কুরবানীর বর্ণনা
কুরবানীর ইতিহাস ততোটা প্রাচীন যতোটা প্রাচীন ধর্ম অথবা মানবের ইতিহাস। মানুষ বিভিন্ন যুগে সমান শ্রদ্ধা, জীবনদান, আত্মসমর্পণ, প্রেম-ভালোবাসা, বিনয়-নম্রতা, ত্যাগ ও কুরবানীর, পূজা অর্চনা ও আনুগত্য প্রভৃতির যে যে পন্থা পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, আল্লাহর শরীয়াত মানুষের মনস্তত্ব এবং আবেগ অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রেখে ওসব পন্থা-পদ্ধতি স্বীয় বিশিষ্ট নৈতিক সংস্কার সংশোধনসহ আল্লাহ তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। মানুষ তাদের আপন কল্পিত দেব দেবীর সামনে জীবন দানও করেছে। আর এটাই হচ্ছে কুরবানীর উচ্চতম বহিঃপ্রকাশ। এ জীবন দানকেও আল্লাহ তার নিজের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ ধরনের জীবন উৎসর্গ তিনি ছাড়া অন্যের জন্যে হারাম ঘোষণা করেছেন।
মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানী
মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানীর হযরত আদম (আ ) এর দু পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। এর উল্লেখ কুরআন পাকে রয়েছে।
*******আরবী*********
এবং তাদেরকে আদমের দু পুত্রের কাহিনী ঠিকমতো শুনিয়ে দাও। যখন তারা দুজন কুরবানী করলো, একজনের কুরবানী কবুল হলো, অপরজনের হলো না। (সূরা আল মায়েদাঃ ২৭)
প্রকৃতপক্ষে একজন যার নাম ছিল হাবিল, মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে একটি অতি সুন্দর দুম্বা কুরবানীরূপে পেশ করে।
অপর ব্যক্তির নাম ছির কাবিল। সে অমনোযোগ সহকারে খাদ্যের অনুপযোগী খানিক পরিমাণ খাদ্য শস্য কুরবানী স্বরূপ পেশ করলো। হাবিলের কুরবানী আকাশ থেকে এক খন্ড আগুন এসে জ্বালিয়ে গেল। এটাকে কবুল হওয়ার আলামত মনে করা হতো। অপরদিকে কাবিলের খাদ্য শস্য আগুন স্পর্শই করলো না। আর তা ছিল কবুল না হওয়ার আলামত।
সকল খোদায়ী শরীয়াতে কুরবানী
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যতো শরীয়াত নাযিল হয়েছে সে সবেরও মধ্যে কুরবানীর হুকুম ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদাতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।
*******আরবী*********
আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্যে কুরবানীর এক রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ঐসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যেসব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন। (সূরা হজ্জঃ৩৪)
অর্থাৎ কুরবানী প্রত্যেক শরীয়াতের ইবাদাতের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ ও জাতির নবীদের শরীয়াতে অবস্থার প্রেক্ষিতে কুরবানীর নিয়ম পদ্ধতি ও খুঁটিনাটি বিষয়সমুহ ভিন্ন ভিন্ন রয়েছে। কিন্তু মৌলিক দিক দিয়ে সকল আসমানী শরীয়াতে একথা যে, পশু কুরবানী শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যেই করতে হবে এবং করতে হবে তার নাম নিয়েই।
*******আরবী*********
অতএব ঐসব পশুর ওপরে শুধু আল্লাহর নাম নাও।
পশুর ওপর আল্লাহরই নাম নেয়াকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাকে যবেহ করতে হলে আল্লাহর নাম নিয়েই যবেহ করতে হবে এবং তার নাম নিয়েই তার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্যে যবেহ কর। কারণ তিনি তোমাদেরকে এসব পশু দান করেছেন। তিনি এসব তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি তাদের মধ্যে তোমাদের জন্যে বিভিন্ন মঙ্গল নিহিত রেখেছেন।
কুরবানী এক বিরাট স্মরণীয় বস্তু
আজকাল দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমানরা যে কুরবানী করে এবং তার ফলে বিরাট উৎসর্গের যে দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় তা প্রকৃতপক্ষে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর ফিদিয়া। কুরআনে এ মহান কুরবানীর ঘটনা পেশ করে তাকে ইসলাম, ঈমান ও ইহসান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কুরবানী প্রকৃতপক্ষে এমন এক সংকল্প,দৃঢ় বিশ্বাস,আত্মসমর্পণ ও জীবন দেয়ার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মানুষের কাছে যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর এবং তার পথেই তা উৎসর্গীকৃত হওয়া উচিত। এটা এ সত্যেরও নিদর্শন যে, আল্লাহর ইংগিত হলেই বান্দাহ তার রক্ত দিতেও দ্বিধা করে না। এ শপথ, আত্মসমর্পণ ও জীবন বিলিয়ে দেয়ার নামই
ঈমান, ইসলাম ও ইহসান।
*******আরবী*********
যখন সে (ইসমাঈল) তার সাথে চলাফেরার বয়সে পৌছলো তখন একদিন ইবরাহীম তাকে বললো প্রিয় পুত্র। আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যেন যবেহ করছি। বল দেখি কি রা যায়? পুত্র (বিনা দ্বিধায়) বললো, আব্বা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা শীঘ্র করে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে অবিচল দেখতে পাবেন। অবশেষে যখন পিতা পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদেরকে সোপর্দ করলেন এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপর করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্যে) তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, ইবরাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট অগ্নি পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কুরবানী ফিদিয়া স্বরূপ দিয়ে তাকে (ইসমাঈলকে) উদ্ধার করেছি। আরআমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে (ইবরাহীমের) এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম। শান্তি ইবরাহীমের ওপর, এভাবে জীবনদানকারীদেরকে আমরা এ ধরনের প্রতিদানই দিয়ে থাকি। নিশ্চিতরূপে সে আমাদের মুমিন বান্দাদের মধ্যে শামিল। (সুরা আস সাফফাতঃ ১০২-১১১)
অর্থাৎ যতদিন দুনিয়া টিকে থাকবে ততদিন উম্মতে মুসলেমার মধ্যে কুরবানীর এ বিরাট স্মৃতি হযরত ইসমাঈল (আ ) এ ফিদিয়া রূপে অক্ষুণ্ণ থাকবে। আল্লাহ এ ফিদিয়ার বিনিময়ে হযরত ইসমাঈল (আ ) এর জীবন রক্ষা করেন এ উদ্দেশ্যে যে, কিয়ামত পর্যন্ত যেন তার উৎসর্গীকৃত বন্দাগণ টিক এ দিনে দুনিয়া জুড়ে কুরবানী করতে পারে। এভাবে যেন তারা আনুগত্য ও জীবন দেয়ার এ মহান ঘটনার স্মৃতি জাগ্রত রাখতে পারে। কুরবানীর এ অপরিবর্তনীয় সুন্নাতের প্রবর্তক হযরত ইবরাহীম (আ ) এবং হযরত ইসমাঈল (আ ) আর এ সুন্নাতকে কিয়ামত পর্যন্ত জারী রাখবে হযরত নবী মুহাম্মাদ (স) এর উম্মতের জীবন দানকারী মুমিনগণ।
নবী (স) এর প্রতি নির্দেশ।
কুরবানী ও জীবন দানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্যে নবী (স) কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
*******আরবী*********
বল, হে মুহাম্মাদ (স) আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তার কোনো শরীক নেই, আমাকে তারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি সকলের আগে তার অনুগত ও ফরমা বরদার। (সূরা আনআমঃ ১৬২-১৬৩)
আল্লাহর ওপর পাকা পোক্ত ঈমান এবং তার তাওহীদের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের অর্থই এই যে, মানুষের সকল চেষ্টা চরিত্র তারই সন্তুষ্টির জন্যে নির্দিষ্ট হবে। আর সে ঐসব কিছুই তার পথে কুরবান করে তোর ঈমান, ইসলাম, আনুগত্য ও জীবন দেয়ার প্রমাণ পেশ করবে।
কুরবানীর প্রকৃত স্থান তো সেটা যেখানে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ হাজী তাদের নিজ নিজ কুরবানী পেশ করে। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে হজ্জের অন্যতম আমল। কিন্তু মেহেরবান আল্লাহ এ বিরাট মর্যাদা থেকে তাদেরকেও বঞ্চিত করেননি যারা মক্কা থেকে দূরে রয়েছে এবং হজ্জে শরীক হয়নি। কুরবানীর আদেশ শুধু তাদের জন্যে নয় যারা বায়তুল্লাহর হজ্জ করে, বরঞ্চ এ এক সাধারণ নির্দেশ। এটা প্রত্যেক সচ্ছল মুসলমানের জন্যে। আর একথা হাদীস থেকে প্রমাণিত আছে, হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) বলেন, নবী (স) দশ বছর মদীনায় বাস করেন এবং প্রতি বছর কুরবানী করতে থাকেন। (তিরমিযি, মেশকাত)
নবী (স) বলেন, যে সামর্থ্য থাকা সত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে। (জামাউল ফাওয়ায়েদ)
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) ঈদুল আযহার দিনে বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করেছে তাকে পুনরায় করতে হবে। যে নামাযের পরে করেছে তার কুরবানী পূর্ণ হয়েছে এবং সে ঠিক মুসলমানদের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।
একথা ঠিক যে, ঈদুল আযহার দিনে মক্কায় এমন কোনো নামায হয় না যার আগে কুরবানী করা মুসলমানদের সুন্নাতের খেলাপ। এ মদীনার কথা এবং তার সাক্ষ্যই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) পেশ করেছেন। তিনি আরও বলেন, নবী (স) ঈদগাহেতেই কুরবানী করতেন।
কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক
কুরআন কুরবানীর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের প্রতি ইংগিত করে। সত্য কথা এই যে, কুরবানী প্রকৃতপক্ষে তা-ই যা এসব উদ্দেশ্যের অনুভূতিসহ করা হয়।
১. কুরবানীর পশু আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন
*******আরবী*********
আর কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমার জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর একটি বানিয়ে দিয়েছি। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৬)
……. শব্দ ………… এর বহুবচন। …….. (শারীয়াহ) ঐ বিশেষ নিদর্শনকে বলে যা কোনো আধ্যাত্মিক ও অর্থপূর্ণ তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তা স্মরণ করার কারণ ও আলামত হয়ে পড়ে, কুরবানীর পশু ঐ আধ্যাত্মিক তত্ত্বের অনুভূত আলামত। কুরবানীকারী আসলে এ আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে যে, কুরবানীর পশুর রক্ত তার আপন রক্তেরই স্থলাভিষিক্ত। সে আবেগও প্রকাশ করে যে, তার জীবনও আল্লাহর পথে ঐভাবে কুরবানী করা হবে, যেভাবে এ পশু সে কুরবানী করেছে।
২. কুরবানী আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
*******আরবী*********
এভাবে এসব পশুকে তোমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছি যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার। (সূর আল হজ্জঃ৩৬)
আল্লাহ তায়ালা পশুকে মানুষের বশীভূত করে দিয়ে তাদের ওপর বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। মানুষ এসব থেকে বহু উপকার লাভ করে। তার দুধ পান করে, গোশত খায়। তার হাড়, চামড়া, পশম প্রভৃতি থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরী করে। চাষাবাদে তার সাহায্য নেয়। তাদের পিঠে বোঝা বহন করে, তাদেরকে বাহন হিসেবেও ব্যবহার করে। তাদের দ্বারা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তিও প্রকাশ করে। কুরআন এসবের উপকারের দিকে ইংগিত করে ও তাদেরকে মানুষের বশীভূত করার উল্লেখ করে আল্লাহ পুরস্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রেরণা সঞ্চার করতে চায়। সেই সাথে এ চিন্তাধারাও সৃষ্টি করতে চায় যে, যে মহান আল্লাহ এ বিরাট নিয়ামত দান করেছেন- তার নামেই কুরবানী হওয়া উচিত। কুরবানী আল্লাহর বিরাট নিয়ামতের বাস্তব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
৩. কুরবানী আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ
*******আরবী*********
আল্লাহ এভাবে পশুদেরকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা তার দেয়া হেদায়াত অনুযায়ী তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ কর। (সূরা আল হজ্জঃ ৩৭)
অর্থাৎ আল্লাহর নামে পশু যবেহ করা প্রকৃতপক্ষে একথারই ঘোষণা যে, যে আল্লাহ এসব নিয়ামত দান করেছেন এবং যিনি এসব আমাদের জন্যে বশীভূত করে দিয়েছেন- তিনিই এসবের প্রকৃত মালিক। কুরবানী সেই আসল মালিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং একথারও বাস্তব বহিঃপ্রকাশ যে, মুমিনের অন্তর থেকে আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখে।
পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে সে উপরোক্ত সত্যের বাস্তব বহিঃপ্রকাশ ও ঘোষণা করে এবং মুখে বিসমিল্লাহি আল্লাহ আকবার বলে এ সত্যের স্বীকৃতি দান করে।
কুরবানীর প্রাণ শক্তি
প্রাক ইসলামী যুগে লোক কুরবানী করার পর তার গোশত বায়তুল্লাহর সম্মুখে এনে রেখে দিত। তার রক্ত বায়তুল্লাহর দেয়ালে মেখে দিত। কুরআন বললো, তোমাদের এ গোশত ও রক্তের কোনোই প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তার কাছে তো কুরবানীর সে আবেগ অনুভূতি পৌঁছে যা যবেহ করার সময় তোমাদের মনে সঞ্চারিত হয় অথবা হওয়া উচিত। গোশত ও রক্তের নাম কুরবানী নয়। বরঞ্চ কুরবানী এ তত্ত্বেরই নাম যে, আমাদের সবকিছুই আল্লাহর জন্যে এবং তার পথেই উৎসর্গ করার জন্য।
কুরবানীকারী শুধুমাত্র পশুর গলায় ছুরি চালায় না। বরঞ্চ তার সকল কু প্রবৃত্তির ওপর ছুরি চালিয়ে তাকে নির্মূল করে। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কুরবানী করা হয়, তা হযরত ইবরাহীম (আ ) ও হযরত ইসমাঈল (আ ) এর সুন্নাত নয়, একটা জাতীয় রসম মাত্র। তাতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে, কিন্তু সেই তাকওয়ার অভাব দেখা যায় যা কুরবানীর প্রাণ শক্তি।
*******আরবী*********
ওসব পশুর রক্ত মাংস আল্লাহর কাছে কিছুতেই পৌঁছে না বরঞ্চ তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তার কাছে পৌঁছে।
যে কুরবানীর পেছনে তাকওয়ার আবেগ অনুভূতি নেই আল্লাহর দৃষ্টিতে সে কুরবানীর কোনোই মূল্যে নেই। আল্লাহর কাছে সে আমলই গৃহীত হয় যার প্রেরণা দান করে তাকওয়া।
*******আরবী*********
আল্লাহ শুধুমাত্র মুত্তাকীদের আমল কবুল করেন।
উট কুরবানীর আধ্যাত্মিক দিক
এবং কুরবানীর উটগুলোকে আমরা তোমাদের জন্যে আল্লাহ পুরস্তির নিদর্শন বানিয়ে দিয়েছি। এতে তোমাদের জন্যে শুধু মঙ্গল আর মঙ্গল। অতএব, তাদেরকে সারিবদ্ধ করে দাড় করিয়ে তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও এবং যখন (পড়ে গিয়ে) তাদের পার্শ্বদেশ যমীনে লেগে যাবে তখন তোমাদের স্বয়ং তা (গোস্ত) খাও এবং খাইয়ে দাও তাদেরকে যারা চায় না এবং তাদেরকেও যারা চায়। (সূরা হজ্বঃ ৩৬)
উট কুরবানী করার নিয়ম এই যে, তাদেরকে এক সারিতে দাড় করিয়ে তাদের হলকুমে (কণ্ঠদেশে) ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন তার থেকে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়। রক্ত নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা মাটিতে পড়ে যায়। কুরবানীর এ দৃশ্য একবার মনের মধ্যে অংকিত করুন এবং চিন্তা করুন যে, পশুর এ কুরবানী কোন বস্তু। এটা তো এই যে, এভাবে আমাদেরও জীবন আল্লাহর পথে কুরবান হওয়ার জন্যে তৈরী আছে। প্রকৃতপক্ষে এ কুরবানী আপনজনের কুরবানীরই স্থলাভিষিক্ত। এ অর্থেই উট কুরবানীর চিন্তা করুন। তার আহত হওয়া, রক্ত প্রবাহিত হওয়া, মাটিতে পড়ে যাওয়া এবং আল্লাহর পথে জীবন দেয়ার দৃশ্যটা একবার ভেবে দেখুন, যেন মনে হবে যে, জেহাদের ময়দানে আল্লাহর সৈনিকগণ সারি বেধে দাড়িয়ে আছে। তাদের কণ্ঠদেশে শত্রুর তীর অথবা গুলি বিদ্ধ হচ্ছে, তারপর খুনের ঝর্ণা ছুটছ। তারপর খুনরাঙা যমীন তাদের জীবনদানের সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং তারা একজন মাটিতে পড়ে আল্লাহর হাতে তাদের জান পেশ করছে।
কুরবানীর পদ্ধতি ও দোয়া
যবেহ করার জন্য পশুকে এমনভাবে শোয়াতে হবে যেন তা কেবলামুখী হয়, ছুরি খুব ধারালো করতে হবে। যথাসম্ভব কুরবানী নিজ হাতে যবেহ করতে হবে। কোনো কারণে নিজ যবেহ করতে না পারলে তার নিকটে দাড়িয়ে থাকতে হবে।
যবেহ করার সময় প্রথম এ দোয়া পড়তে হবে-
*******আরবী*********
আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ইবরাহীমের তরীকার ওপরে একনিষ্ঠ হয়ে ঐ আল্লাহর দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করছি যিনি আসমান যমীন পয়দা করেছেন এবং আমি কখনো শিরককারীদের মধ্যে নই। আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ- রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্যে তার কোনো শরীক নেই। এ নির্দেশই আমাকে দেয়া হয়েছে এবং আমি অনুগতদের মধ্যে একজন। হে আল্লাহ! এ তোমারই জন্যে পেশ করা হচ্ছে এবং এ তোমারই দেয়া। (মেশকাত)
তারপর বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে যবেহ করতে হবে। যবাইয়ের পর এ দোয়া পড়তে হবে-
*******আরবী*********
আয় আল্লাহ! তুমি এ কুরবানী আমার পক্ষ থেকে কবুল কর যেমন তুমি তোমার পিয়ারা হাবীব মুহাম্মাদ (স) এবং তোমার খলীল ইবরাহীম (আ ) এর কুরবানী কবুল করেছিলে।
দোয়ার প্রথমে ………… শব্দ আছে। নিজের কুরবানী হলে …… বলতে হবে। আর অন্য বা একাধিক লোকের পক্ষ থেকে হলে তাদের নাম বলতে হবে।
কুরবানীর ফযিলত ও তাকীদ
নবী (স) কুরবানীর ফযিলত ও অসংখ্য সওয়াবের উল্লেখ করে বলেন,
১. নাহারের দিন অর্থাৎ যুলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখ কুরবানীর রক্ত প্রবাহিত করা থেকে ভালো কাজ আল্লাহর কাছে আর কিছু নেই। কিয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, পশম ও খুর সহ হাজির হবে। কুরবানীর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা কবুল হয়ে যায়। অতএব, মনের আগ্রহ সহ এবং সন্তুষ্ট চিত্তে কুরবানী কর। (তিরমিযি ইবনে মাজাহ)
২. সাহাবায়ে কেরাম (রা) নবী (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ কুরবানী কি বস্তু? নবী বলেন, এ তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ ) এর সুন্নাত। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এতে আমাদের জন্যে কি সওয়াব রয়েছে? নবী (স) বলেন, তার প্রত্যেক পশমের জন্যে এক একটি সওয়াব পাওয়া যাবে। (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)
৩. হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন যে, নবী (স) হযরত ফাতেমা যোহরা (রা) কে বলেন, ফাতেমা! এসো, তোমার কুরবানীর পশুর কাছে দাড়িয়ে থাক। এজন্যে যে, তার যে রক্ত কণা মাটিতে পড়বে তার বদলায় আল্লাহ তোমার পূর্বের গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। হযরত ফাতেমা (রা) বলেন, এ সুসংবাদ কি আহলে বায়েতের জন্য নির্দিষ্ট, না সকল উম্মতের জন্যে? নবী (স) বলেন, আমাদের আহলে বায়েতের জন্যও এবং সকল উম্মতের জন্যেও। (জামউল ফাওয়োদে)
৪. হযরত ইবনে বারীদাহ (রা) তার পিতার বরাত দিয়ে বলেন, নবী (স) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে নামাযে যেতেনে না। আর ঈদুল আযহার দিন ঈদুল আযহার নামাযের আগে কিছু খেতেন না। (তিরমিযি, আহমাদ)
তারপর নামায থেকে ফিরে এসে কুরবানীর কলিজী খেতেন।