আন্তর্জাতিক দাওয়াতের সূচনা
রসূল সা. এর হাতে গড়া যে দলটি ইসলামী আন্দোলন পরিচালনার সৌভাগ্য লাভ করেছিলো, তার কর্ম ক্ষেত্র শুধু দেশীয় ও জাতীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিলনা, বরং তা এমন ‘খায়রা উম্মাহ’ বা শ্রেষ্ঠ দল ছিল, যাকে সারা পৃথিবীর ও সর্বকালের ‘মানবজাতির কল্যানার্থে’ আবির্ভূত করা হয়েছিলো। অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতিকে সত্য, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ইনসাফ ও সৌভ্রাতৃত্বের বিধান বাস্তবায়নের পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। শুধু আরবদের সংস্কার, সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংঘবদ্ধ করাই তাঁর চূড়ান্ত ও সর্বশেষ লক্ষ্য ছিল না, বরং তাঁর লক্ষ্য ছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করা এবং যাবতীয় উপায় উপকরণকে কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবীর সকল জাতি ও দেশকে ইসলামী বিধান বাস্তবায়নের আহবান জানানো। ঐ রাজতান্ত্রিক যুগে আল্লাহর যে কোটি কোটি বান্দা ছোট ছোট শ্রেনী ও পরিবারের গোলামীর যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল, যাদের না ছিল বিচার স্বাধীনতা, না ছিল অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এবং না ছিল কোন রাজনৈতিক অধিকার। তাদের নির্যাতিত, নিষ্পেষিত অবস্থা সম্পর্কে কোন সংস্কার মূলক আন্দোলন কিভাবে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে। পারস্য সম্রাটের কাছে লেখা চিঠিতে রসূল সা. নিজেই স্বীয় দাওয়াতের আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলকে এই বলে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন যে, “ আমি সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে আল্লাহর প্রেরিত দূত বা রসূল।”
বস্তুত আল্লাহ তায়ালা রাজতন্ত্র ও ধর্মীয় পুরোহিতদের কাছে অসংখ্য আঞ্চলিক জাতি সত্তায় বিভক্ত মানবতার জন্য আন্তর্জাতিক যুগের উদ্বোধন খোদ রসূল সা. এর হাতেই করিয়েছেন। একটি মাত্র সত্য ও ন্যায়ের কালেমা সমস্ত ভৌগলিক, বংশীয়, ভাষাগত ও রাজনৈতিক বিভাজনকে উপেক্ষা করে অতি দ্রুত গতিতে সমকালীন সুসংবন্ধ দুনিয়ার তিনটি মহাদেশেই ছড়ীয়ে পড়েছে। শেষ নবী মুহাম্মদ সা. কে ঠিক এমন সময় এই আন্তর্জাতিক দাওয়াতে নিযুক্ত করা হয়েছে, যখন বারুদ, ছাপাখানা, বাষ্পীয় শক্তির আত্ম প্রকাশের দিন খুব বেশি দূরে ছিলনা। সমগ্র পৃথিবী নতুন উপায় উপকরণের বলে একটা শহরে পরিণত হতে যাচ্ছিল। পাঁচ সাতশো বছর বিশ্ব ইতিহাসের বিশাল অঙ্গনে তেমন গুরুতবপূর্ণ কিছু নয়। রসূল সা. এমন সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন, যার মাত্র কয়েক শতাব্দী পর বস্তুগত দিক দিয়ে দুনিয়ার সীমান্তগুলো পরস্পরের সাথে মিলিত হতে যাচ্ছিল। এই সময়টার আগমনের উপযুক্ত সময় পূর্বে ইসলামের সত্য বিধান কায়েমের আন্তর্জাতিক দাওয়াত প্রচলিত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, মানবজাতি ক্রমশ বস্তুগত দিক দিয়ে যতই পরস্পরের ঘনিষ্ঠতর হবে, মানসিক, আদর্শিক, ও নৈতিক দিক দিয়েও ততই একই সূত্রে গ্রোথিত হতে থাকবে। মধ্যবর্তী এই সময়টা দাওয়াতের সম্প্রসারন ও বিশ্বের জাতিগুলোকে নতুন যুগের জন্য প্রস্তুত করার ব্যাপারে যথেষ্ট হতোনা। এ কথা সত্য বটে যে, আন্তর্জাতিক যুগের ধারা সে সময় মুসলিম বিপ্লবী শক্তির আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়ে বস্তুবাদী শক্তির খপ্পরে পড়ে গিয়েছিল। কেননা ইসলামী শক্তি তখন পর্যন্ত ইতিহাসে নিজের একটা প্রভাবশালী ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখলেও তার বিপ্লবী দাওয়াতের তেজ ও উদ্দীপনা বজায় রাখতে পারেনি। কিন্তু তা স্বত্বেও নতুন যুগ ইসলামী আন্দোলনের কাছ থেকে পেয়েছিল মানবতার প্রতি সন্মান প্রদর্শন, মানবিক সাম্য, গনতান্ত্রিক চেতনা, বুদ্ধি বৃত্তিক ও নীরিক্ষা ধর্মী জ্ঞান বিজ্ঞানের যথাযথ মর্যাদা উপলব্ধি, প্রকৃতিকে জয় করার বাসনা, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও অধিকারকে সন্মান প্রদর্শন, মতামত প্রকাশ ও কথা বলার স্বাধীনতা, সংখ্যা লঘুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, ন্যায় বিচারের মৌলিক নীতিমালা এবং আরো কিছু উচ্চতর মূল্যবোধ। এসব জিনিস বস্তুবাদী মানসিকতার আওতায় এসে বিকৃতি ও অস্পষ্টতার শিকার হয়েছে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় ভালো ও কল্যানের যেটুকু পাওয়া যায়, সেটুকু বিশ্ব মানবতার করুনা রসূল সা. এরই অবদান। কোন কোন সত্য নিষ্ঠ প্রাচ্যবাদী লেখকও এ কথা স্বীকার করেছেন।
সুতরাং ইসলামী আন্দোলন নিজের মৌলিক প্রকৃতি অনুসারেই দাবী জানায় যে, তার দাওয়াত আরবের চতুর্সীমায় বন্দী না থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ুক। সাথে সাথে এটা একটা বাস্তব প্রয়োজন ও বটে যে, ইসলাম আরবের বাইরেও বিস্তৃতি লাভ করুক। অন্যথায় আরবে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে একটা সরকারের টিকে থাকাই সম্ভব ছিল না। কেননা সেক্ষেত্রে একটা ইসলামী রাষ্ট্রকে চারদিক থেকে অনৈসলামিক রাষ্ট্রসমূহ দ্বারা ঘেরাও হয়ে থাকতে হতো। বিশেষত রোমান ও পারসিক সাম্রাজ্য সব সময় আরব ভূখন্ডের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি দিত। কিছু কিছু আরব ভূখন্ড তাদের দখলে ছিল এবং কতিপয় আরব গোত্রকে তারা কিনে নিয়ে ব্যবহারও করতো। আর রোম সরকারের সাথে তো মদিনার সংঘর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছিলো।
রসূল সা. ইসলামী আন্দলনকে যে দ্রুততার সাথে এগিয়ে নিয়ে যান, তা আমাদের জন্য বিস্ময়কর। মাত্র ১৩ বছরে প্রাথমিক দাওয়াত দিয়ে আন্দোলন পরিচালনাকারী কর্মীবাহিনী তৈরি করার কাজ সম্পন্ন করে ফেলেন। তারপর কার্যত ইসলামী রাষ্ট্র স্থাপন করার কাজ সম্পন্ন করেন ৮ বছরে। তারপর নিজ জীবনেই বাকী দুই বছর আশেপাশের রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য গুলোর কাছে দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেন।
৬ষ্ঠ হিজরীতে সম্পাদিত হোদায়বিয়ার সন্ধি দেশের ভেতরকার সংঘাত ও সংঘর্ষ গুলোর থেকে তাঁকে বিশ্রাম দিয়ে আরবের বাইরেও দাওয়াতের কাজ সম্প্রসারণের সুযোগ এনে দেয়। ৭ম হিজরীর পহেলা মুহররম উমরাতুল কাযা সম্পন্ন করার অব্যাবহতি পর রসূল সা. দূতের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর শাসকদের ইসলামের দাওয়াত প্রদান করেন। আজকের যুগে এটা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য মনে হয় যে, রসূল সা অন্যান্য দেশের জনগণের পরিবর্তে শাসকদের ইসলামের দাওয়াত দিয়ে ছিলেন কেন? এর কারণ সুস্পষ্ট। সে যুগে রাজা বাদশাহদের সামনে প্রজাদের আদৌ কোন অধিকার ছিলনা। তাদের এমন কোন মৌলিক স্বাধীনতা ছিলনা, যাকে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের ব্যাপারে নিজেরাই কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। তাছাড়া ঐ সব রাজা বাদশাহ এই সব সুযোগ দিতে কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিলনা যে, ভিন্ন দেশের লোকেরা এসে তাদের সাথে মিলিত হবে এবং তাদেরকে তাদের বর্তমান ধর্ম থেকে বিচ্যুত করবে। তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তিই প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদের ধর্মমতের উপরে। তারা ধর্মীয় নেতাদের সহযোগিতা নিয়েই দেশ শাসন করতো। তাছাড়া যেখানে শুধু ধর্মের পরিবর্তেন নয়, মানুষের সার্বিক পরিবর্তন কাম্য, মানুষের রুচি, মানদন্ড, মূল্যবোধ সবকিছুই যেখানে পাল্টে যাওয়ার আশা করা হয় এবং ইসলামের দাওয়াত গ্রহনকারীদের মধ্যে যেখানে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক মনোভাব সৃষ্টি করত নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিপ্লবী আকাংখা জাগিয়ে তোলা হয়, সেখানে রাজা বাদশাহরা তাদের প্রজাদের মধ্যে নীরবে ইসলাম বিস্তারের সুযোগ দিবে, এটা কিভাবে সম্ভব? সেকালের রাজতান্ত্রিক শাসকরা পৃথিবীর সর্বময় কর্তৃত্ব সম্পন্ন প্রভু হয়ে বসেছিল এবং তাদের অনুমতি ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়তে পারতো না। এ কারণে রসূল সা. সরাসরি শাসকদের কাছেই ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন এবং দাওয়াতি চিঠিগুলোতে তাদেরকে তাদের জনগণের প্রতিনিধি আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর জনগণের ভাল মন্দের দ্বায় দায়িত্ব অর্পন করতেন। বিভিন্ন রাজা মহা রাজাকে রসূল সা. সংশ্লিষ্ট জাতির ‘নেতা’ বলে সম্বোধন করতেন। পারস্য সম্রাটকে ও মুয়াওকিসকে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন ‘তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ না কর, তবে তোমার সমগ্র জাতির পাপের ফল তোমাকেই ভোগ করতে হবে’।
রাজা বাদশাহদেরকে চিঠি লিখতে গিয়ে এক দিকে তিনি যেমন প্রচলিত রীতি নীতি মেনে চলতেন, অর্থাৎ সীল মারার জন্য আংটি তৈরি করান এবং তাতে “ মুহাম্মদ রাসুলুল্লাহ” শব্দটা খোদাই করান। অপরদিকে তেমনি নিজের স্বতন্ত্র একটা রীতি ও পদ্ধতি চালু করেন। প্রত্যেক চিঠি “ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” দিয়ে শুরু করতেন। প্রেরক হিসেবে নিজের নাম এবং যার নামে চিঠি পাঠাতেন তার নাম লেখাতেন। অতপর নূন্যতম, অত্যন্ত মাপাজোঁখা ও সতর্ক ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরতেন। সেই যুগের প্রেক্ষাপটে যে কুটনৈতিক ভাষা তিনি চিঠির জন্য অবলম্বন করেন,তা রসূল সা. এর মানসিক শ্রেষ্ঠত্ব আমাদের সামনে এমনভাবে তুলে ধরে যে, আমরা স্তম্ভিত হয়ে যাই। যেমন এই সব চিঠিতে অতি সংক্ষেপে এই বাক্যটি তিনি ব্যবহার করেন যে, “ইসলাম গ্রহণ কর, শান্তি পাবে”। এর আরো একটা অর্থ এই হয় যে, “ আনুগত্য করো, শান্তি পাবে”। শান্তি পাবে কথাটার তাৎপর্য এই যে, এটাই শান্তির একমাত্র পথ বা উপায়। এর অন্য একটা তাৎপর্য এমন যে, তার ভেতরে প্রচ্ছন্ন হুমকি রয়েছে। অর্থাৎ যদি ইসলাম গ্রহণ না করো বা আনুগত্য না করো তাহলে তোমার বিপদ রয়েছে। মাত্র দুটো শব্দ অথচ তা ব্যাপক অর্থবোধক। অনুরূপভাবে “তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ না করো, তাহলে তোমাকে সমগ্র জাতির পাপের ফল ভোগ করতে হবে”। একথাটাও দ্ব্যার্থবোধক। একটা হল ধর্মীয় অর্থ এবং তা এই যে, আল্লাহর কাছে তোমাকেই দায়ী হতে হবে। অপরটি রাজনৈতিক অর্থ এবং সেটি এই যে, এর রাজনৈতিক পরিণাম তুমি ইহকালেই ভোগ করবে। এ ধরণের দ্বার্থবোধক বাক্য রসূল সা. এই জন্য ব্যবহার করতেন না যে, বক্তব্য অস্পষ্ট থেকে যাক এবং উল্টা পাল্টা ব্যাখ্যা করার অবকাশ থেকে যাক (নাউজুবিল্লাহ)। বরং একই বাক্যে একই সাথে উভয় অর্থ বুঝানো হতো। এতো কম শব্দ দ্বারা এতো ব্যাপক অর্থ বোঝানো রসূল সা. এর ‘বালাগাত’ বা ভাষাগত অলংকারিক শ্রেষ্ঠত্বর নিদর্শন। তাছাড়া তিনি প্রত্যেক শাসককে চিঠি লেখার সময় তার ধর্ম এবং তার বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে মানানসই ভাষা প্রয়োগ করতেন। অর্থাৎ গৎ বাঁধা ভাষা সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতেন না। তাছাড়া প্রত্যেক শাসকের কাছে তিনি সেই দেশের ভাষা জানেন এমন দূত পাঠাতেন। [সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ বানিজ্যোপলক্ষে দেশ বিদেশ সফর করে নানা ভাষা রপ্ত করে রেখেছিলেন। আবার কাউকে কাউকে রসূল সাঃ বিশেষ নির্দেশ দিয়ে বিদেশি ভাষা শিখতে বলতেন।]
এইসব চিঠি প্রেরণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের দাওয়াত প্রদান। কিন্তু এ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রনায়কদের তিনি এই সব চিঠির মাধ্যমে এ কথাও বুঝিয়ে দিতেন যে, আরব তখন আর আগের মতো অরক্ষিত বিচরণ ক্ষেত্র নয়। বরং তা একটা সুসংবদ্ধ সরকারের অধীনে পরিচালিত একটা দেশ, এ সরকার সব ধরণের চ্যালেঞ্জ দিতে ও গ্রহনে সক্ষম। এ সরকার কারো হুমকিতে বা চোখ রাঙ্গানিতে ভয় পায়না। একটা পরাক্রান্ত, চৌকস ও সদাসতর্ক সরকার সেখানে সক্রিয় রয়েছে।
এবার আমি সংক্ষেপে বর্ণনা দিচ্ছি কিভাবে বিভিন্ন বিদেশী শাসকদের নিকট দাওয়াতী চিঠি পাঠানো হয়েছে এবং তার ফলাফল কি দাঁড়িয়েছে।
১- আমর বিন উমাইয়া যামরীর রা. এর মাধ্যমে আবসিনিয়ার রাজা আসাম (বা আসহামা) বিন আবজার নাজ্জাশীকে রসূল সা. এর লিখিত দাওয়াত নামা পাঠান। চিঠিতে ইতিপূর্বে আবিসিনিয়ার মোহাজেরদের কথা বিশেষত হযরত জাফর তাইয়ারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মোহাজেরদেরকে নিরাপদ রাখার আদেশ দেয়া হয়েছে। অতপর তাতে স্বয়ং বাদশাহকে ও তাঁর মাধ্যমে রাজার সভাসদদেরকেও ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
নাজ্জাশী আগে থেকেই ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ছিল। হযরত জা’ফরের হাতেও তিনি প্রকাশ্য ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তার বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত একটি চিঠিও তিনি রসূল সা. এর নিকট প্রেরণ করেন। নিজের ছেলে আরহাকে তিনি দূত বানিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি একথাও জানালেন যে, রসূল সা. যদি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হতে আদেশ করেন, তবে তিনি হাজির হতে প্রস্তুত। [সম্ভবত ইনি সেই নাজ্জাশী নন, যার সামনে মোহাজেরগণ হাজির হয়েছিলেন, তিনি মুসলমান হয়েছিলেন এবং রসূল সা. মদিনায় তার গায়েবানা জানাজা পড়িছিলেন। আসাম তাঁর পরে সিংহাসনে আরোহন করেন। যাহোক, এ ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে।]
২- আলা বিন হাযরামির মাধ্যমে রসূল সা. ইরান সম্রাটের করদাতা ও বাহরাইনের শাসক মুনযির বিন সাভীকে দাওয়াতনামা পাঠান। মুনযির তো ইসলাম গ্রহণ করলেনই সাথে সাথে তাঁর প্রজাদের একটা বিরাট অংশ ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি জবাবী চিঠিতেও নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা জানান এবং তাঁর প্রজাদের একাংশ ইসলাম গ্রহণের জন্য প্রস্তুত বলে উল্লেখ করেন। সেই সাথে একথাও জানান যে, কিছু কিছু প্রজা ইসলাম গ্রহণ করতে চায়না, বরং ইহুদী ও খৃষ্টান থাকতে চায়। মদিনা থেকে আবার চিঠি পাঠানো হয় যে, যারা ইহুদী ও খৃষ্টান থাকতে চায়, তাদেরকে নিজেদের ধর্মে থাকতে দেয়া হবে। তবে তাদেরকে জিযিয়া কর দিতে হবে।
৩- জাফল ও আবদ এরা দুজন আম্মানের বাদশাহ জীফারের ছেলে ছিলেন। আমর ইবনুল আ’সের মাধ্যমে দাওয়াতনামা পাঠানো হয়। আমর ইবনুল আ’স প্রথমে ছোট ভাই আবদের সাথে সাক্ষাত করেন। আবদ এই বিষয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা চালান। তিনি তাঁর কাছ থেকে জানতে পারেন যে, নাজ্জাশী মুসলমান হয়ে গেছেন, তথাপি তার জনগণ তাঁকে রাজত্ব থেকে উৎখাত করেনি এবং বিশপ ও পাদ্রীরাও তাঁকে বাঁধা দিতে পারেনি। এমনকি রোম সম্রাটও এ ঘটনা জানার পর কোন পদক্ষেপও নেননি। বরঞ্চ নাজ্জাশী ইসলাম গ্রহণের পর হিরাক্লিয়াসকে কর দেয়াও বন্ধ করেছে। সে হযরত আমর ইবনুল আসের কাছ থেকে রসূল সা. এর প্রধান প্রধান শিক্ষাও জেনে নেয়। এ আলোচনার পর আবদের মনে ইসলাম গ্রহণের প্রেরণা জন্মে। কিন্তু সে আক্ষেপ করে বলতে লাগলো, আমার বড় ভাইও যদি ইসলাম গ্রহণে সম্মত হতো এবং আমরা দুজনে একত্রে মদিনায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে পারতাম, তাহলে ভাল হতো। এরপর দরবার অনুষ্ঠিত হল। দরবারে দুই ভাইয়ের উপস্থিতিতেই মদিনার দূত সীল করা চিঠি খুলে দিলেন। উভয় ভাই চিঠি খুলে পড়লো তারপর কয়েকটি প্রশ্ন করা হল। প্রশ্নের জবাবে আমর বললেন, কোরায়েশরা বাধ্য হয়ে রসূল সা. আনগত্য গ্রহণ করেছে। আর রসূল সা. এর দল এমন লোকদের নিয়ে গঠিত, যারা ভাল মতো চিন্তা ভাবনা করে ও বুঝে শুনে রসূল সা. এর পাশে সমবেত হয়েছে। এরপরও জীফার বাদশাহ দ্বিধান্বিত রইল। কিন্তু তার দুই ছেলেই ইসলাম গ্রহণ করলো এবং সেই রাজ্যের বিপুল সংখ্যক প্রজাও।
৪- মুনযির বিন হারেস বিন আবু শিমার দামেস্কের খৃষ্টান শাসক ছিল। মদিনা থেকে সীলাত বিন আমর দাওয়াতী চিঠি নিয়ে যায়। সেও রসূল সা. এর আন্দোলনকে দুনিয়াবী রাজনীতি মনে করে শর্ত দেয় যে, ইসলামী সরকারের অর্ধেক অংশ থাকবে আমার। পরে তার আয়ুষ্কাল দ্রুত কমে আসে। রসূল সা. যখন তার সম্পর্কে প্রতিবেদন পেলেন তখন বললেন, সে এক ইঞ্চি বা একটা খেজুর পরিমাণ জমি চাইলেও আমি তা দিতে প্রস্তুত নই। ইসলামী রাষ্ট্র যে ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত থাকে, তার প্রতি ইঞ্চি পবিত্র আমানত।
৫- জারীহ বিন মিত্তা মুকাওকিস ইস্কান্দারিয়া সহ সমগ্র মিশরের খৃষ্টান রাজা ছিল। রসূল সা. তার দরবারে দূত বানিয়ে পাঠালেন হাতিব ইবনে আবী বালতায়াকে। তিনি চিঠিও পৌঁছালেন এবং কথাও বললেন। তিনি মৌখিক ভাবে যে বক্তব্য রাখলেন, তা এতো নির্ভীক ও বেপরোয়া ছিল যে, তা থেকে বুঝা যায়, রসূল সা. কি ধরণের বলিষ্ঠ চরিত্র মনমানসের অধিকারী ব্যক্তিত্ব ইসলামের ছাঁচে গ্রঠন করেছিলেন। মুকাওকিসকে সতর্ক করার জন্য হাতেব বলেন, “ এই ভূখন্ডে আগেও এক ব্যক্তি জন্মেছিল, যে আমি তোমাদের সর্বোচ্চ প্রভূ বলে হুংকার ছেড়েছিল। অবশেষে সে আল্লাহর গজবের শিকার হয়ে ধবংস হয়ে গিয়েছিলো। এ ভূখন্ডের পরবর্তি অধিপতি হিসেবে আপনাদের উচিৎ পূর্ববর্তীদের পরিণাম দেখে শিক্ষা গ্রহণ করা। এমনটি হতে দেয়া উচিৎ নয় যে, অন্যেরা আপনাদের পরিণাম দেখে শিক্ষা গ্রহণ করবে”। তার পর যুক্তি প্রমান দ্বারা ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে দিয়ে বললেন, “ আমর আপনাদেরকে হযরত ঈসা আ. সঠিক ও আসল ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। এটা কোন নতুন ধর্ম নয়”। মুয়াকয়াকিস ইসলাম গ্রহনে প্রস্তুত না হলেও নবী সা।। এর চিঠিকে যথেষ্ট সন্মান প্রদর্শন করল এবং তাকে হাতির দাঁতের কৌটায় রেখে কোষাগারে সংরক্ষন করলো। তারপর রসূল সা. এর কাছে দুলদুল নামের বিখ্যাত খচ্চর সহ বেশ কিছু উপঢৌকনাদিও পাঠাল। চিঠির জবাবে সে লিখলো, “আমি জানি, শেষ নবীর আগমন এখনো বাকী। তবে আমার ধারণা তিনি সিরিয়ায় জন্ম নেবেন”।
৬-হিরাক্লিয়াস রোম সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের সম্রাট ছিলেন। তার রাজধানী ছিল কনষ্টান্টিনোপল। রসূল সা. দিহয়া বিন খলীফা কালবীকে দাওয়াতী চিঠি দিয়ে তার কাছে প্রেরন করেন। দিহয়া বাইতুল মাকদাসে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করেন। হিরাক্লিয়াস মদিনার দূতের সন্মানে বিরাট জাঁকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠান করলো এবং রসূল সা. সম্পর্কে বহু খুঁটিনাটি বিষয় সে জিজ্ঞেস করলো। তাছাড়া সে আর আদেশ জারী করলো যে, এ অঞ্চলে মক্কার আর কোন ব্যক্তি থেকে থাকলে আমার কাছে আনা হোক। ঘটনাক্রমে এই সময় রসূল সা. এর বিরোধী শিবিরের নেতা আবু সুফিয়ান বাণিজ্যিক সফরে ওখানে ছিল। তাকে তার সব ক’জন বাণিজ্যিক সাথী সহ দরবারে ডেকে আনা হল। হিরাক্লিয়াস তাদেরকে বলল, “ আমি আবু সুফিয়ানকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবো, সে যদি কোন প্রশ্নের ভুল উত্তর দেয়, তাহলে তোমরা বলে দিও”। আবু সুফিয়ান বলেছে “আমি যদি আশংকা না করতাম যে, সাথীরা আমার মিথ্যার জারিজুরি ফাঁস করে দেবে, তাহলে আমি এই সুযোগে কিছু মনগড়া কথা বলে দিতাম”। কিন্তু আল্লাহ্ এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দিলেন যে, রসূল সা. সম্পর্কে তাঁর কট্টর দুশমনের মুখ দিয়েও সত্য কথাই বেরুল। হিরাক্লিয়াস রসূল সা. এর জন্ম বৃত্তান্ত, পরিবার, চরিত্র, রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ সাথীদের অবস্থা, তাঁর উন্নতির দ্রুততা, যুদ্ধে মুসলমানদের অবস্থা, ইসলামের শিক্ষা এবং অন্য কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। সকল প্রশ্নের জবাবে আবু সুফিয়ানের দেয়া তথ্য গুলো জেনে হিরাক্লিয়াস বলল, ‘আবু সুফিয়ান তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এ ব্যক্তি একদিন আমি যে জায়গায় বসে আছি, এ জায়গারও মালিক হবে। আহা! আমি যদি সেই নবীর কাছে হাজির হতে পারতাম এবং তাঁর পা ধুয়ে দিতে পারতাম!” এরপর রসূল সা. এর চিঠি পড়া হল। সভাসদরা এতে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করলো। কেননা হিরাক্লিয়াসের মানসিক অবস্থা দেখে তারা আগেই ঘাবরে গিয়েছিলো। তারা মক্কার প্রতিনিধিদেরকে তাড়াতাড়ি বের করে দিলো।
হিরাক্লিয়াসের সাথে কথোপকথনের ফলে স্বয়ং আবু সুফিয়ানের মনে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ পড়ে গেল।
৭- খসরু পারভেজ ছিল ইরানের সম্রাট ও অগ্নি উপাসক। রসূল সা. আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রা. কে তার কাছে দূত বানিয়ে দাওয়াতী চিঠি পাঠালেন। খসরু পারভেজ দাম্ভিকতার আতিশয্যে রসূল সা. এর চিঠি এই বলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো যে, আমাদের একজন প্রজার এমন দুঃসাহস হল কি করে? হতভাগা খসরু জানতোনা আরব জাহান কত বড় বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত এবং সেখানে কত জোরদার আদর্শিক শক্তি বিকশিত হচ্ছে। খসরু পারভেজ তার ইয়ামানস্থ গভর্নর বাযানকে নির্দেশ দিলো, চিঠির লেখককে অবিলম্বে গ্রেফতার করে নিয়ে এসো। বাযান একটা সেনাদল পাঠালো রসূল সা. কে গ্রেফতার করে আনতে। সেনাদল যখন তায়েফে পৌছালো, তখন সেখানকার শীর্ষ নেতারা খুব খুশী হল। তারা ভাবলো এবার তাদের প্রিয় জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার শত্রুর মূলোৎপাটিত (মুহাম্মস সা.) হবে। এই সেনাদল মদিনায় পৌঁছল এবং তার নেতা মুহাম্মদ সা. কে জানালো তারা রসূল সা. কে গ্রেফতার করতে এসেছে পারস্য সম্রাটের নির্দেশক্রমে। রসূল সা. তাদেরকে বললেন, কাল সকালে এসে আবার সাক্ষাত করো। পরদিন সকালে তারা এলে রসূল সা. তাদেরকে জানালেন, “ আজ রাতে আল্লাহ তোমাদের সম্রাটকে তার ছেলের হাতেই হত্যা করিয়েছেন। যাও, খবরটা সত্য কিনা খোঁজ নাও। খবরের সত্যতা এবং রসূল সা. এর শিক্ষা ও চরিত্রের মাহাত্ম্য জানার পর বাযান ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। তার দেখা দেখি দরবার ও এলাকার আর অনেকে ঈমান আনলো।
রসূল সা. পারস্য সম্রাট কর্তৃক তাঁর চিঠি ছিঁড়ে ফেলার খবর শুনে বললেন, ‘সে আসলে নিজের সাম্রাজ্যকেই টুকরো টুকরো করেছে’। মনে হয়, আল্লাহ তায়ালার ফয়সালাই রসূল সা. এর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছিলো। কেননা এক মাত্র দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যেই চার পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন সুদৃঢ়, বিশালায়তন ও অত্যন্ত বিলাশ বহুল সাম্রাজ্য ইসলামের কাছে পরাজিত হল। প্রকৃতপক্ষে অভ্যন্তরীণ কলহকোন্দলই এই সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে ছেড়েছিল।
এছাড়া অন্য যেসব ছোট খাটো রাজ্যের শাসকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো হয়েছিল, তাদের একজন তো ছিল রোম সাম্রাজ্যের গভর্নর ফারওয়া বিন ওমর, যিনি ইসলাম গ্রহণ করার পরিণামে পদ ও প্রাণ দুটোই হারিয়েছিলেন। দ্বিতীয় জন নাজদের শাসক ছামামা ৬ষ্ঠ হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তৃতীয় জন জাবালা গাচ্ছানী ৭ম হিজরীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। চতুর্থজন দুমাতুল জান্দালের শাসক উকাইদার ইসলাম গ্রহণ করেন। ৫ম জন যুল কিলাহ হিময়ারী হিময়ার গোত্রের রাজা ছিলেন। তিনি নিজেকে খোদা বলে দাবী করতেন এবং প্রজাদেরকে সিজদা করতে বলতেন। অবশেষে ইনিও ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত ওমর ফারুকের শাসনামলে রাজত্ব ছেড়ে দিয়ে দরবেশের জীবন যাপন করার জন্য মদিনায় আসেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের আনন্দে আঠারো হাজার দাসদাসিকে মুক্ত করে দেন।
উপরোক্ত ঘটনাবলি থেকে জানা যায়, ইসলামী দাওয়াতের এই কলমী সংগ্রাম থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া গেছে এবং তা ইসলামের প্রসার ও বিকাশ সাধনে খুবই সহায়ক হয়েছে। প্রথমত এ দ্বারা পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে ইসলামের দাওয়াত একটা আলোচ্য ও বিবেচ্য বিষয়ে বিষয়ে পরিগণিত হল। দ্বিতীয়ত একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষমতাসীন শাসক এই সব চিঠির কল্যানে এমন অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করে, যখন মুসলমানরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুবই অনগ্রসর ছিল। এ দ্বারা প্রমানিত হয়, ইসলাম একটা সত্য ও স্বাভাবিক ধর্ম। ইসলাম গ্রহনকারী এই ক্ষমতাসীন শাসকদের সাথে সাথে তাদের প্রজারাও ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। রসূল সা. এর চিঠি পেয়েও যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি, তাদের মনের ওপরও এক যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল।তা ছাড়া চিঠি প্রেরনের মাধ্যমে যে আন্তর্জাতিক যুগের সূচনা হয়, তা দেশের ভেতরেও পরিবেশ অনুকূল করতে যথেষ্ট সহায়ক হয়। এই অভিযানের সবচেয়ে বড় যে উপকার হয় তা এই যে, মুসলমানদের সামনে শুরু থেকেই একটা সুপরিসর কর্মক্ষেত্র উপস্থিত হয়ে যায় এবং তাদের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটা বিরাট ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নির্ধারন করে দেয়া হয়। এর ফল দাঁড়ায় এই যে, সমগ্র আরবে ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরও মুসলিম মোজাহেদরা ক্ষান্ত হয়নি, ভোগ বিলাসে মত্ত হয়নি, এবং তাদের মনে এ ধারণা জন্মেনি যে, যা কিছু করণীয় ছিল, তা করে ফেলেছি। বরং তাদের আকাংখা ও অভিলাষ আরো বেড়ে গেছে। নিজের সাথীদেরকে দূতিয়ালী কর্মকান্ডে নিযুক্ত করে রসূল সা. তাদেরকে অনাগত দিনের দ্বায় দায়িত্ব বহনের চমৎকার প্রশিক্ষণ দিয়ে ফেলেছিলেন। তারা অজানা অচেনা পরিবেশে, জাঁকজমকপূর্ণ সামাজিক, ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এবং ভাবগম্ভীর শাহী দরবারে উপস্থিত হতেন এবং প্রকাশ্য মজিলিসে আলাপ আলোচনা ও ভাষণ দানের অভিজ্ঞতা অর্জন করতেন। তারা সমকালীন শাসক প্রশাসকদের মনস্তত্ব বুঝার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছেন। তারপর তারা যে বিশ্বস্ততা, দৃঢ়তা, বলিষ্ঠতা, আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি ও সরলতা সহকারে সত্য প্রকাশের জন্য যে দৃপ্ততা ও দুসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা তাদের যোগ্যতা ও প্রতিভাকে আরো শাণিত করেছে এবং তাদের চরিত্রকে আরো সতেজ ও উজ্জ্বল করেছ।
রসূল সা. সূচিত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই অসম্পূর্ণ দাওয়াতী অভিযানকে সম্পূর্ণ করার গৌরব লাভ করেন তাঁর স্থলাভিষিক্ত সাথী গণ এবং তাঁর প্রশিক্ষন প্রাপ্ত দল।
সর্বশেষ বিক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া
যে কোন বিপ্লব যখন দ্বন্দ্ব সংঘাতের সব কয়টা স্তর অতিক্রম করে এবং প্রাচীন নেতৃত্বের দর্প চূর্ণ করে চূড়ান্ত সাফল্যের স্বর্ণযুগে উপনীত হয়, তখন এই সাফল্যে ঈর্ষাকাতর হয়ে কোন কোন হীনমনা লোক ভেতরে ভেতরেই ক্ষুব্দ হতে থাকে। তারপর সুযোগ পেলেই সর্বশেষ ধৃষ্টতা প্রকাশ করে বিপ্লবের সয়লাবের সামনে বালুর বাঁধ দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ইসলামী বিপ্লবও এ ধরণের একটা অনাকাংখিত পরিস্থিতির সন্মুখীন হয়েছিলো। কোরায়েশ, ইহুদী এবং স্থানীয় নেতৃত্বের শক্তি যখন বিলুপ্ত হল এবং জনগণ ইসলামের দিকে অগ্রসর হতে লাগল, তখন একটা সর্বশেষ বিক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া সম্পুর্ণ নতুন আকারে দেখা দিল। কিছু লোক ভাবল, “এটা কেমন কথা যে, একজন লোক নবুয়তের দাবী তুলে আত্মপ্রকাশ করলো, গুটি কয়েক লোক তাঁর সমর্থক হল, দ্বন্দ্ব সংঘাত করল এবং তারপর এই লোকটাই সারা আরবের শাসক হয়ে বসলো। আমরাও এই পদ্ধতিটা যাচাই করে দেখলে ক্ষতি কি?” বিশেষত এই লোকগুলো যখন যাকাতের বিপুল সম্পদ মদিনার দিকে যেতে দেখতো, তখন তাদের মনটা লোভাতুর হয়ে উঠত। মুসলমানদের মধ্যে যারা আন্তরিকভাবে নয় বরং নেহাত পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে মুসলমান হয়েছে এবং তাদের মনে বিরোধী মনোভাব ধুমায়িত হচ্ছে, তাদেরকে তারা চিনত। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে তারা শেষ খেলাটা খেলবে বলে মনস্থ করলো। তারা একথা ভাল করেই জানত যে, এখন জাহেলী ধ্যান ধারণা ও পৌত্তলিক মতবাদের উপর ভর করে আর কোন আন্দোলন করা সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহর একত্ব, অহি, নবুয়ত ও আখেরাত সংক্রান্ত আকিদা বিশ্বাস সমগ্র পরিবেশ টাকে পরোপুরিভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তাই তারাও নিজেদের নকল মালে এই সব লেবেল এঁটে সাজিয়ে একটা দোকান খুলে মানুষকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু এই বেকুফরা জানতোনা যে, নাজারে কোন নতুন মুদ্রা চালাতে হলে শুধু একটা নকল নকশা ছাপানোই যথেষ্ট নয় এবং সেজন্য খাঁটি ধাতুরও প্রয়োজন। ইসলামের মুদ্রায় যে ধাতু ব্যবহারিত হতো (অর্থাৎ ইসলামের তৈরি জনশক্তি) তাও ছিল স্বত্বই নির্ভেজাল ও খাঁটি (রসূল সা. বলেছেনঃ তোমাদের যারা জাহেলী যুগে ভাল ছিল, ইসলামেও তারাই ভাল)। তদুপরি দশ বিশ বছর ধরে তাকে চুল্লীতে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মরিচামুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু স্বার্থপর লোকেরা সাধারণত সুক্ষদর্শী হয়না। তারা কেবল নিজেদের পছন্দনীয় স্বার্থই দেখে। কোন কিছু অর্জনের পেছনে যে ত্যাগ ও কুরবানী দেয়া হয়, সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করেনা। মোট কথা ইতিহাসের এই চিরসত্যটাই ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও পুনরায় সত্য হয়ে দেখা দিলো যে, প্রত্যেক জনপ্রিয় ও জনকল্যানমুখী আন্দোলন এবং প্রত্যেক মহান ব্যক্তিত্বকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য সমাজে নিকৃষ্ট শ্রেণীর লোকেরাই সক্রিয় থাকে। রসূল সা. পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দেয়া এ ধরণের কুচক্রী ষড়যন্ত্রীদের সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন।
১- ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, একটা প্রতিনিধি দলের সাথে জনৈক মুসাইলিমা বিন হাবীব অরফে মুসাইলিমা কাযযাব অর্থাৎ মিথ্যাবাদী মুসাইলিমা মদিনায় এসেছিল। ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানীতে জাঁকজমক দেখে তার মধ্যে তীব্র ক্ষমতার মোহ জেগে উঠেছিল। সে রসূল সা. এর কাছে একটা চিঠি লিখে ইসলামী সরকারের ক্ষমতার অংশীদারী চেয়ে বসলো এবং হুমকিও দিল। রসূল সা।। তার দাবী কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন। এতে অধীর হয়ে সে নবুয়তের দাবী করে বসলো। সে একজন সাহিত্যিক তো ছিলই। কোরআনের আয়াতের বাচনভংগীর অনুকরণ করে মিত্রাক্ষরান্ত শব্দ দিয়ে বাক্য বানিয়ে বানিয়ে সে অশিক্ষিত মরুচারিদের শুনাতো। যেহেতু কিছু লোক এখনো জাহেলিয়াতের সাথে সম্পর্ক রাখতো এবং তারা ইসলামী শিক্ষা দীক্ষায় তখনো তেমন পরিপক্কতা লাভ করেনি, তাছাড়া আঞ্চলিক ও গোত্রীয় বিদ্বেষ ও অহমবোধ তখনো কিছুটা অবশিষ্ট ছিল, তাই কিছু না কিছু অনুসারী তার ভাগ্যে জুটেই গেল। তাছাড়া তার মনগড়া ওহিতে নামায মাফ এবং ব্যকভিচার ও জুয়া বৈধ করে দেয়া হয়েছিলো, তাই পাপিষ্ঠ শ্রেনীর লোকেরা তার পাশে ভীড় জমালো। ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে তার তৈরি করা এই শক্তি হযরত আবু বকরের আমলে সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
২-মুসাইলিমার প্রতিবেশী এক মহিলাও নবুয়তের দাবী তুললো। সাজাহ নাম্নী এই মহিলার সাথে মুসাইলিমা সাক্ষাত করে এবং গোপনে আলোচনার মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে যোগসাজশ গড়ে উঠে। এক পর্যায়ে মুসাইলিমার মধ্যেই তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। মুসাইলিমার অশ্লীল সাহিত্য সাজাহকে যৌনতার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরে মুসলমানদের সাথে লড়াইতে মুসাইলিমা নিহত হলে সাজাহ তওবা করে এবং আমরন ইসলামের উপর বহাল থাকে।
৩- বিদায় হজ্জের পর ইয়ামানের উর্বর ও রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্ববহ অঞ্চলে আসওয়াদ আনসী নবুয়তের দাবীর মাধ্যমে বিদ্রোহ করে। তার আসল নাম ছিল যুলখিমার আবহালা বিন কা’ব। মাযহাজ গোত্র থেকে সে কিছু অনুসারী পেয়ে যায়। নাজরান এয়ালাকায় ও তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। তার প্রভাব বৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল তার যাদুমন্ত্র ইত্যাদি। ইসলামী সরকারের কিছু বেসরকারী কর্মকর্তা এবং দাওয়াতী কর্মীদেরকে সে হত্যা করায় এবং কতক লোককে সে নিজ এলাকা থেকে বহিষ্কার করে। রসূল সা. পাশ্ববর্তী কর্মকর্তাদেরকে শক্তি সঞ্চয় পুর্বক এই বিদ্রোহ দমন করবার নির্দেশ পাঠালেন। সে জনৈক ইরানী বংশোদ্ভূত মুসলমানকে হত্যা করিয়ে তার সুন্দরী স্ত্রীকে জোর পূর্বক দখল করে। এই মহিলা পরিপক্ক ঈমানদার ছিলেন। তাঁর সাহায্যে ইসলামী সরকার আসওয়াদকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। রসূল সা. এর ইন্তেকালের মাত্র দুই এক দিন আগে এই কুচক্রী খতম হয় এবং তার সহযোগীরাও নির্মূল হয়। তবে তার ছড়ানো বিভ্রান্তির প্রভাব হাযরামাওত থেকে তায়েফ পর্যন্ত ছড়ায় এবং হযরত আবু বকরের খেলাফত আমলের প্রথম ভাগেই তার পুরোপুরি উচ্ছেদ করা সম্ভবপর হয়।
৫-আম্মানের শাসক হাওযা বিন আলীর স্থলাভিষিক্ত লাকীত বিন মালেক আযদীর মাথায়ও নানা রকমের গোমরাহীর কীট কিলবিল করতে শুরু করেছিলো।
এই সব অপশক্তি বিভিন্ন একালায় মাথা তুলতে পেরেছিল নিছক আশেপাশের পুরনো জাহেলিয়াত পূজারী, মোনাফেক, অপরাধ প্রবণ, ব্যভিচার, মদ,জুয়া ও সুদের পুরনো ভক্ত, ইসলামের এককেন্দ্রিক শক্তির পরিবর্তে পুরনো গোত্রবাদে ফিরে যেতে ইচ্ছুক, যাকাত দিতে অনিচ্ছুক, মদিনায় যাকাতের সম্পদ যেতে দেখে মনে মনে ক্ষুব্ধ এবং ছোট ছোট নেতৃত্বের মোহাচ্ছন্ন ব্যক্তিবর্গের আসকারা পেয়ে। এই স্বার্থপর পুরনো পাপীদেরকে এই অপশক্তিগুলো সংঘটিত করেছিল এবং জাহেলিয়াতের মরনোন্মুখ শক্তি আপন আধিপত্য পুনর্বহালের শেষ চেষ্টা চালিয়েছিল।
কিন্তু রসূল সা. এর তৈরি করা নেতৃত্ব অত্যন্ত বিপদজনক পরিস্থিতিতেও কঠোর হস্তে এই সব অপশক্তিকে দমন করে এবং আরবের সকল মানুষকে অটুট শৃংখলার বন্ধনে আবদ্ধ করে।
ইসলামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সম্মেলন
হজ্জ হচ্ছে ইসলামের একটা উঁচু মানের এবাদত। যে কা’বা শরীফ ও তার পবিত্র চত্তর ছিল হযরত ইবরাহীমের দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু, যে হারাম শরীফের প্রতিটি অনুপরমানুতে ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত মূল্যবান স্মৃতি খোদিত রয়েছে, যার আকাশে বাতাসে হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আ. এর দোয়া গুঞ্জরিত হচ্ছে এবং যার সমগ্র পরিবেশে স্বয়ং রসুল সা. এর জীবন ও কর্মের স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সেই কা’বা শরীফ এই হজ্জের মাধ্যমে চিরদিনের জন্য ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের বিশ্ব জোড়া কেন্দ্রে পরিণত হল। প্রত্যেক সামর্থবান মুসলমানদের জন্যে সারা জীবনে কমের পক্ষে একবার এই কেন্দ্রে নির্দিষ্ট হজ্জের দিনে হাজির দেয়া, হজ্জের করণীয় কাজ গুলো সম্পন্ন করা হযরত ইবরাহীমের কুরবানীর সুন্নাত পুনরুজ্জীবিত করা, পূর্বতন নবীদের জীবনেতিহাস আলোচনা করা এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, সারা বিশ্ব থেকে আগত ইসলামী ভাইবোনদের সাথে সংযোগ স্থাপন করা এবং সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সর্বাত্মক বিনয়ের সাথে নিজেকে আল্লাহর নিকট সোপার্দ করা ফরয। হজ্জ ফরয করার এই আদেশ জারী হয় ৯ম হিজরীতে।
রসূল সা. এ বছরই হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. কে আমীরুল হাজ্জ তথা হজ্জ প্রতিনিধি দলের নেতা বানিয়ে তিনশো সাহাবী সহ মক্কায় পাঠালেন যেন তিনি নিজের নেতৃত্বে হজ্জ সম্পাদন করান। প্রসঙ্গত এই হজ্জ সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় উল্লেখ করছি। কেননা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়েই এই ঘটনা ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হযরত আবু বকর সিদ্দীককে রা. আমীর বানানোর পাশাপাশি হযরত আলী রা. কেও অন্য একটা দায়িত্ব সোপার্দ করা হয়েছিলো। সেটি হল তিনি যেন সূরা তওবার প্রথম চল্লিশ আয়াত হজ্জের সমাবেশে পড়ে শোনান এবং আল্লাহস নাযিল করা জরুরী ঘোষণাবলী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। প্রথম ঘোষণা ছিল এই যে, যারা সাবেক জাহেলী ও পৌত্তলিক ব্যবস্থার উপর বহাল থেকে রসূল সা. বা ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষন করেছিলো, তাদের আরো চার মাস সময় দেয়া হচ্ছে। এই চার মাস পর এই ধরণের সকল চুক্তি আল্লাহর হুকুমে বাতিল হয়ে যাবে।
এই চার মাসের মধ্যে তাদের নিজ নিজ কর্মপন্থা স্থির করে নিতে হবে যে, তারা কি ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করবে, না যুদ্ধ করবে, না ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলমান হিসেবে বসবাস করবে। অর্থাৎ এখন ইসলামী রাষ্ট্র নিজেদের অভ্যন্তরে স্বাধীন সত্তা বহাল রেখে নিজের দাবী ও চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম নয়, এ ধরণের চুক্তি বাতিল করার জন্যও প্রকাশ্য ঘোষণা জরুরী ছিল। তাছড়া চার মাসে সময় প্রতিপক্ষ কে দেয়া হয়েছিলো, তা যথেষ্ট ছিল। এ সুযোগও দেয়া হয়েছিলো যে, কোন মোশরেক যদি এই সময় মদিনায় ইসলামকে বুঝতে চায়, তবে সে নিরাপদে আসা যাওয়ার সুযোগ পাবে। তাছাড়া মোশরেকদের মধ্যে থেকেও যারা সততার সাথে চুক্তি মেনেছিল, তাদেরকে বাড়তি এই সুবিধা দেয়া হয়েছে যে, তাদের চুক্তি চার মাস পর বাতিল হবেনা বরং নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত বহাল থাকবে। আসল চাপ ছিল সেই মোশরেকদের উপর, যারা ইসলামের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা ও যুদ্ধ চালিয়েছে, সংঘর্ষ চালাতে গিয়ে সমস্ত নৈতিক নিয়ম নীতি লংঘন করেছে, বারবার ওয়াদা খেলাফ করেছে রবং মানবতা, ভদ্রতা, শিষ্টাচারের যাবতীয় রীতি ভংগ করেছে। এরা ছিল সেই সব মোশরেক যারা হকের পথে চলতে মানুষকে বাঁধা দিয়েছে, যারা আল্লাহর দ্বীনের খুঁত ধরার চেষ্টা করেছে, যারা রসূল সা. কে বাড়ী থেকে বিতাড়িত করতে সচেষ্ট হয়েছে এবং যারা সবসময় প্রথম আক্রমন চালিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ বাধায়।
দ্বিতীয় ঘোষণা ছিল, ভবিষ্যতে আর কোন মোশরেককে কা’বা শরীফের মোতাওয়াল্লী বানানো হবেনা। তৃতীয় ঘোষণা ছিল, ভবিষ্যতে আর কোন মোশরেক হারাম শরীফের সীমানার মধ্যে প্রবেশ করতে পারবেনা। এ বিষয়ে হযরত আলী রা. রসূল সা. এর পক্ষ থেকে এ কথাও জানালেন যে, এখন থেকে কোন ব্যক্তি কা’বা শরীফে উলংগ হয়ে তাওয়াফ করতে পারবেনা। চতুর্থ ঘোষণা, আল্লাহর পক্ষ থেকে চারটি নিষিদ্ধ মাস বহাল রাখা হল এবং এ মাস গুলোতে বিন্দু মাত্রও কোন রদবদল করার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি। কথা প্রসংগে এ কথাও জানিয়ে দেয়া হয় যে, মোশরেকরা যতই অপছন্দ করুক, আল্লাহ তাঁর এই দ্বীন কে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত ও বিজয়ী করার জন্যই তাঁর রসূলকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে।
কেউ কেউ হযরত আলী রা. এর এই অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে নানা রকমের আজগুবী ও উদ্ভট কথা বলে থাকে। অথচ ব্যাপার ছিল শুধু এটুকু যে, রসূল সা. হযরত আবু বকর রা. কে আমীর বানানোর মাধ্যমে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন, আর হযরত আলীকে ব্যক্তিগত প্রতিনিধি, ব্যক্তিগত সচিব বা দূত হিসাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ঘোষণা দেয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। সরকার পরিচালনার বিষয়টি সম্পর্কে যাদের সঠিক ধারণা আগ্রহে, তারা জানেন যে, কোন কোন ক্ষেত্রে এরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন না করে উপায়ন্তর থাকে না। সরকারের একজন গভর্নর থাকা সত্বেও কোন বিশেষ প্রয়োজনে আলাদা দুত পাঠাতে হয়।
এবার আমরা সেই বিশাল হজ্জ সমাবেশের বিবরণ দেব, যাতে রসূল সাঃ সশরীরে যগদান করেছিলেন এবং যেখানে ইসলামী আন্দোলনের জনশক্তির এক সমুদ্র তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনতে থাকে। দশম হিজরীতে যখন রসূল সা. হজ্জের সংকল্প করলেন, তখন সকল এলাকায় খবর পৌছানো হল। ইসলামী বিপ্লবের বীর সেনানীদের কাফেলা চারদিক থেকে মদিনায় সমবেত হতে লাগলো। এই সফরে উম্মুল মুমিনীনগনের সকলেই রসূল সা. এর সাথে যান। যুল হুলায়ফা থেকে তিনি এহরাম বাঁধেন এবং এখান থেকেই তিনি সেই ঐতিহাসিক শ্লোগান তোলেন, যা আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়া সকল হাজির অন্তরাত্মা থেকে উত্থিত হয়ে থাকে। এই শ্লোগান হলঃ “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক…………”। অর্থাৎ “আমরা হাজির, হে আল্লাহ আমরা হাজির। সকল প্রশংসা তোমার, সকল নিয়ামত তোমার, সমস্ত রাজত্ব তোমার, তোমার কোন শরীক নেই”।
পথিমধ্যে যেখানেই কোন পাহাড়ে ওঠানামা করতে হয়েছে, সকলে সমস্বরে “লাব্বায়েক লাব্বায়েকা”।
মক্কার কাছাকাছি গিয়ে ‘যীতুয়া’ তে তিনি কিছুক্ষন যাত্রা বিরতি করলেন। তারপর মুসলমানদের এই বিশাল জনসমুদ্রকে সাথে নিয়ে মক্কায় প্রবেশ করলেন। তিনি প্রথমে তাওয়াফ করলেন। তারপর সাফা মারওয়া গেলেন। সেখান থেকে কা’বার দিকে ফিরে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিলেন। ৯ই জিলহজ্জ ওয়াদিয়ে নামেরায় উপস্থিত হলেন। দুপুরের পর আরাফাত ময়দানে উপনীত হলেন। সেখানে পাহাড়ের উপর আরোহন করে ‘কুসওয়া’ নামের উটনীর পিঠের উপর বসে খুতবা দিলেন। চারদিকে মকাবিবররা দাঁড়িয়েছিলেন, যারা প্রতিটি বাক্যের পুনরাবৃত্তি করেছিল। এভাবে রসূল সা. এর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ সমবেত প্রত্যেক ব্যক্তির কানে পৌঁছে যাচ্ছিলো।
আজ রসূল সা. এর মনে এক অভুতপূর্ব অনুভূতি বিরাজ করছিল। আজ তাঁর সারা জীবনের শ্রমের ফসল এক লাখ চুয়াল্লিশ মতান্তরে এক লাখ চব্বিশ হাজার মুসলমান তাঁর সামনে উপস্থিত।
ইসলামী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মেনিফেষ্টা
এই সময় রসূল সাঃ দুটো ভাষণ দিয়েছিলেন। প্রথমটা ৯ই জিলহজ্জ আরাফাতের পাহাড়ের উপর থেকে। দ্বিতীয়টা ১০ই জিলহজ্জ মিনায়। এ দুটি ভাষণের বক্তব্য কিছু কিছু বর্ণনায় একাকার হয়ে গেছে।
এ দুটি ভাষণ একাধিক কারণে অসাধারণ গুরুত্বের অধিকারী। প্রথমত, রসূল সাঃ সবচেয়ে বড় ইসলামী সমাবেশে ভাষণ দেন, এবং এমন সময় যখন তাঁর লাগানো সত্যের কালেমার চারা গাছটি বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়ে ফল দিতে শুরু করেছে। প্রচন্ড বিরোধিতার যুগ অতিক্রম করে এত বড় সাফল্য লাভ স্বয়ং জীবন ও চরিত্রের এক বিরাট পরীক্ষা হয়ে থাকে। এ পরিস্থিতিতে তিনি না হয়ে কোন দুনিয়াদার ব্যক্তি হলে এবং নিছক রাজনৈতিক সাফল্য ও বিজয় অর্জনকারী একজন বিজেতা হলে যাবতীয় ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে উঠতো এবং দম্ভ ও অহংকারে নিজেকে খোদার আসনে অধিষ্ঠিত করে ছাড়তো। রসূল সা. ছাড়া অন্য কোন স্বার্থপর ব্যক্তি এই পর্যায়ে পৌঁছলে ধার্মিকতার সমস্ত আলখেল্লা দূরে ছুড়ে ফেলতো এবং ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করতো। কিন্তু রসূল সা. কে আগের চেয়েও বেশী বিনয় এবং আগের চেয়েও বেশী আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখা যায়। দ্বিতীয়ত যেহেতু রসূল সা. স্বীয় প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, এত বড় মুসলিম সমাবেশে তাঁর ভাষণ দিতে পারার এটাই শেষ সুযোগ, তাই এতে তিনি বিদায়ী নির্দেশাবলী সম্বলিত ওসিয়ত পেশ করেছিলেন, যার প্রতিটি শব্দ মূল্যবান। তৃতীয়ত রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের এই পূর্ণতার স্তরে পৌঁছে যাওয়ার পর ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে সমগ্র মানবজাতির নামে কোন বাণী বা কোন মেনিফেষ্টা দেয়ার এটাই ছিল উপযুক্ত সময়। তাই তিনি এ দায়িত্বটা অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। চতুর্থত এ ভাষণ দুটো রসূল সা. এর শ্রেষ্ঠ বাগ্মীতার স্বাক্ষর এবং তাঁর সর্বোত্তম অলংকার সমৃদ্ধ ভাষণ সমূহের অন্যতম। এ দ্বারা এই মহান ও পবিত্র ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বকে উপলব্ধি করা সহজ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, এই ভাষণ দুটোর একাংশ সুনির্দিষ্ট আভ্যান্তরীণ অবস্থা ও সমস্যাবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট, আর এক অংশ আন্তর্জাতিক মেনিফেষ্টা সম্বলিত। মূল বক্তব্যই এই বিভক্তিকে স্পষ্ট করে দেয়।
আরাফাতের ভাষণ
-সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য। আমরা শুধু তাঁরই প্রশংসা করি। তাঁরই কাছে সাহায্য চাই। তাঁর নিকটই নিজেদের গুণাহখাতা মাফ চাই। তাঁরই কাছে অনুশোচনা পেশ করি। আমরা আমাদের প্রবৃত্তির ক্ষতিকর তৎপরতা ও নিজেদের অন্যায় কর্মকান্ড থেকে তাঁরই আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করেন, তাকে কেউ বিপদগামী করতে পারেনা। আর আল্লাহ যাকে হেদায়াত লাভের সুযোগ দেননা, তাকে কেউ সরল ও সঠিক পথে চালাতে পারেনা।
-আমি ঘোষণা করছি, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ সা. তাঁর বান্দা ও রসূল।
-হে আল্লাহর বান্দারা, আমি তোমাদেরকে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করার উপদেশ দিচ্ছি ও উৎসাহিত করছি।
-আমি কল্যাণময় কথা দ্বারা আমার বক্তব্য শুরু করছি।
-হে জনতা, তোমরা আমার কথাগুলো মনোনিবেশ সহকারে শোন। আমি তোমাদেরকে বুঝিয়ে বলছি। কেননা এ বছরের পর তোমাদের সাথে এই স্থানে আমার আর সাক্ষাত হবে বলে মনে হয়না।
-হে জনমন্ডলি, তোমাদের একের জীবন ও সম্পদ অপরের জন্য নিষিদ্ধ। তোমাদের প্রভুর নিকট পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত এ বিধান মেনে চলবে। তোমাদের এই মাস এই শহর এবং তোমাদের এই দিন যেমন পবিত্র ঠিক তেমনি।
-জেনে রেখ, আমি তোমাদের কাছে কথা পৌঁছে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো।
-যার হাতে কারো কোন জিনিস আমানত রয়েছে, সে যেন তা তার মালিকের কাছে পৌঁছে দেয়।
-জাহেলিয়ত যুগের সুদগুলো বাতিল করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা আব্বাসের সুদ রহিত করলাম।
-জাহেলি যুগের সমস্ত খুনের বদলার দাবী রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমের বিন রবীয়ার খুনের দাবী রহিত করলাম। জাহেলিয়ত যুগের সমস্ত পদ পদবী ও সম্মান বাতিল করা হলো। কেবল কা’বা শরীফের তত্ত্বাবধায়কের পদ এবং হাজীদেরকে পানি সরবরাহের পদ-এই দুটো পদ বহাল থাকবে।
-ইচ্ছাকৃত হত্যাকান্ডের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। অনিচ্ছাকৃত হত্যাকান্ডের বদলা একশো উট। এ ক্ষেত্রে একশো উটের বেশী দাবী করলে তা হবে জাহেলী রীতি।
-হে জনমন্ডলি, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর শয়তান আর আশা করেনা যে এই ভুখন্ডে তার আনুগত্য করা হবে। কিন্তু তোমরা যে গুনাহগুলোকে হালকা মনে কর, তাতে যদি শয়তানের আনুগত্য কর, তবে তাতেও সে খুশী হবে।
-হে জনমন্ডলি, হারাম মাসগুলোর রদবদল করা অধিকতর কুফরি কাজ। এক বছর তাকে হারাম এবং আরেক বছর হালাল গণ্য করে আগ পিছ করে কোন মতে গুণতি পূরণ করার মাধ্যমে কাফেররা আরো বেশী গোমরাহীতে লিপ্ত হয়।
-নিশ্চয় আবর্তনের পথ ধরে মহাকাল আজ তার সেই প্রারম্ভিক বিন্দুতে প্রত্যাবর্তন করেছে, যেখানে সে আল্লাহ কর্তৃক আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিনে ছিল। অর্থাৎ আল্লাহর নিকট মাস সুনিশ্চিতভাবে বারোটাই। যখন আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তখন থেকেই তাঁর অদৃষ্ট লিপিতে মাসের সংখ্যা এভাবেই লেখা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে চার মাস নিষিদ্ধ। তিনটে মাস ধারাবাহিক-জিলকদ, জিলহজ্জ ও মুহাররম। আর একটার অবস্থান একাকী অর্থাৎ রজব মাস, যা জমাদিউস সানী ও শাবানের মাঝখানে অবস্থিত।
-জেনে রেখ, আমি কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থেকো।
-হে জনতা, তোমাদের নারীদেরকে তোমাদের ওপর কিছু অধিকার দেয়া হয়েছে।
তোমাদেরও তাদের কাছে কিছু অধিকার প্রাপ্য রয়েছে। তোমাদের স্বামীদের শয়নকক্ষে তোমরা ছাড়া আর কাউকে আসতে না দেয়া তোমাদের কর্তব্য। তোমরা পছন্দ করনা এমন কোন ব্যক্তিকে তোমাদের অনুমতি ছাড়া বাড়ীতে ঢুকতে দেয়া তোমাদের স্ত্রীদের পক্ষে অনুচিত। কোন নির্লজ্জ ও অশ্লীল কাজ করা স্ত্রীদের উচিত নয়। যদি তারা তা করে তবে তোমাদেরকে আল্লাহ অনুমতি দিয়েছেন যে, তাদের সংশোধনের জন্য তাদের কাছ থেকে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে পার। এরপর তারা অনুগত হয়ে চললে তাদেরকে নিয়মানুযায়ী খোরপোশ দেয়া তোমাদের দায়িত্ব। নিশ্চয়ই মহিলারা তোমাদের অধীন। তারা নিজেদের কল্যাণের জন্য নিজেরা কিছু করতে পারেনা। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে নিজেদের সাথী বানিয়েছে এবং তাদের দেহকে আল্লাহরই আইন অনুসারে ভোগ করে থাক। কাজেই নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর এবং উত্তম পন্থায় তাদেরকে শিক্ষা দীক্ষা দান কর।
-জেনে রেখ, আমি আমার কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমিও সাক্ষী থেকো।
-হে জনতা, মুসলমানরা পরস্পরের ভাই ভাই। এক ভাই এর সম্মতি ছাড়া তার সম্পদ অন্য ভাই কর্তৃক গ্রহণ করা বৈধ নয়।
-সাবধান, আমি কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ! তুমিও সাক্ষী থাকো।
-আমার পরে এই ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পরিত্যাগ করে তোমরা কাফের সুলভ জীবন গ্রহণ করে একে অপরের গলা কাটতে শুরু করে দিওনা।
-আমি তোমাদের কাছে এমন একটা জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা মেনে চললে তোমরা বিপদগামী হবেনা। সেটি হলো আল্লাহর কিতাব।
-সাবধান, আমি কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমিও সাক্ষী থাকো।
-তোমাদের কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। বল, তোমরা কী বলবে? লোকেরা সমস্বরে বলে উঠলো, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং উম্মাতের শুভ কামনায় যা কিছু করা উচিত, তা আপনি করেছেন। সত্যের ওপর থেকে সমস্ত পর্দা তুলে দিয়েছেন এবং আল্লাহর আমানতকে আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন।”
-হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক।
-যারা এখানে উপস্থিত আছে, তারা যেন এই কথাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়। হয়তো বা কিছু উপস্থিত লোকের চেয়ে কিছু অনুপস্থিত লোক এ কথাগুলোকে অধিকতর ভালোভাবে মনে রাখতে পারবে এবং সংরক্ষণ করবে।
-হে জনতা, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর জন্য উত্তরাধীকারের স্থায়ী অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এক তৃতীয়াংশের বেশী সম্পত্তি ওসিয়ত করা জায়েজ নয়।
-যার বিছানায় সন্তান জন্ম নেবে সন্তান তারই। আর ব্যভিচারীর জন্য পাথর।”
-যে ব্যক্তি নিজের পিতা ছাড়া আর কাউকে পিতা বলে মেনে নেবে অথবা যে ক্রীতদাস নিজের মনিব ছাড়া অন্য কাউকে মনিব বলবে, তার ওপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের এবং সকল মানুষের অভিসম্পাত! কেয়ামতের দিন তার কাছ থেকে কোন বিনিময় গ্রহণ করা হবেনা।
-তোমাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি নেমে আসুক।
মিনার ভাষণ
-হে জনমন্ডলী, আমার পর আর কোন নতুন নবী আসবেনা। তোমাদের পরও কোন নতুন উম্মাত জন্ম নেবেনা। সুতরাং মনোযোগ দিয়ে শোন এবং আপন প্রতিপালকের দাসত্ব কর। পাঁ ওয়াক্ত নামায পড়। রমযানের রোযা রাখ। সম্পদের যাকাত সাগ্রহে দিতে থাক। হজ্জ আদায় কর এবং আপন নেতা ও দায়িত্বশীলদের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা আল্লাহর জান্নাতে যেতে পার।’
আন্তর্জাতিক মেনিফেষ্টো হিসাবে এই দুটি ভাষণে রসূল সা. যা কিছু বর্ণনা করেছেন, তা মানবীয় চিন্তা ও কল্পনার অতীত। বরঞ্চ আর কোন মেনিফেষ্টো কার্যত এই মেনিফেষ্টোর মত এত উঁচুমানের মানুষ তৈরী করতে পারেনি। এতে আল্লাহর একত্বের বিপ্লবী আকীদা ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহর দাসত্বও এবাদতকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মৌল চালিকা শক্তিরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। এতে মুসলমানদের জন্য পরস্পরের জানমাল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং হত্যাকান্ডের শাস্তি মৃত্যুদন্ড অপরিহার্য করা হয়েছে। সুদখোরীর জাহেলী রীতিকে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাগৈসলামিক যুগের প্রতিশোধ ও পাল্টা-প্রতিশোধের অব্যাহত ধারাবাহিকতাকে রহিত করা হয়েছে। জাহেলী যুগের পদমর্যাদা ও খেতাব খতম করা হয়েছে। এতে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার নির্ধারিত হয়েছে। পারিবারিক ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুত করা হয়েছে। নারীদেরকে আল্লাহর আমানত আখ্যায়িত করে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে জরুরী আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহর কিতাবকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার ভিত্তি বলে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহর একত্ব ও মানবজাতির পিতার এককত্বের ভিত্তিতে মানবীয় ঐক্যের ধারণা দেয়া হয়েছে। ভৌগলিক ও বংশীয় ভেদাভেদকে নিরর্থক এবং সততা ও খোদাভীতিকে সম্মান ও মহত্বের মানদন্ড বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যখনই এবং পৃথিবীর যে স্থানেই ইসলামী আন্দোলন চলবে এবং ইসলামী ব্যবস্থা চালু হবে, তার ভিত্তি এই অটল ও অটুট মতাদর্শগুলোর ওপরই প্রতিষ্ঠিত হবে। এ মেনিফেষ্টো ইসলামের মৌলিক মেনিফেষ্টো এবং মানবজাতিকে এর দিকে ডাকা যেতে পারে। আর এই মেনিফেষ্টোর বিরুদ্ধে জীবনের যে কাঠামো তৈরী হবে, তা অনৈসলামিক হবে এবং কোন খাঁটি মুসলমান তা গ্রহণ করতে পারেনা। এই মেনিফেষ্টোকে আমরা আমাদের যে কোন নেতৃত্বের তৎপরতা যাচাই করার কষ্টিপাথর বানাতে পারি এবং আমাদের প্রত্যেক সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপকে এর আলোকে মূল্যায়ন করতে পারি। এ মেনিফেষ্টোর দর্পণে আমরা নিজেদের চেহারাও দেখতে পারি, অন্যান্য অনৈসলামিক সমাজব্যবস্থাকেও দেখতে পারি।
এ হচ্ছে আমাদের প্রিয় নবীর শেষ ভাষণ। এ ভাষণ তিনি আমাদের উদ্দেশ্যেই দিয়েছেন। এ ভাষণ রসূল সা. এর ওসিয়ত স্বরূপ। এর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরার পর রসূল সা. দরদভরা কন্ঠে বলেছেন, আমি আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এ কথাটা পড়ে আমাদের সাবধান ও সচেতন হয়ে যাওয়া উচিত। আমাদের এ যাবতকার আচরণে অনুতপ্ত হয়ে এবং অনৈসলামিক ব্যবস্থার দাসত্বের জিঞ্জীর ছুড়ে ফেলে দিয়ে রসূল সা. এর জীবনাদর্শের অনুসারী হওয়া উচিত। যে ব্রত সফল করার জন্য রসূল সা. এত কষ্ট ও নির্যাতন সহ্য করেছেন, যে অসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার কোন নজীর পাওয়া যায়না, সেই ব্রত সফল করতে আমাদেরও এগিয়ে আসা উচিত।
রসূল সা. সুষ্ঠু ও শান্তভাবে হজ্জ আদায় করলেন। হজ্জ পালনরত সকল মুসলমানের সাথে দেখা সাক্ষাত করলেন। লোকেরা বহু প্রশ্ন করলো। অতঃপর বিদায়ী তওয়াফের মাধ্যমে এই পবিত্র সফর সমাপ্ত করলেন।
এ ছিল ইসলামের পূর্ণতা অর্জনের দৃশ্য। দেড় লাখ মানুষের এই উদ্দীপনায়ময় ও স্বতস্ফুর্ত সমাবেশ যে বিষয়ে সাক্ষ্য দিল, তা এই যে, ইসলামী আন্দোলন আসল বিজয় অর্জন করেছিল জনমতের যুদ্ধে এবং হৃদয়ের অভ্যন্তরে পরিবর্তন সাধনের সংগ্রামে। আর ভেতরের এই পরিবর্তনই বাইরের গোটা জগতে বিপ্লব এনে দিয়েছিল।