হাদীস লিখনে উৎসাহ দান
তাবেয়ী হাদীসবিদগণ তাঁহাদের নিকট হাদীস শিক্ষার্থীদিগকে হাদীস লিখিয়া লইতে বিশেষ উপদেশ দান করিতেন। সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিবের হাদীসের ছাত্র আবদুর রহমান ইবনে হারমালাতা তাঁহার নিকট তাঁহার স্মরণশক্তির দুর্বলতার অভিযোগ করিলে তিনি তাঁহাকে সব হাদীস লিখিয়া লইবার উপদেশ দিয়াছিলেন।[********************] শা’বী তো তাঁহার ছাত্রদের নিকট রাসূলে করীমের কথিত এবং সাহাবা ও তাবেয়ী’দের দ্বারা বহু বর্ণিত হাদীসটি বারবার আবৃত্তি করিতেন। সেই হাদীসটি হইলঃ
******************************************************
লেখার কাজ হইল হাদীসের ইলমকে ধরিয়া রাখা।[********************]
হাদীস লিখিয়া রাখার যে ফায়দা রহিয়াছে তাহা তিনি বিশেষভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিয়া বুঝাইয়া দিতেন। তিনি বলিতেনঃ
******************************************************
তোমরা আমার নিকট হইতে যেসব হাদীস শুনিতে পাও তাহা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লিখিয়া লইবে- তাহা প্রাচীরগাত্রে লিখিতে হইলেও বিরত হইবে না।[********************]
তাঁহার সম্পর্কে জানা গিয়াছে যে, তিনি নিজেও বিশেষ বিশেষ হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতেন। সেই কারণেই তাঁহার ইন্তেকালের পর ফারায়েজ ইত্যাদি সম্পর্কিত হাদীসমূহ সংকলিত এক গ্রন্হ পাওয়া যায়।[********************]
মুজাহিদ ইবনে যুবায়র (মৃঃ ১০৩ হিঃ) লোকদের সঙ্গে লইয়া তাঁহার কক্ষে প্রবেশ করিতেন ও তাঁহাদের সামনে স্বীয় হাদীস সংকলনসমূহ পেশ করিতেন। তাহারা তাহা হইতে হাদীস নকল করিয়া লইত।[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ১২৮। ************]
আতা ইবনে আবূ রিবাহ (মৃঃ ১১৪ হিঃ) নিজেও হাদীস লিখিয়া রাখিতেন এবং অন্যদের তাহা করিতে উপদেশ দিতেন।[********************]
কাতাদাহ ইবেন দায়ামাতা হাদীস লিখন সম্পর্কে যে-কোন প্রশ্নকারীকে অসংকোচে ও জোরালো ভাষায় বলিতেনঃ
******************************************************
তোমাকে লিখিয়া রাখিতে কে নিষেধ করিতেছে? মহান আল্লাহ নিজেই সব কিছু লিখিয়া রাখার কথা ঘোষণা করিয়াছেন এই বলিয়াঃ কিয়ামত সম্পর্কিত ইলম আমার আল্লাহর নিকট লিখিত রহিয়াছে, অথচ তিনি না ভ্রষ্ট হন, না ভুলিয়া যান।[******************** আয়াতটি সূরা তা-হা’র ৫২ নং আয়াত।]
উমর ইবনে আবদুল আযীয
(জন্ম-৬১ হিঃ মৃত্যু-১০১ হিঃ)
উমর ইবনে আবদুল আযীয তাবেয়ী ইলমে হাদীসে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি প্রথমত মদীনায় মুহাদ্দিস সালেহ ইবেন কাইসানের নিকট হাদীস ও দ্বীনী-ইল শিক্ষা সম্পর্ক স্থাপন, পারস্পরিক চর্চা ও আলোচনার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন এবং হাদীসের অনন্যসাধারণ জ্ঞান ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ ‘আমি যখন মদীনা হইতে চলিয়া গেলাম, তখন আমার অপেক্ষা (হাদীসে) বড় আলিম আর কেহ ছিল না।[********************]
হাফেয যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
উমর ইবনে আবদুল আযীযী ইমাম, ফিকাহবিদ, মুজতাহিদ, সুন্নাত ও হাদীসে বিশেষ পারদর্শী, বিরাট মর্যাদাসম্পন্ন, লব্ধপ্রতিষ্ঠ হাদীস-অভিজ্ঞা, গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী, হাদীসের হাফেয, আল্লাহর হুকুম পালনকারী, বিনয়ী ও আল্লাহ পরস্ত লোক ছিলেন।[********************]
উমর ইবনে আবদুল আযীয বিপুল সংখ্যক হাদীসের বর্ণনা করিাছেন। তিনি নিম্নোক্ত সাহাবী ও তাবেয়ী মুহাদ্দিসগণ হইতে হাদীস শিক্ষা ও বর্ণনা করিয়াছেনঃ
(১) উকবা ইবনে আমের (২) ইউসুফ ইবনে আবদুল্লাহ (৩) হযরত তমীমুদদারী (রা) (৪) হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) (৫) সালেম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (৬) হযরত মু’আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা) (৭) হযরত আয়েশা (রা) (৮) আসমা বিনতে উমাইয়া (৯) খাওলা (১০) সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (১১) আবদুল্লাহ ইবনে কারুয (১২) আবান ইবনে উসমান (১৩) আবূ বকর ইবনে আবদুর রহমান ইবনে হারিস ইবনে হিশাম (১৪) উরওয়া ইবনে যুবায়র (১৫) মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে রওফল (১৬) আবূ বুরাদাহ (১৭) আবূ সালমাহ (১৮) সায়ীদ ইবনে খালিদ (১৯) আমের ইবনে সায়াদ (২০) ইয়াহইয়া ইবনুল কাসিম (২১) কায়স ইবনে হারিস (২২) আবদুল আযীযী (উমরের পিতা) (২৩) আবদুল্লাহ ইবনে মওহাব (২৪) উবাদা ইবনে আবদুল্লাহ (২৫) ইবনে শিহাব জুহরী (২৬) রবী’ ইবনে সাবুরা (২৭) মুহাম্মদ ইবনে সাবিত ইবনে শুরাহবীল এবং আরো অনেক মুহাদ্দিসের নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।[এ, এইচ, হালে সম্পাদিত ‘মুসনাদে উমর ইবনে আবদুল আযীয’–এর ভূমিকা।]
যত বিপুল সংখ্যক মরফু হাদীস তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল, তত আর কোন তাবেয়ীরই ছিল না। আইয়ূব সখতীয়ানী বলিতেনঃ
‘আমি যত লোকের সঙ্গেই সাক্ষাত করিয়াছি, উমর ইবনে আবদুল আযীয অপেক্ষা রাসূলে করীম হইতে অধিক হাদীস বর্ণনাকারী আর কাহাকেও দেখি নাই।[********************]
ইমাম মকহুল
ইমাম মকহুল প্রথম জীবন শুরু করেন ক্রীতদাস হিসাবে। এই অবস্থার মধ্যেও তিনি ইলম শিক্ষালাভে মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। গোলামী মুক্তিলাভের পরই তিনি সমগ্র মুসলিম জাহানে পর্যটনে বাহির হইয়া পড়েন। ইসলামী রাজ্যের প্রত্যেকটি কেন্দ্রেই তিনি গমন করেন এবং সেখান হইতে সম্ভাব্য সমস্ত হাদীসজ্ঞান আয়ত্ত করিয়া লন। প্রথমে তিনি মিসরের জ্ঞান-সম্পদ অর্জন করেন।[********************] এবং তাহা নিঃশেষে আয়ত্ত করার পূর্বে তিনি মিসর হইত বাহিরে পদার্পণ করেন নাই।[********************]
অতঃপর তিনি মদীনা গমন করেন এবং সেখানে হইতে ইরাক চলিয়া যান। এই উভয় স্থান হইতে তিনি সমস্ত হাদীস-সম্পদ আহরণ করিয়া সিরিয়া রওয়ানা হইয়া যান। সিরিয়ার তদানীন্তন প্রত্যেক হাদীসবিদের নিকট হইতেই তিনি হাদীস শিক্ষালাভ করেন। মোটকথা, হাদীস শিক্ষালাভ ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি মুসলিম জাহানের প্রতিটি কেন্দ্রের অলি-গলি ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ ‘ইলমে হাদীসের সন্ধানে আমি সারা জাহান পরিক্রম করিয়াছি।[********************]
তিনি কয়েকজন সাহাবীর নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা হইতেছেনঃ (১) হযরত আনাস (রা), (২) হযরত আবূ হিন্দদারী (রা) (৩) হযরত ওয়াসিলা ইবনে আসকা (রা) (৪) হযরত আবূ ইমাম (রা), (৫) হযরত আবদুর রহমান ইবনে গানাম (রা) (৬) হযরত আবূ জানদাল ইবনে সুহাইল (রা)।[********************]
এতদ্ব্যতীত সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, মুসরুক, যুবাইর ইবনে নুফাইর, কারীব আবূ মুসলিম, উরওয়া ইবনে যুবাইর, মগরী ইবনে কাসীর প্রমুখ বিশিষ্ট তাবেয়ীর নিকট হইতেও হাদীস শিক্ষা করেন।[********************]
ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদের বর্ণনা মতে তিনি ১১২, ১১৩ কিংবা ১১৮ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। তাঁহার জন্ম তারিখ সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। হাদীস ও ফিকাহ সম্পর্কে তিনি দুইখানি গ্রন্হ রচনা করেন। অথচ এই সময় পর্যন্ত গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ সূচিতই হয় নাই।[********************]
ইমাম শা’বী
ইমাম শা’বী তাঁহার সময়কার অনন্য শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ তাবেয়ী। তিনি যখন পূর্ণ বয়স্ক হন তখন কূফা নগরে বিপুল সংখ্যক সাহাবী জীবিত ও বর্তমান ছিলেন। তাঁহাদের নিকট তাঁহার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। জীবনে তিনি প্রায় পাঁচশত সাহাবীর সহিত সাক্ষাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে ৪৮ জন সাহাবীর নিকট হইতে তিনি রীতিমত হাদীস শিক্ষালাভ করিয়াছেন।[********************] হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমরের খিধমতে একাদিক্রমে দশ মাস পর্যন্ত থাকিয়া তিনি হাদীসের গভীর ও ব্যাপক শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন।[********************]
এই হাদীস শিক্ষালাভ ও সংগ্রহ করার জন্য তাঁহাকে প্রাণান্তকর পরিশ্রম ও কষ্ট স্বীকার করিতে হইয়াছে। তিনি কেমন করিয়া হাদীসের এই জ্ঞান-সমুদ্র আয়ত্ত করিয়াছিলেন, তাহা জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিয়াছিলেনঃ সমস্ত চিন্তা –ভাবনা পরিত্যাগ করিয়া, দেশ-দেশান্তর পর্যটন করিয়া, গর্দভের ন্যায় শক্তি ব্যয় ও কাকের মত প্রত্যুষ জাগরণ সহ্য করিয়া।[********************] হাদীসে তাঁহার জ্ঞান যে কত ব্যাপক ও গভীর ছিল, তাহা তাঁহার নিজেরই একটি কথা হইতে প্রমাণিত হয়। তিনি বলিয়াছেনঃ
বিশ বৎসর পর্যন্ত আমি কাহারো নিকট হইতে এমন কোন হাদীস শুনিতে পাই নাই, সে সম্পর্কে আমি হাদীসের সেই বর্ণনাকারী অপেক্ষা অধিক ওয়াকিফহাল ছিলাম না।[********************]
তিনি ইমাম আবূ হানীফার কেবল উস্তাদই ছিলেন না, হাফেয যাহবীর মতে ******************** তিনি আবূ হানীফার প্রধান উস্তাদ ছিলেন।[ঐ]