বিদায় হে মক্কা!
অস্থিতিশীল নিমজ্জমান সমাজ ব্যবস্থার শেষ অস্ত্র হয়ে থাকে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও নির্যাতন নিপীড়ন। এতেও যদি প্রতিপক্ষকে দমন করা সম্ভব না হয়, তাহলে সংস্কার বিরোধীরা বিপ্লবী আন্দোলনের মূল নায়ককে হত্যা করতে কৃত সংকল্প হয়। মক্কাবাসীতো আগে থেকেই আক্রোশে অধীর ছিল এবং তাঁকে খতম করে দিতেই উৎসুক ছিল। কিন্তু পেরে ওঠেনি। এবার চরম মহুর্ত উপস্থিত। দ্বন্দ্ব সংঘাত একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। একটা হেস্তনেস্ত হওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছিল। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি ছাঁটাই বাছাই হয়ে পরস্পর থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে গেছে। আকীদা বিশ্বাস ও মনমানসিকতার দিক দিয়ে একটা সুস্পষ্ট সীমারেখা চিহ্নিত হয়ে গেছে। এক পক্ষ এই সীমারেখার ওপারে রয়ে গেছে, আর এক পক্ষ এপারে। কোন পক্ষেরই আর ঐ সীমারেখা অতিক্রম করার সুযোগ নেই। ইসলামী আন্দোলন এখন একটা সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ শক্তি। এর দলীয় শৃংখলা অটুট এবং চারিত্রিক মান অত্যন্ত উন্নত। এর যুক্তি খুবই ধারালো এবং আবেদন অসাধারণ রকমের চিত্তাকর্ষক। এর নেতা ও কর্মীদের ওপর পরিচালিত যুলুম নিপীড়ন জনগণের হৃদয় জয় করার ক্ষমতা রাখে। সত্যের ক্ষুদ্র চারাগাছটা পরিণত হয়েছে বিশাল মহীরূহে। জাহেলী সমাজের কর্ণধারদের কাছে কালও যে আশংকা ছিল নিছক আনুমানিক, আজ তা বাস্তব। উদ্ভুত উপস্থিতি তাদের কাছে দাবী জানাচ্ছিল যে, এই আশংকাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা যদি তোমাদের থেকে থাকে, তবে প্রতিহত কর। অন্যথায়, নবাগত যুগের যে আলোর সয়লাব আসছে, তাতে তোমাদের ধর্ম, পদ পদবী, জাহেলী ঐতিহ্য-সব কিছুই ভেসে যাবে। তারপর তোমাদের উদ্ধত মস্তককে নোয়াতে হবে মুহাম্মদ ও তাঁর আদর্শের সামনে। জাহেলিয়াতের নেতারা ইতিহাসের এ চ্যালেঞ্জ শুনতে পাচ্ছিলো এবং ক্রমাগত উৎকন্ঠিত হচ্ছিলো। তাই এই পর্যায়ে উপনীত হয়ে রসূল সা. এর রক্তপিপাসু দুশমনেরা তাঁর বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর চক্রান্তের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়।
ইসলামী আন্দোলনের সাথীদের জন্য যে মক্কা জ্বলন্ত চুলোর রূপ ধারণ করেছিল তা এমনিতেও উত্তাপের সর্বোচ্চ মাত্রায় উপনীত হয়েছিল। নির্যাতন ও নিপীড়ন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। কোরায়েশ নরপশুরা তাদের যুলুমের ষ্টীম রোলার চালিয়ে সত্যের নিশানাবাহীদের জীবন দুর্বিষহ করে এবং তাদের ধৈর্যর বাঁধ ভেংগে গিয়েছিল। এর স্পষ্ট অর্থ ছিল এই যে, এ পরিস্থিতিতে কোন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসন্ন, কোন মুক্তির পথ বেরিয়ে আসা অবধারিত এবং ইতিহাসের কোন নতুন অধ্যায় সংযোজন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কোরায়েশ তাদের জন্য এক বিরাট সৌভাগ্যের দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। তারা নিজেদেরকে ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রী হবার অযোগ্য প্রমাণ করেছিল। এহেন মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশে মে’রাজের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর যখন রসূল সা. উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুসংবাদ দিলেন, আভাসে ইংগিতে হিজরতের পথ উন্মুক্ত হওয়ার ও তারপর ক্ষমতার যুগ শুরু হওয়ার আশ্বাস দিলেন, তখন মুসলমানদের মধ্যে নতুন আশা উদ্দীপনা সঞ্চারিত হলো। যারা সহিংসতার স্বীকার হয়েছিল, তারা সান্ত্বনা পেল এবং তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি পেল। তারপর যখন রসূল সা. সেই প্রতিশ্রুত মহুর্তটি ঘনিয়ে আসতে দেখলেন তখন তার আবেগ ও অনুভূতি তুংগে উঠলো। তিনি গায়েবী সূত্র থেকে বুঝতে পারলেন যে, ভবিষ্যতের সেই হিজরতের স্থান হবে মদিনা। একদিকে পরিস্থিতির সুস্পষ্ট সাক্ষ্য, বিশেষতঃ আকাবার বায়য়াতের দুটো ঘটনা, অপর দিকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত তথ্য থেকে এটা জানা যাচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে রসূল সা. তাঁর সাথীদের মদিনা চলে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলেন এবং সাহাবীগণ একের পর এক চলে যেতে লাগলেন। ক্রমান্বয়ে অনেকেই চলে গেল। মহল্লার পর মহল্লা খালি হয়ে গেল। একবার আবু জাহল অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কোরায়েশ নেতা বনু জাহশ গোত্রের শূন্য বাড়ীঘর দেখে মন্তব্য করলোঃ
‘এটা আমাদের ভাতিজার(মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কীর্তি। সে আমাদের ঐক্য ভেঙ্গে দিয়েছে। আমাদের সমাজকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। আমাদের পরস্পরের মধ্যে ভাংগন লাগিয়ে দিয়েছে।’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃঃ ১১৪) সাথীদেরকে মদিনা পাঠানো সত্ত্বেও রসূল সা. নিজ দাওয়াতের কেন্দ্রভূমি ত্যাগ করেননি। তিনি আল্লাহর অনুমতির অপেক্ষায় ছিলেন। কোরায়শরা আটক করে রেখেছিলেন কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে যেতে বাধা দিয়েছিল, এমন স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি ছাড়া কোন মুসলমানই আর মক্কায় অবশিষ্ট ছিল না। তবে ঘনিষ্ঠ সাথীদের মধ্যে যখন হযরত আবু বকর ও হযরত আলী তখনো মক্কায় ছিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে যখন কোরায়েশরা বুঝতে পারলো যে, মুসলমানরা যখন একটা ঠিকানা পেয়ে গেছে এবং এক এক করে সবাই চলে গেছে, তখন মুহাম্মদ সা. অচিরেই আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। এরপর আমাদের আওতার বাইরে গিয়ে শক্তি অর্জন করবে এবং অতীতের সব কিছুর প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। তখন তারা সবাই মক্কার গণ মিলনস্থল ‘দারুননাদওয়া’তে সমবেত হলো এবং সলাপরামর্শ করতে লাগলো, মুহাম্মদের বিরদ্ধে এখন কী পদক্ষেপ নেয়া যায়। একটা প্রস্তাব এল, তাঁকে কোন লোহার তৈরী হাজতখানায় আটক করা হোক এবং দরজা বন্ধ করে রাখা হোক। এতে আপত্তি তোলা হলো যে, সে এমন এক ব্যক্তি, যার কথা বদ্ধ লোহার ঘর থেকেও বাইরে চলে যাবে। অন্য কোন উপায় খুঁজতে হবে। মজলিসের জনৈক সদস্য প্রস্তাব দিল, তাঁকে মক্কা থেকে বের করে দেয়া হোক। তারপর তার কী পরিণতি হয় তা দিয়ে আমাদের কী কাজ। কিন্তু এ প্রস্তাবেও আপত্তি উঠল। অনেকে বললো, তোমরা কি তার চিত্তাকর্ষক কথাবার্তা খবর রাখ না? সে কেমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, তা কি তোমরা জাননা? এ সব জিনিসই তো তার জনমনে এত ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতারকারণ। এ পদক্ষেপ নিলে তার কবল থেকে তোমরা রেহাই পাবানা। সে আরবদের ওপর সর্বাত্মক প্রভাব বিস্তার করবে এবং নিজের বাগ্মীতার জোরে তাদেরকে স্বমতে দীক্ষিত করে ফেলবে। তারপর সমগ্র আরব জনগণকে সাথে নিয়ে তোমাদের ওপর হামলা চালাবে, ক্ষমতার বাগডোর তোমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেবে এবং তারপর তোমাদের সাথে যেমন খুশী আচরণ করবে। এবার ধুরন্ধর আবু জাহল এক সুচতুর কৌশল উদ্ভাবন করলো। সে বললো, মক্কার প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন শক্তিশালী ও প্রতাপশালী যুবককে বেছে নিয়ে তাদের সবাইকে তলোয়ার দিতে হবে এবং তারা সবাই একযোগে আক্রমন চালিয়ে মুহাম্মদকে সা. হত্যা করবে। এভাবেই আমরা তার খপ্পর থেকে মুক্তি পেতে পারি। এতে মুহাম্মদের খুনের দায়দায়িত্ব ও রক্তপণ সকল গোত্রের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। বনু হাশেম গোত্র একাকী এত সব গোত্রের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারবে না এবং সে সাহস ও করবেনা। ব্যাস, এই কৌশলটাই সবার মনোপুত হয়ে গেল এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে এই ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক সমাপ্ত হলো। এই বৈঠকের সম্পর্কে কোরআন নিম্নরূপ পর্যালোচনা করেছেঃ
“আর সেই সময়টার কথা স্মরণ কর, যখন কাফেররা তোমাকে বন্দী করা, হত্যা করা বহিষ্কার করার ফান্দি আঁটছিল। তারা তাদের পছন্দমত চক্রান্ত আটে, আর আল্লাহ পাল্টা পরিকল্পনা করেন। আল্লাহ সবার চেয়ে দক্ষ পরিকল্পনাকারী।” (সূরা আনফাল-৩০)
রহস্যঘেরা সেই কালো রাত সামনে। দুপুর বেলা রসূল সা. তাঁর প্রিয়তম ও ঘনিষ্ঠতম সহচর হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এর বাড়ীতে গেলেন। গিয়ে গোপনে জানালেন, হিজরতের অনুমতি পেয়ে গেছি। হযরত আবু বকর রা. তার সহযাত্রী হবার অনুমতি চাইলেন। এ অনুমতি তিনি চাওয়ার আগেই পেয়েছিলেন। এ সৌভাগ্য লাভের জন্য আনন্দের আতিশয্যে হযরত আবু বকরের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। তিনি হিজরতের জন্য আগে থেকেই দুটো উটনীকে ভালোভাবে খাইয়ে দাইয়ে মোটাতাজা করে রেখেছিলেন। ঐ উটনী দুটো দেখিয়ে তিনি রসূল সা. কে বললেন, এই দুটোর যেটা আপনার ভালো লাগে হাদিয়া হিসেবে গ্রহণ করুন। কিন্তু রসূল সা অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ‘জায়দা’ নামক উটনীটাকে মূল্য দিয়ে কিনে নিলেন। রাত হলে রসূল সা. আল্লাহর ইংগিতক্রমে নিজের ঘরে ঘুমালেন না। তাঁর অপর প্রিয়তম সাথী হযরত আলীকে আপন বিছানায় নির্ভয়ে ঘুমানোর নির্দেশ দিলেন। সেই সাথে লোকজনের রক্ষিত আমানতগুলো তাঁর কাছে অর্পণ করলেন এবং সকাল বেলা সংশ্লিষ্ট মালিকদের কাছে ফেরত দিতে বললেন। এত উঁচু মানের নৈতিকতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর কটাই বা আছে যে, এক পক্ষ যাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে, সে স্বয়ং হত্যাকারীদের আমানত ফেরত দেয়ার চিন্তায় বিভোর? এর পর রসূল সা. হযরত আবু বকর সিদ্দীকের বাড়ীতে চলে গেলেন। হযরত আসমা বিনতে আবু বকর দ্রুত নিজের কোমরের বেল্ট কেটে দুটো বানালেন এবং একটি দিয়ে খাবারের পুটুলি ও অপরটা দিয়ে পানির মসকের মুখ বাঁধলেন। সত্যের পথের এই দুই অভিযাত্রী রাতের আধারে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
আজ বিশ্বমানবতার সবচেয়ে বড় উপকারী ও শুভাকাংখী বন্ধুর সা. একেবারেই বিনা অপরাধে আপন ঘরবাড়ী থেকে বিতাড়িত হবার দিন। আজ তিনি সেই সব অলিগলিকে বিদায় জানাতে জানাতে যাত্রা করেছেন, যেখানে চলাফেরা করে তিনি বড় হয়েছেন, যার ওপর দিয়ে তিনি সত্যের বাণী সমুন্নত করতে হাজার হাজার বার দাওয়াতী সফর করেছেন, যেখানে তিনি অসংখ্য গালাগাল খেয়েছেন এবং নির্যাতন সয়েছেন। আজ তাঁর হারাম শরীফের পবিত্র আধ্যাত্মিক কেন্দ্র থেকে বিদায় নেয়ার পালা, যেখানে তিনি বহুবার সিজদা করেছেন, বহুবার আপন জাতির কল্যাণ ও সুখশান্তির জন্য দোয়া করেছেন, বহুবার কোরআন পড়েছেন, বহুবার এই চত্তরে ও নিরাপত্তার গ্যারান্টিযুক্ত এই একমাত্র আশ্রয়স্থলেও বিরোধীদের হাতে নিপীড়িত হয়েছেন এবং মর্মঘাতী বোলচাল শুনেছেন। যে শহরে হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আ. এর পবিত্র স্মৃতি ও কীর্তি রক্ষিত এবং যে শহরের আকাশ বাতাস আজও তাঁর দোয়ায় মুখরিত, সেই শহরকে আজ তাঁর শেষ সালাম নিবেদন করতে যাচ্ছেন।
এটা করতে গিয়ে তাঁর হৃদয় যে বিদীর্ণ হয়ে গেছে, কলিজা যে কেটে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে, চোখে যে অশ্রুর বান ডেকেছে, সেতো সম্পুর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও জীবনের লক্ষ্য অর্জনে যেহেতু এ কুরবানীর প্রয়োজন ছিল, তাই শ্রেষ্ঠ মানব এ কুরবানীও দিতে দ্বিধা করলেন না।
আজ মক্কার দেহ থেকে যেন তাঁর প্রাণ বেরিয়ে গেছে। মক্কার বাগানের ফুল থেকে যেন সুগন্ধি হারিয়ে গেছে। এর ঝর্ণা যেন শুকিয়ে গেছে। কারণ তার সমাজের ভেতর থেকে নীতিবান ও চরিত্রবান লোকগুলো বেরিয়ে গেছে।
সত্যের দাওয়াতের চারা গাছটি মক্কার মাটিতেই জন্মেছিল। কিন্তু তার ফল আহরণ করার সৌভাগ্য মক্কাবাসীর কপালে জোটেনি। এ সৌভাগ্য অর্জন করল মদিনাবাসী এবং সারা দুনিয়ার অধিবাসীরা। মক্কাবাসীকে আজ ধাক্কা দিয়ে পিছনে হটিয়ে দেয়া হলো এবং মদিনাবাসীর জন্য সামনের কাতারে জায়গা বানানো হলো। যারা নিজেদেরকে বড় মনে করত, অভিজাত ও কুলীন মনে করত, তাদেরকে নিম্নতর স্তরে নামিয়ে দেয়া হলো। আর যাদেরকে অপেক্ষাকৃত নীচ মনে করা হতো, তাদের জন্যই আজকের দিনে বরাদ্দ হলো উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠতর স্থান।
রসুল সা. শেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মক্কাকে বললেনঃ
“আল্লাহর কসম, তুমি আল্লাহর সবোর্ত্তম ভূখণ্ড এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে সবার্পেক্ষা প্রিয় ভূখণ্ড। আমাকে এখান থেকে জোরপূবর্ক তাড়িয়ে দেয়া না হলে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।” (তিরমিযী)
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সূর পবর্ত গুহায় উপনীত হলেন।
কোন্ পথ ধরে যেতে হবে, সেটা স্বয়ং রাসুল সা. নির্ধারণ করেছিলেন। আব্দুল্লাহ বিন আরিকতকে নির্দিষ্ট মজুরীর ভিত্তিতে পথ প্রদর্শক নিয়োগও তিনিই করলেন। তিনি তিন দিন গুহায় কাটালেন। হযরত আবু বকরের ছেলে আব্দুল্লাহ রাতে মক্কার সমস্ত খবর পৌছাতেন। আমের বিন ফুহাইরা (হযরত আবু বকরের ক্রীতদাস) মেষপাল নিয়ে সারাদিন গুহার আশপাশ দিয়ে চরিয়ে বেড়াতো, আর অন্ধকার হলে গুহার কাছে নিয়ে যেত, যাতে হযরত আবু বকর ও রসূল সা. প্রয়োজনীয় দুধ নিতে পারেন।
এদিকে কোরায়েশরা সারা রাত রসূল সা. এর বাড়ী ঘেরাও করে রাখলো। তাছাড়া পুরো শহরের চতুঃসীমানাও বন্ধ করে রাখা হলো। কিন্তু সহসা যখন তারা জানতে পারলো যে, সেই ইপ্সিত ব্যক্তিটাই হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। রসূল সা. এর বিছানায় আলীকে দেখে তারা গভীর হতাশায় ভেঙ্গে পড়ল এবং তাঁকে অনেক বকাবকি করে গায়ের ঝাল মিটিয়ে চলে গেল। চারদিকে তালাশ করতে লোক পাঠানো হলো। কিন্তু কোন হদিসই মিললোনা। একটা দল অনেক দৌড়ঝাপ করে সূর পবর্তগুহার ঠিক মুখের উপর এসে পড়লো। ভেতর থেকে তাঁদের পা পর্যন্ত দেখা যেতে লাগল। কী সাংঘাতিক নাজুক মূহুর্ত ছিল সেটি, তা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। হযরত আবু বকর এই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন যে, এই লোকগুলো গুহায় ঢুকে পড়লে গোটা ইসলামী আন্দোলন হুমকীর সম্মুখীন হবে। এরূপ মূহুর্তে সাধক মানবীয় স্বভাবপ্রকৃতির অধিকারী কোন মানুষের ভেতর যে ধরণের অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ার কথা, হযরত আবু বকরের মধ্যে সে ধরণেরই অনুভূতি জন্মেছিল। কিন্তু যেহেতু রসূল সা. কে আল্লাহর কিছু প্রতিশ্রুতি দেয়া ছিল, এবং তাঁর পক্ষ থেকে সাহায্য ও নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, তাই তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন যে, আল্লাহ আমাদেরকে নিরাপদে রাখবেন। তথাপি হযরত মূসার কাছে যেমন ওহি যোগে ‘ভয় পেয়োনা’- এই আশ্বাসবাণীটা এসেছিল,তেমনি রসূল সা. এর কাছেও এল। তিনি সাথী আবু বকরকে বললেন “তুমি চিন্তা করোনা, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” তাই দেখা গেল, যারা গর্তের মুখের কাছে এসেছিল, তারা এখান থেকেই ফিরে গেল।
তিন দিন গুহার মধ্যে অবস্থান করার পর রসূল সা. হযরত আবু বকর ও পথ প্রদর্শক আমের বিন ফুহাইরাকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কোরায়েশের গোয়েন্দারা যাতে তাদের পিছু নিতে না পারে, সে জন্য সাধারণ চলাচলের পথ বাদ দিয়ে সমুদ্রোপকূলের দীর্ঘ পথ অবলম্বন করা হয়। এদিকে মক্কায় ঘোষণা করা হয় যে, মুহাম্মদ সা. ও আবু বকর- এই দু’জনের যে কোন একজনকেও কেউ যদি হত্যা অথবা গ্রেফতার করতে পারে, তবে তাকে শত শত উট পুরস্কার দেয়া হবে। অনেকেই খোঁজাখুঁজিতে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। সুরাকা বিন জা’সাম খবর পেল যে, এ ধরণের দু’জনকে উপকূলীয় সড়কে দেখা গেছে। সে একটা বর্শা হাতে ঘোড়া হাঁকিয়ে রওনা হয়ে গেল। কাছাকাছি এসেই সুরাকা যখন ত্বরিত গতিতে ধাওয়া করলো, অমনি তার ঘোড়ার সামনের দু’পা মাটিতে দেবে গেল। সুরাকা দু’তিনবার ব্যর্থ চেষ্টা চালানোর পর ক্ষমা চাইল এবং একটা লিখিত নিরাপত্তানামাও চাইল। এর অর্থ দাঁড়ায়, সে উপলব্ধি করল যে, এই ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে একটা নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। নিরাপত্তানামা লিখে দেয়া হলো। সেই নিরাপত্তানামা মক্কা বিজয়ের দিন কাজে লাগলো। এই সময় রসূল সা. সুরাকাকে এই বলে সুসংবাদও দিলেন যে, ‘হে সুরাকা, তুমি যেদিন ইরানের সম্রাটের কংকন পরবে, সেদিন তোমার কেমন মর্যাদা হবে দেখ।’ হযরত ওমরের খেলাফত যুগে ইরান জয়ের সময় এ ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছিল। এই সময় হযরত যোবায়ের ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে সিরিয়া থেকে আসছিলেন। পথিমধ্যে তিনি রসূল সা. ও আবু বকরের সাথে মিলিত হন এবং উভয়কে সাদা পোশাক হাদিয়া দেন।
এই সফর কালে বারীদা আসলামীও ৭০ জন সাথী সমেত তাঁদের সাথে সাক্ষাত করেন। মূলত তাঁরা পুরস্কারের লোভে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু সামনে আসামাত্রই বারীদার মধ্যে পরিবর্তন এল। পরিচয় গ্রহণের সময়ই যখন রসূল সা. তাকে সুসংবাদ দিলেন যে, “তোমার অংশ নির্ধারিত হয়ে গেছে” (অর্থাৎ তুমিও ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে অবদান রাখবে এটা নির্ধারিত হয়ে গেছে)। তখন বারীদা তাঁর সত্তর জন সাথীসহ ইসলাম গ্রহণ করলো। এরপর বারীদা বললো, ‘রসূল সা. মদিনায় প্রবেশকালে তাঁর সামনে একটা পতাকা থাকা উচিত।’ রসূল সা. সম্মতি দিলেন এবং নিজের পাগড়ি বর্শার মাথায় বেঁধে বারীদার হাতে সমর্পণ করলেন। এই পতাকা উড়িয়ে এই কাফেলা মদিনায় প্রবেশ করলো।
*******
“অবশ্য অবশ্য তোমাদেরকে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করা হবে। আর আহলে কিতাব ও মোশরেক- উভয় গোষ্ঠীর কাছ থেকে তোমাদের অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনতে হবে। এ সব পরীক্ষায় তোমরা অবিচল থাকতে পারলে এবং (নোংরামি থেকে) সংযত থাকলে নিঃসন্দেহে সেটা হবে সাহসিকতাপূর্ণ কীর্তি।” (আল ইমরান, ১৮৬)
*******
‘কোন নবীর প্রতি তাঁর আত্মীয় স্বজনের যতটা অসদাচারী হওয়া সম্ভব, তোমরা ততটাই অসদাচারী ছিলে। তোমরা আমাকে অবিশ্বাস করলে আর অন্যরা আমার সত্যবাদিতার সাক্ষ্য দিল। তোমরা আমাকে মাতৃভূমি থেকে বহিষ্কার করলে, আর অন্যরা আমাকে নিজেদের কাছে ঠাই দিল। তোমরা আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালালে। আর অন্যরা আমার সহযোগিতা করলো।’
– বদরের ময়দানে মোশরেকদের লাশকে সম্বোধন করে দেয়া রসূল সা. এর ভাষণ।