জেনায়েতের বয়ান
জেনায়েত অর্থ কোনো হারাম কাজ করা, গুনাহ করা প্রভৃতি। কিন্তু হজ্জ প্রসঙ্গে জেনায়েতের অর্থ হলো এমন কোনো কাজ করা যা হেরেমে হওয়ার কারণে অথবা এহরাম বাধার কারণে হারাম হয়ে যায়। জেনায়েত দু প্রকারের
একঃ জেনায়েতে হেরেম
দুইঃ জেনায়েতে এহরাম
লোকের পক্ষ থেকে এমন কোনো কাজ হয়ে যায় যা হেরেমের গণ্ডির মধ্যে হারাম অথবা এমন কোনো কাজ হয় যা এহরাম অবস্থায় হারাম, তাহরে এ দুটোর ক্ষতিপূরণের জন্যে কাফফারা ও কুরবানীর পৃথক পৃথক হুকুম রয়েছে, যা পরে বলা হচ্ছে।
হেরেমে মক্কা ও তার মহত্ত্ব
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে বরকতপূর্ণ এবং সবচেয়ে সম্মানের গৃহ ঐটি যাকে আল্লাহ তার আপনঘর বলে উল্লেখ করেছেন। যে ঘর তাওহীদ ও নামাযের কেন্দ্রবিন্দু এবং পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর। যা আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে তৈরী করা হয়েছিল এ ঘর হচ্ছে হেদায়াত ও বরকতের উৎস এবং সমগ্র মানবতার আশ্রয়স্থল।
এ আল্লাহর ঘর যে মুবারক মসজিদের মাঝখানে অবস্থিত, তাকে মসজিদুল হারাম (সম্মানার্হ মসজিদ) বলা হয়েছে। এ দুনিয়ার সকল মসজিদ থেকে উৎকৃষ্টতমই নয়, বরঞ্চ প্রকৃত মসজিদ বলা হয়েছে। দুনিয়ার অন্যান্য মসজিদগুলোতে নামায এইজন্যে সহীহ যে, ওগুলো এ মসজিদে হারামের স্থলাভিষিক্ত এবং ওদিকে মুখ করেই সকলকে নামায পড়তে হয়। মসজিদুল হারামের মহত্ত্ব এতোখানি যে, তাতে এক নামায পড়লে এক লক্ষ নামাযের সওয়াব পাওয়া যায়। (ইবনে মাজাহ)
তারপর আল্লাহ তায়ালা শুধু এ মক্কা শহরকেই হেরেম গণ্য করেননি, বরঞ্চ তার চারদিকে কয়েক কিলোমিটার ব্যাপী অঞ্চলকে হেরেমের সীমাভূক্ত করে হেরেম (অর্থাৎ সম্মানযোগ্য অঞ্চল) বলে ঘোষণা করেছন। তার মহত্ত্বের জন্যে সম্মান প্রদর্শনের কিছু রীতি পদ্ধতি ও হুকুম আহাকাম নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এ সীমারেখার ভেতরে বহু কাজ এ অঞ্চলের সম্মানের জন্যে হারাম ও নাজায়েয করা হয়েছে যা সারা দুনিয়ায় জায়েয ও মুবাহ।
হেরেমের এ সীমারেখা প্রথমে হযরত ইবরাহীম (আ ) নির্ধারণ করেন। পরে নবী (স) তার রেসালাতের যুগে এ সীমারেখার তাজদীদ বা নবায়ন করেন। এ সীমারেখা সুপরিচিত ও সুপরিজ্ঞাত। মদীনার দিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত হেরেমের সীমানা, ইয়ামেনের দিকে প্রায় এগারো কিলোমিটার তায়েফের দিকেও তাই এবং ইরাকের দিকেও প্রায় এতো কিলোমিটার, জেদ্দার দিকে প্রায় ষোল কিলোমিটার পর্যন্ত হেরেমের সীমানা। নবী (স) এর পরে হযরত ওমর (রা) হযরত ওসমান (রা) এবং হযরত মুয়াবীয়া (রা) ঐ একই সীমারেখা নবায়ন করেন। অতএব, এ সীমারেখা এখন অতি সুপরিচিত। হেরেমের সীমারেখার মহত্ত্ব ও সম্মান আল্লাহ ও তার দীনের সাথে সম্পর্ক ও আনুগত্যের পরিচায়ক। যতদিন পর্যন্ত উম্মত সামগ্রিকভাবে এ ভক্তি শ্রদ্ধা অক্ষুণ্ণ রাখবে ততদিন তাদের ওপর আল্লাহর হেফাজত ও রহমত অব্যাহত থাকবে এবং তারা দুনিয়াতে মাথা উঁচু করে জীবন যাপন করতে পারবে।
নবী (স) বলেন- আমার উম্মত যতদিন মুকাদ্দাস হেরেমের মহত্ত্ব ও ভক্তি শ্রদ্ধার হক আদায় করতে থাকবে, ততদিন তারা কল্যাণ লাভ করতে থাকবে। আর যখন তারা এর সম্মান নষ্ট করবে, তখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। (ইবনে মাজাহ)
জেনায়েতে হেরেম
১. হেরেমে উৎপন্ন বন্য তৃণলতা, ঘাস, সবুজ শ্যামল গুল্ম গুচ্ছ কাটা বা উৎপাটন করা জেনায়েত। এ যদি কারো মালিকানাধীন না হয় তাহলে তার কাফফারা এই যে, তার মূল্য আল্লাহর পথে সদকা করতে হবে, যদি কারো মালিকানাধীন হয় তাহলে দ্বিগুণ মূল্য দিতে হবে। সদকাও করতে হবে মালিককেও মূল্য দিতে হবে।
২. ইযখির (ইযখির এক প্রকার সুগন্ধি ঘাস) কাটা বা উৎপাটন করা জায়েয। হযরত আব্বাস (রা) এর অনুরোধে নবী (স) ইযখির কাটার অথবা উৎপাটনের অনুমতি দিয়েছিলেন।
৩. বন্য তৃণ লতা, ঝোপ ঝাড় হোক না কেন, কাটা বা উৎপাটন করা জেনায়েত।
৪. কোন ডাল-পালা যদি বন্য না হয়, লাগানো হয়, তাহলে তা কাটা জেনায়েত হবে না। তেমন কোনো গাছের কিছু পাতা ছেড়া জেনায়েত নয়। যদি তা কারো মালিকানাধীন না হয়।কারো মালিকানাধীন হলে তার বিনা অনুমতিতে ছেড়া যাবে না। মালিক স্বয়ং ছিঁড়লে জেনায়েত হবে না।
৫. হেরেমের শিকার মারা জেনায়েত। হত্যাকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৬. হেরেমের পাখীর ডিম ভাঙ্গা বা রান্না করা জেনায়েত। টিড্ডি মারাও জেনায়েত।
৭. কারো কাছে কিছু শিকার রয়েছে এবং সে হেরেমে প্রবেশ করছে। তার সে শিকার ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব। তবে শিকার যদি রশি দিয়ে বাধা থাকে এবং রশি তার হাতে থাকে অথবা শিকার খাঁচায় আবদ্ধ আছে তাহলে তা ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব নয়।
৮. মীকাতে ইহরাম না বেধে হেরেমে প্রবেশ করাও জেনায়েত। এর জন্য একটি কুরবানী ওয়াজিব।
৯. হেরেমের সীমার ভেতরে এসব মারা জেনায়েত নয়, যথা- বোলতা, সাপ, বিচ্ছু, ইঁদুর, মাছি, ছারপোকা, মশা, পিঁপড়ে প্রভৃতি এবং ঐসব জীব যা আক্রমণ করতে আসে এবং যার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা অপরিহার্য।
১০. হেরেমের বাইরে গিয়ে মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটা (ইহরাম খোলার জন্য) জেনায়েত। তার জন্যে একটি কুরবানী ওয়াজিব।
ইহরাম জেনায়েত
ইহরামের জেনায়েত তিন প্রকার।
১. যার জন্যে দু কুরবানী।
২. যার জন্যে এক কুরবানী।
৩. যার জন্যে সদকা কুরবানী।
যাতে দু কোরবানী ওয়াজিব
১. পুরুষ যদি কোনো গাঢ় খুশবু অথবা গাঢ় মেহদী মাথায় লাগায় এবং একদিন একরাত স্থায়ী হয়, তা সমস্ত মাথায় লাগানো হোক বা এক চতুর্থাংশ মাথায় দুটো কুরবানী তার জন্যে ওয়াজিব। কিন্তু হোক স্ত্রীলোক এমন করলে একটি কুরবানী দিতে হবে।
২. ঐসব জেনায়েত যার জন্যে হজ্জে ইফরাদকারীর একটি কুরবানী ওয়াজিব হয়, কারেনের জন্যে দু কুরবানী ওয়াজিব হবে।
৩. তামাত্তু হজ্জকারী যদি হাদীর পশু সাথে করে আনে তাহলে তার জন্যে সকল জেনায়েতের জন্যে দু কুরবানী, আর মুফরেদের জন্যে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।
যেসব জেনায়েতের জন্যে এক কুরবানী
শুধু দু’অবস্থায় উট অথবা গরু কুরবানী ওয়াজিব হয়। নতুবা যেখানে যেখানে কুরবানীর কথা বলা হয়েছে সেখানে ছাগল অথবা ভেড়া কুরবানী বুঝতে হবে।
১. জানাবাতের অবস্থায় (যার জন্যে গোসল ফরয হয়) যদি কেউ তাওয়াফে যিয়ারত করে, তাহলে এক উট অথবা গরু কুরবানী ওয়াজিব হবে।
২. আরাফাতে অবস্থানের পর তাওয়াফে যিয়ারত অথবা মস্তক মুণ্ডনের পূর্বে স্ত্রী সহবাস করলে উট অথবা গরু কুরবানী ওয়াজিব হবে। এ দু অবস্থায় ছাড়া অন্য সকল অবস্থায় ছাগল অথবা ভেড়া কুরবানী ওয়াজিব হবে।
৩. তাওয়াফের ওয়াজিবগুলোর মধ্যে কোনো একটি বাদ গেলে একটি কুরবানী ওয়াজিব হবে।
ইহরামের নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বেচে থাকাও তাওয়াফের ওয়াজিবগুলোর মধ্য শামিল। এসবের মধ্যে কিছু নিষিদ্ধ কাজের কুরবানী সম্পর্কে নিম্নে মাসায়েল বয়ান করা হচ্ছে।
৪. যদি বেশী খুশবু লাগানো হয় তাহলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে। যদি অল্প খুশবু লাগানো হয় কিন্তু শরীরের বৃহৎ অংশে যেমন মাথা, হাত পা প্রভৃতির ওপর মালিশ করা হয়, তাহলেও এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।
৫. যদি একই স্থানে সমস্ত শরীরে খুশবু লাগানো হয় তাহলে এক কুরবানী এবং বিভিন্ন স্থানে সমস্ত শরীরে লাগানো হয় তাহলে প্রত্যেক স্থানের এক একটি কুরবানী করতে হবে।
৬. খুশবু লাগানোর পর কুরবানী করা হলো কিন্তু খুশবু গেল না, তাহলে পুনরায় কুরবানী করতে হবে।
৭. খুশবুদার পোশাক পরে একদিন কাটালে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।
৮. তরল মেহদী মাথা, দাড়ি, হাত ও পায়ে মাখলে এক কুরবানী।
৯. সিলাই করা কাপড় পরিধান করলে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার শর্ত এই যে, যদি তা একদিন ও একরাত পরিধান করে থাকা হয়। তার কম সময় পরিধান করে থাকলে কুরবানী ওয়াজিব হবে না। শুধু সদকা করতে হবে। এটাও শর্ত যে, সিলাই করা কাপড় নিয়ম মাফিক পরিধান করবে। যদি কোর্তা বা শিরওয়ানী এমনি কাঁধের ওপর ফেলে রাখে এবং আস্তিনে হাত দেয়া না হয়, তাহলে জেনায়েত হবে না।
নাজাসাতে হুকমী থেকে পাক না হয়ে তাওয়াফ করলে কুরবানী ওয়াজিব হওয়া সম্পর্কে মাসায়ালা নিম্নরূপ:
১০. তাওয়াফে যিয়ারত ছাড়া যে কোনো তাওয়াফ জানাবাত অবস্থায় করা হলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।
১১. তাওয়াফে যিয়ারত হাদাসে আসগর অবস্থায় করা হলে এক কুরবানী ওয়াজিব এবং ওমরার তাওয়াফ হাদাসে আসগর অবস্থায় করা হলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।
১২. তাওয়াফে যিয়ারতে ঊর্ধ্ব সংখ্যায় তিন চক্কর বাদ পড়লে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে এবং তিনের বেশী বাদ গেলে শুধু কুরবানীতে হবে না; দ্বিতীয়বার তাওয়াফ করতে হবে।
১৩. হজ্জের ওয়াজিবগুলোর মধ্যে কোনো ওয়াজিব পরিত্যাগ করলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।
১৪. মুফরেদ মস্তক মুণ্ডন বা চুল ছাটা অথবা তাওয়াফে যিয়ারত ১০ই যুলহজ্জের পরে করলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।
১৫. কারেন যদি যবেহ করার পূর্বে অথবা রামী করার পূর্বে মস্তক মুণ্ডন করে তাহলে এক কুরবানী ওয়াজিব হবে।
যেসব জেনায়েত শুধু সদকা ওয়াজিব
১. খুশবু ব্যবহার এমন পরিমাণে করা যার জন্যে কুরবানী ওয়াজিব হয় না সে অবস্থায় সদকা ওয়াজিব হবে। (সদকা অর্থ সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ সদকা) যেমন, এক অঙ্গের কম স্থানে খুশবু লাগানো হলো, অথবা পোশাক এক বর্গ বিঘত স্থানের কম অথবা বেশী স্থানে লাগানো হলো কিন্তু পুরো একদিন বা পুরো এক রাত ব্যবহার করা হলো না।
২. সেলাই করা পোশাক একদিন অথবা এক রাত্রের কম সময়ে পরিধান করা হয়েছে অথবা এতো সময় মাথা ঢাকা হয়েছে, তাহলে এক সদকা ওয়াজিব হবে। আর যদি অল্প সময়ের জন্য মাথা ঢাকা হয়েছে অথবা সেলাই করা কাপড় পরা হয়েছে। যেমন এক ঘন্টারও কম, তাহলে একমুষ্টি আটা দিলেই যথেষ্ট হবে।
৩. তাওয়াফে কুদুম অথবা তাওয়াফে বেদা (বিদায়ী তাওয়াফ) অথবা কোনো নফল তাওয়াফ হাদাসে আসগারের অবস্থায় করলে এক সদকা ওয়াজিব হবে।
৪. তাওয়াফে কুদুম অথবা বিদায়ী তাওয়াফ অথবা সায়ী তিন অথবা তিনবারের কম চক্কর পরিত্যাগ করলে প্রত্যেক চক্করের জন্য এক একটি সদকা ওয়াজিব হবে।
৫. এক দিনে যতবার রামী ওয়াজিব তার অর্ধেকের কম ছেড়ে দিলে যেমন ১০ই তারিখ জুমরাতুল ওকবায় সাত রামী ওয়াজিব, তার মধ্যে কেউ তিন রামী অর্থাৎ পাথর মারা বাদ দিল। তাহলে প্রত্যেক পাথরের বদলায় এক এক সদকা ওয়াজিব হবে।
৬. কেউ অন্য কোনো ব্যক্তির মাথা অথবা ঘাড়ের চুল বানিয়ে দিল, তা সে দ্বিতীয় ব্যক্তি মুহরেম অথবা গায়ের মুহরেম হোক, তাহলে এক সদকা যে চুল বানিয়ে দেবে তার ওপর ওয়াজিব হব।
৭. পাঁচটি নখ অথবা তার বেশী কাটিয়ে নেয়া হলো, কিন্তু এক হাত বা পায়ের নখ নয়, বিভিন্ন হাত পায়ের তাহলে এক সদকা ওয়াজিব হবে।
নীতিগত হেদায়েত
১. যদি একটি সদকার মূল্য অথবা কয়েকটি ওয়াজিব সদকার মূল্য একটি কুরবানীর মূল্যের সমান হয়, তা কুরবানী সস্তা হওয়ার কারণে হোক কিংবা কয়েকটি সদকার মূল্য এতো বেশী হলো যে, তা দিয়ে একটি কুরবানী খরিদ করা যায়, তাহলে স মূল্য থেকে কিছু অর্থ কমিয়ে ফেলা উচিত যাতে করে অবশিষ্ট মূল্য কুরবানীর সমান না হয়।
২. হজ্জের কোনো ওয়াজিব যদি বিনা কারণে বাদ যায় তাহলে কুরবানী ওয়াজিব হবে। আর যদি কোনো ওজরের কারণে বাদ পড়ে তাহলে কুরবানী ও সদকা কোনোটাই ওয়াজিব হবে না।
৩. ইহরাম অবস্থায় যে কাজ নিষিদ্ধ তা করলে কোনো সময়ে কুরবানী এবং কোনো সময়ে সদকা ওয়াজিব হয়। কুরবানী ওয়াজিব হলে এ এখতিয়ারও থাকে যে, কুরবানীর পরিবর্তে ছয়জন মিসকীনকে একটি করে সদকা দিয়ে দেয়া যায়। এ এখতিয়ারও আছে যে, যখন এবং যেখানে ইচ্ছা তিনটি রোযাও রাখা যায়।
সদকা ওয়াজিব হওয়ার পর সদকার স্থলে একটি রোযা রাখার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে।
শিকারের বিনিময়
ইহরামে নিষিদ্ধ কাজের মধ্যে বন্য পশু শিকারও শামিল। এ শিকার করা নিষিদ্ধ এবং শিকারের কাউকে সাহায্য করাও নিষিদ্ধ। বন্য পশু শিকার করলে তার বদলা দিতে হবে। বদলা অর্থ শিকারের মূল্য যা দুজন ন্যায়পরায়ণ লোক ঠিক করে দেবে। কুরআনে আছেঃ
*******আরবী*********
হে ঈমানদারগণ ইহরাম অবস্থায় শিকার করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত শিকার করে, তাকে তার সমতুল্য এক পশু বদলা দিতে হবে। আর এর ফায়সালা তোমাদের মধ্যে থেকে দুজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি করবে। আর এ হাদী কাবায় পাঠাতে হবে অথবা এ জেনায়েতের কাফফরা স্বরূপ কয়েকজন মিসকীনকে খানা খাওয়াতে হবে অথবা সেই পরিমাণে রোযা রাখতে হবে যাতে করে কৃতকর্মের পরিমাণ ভোগ করতে পারে। (সূর আল মায়েদাঃ ৯৫)
এ আয়াতে যে শিকার হারাম করা হয়েছে তা স্থল ভাগের শিকার। নদী বা সমুদ্রের শিকার জায়েয। তা খাওয়া জায়েয হোক বা না হোক। কুরআন সুস্পষ্ট করে বলেঃ
*******আরবী*********
তোমাদের জন্য সামুদ্রিক শিকার ও তা খাওয়া হালাল করা হয়েছে, তোমাদের জন্যে অবস্থান কালেও এবং কাফেলার পাথেয় হিসেবেও। কিন্তু স্থল ভাগের শিকার যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় আছে তোমাদের জন্যে হারাম। (সূরা আল মায়েদাঃ৯৬)
শিকার ও তার বদলার মাসায়েল
১. স্বয়ং শিকার করা যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি শিকারির সাহায্য করাও নিষিদ্ধ। শিকারির জন্যে যেমন বদলা দিতে হবে, সাহায্যকারীকেও বদলা নিতে হবে।
২. কয়জন মুহরেম মিলিত হবে কোনো শিকার করলো অথবা একজন শিকার করলো এবং অন্যান্যজন সাহায্য করলো তাহলে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা বদলা দিতে হবে।
৩. যদি একজন মুহরেম কয়েকটা শিকার করে তাহলে প্রত্যেক শিকারের জন্য আলাদা বদলা দিতে হবে।
৪. শুধু বন্য পশু শিকার করলে তার বদলা দিতে হবে। পালিত পশু শিকার করলে বা হত্যা করলে তার বদলা দিতে হবে না। যেমন কেউ যদি ছাগল, গরু, উট, মুরগী ইত্যাদি মারে তাহলে তার বদলা দিতে হবে না
৫. যেসব পশুর গোশত হালাল নয়, তা যতো বড়ো হোক না কেন তার বদলা একটি ছাগল। যেমন কেউ হাতি মারল, তাহলে তার বদলায় একটা ছাগল দিতে হবে।
৬. জুই অথবা ফড়িং যদি তিনটার চেয়ে বেশী নিজে মারে অথবা অন্যকে মারতে আদেশ দেয় তাহলে এক সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। তিনটা অথবা তিনটার কম মারলে যা ইচ্ছা সদকা হিসেবে দিয়ে দেবে।
৭. শিকার যদি কারো মালিকানায় হয় তাহলে দ্বিগুণ বদলা দিতে হবে আল্লাহর পথে দিতে তো হবেই, মালিককে প্রস্তাবিত মূল্যও দিতে হবে।
৮. শিকার যে স্থানে করা হবে সে স্থানের এবং সে সময়ের মূল্য ওয়াজিব হবে। অন্য কোনা স্থান বা সময়ের মূল্য ধরা যাবে না। এজন্যে স্থান ও কালের জন্য মূল্যর মধ্যে কম বেশী হয়।
৯. এটাও করা যেতে পারে যে, শিকারের সমতুল্য পশু খরিদ করে হেরেমে যবেহ করার জন্য পাঠিয়ে দিতে হবে। এটাও করা যেতে পারে যে, তার মূল্য দ্বারা খাদ্যশস্য খরিদ করে প্রত্যেক মিসকীনকে এক এক সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ দিয়ে দিতে হবে। অথবা প্রত্যেক মিসকীনকে সদকার পরিবর্তে এক একটি রোযা রাখতে হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত মূল্য যদি কোনো কুরবানী খরিদ না করা যায় তাহলে দুটো পন্থা আছে। প্রত্যেক মিসকীনকে সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ দিয়ে অথবা প্রত্যেক সদকার পরিবর্তে একটি করে রোযা রাখবে।
১০. যদি শিকারের প্রস্তাবিত মূল্যে এতোটা না হয় যার দ্বারা এক সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ খাদ্য শস্য কেনা যায়, তাহলে যতোটুকু পাওয়া যায় সদকা করবে অথবা রোযা রাখবে।
১১. বদলাতে যে সদকা দেয়া হবে তার হুকুম ও ব্যয়ের খাত তাই, যা সদকায়ে ফিতরের।
এহসানের বয়ান
এহসানের ………… আভিধানিক অর্থ বাধা দেয়া, নিষেধ করা, বিরত রাখা। পরিভাষায় এহসানের অর্থ এইযে, কোনো ব্যক্তি হজ্জ অথবা ওমরার জন্যে ইহরাম বাধলো। তারপর হজ্জ বা ওমরায় যাওয়া থেকে তাকে বিরত রাখা হলো, এমন ব্যক্তিকে পরিভাষায় বলা হয় মুহসসার (যাকে বিরত রাখা হয়েছে)।
ইহরাম বাধার পর হজ্জ থেকে বিরত থাকা, হজ্জ ওমরাহ করতে না পারা জেনায়েত। এজন্যে মুহাসসারের ওয়াজিব যে, সে এহসানের বদলার সাধ্যমত কুরবানী করবে। তাকে বলে দমে এহসার। কুরআন বলেঃ
*******আরবী*********
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে হজ্জ ও ওমরার নিয়ত করলে তা পূরণ কর। যদি কোথাও পরিবেষ্টিত হয়ে পড় কিংবা থেমে যেতে হয়, তাহলে যে কুরবানীই পাওয়া যায় তা আল্লাহর সামনে পেশ কর এবং মাথা মুণ্ডন করো না, যতক্ষণ না হাদীর পশু গন্তব্য স্থানে পৌঁছে যায়। (সূরা বাকারাঃ ১৯৬)
এহসানের কয়েকটা উপায়
ইহরাম বাধার পর বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার ও হজ্জ করতে না পারার বহু কারণ হতে পারে যার কিছুটা উল্লেখ করা হলোঃ
১. পথ নিরাপদ না হওয়া, দুশমনের ভয় থাকা, হত্যা ও লুণ্ঠনের ভয়, পথে কোনো হিংস্র জন্তু থাকা অথবা অন্য কোনো প্রকারের জানমালের আশংকা হওয়া।
২. ব্যাধিগ্রস্ত হওয়া, এমন আশংকা যে, সামনে অগ্রসর হলে রোগ বেড়ে যাবে, দুর্বলতার কারণে আর অগ্রসর হওয়ার শক্তি না থাকা।
৩. ইহরাম বাধার পর নারীর সাথে কোনো মুহাররাম পুরুষ না থাকা, আছে তবে অসুস্থ হলো, অথবা মারা গেল, অথবা ঝগড়া হলো এবং সঙ্গে যেতে অস্বীকার করলো কিংবা কেউ তাকে যেতে দিল না।
৪. সফর খরচ রইলো না, কম হয়ে গেল অথবা চুরি হয়ে গেল।
৫. রাস্তা ভুলে গেল এবং রাস্তা বলে দেয়ার কেউ রইলো না।
৬. কোনো নারীর ইদ্দত শুরু হলো। যেমন স্বামী তালাক দিল অথবা ইহরাম বাধার পর স্বামীর মৃত্যু হলো।
৭. কোনো নারী স্বামীর বিনা অনুমতিতে ইহরাম বাধলো এবং ইহরাম বাধার পর স্বামী নিষেধ করলো। এ সকল অবস্থায় ইহরাম বাধার পর সে ব্যক্তি মুহাসসার হয়ে যাবে।
এহসানের মাসায়েল
১. এহসানের ফলে মুহাসসার সাধ্য মতো উট,গরু, ছাগল যা পারে তা-ই খরিদ করে হেরেমে পাঠিয়ে দেবে যেন তার পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয়।
২. এহসানের কুরবানী ওয়াজিব। যতক্ষণ মুহাসসারের পক্ষ থেকে হেরেমে কুরবানী করা না হয়, ততোক্ষণ মুহাসসার তার ইহরাম খুলবে না। কুরবানীর পশু বা তার অর্থ পাঠাবার সময় সে যবেহ করার দিন ধার্য করে দেবে যাতে করে ঐদিন সে তার ইহরাম খুলতে পারে।
৩. ওমরাহ অথবা হজ্জে এফরাদ করতে বাধাপ্রাপ্ত হলে এক কুরবানী এবং হজ্জে কেরান বা তামাত্তু করতে না পারলে দু কুরবানী পাঠাতে হবে যা তার অর্থ পাঠাতে হবে।
৪. এহসানের কুরবানীর গোশত মুহাসসারের জন্য খাওয়া জায়েয নয়। কারণ এটাও এক প্রকার জেনায়েতের কুরবানী।
৫. কুরবানীর পশু পাঠাবার পর যদি বাধা উত্তীর্ণ হয়ে যায় এবং এটা সম্ভব হয় যে, মুহাসসার কুরবানীর পশু যবেহ হবার পূর্বে মক্কায় পৌছতে পারবে এবং হজ্জের সৌভাগ্য লাভ করবে। তাহলে শীঘ্রই হজ্জের রওয়ানা হওয়া তার ওপর ওয়াজিব হবে। কিন্তু যদি কুরবানীর পূর্বে পৌছতে না পারে এবং হজ্জের সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে রওয়ানা না হওয়াই তার জন্য ওয়াজিব।
বদলা হজ্জ
বদলা হজ্জের অর্থ হলো নিজের স্থলে নিজের খরচায় অন্যকে দিয়ে হজ্জ করানো। এক ব্যক্তির ওপর হজ্জ ফরয কিন্তু কোনো অনিবার্য কারণে সে নিজে হজ্জে যেতে পারছে না। যেমন অসুস্থতা, অতি বার্ধক্য এবং এ ধরনের অন্য কোনো কারণে। সে জন্য তার এ সুযোগ রয়েছে যে, সে অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করে হজ্জে পাঠিয়ে দেবে এবং সে ব্যক্তি তার হয়ে হজ্জ করবে।
হযরত আবু রেযীন (রা) নবী (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতা অতি বৃদ্ধ হয়েছেন, না তিনি হজ্জ করতে পারেন না ওমরাহ। তিনি সওয়ারীর ওপর বসতেও পারেন না। নবী (স) বলেন তুমি তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ্জ ও ওমরাহ কর। (তিরমিযি)
এর থেকে জানা গেল যে, অন্যের পরিবর্তেও হজ্জ করা সহীহ হবে। যে ব্যক্তি স্বয়ং তার ফরয হজ্জ আদায় করতে পারে না সে অন্যকে পাঠিয়ে নিজের ফরয আদায় করতে পারে। বরঞ্চ এমন অবস্থায় নিজের ফরয আদায় করানো উচিত। এ হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত ফরয এবং যে ব্যক্তি অন্যকে পাঠাবার সুযোগ পায় না সে অসিয়ত করে যাবে যে, তারপর তার মাল থেকে বদলা হজ্জ করাতে হবে।
এ ব্যক্তি নবী (স) এর দরবারে হাজির হলো এবং বললো ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার পিতার মৃত্যু হয়েছে এবং তার জীবদ্দশায় তিনি ফরয হজ্জ আদায় করতে পারেন নি। তাহলে আমি কি তার হয়ে হজ্জ করবো? নবী (স) বললেন, যদি তার কোনো ঋণ থাকতো তাহলে তুমি তা পরিশোধ করতে? লোকটি বললোঃ জি হ্যাঁ, অবশ্যই পরিশোধ করতাম। নবী (স) বললেন, আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করা তো আরও জরুরী। (জামউল ফাওয়ায়েদ)
বদলা হজ্জ সহীহ হওয়ার শর্ত
বদলা হজ্জ সহীহ হওয়ায় ষোলটি শর্ত যার মধ্যে প্রথম পাঁচটি শর্ত তার সাথে সম্পর্কিত যে বদলা হজ্জ করাবে এবং এগারোটি শর্ত বদলা হজ্জকারীর সাথে সম্পর্কিত।
১. যে বদলা হজ্জ করাতে চায়, শরীয়াতের দৃষ্টিতে তার ওপর হজ্জ ফরয হতে হবে। এমন ব্যক্তি যদি বদলা হজ্জ করায় যার ওপর হজ্জ ফরয নয় অর্থাৎ তার সামর্থ্য নেই, তাহলে এ বদলা হজ্জ ফরয আদায় হবে না। যেমন সে বদলা হজ্জের পর সে ব্যক্তি আর্থিক দিক দিয়ে সামর্থবান হলো এবং তার ওপর হজ্জ ফরয হলো।তখন তার করানো বদলা হজ্জের দ্বারা তার ফরয আদায় হবে না। বরঞ্চ পুনরায় বদলা হজ্জ করাতে হবে, যদি সে নিজে না পারে।
২. যে বদলা হজ্জ করাতে চায় তার স্বয়ং অক্ষম হতে হবে। তার অক্ষমতা যদি সাময়িক হয় যা দূর হওয়ার আশা আছে। তাহলে বদলা হজ্জ করাবার পর যখন সে অক্ষমতা স্থায়ী হয় ও তা দূর হবার কোনো সম্ভাবনা না থাকে, যেমন বার্ধক্যের কারণে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে অথবা অন্ধ হয়েছে তাহলে এ অক্ষমতার শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা শর্ত নয়। যদি আল্লাহ তায়ালা তার বিশেষ মেহেরবানীতে বদলা হজ্জ করাবার পর তার ক্ষমতা দূর করে দেন তাহলে পুনর্বার হজ্জ করা ফরয হবে না ফরয আদায় হয়ে গিয়েছে বুঝতে হবে।
৩. বদলা হজ্জ করাবার পূর্বে এ অক্ষমতা প্রকাশ হওয়া দরকার। বদলা হজ্জ করাবার পর যদি অক্ষমতা প্রকাশ পায় তাহলে বদল হজ্জ ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য হবে না। অক্ষমতা প্রকাশ পাওয়ার পর বদলা হজ্জ করানো জরুরী হবে।
৪. যে বদলা হজ্জ করাতে চায় তাকে স্বয়ং অন্য কাউকে হজ্জের জন্যে বলতে হবে। যদি কেউ নিজে নিজে অন্যের পক্ষ থেকে তার বলা ছাড়া হজ্জ করে তাহলে ফরয দায়মুক্ত হবে না মরবার সময় অসিয়ত করাও বলার মধ্যেই শামিল। অবশ্য কারো ওয়ারিশ যদি মৃত ব্যক্তির অসিয়ত ছাড়া তার পক্ষ থেকে বদলা হজ্জ করে বা অন্য কারো দ্বারা করায় তাহলে ফরয আদায় হয়ে যাবে।
৫. যে বদলা হজ্জ করাবে তাকে স্বয়ং হজ্জের সমুদয় খরচ বহন করতে হবে।
৬. বদলা হজ্জকারীকে মুসলমান হতে হবে।
৭. বদল হজ্জকারীকে হুশ জ্ঞানসম্পন্ন লোক হতে হবে- পাগল বা মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়া চলবে না।
৮. বদল হজ্জকারীকে বুদ্ধিমান হতে হবে- নাবালেগ হলেও চলবে। বুদ্ধি শুদ্ধি নেই এমন লোকের বদলা হজ্জ চলবে না। ফরয আদায় হবে না।
৯. বদলা হজ্জকারী ইহরাম বাধার সময় তার পক্ষ থেকে হজ্জের নিয়ত করবে- যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে।
১০. সেই ব্যক্তি বদলা হজ্জ করবে যাকে হজ্জ করতে বলবে ঐ ব্যক্তি যার পক্ষ থেকে বদলা হজ্জ করা হচ্ছে। অর্থাৎ যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে সে যাকে বদলা হজ্জ করতে বলবে একমাত্র সেই করবে। তবে যদি এ অনুমতি সে দেয় যে, অন্য কাউকে দিয়েও সে বদলা হজ্জ করাতে পারবে। তাহলে অন্য ব্যক্তির দ্বারাও বদলা হজ্জ সহীহ হবে।
১১. বদলা হজ্জকারী ঐ ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী হজ্জ করবে যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে। যেমন যে ব্যক্তি বদলা হজ্জ করাচ্ছে সে যদি কেরানের কথা বলে কিংবা তামাত্তুর কথা বলে তাহলে বদলা হজ্জকারীকে তদনুযায়ী কেরান অথবা তামাত্তু হজ্জ করতে হবে।
১২. বদলা হজ্জকারী একই প্রকার হজ্জের এবং এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে ইহরাম বাধবে। দু ব্যক্তির পক্ষ থেকে বদলা হজ্জের ইহরাম বাধলে ফরয আদায় হবে না।
১৩. বদলা হজ্জকারী যানবাহনে করে হজ্জে যাবে পায়ে হেটে নয়।
১৪. বদলা হজ্জ যে করাতে চায় তার স্থান থেকেই বদলা হজ্জকারীকে হজ্জের সফর শুরু করতে হবে। যদি মৃত ব্যক্তির এক তৃতীয়াংশ মাল থেকে বদলা হজ্জ করানো হয় তাহলেও এ অর্থে যেখান থেকে হজ্জের সফর শুরু করা যেতে পারে, সেখান থেকে সফর করতে হবে।
১৫. বদলা হজ্জকারী যেন হজ্জ নষ্ট না করে। হজ্জ নষ্ট করার পর তার কাযা করলে যে বদলা হজ্জ করাচ্ছে তার ফরয আদায় হবে না।
১৬. হানাফীদের মতে বদলা হজ্জকারীর জন্যে এ শর্ত আরোপের প্রয়োজন নেই যে, তাকে প্রথমে আপন ফরয হজ্জ আদায় করতে হবে এবং তারপর সে বদলা হজ্জ করতে পারবে। অবশ্য আহলে হাদীসের কাছে শর্ত এই যে, প্রথমে ফরয হজ্জ করে না থাকলে সে বদলা হজ্জ করতে পারবে না।
মদীনায় উপস্থিতি
মদীনায় তাইয়েবাতে হাজিরা দেয়া অবশ্য হজ্জের কোনো রুকন নয়। কিন্তু মদীনার অসাধারণ মহত্ব ও ফযিলত মসজিদে নববীতে নামাযের প্রভূত সওয়াব এবং নবীর দরবারে হাজিরার প্রবল আকাংখা মুমিনকে মদীনায় টেনে নিয়ে যায়। চিরদিন তা-ই হয়ে এসেছে। মানুষ দূর দূরান্তে সফর করে আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌছবে এবং তারপর দরবারে নববীতে দরূদ ও সালাম পেশ না করেই বাড়ী ফিরবে এ এক চরম বেদনাদায়ক নৈরাশ্য। তার জন্যে মুমিনের দিল আর্তনাদ করে ওঠে।
মদীনা তাইয়েবার মহত্ত্ব ও ফযিলত
এর থেকে অধিক মহত্ত্ব ও ফযিলত মদীনার আর কি হতে পারে যে, এখানে মানবতার মহান শুভাকাঙ্ক্ষী তার জীবনের দশটি বছর অতিবাহিত করেছেন। এখানে তার পবিত্র হস্তে নির্মিত মসজিদ রয়েছে। যার মধ্যে তিনি তার সাহাবায়ে কেরামসহ নামায আদায় করেছেন। এখানেই সেই ঐতিহাসিক প্রান্তর রয়েছে যেখানে হক ও বাতিলের সিন্ধান্তকর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং এ পাক যমীনেই বদরের শহীদগণ শান্তিতে শায়িত রয়েছেন যাদের জন্যে গোটা উম্মাতে মুসলেমা গর্বিত। এখানেই ঐসব পাকরূহ বিশ্রাম করছে যাদেরকে তাদের জীবদ্দশায় নবী (স) বেহেশতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন, আর এ পাক যমীনেই রহমতের নবী স্বয়ং অবস্থান করছেন।
হিজরতের পূর্বে এ শহরের নাম ছিল ইয়াসরাব। হিজরতের পর মদীনায়ে তাইয়েবা নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এর নাম রেখেছেন তাবা ………. বলে। (হযরত জাবের বিন সামরা (রা) বলেন, আমি নবী (স)কে একথা বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তায়ালা মদীনার নাম তাবা রেখেছেন। (মুসলিম)
তাবা, তীবা ও তাইয়েবা …………… শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে পবিত্র ও মনোরম সত্য কথা বলতে কি মদীনার পাক যমীন প্রকৃতপক্ষে পবিত্র ও মনোরম।
হিজরতের পর হযরত আবু বকর (রা) এবং হযরত বেলাল (রা) কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। কারণ এখানকার আবহাওয়া ছিল খুবই খারাপ ও অস্বাস্থ্যকর। প্রায়ই মহামারি রোগ দেখা দিত। নবী (স) দোয়া করেন, হে পরওয়ারদেগার! মদীনার জন্যে আমাদের হৃদয়ে মহব্বত পয়দা করে দাও যেমন মক্কার জন্যে আমাদের মহব্বত রয়েছে। এখানকার জ্বর ব্যাধিকে হুজফার দিকে বিতাড়িত করে দাও এবং এখানকার আবহাওয়া মনোরম করে দাও। (বুখারী)
মদীনার প্রতি নবী (স) এর যে অসাধারণ মহব্বত ছিল এর থেকে অনুমান করা যায় যে, যখনই করা যায় যে, যখনই তিনি কোনো সফর থেকে মদীনায় ফিরতেন, তখন দূর থেকে শহরের দালান কোঠা দেখেই তিনি আনন্দে অধীর হয়ে পড়তেন এবং বলতেন, এইতো তারা এসে গেল। (বুখারী) তারপর তিনি ঘাড়ের ওপর থেকে চাদর নামিয়ে ফেলে বলতেন, এ হচ্ছে তাইয়েবার বাতাস ওহ! কত মধুর।
তার সঙ্গী সাথীদের মধ্যে যারা ধুলাবালি থেকে বাঁচবার জন্যে মুখ ঢেকে রাখতেন তাদেরকে বলতেন, মদীনার মাটিতে আরোগ্য রয়েছে। (জাযবুল কুলুব)
নবী (স) বলেন,ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন, মদীনার মাটিতে সকল রোগের ওষুধ রয়েছে।
হযরত সাদ (রা) বলেন,আমার মনে হয়, নবী বলেছিলেন, এর মাটিতে কুষ্ঠরোগেরও আরোগ্য রয়েছে। (আত -তারগীব)
মদীনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকে তাকীদ করে নবী (স) বলেছেন-ইবরাহীম (আ ) মক্কাকে হেরেম বলে ঘোষণা করেন এবং আমি মদীনাকে হেরেম ঘোষণা করছি। মদীনার দু ধারের মধ্যবর্তী স্থানও হেরেম। এখানে না খুনখারাবি করা যাবে, না অস্ত্রধারণ করা যাবে। গাছের পাতা পর্যন্ত ছেড়া যাবে না। অবশ্য পশুর খাদ্যের জন্য তা করা যেতে পারে। (মুসলিম)
মদীনায় বসবাস করতে গিয়ে সেখানে দুঃখ কষ্ট স্বীকার করার ফযিলত বয়ান করে নবী (স) বলেন, আমার উম্মাতের মধ্যে যে ব্যক্তি মদীনায় দুঃখ কষ্ট স্বীকার করে বসবাস করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার জন্যে শাফায়াত করব। (মুসলিম)
নবী (স) বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সকলের প্রথমে আমি মদীনাবাসীদের শাফায়াত করব। তারপর মক্কাবাসীর এবং তারপর তায়েফবাসীর। (তাবারানী)
হযরত ইবরাহীম (আ ) মক্কা ভূমিতে তার বংশধরকে পুনর্বাসিত করতে গিয়ে এ ঘোষণা করেন-
*******আরবী*********
অতএব (হে আল্লাহ) তুমি মানুষের অন্তঃকরণ তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদের খাদ্যের জন্যে ফলমূল দান কর। যাতে করে তারা কৃতজ্ঞ বান্দাহ হতে পারে। (সূরা ইবরাহীম)
নবী (স) এ দোয়ার বরাত দিয়ে মদীনার সপক্ষে কল্যাণ ও বরকতের দোয়া করেন-
আয় আল্লাহ! ইবরাহীম (আ )তোমার খাস বান্দাহ। তোমার দোস্ত এবং তোমার নবী ছিলেন। আমিও তোমার বান্দাহ ও নবী। তিনি মক্কার কল্যাণ ও বরকতের জন্য তোমার কাছে দোয়া করেন। আমিও মদীনার কল্যাণ ও বরকতের জন্য তেমনি দোয়া করছি বরঞ্চ তার চেয়ে অধিক। (মুসলিম)
মদীনার পবিত্রতা ও দীনি গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন- কিয়ামত সে সময় পর্যন্ত হবে না, যতক্ষণ না মদীনা তার ভেতর থেকে দুষ্কৃতিকারীদেরকে এমনভাবে বের করে দেবে যেমন কর্মকারের চুল্লি লোহার ময়লা বের করে দেয়। (মুসলিম)
মদীনায় মৃত্যুবরণের আকাংখা এবং চেষ্টা করার ফযিলত বর্ণনা করে নবী (স) বলেন-
কেউ মদীনায় মৃত্যুবরণ করতে পারলে যেন তা অবশ্যই করে। এজন্যে যে, যে ব্যক্তি মদীনায় মৃত্যুবরণ করবে আমি তার শাফায়াত করব। (মুসনাদে আহমদ, তিরমিযি)
হযরত ইবনে সাদ ৯রা) বলেন, হযরত আওফ বিন মালেক আশজানী (রা) স্বপ্ন দেখেন যে, হযরত ওমর (রা) কে শহীদ করে দেয়া হয়েছে। এ স্বপ্নের কথা তার কাছে বলা হলে তিনি দুঃখ করে বলেন-
আমার শাহাদাতের ভাগ্য কেমন করে হবে। আমি তো আরব ভূখণ্ডেই অবস্থান করছি, স্বয়ং কোনো জেহাদেই শরীক হই না এবং লোক আমাকে সর্বদা ঘিরে রাখে। তবে হ্যাঁ যদি আল্লাহর ইচ্ছা হয় তাহলেও এ অবস্থাতে তিনি আমাকে শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করবেন। তারপর তিনি এ দোয়া পড়লেন-
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! আমাকে তোমার পথে শহীদ হওয়ার সৌভাগ্য দান কর এবং তোমার রাসূলের শহরে আমার মৃত্যু দাও।
মসজিদে নববীর মহত্ত্ব
মসজিদে নববীর বড়ো মহত্ত্বও এই যে, নবী পাক তার পবিত্র হাতে এ মসজিদ তৈরী করেন এবং কয়েক বছর ধরে তার মধ্যে নামায পড়েন। এ মসজিদকে তিনি তার নিজের মসজিদ বলে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, আমার মসজিদে এক নামায পড়া অন্য মসজিদে হাজার নামাজের চেয়ে বেশী উত্তম, শুধু মসজিদুল হারাম ছাড়া।
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ক্রমাগত চল্লিশ ওয়াক্ত নামায এভাবে পড়বে যে মাঝের একটি নামাযও বাদ যাবে না, তার জন্য জাহান্নামের আগুন ও অন্যান্য আযাব মাফ করা হবে এবং এভাবে মুনাফেকি থেকেও তাকে রক্ষা করা হবে। (মুসনাদে আহমদ, আত–তারগীব)
নবী (স) বলেন, আমার ঘর ও আমার মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগানের মধ্যে একটি এবং আমার মিম্বর হাউজে কাওসার। (বুখারী, মুসলিম)
রওযা পাকের যিয়ারত
সেসব মুসলমান কত ভাগ্যবান ছিলেন যাদের চক্ষু শীতল হতো রাসূলে পাক (স) এর দীদার লাভে তারা সর্বদা রাসূলের সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন এবং তার কথায় প্রেরণা লাভ করেছেন। এ সৌভাগ্য শুধু সাহাবায়ে কেরামের জন্যে নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু এ সুযোগ তো কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে যে, রাসূল প্রেমিকগণ তার রওযা পাকে হাজিরা দেবে এবং তার দহলিজে দাড়িয়ে তার ওপর দরূদ ও সালাম পেশ করবে।
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, নবী (স) বলেছেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করলো এবং আমার মৃত্যুর পর আমার রওযা যিয়ারত করলো, সে আমার যিয়ারতের সৌভাগ্য ঠিক তার মতো লাভ করলো যে আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারত লাভ করেছে। (বায়হাকী)
যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমার কবর যিয়ারত করলো, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার যিয়ারত করলো। যে আমার করব যিয়ারত করলো, তার জন্যে আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল। আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্বেও আমার কবর যিয়ারত করলো না, তার কোনো ওজর ওজরই নয়। (ইলমুল ফিকাহ)
যে ব্যক্তি আমার কবর যিয়ারতের জন্যে এলো এবং এছাড়া তার আর অন্য কোনো কাজ ছিল না, তার জন্য আমার ওপর এ হক হয়ে গেল যে, আমি তার শাফায়াত করি। (ইলমুল ফিকাহ)
রওযা পাকের যিয়ারতের হুকুম
রওযা পাক যিয়ারত করা ওয়াজিব। হাদীস থেকে তাই মনে হয়। নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করলো কিন্তু আমার কবর যিয়ারত করতে এলো না সে আমার ওপর যুলুম করলো। আর এক হাদীসে আছে, যে শক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমার কবর যিয়ারত করলো না, তার ওজর গ্রহণযোগ্য নয়। এসব হাদীসের আলোকে ওলামায়ে কেরাম রওযা পাক যিয়ারত ওয়াজিব বলেছেন।
বস্তুত সাহাবায়ে কেরাম (রা) তাবেঈন এবং অন্যান্য ইসলামী মনীষীগণ রওযা যিয়ারতের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। হযরত ওমর (রা) এর অভ্যাস ছিল যখনই কোনো সফর থেকে আসতেন সর্বপ্রথম রওযা পাকে গিয়ে দরুদ ও সালাম পেশ করতেন।
হযরত ওমর (রা) একবার কাব আহবারকে নিয়ে মদীনা এলেন এবং সর্বপ্রথম রওযা পাকে হাজির হয়ে দরূদ ও সালাম পেশ করলেন।
হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয সিরিয়া থেকে এ উদ্দেশ্যে তার বাণী বাহককে মদীনায় পাঠালেন যে, সে সেখানে পৌঁছে দরবারে রেসালাতে তার (ওমর বিন আবদুল আযীয) সালাম পৌঁছাবে।