ইহুদীদের ঐতিহাসিক অবস্থান ও ভূমিকা
ইসলাম ও জাহেলিয়াতের ইতিহাসের এটা একটা মর্মান্তিক ঘটনা যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রয়াস প্রতিরোধের কাজটা সবার্ধিক ঈমানী আবেগ ও উদ্দীপনা নিয়ে চিরকাল ধর্মীয় মহলই করে এসেছে। ধর্মীয় মহলের যেখানে সত্য দ্বীনের দাওয়াতের প্রথম আওয়াযেই সাড়া দিয়ে প্রথম কাতারে গিয়ে দাঁড়ানোর কথা, সেখানে কতিপয় ব্যতিক্রম বাদে তারাই সবর্প্রথম তাকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। ধর্মীয় মহল প্রথমে ধর্মের খাদেম ও পতাকাবাহী হয়। কিন্তু ক্রমে ক্রমে যখন তাদের একটা পদমর্যাদার সৃষ্টি হয়ে যায় এবং ধর্মের সাথে তাদের কিছু স্বার্থ জড়িত হয়ে যায়, তখন তারা ধর্মকে নিজেদের তাবেদার বানিয়ে নেয় এবং ধীরে ধীরে ধর্মের নামে নিজেদের কিছু চিরস্থায়ী অধিকার সৃষ্টি করে ফেলে। ধর্মপ্রাণ জনসাধারণকে তারা নিজেদের কিছু শ্রেণী ভিত্তিক দাবীদাওয়া মানতে বাধ্য করে এবং পরিণামে তাদের জন্য কিছু বিশেষ সম্মানজনক পুরস্কার নির্দিষ্ট হয়ে যায়। ধর্ম তার অনুসারীদের নৈতিক অধোপতনের যুগে সবর্দাই এই সব স্তর অতিক্রম করে থাকে। এ পর্যায়ে এসে ধর্ম একটা চমৎকার লাভজনক ব্যবসায়ে পরিণত হয় এবং তা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরযোগ্য স্থাবর সম্পত্তির রূপ ধারণ করে। এ পর্যায়ে এসে ওয়ায নসীহত হয়ে যায় ব্যবসায়িক পণ্য, ধর্মীয় বিদ্যা হয়ে যায় জীবিকার উপায়, আর ফতোয়া বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পর্যবসিত হয়ে একটা নিজস্ব বাজার মূল্য সৃষ্টি করে। ধর্মীয় পদ আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ও ক্ষমতার সিড়িতে পরিণত হয়। ধর্মীয় নেতারা একবার এই স্তরে উপনীত হলে তাদের বাণিজ্যিক মানসিকতা প্রত্যেক ব্যাপারে এরূপ চিন্তা করতে বাধ্য হয় যে, আমাদের স্বার্থ বহাল আছে কিনা এবং আমাদের পদমর্যাদা অন্য কেউ কেড়ে নিচ্ছে নাতো ? ব্যবসায়ী মনমানস যখন এসব গুণবৈশিষ্ট সহকারে ধর্মের গণ্ডীতে প্রবেশ করে তখন তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত বৈশিষ্টগুলো দেখা দিতে থাকেঃ
– কারো দিক থেকে ভিন্নমত পোষণ সহ্য করতে পারে না এবং কোন বৃহত্তর উদ্দেশ্যে অন্যদের সাথে সহযোগিতা করতে পারেনা।
– নিজেদের মধ্যে কোন ভুল ভ্রান্তি বা দুবর্লতার কথা স্বীকার করে না এবং তা সংশোধনেও প্রস্তুত হয় না।
– নেতৃত্বের পদ ও প্রভাব বিস্তারের গদি ছেড়ে অন্য কারো নেতৃত্বে, নির্দেশে বা আহ্বানে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেনা।
এই সব বৈশিষ্টের চরম অবস্থায় এসে পৌঁছে ছিল ইহুদী জাতি। তারা কখনো এটা মেনে নিতে পারেনি যে, তাদের শ্রেণীর চৌহদ্দির বাইরেও সত্যের অস্তিত্ব থাকতে পারে। তাদের আনুগত্য না করে কেউ সুপথে পরিচালিত হতে পারে এবং নেতৃত্বের পদ তাদের ছাড়া আর কারো প্রাপ্য হতে পারে-এ কথা তারা স্বীকারই করতনা।
বিরোধিতা মক্কার কোরায়েশও করেছে, মদিনার ইহুদিরাও করেছে। উভয় গোষ্ঠীর কেউই বিরোধিতায় কোন কমতি রাখেনি। কিন্তু উভয়ের বিরোধী ভূমিকায় বিরাট পার্থক্য রয়েছে। উভয়ের ভূমিকার তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, কোরায়েশদের বিরোধিতার পিছনে আসল চালিকা শক্তি ছিল দাম্ভিকতা ও অহংকার। কিন্তু ইহুদীদের মন আচ্ছন্ন প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতায়। কোরায়েশ আভিজাত্যবোধ ও শ্রেষ্ঠত্ববোধের রোগে আক্রান্ত ছিল, আর ইহুদীরা আক্রান্ত ছিল হীনমন্যতার ব্যাধিতে। এ জন্য কোরায়েশদের মধ্যে ছিল খোলাখুলি প্রত্যাখ্যান ও সঙ্ঘাতের মনোভাব। আর ইহুদীদের বিরোধিতায় কুটিল ষড়যন্ত্র ও ধাপ্পাবাজী স্বভাবের প্রাধান্য ছিল। কোরায়েশদের মধ্যে ছিল বীরোচিত ঔদ্ধত্য, আর ইহুদীদের স্বভাবে ছিল কাপুরুষোচিত ইতরামি। কোরায়েশদের বিরোধিতা যেখানে সরাসরি আক্রমণাত্মক বৈশিষ্টের অধিকারী ছিল, সেখানে ইহুদীরা এগিয়ে ছিল গোপন যোগসাজশ, চক্রান্ত, কপটতা ও ভণ্ডামির দিক থেকে। মক্কায় শুধু দুটো সম্প্রদায় ছিলঃ মুসলমান ও কাফের। কিন্তু মদিনায় মুসলমান ও কাফের এই দুই শক্তির মাঝে তৃতীয় শক্তি মোনাফেকদেরও অভ্যুদয় ঘটে। এই পর্যালোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বক ধার্মিকতা ও বিকৃত দ্বীনদারী উগ্র প্রকাশ্য কুফরী, শেরক ও জাহেলিয়াতের চেয়েও কতটা নীচ হীন স্বভাবের হয়ে থাকে এবং সত্য ও ন্যায়ের বিরোধিতায় কতো বেশী জঘন্য ভূমিকা পালন করে থাকে?
আমরা এটাও দেখতে পাই যে, কুফরি ও দ্বীনদারীর এই সংঘাতে ইহুদীদের বিকৃত ও স্বার্থবাদী দ্বীনদারী ইসলামের মোকাবেলায় মক্কার কাফের ও মোশরেক শক্তির সবার্ত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করেছে। অথচ যতই মতভেদ থাকুক, এক আল্লাহর এবাদত ও নৈতিকতার পতাকাবাহীদের প্রতি তো তার অধিকতর সহানুভুতি থাকা উচিত ছিল। অন্তত এটুকু সহনীয় তো হতে পারতো যে, ইহুদীরা ইসলাম বিরোধিতায় নিজেদের অবস্থানকে কাফের ও মোশরেকদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে পারতো। কিন্তু “এসো আমাদের ও তোমাদের মধ্যকার একটি সম্মত বক্তব্যে আমরা একমত হই” এই দায়পূর্ণ আহ্বান শোনার পরও তারা শ্রেষ্ঠতম মানব মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের পবিত্র ধর্মীয় চিন্তা ও কর্মকে বাদ দিয়ে আবু জাহল ও আবু লাহাবের ন্যায় নিকৃষ্ট মানুষদের সহযোগী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বক ধার্মিকতা ও বিকৃত দ্বীনদারীর আর একটা চিরন্তন ঐতিহাসিক ভূমিকা এই হয়ে থাকে যে, তা যুদ্ধের ময়দানেও কোন অবস্থায়ই ধর্মীয় পক্ষের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত হয়না। বরং তা অবধারিতভাবে ধর্মের শত্রুদের পক্ষেই যায়। কুফরী, নাস্তিকতা ও পাপাচারীদেরই সহযোগী হয়ে যায়। গুটিকয় ব্যতিক্রমী ব্যক্তির কথা আমি আলোচনা করছিনা। এ ধরণের ব্যতিক্রম যে কোন গোষ্ঠীর মধ্যে নিকৃষ্টতম বিকৃতির সময়েও কিছু না কিছু পাওয়া যায়। আমরা কেবল সাধারণ নীতিগত বিষয়েই আলোচনা করছি।
এই ছিল ইহুদীদের ন্যাক্কারজনক অবস্থান। তারা নিজেদের গোপন ঘাঁটি থেকে বেরিয়ে ধর্মজ্ঞান ও ধর্মাচারের সকল অস্ত্র ধারণ করত নাশকতামূলক ও নেতিবাচক ফ্রন্টে গিয়ে তারা ইসলামের দিকে অস্ত্র তাক করে ওৎ পেতে বসে এবং কার্যত কাফের ও মোশরেকদেরকে সবার্ত্মক সহযোগিতা দেয়। তারা রসূল সা. এবং ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মী সাহাবীগণের বিরুদ্ধে অশ্রাব্য গালাগাল ও কটুবাক্য বর্ষণ করে, ব্যাংগ বিদ্রুপ করে, নিত্যনতুন প্রশ্নাদি তুলে হয়রানি করে। অপবাদ ও অপপ্রচারের তাণ্ডব তোলে এবং গোয়েন্দাগিরি করে। কখনো কখনো মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ বাধাবার চেষ্টা করে, তাদেরকে কাফের ও ফাসেক বলে ফতোয়া দেয়, রসূল সা. কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে এবং যুদ্ধ ও আপদকালীন অবস্থায় ভয়ংকর ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা করে। ইসলামের ক্ষতি সাধনে তারা সাধ্যমত কোন কিছুই করতে বাদ রাখেনি। কিন্তু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তারা একটা মারাত্মক ভুল ধারণায় পতিত থাকে। নাশকতামূলক কার্যকলাপে লিপ্ত নেতিবাচক স্বভাবের লোকেরা চিরকালই এ ধরনের ভুল ধারণায় পতিত হয়ে থাকে। (কিন্তু পরবর্তীকালের লোকেরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণও করেনা।) তাদের ভুল ধারণাটা ছিল এই যে, যারা কোন নীতি ও আদর্শের ধার ধারেনা, কোন গঠনমূলক কর্মসূচী রাখেনা এবং নৈতিক অধোপতনের সবর্নিম্ন স্তরে নেমে যায়, তারা যে কোন আদর্শবাদী ও গঠনমূলক আন্দোলনকে প্রতিহত করতে পারে। আসলে তাদের ভূমিকা এ রকম, যেমন উঠতি সূর্যের আলোক রশ্মির প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে চামচিকেরা শূণ্যে পাখনা মেলে কৃত্রিম অন্ধকার সৃষ্টির ব্যর্থ চেষ্টা চালায়, সশস্ত্র সেনাবাহিনীর গতিরোধ করার জন্য যেমন কিছু মশামাছি ভনভন করে, কিংবা পূর্ণিমার চাঁদ দেখে যেমন কোন গোঁয়ার তার দিকে থুথু নিক্ষেপ করে।
যাদের নিজস্ব কোন মূল্য নেই, যাদের কাছে কোন প্রাণবন্ত আদর্শ নেই, যাদের স্বভাব চরিত্রে সমকালীন মানব সমাজের জন্য কোন আদর্শ নেই এবং যাদের কাছ থেকে মানব জাতির কোন গঠনমূলক সেবা পাওয়ার কোন আশা নেই, তারা নিছক অন্যদের গতি রোধ করে নিজেদের জন্য কোন স্থায়ী সাফল্য আনতে পারেনা। যাদের কাছে স্থবিরতা, কর্মবিমুখতা, গোঁড়ামি, বিকৃতি ও নাশকতা ছাড়া অন্য কোন উপকরণ নেই, তারা সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক কাজে নিয়োজিত একটা কর্মচঞ্চল দলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আর যাই হোক, নিজেদের মধ্যে কোন মূল্য ও মর্যাদা সৃষ্টি করতে পারেনা। শেষ পর্যন্ত এ ধরনের লোকদের কপালে ব্যর্থতা ও অপমান ছাড়া আর কিছুই জোটেনা। কিন্তু যখন কোন বিকারগ্রস্ত জনগোষ্ঠী আবেগপ্রসূত প্রতিক্রিয়ার গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে বিবেচনা শক্তি হারিয়ে ফেলে, তখন সে আর পরিণাম নিয়ে ভাবেনা। শুধুই সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। বিকারগ্রস্ত ইহুদী সম্প্রদায়ও হীনমন্যতা ও হিংসার চোটে অন্ধ হয়ে ইসলামের সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়।
মদিনার মুসলমানদের চরিত্রের সাথে ইহুদীদের চরিত্রের তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে এও বুঝা যায় যে, সত্য ও ন্যায়ের পতাকাবাহীদের ডাকে যারা সাড়া দেয়, তাদের চরিত্র যতটা উন্নত মানের হয়ে থাকে, তাদের বিরোধিতাকারিদের চরিত্রেও ঠিক ততই অধোপতন ঘটে। ইতিবাচক আন্দোলন মানবতাকে যত সুষমামণ্ডিত করে, নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তাঁকে ততটাই বিকৃত ও বিনষ্ট করতে উদ্যত হয়।
ইসলামী সমাজের পরিচালকের সামনে একদিকে অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী গঠনমূলক পরিকল্পনা ছিল। অপরদিকে অব্যাহতভাবে আগমনরত শরণার্থীদের পুনবার্সন ও তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা দানের সমস্যা ছিল। উপরন্তু মক্কার কোরায়েশদের পক্ষ থেকে প্রতিমূহুর্তে আক্রমনের আশংকাও ছিল এবং তা প্রতিরোধের জন্য টেকসই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য ছিল। আর এই সমস্ত সমস্যাগুলোর ওপর বাড়তি আর একটা মারাত্মক সমস্যা এই ছিল যে, মদিনার নবগঠিত রাষ্ট্র ও বিকাশমান সমাজের অভ্যন্তরে কুচক্রী ও বিশ্বাসঘাতক গৃহশত্রু বিভীষণদের একটা বৃহৎ গোষ্ঠী নানা রকমের বিভ্রান্তিকর ও বিভেদাত্মক তৎপরতা চালাচ্ছিল। ভেবে দেখা দরকার যে, এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বনবীর দায়দায়িত্ব কত নাজুক ও জটিল হয়ে থাকতে পারে। ঐ একটি মাত্র মস্তিষ্ক দিনরাত কত রকমের সমস্যার ভাবনায় ছিল তা বোধ হয় আমাদের আমাদের পক্ষে চিন্তা করাও কষ্টকর। আমরা হয়তো ভেবেও কূল কিনারা পাবোনা যে, ক্ষুদ্র একটি ইসলামী সংগঠন এবং একেবারে প্রাথমিক পর্যায় অতিক্রমরত আন্দোলন কত বড় প্রাণান্তকর পরিস্থিতিতে পড়েছিল। আর এই যাবতীয় জতিলতা সৃষ্টির দায়ভার ইতিহাসে একমাত্র ইহুদীদের ঘাড়েই চাপানো হয়েছে। এ দায়ভার যথার্থই আল্লাহকে মান্যকারী, হযরত ইবরাহীম আ. ও হযরত মূসা আ.-এর ভক্ত, তাওরাতের অনুগত এবং পবিত্রতা, আধ্যাত্মিকতা, আল্লাহর জ্ঞান ও খোদাভীরুতার স্বগত ঠিকাদার ইহুদী সম্প্রদায়ের ওপরই বর্তায়।
শুরুতে ইহুদীরা রসূল সা. ও ইসলামের প্রতি অত্যন্ত আশান্বিত ছিল। তারা দেখতে পাচ্ছিল যে, এই নব আবির্ভূত ধর্মের অনুসারীরা হযরত ইসমাঈলের বংশধরদের সাথে (অর্থাৎ কোরায়েশদের সাথে-অনুবাদক) দ্বন্দ্বে লিপ্ত, ইহুদীরা যেসব নবীর ভক্ত তারাও তাদেরকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে, তাদের কিতাবকেও তারা ভক্তি করে এবং তাদের কেবলা অর্থাৎ বাইতুল মাকদাসকে নিজেদের কেবলা হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ কারণে তাদের ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে, ধীরে ধীরে মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সহচর বৃন্দকে ইহুদী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া যাবে। ইহুদীরা ন্যায় ও সত্যের দৃষ্টিতে এ কথা ভাবছিল না, বরং এটা ছিল তাদের নির্ভেজাল ও বাণিজ্যিক ভাবনা। তারা ভেবেছিল, এই বাস্তুভিটে চ্যুত সবর্হারা লোকদেরকে তারা অচিরেই নিজেদের অনুগত বানাতে পারবে। এই আশায়ই তারা মুসলমানদের সাথে তেমন কোন বাদানুবাদ ছাড়াই চুক্তি সম্পাদন করে এবং মদিনায় যে রাজনৈতিক সংগঠনটা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছিল, তাকে মেনে নেয়। তাদের ধারণা ছিল যে, এই বিকাশমান রাজনৈতিক শক্তি তো আমাদের পকেটেই রয়েছে। আমাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রতাপ তাদের চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। সত্য ও ন্যায়কে উপলব্ধি করা, চিন্তা ও চরিত্রের সংশোধন করা কিংবা পরকালে মুক্তির ব্যবস্থা করার কোন উদ্যোগ, চেষ্টা বা চিন্তা চেতনা ইহুদীদের ছিলনা। নিছক একটা গোষ্ঠী স্বার্থ এই হতভাগাদের মাথায় সওয়ার ছিল। তারা মনে করতো মদিনায় তাদের দোরগোড়ায় শিকার এসে জড় হচ্ছে। তাই তারা ফাঁদ ও জাল পেতে শিকার ধরার জন্য ওৎ পেতে বসেছিল। তাদের দৃষ্টিতে মুসলমানরা ছিল সাগর থেকে কিনারের দিকে ভেসে আসা মাছের ঝাঁক। আর সেগুলোকে ধর্মীয় ভণ্ডামির জালে আটকানোর জন্য ইহুদী জেলেরা সমস্ত প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত হয়ে তীরে এসে বসে ছিল। কিন্তু অল্প কিছু দিনের অভিজ্ঞতাতেই তাদের আকাশ কুসুম কল্পনা ভেস্তে যেতে লাগলো। মুসলমানরা তাদের বুঝিয়ে দিল যে, তারা এত সহজ শিকার নয়। তারা এমন মজবুত শক্তি যে, শিকারী স্বয়ং তাদের হাতে শিকারে পরিণত হয়। তারা দেখতে পেল যে, ক্রমান্বয়ে একটা বিপ্লবী মেজাজের ইসলামী রাষ্ট্র বিকাশ লাভ করতে যাচ্ছে। এই রাষ্ট্র স্বয়ং একটা দূর্গের মত শক্তিশালী হতে লাগলো। ইহুদীরা মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝে ফেলল যে, সাংবিধানিক চুক্তির মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের পত্তনে তারাও অংশ নিয়েছে, সে রাষ্ট্রটা তাদের হাতের পুতুল হওয়া তো দূরের কথা, তার কোথাও তাদের আংগুল ঢুকানোরও অবকাশ নেই। ঐ রাষ্ট্রে তারা যে মোড়ল সুলভ আসন লাভ করার স্বপ্ন দেখেছিল, সে ব্যাপারে অচিরেই তারা চরমভাবে ব্যর্থ হলো। ঐ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও তৎপরতায় প্রভাব বিস্তারের যে চেষ্টা তারা করেছিল তাতে তারা বারবার ব্যর্থ হলো। ঐ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি, অন্যান্য কর্মকর্তা ও তার মূলনীতিতে আস্থাশীল নাগরিকগণকে নিজেদের বাগে আনতে তারা যতগুলো ষড়যন্ত্র করেছিল, তার সবই নস্যাত হয়ে গেল। বরঞ্চ প্রাথমিক পর্যায়েই এমন বিপত্তি ঘটলো যে, তাদের লোকেরাই রসূল সা. এর পেশ করা মূলনীতির সামনে আত্মসমর্পণ করতে লাগলো। এই ‘বিপজ্জনক’ বৈপ্লবিক স্রোত কেবল নিরক্ষর সাধারণ ইহুদীদেরকে নয়, বরং বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এরপরই তারা সম্বিত ফিরে পেল। তারা বুঝতে পারলো যে, তাদের আধ্যাত্মিকতার রমরমা ব্যবসা লাটে উঠতে চলেছে। তাদের সাধের শিকারগুলো একে একে হাতছাড়া হতে চলেছে। ইহুদীরা তাদের সম্পাদিত চুক্তির সবর্নাশা ফল দেখে আঁতকে উঠলো। এই চুক্তির আলোকে একদিকে তারা মুসলিম রাষ্ট্রের আইনের আনুগত্য করতে ছিল বাধ্য। অপরদিকে মুসলমানদের সাথে প্রতিরক্ষামূলক মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে রেখেছিল। তৃতীয় দিকে তারা দেখতে পাচ্ছিল, যে আশায় তারা এসব করেছিল, তা সবই মরিচীকায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে।
তাই এ কারণে ভেতরে ভেতরে তাদের মধ্যে চরম বিদ্বেষাত্মক লাভা পুঞ্জীভূত হতে লাগলো এবং থেকে থেকে সেই লাভা তাদের সমাজদেহ থেকে উদ্গীরণ করা হতে লাগলো। বিশেষত, কেবলা পরিবর্তনের ঘটনায় তো ইহুদী সমাজের প্রতিহিংসার মনোভাব নগ্নভাবে প্রকাশ পেল। প্রথমে তা অপপ্রচারে রূপ ধারণ করলো। তারপর তা পরিণত হলো নাশকতামূলক তৎপরতায়। সবর্শেষে তা বিশ্বাসঘাতকতার আকারে আত্মপ্রকাশ করলো। আসুন, মাদানী যুগে এই মনোভাবের প্রতিক্রিয়া থেকে সৃষ্ট সেই ইসলাম বিরোধী তৎপরতার পর্যালোচনা করা যাক, যা মানবতার শ্রেষ্ঠতম শুভাকাংখী ও তার সাথীরা ভোগ করেছিলেন এবং যা থেকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে ইসলামী রাষ্ট্রকে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
অসহিষ্ণু আচরণ
মদিনার সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে যেসব গুরুদায়িত্ব বহন করতে হচ্ছিল, তার আলোকে ঐ রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভূমিকাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত যারা প্রথম কাতারের কর্মী ছিল, তাদের কোন একজনের অভাবও রসূল সা. এবং তাঁর সাথীদের জন্য মর্মঘাতী ছিল। বনু নাজ্জার গোত্রের কাছে ইসলাম প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত আবু উমামা আসয়াদ বিন যারারা ঠিক এ ধরনেরই একজন কর্মী ছিলেন। কিন্তু একেবারে প্রাথমিক যুগেই তিনি ইন্তিকাল করেন। ফলে ইসলামের একজন সুযোগ্য সৈনিকের অভাব ঘটলো। এ ঘটনা রসূল সা. এর জন্য এমনিতেই মর্মঘাতী ঘটনা ছিল। তদুপরি মদিনার ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের মাধ্যমে তাঁর এই মনোকষ্টকে দ্বিগুন করে তুললো। ইহুদী ও তাদের তল্পীবাহক মোনাফেকরা বলে বেড়াতে লাগলো যে, “দেখলে তো! মুহাম্মাদ সা. যদি সত্যি সত্যি নবী হতো, তাহলে তাঁর এমন সক্রিয় কর্মী এমন অসময়ে মারা যেত নাকি?” অর্থাৎ কিনা, তাঁর মৃত্যুতে তাদের উল্লাসের অবধি রইল না। চারদিক থেকে প্রতিনিয়ত দুঃখ দুবির্পাকের আঘাতে জর্জরিত স্বয়ং রসূল সা. এর সংবেদনশীল মনও পর্যন্ত এ অপপ্রচারে নীরব থাকতে পারেনি। তিনি বললেনঃ “আবু উমামার মৃত্যুটা ইহুদী ও আরবের মোনাফেকদের জন্য নিদারুণ মৃত্যু! ওরা বলে বেড়াচ্ছে যে, মুহাম্মাদ সা. যদি নবী হতো, তাহলে তার সাথী মরতোনা। অথচ আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি নিজেও রক্ষা পেতে পারিনা, আমার কোন সাথীকেও রক্ষা করতে পারিনা।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)
এই ক্ষুদ্র ঘটনা থেকেই বুঝা যায় যে, শত্রুদের মনে কত আক্রোশ পুঞ্জীভূত ছিল। বনু নাজ্জার গোত্রের লোকেরা এসে রসূল সা. কে বলল, “এখন আমাদের জন্য আর একজন দায়িত্বশীল নিয়োগ করে দিন।” বনু নাজ্জার যেহেতু রসূল সা. এর আত্মীয় ছিল, তাই তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য রসূল সা. বললেন, “তোমরা আমার মাতুল, আমি তোমাদের সব কিছুর সাথে আছি এবং আমিই তোমাদের দায়িত্বশীল।”
যে সব শর্তের ভিত্তিতে ইহুদীরা চুক্তিতে সই করেছিল, তাঁর কারণে তারা ইসলামী আন্দোলনের উন্নতি ও বিস্তার লাভে বাধা দিতে পারছিলনা। তাদের চোখের সামনে সাধারণ মানুষ ও তাদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হচ্ছিল। অথচ তাদের আধ্যাত্মিক নেতারা, পীর দরবেশরা ও মুফতিরা নীরব দর্শক হয়ে তা দেখছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাদের ঘরে ঘরেও ইসলাম প্রবেশ করা শুরু করেছিল। তাদের নিজেদের লোকেরা, বিশেষত গণ্যমান্য লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকায় ধর্মব্যবসায়ী মানসিকতার অধিকারী এই সম্প্রদায়ের ধৈর্যের বাঁধ না টুটে গত্যন্তর ছিলনা। তাছাড়া প্রত্যেক বিপ্লবী আন্দোলনের প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা এত অপ্রতিরোধ্য হয়ে থাকে যে, নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে যারা তার প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে, তাদের মোকাবিলা করার জন্য তাদের পরিবারের নবীনরাই ঐ বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে থাকে। ফলে ছেলে বাপের সাথে, বউরা শাশুড়ীর সাথে, মেয়েরা মায়ের সাথে, পৌত্রেরা দাদা নানার সাথে এবং দাসেরা মনিবের সাথে বিরোধে লিপ্ত হয়ে থাকে।
প্রবীণদের ধর্মাচার যখন নবীন আন্দোলনের এই অভ্যন্তরীণ আক্রমণের শিকার হয়, তখন প্রবীণরা ক্রোধে বেসামাল হয়ে যায়। এ পর্যায়ে এসে তাদের ধৈর্যসহিষ্ণুতা একেবারেই ফুরিয়ে যায়। ইতিহাস মদিনায়ও তার এই চিরচারিত রীতির পুনরাবৃত্তি করলো। আমি আগেই বলেছি মদিনায় কত জোরেশোরে ইসলামের বিজয় পতাকা উত্তীর্ণ হচ্ছিল এবং কত দ্রুত গতিতে ঘরে ঘরে নতুন আদর্শের বিজয় ডংকা বাজছিল। এই অকল্পনীয় পরিবর্তন ঘটতে দেখে ইহুদীরা আক্রোশে অধীর হয়ে উঠছিল। বিশেষত যখন বিভিন্ন গোত্রের সরদাররা এবং খ্যাতনামা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ইসলামের সত্য দাওয়াতে সাড়া দিত, তখন হিংসা ও হীনমন্যতার প্রভাবে সমগ্র ইহুদী সমাজের দেহ শিউরে উঠতো। উদাহরণ স্বরূপ তাদের চোখের সামনেই যেদিন আবু কায়েস আবি আনাস ইসলাম গ্রহণ করলো, সেদিন ইহুদীদের মন যে উত্তেজনায় কি তোলপাড় হয়েছিল, তা বোধকরি ভাষায় ব্যক্ত করার সাধ্য কারোই ছিলনা। ইনি একজন নামকরা প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন। জাহেলী যুগেই তিনি সমাজের প্রচলিত ধারার বিপরীত দিকে চলতে শুরু করেছিলেন। শুধুমাত্র স্বভাবসুলভ প্রজ্ঞা ও বিবেকের তাগিদে তিনি মূর্তিপূজা ছেড়ে দেন, স্ত্রী সহবাসে পর গোসল করা জরুরী সাব্যস্ত করেন এবং ঋতুবতী স্ত্রীদের কাছ থেকে দূরে থাকেন। প্রথমে খৃষ্ট ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হন, কিন্তু সহসাই থেমে যান। নিজ গৃহে মসজিদ বানিয়ে নেন এবং তাতে অপবিত্র অবস্থায় প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকেন। তিনি প্রকাশ্যে বলতেন, আমি ইবরাহীম আ. এর খোদার এবাদত করি। বার্ধক্য পীড়িত এই ব্যক্তি হক কথা বলায় খুবই সাহসী ছিলেন। তিনি জাহেলী যুগে আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতেন। তিনি কবিতার মাধ্যমে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেন। তাঁর কিছু কবিতা ইতিহাস ও সীরাত গ্রন্থাবলীতে সংকলিত আছে। এ ধরনের তীক্ষ্ণ মেধাবী ও সৎ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি যে সমাজে বিশিষ্ট গণ্যমান্য হিসাবে চিহ্নিত হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।
বিচিত্র নয় যে, ইহুদীরা তার সাথে তর্কবিতর্ক করে থাকবে এবং নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা করে থাকবে। কিন্তু তাঁর নির্মল ও বিকারমুক্ত স্বভাব প্রকৃতি তাঁর মধ্যে সত্য দ্বীনের যে চাহিদা ও রুচি সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তা স্বয়ং রসূল সা. ছাড়া আর কারো পক্ষে পূরণ করা সম্ভব ছিলনা। রসূল সা. যখন মদিনায় পৌঁছলেন, তখন তাঁর সৌভাগ্যের মূহুর্তটি ঘনিয়ে এল। তিনি ইসলামী আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন এবং ইসলামের বাস্তব অনুসারীতে পরিণত হলেন। এ ঘটনায় ইহুদীদের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে, সেটা কল্পনা শক্তি প্রয়োগ করে কিছুটা আঁচ করা সম্ভব।
তবে এ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে, তাদের নিজস্ব সামাজিক গণ্ডির বাইরেই হয়েছে। আসল তোলপাড় সৃষ্টিকারী ঘটনা তখনই ঘটলো যখন ইসলাম খোদ ইহুদী সমাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। তন্মধ্যে যে ঘটনাটা ইহুদী সম্প্রদায়ের মানসিক ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে দেয়, তা ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মতাত্মিকের মানসিক বিপ্লব। ইতিহাস সাক্ষী যে, শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, তা সে দুনিয়াদারী কিংবা দ্বীনদারী যে দিককারই হোক না কেন, তাদের মধ্যে সত্য গ্রহণের আনুপাতিক হার খুবই কম হয়ে থাকে। তবে সৎ স্বভাব সম্পন্ন লোকেরা অবশ্যই সকল মহলে বর্তমান থাকে। সত্যের সূর্য দীপ্তি ছড়ানোর সময় তারা চোখ বুজে একগুঁয়েমি ও বিদ্বেষ পরায়ণতার বদ্ধ কুঠুরিতে গিয়ে আত্মগোপন করেনা। বরং উজ্জ্বল আলোক রশ্মি প্রবেশের জন্য মন মগজের বাতায়ন খুলে দেয়। গণ্যমান্য ও জ্ঞানী গুণীদের কাতার থেকে যদিও খুব কম লোকেরই সমাগম ঘটে থাকে ইসলামী বিপ্লবী আন্দোলনে, কিন্তু যারা আসে তারা খুবই মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকে। কেননা তাদেরকে স্বার্থ ও পদ মর্যাদার বড় বড় শেকল ভেংগে আসতে হয়। ইহুদী সমাজে এ ধরনেরই এক অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন সালাম। তাঁর প্রাগৈসলামিক নাম ছিল হাসীন। তিনি একজন উঁচুদরের আলেম ও খোদাভীরু ধর্মীয় নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন বনু কাইনুকা গোত্রের লোক। রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাতের পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নিজের পরিবার পরিজনকেও ইসলামে দাওয়াত দেন ও উদ্বুদ্ধ করেন। শেষ পর্যন্ত গোটা পরিবারই ইসলাম গ্রহণ করে। তাঁর এক আত্মীয় তাঁর কাছ থেকে শুনে তাঁর ইসলাম গ্রহণের যে কাহিনী বর্ণনা করেছেন, তা শুনুনঃ “আমি যখন আল্লাহর বার্তাবাহকের আগমনের খবর প্রথম শুনলাম, তখন তাঁর নাম, গুণবৈশিষ্ট ও আগমনের দিনক্ষণ জেনে নিলাম। কেননা আমরা তাঁর প্রতীক্ষায় ছিলাম। তাই এই খবরটা শুনে মনে মনে আনন্দিত হচ্ছিলাম। কিন্তু মুখে কিছু বলছিলাম না। তিনি যখন মদিনায় চলে এলেন, তখন পর্যন্ত আমি চুপচাপ ছিলাম। যখন তিনি কোবায় বনু আমর ইবনে আওফের বসতিতে পৌঁছলেন, তখন একটা লোক এসে আমাকে তাঁর আগমন বার্তা শোনালো। এ সময় আমি আমার খেজুর গাছের মাথার ওপর চড়ে কাজ করছিলাম। আমার ফুফু খালেদা বিনতে হারেস নিচে বসা ছিলেন। আমি আগমন বার্তা শোনামাত্র উচ্চস্বরে আল্লাহু আকবর ধ্বনি তুললাম। ফুফু আমার ধ্বনি শুনে বললেন, “আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করে দিক! হযরত মূসা বিন ইমরানের আগমনের খবর শুনলেও তুই এমন উল্লাস প্রকাশ করতিনা।” আমি বললাম, “ফুফুজান! আল্লাহর কসম, ইনি মূসা বিন ইমরানের ভাই এবং তাঁরই ধর্ম পালনকারী। মূসা বিন ইমরান যে বিধান এনেছিলেন, ইনিও তাই নিয়ে এসেছেন।” ফুফু বললেন, “হে আমার ভাতিজা, যে নবীর কথা আমাদেরকে বলা হয় যে, কেয়ামতের আগে আসবেন, ইনি কি সেই নবী?” আমি বললাম, “হাঁ, ইনিই তো সেই নবী।” এরপর আমি আল্লাহর নবীর সান্নিধ্যে পৌঁছলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করলাম। তারপর নিজের পরিবার পরিজনের কাছে এলাম এবং তাদেরকেও দাওয়াত দিলাম। ফলে তারা সবাইও ইসলাম গ্রহণ করলো। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)
এই নওমুসলিম আলেম যেহেতু ইহুদীদের দুবর্লতাগুলো জানতেন এবং তাদের বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা ও নিকৃষ্ট চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন, তাই তাঁর ইসলাম গ্রহণে কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হবে, তাও জানতেন। স্বার্থপরতার ভিত্তিতে যখন দল ও গোষ্ঠী গঠিত হয়, তখন চরিত্রের এত অধোপতন ঘটে থাকে যে, ভালোকে ভালো ও মন্দকে মন্দ বলার পরিবর্তে নিজেদের মন্দকে ভালো এবং প্রতিপক্ষের ভালোকে মন্দ বলা হয়। নিজের গোয়ালের গরু কালো হলেও তাকে সাদা এবং অন্যের গোয়ালের গরু সাদা হলেও তাকে কালো বলা হয়। এমনকি নিজের গোয়ালের সাদা গরু গোয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ামাত্রই কালো বলে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। সকল যুগেই এ ধরনের ধর্মচারীদের চরিত্র একই রকম হয়ে থাকে। যতক্ষণ কোন ব্যক্তি তাদের সাথে থাকে অথবা অন্তত পক্ষে এই তার সম্পর্কে এই আশংকা জন্মেনা যে তার তৎপরতা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, ততক্ষণ তার গুণাবলী খোলামনে স্বীকার করা হয়। বরং কখনো অতিরঞ্জিত করে ঢালাওভাবে তার বিদ্যা ও চরিত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়। কিন্তু সময়ের কিছু পরিবর্তনের সাথে সাথে এ ধরনের কোন মহান ব্যক্তিত্বের ভূমিকা কারো ধর্মব্যবসায়ের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হলে তৎক্ষণাত মতামত পালতে যায়। আগে যিনি আলেম ছিলেন এখন তাকে মূর্খ বলা হয়। আগে যিনি মুমিন ছিলেন, এখন তাকে বলা হয় কাফের, ফাসেক এবং আরো অনেক কিছু। আগে যে ব্যক্তি জাতির সেবক বলে গণ্য হতো, এখন তাকে বলা হয় বিপথগামী। আগে যে ব্যক্তি ভক্তিশ্রদ্ধার পাত্র ছিল, এখন সে হয়ে যায় গালাগালের শিকার। বিকৃত স্বভাবের অধিকারী ইহুদী জাতির চরিত্রের এইসব হীনতা ও নীচতা আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের জানা ছিল। তিনি এই হীনতা ও নীচতার ওপর থেকে আবরণ তুলে ফেললেন। মনে মনে একটা নাটকের পরিকল্পনা করে নিজের ইসলামের গ্রহণের বিষয়টা গোপন রেখেছিলেন। উপযুক্ত সময় রসূল সা. এর কাছে হাজির হয়ে বললেন, ইহুদীরা একটা বাতিলপন্থী জাতি। তাদের বিকারগ্রস্ত স্বভাবের মুখোশ খুলে ফেলার জন্য আপনি আমাকে আপনার গৃহে পর্দার আড়ালে বসিয়ে রাখুন। তারপর তাদের চোখের আড়ালে রেখে আমার সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাইবেন। তারপর দেখবেন, আমার ইসলাম গ্রহণের কথা নাজানা অবস্থায় তারা আমার সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে। তারা যদি আমার ইসলাম গ্রহণের খবর জেনে ফেলে, তাহলে আমার ওপর অপবাদ আরোপ করবে ও দোষ বদনাম করবে। রসূল সা. অবিকল তাই করলেন। আব্দুল্লাহ বিন সালামকে তাঁর ঘরে পর্দার আড়ালে বসিয়ে রাখলেন। এদিকে ইহুদী নেতারা এলো এবং আলাপ আলোচনা চললো। তারা নানা প্রশ্ন করলো এবং তাঁর জবাব দেয়া হলো। সবর্শেষ রসূল সা. জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যকার হাসীন বিন সালাম কেমন লোক? তারা বলল, ‘উনি আমাদের সরদার এবং সরদারের ছেলে। উনি আমাদের একজন মহৎ ব্যক্তি এবং একজন বড় আলেম। এভাবে তারা গুণকীর্তন করার পর আব্দুল্লাহ বিন সালাম পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন এবং তাদেরকে সম্বধন করে বললেন, “ হে ইহুদী সম্প্রদায়, আল্লাহকে ভয় করো এবং যে ধর্ম মুহাম্মাদ সা. নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহর কসম, তোমরা ভালোভাবেই জান যে, ইনি আল্লাহর প্রেরিত রসূল। তোমরা মুহাম্মাদ সা. এর পবিত্র নাম ও গুণাবলী তাওরাতে লিখিত দেখে থাক। তাই আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর রসূল। তাঁর ওপর ঈমান আনছি, তাঁকে সত্য বলে জানি এবং স্বীকার করছি।” ইহুদীরা এই নাটকে যারপর নাই বিব্রত হলো এবং তৎক্ষণাত বলল, “তুমি মিথ্যুক।” এরপর আব্দুল্লাহ বিন সালামের নিন্দাবাদ ও কুৎসা রটানো শুরু করে দিল। এক্ষুনি কয়েক সেকেন্ড আগে যাকে মহান ব্যক্তি ও আলেম বলে আখ্যায়িত করেছে, তাকেই মিথ্যুক বলতে শুরু করে দিল। আব্দুল্লাহ রসূল সা. কে বললেন, “আমি আপনাকে বলেছিলাম না যে, এরা একটি বাতিলপন্থী সম্প্রদায়। এরা অহংকার, মিথ্যাচার ও অসদাচারের দোষে দুষ্ট।” এভাবে একটা নাটকীয় পদ্ধতিতে আব্দুল্লাহ বিন সালাম নিজের গোটা পরিবারের ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলেন। এ ঘটনায় ইহুদীদের মনমগজে কি সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে ভেবে দেখুন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, ১৩৮-১৩৯ পৃঃ)
এর অল্প কিছুদিন পর ওহুদ যুদ্ধের দিন প্রখ্যাত আলেম ও সম্মানিত ব্যক্তি মুখাইরিকের বেলায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটে। ইনি ইহুদীদের মধ্যে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর ছিল অনেকগুলো খেজুরের বাগান। তিনি নিজের জ্ঞানের আলোকে রসূল সা. এর গুণাবলী দেখে তাঁকে চিনে ফেলেছিলেন। ঘটনাক্রমে ওহুদের দিন এসে গেল এবং তা ছিল শনিবার। একটা মজলিশে তিনি বললেন, “হে ইহুদী জনমণ্ডলী, আল্লাহর কসম তোমরা জান যে, মুহাম্মাদ সা. এর সাহায্য করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য।” তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, মক্কার মোশরেকদের মোকাবিলায় মুসলমানদের দলকে সাহায্য করা তোমাদের ওপর নীতিগতভাবে ফরয। এর জবাবে ইহুদীরা যা বললো তা তাদের ধাপ্পাবাজি ও খল মানসিকতারই ঘৃণ্য ছবি তুলে ধরে। তারা বললো, “আজ তো শনিবার।” এ জবাব শুনে মুখাইরিক তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বললেন, “তোমাদের জন্য কোন শনিবার নেই।” অতঃপর তিনি অস্ত্র হাতে নিয়ে ওহুদের ময়দানে গিয়ে রসূল সা. এর সাথে মিলিত হলেন। যাওয়ার সময় নিজের পরিবার পরিজনদের সাথে দেখা করে বলে গেলেন, আমি যদি আজ নিহত হই, তবে আমার সমস্ত ধন সম্পদ রসূল সা. এর হাতে সমর্পন করবো। তিনি আল্লাহর নির্দেশে যেভাবে ভালো মনে করেন, তা খরচ করবেন। সত্যিই এই ত্যাগী সৈনিকটি ঐদিন মারা গেলেন। রসূল সা. তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি গ্রহণ ব্যয় করেন। তবে মুখাইরিক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন কিনা, সে সম্পর্কে কিছুটা মতভেদ আছে।
ইসলামী আন্দোলনের এই বিজয়াভিযানে ইহুদীদের ভণ্ডামি যে গোপন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে, তা একটা মজার ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উম্মুল মুমিনীন হযরত সফিয়া বিনতে হুয়াই বিন আখতার বর্ণনা করেন, আমি আমার বাবা (ইহুদী সরদার হুয়াই) ও চাচার কাছে অন্য সব সন্তানের চেয়ে বেশী প্রিয় ছিলাম। তারা উভয়ে সব সময় আমাকে সাথে সাথে রাখতেন। রসূল সা. যখন মদিনায় এসে কোবায় অবস্থান করতে লাগলেন, তখন আমার বাবা হুয়াই বিন আখতার ও চাচা ইয়াসার বিন আখতার খুব ভোরে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলেন। সূর্যাস্তের সময় ফিরে এলেন। মনে হলো, তারা খুবই ক্লান্ত ও অবসন্ন। তারা খুব ধীর গতিতে চলছিলেন। আমি অভ্যাস মত মুচকি হেসে তাদের সামনে গেলাম। কিন্তু ক্লান্তির কারণে তারা আমার দিকে ভ্রুক্ষেপই করলো না। আমার চাচা আবু ইয়াসার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হে, ইনিই কি সেই (প্রতিশ্রুত নবী) ব্যক্তি?” বাবা বললেন, “হাঁ, আল্লাহর কসম।” চাচা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি তাঁকে চিনে ফেলেছ? তুমি কি নিশ্চিত?” বাবা বললেন, হাঁ। চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “এখন তাঁর সম্পর্কে তোমার মনোভাব কি?” বাবা বললেন, “শুধুই শত্রুতা। যতদিন বেঁচে আছি, খোদার কসম, শত্রুতাই করে যাবো।”
এই ছিল ইহুদীদের আসল মানসিকতা। তারা খুব ভালো করেই জানতো যে, তাদের কাছে যিনি এসেছেন তিনি সত্যের আহ্বায়ক এবং নবী। তাঁর প্রতিটি কথা তার সত্যতার সাক্ষ্য বহন করছে। তাঁর সমগ্র চরিত্র তাঁর মর্যাদাকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। তাঁর চেহারা তাঁর নবুয়তের লক্ষণ প্রতিফলিত করছে। তারা শুধু জানতো ও বুঝতো তা নয়, বরং গোপন বৈঠকে তা মুখ দিয়ে স্বীকারও করতো। কিন্তু ঈমান ও আনুগত্যের পথ অবলম্বন না করে তারা বিরোধিতা ও শত্রুতার জন্য কৃতসংকল্প হতো। এটাই ছিল ইহুদীদের চিরাচরিত স্বভাব। সূর্য উঠলে যে আলোর বান ডাকে তা কে না জানে। মানুষ ও জীবজন্তুর চোখ আছে, তাই তারা এ দৃশ্য দেখতে পায়। কিন্তু যে ঘাসপাতার চোখ নেই, তারাও টের পায় যে, প্রত্যেক অন্ধকার রাতের শেষে যে ঘটনা প্রতিদিন ঘটে থাকে, তা ঘটে গেছে। এমনকি তাপ, উষ্ণতা, মাটির নিষ্প্রাণ কণাগুলো, পানির ফোঁটাগুলো এবং বাতাসের ঝাপটাগুলোও জেনে ফেলে যে, আলোর বার্তাবাহক আবির্ভূত হয়েছে। সূর্যোদয় এমন এক বিপ্লবাত্মক ঘটনা যে, চামচিকে ও বোবা পর্যন্ত তা জেনে ফেলে। কিন্তু তাদের স্বভাবের বক্রতা এই যে, রোদ ওঠার পর আর সব জীব জানোয়ারের চোখ খুলে যায়, কিন্তু পেঁচা ও চামচিকের চোখ বন্ধ হয়ে যায়। উপরন্তু তাদের জন্য সূর্যোদয়ের আলামতই হয়ে থাকে সূর্য রশ্মিতে তাদের চোখ ঝলসে যাওয়া ও বুজে যাওয়া। মানুষ এত অন্ধ হতে পারেনা যে, তাঁর সামনে আল্লাহর নবীগণ অলৌকিক পর্যায়ের জ্ঞান ও চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হবেন এবং সে অনুভবই করবেনা যে, কোন অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ও মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে। এসব লোক দেখে, জানে, বোঝে এবং এ সব কিছুর পরও চোখ বন্ধ করে রাখে। তারপরও যদি আলো চোখের ভিতর প্রবেশ করে, তবে চোখের ওপর পত্তি বেঁধে নেয়; হাত দিয়ে ঢেকে নেয়, মুখ বালুতে লুকায়, কক্ষের দরজা জানালা বন্ধ করে তাঁর ওপর কালো পর্দা ফেলে দেয়। প্রবাদ আছে যে, ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগানো যায়, কিন্তু জাগ্রত ব্যক্তিকে জাগানো যায়না। অনুরূপভাবে, অজ্ঞ লোককে জ্ঞান দান করা যায়। কিন্তু যে ব্যক্তি জেনেও না জানার ভান করে, তাকে অজ্ঞতার জগত থেকে বের করে আনা সম্ভব নয়। ইহুদী জাতির অধিকাংশ এবং তাদের বড় বড় আলেমদের এই অবস্থাই হয়েছিল। কোরআনও তাদের এই বিকৃতির উল্লেখ করে বলেছে যে, ********
“অর্থাৎ তারা নিজের সন্তানদেরকে যেমন নিশ্চিতভাবে জানে ও চেনে, রসূল সা. কেও ঠিক তেমনি জানে ও চেনে।”
ইহুদী নেতারা রসূল সা. এর উচ্চ মর্যাদা ও সাধারণ মানুষরা তাঁর নতুন দাওয়াতের প্রতি ধাবমান হতে দেখে হিংসায় জ্বলতে থাকতো এবং তাদের হৃদয়ের জগতে ঘোরতর অসহিষ্ণুতা সংকীর্ণতা কেবল বৃদ্ধিই পেত।
কুতর্ক ও বাজে প্রশ্নের বাণ
বিকারগ্রস্ত ভণ্ড ধার্মিকদের মনে যখন কোন সক্রিয় দাওয়াত, কোন বিকাশমান আন্দোলন ও কোন মহান দাওয়াতদাতার বিরুদ্ধে বিদ্বেষ জন্মে যায় এবং ক্রমান্বয়ে তা জোরদার হয়, তখন তারা বুঝ সৃষ্টিকারী আলাপ-আলোচনার দ্বার রুদ্ধ করে বিতর্কের পথ খুলে দেয়। বিতর্কের মাধ্যমে যে সব প্রশ্ন ও সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করা হয়, তা কখনো কোন কথা বুঝার উদ্দেশ্যে নয় বরং না বুঝার উদ্দেশ্যেই করা হয়। অন্য কথায়, ‘আমি মানবোনা’ এটাই হয়ে থাকে তাদের বিতর্কের প্রেরণার উৎস। কিন্তু বিতর্কের উদ্দেশ্য কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং এর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে সরলমতি জনসাধারণকে সত্যানুসন্ধানের স্বাভাবিক পথ হটিয়ে দিয়ে সন্দেহ সংশয়ের কবলে নিক্ষেপ করা, যাতে তারা সহজ সরল যুক্তি থেকে দূরে সরে গিয়ে জটিল তাত্বিক প্রশ্নের ফাঁদে আটকা পড়ে যায় এবং দাওয়াতের যৌক্তিক মূল্য ও নৈতিক প্রভাব যাচাই করার পরিবর্তে পেঁচালো সমস্যাবলীর কানাগলিতে ঘুরপাক খেতে থাকে। ভণ্ড আলেমরা নিজেদের সম্পর্কে তো পুরোপুরি আস্থাশীল থাকে যে, ইসলামী আন্দোলন তাদেরকে কখনো নিঃশেষ করতে পারবেনা। তাদের আশংকা থাকে সাধারণ মানুষদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া নিয়ে। তাই তাদেরকে তাদের সমর্থনের উপর বহাল রাখার জন্যে তারা বাঁকা বাঁকা প্রশ্নের বেড়ি তৈরী করে থাকে। ইহুদী ভণ্ড আলেমরাও এই কারসাজিতেই লিপ্ত ছিল।
আব্দুল্লাহ ইবনে সালামের ইসলামী আন্দোলনে শামিল হয়ে যাওয়ার পর ইহুদীরা সবার্ত্মকভাবে মনোযোগ দিল বিতর্ক সৃষ্টির দিকে। বাঁকা ও জটিল বাহাসের তীর নিক্ষেপ করতে লাগলো ইসলামী আন্দোলনের উপর। কিন্তু এই ন্যাক্কারজনক যুদ্ধের তৎপরতাও প্রকাশ্য ঘাঁটি থেকে নয়, বরং মোনাফেকদের গোপন ঘাঁটি থেকে চালু করা হলো। খোদাভীরুতার জমকালো পোশাকে আবৃত বহুরূপী লোকেরা ইসলামী আন্দোলনের সম্মেলনগুলোতে যোগদান করতো এবং কথা প্রসংগে অত্যন্ত সরল ও নিরীহ গোবেচারার ভাব দেখিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে হরেক রকমের প্রশ্ন তুলতো।
এক বৈঠকে তারা রসূল সা. এর কাছে প্রশ্ন রাখলোঃ আল্লাহ যখন গোটা সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করেছেন, তখন আল্লাহ তায়ালাকে কে সৃষ্টি করেছে? দেখলেন তো মনের বক্রতা? ইহুদীরা আল্লাহর ওপর ঈমান রাখে বলে দাবী করতো। তারা তাঁর নবীদের ওপর বিশ্বাসী এবং তাঁর কিতাবসমূহের নিশানবাহী ছিল। আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে তারা আগে থেকেই ওয়াকিফহাল ছিল। অথচ ইসলাম যখন সেই আল্লাহর দিকেই আহ্বান জানালো, তখন আল্লাহ সম্পর্কে তাদের মনে খুবই জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়ে গেল। তাদের প্রশ্ন থেকে বাহ্যত মনে হতো যে, এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেলেই তাদের জন্য সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ খুলে যাবে। কিন্তু প্রশ্নের বক্রতা থেকে বুঝা যাচ্ছিল, হেদায়াত লাভ করা তাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং মানুষকে হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য পালাবার পথ দেখানোই প্রকৃত উদ্দেশ্য। রসূল সা. এই বাঁকা প্রশ্নের জবাব খুবই সোজাভাবে দিলেন। অর্থাৎ খুবই সহজ সরল পন্থায় সূরা ইখলাস পড়ে শুনিয়ে দিলেনঃ “(হে মুহাম্মাদ) বল, আল্লাহ এক। তিনি অভাবশূন্য। তিনি কারো সন্তান নন এবং তাঁরও কোন সন্তান নেই। কেউ তাঁর সমকক্ষ হতে পারে না।” (হায়াতে মুহাম্মদঃ মুহাম্মদ হোসেন মিশরী)
আসুন, আপনাকে আর একটা মজার মজলিশে নিয়ে যাই। ইহুদীদের কতিপয় নামকরা আলেম একবার রসূলের সা. বৈঠকে এলো এবং বললো, “আমাদের চারটে প্রশ্নের জবাব দিন। তাহলে আমরা আপনার দাওয়াতকে গ্রহণ করবো এবং আপনার আনুগত্য করবো।” রসূল সা. বললেন, “তোমাদের প্রতিশ্রুতির দায়দায়িত্ব তোমাদের ওপরই থাকলো, কী প্রশ্ন করতে চাও কর।” প্রশ্নগুলো সামনে আসার আগে পাঠক নিজেই একটু ভাবুন তো যে, ইসলামী আন্দোলনের যথার্থ রূপ অনুধাবন করার জন্য বুদ্ধিমান লোকদের পক্ষ থেকে কী ধরনের প্রশ্নের আশা করা উচিত। তাদের উচিত ছিল মৌলিক তত্ত্ব সমূহ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা, ইসলামের নৈতিক মূল্যবোধ সমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি জানতে চাওয়া। মুসলমান হতে হলে কী কী করা উচিত জিজ্ঞাসা করা। কিন্তু এসব জিনিসের প্রতি তাদের কোন আকর্ষণই ছিলনা। তারা নিজেদের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার বাহাদুরি জাহির করার জন্য একে একে নিম্নের প্রশ্নগুলো তুলে ধরলোঃ
১-শিশুরা পিতার বীর্য দ্বারা তৈরী হওয়া সত্বেও দেখতে মায়ের মত হয় কেন?
২-রসুল সা. এর ঘুম কেমন হয়?
৩-ইসরাঈল (এয়াকুব আলাইহিস্ সালাম) কোন্ কোন্ জিনিসকে নিজের জন্যে হারাম করে নিয়েছিলেন এবং কেন?
ইসলামী আন্দোলন সঠিক কিনা তা যাচাই করার জন্যই নাকি এ প্রশ্নগুলো তোলা হয়েছিল। কেবল চতুর্থ প্রশ্নটার কিছুনা কিছু সম্পর্ক সরাসরি ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের সাথে ছিল। কিন্তু এরও প্রকৃতি একই ছিল। চতুর্থ প্রশ্নটা ছিলঃ রূহ কি?
রসূল সা. শান্তভাবে প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিলেন। শেষ প্রশ্নের জবাবে বললেন, তোমরা ভালো করেই জান যে, রূহ হচ্ছে জিবরীল এবং তিনিই আমার কাছে আসেন।
পাঠক হয়তো আশা করছিলেন যে, এই জবাবগুলো পাওয়ার পর তারা তাদের হৃদয়কে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। না, কখখনো নয়। রসূল সা. এর শেষ কথাটা শুনে তারা বললো, “কিন্তু হে মুহাম্মাদ সা., জিবরীল তো আমাদের শত্রু। সে যখনই আসে, আমাদের জন্য খুব খারাবীর বার্তা নিয়ে আসে।” এ কথার অর্থ এই যে, জিবরীল যখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে আল্লাহর দ্বীনের পতাকাবাহী হবার দাবী নিয়ে আসেন, তখনই একটা দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে, নানা রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়, এমনকি পরিস্থিতি জেহাদ পর্যন্ত গড়ায়। তাঁর সাথে আমাদের বনিবনা নেই। এই ফেরেশতার শত্রুতা যদি বাধা হয়ে না দাঁড়াত, তাহলে আমরা নির্ঘাত আপনার সহযোগী হয়ে যেতাম এবং আপনার অনুকরণ ও অনুসরণ করতাম। অর্থাৎ কিনা, দাওয়াত, আন্দোলন এবং বার্তা- সবই সঠিক। কিন্তু এর পটভূমিতে আল্লাহ যে ফেরেশতাকে জড়িত করেছেন, তাতেই আমাদের নিরাপত্তা বিনষ্ট হয়ে গেছে। কাজেই ঐ জিবরীল যেখানে আছে, সেখানে আমরা আসতে পারিনা।
রসূল সা. কোরআনের ভাষায় এর এমন জবাব দিলেন, যারা তা শুনেছে, তারা কখনো তা ভুলতে পারবেনা। তিনি বললেন, “বল, (হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে ব্যক্তি জিবরীলের শত্রু হবে, সে যেন জেনে রাখে, কোরআনকে আল্লাহ নিজের আদেশের আওতায় তোমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে নাযিল করেছেন। এই কোরআন পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থসমূহের সমর্থন করে এবং মুমিনদের জন্য (শত্রুতা, বিপদমুসিবত বা খুনখারাবীর বার্তা নয় বরং) হেদায়াত ও সুসংবাদবাহী। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)
আরো একটা বিতর্কের সূত্রপাত হলো, রসূল সা. কোন এক প্রসঙ্গে নবীদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে হযরত সোলায়মান আ. এর বিষয়টা উত্থাপন করলেন। এ নিয়ে ইহুদী মহলে অনেক কথা হলো। বলা হতে লাগলো, মুহাম্মাদ সা. এর আশ্চার্য কথা শুনেছ? সে বলে যে, দাউদের ছেলে সোলায়মানও নাকি নবী ছিল। আরে, আল্লাহর কসম, সে তো নিছক একজন যাদুকর ছিল (নাউযুবিল্লাহ)। কোরআন তাদের এইসব প্রলাপোক্তি খণ্ডন করে বলেছে, যাদু তো কুফরি। হযরত সোলায়মান কুফরীতে লিপ্ত হননি। ব্যাবিলনের কূয়া সম্পর্কে যে কাহিনী প্রচলিত আছে, সেতো কেবল শয়তানের কারসাজি। (সীরাতে ইবনে হিশাম)