হাদীস গ্রন্হ সংকলন
পূর্বের আলোচনা হইতে প্রমাণিত হইয়াছে, প্রথম পর্যায়েই রাসূলে করীম (স)-এর হাদীসসমূহ গ্রন্হাকারে সংকলিত হইতে পারে নাই। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
নবী করীম (স)-এর হাদীস তাঁহার সাহাবী ও শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীদের যুগে গ্রন্হকারে সংকলিত ও সুসংবদ্ধ ছিল না।[********************]
ইসলামের প্রথম পর্যায়েই হাদীস গ্রন্হসমূহ সংকলিত না হওয়ার মূলে কয়েকটি যুক্তিসংগত কারণ রহিয়াছে। প্রথমত, পূর্বে যেমন বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইয়াছে, সাহাবায়ে কিরাম তীব্র স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিলেন, রাসূলের নিকট হইতে যাহা কিছু শ্রবণ করিতেন, তাহাই তাঁহাদের মুখস্থ হইয়া যাইত, উহা লিখিয়া লওয়ার কোন প্রয়োজন সাধারণভাবে ও স্বভাবতই তাঁহারা মনে করিতেন না।
দ্বিতীয়ত, লিখিবার শক্তি তাঁহাদের অনেকেরই ছিল না। তখন লিখন শিল্পের প্রচলনও পরবর্তীকালের ন্যায় ব্যাপক ছিল না, উহা সাধারণ জনপ্রিয়তাও তখন লাভ করিতে পারে নাই।
তৃতীয়ত, নবী করীম (স) নিজেই প্রথম পর্যায়ে হাদীস লিখিতে নিষেধ করিয়াছেলেন বলিয়া হাদীস গ্রন্হ সংকলনের প্রতি সকল সাহাবীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হইতে পারে নাই।
আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী এই সম্পর্কে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা এখানে প্রণিধানযোগ্যঃ
******************************************************
নবী করীম (স)-এর জীবদ্দশায়ই হাদীসসমূহ সংগৃহীত ও সংকলিত হওয়া বাহ্য দৃষ্টিতে যদিও উত্তম ছিল, কিন্তু কুরআনের অনুরূপ হাদীসেরও সংকলিত হওয়া এবং ঠিক কুরআনের মতই হাদীসেরও সংরক্ষিত হওয়া বোধ হয় আল্লাহরই মর্জি ছিল না।[ফায়জুলবারী শরহে বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৮।]
এইসব কথাই হইল হাদীস গ্রন্হ সংকলনের উদ্দেশ্যে বিশেষ ব্যবস্থা ও যত্ন গ্রহণ সম্পর্কে। অন্যথায় হাদীসের হিফাযত ও উহাকে বিলীন হইয়া যাওয়ার হাত হইতে রক্ষা করার ব্যাপারে রাসূলে করীমরে যুগ হইতে সাহাবাও তাবেয়ীনের যুগ পর্যন্ত উহার প্রতি কখনই এবং কিছু মাত্র কম গুরুত্ব দেওয়া হয় নাই।
সেই কারণেই আমরা দেখিতে পাই যে, কুরআনের সঙ্গে হাদীস মিশিয়া যাওয়ার আশংকা দূরীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেমন সাহাবায়ে কিরাম হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া রাখার দিকে লক্ষ্য দিয়াছেন, অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরামের সময় হইতেই হাদীস সংকলন ও গ্রন্হাকারে উহাকে সুসংবদ্ধকরণের কাজও পূর্ণ মাত্রায়ই সম্পন্ন করা হইয়াছে।
তবে সাহাবীদের যুগে হাদীসকে গ্রন্হাকারে সংকলিত করিয়া লওয়ার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে অনুভূত ছিল না। কেননা তখন সাহাবিগণ নিজেরাই রাসূলের হাদীসের ধারক ছিলেন। যে কোন ব্যাপারে প্রয়োজন দেখা দিলেই জনগণ সাহাবীদের নিকট উপস্থিত হইতেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানিয়া লইয়া সকল ব্যাপারের মীমাংসা করিয়া লইতেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে রাসূলে করীমের ফরমান কি, তাহাও নিঃসন্দেহভাবে সাহাবাদের নিকট হইতে জানিতে পারা যাইত। কিন্তু সাহাবাগণ যখন এক এক করিয়া দুনিয়া হইতে চলিয়া যাএত লাগিলেন তখন সাধারণ মুসলমানও যেমন হাদীস গ্রন্হ সংকলনের প্রয়োজন বোধ করেন, তেমনি হাদীসের অবশিষ্ট ধারক সাহাবীগণও উহাকে সংকলিত করিয়া চিরদিনের তরে সুরক্ষিত করিয়া রাখিয়া যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করিতে থাকেন।
তাবেয়ী যুগে সাহাবায়ে কিরামের বিদ্যমানতা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাহা হযতর আনাস (রা)-এর ইন্তেকালের পর মুরেক নামক জনৈক তাবেয়ীর নিম্নোক্ত উক্তি হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আজ অর্ধেক ইলম – হাদীস – দুনিয়া হইতে চলিয়া গেল।
এই কথার তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেনঃ
******************************************************
সাহাবীদের যুগে কোন অসদুদ্দেশ্যসম্পন্ন ব্যক্তি হাদীস সম্পর্কে আমাদের বিরোধিতা কিংবা মতবিরোধ করিলে আমরা বলিতামঃ যে লোক এই হাদীস স্বয়ং রাসূলের নিকট শ্রবণ করিয়াছেন তাঁহার নিকট চল ( ও ইহার সত্যতা যাঁচাই করিয়া লও)।[********************]
এই কারণেই সাহাবাদের কাফেলার শেষ অন্তর্ধান শুরু হওয়ার পূর্বেই হাদীসি সংকলনের ও হাদীসকে গ্রন্হবন্ধ করিয়া উহাকে চির দিনের তরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে ও তীব্রতা সহকারে অনুভূত হইতে শুরু করে। নবুয়্যাত- উত্তর যুগে এই পর্যায়ে একসঙ্গে পেশ করা আবশ্যক। এখানে প্রথমে খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলের সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হইব। অতঃপর পরবর্তীকালের বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হইবে।