সিজদায়ে তেলাওয়াতের বয়ান
সিজদায়ে তেলাওয়াতের হুকুম
কুরআন চৌদ্দটি (আহলে হাদীসের নিকটে পনেরো আয়াত। তারা সূরা হজ্জের ৭৭ আয়াতেও সিজদা করেন। শাফেয়ীদের মতেও তাই)আয়াত এমন আছে যা পড়লে বা শুনলে সিজদা করা ওয়াজিব হয়। (ইমাম আবু হানীফা ছাড়া অন্যান্যদের মতে সিজদায়ে তেলাওয়াত সুন্নাত।)তা পুরো আয়াত পড়া হোক অথবা পূর্বাপর সহ সিজদার শব্দ (ঐসব আয়াতের উপর রেখা টানা থাকে)পড়া হোক সিজদা ওয়াজিব হয়ে যাবে। একে সিজদায়ে তেলাওয়াত বলে।
নবী (স) যখন কেউ সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করে তখন শয়তান এক ধারে বসে বিলাপ করতে থাকে এবং বলে হয় আফসোস, আদম সন্তানদের সিজদার হুকুম দেয়া হলে তারা সিজদা করলো এবং জান্নাতের হকদার হলো। আমাকে সিজদা করার হুকুম দেয়া হলে আমি অস্বীকার করে জাহান্নামের হকদার হলাম। (মুসলিম, ইবনে মাজা)
সিজদায়ে তেলাওয়াতের স্থানগুলো
সূরা আরাফের ২০৬ আয়াত, সুরা রাদের ১৫ আয়াত, সূরা নহলের ৪৯, ৫০আয়াত, সুরা বনী ইসরাঈলের ১০৯আয়াত, সুরা মরিয়মের ৫৮ আয়াত, সূরা হজ্জের ১৮ আয়াত, সূরা ফুরকানের ৬০ আয়াত,সূরা আন নামলের ২৫-২৫ আয়াত, সূরা হা-মীম সাজদার ৩৮ আয়াত, সূরা আন নাজমের ৬২ আয়াত, সূরা ইনশিকাকের ২০-২১ আয়াত এবং সূরায়ে আলাকের ১৯ আয়াত।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের শর্ত
সিজদায়ে তেলাওয়াতের শর্তঃ
(অর্থাৎ নামাযের যেসব শর্ত,সিজদায়ে তেলাওয়াতেরও তাই। যেসব কারণে নামায নষ্ট হয়, সেসব কারণে সিজদায়ে তেলাওয়াত নষ্ট হয়।)
১. তাহারাত
শরীক পাক হওয়া। অর্থাৎ নাজাসাতে গালীযা থেকে পাক হতে হবে। নাজাসাতে হুকমী থেকে পাক হতে হবে। অযু না থাকলে অযু করতে হবে এবং গোসলের দরকার হল গোসল করতে হবে।
- পোশাক পাক হওয়া।
- নামাযের স্থান পাক হওয়া।
- সতর ঢাকা।
- কেবলার দিকে মুখ করা।
- সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ত করা।
অধিকাংশ আলেমের এ মত। কিন্তু কোনো কোনো আলেমের মতে সিজদায়ে তেলাওয়াতের জন্যে অযু থাকা জরুরী নয়। আহলে হাদীসের মতে অযুসহ সিজদায়ে তেলাওয়াত তো উত্তম কিন্তু বিনা অযুতেও জায়েয।
আল্লামা মওদূদী (র) এ সম্পর্কে নিম্নরূপ অভিমত ব্যক্ত করেনঃ
এ সিজদার জন্যে অধিকাংশ আলেম ঐসব শর্তের পক্ষে যা নামাযের শর্ত। কিন্তু যতো হাদীস সিজদায়ে তেলাওয়াত সম্পর্কে পাওয়া যায় তার মধ্যে এসব শর্তের জন্যে কোনো দলিল নেই। তার থেকে এটাই মনে হয় যে, সিজদার আয়াত শুনার পর যে যেখানে যে অবস্থায় আছে সিজদাহ করবে তা অযু থাক বা না থাক, কেবলামুখী হওয়া সম্ভব হোক বা না হোক। প্রথম যুগের মুসলমানদের মধ্যে এমন লোক পাওয়া যায় যারা এ পদ্ধতিতে আমল করেছেন। ইমাম বুখারী আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) সম্পর্কে বলেন যে, তিনি পথ চলতে চলতে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। কোথাও সিজদার আয়াত এলে ব্যাস মাথা নত করতেন। অযু থাক বা না থাক, কেবলামুখী থাকুন বা না থাকুন। এসব কারণে আমরা মনে করি যে, যদি কেউ অধিকাংশ আলেমগণের খেলাফ আমল করে তাহলে তাকে মন্দ বলা যাবে না। কারণ আলেম সাধারণের মতের সমর্থনে কোনো প্রমাণিত সুন্নাত নেই এবং প্রথম যুগে মুসলমানদের মধ্যে এমন লোকও পাওয়া যায় যাদের আমল আলেম সাধারণের মতের খেলাপ ছিল। (তাফহীমুল কুরআন, দ্বিতীয় খন্ড, সূরা আল আরাফ, টীকা ১৫৭)
সিজদার জন্যে এ নিয়ত করা শর্ত নয় যে, এ সিজদা অমুক আয়াতের। আর যদি নামাযে সিজদার আয়াত পড়ে সিজদা করা হয় তো নিয়ত শর্ত নয়।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ম
কেবলামুখী দাড়িয়ে সিজদায়ে তেলাওয়াতের নিয়ত করতে হবে এবং আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যেতে হবে। সিজদা করার পর আল্লাহু আকবার বলে উঠে দাড়াতে হবে। তাশাহুদ পড়ার ও সালাম ফেরানোর দরকার নেই।
হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) বলেন, যখন তোমরা সিজদার আয়াতে পৌছবে তখন আল্লাহ আকবার বলে সিজদায় যাবে এবং মাথা উঠাবার সময় আল্লাহু আকবার বলবে। (আবু দাউদ)
বসে বসেও সিজদায়ে তেলাওয়াত করা যায় তবে দাড়িয়ে সিজদায় যাওয়া মুস্তাহাব।
সিজদায়ে তেলাওয়াতে সুবহানা রাব্বিয়াল আলা ছাড়াও অন্য মাসনুন তসবিহ পড়া যায়। কিন্তু ফরয নামাযে সিজদায়ে তেলাওয়াত করতে হলে সুবহানা রাব্বিয়াল আলা পড়া ভালো। অবশ্যই নফল নামায অথবা নামাযের বাইরে সিজদায়ে তেলাওয়াতে যে কোনো তসবিহ পড়া যায়। যেমন নিম্নের তসবিহ পড়া যেতে পারেঃ
*******আরবী*********
আমার চেহারা সেই সত্তাকে সিজদা করছে যিনি তাকে পয়দা করেছেন এবং তার মধ্যে কান ও চোখ দিয়েছেন। এসব তারই শক্তির দ্বারা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মহত্ব ও বরকতের উৎস, যিনি সর্বোৎকৃষ্ট স্রষ্টা।
সিজদায়ে তেলাওয়াতের মাসায়েল
১. সিজদায়ে তেলাওয়াত তাদের ওপর ওয়াজিব যাদের ওপর নামায ওয়াজিব। হায়েয নেফাস হয়েছে এমন নারী এবং নাবালেগদের ওপর সিজদায়ে তেলাওয়াত ওয়াজিব নয়। এমন বেহুশ লেকের ওপরও ওয়াজিব নয় যে একদিন এক রাতের বেশী বেহুশ রয়েছে।
২. সিজদার আয়াত নামাযে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সিজদাহ ওয়াজিব হবে বিলম্বের অনুমতি নেই। নামাযের বাইরে সিজদার আয়াত পড়লে তৎক্ষণাৎ সিজদা করা ভালো। বিলম্বেও কোনো দোষ নেই। অবশ্যই বিনা কারণে বেশী বিলম্ব করা মাকরূহ।
৩.যদি নামাযে সিজদার আয়াত পড়া হয়। তাহলে এ সিজদা ঐ নামাযেই আদায় করা ওয়াজিব হবে। যদি সিজদার আয়াত পড়ে কেউ অন্য কোনো নামাযে সিজদা আদায় করে তাহলে জায়েয হবে না। যদি কেউ সিজদার আয়াত পড়ে নামাযের মধ্যে সিজদাহ করতে ভুলে যায় তাহলে তওবা এস্তেগফার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। হ্যাঁ যদি এ নামায নষ্ট হয় তাহলে নামাযের বাইরে সিজদাহ করা যাবে।
৪. কেউ নামায পড়ছে বা পড়াচ্ছে। সে যদি অন্য কারো কাছে সিজদার আয়াত শুনে, তা সে অন্য লোক নামাযেই পড়ুক অথবা নামাযের বাইরে পড়ুক, তাহলে শ্রবণকারী নামাযী বা ইমামের ওপর সিজদায়ে তেলাওয়াত ওয়াজিব হবে না।
৫. কোনো মুক্তাদী সিজদার আয়াত পড়লে, না ইমামের ওপর না মুক্তাদীর ওপর সিজদাহ ওয়াজিব হবে।
৬. কেউ ইমামের নিকটে সিজদার আয়াত শুনলো কিন্তু সে এমন সময় জামায়াতে শামিল হলো যখন সিজদাহ করে ফেলেছে। তাহলে যদি সে ঐ রাকায়াত পেয়ে যায় যে রাকায়াতে ইমাম সিজদাহ করেছে তাহলে তারও সিজদাহ হয়ে যাবে। কিন্তু পরের রাকায়াতে শামিল হলে তাকে নামাযের পর সিজদাহ করতে হবে।
৭. কেউ যদি মনে মনে সিজদার আয়াত পড়ে, মুখে না পড়ে। অথবা শুধু লেখে অথবা এক এক অক্ষর পড়ে, তাহলে সিজদা ওয়াজিব হবে না।
৮. যদি একই স্থানে সিজদার আয়াত বার বার পড়ে তাহলে একই সিজদাহ দিতে হবে। আর যদি কয়েক সিজদার আয়াত পড়ে তাহলে যতো আয়াত পড়বে ততো সিজদাহ করতে হবে। আবার এক আয়াত কয়েক স্থানে পড়লে যতো স্থানে পড়বে ততবার সিজদাহ করতে হবে।
৯। তেলাওয়াতের সময় সকল শ্রোতার যদি অযু থাক, তাহলে সিজদার আয়াত উচ্চস্বরে পড়া ভালো। কিন্তু বিনা অযুতে থাকলে অথবা সিজদাহ করার অবকাশ না থাকে, তাহলে আস্তে আস্তে পড়া ভালো এজন্যে যে, তারা অন্য সময়ে সিজদাহ করতে ভুলে যেতে পারে এবং গুনাহগার হবে।
১০. সিজদার আয়াতের আগে এবং পরের আয়াত পড়া এবং সিজদার আয়াত বাদ দেয়া অথবা পুরো সূরা পড়া এবং সিজদার শেষ আয়াত বাদ দেয়া মাকরূহ।
১১. কিছু নাদান লোক কুরআন পড়তে পড়তে সিজদার আয়াতে পৌছলে কুরআনের ওপরেই সিজদাহ করে। এভাবে সিজদা আদায় হবে না। সিজদায়ে তেলাওয়াত ঐভাবে আদায় করা উচিত যা ওপরে বলা হয়েছে।
১২. সিররী (যা আস্ত পড়া হয়) নামাযগুলোতে এমন সূরা পড়া উচিত নয় যাতে সিজদাহ আছে। এমনি জুমা ও দু ঈদের নামাযে পড়া উচিত নয় যেখানে বিরাট জামায়াত হয়। তাহলে মুক্তাদীদের সন্দেহের সৃষ্টি এবং নামায নষ্ট হবে।
শুকরানা সিজদাহ
শুনে অথবা আল্লাহর রহমতে কোনো বিরাট নিয়ামত লাভ করে অথবা কোনো ব্যাপারে সাফল্য অর্জন করে অথবা কোনো আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় অথবা কোনো বিপদ মুসিবত দূর হয়ে যায় তখন আল্লাহর ফজল ও করমের জন্যে শুকরানা সিজদাহ আদায় করা মুস্তাহাব। কিন্তু এ সিজদাহ নামাযের সাথে সাথেই না করা উচিত। নতুবা অজ্ঞ লোক একে নামাযের অংশ মনে করতে থাকবে অথবা এটা সুন্নাত মনে করে পালন করতে থাকবে। এ নামায থেকে পৃথক সিজদাহ। এজন্যে তা এমনভাবেই করা উচিত যাতে কারো কোনো সন্দেহ না থাকে। হযরত আবু বকর (রা) বলেন, নবী (স) যখন কোনো ব্যাপারে খুশী হতেন অথবা কোনো সুসংবাদ শুনতেন তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য সিজদাহ করতেন। (তিরমিযি)
কোনো কোনো লোক বেতরের পর দু সিজদাহ করে এবং তা সুন্নাত মনে করে এটা ভুল। সুন্নাত মনে করে তা করা ভুল এবং ত্যাগ করা উচিত।