ইস্তেলাম
ইস্তেলামের আভিধানিকদ অর্থ স্পর্শ করা এবং চুমো দেয়া। পারিভাষিক অর্থ হিজরে আসওয়াদকে চুমো দেয়া এবং রুকনে ইয়ামেনী স্পর্শ করা। তাওয়াফের প্রত্যেক পাক বা ঘূর্ণন শুরু করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা এবং তাওয়াফ শেষ করার সময় হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করা সুন্নাত। রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলাম মুস্তাহাব।
হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলামের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে চুমো দেয়ার সময় মুখ থেকে যেন কোনো শব্দ না হয়। হিজরে আসওয়াদে শুধু মুখ রাখা মসনুন। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অত্যন্ত ভিড়ের কারণে চুমো দেয়া সম্ভব না হরে কোনো ছড়ি প্রভৃতির দ্বারা হিজরে আসওয়াদ স্পর্শ করে তাতে চুমো দেবে। তাও সম্ভব না হলে দু হাতের তালু হিজরে আসওয়াদের দিকে করে হাত কান পর্যন্ত তুলে হাতে চুমো দেবে।
হিজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামেনীর ইস্তেলামের ফযীলত সম্পর্কে নবী (স) বলেন-
আল্লাহর কসম! কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জীবন দান করে ওঠাবেন। তার দুটি চোখ হবে যা দিয়ে সে দেখবে। তার মুখ হবে যা দিয়ে সে কথা বলবে। যেসব বান্দাহ তার ইস্তেলাম করতে তাদের সপক্ষে সে সাক্ষ্য দেবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)
রুকনে ইয়ামেনীর দোয়া
রুকনে ইয়ামেনীর ফযীলত বয়ান করতে গিয়ে নবী (স) বলেন- রুকনে ইয়ামেনীতে সত্তরজন ফেরেশতা নিযুক্ত আছে। তারা ঐসব প্রত্যেক বান্দার দোয়ার পর আমীন বলে যারা এ দোয়া করেঃ
হে আল্লাহ! আমি দুনিয়া ও আখিরাতে তোমার কাছ থেকে ক্ষমা ও স্বাচ্ছন্দ্য চাই। হে আমাদের রব! তুমি আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান কর। জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর এবং নেক লোকদের সাথে বেহেশতে স্থান দাও।
তাওয়াফের প্রকার ও তার হুকুমাবলী
বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ছয় প্রকার এবং প্রত্যেকের হুকুম পৃথক পৃথক।
১. তাওয়াফে যিয়ারতঃ একে তাওয়াফে ইফাদা এবং তাওয়াফে হজ্জও বলে। তাওয়াফে যিয়ারত হজ্জের অন্যতম রুকন। কুরআন বলে *******আরবী********* এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করা উচিত। ইমামগণ এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে তাওয়াফে যিরারতের কথাই বলা হয়েছে, যা আরাফাতে অবস্থানের পর দশ তারিখে করা হয়। কোনো কারণে যিলহজ্জের দশ তারিখে করতে না পারলে ১১/১২ তারিখেও করা যেতে পারে।
২. তাওয়াফে কুদুমঃ একে তাওয়াফে তাহিয়্যাও বলে। মক্কা প্রবেশের পর প্রথম যে তাওয়াফ করা হয় তাকে তাওয়াফে কুদুম বলে। এ তাওয়াফ শুধু তাদের জন্য ওয়াজিব যারা মীকাতের বাইরের অধিবাসী। (ইলমুল ফিকাহ ৫ম এবং কুদুরীতে একে মসনুন বলা হয়েছে। ইমাম মালেক (র) এর নিকট অবশ্য তাওয়াফে কুদুম ওয়াজিব বলা হয়েছ। তার যুক্তি এই যে, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহর যিয়ারতের জন্যে আসবে তার উচিত তাওয়াফে তাহিয়্যা করা। আয়নুল হেদায়া, প্রথম খন্ড,পৃঃ ৯৯৭) পরিভাষায় একে আফাকী বলে।
৩. তাওয়াফে বেদাঃ বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় নেবার সময় যে শেষ তাওয়াফ করা হয় তাকে বিদায়ী তাওয়াফ বা তাওয়াফে সদর বলে। এ তাওয়াফও আফাকীর (মীকাতের বহিরাগত) জন্যে ওয়াজিব। এ তাওয়াফের পর মুলতাযেমের সাথে নিজেকে জড়িত করে বুক ও ডান গাল তাতে লগিয়ে এবং ডান হাতে বায়তুল্লাহর পর্দা ধরে একান্ত বিনয় সহকারে ও অশ্রু কাতর কন্ঠে দোয়া করা উচিত। এ হচ্ছে বিদায়ের সময় এবং বলা যায় না যে আবার কখন এ সৌভাগ্য হবে। এ এ তাওয়াফ সম্পর্কে নবী (স) এর হেদায়াত হচ্ছে-
কেউ যেন বিদায়ী তাওয়াফ না করে বায়তুল্লাহ থকে ফিরে না যায়। শুধু মাত্র ঐ মেয়েলোকের জন্যে অনুমতি আছে যার হায়েয হয়েছে। (বুখারী)
৪. তাওয়াফে উমরাহঃ এ হচ্ছে উমরার তাওয়াফ যা উমরার রুকন।এ তাওয়াফ ছাড়া উমরাহ হবে না।
৫. তাওয়াফে নযরঃ কেউ তাওয়াফে নযর মানলে তা করা ওয়াজিব।
৬. নফল তাওয়াফঃ এটা যে কোনো সময়ে করা যায়। মক্কায় যতদিন থাকার সুযোগ হয়। বেশী বেশী তাওয়াফ করার চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর মানুষের কি হতে পারে?
তাওয়াফের ওয়াজিব সমূহ
তাওয়াফের মধ্যে নয়টি জিনিস যত্ন সহকারে পালন করা ওয়াজিব।
১. নাজাসাতে হুকমীঃ অর্থাৎ হাদীসে আসগার ও হাদীসে আকবার থেকে পাক হওয়া। মেয়েদের জন্যে হায়েয, নেফাস অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েয নয়। হযরত আয়েশা (রা) এর হজ্জের সময় মাসিক ঋতু শুরু হলে তিনি কাঁদতে থাকেন। নবী (স) বলেন, এতে কাদার কি আছে? এ এমন জিনিস যা আদম কন্যাদের রক্তের সাথে সম্পর্কিত। তুমি ওসব কাজ করতে থাক যা হাজীদের করতে হয়। কিন্তু বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করবে না যতক্ষণ না তুমি তার থেকে পাক হবে। (বুখারী, মুসলিম)
২. সতরে আওরতঃ অর্থাৎ শরীরের ঐসব অংশ ঢেকে রাখা যা ঢাকা জরুরী। নবী (স) বলেনঃ *******আরবী********* অর্থাৎ উলঙ্গ হয়ে (সতর খুলে) কেউ যেন তাওয়াফ না করে। (বুখারী)
৩. হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম থেকে তাওয়াফ শুরু করা।
৪. তাওয়াফ ডান দিক থেকে শুরু করা। হযরত জাবের (রা) বলেন, নবী (স) মক্কায় তশরিফ আনার পর সর্বপ্রথম তিনি হিজরে আসওয়াদের নিকট গেলেন, তার ইস্তেলাম করলেন এবং তারপর ডান দিক থেকে তাওয়াফ শুরু করলেন।
৫. পায়ে হেটে তাওয়াফ করা। ওজর থাকলে সওয়ারীতে তাওয়াফ জায়েয। নফল তাওয়াফ বিনা ওজরে সওয়ারিতে জায়েয। কিন্তু পায়ে হেটে করাই ভালো।
৬. তাওয়াফের প্রথম চার ফরয চক্করের পর বাকী তিন চক্কর (শওত) পুরো করা।
৭. সাত তাওয়াফে শেষ করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া। হযরত জাবের (রা) বলেন, আমরা নবী (স) এর সাথে বায়তুল্লাহ পৌছার পর তিনি হিজরে আসওয়াদের ইস্তেলাম করলেন। প্রথম তিন চক্করে তিনি রমল (পরিভাষা দ্রঃ) করলেন, বাকী চারটি সাধারণভাবে করলেন। তারপর তিনি মাকে ইবরাহীমের দিকে অগ্রসর হলেন এবং এ আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ (এবং মাকামে ইবরাহীমকে স্থায়ী জায়নামায বানিয়ে নাও) তারপর তিনি এমনভাবে দাঁড়ালেন যে মাকামে ইবরাহীম তার ও বায়তুল্লাহর মধ্যখানে রইলো তারপর তিনি নামায পড়লেন। (মুসলিম)
৮. হাতীমের বাইরে থেকে তাওয়াফ করা যাতে করে হাতীম তাওয়াফের মধ্যে শামিল হয়।
৯. ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে দূরে থাকা।
তাওয়াফে দোয়া
খানায়ে কাবা তাওয়াফ করার জন্য হিজরে আসওয়াদের নিকট পৌছলে *******আরবী********* বলে নিম্ন দোয়া পড়তে হয়ঃ
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! তোমার ওপর ঈমান এনে, তোমার কিতাবের সত্যতা স্বীকার করে, তোমার নবী (স) এর সুন্নাতের অনুসরণে (এ ইস্তেলাম এবং তাওয়াফের কাজ শুরু করছি)।
তাওয়াফের সময় আস্তে আস্তে এ দোয়া পড়তে হবেঃ
*******আরবী*********
আল্লাহ সকল ত্রুটি বিচ্যুতির ঊর্ধ্বে, সকল প্রশংসা তার জন্যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি নেই যে সৎপথে চালাতে পারে এবং কোনো শক্তি নিই যে পাপাচার থেকে বাচাতে পারে।
যখন রুকনে ইয়ামেনী পৌছবে তখন রুকনে ইয়ামেনী এবং হিজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে পড়বে।
*******আরবী*********
নিম্নের দোয়াও পড়বে-
*******আরবী*********
হে আল্লাহ! তুমি আমাকে তৃপ্তি দান কর যা কিছু তুমি আমাকে দিয়েছ তার ওপর এবং তার মধ্যেই আমাকে বরকত দান কর। আর প্রত্যেকটি অদৃশ্য বস্তুতে তুমি মঙ্গল ও কল্যাণসহ তত্ত্বাবধায়ক হয়ে যাও।
তার সাথে নিম্নের দোয়াও পড়া ভালোঃ
*******আরবী*********
আল্লাহ ছাড়া কেউ ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক এবং তার কোনো শরীক নেই। শাসন কর্তৃত্ব তারই, প্রশংসা সব তারই এবং তিনি সকল কিছুর ওপর শক্তিমান।
তাওয়াফের মাসায়েল
১. প্রত্যেক তাওয়াফ অর্থাৎ চক্কর পুরো করার পর দু রাকায়াত নামায পড়া ওয়াজিব। দু তাওয়াফ একত্র করা এবং মাঝখানে নামায না পড়া মাকরূহ তাহরিমী।
২. সাত চক্কর দেয়ার পর যদি কেউ অষ্টম চক্কর দেয় তাহরে অতিরিক্ত ছয় চক্কর দিয়ে আর এক তাওয়াফ করা দরকার। এজন্য যে নফল ইবাদাত শুরু করার পর তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
৩. যেসব সময়ে নামায মাকরূহ। যেসব সময়ে তাওয়াফ মাকরূহ নয়।
৪. তাওয়াফ করার সময় পাঞ্জেগানা নামাযের মধ্যে কোনো নামাযের সময় এলে, অথবা জানাযা এলে অথবা অযূর প্রয়োজন হলে, এসব থেকে ফিরে আসার পর নতুন করে তাওয়াফ শুরু করার প্রয়োজন নেই। যেখানে ছেড়ে যাবে সেখান থেকেই আবার শুরু করে তাওয়াফ পুরো করবে।
৫. তাওয়াফ করতে করতে যদি ভুলে যায় যে, কত চক্কর হলো তাহলো নতুন করে শুরু করতে হবে। তবে যদি কোনো নির্ভরযোগ্য লোক স্মরণ করিয়ে দেয় তাহলে তার কথামতো কাজ করবে।
৬. তাওয়াফের সময় খানাপিনা করা, বেচাকেনা করা, গুনগুন করে কবিতা পাঠ বা গান করা এবং বিনা প্রয়োজনে কথা বলা মাকরূহ।
৭.তাওয়াফকালে নাজাসাতে হাকীকী থেকে পাক হওয়া মসনুন।
৮. হজ্জ ও ওমরাহ উভয়ের প্রথমে যে তাওয়াফ করা হয় তাতে রমল করা মসনুন এবং ইযতেবাগও মসনুন। (এগুলোর জন্যে পরিভাষা দ্রঃ)
রমল
কাঁধ হেলিয়ে দুলিয়ে দ্রুত চলা, যাতে করে শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটে। একে বলা হয় রমল।
নবী (স) যখন সপ্তম হিজরিতে বিরাট সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম (রা) সহ ওমরাহ করার জন্যে মক্কায় আসেন, তখন কিছু লোক পরস্পর এভাবে বলাবলি করতে থাকে এদের কি অবস্থা। এরা বড়ো দুর্বল ও জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। মদীনার আবহাওয়া তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে। আসলে মদীনার আবহাওয়া বড্ড খারাপ।
নবী (স) যখন মক্কাবাসীদের এসব কথা শুনতে পান তখন তিনি হুকুম দেন তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল কর অর্থাৎ দ্রুত চলে শক্তি প্রদর্শন করবে। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাহদের সে সময়ের আচরণ এতো পসন্দ করেন যে, তা স্থায়ী সুন্নাত হিসবে গণ্য হয়।
যে তাওয়াফে সায়ী করা হয় শুধু তাতে রমল সুন্নাত। অতএব যদি কেউ তাওয়াফে কুদুমের পর সায়ী করতে না চায়, সে এ তাওয়াফে রমল করবে না। কিন্তু তাওয়াফে যিয়ারতে রমল করবে যার পরে তাকে সায়ী করতে হয়। তেমনি কেরান হজ্জকারী যদি তাওয়াফে ওমরায় রমর করে থাকে তাহলে তাওয়াফে হজ্জ রমল করবে না। যদি কেউ প্রথম তিন চক্করে রমল করতে ভুলে যায় তাহলে পরে আর মোটেই করবে না। সাত চক্করেই রমল করা মাকরূহ তানযীহি।
ইযতেবাগ
চাদর প্রভৃতি এমন ভাবে গায়ে দেয়া যাতে করে তার এক কিনারা ডান কাঁধের ওপর দেয়ার পরিবর্তে ডান বগলের নীচ দিয়ে গায়ে দেয়া এবং ডান কাঁধ খোলা রাখা। এভাবেও শক্তি প্রদর্শন করা যায়।