হাদীস লিখন
হাদীস সংরক্ষণের যে স্বাভাবিক ব্যবস্থার বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে পেশ করা হইয়াছে, হাদীস সংরক্ষণের মূলে তাহাই একমাত্র উপায় ছিল না। বরং ইহা হইতেও অধিকতর দৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে হাদীস সংরক্ষিত হইয়াছে। হাদীস সংরক্ষণের এই ব্যবস্থা হইতেছে হাদীস লিখন।
হাদীস সম্পর্কে সাধারণ একটি ভূল ধারণা অনেক লোকের মনেই বদ্ধমূল দেখা যায়। হাদীসরে শক্রগণ উহাকে হাদীসের অমৌলিকত্ব ও অপ্রামাণিকতা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে একটি যুক্তি হিসাবে পেশ করিয়া থাকে। তাহা এই যে, হাদীস নবী করীম (স)- এর জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ হয় নাই, হইয়াছে তাঁহার ইন্তেকালের শতাব্দীকাল পরে। অতএব তাঁহাদের মতে হাদীস বিশ্বাসযোগ্য নহে।
কিন্তু হাদীস সংরক্ষণের ইতিহাস সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করিলে একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, এই ধারণা আদৌ সত্য নহে, বরং ইহা শক্রদের অপপ্রচার ও মিথ্যা রটনা মাত্র। ইতিহাস ইহার তীব্র প্রতিবাদ করে।বস্তুত হাদীস সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি এতখানি ভিত্তিহীনি ও অপ্রমাণিত থাকিতে পারে না। ইহার সংরক্ষনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সম্ভাব্য ব্যবস্থাই যথাসময়ে গ্রহণ করা হইয়াছে। ইহাকে যেমন মুখস্থ করা ও স্মরণ রাখা হইয়াছে, নানাভাবে ইহার চর্চা করা হইয়াছে; অনুরূপভাবে ইহার জন্য যথাসময়ে ও যথেষ্ট পরিমাণে লেখনী শক্তিরও ব্যবহার এবং প্রয়োগ হইয়াছে- আর সর্বোপরি এই সব ব্যবস্থার মধ্যে কোন একটিরই উপর একান্তভাবে নির্ভর করা হয় নাই, একটির উপর নির্ভর করিয়া অন্য সব উপায়ের প্রতি কিছুমাত্র উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয় নাই। বরং একই সঙ্গে ও প্রায় একই সময় এই সব ব্যবস্থাই একটি শ্রেণী পরস্পরা নিমানুযায়ী কার্যকর করা হইয়াছে। হাদীস লিখন সম্পর্কে আমাদের বর্তমান পর্যায়ের আলোচনা হইতেই তাহা পাঠকদের সম্মুখে উজ্জ্বল হইয়া উঠিবে।
প্রথমেই উল্লেখ করিয়াছি, নবুয়্যাতের প্রথমকালে যখন কুরআন মজীদ নাযিল হইতেছিল, তখনই রাসূলে করীম (স) তাহা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিবার জন্য বহু ‘ওহী লেখক’ নিযুক্ত করিয়াছিলেন।[************ এক বিবরণ অনুযায়ী ওহী লেখকদের সংখ্যা ছিল অন্ততপক্ষে চল্লিশজন।**********] হযরতের প্রতি কোন আয়াত বা সূরা নাযিল হইলেই তাহা একদিকে যেমন তিনি সমবেত ইসলামী জনতাকে একটি ভাষণের ন্যায় মুখস্থ পড়িয়া শোনাইতেন, অপরদিকে সেই সঙ্গে উক্ত ওহী লেখকদের দ্বারা তাহা সঠিকরূপে লিখাইয়ও রাখিতেন। ইহা ছিল রাসূলে করীমের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘সরকারী’ ব্যবস্থা। ইহার ফলেই রাসূলের জীবনের শেষভাগ পর্যন্ত কুরআন মজীদ পূর্ণ লিখিত ও সংরক্ষিত রূপ লাভ করিতে সমর্থ হয়।
কিন্তু এই সময় কেবল যে নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘ওহী লেখক’-ই ওহী বা কুরআন লিখিয়া রাকিতেন, আর অপর কোন সাহাবী তাহা লিখিতেন না, তাহা নহে। বরং রাসূলে করীম কর্তৃক নিযুক্ত লেখক ছাড়া আরো বহু সাহাবী রাসূলের দরবারে উপস্থিত থাকিয়া নিজস্বভাবে কুরআনের আয়াত লিখিয়া রাখিতেন।
রাসূলে করীমের হাদীস লিখনের ব্যাপারেও আমরা তাহাই দেখিতে পাই। সেখানে কিছু সংখ্যক সাহাবী রাসূলের অনুমতিক্রমে এবং বহ লোক নিজস্বভাবে স্বকীয় উদ্যোগে হাদীস লিখিয়া রাখিতে শুরু করেন। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে ইহাতে একটি অসুবিধা দেখা দেয়। তাহা এই যে, বহুসংখ্যক সাহাবী রাসূলের নিকট হইতে যাহা কিছুই শুনিতে পাইতেন, তাহা আল্লাহর বাণী হউক কি রাসূলের নিজস্ব কথা- সবই একসঙ্গে ও একই পাত্রে লিখিতে শুরু করেন। ইহার ফলে কুরআন ও হাদীস সংমিশ্রিত হইয়া যাওয়ার এবং উহাদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা কঠিন হইয়া পড়ার তীব্র আশংকা দেখা দেয়। আর ইহার পরিণাম যে কত ভয়াবহ, তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়। নবী করীম (স) ইহাকে কিছুতেই সমর্থন করিতে পারেন না। এইরূপ লেখকদের লিখিত জিনিস দেখিয়া তিনি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এই প্রসঙ্গে হযরত আবূ সাঈদ (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হইয়াছেঃ একদা কিছু সংখ্যক সাহাবী বসিয়া লিখিতেছ? তাঁহারা বলিলেনঃ *********** ‘আপনার নিকট হইতে যাহা শুনিতে পাই, তাহাই আমরা লিখিয়া লইতেছি। তখন তিনি বলিলেনঃ *********** আল্লাহর কিতাবের সংগে মিশাইয়া আর একখানা কিতাব লিখিত হইতেছে কি?
ইহার অথ এই যে, কুরআন ও হাদীস একত্র মিলাইয়া মিশাইয়া লিপিবদ্ধ করা ও উহাদের মধ্যে পার্থক্য করার কোন ব্যবস্থা না করা কুরআনের চিরস্থায়ী ও অক্ষুণ্নতার পক্ষে যেমন মারাত্মক, তেমনি মারাত্মক দ্বীন-ইসলামেন ভিত্তির দৃঢ়তা ও নির্ভরযোগ্যতার পক্ষেও। এই কারণে রাসূলে করীম (স) তাঁহাদিগকে আদেশ দিলেনঃ
******************************************************
এইরূপ লেকার নিয়ম তোমরা ত্যাগ কর। কেবলমাত্র আল্লাহর কিতাব খালিসভাবে লিপিবদ্ধ কর। উহার সহিত অন্য কিছুই মিলইও না।
ফলে এইসব সাহাবী কর্তৃক কুরআন ও হাদীস মিলাইয়া যাহা কিছু লিখিত হইয়াছিল, তাহা সব বিনষ্ট করিয়া দেওয়া হয়, অতঃপর কুরআনকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে লিপিবদ্ধ করা হইতে থাকে।[মুসনাদে ইমাম আহমদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭১, মজমায়ুজ জাওয়ায়িদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫২।]
রাসূলে করীমের এই কাজ ও কথার যৌক্তিকতা একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায়। কুরআনকে যদি কোন একজন সাহাবীও হাদীসের সঙ্গে একত্র করিয়া লিখিয়া রাখিতেন, তাহা হইলে উত্তরকালে উহা কুরআন মজীদের নির্ভরযোগ্যতার বিরুদ্ধে এক চ্যালেঞ্জ হইয়া দাঁড়াইত। কুরআন মজীদকে বর্তমানের ন্যায় খালিসভাবে অবিকৃত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক মহান গ্রন্হ হিসাবে দুনিয়ার মানুষ কিছুতেই লাভ করিতে পারিত না; আল্লাহর কালাম এবং রাসূলের কথা ও কাজের বিবরণকে আলাদা আলাদাভাবে জানিতে ও চিহ্নিত করিতে সমর্থ হইত না। এই কারণে প্রতশ পর্যায়ে নবী করীম (স) কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিপিবদ্ধ করিতে সাহাবাগণকে স্পষ্ট ও তীব্র ভাষায় নিষেধ করিয়াছিলেন; কিন্তু উহার মৌখিক প্রচার ও বর্ণনা করিতে রাসূলে করীম (স) আদৌ নিষেধ করেন নাই। নবী করীম (স)-এর বাণী নিম্নরূপঃ
******************************************************
আমার কোন কথাই লিখিও না। কুরআন ব্যতীত আমার নিকট হইতে অন্য কিছু কেহ লিখিয়া থাকিলে তাহা মুছিয়া ফেল। তবে আমার কথা বা আমার সম্পর্কে কথা মৌখিক বর্ণনা কর, তাহাতে দোষ নাই। কিন্তু মৌখিক বর্ণনায়ও যেন কোন প্রকার মিথ্যার প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। বস্তুত যে আমার সম্পর্কে কোন মিথ্যা কথা বলিবে, সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় গ্রহণ করে।[সহীহ মুসলিম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪১৪, আবু সাঈদ খুদরী বর্ণিতঃ *****************************]
হযরত আবূ সাঈদ বর্ণিত আর একটি হাদীস নিম্নরূপঃ
******************************************************
আমরা রাসূল (স)-এর নিকট (কুরআন ছাড়া অন্য কথা-হাদীস) লিপিবদ্ধ করিয়া রাখার অনুমতি চাহিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি আমাদিগকে অনুমতি দেন নাই।[*****************]
হযরত যায়দ ইবন সাবিত (রা) হইতেও এই অর্থেরই একটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তাহা এইঃ
******************************************************
রাসূলে করীম (স) আমাদিগকে (কুরআন ব্যতীত) কোন কিছুই না লিখিতে আদেশ করিয়াছেন।[ঐ]
কুরআন ব্যতীত কোন কিছু লিখিতে নিষেধ করার ও সেই ‘অন্য কিছু’ লিখিবার অনুমতি না দেওয়ার গভীর তাৎপর্য রহিয়াছে। রাসূলে করীম (স)- এর এইরূপ করার মুলীভুত কারণ কি, তাহা অবশ্যই প্রণধানযোগ্য।
ইহার প্রথশ কারণ কুরআনের সাথে অন্য জিনিস মিলাইয়া মিশাইয়া লিখায় ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আশংকা। এই সময় পর্যন্ত মুসলমানগণ সাধারভাবে কুরআনের বিশেষ ভাষা, ভাব ও বাণী এবং উহার গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাবধারার সহিত পুরামাত্রায় পরিচিত হইতে পারেন নাই। কুরআন ও অ-কুরআনের মাঝে পার্থক্য করার মত তীক্ষ্ম দৃষ্টি ও বিবেক-বুদ্ধিও তাহাদের মধ্যে তখনও জাগ্রত হয় নাই। ইহার দ্বিতীয় কারণ এই যে, রাসূলে করীম (স)- এর এই নিষেধ ছিল সেই সব সাহাবীদের প্রতি, যাহাদের স্মরণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর, যাঁহারা কানে শুনিয়া খুব সহজেই স্মৃতিপটে মুদ্রিত করিয়া লইতে পারিতেন, কিছু মাত্র ভুলয়া যাইতেন না। কেননা এই শ্রেণীর সাহাবিদণও যদি লেখনীর উপর নির্ভরশীল হওয়ার অভ্যাস করিতে শুরু করেন, তাহা হএল স্মৃতিশক্তির প্রাখর্য হ্রাস পাওয়ার নিশ্চিত আশংকা রহিয়াছে। এবং এইভাবে আল্লাহর এ মহান নিয়ামতের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন কিছুতেই উচিত হইতে পারে না।[***********************]
ইমাম নববী ও সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
******************************************************
হাদীস লিখিতে প্রথমত নিষেধ করা হইয়াছিল। কুরআন পরিচিত হওয়ার পূর্বে এই নিষেধ ছিল প্রত্যেকেরই জন্য। তখন কুরআন ব্যতীত অপর কোন কিছুই লিখিয়া রাখিতে নিষেধ করা হইয়াছিল কুরআনের সঙ্গে উহার মিশ্রিত হওয়ার ও তদ্দরুন সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে। পরে যখন কুরআন সর্বজনপরিচিত হ্য় এবং এই ভয়ের কারণ হইতে নিরাপত্তা লাভ হয় তখন উহা লিখিবার অনুমতি দেওয়া হয়।
আর দ্বিতীয়ত যাঁহাদের স্মরণশক্তি নির্ভরযোগ্য ছিল, তাঁহারা কেবল লেখনীর উপর নির্ভর করিয়া বসিতে পারে- এই ভয়ে তাঁহাদিগকে লিখিতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু সে নিষেধের ফলে লেখা মূলতই হারাম ছিল না। যাঁহাদের স্মরণশক্তি নির্ভরযোগ্য ছিল না, তাঁহাদিগকে হাদীস লিখিয়া লওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।[*******************]
ইমাম খাত্তাবী এই প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
মনে হয় হাদীস লিখিতে নিষেধ করা প্রথশ যুগের ব্যাপার ছিল। পরবর্তীকালে ইহা জায়েয করা হইয়াছে। আর নিষেধ করা হইয়াছিল কুরআনের সহিত মিশাইয়া একই কাগজে হাদীসি লিখিতে। কেননা তাহার ফলে কুরআন ও হাদীস সংমিশ্রিত হইয়া যাইত এবং তাহা পাঠকদের পক্ষে বড় সন্দেহের ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইত।[**********]
ইমাম নববী ও ইমাম খাত্তাবীর এই বিশ্লেষণ হইতে প্রমাণিত হয় যে, প্রথম পর্যায়ে সকলকেই কুরআন ব্যতীত অপর কিছু লিখিতে নিষেধ করা হইলেও তাহাতে ব্যতিক্রম ছিল। নবী করীম (স) সাহাবীদের স্মরণশক্তিকে পূর্ণ মাত্রায় প্রয়োজনীয় কাজে প্রয়োগ করিতে চাহিয়াছিনে। এই কারণে প্রচণ্ড স্মরণশক্তিসম্পন্ন লোকদিগকে হাদীস মুখস্থ করা পরিত্যাগ করিয়া কেবল লেখনী শক্তির উপর নির্ভরশীল হইতে নিষধ করিয়াছিলেন। কিন্তু যাঁহারা স্মরণশক্তি ও লেখনী উভয় শক্তির ব্যবহার করিতে চাহিয়াছেন, তাঁহাদিগকে তিনি হাদীস লিখিতে নিষেধ করেন নাই। বরং তাঁহাদিগকে অনুমতিই দিয়াছেন। নিম্নের হাদীস হইতেও এই কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ঃ
******************************************************
আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি রাসূলের নিকট আসিয়া বলিলেনঃ হে রাসূল ! আমি হাদীস বর্ণনা করিতে চাহি। এইজন্য আমি স্মরণশক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে লেখনীর ও সাহায্য গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, অবশ্য আপনি যদি তাহা পছন্দ করেন। তখন নবী করীম (স) বলিলেনঃ আমার হাদীস লিখিতে চাহিলে উহা স্মরণ রাখার সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়অ রাখার কাজও করিতে পার।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৭।]
শুধু তাহাই নয়, নবী করীম (স)- এর দরবারে বহু সংখ্যক লেখনীধারক লোকই সব সময় উপস্থিত থাকিতেন এবং রাসূলের মুখে যে কথাই তাঁহারা শুনিতে পাইতেন, তাহাই লিখিয়া লইতেন- তাহাও এক ঐতিহাসিক সত্য। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমরের নিম্নোক্ত কথা হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়ঃ
******************************************************
আমরা বহু কয়জন লোক রাসূলের চতুর্থাংশে লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এমন সময় রাসূলে করীম (স)-কে প্রশ্ন করা হইলঃ কনস্টান্টিনোপাল নগর প্রথম বিজিত হইবে, না রোম? উত্তরে তিনি বলিলেনঃ না হেরাক্লিয়াসের শহুর কনস্টান্টিনোপালই প্রথম বিজিত হইবে।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৬৮।]
এই বর্ণনায় প্রথম বাক্যটি প্রণিধানযোগ্য। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলে করীম (স) যখনই দরবারে বসিতেন, তখনই তাঁহার চারিপার্শ্বে লেখকগণও বসিয়া যাইতেন। আর এই সব দলীল-প্রমাণ হইতে এই কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, প্রথম পর্যায়ে প্রধানত কেবলমাত্র কুরআন মজীদই লিপিবদ্ধ হইতে থাকে। আর হাদীসি লেখার জন্য সরকারী পর্যায়ে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয় নাই। তখন হাদীস সাধারণভাবে মুখস্থ করা, মৌখিক চর্চা, বর্ণনা ও আলোচনার মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়। এইভাবে কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর সাহাবিগণকে হাদীসলেখার সাধারণ অনুমতি দেওয়া হয়। তখন হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে কুরআনের মতই সাহাবীদের স্মরণশক্তি, পারস্পরিক চর্চা ও বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে লেখনীশক্তিরও পূর্ণ ব্যবহার হইতে থাকে।[**************]
ইবনে কুতাইবা লিখিয়াছেনঃ
প্রথমে হাদীসি লিখিতে নিষেধ করেন এবং পরে লিখিয়া হিফাজত করার প্রযোজনীয়তা বুঝিতে পারেন।[************]
আল্লামা ইবন জাওযী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
প্রথমাবস্থায় লিখিতে নিষেধ করিয়াছেন। পরে লিখিবার অনুমতি দান করেন।[*************************]
এই পর্যায়ে তিনি সাহাবীদের লক্ষ্য করিয়া স্পষ্ট ভাষায় বলেনঃ
******************************************************
ইলমে হাদীসকে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখ।[***************]
ইলমে হাদীসকে লিখন সম্পর্কিত মূল মাসালাটি সম্পর্কে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা অবতারণা করা আবশ্যক। হাদীস লিখিয়া রাখা আদৌ জায়েয ছিল কিনা, সে বিষয়েও মতভেদ রহিয়াছে। আমাদের মতে হাদীস লিখিয়া রাখা শুধু জায়েযই নহে, ইহা ছিল দ্বীনের এক অতি জরুরী কাজ। স্বয়ং কুরআন মজীদ সবরকমের জরুরবী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লেখনী ব্যবহারের স্পষ্ট নির্দেশ দিয়াছেন। আল্লাহ তা’আল্লা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
******************************************************
লেন-দেন ছোট হউক কি বড় ব্যাপার হউক, নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্তের জন্য তোমরা লিখিয়া রাখিতে একবিন্দু অবহেলা করিও না। লিখিয়া লওয়া আল্লাহর দৃষ্টিতে খুবই ইনসাফপূর্ণ, প্রমাণ রক্ষার জন্য সুষ্ঠু ও সন্দেহ হইতে বাচিঁবার জন্য অতি উত্তম ব্যবস্থা।[সূরা আল-বাকারা, ২৮২ আয়াত। মনে রাখা আবশ্যক যে, এই সূরাটি হিজরতের পর মদীনীয় জীবনের প্রথম অধ্যায়েই নাযিল হইয়াছিল এবং এই সময়ই সব লিখিয়া লইবার তাকীদ করায় হাদীস লিখিয়া রাখার কাজও সাহাবীগণ অবশ্যই করিয়া থাকিবেন। ফলে ইহাকে রাসূলে করীম (স) নিশ্চয়ই নিষেধ করেন নাই।]
ইমাম আবু হানিফা (র) এই আয়াতের ভিত্তিতে যুক্তি পেশ করিয়া বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আল্লাহ তা’আলা যখন সাধারণ লেনদেনের ব্যাপারও সন্দেহ সৃষ্টির আশংকা লিখিয়া লইতে আদেশ করিয়াছেন, আর ইলম –ইলমে হাদীস- মুখস্ত করিয়া রাখা যখন লেনদেনের কথা স্মরণ রাখা অপেক্ষা অনেক কঠিন, তখন এই সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টির ভয়ে তাহা লিখিয়া লওয়া বৈধ হওয়া অধিক প্রয়োজন ও সবচাইতে বেশী উপযুক্ত ব্যাপার।[*********************]
আল্লামা আবূ মলীহ অপর এক আয়াতের ভিত্তিতে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
লোকেরা মুহাদ্দিসগণকে হাদীস লিখিয়া রাখার জন্য দোষ দেয়। অথচ আল্লাহ তা’আলা নিজেই বলিয়াছেনঃ পূর্বের জাতিসমূহের অবস্থা আল্লাহর নিকট লিখিতভাবে সংরক্ষিত রহিয়াছে।[***************]
অথচ আল্লাহ তা’আলা না বিস্মৃত হন, না বিভ্রান্ত হন। এমতাবস্থায়, মানুষ ভূল-ভ্রান্তির প্রতিমূর্তি হইয়াও লিখার প্রয়োজন হইতে কিরূপে মুক্ত হইতে পারে?
অতএব, হাদীস লিখিয়া রাখা কোন কালেই সম্পূর্ণ হারাম ছিল না। শুরুতে উহাকে সাধারণভাবে মুলতবী রাখা হয়- যদিও এই সময় বিশেষ ব্যক্তিতে ইহার অনুমতিও দেওয়া হইয়াছিল।
এই পর্যায়ে যে মতভেদের উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহার বিশেষ কোন মূল্য নাই। একেবারে প্রাথমিককাল ছাড়া সবসময়ই হাদীস লিখিয়া রাখা সম্পূর্ণ জায়েয ছিল।
ইবনুস সালাহ লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
পরে এই মতভেদ দূর হইয়া যায় এবং হাদীস লিখিয়া রাখা মুবাহ হওয়া সম্পর্কে সমস্ত মুসলমানই একমত হন। কেননা উহা যদি তখন লিখিত না হইত, তাহা হইলে শেষকালে উহা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হইয়া যাইত।[***************]