বাণিজ্য কাফেলা ছিল যুদ্ধের অগ্রবর্তী বাহিনী
এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, যুদ্ধের অন্যান্য প্রস্তুতির পাশাপাশি (যার সংবাদ রসূলুল্লাহ সা. তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যেতেন) এই কৌশল অবলম্বনের অর্থ ছিল এইযে, কোরায়েশদের এই বাণিজ্য কাফেলা সামরিক অভিযানেরই অগ্রবর্তী বাহিনী ছিল। অন্য কথায় বলা যায়, এ কাফেলা ইসলামী আন্দোলনের গলা কাটার জন্য সোনার তরবারী যোগাড় করতে বেরিয়েছিল। পরিস্থিতি যখন এমন হয়, তখন আজও পৃথিবীর কোন সুসভ্য সরকারও নিজের সীমান্ত ঘেষা স্থল, নৌ ও আকাশ পথ দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিরাপদে চলাচল করতে দিতে পারেনা। বিমান গুলী করে ভূপাতিত করা হয়, সামুদ্রিক জাহাজকে আটক করা বা টরপেডো দিয়ে ধ্বংস করা হয়, সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়, ডাক চলাচলে বাধা দেয়া হয় এবং বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। শুধু মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের কাছেই এ নজিরবিহীন আবদার কেন করা হয় যে, তার প্রতিপক্ষকে তার বুকে ছুরি চালানোর অবাধ অনুমতি দেয়া উচিত ছিল? তা না দেয়াতে তার প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমকে কেন লুঠতরাজ নাম দেয়া হয়? একথা যখন সবার জানা যে, চুক্তিভিত্তিক মৈত্রী না থাকার কারণে যে সব এলাকা মদিনার আওতাধীন, সে সব এলাকা দিয়েই বাণিজ্যিক পথ গিয়েছে, তখন কোন্ কারণে ইসলামী সরকারের পক্ষে স্বীয় এলাকা দিয়ে শত্রুপক্ষকে চলাচল করতে দেয়া সমীচীন হতো?
মদিনায় এই কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানোর যে আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছিল, তার জন্য সাফাই দেয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। তাকে কোন পর্যায়েই রাজনৈতিক বা প্রতিরক্ষামূলক পাপ মনে করার কোন যৌক্তিকতা নেই। এই কাফেলার ওপর আক্রমণ করার কোন ইচ্ছা যদি মুসলমানদের থেকে থাকে তবে তা ছিল সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত। আবু সুফিয়ানের মনে যদি এ ধরণের আশংকা জন্মে থাকে তবে তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। এরূপ আশংকাযুক্ত পরিবেশে মদিনার কোন একটা পদক্ষেপের কারণে আগে ভাগেই গুজব ছড়িয়ে পড়লো যে, কাফেলার ওপর হামলার প্রস্তুতি চলছে। ওদিকে আবু সুফিয়ান সিরিয়া যাওয়ার সময়ও মদিনার পরিবেশ যাচাই করে গিয়েছিল এবং ফেরার পথে খুবই সন্তর্পণে পা ফেলছিল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর সে যখন অনুভব করলো, রহস্যময় তৎপরতা চলছে এবং বিপদ একেবারেই আসন্ন, তখন সে সামরিক সাহায্য চাওয়ার জন্য মক্কায় দূত পাঠিয়ে দিল এবং কাফেলার পথ পরিবর্তন করলো। দূত মক্কায় পৌঁছে আরবদের বিশেষ ভংগীতে উটের কান কাটলো, নাক চিরলো, উটের পিঠের আসন উল্টে দিল, জামা ছিড়ে ফেললো এবং ঐতিহ্যগত নিয়মে নগ্ন হয়ে চিল্লাতে লাগলোঃ “ওহে, মক্কাবাসী, তোমাদের কাফেলাকে মুহাম্মাদের সা. কবল থেকে বাঁচাতে বেরিয়ে এসো, এত দেরী করোনা যে, তোমাদের পৌঁছার আগেই কাফেলা ধ্বংস হয়ে যায়।” এই পরিচিত নাটুকে পদ্ধতির হাঁকডাক সমগ্র মক্কায় প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি করলো। অল্প সময়ের মধ্যেই এক বিশাল বাহিনী তৈরী হয়ে গেল। এ বাহিনীতে আবু লাহাব ছাড়া সমস্ত প্রবীণ নেতারা সশরীরে উপস্থিত ছিল এবং সবাই ছিল সশস্ত্র। বাহিনির নেতাদের লক্ষ্য শুধু কাফেলাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা ছিলনা, বরং তাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, তারা প্রথম সুযোগেই মুসলিম শক্তিকে নির্মূল করে চিরদিনের মত এ উপদ্রব থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল।
এ সময় মুসলিম শক্তি যদি বিন্দুমাত্র দুর্বলতা দেখাতো, চুপচাপ বসে থাকতো, এবং সামরিক তৎপরতা না চালাতো, তবে তার ফলে কাফেলাকে নিরাপদে মক্কায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তো পেতই, অধিকন্তু কোরায়শী বাহিনীও মদিনার এলাকায় ঢুকে, বাহাদুরী দেখিয়ে নিরাপদে ফিরে যেত। আর এর ফল দাঁড়াতো এই যে, এই নবীন ইসলামী রাষ্ট্রটার প্রভাব প্রতিপত্তি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। মদিনার মোনাফেক ও ইহুদী শক্তির দর্প ও অহংকার আরো বেড়ে যেত, আশেপাশের গোত্রগুলোর চোখে ইসলামী রাষ্ট্রের আর কোন গুরুত্ব থাকতোনা এবং মৈত্রীর সম্প্রসারণ তো দুরের কথা, তার মুষ্টিমেয় সংখ্যক নাগরিকের জান, মাল ও সম্ভ্রম রক্ষা করাই কঠিন হয়ে পড়তো। সংঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত শক্তিকে এমন বহু স্তর অতিক্রম করতে হয় যে, নিজের জনসংখ্যা ও সম্পদের স্বল্পতা এবং কঠিন সমস্যাবলী সত্ত্বেও তাকে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়। এ ধরনের সুযোগ খুব কমই আসে। যখন তা আসে, তখন তার উপযুক্ত সদ্ব্যবহার ও তখনকার দায়িত্ব সাহসিকতার সাথে পালন না করলে, এমন শোচনীয়ভাবে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হতে হয় যে, বহু বছর কেটে গেলেও তার আর প্রতিকার করা যায় না। বরঞ্চ কখনো এমনও হয় যে, সময়ের পেছনে পড়ে গেলে চিরদিনের জন্য গোটা কাজই পণ্ড হয়ে যায়। এ ধরনের ঐতিহাসিক সংঘাতের সময় যখন এসে পড়ে, তখন শুধু সৈনিকের সংখ্যা এবং অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদের পরিমাণ দেখে পদক্ষেপ গ্রহণের ও অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়না। বরং তখন এটাই ভেবে দেখা হয় যে, সময়ের দিক থেকে পেছনে পড়ে গেলে ইতিহাসের প্রবাহ মাথার ওপর দিয়ে গড়িয়ে না যায়। আসলে এরূপ পরিস্থিতিতেই নেতৃত্বের মানও যাঁচাই হয়ে যায়, অনুসারীদেরও যোগ্যতা নির্ণয় হয়ে যায়। মদিনায় এ ধরনেরই একটা ঐতিহাসিক মূহুর্ত এসে পড়েছিল। ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্র যদি পর্যাপ্ত শক্তির অধিকারী হতো, তাহলে কাফেলাকেও নিরাপদে যেতে দেয়া উচিত হতোনা, আর কোরায়েশ বাহিনীকেও উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতে তার কসুর করা সমীচীন হতোনা। কিন্তু একই সাথে এই দুটো কাজ সম্পন্ন করা তার সাধ্যাতীত ছিল। তাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত ছিল এই যে, যে কোন একটাকে পর্যুদস্ত করা চাই্। আল্লাহ চেয়েছিলেন, যুদ্ধ হলে তা যেন এমনভাবে হয় যে, সত্যকে সত্য এবং বাতিলকে বাতিল বলে প্রমাণ করতে পারে এবং কুফরীর মূল উৎপাটিত হয়ে যায়।
রসূল সা. স্বীয় গোয়েন্দা ব্যবস্থা দ্বারা কাফেলা ও বাহিনী উভয়ের গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত হচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ওয়াদিয়ে যাফরানে পরামর্শ সভা ডাকলেন। তিনি সভার সামনে সমগ্র পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরলেন এবং জানতে চাইলেন, মুসলিম বাহিনীর একটা বড় রকমের ঝুঁকি নেয়ার শক্তি ও সাহস আছে কিনা। [আমাদের সময়কার সীরাত লেখকদের মধ্যে এ ব্যাপারে তীব্র মতবিরোধ ঘটেছে যে, রসূল (সা.) মদিনাতেই মোহাজের ও আনসারদের বিশেষ বৈঠক আহবান করে কাফেলাকে বাদ দিয়ে কোরায়েশ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে বেরিয়ে ছিলেন, না মদিনা থেকে বেরুবার সময় কাফেলার উপর আক্রমণ এবং পড়ে ওয়াদিয়ে যাফরানে পৌঁছে যখন জানলেন কাফেলা ভিন্ন পথ ধরে চলে গেছে তখন ওখানেই জরুরী বৈঠক ডেকে কোরায়েশ বাহিনীর সাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেন? এই বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণ হলো প্রাচ্যবিদদের পক্ষ থেকে এই মর্মে ঘৃণ্য অভিযোগ আরোপ যে, মদিনার সরকার (নাউযুবিল্লাহ) লুটতরাজ চালিয়ে অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে সচেষ্ট ছিল। এ জন্য তাফসীর, হাদীস ও ইতিহাস গ্রন্থাবলীর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে গিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, রসূল (সা.) বাহিনী নিয়ে কাফেলাকে আক্রমণ করার জন্য বের হননি, বরং মদিনায় বসেই পরামর্শ করে কোরায়েশ বাহিনীর সাথে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ দৃষ্টিভঙ্গির সর্বপ্রধান প্রবক্তা ছিলেন মাওলানা শিবলী নু’মানী। তিনি মনে করেন কোরআনও তার মতের সমর্থক। অথচ কোরআন, নির্ভরযোগ্য বর্ণনা সমূহ ও ঘটনা প্রবাহ কোনটাই তাঁর মতের সমর্থক নয় এবং যে অভিযোগ থেকে এই বিতর্কের উৎপত্তি, তাও সঠিক নয়। যথাস্থানে আমরা এ আলোচনা সবিস্তারে করবো ইনশাল্লাহ। আসলে দ্বিতীয় দৃষ্টিভংগীটাই সঠিক।] তিনি নিজে সাহস ও হিম্মত রাখতেন যে, যা কিছু শক্তিসামর্থ আছে, তাকে জীবন মরন সংগ্রামে লাগিয়ে দেয়া হোক। তিনি পরামর্শ সভার সামনে দুটো সম্ভাবনাই তুলে ধরলেন যে, একদিকে কোরায়েশ বাহিনী অপরদিকে বাণিজ্যিক কাফেলা রয়েছে। এর যে কোন একটার ওপর আক্রমণ করা হোক। বিরাট সংখ্যক সাহাবী কাফেলার ওপর আক্রমণ প্রস্তাব সমর্থন করলেন। কোরআনের ইংগিত অনুসারে এই দলে এমন কিছু লোক অন্তর্ভুক্ত ছিল, যারা অপেক্ষাকৃত সহজ পথ অবলম্বন করার পক্ষপাতী ছিলেন এবং আর্থিক স্বার্থটা তাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ববহ ছিল। রসূল সা. পুনরায় প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। এর অর্থ ছিল এইযে, তিনি কাফেলার ওপর আক্রমণের পক্ষপাতী ছিলেন না। এই ইংগিতকে বুঝতে পেরে মোহাজেরদের মধ্য থেকে হযরত আবু বকর, হযরত ওমর ও মিকদাদ বিন আমর নিজেদের শর্তহীন সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বললেন, আপনি আল্লাহর নির্দেশক্রমে যেদিকেই পদক্ষেপ নেবেন, আমরা আপনার সাথে থাকবো। আমরা বনী ইসরাঈলের মত এ কথা বলে বসে থাকবোনা যে, তুমি ও তোমার খোদা গিয়ে লড়াই কর, আমরা এখানে বসে রইলাম। রসূল সা. পুনরায় তার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। এর অর্থ ছিল তিনি আনসারদের দৃষ্টিভংগী জানতে চাইছিলেন। আকাবার চুক্তিতে তাদের কাছ থেকে শুধু এই মর্মে অংগীকার নেয়া হয়েছিল যে, মদিনার ওপর আক্রমণ হলে তারা প্রতিহত করবে। তারা রসূল সা. এর সাথে কেবল কাফেলার ওপর আক্রমণের জন্যই বেরিয়েছিল। কিন্তু পরের পরিস্থিতি পুরোদস্তুর যুদ্ধ অনিবার্য করে তুললো। কাজেই তাদের মনোভাব জানা তাঁর প্রয়োজন ছিল। তাঁর এই উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আনসারদের পক্ষ থেকে সা’দ বিন মু’য়ায পরিপূর্ণ ঈমানী আবেগ নিয়ে বললেন, আপনি নিজের মর্জী অনুযায়ী কাজ করুন। আমরা আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত।
শেষ পর্্যন্ত দ্বিতীয় হিজরীর ১২ই রমযান মদিনা রাষ্ট্রের শাসক সা. সশরীরে তিন শতাধিক লড়াকু সৈনিক সাথে নিয়ে (৮৬ মোহাজের, ১৭০ খাজরাজী এবং ৬১ আওসী- মোট ৩১৭ জন, যদিও সাধারনভাবে প্রচলিত সংখ্যা ৩১৩) শহর থেকে বেরুলেন। রসূল সা. এমন বিচক্ষণতার সাথে রওনা হলেন যে, দু’দিকেই আক্রমণ চালানোর ইচ্ছা প্রতীয়মান হয়। এক দৃষ্টি কাফেলার দিকে ছিল, যাতে আবু সুফিয়ান বুঝতে পারে, পথ বিপজ্জনক। অপর দৃষ্টি কোরায়েশ বাহিনীর দিকে ছিল। কিন্তু কাফেলা কোন্ দিকে, বাহিনী কোন্ দিকে এবং উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কতটুকু, তা জানা প্রয়োজন ছিল। উভয়টা একত্রিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা এবং কাফেলা পেছনে থেমে রইল, না সমুদ্রের কিনারের দিকে চলে গেল, তাও জানা যাচ্ছিলনা। অবশেষে সাফরা নামক জায়গায় গিয়ে তিনি বিছবিছ বিন আমর আল জুহানী এবং আদী বিন আর রাগবাকে কাফেলার খোঁজ নিতে বদরের দিকে পাঠালেন। আর নিজে ওয়াদিয়ে যাফরানে উপনীত হলেন। জানা গেলো যে, কাফেলা বদরের পথ ত্যাগ করে সমুদ্র তীরের দীর্ঘ পথ ধরে এগিয়ে গেছে এবং অনেক দূর চলে গেছে। অগত্যা রসূল সা. বদরের দিকে রওনা হলেন।
ওদিকে আবু সুফিয়ান উপকূলীয় এলাকায় পৌছার পর নিজেকে নিরাপদ পেয়ে কোরায়েশী বাহিনীকে বার্তা পাঠালো, আমি ও আমার কাফেলা এখন বিপদমুক্ত। কাজেই তোমরা ফিরে এস। কিন্তু আবু জাহল তখন অন্য রকম স্বপ্নে বিভোর। সে বদরে যেতে ও মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালাতে মরিয়া হয়ে উঠলো। মোহরা ও আদি গোত্রের সরদারদের সাথে করে আনা হয়েছিল কাফেলাকে মুসলমানদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বাঁচাতে। তাই তারা ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে লাগলো। তাদের কথা যখন শোনা হলোনা, তখন তারা নিজেদের লোকজন নিয়ে ফিরে গেল। হাকীম বিন হিযাম এবং উতবা আবু জাহলকে যুদ্ধ থেকে ফেরাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু আবু জাহল তাদের অনুরোধ শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। যারা শান্তির পক্ষে ওকালতি করছিল, তাদেরকে সে প্রচন্ডভাবে গালাগালি করলো এবং সেই সাথে নাখলার ঘটনায় নিহত হাযরামীর ভাই আমেরের ভাবাবেগকে উস্কে দিল। আমের হৈ চৈ করে একটা তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিল। অবশেষে কোরায়েশ বাহিনী বিপুল রণসাজে সজ্জিত হয়ে বদরের ময়দানে এসে উপনীত হলো।
রসূল সাঃ সাহাবীদের পরামর্শে অপেক্ষাকৃত সুবধিাজনক জায়গা দখল করলেন এবং যথোচিত যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বাহিনীকে কিভাবে বিন্যস্ত করা হবে, তা স্থির করলেন। শত্রবাহিনীর সংখ্যা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে গোপন তথ্য সংগ্রহ করলেন। যখন কোরায়েশ বাহিনীর প্রত্যেক যোদ্ধার নামধামসহ পরিচয় জানতে পারেলেন, তখন সাথীদের বলরলন, “মক্কা নিজের কলিজা-গুর্দাগুলোকে তোমাদের সামনে হাজির করেছে।” শত্রুবাহনীর যোদ্ধা সংখ্যা ছিল এক হাজার। এর মধ্যে ছয় শো বর্ম পরিহিত ও একশো সওয়ারী ছিল। তাদের সাথে ছিল অজস্র উট, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ। যোদ্ধাদের মনোরঞ্জন এর জন্য ছিল বহু সংখ্যক মদের মটকা ও গান গাওয়ার জন্য গায়িকার দল। এর মোকাবেলার তিনশোর সামান্য কিছু বেশী সহায় সম্বলহীন লোককে ময়দানে নামিয়ে দেয়া ছিল এক অকল্পনীয় দুঃসাহসিকতা। সামরিক বাহিনী সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও আরো বহু সংখ্যক উপাদান নিয়ে গঠিত হয়ে থাকে। রসূল সা: ভালো করেই জানতেন, তিনি যে সৈনিকদেরকে ‘তিনজনের মোকাবেলায় একজন’ অনুপাতে ময়দানে নামাচ্ছেন, তাদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে নির্যাতিত সুলভ তেজবীর্য, রয়েছে নিজ নিজ মতাদর্শের সত্যতা ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে অবিচল আস্থা এবং তারা সাংগঠনিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় শ্রেষ্ঠতর। তাদের মধ্যে এই চেতনা ছড়িয়ে আছে যে, প্রশ্ন শুধু একটা যুদ্ধে হার জিতের নয়, বরং গোটা আন্দোলন টিকে থাকবে কি ধ্বংস হয়ে যাবে তার। তাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সব কিছুই পূঞ্জীভূত হয়ে গিয়েছিল বদরের ময়দানে। সর্বোপরি, আল্লাহর সাহায্যের ওপর তাদের ছিল অখন্ড বিশ্বাস। এই আল্লাহর সাহায্যই ছিল তাঁদের দৃর্ষ্টিতে আসল নিস্পত্তিকারী শক্তি। তারপর আল্লাহর সাহায্য সম্ভবত একবোরেই আসন্ন হয়ে উঠলো তখন, যখন রসূল সা: অশ্রুভেজা চোখে, সকাতর কন্ঠে ও বেদনাবিধুর ভাষায় দোয়া করলেনঃ
“হে আল্লাহ, এই সেই কোরায়েশ, যারা নিজেদের আভিজাত্যের অহংকারে মাতোয়ারা হয়ে ছুটে আসছে শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, তারা তোমার বান্দাদের তোমার আনুগত্য থেকে ফিরিয়ে রাখবে এবং তোমার রসূলকে মিথ্যুক প্রতিপন্ন করবে। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, সেটা এখন পাঠিয়ে দাও। হে আল্লাহ, কালই ওদেরকে ধ্বংস করে দাও।” তারপর তিনি এ কথাটাও বললেন, “হে আল্লাহ, আজ যদি এই ক’টা প্রাণ খতম হয়ে যায়, তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত আর তোমার এবাদত হবেনা। “ রসূল সাঃ এর মত ব্যক্তিত্ব যখন নিজের আন্দোলনের গোটা পূঁজি ময়দানে হাজির করে এমন মর্মস্পর্শী দোয়া দ্বারা আল্লাহর আরশে করাঘাত করেন তখন ফেরেশতাদের বাহিনী না নেমে কিভাবে পারে? তাই এ পর্যায়ে যথার্থই বিজয়ের সুসংবাদ এসে গেল।
বদরের যুদ্ধের ফলাফল
কালের গোটা ইতিহাস সম্ভবত বদরে ক্ষুদ্র ময়দানে পুঞ্জীভূত হয়ে গিয়েছিল। এই ইতিহাসকে সচলকারী দু’ধরনের শক্তি নিজ নিজ চেতনা ও প্রেরণায় পুরোপুরি উজ্জীবিত হয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। পৈত্রিক ধর্ম, প্রাচীন রসম রেওয়াজ, নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করার জন্যে এক পক্ষের মাথায় খুন চড়ে গিয়েছিল। আর অপর দিকে ছিল দিগন্ত প্রসারী এক আলোর বন্যা, যা মদিনার আকাশ থেকে উদ্ভাসিত নতুন প্রভাতকে মানবতার সমগ্র জীবনক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল এবং যার দৃষ্টিতে জাহেলিয়াতের অন্ধকারের বক্ষ বিদীর্ণ করা ছিল এক পবিত্র কর্তব্য। এ যুদ্ধে পিতাপুত্র, চাচা ভাতিজা, ভাই ভাই, শ্বশুর জামাতা- সবাই রক্তের সম্পর্ককে ভুলে গিয়ে নিজ জীবনাদর্শের রক্ষণাবেক্ষণেল জন্য পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আনসাররা নিজেদেরকে সমগ্র আরবের তীর ও তরবারীর শিকার হতে হবে জেনেও মন প্রাণ দিয়ে রসূল সা: এর সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এটা ছিল এক সুকঠিন পরীক্ষা। রসূলের প্রিয় সাথীগণ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রমাণ করে দিলেন, তারা ইসলামী আন্দোলনের সাচ্চা ও নিঃস্বার্থ পতাকাবাহী। অকল্পনীয় ফলাফলের দিক দিয়ে মানবেতিহাসে এ যুদ্ধের কোন জুড়ি নেই। বলা যেতে পারে, ইতিহাসে এটা ছিল আবাবীলের ঝাঁকের হাতে হস্তিবাহিনীর বিধ্বস্ত হওয়ার আর এক দৃষ্টান্ত। ১৭ই রমযান যুদ্ধ হলো। ইসলামী বাহিনীর ২২ জন বীর যোদ্ধা নিজেদের আদর্শের জন প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, তারা শ্রেষ্ঠতম সত্যের একনিষ্ঠ সাক্ষী। অপর দিকে তারা শত্রুর ৭০ জন যোদ্ধাকে হত্যা করলো এবং নিজেদের কাউকে তাদের হাতে বন্দী হতে না দিয়ে আরো ৭০ জনকে যুদ্ধবন্দী বানালো। তাছাড়া বিপুল পরিমাণ গনীমতের সম্পদও তাদের হস্তগত হলো। উতবা, শায়বা, আবু জাহল, আবুল বুখতারী, যাময়া ইবনুল আসওয়াদ, আস বিন হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, মুনাব্বিহ ইবনুল হুজ্জাজ সহ বহু সংখ্যক নামকরা কোরায়েশ সর্দার মুসলিম মোজাহেদদের তরবারীর গ্রাসে পরিণত হলো। তাদের নেতৃত্বে লড়াইরত শত্রু সৈন্যদের কাতারকে কাতার লন্ডভন্ড হয়ে গেল। প্রকৃত পক্ষে এই প্রথম যুদ্ধেই কোরায়েশদের কোমর ভেঙ্গে গেল এবং তাদের শক্তির গর্ব চূর্ণ হয়ে গেল। এই যুদ্ধের ফলেই ইসলামী আন্দোলন সহসা মাথা উঁচু করে ভবিষ্যতের নতুন জগতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপের যোগ্যতা অজর্ন করলো। এ কারণেই আল কুরআনে বদর যুদ্ধের দিনকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ তথা হক ও বাতিলের ছাঁটাই বাছাইয়ের কষ্টিপাথর বলে আখ্যায়িত করেছে। প্রকৃত পক্ষে এই যুদ্ধই নিষ্পত্তি করে দেয় যে, কোরায়েশদের প্রিয় জাহেলী ব্যবস্থাই টিকে থাকবে এবং টিকে থাকার যোগ্য, না মুহাম্মদ সা: এর উপস্থাপিত ইসলাম টিকে থাকার অধিকারী। এ জন্যই কুরআন তার পর্যালোচনায় বলেছে, ঐ দুই আদর্শের মধ্যে এখন সেই আদর্শেরই টিকে থাকার অধিকার আছে, যার কাছে নিজের টিকে থাকার বৈধতার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। আর জনগণও এ দুটোর যে আদর্শকেই গ্রহণ করতে চায়, প্রমাণের ভিত্তিতে গ্রহণ করবে। তারপর ইচ্ছা করলে ধ্বংসের গভীর গর্তে নিক্ষিপ্ত হবে, আর ইচ্ছা করলে ইসলামের সুউচ্চ মার্গে উন্নীত হবে।
বান্দীদেরকে মাথা পিছু চার হাজার দিরহাম মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। (কোন কোন সরদারের কাছ থেকে আরো বেশী মুক্তিপণ নেয়া হয়।)
এভাবে কোরায়েশকে আড়াই লাখ দিরহামের চেয়েও বেশী অর্থদন্ড দিতে হয়। এই অর্থনৈতিক আঘাত তাদের শক্তিকে আরো অধোপতিত করে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে বদরের এই অপ্রত্যাশিত (কোরায়েশদের দৃষ্টিভংগী অনুসারে) ফলাফলের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল এই যে, আরব গোত্রগুলোর দৃষ্টিতে ইসলামী আন্দোলন ও মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের গুরুত্ব ও মর্যাদা অনেক বেড়ে গেল। এই শক্তি ভবিষ্যতের আশাভরসার কেন্দ্রস্থল রুপে বিবেচিত হবার যোগ্য হয়ে গেল। (এক বণনা অনুসারে) মদিনার কতিপয় ইহুদী গোত্র বদর যুদ্ধের পরই মদিনার সাংবিধানিক চুক্তিতে শরীক হয়েছিল তার আগে নয়। মদিনার বিপুল সংখ্যক অধিবাসী এ যুদ্ধের পর ইসলাম গ্রহণ করে। বদর যুদ্ধের পরই ইসলাম সঠিক অর্থে একটা সর্বস্বীকৃত ও জননন্দিত ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ “স্মরণ কর ঐ সময়টাকে, যখন তোমরা সংখ্যায় ছিলে খুবই কম। পৃথিবীতে তোমাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো এবং তোমরা শংকিত থাকতে যে, লোকেরা তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। তারপর আল্লাহ তোমাদেরকে আশ্রয়স্থল যোগাড় করে দিলেন, নিজের সাহায্য দ্বারা তোমাদেরকে সবল করলেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবিকা দিলেন, যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।” (সূরা আনাফাল-২৬)
এ আয়াত আসলে সকল যুগের ইসলামী আন্দোলনের দুটো প্রধান যুগকে স্পষ্ট করে দিচ্ছে। একটা হলো, সংখ্যার স্বল্পতা, দুর্বলতা ও ভয়ভীতির যুগ। আর অপরটা প্রাবল্য, ক্ষমতা, বিজয়, সাফল্য ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার যুগ। ইসলামে প্রথম যুগটা যেমন স্বাভাবিক ও অনিবার্য, তেমনি দ্বিতীয়টাও স্বাভাবিক ও অবধারিত। এ ধরনের সূচনার যৌক্তিক পরিণতি এটাই। কিন্তু ইসলামের যে ধারণা ব্যাক্তি ও জাতিকে চিরস্থায়ীভাবে প্রথমোক্ত অবস্থায় ফেলে রাখে, তাতেই তো সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত করে এবং ভবিষ্যতের উজ্জ্বল যুগের দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোন পথ উম্মুক্ত করেনা, তা রসূলের সা. শেখানো ইসলাম নয়, বরং তা থেকে বিচ্যুতি ও বিকৃতির কারণেই সে ধারণা সৃষ্টি হয়।
এ পর্যায়ে কাফেরদেরকে উপদেশ সহকারে চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যদি সুস্পষ্ট দিদ্ধান্ত চেয়ে থাক, তবে এই নাও, সে সিদ্ধান্ত তোমাদের সামনে এসে গেছে। এখন ফিরে আস। সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম। আর যদি পুনরায় সেই বোকামী কর, তবে আমিও পুনরায় তোমাদেরকে উচিত শিক্ষা দেব। ………..” (সূরা আনাফাল, ১৯) তারপর মুসলিম জাতিকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে দেখেন শত্রুর কোমরের বাধন খুলে দেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। বরং তাদের হাত অবশ ও অচল করে দিয়ে তবে ক্ষান্ত হও, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধের সূচনা করেছেঃ “এখন তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও, যতক্ষণ ফেতনা ফাসাদ ও অরাজকতা দূর না হয় এবং সবাই একমাত্র আল্লাহর অনুগত না হয়ে যায়।” (আনফাল- ৩৯) অর্থাৎ যুদ্ধের যে আগুন কোরায়েশরা জ্বালিয়েছে, তাকে তখন পুরোপুরি নেভানো ছাড়া দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ পূর্ণতা লাভ করতে পারেনা।
দুটো শক্তির পার্থক্য
বদরের যুদ্ধকে আল্লাহ তায়ালা যে কারণে ‘ইয়াওমূল ফুরকান” তথা ‘হক ও বাতিলের মধ্যে প্রভেদ ও ছাটাই বাছাই করার দিন’ নামে আখ্যায়িত করছেন, যে কারণে বলা হয়েছে, ‘এই নাও, সিদ্ধান্ত এসে গেছে। যে কারণে সুরা আলে-ইমরানে বলা হয়েছে, উভয় বাহিনীর সংঘর্ষে তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, এবং যে কারণে বলা হয়েছে, অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকদের জন্য এতে শিক্ষা রয়েছে’, সেকারণটা আসলে এই যে, এই দুই বাহিনীর সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে বিরাট আদর্শিক ও নৈতিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে গেছে। একটা বাহিনী পার্থিব স্বার্থ ও উদ্দেশ্য, এবং গোত্রীয় ও বংশীয় ভোদাভেদ ভুলে গিয়ে নিছক আল্লাহর পথে মানব জাতির সঠিক কল্যান সাধনের নিমিত্তে প্রাণপণ সংগ্রামে নামে আর অপর বহিনী নিজেদের নেতৃত্বে, আধিপত্য, বংশীয় আভিজাত্য, রাজনৈতিক স্বার্থ ও অন্ধ ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে সামনে অগ্রসর হয়। এ বাহিনী আল্লাহর সামনে বিনীয় সহকারে, নামায রুকু ও সিজদায় মগ্ন থেকে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যে ময়দানে নামে। একটা বাহিনী বিরাট বিরাট ভোজসভা, মদের আসর, গানবাজনার জলসা ও নর্তকীদের নৃত্য ইত্যাদি উপভোগ করতে করতে এগিয়ে আসে। আর অপর বাহিনী ময়দানে আসে সংখ্যার স্বল্পতা, ও অস্ত্রশস্ত্রের অপ্রতুলতার পাশাপাশি ঈমান, ঐক্য, শৃঙ্খলা ও চরিত্রের দিক দিয়ে অধিকতর মজবুত ও শক্তিশালী অবস্থায়। একটা বাহিনী সংখ্যায় বড় এবং সাজসরঞ্জামে শক্তিশালী, কিন্তু নৈতিক শক্তির বিচারে নিতান্ত হীনবল ও অকর্মন্য। এরপর আল্লাহ উভয়ের মধ্যে হারজিতের এত স্পষ্ট ফায়সালা করে দেন যে, অন্ধরাও দেখতে পায়, কোন পক্ষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার যোগ্য আর কোন পক্ষ ফলে ফুলে সুশোভিত হয়ে টিকে থাকার যোগ্য। কয়েকটা ঘটনা লক্ষ্য করলে এ পার্থক্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আবু হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ও আবু হিয়াল নামক দু’জন মুসলিম যুবক এই সময় মক্কা থেকে মদিনায় আসছিলেন। পথিমধ্যে কাফেররা তাদের গতিরোধ করে বলে, আমরা তোমাদের মুহাম্মাদের সা. সাহায্য করতে যেতে দেবনা। তারা যুদ্ধে শরীক না হবার অংগীকার করে অব্যাহতি পান। রসূল সা. এর কাছে এসে পুরো ঘটনা শুনালেন। সংখ্যা স্বল্পতার কারণে মুসলমানদের জন্য এ সময়টা এত নাজুক ছিল যে, একটা পিঁপড়ে সাহায্য পাওয়া গেলে ও মূল্যবান বিবেচিত হতো। তথাপি রসূল সা. সিদ্ধঅন্ত দিলেন যে, তোমরা যে ওয়াদা করে এসেছে, তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে। আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালা নিজেই সাহায্য করবেন। ইতিহাসে এমন গৌরবোজ্জ্বল দুষ্টান্ত ক’টা পাওয়া যাবে?
বদর যুদ্ধে নিহত কোয়ায়েশ নেতাদের লাশ রসূল সা. একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে দাফন করেন। কোন লাশের অবমাননা হতে দেননি।
গণীমত অর্থাৎ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ব্যাপারে প্রচলিত রীতি ছিল এই যে, যার হাতে যা পড়তো, তা তারই হয়ে যেত। এই রীতির কারণে বিজয়ের লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই উচ্ছৃংখলতা, লুটপাট ও হাতাহাতি হতো। কিন্তু কুরআন গণীমতের সম্পদের ব্যাপারে নতুন বিধি জারী করলো। এই বিধির মূল কথা ছিল, গণীমতের সমস্ত জিনিস আল্লাহ ও তাঁর রসূলের। কাজেই এ সম্পদ বন্টন করা ইসলামী সরকারের কাজ। এই নতুন বিধির আলোকে সমস্ত গনীমতের মাল সেনাপতির সামনে স্তুপ করে রাখা হতো। তারপর তা থেকে এক-পঞ্চমাংশ ইসলামী রাষ্টের সামষ্টিক প্রয়োজন পুরণের জন্য রেখে বাকীটুকু সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করা হতো।
জাহেলী ব্যবস্থায়, যুদ্ধবন্দীরা বিজেতা পক্ষের করুণার পাত্র হতো। সাধারণত তাদের ওপর যুলুম নির্যাতন ও অসদাচারণ করা হতো এবং তাদেরকে দাস দাসীতে পরিণত করা হতো। এমনকি আজকের সভ্য যুগেও যুদ্ধ বন্দীদের সাথে পাশবিক আচরণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু রসূল সা. যুদ্ধ বন্দীদের কে নতুন মর্যাদায় অভিষিক্ত করলেন। তাদেরকে আরামে রাখার নির্দেশ দিলেন। কোন কোন সাহাবী এ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে নিজে খেজুর খেয়ে বন্দীদেরকে পেটপুরে উন্নতমানের খাবার খাওয়াতো। হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইরের ভাই বদর যুদ্ধের যুদ্ধবন্দী আবু উমাইর জানিয়েছে যে, যে আনছারীর কাছে আমাকে রাখা হয়েছিল, তারা নিজেরা খেজুর খেয়ে আমাকে ভালো ভালো খাবার খাওয়াতো। এই ব্যবহারে আমি খুবই লজ্জা পেতাম। যে সব বন্দীর কাপড় চোপড় কম থাকতো, তাদেরকে কাপড় দেয়া হতো। হযরত আব্বাস অপেক্ষাকৃত লম্বা আকৃতির লোক হওয়ার কারণে কারো জামা তার গায়ে লাগছিলনা। এ জন্য মোনাফেক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর জন্য নিজের জামা পাঠিয়েছিল। এই অনুগ্রহের বদলা হিসাবেই রসূল সা. আব্দুল্লাহর কাফনের জন্য নিজের জামা দিয়েছিলেন। বন্দীদের মধ্যে সোহায়েল বিন আমরও ছিল। সে রসূল সা. এর বিরুদ্ধে জোরদার ভাষণ দিয়ে বেড়াতো। হযরত ওমর রা. পরামর্শ দিলেন, এ ব্যাটার সামনের দাঁতগুলো ভেঙ্গে দেয়া হোক। যাতে ভবিষ্যতে আর ভাষণ দিতে জোর না পায়। অন্য কেউ হলে নিজের কাছে রক্ষিত একজন অসহায় বন্দীর সাথে যত খারাপ আচরণ সম্ভব হয়, করতে দ্বিধা করতোনা। কিন্তু রসূল সা. বললেন, আমি যদি কারো শরীরের কোন অংশ বিকৃত করি, তাহলে আমি নবী হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ আমার দেহের ঐ অংশ বিকৃত করে শাস্তি দেবেন।
বিজয়ী শক্তি সাধারণত অহংকার মত্ত হয়ে অত্যন্ত অশালীন ও অভদ্র হয়ে যায়। কিন্তু রসূল সা. ও তাঁর সাথীদের মধ্যে তেমন কোন ন্যাক্যারজনক আচরণের হদিস মেলেনা। এমনকি যখন রসূল সা. আবু জাহলের নিহত হওয়ার খবর পেলেন এবং তার মাথা তাঁর সামনে আনা হল, তখন তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন।
বিজয়ী শক্তি যখন মদিনার দিকে মার্চ করলো তখনও না কোন গান বাজনার ব্যবস্থা করা হলো, না মদিনায় পৌঁছে কোন আনন্দোৎসব করা হলো। কেবল সবার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো। এ বিজয় আল্লাহর পুরস্কার- এই অনুভূতির ভিত্তিতেই সবাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
মুসলিম সৈন্যরা যাতে শক্তির নেশায় বিভোর হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের মানসিক ও নৈতিক দুর্বলতা গুলো দূর করতে সচেষ্ট হয়, সে জন্য তাদের সেনাপতি রসূল সা. কুরআনের আয়াতের আলোকে তাদের মনযোগ আকর্ষণ করেন। তাদের সামরিক তৎপরতার ওপর সমালোচনা সুলভ পর্যালোচনা করে অবাঞ্ছিত দিকগুলো তুলে ধরেন। এভাবে তাদের মধ্যে অধিকতর গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক কাজের জন্য উদ্দীপনার সৃষ্টি করা হয়।
সমস্ত সামরিক কর্মকান্ড নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা এখানে সম্ভব নয় জেনেও প্রথম যুদ্ধটার প্রতি একটু বেশী মনোযোগ দিয়েছি। এর উদ্দেশ্য হলো,এদ্বারা পাঠক যেন সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা অর্জন করতে পারে,যা ছাড়া পরবর্তী যুদ্ধগুলো বুঝা সম্ভব নয়। (তথ্যসূত্রঃ তাফহীমুল কুরআন-সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, সূরা আনফালের ভূমিকা ও টীকা,সীরাতুন্নবী,শিবলী নুমানী। আসাহুস সিয়ার। আহদে নববীকে ময়দানহায়ে জং। হাদীসে দেফা)।
বদর যুদ্ধের পর
যদিও বদর যুদ্ধে ইসলামী রাষ্ট্রের একটা ক্ষুদ্র বাহিনী রসূল সা.এর নেতৃত্বে কোরায়েশকে পরাজিত করে একটা সমুচিত শিক্ষা দিয়েছে,কিন্তু সেই সাথে ভবিষ্যতে সংঘাত-সংঘর্ষের একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া অনিবার্য হয়ে উঠল। মক্কার তলোয়ার একবার খাপ থেকে বেরিয়ে আসার পর এবার শান্তি প্রতিষ্ঠার একটামাত্র উপায়ই অবশিষ্ট রইল। সে উপায়টা হলো,এই তলোয়ারকে টুকরো টুকরো করে দিতে হবে এবং এই তলোয়ার উত্তোলনকারী হাতকেও অবশ করে দিতে হবে। আহত শত্রু লেজকাটা সাপের মত প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে থাকে। এ কথা যদিও দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে,কোরায়েশ নেতৃত্ব সদাতৎপর,বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ সরদারদের উপস্থিতি সহসাই শূন্যের কোটায় নেমে গেছে,তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে এবং তাদের দীর্ঘকালের অর্জিত প্রভাব প্রতিপত্তি প্রথমবারের মত উৎখাত হতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু এটাও ইতিহাসের একটা স্বতসিদ্ধ মূলনীতি যে,ধর্মীয়,রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও আধিপত্য যারই হাতে থাকে,সে তা রক্ষা করার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করে। বিশেষত যে সব ব্যক্তি বা শ্রেণী পুরুষানুক্রমিকভাবে সমাজের ওপর আধিপত্য অর্জন করে,তারা তাদের ধড়ে প্রাণ থাকতে এমন কোন শক্তিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ দিতে চায়না,যার বিকাশ বৃদ্ধির ফলে তাদের নেতৃত্বের অবসান অনিবার্য হয়ে ওঠবে। তারা টিকে থাকার জন্য সর্বাত্মক লড়াই করে থাকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। তাই রসূল সা. ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন,বদরের বিজয় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কত বড় দায় দায়িত্ব বহন করে এনেছে। তিনি জানতেন,কোরায়েশ তার সমগ্র ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তিকে,নিজের পুরনো মৈত্রীর বন্ধনগুলোকে এবং নিজের সমগ্র অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েও নিজের এই সামরিক পতাকাকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করবে। যে পতাকা উড়িয়ে সে সর্বপ্রথম মক্কার বাইরে এসেছে,তাকে ভূলুন্ঠিত অবস্থায় রেখে সে মক্কায় গিয়ে শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারেনা। এ পরিস্থিতিতে কার্যত গঠনমূলক ও সংস্কারমূলক কজের আহ্বায়ক এবং সত্য ও ইনসাফের পতাকাবাহীকে গঠনমূলক কাজের পাশাপাশি নিজের ক্ষুদ্র দলটাকে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক ও নিত্য নতুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখতে বাধ্য থাকতে হলো। এ জন্যই বদর যুদ্ধের পর রসূল সা. কে ক্রমাগত সামরিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে হয়। বদর যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর মাত্র সাতদিন পরই রসূল সা.কে একটা সামরিক অভিযানে ‘মাউল কাবার’ নামক স্থানে যেতে হয়। কেননা ওখান থেকে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে,বনু সুলাইম ও বনু গিতফান নামক গোত্র দুটোর কিছু লোক যুদ্ধের উদ্দেশ্যে কিছু শক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছে। কিন্তু প্রতিপক্ষ সামনে এলনা। তিন দিন অবরোধ রাখার পর তিনি ফিরে গেলেন। পরে আবার ঐ লোকদের জড়ো হওয়ার খবর পাওয়া গেল। তাদেরকে দমন করতে গালেব বিন আব্দুল্লাহ একটা সামরিক দল নিয়ে গেলেন। সামান্য কিছু সংঘর্ষ হলো এবং নৈরাজ্যবাদীরা পালিয়ে গেল। রসূল সা.যখন বদরের যুদ্ধ উপলক্ষে মদিনার বাইরে ছিলেন, তখন বনু কাইনুকা চুক্তি ভঙ্গ করে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে বসলো। তাই বলে এত বড় ঘটনাকে উপেক্ষাও করার উপায় ছিলনা। উপেক্ষা করার অর্থ হতো ভবিষ্যতের জন্য মদিনাকে ধ্বংসের সম্মুখীন করা। এ জন্য ২য় হিজরীর শওয়াল মাসে রসূল সা.তাদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি দ্বারা এক ধরনের পুলিশী অভিযান চালালেন এবং তাদের ইচ্ছা অনুসারে শালিশী করানো হলো। সেই শালিশী অনুসারে এই গোষ্ঠীটাকে মদিনার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
বদর যুদ্ধের দু’মাস পর (জিলহজ্জ মাসে) আবু সুফিয়ান দু’শো লোক নিয়ে মদিনা অঞ্চলে এল। সে গোপনে সালাম বিন মুসকামের সাথে সাক্ষাত করে যুদ্ধ বাধাবার ষড়যন্ত্র করতে চাইল। কিন্তু সাফল্যের কোন উপায় না দেখে আরীয নামক স্থানে কিছু গাছগাছালি নষ্ট করে এবং জনৈক আনসারীকে হত্যা করে পালালো। রসূল সা. তার পিছু ধাওয়া করে কারকারাতুল কাযর পর্যন্ত গেলেন। কিন্তু লুটেরার দল পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। পালাতে গিয়ে তারা নিজেদের বোঝা হালকা করার জন্য কিছু ছাতুর বস্তা ফেলে দিয়ে চলে গেল এবং তা মুসলিম বাহিনীর দখলে এল। এ কারণে এই অভিযান ‘গুয়ওয়ায়ে সাওয়ীক’ নামে পরিচিতি হয়ে যায়। জিলহজ্জের বাকী ক’দিন মদিনায় কাটলো। কিন্তু ৩রা হিজরীর মুহাররম মাসে জানা গেল, বনু সালাবা ও বনু মাহারেব হামলা করার জন্য সমবেত হচ্ছে। মাসের শেষে রসূল সা.নাজদে গেলেন এবং প্রায় পুরো সফর মাস ঐ এলাকায় অবস্থান করলেন। শত্রুরা মোকাবিলায় এলনা এবং কোন সংঘর্ষ ছাড়াই তাঁরা ফিরে এলেন। এতদিন অবস্থান করার উদ্দেশ্য ছিল ঐ এলাকায় মৈত্রী সম্পর্কের বিস্তার ঘটানো,যাতে কোরায়েশরা ওদিক দিয়ে বাণিজ্যের পথ না পায়। এ অভিযানকে ‘গুজওয়ায়ে যি আমার’ এবং গুযওয়ায়ে আনমারও বলা হয়ে থাকে।
রবিউস সানী মাসে কোরায়েশদের পক্ষ থেকে আক্রমণের আশংকা দেখা দিল। তাই মদিনায় ইবনে উম্মে মকতুল রা.কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে রসূল সা.সম্ভাব্য হামলা প্রতিহত করতে বুহরান পর্যন্ত পৌঁছলেন এবং জমাদিউল উলা পর্যন্ত সীমান্ত রক্ষার জন্য সামরিক শিবির স্থাপন করে রাখলেন। ওখান থেকেও তিনি কোন সংঘর্ষ ছাড়াই ফিরে এলেন। ৩য় হিজরীতে আবারো কোরায়েশদের একটা বানিজ্যিক কাফেলা বেরুলো। তাদের সম্ভাব্য গমন পথে সতর্কতামূলক সামরিক তৎপরতা চালানো হলো। যায়েদ বিন হারেসা জমাদিউস সানীতে একশো সৈন্য নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন। কাফেলার পথপ্রদর্শক কুরাত বিন হাইয়ান গ্রেফতার হয়ে মুসলিম দলের অন্তর্ভুক্ত হলো। এক লাখ দিরহাম মূল্যের রৌপ্য কাফেলার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হলো।
এভাবে পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ওহুদ যুদ্ধের দিকে গড়ালো।
দ্বিতীয় বৃহত্তম যুদ্ধ ওহুদ
মানবেতিহাসে যখনই দুটো ইতিবাচক ও নেতিবাচক আদর্শিক শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে এবং তাদের একটা মানবজাতিকে কল্যাণ ও উন্নতির পথে নিয়ে যেতে ও অপরটা পূর্ব পুরুষদের অনুসৃত বিধিব্যবস্থা বহাল রাখতে চায়,তখন এ ধরনের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। ওহুদ যুদ্ধে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের যে সংঘর্ষ ঘটে,তাতেও এ ধরনেরই উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল। কোরায়েশরা বদর যুদ্ধে যে সব অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল,তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিটা ছিল তন্মধ্যে খুবই গুরুতর। আড়াই লাখ দিরহামেরও বেশী কেবল বন্দীদের মুক্তিপণ দিতে হয়েছিল। তদুপরি কাফেলার লম্বা রাস্তা ঘুরে আসতেও ব্যয় বেড়ে গিয়েছিল এবং মুনাফার পরিমাণ আগের চেয়েও কম হয়ে গিয়েছিল। উপরন্তু ভবিষ্যতের জন্য ব্যবসায়-বাণিজ্য স্থায়ীভাবে হুমকীর সম্মুখীন হয়ে রইল। কোরায়েশের বাণিজ্যিক কাফেলার কাছ থেকে এক লাখ দিরহামের রৌপ্য মুসলমানরা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল। ভারত ও ইউরোপের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের যা কিছু চলাচল ও মালামাল পরিবহন হতো,তা ইয়েমেন ও মক্কার পথ ধরেই হতো এবং মক্কার কোরায়েশদের পথ ধরেই হতো। আর মক্কার কোরায়েশরা নিজেদের চুক্তিভিত্তিক আচরণ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রহরা ট্যাক্স বসিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতো। তায়েফ ও অন্যান্য এলাকার বাণিজ্যিক আয়ের কথা বাদ দিলেও শুধুমাত্র সিরিয়ার পথ দিয়ে কোরায়েশরা বাৎসরিক আড়াই লাখ আশরাফী আয় করতো। এবার মক্কার আকাশে ভয়াবহ অর্থনৈতিক অচলাবস্থার মেঘ জমে উঠলো। এরূপ পরিস্থিতিতে বদরের প্রতিশোধের ইচ্ছাটা ভেতরে ভেতরে পেকে উঠতে লাগলো।
নতুন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি খুব দ্রুতই শুরু হয়ে গেল। সিরীয় কাফেলার অর্জিত মুনাফা তার কাছ থেকে পুরোপুরি আদায় করে সামরিক তহবিলে জমা দেয়া হলো। আমর জামহী ও মুসাফে’র ন্যায় নামজাদা কবিরা তাদের কবি প্রতিভাকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের আগুন উস্কে দিল। মক্কার মহিলারা তাদের হারানো ভাই ও ছেলের শোকে দিশেহারা হয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা করতে লাগলো। যেমন কেউ কেউ প্রতিজ্ঞা করলো পরবর্তী যুদ্ধে মুসলিম শহীদদের রক্তপান করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কার্যত কোরায়েশ বাহিনীর সাথে বড় বড় অভিযাত পরিবারের বিশিষ্ট মহিলারা রণাঙ্গনের দিকে যাত্রা করতে লাগলো। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলো হিন্দ(উতবার মেয়ে,আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও আমীর মোয়াবীয়ার মা), উম্মে হাকীম(আবু জেহেলের ছেলে ইকরামার স্ত্রী), ফাতেমা(হযরত খালেদের বোন), বারযা(তায়েফের নেতা মাসউদ সাকাফীর মেয়ে, রীতা(আমর ইবনুল আসের স্ত্রী, হান্নাস(হযরত মুসয়াব বিন উমাইরের মা) প্রমুখ।
কোরায়েশগণ নিজেদের স্বেচ্ছাসৈনিকদের প্রস্তুত করা ছাড়াও এবার আহাবীশদেরকেও সাথে নিতে ভুল করলোনা। তাছাড়া আমর ইবনুল আ’স,আব্দুল্লাহ ইবনুয্ যাবয়ারলী, হীরা ইবনে আবি ওহাব, মোসেফ বিন আবদে মানাফ এবং আমর বিন আব্দুল্লাহ জাহমীকে পাঠালো বিভিন্ন আরব গোত্রকে মদিনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য। এভাবে বিপুল শক্তি অর্জিত হয়ে গেল। সাতশো বর্মপরিহিত ও দু’শো অশ্বারোহী সৈনিকসহ তিন হাজার সৈন্যের বাহিনী নিজেই এক ত্রাস সৃষ্টিকারী ছিল। পুরো এক বছর ব্যাপী প্রস্তুতির পর এই বিশাল সামরিক বাহিনী মক্কা থেকে রওনা হলো। তারা মদিনার চারণভূমিতে পৌঁছে নির্দ্বিধায় নিজেদের পশুগুলোকে ঘাসপাতা খাইয়ে মোটা করলো এবং কয়েকদিন রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে বুধবারে ওহুদে গিয়ে শিবির স্থাপন করলো। রসূলের সা.চাচা হযরত আব্বাস আন্তরিকভাবে তাঁর অনুগত ও অনুরক্ত এবং ইসলামী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। শত্রুদের অভ্যন্তরীণ অবস্থার ওপর দৃষ্টি রাখার জন্য তিনি বিশেষ অনুমতিক্রমে মক্কায় অবস্থান করছিলেন। তিনি দ্রুতগামী দূত পাঠিয়ে কোরায়েশদের এসব প্রস্তুতির খবর রসূল সা.কে জানালেন। তদুপরি রসূল সা.নিজস্ব বিশেষ গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ৫ই শওয়াল জানতে পারলেন, কোরায়েশী বাহিনী মদিনার কাছে পৌঁছে গেছে। তিনি এও জানতে পারলেন যে,আরীযের চারণক্ষেত্র তাদের পশুগুলো খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে। উপরন্তু কোরায়েশ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ও তার শক্তি সামর্থ সম্পর্কে সঠিক ধারণা সংক্রান্ত রিপোর্টও তিনি পেয়ে গেলেন। মদিনায় রাতের বেলা প্রহরীর ব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে করা হলো। সকাল বেলা তিনি সাহাবীদের পরামর্শ চাইলেন। অধিকাংশ মোহাজের ও আনসার নেতৃবর্গ শহরে বসেই মোকাবেলা করার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি-এমন যুবকরা উৎসাহ উদ্দিপনার আতিশয্যে শহরের বাইরে যেয়ে যুদ্ধ করার জন্য অধিকতর আগ্রহ প্রকাশ করলো। রসূল সা.উভয় দৃষ্টিভংগী জানার পর বাড়ীতে চলে গেলেন এবং বর্ম পরিধান করে ফিরে এলেন। এ দ্বারা বুঝা গেল যে,তিনি মদিনার বাইরে যেয়ে যুদ্ধ করার প্রস্তাবটাই গ্রহণ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইও মদিনার ভেতরে বসে লড়াই করার পক্ষপাতী ছিল। সবাই এও জানতো যে,তার সাথে কোরায়েশদের যোগসাজশ রয়েছে। দ্বিতীয় বৃহত্তম এই ওহুদ যুদ্ধের আগেই কোরায়েশ তার সাথে দহরম বহরম পাতিয়ে নিয়েছিল। রসূল সা.এ বিষয়টা জানতেন বলেই কোন আলোচনা না করেই দ্বিতীয় দৃষ্টিভংগীটা নীরবে মেনে নিলেন। শুক্রবার জুমুয়ার নামাযের পর তাঁর নেতৃত্বে এক হাজার মুসলমান সৈন্য রওনা হলো। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইও সাথে গেল। তার প্রথম প্রস্তাব বাতিল হওয়ার পর সে একটা দুরভিসন্ধিমূলক প্রস্তাব দিল যে,একটা স্বতন্ত্র যুদ্ধ ফ্রন্ট খোলা হোক। এ প্রস্তাবও যখন রসূল সা. প্রত্যাখ্যান করলেন, তখন এই কুচক্রী হতাশ হয়ে পড়লো। সে শওত নামক স্থান থেকে তিনশো সৈন্য ভাগিয়ে নিয়ে ফিরে চলে গেল। তার অভিযোগ এই ছিল যে,আমাদের কথা যখন মানাই হয়না এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতায় যখন আমাদের কোন অংশই নেই,তখন আমরা কেন যুদ্ধ বিগ্রহ করবো। এই বিশ্বাসঘাতকতা মূলক কাজের প্রভাব অন্যদের ওপরও পড়লো। উদাহরণ স্বরূপ,বনু সালমা ও বনু হারেসা গোত্র ভগ্ন মনে ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু প্রাজ্ঞ মুসলিম নেতারা তাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করলেন এবং তাদের মনোবল বাড়িয়ে দিলেন।
মদিনার বাইরে গিয়ে ময়দানে নামার আগে রসূল সা.সৈন্যদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। একাধিক কিশোরও জেহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধে রওনা হলো। রসূল সা.তাদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তবু এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য তাদের চেষ্টার অবধি ছিলনা। কিশোর রাফে বিন খাদীজ পায়ের পাতার সামনের অংশের ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলো,সে যুদ্ধ করার যোগ্য। আর অপর কিশোর সামুরা কুস্তিতে রাফেকে পরাজিত করে নিজের শক্তি প্রমাণ করলো। একটা নির্মল সততাপূর্ণ পরিবেশে লালিত পালিত হওয়ার কারণে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এমন চারিত্রিক দৃঢ়তা ও প্রাণোৎসর্গের মানসিকতা উঠতে পেরেছিল। মুসলিম নারীদের ওপর যদিও জেহাদ ফরয ছিলনা। কিন্তু আন্দোলনের জন্য অত্যন্ত নাযুক পরিস্থিতি দেখে তাদের মধ্যেও স্বতস্ফূর্ত আবেগের জোয়ার সৃষ্টি হলো। অবশেষে হযরত আয়েশা রা., উম্মে সালীত(হযরত আবু সাঈদ খুদরীর মা), উম্মে সুলাইম(হযরত আনাসের মা)ও উম্মে আম্মারা সহ বেশ কয়েকজন মহিলা মুসলিম বাহিনীর সাথে রওনা হয়ে গেলেন। তারা রণাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। মুসলিম বাহিনীর মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল সাতশো। এদের মধ্যে একশো ছিল বর্মধারী। নিজেদের চেয়ে বারগুণ অধিক সংখ্যক সৈন্য ও সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হতে যাচ্ছিল নিছক ঈমানী শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে।
রসূল সা.ওহুদ পাহাড়টাকে পেছনে রেখে রণাঙ্গনের অত্যন্ত চমৎকার নকশা তৈরী করলেন। মুসায়াব বিন উমাইয়ের হাতে দিলেন ইসলামী পতাকা। যুবাইর বিন আওয়ামকে একটা সেনাদলের সেনাপতি এবং হযরত হামযাকে বর্মহীন সৈন্যদের সেনাপতি নিয়োগ করা হলো। পেছন দিকে আইনাইন পাহাড় (জাবালে রুমাত)এর সুড়ংগে পঞ্চাশজন তীরান্দাজ সৈন্যকে নিযুক্ত করা হলো। এই সৈন্যদের নেতা বানানো হলো আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরকে। কোরায়েশরাও বদরের অভিজ্ঞতার আলোকে মুসলমানদের অনুসৃত সুশৃংখল যুদ্ধের নীতি অবলম্বন করলো। ডানদিকের যোদ্ধা দল (মাইমানা), বামদিকের যোদ্ধাদল (মাইছারা), অশ্বারোহী যোদ্ধা দল ও তীরান্দাজ যোদ্ধাদল প্রত্যেককে আলাদা আলাদা সেনাপতির অধীনে সংঘবদ্ধ করা হলো।
যুদ্ধের সূচনা হিসাবে হিন্দার নেতৃত্বে চৌদ্দ জন কোরায়েশ মহিলা ঢোল বাজিয়ে সামরিক গান গাইতে আরম্ভ করলো। যুদ্ধের উদ্দীপনা সৃষ্টিতে এই গানের সুর কত জোরালো, তা নিম্নের কবিতা থেকেই আঁচ করা যায়ঃ
(আরবী******)
(আরবী******)
“তারকার কণ্যা মোরা,নিপুণ চলার ভংগি,সামনে যদি এগিয়ে যাও জড়িয়ে নেব বুকে,আর যদি হটে যাও পিছে,পৃথক হয়ে যাবো চিরদিনের তরে।” এক পক্ষে চলছিল এরূপ কবিসুলভ প্রণয়োদ্দীপক কামোদ্দীপক সরস সুড়সুড়ি,আর অপর পক্ষে আল্লাহর সন্তোষ কামনা ছাড়া আর ছিলনা কিছুই।
সহসা ময়দানে নামলো আবু আমের নামক ভন্ডপীর। আনসারগণ তার ভন্ডামী সম্পর্কে অবহিত ছিল। কোরায়েশদের জাহেলী,পৌত্তলিক ও চরম বিকারগ্রস্ত সংস্কৃতির সাথে তার সাদৃশ্য ছিল। তাকে দেখা মাত্রই মুসলমানরা বলে উঠলো,“ওহে পাপিষ্ঠ,তোকে আমরা চিনি!” মানবেতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত খুবই বিরল যে,এই আবু আমেরের ছেলে হযরত হানযালা নিজের পিতার ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য রসূল সা.এর কাছে অনুমতি চাইলেন। কিন্তু রসূল সা. এর দয়া ও করুনা অনুমতি দিলনা। পুত্রের হাতে পিতা খুন হবে এটা তিনি সমীচীন মনে করলেন না। এরপর তালহা হাক ডাক শুরু করলো। হযরত আলী তৎক্ষণাত এগিয়ে গিয়ে তার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিলেন। এরপর তার পুত্র উসমান নিজেদের বীরত্বের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে এগিয়ে এল। তার পেছনে একদল গায়িকা গান গাইছিল। হযরত আলীর তরবারী তাকেও এক নিমেষে খতম করে দিল। এরপর শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ।
মুসলমানদের গোটা বাহিনী নিজেদের সংখ্যা ও সাজ সরঞ্জামের ঘাটতি ঈমানী জযবা ও উদ্দীপনা দ্বারা পূরণ করেছিল। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বার্তা বাহকরা জাহেলিয়তের অন্ধকারের সাথে এভাবেই লড়াই করে যাচ্ছিল। এর মধ্যে হযরত হামযা, হযরত আলী ও হযরত আবু দুজানার প্রানপন লড়াই ছিল সবচে দর্শনীয়। শেষ পর্যন্ত জাহেলিয়তের পুজারীদের পরাজয় ঘটলো এবং তাদের গায়িকারা পালিয়ে চলে গেল। মুসলিম বাহিনী বুঝতে পারলো, তারা বিজয়ী হয়েছে। তাই তারা শত্রুদের ভবিষ্যতের জন্য নিসম্বল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের যুদ্ধ সরঞ্জাম ও রসদপত্র ও অন্যান্য জিনিস দখল করা শুরু করলো। রণাঙ্গনের শৃংখলা ভেঙ্গে গেল এবং অরাজকতা ছড়িয়ে পড়লো। সৈন্যরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশনার প্রতি অমনযোগী হয়ে পড়লো। সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হলো, সর্বাধিক নাযুক পাহাড়ী সুড়ঙ্গটাকেও তীরন্দাজরা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। অথচ তাদেরকে কড়াকড়ি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, জয় বা পরাজয় যাই ঘটুক, তোমরা কোন অবস্থায় এই জায়গা থেকে সরবেনা। রসূল সা. এর ভাষা ছিল এ রকমঃ ‘তোমরা যদি দেখতে পাও, পাপীরা আমাদের দেহের গোশ্ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে, তবুও তোমরা এখান থেকে নড়বেনা।’
কিন্তু মুসলমানরা এ সব নির্দেশ ভুলে গিয়ে বিজয়ের ফসল ঘরে তোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এ ব্যস্ততার অত্যন্ত ভয়ংকর ফলাফল তাদেরকে ভোগ করতে হলো। তাদের অর্জিত বিজয় পরাজয়ে রূপান্তরিত হলো। কোরায়েশ বাহিনীতে তখনো খালিদ বিন ওলীদের ন্যায় বিচক্ষণ ও দুর্ধর্ষ বীর ছিল। সে দূর থেকে রণাঙ্গনের এলোমেলো পরিবেশ দেখতে পেয়ে কয়েকজন অশ্বারোহীকে নিয়ে পাহাড়ের পিছন থেকে সেই প্রহরীহীন পাহাড়ী সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বসলো। তারপর কোরায়েশ বাহিনীর আরো যোদ্ধা আক্রমণে শরীক হলো। বিজয়ের আনন্দের ভেতর থেকে সহসা মাথার ওপর তরবারী দেখে মুসলমানদের টনক নড়লো। ওদিকে শত্রুরা স্বয়ং রসূল সা. এর আক্রমণ করার জন্য সৈন্য সমাবেশ করলো। তিনি দৌড়ে দৌড়ে মুসলমানদের ডাকতে লাগলেনঃ ‘ওহে আল্লাহর বান্দারা! আমার কাছে এসো।’ কিন্তু মুসলিম সৈন্যরা কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। এক সময় তাঁর চার পাশে মাত্র এগারজন সাহাবী রয়ে গেল। সুযোগ বুঝে আব্দুল্লাহ বিন কুমাইয়া তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডলে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলো। এতে তাঁর শিরস্ত্রাণ ভেঙ্গে কয়েকটা টুকরো চোয়ালের ভিতর ঢুকে গেল। আর একবার শত্রুদের আক্রমণে তিনি গর্তের মধ্যে পড়ে যান এবং কিছু আঘাতও পান। মুষ্টিমেয় ক’জন সাথী ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতার প্রাণ বাঁচাতে যেরূপ বেপরোয়াভাবে লড়াই করলেন, ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। এহেন প্রলয়ংকরি সংঘর্ষে রসূল সা. এর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা, বরং চৌকসভাবে আত্মরক্ষা করা এবং উবাই ইবনে খালফের ঘাড়ে বর্শা দিয়ে আহত করা অসাধারণ বীরত্বের নিদর্শন। তবু এ সময় রসূল সা. এর আহত হওয়া গর্তে পড়ে গিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া এবং তাঁর সাথে চেহারায় সাদৃশ্য সম্পন্ন সাহাবী জুময়ার ইবনে উমাইরের শহীদ হওয়ার কারণে বিরোধীরা রসূল সা. এর মৃত্যুর গুজব রটানোর সুযোগ পেয়ে যায়। এতে মুসলমানদের মধ্যে অধিকতর অস্থিরতা ও হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। এই গুজবের দু’ধরনের ফল ফললো। হযরত ওমর রা. অস্ত্র ফেলে দিয়ে বললেন, রসূল সা. যখন শহীদ হয়ে গেছেন, তখন আর যুদ্ধ করে কী হবে? রসূল সা. এর ভালোবাসা তাঁর মধ্যে এতোটাই প্রবল ছিল যে, তাঁর দৃষ্টিতে তাঁর মত অমূল্য রত্ন হারানোর পর যত বড় বিজয়ই অর্জিত হোক, তা আর বিজয় মনে হয়না। হযরত আনাস আনসারীর বাবা ইবনে নযর তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘রসূল সা.-এর পর আমরা বেঁচে থেকে কী করবো?’ তারপর এমন প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ করলেন যে, প্রায় ৮০টা আঘাত খেয়ে শহীদ হলেন। এই বিশৃংখল অবস্থার কারণে মুসলমানদের কেউ কেউ স্বপক্ষীয় ভাইদের হাতেও হতাহত হয়েছেন। হযরত হুযায়ফার পিতা মুসলমানদের হাতেই শহীদ হয়ে যান।
এরপর পরিস্থিতি পাল্টাতে লাগলো। প্রত্যেক মুসলিম সৈনিক নিজ নিজ স্থানে তরবারী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল এবং রসূল সা. কে দেখার জন্য ব্যাকূল ছিল। সর্বপ্রথম হযরত কা’ব ইবনে মালেক রসূল সা. কে দেখতে পান। তিনি সবাইকে ডেকে রসূল সা. এর জীবিত থাকার খবর জানিয়ে দেন। এই সুখবর যখন সবার কাছে গেল, তখন সবাই কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসতে লাগলো। শত্রুর ভীড় কমলে রসূল সা. পাহাড়ের চূড়ায় চলে গেলেন। আবু সুফিয়ান সেদিকে অগ্রসর হলে সাহাবীগণ পাথর নিক্ষেপ করে তাকে হটিয়ে দিলেন। এবার শত্রুরা শংকিত হলো, অতর্কিতভাবে যে বিজয় তারা অর্জন করেছে, তা আবার হাতছাড়া হয়ে না যায়। তাই মক্কার বাহিনী দ্রুত সঠকে পড়তে লাগলো।
আবু সুফিয়ান পার্শ্ববর্তী একটা পাহাড়ে আরোহণ করে রসূল সা. সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য সংগ্রহ করতে চেষ্টা করলো। সে উচ্চস্বরে রসূল সা., আবু বকর ও ওমরের নাম ধরে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, এরা কেউ জীবিত আছে নাকি?
এদিক থেকে কোন জবাব দেয়া হলো না কৌশলগত কারণে। তখন সে বলে উঠলো, “সবাই মরেছে।”
হযরত ওমর রা. আর চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি বললেন, “ওরে আল্লাহর শত্রু। আমরা সবাই জীবিত।” আবু সুফিয়ান শ্লোগান দিলঃ
“হুবাল, তুমি শির উঁচু করে থাকো।”
এদিক থেকে পাল্টা শ্লোগান দেয়া হলোঃ
“আল্লাহই চির পরাক্রান্ত, সর্ব শ্রেষ্ঠ!”
আবু সুফিয়ান আবার হাঁক দিলঃ
“আমাদের সাথে উয্যা আছে। তোমাদের উয্যা নেই”
এদিক থেকে জবাব দেয়া হলোঃ
“আল্লাহ আমাদের মনিব, তোমাদের কোন মনিব নেই।”
আসলে এই ছোটখাটো শ্লোগানগুলোর মধ্য দিয়ে সেই দুটো মতবাদ সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, যে দুটো মতবাদের টক্করে ইতিহাসের এত বড় তাণ্ডব সৃষ্টি হয়েছিল। এই যুদ্ধে ৭০ জন মুসলমান শহীদ এবং ৪০ জন আহত হন। অপরদিকে শত্রু বাহিনীর মাত্র ৩০ ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্ভব হয়। রসূল সা. এর চাচা হযরত হামযার ন্যায় বীর সেনানী, তাঁর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ, নামকরা সাহাবীদের মধ্যে মুসয়াব ইবনে উমাইর, হানযালা ইবনে আবি আমের, রাফে বিন মালেক বিন আজলান (শেষোক্ত তিনজনই আকাবার উভয় বায়য়াতে শরীক ছিলেন) আব্দুল্লাহ বিন আমর খাযরাজী, আমর বিন জামূহ এবং সংখ্যক বদরযোদ্ধা সাহাবী দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম সত্যের বৃক্ষকে নিজেদের রক্ত সিঞ্চন করে গেলেন।
অবশেষে যখনই মুসলিম বাহিনী নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল, এবং হাই কমান্ডের সাথে তাদের যোগাযোগ সুপ্রতিষ্ঠিত হলো, তখন শত্রুসেনারা দ্রুত পিছু হটে রণাঙ্গন থেকে চলে গেল। এভাবে আকস্মিক বিজয়ের আড়ালে লুকানো দুর্বলতার মুখোস খুলে গেল এবং মুসলিম বাহিনী আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল।
মুসলমানরা নিজেদের একটা পদস্খলনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বটে, কিন্তু তারা পরাজিত হয়নি, তাদের শক্তিও ভেঙ্গে পড়েনি। তাই রসূল সা. এর নির্দেশে ৭০ জন মোজাহেদের এক বাহিনী কোরায়েশী বাহিনীর পিছু ধাওয়া করলো। ওদিকে আবু সুফিয়ান রওহাতে পৌঁছে যখন পরিস্থিতি পর্্যবেক্ষণ করলো, তখন সে ভীষণ অনুতপ্ত হলো। সে বুঝলো যে, ওহুদে অর্জিত বিজয়ের সুফল সে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে ময়দানেই ফেলে এসেছে। মদিনার শক্তি ধ্বংস করার লক্ষ্যটা তাদের অসম্পূর্ণই রয়ে গেছে। এখন সে হারানো লক্ষ্য পুনরুদ্ধারের কথা ভাবতে লাগলো। কিন্তু গুড়ে বালি! এখন তো সে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। যাকে বলে চোর চলে যাওয়ার পর মাথায় বুদ্ধি আসার মত অবস্থা! রসূল সা. আগেই এ আশংকা পোষণ করেছিলেন। তিনি মদিনায় ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে তাঁর সমগ্র বাহিনীকে সাথে নিয়ে মদিনা থেকে ৮ মাইল দূরে হামরাউল আসাদ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছলেন। ইতিমধ্যে খুযায়া গোত্রের (যারা ইসলাম গ্রহণ না করলেও ইসলামী সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল) নেতা মা’বাদ স্বয়ং গিয়ে আবু সুফিয়ানকে ভয় দেখালো “মুহাম্মাদ সা. এক বিশাল বাহিনী নিয়ে আসছে।” এ খবর শুনে আবু সুফিয়ান আতংকগ্রস্ত হয়ে দ্রুত চলে গেলো।
ওহুদ যুদ্ধের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক
এক্ষণে আমরা এই যুদ্ধের বিশেষ বিশেষ লক্ষণীয় দিকগুলোর দিকে দৃষ্টি দেবঃ
(১) শৃংখলা যে কোন আন্দোলনের আসল শক্তি। সব ধরনের যুদ্ধ ও সংঘাতে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি ও মৌলিক। শৃংখলার ভিত্তি যে নৈতিক গুণটার ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাঁর নাম ধৈর্য। অর্থাৎ ভয়ভীতি ও লাভ লোকসানের পরোয়া না করে স্থির ও অবিচল থাকা যায়। ইসলামী সংগঠন এ সময় প্রশিক্ষণাধীন ছিল এবং বিশেষত রণাঙ্গনের ইসলামী চরিত্রের মজবুত করার জন্য এখনো ব্যাপকতর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়নি। কেননা ওহুদের আগে মাত্র একটা যুদ্ধই সংঘটিত হয়েছিল। কোন মানবীয় সংগঠন কোন আদর্শের ভিত্তিতে নতুন সমাজ গড়ে তোলার সময় পদস্খলন থেকে একেবারে মুক্ত থেকে পূর্ণ সাফল্য ও পরিপক্কতা লাভ করতে পারেনা। কিন্তু এই সামান্য একটা পদস্খলনের মাধ্যমে আল্লাহ মুসলমানদের এমন একটা বাস্তব শিক্ষা দিয়ে দিলেন, যা কেবল উপদেশের মাধ্যমে বদ্ধমূল করা যায় না। এই শিক্ষার মধ্য দিয়ে এ কথাটাও স্পষ্ট করে জানা গেল যে, আল্লাহ তায়ালার প্রাকৃতিক আইন একেবারেই নিরপেক্ষভাবে ও বেপরোয়াভাবে কাজ করে থাকে। এ আইন ভংগ করলে নিতান্ত সৎ লোকও শাস্তি থেকে রেহাই পায় না।
এই যুদ্ধের পর্যালোচনা করতে গিয়ে কোরআন মুসলমানদের মধ্যে তখনো বিদ্যমান ভুলত্রুটি ও দুর্বলতার কঠোর সমালোচনা করে। তাদেরকে ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশ দেয়। (আল ইমরান-১২৫) ধন-সম্পদের যে বাছবিচারহীন লালসা সুদী লেনদেনের প্ররোচনা দিয়ে থাকে এবং যুদ্ধের ময়দানে গনীমত লাভের জন্য অস্থিরতা সৃষ্টি করে থাকে, সেই লোভ লালসা পরিহার করার নির্দেশ দেয়। তাদেরকে পরোক্ষভাবে বুঝায় যে, সুদখোরী ও লোভাতুর মানসিকতা নিয়ে ধৈর্য ধারণ, শৃংখলা রক্ষা ও কোন উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐতিহাসিক লড়াই করা যায় না। এই মানসিক প্রেক্ষাপটের সুযোগ নিয়ে সুদ সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়। (আল ইমরানঃ ১৩০) তাদেরকে বলা হয় যে, ইসলামী বিপ্লবের ঝাণ্ডা তারাই বহন করতে পারে, যারা সুদ ও ধন সম্পদের মোহে অন্ধ না হয়ে বরঞ্চ ধন সম্পদ মহৎ উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং ভাবাবেগে প্রবাহিত না হয়ে ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে। (আল ইমরান- ১৩৪) এ কথাও জানিয়ে দেয়া হয় যে, যে ব্যক্তি দুনিয়াবী স্বার্থ অর্জনের জন্য কাজ করবে, সে দুনিয়ায় যা কিছু পাবে, তা-ই হবে তার চূড়ান্ত প্রাপ্তি। আখেরাতে তার কিছুই প্রাপ্য থাকবেনা। আর যে ব্যক্তি নিজের পার্থিব স্বার্থের ক্ষতি করে আখেরাতের কল্যাণ করতে চাইবে, তার কাজের উপযুক্ত মূল্য দেয়া হবে। (আল ইমরান-১৪৫) তাদেরকে এ কথাও বুঝানো হয় যে, একটা আঘাত খেয়েই তোমরা মর্মাহত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বসে থেকনা। আজ যদি তোমরা আঘাত খেয়ে থাক, তবে কাল শত্রুরাও তোমাদের হাতে আঘাত খেয়েছে। যে কোন সংঘাত সংঘর্ষে চড়াই-উৎরাই বা জয় পরাজয় তো থাকবেই। কিন্তু নিশ্চিত থাকো যে, চূড়ান্ত বিজয় তোমাদেরই হবে। (আল ইমরান, ১৩৯-১৪০) এরপর তাদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সতর্ক করা হয় যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত কোন সস্তা পণ্য নয়। এ সৌভাগ্য কেবল তারাই লাভ করতে পারে, যারা আল্লাহর পথে জান ও মাল উৎসর্গ করতে পারে এবং ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারে। ছাঁটাই বাছাই করে সাচ্চা ঈমানদার ও সত্যের সাক্ষ্য দানের যোগ্য লোক নির্ধারণ কেবল এই সব কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। (আল ইমরান, ১৪০-৪২) (ওহুদের ময়দানে রসূল সা. এর শাহাদাতের গুজবের ফলে সৃষ্ট) চরম হতাশাব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, মুহাম্মাদ সা. আল্লাহ নন, তিনি একজন রসূল মাত্র। অতীতের নবী রসূলগণ যেমন মারা গেছেন, তেমনি মুহাম্মাদকেও সা. একদিন না একদিন তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতেই হবেই। সুতরাং তাঁর তীরোধানে তোমরা ইসলামী আন্দোলন সংগ্রামের সমস্ত কর্মসূচী সিঁকেয় তুলে রাখবে এবং হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে-এটা কিভাবে বৈধ হতে পারে। (আল ইমরানঃ ১৪৪) বস্তুত রসূল সা. এর প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসার কারণেই অমন হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল। আরো বলা হয়েছে যে, পূর্বতন নবীগণের সাথে জেহাদ করে যারা জীবন উৎসর্গ করেছে এবং বাতিলের সামনে মাথা নোয়াতে প্রস্তুত হয়নি, তাদের আদর্শের অনুসারী হয়ে তোমাদের গড়ে ওঠা উচিত। কেননা আল্লাহ ঐ ধরনের ধৈর্যশীলদেরকেই ভালোবাসেন। (আল ইমরানঃ ১৪৬) এই মৌলিক শিক্ষাগুলো দেয়ার পর মুসলিম বাহিনীকে শৃংখলা ভংগ করার কারণে যে মর্মান্তিক পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছিল, কোরআন তার ছবি তুলে ধরেছেঃ
“আল্লাহ সাহায্যের যে প্রতিশ্রুতি তোমাদের দিয়েছিলেন, তা তিনি পূর্ণ করেছেন। প্রথমে আল্লাহর হুকুমে তোমরাই তাদের হত্যা করছিলে। কিন্তু পরে যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে এবং পরস্পর দ্বিমত পোষণ করলে, তখন আল্লাহ তোমাদের লোভনীয় জিনিস তোমাদের দেখানো মাত্রই তোমরা নিজেদের নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে। কেননা তোমাদের কিছু লোক দুনিয়ার জন্য লালায়িত ছিল এবং কিছু লোক আখেরাতের অভিলাষী ছিল। তখন আল্লাহ তোমাদেরকে কাফেরদের মোকাবিলায় পিছু হটিয়ে দিলেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে। তারপরও আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিলেন। কেননা মোমেনদের ওপর আল্লাহ খুবই অনুকম্পাশীল।
স্মরণ কর, যখন তোমরা পালিয়ে যাচ্ছিলে, কারো দিকে ফিরে তাকানোর হুঁশ পর্যন্ত তোমাদের ছিল না এবং রসূল সা. পেছন থেকে তোমাদের ডাকছিল। তখন আল্লাহ তোমাদের এই কাজের প্রতিফল এভাবে দিলেন যে, তোমাদেরকে দুঃখের পর দুঃখ দিলেন, যাতে ভবিষ্যতের জন্য তোমরা শিক্ষা পাও এবং তোমরা যা হারাও বা তোমাদের ওপর যা কিছু বিপদ আসে, তাতে তোমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হও। আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত।” (আল ইমরানঃ ১৫২-১৫৩)
রসূল সা. এর মুখ দিয়ে ওহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর তৎপরতা ও ভূমিকা সম্পর্কে কৃত এই সমালোচনা ও পর্যালোচনা লক্ষ্য করুন এবং ভাবুন যে, দুনিয়ার সাম্রাজ্য লোলুপ সমরনায়ক শাসকদের থেকে এ সমালোচনার প্রকৃতি ও মেযাজ কত পৃথক। এতে না দেয়া হয়েছে সৈনিকদেরকে যা হচ্ছে তা করার অবাধ অনুমতি, না করা হয়েছে তাদেরকে আত্ম প্রবঞ্চনায় নিক্ষেপ করার চেষ্টা, এবং না করা হয়েছে ঘটনাবলীর ভুল ব্যাখ্যা করার কোন কসরত। এ ছিল একটা বেপরোয়া কঠোর সমালোচনা। আলাহর ভয় ছিল এ সমালোচনার মূলমন্ত্র এবং নৈতিক প্রশিক্ষণই ছিল এর উদ্দেশ্য।
(২) এই যুদ্ধে রসূল সা. এর মুষ্টিমেয় সংখ্যক সহচর যেরূপ জীবন বাজি রাখা ভালোবাসা ও আন্তরিক ত্যাগী মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন, তা মুসলিম উম্মাহকে কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পথে জানমাল কুরবানী করার পবিত্র প্রেরণা জোগাতে থাকবে। আসলে যে কোন আন্দোলনই হোক না কেন, তার প্রথম আহবায়ক ও সর্বোচ্চ নেতার ব্যক্তিত্ব তার প্রধান শক্তি হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনে আহবায়ক ও নেতার জন্য গভীর ভালোবাসার দাবী করা হয়েছে। বিশেষত এই পদে যখন নবী ও রসূলের ব্যক্তিত্ব বিরাজমান থাকে, তখন তার জন্য সর্বোচ্চ পরিমাণ আত্মোৎসর্গের মনোভাব অত্যন্ত জরুরী। ইসলামী আন্দোলন কোন অবস্থায়ই তার আহবায়ক ও নেতাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারেনা। আন্দোলন ও তার আহবায়ক-উভয়ের শক্তি, পরাক্রম ও প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন হয়ে যায়। যে দল নিজের আহবায়ক ও নেতাকে উপেক্ষা করে, তাকে প্রভাবহীন করে অথবা নিছক “আমাদের একজন” আখ্যায়িত করে শুধুমাত্র আন্দোলনের নীতিমালাকে বিজয়ী করে নিয়ে যেতে চায়, সে দল একেবারেই একটা অন্ধ ও অবিবেচক দল। আন্দোলনের জন্য নীতি ও নেতৃত্ব উভয়ই অবিচ্ছেদ্য ও অপরিহার্য উপাদান। নীতি ও আদর্শের উপর অটুট ঈমান ও প্রত্যয় আর নেতার জন্য গভীর ভালোবাসা ও আত্মোৎসর্গের মনোভাব একে অপরের উপর নির্ভরশীল ও পরিপূরক। রসূল সা. এর সাহাবীগণ তাঁর সত্তা ও ব্যক্তিত্বের উপর জানমাল ও যথাসম্ভব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকতেন। এর প্রথম কারণ, তিনি রসূল সা.। আর দ্বিতীয় কারণ, তারা জানতেন ও বুঝতেন যে, তাঁর অস্তিত্ব গোটা আন্দোলনের প্রাণ। এ জন্য তাঁর প্রাণ রক্ষা, তাঁর সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি এবং তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তির প্রসার ঘটানোর জন্য তাঁরা জীবন উৎসর্গ করতেন। ওহুদ রণাঙ্গনে তাঁরা রসূল সা. এর নির্ভেজাল ও একনিষ্ট ভালোবাসার অকাট্য প্রমাণ দিয়েছেন।
শত্রুরা যখন দলে দলে হানা দিতে লাগল, তখন রসূল সা. উচ্চস্বরে বললেন, “আমার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে কে প্রস্তুত আছে?” যিয়াদ বিন সাকান এ আওয়াজ শুনে কয়েকজন আনসারকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলেন এবং একে একে সাতজন রসূল প্রেমিক প্রাণোৎসর্গ করলেন। যিয়াদকে মুমূর্ষু অবস্থায় রসূল সা. এর কাছে আনা হলে তিনি অতি কষ্টে মাথা বাড়িয়ে রসূল সা. এর পা স্পর্শ করলেন। আব্দুল্লাহ বিন কুমাইয়া যখন তরবারি দিয়ে রসূল সা. কে আঘাত করলো, তখন মহিলা সাহাবী উম্মে আম্মারা এক লাফ দিয়ে রসূলের সামনে যেয়ে দাঁড়ালেন এবং নিজের ঘাড়ে গভীর জখম নিলেন। তিনি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ানোর কারণেই এই আঘাত রসূল সা. কে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আবু দুজানা, রসূল সা. কে নিজের শরীর দিয়ে ঢালের মত ঢেকে ফেলেন। তাঁর শরীরে অসংখ্য তীর এসে বিদ্ধ হয়। তালহা শত্রুর তরবারি হাত দিয়ে ঠেকান। তাঁর এক হাত কেটে নিচে পড়ে যায়। আবু তালহা, রসূল সা. এর সামনে ঢাল নিয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং এত জোরে তা দিয়ে আঘাত করেন যে, দুতিনটে ধনুক ভেঙ্গে যায়। একজন সহজ সরল মুসলমান খেজুর খেতে খেতে ঘটনাক্রমে এসে পড়ে। এ অবস্থা দেখে তার মধ্যেও লড়াইয়ের আবেগ সৃষ্টি হয়। সে রসূল সা. কে জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি লড়াই করে মারা যাই, তাহলে আমার পরিণাম কি হবে?” রসূল সা. বললেন, “জান্নাত”। সে বললো, “তাহলে এই খেজুর খেতে খেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।” এই বলে খেজুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তুমুলভাবে যুদ্ধ শুরু করে দিল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শহীদী কাফেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। যে আন্দোলনে নেতার প্রতি এমন তীব্র ভালোবাসা সক্রিয় থাকে, সে আন্দোলনকে স্তদ্ধ করে এমন শক্তি কারো নেই। সা’দ বিন রবীও একটা বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। রসূল সা. যেহেতু নিজেও তাঁর সাথীদের প্রতি গভীর স্নেহ পোষণ করতেন, এবং প্রত্যেকের উপর তাঁর মনোযোগ ও দৃষ্টি থাকত, এ জন্য যুদ্ধ শেষে এক এক করে প্রত্যেকের অবস্থা জানতে চাইলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “সা’দ বিন রবী কোথায়?” খোঁজ নেয়া হলে দেখা গেল, তিনি একদিকে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে কাঁতরাচ্ছেন। শেষ মুহূর্তে রসূল সা. এর জন্য সালাম, মহব্বত ও দোয়ার হাদিয়া পেশ করলেন এবং সাথীদেরকে অসিয়াত করলেন যে, “তোমরা সবাই বেঁচে থাকতে যদি শত্রুরা রসূল সা. কে স্পর্শ করারও সুযোগ পায়, তবে আল্লাহর কাছে তোমাদের কোন ওজর আপত্তি গ্রাহ্য হবেনা।” নিজের ব্যথা বেদনার দিকে লক্ষ্য নেই, প্রিয়জনদের কথাও খেয়াল নেই, নিজের ধন-সম্পদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তাভাবনা নেই, সমস্ত চিন্তাভাবনা শুধু ইসলামী আন্দোলন ও তার আহবায়ককে নিয়ে।
(৩) মক্কার ইসলাম বিরোধী বাহিনী তাদের ঘৃণ্য মানসিকতা প্রকাশার্থে মুসলিম শহীদদের লাশগুলোর অবমাননা করল। বিশেষত তাদের মহিলারা তাদের মান্নত পূরণ করার জন্য লাশগুলোর পেট চিরলো ও তাদের নাক, কান কেটে মালা বানিয়ে গলায় পরলো। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী ও মহিলা বাহিনীর সর্দারনী হিন্দা হিংস্রতার নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। সে হযরত হামজার মুখমন্ডল বিকৃত করল এবং বুক চিরে কলজে বের করে চিবালো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশেরও মুখমন্ডল বিকৃত করা হলো। স্বয়ং আবু সুফিয়ান ধনুক দিয়ে হযরত হামজার মুখে আঘাত করতে লাগলো আর বলতে লাগলো, “নাও এখন মজা উপভোগ কর।” অপর দিকে রসূল সা. মুসলিম বাহিনীকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলেন যে, শত্রুদের লাশের অবমাননা ও মুখমন্ডল বিকৃত করোনা। ইসলামী আন্দোলনের মূলনীতিতে মানবতার মর্যাদা সমুন্নত রাখার শিক্ষা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ইসলাম তার অনুসারীদের এ অনুমতি দেয় না যে, অন্য কেউ ইতরসুলভ আচরণ করলে জবাবে সেও তা করতে পারবে।
আবু সুফিয়ান যখন তার লোকদের এসব তৎপরতার কথা শুনলো তখন সানন্দে এগুলোকে অভিনন্দন জানালো। কিন্তু তার এক সঙ্গী এর সমালোচনা করায় তার টনক নড়লো। সে ভাবলো, এসব কাজ করতে গিয়ে কোথাও ইটের বদলে পাটকেল না খেতে হয় এবং জনমতের কাছে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে না যায়। আবু সুফিয়ান যখন যুদ্ধের শেষে পাহাড়ের উপর এল, তখন এই অনুভূতির কারণেই সে বলল যে, “এসব ঘটনা আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঘটানো হয়নি। তবে আমি এগুলোতে ব্যথিতও নই।”
আজ এটা অনুমান করা সহজ নয় যে, ইসলাম বিরোধী শক্তির এই পাশবিক আচরণ জনমনে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছিল কিনা। তবে একটা ঘটনা জানা যায় যে, শাহাদাতপ্রাপ্ত হযরত হামজার লাশের মুখমন্ডলে আবু সুফিয়ানকে ধনুক দিয়ে আঘাত করতে দেখে জালীস বিন যুবান কিনানী নামক জনৈক মুশরিক নিজ গোত্রের লোকদের বলেছিল, “ওহে বনী কেনানা, কুরায়েশের বড় সর্দার নিজের চাচাত ভাইয়ের সাথে কী আচরণ করছে দেখছ?” এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান সচেতন হয়।
(৪) রসূল সা. মুসলমানদেরকে রণাঙ্গনের যে মার্জিত ও সুসভ্য আচরণ পদ্ধতি শেখাচ্ছিলেন, তার একটা ঝলক আবু দু’জানার ঘটনায় লক্ষ্য করা যায়। আবু দু’জানা যখন শত্রু সেনাদের কাতারের পর কাতার লন্ডভন্ড করে সামনে এগুতে থাকেন, তখন হামজার কলজে চিবানো হিন্দ তাঁর সামনে পড়ে যায়। হিন্দ যুদ্ধে শরীক ছিল এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার আবেগ ছিল অত্যন্ত বিষাক্ত। তাই তাকে হত্যা করা দোষের কাজ হতোনা। আবু দু’জানাও তার মাথা তাক করে তরবারি উঁচু করেছিলেন। কিন্তু তৎক্ষণাত তিনি এই ভেবে সচকিত হয়ে তরবারি নামিয়ে ফেললেন যে, রসূল সা. এর দেয়া তরবারি দিয়ে কোন নারীর প্রাণ সংহার করা সমীচীন নয়।
(৫) মুসলিম নারীরা ওহুদ যুদ্ধের সময় যেভাবে ঈমানদারী, বীরত্ব, ধৈর্য ও ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন, তা থেকে বুঝা যায়, রসূল সা. পরিচালিত আন্দোলন নারীদেরকে নিষ্ক্রিয় রাখেনি, বরং তাদেরকে সক্রিয় করেছে, প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং কাজে লাগিয়েছে। কয়েকটা উদাহরণ দেখুন।
উম্মে আম্মারার কথা আমরা কিছু আগেই আলোচনা করেছি যে, একজন মহিলা হয়েও তিনি কিভাবে রসূল (সা.) এর জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
হযরত হামজার বোন সাফিয়া মর্মবিদারী ঘটনাবলী শুনে যখন মদিনা থেকে ওহুদের রণাঙ্গনে এসে পৌঁছলেন, তখন রসূল সা. হামজার ছেলে যুবায়েরকে বললেন, ওকে তোমার আব্বার লাশের কাছে যেতে দিও না। কেননা সে ঐ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারবেনা। সাফিয়া বললেন, “আমি সব কিছু শুনেছি। সত্য ও ন্যায়ের পথে এ ত্যাগ বড় কিছু নয়।” তাঁকে অনুমতি দেয়া হল। সাফিয়া অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে লাশ দেখলেন, মাগফেরাতের দোয়া করলেন এবং চলে আসলেন।
আমর বিন যামূহের স্ত্রী ও খাল্লাদ বদরীর মা হিন্দ আনসারীর জন্য এটা ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। তাঁর বাবা ও স্বামী দুজনই শাহাদাৎ বরণ করেন। কিন্তু তিনি এ সমস্ত আঘাতকে অতি কষ্টে সামলে নিয়ে বারবার কেবল এই কথাই জিজ্ঞেস করছিলেন যে, “আল্লাহ্র রসূল সা. নিরাপদে আছেন ত?” যখন নিশ্চিত হলেন যে, তিনি ভালো আছেন, তখন বেএখতিয়ার বলে উঠলেন, “হে রসূল, আপনি সুস্থ ও নিরাপদ থাকলে আর কোন মুসিবতই অসহনীয় নয়।”
হয়রত আয়েশা, উম্মে সুলায়েম ও উম্মে সলীতের ন্যায় সম্ভ্রান্ত পর্দানশীন মহিলারাও দুর্যোগকালে দৌঁড়ে দৌঁড়ে মসক ভরে পানি এনে আহত সৈনিকদের পান করিয়েছিলেন। মুসলমানদের বিপর্যয় ও রসূল সা. এর শাহাদাতের ভুল খবর শুনে হযরত ফাতেমাও ওহুদে হাজির হয়েছিলেন। তিনি রসূল সা. এর ক্ষতস্থানগুলো ধুয়ে দেন এবং পট্টি বেঁধে দেন।
(৬) মানবতার বন্ধু রসূল সা. যখন নিজের তরবারি আবু দুজানাকে দিয়েছিলেন, তখন আবু দুজানা মাথায় লাল রুমাল বেঁধে তরবারি দুলিয়ে হেলে দুলে চলতে চলতে শত্রুর কাতারের দিকে অগ্রসর হলেন। এ দৃশ্য দেখে রসূল সা. বললেন, “এ ধরণের চালচলন আল্লাহ্র খুবই অপছন্দ। কিন্তু এরূপ ক্ষেত্রে তিনি এটা পছন্দ করেন।” এভাবে তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বুঝিয়ে দিলেন। জীবনের সাধারণ কর্মকান্ডে কোনভাবেই অহংকার প্রদর্শন করা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই অনভিপ্রেত। কিন্তু শত্রুদের সাথে সংঘর্ষ চলার সময় অহংকার ও গর্ব প্রকাশ করা অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়। বিনয় খুবই ভালো জিনিস। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানেও একটা উত্তম নৈতিক বিধির অপপ্রয়োগের মাধ্যমে শত্রুর সামনে বিনয় প্রকাশ করা অত্যন্ত নির্বোধ সুলভ কাজ। যে নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ ধর্মীয় মানসিকতা সততাপ্রীতির নামে কিছু কিছু নৈতিক মূল্যবোধকে বেখাপ্পাভাবে বিপরীত উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। রসূল সা. এই একটি বাক্য দ্বারা সেই মানসিকতার বিলুপ্তি ঘটালেন। শুধু রণাঙ্গনেই নয় বরং তৎকালের অন্যতম রাজনৈতিক প্রচারমাধ্যম রূপে বিবেচিত হত কবিতা ও বাগ্মীতা। তিনি মুসলিম কবি ও বাগ্মীদের দিয়ে গর্ব ও অহংকার প্রকাশ করাতেন। অনুরূপভাবে উমরাতুল কাযার সময়ও রসূল সা. সাহাবাদেরকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে শক্তি প্রকাশ করার আদেশ দিয়েছিলেন আর সাফা ও মারওয়ায় দৌঁড়ানোর সময় বুক টান করে পা উঠানো এবং হেঁটে চলার পর দৌঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। পরবর্তীকালে এটাই একটা সুন্নত তথা ঐতিহ্যে পরিণত হয়। এ সময় তিনি এ মর্মে দোয়া করেন, যে ব্যক্তি আজ কাফেরদের সামনে শক্তি প্রকাশ করবে, আল্লাহ্ তার প্রতি অনুগ্রহ করুন। বস্তুত সংঘাত-সংঘর্ষের যেকোন পর্যায়ে বিনয় প্রকাশ ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যে ব্যক্তি নৈতিক মূল্যবোধ ও নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ স্থান, কাল ও পাত্রের পার্থক্য বুঝে করতে পারেনা, সে এক ধরণের পাগলামিতে আক্রান্ত। এ ধরণের পাগলামি দিয়ে আর যাই চলুক, ইসলামী আন্দোলন চলতে পারেনা।
(৭) সততা ও সত্যনিষ্ঠতা এমন শক্তি, যা মানুষকে প্রচন্ডভাবে আকৃষ্ট করে। মদিনায় ওমর বিন সামেত নামে একজন সৎ যুবক বাস করত। মুসলমানদের সাথে তার আচরণ ছিল সমর্থন ও সহানুভূতিপূর্ণ। কিন্তু সে তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি। ওহুদের যুদ্ধ তার সুপ্ত চেতনাকে জাগিয়ে তুললো। সে ঈমান আনলো এবং কাউকে কিছু না বলে তরবারি নিয়ে যুদ্ধে শরীক হল ও শাহাদাৎ লাভ করলো। মৃত্যুর পূর্বক্ষণে বনু আব্দুল আশহাল গোত্রের লোকেরা তাকে সনাক্ত করল। তারা ওর খবরাদি জানতে চাইলে সে বললো!, “আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের প্রেমে সত্য ও ন্যায়ের সপক্ষে লড়াই করছি।” রসূল সা. সুসংবাদ দিলেন, জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়েও সে জান্নাতবাসী হবে। আরেকটা উদাহরণ বনু সা’লাবা নামক ইহুদী গোত্রের সদস্য মুখাইরীকের। সে সত্যিকার ইহুদী ধর্মের অনুসরণ করতে গিয়ে রসূল সা. এর পক্ষে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। শুধু নিজে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েই ক্ষান্ত থাকলোনা, অন্যান্য ইহুদীদেরকেও যুদ্ধ করার আহবান জানাল। তার স্বগোত্রীয় ইহুদীরা ধর্মীয় ওজর পেশ করলো যে, আজ ত শনিবার যুদ্ধে যাওয়া অবৈধ। কিন্তু মুখাইরীক বলল, আজ কোন শনিবার নেই। অবশেষে সে একাই রণাঙ্গনে পৌঁছল, যুদ্ধ করল ও জীবন উৎসর্গ করলো। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের আরেকটা উদাহরণ কিযমানের। রসূল সা. তার দোজখবাসী হবার আগাম খবর দিয়েছিলেন। সে মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়ে কুরাইশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলো। যুদ্ধ শেষে তাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেলে লোকের তার প্রশংসা করলো যে, তুমি তো অসাধারণ শৌর্যবীর্য দেখালে। সে বললো, আমি তো কেবল আমাদের জাতীয় মর্যাদা রক্ষার্থে লড়েছি। হতভাগা সৈনিকটা ক্ষতস্থানের ব্যথা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করলো। আল্লাহ্ তাকে দিয়ে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করালেন, আবার সে নিহতও হল এবং তার ঠিকানা হল জাহান্নাম। আল্লাহ্ এমন শোচনীয় পরিণতি থেকে মুমিনদের রক্ষা করুন।
(৮) আমরা আগেই ইঙ্গিত করেছি যে, এই সময় জাহেলিয়াতের নেতিবাচক শক্তি ভীষণ দম্ভে বিভোর ছিল এবং কুফরি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার উদ্দীপনায় অতিমাত্রায় উজ্জীবিত ছিল। কোরায়েশের পতাকা উত্তোলনকারীরা যদিও এক একে নিহত হল এবং কেউ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা, কিন্তু নতুন লোকেরা সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের স্থানগ্রহণ করতে লাগল। অবশেষে যখন সাওয়ার নামক এক ব্যক্তি ঝান্ডা তুললো, তখন এমন একটা তরবারির আঘাত খেল যে, তাতে তার দু’খানা হাতই কেটে পড়ে গেল। ঝান্ডা পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সে ঝান্ডার উপর উপুড় হয়ে পড়ে গেল এবং “আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি” বলতে বলতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। কিছুক্ষণ ঝান্ডা মাটিতেই পড়ে রইল। অবশেষে উমরা বিনতে আলাকামা নাম্নী জনৈক মহিলা বীরোচিতভাবে সামনে অগ্রসর হয়ে ঝান্ডা তুলে নিল। এ থেকে বুঝা যায়, ইতিবাচক বিপ্লবী শক্তির আবির্ভাবে রক্ষণশীল শিবিরেও কিছুকালের জন্য উদ্দীপনা বিরাজ করে। ওহুদে সেটাই ঘটেছে। সেখানে মক্কার রক্ষণশীল কুফরি কায়েমী শক্তি তার সর্বশেষ দাপট ও প্রতাপ দেখিয়েছে।
(৯) এই যুদ্ধে মুসলিম শিবিরের বস্তুগত দৈন্যদশা ও রিক্ততার অনেক হৃদয়বিদারক দৃশ্য চোখে পড়ে। মোট সত্তর জন শহীদের লাশ পড়ে ছিল। কিন্তু তাদের জন্য কাফনের ব্যবস্থা করাও কঠিন ছিল। মুসয়াব বিন উমাইরের লাশের উপর শুধু মাথার দিকে কাপড় দেয়া যাচ্ছিল। কিন্তু পা ঢাকা হয়েছিল আযখার ঘাস দিয়ে। পরবর্তীকালে এই পরিস্থিতির কথা যখনই মনে পড়ত, মুসলমানদের চোখে পানি এসে যেত। এই অবস্থা থেকেই আন্দাজ করা যায়, মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধ করা কত কষ্টকর, অনিচ্ছাকৃত অথচ অনিবার্য পদক্ষেপ ছিল, এবং পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে ছাড়া কোন মতেই তাদের এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সম্ভবপর ছিলনা। কিন্তু বাধ্য হয়ে যখন এ কাজ করতেই হল, তখন তারা নিজেদের জীবন দর্শনের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়, নিজেদের মহান লক্ষ্যের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা এবং রসূল সা. এর অকৃত্রিম সাহচর্য দ্বারা সব রকমের ঘাটতি পূরণ করে নিলেন।
(১০) কোরআন মুসলমানদেরকে তাদের সমস্ত ত্রুটি ও দুর্বলতা সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন করা এবং তার সংশোধনে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দানের সাথে সাথে তাদের মধ্যে সৈনিকসুলভ গুণাবলীও সৃষ্টি করে। তাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, রণাঙ্গনে নৈতিক শক্তিই হয়ে থাকে আসল নিষ্পত্তিকারী শক্তি। এই নৈতিক শক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ধৈর্য। তাদেরকে এও শিক্ষা দেয়া হয় যে, হক ও বাতিলের লড়াইতে তারা যেন বংশীয়, গোত্রীয় ও জাতিগত ভাবাবেগ এবং পার্থিব স্বার্থকে সম্পূর্ণরূপে শিঁকেয় তুলে রাখে। আর একমাত্র আল্লাহ্র সন্তোষ, সত্য ও ন্যায়ের বিজয় এবং আখিরাতের সাফল্যকে অগ্রাধিকার দেয়। কোরআন তাদের হৃদয়ে এ কথাও বদ্ধমূল করে যে, জয় পরাজয়ের ফায়সালা সর্বাবস্থায়ই নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহ্র হাতে নিবদ্ধ। একমাত্র তাঁরই সাহায্য কোন শক্তিকে বিজয়ী করতে সক্ষম। কাজেই তাঁরই আইন এবং তাঁরই সন্তোষকে সবসময় সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ বিষয়টাকেই সূরা আল ইমরানের ২৭ ও ২৮ নং আয়াতে একটা দোয়ার আকারে শিখানো হয়েছে :
“বল: হে আল্লাহ্, রাজাধিরাজ, তুমি যাকে চাও রাজত্ব দাও, যার কাছ থেকে চাও রাজত্ব ছিনিয়ে নাও, যাকে চাও সম্মানিত কর এবং যাকে চাও অপমানিত কর। কল্যাণ তোমারই এখতিয়ারাধীন। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশক্তিমান। তুমি রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবেশ করাও। প্রাণহীনের মধ্য থেকে প্রাণীকে এবং প্রাণীর মধ্য থেকে প্রাণহীনকে বের কর, আর যাকে চাও বিনা হিসাবে জীবিকা দাও।”
তাদের মন থেকে মৃত্যুভীতি দূর করা হয়েছে এই বলে যে, মৃত্যু নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহর অনুমতিক্রমে আসবেই। তাই জীবন বাঁচানোর খাতিরে কর্তব্য পালনে ত্রুটি করলে আয়ু দীর্ঘতর হবেনা। সুতরাং মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে কাজ করে যেতে হবে। এই মূল্যবান শিক্ষা গুলোর পাশাপাশি আরো যে শিক্ষাটা দেয়া হলো তা এই যে, যারা সত্যের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আল্লাহর পথে প্রাণোৎসর্গ করে, তাদের মৃত্যু সাধারন লোকদের মতো মৃত্যু নয়। তাদের মৃত্যু অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। কাজেই তাদেরকে সাধারন মৃত লোকদের মত মৃত ভেবনা ও মৃত বলোনা। তারা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে নবজীবন লাভ করে, তাদের আত্মাগুলো জ্যোতির্ময় জীবিকা লাভ করে, আল্লাহর মহা মূল্যবান উপহার ও পুরস্কার তারা আনন্দিত এবং তাদের সমমনা সাথীদের ব্যাপারেও তারা নিশ্চিত ও পরিতৃপ্ত। এ ভাবে শাহাদাতের একটা উচ্চাঙ্গের তাৎপর্য পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। ফলে আল্লাহর পথে সংঘটিত মৃত্যুর অর্থ এত পাল্টে গেছে যে, মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে তার জন্য দোয়া করতে শুরু করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে রাসুল সা. এই মর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন যে, শহীদদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার জন্য সুর করে, চিৎকার করে বা বুক চাপড়ে কাঁদা চলবেনা। একটা সত্যনিষ্ঠ বিপ্লবী আন্দোলন যখন গড়ে উঠে, তখন তা ঐ বিপ্লবী আন্দোলনের সাথেই মানানসই বিশেষ ধরনের পরিভাষার প্রচলন করে, তার ভিতরে বিশেষ ধরনের তাৎপর্য সন্নিবেশিত করে এবং প্রচলিত ধ্যান ধারনার মর্ম পাল্টে দেয়। এই সমস্ত শিক্ষা থেকে বুঝা যায়, ইসলামে যুদ্ধ কোন দুনিয়াবি বা বৈষয়িক কাজ নয়। বরং এটা খালেস আল্লাহর ইবাদত ও নির্ভেজাল ধর্মীয় দাবী।
(১১) কিছু সংখ্যক মোনাফেক ময়দানে বসেছিল। যুদ্ধের আগে যেমন একটা চরম নাজুক মুহূর্তে মুসলমানদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ও সংগঠনের ঐক্যে ফাটল ধরানোতে তাদের যথেষ্ট হাত ছিল, তেমনি যুদ্ধের পরেও তারা অনেক কানা ঘুষা করেছিলো যে, অমুক অমুক কাজ করলে এমন বিপর্যয় ঘটতোনা। তারা এও বলাবলি করছিল যে, নেতৃত্বে যদি আমাদের কিছু দখল থাকতো, তবে ওহুদ যুদ্ধের এমন ফল দেখা দিতনা। পেছনের সুড়ংগে যে তীরন্দাজ দল ছিল, তাদের মনও পরিস্কার ছিলনা। মদিনায় যখন তাদেরকে জিজ্ঞাস করা হল যে, তোমরা অবস্থান পরিবর্তন করলে কেন, তখন তারা নানা রকম খোঁড়া অজুহাত পেশ করলো। ঐ সব অজুহাত শুনে রসুল সা. বললেন, ‘ওসব কিছুনা। আসলে তোমরা আমার সম্পর্কে ভূল ধারনায় লিপ্ত ছিলে যে, আমি তোমাদের সাথে খেয়ানত করবো এবং আমি তোমাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিবনা’। কোরআন এই ভূল ধারনা দূর করর জন্যই বলেছেঃ “কোন নবীর কাছ থেকে এই প্রত্যাশা করা ঠিক নয় যে, তিনি খেয়ানত করবেন”।( আল ইমরান-১৬১)
(১২) শত্রুরা যখন রাসুল সা. কে আহত করে দিলো, তখন জনৈক সাহাবী তাকে পরামর্শ দিলেন, আপনি এই পাষণ্ডদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করুন যেন আল্লাহ্ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। রাসুল সা. জবাবে বললেন, “আমাকে বিশ্ববাসীর জন্য অভিসম্পাত স্বরূপ নয়, অনুগ্রহ স্বরূপ পাঠানো হয়েছে”। তারপর দোয়া করলেন, ‘ হে আল্লাহ্ আমার জাতিকে সুপথে চালিত করো। তারা (আমাকে, আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে এবং জীবন ও জগত সংক্রান্ত তথ্য সমূহ) জানেনা”। আমরা আগেই বলেছি, এই জবাবে ও এই দোয়ায় রসুল সা. এর সেই দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ পেয়েছে, যার আলোকে তিনি বিরোধীদেরকে বিবেচনা করতেন। তিনি যে কোন প্রকার ব্যক্তিগত প্রতিশোধ স্পৃহা পোষণ করতেননা, তা সুস্পষ্ট। তিনি তাদের ধ্বংস নয় বরং তাদের সংশোধন চাইতেন। তাদের সামরিক কর্মকান্ডের জবাবে তিনি যদি অস্ত্র ধারন করে থাকেন, তবে তিনি নেহাত বাধ্য হয়েই তা করেছেন। কেননা তা না করে তাঁর উপায়ান্তর ছিলনা।
ওহদের পর
যদিও মুসলমানরা ওহুদ যুদ্ধে প্রথমে বিজয়ী ও পরে সাময়িক বিপর্যয়ের শিকার হয়, কিন্তু সর্বশেষ পাল্লা তাদের দিকেই ঝুকতে আরম্ভ করেছিল। বিশেষ করে কোরায়েশ কর্তৃক বিজয়কে অসম্পূর্ণ রেখে সটকে পড়া, মুসলিম বাহিনী কর্তৃক তাদের পিছনে ধাওয়া করা, এবং আবু সুফিয়ান কর্তৃক আর একবার ফিরে আসার ইচ্ছা করার পরও মক্কায় চলে যাওয়া মুসলিম বাহিনীর হিম্মত বাড়াতে সহায়ক হয়েছিল। আসলে কোরায়েশ বাহিনী এই যুদ্ধের চূড়ান্ত ফয়সালা না করেই একে স্থগিত রেখে চলে গিয়েছিল। দু’পক্ষের কেউই অপর পক্ষকে সুস্পষ্টভাবে পরাজিত করতে পারেনি। এই ধরনের পরিস্থিতির অর্থ এটাই হয়ে থাকে যে, “বাকিটা পরে দেখা যাবে”। কোরায়েশের পক্ষ থেকে আবু সুফিয়ান পরিষ্কার ভাষায় চ্যালেঞ্জ দিয়ে গিয়েছিল যে, আগামি বছর বদরের ময়দানে আবার টক্কর দিতে আসবো। বদরের যুদ্ধের যেমন একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বেরিয়ে এসেছিল, ওহুদের যুদ্ধের তেমন কোন চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পাওয়া যায়নি। চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পরবর্তি সময়ের জন্য মুলতবি হয়ে গিয়েছিল।
মুসলিম বাহিনী বিজয়ী না হলেও তা পরাজয়ও ছিলনা। কিন্তু তবু বদরের যুদ্ধের যে প্রভাব আশেপাশের এলাকায় পড়েছিল, তাতে কিছু না কিছু ঘাটতি দেখা গিয়েছিল এবং রক্ষনশীল মোশরেক গোত্র গুলোর আশা আকাঙ্ক্ষা পুনরায় জাহেলী শক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করেছিলো। কোন কোন অপরাধপ্রবন অপশক্তির বিদ্রোহী আচরন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। মদিনার চারপাশের উশৃংখল গোত্রগুলো নতুন করে বিদ্রোহাত্মক তৎপরতা ঔদ্ধত্যের সাথে চালাতে লাগলো। কিন্তু মুসলমানদের সংগঠন এত সংহত ও চৌকস ছিল এবং নেতৃত্ব এত মজবুত ছিল যে, তা প্রতিটি অপতৎপরতা তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিহত করে পরিস্থিতিকে ক্রমান্বয়ে সঠিক খাতে প্রবাহিত করে। এভাবে জনগনকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, ইসলামী সরকার যথেষ্ট প্রানবন্ত, সে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, নাগরিকদের জানমালের হেফাজত ও রাষ্ট্রের অখন্ডতা রক্ষায় কোন ত্রুটি করবেনা। তবু ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব পুনর্বহালে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল।
যেসব বিদ্রোহী শক্তি ওহুদ যুদ্ধের পর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছিলো, তাদের মধ্যে কুতুনের তালহা বিন খুয়াইলিদ ও সালমা বিন খুয়াইলিদই অপতৎপরতার সূচনা করেছিলো। তারা বনু আসাদ গোত্র কে মদিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী তৎপরতা চালাতে প্ররোচিত করে। বিশুদ্ধতর অভিমত সম্ভবত এটাই যে, এক ধরনের সশস্ত্র ডাকাতির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। চতুর্থ হিজরীর মুহররম মাসের চাঁদ উঠার সাথে সাথেই এ পরিকল্পনার খবর জানা গেলো। সঙ্গে সঙ্গে এই বিপদ প্রতিহত করার জন্য আবু সালমা মাখযূমীর নেতৃত্বে দেড়শো যোদ্ধার একটা বাহিনী পাঠানো হলো। তারা কুতুন পৌছামাত্রই ডাকাত দল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। তাদের ছেড়ে যাওয়া পশুর পাল ইসলামী সরকার বাজেয়াপ্ত করলো এবং স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে বিতরণ করে দিলো। ৫ই মুহাররম তারিখে অপর এক দিক থেকে খবর এলো যে, বনু খুযায়েল গোত্রের খালিদ বিন সুফিয়ান মদীনা আক্রমন করার জন্য একটা বাহিনী তৈরি করেছে। আবদুল্লাহ বিন আনিস জুহানী আনসারীকে এদের মোকাবেলায় পাঠানো হলো। আবদুল্লাহ বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়ে খালিদের মাথা কেটে নিয়ে এলেন। সম্পূর্ণ একাকী এক বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব প্রদর্শনের পুরুস্কার স্বরূপ রাসুল সা. তাকে নিজের লাঠি প্রদান করলেন।
এর দু’তিন সপ্তাহ পর পুনরায় একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। সফর মাসের প্রথম দিকে আযাল ও কারা গোত্রের লোকেরা একটা ষড়যন্ত্র পাকিয়ে মদিনায় এলো। তারা রসূল সা. এর কাছে আবেদন জানালো, আমাদের মধ্যে থেকে কিছু লোক মুসলমান হয়ে গেছে। তাদের শিক্ষা দীক্ষার জন্য আপনি কয়েকজন লোক পাঠান। রসুল সা. দশজন জ্ঞানি গুনী লোক পাঠালেন (এ সংখ্যা সহিহ বুখারীর বর্ননা অনুযায়ী প্রদত্ত। ইতিহাস ও সীরাত লেখকদের বর্ননা অনুসারে তারা সাত জন ছিল)। এদের আমীর ছিলেন মুরছাদ ইবনে আবুল মুরছাদ। বনু হুযায়েলের আবাসস্থল রজীতে পৌঁছা মাত্রই তারা খুবায়েব ও যায়েদ ছাড়া সবাইকে হত্যা করে ফেললো। খুবায়েব ও যায়েদকে তারা মক্কার কোরায়েশদের কাছে বিক্রি করে দিলো। কোরায়েশরা উভয়কে শুলে চড়িয়ে হত্যা করে। এ ঘটনা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। এ ঘটনা থেকে বেশ বুঝা যায় যে, ওহুদ যুদ্ধের পর বিরোধীদের স্পর্ধা ও ধৃষ্টতা কত বেড়ে গিয়েছিলো। একটা ক্ষুদ্র দলের একাধিক মূল্যবান ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে সফরে গিয়ে পথিমধ্যেই নৃশংসভাবে শহীদ হলেন। এতে রসূল সা. যে মনে কত বড় আঘাত পেয়েছিলেন, তা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। যাদেরকে ইসলামের জ্ঞান দানের লক্ষ্যে তারা গিয়েছিলেন, সেই নরপশুরা তাদের কাছ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ তো দূরের কথা, বিনা অপরাধে তাদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করলো। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একই মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটলো বীর মাউনায়। আবু বারা আমার বিন মালেক নাজদ অঞ্চল থেকে এসে রসূল সা. এর সাথে দেখা করলো। রসূল সা. তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। সে দাওয়াত গ্রহণও করলোনা প্রত্যাখ্যানও করলো না। তবে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে পরামর্শ দিলো যে, আপনি আপনার সাথীদের একটা দল নাজদে পাঠান। আশা করা যায় লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করবে। রসূল সা. নাজদ সম্পর্কে আশংকা প্রকাশ করলেন। রাজীর ঘটনা মাত্র কয়েকদিন আগেই ঘটেছে। আবু বারা হেফাজতের দায়িত্ব নিলো। নজদ এলাকায় ইসলামী সরকারের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্প্রসারিত করা বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বার্থের তাগিদেই জরুরী হয়ে পড়েছিল, তাই রসূল সা. আবু বারার কথায় বিশ্বাস করে সত্তর জনের একটা দল(এ সংখ্যা বুখারিতে উদ্ধৃত, ইবনে ইসহাকের মতে ৪০ জন) পাঠিয়ে দিলেন। এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীর হাফেজ, ক্বারি ও প্রচারকরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এদের নেতা ছিলেন মুনযির বিন আমর। এই দাওয়াতী প্রতিনিধি দল যখন বীরে মাউনা নামক স্থানে পৌছাল, তখন সেখান থেকে হারাম ইবনে মিলহান বনু আমের গোত্রের সর্দার আমের বিন তুফায়েলের নিকট রসূল সা. এর চিঠি নিয়ে গেলেন। আমের বিন তুফায়েল চিঠি পড়ার আগেই নিজের লোককে ইংগিত দিয়ে তাকে হত্যা করিয়ে ফেললো। এরপর সে বনু আমের গোত্রে ঘোষণা করে দিলো যে, “ তোমরা যে যেখানেই থাক, মদিনা থেকে আগত প্রতিনিধি দলের উপর আক্রমন চালাতে চলে এসো”। কিন্তু বনু আমের আবু বারার প্রতিশ্রুতি ভংগ করতে রাজি হলোনা। তখন এই নৈরাজ্যবাদী বনী সুলাইয়েম গোত্রের শাখা রা’য়ান, যাকওয়ান, উসাইয়া ও বনু লিহয়ানকে দাওয়াত দিলো। তারা প্রস্তুত হলো এবং মদিনার দাওয়াতী প্রতিনিধি দলকে ঘেরাও করে ফেললো। প্রতিনিধি দল বললো, “আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। আমরা এখানে থাকতেও চাইনা। আমরা আরো সামনে এগিয়ে যেতে ইচ্ছুক। তাই আমাদের উপর আক্রমন করোনা”। কিন্তু নরঘাতকরা কোন কথাই শুনলনা। তারা ৬৯ জন কে শহীদ করে ফেললো। ৭০ তম সদস্য কা’ব বিন যায়েদ রক্তাত্ত দেহ নিয়ে লাশের স্তুপে লুকিয়েছিলেন এবং কোন মতে প্রানে বেঁচে মদিনায় পৌঁছে সমস্ত ঘটনা রসূল সা. কে জানালেন। শত্রু পরিবেষ্টিত একটা নবীন দলের এ পরীক্ষা কত মর্মান্তিক ভেবে দেখুন। তাঁর ৬৯ জন সুশিক্ষিত ও সুযোগ্য ব্যক্তি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে একইসাথে শাহাদাত প্রাপ্ত হন। রসূল সা. স্পর্শকাতর এ ঘটনার পর নিদারুনভাবে ব্যথিত ও শোকাতুর হন। তিনি এই হৃদয় বিদারক ঘটনার জন্য এক মাস যাবত ফজরের নামাজে তাঁর প্রিয় সাহাবীদের খুনিদের জন্য বদদোয়া করেন। এই বদদোয়ার পরিভাষাগত নাম কুনুতে নাযেলা।
এই নরপশুদের পাশবিক কর্মকান্ডের বিপরীতে বিশ্ব মানবতার ত্রানকর্তা মহানবী সা. এর আচরণটাও লক্ষ্য করুন। ৭০ জন প্রতিনিধির মধ্যকার একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি আমর বিন উমাইয়া মদিনায় ফেরার পথে এক জায়গায় দু’ব্যক্তিকে গাছের ছায়ার নিচে ঘুমন্ত দেখতে পান। ঐ দুই ব্যক্তি তাঁর কাছে খুনিদের দোসর মনে হওয়ায় তিনি তাদেরকে হত্যা করে ফেলেন। তাঁর এই ধারনা ভুল ছিল এবং তারা উভয়ে মিত্র গোত্রের সদস্য ছিল। রসূল সা. এর জন্য রক্তপণ দিয়ে তাঁর খুনের খেসারত দিলেন। কেননা প্রচলিত জুলুমের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ইনসাফের রাজত্বের প্রতিষ্ঠার জন্যই রসূল সা. এত ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
মদিনা অভ্যন্তরীণভাবে স্থিতিশীল না থাকলে এই সব বাহ্যিক জটিলতা সংশোধন সম্ভব ছিলনা। কিন্তু এখানে কিছু কুচক্রী অপশক্তি বিদ্যমান ছিল এবং তারা নিজেদের জমিজমা, ধনসম্পদ, বড় বড় দুর্গের সুবাদে খুবই প্রভাবশালী ছিল। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসে চরম বিশ্বাসঘাতক সুলভ ষড়যন্ত্র চালাত এবং মুসলমানদের প্রত্যেক কাজে বাধা দিত। বিশেষত ইহুদি গোত্রগুলো মদিনার ঐক্য সংক্রান্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও প্রতিদিন বিদ্রোহাত্মক তৎপরতা চালাত। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটির অধিকারী ছিল বনু নযীর গোত্র। তারা হঠকারিতা ও গোয়ার্তুমীতে মত্ত হয়ে বেপরোয়াভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ওহুদ, রজী ও বীরে মাঊনার ঘটনাবলীর পর তাদের ধৃষ্টতা এত বেড়ে গিয়েছিলো যে, এহেন নাজুক মুহুর্তে রসূল সা. কে হত্যা করার জন্যও তারা প্রকাশ্যে চেষ্টা চালায়। ( এ বিষয়ের উল্লেখ আগেই করেছি)। অতীতের অপকর্মগুলোর পর নতুন করে এই প্রকাশ্য অপচেষ্টা চালাতেও যখন ইহুদীদের বিবেকে বাধলোনা, তখন তাদের সম্পর্কে একটা চুড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অনিবার্য হয়ে পড়লো। রসূল সা. তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও প্রাণহানি এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। [কারণ একে তো ইসলামী আন্দোলন স্বভাবতই হিংস্র ও জঙ্গিবাদী নয়। উপরন্তু বিষয়টা কিন্তু দুনিয়ার একটা স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের। ইসলামী আন্দলনকে এই গোষ্ঠীর প্রভাবাধীন এলাকারই কাজ করতে হতো। নচেত তাদের অপরাধ এতো জঘন্য ছিল যে, তাদের বেঁচে থাকারও অধিকার ছিলনা।] এ জন্য শুধু নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার নোটিশ দিয়ে তাদেরকে দশ দিনের মধ্যে মদিনা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চরম পত্র দিয়ে দিলেন। বেরিয়ে না গেলে তাদের সাথে শত্রুর মতো আচরণ করা হবে-এ কথাও জানিয়ে দিলেন। মোনাফিকদের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই পর্যাপ্ত সাহায্য দেয়ার অঙ্গিকার করে তাদেরকে রসূল সা. এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্ররোচিত করলো। বনু নযীর তার প্ররোচনায় পড়ে ইসলামী সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে দিলো যে, আমরা তোমাদের চরম পত্রের পরোয়া করিনা। যা করতে চাও করো। অগ্যতা চতুর্থ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে রসূল সা. মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে অভিযানে বেরুলেন এবং বনু নযীরকে অবরোধ করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অঙ্গিকার রক্ষা করলনা এবং কেউ তাদের সাহায্যে ছুটে এলোনা। অসহায় হয়ে তারা তাদের জনপদকে খালি করে দিলো। রসূল সা. এর অনুগ্রহে তারা শুধু প্রানে রক্ষাই পেলনা বরং উটের পিঠে চড়িয়ে তাদের মূল্যবান জিনিস পত্রও নিয়ে গেলো। এই চরম উত্তেজনার পরিবেশেও বনী নযীরের ভেতর থেকে দু’জন ভাগ্যবান ব্যক্তি বেরিয়ে এলো, যারা আপন গোত্রের অযৌক্তিক ও অন্যায় আচরনের সাথে সাথে রসূল সা. এর দাওয়াতের সত্যতা ও যথার্থতাও উপলব্ধি করলো এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। তারা ছিল ইয়ামীন বিন উমায়ের ও আবু সা’দ বিন ওহাব।
এ সময় মুসলিম বাহিনী কিছু গাছগাছালি কাটতে বাধ্য হয়। এটা তেমন গুরুতর ব্যাপার ছিলনা। কিন্তু পাশ্চাত্যের প্রচারনাবিদরা এখান থেকেও অপপ্রচারের মালমশলা খুঁজে বের করেছে। এটা ছিল অনিবার্য সামরিক তৎপরতা। আজকালও কোন কোন সেনাবাহিনীকে রাস্তা বানানো, শত্রুর গোপন ঘাটি ধ্বংস করা ও অন্যান্য প্রয়োজনে ক্ষেত্র বিশেষে এ জাতীয় কাজ করতে হয়। এমনকি পুলিশকেও অপরাধী পাকড়াও করতে অনেক সময় এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। দালান কোঠা ভেংগে ফেলতে হয় এবং ক্ষেত খামার ও বাগ বাগিচায় প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করতে হয়।
চরম বিপদসংকুল অবস্থায়ও দুষ্কৃতকারীদের দমন করার মাধ্যমে রসূল সা. শুধু নিজের সমস্যাবলীই কমাননি বরং আশেপাশের লোকদের উপর নিজের প্রতাপ ও ভাবমূর্তি অম্লান রেখেছেন। তারা বুঝেছে যে, ইসলামি সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পুরোপুরিভাবেই বহাল আছে।
আবু সুফিয়ান ওহুদের ময়দানে যে আস্ফালন দেখিয়ে এসেছে, সে অনুসারে একটা শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আক্রমন চালানোর জন্য বেরুলো। এবার তার বাহিনীতে ছিল দু’হাজার পদাতিক ও ৫০ জন আরোহী। রসূলও সা. খবর পাওয়ার সাথে সাথে দেড় হাজার পদাতিক ও দশজন আরোহী নিয়ে বদরের ময়দানে উপস্থিত হলেন। সেখানে শিবির স্থাপন করে একটানা আটদিন কোরায়শী বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করলেন। কিন্তু আবু সুফিয়ান মক্কা থেকে মাত্র এক মঞ্জিল দূরে দাহরান বা উসফান নামক জায়গায় এসে ফিরে গেল। কেননা অনাবৃষ্টির কারণে ঐ বছরটা তার কাছে যুদ্ধের উপযোগী মনে হয়নি। আবু সুফিয়ানের ফিরে যাওয়ার খবর শুনে শেষ পর্যন্ত রসূল সাঃ মদিনায় ফিরে গেলেন।
৪র্থ হিজরীর মুহাররম মাসে (মতান্তরে জমাদিউল উলাতে) বনু গিতফান গোত্রের দুটো শাখা গোত্র বনু মোহারেব ও বনু সা’লাবার পক্ষ থেকে মদিনা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে- এ কথা জানা মাত্রই রসূল সাঃ চারশো (মতান্তরে সাতশো) সেচ্ছাসেবক যোদ্ধার বাহিনী নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। মুসলিম বাহিনীর মোকাবিলার জন্য একটা বাহিনী প্রস্তুত ছিল সত্য। কিন্তু তারা কার্যত যুদ্ধ করতে সক্ষম হয়নি। এই সময়কারই ঘটনা। গুরস নামক এক মোশরেক নিজ গোত্রের কাছে এই সংকল্প প্রকাশ করে বাড়ী থেকে বের হয় যে, আমি মুহাম্মাদ সাঃ কে হত্যা করেই বাড়ী ফিরবো। সে যখন এল, রসূল সাঃ একাকী একটা গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তাঁর তলোয়ার গাছের ডালে ঝুলছিল। গুরস ঐ তলোয়ার খানাই হাতে নিয়ে উত্তোলন করে বললো, “বল এখন তোমাকে কে বাঁচাতে পারে।” রসূল সাঃ সম্পূর্ণ নির্ভয়ে বললেন, “আল্লাহ বাঁচাতে পারেন।”
দু’মাতুল জানদাল বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোর মিলনস্থল ছিল, আবার সেখানে খৃষ্টান ও ইহুদীদের ধর্মপ্রচারক এবং রাজনৈতিক গোয়েন্দারাও সক্রিয় ছিল। অন্যদিকে বনু নযীর খয়বর প্রভৃতি জায়গায় যেয়ে আশ্রয় নেয়ার কারণে মদিনার বিরুদ্ধে তাদের নানা রকম ষড়যন্ত্র করার আড্ডাখানা হয়ে উঠেছিল। বিশেষত এ ঘটনাটা খুবই রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন যে, মক্কার কোরায়েশ ও খয়বরের ইহুদীদের যোগসাজসের আওতাধীন খৃষ্টান নেতা উকায়দার মদিনার জন্য খাদ্যশস্য বহনকারী কাফেলাগুলোকে উত্যক্ত করা শুরু করে। রসূল সাঃ জানতে পারলেন, দু’মাতুল জানদালে শত্রুরা তাদের বাহিনী একত্রিত করে মদিনায় আক্রমন করতে চায়। ৫ম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে রসূল সাঃ এক হাজার সৈন্য নিয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে ঐ জায়গা অভিমুখে রওনা দিলেন। দু’মাতুল জানদালের উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনীর রওনা হবার খবর পৌঁছামাত্রই শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। রসূল সাঃ আর সামনে এগুনোর প্রয়োজন অনুভব করলেন না। তিনি পথিমধ্যে মিত্র সংগ্রহের জন্য কাজ করলেন। এই পর্যায়ে আইনিয়া বিন হাসীনের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হলো। পরে ৭ম হিজরীতে হযরত আবদুর রহমান বিন আওফ একটা দাওয়াতী রাজনৈতিক অভিযান নিয়ে গেলেন এবং কালব গোত্রের মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হলো। এরপর নবম হিজরীতে তবুক অভিযানের সময় এ এলাকার ওপর ইসলামী রাষ্ট্রের বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়।
এবার বনুল মুসতালিক সম্পর্কে খবর পাওয়া গেল যে, তারা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বুরাইদা আসলামীকে পাঠিয়ে তদন্ত করানো হলেও ঘটনা সত্য বলেই প্রমাণিত হলো। অগত্যা রসূল সাঃ ৩রা শা’বান সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। অত্যন্ত দ্রুতগতিতেই তিনি মুরাইদীতে (জলাশয়) গিয়ে পৌঁছলেন। বনুল মুস্তালিকের সরদার হারেস বিন যিরার যুদ্ধ করতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু রসূল সাঃ অতর্কিতে সেখানে উপস্থিত হওয়ায় তার সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। থেকে গেল শুধু তার নিজ গোত্রের লোকজন। প্রথম আঘাতেই হারেসের বাহিনী পুরোপুরি পরাজিত হলো। বহুসংখ্যক পশু গনীমতের সম্পদ হিসেবে হস্তগত হলো এবং গোত্রের সকল নারীপুরুষ যুদ্ধবন্দীতে পরিণত হলো। এই সব বন্দীর মধ্যে ছিলেন জুয়াইরিয়া নাম্নী এক মহিলা। তিনি রসূল সাঃ এর সামনে কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে বললেন, আমি মুসলমান অবস্থায় হাজির হয়েছি। রসূল সাঃ তাঁর সম্মতিক্রমে তাকে বিয়ে করলেন। এর ফল হলো এই যে, মুসলিম বাহিনি বনুল মুসতালিকের সমস্ত বন্দীকে এই বলে মুক্ত করে দিল যে, আমরা রসূল সাঃ ‘র আত্মীয়স্বজনকে বন্দী রাখতে পারিনা।
এই যুদ্ধেই ইসলামের বিজয়ের দৃশ্য দেখে মোনাফেকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা প্রথমে পানি নিয়ে ঝগড়া বাধায় এবং মোহাজের ও আনসারদের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টির প্রয়াশ পায়। ফেরার পথে মোহাজেরদেরকে মদিনা থেকে বের করে দেয়ার জন্য আনসারদেরকে উত্তেজিত করতে থাকে। এই সফরেই হযরত আয়েশা কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে থাকে অপবাদের কবলে পড়তে হয়। এ সব কাহিনী ইতিপূর্বে বর্ণনা করে এসেছি।
ওহুদ যুদ্ধের পর খন্দক যুদ্ধের আগে এই সব ছোট খাট ঘটনা ঘটে। ইসলামী রাষ্ট্রকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে, আইন শৃংখলা বহাল করা ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রয়োজনেই এ সব পদক্ষেপ গ্রহন করতে হয়। এ সবের মধ্যে কেবল শিক্ষক প্রতিনিধি সংক্রান্ত ঘটনাবলী ছাড়া অন্য সব ঘটনায় কখনো শুধু সীমান্তে সৈন্য পাঠানো হয়, আর কখনো নিছক পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নির্ভেজাল সামরিক সংঘর্ষ খুবই কম ঘটেছিল এবং খুবই ক্ষুদ্র আকারের ছিল। ওগুলোকে অনর্থক গুরুত্ব দিয়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করলে পাঠকের মনে ভুল ধারণা জন্মাতে পারে। আসল অবস্থা ছিল এই যে, আরবের সমাজ বিভিন্ন ছোট বড় গোত্রে বিভক্ত ছিল। আর প্রত্যেকটা গোত্র, এমনকি গোত্রের শাখাগুলোও নিজ নিজ বলয়ে স্বতন্ত্র প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক একক ছিল। কখনো এওকটা গোত্র বিদ্রোহ করতো, আবার অন্যটা আক্রমণ বা ডাকাতি করতে উদ্যত হতো। একটার দুস্কৃতি বন্ধ করলে আর একটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। এ পরিস্থিতে যখনই একটা কেন্দ্রীয় প্রশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হতো, তখন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছোট বড় গোত্রগুলোর সাথে সংঘাত সংঘর্ষের ঝুঁকি না নিয়ে কখনো তাতে সাফল্যের কোন সম্ভাবনা ছিলনা।
তৃতীয় বড় যুদ্ধ – খন্দক
ওহুদের যুদ্ধে যদিও কোরায়েশ মুসলমানদেরকে এক হাত দেখানোর একটা সুযোগ ঘটনাক্রমে পেয়ে গিয়েছিল এবং দৃশ্যত তারা এর মধ্য দিয়ে বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েও নিয়েছিল। কিন্তু তারা ভালো করেই বুঝেছিল যে, আসলে তারা ওহুদের ময়দান থেকে বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফেরেনি। তারা এও বুঝতে পেরেছিল যে, এখন তারা তাদের বর্তমান ক্ষমতার জোরে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে পরাভূত করতে সক্ষম নয়। তাই তারা এক বছরের বিরতিতে আরো বেশী প্রস্তুতি গ্রহণ ও সৈন্য সংগ্রহের পরে যুদ্ধ করার সংকল্প নিয়ে ওহুদ থেকে বিদায় নিয়েছিল। এ সংকল্প আবু সুফিয়ান প্রকাশও করেছিল। কিন্তু এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মক্কা থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে বের হওয়ার পর পরিস্থিতির প্রতিকূলতার কারণে তারা ফিরে গেল। কোরায়েশ ও ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য ছিল। সে পার্থক্যটা হলো, কোরায়েশের জাহেলী শিবির স্বীয় প্রাণশক্তির দিক দিয়ে স্থবির ও দুর্বল ছিল তার মধ্যে বিকাশ ও বৃদ্ধি লাভের কোণ যোগ্যতা ছিলনা। বরঞ্চ তার কিছু কিছু শক্তি সব সময় তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের পাল্লায় পড়ছিল। মদিনার ইসলামী শক্তি ছিল একটা আদর্শবাদী, দাওয়াতী ও গণমুখী শক্তি। তাই এটা ছিল সদা সক্রিয়, কর্মব্যস্ত, বিকাশমান ও সম্প্রসারণশীল। এই মৌলিক পার্থক্যের কারণে সময়ের আবর্তন মদিনার পক্ষে লাভজনক প্রমাণিত হচ্ছিল। নৈতিক প্রশিক্ষণ ও চারিত্রিক পরিশুদ্ধি, চুক্তিভিত্তিক মৈত্রী সম্পর্ক, প্রতিরক্ষামূলক শক্তি, জনশক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি ও ভূমি স্বত্ত্বের প্রসার-সব দিক দিয়েই মদিনা ক্রমেই স্ফীত, সম্প্রসারিত ও শক্তিমান হয়ে চলছিল। ইসলামী রাষ্ট্র কোরায়েশদের বাণিজ্যিক পথ কার্যত বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে মক্কা অর্থনৈতিক সংকটে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। ইসলামী রাষ্ট্র ওহুদ যুদ্ধের পর দু’বছর বহু জটিলতার শিকার হওয়া সত্বেও যথেষ্ট উন্নতি করেছিল। পক্ষান্তরে কোরায়েশ যে যুদ্ধকে এক বছরের জন্য স্থগিত করেছিল, সে যুদ্ধ এক বছর বিলম্বিত হওয়ার কারণে তা এখন তাদের কাছ থেকে আরো বেশি আগ্রাসী শক্তি সঞ্চয়ের দাবী জানাচ্ছিল। একা কোরায়েশদের পক্ষে প্রয়োজনীয় এত শক্তি যোগান দেয়া সহজসাধ্য ছিলনা। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের রকমারি শ্ত্রুরা পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার কারণে পারস্পরিক ঐক্যের পথ খুঁজে নিয়েছিল। মদিনা থেকে বিতাড়িত যেসব ইহুদী খয়বর ও ওয়াদিওল কুরাতে বসতি স্থাপন করেছিল, তারা কোরায়েশকে মদীনায় হামলা করতে প্ররোচিত করার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াচ্ছিল। মদিনার জন্য খাদ্যশস্য বহনকারী কাফেলাগুলোর পথে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের অপতৎপরতার সূচনা করে। এইসব নির্বাসিত ইহুদী যখন ওহুদ যুদ্ধের ফলাফল জানতে পারলো এবং আবু সুফিয়ানের পুনরায় আক্রমণ চালানোর সংকল্পের কথা শুনলো, তখন তাদের উদ্যম ও উৎসাহ আর দেখে কে। তারা জনশক্তির অধিকারি বনুগিতফানকে খয়বরের খেজুরের পুরো এক বছরের উৎপন্ন ফসল এবং ভবিষ্যতেও একটা নির্দিষ্ট অংশ দেয়ার অংগীকার করে মদিনার ওপর আক্রমণ করতে প্ররোচিত করলো। এতখানি কাজ সম্পন্ন করার পর তারা মক্কায় একটা প্রতিনিধিদল পাঠালো। এই প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভূক্ত ছিল সালাম বিন আবিল হাকীক, সালাম বিন মুশকাম, হুয়াই বিন আখতাব, কিনানা বিন রবী (বনু নযীর), হাওযা বিন কয়েস ও আবু আম্মারা (বনু ওয়েল) প্রমুখ বড় বড় ইহুদী নেতারা। তারা কোরায়েশকে নিশ্চয়তা দিল যে, তোমরা আক্রমণ চালালে আমরা মুহাম্মদ সাঃ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তোমাদের পূর্ণ সাহায্য সহযোগিতা দিতে থাকবো। এই প্রতিনিধিদল মক্কা থেকে পুরোপুরি কৃতকার্য হয়ে ফিরলো এবং ফেরার পথে বনু গিতফান ও অন্যান্য গোত্রের সাথেও দেখা করলো। কোরায়েশরাও তাদের মিত্র ও সমর্থকদের সাথে আলাপ আলোচনা চালালো এবং আহাবীশদেরকেও সাহায্যের জন্য ডাকলো। মোটকথা, এবার জাহেলী শক্তি সমগ্র আরব থেকে তার সমর্থক শক্তি যোগাড় করলো।
আবু সুফিয়ানের সেনাপতিত্বে চার হাজার সৈন্য মক্কা থেকে রওনা হলো। এতে অন্তর্ভূক্ত ছিল তিন হাজার ঘোড়া ও এক হাজার উট। এই বাহিনী যখন মাররুয যাহরান পৌঁছলো, তখন কোরায়েশের অন্যতম মিত্র বনী সুলায়েম, বনু আসাদ, ফাযারা, আশজা ও বনু মাররা প্রভৃতি গোত্র নিজ নিজ এলাকা থেকে থেকে বেরিয়ে কোরায়েশ বাহিনীর সাথে যুক্ত হলো। বনু গিতফান উয়াইনা বিন হিসনের নেতৃত্বে বেরুলো। এভাবে কোরায়েশী বাহিনীর লোকসংখ্যা সর্বমোট কততে দাঁড়ালো, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে ৬ থেকে ৭ হাজার, কারো মতে ১০ হাজার এবং কারো মতে ২৪ হাজার। তবে অধিকাংশের মতে সংখ্যা ছিল দশ হাজার এবং এটাই অগ্রগন্য মত।
রসুল সাঃ যখন দুমাতুল জানদাল সফরে ছিলেন, তখনই এসব প্রস্তুতির কথা জেনে ফেলেছিলেন। এ জন্য তিনি দ্রুত ফিরেও এসেছিলেন। পরামর্শ সভা বসলো। স্থির হল যে মদিনায় বসেই হামলা প্রতিহত করা হবে। শহরের প্রতিরক্ষার জন্য ইরানী পদ্ধতিতে পরীখা বা খন্দক খনন সংক্রান্ত হযরত সালমান ফারসীর পরামর্শ গ্রহণ করা হলো। এর একটা উপকারিতা এই ছিল যে, অভিনব এই প্রতিরক্ষা কৌশল আরব হানাদারদের বেকায়দায় ফেলে দিতে সক্ষম ছিল। তা ছাড়া একটা উঁচু ও মজবুত প্রাচীর দ্বারা যে কাজ সমাধা হতে পারতো, সেই কাজ নিছক শারিরিক পরিশ্রম দ্বারাই সমাধা করা যেত। এই পদ্ধতিতে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য দ্বারা বিপুল সংখ্যক শত্রু সেনাকে ঠেকানো সম্ভব ছিল। রসুল সাঃ ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নিজেই পরিখার নকশা স্থির করতে বেরুলেন। মদিনা শহরটা তিন দিক থেকেই বাড়ী-ঘর ও প্রাচীর ঘেরা বাগবাগিচায় আবদ্ধ ছিল। তাই ঐ তিন দিক পরিখা খননের কোনই প্রয়োজন ছিলনা, পরিখার প্রয়োজন ছিল শুধু উত্তরের খোলা দিকে। স্থির হলো, হাররায়ে শারকী ও হাররায়ে গারবী (পূর্বের প্রস্তরময় প্রান্তর ও পশ্চিমের প্রস্তরময় প্রান্তর) কে যুক্ত করে এমন একটা অর্ধবৃত্তাকার পরিখা সিলা পর্বতের পশ্চিম কিনার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিতে হবে। এই আংশটার খনন কার্যত সামরিক ব্যবস্থাপনায় করানো হলো। তবে কোন কোন গোত্র নিজ নিজ বাড়ীঘরের রক্ষণাবেক্ষণের খাতিরে নিজস্ব উদ্যোগে পরিখা আরো বাড়িয়ে নিল। ফলে পরিখা দক্ষিণে ঈদগাহের (মসজিদে গামামার) পশ্চিম দিক দিয়ে টেনে নিয়ে কোবার দিকে অনেক দূর পর্যন্ত লম্বা করা হলো। যে তিন হাজার মুসলিম মোজাহেদের উপর পরবর্তীতে সরাসরি যুদ্ধ করার দায়িত্ব অর্পিত ছিল, তারাই খন্দক খননে স্বেচ্ছা শ্রমিকের ভূমিকা পালন করলো। দশ দশ জনের এক একটা গ্রুপ বানানো হলো এবং প্রত্যেক গ্রুপকে দশ গজ করে খন্দক খননের কাজ অর্পন করা হলো। খন্দক আনুমানিক দশ গজ চওড়া করা হয়েছিল। কেননা কোন কোন ঘোড় সওয়ার শত্রুসেনা খন্দকের ওপর দিয়ে ঘোড়াকে লাফিয়ে পার করতে গিয়ে ভেতরে পরে মারা গিয়েছিল। খন্দকের গভীরতাও সম্ভবত পাঁচ গজের কম ছিলনা। আর এর দৈর্ঘ ছিল সাড়ে তিন মাইল। মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকরা মাত্র তিন সপ্তাহে এত বড় কাজ কিভাবে সম্পন্ন করলো, তা ভাবতেও বিষ্ময়ে স্তম্ভিত হতে হয়। প্রায় তিন লাখ আট হাজার বর্গগজ মাটি খনন করতে ও তা স্থানান্তর করতে হয়েছে। সরঞ্জামাদির ব্যাপারে অবস্থা ছিল এই রকম যে, মাটি কাটা ও খনন করার কিছু কিছু উপকরণ চুক্তির আওতায় বনু কুরায়যার কাছ থেকে ধার নেয়া হয়েছিল। ঝুড়ি-টুকরীর অভাবে সাধারণ মুসলমানরা তো দুরের কথা, আবু বকর ও ওমরের রাঃ মত ব্যক্তিরাও চাদরে ও আঁচলে ভরে ভরে মাটি তুলছিলেন। খন্দকের সাথে জায়গায় জায়গায় উঁচু উঁচু পর্যবেক্ষণ মঞ্চ বানানো হয়েছিল। ঐ সব মঞ্চ থেকে খন্দকের সকল অংশ এক সাথে তদারক করা যেত।
খন্দক খননের কাজ কোন মতে হতে না হতেই ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সম্মিলিত শত্রুবাহিনী মদিনার উপকন্ঠে এসে পৌঁছলো। কোরায়েশ কিনানা ও আহাবিশ সৈন্যরা ওয়াদিয়ে আকীকের কাছাকাছি রওমার কূপের কাছে শিবির স্থাপন করলো। গিতফান ও বনু আসাদ পূর্বদিকে ওয়াদিউন নুমানের কাছে যাম্বু নকমা নামক জায়গা থেকে নিয়ে ওহুদ পর্বত পর্যন্ত ছড়িয়ে শিবির স্থাপন করলো। অন্যদিকে মুসলিম বাহিনী সিলা পর্বতকে পেছন দিকে রেখে কেন্দ্রীয় শিবির স্থাপন করলো, এখানে যে স্থানটায় রসুল সাঃ এর শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার স্মৃতি হিসাবে সেখানে আজও মসজিদুল ফাতহ বিদ্যমান।
ইসলামের শত্রুরা যদিও বিপুল সংখ্যায় কাতারবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই খন্দক বা পরিখা তাদের জন্য এক নতুন সমস্যা হয়ে দেখা দিল। এ ধরনের প্রতিরোধব্যুহ তারা আর কখনো দেখেনি। এই কৌশল সম্পর্কে তারা একেবারেই অজ্ঞ ছিল। তাদের ঘোড়া ও উট খন্দকের বহিসীমান্ত পর্যন্তই কার্যোপযোগী ছিল। দু’একজন ঘোড় সওয়ার সৈনিক অতি উৎসাহে লাফিয়ে খন্দক পার হবার চেষ্টা করতে গিয়ে খন্দকে পড়ে মারা গিয়েছিল। তারা বিভিন্ন দিক থেকে ছুটে আসতো। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর সৈনিকরা কোন রকম শৈথিল্য না দেখিয়ে তৎক্ষণাৎ তাদের সামনে এসে দাঁড়াতো এবং তীর নিক্ষেপকারী শত্রুদের মুখ ফিরিয়ে দিত। তরবারী ও বর্শা একেবারেই অকর্মণ্য ছিল। প্রতিদিনই উভয় পক্ষ থেকে কিছু কিছু তীর নিক্ষেপণ চলতো। কয়েকদিনের অবরোধে বিরক্ত হয়ে একদিন শত্রুবাহিনী খুব জোর দেখালো। কখনো এখান থেকে এবং কখনো ওখান থেকে হামলা করলো, কিন্তু কোনই লাভ হলোনা। অবশেষে কোরায়েশ বাহিনীর খ্যাতনামা প্রবীন ঘোড়সওয়ার যোদ্ধা ওমর বিন আবদু উদ আবেগে মাতোয়ারা হয়ে ছুটলো। সে আবু জাহেলের ছেলে ইকরামা, হুবাইরা বিন আবু ওহব এবং যিরার ইবনুল খাত্তাবকে উস্কে দিল এবং বনু কিনানার কিছু লোককে সাথে নিয়ে নিল। অবশেষে একটা সুবিধাজনক জায়গা দেখে ঘোড়াকে লাফিয়ে পার করলো। তার পিছু পিছু দু’একজন সাথীও খন্দক পার হয়ে গেল। অন্যরা সবাই খন্দকের কিনারে দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে গিয়ে সে মুসলমানদেরকে যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দিল। হযরত আলী তার মোকাবিলায় এগিয়ে এলেন এবং সামান্য আঘাত খেয়ে তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। এই একটা দিন মুসলিম বাহিনীর জন্য এত কঠিন ছিল যে, বিভিন্ন দিক থেকে আগত শত্রুদেরকে প্রতিহত করতে গিয়ে চার ওয়াক্ত নামাজ কাযা হয়ে গেল।
অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়াটা মুসলমানদের জন্য উদ্বেগজনক ছিল। কিন্তু শত্রুরাও এতে বিচলিত ছিল। অনেক সলাপরামর্শের পর একটা চুড়ান্ত হামলা করার জন্য স্থির করা হলো যে, ইহুদী গোত্র বনু কুরায়যাকে রসুল সাঃ এর সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং তারা ভেতর থেকে হামলা চালাবে। আবু সুফিয়ানের অনুরোধে হুয়াই বিন আখতাব এ দায়িত্ব গ্রহণ করলো। সে বনু কুরায়যার সর্দার কা’ব বিন আসাদের সাথে দেখা করলো এবং নিজের বক্তব্য পেশ করলো। কা’ব প্রথমে তো অস্বীকার করলো। সে বললো, আমি মুহাম্মদ সা. কে সব সময় ওয়াদা পালন করতে দেখেছি। কাজেই তাঁর সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করা অত্যন্ত অমানুষিক কাজ হবে। কিন্তু হুয়াই বিন আখতাব সর্বাত্মক জোর দিয়ে অনুরোধের পুনরাবৃত্তি করলো এবং বললো, “আমরা অগণিত সৈন্য নিয়ে এসেছি। সমগ্র আরব জাতি আমাদের সাথে চলে এসেছে। গোটা বাহিনী মুহাম্মাদের সা. রক্তের নেশায় বিভোর। এ সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক নয়। এখন ইসলামের অন্তিম সময় উপস্থিত।” মোটকথা, প্ররোচনার কৌশলটা সফল হলো। আর বিষয়টা তাৎক্ষনিকভাবে মুসলমানদের কানে চলে গেলো। রসূল সা. ব্যাপারটার সত্যাসত্য তদন্ত করলেন। তদন্তেও সঠিক প্রমানিত হলো। সাহাবাদের একটা দল যখন বিষয়টা সত্য বলে সাক্ষ্য দিল, তখন রাসূল সা. এর মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারিত হলো, “আল্লাহু আকবার! হাসবুনাল্লাহ ওয়া নিমাল ওয়াকিল।” (“আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট। তিনি উৎকৃষ্টতম অভিভাবক।”)
রণাঙ্গনের ব্যাপকতা, অবরোধের দীর্ঘস্থায়ীত্ব, সৈন্য স্বল্পতা, সাজ সরঞ্জামের অভাব, ক্ষুধার প্রচণ্ডতা, সেই সাথে নিদ্রাহীনতা, মোনাফেকদের নানা রকমের খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে রণাঙ্গন থেকে সটকে যাওয়া এবং ব্যাস্ততার আতিশয্যে নামায পর্যন্ত ক্বাযা হয়ে যাওয়া- এ সব কোন মামুলী পরীক্ষা ছিলনা। উপরন্তু যখন মদিনার অভ্যন্তরে বিশ্বাসঘাতকতার আশংকা ছড়িয়ে পড়লো এবং দেড় হাজারেরও বেশী যোদ্ধা পুরুষ যোগান দিতে সক্ষম বনু কুরায়যার অতর্কিতভাবে গৃহশত্রু বিভীষণের ভুমিকায় নেমে যাওয়ার মত পরিস্থিতি যখন সৃষ্টি হয়ে গেল, তখন তিন হাজার মরণপণ মোজাহেদের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, তা আজ অনুমান করা কঠিন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. জানান, এ খবরটা জানার পর আমাদের মধ্যে আশংকা ছড়িয়ে পড়েছিল যে, আমাদের বাড়ীতে নারী ও শিশুদের উপর হামলা হতে পারে। এই আশংকার কারণে আমরা বারবার পাহাড়ের উপর উঠে দেখতাম, কোন ঘটনা ঘটে গেল নাকি। নিজেদের বাড়ীঘর শান্ত দেখলে আল্লাহর শোকর আদায় করতাম। রাসূল সা. তিনশো মোজাহিদের একটা বাহিনী মদিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পাঠালেন। এই সময়কার পরিস্থিতির চিত্র কোরআন যেভাবে তুলে ধরেছে, তা হলোঃ
“স্মরণ কর, যখন শত্রুরা ওপর থেকেও এবং নিচ থেকেও তোমাদের দিকে অগ্রসর হলো, যখন তোমাদের চক্ষুগুলো স্থির হয়ে গেল এবং হৃদয়গুলো মুখের কাছে এসে গেল, আর আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদের মনে নানা রকমের ধারণা ঘুরপাক খেতে লাগলো।”
(আহযাব-১০)
বস্তুত এই ঘটনায় মুসলমানদের যে ধরনের কঠিন পরীক্ষা হয়েছিল, তেমন পরীক্ষা পূর্ববর্তী বড় বড় দুটো যুদ্ধের কোনটাতেই হয়নি। ওহুদ যুদ্ধে অবর্ণনীয় কষ্ট হয়েছে সত্য। কিন্তু যা কিছুই হয়েছে, একদিনে হয়ে গেছে। কিন্তু এবারের দুঃখকষ্ট ছিল দীর্ঘস্থায়ী, আর হানাদার শুধু কোরায়েশরা ছিলনা, আরো অনেকে ছিল। মুসলমানদের দুঃখ কষ্ট দেখে রসূল সা. এই কৌশল উদ্ভাবন করলেন যে, শত্রু বাহিনীর কোন না কোন অংশকে আপোষমূলক চেষ্টাতদবির দ্বারা রণাঙ্গন থেকে সরিয়ে দিতে হবে। প্রচণ্ড অর্থলোলুপ বনু গিতফানের দুই সরদারকে তিনি ডেকে আনালেন এবং কথাবার্তা বললেন। তাদেরকে তিনি মদিনার মোট উৎপন্ন ফসলের এক তৃতীয়াংশ দিয়ে আপোষ রফা করাবার প্রস্তাব দিয়ে সমঝোতায় উপনীত হলেন এবং চুক্তির খসড়াও তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু সাক্ষর দেয়ার আগে তিনি সাদ বিন মুয়ায ও সাদ বিন উবাদা (আওস ও খাজরাজের সরদার) এর কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরী মনে করলেন। তিনি তাদের উভয়কে বুঝালেন যে, “তোমারা এত বিপুল সংখ্যক শত্রুর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে গেছ যে, তাদেরকে প্রতিহত করা সহজ নয়। তাই শত্রুর শক্তি খর্ব করার এ ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।” উভয়ের আত্মাভিমান জেগে উঠলো। তারা বললো, “হে রসূল, আমরা যখন কাফের ছিলাম তখনো তো এইসব গোত্র আমাদের ধনসম্পদ এভাবে নিতে পারেনি। আর আজ যখন আমরা ইসলাম গ্রহণ করে আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেছি, তখন তাদের হাতে আমাদের সম্পদ এভাবে সোপর্দ করবো? আল্লাহর কসম, এটা কখনো হতে পারেনা। আমাদের এমন চুক্তির দরকার নেই।” রসূল সা. এই জবাব শুনে যারপর নাই খুশী হলেন। তিনি চুক্তির খসড়াটা হযরত সাদের কাছে দিলে সা’দ তা ছিড়ে ফেললেন।
তথাপি পরিস্থিতির জটিলতা যথাস্থানে বহালই ছিল। আল্লাহ তায়ালা সহসা একটা সমাধান বের করে দিলেন। এটা ছিল একটা বিস্ময়কর ঘটনা এবং ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সত্যতার উজ্জ্বলতম নিদর্শন। এহেন প্রলয়ংকরী মুহূর্তে সহসা নঈম ইবনে মাসঊদ সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি রসূল সা. এর কাছে এসে বললেন, “হে রসূল, আমি মুসলমান হয়ে গেছি।” এই বলে তিনি প্রকাশ্যে কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে নিজের বিশুদ্ধ আকীদা ঘোষণা করলেন। তারপর বললেন, “এখনো যেহেতু শত্রুরা আমার ইসলাম গ্রহণের খবর জানেনা। সুতরাং যদি অনুমতি দেন, তবে আমি কোরায়েশ ও বনু কুরায়যার ঐক্য ভাঙ্গার জন্য কিছু কাজ করতে পারি।” রসূল সা. অনুমতি দিলেন। নঈম বনু কুরায়যার কাছে গেলেন। তাদের সাথে প্রাথমিক কথাবার্তার পর তিনি তাদের বললেন, ‘যদি বিজয় অর্জিত হয় তাহলে তো ভালো কথা। কিন্তু পরাজয় যদি কপালে জোটে, তাহলে কী হবে ভেবে দেখ। পরাজিত হলে কোরায়েশ ও গিতফান সবাই চলে যাবে এবং তোমরা একাই মুহাম্মদ সা. এর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে। কাজেই তোমরা কোরায়েশ ও গিতফানকে বল, তারা যেন তাদের কয়েকজন লোককে তোমাদের কাছে যিম্মী হিসেবে রেখে দেয়। এই শর্ত পূর্ণ করলে তাদের সাথে সহযোগিতা কর, নচেত ওদের থেকে পৃথক হয়ে যাও।’ এরপর নঈম কোরায়েশ নেতাদের কাছে গেলেন। তাদেরকে বললেন যে, আমার কাছে কিছু তথ্য রয়েছে, যা তোমাদেরকে জানানো আমি জরুরী মনে করছি। বনু কুরায়যা এখন মত পাল্টে ফেলেছে। এর প্রমাণ আপনারা অচিরেই পেয়ে যাবেন। তারা আপনাদের কাছে কিছু লোক যিম্মী হিসেবে চাইবে। ফলে কোরায়েশ বনু কুরায়যাকে জানালো যে আমরা এই দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ আর সহ্য করতে পারছিনা। এখন তোমরা যদি আমাদের সাথে সহযোগিতা কর, তবে একটা চূড়ান্ত হামলা চালাবো। বনু কুরায়যা তাদের কিছু লোক যিম্মী রাখার দাবী জানালো। এবার কোরায়েশ নঈমের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করলো। বনু কুরায়যার ওপর তাদের আর আস্থা থাকলোনা। এই কৌশলের ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতির চিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেল।
ইসলামের শত্রুদের ঐক্যে ফাটল ধরার কারণে তারা ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করতে লাগলো। প্রায় এক মাস হয়ে গেল, তারা বাড়ী থেকে বেরিয়েছে। কাজকর্মের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। অনেক টাকা পয়সা ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে। অথচ তাতে কোন ফায়দা হলোনা। এদিকে এত বিশাল বাহিনী ও তার পশুদের রসদের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলো। কোরায়েশদের রসদের একটা বিরাট অংশ পথিমধ্যে একটা মুসলিম বাহিনীর হস্তগত হলো। তাছাড়া আবহাওয়াও প্রতিকূল হয়ে গেল। ঠাণ্ডা সহ্যের বাইরে চলে গেল। এ ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীতে প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর প্রভাব খুবই মারাত্মক হয়ে থাকে। আল্লাহর ইচ্ছার সামান্য একটা ইংগিত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান করে দেয়। ইতিহাসের সাক্ষ্য এই যে, প্রাকৃতিক উপাদান যুক্ত হয়ে অনেক সময় অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় সত্যের পাল্লাকে ভারী করে দেয়। এক রাতে সহসা এমন ঝড় এল যে, হানাদারদের তাবু উৎপাটিত হয়ে গেল, চুলো নিভে গেল, হাড়িপাতিল ও তৈজসপত্র সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল, পশুরা ভড়কে গেল। এক কথায়, তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা একেবারেই বরফ হয়ে গেল। তারা ভীষণ আতংক গ্রস্ত হয়ে যুদ্ধ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে লাগলো। এই গায়েবী সাহায্যের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন:
“আল্লাহর সেই অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যখন তোমাদের বিরুদ্ধে সৈন্যসামন্ত সমবেত হলো, আর আমি তাদের ওপর ঝড় পাঠিয়ে দিলাম এবং সেই গায়েবী বাহিনী পাঠালাম যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি।” (সূরা আহযাব-৯)
সৈন্যদের মধ্যে সর্বব্যাপী ত্রাস, হতাশা দেখে আবু সুফিয়ান বুঝতে পারলো যে, তাদের পক্ষে আর বেশী দিন টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই অকস্মাৎ তারা মদিনা থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। রসূল সা. বললেন, “এখন কোরায়েশদের আক্রমণের যুগ শেষ হলো।” অর্থাৎ তাদের নিজেদের একক শক্তির ধার তারা বদর ও ওহুদে পরীক্ষা করেছে। আর খন্দকে তারা সারা আরব থেকে মিত্রদেরকে সাথে নিয়ে সংঘবদ্ধ আক্রমণ চালিয়েছে। এ আক্রমণও বিফলে গেল। এখন যেহেতু এত শক্তি একত্রিত করা তাদের পক্ষে আর ভবিষ্যতে সম্ভব হবেনা, কাজেই কোরায়েশ আর কিভাবে ভবিষ্যতে যুদ্ধ করতে সক্ষম হবে? পরবর্তীকালের যুদ্ধে তো আরো বেশী শক্তির প্রয়োজন হবে।
এ যুদ্ধে উভয় পক্ষেই খুব কম প্রানহানি হয়েছে। মুসলিম বাহিনীতে হয়েছে অনেক কম। তাদের মোট ৬ ব্যক্তি শহীদ হন। তবে এদের মধ্যে হযরত সা’দ ইবনে মুয়াযের ন্যায় অসাধারণ ব্যক্তিও ছিলেন। তিনি তীরের আঘাতে আহত হন এবং কয়েকদিন পর ইন্তিকাল করেন।
খন্দক যুদ্ধের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
এ যুদ্ধের শিক্ষামূলক বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
১- সবচেয়ে বেশী ঈমান বৃদ্ধিকারী বিষয় ছিল মুসলিম সেচ্ছাসেবকদের মরণপণ উৎসাহ উদ্দীপনা। তারা শুধু যে এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে সামগ্রিকভাবে পরম ধৈর্য্য ও অটুট মনোবলের পরিচয় দিয়েছেন তা নয়, বরং খন্দক খননের কাজটা এমনভাবে সম্পন্ন করলেন যেন জ্বিনদের কোন বাহিনী পৃথিবীটাকে ধরে উল্টে দিল। তারা ইসলামী গান গাইতে গাইতে এ কাজ করেছেন।
(আরবী********)
“আমরা সেই সব লোক, যারা মুহাম্মাদের হাতে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে আজীবন জেহাদ করে যাবো।”
অপর এক দল গেয়ে ওঠে:
(আরবী********)
“শত্রুরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে আমাদেরকে সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু আমরা তা মানিনা।” বিশেষত ‘মানিনা’ ‘মানিনা’। এই শব্দটা যখন সমস্বরে জোরদার আওয়াজে গাওয়া হতো, তখন এক দুর্গম সংকল্প আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠতো।”
তাদের এই উৎসাহ উদ্দীপনার একটা কারণ ছিল এইযে, তারা সারা জীবন সংগ্রাম করে এ যাবত যা কিছু অর্জন করেছে, তা হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। ইসলামী আন্দোলন ও মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র ছিল তাদের কাছে সর্বাধিক প্রিয় বস্তু। এর জন্য তারা তাদের জানমাল সব কিছু উৎসর্গ করাকে সৌভাগ্যের বিষয় মনে করতো। মানবজাতির ইহপরকালীন সর্বময় মংগল সাধনের পবিত্র সংগ্রাম ও সাধনা ছিল তাদের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় কাজ। আর দ্বিতীয় প্রধান কারণ ছিল এইযে, তাদের প্রিয়তম নেতা তাদের সাথে কর্মক্ষেত্রে শুধু সশরীরে উপস্থিতই ছিলেন না, বরং সক্রিয়ভাবে প্রতিটি কাজে অংশগ্রহণ করছিলেন। খননের কাজ যখনই শুরু হলো, রসূল সা. নিজের বাড়ী থেকে কর্মক্ষেত্রে চলে এলেন এবং সন্নিহিত একটা পাহাড়ে তাঁর থাকার জন্য তাঁবু স্থাপন করা হলো। বর্তমানে এই স্থানটাতে ‘মসজিদুয্ যুবাব’ প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। দশ দশ জন করে যে গ্রুপ গঠিত হয়েছিল, তেমনি একটি গ্রুপে রসূল সা. নিজেও সদস্য ছিলেন। এটা একটা সুপ্রসিদ্ধ ব্যাপার যে, হযরত সালমান ফারসী অন্য যে কোন ব্যক্তির চেয়ে দশগুণ বেশী কাজ করতে সক্ষম ছিলেন। এ জন্য প্রত্যেক গ্রুপ তাঁকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করতো। এই টানাপোড়নের নিস্পত্তি রসূল সা. এভাবে করলেন যে, তিনি বললেন: ‘সালমান আমাদের পরিবারের গ্রুপের সদস্য।’ এভাবে হযরত সালমানকে সম্মানিতও করা হলো এবং বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দের আশংকা ও দূর হলো। রসূল সা. মাটি কাটা ও বহন করা উভয় কাজই করলেন। এমনকি কোদালে কঠিন পাথর বেধে গেলে সেই পাথর ভাঙ্গার জন্যও তিনি নিজে হাজির হতেন। তিনি নিজ হাতে এ রকম দু’টো পাথর ভেঙ্গেছেন বলে বর্ণিত আছে।
২- এই যুদ্ধের সময় মুসলমানদের অভাব অভিযোগ ও দৈন্যদশা কত তীব্র ছিল, তা আমি আগেই বলে এসেছি। খননের সরঞ্জাম বনু কুরায়যার কাছ থেকে ধার নেয়া হয়েছিল। মাটি বহনের জন্য ঝুড়ির পর্যন্ত সংস্থান ছিলনা। এ জন্য প্রত্যেকে নিজ নিজ কাপড় ব্যবহার করতো। সেই সাথে খাদ্য দ্রব্যেরও ছিল নিদারুন সংকট। যেহেতু তিন হাজার লোক এক নাগাড়ে দু’তিন সপ্তাহ খননের কাজে এবং আরো দু’তিন সপ্তাহ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং সমস্ত কৃষি ও বাণিজ্যিক তত্পরতা বন্ধ ছিল, তাই অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়া অবধারিত ছিল। মুসলিম মোজাহেদরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করেও একাধারে তিনদিন ধরে উপোষ করেছে। এটাও সবাই হাসিমুখে সহ্য করেছে। কারণ এই উপোষে মুসলমানদের নেতা রসূল সা. নিজেও অংশীদার ছিলেন। বরং তিনি অন্যদের চেয়েও বেশী ক্ষুধা সহ্য করেছেন। কেউ এসে যখন দেখিয়েছে যে, সে ক্ষুধার যন্ত্রনায় পেটে পাথর বেঁধে নিয়েছে, তখন রসূল সা. কাপড় সরিয়ে দেখিয়েছেন যে তিনি দুটো পাথর বেঁধেছেন, ত্যাগ ও কুরবানীর এই গুন ততক্ষণই বহাল থাকে, যতক্ষন দলের সবাই তাতে অংশ গ্রহন করে। কিন্তু কিছু লোক যদি নিজেকে ত্যাগের উর্দ্ধে রেখে ত্যাগ ও কুরবানীর দায়িত্ব শুধু অন্যদের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে, তাহলে এ গুন পুরো দল থেকেই উধাও হতে আরম্ভ করে। বিশেষত ইসলামী দলের নেতা ও দায়িত্বশীলদের উচিত যেন এই গুণটিতে অন্য সবার চেয়ে অগ্রগামী থাকতে চেষ্টা করে।
৩- সাধারণভাবে সমাজে শৃংখলা বজায় রাখা এমনিতেও ইসলামী আন্দোলনের অপরিহার্য দাবী। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে তো সর্বাত্মক শৃংখলা ছাড়া শত্রুর মোকাবিলা কার্যকরভাবে করাই সম্ভব নয়। রসূল সা. প্রথম যুদ্ধ থেকেই সামরিক শৃঙ্খলার শিক্ষা দিয়েছিলেন। খন্দকের যুদ্ধ পর্যন্ত এসে অভিজ্ঞতা অনেক ব্যাপকতর হয়েছিল। তাই খন্দকের যুদ্ধে শৃংখলার দিকটা যথেষ্ট মজবুত ছিল। খন্দকের খনন কার্য পূর্ণ শৃংখলা ও কর্মবন্টনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল। তাছাড়া এ কাজের তত্বাবধান ও রণাঙ্গনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় পর্যবেক্ষণ মঞ্চ তৈরী করা হয়েছিল এবং পালাক্রমে প্রহরার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। এমনকি মুসলিম মোজাহেদের মধ্যে পারস্পরিক পরিচয় বিনিময়ের জন্য সংকেতও নির্ধারিত ছিল। বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতকতা তদন্তকারী দল ফিরে এসে যখন অভিযোগের সমর্থনে রিপোর্ট দেয়, তখন সেই দলও সাংকেতিক পন্থায় রিপোর্ট দেয়। তদন্তকারী দলের সদস্যরা শুধু বলেছিল “আযাল ও কারা”। অর্থাৎ আযাল ও কারার লোকেরা শিক্ষক দলের সাথে যেরূপ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, বনু কুরায়যাও তদ্রুপ করেছে। এতদসত্ত্বেও একটা ক্ষেত্রে রাতের অন্ধকারে ভুলবশত মুসলিম মোজাহেদদের দুটো গ্রুপে সংঘর্ষ ঘটে যায় এবং এক ব্যক্তি শাহাদাত বরণ করেন। খনন কার্য শুরু হওয়ার পর থেকে শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কেউ রসূল সা. এর কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেনি।
৪- রসূল সা. বনু গিতফানের সাথে আপোষমূলক চুক্তি করার যে পথ বের করেছিলেন, তা থেকে জানা যায় যে, ইসলামী আন্দোলনকে বিপজ্জনক বিরোধিতা থেকে রক্ষা করার এবং শত্রুর শক্তি খর্ব করার জন্য কখনো যদি কিছুটা পিছু হটতে হয় কিংবা কিছুটা নমনীয় হতে হয়, তবে সেটা তেমন অকল্পনীয় ব্যাপার হবেনা। দীর্ঘ দ্বন্দ-সংঘাতে জড়িত হয়ে যে রকমারি লোকজনের সাথে পরিচয় ঘটে, তাদের সাথে মাঝে মাঝে আপোষমূলক লেনদেন করার প্রয়োজন হতে পারে। ইসলামী আন্দোলনের বহু জটিল প্রয়োজন দেখা দিতে পারে এবং সে সব প্রয়োজন মেটাতে তাকে বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতেই হয়। পরিস্থিতিকে বুঝা ও তা থেকে সর্বোত্তম পথ খুঁজে বের করার যোগ্যতা যে কোন দক্ষ ও সুক্ষ্মদর্শী নেতৃত্বের অপরিহার্য গুন হওয়া উচিত। নীতি ও আদর্শ এক জিনিস, কর্মপদ্ধতি অন্য জিনিস। নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে কোন নমনীয়তা ও আপোষহীনতার কোনই অবকাশ থাকেনা। কিন্তু কর্মপদ্ধতিতে থাকে। যারা নীতির ন্যায় কর্মপদ্ধতির ক্ষেত্রেও একই ফর্মুলাকে সব অবস্থায় ব্যবহার করতে চায়, তারা ইতিহাসে কোন উল্লেখযোগ্য কীর্তি সম্পাদনে প্রায়ই সক্ষম হয়না।
এ কথা স্বতন্ত্র যে, মদিনার আনসারগণ তাদের ঘাড়ে একটা অসহনীয় বিপদ এসে পড়েছে ভেবে ঘাবড়ে যেতে পারে এই আশংকায় রসূল আগে ভাগেই তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজেছিলেন, আর এ কারণেই তিনি গিফতানের সাথে সমঝোতায় পৌঁছতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আওস ও খাজরাজের নেতৃদ্বয় দৃঢ়তা প্রদর্শন করায় তিনি সান্ত্বনা পেয়ে যান।
৫-এই সমঝোতা প্রস্তাবকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার আগে রসূল সা. আনসার নেতাদের সাথে পরামর্শ করার মাধ্যমে শুরাতন্ত্রকে সুসংহত করে দিলেন। রণাঙ্গণেও তিনি এককভাবে কোন বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন না।
৬-নঈম বিন মাসউদ শত্রুদের ভেতরে অনৈক্য সৃষ্টির জন্য যে ভূমিকা পালন করেন তা রসূল সা. এর অনুমতি নিয়েই করেছিলেন। রসূল সা. “যুদ্ধ এক ধরনের প্রতারণা” এই মূলনীতির ভিত্তিতেই ঐ কাজের অনুমতি দিয়েছিলেন। এ থেকে জানা যায় যে, (অলংঘনীয় নৈতিক সীমারেখার আওতার মধ্য থেকেই)দ্বন্দ্ব সংঘাতে বা যুদ্ধ বিগ্রহে বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। বরঞ্চ ক্ষেত্র বিশেষে তা অনিবার্য হয়েও পড়তে পারে। চরম বিপদসংকুল ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে যদি সরলতার সাথে নীরব ও নিস্ক্রিয় দর্শক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকা হয় এবং কৌশলের পথ অবলম্বন করা না হয়, তবে মহা সর্বনাশও ঘটে যেতে পারে। ইবনে ইসহাকের একটা দূর্বল বর্ণনা হিসেবে না ধরলে নঈম ইবনে মাসঊদ একটা মিথ্যে কথাও না বলে এবং কোন নৈতিকতার সীমা লংঘন না করে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে একটা অসাধারণ কাজ সমাধা করেছিলেন।
৭-রসূল সা. এর গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত সাহাবী হযরত সালমান ফারসী বর্ণনা করেন, খনন কার্য চালানোর সময় প্রকান্ড এক পাথরের দেখা পেয়েছিলাম যা আমি কোন ক্রমেই ভাংতে পারিনি। রসূল সা. নিকটেই ছিলেন। আমার কাছ থেকে কোদাল নিয়ে তিনি আঘাতের পর আঘাত হানতে লাগলেন। প্রথম আঘাতের পর তিনি বললেন, আমার জন্য ইয়ামান বিজিত হলো দ্বিতীয় আঘাত হেনে তিনি বললেন, সিরিয়া ও মরক্কো আমার সামনে মাথা নুইয়েছে।তৃতীয়বারে বললেন, প্রাচ্য অঞ্চল (ইরান) আমার দখলে এসেছে। এই ভবিষ্যদ্বাণী দু’দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এ দ্বারা বুঝা যায় যে, রসূল সা. প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের সাফল্যের স্তরগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখতেন। আর এই ধারনার স্বপক্ষে তার কাছে আল্লাহর কাছ থেকে ওহিও আসতো। দ্বিতীয়ত চরম প্রতিকূল পরিবেশেও যখন শক্তি সর্বনিম্ন পর্যায়ে এবং বিপদ মুসিবত সবচেয়ে মারাত্মক পর্যায়ে ছিল, তখনো তিনি নিশ্চিত বিশ্বাস রাখতেন যে, ইসলামের বিজয় অবধারিত।
বরঞ্চ আমরা এ কথাও না বলে পারিনা যে, মক্কী যুগ থেকে মাদানী যুগ পর্যন্ত রসূল সা. এর মুখে ইসলামের হাতে আরব বিশ্ব ও অনারব বিশ্ব শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে-এই কথাটা এতবার উচ্চারিত হতে দেখা যায় এবং তা সর্বমহলে এত বেশী কথিত যে, এটা ইসলামী আন্দোলনের একটা স্থায়ী শ্লোগানের রূপ ধারণ করে। এ বিষয়ে আমি অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করবো। বিভিন্ন দুর্যোগের মুহূর্তে এই ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে গিয়ে মুয়াত্তাব বিন কুশাইর নামক এক মোনাফেক বলেছিলো যে, একদিক মুহাম্মদ সা. রোম সাম্রাজ্য ও পারস্য সম্রাজ্যের চাবিকাঠি আমাদের হাতে দিয়ে দেন, অপরদিকে আমাদের বাস্তবতা এই যে, আমাদের কোন ব্যক্তি ভয়ে পায়খানায় যাওয়ার জন্যও বাড়ীর বাইরে যেতে পারেনা।
৮-এই যুদ্ধে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে যদিও ‘নারী ও শিশুদেরকে দুর্গের ভেতরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু এ সময়ও মুসলিম নারীগণ উচ্চাংগের ভূমিকা পালন করেছিলেন। রশীদা নামি এক মহিলা কিছু ওষুধপত্র ও ব্যান্ডেজের সরঞ্জামাদি নিয়ে রণাঙ্গনে চলে এসেছিলেন এবং তিনি আহতদের অনেক সেবা করেছিলেন। হযরত সা’দ বিন মুয়াযের ক্ষতস্থানেও তিনি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলেন। নারীদের একটা শিবিরের আশে পাশে জনৈক ইহুদী যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। রসূল সা. এর ফুফু হযরত সফিয়া ওখানেই ছিলেন। অসুস্থতার কারণে হযরত হাসসান ইবনে ছাবেতকে ওখানে রাখা হয়েছিল। হযরত সফিয়া হাসসানকে বললেন ঐ লোকটাকে ধরে ধোলাই দিতে। অসুস্থ হাসসান অপারগতা প্রকাশ করলে দুঃসাহসী নারী হযরত সফিয়া নিজেই একটা কাঠ নিয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেললেন। তারপর তার মাথাটাও কেটে দুর্গের বাইরে ছুঁড়ে মারলেন, যাতে অন্যান্য দুস্কৃতকারীরা সাবধান হয়ে যায়। এ ঘটনার পর আর কোন শত্রু ওদিকে যাওয়ার সাহস পায়নি। হযরত আয়েশা যে দুর্গে ছিলেন, সেই দুর্গে হযরত সা’দ বিন মুয়াযের মাও ছিলেন। হযরত আয়েশা রা. দুর্গ থেকে বেরিয়ে পায়ের আওয়ায শুনে তাকিয়ে দেখেন সা’দ বিন মুয়ায একটা বর্শা নিয়ে বীর দর্পে এগিয়ে চলেছেন রণাঙ্গানের দিকে। চলার পথে একমনে কবিতা আবৃত্তি করে চলেছেনঃ
‘একটু থামো, আরো একজন যুবক যুদ্ধে শরীক হোক,
মৃত্যু যখন অবধারিত, তখন মৃত্যুকে
ভয় করা কী প্রয়োজন?’
সা’দের মা যখন ছেলের কবিতা শুনলেন, তখন উচ্চস্বরে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি চলে যাও সা’দ। তোমার তো অনেক দেরী হয়ে গেছে।’ একটু পরই যখন সা’দ তীরবিদ্ধ হলেন এবং সে আঘাতেই তিনি শাহাদাত বরণ করলেন, তখন সা’দের কবিতার মর্ম বাস্তব রূপ লাভ করল।
একজন মুসলমান মায়ের আবেগ দেখলেন তো!
৯-খন্দক যুদ্ধের লোমহর্ষক পরিস্থিতিতে নিপতিত নিষ্ঠাবান মুসলমানরা বিপদ মুসিবতের এই তান্ডব দেখে কিছুমাত্র ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার পরিবর্তে স্বতস্ফূর্ত কন্ঠে বলে উঠলোঃ “এতো অবিকল সেই পরিস্থিতি, যার সম্মুখীন হতে হবে বলে আল্লাহ ও তার রসূল আমাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছেন।” বস্তুতঃ এরূপ বিপদসংকুল পরিস্থিতি অতিক্রম না করে পৃথিবীতেও যেমন সত্যের বিজয় সম্ভব নয়, তেমনি আখেরাতেও জান্নাতের নাগাল পাওয়া যায়না। সূরা আহযাবে এরূপ নিবেদিত প্রাণ মোমেনদের প্রশংসা করা হয়েছে। এরাই আন্দোলনের আসল প্রাণশক্তি ও আসল মূলধন।
১০-রসূল সা. সম্পর্কে এ কথা সবার জানা যে, তিনি মুসলমানদেরকে একটা স্বতন্ত্র সভ্যতায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের মনে এই মূলনীতি খুব ভালোভাবে বদ্ধমূল করেছিলেন যে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অংগনে বিজাতীয় অনুকরণ অবাঞ্ছিত। তার পরিবর্তে নতুন সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নিজস্ব আদর্শের আলোকে গঠন করতে হবে। নিজস্ব ইসলামী অভিরুচি অনুসারে প্রতিটি সাংস্কৃতিক ধারাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। কিন্তু যখন আমরা রসূল সা. কে পরিখা তৈরীর ইরানী প্রতিরক্ষা কৌশলকে খোলা মনে গ্রহণ করতে দেখি, তখন বুঝা যায় যে, বস্তুগত উপায় উপকরণ, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও কারিগরি তথ্যের আদান প্রদানকে সমগ্র মানবজাতির জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কোন এক সময় যে সব উপায় উপকরণ, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও কারিগরি তথ্য ও রীতিনীতি কার্যকর থাকবে সেগুলোকে সকল যুগে, সকল সংস্কৃতিতে ও সকল পরিস্থিতিতে অবিকল সেইভাবে কার্যকর করা অপরিহার্য মনে করতে হবে, এটা জরুরী নয়। এ সব জিনিসকে শরীয়ত বা সুন্নাত নামে আখ্যায়িত করতে হবে, এটাও জরুরী নয়। এ সব ব্যাপারে অন্যান্য জাতি ও সংস্কৃতি থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান গ্রহণ করা উচিত। একটা ইসলামী রাষ্ট্র ও তার নেতৃত্বের জন্য ইসলামের দৃষ্টিতেই এটা অপরিহার্য কর্তব্য যে তারা সমকালীন সর্বাধিক প্রভাবশালী উপায় উপকরণকে কাজে লাগাবে, কারিগরি বিদ্যা ও প্রযুক্তিতে নিজ জনগণকে এগিয়ে নেবে এবং সর্বাধিক সফল প্রযুক্তি অন্যদের কাছ থেকেও শিখবে, নিজেরাও উদ্ভাবন করবে।