হাদীস সংরক্ষণ
ইসলাম বিশ্বমানবের জন্য এক চিরন্তন জীবন- ব্যবস্থা। এইজন্য উহার প্রধান ও প্রাথমিক বুনিয়াদ কুরআন মজীদের হিফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি ঘোষণা করিয়াছেনঃ
******************************************************
নিশ্চয়ই আমিই কুরআন নাযিল করিয়াছি এবং আমিই উহার সংরক্ষণকারী।[সূরা আল-হিজর, আয়াত- ৯।]
বস্তুত আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদ নাযিল করার সঙ্গে সঙ্গে উহার পূর্ণ সংরক্ষণের সার্বিক ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করিয়াছেন। জিবরাঈলের মারফতে রাসূলে করীমের নিকট কুরআন নাযিল হইয়াছে, তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তাহা লোকদিগকে পাঠ করিয়া শোনাইয়াছেন। অতঃপর ইহাকে চিরতরে সংরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে দুইটি উপায় অবলম্বিত হইয়াছে। একদিকে সাহাবায়ে কিরাম কুরআন শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে তাহা মুখস্থ করিয়া লইয়াছেন। স্মরণ শক্তির মণিকোঠায় ইহার প্রতিটি শব্দ ও অক্ষর চিরদিনের তরে সুরক্ষিত করিয়া লইয়াছেন। [সূরা আল-আনকাবূত, ৪৯ আয়াতের ব্যাখ্যায় শাহ আবদুল কাদির লিখিত আলোচনা, **************** পৃষ্ঠা ১২৪।]
ফলে উহার একটি বিন্দুও বিলুপ্ত বা বিকৃত হইতে পারে নাই। এই উপায়ে সংরক্ষণে লাভের দিক দিয়াও কুরআন মজীদ আসামানী গ্রন্হাবলীর ইতিহাসে অতুলনীয় জিনিস, দুনিয়ার অপর কোন গ্রন্হই মুখস্থ করিয়া রাখাকে এক বিরাট সওয়াবের কাজ বলিয়া বিশ্বাস করেন। এই কারণে কুরআন মজীদ মুখস্থ করার রীতি আবহমানকাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে। এমন কি, গ্রন্হাকারে লিপিবদ্ধ কুরআন যদি আজ বিলুপ্তও হইয়া যায়, তবুও হাফেজদের স্মৃতিপটে রক্ষিত কুরআন মজীদ তাহার স্থান দখল করিতে পারিবে। পুনরায় কুরআনকে লিখিতরূপ দান করা কিছুমাত্র অসুবিধার ব্যাপার হইবে না। ইহা যে কুরআন মজীদের এক মু’জিযা তাহাতে সন্দেহ নাই।
অপরদিকে কুরআন নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নবী করীম (স) সর্বক্ষণ নিযুক্ত ওহী-লেখকদের দ্বারা তাহা লিখাইয়া লইয়াছেন। হযরত বরা ইবনে আজিব (রা) বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসটি ইহার জ্বলন্ত প্রমাণঃ
******************************************************
নিষ্ক্রিয় মু’মিন লোক ও আল্লাহর পথে জিহাদকারী লোক কখনো সমান হইতে পার না- এই আয়াত যখন নাযিল হইল, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ যায়দকে ডাকিয়া দাও এবং তাহাকে দোয়াত, তখতি ইত্যাদি লইয়া আসিতে বলিও। তিনি (যায়দ) যখন আসিলেন, তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ এই আয়াতটি লিখ……………।[বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৪৬।]
এইভাবে সমস্ত কুরআন মজীদ নবী করীম (স) এর জীবদ্দশায়ই নির্দিষ্ট লেখকের দ্বারা লিখিত হয়। প্রায় চল্লিশ জন সাহাবী কুরআন মজীদ লিখিবার জন্য নিযুক্ত ছিলেন। [***********] প্রায় ছাব্বিশ জন সাহাবী ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে প্রখ্যাত। হযরত আবূ বকর, হযরত উমর, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত যায়দ ইবনে সাবিত, হযরত আবদুল্লাহ ইবন সায়াদ, হযরত জুবাইর ইবনুল আওয়াম, হযরত খালিদ ইবন সায়ীদ, হযরত আমর ইবনুল আ’স, হযরত মুয়াবিয়া ইবন আবূ সুফিয়ান, হযরত উবাই ইবন কায়াব (রা) প্রমুখ তাহাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। [তাবাকাতে ইবন সায়াদ, তারীখ-ই তাবারী, ***************************************]
এই উভয়বিধ উপায় অবলম্বিত হওয়ার ফলে কুরআন মজীদ সর্বপ্রকার বিকৃতিও বিলুপ্তির হাত হইতে চিরকালের তরে রক্ষা পাইয়াছে।
কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে কেবল কুরআন মজীদকে রক্ষা করাই দ্বীন ইসলাম রক্ষা ও স্থায়িত্বের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এই কারণে আমরা দেখিতেছি, কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তা’আলা হাদীস সংরক্ষণেরও যথাযথ ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাসে আমাদের সামনে স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, কুরআন সংরক্ষণের জন্য প্রধানত দুইটি বাহ্যিক উপায় অবলম্বিত হইয়াছে, রাসূলের সুন্নাত তথা হাদীসও প্রধানত ঠিক সেই দুইটি উপায়ের সাহায্যেই সুরক্ষিত হইয়াছে। আর তাহা হইতেছে আল্লাহ তা’আলার কায়েম করা স্বাভাবিক ব্যবস্থা এবং মানুষের মানবিক প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থাপনা। এই পর্যায়ে বিস্তারিত ও ঐতিহাসিক তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক আলোচনা পেশ করার জন্য আমরা এখানে চেষ্টা করিব।
স্বাভাবিক ব্যবস্থা
হাদীস সংরক্ষণের স্বাভাবিক ব্যবস্থা যাচাই ও পরীক্ষা করিয়া দেখিলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করিয়াছে বলিয়া মনে হয়। প্রথম, তদানিীন্তন আরবদের স্বাভাবিক স্মরণশক্তির তীক্ষ্ণতা ও প্রাখর্য। দ্বিতীয়, সাহাবায়ে কিরামের জ্ঞান-পিপাসা, জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানানুশীলনের অপূর্ব তিতিক্ষা এবং তৃতীয়, ইসলামী আদর্শ ও জ্ঞান বিস্তারের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দায়িত্ববোধ। এই তিনটি বিষয়েরই বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা যাইতেছে।
আরব জাতির স্মরণশক্তি
তদানীন্তন আরব জাতির স্মরণশক্তি বস্তুতই এক ঐতিহাসিক বিস্ময়। কুরআন এবং হাদীসের সংরক্ষণে ইহার যথেষ্ট অবদান রহিয়াছে। কুরআন মজীদ ইহাকে একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসাবে গণ্য করিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
বরং এই কুরআন সুস্পষ্ট আয়াত সমষ্টি, ইহা জ্ঞানপ্রাপ্ত লোকদের মানসপটে সুরক্ষিত।[সূরা আল-আনকাবুত, ৪৯ আয়াত।]
এই আয়াতে সেকালের মুসলিম জ্ঞানী লোকদের স্মরণশক্তির দিকে সুস্পষ্ট ইংগিত রহিয়াছে এবং কুরআন মজিদ যে তাহাদের মানসপটে স্মৃতিশক্তির মাধ্যমে সুরক্ষিত ছিল, তাহাও ব্যক্ত করা হইয়াছে। আল্লামা বায়াযাবী এই আয়াতের তাফসীরে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
অর্থাৎ তাঁহারা কুরআনক এমনভাবে হিফয করিয়া রাখিতেন ও উহার সংরক্ষণ করিতেন যে, কেহই উহাকে বিকৃত বা রদবদল করিতে পারিত না।[তাফসীরে বায়যাবী, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৯।]
ইতিহাস প্রমাণ করিয়াছে যে, তদানীন্তন আরব সমাজের লোকদের স্মরণশক্তি অসাধারণরূপে প্রখর ছিল, কোন কিছু স্মরণ করিয়া রাখার জন্য একবার শ্রবণই তাহাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই সম্পর্কে ইবন আবদুল বির লিখিত এই ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখযোগ্যঃ
******************************************************
আরব জাতি স্বভাবতই স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিল এবং উহা ছিল তাহাদের বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য।
******************************************************
তাহারা স্বাভাবিকভাবেই স্মরণশক্তি লইয়া জন্মগ্রহণ করিত।[****************]
******************************************************
এই কথা প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত যে, আরব জাতি মুখস্থ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি ও প্রতিভার বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ছিল। তাহাদের এক একজন লোক যে কাহারো দীর্ঘ কবিতা একবার শুনিয়াই মুখস্থ করিয়া ফেলিতে ও স্মরণ রাখিতে সক্ষম হইত।[***************]
হযরত ইবন আব্বাস (রা) উমর ইবন আবূ রাবিয়ানামক প্রসিদ্ধ আরব কবির এক দীর্ঘ কবিতা একবার মাত্র শ্রসণ করিয়া সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছিলেন। [***************] রাসূলের সাহাবিগণও খালেস আরব জাতির লোক ছিলেন। তাঁহারা প্রথমে না কিছু লিখিতে পারিতেন, না পারিতেন কোন লিখিত জিনিস পাছ করিতে। ফলে তাঁহাদের সকলকেই কেবল স্মরণশক্তির উপর নির্ভরশীল হইয়া থাকিতে হইত। জাহিলিয়াতের যুগে তাঁহারা তাঁহাদের দীর্ঘ বংশতালিকা, পূর্বপুরুষদের অপূর্ব প্রশংসা ও গুণ-গরিমার কথা সবিস্তারে মুখস্থ করিয়া রাখিতেন। তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে যখন বংশ-গৌরবের প্রতিযোগিতা হইত, তখন তাঁহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অতীত বংশ গৌরব ও স্তুতি গাঁথা একটানা মুখস্থ বলিয়া যাইতেন। তাঁহাদের প্রায় প্রত্যেকেই স্মরণশক্তির তীক্ষ্ণতার কারণে নিজ নিজ বংশের ভাষ্যকার বা মুখপাত্র ছিলেন।
আল্লাহ তা’আলা স্বাভাবিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন এই আরব জাতিকেই হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়্যাত ও প্রচরিত বাণীর সংরক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। প্রখর স্মরণশক্তিসম্পন্ন এইসব হৃদয়কে কুরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদীস মুখস্থ রাখার জন্য পূর্ণ মাত্রায় প্রস্তুত করিয়াছিলেন। [***************************]
ঠিক এই কারণেই আমরা দেখিতে পাই যে, কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহাবিগণ নবী করীম (স)- এর মুখে তাহা শুনিয়াই মুখস্থ করিয়া লইতে পারিতেন। এইভাবে পূর্ণ কুরআন মজীদ মুখস্থ করিয়ালওয়া এবং রাখা তাহাদের পক্ষে কিছুমাত্র কঠিন ব্যাপার ছিল না।
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী কাতাদাহ ইবন দায়ামহ দাবি করিয়া বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আল্লাহ এই জাতিকে স্মরণশক্তির এমন প্রতভা দান করিয়াছেন, যাহা কোন জাতিকেই দান করা হয় নাই। ইহা এক বিশেষত্ব, যাহা কেবল তাহাদিগকেই দেওয়া হইয়াছে এবং ইহা এমন এক সম্মান ও মর্যাদা যাহা দ্বারা শুধু তাহাদিগকেই সম্মানিত করিয়াছেন।[যুরকানী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৫।]ৱ
হযরত আবু হুরায়রা (রা)-এর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিপুল সংখ্যাক হাদীসের হাফেজ ছিলেন। কিন্তু উমাইয়া বংশের শাসক খলীফা মারওয়ান ইবন হিকামের মনে এই সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক হয়। তিনি হযরত আবূ হুরায়রার পরীক্ষা লওয়ার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন। একদিন হযরত আবূ হুরায়রাকে কিছু সংখ্যক হাদীস শোনাইবার জন্য অনুরোধ করিলেন। আবূ হুরায়রা (রা) তখন কিছু সংখ্যক হাদীস শোনাইয়া দেন। মারওয়ানের নির্দেশ মুতাবিক পর্দার অন্তরালে বসিয়া হাদীসসমূহ লিখিয়া লওয়া হয়। বৎসরাধিক কাল পরে একদিন ঠিক এই হাদীসসমূহই শোনাইবার জন্য হযরত আবূ হুরায়রাকে অনুরোধ করা হইলে তিনি সেই হাদীসসূহই এমনভাবে মুখস্থ শোনাইয়াদেন যে, পূর্বের শোনানো হাদীসের সহিত ইহার কোনই পার্থক্য হয় না। ইহা হইতে হযরত আবূ হুরায়রার স্মরণশক্তির প্রখরতা অনস্বীকার্যভাবে প্রমাণিত হয়।[কিতাবুল কুনী, ইমাম বুখারীকৃত, পৃষ্ঠা ৩৩।]
প্রসিদ্ধ হাদীস-সংকলক ইমাম ইবন শিহাব জুহরীও ছিলেন অসাধারণ স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনিও একবার এক পরীক্ষার সম্মখীন হইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তদানীন্তন বাদশাহ হিশাম তাঁহার পুত্রকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছু সংখ্যক হাদীস লিখিয়া দিতে তাঁহাকে অনুরোধ করেন। জুহরী তখনি চারশত হাদীস লিখাইয়া দেন। দীর্ঘদিন পর সেই হাদীসসমূহ পুনরায় লিখাইয়া দেওয়ার জন্য অনুরুদ্ধ হইয়া তিনি আবার তাহা লিখিইয়া দেন। বাদশাহ এই উভয়বারে লিখিত হাদীসসমূহের তুলনামূলক পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পান যেঃ
******************************************************
এই দ্বিতীয়বারে সেই হাদীসসমূহের একটি অক্ষরও বাদ পড়িয়া যায় নাই।[তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০১।]
ইহা যেম ইমাম জুহরীর অপরিসীম স্মৃতিশক্তির বাস্তব প্রমাণ, তাহাতে সন্দেহ নাই।
ইবনে শিহাব জুহরী বলিতেনঃ
******************************************************
আমি যখনি ‘বকী’ বাজারের নিকট যাতায়াত করিতাম, তখন আমার কর্ণদ্বয় এই ভয়ে বন্ধ করিয়া লইতাম যে, উহাতে কোন প্রকার অশ্লীল কথা যেন প্রবেশ করিতে না পারে। কেননা, আল্লাহর শপথ, আমার কর্ণে কোন কথা প্রবেশ করিলে আমি তাহা কখনো ভুলিয়া যাই না।[******************]
তিনি আরো বলেনঃ
******************************************************
আমি আমার খাতা বইতে হাদীস বা অন্য যাহা কিছু লিখিয়াছি, তাহই মুখস্থ করিয়াছি।[**************]
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ও বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী ইমাম শা’বী স্বীয় স্মরণশক্তি প্রখরতার পরিচয় ও বিবরণ দান প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি কখনো কোন খাতা হইতে কোন হাদীস লিখি নাই এবং কখনো কাহারো নিকট হইতে কোন হাদীস একাধিকবার শ্রবণ করার প্রয়োজন বোধ করি নাই।[***************]
ইমাম অকী’ও অনুরূপ একজন আসামন্য স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ
******************************************************
তাঁহার মত হাদীস হিফযকারী লোক আমি আর দেখি নাই।[তারীখে খতবী, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৪।]
অপর এক মুহাদ্দিস তাঁহার সম্পর্কে বলেনঃ
******************************************************
‘অকী’র স্মরণশক্তি ছিল প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য।[তারীখে খতবী, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৭৪।]
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুহাদ্দিস কাতাদাহর স্মরণশক্তিও ছিল অতুলনীয়। তাঁহার এই ঐতিহাসিক স্মরণ শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসকার হাফিজ যাহবীর নিম্নোক্ত বর্ণনা হইতে। তিনি বলেনঃ
******************************************************
কাতাদাহ ছিলেন বসরাবাসীদের মধ্যে সর্বাধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি যে কথাই শুনিতেন, তাহাই স্রমণ করিয়ালইতেন। হযরত জাবিরের সংকলিত হাদীস গ্রন্হ তাঁহার সম্মুখে একবার পাঠ করা হইলে তিনি তাহা মুখস্থ করিয়া ফেলেন।[তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬।]
ইয়াহইয়া ইবনে কাতান বলেনঃ আমি সুফিয়ান সওরী অপেক্ষা অধিক স্মরণশক্তিসন্পন্ন লোক দেখি নাই। তাঁহার ত্রিশ হাজার হাদীস মুখস্থ ছিল। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
‘আমি যাহা কিছু একবার মুখস্থ করিয়াছে তাহা কখনই ভুলিয়া যাই নাই’।[তাযকিয়াতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, ২৬ পৃষ্ঠা।]
সুফিয়ান ইবন উয়াইনার সাত সহস্র হাদীস কন্ঠস্থ ছিল এবং এজন্য তিনি কোন কিতাব রাখিতেন না।
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল বলেনঃ রাজধানী বাগদাদে মুহাদ্দিস আবূ জুরয়া অপেক্ষা অধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোক দেখা যায় নাই। কেবলমাত্র কুরআন সম্পর্কেই দশ হাজার হাদীস তাঁহার মুখস্থ ছিল। বস্তুত স্মরণশক্তির দিক দিয়া তিনি ছিলেন অতুলনীয়।
কাযী আবূ বকর ইসফাহানী মাত্র পাঁচ বৎসর বয়সেই সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেন।
ইমাম বুখারীর উস্তাদ মুহাদ্দিস ইসহাক ইবন রাহওয়া-এর স্মরণশক্তি অতিশয় তীক্ষ্ণ ছিল। অসংখ্য হাদীস তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। তাঁহার শিক্ষার্থীদিগকে তিনি মুখস্থ কয়েক সহস্র হাদীস লিখিয়াই দিয়াছিলেন, ইহাতে তিনি একবারও কিতাব দেখার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। তিনি নিজেই বলিতেনঃ ‘সত্তর সহস্র হাদীস আমার চোখের সম্মুখে সব সময় ভাসমান থাকে’।
মুহাদ্দিস আবু জুরয়া তাঁহার সম্পকের্ক বলিতেনঃ
তাঁহার (ইবন রাহওয়ার) মত স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোক একজন দেখি নাই।[****************]
তদানীন্তন শাসনকর্তা আমীর আবদুল্লাহ তাঁহার স্মরণশক্তির বিস্ময়কর পরিচয় পাইয়া বলিয়াছিলেনঃ
******************************************************
আপনি অনেক বিষয় মুখস্থ করিয়া রাখিতে পারেন তাহা জানি, কিন্তু আপনার এই স্মরণশক্তির পরিচয় পাইয়া আমি আশ্চর্যান্বিত হইতেছি।[কিতাবুল-কুনী, ইমাম বুখারী কৃত, পৃষ্ঠা ৩৩]
পরবর্তী যুগের হাদীসবিদ ইমাম বুখারীর স্মরণশক্তিও কোন অংশে কম উল্লেখযোগ্য নয়। নওয়াব সিদ্দীক হাসান আবূ বকর ইবন আবূ ইতাব হইতে উল্লেখ করিয়াছেনঃ
******************************************************
ইমাম বুখারী বাল্যাবস্থায়ই সত্তর হাজার হাদীস সম্পূর্ণ মুখস্থ করিয়া লইয়াছিলেন।[************]
তাঁহার সম্পর্কে আরো উল্লেখ করিয়াছেনঃ
******************************************************
বর্ণিত আছে, তিনি একবার মাত্র কিতাব দেখিয়া তাহা সবই মুখস্থ করিয়া লইতেন।[*************]
মুহাম্মদ ইবন আবূ হাতেম বলিয়াছেনঃ দুইজন লোক আমার নিকট বলিয়াছেন যে, আমরা একত্রে হাদীস শ্রবণ করিতাম, ইমাম বুখারী তখন আমাদের মধ্যে বালক বয়সের ছিলেন। আমরা যাহা শুনিতাম তাহা সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়া লইতাম; কিন্তু ইমাম বুখারী কিছুই লিখিতেন না। একদিন তাঁহাকে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেনঃ তোমরা আমার প্রতি বড় অবিচার করিলে। আচ্ছা, তোমরা কি লিখিয়াছ তাহাই আমাকে শোনাও। অতঃপর আমাদের লিখিত পনেরো হাজারেরও অধিক হাদীস তাঁহাকে দেখাইলাম।
******************************************************
অতপর তিনি তাঁহার স্মরণশক্তিতে রক্ষিত এই সব হাদীসই মুখস্থ পড়িয়া শোনাইলেন। এমনকি তাঁহার মুখস্থ পাঠ শুনিয়া আমাদের লিখিত কিতাবগুলিকে সংশোধন করিয়া লইলাম।[*****************]
ইমাম বুখারী সম্পর্কে আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি বাগদাদ আগমন করিলে মুহাদ্দিসগণ তাঁহার নিকট উপস্থিত হইলেন ও আলাদা আলাদাভাবে মোট একশতটি হাদীস তাঁহার সম্মুখে এমনভাবে পেশ করিলেন যে, উহার প্রত্যেকটির সনদ উল্টাপাল্টা করিয়া দেওয়া হইয়াছে, একটির সনদ অপরটির সহিত জুড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। এইসব হাদীস সম্পর্কে ইমাম বুখারীর মতামত জানিতে চাহিলে তিনি এই হাদীসসমূহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন। অতঃপর প্রত্যেকটি হাদীসকে সঠিকভাবে উল্লেখ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, তাঁহারা উহাকে যেভাবে উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহাতে এই ভূল ছিল এবং কোন হাদীসের সনদ কোনটি-কোনটি নয়, তাহাও তিনি অকাট্যভাবে প্রকাশ করিয়া দিলেন। তাঁহার এই অপরিসীম স্মরণশক্তি দর্শনে সকলেই গভীর বিস্ময় প্রকাশ করেন।
******************************************************
তাঁহার এই অপরিসীম স্মরণশক্তির কথা তাঁহারা স্বীকার করিলেন এবং এই ব্যাপারে তাঁহার বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সকলেই বিশ্বাস করিলেন।[*************]
এই সব ঘটনা হইতে এই কথা প্রমাণিত হয় যে, এই যুগের মুসলিম মনীষীদের স্মরণশক্তি স্বাভাবত অত্যন্ত তীক্ষ্ন ও প্রখর ছিল। সাহাবাদের যুগ হইতে তাবে-তাবেয়ীন ও মুহাদ্দিসীনের যুগ পর্যন্ত ইহার কোন ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। সেকালের আরবদের মধ্যেও যেমন এই বিস্ময়কর স্মরণশক্তি বর্তমান ছিল, অনারব মুসলিমদের মধ্যেও তাহার প্রকাশ দেখা গিয়াছে। বস্তুত মুসলিম উম্মতের প্রতি ইহা ছিল আল্লাত তা’আলার এক অপরিসীম ও মহামূল্য অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহ ছিল বলিয়াই কুরআন এবং হাদীস ইসলামের এই ভিত্তিদ্বয় যথাযথভাবে সংরক্ষিত হইতে ও সুরক্ষিত থাকিতে পারিয়াছে।
এই যুগের এই বৈশিষ্ট্যের একটি জীবতাত্ত্বিক তাৎপর্যও রহিয়াছে। আল্লাহ তা’আলা মানবদেহে যতগুলি শক্তি ও সামর্থ্য দান করিয়াছেন, তন্মধ্যে কোন একটির ব্যবহার না হইলে কিংবা কোন একটি অঙ্গ অকেজো হইয়া পড়িলে অপরচির শক্তি বৃদ্ধি পায়। যাহার একটিমাত্র হাত, তাহার সে হাতে দুই হাতের শক্তি সঞ্চিত হয়। অন্ধ ও দৃষ্টিহীন ব্যক্তির আন্দাজ অনুমান ও অনুভূতির শক্তি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। ইসলামের প্রথম যুগের মুসলামানদের ব্যাপারে ইহার সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। একালে সাধারণভাবে লেখাপড়ার বেশী প্রচলন ছিল না। মানুষ লেখনীশক্তির প্রয়োগ অপেক্ষা স্মরণশক্তির ব্যবহার বেশী করিত। ফলে এ্ই যুগে স্মরণশক্তির প্রয়োগ অপেক্ষা স্মরণশক্তির ব্যবহার বেশি করিত। ফলে এই যুগে স্মরণশক্তির বিস্ময়কর বিকাল পরিলক্ষিত হয়।কুরআন ও হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রাথমিক উপায় হিসাবে ইহা খুবই গুরত্বপূর্ণ স্থান দখল করিয়াছে।