ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব
হাদীস ইসলামী মিল্লাতের এক অমুল্য সম্পদ, ইসলামী শরীয়াতের অন্যতম অপরিহার্য উৎস। ইহাকে বাদ দিয়াইসলামী জীবন-ধারা ধারণাতীত। হাদীসের গুরুত্ব নির্ধারণের পূর্বে স্বয়ং রাসূলে করীম (স)- এর গুরুত্ব এবং মর্যাদা (Position) নির্ধারণ একান্ত প্রয়োজন।
ইসলামের দৃষ্টিতে রাসূলের আদেশ –নিষেধ, তাঁহার যাবতীয় কাজ-কর্ম, কথাবার্তা- এক কথায় তাঁহার মূখ- নিঃসৃত বাণী ও গোটা কর্মময় জীবনই ইসলামী মিল্লাতের জ ন্য একান্ত অনুসরণীয় এক মহান আদর্শ। রাসূল প্রেরণের মূলে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই এই ছিল যে, উম্মত তাঁহাকে পূর্ণ মাত্রায় অনুসলণ করিয়াচলিবে, তাঁহার হুকুম আহকাম পুরাপুরি পালন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বাস্তব জীবন ধারাকেও অনুসরণ করিয়া চলিবে। কুরআন মজীদ স্পষ্ট ভাষায় রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য ঘোষণা করিয়া বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি রাসূল পাঠাইয়াঠি একমাত্র ইএ উদ্দেশ্যে যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁহাকে অনুসরণ করা হইবে- তাঁহাকে মানিয়া চলা হইবে। [সূরা আন-নিসা, ৬৪ আয়াত।]
অপর এক আয়াতে রাসূলকে আনুগত্য ও অনুসরণ করিয়াচলার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়াছেন, বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হে ঈমানদার লোকগণ, আল্লহ এবং তাঁহার রাসূলের আনুগত্য কর, তাঁহাদের আদেশ শ্রবণের পর তাহা অমান্য করিয়া পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করিও না। তাহাদের মত হইও না, যাহারা বলে- আমরা শুনিয়াছি, কিন্তু কার্যত তাহারা শোনে না। [সূরা আল-আনফাল, আয়াত ২০ ও ২১।]
এখানে ঈমানদার লোকদের প্রতি প্রথমে আল্লাহর আনুগত্য করার আদেশ দান করা হইয়াছে, সেই সঙ্গে রাসূলেরও অনুসরণ বা আনুগত্য করিতে আদেশ করা হইয়াছে। আল্লাহর এবং রাসূলের আনুগত্য করিতে বলা হইয়াছে একই ******** ‘আনুগত্য কর’আদেশমূলক শব্দ দ্বারা। আল্লাহ এবং রাসূল উভয়কেই মানিয়া চলা মুসলমানের কতৃব্য ঘোষিত হইয়াছে এবং এই কর্তব্যের ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নাই। তবে বাহ্যত শুধু এতটুকুই পার্থক্য করা যাইতে পারে যে, আল্লাহর নাম প্রথমে উল্লিখিত হইয়াছে- অতএব তাহার আনুগত্য করিতে হইবে মূলত এবং প্রথমত, আর তাঁহার পরই আনুগত্য করিতে হইবে রাসূলের।
দ্বিতীয়ত আল্লাহর আনুগত্য করা যায় আল্লাহর কিতাব-কুরআন মজীদের আদেশ-নিষেধ মান্য করিয়া। আর রাসূলের আনুগত্য করিতে হয় রাসূলের আদেশ-নিষেধ ও অনুসৃত রীতি-নীতি পালন করিয়া। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ত্রিশ পারা কুরআন মজীদে বর্তমান; কিন্তু রাসূলের আদেশ-নিষেধ কোথায় পাওয়া যাইবে? তাহা পাওয়া যাইবে রাসূলের কথা, কাজ, সমর্থন সম্বলিত মহান সম্পদ-হাদীসের মাধ্যমে।
আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
বল হে নবী, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমাকে অনুসরণ করিয়াচল। তাহা হইলে আল্লাহও তোমাদের ভালবাসিবেন; তোমাদের গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গুনাহ মার্জনাকারী, দয়াশীল।[সূরা আল-ইমরান, ৩১ আয়াত।]
অর্থাৎ আল্লাহকে ভালবাসার অনিবার্য দাবি ও বাস্তব শর্ত হইতেছে রাসূলকে কার্যত অনুসরণ করিয়া চলা; আল্লাহর ভালবাসা ও তাঁহার নিকট হইতে গুনাহের মাজনা লাভের একমাত্র পথ ও উপায় হইতেছে রাসূল (স)- কে অনুসরণ করা। রাসূলকে অনুসরণ না করিলে আল্লাহর ভালবাসা ও তাহার নিকট গুনাহ মার্জনা লাভ স্ভব নহে। কেবল ইহাই নয়, রাসূলকে অনুসরণ করিয়া না চলিলে মানুষ ঈমানদারই হইতে পারে না, মুসলিম থাকিতে পারে না, বরং কাফির হইয়া যায়।
আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ
******************************************************
বল হে নবী, আল্লাহ ও রাসূলকৈ মানিয়া চল; যদি তাহা না করা তবে জানিয়া রাখ, আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না।[সূরা আল-ইমরান, ৩২ আয়াত।]
এই আয়াতেও আনুগত্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর পরে ও সঙ্গে সঙ্গেই রাসূলকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেওা হইয়াছে। ফলে কেবল আল্লাহর আনুগত্য করিলেই চলিবে না, রাসূলেরও আনুগত্য করিতে হইবে। আল্লাহর আনুগত্য না করিলে মানুষ যেমন কাফির হইয়া যায়, রাসূলের আনুগত্য না করিলেও মানুষ অনুরূপভাবেই কাফির হইয়া যাইবে। আয়াতের শেষাংশ এই কথা স্পষ্ট ভাষায়ই ব্যক্ত করিয়াছেন। সেই সঙ্গে এই কথাও বলা হইয়াছে যে, এই কাফিরদিগকে আল্লাহ কিছুমাত্র ভালবাসেন না- পছন্দ করেন না।
মুসলিম হওয়ার জন্য আল্লাহর সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের আনুগত্য করা এইরূপ তাকীদ হওয়ার বিশেষ কারণ রহিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র আল্লাহর কালাম পৌঁছাইয়া দেওয়াই রাসূলের একমাত্র কাজ নহে। আল্লাহর কালাম ব্যাপক প্রচার করা, লোকদিগকে উহা বিশদভাবে বুঝাইয়া দেওয়া, উহার ভিত্তিতে লোকদের মন-মগজ চরিত্র ও জীবন গঠন করা এবং তদনুযায়ী এক আদর্শ সমাজ গঠন করাও রাসূলের কাজ, সন্দেহ নাই।
কুরআন মজীদে এই সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
সেই মাহন আল্লাহ-ই উম্মী লোকদের প্রতি তাহাদের মধ্যে হইতেই একজন রাসূল পাঠাইয়াছেন। রাসূল আল্লাহর আয়াতসমূহ তাহাদের সম্মুখে তিলাওয়াত করে, তাহাদিগকে পবিত্র-পরিশুদ্ধ ও সুসংগঠিত করে, তাহাদিগকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়- যদিও তাহারা ইহার পূর্বে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল। [সূরা জুময়া, আয়াত ২।]
আয়াতে নবী করীমের তিনটি সুস্পষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ঘোষণা করা হইয়াছেঃ
প্রথম, কুরআনের আয়াতসমূহ পাঠ করা, পাঠ করিয়া লোকদিগকে শোনানো। দ্বিতীয়, জন-মনকে পবিত্র-পরিচ্চন্ন ও বিশুদ্ধকরণ, বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট আদর্শের মানদণ্ডে তাহাদের লালন-পালন ও গঠন করা। শিরক ও চরিত্রহীনতার পংকিলতা হইতে তাহাদিগকে পরিশুদ্ধকরণ।
তৃতীয়, আল্লাহর কিতাব ও জরুরী জ্ঞান শিক্ষা দান, ইসলামী জ ীবনাদর্শ বাস্তাবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বুদ্ধি ও প্রতিভার বিকাশ সাধন, ‘সুন্নাত’ শিক্ষা দান।
আলোচন্য আয়াতে প্রথম ও তৃতীয় পর্যায়ে যে কাজের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে-আয়াত তিলাওয়াত করা ও কিতাবের তালীম দেওয়া- এই্ দুইটি কি একই ধরনের কাজ? একই ধরনের কাজ হইলে ইহা নিঃসন্দেহে পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট। আর তাহা হইলে উভয় ক্ষেত্রে একই ধরনের শব্দ প্রয়োগ হওয়া উচিত ছিল। অথচ উভয় ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শব্দের ব্যবহার হইয়াছে। ফলে অর্থের তারতম্যের কারণে ইহা দুইটি স্বাতন্ত্র কাজরূপেই প্রতিফলিত হইয়াছে। বস্তুত ‘আয়াত তিলাওয়াত’ ও ‘কিতাবের তালীম’ দুইটি আলাদা আলাদা কাজ, স্বতন্ত্র দায়িত্ব বিশেষ।
অতএব কুরআন তিলাওয়াত করা সঙ্গে সঙ্গে উহার কঠিন ও অভিনব পারিভাষিক শব্দসমূহের ব্যাখ্যা, নির্দেশিত বিষয়সমূহের বিশ্লেষণ, সংক্ষিপ্ত বিষয়গুলির বিস্তৃ রূপদান এবং স্বীয় কথা ও কাজের মাধ্যমে উহার বাস্তব রূপায়ণ ও প্রতিষ্ঠা- এ সবই রাসূলৈ করীমের দায়িত্ব ও কর্তব্যরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছে।
আয়াতের শেষাংশে ‘কিতাব’ ও ‘হিকমাত’ শিক্ষাদানের কথা বলা হইয়াছে। ‘আল কিতাব’ অর্থঃ কুরআন মজীদ, কিন্তু ‘হিকমাত’ অর্থ কি?
কুরআন মজীদের বহুস্থানে ‘হিকমাত’ শব্দটি ‘আল-কিতাবের’ সঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে এবং সকল রাসূলকে যেমন কিতাব দেওয়া হইয়াছে, তেমনি হিকমাতও দান করা হইয়াছি বলিয়া স্পষ্ঠ ভাষায় ঘোষণঅ করা হইয়াছে। সূরা আল-আমরানে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
স্মরণ কর, আল্লাহ নবীদের নিকট হএত প্রতিশ্রুতি লইয়াছেন যে, (আজ) তোমাদিগকে কিতাব ও হিকমাত দান করিয়াছি। [সূরা আল-ইমরান, ৮১ আয়াত।]
আয়াতে উল্লিখিত ‘কিতাব’ অর্থ যে আল্লাহর কালাম সম্বলিত আসমানী গ্রন্হ, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ‘হিকমাত’ শব্দের তাৎপর্য কি? ইহা দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা কি বুঝাইতে চাহেন? কিতাবের সাথে আল্লাহ রাসূলগণের প্রতি এমন আর কি জিনিস নাযিল করিয়াছেন, যাহাকে তিনি ‘হিকমাত’ নামে অভিহিত করিয়াছেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা ও অনুসন্ধান আবশ্যক।
অভিধানের দৃষ্টিতে ‘হিকমত’ শব্দের মূল হইতেছে *******, ইহার অর্থ ****************** ‘সংশোধন উদ্দেশ্যে কোন জিনিস বা কাজ হইতে নিষেধকরণ’। লাগামকে এই দৃষ্টিতেই ‘হাকামাতুন’ ****** বলা হয়; কেননা, উহা দ্বারা ঘোড়াকে বিদ্রোহ ও যথেচ্ছা গমন হইতে বিরত রাখা হয়। এই অর্থগত সামঞ্জস্যের কারণেই ‘হিকমাতে’র অর্থ করা হয়- *************** জিনিসগুলিকে যথোপযুক্ত স্থানে স্থাপন করা-রাখা এবং অনুপযুক্ত স্থানে রাখা, বন্দ করা।
‘তাজুল-উরুস’ অভিধানে ইহার অধিকতর বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
বিচার-মীমাংসার ক্ষেত্রে সুবিচার-ইনসাফ ও ন্যায়পরতাকে বলা হয় ‘হিকমাত’।
‘জিনিসসমূহের প্রকৃত নিগূঢ় তত্ত্ব ও হাকীকত (Reality) জানিয়া লওয়া এবং এই বিশুদ্ধ ও নির্ভুল জ্ঞানের দৃষ্টিতে আমল করা। এই কারণে ‘হিকমাত’ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ জ্ঞানগত, আর অপর ভাগ বাস্তবমূলক বা কাজ সম্পর্কিত। [তাজুল ‘উরুস’‘হিকমাত’ শব্দের আলোচনা।]
ইমাম রাগেব ইসফাহানী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
হিকমাত হইতেছে জ্ঞান ও বুদ্ধির সাহায্যে প্রকৃত সত্য লাভ, সত্য লাভের যোগ্যতা ও প্রতিভা। অতএব আল্লাহর ‘হিকমাত’ হইতেছে সমস্ত জিনিস ভাল করিয়া জানা-চেনা এবং চূড়ান্ত বিধানের ভিত্তিতে নূতন জিনিস সৃষ্টি ও উদ্ভাবন। আর মানুষের ‘হিকমাত’ হইতেছে বস্তুজগতের বিষয়াদি সম্পর্কে পরিচিতি ও জ্ঞানলাভ এবং ভাল ভাল কাজ সম্পাদন।[১০৭]
লিসানুল আরব গ্রন্হে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
কার্যত সর্বোত্তম ও উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ সম্পর্কে সূক্ষ্ম গভীর জ্ঞান লাভই হইতেছে হিকমাত।[১০৮]
ইমাম ইবনে জরীর তাবারী বিভিন্ন লোকের কথা উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
হিকমাত সম্পর্কে আমার দৃষ্টিতে সঠিক কথা এই যে, হিকমাত হইতেছে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সম্পর্কেত ইলম, যাহা রাসূলের বর্ণনা ছাড়া কিছুতেই লাভ করা সম্ভব নয় এবং উহার সম্পর্কে গভীর সূক্ষ্ম পরিচিতি লাভ করাও হিকমাত। উহার সহিত সামঞ্জস্যশীল আর যেসব জিনিস দ্বারা উহা লাভ করা যায়, তাহাও উহার অন্তুর্ভক্ত। আমার মতে ‘হিকমাত’ শব্দটি ‘হাকাম’ হইতে নির্গত হইয়াছে। উহার অর্থ হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকরণ। [১০৯**************]
ইমাম শাফেয়ী (র) লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞানে সর্বাধিক পারদর্শী আস্থাভাজন বিশিষ্ট লোকদের নিকট আমি শুনিয়াছি, তাঁহারা বলিয়াছেনঃ হিকমাত হইতেছে রাসূলে করীম (স)-এর সুন্নাত।[কিতাবুর রিসালা; ২৮ পৃষ্ঠা।]
অতঃপর তিনি লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
রাসূলের সুন্নাত হইতেছে সেই হিকমাত, যহা হযরতের দিল মুবারকে আল্লাহর নিকট হইতে উদ্রেক করা হইয়াছে।[কিতাবুর রিসালা; ২৮ পৃষ্ঠা।]
কুরআন মজীদের যেসব স্থানে ‘আল-কিতাবের’ সঙ্গে ‘আল-হিকমাতে’র উল্লেখ হইয়াছে, সেসব স্থানেই কিতাব অর্থ আল্লাহর নিজস্ব কালাম, যাহা রাসূলের প্রতি নাযিল হইয়াছে এবং যাহাতে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও উপদেশ নসীহত বর্ণিত হইয়াছে। আর ‘আল-হিকমাত’ অর্থ সে সবের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে বিশুদ্ধ ও সঠিক জ্ঞান এবং সে নির্ভূল জ্ঞান অনুযায়ী সঠিক কাজ। বস্তুত এই নির্ভূল জ্ঞান ও তদনুযায়ী সঠিক কাজ করার যথেষ্ট বুদ্ধি প্রত্যেক রাসূলকেই দেওয়া হইয়াছে। নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে ইহা আল্লাহর স্থায়ী ও নির্বিশেষ নিয়ম।
এই নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (স) কেও আল-কিতাব কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে ‘আল হিকমাত’ ও দেওয়া হইয়াছে। কুরআন মজীদের বহু সংখ্যক আয়াতে ইহা স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করা হইয়াছে। এখানে একটি আয়াত উল্লেখ করা যাইতেছে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
হে নবী, আল্লাহ তোমার প্রতি ‘আল-কিতাব’ ও ‘আল-হিকমাত’ নাযিল করিয়াছেন এবং তুমি যেসব কথা জানিতে না, তাহার শিক্ষা তোমাকে দান করিয়াছেন। আর ইহা তোমার প্রতি আল্লাহর এক বিরাট অনুগ্রহ।[সূরা আন-নিসা, ১১৩ আয়াত।]
কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দেওয়া এই ‘আল-হিকমাত’ নিশ্চিতরূপে কুরআন হইতে এক স্বতন্ত্র জিনিস। ইহার সুন্নাত এবং ইহার বিস্তৃত বিবরণ হাদীস সম্পদেই পুঞ্জীভূত রহিয়াছে।[হাদীসকে হিকমাত বলার তাৎপর্য কি, তাহা অনুধাবনীয়। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ ********************** সুন্নাত বা হাদীসকে হিকামত বলার তাৎপর্য এই যে, উহা দ্বারাই হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করা হইয়াছে ***************** এবং কুরআনের মোটামুটি কথার উহার দ্বারা ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।]
‘আল-হিকমাত বা সুন্নাতও যে আল্লাহর নিকট হইতেই অবতীর্ণ, তাহা পূর্বোক্ত আয়াত স্পষ্ট ভাষায় প্রমাণ করে। বস্তুত আল্লাহ তা’আলা বিশ্বমানবতার পথ-নির্দেশের জন্য এবং হিদায়আয়াতের পথে পরিচালনার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র আল-কিতাব নাযিল করাই যথেষ্ট মনে করেন নাই; সেই সঙ্গে রাসূল ও রাসূলের সুন্নাতকেও আল্লাহর তরফ হইতে প্রেরণের প্রয়োজন মনে করিয়াছেন। অন্যথায় শুধুমাত্র ‘আল-কিতাব’ মানুষের প্রকৃত কোন কল্যাণ সাধন করিতে পারিত না।
কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করাও রাসূলেরই অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। নিম্নোক্ত আয়াত এই দৃষ্টিতে সুন্নাত বা হাদীসের গুরুত্ব ঘোষণা করে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
হে নবী, তোমার প্রতি এই কিতাব এই উদ্দেশ্যে নাযিল করিয়াছি যে, তুমি লোকদের জন্য অবতীর্ণ এই কিতাব তাহাদের সম্মুখে বয়ান ও ব্যাখ্যা করিবে এবং এই উদ্দেশ্যে যে, তাহারা ইহা চিন্তা ও গবেষণা করিবে’।[সূরা আন-নাহাল, আয়াত ৪৪; বয়ান’ করার তাৎপর্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনে আবুল বার বলিয়াছেনঃ নবী করীমের কুরআন ‘বয়ান’ করা দুই প্রকারের হইয়াছেঃ প্রথম, কুরআনের মোটামুটি কথার ব্যাখ্যা, যেমন পাঁচবারের নামায ও সময়, উহার সিজদা, রুকু ও অন্যান্য হুকুম আহকাম হইবে তাহা বলা এবং হজ্জের নিয়ম প্রণালী বর্ণনা করা। নবী করীম (স) যখন হজ্জ করিয়াছিলেন, তখন বলিয়াছিলেনঃ ************ ‘আমার নিকট হইতে তোমরা হজ্জের নিয়ম-কানুন গ্রহণ কর’। ইহার প্রয়োজন এই যে, কুরআনে তোম কেবল নামায, যাকাত ও হজ্জের মোটামুটি আদেশ দেওয়া হইয়াছে, এ সবের কোন ব্যাখ্যা করা হয় নাই-কোন বিস্তৃত রূপ দেওয়া হয় নাই। হাদীসই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পেশ করে।(******************)]
আলোচ্য আয়াতের মূল প্রতিপাদ্য কথা এই যে, জনগণের সম্মযখে কুরআনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করাই রাসূলের প্রতি কুরআন নাযিল করা আসল উদ্দেশ্য। বস্তুত কোন বিষয়কে সঠিক রূপ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝাইয়া দেওয়ার জন্য তিনটি কাজ একান্তই অপরিহার্যঃ
প্রথম, মুখের কথা দ্বারা উহার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা, আলোচনার মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক রূপ উদঘাটিত করা।
দ্বিতীয়, নিজ জীবনের কাজ-কর্ম ও বাস্তব জীবনধারার সাহায্যে উহার ব্যবহারিক মূল্য ও গুরুত্ব উজ্জ্বল করিয়াতোলা।
তৃতীয়, লোকদের দ্বারা উহাকে কার্যকর ও বাস্তবায়িত করার জন্য চেষ্টা করা, সঠিকরূপে তাহারা উহার মর্মার্থ অনুধাবন ও অনুসরণ করিতেছে কিনা, সেদিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা; যাচাই ও পরীক্ষা কার্যে আত্মনিয়োাগ করা এবং সিঠকরূপে কার্যকর হইতে দেখিলে তাহাকে সমর্থন ও অনুমোদন দান, আর কোনরূপ ভূল-ক্রন্তি বা ক্রটি বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হইলে তাহার সংশোধন করা।
নবী করীম (স)- এর প্রতি কুরআন নাযিল হওয়ার এই উদ্দেশ্যে ঘোষিত হইয়াছে যে, তিনি কুরআনকে এই তিন-তিনটি দিক দিয়া সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল করিয়া জনসমক্ষে তুলিয়া ধরিবেন। রাসূলে করীম (স) তাঁহার তেইশ বছরের নবুয়তী জীবনে এই দায়িত্ব পূর্ণ মাত্রায় ও যথাযথরূপরে পালন করিয়াছেন। এই দায়িত্ব পালন করিতে গিয়া তিনি যাহা কিছু বলিয়াছেন বা করিয়াছেন, তাহার নির্ভরযেগ্য রেকর্ডই হইতেছে হাদীস। অতএব হাদীস যে কুরআন সমর্থিত এবং কুরআন সমর্তন করে না এমন কোন জিনিস যে হাদীসে পাওয়া যায় না, তাহাতে তো সন্দেহ থাকিতে পারে না। ইমাম শাতেবী এ এ জন্যই লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
সুন্নাতে বা হাদীসে এমন জিনিসই পাওয়া যাইবে, কুরআন যাহার পূর্ণ সমর্থন করে। কুরআন সমর্থন করে না এমন কোন জিনিসই হাদীসে পাইবে না। [১১৫*********]
রাসূলে করীম (স) যে কুরআন মজীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আয়াতের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিয়াছেন, তাহার বাস্তব প্রমাণ হইতেছে হাদীস গ্রন্হসমূহের তাফসীর অধ্যায়সমূহ। যেসব আয়াতের সঠিক অর্থ সাহাবায়ে কিরাম (রা) বুঝিতে পারেন নাই এবং তাহার কারণে তাহারা কাতর হইয়া পড়িয়াছেন, রাসূলে করীম (স) সে সবের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিয়া সাহাবাদের উদ্বেগ দূরীভূত করিয়াছেন। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটির উল্লেখ করা যাইতে পারে। আল্লাহ তা’য়ালার ইরশাদঃ
******************************************************
যাহারা ঈমান আনিয়াছে এবং তাহাদের ঈমানকে কোন প্রকার জুলুমের সহিত মিশ্রিত করে নাই………….
যখন নাযিল হয়, তখন ইহা সাহাবাদের পক্ষে বড়ই উদ্বেগের কারণ হইয়া পড়ে। তায়হারা ইহার সঠিক তাৎপর্য জানিবার জন্য রাসূলের নিকট জিজ্ঞাসা করিলেনঃ
******************************************************
আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে তাহার ঈমানকে জুলুমের সহিত মিশ্রিত করে নাই?
এই প্রশ্ন শুনিয়া নবী করীম (স) বুঝিতে পারিলেন যে, সাহাবায়ে কিরামের নিকট এই আয়াতটি অত্যন্ত দুর্বোধ্য অনুভূত হইয়াছে। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ
******************************************************
তোমরা যেরূপ ধারণা করিয়াছে, আয়াতের অর্থ তাহা নহে। এখানে জুলুম অর্থ শিরক ছাড়া আর কিছু নয়। তোমারা কি শোন নাই, লোকমান তাহার পুত্রকে বলিয়াছেনঃ ‘হে প্রিয় পুত্র, আল্লাহর সাথে শিরক করিও না, নিশ্চয়ই শিরক এক বিরাট জুলুম সন্দেহ নাই। [সহীহ বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, কিতাবুত তাফসীর, ৭০৮ পৃষ্ঠা।]
রাসূলের নিকট উক্ত আয়াতের প্রকৃত ব্যাখ্যা জানিতে পারিয়াই সাহাবায়ে কিরাম সান্তনা লাভ করেন। এই কারণে কুরআন মজীরে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা জানিবার জন্যও বিশ্ব মুসলিম রাসূলের হাদীসের মুখাপেক্ষী। রাসূলের ব্যাখ্যা ব্যাতীত কুরআনের সঠিক তাৎপর্য জানিবার জন্য নির্ভরযোগ্য অপর কোন উপায়ই থাকিতে পারে না।
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হে নবী, তোমার প্রতি এই কিতাব সত্যতা সহকারে নাযিল করিয়াছে এই উদ্দেশ্যে যে, আল্লাহর প্রদর্শিত নিয়ম পদ্ধতি অনুযায়ী তুমি লোকদের মধ্যে বিচার ফয়সালা করিবে।[সূরা আন-নিসা, ১০৫ আয়াত।]
আল্লাহ তা’আলা কিতাব নাযিল করিয়াছেন এই উদ্দেশ্যে যে, রাসূলে করীম (স) লোকদের মধ্যে বিচার ফয়সালা করিবেন, কিন্তু কোন পদ্ধতিতে তাহা করিবেন? ইহার উত্তরে বলা হইয়াছে-************ ‘যে পদ্ধতি আল্লাহ তোমাকে দেখাইয়াছেন’। তাহা হইলে মূল কিতাবও যেমন আল্লাহ নাযিল করিয়াছেন, তদনুযায়ী বিচার-ইনসাফ কায়েম করার নিয়ম পদ্ধতিও ওহীর মাধ্যমেই প্রাপ্ত। [তাফসীরে রুহুল মাআনী, ৫ম খণ্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা। তাফসীরে বায়যাবী, ১ম খণ্ড, ২০৫ পৃষ্ঠা। উভয়ই ************* -এর তাফসীর করিয়াছেন ********* রূ ‘যাহা তোমাকে বুঝাইয়া দিয়াছেন এবং যে বিষয়ে তেমার নিকট ওহী পাঠাইয়াছেন’ বলিয়া।] এব ইহার বিবরণ হাদীসের মারফতেই লাভ করা যাইতে পারে।কুরআন মজীদি সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার আল্লাহ তা’আলা নিজেই গ্রহণ করিয়াছেন। এই সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
নিশ্চয়ই আমার উপর ন্যস্ত রহিয়াছে উহার সংগ্রহ এবং উহার পাঠ অধ্যয়ন। অতএব আমি যখন াঠ করি, তখন তুমি উহার পাঠ অনুসরণ কর। এতদ্ব্যতীত উহার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দানও আমারই কাজ।[সূরা আল-কিয়ামাহ, ১৭, ১৮, ১৯ আয়াত।]
এই আয়াত অনুযায়ী তিনটি কাজের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করিয়াছেনঃ কাজ তিনটি নিম্নরূপঃ
ক) কুরআন মজীন সঞ্চয়ন, সংগ্রহ ও সন্নিবদ্ধকরণ।
খ) কুরআন মজীদের পাঠ শিক্ষা দান।
গ) কুরআনের অর্থ, ভাব ও তাৎপর্য বুঝাইয়া দেওয়া।
কিন্তু এই তিনটি কাজ আল্লাহ তা’আলা কিভাবে সম্পন্ন করিলেন, তাহা বিচার্য। এই কথা সর্বজনবিদিত যে, আল্লাহ তা’আলা জিব্রাঈলের মারফতে কুরআন মজীদ রাসূলকে পড়াইয়া দিয়াছেন, জিব্রাঈলের পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলকেও সেই পাঠের অনুসরণ করিতে বলিয়া রাসূলকে উহার অধ্যয়ন শিক্ষা দিয়াছেন এবং এইভাবে রাসূলের হৃদয়পটে পূর্ণাঙ্গ কুরআনকে সঞ্চিত ও সুসংবদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। আল্লাহর তিনটি কাজের মধ্যে প্রথম দুইটি কাজ এইভাবেই সুসম্পন্ন হইয়াছে। কিন্তু তৃতীয় কাজটি কিভাবে সম্পন্ন করা হইল? আল্লাহ নিশ্চয়ই রাসূলকে কুরআনের অর্থ, ভাব, তাৎপর্য ও কঠিন অংশের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়াছেন এবং তাহা কুরআন হইতে স্বতন্ত্রভাবে করা হইয়াছে। বস্তুত এ প্রসঙ্গে আল্লাহর শিক্ষা দেওয়া যাবতীয় বিষয় হাদীসের মধ্যে সঞ্চিত হইয়া আছে।
ইসলামী জীবনাদর্শের প্রতি বিশ্বাসীদের জন্য হালাল-হারাম নির্ধারণের দায়িত্ব রাসূলের উপর অর্পিত হইয়াছে।রাসূল এই কাজ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবেই আনজাম দিয়াছেন। কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
রাসূল ভাল কাজের আদেশ করেন; খারাপ কাজ হইতে লোকদিগকে বিরত রাখেন; লোকদের জন্য ভাল ও উৎকৃষ্ট জিনিস হালাল করিয়া দেন এবং খারাপ ও নিকৃষ্ট জিনিস হারাম ঘোষণা করেন।[সূরা আল-আরাফ, ১৫৭।]
অতএব রাসূলের যাতবীয় আদেশ-নিষেধ উপদেশ এবং তাঁহার ঘোষিথ হালাল ও হারাম বিশ্বাস করা ও মানিয়া চলা মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য। তাঁহার এই সমস্ত কাজের বিস্তারিত ‘রেকর্ড’ হাদীসের মধ্যে সঞ্চিত হইয়া আছে।রাসূলকে আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের চূড়ান্ত মীমাংসাকারী করিয়া পাঠাইয়াছেন। এই সম্পর্কে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় ঘোষণা দেওয়া হইয়াছে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতেঃ
******************************************************
তোমার আল্লাহর শপথ, লোকেরা কিছুতেই ঈমানদার হইতে পারিবে না, যদি না তাহারা –হে নবী- তোমাকে তাহাদের পারস্পরিক যাবতীয় ব্যাপারে বিচারক ও সিদ্ধান্তকারীরূপরে মানিয়া লয়, তোমার ফয়সালা সম্পর্কে মনে কুন্ঠাহীনতা বোধ করে এবং তাহা সর্বান্তকরণে মানিয়া লয়।[সূরা আন-নিসা, ৬৫ আয়াত।]
জীবনে সমগ্র ক্ষেত্রে রাসূলের আনুগত্য করাও প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। এই সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের মধ্য হইতে দায়িত্বশীল লোকদেরও,,,,,,,,,,,,,,। কোন বিষয়ে তোমরা পরস্পর মতবিরোধ করিলে উহাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরাও।[সূরা আন-নিসা ৫৯ আয়াত।]
এই আয়াতে তিনটি বিভিন্ন সত্তার আনুগত্য করার স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ করা হইয়াছে। প্রথমে আল্লাহর আনুগত্য, দ্বিতীয় রাসূলের আনুগত্য এবং তৃতীয় মুসলিম দায়িত্বশীল লোকদের আনুগত্য। আল্লাহ ও রাসূলের প্রসঙ্গ স্পষ্ট ভাষায় দুই-দুইবার ******* ‘আনুগত্য’ বলার কারণে উভয় আনগত্যই মৌলিক ও স্বতন্ত্র মর্যাদা সম্পন্নরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই নির্দেশ অনুসারে কুরআন মজীদ মানিয়া চলিলেই আল্লাহর আনুগত্য কার্যকর হইতে পারে। কিন্তু ‘রাসূলের আনগত্য কর’ এই আদেশ কার্যকর করার কি পথ?…………… এই জন্য হাদীসকে মানিয়ালওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় হইতে পারে না। পক্ষান্তরে পারস্পরিক বিরোধী বিষয়ের চুড়ান্ত মীমাংসার জন্য আল্লাহর ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করিতে বলা হইয়াছে। আল্লাহ দিকে প্রত্যাবর্তন করা যায় আল্লাহর কিতাবের সাহায্য গ্রহণ করিলে, কিন্তু রাসূলের অবর্তমানে রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করার কি উপায় হইতে পারে? তাহার উপায় হইতেছে রাসূলের সুন্নাত বা হাদীসকে গ্রহণ করা। তাহা করা হইলেই আল্লাহর এই আদেশ পালন করা সম্ভব হইতে পারে। ইহা ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। এই জন্যই উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মায়মুন ইবনে মাহরান বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আল্লাহর প্রতি ফিরানোর অর্থ আল্লাহর কিতাবের প্রতি ফিরানো এবং রাসূলের প্রতি ফিরানোর অর্থ রাসূলে করীমের জীবদ্দশায় তাঁহার নিজের নিকট পেশ করা। আর আল্লাহ যখন তায়হার জান কবজ করিয়া লইলেন তখন ইহার বাস্তব অর্থ তাঁহার সুন্নাতের দিকে ফিরানো। [১২৩*********]
আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানী এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
যদিও প্রকৃতপক্ষে আনুগত্য পাইবার যোগ্য অধিকারী হইতেছেন একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। কিন্তু তাহা সত্বেত্বও রাসূলেরও আনুগত্য করার আদেশ নূতন করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু পরবর্তী ‘উলীল আমর’ ******** এর পূর্বে ‘আনুগত্য কর’ নূতন করিয়াবলা হয় নাই। ইহার কারণ এই যে, মানুষ মানিয়া চলিতে বাধ্য শুধু দুইটি জিনিস, তাহা হইল ‘কুরআন ও সুন্নাহ’। কাজেই এখানে অর্থ হইবে এই, যেসব বিষয়ে কুরআনে স্পষ্ট ফয়সালা করিয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহাতে আল্লাহর আনুগত্য কর, আর যাহা কুরআন হইতে জানিতে পারিয়া তোমাদিগকে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং যাহা সুন্নাতের দলিল দিয়া তোমাদের সামনে প্রমাণ করা হইয়াছে, তাহাতে রাসূলের আনুগত্য কর। ফলে আয়াতের মোট অর্থ দাঁড়াইল এইরূপঃ তিলাওয়াত করা হয় যে ওহী, তাহা হইতে তোমাদিগকে যে হুকুম দেওয়া হইবে, তাহা পালন করিয়া আল্লাহর আনুগত্য কর। আর যে ওহী কুরআন নয়, তাহা হইতে তোমাদিগকে যে হুকুম করা হইবে তাহা পালন করিয়া তোমরা রাসূলের আনুগত্য কর।[*****************************]
আল্লামা তাইয়্যেবী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
আল্লাহর হুকুম ‘রাসূলের আনুগত্য কর’ কথায় আনুগত্যের আদেশের পুনরাবৃত্তি করার কারণে বুঝা গেল যে, রাসূলে করীম (স) স্বতন্ত্র স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী। আর ‘উলীল আমর’- এর ক্ষেত্রে এই শব্দটির পুনরুল্লেখ না হওয়ায় বুঝা গেল যে, ‘উলীল আ্মর’ এমনও হইতে পারে যাহার আনুগত্য করা ওয়াজিব নহে। [১২৫**************]
রাসূলে করীম (স) কে অমান্য করা হইরে তাহাতে কতখানি অপরাধ হইতে পারে? এই সম্পর্কে নিম্নোদ্ধৃত আয়াত হইতে অনেক তত্ত্বই জানিতে পারি। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা যখন পরস্পর পরামর্শে মিলিত হও তখন গুনাহের কাজ, সীমালংঘনমূলক কাজ ও রাসূলের নাফরমানী করার বিষয়ে পরামর্শ করিও না। বরং পরামর্শ কর নেক কাজ ও আল্লাহ ভীতিমূলক কাজ সম্পর্কে। আর আল্লাহকে ভয় করিয়া চল, যাঁহার নিকট তোমাদের সকলকেই একত্রিত করা হইবে।[সূরা মুযাদালাহ, আয়াত নং ৯]
এই আয়াতে রাসূলকে অমান্য করিতে স্বতন্ত্রভাবে নিষেধ করা হইয়াছে। একদিকে পাপ, সীমালংঘন ও রাসূলের অনানুগত্য বা নাফরমানীর কথা উল্লেখ করা হইয়াছে, অপরদিকে উল্লেখ করা হইয়াছে নেকী ও আল্লাহ ভীতিমূলক কাজের। ইহার অর্থ এই যে, রাসূলের অবাধ্যতা ও অনানুগত্য করিলে যেমন গোনাহ ও সীমালংঘন করা হয়, অনুরূপভাবে সকল কল্যাণ নেকী ও আল্লাহভীতি হইতেও বঞ্চিত ইতে হয়। আয়াতের শেষাংশে পরকালের কথা উল্লেখ করিয়াবলা হইয়াছে যে, রাসূলকে অমান্য ও অনানুগত্য করিলে কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।
রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ মুসলিম জীবনের এক চিরন্তন কর্তব্য। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
অতএব তোমরা আল্লাহ এবং তাঁহার ‘উম্মী’ নবীর প্রতি ঈমান আন; যে নবী নিজে আল্লাহ এবং তাঁহার বাণীর প্রতি ঈমানদার এবং তোমরা তাহার অনুসরণ করিয়া চল। [সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৫৯]
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হইয়াছেঃ
******************************************************
রাসূল তোমাদিগকে যাহা কিছু দান করে তাহা পূর্ণরূপে তোমরা গ্রহণ ও ধারণ কর; আর যাহা হইতে নিষেধ করে, তোমরা তাহা হইতে বিরত থাক। (রাসূলের আদেশ-নিষেধ মানিয়া চলার ব্যাপারে) আল্লাহকে ভয় কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।[সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭]
রাসূলের আদেশ-নিষেধ অমান্য বা তাঁহার বিরোধিতা করিলে আল্লাত তা’আলা কঠোর শাস্তি দান করিবেন। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
রাসূলের আদেশের যাহারা বিরোধিতা করে, তাহাদের ভয় করা উচিত যে, তাহাদের উপর কোন বিপদ মুসীবত আসিতে পারে অথবা কোন পীড়াদায়ক আযাবে তাহারা নিক্ষিপ্ত হইতে পারে।[সূরা আন-নূর, আয়াত-৬৩]
রাসূলের ‘ইতায়াত’ বা আনুগত্য স্বীকার করা এবং বাস্তব জীবন তাঁহাকে অনুসরণের ভিত্তিতে যাপন করার উপরই মানুষের হিদায়াত ও কল্যাণ লাভ একান্তভাবে নির্ভরশীল।
আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ
******************************************************
তোমরা রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করিলেই হিদায়াত প্রাপ্ত হইবে।[সূরা আন-নূর, আয়াত- ৫৪]
আবার আল্লাহর আনুগত্যও নির্ভর করে রাসূলের আনুগত্যের উপর। অন্য কথায়, রাসূলের আনুগত্য না করিলে আল্লাহর আনুগত্য করা সম্ভব হইতে পারে না। এই কথাই স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছে নিম্নোক্ত আয়াতেঃ
******************************************************
যে লোক রাসূলের আনুগত্য করিবে, সে-ই ঠিক আল্লাহর আনুগত্য করিল।[সূরা আন-নিসা, আয়াত-৮০]
‘ইত্তিবা’ ও ‘ইতয়াতে’ রাসূল
উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলেরও আনুগত্য ও অনুসরণ করার জন্য স্পষ্ট ভাষায় আদেশ করা হইয়াছে। আল্লাহর এই আদেশকে সঠিকরূপে অনুধাবন করার জন্য কুরআনে ব্যবহৃত ‘ইত্তিবা’ ও ‘ইতায়াত’ শব্দদ্বয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আবশ্যক। এখানে আমরা এই শব্দ দুইিট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করিব।
আরবী ভাষায় ‘ইত্তিবা’ (*******) বলা হয় কোন ব্যক্তির পিছনে পিছনে চলাকে। ইবনে মনজুর তাঁহার বিখ্যাত অভিধান গ্রন্হ ‘লিসানুল আরব’-এ বলিয়াছেনঃ
******************************************************
অভিধান ও ব্যাকরণ শাস্ত্রের ইমাম ফরা বলেনঃ ইত্তিবা বলিতে বুঝায়ঃ কোন ব্যক্তি অগ্রে অগ্রে চলে এবং তুমি তাহার পিছনে পিছনে চল। এখন তুমি যদি বল, আমি তাহার ‘ইত্তিবা’ করি, তবে বুঝাইবে যে, তুমি তাহার পদাংক অনুসরণ করিয়া পিছনে পিছনে চলিতেছ।[*****************]
‘তাজুল উরুস’ গ্রন্হে বলা হইয়াছেঃ
******************************************************
‘তুব্বু’ বা ‘তুব্বু’ যেমন সুক্কারু, অর্থ ছায়া। উহাকে ছায়া বলা হয় এই জন্য যে, উহা সব সময়ই সূর্যের অনুসরণ করিয়া চলে। এই সম্পর্কের দৃষ্টিতে মধুমক্ষিকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ও সর্বোক্তম (পুরুষ) মক্ষিকাকেও ‘তুব্বা’ বলা হয়। কেননা সমস্ত সাধারণ মক্ষিকা উহাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করিয়া চলে।[*******************]
ইমাম আবুল আল-আ-মদী উহার পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসংগে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
‘মুতাবিয়াত-অনুসরণ- কখনো কথার ব্যাপারে হয়, কখনো কোন কাজ করা বা না করার ব্যাপারে হয়। কথার ব্যাপারে ‘ইত্তিবা’ হইতেছে কথার দাবি ও প্রকৃতি অনুযায়ী কাজ করা। আর কাজের ক্ষেত্রে ‘ইত্তিবা’ হইতেছে কাহারো কাজ দেখিয়া তাহা এমনভাবে করা ঠিক যেভাবে সে করিতেছে। এবং সে করিতেছে বলিয়াই সেই কাজ করা হইবে।[***************]
এই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যাইতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলার নির্দেম অনুযায়ী রাসূলের ‘ইত্তিবা’ করার জন্য রাসূলের প্রত্যেকটি কথা এমনভাবে পালন করিতে হইবে, যেমনভাবে পালন করা তাঁহার কথার লক্ষ্য ও দাবি এবং রাসূলের কাজগুলিকে যেভাবে তিনি সম্পন্ন করিয়াছেন ঠিক সেইভাবেই সম্পন্ন করিতে হইবে। অন্যথায় রাসূলকে ‘ইত্তিবা’ করার আল্লাহর আদেশ পালন হইতে পারে না।
‘ইতায়াত’ (**********) শব্দটিও অনুরূপভাবে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। আরবী ভাষায় ‘ইতায়াত’ বলা হয় কাহারো সম্মখে আনুগত্যের মস্তক অবনমিত করাকে, কাহারো হুকুম আহকামযথাযথরূপে পালন করাকে।
‘লিসানুল আরব’ গ্রন্হে উল্লেখ করা হইয়াছেঃ
******************************************************
‘তাহযীব’ নামক প্রামাণ্য অভিধান গ্রন্হে বলা হইয়াছে ************* কথাটির অর্থ কাহারো সম্মুখে আনুগত্যের মস্তক নত করিয়া দেওয়া। কেহ যদি অপর কাহারো আদেশ পালন করে, তখন বলা হয় ********** সে তাহার আনুগত্য করিল।[*****************]
ইমাম আবুল হাসান আল-আ-মদী ‘ইতায়াত’ শব্দর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
কাহাকেও বড় জানিয়া বা বড় করার উদ্দেশ্যে যদি কেহ তাহার মত কাজ করে, তবে সে তাহার ‘অনুগত হইল’ বলা হয়।[******************]
‘ইত্তিবা’ ও ‘ইতায়াত’ শব্দদ্বয়ের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের এই আলোচনা হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইল যে, রাসূলের কথাও কাজকে পুরাপুরি মানিয়া লওয়া এবং যথাযথরূপে পালন করা এক কথায় তাহার পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য ও অনুসরণ করা মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য। আর রাসূলের যাবতীয় কথা ও কাজের বিবরণ যেহেতু হাদীসের মাধ্যমেই জানা যাইতে পারে, এজন্যই দ্বীন-ইসলামে হাদীসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
এই প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের আর একটি আয়াতের উল্লেখ করা আবশ্যক বোধ হইতেছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
কোন বিষয়ে আল্লাহ ও রাসূলের ফযসালা এবং ফরমান আসার পর তাহা মানা-না- মানার ব্যাপারে মু’মিন পুরুষ ও স্ত্রীলোকের কোন ইখতিয়ারই থাকিতে পারে না। সে লোক আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের নাফরমানী করে, সে পথভ্রষ্ট হইয়া ইসলাম হইতে বহুদূরে চলিয়া যায়।[সূরা আল-আহযাব, ৩৬ আয়াত।]
এই আয়াত হইতে একসঙ্গে তিনটি কথা জানা যায়। প্রথশ এই যে, কোন বিষয়ে আল্লাহর যেমন স্বাধীনভাবে কোন ফয়সালা করার বা ফরমান দেওয়ার অধিকার আছে, আল্লাহর রাসূলেরও ঠিক সেইরূপ অধিকার আছে। দ্বিতীয় এই যে, মু’মিন স্ত্রী-পুরুষ যেমন আল্লাহর ফরমান ও ফয়সালা মানিয়া লইতে বাধ্য, রাসূলের ফয়সালা ও ফরমানও অনুরুপভাবে মানিয়া লইতে বাধ্য। তৃতীয় এই যে, আল্লাহর ফরমান ও ফয়সালা না মানিলে যেমন মানুষ গোমরাহ ও কাফির হয়, রাসূলের ফয়সালা ও ফরমান না মানিলেও সেইভাবেই গোমরাহ ও কাফির হইতে হয়।
অতএব কুরআন মজীদের মত রাসূলের ফরমান ও ফয়সালা নির্ভরযোগ্য রেকর্ড-হাদীস- মানিয়া লওয়াও প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানদার হওয়া এবং ঈমানদার হইয়া জীবন যাপন করার জন্য একান্তই অপরিহার্য।