ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার অপচেষ্টা
ইসলামী দাওয়াতের বিরোধীরা যখন পানি মাথার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখে, তখন বেশামাল হয়ে আন্দোলনকে বা তার নেতা ও কর্মীদেরকে সমাজের সব ধরণের কার্যকর সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্ছিত করার চেষ্টা চালায়। প্রত্যক্ষভাবে পারা না গেলেও পরোক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করে বিপ্লবের সৈনিকদের নিস্ক্রিয় করে দিতে চায়।
মক্কাবাসী রসূল সা. কে একেবারেই খতম করে দিতে চাইত। কিন্তু ভয় পেত যে, গোত্রীয় জিঘাংসা ও প্রতিশোধ পরায়ণতার আগুন এমনভাবে জ্বলে উঠবে যখন রক্তপাতের ধারাবাহিকতা বন্ধ করার সাধ্য আর কারো থাকবেনা। নিকট অতীতে এক সর্বনাশা যুদ্ধ তাদেরকে এত ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছিল যে, এক্ষণি অনুরূপ আর একটা যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে তারা মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। এছাড়া আরো একটা জটিলতাও ছিল। বনু হাশেম ও বনু উমাইয়ার মধ্যে ছিল পুরানো কোন্দল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বনু উমাইয়ার নেতারা বিশেষত আবু লাহাব কিছুতেই বরদাশত করতে পারছিলনা যে, বনু হাশের গোত্রের কোন পরিবারে কেউ নবী হোক এবং সেই সুবাদে ঐ পরিবার সমাজের স্বীকৃতি লাভ করুক। বনু হাশেম দু’একবার এই মর্মে মন স্থিরও করে ফেলেছিল যে, ‘মুহাম্মদকে খোলাখুলিভাবে সমর্থন করলে ক্ষতি কী? সে তো আমাদেরই লোক। সে যদি বড় হয় এবং তার ধর্ম যদি বিস্তার লাভ করে, তবে তা তো আমাদেরই কল্যাণ ও সমৃদ্ধি এনে দেবে।’ কিন্তু বনু উমাইয়ার নেতারা তাদেরকে ঐ সিদ্ধান্ত কখনো কার্যকরী করতে দেয়নি। বনু হাশেম কার্যকরভাবে কিছু করতে পারেনি বটে, তবে তাদের একজন সদস্যের গায়ে হাত তোলা সহজ ব্যাপার ছিলনা, যতক্ষণ না তারা তাকে গোত্র থেকে বহিষ্কার করেছে। এদিকে রসূল সা. ছিলেন তাঁর চাচা আবু তালেবের অভিভাবকত্বে। এ অভিভাবকত্ব যতক্ষণ বহাল ছিল, ততক্ষণ বলতে গেলে গোটা বনু হাশেম গোত্র তাঁর রক্ষক ছিল। তাঁর শত্রুরা তাই সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা চালালো যাতে রসূল সা. কে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত করা যায়। এ জন্য আবু তালেবের ওপর চাপ প্রয়োগ অনেকদিন ধরে অব্যাহত ছিল, কিন্তু তারা প্রতিবারই তাতে ব্যর্থ হয়।
একবার রবীয়ার দু’ছেলে উতবা ও শায়বা, আবু সুফিয়ান বিন হারব, আবুল বুখতারী, আসওয়াদ বিন আব্দুল মুত্তালিব, আবু জাহল, ওলীদ ইবনুল মুগীরা, হাজ্জাজ বিন আমেরের দু’ছেলে নাবাইহ ও মুনাব্বিহ এবং আস বিন ওয়ায়েলের মতো শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের এক শক্তিশালী প্রতিনিধি দল আবু তালেবের কাছে উপস্থিত হয়ে বললোঃ
‘হে আবু তালেব আপনার ভাতিজা আমাদের দেবতা ও ঠাকুরদের গালি দেয়, আমাদের ধর্মের খুঁত ধরে, আমাদের পূর্ব পুরুষদের বোকা ঠাওরায় ও বিপথগামী আখ্যায়িত করে। এখন আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ, হয় আপনি ওকে আমাদের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করা থেকে নিবৃত্ত করুন, নচেত আামাদের হাতে সোপর্দ করুন। কেননা আকীদা বিশ্বাসের দিক দিয়ে আপনিও আমাদেরই দলভুক্ত এবং ওর বিরোধী। আপনি যদি ওকে সামলাতে না পারেন তবে আমরা অবশ্যিই পারবো।’
আবু তালেব সমস্ত কথাবার্তা শান্তভাবে শুনলেন এবং প্রতিনিধি দলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিদায় করলেন। রসূল সা. নিজের কাজ যথারীতি অব্যাহত রাখলেন এবং কোরায়েশরা তেলে বেগুনে জ্বলতে লাগলো। প্রতিনিধি দলের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। দেখবেন, এতে কত গভীর আবেগ সক্রিয় রয়েছে। এত অত্যন্ত জোরদার আবেদন জানানো হয়েছে। এ বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, ইসলামের দুশমনরা জনগণকে উত্তেজিত করার বিশেষ আয়োজন করে রেখে এসেছিল। এমন সব স্লোগান ও অভিযোগ তুলেছিল, যা শোনা মাত্রই জনতা ক্রোধে ফেটে পড়বে এবং রসূল সা. এর বিরুদ্ধে ভয়ংকরভাবে ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত হবে। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংগঠিত করা হয়েছে, তখন জনগণকে উস্কানি দেয়ার লক্ষ্যে কিছু না কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য অবশ্যই পরিবেশন করা হয়েছে।
এ ধরণের বিভ্রান্তিকর তথ্যের মধ্যে একটি ছিল এই যে, তোমাদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা হচ্ছে এবং তোমাদের দেবদেবীকে গালি দেয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয়টি এই ছিল যে, চিরাচরিত ও পৈত্রিক ধর্মের খুঁত ধরা হচ্ছে।
তৃতীয়টি হলো, পূর্ব পুরুষদের অবমাননা করা হচ্ছে।
মক্কার মোশরেকরা উত্তেজনাকর এসব উপকরণ সংগ্রহ করে ফেলেছিল। যদিও রসূল সা. এর কাছে নাযিল হওয়া ওহীতে কোরায়েশদের দেবদেবীকে গালি দেয়া হয়নি। রবং গালি দিতে মুসলমানদের নিষেধ করা হয়েছে। তবুও এই সব দেবদেবীর বিরুদ্ধে উপস্থাপিত যুক্তি প্রমাণকে গালি আখ্যায়িত করে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি ওদের পূর্ব পুরুষদের অবমাননা করেননি, কেবল এ কথাই বলেছেন যে, কোন জিনিস শুধু পুরুষানুক্রমিকভাবে চলে আসছে এই অজুহাতে ধারণ করে রাখা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কিন্তু এ কথাটাকেও পূর্ব পুরুষদের অবমাননা বলে ধরে নেয়া হয়েছে। অনুরুপভাবে রসূল সা. তাওহীদের যৌক্তিকতা ও শেরকের অযৌক্তিকতার প্রমাণ করার জন্য যা কিছু বলেছেন এবং মোশরেকদেরই প্রশ্নের জবাবে প্রচলিত ধর্মমতের যে পর্যালোচনা করেছেন, তাকে গতানুগতিক ধর্মের দোষ অন্বেষণের পর্যায়ে ফেলা হয়েছে।
আরেকবার এলো অন্য এক প্রতিনিধি দল। তারাও একই কাসুন্দি ঘেঁটে বললোঃ
‘হে আবু তালেব আপনি আমাদের মধ্যে বয়সেও প্রবীণ, মান মর্যাদায়ও শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত। আমরা দাবী করেছিলাম যে, আপনার ভাতিজার অত্যাচার থেকে আমাদের বাঁচান। কিন্তু আপনি কিছুই করলেন না। আল্লাহর কসম, আমাদের বাপদাদাকে যেভাবে গালি দেয়া হচ্ছে, আমাদের পূর্ব পুরুষদের যেভাবে বেকুফ ঠাওরানো হচ্ছে এবং আমাদের দেবদেবীর যেভাবে সমালোচনা করা হচ্ছে, তা আমাদের কাছে অসহ্য। আপনি যদি ওকে না ঠেকান, তবে আমরা ওকেও দেখে নেব, আপনাকেও দেখে নেব। হয় আমরা বেঁচে থাকবো,না হয় মুহাম্মদ ও তার সমর্থকরা বেঁচে থাকবে। [সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, পৃঃ ১০৮]
আবু তালেব এবার রসূলকে সা. ডাকলেন এবং সমস্ত কথাবার্তা তাঁকে জানালেন। তারপর খুবই অনুনয় করে বললেনঃ ‘ভাতিজা, আমার ওপর এমন বোঝা চাপিওনা, যা বহন করতে পারিনা।’ এ পর্যায়ে তিনি এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন যে, তাঁর একমাত্র আশ্রয়স্থলও যেন টলটলায়মান হয়ে পড়লো। বাহ্যত ইসলামী আন্দোলনের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত এসে পড়েছিল। কিন্তু লক্ষ্য করুন, কী গভীর আন্তরিকতা ও অবিচল সংকল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বললেনঃ
‘চাচাজান, আল্লাহর কসম, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ উপহার দিয়েও এই কাজ পরিত্যাগ করতে বলে, তবুও আমি তা পরিত্যাগ করতে পারবোনা। আমার এ কাজ সেই দিন বন্ধ হবে, যেদিন হয় আল্লাহ আমাকে এ কাজে বিজয়ী করবেন, নচেত আমি এই চেষ্টা সাধনা করতে করতে খতম হয়ে যাবো।’
রসূল সা. এর এ উক্তির মধ্য দিয়ে আমরা সেই আসল শক্তির সোচ্চার কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি, যে শক্তি ইতিহাসকে ওলট পালট করে দেয় এবং সকল প্রতিরোধ ও ষড়যন্ত্রকে চূর্ণ করে আপন লক্ষ্যে উপনীত হয়। পরিতাপের বিষয় হলো, কোরায়েশ এই শক্তির উপস্থিতি টের পায়নি। আবু তালেব এই শক্তির মায়াবী প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বললঃ ‘যাও ভাতিজা, তোমার যা ভালো লাগে তার দাওয়াত দাও গে। আমি কোন অবস্থায় তোমাকে অসহায় ছেড়ে দেবনা।’
কিছুদিন পর আরেক প্রতিনিধি দল এলো আম্মারা ইবনে ওলীদকে সাথে নিয়ে। এবার তারা এল এক ব্যতিক্রমধর্মী পরিকল্পনা নিয়ে। তারা আবু তালেবকে বললোঃ ‘এই দেখুন, এ হচ্ছে কোরায়েশ বংশের সবচেয়ে সুঠাম ও সুদর্শন যুবক। একে নিয়ে নিন। এর বুদ্ধি ও শক্তি আপনার অনেক কাজে লাগবে। একে নিজের ছেলে বানিয়ে নিন এবং তার বিনিময়ে মুহাম্মদকে আমাদের হাতে অর্পণ করুন। কেননা সে আপনার ও আপনার চৌদ্দ পুরুষের ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, আপনার দেশের জনগনের মধ্যে বিভেদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছে এবং তাদের পূর্ব পুরুষকে বেকুফ গণ্য করেছে। ওকে আমরা হত্যা করতে চাই। আপনাকে একজন মানুষের পরিবর্তে আর একজন মানুষ দিচ্ছি। [ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৭৯]
লোকগুলোর চিন্তার ধরণটা দেখুন। মুহাম্মদ সা. এর ন্যায় সুমহান ব্যক্তিত্ব যেন একটা বাণিজ্যিক পণ্য। আর আবু তালেব যেন তার চাচা নয়, বরং একজন ব্যবসায়ী! প্রতিনিধিদের কথা শুনে আবু তালেবের ভাবাবেগে প্রচন্ড আঘাত লাগলো। তিনি বললেনঃ ‘তোমরা চাও যেন তোমাদের সন্তানকে তো আমি আদরযত্নের সাথে লালন পালন করতে থাকি, কিন্তু আমার ভাতিজাকে নিয়ে তোমরা যবাই করে দাও। এমনটি কস্মিনকালেও হতে পারেনা।’ শেষ পর্যন্ত উত্তেজিত বাক্য বিনিময়ের মধ্য দিয়ে ঘটনার সমাপ্তি ঘটলো। খোদ প্রতিনিধি দলের মধ্যে দ্বিমতের সৃষ্টি হলো।
এবার কোরায়েশরা রসূল সা. এর সাথীদের ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য যে সমস্ত গোত্রে কোন মুসলমান ছিল, সেই সব গোত্রকে উস্কে দিতে লাগলো। তাদেরকে ইসলাম থেকে ফেরানোর জন্য কঠোর নির্যাতন চালানো শুরু হলো। কেবল রসূল সা. কে আল্লাহ আবু তালেবের পৃষ্ঠপোষকতায় রক্ষা করলেন। আবু তালেব কুরায়েশদের হাবভাব দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন এবং বনু হাশেম ও বনু আব্দুল মুত্তালেবের কাছে রসূল সা. এর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আবেদন জানালেন। লোকেরা সমবেত হলো এবং মুহাম্মদ সা. কে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। কিন্তু আবু লাহাবের প্রবল বিরোধিতায় কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেলনা।
পরবর্তী সময় যখন শত্রুদের মধ্য থেকে হামযা ও ওমরের ন্যায় দু’জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ইসলামী আন্দোলনে যোগদান করলো, তখন শত্রু মহলে আবারো প্রচন্ড গাত্রদাহের সৃষ্টি হলো। স্পষ্ট বুঝা গেল যে, মুহাম্মদের সা. এর পরিচালিত আন্দোলন তখন ঘরে ঘরে ঢুকতে আরম্ভ করেছে। সুতরাং একটা কিছু করা চাই। আবু তালেব তখন রোগ শয্যায়। তারা তাঁর কাছে হাজির হলো। এবার তাদের পরিকল্পনা এই ছিল যে, রসূল সা. এর সাথে তাদের এই মর্মে চুক্তি হয়ে যাক যে, সেও আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবেনা, আর আমরাও তার ব্যাপারে নাক গলাবোনা। সে আমাদের ধর্মের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবেনা, আর আমরাও তার ধর্মের সাথে কোন সম্পর্ক রাখবোনা। রসূল সা. কে ডাকা হলো। তিনি কোরায়েশদের দাবী দাওয়া শোনার পর বললেনঃ
(আরবীঃ *********)
‘‘ওহে কোরায়েশ নেতৃবৃন্দ, তোমরা আমার এই একটা মাত্র কথাকে মেনে নাও, দেখবে আরব ও অনারব নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতি তোমাদের অনুগত হয়ে গেছে।’’
একটু কল্পনা করুন তো, কী প্রাণঘাতি পরিবেশ। ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতার বিষে জর্জরিত কী ভয়াবহ পরিস্থিতি। তা সত্ত্বেও রসূল সা. এর মনে স্বীয় দাওয়াতের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে কত গভীর ও অবিচল আস্থা। যেন রাতের প্রগাঢ় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে বলছেন, এক্ষুণি সূর্য উঠবে। শুধু তাই নয়, এও লক্ষ্য করুন যে, নিজের আদর্শের শুধু ধর্মীয় দিক নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকও তাঁর সামনে কি রকম উজ্জ্বল ছিল।
আবু জেহেল ঝনাত্ করে বলে উঠলোঃ ‘হ্যাঁ, তোর বাপের কসম, একটা কেন, দশটা কথা চলবে।’
অন্য একজন বললোঃ ‘আল্লাহর কসম, এ লোকটা তোমাদের পছন্দ মাফিক কোন কথাই মেনে নেবে বলে মনে হচ্ছেনা।’
এরপর তারা হতাশ হয়ে চলে গেল। তবে প্রতিনিধি দলটির কথাবার্তা থেকে কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল। প্রথমত, ইসলামী আন্দোলনকে তারা এমন একটা শক্তি হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে, যাকে উৎখাত করার বৃথা চেষ্টার চেয়ে আপোষ ও সহাবস্থানের কোন উপায় খুঁজে বের করা অনেক ভালো। দ্বিতীয়ত, কোরায়েশগণ তাদের সমস্ত নির্যাতন নিষ্পেষণ ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও নিজেদের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।
এ ছিল স্বয়ং রসূল সা. এর অবস্থা। পক্ষান্তরে তাঁর সংগীদের মধ্যেও যারা কারো না কারো অভিভাবকত্বের আওতায় জীবন যাপন করছিল, তাদেরকেও অভিভাবকত্বহীন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছিল।
উদাহরণ স্বরূপ, হযরত আবু সালমাও আবু তালেবের নিরাপত্তা হেফাজতে ছিলেন। তাঁর গোত্র বনু মাখযুমের লোকেরা এল। তারা বললো, আবু তালেব, আপনি আপনার ভাতিজাকে তো আমাদের হাতে সোপর্দ করলেন না। কিন্তু আমাদের গোত্রের লোককে ঠেকানোর কী অধিকার আছে আপনার? আবু তালেব বললেন, ‘সে আমার ভাগ্নে এবং আমার কাছে নিরাপত্তা চেয়েছে। তোমরা ওর ওপর যুলুম চালাচ্ছিলে। আল্লাহর কসম, হয় তোমরা যুলুম থেকে বিরত হবে, নচেত আমি ওর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা করা দরকার করবো।’
অনুরূপভাবে, আবিসিনিয়ায় হিজরত শুরুর পর একবার হযরত আবু বকর মক্কার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা ত্যাগ করে চললেন। কিছু দূর গেলে ইবনুদ দুগুন্না নামক এক ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়। সে যখন জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো, উনিও হিজরত করছেন, তখন সে বললো, আপনার মত লোকদের এভাবে মাতৃভূমি ত্যাগ করা উচিত নয়। আপনি বিপদাপদে আত্মীয় স্বজনকে সাহায্য করেন, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেন, এবং নগ্ন লোককে কাপড় দেন। নিজে সৎকাজ করেন এবং অন্যদেরকেও সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। ইবনুদ দুগুন্না এভাবে হযরত আবু বকরকে নিজ দায়িত্বে নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিয়ে ফিরিয়ে আনলো এবং কোরায়েশদের সামনে ঘোষণা করে দিল যে, আবু বকর তাঁর নিরাপত্তা হেফাজতে আছেন। বাড়িতে তিনি নিজের নামায পড়ার জায়গায় বসে সুললিত কণ্ঠে কোরআন পড়তেন। সেই সাথে তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তো। ফলে যে-ই তার তেলাওয়াত শুনতো, সে প্রভাবিত হতো। ক্রমে ক্রমে ব্যাপারটা কোরায়েশদের কানে গেল। তারা ইবনুদ দুগুন্নার কাছে এসে বললো, তুমি আবু বকরকে আশ্রয় দিয়ে তো আমাদের সর্বনাশ করেছ। তিনি সুললিত কণ্ঠে কোরআন পড়েন, আর তা শুনে আমাদের মহিলারা ও শিশুরা প্রভাবিত হচ্ছে, তোমার আশ্রয় দেয়ার প্রয়োজন নেই। আবু বকরকে নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। সেখানে বসে সে যা ইচ্ছে করুক। আমরা নাক গলাতে যাব না। ইবনুদ দুগুন্না অগত্যা আবু বকর রা. কে তাঁর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিল। (ইবনে হিশাম)
নেতিবাচক ফ্রন্ট
শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ সা. মানবজাতির যে বৃহত্তম সেবায় নিয়োজিত ছিলেন, তাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য ইসলামের শত্রুরা হরেক রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। কিন্তু সে সব সত্ত্বেও তাঁর দাওয়াতী কাজ অব্যাহত ছিল এবং তার সুফলও কিছুনা-কিছু পাওয়া যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় বিরুদ্ধবাদী প্রচারণার একটা সক্রিয় সেল গঠন করা হলো। এই সেলের আওতায় মক্কার কতিপয় শীর্ষস্থানীয় নেতা রসূল সা. এর কাছাকাছি অবস্থান করতে লাগলো। তাদের প্রধান সমস্যা ছিল এই যে, মক্কা ছিল সমগ্র আরবের কেন্দ্রস্থল। এখান দিয়ে সব জায়গা থেকে কাফেলা যাতায়াত করতো এবং সত্যের দাওয়াতের নিত্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হতো। মক্কার সরদারদের যে ধাপ্পাবাজী খোদ মক্কাবাসীর ওপর চলতো, সেটা বহিরাগতদের ওপর চলতোনা। তাছাড়া নবাগতদের মধ্যে অনেক মেধাবী ও নির্মল বিবেকধারী লোকও থাকতো। তারা কোন দাওয়াতকে নিছক যুক্তির বিচারে এবং দাওয়াত দাতাকে শুধু তার আচার ব্যবহার ও স্বভাব চরিত্রের আলোকে যাচাই করে কোন বিদ্বেষ বা কোন ঐতিহাসিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। মুহাম্মদ সা. এর দাওয়াত ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের অন্তরে কোন হিংসা বিদ্বেষ ছিলনা এবং থাকার কোন কারণও ঘটেনি। এ পরিস্থিতিতে শুধু মক্কাকে মুহাম্মদদের সা. দাওয়াতের প্রভাব থেকে রক্ষা করায় কোন লাভ হতোনা, যদি মক্কার বাইরের আরবীয় সমাজ ঐ দাওয়াত দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। কোরআনে বিষয়টির পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে এভাবেঃ
(আরবী*******)
‘তারা কি দেখতে পায়না, তাদের প্রভাবাধীন এলাকাকে আমি চারদিক থেকে সংকুচিত করে আনছি?’ এ দিক দিয়ে তাদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক সময় ছিল হজ্জের মওসুম। আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা দলে দলে তাদের সরদারদের নেতৃত্বে মক্কায় সমবেত হতো। এ সময় রসূল সা. ঐ সব দলের সদস্য ও নেতাদের সাথে তাঁবুতে তাঁবুতে গিয়ে সাক্ষাত করতেন এবং দাওয়াত দিতেন। প্রতিক্রিয়াশীল নেতিবাচক আন্দোলনের নেতারা তা দেখে তেলেবেগুনে জ্বলতো। একবার হজ্জের মওসুম সমাগত হলে কোরায়েশ নেতারা ওলীদ ইবনুল মুগীরার বাড়ীতে জমায়েত হলো এবং গভীরভাবে ভাবতে লাগলো। ওলীদ সমস্যাটা এভাবে তুলে ধরলোঃ
‘হে কোরায়েশ জনতা, হজ্জের মওসুম সমাগত। সমগ্র আরব থেকে তোমাদের এখানে দলে দলে লোক আসবে। তারা সবাই আমাদের এই লোকের (মুহাম্মাদের) ব্যাপারটা জেনে গেছে। তাই তারা বিষয়টা ভালো করে জানার কৌতুহল নিয়েই আসবে। কাজেই তোমরা এখন এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নাও। পরস্পর কোন মতভেদে লিপ্ত হয়োনা। একজনের কথা আরেকজন মিথ্যা সাব্যস্ত করতে থাকবে ও খন্ডন করতে থাকবে এমন যেন না হয়।’
উপস্থিত জনতা বললোঃ ‘আপনিই বলুন। একটা কর্মসূচী আপনিই ঠিক করে দিন। আমরা সেই মোতাবেক কাজ করবো।’
কিন্তু ওলীদ জোর দিয়ে বললোঃ ‘তোমরাই আলোচনা কর, আমি শুনি।’
অগত্যা আলোচনা শুরু হয়ে গেল।
একদল বললোঃ আমরা তো মনে করি, মুহাম্মদ একজন জ্যোতিষী। এই কথাই হজ্জে আগত লোকদের বলে বুঝাতে হবে।
ওলীদঃ না, আল্লাহর কসম, মুহাম্মদ জ্যোতিষী নয়। আমরা বহু জ্যোতিষী দেখেছি। জ্যোতিষীদের মত ছন্দবদ্ধ ও মিত্রাক্ষর পয়ারে মুহাম্মদ কথা বলেনা।
লোকেরা বললোঃ তাহলে আমরা বলবো, ওকে ভূতে ধরেছে।
ওলীদঃ না, সে ভূতেধরাও নয়। ভূতে ধরা মানুষের যেমন গলা ধরে যায়, অংগপ্রত্যংগ কাঁপে, এবং চিন্তাধারা এলোমেলো থাকে, মুহাম্মাদের মধ্যে সে সব লক্ষণ নেই।
জনতাঃ তাহলে আমরা বলবো, ও একজন কবি।
ওলীদঃ না, ও কবি বলেও তো আমার মনে হয়না। আমরা হরেক রকম ছন্দের কবিতা চিনি। সে অনুসারে সে কবিও নয়।’
জনতাঃ তাহলে আমরা বলবো সে একজন যাদুকর।
ওলীদঃ না, সে যাদুকরও নয়। আমরা অনেক যাদুকর ও তাদের জাদু দেখেছি। জাদুতে ফুঁক ও মাদুলী দেয়ার যে রীতি আছে, মুহাম্মাদের সা. কাছে তা তো নেই।
জনতাঃ তাহলে ওহে আবু আবদুশ্শামস, আপনিই বলুন, মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালানোর জন্য আমরা কী বলবো?
ওলীদঃ আল্লাহর কসম। ওর কথাবার্তা বড়ই মধুর। তার কথার শেকড় অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এবং তার শাখা প্রশাখায় অনেক ফল ধরে। এ দাওয়াত বিজয়ী হবেই। একে পরাভূত করা যাবে না। এ দাওয়াত অন্য সব কিছুকে পর্যদুস্ত করে দেবে। তোমরা যেটাই বলবে, নিরর্থক ও বৃথা হয়ে যাবে। তবে তোমরা যা যা বলেছ, তার মধ্যে শেষের কথাটাই কিছুটা মানানসই হয়েছে। তোমরা এটাই বলবে যে, সে একজন জাদুকর। তার কথায় জাদু রয়েছে। সে কথা দিয়ে বাপ-বেটায়, স্বামী-স্ত্রীতে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, ব্যক্তি ও গোত্রে এবং গোত্রে-গোত্রে বিভেদ ও বিচ্ছেদ ঘটায়। (ইসলামের দাওয়াতের দিকে ইংগিত করে এ কথা বলা হয়েছে। কেননা এই দাওয়াতের ভিত্তিতে সমাজে দুটো দল সৃষ্টি হয়ে গেছে। অথচ এর আসল কারণ হলো, ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্র।) তোমরা বলবে যে, তার জাদুর কারণেই লোকেরা তাকে বয়কট করে রেখেছে। (সীরাতে ইবনে হিশাম ও সীরাতুল মুস্তাফা, ইদ্রীস কান্দুলভী)
লক্ষ্য করুন, কিভাবে একজন মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানোর জন্য ষড়যন্ত্র করা হয়। যে কথা বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়না, সে কথাই জোর করে চালু করার চক্রান্ত করা হয়। ঐ মজলিসেই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, মক্কা অভিমুখী এক এক রাস্তার মুখে এক একটা দল বসে থাকবে। তারা প্রত্যেক প্রতিনিধি দলকে মুহাম্মাদ সা. ও তার দাওয়াত সম্পর্কে সতর্ক করে দেবে। এই পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করা হলো। কিন্তু এর ফল হলো উল্টো। রসূল সা. সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আরবের কোণে কোণে পৌঁছে গেল। যারা এ সম্পর্কে কিছুই জানতোনা, তারাও জেনে গেল যে, আরবে একটা নতুন ধর্মের দাওয়াত চালু হয়েছে এবং মুহাম্মদই সা. তার পতাকাবাহী।
এবার আসুন, ইতিহাসের পর্দায় ইসলামের আহ্বায়ক ও তার বিরুদ্ধে কর্মরত নেতিবাচক আন্দোলনকারীদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করা যাক।
রবীয়া বিন উবাদা বর্ণনা করেন, আমি তখন একজন তরুণ। মীনায় বাবার সাথে থাকতাম। দেখতাম যে, রসূল সা. আরবের বিভিন্ন গোত্রের তাঁবুতে তাঁবুতে যেয়ে বলছেন, হে অমুক গোত্রের জনমন্ডলী, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রসূল। তোমাদের কাছে আমার দাওয়াত, তোমরা শুধু আল্লাহর এবাদত কর, তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করোনা। যে সমস্ত দেবমূর্তির তোমরা পূজা করে থাক, তা বর্জন কর। আমার ওপর ঈমান আনো। আমাকে সমর্থন কর ও আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত কর। তাহলে আল্লাহ যে সমস্ত কথা বলার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন, তা বিস্তারিতভাবে বলবো।’
ঘটনার প্রতিবেদক বলেন, এক ব্যক্তি এতেনীয় পোশাক পরে রসূল সা. এর পেছনে পেছনে চলছিল। রসূল সা. যখনই তার কথা বলা শেষ করতেন, অমনি ঐ লোকটা চিৎকার করে বলতোঃ ‘ওহে অমুক গোত্রের অতিথিবৃন্দ, এই লোকটা তোমাদেরকে লাত ও উয্যা থেকে দূরে সরিয়ে নতুন ধর্ম ও ভ্রষ্টতার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। ওর কথা তোমরা শুনোনা এবং মান্য করোনা।
ঐ তরুণ এ দৃশ্য দেখে নিজের বাবাকে জিজ্ঞেস করে, দাওয়াতদাতার পেছনে পেছনে যে লোকটা ছুটে চলেছে সে কে? সে তো ওর প্রত্যেকটা কথা খন্ডন করছে।’
বাবা জবাব দেন, ‘সে ঐ ব্যক্তির চাচা আবু লাহাব।’
হজ্জের ন্যায় বিভিন্ন মেলায়ও রসূল সা. হাজির হতেন, যাতে সামাজিক সমাবেশগুলো দ্বারা কিছু না কিছু উপকৃত হওয়া যায়। একবার যুল মাজায নামক মেলায় হাজির হয়ে জনতাকে কলেমায়ে তাইয়েবার দাওয়াত দিলেন। আবু জাহেল তাঁর পিছু লেগে ছিল। সে এমন ইতরামির পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল যে, হাতে ধুলোবালি নিয়ে রসূল সা. এর মুখে নিক্ষেপ করছিল এবং বলছিল, তোমরা ওর কথা শুনোনা। ও লাত ও উয্যার পূজা বন্ধ করতে চায়। (সীরাতুন্নবী, শিবলী নুমানী)
বিরুদ্ধবাদী প্রচারণার এই জোরদার অভিযানের খবরাদি শুনে আবু তালেব শংকিত হন যে, আরবের জনগন সংঘবদ্ধভাবে বিরোধিতা শুরু করে না দেয়। এ জন্য তিনি একটা দীর্ঘ কবিতা লিখে কা’বার দুয়ারে ঝুলিয়ে রাখেন। এতে তিনি একদিকে সাফাই দেন যে, আমি নিজে মুহাম্মাদের দাওয়াত গ্রহণ করিনি। অপর দিকে তিনি এ কথাও ঘোষণা করেন যে, আমি কোন অবস্থাতেই মুহাম্মদকে পরিত্যাগ করতে পারবোনা। প্রয়োজন হলে তার জন্য আমি নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দেব। আবু তালেবের নামে সংকলিত এ জাতীয় কবিতার বেশির ভাগই ঐতিহাসিকভাবে দূর্বল। তবে এর বেশ কিছু অংশ যে সঠিক, সে ব্যাপারেও সন্দেহের অবকাশ নেই। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
বিরূপ প্রতিক্রিয়া
যখনই কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মক্কায় আসতো, অমনি ইসলামের শত্রুরা তাকে ঘিরে ধরতো এবং রসূল সা. এর প্রভাব থেকে তাকে বাঁচানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতো। কিন্তু অধিকাংশ সময় উল্টো ফল ফলতো। এ ধরণের কয়েকটা ঘটনার উল্লেখ করা জরুরী মনে হচ্ছে।
তোফায়েল বিন আমর দাওসী একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও নামকরা কবি ছিলেন। একবার তিনি মক্কায় বেড়াতে এলে কোরায়েশদের কতিপয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তার সাথে দেখা করতে গেল। তারা গিয়ে বললোঃ ‘তোফায়েল সাহেব, আপনি আমাদের শহরে আগমন করেছেন, এতে আমরা আনন্দিত। তবে এখানে যে ক’টা দিন থাকবেন একটু সাবধানে থাকবেন। এখানে মুহাম্মাদের সা. কার্যকলাপ আমাদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এ লোকটা আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করে দিয়েছে এবং আমাদের স্বার্থ ধ্বংস করে দিয়েছে। ওর কথাবার্তা জাদুর মত। সে পিতাপুত্রে, ভাইয়ে ভাইয়ে এবং স্বামী স্ত্রীতে বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে। আপনার ও আপনার গোত্রকে নিয়ে আমরা শংকিত, পাছে আপনারা ওর ধাপ্পার শিকার হয়ে যান। তাই মুহাম্মাদের সা. সাথে আপনার একেবারেই কোন কথা না বলা ও তার কোন কথা না শোনা সবচেয়ে উত্তম।’
তোফায়েল বলেনঃ আমি মুহাম্মাদের সাথে কোন কথা বলবোনা এবং তাঁর কোন কথা শুনবোনা-এই মর্মে ওয়াদা না করায় তারা আমার পিছু ছাড়েনি। তাই মসজিদুল হারামে যাওয়ার সময় কানে তুলো দিয়ে যেতাম। এই সময় হঠাৎ একদিন দেখলাম, রসূল সা. কা’বার কাছে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন। আমিও তাঁর খুব কাঁছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি তাঁর আবৃত্তি করা খুবই মধুর বাণী শুনলাম। মনে মনে বললামঃ আমি কি মায়ের দুধ খাওয়া শিশু? আল্লাহর কসম, আমি তো একজন বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। আমি একজন কবি। ভালোমন্দ বাছবিচারের ক্ষমতা আমার আছে। তাহলে মুহাম্মাদের কথা শুনতে আমাকে কে বাধা দিতে পারে? তিনি যে দাওয়াত দেন তা যদি ভালো হয় তাহলে গ্রহণ করবো। আর খারাপ হলে প্রত্যাখ্যান করবো।’
এই চিন্তা-ভাবনায় খানিকটা সময় কেটে গেল। নামায শেষে রসূল সা. বাড়ীর দিকে রওনা হলেন। তোফায়েল তাঁর সাথে সাথে চললেন। পথে তাঁকে সব কথা জানালেন যে, তাঁর কাছে তাঁর সম্পর্কে কিরূপ অপপ্রচার করা হয়েছে এবং কিভাবে তাকে রসূল সা. এর কাছ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। বাড়ীতে পৌঁছে তিনি রসূল সা. এর দাওয়াত কি, সবিস্তারে জানতে চাইলেন। রসূল সা. তাঁকে ইসলামের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে এবং কোরআন পড়ে শোনালেন। তোফায়েল বলেনঃ ‘আল্লাহর কসম, এত সুন্দর বাণীও আমি কখনো শুনিনি, এমন নির্ভুল ও সত্য দাওয়াতও আমি কখনো পাইনি। আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। অতঃপর তিনি নিজ গোত্রের কাছে গিয়ে ইসলাম প্রচার করলেন। এতে তাঁর সমগ্র গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে।
তোফায়েল এমন আবেগোদ্দীপ্ত প্রচারকে পরিণত হন যে, বাড়ীতে গিয়ে বৃদ্ধ পিতার সাথে দেখা হওয়া মাত্রই বলেনঃ ‘আপনিও আমার কেউ নন, আমিও আপনার কেউ নই।’ পিতা বললেনঃ ‘সে কী? তোমার কী হয়েছে বাবা!’ তোফায়েল বললেনঃ ‘আমি এখন মুহাম্মদ সা. এর ধর্ম গ্রহণ করেছি এবং তাঁর আনুগত্যের পথ অবলম্বন করেছি।’ পিতা বললেনঃ ‘বাবা, তোমার ধর্ম যা, আমার ধর্মও তাই হবে।’ তিনি তৎক্ষণাত গোসল করে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তোফায়েল একই পন্থায় নিজের স্ত্রীকেও দাওয়াত দিলেন। সেও ইসলাম গ্রহণ করলো। এরপর গোত্রের সবার মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। পরে তিনি রসূল সা. এর কাছে এসে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন এবং তাঁর গোত্রের বিভিন্ন চারিত্রিক দোষের উল্লেখ করে তাদের জন্য আযাবের দোয়া করতে রসূল সা. কে অনুরোধ করেন। কিন্তু রসূল সা. হেদায়াতের ও সংশোধনের দোয়া করেন এবং তোফায়েলকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেন, যেন, ধৈর্যের সাথে নিজের গোত্রের সংশোধনের জন্য কাজ করে যেতে থাকে এবং তাদের সাথে নম্র আচরণ করে। (ইসলাম প্রচারে তার জবরদস্তির প্রবণতা ইসলামী কর্মনীতির সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিলনা।) [সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খন্ডঃ ৪০৭-৯ পৃষ্ঠা]
আরো একটা ঘটনা লক্ষ্য করুন। আ’শা ইবনে কায়েসও একজন বিশিষ্ট কবি ছিলেন। তিনি রসূল সা. সম্পর্কে অনেক কিছু শুনে ইসলাম গ্রহণ করার মানসে মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। তিনি রসূল সা. এর প্রশংসাসূচক একটা কবিতাও রচনা করেছিলেন। আ’শা মক্কার সীমার ভেতরে পৌঁছা মাত্রই জনৈক কোরায়েশী মোশরেক (ইবনে হিশামের মতে, সে ছিল আবু জাহল) এসে তাকে ঘিরে ধরলো এবং তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। আ’শা বললেন, আমি মুহাম্মদ সা. এর কাছে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে চাই। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে বেশ কথাবার্তা হলো। কূচক্রী মোশরেকটি আ’শার মনোভাব যাচাই করার জন্য বললো, দেখ, মুহাম্মদ তো ব্যভিচার নিষিদ্ধ করে।’ এতেও যখন আ’শা দমলেন না, তখন সে বললো, মুহাম্মদ সা. মদ খেতেও নিষেধ করে। এভাবে এটা ওটা বলতে বলতে সে আ’শার সংকল্পটাকে দুর্বল করে দিল। শেষ পর্যন্ত তাকে এই মর্মে রাজী করালো যে, এবারকার মত তুমি চলে যাও। আগামী বছর এসে ইসলাম গ্রহণ করো। আ’শা ফিরে গেল। কিন্তু পরের বছর মক্কায় ফিরে আসার আগেই হতভাগার মৃত্যু হয়ে গেল।
সবচেয়ে মজার ঘটনা ছিল মুরদ আরাশীর। বেচারা একটা উট নিয়ে মক্কায় এসেছিল। আবু জাহলের সাথে উট বিক্রির বিষয়ে তার কথাবার্তা পাকা হয়। কিন্তু আবু জহল দাম দিতে গড়িমসি করতে থাকে। বাধ্য হয়ে সে কোরায়েশদের বিভিন্ন নেতার কাছে গিয়ে উটের দাম আদায় করিয়ে দেয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকে। পবিত্র কা’বার চত্তরে কোরায়েশদের একটা বৈঠক চলছিল। আরাশী ঐ বৈঠকে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের কাছে আবেদন জানালো যে, আপনাদের কেউ আবু জাহলের কাছে থেকে আমার পাওনাটা আদায় করে দিন। আমি একজন বিদেশী। আমার ওপর যুলুম করা হচ্ছে। বৈঠকের লোকদের মধ্যে এমন কেউ ছিলনা, যে আবু জাহলের কাছে গিয়ে বিদেশীর হক আদায় করে দেয়ার দুঃসাহস দেখায়। এ জন্য তারা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, ঐ যে একটা লোক (মুহাম্মদ সা.) বসে আছে, ওর কাছে যাও। সে আদায় করে দেবে। আসলে এটা ছিল একটা পরিহাস মাত্র। কেননা সবাই জানতো মুহাম্মাদের সা. সাথে আবু জাহলের কি সাংঘাতিক শত্রুতা। আরাশী রসূল সা. এর কাছে এসে তার সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। রসূল সা. তৎক্ষণাত উঠলেন এবং বললেন, আমার সাথে এস। সবাই অপেক্ষা করতে লাগলো কী ঘটে তা দেখার জন্য। রসূল সা. হারাম শরীফ থেকে বেরিয়ে সোজা আবু জাহলের বাড়ীতে গেলেন এবং দরজায় করাঘাত করলেন। ভেতর থেকে আওয়ায এলো, কে? তিনি বললেনঃ আমি মুহাম্মদ। বাইরে এস। আমার জরুরী কথা আছে।
আবু জাহল বেরিয়ে এল। মুখ তার ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। তিনি বললেন, এ লোকটার যা পাওনা আছে, দিয়ে দাও। আবু জাহল বিনা বাক্যব্যয়ে পাওনা পরিশোধ করে দিল। আরাশী সানন্দে হারাম শরীফের বৈঠকরত লোকগুলোর কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা জানালো।
মুহাম্মদ সা. এর নির্মল চরিত্রের প্রভাবেই ঘটেছিল এ ঘটনা। আবু জাহল নিজেও এর স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং বৈঠকরত কোরায়েশ নেতাদের কাছে তা ব্যক্তও করেছিল। সে বললো, মুহাম্মদ এসে দরজায় করাঘাত করলো। আমি তার আওয়ায শুনতেই কেন যেন ভয় পেয়ে গেলাম। (ইবনে হিশাম)
স্বয়ং আরাশী এবং মক্কাবাসীর ওপর এ ঘটনার কেমন প্রভাব পড়ে থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
যে সব নওমুসলিম আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন, তাদের কল্যাণে ঐ এলাকায় ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল। সেখান থেকে ২০ জন খৃস্টান মক্কায় এল। তারা হারাম শরীফে রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করে। রসূল সা. তাদের সাথে কথা বলেন, তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন, কোরআন শোনান এবং ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। তাদের চোখে পানি এসে যায় এবং তারা নির্দ্বিধায় ঈমান আনে। তারা যখন উঠে বেরুলো, তখন মসজিদের বাইরে কোরায়েশরা জটলা পাকাচ্ছিল। আবু জাহল আবিসিনিয়ার প্রতিনিধি দলকে বললো, তোমরা কেমন নির্বোধ! নিজেদের ধর্মকে পরিত্যাগ করলে! প্রতিনিধি দল বললো, ‘আপনাদেরকে আমরা ছালাম জানাচ্ছি। আমরা আপনাদের সাথে কোন বিবাদ বিসম্বাদে যেতে চাইনে। আমাদের পথ ভিন্ন এবং আপনাদের পথও ভিন্ন। আমরা একটা কল্যাণ থেকে বঞ্ছিত হতে চাইনে।’
মক্কার কুচক্রীরা প্রচন্ড প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এই আশংকায় আকাবার দ্বিতীয় বায়আতের পুরো ঘটনাটা রাতের গভীর অন্ধকারে কঠোর গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন করা হয়। মদীনা থেকে আগত প্রতিনিধি দল যখন বায়আত সম্পন্ন করে নিজেদের অবস্থান স্থলে পৌঁছলো, তখন কোরায়েশ নেতারা সেখানে গিয়েই তাদের সাথে সাক্ষাত করলো। কোরায়েশদের গোয়েন্দাগিরির ব্যবস্থা এত মজবুত ছিল যে, তারা বায়আতের পুরো ঘটনা জানিয়ে তাদেরকে বললো, তোমরা মুহাম্মদ সা. কে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাও এবং তার হাতে হাত দিয়ে তোমরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করার শপথ নিয়েছ। ভালো করে শুনে নাও, তোমরা যদি আমাদের সাথে আরবদের লড়াই বাধিয়ে দাও, তাহলে আমাদের চোখে তোমাদের চেয়ে ঘৃণ্য মানুষ আর কেউ থাকবে না। আনসারগণ ব্যাপারটা গোপন করার চেষ্টা করলেন। তাই তখনকার মত ব্যাপারটা আর সামনে গড়ালোনা এবং আনসারগণ মদীনায় রওনা হয়ে গেল। কিন্তু কোরায়েশগণ এরপরও গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে যায় এবং সমস্ত তথ্য জেনে ফেলে। তারা আনসারী কাফেলার পিছু ধাওয়া করে এবং সা’দ বিন উবাদা ও মুনযির বিন আমরকে পাকড়াও করে নিয়ে আসে। তারা উভয়ে নিজ নিজ গোত্রে ইসলাম প্রচারের অংগীকার করেছিলেন। কোরায়েশগণ তাদের উভয়কে পিছমোড়া দিয়ে বেধে ভীষণ মারধর করে।
সা’দ বিন উবাদা বর্ণনা করেছেন, আমাদের এই করুণ অবস্থায় কোরায়েশদের এক দীর্ঘাঙ্গী ও সুদর্শন ব্যক্তি এল। আমি মনে মনে বললাম, এই গোত্রটির মধ্যে যদি কোন ভালো লোক থেকে থাকে, তবে সে বোধহয় এই ব্যক্তি এবং এর কাছ থেকে হয়তো কিছুটা সদ্ব্যবহার পাওয়ার আশা করা যায়। কিন্তু সে কাছে এসেই আমাকে প্রচন্ড একটা থাপপড় মারলো। এবার আমি বুঝে নিলাম, এদের কাছ থেকে কোন সদ্ব্যবহার আশা করা যায় না। অবশেষে তাদের একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, কোরায়েশদের মধ্যে কি এমন কেউ নেই, যার সাথে তোমাদের কোন পূর্বপরিচয়, সৌহার্দ বা চুক্তি আছে? আমি জুবাইর ইবনে মুতায়াম ও হারেস বিন হারবের নামোল্লেখ করলাম। সে আমাকে ঐ দু’জনের নাম ধরে ধরে ডাকার পরামর্শ দিল। আমি তাই করলাম। তখন তারা উভয়ে এসে আমাদের মুক্ত করলো।
এই ঘটনাগুলো থেকে বুঝা যায়, ইসলামী দাওয়াতের বিরোধীরা কত সক্রিয় ছিল।
সাহিত্য ও গান বাজনার ফ্রন্ট
নযর বিন হারেস ছিল ইসলাম বিরোধী অভিযানের আর এক হোতা। সে নিজের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ঘন ঘন পারস্য যেত। সেখান থেকে সে অনারব রাজা বাদশাদের ঐতিহাসিক সাহিত্যিক কিচ্ছা কাহিনী সংগ্রহ করে আনতো। তারপর মক্কায় কোরআনের বৈপ্লবিক সাহিত্যের মোকাবিলায় অনারব বিশ্ব থেকে আমদানী করা বিনোদন মূলক সাহিত্যের আসর গড়ে তুলত। এসব আসরে সে জনগণকে এ বলে দাওয়াত দিতে থাকে যে, আরে মুহাম্মদের সা. কাছ থেকে আ’দ সামূদের পঁচাবাসি কিচ্ছা শুনে কি করবে, আমার কাছে এস, আমি তোমাদের রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের দেশের মজার মজার কাহিনী শোনাবো। নযর বিন হারেসকে একটা স্বতন্ত্র মানবীয় চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত করে কোরআন বলেছেঃ
‘এক শ্রেণীর লোক এমনও আছে যারা বিভ্রান্তিকর চিত্তবিনোদনমূলক কিচ্ছা-কাহিনী কিনে আনে, যাতে করে তা দ্বারা না জেনে বুঝে মানুষকে বিপথগামী করতে পারে এবং তাদেরকে উপহাস করতে পারে।’ (সূরা লুকমানঃ ৬)
এই নযর বিন হারেস একবার এক মজলিসে আবু জাহলের সামনে রসূল সা. এর দাওয়াত ও আন্দোলন সম্পর্কে নিম্নরূপ ভাষণ দিয়েছিলঃ
‘হে কোরায়েশ জনমন্ডলী, আজ তোমরা এমন একটা জিনিসের সম্মুখীন, যার মোকাবিলায় ভবিষ্যতে তোমাদের কোন কৌশল সফল হবে না। মুহাম্মদ সা. এক সময় তোমাদের সবার প্রাণপ্রিয় এক কিশোর ছিল। তোমাদের সবার চাইতে সত্যবাদী এবং সবার চাইতে আমানতদার ও বিশ্বাসী ছিল। পরে যখনই সে প্রৌঢ় বয়সে পদার্পন করলো এবং নিজের দাওয়াত পেশ করলো, অমনি তোমরা বলতে আরম্ভ করলে, সে যাদুকর……, বলতে আরম্ভ করলে, সে জ্যোতিষী, বলতে আরম্ভ করলে সে উন্মাদ।….. আসলে এর কোনটাই ঠিক নয়। হে কোরায়েশ জনমন্ডলী, তোমরা তোমাদের নীতি সম্পর্কে আরো একটু চিন্তাভাবনা কর। কেননা আল্লাহর কসম তোমাদের সামনে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস উপস্থিত।’ (সীরাতে ইবনে হিশাম)
নযর বিন হারেসের এ ভাষণ থেকে বুঝা যায়, রসূলের সা. দাওয়াতকে সে একটা অসাধারণ ব্যাপার মনে করতো এবং তাঁর চারিত্রিক মাহাত্ম সম্পর্কেও সচেতন ছিল। কিন্তু সে নিজের সচেতন বিবেককে পদদলিত করে রসূলের দাওয়াতের বিরোধীতা করার জন্য কুটিল শয়তানী চক্রান্ত আঁটতো। সে ভালো করেই বুঝতো যে, একটা ইতিবাচক ও মহৎ উদ্দেশ্যমূলক আন্দোলনের আন্তরিকতাপূর্ণ আহ্বানের মোকাবিলায় সাধারণ লোকদের জন্য বিনোদনমূলক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অধিকতর আকর্ষণীয় উপাদান থাকতে পারে। এ জন্য সে বিনোদনমূলক ও নান্দনিক সাহিত্যের একটা আসর গড়ে তুলতো। নযর বিন হারেস বলতো, ‘আমি মুহাম্মাদের চেয়েও চিত্তাকর্ষক ও মজাদার কিচ্ছাকাহিনী শোনাতে পারি।’ এরপর যখন সে বিদেশী কিচ্ছাকাহিনী বলতো, তখন বলতো, মুহাম্মাদের সা. কিচ্ছাকাহিনী আমার কিচ্ছাকহিনীর চেয়ে কোন্ দিক দিয়ে ভালো? পক্ষান্তরে কোরআনের কিচ্ছাকাহিনীকে সে পূরাকালের কিচ্ছাকহিনী বলে ব্যংগ করতো।
শুধু এখানেই শেষ নয়, সে গানবাজনায় পারদর্শিনী একটা দাসীও কিনে এনেছিল। সে লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়াত এবং খাওয়ার পর ওই দাসীর গানবাজনা শোনাতো। যে যুবক সম্পর্কেই সে খবর পেতো যে, সে ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, তার কাছে সে ওই গায়িকাকে নিয়ে যেত এবং দাসীকে নির্দেশ দিত, ‘এ যুবককে খাইয়ে দাইয়ে অ গানবাজনা শুনিয়ে পরিতৃপ্ত কর।’ শিল্প ও সংস্কৃতির এরূপ প্রদর্শনীর আয়োজন করার পর সে সগর্বে বলতো ‘মুহাম্মদ সাঃ যে দাওয়াত দেয়, সেটা বেশি আনন্দদায়ক, না আমি যেটার আয়োজন করছি সেটা বেশি আনন্দদায়ক?’ (সিরাতুল মুসতাফা, মাওলানা ইদ্রীস কান্দালভী, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ১৮৮)
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মূল প্রাণশক্তি হল আল্লাহর আনুগত্য ও নৈতিকতা। নরনারীর অবাধ মেলামেশা ও অশ্লীলতার পরিবেশে ওই প্রাণশক্তির মৃত্যু ঘটে। যে পরিবেশে খাওয়া দাওয়া, গান বাজনা, বিনোদন, ললিত কলা ও যৌনতার প্রতি সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়, সে পরিবেশ ইসলামী দাওয়াতের উপযোগী হতে পারেনা। এ কারণেই নযর বিন হারেস একদিকে বিনোদনমূলক কিচ্ছাকাহিনী পরিবেশন করা শুরু করে অপরদিকে গান বাজনা, নারী পুরুষের সম্মিলন ও অশ্লীলতার সমাবেশ ঘটায়।
কিন্তু একটা গঠনমূলক দাওয়াত ও সদুদ্দেশ্যমুলক আন্দোলনের প্রতিরোধে বিনোদনমূলক সাহিত্য সফল হয়না এবং ললিত কলা তথা গান বাজনা ইত্যাদিও কোন কাজে লাগেনা। দু’চারদিন একটু হৈ চৈ হলো। তারপর সব স্তব্ধ হয়ে গেল।
নযর বিন হারেসের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর সে কোরায়েশ নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে মদীনায় ইহুদী ধর্মযাজকদের কাছে গেল। তাদের কাছে সে জিজ্ঞাসা করল তোমরা তো জ্ঞানীগুণী মানুষ আর আমরা অশিক্ষিত মূর্খ, ইসলামী আন্দোলনকে আমরা কিভাবে ঠেকাই এবং কিভাবে মুহাম্মাদ সাঃ কে প্রতিরোধ করি, তা বলে দাও। ইহুদী আলেমরা তাদের শেখালো যে, তোমরা মুহাম্মদ সাঃ এর কাছে যুলকারনাইন ও আসহাবে কাহফের ঘটনা জিজ্ঞেস কর এবং আত্মা কি জিনিশ জানতে চাও। তারা ঐ তিনটে প্রশ্ন যথা সময়ে রসূল সাঃ এর কাছে তুললো এবং ওহীর সাহায্যে তিনি তার সন্তোষজনক জবাব ও দিলেন। কিন্তু কাফেরদের হঠকারিতার প্রতিরোধ কিভাবে সম্ভব? (সীরাতে ইবনে হিশাম)
আপোষের চেষ্টা
গোপনীয়তার প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করার পর যখন ইসলামী আন্দোলন দ্রুতগতিতে ছড়াতে লাগলো এবং পরবর্তীতে যখন অপপ্রচার ও হিংস্রতার বিভিন্ন আয়োজন ব্যর্থ ও নিষ্ফল হয়ে গেল, তখন বিরোধীরা অনুভব করতে আরম্ভ করলো যে, ইসলামী আন্দোলন একটি অজেয় শক্তি এবং তা অচিরেই দেশে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়ে ছাড়বে। তাই আপোষ মীমাংসা ও সমঝোতার একটা পথ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা এবং দু’পক্ষের মাঝে লেনদেনের ভিত্তিতে এ দ্বন্দ্ব সংঘাতের অবসান ঘটানো যায় কিনা, সে জন্য পুনরায় উদ্যোগ আয়োজন ও চেষ্টা তৎপরতা শুরু হলো। কিন্তু আদর্শবাদী আন্দোলনে এতো বেশি শৈথিল্যের অবকাশ থাকেইনা যে, লেনদেন ও গোঁজামিলের মাধ্যমে একটা মধ্যবর্তী পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তবু ফোরামের নেতারা এ কৌশলটাও সর্বতভাবে পরীক্ষা করে দেখল যে, হয়তোবা কোনদিক দিয়ে কিছু সুযোগ সুবিধা আদায় করা যেতে পারে।
উদাহরণ স্বরূপ, তাদের একটা আপোষ প্রস্তাব এই ছিল যে, রসূল সাঃ তাদের দেবদেবী ও দেবমূর্তিগুলোর নিন্দা সমালোচনা করবেন না এবং তাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করবেননা। এছাড়া আর যত ইচ্ছা ওয়াজ নছিহত ও নৈতিক উপদেশ দিতে চান, দেবেন, তাতে কোন আপত্তি করা হবে না। অর্থাৎ তিনি মূল দাওয়াতী কলেমা থেকে বাতিলকে প্রত্যাখ্যানজনিত বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন। অন্য কথায় এর অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহর নাম নেওয়ার অবকাশ থাকবে কিন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নেই (লাইলাহ ইল্লাল্লাহ) এ কথা বলা যাবে না। যে বাতিল ধ্যানধারণার উপর প্রচলিত সভ্যতা দাড়িয়ে আছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। সমাজে খারাপ পরিবেশ ও খারাপ উপাদান যেটুকু যেভাবে আছে, তাকে ওইভাবেই বহাল থাকতে দিতে হবে। সত্য ও ন্যায়কে এমন আকারে পেশ করতে হবে, যেন তা বিপ্লবের পথকে উন্মুক্ত না করে এবং তা থেকে বৈপ্লবিক প্রেরণা নির্মূল করে দিতে হবে। ইসলামের রাজনৈতিক সংলাপ নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে। সমাজ ব্যবস্থাকে যথারীতি বহাল রেখে তার অধীনে আধ্যাত্মিক সমাজ সংস্কারের কাজ করে যেতে হবে। ভাবখানা এই যে, কোরায়েশদের শ্রেণীগত শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার ও নেতৃত্ব, ধর্মীয় নেতৃত্ব ও কৌলীন্য, কায়েমী স্বার্থ এবং অর্জিত পদমর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা সবই বহাল রাখতে হবে। এরপর তুমি যা করতে চাও কর। কিন্তু ইসলামী আন্দোলন যদি এ শর্ত মেনে নিত, তবে তা আপনা থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যেত।
তাদের পক্ষ থেকে এই শর্তও আরোপ করা হয় যে, এই কোরআন বাদ দিয়ে তদস্থলে অন্য কোন কোরআন আনতে হবে অথবা তাতে এমন রদবদল করতে হবে, যাতে আমাদের দাবী দাওয়াও পূর্ণ হয়।
ائْتِبِقُرْآنٍغَيْرِهَٰذَاأَوْ
‘এই কোরআন বাদ দিয়ে অন্য কোরআন নিয়ে এস, অথবা এতে রদবদল ঘটাও।’ (সূরা ইউনুসঃ ১৫)
এর যে জবাব ওহীর ভাষায় রসূল সাঃ এর পক্ষ থেকে দেয়া হয়, তা হলোঃ ‘আমি আমার নিজের খেয়াল খুশী মোতাবেক এ কোরআনকে বদলে ফেলবো, এ অধিকার আমার নেই। আমার কাছে যে ওহী আসে, তা ছাড়া অন্য কিছুর অনুসরন আমি করতে পারিনা। আমি যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হই, তাহলে আমাকে কেয়ামতের ভয়াবহ দিনের আযাব ভোগ করতে হতে পারে। যে ব্যক্তি নিজের মনগড়া কথাকে আল্লাহর বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তার চেয়ে বড় জালেম আর কে আছে?’
আপোষ মীমাংসার পথ বের করার জন্য ইসলামী আন্দোলনের বিরোধীদের পক্ষ থেকে এ দাবীও করা হয় যে, তুমি তোমার আশপাশ থেকে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকগুলোকে বের করে দাও। যারা কাল পর্যন্ত আমাদেরই গোলাম ছিল তাদেরকে যদি বের করে দাও, তাহলে আমরা তোমার কাছে এসে বসতে পারি, তোমার উপদেশ শুনতে পারি। নচেৎ বর্তমান অবস্থায় আমরা তোমার কাছে আসতে পারিনা এবং তোমার কথাবার্তা শুনতে পারিনা। নিম্ন স্তরের লোকেরা আমাদের পথ বন্ধ করে রেখেছে। অথচ তোমার ওখানে তারাই বড় বড় নেতা হয়ে জেঁকে বসে আছে। এই লোকদের সম্পর্কেই তারা বিদ্রূপ করে বলতো, এরাই নাকি রোম ও পারশ্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে ! মোশরেকদের মন যে ইসলামী আন্দোলনের খিদমতের জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিল, তা নয়। বরং তাদের উদ্দেশ্য এই ছিল যে, যে সব তাজা প্রাণ তরুণ সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডা তুলে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছিল, যারা নিজেদের যাবতীয় স্বার্থ কুরবানী করে সব রকমের বিপদ মুসিবত হাসিমুখে বরণ করে নিচ্ছিল এবং যাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস এই পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের কাজে নিবেদিত ছিল, তাদের উৎসাহ যেন ভেঙ্গে যায় এবং ইসলামী আন্দোলন যেন তাদের একনিষ্ঠ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
রসূল সাঃ এর মনে এই প্রতারণাপূর্ণ আপোষ প্রস্তাবের কোন প্রভাব পড়ার আগেই কোরআন তাকে সতর্ক করে দেয় যে, এটা ইসলামের শত্রুদের চিরচারিত একটা ধাপ্পাবাজী। পূর্ববর্তী সকল নবীর সাথেই এই ধাপ্পাবাজির আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। সূরা হুদের ২৭নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, হযরত নূহ আঃ এর কাছেও অবিকল এই ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সূরা আনআমের ৫২নং আয়াতে রসূল সাঃ কে উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে, তুমি ইসলামের শত্রুদেরকে খুশি করার জন্য সকাল বিকাল আল্লাহর নাম জপধারী একনিষ্ঠ সাথীদের নিজের সান্নিধ্য থেকে দুরে সরিয়ে দিও না। সূরা শুয়ারার ২১৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে তোমার এইসব নিষ্ঠাবান অনুসারীদেরকে স্নেহের সাথে লালন করতে থাক। এমনকি সূরা আবাসের প্রথম দশ আয়াতে রসূল সাঃ কে শুধু এজন্য ভৎর্সনা করা হয়েছে যে, তিনি একজন প্রভাবশালী কাফেরের সাথে কথা বলার সময় নিজের একজন অন্ধ সাহাবীর প্রশ্ন করাকে অপছন্দ করেছিলেন।
একবার কট্টরপন্থী কোরায়েশ নেতৃবৃন্দের বৈঠকে এ প্রসঙ্গে চিন্তাভাবনা হচ্ছিল। সে সময় অপরপ্রান্তে রসূল সাঃ একাকী বসে ছিলেন। উতবা ইবনে রবীয়া বৈঠকে উপস্থিত কোরায়েশ নেতৃবৃন্দকে বললো, ‘তোমরা যদি সম্মতি দাও তবে আমি মুহাম্মাদের সাথে গিয়ে কথাবার্তা বলি। আমি তার কাছে কয়েকটা বিকল্প ফরমুলা তুলে ধরবো, যার মধ্যে থেকে কোন একটা হয়তো সে গ্রহণ করবে। আমরা সেটা মেনে নিলে সে হয়তো আমাদের সাথে আর দ্বন্দ্ব-সংঘাত করতে চাইবেনা।’ এটা স্পষ্টতই একটা আপোষের উদ্যোগ ছিল। কোরায়েশদের এ পর্যন্ত আসা সম্ভবত হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণ এবং ইসলামী আন্দোলনের দ্রুত বিস্তৃতির কারণেই সম্ভব হয়েছিল। উপস্থিত সকলের সম্মতিক্রমে উতবা গিয়ে রসূল সাঃ এর সাথে নিম্নরূপ কথা বলেঃ
‘হে ভাতিজা, আমরা তোমাকে কতখানি মর্যাদা দিয়ে থাকই, তা তো তুমি জানই। সমগ্র গোত্রের মধ্যে তুমি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। বংশগতভাবেও তুমি বিশিষ্টতার দাবীদার।’ এভাবে কিছুক্ষণ তোষামোদিতে পরিপূর্ণ কিন্তু বাস্তব ভূমিকা দেওয়ার পর উতবা একটু অনুযোগের সুরে বলল, ‘তুমি জাতিকে খুবই উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছ। তাদের ঐক্যকে খণ্ড বিখন্ড করে দিয়েছ। তাদের নেতৃবৃন্দকে বেকুব ও নির্বোধ বলে আখ্যায়িত করছ। তাদের ধর্মের ও তাদের দেবদেবীদের খুঁত ধরেছ। তাদের অতীত পূর্বপুরুষদের বিধর্মী আখ্যায়িত করেছ। এবার আমার কথা শোনো। আমি যে কয়টা প্রস্তাব দিচ্ছি, তা নিয়ে তুমি চিন্তাভাবনা কর। হয়তো তার কোন একটা তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। রসুল সাঃ বললেন, ঠিক আছে। আপনি বলুন। আমি শুনবো। উতবা নিম্নোক্ত বিকল্প প্রস্তাবগুলো একে একে তুলে ধরলোঃ
‘তোমার উদ্দেশ্য যদি ধনসম্পদ অর্জন করা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তোমার জন্য এত ধনসম্পদ সংগ্রহ করে দেব, যাতে তুমি আমাদের সবার চেয়ে ধনবান হয়ে যাবে।
আর যদি তুমি এর দ্বারা নেতৃত্ব ও ক্ষমতা পেতে চাও, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা ও সরদার নিযুক্ত করতে প্রস্তুত আছি। আমরা কোন ব্যাপারেই তোমার মতামত না নিয়ে সিদ্ধান্ত নেব না।
তুমি যদি দেশে রাজা হতে চাও, আমরা তোমাকে রাজা বানাতেও প্রস্তুত।
আর যদি এর কারণ এই হয়ে থাকে যে, তোমার উপর কোন জিন ইত্যাদির প্রভাব রয়েছে, এবং সেইসব অশিরীরী জীব তোমার উপর প্রবল হয়ে পড়েছে, তাহলে আমরা চাঁদা তুলে তোমার চিকিৎসার ব্যাবস্থা করবো। এরপর তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে ভালো কথা, নচেৎ আমাদের অক্ষমতা প্রমাণিত হবে।’
এই আপোষমূলক প্রস্তাবগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মনভাব ও ধ্যাণধারণার প্রতিফলন ঘটেছে। ইসলামী আন্দোলনের বিরোধীরা সাধারণত এসব ধ্যানধারনা পোষণ করতো। এই প্রস্তাবগুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তাদের দৃষ্টিতে দুটো সম্ভাবনাই ছিল। প্রথমত রসূল সাঃ হয়তো জাহেলী সমাজ ব্যাবস্থার সাথে এত বড় সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার উদ্যোগ সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে নিচ্ছেন না, বরং কোন ভূত প্রেতের প্রভাবে কিংবা অচেতন অবস্থায় নিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, যদি তিনি সজ্ঞানে ও সচেতন অবস্থায় এ সব উদ্যোগ নিয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই রাজত্ব বা ক্ষমতা লাভই তার উদ্দেশ্য। যাহোক সব ক’টা প্রস্রাব শোনার পর রসূল সাঃ বললেন, ‘ওহে অলীদের বাবা, আপনার কথা শেষ হয়েছে?’ সে বলল, হাঁ। রসূল সাঃ বললেন এবার আমার বক্তব্য শুনুন। উতবা বলল, ‘আচ্ছা বল, শুনি।’ রসূল সাঃ সবক’টা প্রস্তাব একদিকে রেখে সূরা হা-মীম সিজদার শুরু থেকে পরতে শুরু করলেনঃ
‘হা-মীম। এ হচ্ছে পরম দয়ালু ও করুণাময়ের প্রেরিত বাণী। এ হচ্ছে একটা সুলিখিত গ্রন্থ, যার প্রতিটি আয়াত সুস্পষ্ট। এ হচ্ছে আরবী ভাষায় রচিত কোরআন – বুদ্ধিমান লোকদের জন্য। এ গ্রন্থ বিশ্বাসীদের সুসংবাদদাতা এবং অবিশ্বাসীদের দুঃসংবাদদাতা। কিন্তু ওদের অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং তারা কর্ণপাত ই করেনা। তারা বলে যে, আমাদের মন এ সব তত্ত্বের বিরোধী, যার দিকে তুমি আমাদের ডাকছ। আর আমাদের কানে রয়েছে ভারী ঢাকনা এবং আমাদের ও তোমাদের মধ্যে রয়েছে একটা আড়াল। সুতরাং, তুমি নিজের কাজ করে যাও, আমরাও আমাদের কাজ করে যাব। (আয়াত ১-৫)
রসূল সাঃ যতক্ষণ শোনাতে লাগলেন, ততক্ষণ উতবা দুহাত পেছনে নিয়ে তার উপর হেলান দিয়ে নীরবে মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলো। সিজদার আয়াত এলে তিনি পড়া বন্ধ করে সিজদা করলেন। তারপর বললেন, ‘ওলীদের বাবা, শুনলেন তো? এখন যা ভালো বোঝেন করুন।’
এরপর উতবা উঠল এবং তার সঙ্গীদের কাছে চলে গেল। তারা উতবার চেহারা দেখেই বলল, উতবার চেহারা বদলে গেছে। যাওয়ার সময় ওর চেহারা যেমন ছিল, এখন তেমন নেই। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে তারা জিজ্ঞাসা করলো, ‘ব্যাপার কি?’
উতবা বললঃ
‘ব্যাপার হলো, আমি এমন বানী শুনে এলাম, যা জীবনে আর কখন শুনিনি। আল্লাহর কসম, ওটা কবিতাও নয়, যাদুও নয়, জ্যোতিষীর কথাও নয়। হে কোরেশ জনমণ্ডলী, আমার কথা শোন। আমি পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই বলছি, মুহাম্মদকে তার বর্তমান অবস্থায় ছেড়ে দাও এবং তার পেছনে লেগনা। আল্লাহর কসম, আমি যে বানী শুনেছি, তার দ্বারা নিশ্চয়ই বড় রকমের ফল ফলবে। আরবরা যদি মুহাম্মাদকে হত্যা করে, তবে অন্যদের দ্বারা তোমরা ওর কবল থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে। আর যদি সে আরবের রাজা হয়ে যায়, তাহলে তার রাজত্ব তোমাদেরই রাজত্ব এবং তার শক্তি তোমাদেরই শক্তি হবে। তখন তারই কল্যাণে তোমরা সবচেয়ে সৌভাগ্যশীল জাতিতে পরিণত হবে। (সীরাতে ইবানে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৩১৩-৩১৪)
উতবার এই বক্তব্য থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানা যায়। প্রথমত, সেকালের আরবের বড় বড় বাগ্মী ও কবি সাহিত্যিকগণ কোরআনের ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব ও চমৎকারিত্বের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হত। দ্বিতীয়ত যতক্ষণ বিরোধীরা ইসলামের মূল দাওয়াতকে সরাসরি দাওয়াতদাতার মুখ থেকে না শুনতো, ততক্ষণই তারা নানা রকম বিষাক্ত অপপ্রচারে প্রভাবিত হতো এবং বিরোধীতার উপর অবিচল থাকতো। কিন্তু যখনই কেউ আসল দাওয়াতের কিছু অংশ সরাসরিভাবে শোনার সুযোগ পেয়েছে, অমনি তার মন তাকে গ্রহণ করেছে। তৃতীয়ত ওহীর বাণী সম্পর্কে মোশরেক সমাজের প্রত্যেক মেধাবী মানুষের ধারনা এই ছিল যে, এই বাণীর ভিত্তিতে বড় কোন বিপ্লব সংগঠিত হবেই। তারা এর অন্তরালে একটা পূর্নাঙ্গ বিপ্লবের দৃশ্য দেখতে পেত এবং অনুমান করতো যে, এই কলেমার ভিত্তিতে একটা সাম্রাজ্য এবং একটা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবেই।
কিন্তু উতবার কথা শুনে কোরায়েশদের মজলিশে ঠাট্টাবিদ্রূপ শুরু হয়ে গেল এবং অনেকেই বলল, ‘ওলীদের বাবা, মুহাম্মাদ তো আপনাকেও যাদু করে দিয়েছে দেখছি।’ উতবা বলল, ‘ওর সম্পর্কে আমার যা অভিমত, তাতো বললামই। এখন তোমরা যা ভালো মনে কর, কর।’
এর কিছুদিন পর এ ব্যাপারে আরও একটি চেষ্টা করা হলো। একদিন সূর্যাস্তের পর কোরায়েশদের সকল বড় বড় সরদার কাবা শরীফের চত্বরে জমায়েত হলো। উতবা ইবনে রবীয়া, শায়বা ইবনে রবীয়া, আবু সুফিয়ান বিন হারব, নযর বিন হারিস, কানদা, আবুল বুখতারী, আসওয়াদ বিন মুত্তালিব, যাময়া বিন আসওয়াদ, ওলীদ বিন মুগীরা, আবু জাহল বিন হিশাম, আব্দুল্লাহ বিন উমাইয়া, আ’শ বিন ওয়ায়েন, নবীহ ও মুনাবিবহ বিন হুজ্জাজ, (বনুসাহম) এবং উমাইয়া বিন খালফ এরা সবাই এদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা রসূল সা. কে ডেকে পাঠালো। রসূল সা. একটা নতুন আশায় বুক বেধেঁ তাদের কাছে এলেন। কিন্তু তারা নতুন কিছু বললেন না। ইতিপূবে উতবা ইবনে রবীয়ার মাধ্যমে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি করলো। শুনে রসূল সা. নিম্নরূপ জবাব দিলেনঃ ‘তোমরা যা বলছ, আমার ব্যাপারটা তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি যে দাওয়াত তোমাদের কাছে নিয়ে এসেছি, তার উদ্দেশ্য ধনসম্পদ অর্জন, নেতৃত্ব ও সরদারী লাভ কিংবা রাজত্ব কায়েম করা নয়। আমাকে তো আল্লাহ তোমাদের কাছে নবী ও রসূল করে পাঠিয়েছেন। তিনি আমার কাছে কিতাব নাযিল করেছেন এবং আমাকে তোমাদের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা হবার আদেশ দিয়েছেন। সে অনুসারে আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর নিদের্শাবলী পৌছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের হিতাকাংখীর দায়িত্ব পালন করেছি। আমি যা কিছু নিয়ে এসেছি, তা যদি তোমরা গ্রহণ কর, তাহলে সেটা তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নিশ্চিত করবে। আর যদি প্রত্যাখ্যান কর, তাহলে আমি ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় ধৈর্যের পরিচয় দেব, যতক্ষণ না আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে নিজের ফয়সালা জারী করেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, পৃঃ 315)
এ জবাব শুনে তারা যখন দেখলো সামনে অগ্রসর হবার পথ পাওয়া যাচ্ছে না, তখন নানা রকমের কূটতর্ক শুরু করলো। উদাহরণ স্বরূপ, তারা বললো: তুমি তো জান, আমাদের দেশটা বড়ই সংকীণ। এখানে পানি খুব কম এবং জীবন যাপন অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। তুমি আল্লাহকে বল তিনি যেন ঐ পাহাড়গুলো সরিয়ে দেন, আমাদের ভূখন্ডকে প্রশস্ত করে দেন এর উপর ইরাক ও সিরিয়ার মত নদনদী সৃষ্টি করেন। তাঁকে বল, তিনি যেন আমাদের বাপদাদাদের জীবিত করে দেন, বিশেষত কুসাই বিন কিলাবকে যেন অবশ্যই জীবিত করেন। কেননা তিনি খুব সত্যবাদী ছিলেন এবং তাকে আমরা জিজ্ঞেস করবো তোমার দাওয়াত সত্য না মিথ্যা। এভাবে যদি আমাদের পূবপুরুষরা একে একে জীবিত হয়ে তোমার দাওয়াতকে সত্য বলে সাক্ষ্য দেয় এবং আমরা যা যা দাবি করছি, তা তুমি করে দেখাও, তাহলে আমরা মেনে নিব যে, তুমি আল্লাহর রসূল। আর যদি তা না কর, তাহলে আমাদের উপর তুমি আযাবই নামিয়ে আনো’। রসূল সা. এইসব অসম্ভব দাবী-দাওয়ার জবাবে এই কথাই বারংবার বলেছেন যে, ’আমি এসবের জন্য প্রেরিত হইনি’। অবশেষে রসূল সা. যখন বাড়ীর দিকে ফিরে চললেন, তখন তাঁর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইও তাঁর সাথে সাথে চললো। সে বললো তোমার গোত্রের লোকেরা তোমাকে কতকগুলো সুযোগ সুবিধা দিতে চাইল। কিন্তু তুমি তার একটি ও গ্রহণ করলেনা। এখন তো আল্লাহর কসম, আমি তোমার উপর আর ঈমান আনছিনে, এমনকি তোমাকে আকাশের উপর সিঁড়ি লাগিয়ে সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠিয়ে যেতে দেখলে ও নয়। আবার তোমাকে যদি আকাশ থেকে নেমে আসতে স্বচোক্ষে দেখি এবং তোমার সাথে চার চারজন ফেরেশতা এসে ও যদি তোমার সত্যতার স্বপক্ষে স্বাক্ষ্য দেয়, তবুও নয়। আল্লাহর কসম, আমি যদি ঈমান আনিও, তবুও আমার আদৌ মনে হয়না যে, আমি সত্যিই তোমার সমথকে পরিণত হয়ে যাবো। (সীরাত ইবনে হিশাম)
এরপর রসূল সা. খুবই মর্মাহত হয়ে বাড়ী ফিরে এলেন।
এ ধরণের আরো একটি ঘটনা ঘটে তায়েফ সফরের পর। রসূল সা. এই সময় মক্কা থেকে বেরিয়ে পার্শ্ববতী বনুকান্দা, বনু হানিফা ও অন্যান্য গোত্রে দাওয়াত ও প্রচারের কাজ শুরু করেন। বনু আমের গোত্রে যখন দাওয়াত দিতে গেলেন, তখন ঐ গোত্রের সদার বুখায়রা বিন ফিরাসের সাথে দেখা করলেন। বুখায়রা রসূল সা. এর দাওয়াত শুনলেন। তারপর নিজের সমর্থকদের বললেনঃ ’আল্লাহর কসম কোরায়শ গোত্রের এই যুবককে আমি যদি পেতাম, তাহলে আমি তার মাধ্যমে গোটা আরব জয় করে ফেলতাম।’ তারপর সে রসূল সা. কে জিজ্ঞেস করলো, আমরা যদি এই দাওয়াত গ্রহণ করি, এবং তুমি যদি তোমার বিরোধীদের উপর জয়যুক্ত হও, তাহলে তোমার পরে ইসলামের যাবতীয় কতৃত্ব কি আমার হাতে চলে আসবে?
ভেবে দেখার বিষয় হলো, প্রাথমিক সংক্ষিপ্ত দাওয়াত পাওয়া মাত্রই ঐ ব্যক্তির মনে ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে, এ দাওয়াত এক বিপ্লব সৃষ্টিকারী দাওয়াত। এর বিজয় হওয়ার সম্ভাবনা ও রয়েছে এবং বিজয়ী হলে তা তাদের স্বাথোদ্ধারেরও সহায়ক হবে। এ সব ধারণার কারণেই বুখায়রার মনে ব্যবসায়ী সুলভ মনোভাব সৃষ্টি হয়ে যায়। কিন্তু রসুল সা. তো স্রেফ দাওয়াতদাতা ছিলেন। তিনিতো আর রাজনৈতিক ব্যবসা খুলে বসেননি। তাই তিনি জবাব দিলেনঃ
‘এটাতো আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আমার পরে তিনি যাকে চাইবেন নিযুক্ত করবেন।‘
বুখায়রা বললোঃ
’বেশ তো! আজ আমরা সমগ্র আরববাসীর সাথে লড়াই করবো। তারপর যেই তোমার স্বাথ উদ্ধার হয়ে যাবে, তখন অন্যেরা সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নেবে। তুমি যাও। আমাদের এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই।’ (রহমাতুল্লিল আলামীন, প্রথম খন্ড, পৃঃ-89)
রসূল সা. যদি কোন অরাজনৈতিক বক্তা হতেন অথবা সুফীবাদী বা পীরীমুরিদী কায়দায় সমাজের নৈতিক পরিশুদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করতেন, তাহলে সিদেসাধাভাবে জবাব দিতেন যে, ’আরে মিয়া, তুমি এ সব কি স্বপ্ন দেখছ? এতো আল্লাহ ওয়ালাদের সংস্কারমূলক কাজ। এতে স্বাথ ও সুযোগ-সুবিধার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে? কিভাবেই বা কথা ওঠে স্থলাভিষিক্ত হবার বা নেতৃত্ব ও সরদারী লাভের? রসূল সা. নিজেও যেমন জানতেন তাঁর আন্দোলন কত সুদূর প্রসারী এবং তাঁর রাজনৈতিক সম্ভাবনাই বা কতখানি। তেমনি যার সাথে তিনি কথা বলতেন সেও টের পেয়ে যেত এ দাওয়াতের শেষ গন্তব্য কোথায়।
এই সব রকমারী আপোষ-প্রচেষ্টা থেকে বিরোধী শক্তি যে সুবিধাটা বাগাতে চেয়েছিল তা হলো, রসূল সা. যদি আন্দোলনে নিরাপদে অগ্রসর হওয়ার পথ বের করা বা নির্যাতন থেকে সংগীদের বাচাঁনোর জন্য আপোষ করতে রাজী হয়ে যান, তাহলে আদশবাদী আন্দোলন হিসেবে তাঁর দাওয়াতের শক্তি চূর্ণ হয়ে যাবে। আর যদি তিনি আপোষহীনতার পরিচয় দেন, তাহলে প্রচারণা চালানো যাবে যে, দেশবাসী দেখে নাও, আমরা দ্বন্দ্ব কলহ মেটানোর জন্য কত সুযোগ সুবিধা দিতে চাইলাম এবং কত উপায় বের করলাম, কিন্তু এই ব্যক্তি এমন হঠকারী যে, কোন সমাধানকেই সে গ্রহণ করলো না। বাস্তবিকই রসূল সা. এর অবস্থানটা ছিল খুবই স্পশকাতর। তাই কোরআন এই সব আপোষ ফর্মূলার মোকাবিলায়
রসূল সা. কে দৃঢ়তা প্রদর্শনের জন্য ক্রমাগত সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে থাকে। এমনকি এক জায়গায় তো অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বিরোধীদের এই ধোকা থেকে আত্মরক্ষা করার নিদেশ দেয়া হয় এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে সংরক্ষণের আশ্বাসও দেয়া হয়।
সূরা বানী ঈসরাঈলের ৭৪ ও৭৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ
’আমি যদি তোমাকে দৃঢ়তা দান না করতাম, তাহলে বিচিত্র নয় যে, তুমি তাদের প্রতি খানিকটা নমনীয় হয়ে যেতে। তা যদি হতে, তাহলে আমি তোমাকে দুনিয়া ও আখেরাতে দ্বিগুণ শাস্তির মজা ভোগ করিয়ে দিতাম। তখন তুমি আমার মোকাবেলায় কাউকে সাহায্যকারী পেতেনা। ‘
মোটকথা, অত্যধিক বিচক্ষণতা, কুশলতা ও ধৈয্য-সহিঞ্চুতা দ্বারা রসূল সা. আন্দোলনকে এসব সওদাবাজী থেকে রক্ষা করেছেন।
সহিংসতার চরম রূপ
ইসলামের শত্রুরা চিরকালই উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে অসৎ এবং যুক্তির দিক দিয়ে অসার ও দেউলে হয়ে থাকে। তাদের আসল সমস্য হয়ে থাকে স্বার্থপরতা ও গদির নেশা। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে কেউ ময়দানে নামলেই তারা সর্বশক্তি নিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং যুক্তি-প্রমাণের জবাব দেয় সহিংসতা সন্ত্রাস ও গুন্ডামী দিয়ে। ইসলামী আন্দোলন মানবীয় বিবেক বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির বলে কাজ করে। কিন্তু ইসলাম বিরোধীরা ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আবেগ উত্তেজনা দিয়ে এর গতি রোধে সচেষ্ট হয়। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য কোন শক্তি যদি সামান্যতম তৎপরতাও চালায়, তবে তাকে সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও বাহকদের হাতে মার খেতে হয়। কিন্তু ইসলামের দাওয়াত যে সুদূরপ্রসারী ও সর্বাত্মক পরিবতনের আহবান জানায়, তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্রচলিত রাষ্ট্র ও সমাজের কর্ণধাররা এক ধরণের তীব্র উম্মত্ততায় ভোগে। মক্কায় এই অবস্থাটাই দেখা দিয়েছিল। যদিও প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনার সাথে সাথেই সহিংসতা ও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে জাহেলিয়াতের হিংস্রতা ও মুসলিম নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। পাচঁ ছয় বছরের মধ্যে মক্কা ইসলাম গ্রহণকারীদের জন্য একটা জ্বলন্ত চুলোয় পরিণত হলো। হযরত খাদীজা ও জনাব আবু তালেবেরে ইন্তেকালের পর এই চুলোর দহনশক্তি আরো তীব্র ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। কম হোক, বেশী হোক, এই চুলোয় দগ্ধ হওয়া থেকে কেউই রেহাই পায়নি। এই চুলোয় দগ্ধ হয়ে ও তপ্ত হয়ে ও গলে গলে তাঁরা খাঁটি সোনায় পরিণত হয়। এই চুলোর আঁচের সবচেয়ে বড় অংশ আন্দোলনের নেতা যদিও মুহাম্মদ সা. নিজেই ভোগ করেন, কিন্তু তাঁর সহচররা ও কম ভোগ করেননি। সাহাবায়ে কেরামের উপর পরিচালিত এই ভয়ংকর নিযাতনের কথা ইতিহাস থেকে আমরা খুব কমই জানতে পারি। তথাপি ইতিহাস থেকে যেটুকু জানা যায়, তাও লোমহষক। এখানে আমি ইসলামের দুশমনদের পরিচালিত এই নিযাতনের কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি।
সরাসরি রসূল সা. এর ওপর তো প্রতি মুহুর্তেই রকমারি যুলুম চালানো হতো। কিন্তু তাঁর সহচরবৃন্দকে যে যন্ত্রণা দেয়া হতো, তাও পরোক্ষভাবে রসূল সা. এর সংবেদনশীল মনকে ও ফোঁড় ও ফোঁড় করে দিত। এবার লক্ষ্য করুন কার ওপর কেমন নিযাতন চলেছে।
খাব্বাব ইবনুল আরত তামীমীকে জাহেলিয়তের যুগে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। উম্মে নুমার নাম্নী এক মহিলা তাকে খরিদ করে নেয়। হযরত আরকামের বাড়ী যখন ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল এবং সেখান থেকেই রসূল সা. সমস্ত সাংগঠনিক কাযক্রম পরিচালনা করতেন, তখনই হযরত খাব্বার ইসলাম গ্রহণ করেন। কোরায়েশরা জ্বলন্ত অঙ্গার বিছিয়ে তাকে সেই আগুনের বিছানায় শুইয়ে দিত। সংগে সংগে একজন মানুষ ও বুকের উপর দাড়িয়ে যেত, যাতে খাব্বার পাশ ফিরে শুতে না পারে। শেষ পযন্ত পিঠের নিচেই অংগারগুলো নিভে যেত। পরবতীকালে খাব্বার রা. হযরত ওমর রা. কে একবার নিজের পিঠ দেখালে তিনি কুষ্ঠের ন্যায় সাদা সাদা দাগ দেখতে পান। পেশায় তিনি একজন কামার ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি যখন বিভিন্ন লোকের কাছে নিজের পাওনা চান, তখন তারা জবাব দেয়, যতক্ষণ পযন্ত মুহাম্মদ সা. এর সাথে সম্পক ছিন্ন না করবে, ততক্ষণ এক পয়সা ও পাবে না। এভাবে তার উপর অথনৈতিক নিষ্পেষণ চালানো হচ্ছিল। কিন্তু এই সত্যের সৈনিক জবাব দিলেন, এটা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়।
কৃষ্ণাংগ হযরত বিলাল ছিলেন উমাইয়া বিন খালাফের ক্রীতদাস। সূয ঠিক মাথার উপর এলে আরবের উত্তপ্ত মরুভূমির বালুর উপর তাকে শুইয়ে দেয়া হতো এবং বুকের উপর ভারী পাথর দিয়ে রাখা হতো, যাতে তিনি পাশ ফিরে শুতে না পারেন। উমাইয়া তাকে বলতো, ইসলাম থেকে ফিরে আস, নচেত এভাবেই খতম হয়ে যাবে। হযরত বিলাল রা. এর জবাবে চিৎকার করে শুধু ’আহাদ’ ’আহাদ’ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক) বলতেন। এতে উমাইয়ার রাগ আরো বেড়ে যেত। সে তাঁর গলায় দড়ি বেঁধে শহরের উচ্ছৃংখল ছেলেদেরকে তার পেছনে লেলিয়ে দিত। তারা তাকে গলিতে গলিতে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতো। কিন্তু এই নিবেদিত প্রাণ আল্লাহ প্রেমিক সেই অবস্থায়ও উচ্চস্বরে ‘আহাদ আহাদ’ ঘোষণা করে যাচ্ছিলেন। কখনো তাকে গরুর চামড়ায় জড়িয়ে আবার কখনো লোহার বর্ম পরিয়ে প্রখর রৌদ্রে বসিয়ে দেয়া হতো। হযরত আবু বকর রা. অন্য একটা ক্রীতদাসের বিনিময়ে তাকে খরিদ করে মুক্ত করে দেন।
আম্মার বিন ইয়াসার ছিলেন কাহতান বংশোদ্ভুত। তাঁর পিতা ইয়াসার ইয়ামান থেকে নিজের দু‘ভাইকে সাথে নিয়ে হেজাজে এসেছিলেন তাদের অপর এক হারানো ভাইকে খুঁজতে। দু‘ভাই পরে ইয়ামানে ফিরে যান। কিন্তু ইয়াসার আবু হুযাইফা মাখযুমীর সাথে মৈত্রী স্থাপন পূবক মক্কায়ই থেকে যান এবং এখানেই বিয়ে করেন। ইয়াসার সহ তার পুরো পরিবার পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কায় আম্মার বিন ইয়াসারের কোন স্বপক্ষীয় না থাকায় তার ওপর ভীষণ অত্যাচার চালানো হতো। ইসলাম গ্রহেণের শাস্তি স্বরূপ তাকেও তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে দেয়া হতো। কোরায়েশরা তাকে মারতে মারতে বেহুঁশ করে ফেলতো। তার পিতামাতার উপর ও একই রকম শারীরিক নিযাতন চালানো হতো। তাকে পানিতে ডুবানো হতো। জ্বলন্ত অংগারের ওপরও শোয়ানো হতো। রসূল সা. তাঁর মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন এবং বেহেশতের সুসংবাদ শোনাতেন। হযরত আলীর রা. বণনা মোতাবেক রসূল সা. বলতেন, আম্মারের মাথা থেকে পা পযন্ত ঈমানে পরিপূণ। হযরত আম্মারের মা হযরত সুমাইয়া রা. কে ইসলাম গ্রহণের অপরাধে হত্যা করা হয়।
আবু জাহল স্বয়ং বর্শার আঘাতে অত্যন্ত পাশবিক পন্থায় তাকে হত্যা করে। ইসলামের এটাই প্রথম শাহাদাতের ঘটনা। হযরত আম্মারের বাবা হযরত ইয়াসার ও নির্যাতনের চোটে শহীদ হয়ে যান।
সুহায়েব ও আম্মারের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাকে এত নিমমভাবে প্রহার করা হতো যে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতেন। হিজরতের সময় কোরায়শরা তার সমস্ত সহায় সম্বল তাদেরকে দিয়ে যেতে হবে এই শর্তে তাঁকে হিজরত করার অনুমতি দেয়। সুহায়েব রা. এই শর্ত সানন্দে মেনে নেন এবং খালি হাতে মদীনায় চলে যান।
আবু ফুকইহা সুহালী ছিলেন সাফওয়ান বিন উমাইয়ার ক্রীতদাস। তিনি ইসলাম গ্রহণে হযরত বিলালের সমসাময়িক ছিলেন। একবার তার বুকের উপর এত ভারী পাথর চাপা দেয়া হয় যে, তার জিভ বেরিয়ে পড়ে। কখনো তাকে লোহার বেড়ি পরিয়ে তপ্ত বালুর ওপর উপুড় করে শুইয়ে দেয়া হতো। হযরত আবু বকর রা. তাকে ও কিনে স্বাধীন করে দেন।
হযরত ওমরের রা. ইসলাম গ্রহণের পূবে তাঁর পরিবারে লুবাইনা নাম্নী এক দাসী ছিল। ওমর রা. তাকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। তারপর বলতেন, তোকে দয়া করে নয়, বরং ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিয়েছি।
হযরত ওমরের পরিবারের আর এক দাসী ছিল যুনাইরা। ইসলাম গ্রহণের অপরাধে তাকে ও হযরত ওমর রা. অত্যন্ত নিমমভাবে প্রহার করতেন। আবু জাহল একবার তাকে পেটাতে পেটাতে চোখ নষ্ট করে দেয়। তবে একটি বণনা থেকে জানা যায় যে, ঈমানের বরকতে আল্লাহ তায়ালা অচিরেই তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক তাকে ও কিনে স্বাধীন করে দেন।
নাহদিয়া ও উম্মে উবাইস নামক দুটো দাসী ও ইসলাম গ্রহণের কারণে কঠোর নির্যাতন সহ্য করে।
হযরত ওসমানের বয়সের দিক দিয়ে ও সম্মানাহ ছিলেন এবং প্রচুর ধনসম্পদ ও পদমযাদার অধিকারী ছিলেন। তবুও তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁর আপন চাচা তাঁকে রশি দিয়ে বেঁধে মারে।
হযরত আবু যর ইসলাম গ্রহণ করা মাত্রই কা‘বা শরীফে এসে ঘোষণা দেন। সংগে সংগে কোরায়েশ সন্ত্রাসীরা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মারতে মারতে ধরাশায়ী করে দেয়।
হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে তাঁর চাচা ইসলাম গ্রহণের শাস্তি স্বরূপ চাটাইতে জড়িয়ে নাকে ধূঁয়া দিতেন। কিন্তু তিনি পূর্ণ দৃঢ়তার সাথে বলতেন, ’কোন অবস্থায়ই আমি কুফরির দিকে ফিরে আসবো না।’
আপন চাচাতো ভাই সাঈদ বিন যায়েদ ইসলাম গ্রহণ করলে হযরত ওমর রা. তাকে রশী দিয়ে বেঁধে রাখেন।
সাইদ বিন ওয়াক্কাসও অসহনীয় নির্যাতন ভোগ করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ইসলাম গ্রহণের পর সবপ্রথম কা’বা শরীফের চত্তরে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করেন। সূরা রহমান তেলাওয়াত শুরু করতেই কাফেররা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখের ওপর উপর্যুপরি ঘুষি মারতে থাকে। কিন্তু তারপরও তিনি তেলাওয়াত অব্যাহত রাখেন এবং আহত মুখমণ্ডল নিয়ে বাড়ী ফিরে আসেন।
উসমান ইবনে মাযঊন প্রথমত ওলীদ বিন মুগীরার আশ্রয়ে থাকার কারণে নিরাপদে ছিলেন। কিন্তু রসূলের সা. সাহাবীদের ওপর ভয়ংকর যুলুম নির্যাতন হতে দেখে তিনি অনুভব করেন যে, আমার সাথীরা যখন এত নির্যাতন ভোগ করছে, তখন আমি একজন মোশরেকের আশ্রয়ে থেকে নিরাপদ জীবন যাপন করবো কেন? তিনি ওলীদ বিন মুগীরাকে বললেন, আমি আপনার আশ্রয় ফিরিয়ে দিচ্ছি। ওলীদ তাকে বুঝালো যে, ‘ভাতিজা, আমার আশংকা হয়, কেউ তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে।’ তিনি বললেন, ‘না, আমি তো আল্লাহর আশ্রয়ে থাকবো। তাঁর ছাড়া আর কারো আশ্রয় আমার পছন্দ নয়।’ কা’বা শরীফে গিয়ে তিনি ওলীদ বিন মুগীরার আশ্রয় ফেরত দেয়ার ঘোষণা দিলেন। তারপর কোরায়েশদের মজলিসে গিয়ে বসলেন। সেখানে কবি লবীদ স্বরচিত কবিতা পড়ছিল। সে যখন পড়লোঃ ‘‘আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুই বাতিল’’ তখন উসমান বললেন, তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু লবীদ যখন এর পরবর্তী চরণ পড়লো, ‘‘সমস্ত নিয়ামত ধ্বংসশীল’’ তখন উসমান বললেন, এ কথাটা তুমি ভুল বলেছ। বেহেশতের নিয়ামত কখনো ধ্বংস হবে না।’ লবীদের মাথায় খুন চড়ে গেল। সে চারদিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলো, কে তার ভুল ধরার ধৃষ্টতা দেখালো। লবীদ বললো, ‘ওহে কোরায়েশ জনমন্ডলী, তোমাদের সহযোগী কবির সাথে এমন বেআদবী কে করলো? একজন বললোঃ ‘এ হচ্ছে ধর্মচ্যুত জনৈক বেকুফ। ওর কথা গায় মাখিও না।’ উসমান চুপ থাকতে পারলো না। তিনি তার কথার যুৎসই জবাব দিলেন। এতে ঐ লোকটি উঠে উসমানকে এমন জোরে থাপ্পড় দিল যে, তার চোখ নষ্ট হয়ে গেল।’ এ দৃশ্য দেখে ওলীদ বিন মুগিরা বললো, তুমি আমার আশ্রয়ে থাকলে আজ এভাবে চোখ খোয়াতে না। উসমান বললেন, আমার যে চোখটা অক্ষত আছে, তাও হারাতে রাযী আছি। আমি যার আশ্রয়ে আছি, তিনি তোমার চেয়েও প্রতাপশালী ও শক্তিশালী।
হযরত আবু যর গিফারী ইসলাম গ্রহণের পর বিপ্লবী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে সরাসরি হারাম শরীফে উপনীত হলেন এবং সেখানে উচ্চস্বর নিজের নতুন আকীদা-বিশ্বাস ঘোষণা করলেন। কোরায়েশরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বললো, এই ধর্মত্যাগীকে পেটাও। অমনি মারপিট শুরু হয়ে গেল। তাকে মেরে ফেলাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু রসূলের সা. চাচা আব্বাস ঘটনাক্রমে ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, আরে এ তো গিফার গোত্রের লোক। তোমাদের বাণিজ্যোপলক্ষে ওদের এলাকা দিয়েই যেতে হয়। একটু সাবধানে কাজ কর।’ অগত্যা কোরায়েশরা সংযত হলো। পরের দিন তিনি আবারো নিজের ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ঘোষণা করলেন এবং আবারো গণপিটুনি খেলেন।
হযরত উম্মে শুরাইক ইসলাম গ্রহণ করলে তার আত্মীয় স্বজন তাকে প্রখর রোদে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এ সময় তাকে খাবার জন্য রুটির সাথে মধু দিত এবং পানি খেতে দিতনা, যাতে গরম বেশি অনুভূত হয় এবং দ্বিগুণ শাস্তি ভোগ করে। এ অবস্থায় এক নাগাড়ে তিন দিন কেটে গেল। চরম কষ্টের ভেতরে যখন তাকে বলা হলো, ইসলাম ত্যাগ কর, তখন তার বোধশক্তি অবশ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝতেই পারলেননা তাকে কি করতে বলা হচ্ছে। অবশেষে যুলুমবাজরা আকাশের দিকে ইংগিত দিয়ে বললো, আল্লাহর একত্ব অস্বীকার কর। এবার তিনি তাদের দাবী বুঝতে পেরে বললেন, আমি আমার আকীদা বিশ্বাসে অবিচল আছি এবং থাকবো।
খালেদ ইবনুল আ’স ইসলাম গ্রহণ করার পর তার বাবা তাকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়। উপরন্তু তাকে ক্ষুধার শাস্তিও দেয়া হয়।
মোটকথা, এমন কেউ ছিলনা যাকে কঠিন অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়নি। হযরত উসমানের ন্যায় হযরত আবু বকর ও তালহাকেও রশী দিয়ে বেধে রাখা হয়। ওলীদ ইবনে ওলীদ, আইয়াশ বিন আবি রবীয়া এবং সালমা বিন হিশামকে কঠোর নির্যাতন করা হয় এবং তাদেরকে হিজরত করতেও বাধা দেয়া হয়। হযরত ওমর নিজের বোন ও ভগ্নিপতির ওপর যে নির্যাতন চালান তাও ছিল অমানুষিক। এর বিস্তারিত বিররণ পরে দেয়া হবে।
একদিকে এই ভয়াবহ নির্যাতন আর অপরদিকে ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহীদের দৃঢ়তা লক্ষ্য করুন। নারী-পুরুষ, দাস-দাসী, যে-ই একবার এই দাওয়াতকে গ্রহণ করেছেন, সে আর পিছু হটেনি। যুলুম-নির্যাতন কোন এক ব্যক্তিকেও ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করতে পারেনি। আমরা দেখতে পাই, সার্থক অর্থে একটা বিপ্লবী প্রেরণা তাদের অস্থিমজ্জায় সঞ্চালিত হয়েছিল। তাদের অতুলনীয় ধৈর্য কোরায়েশদের নিপীড়নমূলক স্বৈরাচারকে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ করে দিয়েছিল। ইসলামের আহ্বানে যে-ই একবার সাড়া দিত, তার ভেতরে সম্পূর্ণ নতুন একটা মানুষ জন্ম নিত এবং তার বুকে নতুন শক্তি সঞ্চারিত হতো।
আবিসিনিয়ায় হিজরত
প্রতিটি বিপদ মুসিবতেরই একটা সহ্য সীমা থাকে। ইসলামী আন্দোলনের নিশানবাহীরা কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছিল, এবং তাতে তারা ধৈর্যের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তা অবশ্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু যুলুম নির্যাতনের বিরতির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলনা। বরং ক্রমেই তা জোরদার হচ্ছিল। রসূল সা. তাঁর সংগীদের দুরবস্থা দেখে মর্মাহত হতেন। কিন্তু তাঁর কিছুই করার ক্ষমতা ছিলনা। তাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল আল্লাহর প্রতি আস্থা, আখেরাতে অবিচল ঈমান, সত্যের চূড়ান্ত বিজয়ের দৃঢ় আশা এবং আবেগভরা দোয়া। রসূল সা. তাঁর সাথীদের এই বলে প্রবোধ দিতেন যে, আল্লাহ কোন না কোন পথ অবশ্যই বের করবেন। বাহ্যত মক্কার পরিবেশ হতাশাব্যঞ্জক হয়ে উঠছিল এবং এমন কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না যে, ঐ অনুর্বর ভূমিতে ইসলামী আন্দোলনের পবিত্র বৃক্ষে কোন ফল জন্মাবে। পরিস্থিতি দেখে স্পষ্টতই মনে হচ্ছিল, মক্কায় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের সম্ভাবনা নেই, এ সৌভাগ্য হয়তো অন্য কোন ভূখন্ডের কপালে লেখা রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে আগেও হিজরাতের অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই অনুমিত হচ্ছিল যে, রসূল সা. ও তার সাহাবীদেরকেও হয়তো মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে হবে। একটা সর্বাত্মক মানব কল্যাণমূলক মতাদর্শের সূচনা যদিও একটা বিশেষ দেশ ও বিশেষ জাতির মধ্যেই হয়ে থাকে, কিন্তু তা জাতীয়তাবাদ বা আঞ্চলিকাতাবাদের সংকীর্ণতার উর্দ্ধে অবস্থান করে এবং তা কোন দেশ ও জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনা। কোন বিশেষ এলাকার মানুষ যদি অযোগ্য প্রমাণিত হয়, তবে তা অন্য কোন জনপদকে এই লক্ষ্যে মনোনীত করে। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট অনুমতি বা নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত দাওয়াতের কেন্দ্রীয় ভূমিকে পরিত্যাগ করা নবীদের নীতি নয়। তা সত্ত্বেও রসূল সা.যুলুম ও ধৈর্যের সংঘাতকে এমন এক পর্যায়ের দিকে ধাবমান হতে দেখছিলেন, যেখানে সহনশীলতার মানবীয় ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। মুসলমানগণ ব্যাকুল ভাবে অপেক্ষা করছিলেন আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে। এরূপ পরিস্থিতিতে তিনি সাহাবীদের পরামর্শ দিলেন, ‘‘তোমরা দুনিয়ার কোন দেশে চলে যাও। আল্লাহ অচিরেই তোমাদের কোথাও একত্রিত করবেন।’’ তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ দেশে যাবো? রসূল সা. আবিসিনিয়ার দিকে ইংগিত করলেন। ঐ দেশটার রাজা অপেক্ষাকৃত ন্যায়পরায়ণ এবং হযরত ঈসার আ. আদর্শের অনুসারী বলে রসূল সা. জানতেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, ঐ দেশটাই হিজরতের উপযোগী। তিনি আবিসিনিয়া সম্পর্কে বললেন, ‘ওটা সততা ও ন্যায়পরায়ণতার দেশ’। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
নবুয়তের পঞ্চম বছর রসূল সা. এর বিপ্লবী দলের এগারো জন পুরুষ ও চারজন মহিলার কাফেলা হযরত উসমান ইবনে আফফানের নেতৃত্বে রাতের অন্ধকারে আবিসিনিয়া অভিমুখে রওনা হলো। হযরত উসমানের তাঁর মহীয়সী স্ত্রী অর্থাৎ রসূল সা. এর কন্যা রুকাইয়াও হিজরতের এই প্রথম সফরে সংগিনী হন। রসূল সা. এই মহান দম্পতি সম্পর্কে মন্তব্য করেনঃ হযরত লুত ও হযরত ইবরাহীমের পর এটাই আল্লাহর পথে মাতৃভূমি ত্যাগকারী প্রথম দম্পতি। (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, রহমাতুল্লিল আলামীন)
এই কাফেলার গৃহত্যাগের খবর যখন কোরায়েরশরা জানতে পারলো, তৎক্ষণাত তারা তাদের পিছু ধাওয়া করতে লোক পাঠালো। কিন্তু জেদ্দা বন্দরে পৌঁছে জানতে পারলো, তাৎক্ষণিকভাবে নৌকা পেয়ে যাওয়ায় তারা এখন নাগালের বাইরে। এই মোহাজেররা খুব অল্প দিন (রজব থেকে শাওয়াল পর্যন্ত) আবিসিনিয়ায় থাকেন। তারা একটা গুজব শুনতে পান যে, কোরায়েশরা ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাই মক্কায় ফিরে আসেন। কিন্তু মক্কার কাছাকছি পৌঁছেই জানতে পারেন, ঐ গুজব ছিল ভুল। এবারে দেখা দিল কঠিন সমস্যা। কেউ লুকিয়ে এবং কেউ বিভিন্ন ব্যক্তির সহায়তায় শহরে প্রবেশ করলো। এভাবে ফিরে আসার অনিবার্য পরিণাম স্বরূপ আগের চেয়েও প্রবলভাবে নির্যাতন হতে লাগলো।
এরপর আরেকটা বড় কাফেলা আবিসিনিয়ায় হিজরত করলো। এ কাফেলায় ৮৫ জন পুরুষ ও ১৭ জন মহিলা ছিল। আবিসিনিয়ায় তারা নিরাপদ পরিবেশ পেলেন এবং নিশ্চিন্তে ইসলামী জীবন যাপন করতে লাগলেন।
এবার লক্ষ্য করুন, ইসলামের শত্রুদের আক্রোশ কত সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে। তারা একটা বৈঠকে মিলিত হয়ে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ আলোচনা চালালো। তারা স্থির করলো, আব্দুল্লাহ ইবনে রবীয়া ও আমর ইবনুল আ’সকে আবিসিনিয়ার রাজার কাছে দূত করে পাঠাবে। দূতদ্বয় রাজার সাথে আলোচনা করে মোহাজেরদের ফিরিয়ে আনবে। এ উদ্দেশ্যে নাজ্জাশী ও তার সভাসদদের জন্য মূল্যবান উপঢৌকন প্রস্তুত করা হলো এবং বিপুল জাঁকজমকের সাথে দূতত্বয় রওনা হলো। আবিসিনিয়া পৌঁছে তারা সভাসদ ও পাদ্রীদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো এবং তাদের ঘুষ দিল। তারা তাদেরকে বুঝালো যে, আমাদের দেশে কয়েকজন বেয়াড়া লোক একটা ধর্মীয় গোলযোগ সৃষ্টি করেছে। ওরা আমাদের পৈতৃক ধর্মের জন্য যতটা বিপজ্জনক, ঠিক ততটা বিপজ্জনক আপনাদের ধর্মের জন্যও। আমরা ওদেরকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার পর ওরা আপনাদের এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ওদেরকে এখানে থাকতে দেয়া উচিত নয়। এ উদ্দেশ্যে আপনারা আমাদের সহযোগিতা কররুন। তারা চেষ্টা চালিয়েছিল যাতে দরবারে পুরো ঘটনা নিয়ে আলোচনাই না হতে পারে, মোহাজেররা আদৌ কথা বলারই সুযোগ না পায় এবং রাজা কোরায়েশ দূত দ্বয়ের একতরফা কথা শুনেই মোহাজেরদেরকে তাদের হাতে সমর্পণ করেন। এ উদ্দেশ্যে ঘুষ ও গোপন যোগসাজশের পথ অবলম্বন করা হয়। সভাসদদের নেপথ্যে বশীকরণের পর তারা উপঢৌকনাদি নিয়ে নাজ্জাশীর সামনে উপস্থিত হয়। তারা নিজেদের আগমণের উদ্দেশ্যে এভাবে ব্যাখ্যা করে, মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আমাদেরকে আপনার দরবারে এই আবেদন পেশ করার জন্য পাঠিয়েছেন যে, আপনি আমাদের লোকগুলোকে আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন। সভাসদ ও পাদ্রীরা তাদের আবেদনকে সংগে সংগেই সমর্থন করলো। কিন্তু নাজ্জাশী একতরফা দাবীর ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন, মোহাজেরদের বক্তব্য না শুনে আমি তাদেরকে তোমাদের হাতে সমর্পন করতে পারি না।
পরদিন দরবারে উভয় পক্ষকে ডাকা হলো। মুসলমানদের কাছে যখন নাজ্জাশীর আহ্বান পৌঁছলো, তখন তারা পরামর্শে বসলেন। তারা আলোচনা করলেন, রাজা তো খৃষ্টান, আর আমরা আকীদা বিশ্বাসে ও রীতিনীতিতে তার সাথে ভিন্ন মত পোষণ করি। এমতাবস্থায় তার কাছে আমরা কি বলবো? আলাপ আলোচনার পর তাঁরা স্থির করলেন যে, রসূল সা. আমাদের যা যা শিখিয়েছেন, আমরা হুবহু তাই বলবো, তা থেকে চুল পরিমাণও ভিন্ন কিছু বলবো না। এতে পরিণাম যা হয় হোক। ভেবে দেখুন, তাঁদের ঈমান কত মজবুত ছিল। কঠিন অবস্থায়ও সত্য ও সততার ওপর অবিচল থাকাই আল্লাহর বিধান। এরপর যখন মোহাজেররা দরবারে পৌঁছলেন, তখন প্রচলিত রীতি অনুসারে নাজ্জাশীকে সিজদা করলেন না। সভাসদরা এতে আপত্তি তুলে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা সিজদা করলে না কেন? মোহাজেরদের মুখমাত্র হযরত জাফর জবাব দিলেন, আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা করিনা। এমনকি স্বয়ং রসূল সা. কেও আমরা সাদাসিদাভাবে শুধু সালামই করি। লক্ষ্য করুন যে, কী নাজুক পরিস্থতিতে প্রকৃত তাওহীদের এই দুঃসাহসিক অভিব্যক্তি ঘটানো হচ্ছিল। যে শক্তির সামনে প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিজেদের আসল পরিচয় গোপন রেখে চাতুর্যের আশ্রয় নিচ্ছিল, সেই শক্তির সামনেই তারা অকুতোভয়ে আদর্শবাদী একনিষ্ঠতার পরিচয় দিলেন।
এবার মক্কার দূতদ্বয় তাদের দাবী পেশ করলো যে, এই মোহাজেররা আমাদের দেশের পলাতক আসামী। তারা একটা নতুন ধর্ম উদ্ভাবন করেছে এবং তার ভিত্তিতে একটা সর্বনাশা তান্ডবের সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই ওদেরকে আমাদের হাতেই সোপর্দ করা হোক। নাজ্জাশী মুসলমানদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের ব্যাপার কী? তোমরা কি খৃষ্টবাদ ও পৌত্তলিকতা ছাড়া তৃতীয় কোন ধর্মকে গ্রহণ করেছ?
মুসলমানদের মুখপাত্র হিসাবে হযরত জাফর উঠে দাঁড়ালেন এবং নাজ্জাশীর কাছে এই মর্মে আবেদন জানালেন যে, তিনি প্রথমে মক্কার দূতদ্বয়ের কাছে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চান। তাকে এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করার অনুমতি দেয়া হোক। নাজ্জাশীর অনুমতি লাভের পর তিনি নিম্নরূপ জিজ্ঞাসাবাদ করলেনঃ
হযরত জা’ফরঃ আমরা কি মক্কায় কারো ক্রীতদাস ছিলাম যে, আমরা আমাদের মনিবের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি? তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে তো আমাদের অবশ্যই ফেরত পাঠানো উচিত।
আমর ইবনুল আসঃ না, তোমরা ক্রীতদান নও, স্বাধীন ও সম্ভ্রান্ত।
হযরত জা’ফরঃ আমরা কি কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এসেছি? যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী বা অভিভাবকদের কাছে ফেরত পাঠানো উচিত।
আমর ইবনুল আ’সঃ না, তোমরা এক ফোঁটা রক্তও প্রবাহিত করনি।
হযরত জা’ফরঃ আমরা কি কারো ধনসম্পদ চুরি করে এসেছি? তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সেই পাওনা পরিশোধ করতে প্রস্তুত।
আমর ইবনুল আ’সঃ না তোমাদের কাছে কারো এক পয়সাও পাওনা নেই।
এই জেরার মাধ্যমে যখন মুসলমানদের নৈতিক অবস্থা ও মান সুস্পষ্ট হয়ে গেল, তখন হযরত জা’ফর নিম্নরূপ ভাষণ দিলেনঃ
‘‘হে রাজা, আমরা একটা মূর্খ ও অজ্ঞ জাতি ছিলাম। আমরা মূর্তি পূজা করতাম, মরা জন্তুর গোশত খেতাম, ব্যভিচার করতাম, প্রতিবেশিকে কষ্ট দিতাম, ভাইয়ে ভাইয়ে যুলুম অত্যাচার করতাম, এবং আমাদের সবলেরা দুর্বলদের শোষণ ও নিপীড়ন করতো। এমতাবস্থায় আমাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি জন্ম নিল যার সততা ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা ও ভদ্রতা সম্পর্কে আমরা আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলাম। তিনি আমাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং আমাদেরকে পাথর পূজা পরিত্যাগ করা, সত্য কথা বলা, রক্তপাত বন্ধ করা, এতীমদের সম্পদ আত্মসাত না করা, প্রতিবেশীর সেবা ও উপকার করা, সতী নারীদের বিরুদ্ধে অপবাদ রটনা না করা, নামায পড়া, রোযা রাখা ও দানসদকা করার শিক্ষা দিলেন। আমরা তাঁর ওপর ঈমান আনলাম, পৌত্তলিকতা ছেড়ে দিলাম, এবং সমস্ত খারাপ কাজ বর্জন করলাম। এই অপরাধে আমাদের গোটা জাতি আমাদের শত্রু হয়ে গেল। তারা আমাদেরকে আগের সেই গোমরাহীতে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য শক্তি প্রয়োগ করে। এই পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের ঈমান ও জান বাঁচানোর জন্য আপনার রাজ্যে পালিয়ে এসেছি। আমাদের জাতি যদি আমাদেরকে মাতৃভূমিতে থাকতে দিত, তাহলে আমরা আসতাম না। এই হচ্ছে আমাদের প্রকৃত অবস্থা।’’
কথা যদি সত্য হয় এবং বক্তা যদি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সহকারে তা বলে, তবে শ্রোতার মনে তা প্রভাব বিস্তার না করে পারে না। নাজ্জাশীর মত খোদাভীরু রাজার মন গলে গেল। তিনি বললেন, তোমাদের ওপর যে কিতাব নাযিল হয়েছে, তার কিছু অংশ আমাকে শোনাও তো দেখি। হযরত জা’ফর সূরা মরিয়মের প্রথম থেকে কিছু অংশ পড়ে শোনালেন। আল্লাহর এই আয়াতগুলো শুনে রাজার মন আরো নরম হলো এবং তাঁর চোখে পানি এসে গেলো। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেনঃ “আল্লাহর কসম, এই বাণী এবং ইনজিল একই উৎস থেকে এসেছে।” তিনি আরো বললেন “মুহাম্মাদ (সাঃ) তো সেই রসূলই, যার ভবিষ্যদ্বাণী হযরত ঈসা (আঃ) করেছিলেন। আল্লাহর শোকর যে, আমি সেই রসূল (সাঃ) এর যুগটা পেয়ে গেলাম।” সঙ্গে সঙ্গে তিনি এই রায়ও দিলেন যে, মোহাজেরদের ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত দরবারের কার্যক্রম শেষ হলো এবং দূতদ্বয় ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। পরে তারা উভয়ে স্থির করলো যে, আর একবার চেষ্টা করে দেখা যাক। নাজ্জাশী একজন খৃষ্টান। হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে মুসলমানদের আকীদা বিশ্বাস দরবারে তুলে ধরলে বিচিত্র নয় যে, রাজার মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষের আগুন জ্বলে উঠবে।
পরদিন আমর ইবনুল আ’স পুনরায় দরবারে হাজির হলো। নাজ্জাশীকে উস্কে দেয়ার জন্য এই অপবাদ আরোপ করলো যে, এই মোহাজেররা হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে খুবই খারাপ ধারনা পোষণ করে। নাজ্জাশী পুনরায় মুসলমানদের ডাকলেন। তারা যখন পরিস্থিতি জানলেন তখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন যে, হযরত ঈসা (আঃ) “আল্লাহর পুত্র”- এই কথা অস্বীকার করলে নাজ্জাশীর কি প্রতিক্রিয়া হয় কে জানে?
কিন্তু ঈমানদারদের দৃঢ়তা এবারও তাদেরকে নির্দেশ দিলো, যা সত্য তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দাও। হযরত জা’ফর তাঁর ভাষনে বললেনঃ
“আমাদের নবী বলেছেনঃ হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর দাস, আল্লাহর নিদর্শন ও আল্লাহর রসূল”।
একথা শুনে নাজ্জাশী মাটি থেকে একটা ঘাসের টুকরো হাতে নিয়ে বললেন, ‘তুমি যা বলেছ, হযরত ঈসা (আ:) তা থেকে এই ঘাসের টুকরো পরিমাণও বেশি কিছু নন’। ষড়যন্ত্রের শিকার এবং ঘুষ ও উপঢৌকন দ্বারা বশীভূত পাদ্রীরা মনে মনে অনেক ছটফট করলো। এক পর্যায়ে তাদের নাক দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু নাজ্জাশী তার কোন তোয়াক্কা করলেন না। পরিষ্কার নির্দেশ দিলেন যে, সব উপঢৌকন ফেরত দেয়া হোক। মক্কার প্রতিনিধিদ্বয় একেবারেই ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলো।