নফল রোযার ফযিলত ও মাসায়েল
শাওয়ালের ছয় রোযা
এ রোযার অনেক ফযিলত হাদীসে বয়ান করা হয়েছে। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখলো এবং পরপর শাওয়ালের ছয় রোযা করলো, সে যেন হামেশা রোযা রাখলো। (মুসলিম, আবু দাউদ)
নবী (স) আরও বলেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখলো এবং তারপর শাওয়ালের ছটি রোযা রাখলো সে গোনাহ তেকে এমন পাক হলো যেন তার মা তাকে আজই প্রসব করলো। (মুসলিম, আবু দাউদ)
এটা জরুরী নয় যে, সে রোযাগুলো ঈদের পর একত্রে করতে হবে। একত্রেও করা যায় এবং মাঝে বাদ দিয়েও করা যায়।
তবে শাওয়ালের ছয় তারিখে এ রোযা শুরু করা ভালো। তবে তা জরুরী নয়। পুরো মাসের মধ্যে যখনই সুবিধা হয় করা যেতে পারে।
আশুরার দিনের রোযা
মহররমের দশ তারিখকে ইয়াওমে আশুরা বা আশুরার দিন বলে। ঐ দিনে মক্কার কুরাইশরাও রোযা রাখতো এবং কাবা ঘরে নতুন গেলাব চড়াতো। এ রোযাকে হযরত ইবরাহীম (আ ) এর প্রতি আরোপ করা হতো। নবী (স) নিজেও এ রোযা রাখতেন। তারপর যখন তিনি হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন দেখলেন যে, ইহুদীরাও সে রোযা রাখছে। তখন তিনিও ঐ দিন রোযা রাখলেন এবং সকল সাহাবীকে রোযা রাখার তাকীদ করলেন।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) যখন হিজরত করে মদীনায় এলেন তখন ইহুদীদেরকে আশুরার দিনে রোযা রাখতে দেখলেন। তিনি তখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কাছে এ দিনের কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, তোমরা এ দিনে রোযা রাখ? তারা বলল, এ বড় মহত্বপূর্ণ দিন। এ দিনে আল্লাহ হযরত মূসা (আ ) কে এবং তার জাতিকে নাজাত দান করেন ও ফেরাউন এবং তার লোক লস্করকে নিমজ্জিত করেন। এজন্যে মূসা (আ ) আল্লাহর অনুগ্রহের শোকারগুজারির জন্য ঐ দিন রোযা রাখেন। আমরাও এ জন্যে এ দিনে রোযা রাখি।
নবী (স) বলেন, মুসা (আ ) এর সাথে আমাদের সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে বেশী। আর আমরা এ জিনিসের বেশী হকদার যে এ দিন আমরা রোযা রাখি।
তারপর নবী (স) স্বয়ং সে দিন রোযা রাখলেন এবং উম্মতকেও রোযা রাখার হুকুম দিলেন। (বুখারী, মুসলিম)
দশ তারিখের সাথে নয় তারিখ অথবা এগার তারিখ রোযা রাখা ভালো যাতে করে সেদিনের ফযীলতও লাভ করা যায় এবং ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্যও না হয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, নবী (স) স্বয়ং এ রোযা রাখা শুরু করেন এবং সাহাবীদেরকেও রোযা রাখার তাকীদ করেন। তখন সাহাবীগণ আরজ করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঐ দিনকে তো ইহুদী-নাসারাগণ বড় দিন হিসেবে পালন করে। আমরা ঐদিনে রোযা রাখলে তো তাদের সাথে সাদৃশ্য হয়। তখন তিনি বলেন, সামনে বছর ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ তারিখে রোযা রাখবো। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, কিন্তু সামনে বছর আসার পূর্বেই নবী (স) ইন্তেকাল করেন। (মুসলিম)
আরাফাতের দিনের রোযা
হজ্জের মাসের নয় তারিখকে ইয়াওমে আরফা বা আরাফাতের দিন বলা হয়। হাদীসে এ দিনের রোযার অনেক ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। নবী (স)বলেন, আমি আল্লাহর সত্তা থেকে এ আশা রাখি যে, আরাফাতের দিনের রোযা আগামী বছর ও গত বছর এ উভয় বছরের কাফফারা বলে গণ্য হবে। (তিরমিযি)
আরাফার দিনের রোযার সওয়াব এক হাজার দিনের রোযার সমান। (তিরমিযি)
নবী (স)এ দিনে রোযার যত্ন নিতেন। আরাফার দিনের আগের আট দিনের রোযারও বড়ো সওয়াব আছে।
নবী (স)বলেন, যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের মত আল্লাহর নিকট কোনো দিনই এত প্রিয় নয়। এ দশ দিনের রোযা সারা বছর রোযা রাখার সমান এবং এসব রাতের নফল নামায শবে দকর এর নফরে সমান।
আইয়ামে বীযের রোযা
প্রত্যেক চাঁদ মাসের ১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখকে আইয়ামে বীয বলে। এ হচ্ছে শুক্লপক্ষের বিশেষ কয়েকটি দিন। এগুলোকে বলা হয় আইয়ামে বীয- (উজ্জ্বল জোস্না প্লাবিত তারিখগুলো)। নবী (স) এ দিনগুলোর রোযার বড়ো তাকীদ করতেন।
হযরত কাতাদাহ বিন মালহান (রা) বলেন, নবী (সা) আমাদেরকে তাকীদ করতেন যে, আমরা যেন চাঁদের তের, চৌদ্দ ও পনেরো তারিখে রোযা রাখি। তিনি বলতেন, এ তিন রোযা সওয়াবের দিক দিয়ে হামেশা রোযা রাখার বরাবর। (আবু দাউদ, নাসায়ী)
সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা
নবী (স) স্বয়ং সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন এবং সাহাবীগণকে রাখার তাকীদ করতেন। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, নবী (সা) সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। (তিরমিযি, নাসায়ী)
উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে নবী (সা) বলেন,সোম ও বৃহস্পতিবার আমল (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। আমি চাই যে, যেদিন আমার আমল পেশ করা হয় সেদিন রোযা রাখি। (তিরমিযি)
একবার সাহাবীগণ নবী (স)কে সোমবার রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাবে বললেনঃ ঐদিন আমার জন্ম হয়েছিল এবং ঐদিনই আমার ওপর কুরআন নাযিল হওয়া শুরু হয়। (মুসলিম)
নফল রোযার বিভিন্ন মাসায়েল
১. নফল রোযা রাখার পর ওয়াজিব হয়ে যায়। কোনো কারণে নষ্ট হলে বা নষ্ট করলে কাযা ওয়াজিব হয়ে যায়।
২. বিনা ওজরে নফল রোযাও ভাঙা জায়েয নয়। অবশ্যই নফল রোযা ফরয রোযার তুলনায় সামান্য ওজরে ভাঙা যায়।
৩. কেউ রোযাদারকে খানার দাওয়াত করলো এবং মনে করা হলো যে, মেহমান না খেয়ে মেজবান অসন্তুষ্ট হবে অথবা সে মেহমানকে ছেড়ে খেতে রাজী হবে না অথবা না খেলে মেজবান মনে আঘাত পাবে এমন অবস্থায় রোযা ভাঙা জায়েয। কিন্তু রোযাদারের উচিত তার কাযা আদায় করা।
৪. মেয়েদের জন্যে রমযানের রোযা ছাড়া অন্য যে কোনো রোযা স্বামীর অনুমতি ছাড়া করা মাকরূহ তাহরীমি। যদি কেউ রাখে এবং তার স্বামী রোযা ভাঙতে বলে তাহলে ভেঙে দেয়া জরুরী। তারপর সে রোযার কাযাও স্বামীর অনুমতি নিয়ে করবে।
৫. যদি কেউ ঐসব দিনে রোযা রাখার মানত করে যেসব দিনে রোযা রাখা হারাম। যেমন, দু ঈদের দিন। তাহলে অন্য কোনো দিনে রাখবে।
৬. কেউ নফল রোযা রাখলো এবং তার বাড়ীতে মেহমান এলো। এখন সে যদি মেহমানের সাথে খানা না খায় তাহলে মেহমান অসন্তুষ্ট হবে। এমন অবস্থায় নফল রোযা ভাঙা জায়েয।
৭. কেউ ঈদের দিনে রোযার নিয়ত করলো এবং রোযা রাখলো। তারও উচিত রোযা ভেঙে ফেলা এবং তার কাযা করা।
৮. রমযানের এক দুদিন আগে রোযা রাখা ঠিক নয়। নবী (স)বলেন, কেউ যেন রমযানের এক দুদিন আগে রোযা না রাখে। কিন্তু যদি কেউ ঐ দিন রোযা রাখতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে রাখতে পারে। (বুখারী)