন হইয়া না যায় সেজন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রৃহণে কোন এক স্তরেই এক বিন্দু উপেক্ষা, অসতর্কতা বা গাফিলতির প্রশয় দেওয়া হয় নাই। কিন্তু এতদসত্ত্বেও একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, হাদীসের এই দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় এমন এক-একটি অব্স্থা দেখা দিয়াছে, যখন দুষ্ট লোকেরা স্বার্থ কিংবা অসদুদ্দেশ্যে প্রণোদিত হইয়া নিজেদের ‘কথা’কে রাসূলের হাদীস নামে চালাইয়া দিতে চেষ্টা করিয়াছে এবং এমন কিছু কিছু ‘কথা’ রাসূলের বিরাট হাদীস সমুদ্রের সহিত মিশিয়া যাইবার সুযোগ লাভ করিয়াছে।
রাসূলের হাদীস সংরক্ষণের এই অবিমিশ্র ও নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায় এইরূপ একটি দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটিতে পারিল, তাহা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি তাহা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ সাপেক্ষও।
আমরা এখানে হাদীস জালকরণের এই ইতিহাস সংক্ষিপ্ত ও ব্যাপকভাবে আলোচনা করিব।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতার পুংখানুপুংখভাবে পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় সর্বপ্রথম হাদীস জালকরণের কাজ প্রখ্যাত ‘খাওয়ারিজ’দের কর্তৃক সূচিত হয়। সিফফীন যুদ্ধে (৩৬ হিঃ) সন্ধিসূত্র লইয়া হযরত আলী (রা)-এর সমর্থকদের মধ্যে মারাত্মক মতভেদ দেখা দেয় এবং তাহারা এই সন্ধিকে মানিয়া লইতে বিন্দুমাত্র রাযী হয় না। অতঃপর তাহারা এক স্বতন্ত্র ধর্মীয় দলের রূপ ধারণ করে।
খাওয়ারিজগণ হাদীস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। তাহারা অন্যান্য লোকের নিকট হইতে কোন কথাকেই সত্যরূপে গ্রহণ করিতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। তাহারা মিথ্যুককে মনে করিত কাফির। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাহারা হাদীস জালকরণের কাজ করিতে ও রাসূলের নামে মিথ্যা প্রচার করিতে শুরু করে। আর ইহার মূলে তাহাদের উদ্দেশ্যে ছিল নিজেদের বিশেষ মতের সমর্থন যোগানো মাত্র।
আল্লামা ইবনুল জাওজী তাঁহার ‘কিতাবুল মওজুআত’ নামক গ্রন্হে ইবনে লাহইয়ার নিম্নোক্ত উক্তির উল্লেখ করিয়াছেনঃ
******************************************************
এই হাদীস দ্বীন-ইসলামের অন্যতম ভিত্তি। দ্বীনের এই ভিত্তিগত জিনিস তোমরা যাহার নিকট হইতে গ্রহণ কর, তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিও। কেননা আমরা যখন যাহা ইচ্ছা করিতাম তখনি উহাকে হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিতাম।
অর্থাৎ এই ব্যক্তি পূর্বে খাওয়ারিজ দলভুক্ত ছিল এবং তখন ইচ্ছামত কথা রাসূলের হাদীস বলিয়া চালাইয়া দিত। খাওয়ারিজদের কর্তৃক হাদীস জালকরণের গোড়ার কথা ইহাই।
ইহারি পর আমরা শিয়া সম্প্রদায়কেও হাদীস জালকরণ কাজে লিপ্ত দেখিতে পাই। তাহারা আসলে ছিল ইসলামের উৎকট দুশমন। ইসলামের মূল বুনিয়াদের উ পর আঘাত হানিবার অবাধ সুযোগ লাভের কুমতলবে তাহারা শিয়া মতবাদের চরম বিভ্রান্তির আশ্রয় লইয়াছিল। প্রথমে তাহারা কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত চরম বিকৃতি ও কদর্থ প্রবিষ্ট করাইতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাহাতে তাহারা কোন সাফল্য লাভ করিতে পারিবে না মনে করিয়া রাসূলের হাদীসের প্রতি লক্ষ্য আরোপ করে এবং রাসূলের হাদীসের নামে অসংখ্য মিথ্যা কথা চালাইয়া দিতে চেষ্টা করে। তাহারা হযরত আলীর উচ্চ প্রশংসা ও হযরত মুয়াবিয়ার মর্যাদা লাঘবের উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক হাদীস জাল করে। হযরত আলীর স্বপক্ষে এমন অনেক হাদীস তাহারা চালাইয়া দিয়াছে, যাহার কোন কোনটি হইতে হযরত আলীর নবুয়্যাত এবং কোন কোনটি দ্বারা রাসূলের পরে হযরত আলীর খিলাফতের অধিকার প্রমাণিত হয়।
শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বপ্রধান ‘হাদীস রচনাকারী’ হইতেছে মুখতার ইবনে আবূ উবাইদ। তিনি প্রথমে ছিলেন খাওয়ারিজ দলভুক্ত। পরে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সমর্থকদের মধ্যে শামিল হন। আর শেষ পর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণ শিয়া মত ধারণ ও শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়া যান। তিনি প্রকাশ্যভাবে হাদীস জাল করিতেন। তিনি যখন কূফার আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সহিত সাক্ষাৎ করেন, তখন জনৈক মুহাদ্দিসকে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমার জন্য রাসূলের নামে এমন কিছু হাদীস রচনা করিয়া দাও, যাহা হইতে প্রমাণিত হইবে যে, তিনি (মুখতার) তাহার পরই খলীফা হইবেন।
মুসলমানদের মধ্যে যাহারা দুর্বল ঈমানদার তাহারাও রাসূলের নামে অনেক হাদীস জাল করিতে শুরু করে। তাহারা হযরত আলীর সম্মান লাঘব এবং হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের অধিক মর্যাদা প্রমাণের জন্য ও বহু হাদীস রচনা করে।
হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস জালকরণের এক নূতন ফিতনা জাগ্রত হয়। লোকেরা কিসসা-কাহিনী, মিথ্যঅ ও অমূলক কিংবদন্তী হাদীসের রূপে বর্ণনা পরম্পরা সূত্র সহকারে প্রচার করিতে শুরু করে। এই সময়কার হাদীস রচয়িতাদের মধ্যে রাজনৈতিক স্বার্থবাদী, কিসসা-কাহিনী বর্ণনাকারী ও গোপনে ধর্মদ্রোহিতাকারী লোকেরাই প্রধান হইয়া দেখা দেয়।[এই দীর্ঘ আলোচনার উৎসঃ ********************]
উপরোক্ত ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, মোটামুটি তিনটি কারণে ইসলামে হাদীস জালকরণের ফিতনার উদ্ভব হয়ঃ
ক) রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের মতের প্রতিষ্ঠা ও প্রাধান্য স্থাপন, নিজেদের আচরিত রাজনৈতিক মতাদর্শকে সপ্রমাণিতকরণ ও জনগণের নিকট উহাকে গ্রহণযোগ্য করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে হাদীস জালকরণ।
খ) জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচার, ওয়ায-নসীহত দ্বারা জনগণকে অধিক ধর্মপ্রাণ বানানো, ইবাদত বন্দেগীতে অধিকতর উৎসাহী বানানো এবং পরকালের ভয়ে অধিক ভীত করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে হাদীস জালকরণ।
গ) ব্যক্তিগত স্বার্থ লাভ উহাকে সহজসাধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী করিয়া তোলার উদ্দেশ্যে মনগড়া কথাকে ‘হাদীস’ নামে চালাইয়া দেওয়া।
বিশেষ রাজনৈতিক কারণে হাদীস রচনা করা হয় প্রথমত হযরত আলী (রা)-কে কেন্দ্র করিয়া। নবী করীমের পরে তিনিই যে খলীফা হইবার অধিকারী- অন্য কেহ নয়, এই কথা প্রমাণ করাই এইরূপ হাদীস রচনার উদ্দেশ্য ছিল। এই পর্যায়ের তিনটি জাল হাদীসের দৃষ্টান্ত পেশ করা যাইতেছেঃ
ক) নবী করীম (স) বিদায় হজ্জ হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় ‘গাদীরে খাম’ নামক স্থানে যে ভাষণ দান করেন, তাহাতে তিনি হযরত আলীর প্রতি ইশারা করিয়া নিম্নোক্ত কথাও বলিয়াছিলেন বলিয়া প্রচার করা হয়ঃ
(ক) ******************************************************
এই ব্যক্তিই আমার উত্তরাধিকারী, আমার ভাই, আমার পরে এই-ই খলীফা; অতএব তোমরা সকলে তাহার কথা শোন এবং তাহাকেই মানিয়া চল।
(খ)- ******************************************************
আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ এমন এক পূণ্য যে, ইহা থাকিলে কোন পাপই তাহার ক্ষতি করিতে পারিবে না। পক্ষান্তরে, আলীর প্রতি হিংসা ও শক্রতা পোষণ এমন এক পাপ যে, কোন নেক কাজই তাহাকে কোন ফায়দা দিতে পারে না।
******************************************************
যে ব্যক্তি হযরত আলীর প্রতি হিংসা পোষণ করা অবস্থায় মরিবে, সে হয় ইয়াহুদী কিংবা নাসারা হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইবে।
হাদীস নামে প্রচারিত এই বাক্যত্রয় যে কিছুতেই হাদীসে রাসূল হইতে পারে না; বরং ইহা নিছক রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যে স্বকপোলকল্পিত তাহা প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝিতে পারা যায়।[********************]
হযরত আলী নবী করীমের উত্তরাধিকারী প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে শিয়াগণ যে কত শত হাদীস জাল করিয়া চালাইয়াছে, তাহার ইয়াত্তা নাই। কিন্তু তাহাদের প্রত্যেকটি কথাই যে সুস্পষ্ট মিথ্যা, তাহা হযরত আলী (রা) হইতে বর্ণিত বিশুদ্ধ হাদীস হইতেও প্রমাণিত হয় এবং তাহা সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির অগম্য বিবেচিত হয়।
ইহার বিপরীত দিকে হযরত আবূ বকর ও উমরের অতিরিক্ত প্রশংসায় যেসব জাল হাদীস প্রচার করা হইয়াছে তাহাও অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বিবেচিত হইতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না।
দৃষ্টান্তস্বরূপ এই পর্যায়ের দুইটি হাদীস উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ
******************************************************
আমাকে যখন আকাশের দিকে মি’রাজে লইয়া যাওয়া হইল, তখন আমি বলিলামঃ হে আল্লাহ! আমার পরে আলী ইবনে আবূ তালিবকে খলীফা বানাও। তখন আকাশ-জগত কম্পিত হইয়া উঠিল এবং সর্বদিক হইতে ফেরেশতাগণ অদৃশ্য ধ্বনি করিয়া উঠিলেনঃ হে মুহাম্মদ! আল্লাহর এই আয়াত পাঠ কর, (যাহার অর্থ) তোমরা কিছু চাহিতে পারিবে না, আল্লাহ যাহা চাহিবেন তাহাই হইবে। আর আল্লাহ ইচ্ছা করিয়াছেন যে, তোমার পরে আবূ বকর সিদ্দীকই খলীফা হইবে।
******************************************************
বেহেশতের প্রত্যেকটি বৃক্ষের প্রত্যেকটি পত্রে লিখিত আছেঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ, আবূ বকর, উমর ফারুক ও উসমান যুন্নুরাইন।
হযরত মুয়াবিয়ার প্রশংসায়ও হাদীস জাল করা হইয়াছে। যেমনঃ
******************************************************
তোমরা যখন মুয়াবিয়াকে আমার মিম্বারে দাঁড়াইয়া খুতবা দিতে দেখিবে, তখন তাঁহাকে তোমরা গ্রহণ করিও, কেননা সে বড়ই বিশ্বস্ত-আমানতদার ও সুরক্ষিত।
এইভাবে জনগণের মধ্যে ভিত্তিহীন ও নিতান্ত অমুলক অনেক কথাই রাসূলের হাদীস নামে প্রচার করা হইয়াছে। এখানে এই পর্যায়ের আরো তিনটি কথা উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
(ক)****************************************************** – জন্মভূমির প্রেম ঈমানের অংশ।
(খ)******************************************************- হে মুহাম্মদ! তোমাকে যদি সৃষ্টি করিতে না হইত, তাহা হইলে এই আকাশমণ্ডল ও জগতই সৃষ্টি করিতাম না’।
(গ)******************************************************- আলী ইবনে আবূ তালিবের জন্য অস্তমি সূর্যকে পুনরুত্থিত করা হয়।[আহমদ ইবনে হাম্বল বলিয়াছেনঃ ******************** এই হাদীসের কোন ভিত্তি নাই। ইবনে জাওজী দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ ******************** “ইহা হাদীস নয়, রচিত কথা। অবশ্য ইমাম সয়ূতী ও তাহাভী সহীহ বলিয়া দাবি করিয়াছেন। ********************]
এই তিনটি কথাই হাদীসরূপে সমাজে প্রচারিত হইয়াছে এবং ওয়াজকারীদের মুখে মুখে ব্যাপক প্রচার লাভ করিয়াছে। কিন্তু প্রকৃতপকেষ এই তিনটি কথাই সম্পূর্ণ মিথ্যা- জাল।
হাদীস জালকরণের প্রতিরোধ ব্যবস্থা
খাওয়ারিজগণ প্রথমত নিজেদের গরজে হাদীস জাল করিতে শুরু করিলেও ইহা বেশী দূর চলিতে পারে নাই। খাওয়ারিজদের নিজস্ব আকীদা বিশ্বাসই তাহাদিগকে এই পথে বেশী দূর অগ্রসর হইতে দেয় নাই।
১. খাওয়ারিজদের আকীদা ছিলঃ যে লোক মিথ্যাবাদী যে কাফির! ফলে তাহাদের মধ্যে মিথ্যা কথা ও হাদীস জালকরণের প্রবণতা আপনা হইতেই খতম হইয়া যায়।
২. খাওয়ারিজগণ ছিল বেদুঈন, স্বভাবত কঠোর ও রূঢ় প্রকৃতির। তাহারা অন্যান্য জাতি বা গোত্রের কোন কথা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত ছিল না। এই কারণে পারস্যবাসী ও ইয়াহুদীদের- যাহারা প্রধানত শিয়া মত গ্রহণ করিয়াছিল ও জাল হাদীস রচনা করিয়াছিল- কোন কথাই তাহাদের নিকট কোন গুরুত্ব লাভ করিতে পারে নাই।
৩. খাওয়ারিজগণ প্রতিপক্ষের সহিত লড়াই করার ব্যাপারে তাহাদের নিজেদের বীরত্ব, শক্তি-সামথ্য ও অস্ত্রশসস্ত্রের উপর অধিক নির্ভরশীল ছিল। এইজন্য তাহারা মিথ্যা কথার আশ্রয় ******************** লইতে কখনো প্রস্তুত হয় নাই। আর প্রতিপক্ষকে তাহারা কাফির মনে করিত বলিয়া মিথ্যার আশ্রয় লওয়ার কোন প্রয়েঅজন বোধ করে নাই। কেননা কাফিরদিগকে দমন করার জন্য তরবারির ব্যবহার ভিন্ন অন্য কোন হাতিয়ার ব্যবহার করা যায় বলিয়া তাহারা মনেই করিত না।
এই তিনটি কারণেই অন্যান্য ফাসাদ ও বিপর্যয়কারী উপদল অপেক্ষা খাওয়ারিজ দের দ্বারা খুব কম সংখ্যকই জাল হাদীস রচিত হইয়াছে। আর যে দুই চারটি হাদীস তাহারা জাল করিয়াছে, ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ মুসলিম সমাজ তাহা সহজেই চিনিতে ও উহা প্রত্যাহার করিতে সমর্থ হইয়াছে। ফলে এই পর্যায়ে হাদীস জালকরণের কাজ যতটুকুই হইয়াছে তাহা তেমন কোন বিপদের কারণ হইয়া দেখা দেয় নাই।
কিন্তু পরবর্তীকালে শিয়া সম্প্রদায়ের রচিত হাদীসসমূহ মুসলিম সমাজে মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব করে। অবশ্য আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহ এই পর্যায়ে মুসলিমদের ঈমান ও দ্বীন রক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করিয়া দেয়। খাওয়ারিজ, শিয়া ও তাহাদের মত অন্যান্য ভ্রান্ত ও অসৎ প্রকৃতির দল-উপদল ছিল একদিকে- ইসলামের মূলোৎপাটনে আত্ম নিয়োজিত; কিন্তু ইহার বিপরীত দিকে অচলায়তন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল সুসংবদ্ধ মুসলিম সমাজ ও ইসলামী জনতা। তাহাদিগকে খাওয়ারিজ ও শিয়াদের ভ্রান্ত মতবাদ ও অমূলক প্রচারণা কিছুমাত্র প্রভাবান্বিত করিতে পারে নাই। বরং তাঁহারা অত্যন্ত দৃঢ়তাসহকারে কুরআন ও সহীহ হাদীসকে আঁকাড়াইয়া ধরিয়া থাকে। সেই সঙ্গে তাঁহারা বিশুদ্ধ ও সহীহ হাদীসসমূহের ব্যাপক শিক্ষা দান ও প্রচারে নিযুক্ত হন। এই সময় পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক সাহাবী বাচিঁয়াছিলেন, তাঁহাদের সঙ্গে ছিল উহাদেরই সর্বপ্রযত্নে তৈরী করা ইসলামী জ্ঞানে দীক্ষিত তাবেয়ীনের এক বিরাট জামা’আত। তাঁহারা সকলেই সমবেতভাবে হাদীস জালকরণের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করিয়াছেন, ইসলামের স্বচ্ছ বিধানে গোলক ধাঁধা সৃষ্টির সকল ষড়যন্ত্রের জাল তাঁহারা ছিন্ন ভিন্ন করিয়া দেন এবং মিথ্যাবাদীদের মিথ্যাকে একটি একটি করিয়া জনসমক্ষে উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়া ধরেন।
এই সময় মুসলিম সমাজ ‘হাদীস’ নামে কোন কথা গ্রহণের ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন হইয়া উঠে। কেবলমাত্র বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত হইলেই কোন কথাকে হাদীস বলিয়া গ্রহণ করিতে তাঁহারা আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। বরং তাঁহারা উহার সনদ সূত্রকে যাচাই করিতে শুরু করেন, উহাতে উল্লিখিত প্রত্যেকটি ব্যক্তি চরিত্র, তাকওয়া, ইলম, স্মরণশক্তি ও বর্ণনাকারীদের পারস্পরিক সাক্ষাৎ সম্পর্কে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে খোঁজ-খবর লইতে শুর করেন।
ইমাম মুসলিম সহীহ মুসলিমের ভূমিকায় [১১ পৃষ্ঠা] ইবনে সিরিন তাবেয়ীর এই উক্তিটি উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ
******************************************************
মুসলমানগণ পূর্বে হাদীসের সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন না, কিন্তু পরে যখন ফিতনা ও বিপর্যয় দেখা দেয়, তখন তাঁহারা বলিতে শুরু করেনঃ বর্ণনাকারীদের নাম বল, তাহাদের মধ্যে যাহারা আহলে সুন্নাত, তাহাদের নিকট হইতে হাদীস গ্রহণ করা হইবে; আর যাহারা বিদয়াতপন্হী, তাহাদের বর্ণিত হাদীস প্রত্যাখ্যান করা হইবে।
এইভাবে তাবেয়ী মুহাদ্দিসগণ সাহাবীদের নিকট হাদীস বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন। ভাল-মন্দের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য করা ও অন্ধভাবে সব কথা গ্রহণ না করাই ছিল এই জিজ্ঞাসাবাদের মূল উদ্দেশ্য।
এই সময় গোটা মুসলিম সমাজ হাদীসের ব্যাপরে অত্যন্ত কঠিন ও অনমনীয় হইয়া উঠে। মিথ্যা কথা প্রচারকারী লোক হাদীস শ্রবণের উদ্দেশ্যে মসজিদে সাহাবীদের নিকট আসিয়া বসিত, তখন সাহাবিগণ তাহাদিগকে কঠোর ভাষায় ভৎসনা করিতেন ও মসজিদ হইতে বিতাড়িত করিয়া দিতেন। অনেক সময় এই ধরনের লোকদিগকে তাড়াইবার জন্য পুলিশের সাহায্যও গ্রহণ করা হইত।
একবার একজন কিসসা-কাহিনী বর্ণনাকারী ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)-এর নিকটে আসিয়া বসে। তিনি তখন তাহাকে সেখান হইতে উঠিয়া যাইতে বলেন। কিন্তু সে উঠিয়া যাইতে অস্বীকার করে। তখন হযরত ইবনে উমর (রা) পুলিশ ডাকিয়াপাঠান ও তাহার সাহায্যে তাহাকে বিতাড়িত করেন।
এই ধরনের অনেক ঘটনারই উল্লেখ পাওয়া যায় হাদীসের কিতাবসমূহে। তাহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবী ও তাবেয়ীনের যুগে হাদীস জালকারী ব্যক্তিগণ সাধারণ্যে পরিচিত ও চিহ্নিত ছিল। তাঁহারা ইহাদের শয়তানী তৎপরতা ধরিয়া ফেলিতেন, ফলে জনসাধারণ তাহাদের বিভ্রান্তির জালে কখনোই জড়াইয়া পড়িতে পরিত না।
এই সময়কার হাদীসবিদগণ কেবল মিথ্যাবাদী ও হাদীস জালকারীদের ষড়যন্ত্র জাল ছিন্ন করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই; বরং এই গ্রন্হের পূর্ববর্তী আলোচনা প্রমাণ করে যে, এই সময় অপর দিকে তাঁহারা সহীহ হাদীসসমূহ নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংগ্রহ ও সংকলনের কাজেও পূর্ণরূপে আত্মানিয়োগ করিয়াছিলেন।[********************]
শুধু তাহাই নয়, এই সময় হাদীস সমালোচনা করা এবং যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া প্রত্যেকটি হাদীস গ্রহণের জন্য স্থায়ী মানদণ্ডও নির্ধারিত হয়। ইহার ফলেই হাদীস সমালোচনা-বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়।
হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞানের উৎপত্তি
উপরে যে হাদীস জালকরণ সম্পর্কে আলোচনা করা হইয়াছে, উহারই প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে এক স্বতন্ত্র হাদীস-বিজ্ঞান রচিত হয়। উহাকে (******************************************************
) –‘হাদীস জালকারণ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করা’ বলা হয়। এই জ্ঞানের সংজ্ঞা দান প্রসঙ্গে নওয়াব সিদ্দীক হাসান লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
হাদীস জালকরণ সম্পর্কিত ইলম এমন এক প্রকারের বিজ্ঞান, যাহা দ্বারা কোন হাদীসটি জাল এবং কোনটি প্রমাণিত-প্রতিষ্ঠিত তাহা জানিতে ও চিনিতে পারা যায় এবং উহা দ্বারা জালকারীর অবস্থাও জানা যায় যে, সে উহা সত্য বলিয়াছে, না মিথ্যা। এই বিশেষ জ্ঞানের উদ্দেশ্য হইতেছে সত্য ও মিথ্যা হাদীস এবং সত্য বর্ণনাকারী ও মিথ্যা বর্ণনাকারীর মধ্যস্থিত পার্থক্য বুঝিবার প্রতিভা ও যোগ্যতা অর্জন। এই জ্ঞানের লক্ষ্য ও ফায়দা এই যে, ইহার সাহায্যে এই ধরনের মিথ্যা ও জাল হাদীস হইতে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হয়। অথবা হাদীসটি বর্ণনা করার সঙ্গে সঙ্গে উহা যে জাল তাহাও বলিয়া দেওয়া সম্ভব হয়। হাদীসের ক্ষেত্রে ইহা অত্যন্ত জরুরী ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান। কেননা নবী করীম (স) বলিয়াছেনঃ যে ব্যক্তি আমার প্রতি কোন মিথ্যা কথা আরোপ করে, যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় বানাইয়া লয়।[********************]
এইরূপ জ্ঞানের উৎপত্তি হওয়ার ফলে সকল প্রকার জাল হাদীস হএত মুসলিম সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব হইয়াছে। এই পর্যায়ে হাদীসজ্ঞান সম্পর্কে পারদর্শী মনীষিগণ অভাবিতপূর্ব ও অতি প্রয়োজনীয় এবং বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় দান করিয়াছেন। মনীষিগণ এমন অনেক নীতিগত (theoritical) নিয়ম-নীতি রচনা করিয়া দিয়াছেন, যাহার সাহায্যে মওজু বা জাল হাদীস অতি সহজেই চিনিতে পারা যায়। এইজন্যই তাঁহারা কতকগুলি লক্ষণ ও চিহ্নিত করিয়া দিয়াছেন। সেই সব লক্ষণ যে সব হাদসে পরিলক্ষিত হইবে, সে সবের জাল হওয়া সম্পকে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকিবে না।
আর দ্বিতীয়পন্হা হইতেছে practical- ব্যবহারিক ও বাস্তবঃ এই পর্যায়ে তাঁহারা হাদীস জালকরণে অভ্যস্ত লোকদের বিস্তারিত পরিচয় জনসমক্ষে পেশ করিয়া দিয়াছেন। জনগণের সহিত তাহাদিগকে সবিস্তারে পরিচিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং তাহাদের মনগড়াভাবে রচিত ও মিথ্যা-মিথ্যি প্রচারিত ‘হাদীসসমূহ’ও সকলের সম্মুখে উপস্থাপিত করা হইয়াছে।
মনীষিগণ এই পর্যায়ে বহুসংখ্যক মূল্যবান গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। এই গ্রন্হাবলী ‘কিতাবুল মওজুয়াত’ নামেই পরিচিত। একদিকে যেমন রাসূলে করীম (স)-এর প্রকৃত হাদীসসমূহ সহীহ, জামে, সুনান ও মুসনাদ প্রভৃতি ধরনের হাদীস গ্রন্হাবলীতে সন্নিবদ্ধ ও সুসংকলিত হইয়াছে, অপরদিকে তেমনি মিথ্যা ও রচিত হাদীসসমূহ হাদীসবিদ আলিমের নিকট স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে। ফলে প্রকৃত হাদীস ও উহার মর্যাদা জানিয়া লওয়া উহা ‘সহীহ’ কিংবা ‘হাসান’ বা যয়ীফ কিংবা মওজু তাহা চিনিতে পারা খুবই সহজ হইয়া পড়িয়াছে। হাদীস-বিজ্ঞানীদের এই অবদান ইসলামী জ্ঞান-চর্চার ইতিহাসে চির উজ্জ্বল হইয়া থাকিবে।
জাল হাদীসের কয়েকটি লক্ষণ
পূর্বেই বলিয়াছি জাল হাদীস চিনিয়া লইবার জন্য মনীষিগণ এমন সব নিয়ম নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, যাহা বাস্তবিকই অব্যর্থ ও সর্বতোভাবে নির্ভরযোগ্য। কেননা হাদীস সমালোচনা ও যাচাই পরীক্ষা করার সুদৃঢ় ও তীক্ষ্ণ জ্ঞান এবং প্রতিভা তাঁহাদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বর্তমান ছিল। এখানে আমরা কয়েকটি নিয়মের উল্লেখ করিতেছিঃ
১. জাল হাদীস বর্ণনাকারীর মধ্যে এমন লক্ষণ দেখা যায়, যাহার ভিত্তিতে সহজেই বুঝিতে পারা যায় যে, বর্ণনাকারী সম্পূর্ণ মিথ্যঅ কথা রচনা করিয়া রাসূলের হাদীস হিসাবে চালাইয়া দিয়াছে।
এখানে দুইটি জাল হাদীসের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করিয়া কথাটিকে স্পষ্ট করিয়া তুলিতে চেষ্টা করা যাইতেছেঃ
(ক) সাইন ইবনে উমর তামামী বলেন, আমি সায়াদ ইবনে জরীফের নিকট উপস্থিত ছিলাম। এই সময় তাহার পুত্র একখানি কিতাব হাতে লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে উপস্থিত হইল। জিজ্ঞাসা করিলঃ তোমার কি হইয়াছে? পুত্র বলিলঃ আমাকে শিক্ষক মারিয়াছেন। তখন সে বলিলঃ ‘আমি আজ তাহাকে নিশ্চয়ই লজ্জিত করিব’। ইবনে আব্বাস হইতে ইকরামা রাসূলের এই কথাটি বর্ণনা করিয়াছেনঃ
******************************************************
তোমাদের বালকদের শিক্ষকগণ তোমাদের মধ্যে অধিক দুষ্ট লোক, ইয়াতীম ছেলেদের প্রতি তাহারা খুবই কম দয়াশীল এবং মিসকীনের প্রতি অন্যন্ত কঠোর।
(খ) মা’মুন ইবনে আহমদ আল হারাভীকে লক্ষ্য করিয়া একজন বলিলঃ শাফেয়ী ও তাঁহার খুরাসানী অনুসরণকারীদের সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? নবী করীম (স) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
******************************************************
‘আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি হইবে, যাহার নাম হইবে মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস। সে আমার উম্মতের পক্ষে ইবলীস হইতেও ক্ষতিকর। আমার উম্মতের মধ্যে আর এক ব্যক্তি হইবে, যাহার নাম আবূ হানীফা, সে আমার উম্মতের জন্য প্রদীপস্বরূপ।
এই হাদীস দুইটির বর্ণনাকারী যে স্বার্থ ও হিংসা-প্রণোদিত হইয়া রাসূলের নামে মিথ্যা কথাকে হাদীস বলিয়াচালাইয়া দিয়াছে তাহা বুঝিতে একটুও কষ্ট হয় না।
২. বর্ণিত হাদীসের মধ্যে এমন লক্ষণ পাওয়া যায়, যাহা হাদীসটির জাল হওয়ার কথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে। যেমন হাদীসের মূল কথায় এমন কোন শব্দের উল্লেখ থাকা, যাহার অর্থ অত্যন্ত হাস্যকর কিংবা শব্দ ও অর্থ উভয়ই বাচালতাপূর্ণ। কেবল শব্দটি যদি হাস্যকর হয় তাহা হইলেই হাদীসটি জাল হইবে এমন কথা সাধারণভাবে বলা যায় না। কেননা হাদীসটি হয়ত মূল অর্থের দিক দিয়া সহীহ, কিন্তু উহার কোন পরবর্তী বর্ণনাকারী শব্দে কিছুটা পরিবর্তন সূচিত করিয়া নিজের ইচ্ছামত কোন শব্দ বসাইয়া দিয়াছে। অথচ মূলতঃ হাদীসটি রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণিত। তবে বর্ণনাকারী যদি এই দাবি করেন যে, হাদীসের ভাষা ও শব্দসমূহ সবই রাসূলে করীম (স) হইতে বর্ণিত, তাহা হইলে তাহাকে মিথ্যাবাদী না বলিয়া উপায় নাই। কেননা, নবী করীম (স) ছিলেন আরবদের মধ্যে অত্যন্ত শুদ্ধ ও মিষ্টভাষী। এইরূপ অবস্থায় হাদীসের একটি শব্দও যদি হাস্যকর বা হালকা ধরনের হয় তাহা অবশ্যই জাল এবং মিথ্যা হইবে।[********************]
হাস্যকর অর্থ সম্বলিত একটি জাল হাদীস এইরূপঃ
******************************************************
তোমরা মোরগকে গালাগালি করিও না, কেননা উহা আমার বন্ধু।[এই গোটা হাদীসটি জাল হইলেও উহার প্রথম অংশ রাসূলেরই কথা। আবূ দাউদ উত্তম সনদে উহা উদ্ধৃত করিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ ******************** মোরগকে গাল দিও না, কেননা উহা নামাযের জন্য সজাগ করে। ********************]
ইহা নবী করীম(স)-এর কথা হইতে পারে না, তাহা কে-না বুঝিতে পারে?.
৩. হাদীস জাল হওয়ার আল একটি লক্ষণ হইতেছে উহার স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেকের বিপরীত হওয়া। হাদীস যদি স্বাভাবিক বুদ্ধি ও বিবেকের বিপরীত হয় এবং উহার গ্রহণযোগ্য কোন তাৎপর্য দান সম্ভব না হয়, অথবা উহা যদি সাধারণ অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণের বিপরীত হয়, তবে তাহাও জাল বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে। যেমন দুই বিপরীত জিনিসকে একত্র করার সংবাদ দান; কিংবা সৃষ্টি কর্তাকে অস্বীকারের কোন কথা। কেননা শরীয়াতের কোন বিধান স্বাভাবিক ও সুষ্থ বিবেকবুদ্ধির বিপরীত হইতে পারে না।
একটি জাল হাদীস এইরূপঃ
******************************************************
আল্লাহ অশ্ব সৃষ্টি করিলেন। উহাকে চালাইলেন। ফলে উহার খুব ঘাম বাহির হইল। অতঃপর উহা হইতে তিনি নিজেকে সৃষ্টি করিলেন।
কোন সুস্থ বুদ্ধির লোক-ই কি এইরূপ হাস্যকর কথা বলিতে পারে?
দ্বিতীয়টি এইরূপঃ
******************************************************
‘বাজেঞ্জান বেগুন সকল প্রকার রোগের ঔষধি’।
ইহা সম্পূর্ণ বাতিল ও ভিত্তিহীন কথা। কেননা পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত হইয়াছে যে, বাজেঞ্জান রোগের মাত্রা বৃদ্ধি করে ও উহাকে কঠিন করিয়া দেয়। এই হাদীসটি (?) শুনিলেই সাধারণ বুদ্ধি (common sense) বলিয়া উছে, ইহা মিথ্যা।[********************]
৪. হাদীস যদি ক কুরআনের স্পষ্ট বিধানের কিংবা মুতাওয়াতির হাদীস বা অকাট্য ধরনের ইজমার বিপরীত হয়, তবে তাহাকে জাল বা মওজু মনে করিতে হইবে।[********************]
এই দৃষ্টিতেই যেসব হাদীসে দুনিয়ার অবশিষ্ট আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হইয়াছে সাত হাজার বৎসর, সে সবকে মিথ্যা বলিয়া ঘোষণা ক রা হইয়াছে। কেননা তাহা কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতের বিপরীত। আল্লাহা তা’আলা বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হে নবী! লোকেরা তোমার নিকট জিজ্ঞাসা করে কিয়ামত কখন কায়েম হইবে। তুমি বলিয়া দাও যে, এ সম্পর্কিত জ্ঞান কেবলমাত্র আমার আল্লাহরই আয়ত্ত, তিনিই উহা উহার সঠিক সময়ে উঘাটিত করিবেন।[********************]
হাদীসবিদ নিম্নোদ্ধৃত হাদীসটিকে বাতিল ও মওজু ঘোষণা করিয়াছেন।[********************]
******************************************************
অবৈধ সন্তান বেহেশতে প্রবেশ করিতে পারিবে না।
কেননা উহা কুরআনের নিম্নোক্ত স্পষ্ট ঘোষণার বিপরীত। আল্লাহ বলিয়াছেনঃ
******************************************************
কোন বোঝা বহনকারীই অপর কাহারো (পাপের) বোঝা বহন করিবে না।[********************]
এইভাবে যেসব ‘হাদীস’ এই ধরনের অর্থ প্রকাশ করে যে, যাহার নাম আহমদ কি মুহাম্মদ সে কখনো দোযখে যাইবে না। কেননা এ কথা সর্বজনবিদিত যে, কেবলমাত্র নাম বা উপনাম কি উপাধি কখনই দ্বীন পালনের প্রয়োজন পূর্ণ করিতে পারে না। অতএব কেবল নাম বা উপনাম উপাধির সাহায্যেই কেহ দোযখ হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে না। তাহা রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় হইতেছে ‘আমালুস সালেহ’- নেক আমল।
৫. যেসব হাদীসে বিপুল সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত কোন ঘটনার উল্লেখ থাকে; কিন্তু তাহা না সাহাবীদের যুগে ব্যাপক প্রচার লাভ করিতে পারিয়াছে, না অল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত অপর কেহ তাহার বর্ণনা করিয়াছে। এইরূপ হাদীস যে জাল, তাহাতে সন্দেহ নাই। এক শ্রেণীর শিয়াদের নিম্নোক্ত দাবিটিও এই পর্যায়ের জাল হাদীসঃ
******************************************************
বিদায় হজ্জ হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় গদীরে খাম-এর এক লক্ষেরও অধিক সাহাবীর উপস্থিতিতে নাবী করীম (স) হযরত আলী (রা)-কে খিলাফত দান করিয়াছিলেন।
দাবি করা হইয়াছে যে, বিপুল সংখ্যক- এক লক্ষেরও অধিক সংখ্যক সাহাবীর উপস্থিতিতে নবী করীম (স) হযরত আলী (রা)-কে খিলাফত দান করিয়াছিলেন; কিন্তু সাধারণভাবে সাহাবীগণ ইহার কোন গুরুত্বই দিলেন না, নবী করীমের ইন্তেকালের পরে খলীফা নির্ধারণের সময়ে এই কথা কোন সাহাবীর স্মরণই হইল না, ইহা এক অসম্ভব ব্যাপার। কাজেই ইহা সম্পূর্ণ স্বকপোলকল্পিত।
৬. সাধারণ যুক্তি ও সুস্থ বিবেক-বিরোধী কোন কথা কোন হাদীসে উল্লিখিত হইলেও তাহাকে জাল মনে করিত হইবে। যেমন হাদীস বলিয়া পরিচিত একটি কথায় উদ্ধৃত হইয়াছেঃ
******************************************************
না তুর্কিদের জুলুম ভালো, না আরবদের সুবিচার।
কেননা জোর জুলুম সাধারণভাবেই নিন্দিত, যেমন সুবিচার সকল অবস্থায়ই প্রশংসনীয়।
৭. হাদীসের বর্ণনাকারী যদি রাফেযী মতাবলম্বী হয় এবং হাদীসে যদি রাসূলের বংশের লোকদের ফযীলত বর্ণিত হয়, বুঝিতে হইবে যে তাহা জাল। কেননা রাফেযী মতের লোকেরা সাধারণতই রাসূলের বংশের লোকদের অমূলক প্রশংসায় এই ধরনের কথা রাসূলের নামে চালাইয়া দিতে এবং সাহাবীদের গালাগাল ও কুৎসা বর্ণনায় অভ্যস্ত। বিশেষতঃ তাহারা প্রথম দুই খলীফার প্রতি রীতিমত শক্রতা পোষণ করে এবং তাঁহাদিগকে খিলাফতের ব্যাপারে হযরত আলীর অধিকার হরণকারী বলিয়া মনে করে।
৮. কোন হাদীসের উল্লেখিত ঘটনা যদি বিশুদ্ধ নির্ভরযোগ্য ও সপ্রমাণিত ইতিহাসের বিপরীত হয়, তবে বুঝিতে হইবে যে, তাহা নিঃসন্দেহে জাল। যেমন এক হাদীসে বলা হইয়াছে যে, খায়বারবাসীদের উপর হইতে জিযিয়া প্রত্যাহার করা হইয়াছিল হযরত সায়াদ ইবনে মুয়ায- এর শাহাদাতের কারণে। ইহা প্রকৃত ইতিহাসের বিপরীত কথা। কেননা হযরত সায়াদ খন্দক যুদ্ধে শহীদ হইয়াছিলেন এবং তাহা খায়বার যুদ্ধের পূর্বে অনুষ্ঠিত ঘটনা। দ্বিতীয়তঃ ‘জিযিয়া’ খায়বার যুদ্ধকালে বিধিবদ্ধও হয় নাই, বরং তাবুক যুদ্ধের পূর্বে তাহা সাহাবীদের নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিতই ছিল। তৃতীয়তঃ উহাতে বলা হইয়াছে যে, উহা মুয়াবিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ান লিখিয়াছেন। অথচ মুয়াবিয়া তো মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম কবুল করিয়াছিলেন। খায়বার যুদ্ধকালে তিনি মুসলমানই ছিলেন না।
৯. কেহ যদি আল্লাহর নির্ধারিত সাধারণ আয়ূষ্কালের অধিক আয়ূ লাভের দাবি করে এবং বহু পূর্বকালে অতীত কোন ব্যক্তির সাক্ষাত লাভ করিয়াছে বলিয়া প্রচার করে, বুঝিতে হইবে যে, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যেমন রতনহিন্দীস দাবি করিয়াছে যে, নবী করীম (স)- এর সাক্ষাৎ পাইয়াছে। অথচ এই ব্যক্তি ব্যক্তি জীবিত ছিল ছয়শত হিজরী সনে। জাহেল লোকদের ধারণা এই যে, এই ব্যক্তি নবী করীমের সহিত একত্রিত হইয়াছিল, তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ করিয়াছে এবং রাসূল তাঁহার দীর্ঘায়ু লাভের জন্য দোয়া করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ এইরূপ দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কেননা নবী করীম (স)- এর সহিত সাক্ষাৎপ্রাপ্ত সাহাবাগণের অধিকাংশই ঊনষাট হিজরী সনের পূর্বেই অন্তর্ধান করেন। তখন কেবলমাত্র হযরত আবূত-তোফাইল জীবিত ছিলেন। আর তিন যখন ইন্তেকাল করেন, তখন লোকেরা এই বলিয়া কাঁদিয়াছিলঃ
******************************************************
নবী করীমের সাক্ষাৎপ্রাপ্ত লোকদের মধ্যে ইনিই সর্বশেষ ব্যক্তি।
১০. সূফীগণ রাসূলের নিকট হইতে কোন ধারাবাহিক সনদ সূত্র ব্যতীত কাশফ বা স্বপ্নযোগে হাদীস লাভ করিয়াছেন, এইরূপ দাবিও সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। দ্বীন-ইসলামের সকল আলিমই এই সম্পর্কে সম্পূর্ণ একমত যে, স্বপ্ন বা কাশফ এর সূত্রে শরীয়াতের কোন সত্য প্রমাণিত হয় না। কেননা তাহা আদৌ নির্ভরযোগ্য নহে। উহা বরং শরীয়াতের মূল বিধানের উপর অমূলক বাড়াবাড়ি মাত্র। কুরআন এবং ধারাবাহিক ও বিশুদ্ধ সনদসূত্রে বর্ণিত হাদীস ব্যতীত শরীয়াতের তৃতীয় কোন ভিত্তি নাই, আছে বলিয়া কেহ মনে করিলেও তাহা মিথ্যা এবং প্রত্যাখ্যানযোগ্য।[এই পর্যন্তকার দীর্ঘ আলোচনা গৃহীত হইয়াছে ******************** গ্রন্হের ৪৭৯-৪৮৫ পৃষ্ঠা হইতে এবং ******************** হইতে সাহায্য গ্রহণ করা হইয়াছে।]
হাদীস সমালোচনার পদ্ধতি
হাদীস-সমালোচনা বিজ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা জাল হাদীস চিনিবার বিভিন্ন উপায়ের উল্লেখ করিয়াছি। হাদীস জালকরণের এই পরিস্থিতিতে সূক্ষ্ম ও অকাট্য মানদণ্ডের ভিত্তিতে হাদীস যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া কোনটি জাল আর কোনটি বিশুদ্ধ তাহা স্পষ্টরূপে যাচাই করার তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়। এই জন্য প্রত্যেকটি হাদীসের সনদ, সনদের সহিত সংশ্নিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তি তাহাদের পারস্পরিক সাক্ষাত, হাদীস শ্রবণ ও গ্রহণ অবস্থা, হাদীসের মূল উৎস প্রভৃতি আঁতিপাতি করিয়া খুঁজিয়া দেখার কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হয়। এই সময়ে মুসলিম সমাজের বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত করা হয় যে, কেবলমাত্র বিশুদ্ধ ও নির্ভূল হাদীসই গ্রহণ করা হইবে, তাহা ব্যতীত অপর কোন ‘হাদীস’ই গ্রহণ করা হইবে না। কেননা হাদীস গ্রহণ ও তদানুযায়ী কাজ করা ঠিক তখনই সম্ভব, যখন প্রমাণিত হইবে যে, ইহা প্রকৃতই রাসূলের বানী এবং ইহার হাদীস হওয়ার ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নাই। আর হাদীসের এই প্রমাণ নির্ভর করে উহার বর্ণনা পরম্পরা বা সনদের বিশুদ্ধতার উপর, সনদে উল্লিখিত প্রত্যেক বর্ণনাকারীর বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার উপর, সমালোচনা আঘাতে তাঁহাদের মধ্যে কাহারো ‘আহত’ না হওয়ার উপর। হাদীসের সনদ এইসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে দ্বিতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা ও যাচাই করিতে হইবে মূল হাদীসের নিজস্ব গুণাগুণ; মূল বক্তব্যের যথার্থতা ও বিশ্বাস্যতা। হাদীস বিজ্ঞানের পরিভাষায় প্রথম পদ্ধতিকে বলা হয় ‘রিওয়ায়েত’- যাচাই করা। আর দ্বিতীয়টিকে বলা হয় দিরায়েত- বুদ্ধি ও সুস্থ বিবেকের কষ্টিপাথরে মূল কথাটির যাচাই করা।
সনদ-পরীক্ষার কাজ
সনদের দিক দিয়া হাদীসের সত্যাসত্য যাচাই করা এক বিশেষ বিজ্ঞান। বিশেষজ্ঞগণ সংজ্ঞা দান করিয়াছেন এই ভাষায়ঃ
******************************************************
রাসূলে করীম, সাহাবী ও তাবেয়ীনের যে কথা, কাজ, সমর্থন অনুমোদন বা কোন গুণ বর্ণনা করা হইবে, উহার বর্ণনা-পরম্পরাকে খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিবেচনা করার উপরই এই বিজ্ঞান নির্ভরশীল।[********************]
হাদীস গ্রহণযোগ্য কিনা, তাহা নির্ধারণের জন্য সর্বপ্রথম হাদীসেন বর্ণনা সূত্রে যাচাই করিতে হইবে। এই পর্যঅয়ে হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির বিভিন্ন দিক দিয়া পরীক্ষা করা অপরিহার্য। বর্ণনাকারী কি ধরনের বা কি চরিত্রের লোক, ইসলামী জ্ঞান ও বিদ্যা তাঁহার কতখানি আয়ত্ত, বোধশক্তি কতখানি তীব্র ও উন্নত, প্রতিভা ও স্মরণশক্তিই বা কিরূপ, তাঁহার আকিদা, বিশ্বাস, চিন্তা ও মতবাদ নির্ভুল কিনা, ইসলাম মুতাবিক কিনা, বিদয়াতপন্হী নয়তো? সে সুস্থ বিবেক ও চিন্তাশক্তিসম্পন্ন কিনা, মাসনিক রোগগ্রস্ত নয় তো, সত্য কথাকে যথাযথরূপে বলিতে অভ্যস্ত, না মিথ্যা কথাও কখনো কখনো বলিয়া থাকে, সৎকর্মশীল ও চরিত্রবান, না চরিত্রহীন ও দুষ্কৃতি অনুরাগী, হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনা বিজ্ঞানে এই ধরনের প্রশ্নই প্রধান। ইহার পরও জানিবার বিষয় হইতেছে, সে কোথায় কাহার নিকট হইতে হাদীস শ্রবণ ও শিক্ষা করিয়াছে। যাহার নিকট হইতে সে হাদীস বর্ণনা করে, তাহার সহিত তাহার প্রকৃতই সাক্ষাৎ হইয়াছে কিনা, হইয়া থাকিলে কোথায়, কখন এবং তখন তাঁহার বয়স কত ছিল, এইসব বিষয়ও পুংখানুপংখরূপে বিচার্য।
বস্তুত ইহা এক বিশেষ জ্ঞান, ইহাকেই বলা হয়ঃ ******************** ইহার সংজ্ঞাদান প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
ইহা এমন এক বিজ্ঞান, যাহাতে বিশেষ শব্দে হাদীস বর্ণনাকারীদের সমালোচনা করা হয় এবং তাহাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়।
এইজন্য হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির বিস্তারিত জীবনচরিত সম্পর্কে গভীর সূক্ষ্মজ্ঞান অর্জন অপরিহার্য। এই জ্ঞানকে বলা হয়ঃ
******************************************************
লোকদের নাম-পরিচয় সংক্রান্ত বিদ্যা ও জ্ঞান।
ইহার ব্যাখ্যা করিয়া বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
অর্থাৎ হাদীসের সনদে উল্লেখিত সাহাবী, তাবেয়ী ও সকল বর্ণনাকারী সম্পর্কে জ্ঞান। কেননা এই জ্ঞান হইতেছে হাদীস জ্ঞানের অর্ধেক।[********************]
এই জ্ঞানের প্রয়োনজনীয়তা সম্পর্কে সুফিয়ান সওরী বলিয়াছেনঃ
******************************************************
সনদসূত্র ও সনদ সম্পর্কিত জ্ঞান হইতছে ঈমানদার লোকদের হাতিয়ার বিশেষ, আর তাহার নিকট যদি হাতিয়ারই না থাকিল তবে সে কি জিনিস লইয়া যুদ্ধ (শক্রপক্ষের সহিত মুকাবিলা) করিবে?।[********************]
ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
সনদসূত্র ও তৎসংক্রান্ত জ্ঞান ব্যতীতই যে লোক হাদীস সন্ধান ও গ্রহণ করে, সে ঠিক রাত্রির অন্ধকারে কাষ্ঠ আহরণকারীর মত লোক। সে কাষ্ঠের বোঝা বহন করিতেছে, অথচ তাহার মধ্যে বিষধর সর্প রহিয়াছে। উহা তাহাকে দংশন করে; কিন্তু সে টেরই পায় না।[********************]
হাদীষ বর্ণনাকারী সকল পর্যায়ের ও স্তরের লোকদের সমালোচনা ও যাঁচাই পরীক্ষা করা এবং তাঁহাদের মধ্যে নির্ভরযোগ্য লোকদিগকে যথাযোগ্য মর্যাদা দান ইসলামে এক অতীব জরুরী কার্যক্রম। আল্লাহ তা’আলা স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়াছেনঃ
******************************************************
হে ঈমানদারগণ! কোন ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন খবর লইয়া আসিলে তোমরা উহার সত্যতা যাচাই করিয়া লও। অন্যথায় অজ্ঞতাবশত কোন জাতির উপর বিপদ টানিয়া আনিতে পার এবং ফলে তোমরা লজ্জিতও হইতে পার।[********************]
এই স্পষ্ট নির্দেশের কারণেই সাহাবায়ে কিরাম প্রত্যেকটি কথা বা হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে বিশেষ কড়াকড়ি ও সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। যাহার-তাহর কথা বা হাদীস অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণ-সাক্ষ্য ব্যতীত গ্রহণ করিতে তাঁহারা প্রস্তুত হইতেন না। পরবর্তীকালে ইলমে হাদীসৈর ক্ষেত্রে ইহাই ‘হাদীস-সমালোচনার বিজ্ঞান’ উৎপত্তির ভিত্তি স্থাপন করে। ‘ইলমে আসমাউর রিজাল’ এই কারণেই রচিত হয়। হাদীস কোনটি গ্রহণযোগ্য, সে বিষয়ে ফায়সালা করার জন্য এই বিজ্ঞান একান্তই অপরিহার্য। এ সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
হাদীস বর্ণনাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির সমালোচনা ও যথাযোগ্য মর্যদা দান সম্পর্কে কথা বলা রাসূলে করীম, বিপুল সংখ্যক সাহাবী এবং তাবেয়ীন হইতে প্রমাণিত। তাঁহাদের পরেও এই কাজ চলিয়াছে। তাঁহারা সকলেই এই কাজকে বিধিসম্মত মনে করিয়াছেন ইসলামের শরীয়াতকে মিথ্যা ও জালিয়াতের করাল গ্রাস হইতে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, লোকদিগকে নিছক আঘাত দান বা দোষী প্রমাণের উদ্দেশ্যে নহে।[]
মুহাম্মদ ইবনে সিরীন তাবেয়ী বলিয়াছেনঃ
******************************************************
নিশ্চয় জানিও, এই জ্ঞান দ্বীন-ইসলামের মৌলিক ব্যাপার, অতএব তোমরা কাহার নিকট হইতে দ্বীন গ্রহণ করিতেছে, তাহা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে অবশ্যই দেখিয়া লইবে।[]
হাদীস সমালোচনা বিজ্ঞঅন উৎপত্তির ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি আরো বলিয়াছেনঃ
******************************************************
পূর্বে লোকেরা হাদীসের সনদ ও বর্ণনাকারীদের পরিচয় জানিতে চাহিত না। কিন্তু যখন ফেতনা শুরু হইয়া গেল তখন তাহারা বলিতে লাগিলঃ তোমাদের বর্ণনাকারীদের নাম পরিচয় বল। প্রকৃত হাদীস ধারণকারী লোক হইলে তাহাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা হইবে আর বিদয়াত-পন্হী হইলে তাহাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা হইবে না।[]
হাদীস যাচাই সংক্রান্ত এই জরুরী ইলম- ‘ইলমে আসমাউর রিজাল’ সম্পর্কে প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ডাঃ স্প্রিংগার বলিয়াছেনঃ
মুসলিমদের আসমাউর রিজাল- এর মত বিরাট ও ব্যাপক চরিতবিজ্ঞান সৃষ্টি করিতে পারিয়াছে এমন অপর কোন জাতি দুনিয়ায় কোন দিন ছিল না, বর্তমানেও এইরূপ অপর কোন জাতির অস্তিত্ব দুনিয়ায় নাই। এই বিজ্ঞানের সাহায্যেই আজ পাঁচ লক্ষ্য হাদীস বর্ণনাকারী লোকদের বিস্তারিত জীবনচরিত সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যাইতে পারে।[******************** গ্রন্হের ইংরেজী অনুবাদের ভূমিকা (কলিকাতায় মুদ্রিত ১৮৫৩ সন।)]
হাদীস সমালোচনার ব্যাপারে হাদীস-বিজ্ঞানিগণ অশেষ সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছেন। কোন স্মরণ-শক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি যদি ষাট বৎসর বয়সে স্মরণশক্তি হারাইয়া ফেলে ও ভুলিয়া যাওয়ার রোগে আক্রান্ত হয়, তাহা হইলে তাহার জীবন চরিতে একথা অবশ্যই লিখিত হইয়াছে যে, ‘এই ব্যক্তি প্রথম জীবনে স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিল; কিন্তু ষাট বৎসর বয়সে তাহার স্মরণশক্তি বিলুপ্ত হইয়াছে। কাজেই তাহার বর্ণিত কেবল সেই সব হাদীসই গ্রহণ করা যাইবে, যাহা সে স্মরণশক্তি বর্তমান থাকা অবস্থায় বর্ণনা করিয়াছে, এ্ই দুর্ঘটনার পরে বর্ণিত কোন হাদীসই তাহার নিকট হইতে গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। এই চরিত-বিজ্ঞান রচনার ব্যাপারে রচয়িতাগণ কর্তৃক কোন পক্ষপাতিত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, বিশেষ কাহারো প্রতি অকারণ ঝোঁক ও কাহারো সম্পর্কে মাতাতিরিক্ত প্রশংসা করার মত মারাত্মক ক্রটি প্রদর্শিত হয় নাই। তাঁহারা প্রত্যেক ব্যক্তি সম্পর্কে পূর্ণ সত্যের উপর নির্ভর করিয়া বাস্তব ঘটনার বিশ্নেষণ করিয়াছেন। তাঁহাদের দৃষ্টি ছিল সম্পূর্ণ সত্যের উপর নির্ভর করিয়াবাস্তব ঘটনার বিশ্নেষণ করিয়াছেন। তাঁহাদের দৃষ্টি ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও আবিলতা বিমুক্ত। যাহার যতটুকু মর্যাদা ও স্থান, তাহাকে ঠিক ততটুকুই দিয়াছেন, দিতে কোন প্রকার কার্পণ্য বা সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিচয় দেন নাই।
হাদীস সমালোচনার পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এখানে দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি কথার উল্লেখ করা যাইতেছে। (অবশ্য নীতিগত আলোচনা পূর্বেও করা হইয়াছে।)
মুহাদ্দিস শেখ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক শেয়খ উবাদ ইবনে কাসীর সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁহার তাকওয়া পরহিযগারির তো বিপুল প্রশংসা করিয়াছেন, কিন্তু বলিয়াছেন যে, নৈতিক কারণে তাঁহার বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করা যাইবে না।
ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে হাকেমকে এক ব্যক্তি একটি হাদীস শুনাইল। ইমাম, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ এই হাদীসটি তুমি কাহার নিকট হইতে কখন শুনিয়াছ? সে উত্তরে বলিলঃ ‘আবদ ইবনে হুমাইদের নিকট হইতে অমুক সনে আমি এই হাদীসটি শ্রবণ করিয়াছি’।
তখন ইমাম আবদুল্লাহ তাঁহার সম্মুখে সমবেত ছাত্রদের লক্ষ্য করিয়াবলিলেনঃ ‘দেখ, এই লোকটির মতে আবদ ইবনে হুমাইদ তাঁহার মৃত্যুর সাত বছর পরে এই ব্যক্তির নিকট হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন’।
কেননা সেই ব্যক্তি আবদ ইবনে হুমাইদের নিকট হইতে হাদীস শ্রবণের যে সনের উল্লেখ করিয়াছিল, তাহার সাত বৎসর পূর্বেই আবদ ইবনে হুমাইদ ইন্তেকাল করিয়াছেন। অর্থাৎ এই ব্যক্তি তাঁহার নিকট হইতে যে হাদীস শ্রবণের দাবী করিয়াছে তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং হাদীসটি অগ্রহণযোগ্য।
ইয়াহুদীরা মুসলিম খলীফার নিকট রাসূল কর্তৃক লিখানো একখানি দস্তাবেজ পেশ করিয়া দাবি করে যে, আমাদের উপর ধার্যকৃত জিযিয়া প্রত্যাহার হওয়া উচিত। দস্তাবেজে লিখিত ছিল যে, খায়বার অধিবাসী ইয়াহুদীদের জিযিয়া মাফ করিয়া দেওয়া হইল। খলীফা এবং শাসন পরিচালকদের পক্ষে ইহা অবনত মস্তকে মানিয়া লওয়া ও ইয়াহুদীদের জিযিয়া প্রত্যাহার করা ভিন্ন গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু হাদীস বিজ্ঞানিগণ যখন দস্তাবেজখানা পাঠ করিলেন, দেখিলেন, উহাতে হযরত সায়াদ ইবনে মুয়াযের সাক্ষ্য উদ্ধৃত হইয়াছে। অথচ তিনি খায়বার যুদ্ধের পূর্বেই ইন্তেকাল করিয়াছেন।
দ্বিতীয়ত, এই দলীলের, লেখক হিসাবে মুয়াবিয়া ইবনে আবূ সূফিয়ানের নাম লিখিত রহিয়াছে, অথচ ইহা সর্বজনবিদিত যে, খায়বার যুদ্ধ পর্যন্ত মুয়াবিয়া ইসলামই কবুল করেন নাই।
তৃতীয়ত, উক্ত দলীলে যে সময়ের উল্লেখ করা হইয়াছে, তখন পর্যন্ত জিযিয়া সম্পর্কিত আল্লাহর ফরমান নাযিলই হয় নাই, নাযিল হইয়াছে তাহার অনেক পর। আর চতুর্থ, এই যে, যেসব ইয়াহুদী ইসলামের শক্রতা পরিহার করিয়া ইসলামের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে, এই দলীল হইতে কেবল তাহাদের জিযিয়া মাফ করাই প্রমাণিত হয়। কিন্তু ইসলামের শক্রতায় যাহারা জর্জরিত, তাহাদের জিযিয়া মাফ করার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না।
মুহাদ্দিসগণ এইসব যুক্তি অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে ঘোষণা করিলেন যে, এই দস্তাবেজখানি সম্পূর্ণ জাল। অতএব উহা প্রত্যাহারযোগ্য।
হাদীসের সমালোচনা-বিজ্ঞানের বাস্তব কার্যক্রম সম্পর্কে ইহা কয়েকটি দৃষ্টান্তমাত্র। এইরূপ সমালোচনা ও যাচাই পরীক্ষার কষ্টিপাথরে হাদীস বিজ্ঞানিগণ এক একটি হাদীসের সমালোচনা, যাচাই ও পরীক্ষা করিয়াছেন। আর এই বিরাট মহান কার্য সম্পাদন সম্ভব হইয়াছে কেবলমাত্র ‘আসমাউর-রিজাল’ শাস্ত্রের সাহায্যে। ইহার ভিত্তি কুরাআন মজীদের পূর্বোক্ত আয়াতের উপর স্থাপিত। সাহাবায়ে কিরাম ইহার পূর্ণ অনুসরণ করিয়াছেন। পরবর্তীকালে মুহাদ্দিসগণ এই মানদণ্ডের সাহায্যে সত্য ও মিথ্যা হাদীসের পার্থক্য করিয়াছেন।
হাদীস-সমালোচনা পর্যায়ে যাঁহারা কিছু না কিছু কাজ করিয়াছেন, তাঁহাদের নাম নিম্নে পর্যায়ক্রমে উল্লেক করা যাইতেছেঃ
সাহাবীদের পর্যায়েঃ ১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবাস (মৃঃ ৬৮ হিঃ), ২. উবাদাহ ইবনে সামিত (মৃঃ ৩৪ হিঃ), ৩. আনাম ইবনে মালিক (মৃঃ ৯৩ হিঃ)।
তাবেয়ীদের পর্যায়েঃ আমের শা’বী (মৃঃ ১০৪ হিঃ), ইবনে সিরীন (মৃঃ ১৬০ হিঃ), সায়ীদ ইবনে মুসাইয়্যিব (মৃঃ ৯৩ হিঃ)।
দ্বিতীয় শতকের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিগণ ইতেছেন, ইমাম শো’বা (মৃঃ১৬০ হিঃ), আনাস ইবনে মালিক (মৃঃ ১৭৯ হিঃ), মা’মর (মৃঃ ১৫৩ হিঃ), হিশাম আদাস্তাওয়ায়ী (মৃঃ ১৫৪ হিঃ), ইমাম আওযায়ী (মৃঃ ১৫৬ হিঃ), সুফিয়ান আস-সওরী (মৃঃ ১৬১ হিঃ) ইবনুল মাজেশূন (মৃঃ ১৬৩ হিঃ), হাম্মাদ ইবনে সালমা (মৃঃ ১৬৭ হিঃ), লাইস ইবনে সায়াদ (মৃঃ ১৭৫ হিঃ)।
তাঁহাদের পরবর্তী পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য হইতেছেনৎ আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (মৃঃ ১৮১ হিঃ), হুশাইম ইবনে বুশাইর (মৃঃ ১৮৮ হিঃ), আবূ ইসহাক আলফাজারী (মৃঃ ১৮৫ হিঃ), আল-মুয়াফী ইবনে ইমরান আল-মুসেলী (মৃঃ ১৮৫ হিঃ), বিশর ইবনুল মুফাযাযল (মৃঃ ১৯৬ হিঃ), ইবনে উয়াইনাহ (মৃঃ ১৯৭ হিঃ)। তাঁহাদের পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য হইতেছেঃ ইবনে আলীয়া (মৃঃ ১৯৩ হিঃ), ইবনে অহব (মৃঃ ১৯৭ হিঃ) ও অকীত ইবনে জাররাহ (মৃঃ১৯৭ হিঃ)।
এই যুগে দুইজন বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে। তাঁহারা হইতেছেনঃ ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতাব (মৃঃ ১৮৯ হিঃ) ও আবদুর রহমান ইবনে মাহদী (মৃঃ ১৯৮ হিঃ)।
তাঁহাদের পরের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হইতেছেনঃ ইয়াযীদ ইবনে হারূন (মৃঃ ২০৬ হিঃ), আবূ দাঊদ তায়ালিসী (মৃঃ ২০৪ হিঃ), আবদুর রাযযাক ইবনে হাম্মান (মৃঃ ২১১ হিঃ) ও আসেম নাবীল ইবনে মাখলাদ (মৃঃ ২১২ হিঃ)।
তাঁহাদের পরে উল্লেখযোগ্য হইতেছে সমালোচনা বিজ্ঞানের গ্রন্হকারগণ। এই পর্যায়ে প্রধান উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হইতেছেনঃ ইয়াইয়া ইবনে মুয়ীন (মৃঃ ২৩৩ হিঃ), আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে সায়াদ (মৃঃ ২৩০ হিঃ), আবূ খায়সামা যুবাইর ইবনে হারব (মৃঃ ২৩৪ হিঃ), আবূ জাফর আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ নবীল, আলী ইবনে মদীনী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ নুমাইর (মৃঃ ২৩৪ হিঃ), আবূ বকর ইবনে আবী শাইবা (মৃঃ ২৩৫ হিঃ), আবদুল্লাহ ইবনে আমর আল কাওয়ারীরী (মৃঃ ২৩৫ হিঃ), ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় ইমামে খুরাসান (মৃঃ ২৩৭ হিঃ), আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ আম্মার আলমুসেলী (মৃঃ ২৪২ হিঃ), আহমদ ইবনে সালেহ- হাফেজে মিসর (মৃঃ ২৪৮ হিঃ), হারূন ইবনে আবদুল্লাহ আল হাম্মাল (মৃঃ ২৪৩ হিঃ)।
তাঁহাদের পরে ইসহাক আল কাওসাজ (মৃঃ ২৫১ হিঃ), ইমাম দারেমী (মৃঃ ২৫৫ হিঃ), ইমাম বুখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ), হাফেজ আল-আজলী, ইমাম আবূ জুরয়া (মৃঃ ২৬৪ হিঃ), আবূ হাতেম (মৃঃ ২৭৭ হিঃ), ইমাম মুসলিম (মৃঃ ২৬১ হিঃ), আবূ দাঊদ সিজিস্তানী (মৃঃ ২৭৫ হিঃ), বাকী ইবনে মাখলাদ (মৃঃ ২৭৬ হিঃ), আবূ জুরয়া দেমাশকী (মৃঃ ২৮১ হিঃ)।
তাঁহাদের পরে উল্লেখযোগ্য আবদুর রহমান ইউসুফ আল বাগদাদী। তিনি হাদীস সমালোচনা পর্যায়ে একখানি গ্রন্হও রচনা করেন। ইবরাহীম ইবনে ইসহাক আল-হারবী (মৃঃ ২৮৫ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে অজ্জাহ (মৃঃ ২৮৯ হিঃ), হাফেজ কুরতবা আবূ বকর ইবনে আবূ আসেম (মৃঃ ২৮৭ হিঃ০ আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ (মৃঃ ২৯০ হিঃ), সালেহ জাজরা (মৃঃ ২৯৩ হিঃ), আবূ বকর আল বাযযার (মৃঃ ২৯২ হিঃ), মুহাম্মদ ইবনে নসর আল-মারওয়াযী (মৃঃ ২৯৪ হিঃ)-ও এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।
এইভাবে প্রত্যেক যুগেই বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের উদ্ভব হইয়াছে, যাঁহারা হাদীসের সমালোচনা করিয়া উহার যথার্থতা যাচাই করিয়াছেন। ফলে কোন সময়ই নিতান্ত জাল ও মিথ্যা হাদীস ‘হাদীস’ নামে পরিচিত হইতে ও প্রচারিত হইয়া হাদীসরূপে টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। সাহাবীদের যুগ হইতে অষ্টম হিজরী শতক পর্যন্ত এইরূপ অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে।
এই পর্যায়ে যেই সব গ্রন্হ রচিত হইয়াছে, তন্মধ্যে এইখানে কয়েকখানি উল্লেখযোগ্য গ্রন্হের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া যাইতেছেঃ
১. তাবকাতে ইবনে সায়াদ। ইহা বিরাটায়তন গ্রন্হ’ পনের খণ্ডে বিভক্ত ও সমাপ্ত।
২. ইমাম সুয়ূতী উক্ত গ্রন্হের সংক্ষিপ্তাসার রচনা করিয়াছেন। উহার নাম-
******************************************************
৩. ইমাম বুখারী রচিত তারীখে কবীর; তারীখে সগীর ও তারীখে আওসাত।
৪, ইবনুল মাদীনী লিখিত ইতিহাস দশ খণ্ডে সমাপ্ত।
৫. ইবনে হাব্বান রচিত ********************* দশ খণ্ডে সমাপ্ত।
৬. কিতাবুত তাকমীল- ইমাম ইবনে কাসীল রচিত। পূণ নামঃ
******************************************************
হাদীস বর্ণনার দুইটি পদ্ধতি
নবী করীম (স) ইতে হাদীস বর্ণনার দুইটি পদ্ধতি রহিয়াছে। নবী করীমের মুখ-নিসৃত কথা- যেভাবে যেসব শব্দ সহকারে তিনি কথাটি বলিয়াছেন, হুবহু সেইভাবে ও সেই সব শব্দ সহকারে বহু হাদীস বর্ণনা করা হইয়াছে। বর্ণনাকারী উহার ভাষা ও শব্দের কোনরূপ পরিবর্তন করেন নাই। এইরূপ বর্ণনাকে বলা হয় রেওয়ায়েত বিল- লাফজ- শাব্দিক বর্ণনা বা রাসূলের ব্যবহৃত শব্দ ও ভাষায় বর্ণনা করা।
আর রাসূলের মূল বক্তব্যকে নিজস্ব ভাষায় ব্যক্ত ও বর্ণনা করা হইলে এই পদ্ধতিকে বলা হয় রেওয়ায়েত বিল মা’না- ভাব বর্ণনা বা নিজের ভাষায় মূল কথাটি বলিয়া দেওয়া। কিন্তু ইহাতে জরুরী শর্ত এই যে, রাসূলের ব্যবহৃত শব্দ ও ভাষার পরিবর্তে যে শব্দ ও ভাষা ব্যবহৃত হইবে, তাহা অবশ্যই মূল ভাব ও অর্থের ধারক ও প্রকাশক হইতে হইবে। অর্থাৎ রাসূল যাহা বলিতৈ চাহিয়াছেন তাহাকে নিজস্ব ভাষায় এমনভাবে বলিতে হইবে যেন, তাহাতে মূল বক্তব্য যথাযথভাবে প্রকাশ করা হয়, শ্রোতার মনে যেন সেই ভাব ও অর্থই জাগ্রত হয়, যাহা জাগ্রত হইয়াছিল রাসূলের নিকট হইতে উহার প্রথম শ্রবণকারীদের মনে। ইহাতে কোন প্রকার পার্থক্য সৃষ্টি হইলে কিংবা মূল কথার কমবেশী হইয়া গেলে বর্ণনার দায়িত্ব সঠিকরূপে পালন হইতে পারে না।
এই শেষোক্ত পদ্ধতিতেও রাসূলের হাদীস বর্ণনা করা সম্পূর্ণ বিধিসম্মত। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে বর্তমান হাদীসসমূহের অধিকাংশই এই পদ্ধতিতে বর্ণিত। অর্থাৎ রাসূলের কথাটিকে নিজস্ব ভাষায় বর্ণনা করা হইয়াছে।
একজন সাহাবী নবী করীম ( স)-এর খেদমতে আরয করিলেন, ‘আমরা আপনার হাদীস শ্রবণ করি; কিন্তু উহাকে শব্দে বর্ণনা করার সামর্থ্য আমাদের হয় না। (এখন আমরা কি করিব?) নবী করীম (স) বলিলেনঃ ‘তোমরা যখন হালালকে হারাম ও হারামকে হালালে পরিণত কর না, বরং মূল কথাটিকেই নিজস্ব ভাষায় পৌঁছাইয়া দাও, তখন উহাতে কোনই দোষ নাই।[*********************]
হাদীস বর্ণনাকারীদের শ্রেণী বিভাগ
(গুণগত)
হাদীস বর্ণনাকারী লোক গুণগত দিক দিয়াচার শ্রেণীতে বিভক্ত। এই শ্রেণী-পার্থক্যের দৃষ্টিতেই তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের পর্যায় ও মর্যাদা নির্ণীত হইয়া থাকে।
প্রথম শ্রেণীর হাদীস বর্ণনাকারী তাঁহারা, যাঁহারা অত্যন্ত মুত্তাকী, শরীয়াতের পাবন্দ, তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তিসম্পন্ন, ইসলামের বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞাননে পারদর্শী, সূক্ষ্ম বুদ্ধিমান, সুবিবেচক, মুখস্থ করা হাদীসসমূহের পূর্ণ হেফাজতকারী এবং বিদয়াত-বিরোধী।
দ্বিতীয় শ্রেণীর বর্ণনাকারী তাঁহারা, যাঁহাদের গুণ সর্বদিক দিয়াই প্রথম শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের সমান। কিন্তু কেবল স্মরণশক্তির দিকদিয়া প্রথম শ্রেণী অপেক্ষা কম। এই পর্যায়ে দুই ধরনের লোক পাওয়া যায়। এক ধরনের লোক- যাঁহারা হাদীস লিখিয়া রাখিতেন, কেবলমাত্র স্মরণশক্তির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিলেন না। আর দ্বিতীয় ধরনের লোক- যাঁহারা হাদীস লিখিয়া রাখিতেন না। ফলে মূল হাদীসের কোন কোন শব্দ ভূলিয়া যাওয়ার কারণে বর্ণনা করার সময় উহার সম-অর্থবোধক শব্দ তদস্থলে ব্যবহার করিতেন।
তৃতীয় শ্রেণীর বর্ণনাকারী তাঁহারা, যাঁহারা শরীয়াতের অনুসরণকারী মুত্তাকী ছিলেন; জ্ঞান-বুদ্ধি, বোধশক্তি ও অন্তর্দৃষ্টির দিক দিয়া দ্বিতীয় শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের সমান নহেন। যাহা তাঁহাদের স্মরণে রক্ষিত আছে, কেবল তাহাই মূলধন; যাহা ভুলিয়া গিয়াছেন, সেদিকে তাঁহাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নাই। ভুলিয়া যাওয়ার অংশকে তাঁহারা কল্পনার সাহায্যে পুরণ করিয়া দিতেন।
চতুর্থ শ্রেণীর বর্ণনাকারী, যাঁহারা দ্বীন-ইসলামের অনুসরণকারী ও শরীয়াত পালনকারী বটে; কিন্তু বুদ্ধি-বিবেচনা ও দূরদৃষ্টির দিক দিয়া তাঁহারা পশ্চাৎপদ। লোকদিগকে নসীহত করা, পরকালীন শান্তির আশ্বাস এবং আযাবের ভয় প্রদর্শনের জন্য হাদীস রচনা করাকে তাঁহারা জায়েয মনে করিতেন। এই লোকদের আবার চারটি পর্যায় রহিয়াছে। প্রথম তাঁহারা, যাঁহারা বৈষয়িক মান-সম্মান লাভের উদ্দেশ্যে হাদীসসমূহের রদ-বদল কিংবা নূতন হাদীস রচনা করিতে দ্বিধাবোধ করিতেন না। দ্বিতীয়, তাঁহারা, যাঁহারা নিজেদের খুঁটিনাটি মাসলা সম্পর্কিত মতের সমর্থনে উস্তাদের নিজস্বভাবে প্রয়োগকৃত শব্দ হাদীসের মধ্যে শামিল করিয়া দিতেন। তৃতীয় তাঁহারা যাঁহারা বৃদ্ধি-বিবেচনা কম হওয়ার কারণে উস্তাদের উল্লিখিত ব্যাখ্যাদানকারী শব্দসমূহকে মূল হাদীসেরই অংশ মনে করিতেন। চতুর্থ হইতেছে ইসলামের সেইসব দুশনম লোক, যাহারা মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে দলাদলি, বিভেদ-বিচ্ছেদ ও কোন্দল সৃষ্টি এবং উহাতে ইন্ধন যোগাইবার অসদুদ্দেশ্যে হাদীস রচনা করিয়া প্রচার করিতে বিন্দুমাত্র ভয় পাইত না।[*********************]
হাদীস গ্রহণের শর্তাবলী
কোন ধরনের হাদীস গ্রহণ করা হইবে এবং কোন ধরনের হাদীস গ্রহণ করা যাইবে না, তাহা নির্ধারণ ও এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইলমে হাদীসের ইমামগণ বিভিন্ন শর্ত নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে, কেবলমাত্র সহীহ হাদীস ছাড়া অপর কিছুই গ্রহণ করা হইবে না, এই কথায় হাদীসের সকল ইমামই সম্পূর্ণ একমত ও দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু কি কি গুণে একটি হাদীস ‘সহীহ হাদীস’ নামে অভিহিত হইতে পারে, এই পর্যায়ে হাদীসের প্রত্যেক ইমাম নিজস্বভাবে চিন্তা ও গবেষণা পরিচালনা করিয়াছেন। তবে যেহেতু এই গবেষণা ও চর্চা এবং হাদীস-বিজ্ঞানের উন্নয়ন একই সময় ও সকল মুহাদ্দিসের একত্র উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয় নাই, বরং বিভিন্ন সময়ে হাদীস-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ-ধারার বিভিন্ন স্তরে ইহা অনুষ্ঠিত হইয়াছে, সেই কারণে ইহাতে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্প্রসারণ সূচিত হইয়াছে। ফলে বাহ্যদৃষ্টিতে ইহাতে কিছু মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হইতেছে। আমরা এখান বিভিন্ন ইমামের আরোপিত শর্তাবলীর উল্লেক করিতেছি।
ইমাম আজম (র)
ইমাম আজম আবূ হানীফা (র) হাদীসের ‘সহীহ’ হওয়ার জন্য যে শর্ত আরোপ করিয়াছেন, তাহা অপরাপর মুহাদ্দিসের আরোপিত শর্তের তুলনায় অত্যন্ত কঠিন বলিয়া মনে হয়। আর প্রকৃতপক্ষে তিনি এই দিক দিয়া বড়ই কঠোর প্রকৃতির লোক ছিলেন। ইমাম বুখারীর উস্তাদ শেখ অকী বলেনঃ ইমাম আজমের ন্যায় কঠিন শর্ত সাধারণভাবে আরোপিত হইলে সহীহ হাদীসের সংখ্যা হ্রাস পাইয়া যাওয়ার আশংকা রহিয়াছে।[*********************]
ইমাম আবূ হানীফার শর্তাবলী নিম্নরূপঃ
১. হাদীস বর্ণনাকারীকে অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের অন্তভূক্ত হইতে হইবে।
২. হাদীসের বর্ণনা শাব্দিক- রাসূলের ব্যবহৃত শব্দসমূহ হুবহু উল্লেখ সহকারে (*********************) হইতে হইবে। মূল হাদীসের অর্থ বা নিজস্ব ভাষায় বর্ণনা করিলে (*********************) তাহা গ্রহণ করা যাইবে না।
৩. হাদীস-দরসের বৈঠকে নিয়োজিত উচ্চ ঘোষণাকারীর (*********************) মুখে হাদীস শ্রবণ করিয়া থাকিলে এই শ্রবণকারিগণ পরবর্তীদের নিকট ********************* (অমুকে আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন) বলিয়া হাদীস বর্ণনা করিতে পারিবেন না। (করিলে সে হাদীস গ্রাহ্য হইবে না।)
৪. যেসবমুহাদ্দিসদেরনিকটলিখিতভাবেহাদীস-সম্পদসুরক্ষিতরহিয়াছে, হাদীসেরপ্রতিটিশব্দযদিতাঁহাদেরস্মরণেথাকে, তবেতাঁহাদেরমৌখিকবর্ণনাকবুলকরাযাইবে। অন্যথায়উক্তলিখিতহাদীসসম্মুখেরাখিয়াইহাদীসবর্ণনাকরিতেহইবে। (এইরূপনাকরিয়াথাকিলেসেহাদীসগ্রহণযোগ্যহইতেপারেনা)।
৫. এইসময়পর্যন্তযেসবহাদীসের (*********************) অর্থ ও ভাব বর্ণিত হইয়াছে, শব্দগতভাবে বর্ণিত হয় নাই, তবে উহাদের বর্ণনাকারী যদি ফিকাহ-পারদর্শী হন অন্তত বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী ও সুবিবেচক এবং ‘দিরায়তের’ দৃষ্টিতেও যদি তাঁহার বর্ণিত কথা নির্ভূল হয়, তবে তাহা ‘সহীহ হাদীস’ রূপে কবুল করা যাইবে।
৬. নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ কারবার, লেন-দেন ও ইবাদত সম্পর্কে যদি কোন ‘খবরে-ওয়াহিদ’ বর্ণিত হয়, তবে উহার সমর্থনে ও অনুকুলে সাক্ষী হিসাবে অপর বর্ণনা সূত্র বা সনদ পেশ করিতে হইবে। গ্রহণযোগ্য ‘সাক্ষী’ না পাওয়া গেলে অন্তত দিরায়াতের বিচারে মূল হাদীসটিকে অবশ্যই বিশুদ্ধ ও সহীহ হইতে হইবে।
সিহাহ-সিত্তাহ সংকলকদের শর্তাবলী
‘সিহাহ-সিত্তাহ’ গ্রন্হাবলী সংকলকগণও হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে নিজস্বভাবে বহু জরুরী শর্ত আরোপ করিয়াছেন। এখানে প্রত্যেকের আরোপিত শর্তাবলী স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা যাইতেছে।
ইমাম বুখারী (র)
১. হাদীসের বর্ণনাসূত্রের পরস্পরা (*********************) ধারাবাহিক, সংযুক্ত ও অবিচ্ছিন্ন (*********************) হইবে। হাকেম আবূ আবদুল্লাহ নিশাপুরূ (র) লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
প্রথম শ্রেণীর সহীহ হাদীস সেইটি, যাহাকে প্রখ্যাত সাহাবী রাসূলে করীমের নিকট হইতে বর্ণনা করিবেন এবং সেই হাদীসের অন্তত আরো দুইজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থাকিবেন। অতঃপর সেই সাহাবীর নিকট হইতে এমন একজন তাবেয়ী উহার বর্ণনা করিবেন, যিনি সাধারণত সাহাবীর নিকট হইতেই হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে প্রখ্যাত এবং এই পর্যায়েরও উহার উপর দুইজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী থাকিবেন। তাহার পর এমন তাবে-তাবেয়ীন উহার বর্ণনা করিবেন, যাঁহারা হাদীসের হাফেজ ও অতিশয় সতর্ক। এক পর্যায়ে বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য। তাহার পর হইবেন ইমাম বুখারীর উস্তাদ- হাদীসের হাফেজ ও হাদীস বর্ণনায় বিশ্বস্ততা রক্ষা করার দিক দিয়া প্রখ্যাত।[*********************]
২. হাদীসের বর্ণনাকারীকে তাহার উস্তাদদের সাহচর্যে অধিক দিন বসবাসকারী হইতে হইবে।
৩. বর্ণনাকরীকে প্রথম শ্রেণীর বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য, প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হইতে হইবে।
৪. যিনি যাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিবেন, তাঁহাদের পরস্পরের সহিত বাস্তব সাক্ষাৎ প্রমাণিত হইতে হইবে।
ইমাম মুসলিম (র)
শায়খ আবূ আমর ইবনুস সালাহ লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম মুসলিম তাঁহার সহীহ গ্রন্হে হাদীস গ্রহণের জন্য এই শর্ত করিয়াছেন যে, হাদীসের সনদসূত্র অবশ্যই ‘মুত্তাসিল’ পরস্পর সংযুক্ত ও অবিচ্ছিন্ন হইবে, একজন ‘সিকাহ’ ব্যক্তি অপর ‘সিকাহ’’ ব্যক্তির নিকট হইতে বর্ণনা করিবেন, প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত এই অবস্থাই হইবে এবং উহা ‘শায’ (*********************) ও ‘ইল্লাত’ (*********************) হইতে বিমুক্ত হইবে।
২. হাদীস যিনি যাঁহার নিকট হইতে বর্ণনা করিবেন, তাঁহাদের উভয়ের একই যুগের ও একই সময়ের লোক হইতে হইবে।
৩. হাদীসের কোন বর্ণনাকারীই ‘মজহুল’ (*********************) অজ্ঞাত পরিচয় হইবেন না। তাহাদের সর্বজন পরিচিত হইতে হইবে।
৪. মূল হাদীসে কোন দোষক্রটির অস্তিত্ব থাকিবে না।
হাদীস গ্রহণের শর্তে ইমাম বুখারী ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য রহিয়াছে। এই কারণে বহু হাদীস ইমাম বুখারীর নিকট সহীহ কিন্তু ইমাম মুসলিমের নিকট সহীহ নয় বরং ইহার বিপরীত। এই কারণে যাঁহাদের নিকট হইতে ইমাম বুখারী হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন, কন্তু ইমাম মুসলিম গ্রহণ করেন নাই, আর ইমাম মুসলিম গ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু ইমাম বুখারী গ্রহণ করেন নাই- এমন শায়খ বা হাদীসের উস্তাদদের সংখ্যা ৬২৫ জন।[]
ইমাম নাসায়ী ও ইমাম আবূ দাঊদ (র)
১. সহীহ হাদীসের প্রধান দুইখানি গ্রন্হ বুখারী ও মুসলিম শরীফে যেসব হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে সেসব সনদসূত্রে; তাহা সবই এই ইমামদ্বয়ের নিকট অবশ্যই গ্রহণযোগ্য।
২. প্রধান হাদীস-গ্রন্হদ্বয়ে হাদীস গ্রহণের যে শর্ত অনুসৃত হইয়াছে তাহাতে উত্তীর্ণ সকল হাদীসই গ্রহণযোগ্য।
৩. যেসব হাদীস সর্ববাদী সম্মতভাবে ও মুহাদ্দিসীনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে পরিত্যক্ত হয় নাই ও যে সবের সনদ ‘মুত্তাসিল’- ধারাবাহিক বর্ণনা পরম্পরাসূত্রে কোন বর্ণনাকারীই উহ্য নহে, তাহা অবশ্যই গ্রহণ করা হইবে। মূল হাদীস সহীহ হইলে এবং ‘মুরসাল’ (*********************) কিংবা ‘মুনকাতা’ (*********************) না হইলে তাহাও গ্রহণযোগ্য।
৪. চতুর্থ পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের মধ্যে উত্তম বর্ণনাকারী হইতে বর্ণিত হাদীও গ্রহণযোগ্য।
৫. প্রকৃত সহীহ হাদীসের সমর্থন পাওয়া গেলে ইমাম আবূ দাঊদ এমন হাদীসও গ্রহণ করেন, যাহার বর্ণনাকারী যঈফ, দুর্বল ও অজ্ঞাতনামা।
এইসব শর্ত ইমাম নাসায়ী ও ইমাম আবূ দাঊদের নিকট সমভাবে গৃহীত। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে ইমাম নাসায়ীর আরোপিত শর্ত ইমাম আবূ দাঊদ অপেক্ষা অধিক উন্নত এবং কড়া। ইমাম নাসায়ী হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছেন। তাঁহাদের অবস্থা সম্পর্কে অধিকতর খোঁজ-খবর লওয়ার প্রয়োজন মনে করিয়াছেন। এই কারণেই ইমাম নাসায়ী এমন অনেক বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেন নাই, যাঁহাদের নিকট হইতে ইমাম আবূ দাঊদ ও ইমাম তিরমিযী হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন। হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী (র) এই সম্পর্কে বলিয়াছেন, তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসও গ্রহণযোগ্য।
******************************************************
এমন অনেক বর্ণনাকারীই আছেন, যাঁহাদের নিকট হইতে ইমাম আবূ দাঊদ ও তিরমিযী হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু ইমাম নাসায়ী তাঁহাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ হইতে বিরত রহিয়াছেন। বরং বুখারীও মুসলিম শরীফে যাঁহাদের হাদীস গৃহীত হইয়াছে এমন এক বিরাট সংখ্যক বর্ণনাকারীরও হাদীস গ্রহণ করিতে ইমাম নাসায়ী প্রস্তুত হন নাই।[*********************]
ইমাম তিরমিযী (র)
১. প্রথম দুইখানি সহীহ গ্রন্হ বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত সমস্ত হাদীসই গ্রহণযোগ্য।
২. প্রধানত মুহাদ্দিস ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের আরোপিত শর্তে আর যেসব হাদীসই উত্তীর্ণ ও সহীহ প্রমাণিত হইবে তাহা গ্রহণীয়।
৩. ইমাম আবূ দাঊদ ও ইমাম নাসায়ী যেসব হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন ও উহাদের দোষ-ক্রটি দূর করিয়া দিয়াছেন, তাহাও গ্রহণীয়।
৪. ফিকাহবিদগণ যেসব হাদীস অনুযায়ী আমল করিয়াছেন, তাহাও গ্রহণীয়।
৫. যেসব হাদীসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হইবে এমন এক নির্দেশ, যাহা সব সময়ই কার্যকর হইয়াছে, তাহা ও গ্রহণীয়।
৬. যেসব সিকাহ বর্ণনাকারীর সমালোচনা করা হইয়াছে এবং তাঁহাদের সম্পর্কে সবকিছু সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হইয়াছে, তাঁহাদের হাদীসসমূহও গ্রহণীয়।
৭. যেসব বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসসমূহের সমালোচনা করা হইয়াছে এবং তাঁহাদের বিশ্বস্ততাও প্রমাণিত হইয়াছে তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসও গ্রহণযোগ্য।
ইমাম ইবনে মাজাহ (র)
১. প্রথমোক্ত পাঁচজন মুহাদ্দিস যেসব হাদীস গ্রহণ করিয়াছেন তাহা তাঁহার নিকটও গ্রহণীয়।
২. পূর্বোক্ত পাঁচজনের আরোপিত শর্তে অন্যান্য যেসব হাদীস উত্তীর্ণ হইতে পারে তাহাও গ্রহণীয়।
৩. বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আলেমগণ যেসব হাদীস অনুযায়ী আমল করেন তাহাও গ্রহণযোগ্য।
৪. চতুর্থ পর্যায়ের উত্তম বর্ণনাকারীদের বর্ণিত সেইসব হাদীসও গ্রহণীয়, যাহা যাচাই ও পরীক্ষা করার পর সহীহ প্রমাণিত হইয়াছে।
বস্তুত ইলমে হাদীসের ইমামগণের আরোপিত শর্তসমূহ ও হাদীস সমালোচনার পদ্ধতির গুরুত্ব এবং যথার্থতা ইসলামের দুশমনগণও স্বীকার করিতে বাধ্য।[*********************]
দিরায়াত বা মূল হাদীস যাচাই করার পন্হা
কেবলমাত্র সনদের দিক দিয়া হাদীসের যাচাই, ওজন ও পরীক্ষা করার নিয়ম পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাসমূহে আলোচিত হইয়াছে। ইহার দ্বিতীয় কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য পন্হা হইতেছে মূল হাদীসের (*********************)- যথার্থতা যাচাই করা। হাদীস-বিজ্ঞানের পরিভাষায় ইহাকে বলা হয় ‘দিরায়ত’। এই প্রকিয়ার বিভিন্ন দিক রহিয়াছে। তবে ইহার সারকথা এই যে, ইহাতে হাদীস বর্ণনাকারীদের সমালোচনা ও যাচাই না করিয়া মূল হাদীসটিকে যুক্তিবাদের কষ্টিপাথরে ওজন করিয়া দেখা হয়। ‘রওয়ায়েত’ বা সনদ যাচাই করার প্রক্রিয়া কেবলমাত্র হাদীস বর্ণনাকারীদের ব্যক্তিগত গুণ-চরিত্র ও পারস্পরিক সম্পর্ক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু হাদীসের মর্মকথায় কোন ভূল, অসত্য, অবস্তবতাএবং কুরআন ও সহীহ হাদীসের পরিপন্হী কিছু থাকিলে এই পন্হার যাচাই-পরীক্ষায় তাহা ধরা পড়িতে পারে না। অতএব কেবলমাত্র এই পদ্ধতিতে যাচাই করিয়া কোন হাদীস উত্তীর্ণ পাইলেই তাহা গ্রহণ করা যাইতে পারে না। এই কারণে মূল হাদীস (*********************)- হাদীসের মর্মবাণীটুকু তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিবেচনার মানদন্ডে যাচাই করার উদ্দেশ্যে এই ‘দিরায়াত’ প্রক্রিয়ার প্র য়োগ করা হইয়া থাকে। হাদীস যাচাই-পরীক্ষার ব্যাপারে ‘দিরায়াত’ নীতির প্রয়োগ ‘রওয়ায়েত’ নীতির মতই কুরআন ও হাদীস সম্মত। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই কেবলমাত্র ‘রওয়ায়েতের’ উপর নির্ভরশীল কোন ‘কথা’ গ্রহণ বা বর্জনের সিদ্ধান্ন করিতে নিষেধ করিয়াছেন।
হযরত আয়েশা (রা) সম্পর্কে মদীনার মুনাফিকগণ দুর্নাম রটাইয়া দিলে কিছুসংখ্যক মুসলমানও তাহাতে প্রভাবান্বিত হইয়া পড়েন। তখন আল্লাহ তা’আলা তাহাদের সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেনঃ
******************************************************
তোমরা যখন সে কথা শুনিতে পাইয়াছিলে, তখন তোমরা (শুনিয়াই) কেন বলিলে না যে, এই ধরনের কথা বলা আমাদের কিছুতেই উচিত নহে। তখন বলা উচিত ছিল যে, আল্লাহ পবিত্র মহান, ইহা এক সুস্পষ্ট মিথ্যা কথা ও বিরাট দোষারোপ ছাড়া আর কিছুই নহে। (ইহা সত্য হওয়া কিছুতেই সম্ভবপর নহে)।[*********************]
অর্থাৎ মূল সংবাদটি শ্রবণমাত্রই একথা মনে করা উচিত ছিল যে, ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। অতএব তখনই ইহার প্রচার ও প্রসার বন্ধ করিয়া দেওয়া কর্তব্য ছিল। এই ‘দোষারোপ’ শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গেই উহাকে মিথ্যা বলিয়া বাতিল করার এই খোদায়ী তাগীদ ‘দিরায়াত’ প্রয়োগেরই নির্দেশ।
বস্তুত হাদীস যাচাইয়ের ব্যাপারে দিরায়াত রীতি এক সর্বোন্নত ও সর্বাধিক তীক্ষ্ণ শাণিত হাতিয়ার। এই পর্যায়ে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি রাখা হয়ঃ
১. যে ঘটনা শত-সহস্র লোকের সম্মুখে সংঘটিত হইয়াছে- যে ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময়ই বিপুল সংখ্যক লোকের গোচরীভূত না হইয়া পারে না, সেই ঘটনা কিংবা অনুরূপ কোন ঘটনার কথা যদি মাত্র একজন বর্ণনাকারী কর্তৃক বর্ণিত হইয়া থাকে, তবে উহার সত্যতা সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের উদ্রেক হইবে। এইরূপ ঘটনা বহু সংখ্যক সাহাবী হইতে বর্ণিত না হইলে এই একজন ব্যক্তির বর্ণনাকে কিছুতেই ‘সহীহ হাদীস’ মনে করা ও নিঃশংকচিত্তে উহাকে গ্রহণ করা যাইতে পারে না।
২. যে ঘটনা এমন লোকদের হইতে বর্ণিত হইয়াছে, যাঁহাদের মূল ঘটনা বা উহার ক্ষেত্রের সহিত সাক্ষাৎ সম্পর্কে থাকার কোন কারণ নাই কিংবা তাহা অসম্ভব, এইরূপ বর্ণনার সমর্থন যদি মূল ঘটনা ও ঘটনাস্থলের সহিত নিকট-সম্পর্কশীল লোকদের বর্ণনা হইতে না পাওয়া যায় অথবা তাহাদের হইতে যদি উহার বিপরীত বর্ণনা পাওয়া যায়, তাহা ইলে প্রথমোক্ত বর্ণনাকারীদের বর্ণিত হাদীস ‘সহীহ হাদীস’ রূপে গ্রহণ করা যাইবে না। তাহাদের পরিবর্তে মূল ঘটনার সহিত নিকটতর সম্পর্কশীল লোকদের বর্ণিত হাদীসই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে। যেমন নবী করীম (স)-এর দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে যদি কোন হাদীস প্রথমত এমন লোক হইতে বর্ণিত হয়, যে লোক কোন দিক দিয়াই হযরতের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয় কিংবা কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট শ্রবণও করে নাই, তবে তাহার বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। কিন্তু এইরূপ হাদীস যদি রাসূলের এই জীবনাংশের সহিত কোন না কোন দিক দিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির- যেমন রাসূলের কোন স্ত্রী কিংবা নিকটাত্মীয়ের- তরফ হইতে বর্ণিত হয় অথবা এই ধরনের কোন ব্যক্তির নিকট হইতে শ্রবণ করিয়া বর্ণনা করা হয়, তবে তাহা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে।
৩. যে হাদীসের বর্ণনাকারী হাদীসের ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তাঁহার বর্ণিত হাদীস অন্য ধরনের হাদীসের ব্যবহারিক মূল্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নহেন এমন বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীসের তুলনায় অধিক গ্রহণযোগ্য। এমনকি, কাহারো কাহারো মতে ফকীহ তাবেয়ী যদি সাহাবীর নাম উল্লেখ না করিয়াই রাসূল হইতে সরাসরি হাদীস বর্ণনা করেন, তবে তাহাও উপরোক্ত নীতি অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য হইবে। সাহাবীদের যুগে হাদীস যাচাই করার এই দিরায়াত পদ্ধতির নিয়ম-কানুন বিস্তারিতরূপে রচিত হয় নাই। তবে সে যুগে এই প্রকিয়ার দৃষ্টিতে হাদীস যাচাইয়ের কয়েকটি দৃষ্টান্ত পশ করা যাইতেছেঃ
১। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কৃর্তক বর্ণিত হাদীসঃ
******************************************************
আমি রাসূল (স)-কে বলিতে শুনিয়াছি, আগুনে উত্তপ্ত জিনিস গ্রহণ করার পর (নামায পড়ার জন্য) অযু কর।
এই হাদীস শুনিয়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলিয়া উঠিলেনঃ ‘তবে তো অযু থাকা-অবস্থায় গরম পানি ব্যবহার করিলেও আবার অযু করিতে হইবে?[তিরমিযী- কিতাবুত তাহারাত] অন্য কথায় ‘দিরায়াত’ প্রক্রিয়ায় এই হাদীস সহীহ বলে প্রতিপন্ন হয় না।
২। অপর এক হাদীসে উল্লিখিত হইয়াছেঃ
******************************************************
জুময়ার দিন এমন একটি মুহূর্ত আছে, যখন কোন মুসলিম যদি নামায পড়িতে থাকা অবস্থায় আল্লাহর নিকট কোন কল্যাণের প্রার্থনা করে, তবে আল্লাহ তাহাকে তাহা বিশেষভাবে দান করেন।
এই চরম মুহূর্তটি যে ঠিক কখন, তাহা নিশ্চিতরূপে জানিবার জন্য সাহাবায়ে কিরাম বিশেষ আগ্রহান্বিত হন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা) জানিতে পারিলেন যে, জুমুয়ার দিনের শেষ মুহূর্তেই এই চরম সময়টি অবস্থিত। কিন্তু হযরত আবূ হুরায়রা (রা) ইহা শুনিয়া বলিলেনঃ ‘তাহা কিরূপে হইতে পারে? রাসূল তো বলিয়াছেনঃ নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় যদি কেহ আল্লাহর নিকট দোয়া করে তবে তাহা তিনি মঞ্জুর করিবেন। কিন্তু দিনের শেষ মুহূর্তে তো কোন নামায পড়া জায়েয নহে। কাজেই এই হাদীস হইতে এইরূপ সময় নির্ধারণ যুক্তিসঙ্গত নহে।[আবূ দাউদ-কিতাবুস সালাত]
প্রথমোক্ত হাদীসে মূল কথায় যথার্থতা ‘দিরায়াত’- এর ভিত্তিতে যাচাই করা হইয়াছে, আর দ্বিতীয় হাদীসে হাদীসের বিশেষ ব্যাখ্যার যাচাই করা হইয়াছে।
‘দিরায়াত’-এর ভিত্তিতে হাদীস যাচাই করার কাজে হযরত আয়েশার বিশেষ দক্ষতা ও প্রতিভা ছিল। তিনি ইহার ভিত্তিতে কতকগুলি হাদীস সম্পর্কে আপত্তি তুলিয়াছেন এবং তাঁহার আপত্তির ভিত্তিতে দিরায়াতের কতকগুলি মূলনীতি নির্ধারণ করা সম্ভব হইয়াছে। যেমন-
১. তাঁহার সম্মুখে যখন রাসূলের কথা বলিয়া নিম্নোক্ত বাক্য উল্লেখ করা হইলঃ
******************************************************
মৃত ব্যক্তির জন্য তাহার পরিবাবর্গেল কান্নাকাটির কারণে তাহাকে আযাব দেওয়া হইবে।
তখন তিনি বলিলেনঃ ইহা সত্য বলিয়া স্বীকার করা যায় না। কেননা কুরআন মজীদ সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেঃ
******************************************************
কোন লোকই অপর কাহারো গুনাহর বোঝা বহন করিবে না।
ইহা হইতে দিরায়াতের দৃষ্টিতে হাদীস যাচাই করার এই মূলনীতি প্রমাণিত হইল যে, কুরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণার বিপরীত কোন হাদীস গ্রহণ করা যাইতে পারে না।[*********************]
২. সাহাবীদের যুগে জনসাধারণের মধ্যে এই হাদীস প্রচারিত হইয়া পড়ে যে, মি’রাজের রাত্রে নবী করীম (স) আল্লাহর প্রত্যক্ষ সাক্ষাত লাভ করিয়াছেন। হযরত আয়েশা (রা) ইহা শুনিয়া বলিলেনঃ এই হাদীসের বর্ণনাকারী সুস্পষ্ট মিথ্যাবাদী। কেননা কুরআন মজীদ স্পষ্ট বলিয়াছেঃ
******************************************************
কোন সৃষ্টি আল্লাহকে আয়ত্ত করিতে পারে না, তিনিই সমস্ত সৃষ্টি আয়ত্ত করিয়া থাকেন।
পূর্বের বিস্তারিত আলোচনা হইতে দিরায়াত প্রক্রিয়ার যে কয়টি মূলনীতি প্রকাশিত হয়, তাহা এখানে একত্রে উল্লেখ করা যাইতেছেঃ
১। হাদীস কুরআনের সুস্পষ্ট দলীলের বিপরীত হইবে না।
২। হাদীস মুতাওয়াতির সূত্রে প্রমাণিত সুন্নাতের বিপরীত হইবে না।
৩। হাদীস সাহাবায়ে কিরামের সুস্পষ্ট ও অকাট্য ইজামার বিপরীত হইবে না।
৪। হাদীস সুস্পষ্ট বিবেক-বুদ্ধির বিপরীত হইবে না।
৫। হাদীস শরীয়াতের চির সমর্থিত ও সর্ব-সম্মত নীতির বিপরীত হইবে না।
৬। কোন হাদীস বিশুদ্ধ ও নির্ভূলভাবে গৃহীত হাদীসের বিপরীত হইবে না।
৭। হাদীসের ভাষা আরবী ভাষায় রীতি-নীতির বিপরীত হইবে না। কেননা নবী করীম (স) কোন কথাই আরবী রীতি-নীতির বিপরীত ভাষায় বলেন নাই।
৮। হাদীস এমন কো অর্থ প্রকাশ করিবে না, যাহা অত্যন্ত হাস্যকর, নবীর মর্যাদা বিনষ্টকারী।
উসূলে হাদীস-এর গ্রন্হসমূহে এই পর্যায়ে আরো অনেক মূলনীতির উল্লেখ করা হইয়াছে।
হাদীস যাচাই করা এবং সহীহ কি গায়বে সহীহ পরখ করার জন্য উপরে বর্ণিত দুইটি পন্হা- ‘রেওয়ায়াত’ ও ‘দিরায়াত’- প্রয়োগ করার ব্যাপারে হাদীস-বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে। এক শ্রেণীর লোক কেবলমাত্র রেওয়ায়াত- প্রক্রিয়া বা সনদ যাচাইর উপর গুরুত্ব আরোপ করিয়া থাকেন। তাঁহাদের দৃষ্টিতে সনদ ঠিক থাকিলেই এবং উহার ধারাবাহিকতা ও সুস্থাতা-বিশুদ্ধতা যথাযথভাবে রক্ষিত হইলেই হাদীস নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য হইতে পারে। আরি অপরদের মতে সনদ ঠিক হওয়ার তুলনায় মূল হাদীসটি যুক্তিসংগত হওয়া-দিরায়াত-প্রক্রিয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এই দিক দিয়া কোন হাদীস সঠিকরূপে উত্তীর্ণ না হইলে তাহা গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। এমনকি সনদ ঠিক হইলেও এবং সনদ বিচারে তাহা গ্রহণযোগ্য প্রমাণিত হইলেও তাহা গ্রহণ করা যাইতে পারে না।
কিন্তু প্রকৃত মুহাক্কিক আলিমের দৃষ্টিতে এককভাবে এই দুইটি পন্হাই ভারসাম্যহীন। উহার একটি একান্তভাবে সনদ নির্ভর, সনদ ছাড়া সেখানে আর কিছুই বিচার্য নহে। আর সনদ ঠিক ও নির্ভরযোগ্য হইলেও সে হাদীস একান্তই গ্রহণীয়। দ্বিতীয়টি নিরংকুশভাবে বুদ্ধিভিত্তিক। সাধারণ বুদ্ধি ও যুক্তির দৃষ্টিতে মূল হাদীসটি গ্রহণযোগ্য হইলে উহার সনদ বিচারের কোন প্রয়োজনই মনে হয় না। অথচ প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র সনদ কোন কথাকে সত্য ও সঠিক প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট হইতে পারে না, যেমন যথেষ্ট নয় কেবলমাত্র বুদ্ধি ও যক্তি-বিচার! এই কারণে এই দুইটি প্রক্রিয়ার মাঝে পূর্ণ সামঞ্জস্য স্থাপন ও ভারাসাম্য রক্ষা করা অপরিহার্য।
হাদীস সমালোচনার সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি
হাদীস যাচাই করার সামঞ্জস্যপূর্ণ পন্হা কি হইতে পারে, তাহা বাস্তবিকই গবেষণা সাপেক্ষ। এই সম্পর্কে সুচিন্তিত অভিমত এই যে, প্রথমে সনদ যাচাই করিতে হইবে এবং তাহার হাদীমের মূল বাণী ********************* টুকু পরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে। সনদ যদি ঠিক হয় এবং মূল হাদীসটুকুও ‘দিরায়াতে’র মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়, তবে সেই হাদীস সর্বতোভাবে গ্রহণযোগ্য।
তবে অনেক হাদীস এমন রহিয়াছে যাহার সনদ নির্ভূল, আর মূল হাদীসের কথাটুকু সাধারণ বুদ্ধির অগম্য, এই ক্ষেত্রে দেখিবার ও বিবেচনার বিষয় শুধু এতটুকু যে, উহা কুরআনের খেলাফ নয় তো; কুরআন যাহা হালাল করিয়াছে, হাদীস তাহা হারাম কিংবা ইহার বিপরীত কিছু প্রমাণ করিতেছে না তো। কেননা সকলেই জানেন, মি’রাজ সম্পর্কীয় হাদীস ২৫ জন সাহাবী ও তিনশত তাবেয়ী হইতে বর্ণিত হইয়াছে, অথচ ইহা সাধারণ বুদ্ধির পক্ষে দূরধিগম্য। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও ইহা অবশ্যই সত্য ও বিশুদ্ধ হাদীসরূপে গ্রহণীয়। কেননা ইহা যেমন অসম্ভব ব্যাপার কিছু নয়, তেমনি কুরআনের সহিত পূর্ণ সামঞ্জস্যসম্পন্নও। ইহা কুরআনের অস্পষ্ট বা মোটামুটিভাবে উল্লিখিত বিষয়ের ব্যাখ্যা।
অনুরূপভাবে হাদীসসমূহের শব্দ ও ভাষা যাচাই করিয়াও নিশ্চিতরূপে বুঝিতে পারা যায় যে, উহা প্রকৃতই রাসুলে করীমের কথা কিনা। কোন হাদীসে রাসূলের যুগে অব্যবহৃত কোন পরিভাষার উল্লেখ থাকিলে তাহা রাসূলের হাদীস হইতে পারে না। যথাঃ
ক) হাদীসের কিাতবে উদ্ধৃতি পাওয়া যায়ঃ
******************************************************
কাদরীয়া পন্হীরা এই উম্মতের অগ্নিপূজক এবং রাফেযীরা এই উম্মতের ইয়াহুদী।
ইহার ভাষা ও শব্দসমূহ স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, ইহা কিছুতেই রাসূলের কথা হইতে পারে না। দ্বিতীয়ত ‘আল-কাদারী’ ও ‘রাফেযী’ ইত্যাদি শব্দ বিশেষ পরিভাষার পরিচয় বহন করে। আর এই ভাষা রাসূলে করীমের যুগে আদৌ প্রচলিত ছিল না বলিয়া রাসূল কর্তৃক ইহার প্রয়োগ হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না।
খ) নিম্নোক্ত কথাটিও ‘হাদীস’ নামে কথিতঃ
******************************************************
যে লোক ‘কুরআন মখলুক’ মনে করে সে কাফির।
কুরআন ‘মখলূক’ কি মখলুক নয়’- ইহা লইয়া আব্বাসীয় যুগে তদানীন্তন মনীষীদের মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। রাসূলে করীমের যুগে এই ধরনের কথা ধারণা পর্যন্ত করা যায় নাই। কাজেই এই ধরনের কথা কখনো রাসূলের মুখ হইতে নিঃসৃত হইয়াছে বলিয়া বিশ্বাষ করা যাইতে পারে না।
হাদীস যাচাই পর্যায়ে ‘দিরায়াত’ রীতি প্রয়োগ সম্পর্কে আল্লামা ইবনে জাওযী মুহাদ্দিসের যে নীতি ও পদ্ধতির উল্লেখ করিয়াছেন তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ
******************************************************
যেসব হাদীস সাধারণ বুদ্ধির বিপরীত পাইবে কিংবা সাধারণ মূলনীতির উল্টা দেখিবে, মনে করিবে যে, তাহা মওজু বা মনগড়া হাদীস। অতঃপর উহার বর্ণনাকারীদের যাচাই-পরখ করার কোন প্রয়োজন করে না। অনুরূপভাবে সেইসব হাদীসও মওজু যাহা সাধারণ অনুভূতি ও পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে বাতিল প্রমাণিত হইয়াছে। যাহা কুরআন, মুতাওয়াতির হাদীস ও অকাট্য ইজমার খেলাফ এবং যাহার কোন ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, তাহাও মওজু অথবা যেসব হাদীসে সাধারণ ও গুরুত্বহীন কথার উপর কঠোর আযাবের ভীতি প্রদর্শন করা হয়; কিংবা সামান্য কাজের ফলে বিরাট পুরস্কার দানের ওয়াদার উল্লেখ হয়, তাহাও মওজু- এই ধরনের হাদীস সাধারণত ওয়ায়েজ ও সুফীদের বর্ণনাসনূত্রে পাওয়া যায়।[*********************]
এতদ্ব্যতীত মনস্তাত্ত্বিক তুলাদণ্ডেও হাদীস যাচাই করার প্রয়োজন রহিয়াছে। যে ব্যক্তি রাসূলের হাদীস ব্যাপক ও নিরবচ্ছিন্নভাবে অধ্যায়ন করিবে, চর্চা করিবে, গভীর সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে উহা লইয়া গবেষণা করিবে, তাহার অন্তর্লোকে এক তীব্র স্বচ্ছ আলোকচ্ছটা প্রস্ফূটিতে হইয়া উঠিবে। সে সহজেই বুঝিতে পারিবে কোনটি প্রকৃতই রাসূলের হাদীস, কোনটি নয়; রাসূল কোন ধরনের কথা বলিতে পারেন, কোন ধরনের কাজ নয়, কি ধরনের কথা বা কাজ তাঁহার সমর্থিত হইতে পারে, আর কোন ধরনের নয়।…………….. তাহা উপলীব্ধি করা তাহার পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন হইবে না।[*********************]
এই পর্যায়ে চূড়ান্ত অভিমত এই যে, হাদীসের গ্রহণীয় হওয়া না হওয়া সম্পর্কে শেষ ফয়সালা সনদ ও মূল হাদীস (মতন) উভয়ের যথাযথ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যাচাই করার ভিত্তিতেই হওয়া আবশ্যক।