ইহুদীদের শাইলকী কর্মকান্ড
এটা সবর্জন বিদিত যে, মদিনার সীমিত উপায় উপকরণ ও সহায় সম্পদের ওপর যখন মোহাজেরদের চাপ বাড়তে লাগলো এবং সহায় সম্বলহীন ও আশ্রয়হীন মানুষেরা নিজেদের অর্থনৈতিক জীবনের পুনর্গঠনে নিয়োজিত হলো, তখন ইসলামী আন্দোলনের অধিকাংশ কর্মীর মধ্যে দারিদ্র ও ক্ষুধা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দারিদ্র ও ক্ষুধার এই পরীক্ষায় ইসলামী আন্দোলনের নেতা স্বয়ং এবং তাঁর পরিবার পরিজন সাধারণ সাথীদের সমান অংশীদার ছিলেন। বরং পরীক্ষার প্রধান অংশ তাঁর ঘাড়েই পড়লো। বিপদ মুসিবত কখনো একাকী আসে না। দারিদ্র ও ক্ষুধার কষ্টের পাশাপাশি মোহাজেরদের মধ্যে রোগব্যাধিও ছড়িয়ে পড়ে। নতুন আবহাওয়া বহিরাগতদের শরীরে সইলনা। তারা একের পর এক রোগাক্রান্ত হতে লাগলো। অপ্রতুল খাদ্যের সাথে সাথে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়া এক কষ্টদায়ক জ্বর মোহাজেরদের হাড্ডিসার ও অর্থনৈতিক চেষ্টা সাধনার অযোগ্য করে তুললো। ইসলামী আন্দোলন একদিকে সমস্যা ও বিরোধিতার নিত্য নতুন ফ্যাকড়ার সম্মুখীন হচ্ছিল। সদ্য গঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বদিক দিয়ে পুনর্গঠনের প্রয়োজন ছিল। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ শত্রুদের পক্ষ থেকে হরেক রকমের হুমকি আসছিল। কর্মক্ষম লোকেরা ক্রমেই শয্যাগত হচ্ছিল। খাদ্য ও পোশাকের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিলনা। এমন একটা অবস্থাকে এই ক্ষুদ্র বিপ্লবী দল যে শক্তির বলে অতিক্রম করলো, তা ছিল আল্লাহর প্রতি ঈমান, উদ্দেশ্যের প্রতি ভালোবাসা ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধের শক্তি। আসলে বড় বড় ঐতিহাসিক কাজ সম্পাদনকারী ব্যক্তি ও সংগঠন সমূহের কেন্দ্রীয় শক্তিই হয়ে থাকে ঈমান ও ভ্রাতৃত্ব। এই শক্তি শারীরিকভাবে দুবর্ল লোকদেরকেও সবল রেখেছিল এবং সহায়-সম্পদের ঘাটতির প্রভাব অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়েও প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলছিল, তাকে সর্বব্যাপী মহামারী রোগ অনেকটা দুবর্ল করে দিল। এই সময় এ গুজবও ছড়িয়ে পড়ে যে, মদিনার ইহুদীরা যাদু করে দিয়েছে এবং মুসলমানরা এখন আর ওখানে টিকে থাকতে পারবে না। এ সময়ে পরিস্থিতি কত সংকটাপন্ন ছিল, সে সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য রসূল সা. এর কতিপয় সাহাবীর বক্তব্য শুনুন।
হযরত আবু বকর রোগ শয্যায় যন্ত্রণায় ছটফট করছেন এবং একটি কবিতা আবৃত্তি করে উদ্বেগ প্রকাশ করছেনঃ
******
“প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিবারে অবস্থান করে। অথচ মৃত্যু তার জুতোর ফিতের চেয়েও নিকটবর্তী।”
এদিকে হযরত বিলাল রোগ শয্যায় এপাশ ওপাশ করছেন, আর প্রচণ্ড রোগযন্ত্রণায় কাতর হয়েও কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন, যার অর্থ হলোঃ
‘‘এখন মক্কার সমতল প্রান্তের, পাহাড় ও ঝর্ণার স্মৃতি চারণ করা হচ্ছে।যে সমতল ভূমিতে আযখর ও জুলাইল ঘাস জন্মে, সেখানে কি একটা রাত কাটাতে পারবো কখনো? মাজান্না ঝর্ণার পানিতে কি আর কখনো নামতে পারবো এবং শামা ও তোফায়েল পাহাড়ের দৃশ্য কি আর কখনো দেখতে পাবো?
আমের গাইছিলেনঃ ‘‘আমি মৃত্যুর স্বাদ উপভোগ করার আগেই মৃত্যুকে পেয়েছি।কাপুরুষের মৃত্যু আসে তার ওপর থেকে।’’ ইনি এত তীব্র শারীরিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন যে, মৃত্যু আসার আগে যেন মৃত্যুর পায়ের আওয়ায পেয়ে গিয়েছিলেন।’’
হযরত শাদ্দাদও রুগ্ন ছিলেন।রসূল সা. তাঁর এই সাথীকে দেখতে এলেন।রোগী রোগযন্ত্রণায় কাতর হয়ে বললেন, ‘‘বাতহানের পানি পান করলে হয়তো উপকার হতো।’’ রসূল সা. বললেন, চলে যাও।কে বাধা দিচ্ছে? রোগী বললেন, ‘‘হিজরতের কী হবে?’’ রসূল সা. প্রবোধ দিয়ে বললেন, ‘‘চলে যাও।তুমি যেখানেই যাবে মোহাজেরই থাকবে।’’
হোদায়বিয়ার সন্ধির পর যখন মুসলমানরা মক্কায় গেল, তখন তাদের শরীর বারবার রোগাক্রান্ত হওয়ার দরুন ভীষণ দুর্বল ছিল।আর এই অবস্থা দেখে মক্কাবাসী টিটকারী দেয় যে, ‘‘আবার মদীনায় যেওনা।’’ এই টিটকারীর কারণে রসূল সা. এর নির্দেশে মুসলমানরা বিরোচিত ভঙ্গিতে চলতো।
এসব কারণে রসূল সা. বলতেনঃ (********)
‘‘অর্থাৎ হিজরত কোন ছেলে খেলা নয়, বরং খুবই কঠিন কাজ।জনৈক বেদুঈন একবার রসূলের সা. কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করে।কিন্তু মদিনায় আসা মাত্রই তার জ্বর হলো।সে ইসলামকে অশুভ মনে করে ইসলাম পরিত্যাগ করে চলে গেল।এই ঘটনায় রসূল সা. বললেনঃ ‘‘মদিনা স্বর্ণকারের চুল্লীর মত।খাদকে বের করে দেয় এবং খাঁটি সোনাকে আলাদা করে।’’ (বুখারী) অর্থাৎ আন্দোলনের মহান কাজ সম্পাদনের জন্য যারা উদ্যোগী হয়, তাদেরকে পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়।সেই পরীক্ষায় খাঁটি ঈমানদার লোকেরাই পাশ করে।মেকি ও ভন্ড ঈমানের দাবীদাররা কোন না কোন পর্যায়ে আলাদা হয়ে যায়।তাই মদিনার এই অগ্নি পরীক্ষার পর্যায়টা স্বর্ণকারের চুল্লীর ভূমিকা পালন করছিল। (উসওয়ায়ে সাহাবা মাওলানা আবদুস সালাম নদভী)
এই সময়ই রসূল সা. আল্লাহর কাছে কাতর কণ্ঠে দোয়া করেনঃ ‘‘হে আল্লাহ! আমাদের কাছে মক্কাকে যেমন আকর্ষণীয় বানিয়েছিলে, মদিনাকেও তেমনি চিত্তাকর্ষক বানাও, অথবা তার চেয়েও বেশি।আমাদের জন্য এর খাদ্য শস্যে বরকত দাও।আর মদিনায় যে রোগ মহামারী এসেছে, তাকে মাহিয়ার দিকে সরিয়ে দাও।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম ২য় খন্ড)
অন্যদিকে দারিদ্র ও ক্ষুধা চরম উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।নতুন জায়গায় এসে অর্থনৈতিক জীবনের ভিত্তি গড়ে তোলা এবং তাতে হালাল জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থা করা- তাও এমন পরিস্থিতিতে যে আন্দোলনের সামনে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন ব্যয়ের খাত এসে উপস্থিত হচ্ছিল- কত কঠিন, তা বলারই অপেক্ষা রাখেনা।সত্যের সৈনিকদের এই সময় যে বিপর্যয়কর অবস্থা অতিবাহিত করতে হয়েছে তার বেদনাদায়ক বিবরণে ইতিহাস ও সীরাতের গ্রন্থাবলী পরিপূর্ণ।
হযরত আবু তালহা এই দুর্যোগকালীন সময়ের বিবরণ দিয়েছেন এভাবেঃ
আমরা ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে সাহায্য লাভের জন্য রসূল সা. এর নিকট গেলাম।পুরো অবস্থা জানালাম এবং পেট খুলে দেখালাম যে, একাদিক্রমে কয়েকদিন উপোষ করার কারণে (পাকস্থলীতে সৃষ্ট বিশেষ ধরণের প্রদাহ রোধ করার উদ্দেশ্যে) পেটে একটা পাথর বেঁধে রেখেছিলাম।এটা দেখার পর মানবেতিহাসের ঐ শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিটিও পেট খুলে দেখালেন, সেখানে একটা নয়, দুটো পাথর বাঁধা রয়েছে।এ দৃশ্য দেখে আমরা যারা নিজেদের দুঃখের কাহিনী বণ্যনা করছিলাম, মনে সান্ত্বনা পেয়ে গেলাম। (শামায়েলে তিরমিযী, আইশুন্নাবী সংক্রান্ত অধ্যায়)
একবার এ ধরনেরই পরিস্থিতিতে হযরত আবু বকর রা. এলেন এবং সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য নিজের দুর্দশা বর্ননা করতে চাইলেন।কিন্তু এতে অনর্থক রসূল সা. এর মনোকষ্ট বেড়ে যাবে এই ভেবে চুপ থাকলেন।কিছুক্ষণ পর হযরত ওমর রা. এলেন।তিনিও একই মুসিবতে আক্রান্ত ছিলেন।তাঁর আগমনের কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি খোলাখুলি বলে ফেললেন, ক্ষুধার তাড়নায় দিশেহারা হয়ে গেছি।একথা শুনে রসূল সা. বললেন, আমার অবস্থাও তদ্রুপ।সিদ্ধান্ত হলো, সবাই মিলে বাগবাগিচার মালিক অপেক্ষাকৃত সচ্ছল সাহাবী আবুল হাইসামের কাছে যাওয়া যাক।তিনজন তার কাছে যখন গেলেন, দেখলেন, ঐ বেচারা ভৃত্য না থাকায় নিজেই পানি আনতে গেছে।ফিরে এসে আগন্তুকদের দেখে আনন্দের আতিশয্যে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।তারপর বাগিচায় নিয়ে গিয়ে খেজুর খেতে দিলেন।তারা খেজুর খেয়ে পানি পান করলেন এবং আবুল হাইসামের জন্য দোয়া করে ফিরে এলেন। (শামায়েলে তিরমিযী)
সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস একবার বর্ণনা করেন, আমিই ইসলামী আন্দোলনের সেই সদস্য যার হাতে সর্বপ্রথম ইসলামের একজন শত্রুর রক্ত ঝরেছে এবং আমিই জেহাদের ময়দানে সর্বপ্রথম তীর নিক্ষেপ করেছি।আমরা এমন অবস্থায় জেহাদ করেছি যে, গাছের পাতা ও কিকর ফল খেতে খেতে আমাদের মুখে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে যেত এবং উট ও ছাগলের মত পায়খানা হতো। [এ ঘটনাও শামায়েলে তিরমিযী থেকে গৃহীত।এটা কিছুটা পরবর্তীকালের ঘটনা হলেও এ দ্বারা মদিনার অর্থনৈতিক সংকটকালের ব্যাপারে সাধারণ ধারণা জন্মে।]
রসূল সা. এর ঘনিষ্ট সহচর হযরত আবু হুরায়রা জানান, ‘‘এক সময় আমি মসজিদে নববীর মিম্বর ও হযরত আয়েশার কক্ষের মাঝখানে ক্ষুধার জ্বালায় বেহুশ হয়ে পড়েছিলাম।লোকেরা আমাকে জ্বিনে ধরা ভেবে (চিকিৎসার ব্যবস্থা হিসেবে) পা দিয়ে ঘাড় টিপে দিত।অথচ আমাকে জ্বিনে ধরতোনা।শুধু ক্ষুধার জ্বালায় এমন অবস্থা হতো। (শামায়েলে তিরমিযী, আইশুন্নবী অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।হযরত আবু হুরায়রা আরো জানান যে, একবার আমি হযরত ওমরের সাথে কোথাও যাচ্ছিলাম।একটা আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করতে করতে চলছিলাম।সহসা বেহুশ হয়ে পড়ে গেলাম।ক্ষুধার কারণে এ অবস্থা হয়েছিল।
এরূপ পরিস্থিতিতে যদিও রাসূল সা. বাইতুল মালে আগত দ্রব্যাদি তাৎক্ষণিকভাবে সাহাবীদের ক্ষুধা দূর করার জন্য ব্যয় করতে থাকতেন।কিন্তু সংকট এত ব্যাপক ছিল যে, বাইতুল মালের উপার্জন এবং সচ্ছল মোহাজের ও আনসারদের মুক্ত হস্তে দান ও যথেষ্ট হতোনা।সাধারণ ক্ষুধার্ত মোহাজেরগণ ছাড়াও আসহাবে সুফফার (মসজিদে নববীতে সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থানরত অসহায় সাহাবীগণ) স্থায়ী নিবাসও বিপুল সাহায্যের মুখাপেক্ষী ছিল।অনবরতই মেহমান আসতো।বেদুঈনরা যখন তখন ইসলাম গ্রহণ, সাক্ষাত ও শরীয়তের বিধি জিজ্ঞেস করতে আসতো, সাহায্য প্রার্থীরা এসে এসে সাহায্য চাইত।এবং একের পর এক মোহাজেরদের আগমণও অব্যাহত ছিল।এরূপ পরিস্থিতিতে বাইতুল মাল কতদূর সামাল দিতে পারে? সাথীদের ও অভাবীদের চাহিদার চাপ যখন বেড়ে যেত তখন রসূল সা. সাহায্যের জন্য আবেদন জানাতেন এবং যে যা পারতো, আন্তরিকতা সহকারে দিত।কখনোবা ঋণ গ্রহণ করা হতো।মুসলমানদের ভেতর থেকে বেশি ঋণ পাওয়া যেতনা।তাই ইহুদী বিত্তশালীদের কাছে যেতে হতো।ইহুদীরা ছিল ঝানু সুদখোর মহাজন।গোটা এলাকায় ছড়িয়ে ছিল তাদের সুদের জাল।কিন্তু মুহম্মদ সা. ও তাঁর সাথীদেরকে তারা যে উদ্দেশ্যে ঋণ দিত, তা ছিল সুদের চেয়েও ভয়ংকর।উদ্দেশ্য ছিল অর্থ কড়ি ও সাহায্যের জোরে তাদেরকে বশীভূত করা।এই মানসিকতা নিয়ে তারা ঋণ আদায় করতে গিয়ে একেবারেই শাইলকের রূপ ধারণ করতো এবং অপমানজনক আচরণ করতো।মোশরেকদের অবস্থাও ছিল একই রকম।এই তিক্ত অভিজ্ঞতা স্বয়ং রসূল সা. ও তাঁর সাথীদেরকেও অর্জন করতে হয়েছিল।এ ধরণের বহু ঘটনা ইতিহাস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ রয়েছে।বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গকারীগণ এত দুঃখকষ্ট সহ্য করেছেন।এমন চরম বেগতিক অবস্থায়ও ইসলামের সৈনিকদের ঈমান ও লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে বিন্দুমাত্রও দুর্বলতা আসেনি।
রসূল সা. নিজের ঘনিষ্ট সহচর ও ব্যক্তিগত সহকারী হযরত বিলালকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন যেন ইসলামী আন্দোলন ও তার সৈনিকদের প্রয়োজনে বাইতুলমালে প্রাপ্ত সম্পদ মুক্তহস্তে ব্যয় করেন।হযরত বিলাল করতেনও তাই।একবার নব্বই হাজার দিরহাম এল এবং তা একটা মাদুরের উপর স্তুপ করে রাখা হলো।ওখানে বসে বসেই রসূল সা. ঐ অর্থ অভাবীদের মধ্যে বিতরণ করলেন।একটা দিরহামও অবশিষ্ট রইলনা।বিলি বন্টন শেষ হয়ে যাওয়ার পর জনৈক সাহায্য প্রার্থী এলে তার জন্য ঋণ গ্রহণের নির্দেশ দিলেন।হযরত আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন, একবার বিলালের সামনে খেজুর স্তুপীকৃত ছিল।রসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের মাল? হযরত বিলাল বললেন, ওটা ভবিষ্যতের অজ্ঞাত প্রয়োজনের জন্য রেখে দেয়া হয়েছে।রসূল সা. বললেন, ‘‘এই মাল এভাবে আটকে রাখার কারণে কেয়ামতের দিন যে তোমার কাছে জাহান্নামের ধূঁয়া পৌঁছে যেতে পারে, তা কি তুমি জান? ওটাও বন্টন করে দাও।হে বিলাল, সর্বময় ক্ষমতার মালিকের পক্ষ থেকে কোন কিছুর আশংকা করোনা।’’ হযরত বিলাল বর্ণনা করেন, একবার মদিনার জনৈক মোশরেক তাঁর কাছে এল সে বললো, ‘‘আমার কাছে অনেক সম্পদ আছে।যখন প্রয়োজন হয় নিও।’’ হযরত বিলাল তার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে লাগলেন।একদিন যখন বিলাল ওযু করে আযান দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন সহসা ঐ মহাজন কতিপয় কারবারীকে সাথে করে এসে চিল্লাতে লাগলো, ‘‘ও হাবশী!’’ হযরত বিলাল তার কাছে এগিয়ে গেলেন।সে খুব উত্তেজিত হলো এবং বকাবকি করতে লাগলো।সে সতর্ক করলো যে, মাস প্রায় শেষ হয়ে আসছে।সময়মত ঋণ ফেরত না দিলে (আরবের জাহেলী প্রথা অনুসারে) তোমাকে গোলাম বানিয়ে নেব।তখন তোমার সাবেক অবস্থা ফিরে আসবে।হযরত বিলাল বলেন, এই অপমানজনক আচরণে আমি অন্য যে কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির মতই বিব্রত বোধ করলাম।হযরত বিলাল এশার নামাযের পর এই দুঃখজনক ঘটনা জানাতে রসূল সা. এর কাছে হাজির হলেন।ঋণ পরিশোধ করার কোন উপায় না দেখে তিনি নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন এবং বললেন, ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা হলে আমি ফিরে আসবো।কিন্তু হযরত বিলাল তার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করার আগেই পরদিন সকালে রসূল সা. তাকে ডেকে পাঠালেন।গিয়ে দেখলেন, ফিদিকের শাসকের পক্ষ থেকে চারটে পণ্য বোঝাই উট এসে দাঁড়িয়ে আছে।ঋণদাতাকে ডেকে ঋণ ফেরত দেয়া হলো এবং বাদবাকী মাল যথারীতি বিলি বন্টন করা হলো।
ইসরামী আন্দোলনের সৈনিক আবু হাদরু আসলামী জনৈক ইহুদীর কাছে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন।ঋণ পরিশোধের জন্য তাঁর কাছে পরণের কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।আবু হাদরু ইহুদির কাছে আরো সময় চাইলেন।কিন্তু ঐ শাইলকরূপী মহাজন একটুও সময় দিতে রাজি হলোনা।সে আবু হাদরুকে ধরে রসূলের সা. কাছে এনে বললো, আমার পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করুন।রসূল সা. আবু হাদরুকে বললেন, ঋণ পরিশোধ করে দাও।আবু হাদরু ওযর পেশ করলেন।কিন্তু রসূল সা. মহাজনের অনড় মনোভাব দেখে বললেন, যেভাবে পার ঋণ ফেরত দাও।সাহাবী আবার বললেন, খয়বরের যুদ্ধ আসন্ন।ওখান থেকে ফিরে আশা করি পরিশোধ করা সম্ভব হবে।রসূল সা. পুনরায় কঠোরভাবে এই মুসিবত থেকে উদ্ধার পাওয়ার আদেশ দিলেন।শেষ পর্যন্ত আবু হাদরুর পরনের পোশাক খুলে নিয়ই ইহুদী বিদায় হলো।আবু হাদরু নিজের পাগড়ি খুলে কোমরে জড়ালেন।কত সামান্য ঋণের জন্য ইহুদী মহাজনের যুলুমের ধরণ দেখুন যে, সে খাতকের পরনের কাপড় খুলে নিয়েই ক্ষান্ত হলো।
হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ ইসলামী আন্দোলনের আরেকজন নামকরা ব্যক্তি।তিনি মদিনার অধিবাসী ছিলেন এবং বেশ সচ্ছল ছিলেন।তথাপি মাঝে মাঝে প্রয়োজনের তাগিদে জনৈক ইহুদী মহাজনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হতেন।একবার খেজুরের ফলন ভালো না হওয়ায় যথাসময়ে ঋণ ফেরত দিতে না পেরে পরবর্তী ফসল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিলেন।পরবর্তী ফসলও খারাপ হলো।মহাজন আর সময় দিতে রাজি হলোনা।অবশেষে তিনিও নিজের দুরাবস্থা বর্ণনা করার জন্য রসূল সা. এর দরবারে হাজির হলেন।রসূল সা. কতিপয় সাহাবীকে সাথে নিয়ে ইহুদীর বাড়িতে গেলেন।তিনি জাবেরকে আরেকটু সময় দিতে অনুরোধ করলেন।কিন্তু ইহুদী অস্বীকার করলো।রসূল সা. কিছুক্ষণ এদিক ওদিকে ঘোরাফিরা করে আবার এসে ইহুদীর সাথে আলোচনা করলেন।কিন্তু পাষাণ হৃদয় মহাজনের মন গললো না।অতঃপর কিছুক্ষণের জন্য রসূল সা. ঘুমালেন।জেগে আবার একই অনুরোধ করলেন।এবারও সে অনড়।অবশেষে রসূল সা. জাবেরের খেজুর বাগানে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং তাকে বললেন, খেজুর নামাও।খেজুর নামানো হলে আশাতীত খেজুর পাওয়া গেল।ঋণও পরিশোধ হলো এবং কিছু বেঁচেও গেল (সীরাতুন্নবী, শিবলী নু’মানী)
রসূল সা. এর ব্যক্তিগত বর্ম জনৈক ইহুদীর কাছে বন্ধক ছিল।তাঁর ইন্তিকাল পর্যন্তও ঐ বর্ম ছাড়ানোর মত অর্থ সঞ্চিত হয়নি। (সীরাতুন্নবী, শিবলী)
একবার রসূল সা. এর কাছে জনৈক বেদুঈন এসে ঋণ পরিশোধের জন্য তাড়া করতে লাগলো।স্বভাবসূলভ ভংগীতে সে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে কথাবার্তা বললো।সাহাবীগণ তাকে বুঝালো যে, কত বড় ব্যক্তির সাথে কথা বলছ লক্ষ্য কর।সে বললো, আমি তো আমার পাওনা ফেরত চাইছি।রসূল সা. সাহাবাগণকে বললেন, তোমাদের উচিত ওকে সমর্থন করা।কেননা এটা তার প্রাপ্য।অতঃপর তার প্রাপ্য পরিশোধ করার আদেশ দিলেন এবং প্রাপ্যের চেয়ে কিছু বেশি দিলেন। (সীরাতুন্নবী, শিবলী)
যায়েদ বিন সাহনার ঘটনা থেকে এই সংকট সম্পর্কে আরো ধারণা পাওয়া যায়।ইনি একজন ইহুদী আলেম ছিলেন এবং বিভিন্ন আলামতের আলোকে রসূল সা.-এর নবুওয়াতের দাবীর সত্যতা যাচাই করছিলেন।তিনি জানান, জনৈক বেদুঈন এসে রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করলো।সে বললো, আমার গোত্র মুসলমান হয়ে গেছে।আমি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার সময় বলেছিলাম, তোমরা ইসলাম গ্রহন করলে আল্লাহ তোমাদেরকে প্রচুর সম্পদ দেবেন।কিন্তু দুভাগ্যবশত এর বিপরীত দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।এখন তাদেরকে সাহায্য না করলে তাদের ইসলাম পরিত্যাগ করার আশংকা আছে।রসূল সা. হযরত আলীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।হযরত আলী রা. বললেন, এ মুহুর্তে কিছুই নেই।যায়েদ বিন সাহনা বললেন, আমার কাছ থেকে ৮০ মিসকাল স্বর্ণ নিয়ে নিন।এর বদলে মৌসুমে খেজুর দেবেন।কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল।রসূল সা. স্বর্ণ নিয়ে বেদুঈনকে দিলেন।নির্দিষ্ট মেয়াদের দুতিন দিন বাকী থাকতে একদিন রসূল সা. যখন কতিপয় সাহাবীকে সাথে নিয়ে একজনের জানাযা পড়ে একটি প্রাচীরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখন যায়েদ রসূল সা. এর গায়ের জামা ও চাদর ধরে অত্যন্ত রুক্ষভাবে বললেন, ‘‘হে মুহাম্মাদ! আমার ঋণ পরিশোধ করনা কেন? আল্লাহর কসম, তোমরা আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর কেমন লোক তা আমি বিলক্ষণ জানি।তোমরা ঋণ পরিশোধ না করায় অভ্যস্ত।’’
হযরত ওমর রা. যায়েদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।তারপর বললেন, ‘‘হে আল্লাহর শত্রু! আল্লাহর কসম, আমি যদি (রসূলের দিক থেকে তিরস্কারের) আশংকা না করতাম, তাহলে তোর গর্দান উড়িয়ে দিতাম।’’ রসূল সা. হযরত ওমরকে বললেন, ‘‘ওমর! এ ক্ষেত্রে তোমার উচিত ছিল, একদিকে আমাকে সুষ্ঠুভাবে ঋণ পরিশোধ করার পরামর্শ দেয়া এবং অপরদিকে এই ব্যক্তিকে ভদ্রজনোচিত পন্থায় ঋণ ফেরত চাওয়ার উপদেশ দেয়া।’’ তারপর বললেন, যাও, ওর পাওনা দিয়ে দাও।আর ধমক দেয়ার বদলে অতিরিক্ত বিশ সা খেজুর দিও।
আসলে এ ঘটনা ছিল যায়দ বিন সাহনার পক্ষ থেকে রসূল সাঃ এর নবুয়তের শেষ পরীক্ষা।তিনি হযরত ওমরকে নিজের পরিচয় জানালেন এবং তাকে সাক্ষী করে ইসলাম গ্রহণ করলেন।অতপর নিজের অর্ধেক সম্পত্তি মুসলিম জনগণকে দান করলেন।এই যায়দ বিন সাহনা ইহুদী মহাজনদের মধ্যে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।কিন্তু তার এ ঘটনা থেকেও জানা যায় ইসলামী আন্দোলন ও তার সদস্যরা কিরূপ আর্থিক সংকটে ছিলেন, সংকটের কারণে কত ঋন গ্রহণ করতে হতো এবং ঋণদাতাদের পক্ষ থেকে কত কঠিন আচরণ সইতে হতো।
ইহুদীরা ও ধনী মোশরেকরা একদিকে তো ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে মহাজনীর অস্ত্র প্রয়োগ করতো।অপরদিকে তারা মুসলমানদেরকেও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় থেকে ফেরানোর চেষ্টা করতো, যাতে করে আন্দোলন আর্থিক অভাবের কারণে দুর্বল হয়ে যায়।এ উদ্দেশ্যে একদিকে তারা আল্লাহর পথে দানে উদ্বুদ্ধকারী আয়াতগুলো নিয়ে বিদ্রুপ করতো।তারা বলতো, এই দেখ, মুসলমানদের আল্লাহ তায়ালাও দেউলে হয়ে ঋণের জন্য ধর্না দিয়েছে।আবার কখনো বলতো, আল্লাহর হাত শেকলে বাধা।এ সব কথা ইহুদীদের মুখ থেকে পাচার হয়ে মোনাফেকদের মুখেও উচ্চারিত হতো এবং গোটা পরিবেশকে কলুষিত করতো।অন্যদিকে তারা দানে অভ্যস্ত মুসলমানদের সাথে সাক্ষাত করে বলতো, ‘আরে,নিজেদের সম্পদ নষ্ট করছ কেন? মক্কার ক’জন কাংগালকে খাইয়ে দাইয়ে তোমাদের কী লাভ? নিজেদের ছেলেমেয়েদের সেবাযত্ন কর।ব্যবসায় বাণিজ্যে সম্পদ খাটাও।সম্পদ বিনিয়োগের এমন নির্বোধসুলভ খাত কোথা থেকে পেলে?’ এই সব অপপ্রচারাভিযান পরিচালনাকারী ইহুদী ও মোনাফেকদের সম্পর্কেই কোরআনে বলা হয়েছে যে, ******** “অর্থাৎ তারা মানুষকে কার্পন্য করার শিক্ষা দেয়।এরা আনসারদের কাছে এসে বসতো এবং শুভাকাংখীর বেশ ধারণ করে বলতো, “নিজেদের টাকা পয়সা এভাবে উড়িওনা।এতে তোমরা অভাব অনটনে পড়বে।কাজেই তোমরা ইসলামী আন্দোলনের পেছনে এত অর্থ ব্যয় করোনা।পরিস্থিতি কী হয়ে দাড়াবে, তা বুঝতে চেষ্টা কর”।(সীরাতে ইবনে হিসাম)
ওদিকে ইহুদীদের ক্রীড়ানক পঞ্চম বাহিনীর লোকদের মধ্যে কানাঘুষা হতো যে, “রসূল সাঃ এর সাথীদের জন্য অর্থ ব্যয় করা বন্ধ কর।ওরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাক।”(সূরা মুনাফিকুন,আয়াত-৭)
কত দূরদর্শী কুট পরিকল্পনা ছিল! একদিকে আল্লাহর পথে দান করার মানসিকতা ও জযবার উৎস বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ।অপরদিকে মহাজন হয়ে নিজেদের শাইলকী যুলুম দ্বারা ইসলামী আন্দোলনকে পিষ্ট করে ফেলার অপচেষ্টা।এ পরিকল্পনা সফল হলে ঈমান, যুক্তি এবং আমল ও চরিত্রের ময়দানে মোকাবেলা না করেই ইসলামী বিপ্লবকে পরাজিত করা যেত।কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটা ছিল সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে জড়িত।তাই তার সুক্ষ তদবীরে ইসলামের শত্রুদের চক্রান্ত নস্যাত হয়ে গেল।
এই কাহিনীতে মূল বিষোয় হলো রসূল সাঃ ও সাহাবায়ে কেরামের সেই ধৈর্যশীল সুলভ চরিত্র ও ভূমিকা যা বিরোধীদের হীন নিপীড়নের জবাবে আত্নপ্রকাশ করেছিল।যারা চরম নৈরাজ্যজনক ও কষ্টদায়ক পরিস্থিতিতেও তাদের উচ্চস্তরের নৈতিক মানকে এতটুকুও নিচে নামতে দেননি।তারা যে মানবতার কত বড় ও উজ্জ্বল নমুনা ছিলেন,ভেবেও তার কুল কিনারা পাওয়া যায়না।
ইহুদীদের গড়া পঞ্চম বাহিনী
মানবেতিহাসের হাজারো অবজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, যখনই সততা ও মানব কল্যাণের লক্ষ্যে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সহকারে কোন আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে এবং তা বিজয়ের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে, তখন তার প্রতিরোধকারী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর একটি হয়ে থাকে যারা প্রকাশ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং সমকালীন অস্ত্র প্রয়োগ করে তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায়।অপর শক্তিটি হয়ে থাকে সেই সব নৈরাজ্যবাদী ও নাশকতাবাদী লোক,যারা চারিত্রিক হীনতা ও নীচতার কারণে কাপুরুষতা ও শঠতার নিম্নস্তরে নেমে আসে এবং মোনাফেকীর গোপন ঘাটিতে বসে চক্রান্তের জাল বিস্তারের কাজে আত্ননিয়োগ করে।মক্কার মোশরেকদের প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ ছিল প্রথমোক্ত শক্তি আর মদিনার ইহুদী ও তাদের বংশবদরা ছিল শেষোক্ত শক্তি।
যেহেতু ইসলামী আন্দোলন একটা রাষ্ট্রের রূপ ধারণ করেছিল, এই রাষ্ট্র সকলের চোখের সামনেই বেড়ে উঠছিল এবং চারদিক থেকে বিবেকবান, সক্রিয় ও কর্মপ্রিয় লোকেরা এতে যোগদান করছিল।তাই বিরোধী শক্তি হীনমন্যতা ও প্রতিহিংসা পরায়ণতার ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছিল।কিন্তু তাদের মনের অভ্যন্তরে যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল তা প্রকাশ করা ও পরিস্থিতির ওপর প্রভাব বিস্তার করার কোন উপায় ছিলনা।ইসলামী আকীদা ও আদর্শের মোকাবেলায় ইহুদীদের কাছে কোন যুক্তিসংগত, সহজ সরল, জনগণকে আকর্ষণকারী এবং চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী কোন গঠনমূলক মতবাদ ইহুদী সম্প্রদায়ের কাছে ছিলনা।তাদের কাছে ছিল কতগুলো নিষ্প্রাণ ও অসার আকীদা-বিশ্বাস, যা ইতিহাসের প্রবাহকে রোধ করা ও মানুষের স্বভাব প্রকৃতিতে পংগুত্ব ও স্থবিরতা সৃষ্টি করার ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল।ইসলামী আন্দোলন যে উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী জনশক্তির সমাবেশ ঘটিয়েছিল, তাদের সামনে টিকে থাকার মত সমমানের নৈতিক চরিত্র সম্পন্ন জনশক্তি ইহুদীদের কাছে ছিলনা।তাদের কাছে যে জনশক্তি ছিল, তা নৈতিক দিক দিয়ে মনুষ্যত্বের কাংখিত সর্বমিম্নমানের চেয়েও নিম্ন মানের ছিল।এই পতিত দশা থেকে টেনে তোলার মত কোন প্রেরণা ও চালিকাশক্তি তাদের কাছে অবশিষ্ট ছিলনা।মানবতার পুনর্গঠনের কোরআনী দাওয়াত যে নতুন মানুষ গড়ে তুলেছিল, ইহুদীবাদের গড়া প্রাচীন ধাচের মানুষ তার সামনে দাড়ানোরই যোগ্য ছিল না।অপপ্রচার চালিয়ে ভুল বুঝাবুঝি ও শত্রুতা যতই সৃষ্টি করুক না কেন, যুক্তি ময়দানে ইহুদী শক্তি ক্রমেই পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল।তারা নিজেদেরকে যাই মনে করুকনা কেন,ইতিহাসের শক্তি ইসলামী আন্দোলনেরই পক্ষে ছিল।বাস্তবতার রণাঙ্গনে ইহুদীদের ওপর সর্বদাই দুরন্ত আঘাত আসছিল।সমকালীন মানব সমাজ তাদেরকে পেছনে ফেলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।রাজনৈতিক অংগনে ইহুদীদের সাধ ছিল ইসলামী বিপ্লবকে ধ্বংস করে দেবে।কিন্তু মৈত্রী চুক্তি তাদের হাত বেধে রেখেছিল।এ ই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তারা একেবারেই অক্ষম ও অসহায় হয়ে পড়েছিল।আর এই অক্ষমতা ও অসহায়ত্বের অনুভূতি তাদের চরিত্রের মৌলিক বৈশিষ্টের সাথে মিলিত হয়ে কাপুরুষত্বের রূপ ধারণ করেছিল।অসহায়ত্ব ও কাপুরুষোত্বের পরিবেশে মানুষের মনে যে প্রতিদ্বন্দ্বী মানসিকতা সক্রিয় থাকে, তা সর্বদাই হিংসা ও বিদ্বেষের পথ দিয়ে তাকে মোনাফেকীর গোপন ঘাটিতে পৌছে দিয়ে থাকে।ফলে সে প্রতিপক্ষের ওপর সম্মুখ থেকে আক্রমণ চালানোর পরিবর্তে পেছন থেকে গোপন আঘাত হানে।প্রকাশ্য ডাকাতির পরিবর্তে সে সিঁদেল চুরির চক্রান্ত আটে।এই কাপুরুষোচিত ভূমিকাই অবলম্বন করলো ইহুদী সম্প্রদায়।
বাস্তব পরিস্থিতি ঘৃণ্য মোনাফেক চক্রের আবির্ভাবের জন্য দুট সহায়ক উপরকণ সৃষ্টি করে দেয়।প্রথমত ইহুদী চক্র ও তাদের বংশবদদের প্রতিহিংসামূলক মানসিকতা।এই মানসিকতার যেহেতু প্রত্যক্ষ আক্রমণের ক্ষমতা ছিলনা, তাই মোনাফেকীর গোপন ঘাটি সক্রিয় হয়ে উঠলো।দ্বিতীয়ত ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তি দেখে অনেকে নিজেদের ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য এই চোরা পথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলো।
এই চোরা পথের উদ্বোধন ইহুদী মস্তিস্কই করেছিল।তাদের নামকরা সরদাররা নিজেদের বৈরী মানদিকতাকে লুকিয়ে রেখে ইসলামের আলখেল্লা পরে ইসলামী সংগঠনে প্রবেশ করতে লাগলো।বনু কাইনুকার নিম্নোক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ “পঞ্চম বাহিনী” হিসেবে ইসলামে প্রবেশ করেঃ
(১) সা’দ বিন হানীফ (২) যায়েদ বিন লুসিত (৩) নুমান বিন আওফা বিন আমর (৪) রাফে বিন হুরাইমালা (৫) রিফা বিন যারেদ বিন তাবুত (৬) সালসালা বিন বারহাম (৭) কিনানা ইবনে সূরিয়া।
এদের মধ্যে যায়েদ বিন লুসিত হলো সেই ব্যক্তি,যে বনু কাইনুকার বাজারে হযরত ওমরের সাথে মারামারি বাধিয়ে দিয়েছিল।তা ছাড়া এই ব্যক্তি রসূল সাঃ এর উটনী হারিয়ে গেলে টিটকারী দিয়েছিল যে,“এমনি তো উনি আকাশের খবরাদি দিয়ে থাকেন, অথচ ওর উটনীটা এখন কোথায় আছে তা জানেন না!” এর জবাবে রসূল সাঃ বলেছিলেন, “আল্লাহ যা আমাকে জানিয়ে দেন তাছাড়া আমি আর কিছু জানিনা।এখন আল্লাহ আমাকে উটনীর খবর জানিয়ে দিয়েছেন।উটনীটা অমুক মাঠে আছে এবং একটা গাছের সাথে তার বাগের রশী আটকে গেছে।” সাহাবীগণ তালাশে ছুটে গেলে অবিকিল সেই অবস্থাই স্বচোক্ষে দেখলেন।
রাফে বিন হুরাইমালা এমন উচুস্তরের মোনাফেক ছিল যে, সে যেদিন মারা গেল সেদিন রসূল সাঃ বললেন, আজ মোনাফেকদের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা মারা গেছে।রিফা বিন যায়েদ বিন তাবুতও অনুরূপ একজন।বনুল মুসতালিক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার সময় একটা ঝড় উঠলে লোকেরা ভয় পেয়ে গেল।রসূল সাঃ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “এই ঝড় জনৈক মোনাফেক নেতাকে শাস্তি দেয়ার জন্য এসেছে।” মদিনায় পৌছার পর সবাই জানতে পারলো যে, ঐঝড়েই রিফা পটল তুলেছে।(সীরাত ইবনে হিশাম,২য় খন্ড)
মজার ব্যাপার হলো, মোনাফেকদের কাতারে যত লোক শরীক হয়েছে, তারা সকলেই ছিল বয়সে প্রাচীন ও সচ্ছল।তারা ছিল স্বার্থপর এবং পাষাণ হৃদয়।যুবকরা সাধারণত ইসলামী আন্দোলনের সাথী ছিল।মাত্র একজন যুবক কিস বিন আমর বিন সাহলকে পঞ্চম বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাওয়া যায়।
এই চক্রটি এত সীমিত ছিলনা।আসলে এই কয় ব্যক্তি তো ছিল পঞ্চম বাহিনীর নেতা ও সেনাপতি।তারা নিজেদের পরিচিত মহল থেকে নতুন নতুন মোনাফেককে ভর্তিও করতো।তাছাড়া মুসলমানদের মধ্য থেকে দুর্বল লোকদেরকে খুজে খুজে তাদেরকেও প্রভাবিত করতো, তাদেরকে ব্যবহার করতো, তাদের মধ্যে সন্দেহ সংশয় ছড়িয়ে মুসলমানদের বৈঠকাদিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীতে বিদ্রুপ ও উপহাসের মাত্রা যোগ করে পরিবেশকে খারাপ করতো।মসজিদে গিয়ে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুনে নিজেদের বৈঠকগুলোতে তার রিপোর্ট দিত।রাতের বেলা বসতো ষড়যন্ত্রের বৈঠক, তৈরী হতো নতুন নতুন ক্ষতিকর পরিকল্পনা এবং নতুন নতুন পন্থায় তা বাস্তবায়ন করা হতো।মোনাফেকদের তৈরী করা এই বেঢংগা চালচলন তার নিজস্ব অস্বাভাবিকতার কারণে রসূল সাঃ ও মুসলমানদের দৃষ্টিতে সুপরিচিত ছিল।সাথে সাথে প্রত্যেকটি স্তরে ওহীর মাধ্যমে তাদের চিন্তা, কর্মকান্ড ষড়যন্ত্র, এমনকি তাদের অপরাধ প্রবণ বিবেকের বিশেষ বিশেষ আলামতকেও চিহ্নিত করতে থাকতো।একবার তো মসজিদে নববীতে এই মোনাফেক সরদারদের আচরণ অসহনীয় হয়ে ওঠে।সাধারণ সমাবেশে এই চক্রটি একেবারেই আলাদাভাবে বসেছিল এবং পৃথকভাবে কানাঘুষায় লিপ্ত ছিল।এ দৃশ্য দেখে রসূল সাঃ তাদেরকে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন।কেউ কেউ পরস্পরের সাথে এত ঘনিষ্ঠ ছিল যে, হাত ধরাধরি ও জড়াজড়ি করা অবস্থায়ই বহিস্কৃত হলো।
এই মোনাফেক চক্রের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কেন্দ্রীভূত ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর সত্তায়।হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে অপবাদ রটনার নাটকের প্রধানতম খলনায়ক ছিল এই ব্যক্তি।ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা তার মেরুমজ্জায় মিশে ছিল।এই দুরারোগ্য ঘৃণা ও বিদ্বেষের মূল কারণ হযরত উসাইদ বিন হুযাইরের মুখ থেকে শুনুন।তিনি রসূল সাঃ এর কাছে বনুল মুস্তালিক যুদ্ধের সময় আব্দুল্লাহ বিন উবাই সম্পর্কে বলেনঃ
“হে রসূলুল্লাহ! এই ব্যক্তির (দুঃখভারাক্রান্ত আবেগের) প্রতি একটু সদয় হোন।মদিনায় যখন আপনার শুভাগমন ঘটেছিল, তখন আমারা তাদের রাজকীয় সিংহাসনে বসানোর সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম।তার জন্য মুকুট তৈরী হচ্ছিল।আপনার আগমনে তার বাড়াভারে ছাই পড়েছে।বেচারা সেই আক্রোশ ঝাড়ছে।” (তাফহীমুল কুরআন,সূরা নূরের ভূমিকা)
কোন দাওয়াত বা আন্দোলনের কারণে যাদের পরিকল্পনা নস্যাত হয়ে যায় এবং যাদের স্বার্থ সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছেও বিফলে যায়, তারা বুকের ভেতরে বিষ ভরে নিয়ে সারা জীবন ছটফট করতে থাকে।এমন পরাজিত প্রতিদ্বন্দী কখনো প্রতিপক্ষকে ক্ষমা করতে পারেনা।ইসলামের অবস্থাও ছিল তাই।আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তার ব্যর্থতার তিক্ত স্মৃতি প্রথম দিন থেকেই বহন করছিল এবং আজীবন বহন করেছে।শুরুতেই সে ইসলাম গ্রহণ করেছে, যাতে এই নতুন শক্তির ভেতরে নিজের জন্য জায়গা তৈরী করে নিতে পারে এবং তার ভেতর থেকে ধাপে ধাপে উঠে ক্ষমতা ও নেতৃত্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছতে পারে।কিন্তু এই ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যেদিকেই কেউ যেতে চায় তাকে ঈমান ও আমলের পথ ধরেই যেতে হয়।তাই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর পক্ষে মোনাফেক হিসেবে অবস্থান করা ছাড়া গত্যন্তর ছিলনা।শুরু থেকে এই মোনাফেকী গোপন ছিল।কিন্তু একদিন তার মনের এই নোংরা ব্যাধি ঘটনাক্রমে জনসমক্ষে বেরিয়ে পড়ে।
একদিন রসূল সাঃ অসুস্থ সাহাবী সা’দ বিন উবাদাকে দেখতে গিয়েছিলেন।গিয়েছিলেন একটা গাধায় আরোহন করে।তার পেছনে বসেছিল উসামা বিন যায়েদ।এই উসামাই বর্ণনা করেন, পথিমধ্যে এক জায়গায় আব্দুল্লাহ বিন উবাই মজলিস জমিয়ে বসেছিল।তার চারপাশে স্বগোত্রের লোকেরাই উপবিষ্ট ছিল।রসূলকে সাঃ ওখান দিয়ে যেতে দেখে সে বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।রসূল সাঃ তার কাছে গিয়ে সালাম দিলেন।তারপর একটু থেমে কোরআনের একটা অংশ পড়লেন, ইসলামের দাওয়াত দিলেন, আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং তার ক্রোধ সম্পর্কে সতর্ক করলেন।আব্দুল্লাহ বিন উবাই নিরবে ও রুদ্ধশ্বাসে বসে রইল।কিন্তু রসূল সাঃ যখন কথা শেষ করে রওনা হলেন, তখন সে অত্যন্ত অভদ্র ও অশালীন ভাষায় চিৎকার করে বললো, “ওহে অমুক! তোমার কথা বলার এই পদ্ধতি ঠিক নয়।নিজের ঘরে বসে থাকো গে।যে ব্যক্তি তোমার কাছে যায়, তাকে যা বলতে চাও বলে দিও।যে ব্যক্তি তোমার কাছে না যায়, তাকে উত্যক্ত করোনা।কারো বাড়ীতে গিয়ে উপযাচক হয়ে এমন দাওয়াত দিওনা যা তার পছন্দ হয়না।” দেখুন প্রতিটা শব্দ কেমন বিষে ভরা! কেমন নোংরা ও মর্মঘাতী ভাষা এবং কেমন উস্কানীপূর্ণ ভাবাবেগ।
আসলে এ কথাগুলো ব্যক্তি আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর ছিলনা।এ ছিল আসন্ন সুখ সমৃদ্ধির যুগের বিরুদ্ধে পতনোন্মুখ জাহেলিয়াতের বিষোদগার।
রসূল সাঃ নিজের উচ্চ মর্যাদাপূর্ন অবস্থান থেকে এই ইতরসুলভ প্রলাপ শুনলেন।শুনে তার মহানুভব হৃদয়ে হয়তো ক্রোধের পরিবর্তে করুণারই উদ্রেক করে থাকবে।
মজলিসে মুসলিম দলের সদস্য আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহাও উপস্থিত ছিলেন।তার আত্নসম্মানবোধ তাকে আপন কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করলো।তিনি মোনাফেক নেতাকে তীব্র কন্ঠে জবাব দিলেনঃ “রসূল সাঃ কেন আসবেন না? আমরা তাকে চাই।তিনি আমাদের বাড়ীতে ও মজলিসে আসবেন।আমরা তাকে ভালোবাসি এবং তারই ওছিলায় আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন।”
পথিমধ্যে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর বিশ্বমানবতার নেতা সা’দ বিন উবাদাকে দেখতে গেলেন।সা’দ রসূল সাঃ এর মুখমন্ডলে অস্বাভাবিক চিহ্ন দেখে কারন জিজ্ঞেস করলেন।রসূল সাঃ ঘটনা বর্ণনা করলেন।সা’দও একই পটভূমি বর্ণনা করলেন যেঁ, “আল্লাহ যখন আপনাকে মদিনায় নিয়ে এলেন তখন আমরা ওর জন্য মুকুট বানাচ্ছিলাম।আপনি এসে তো তার রাজত্বের স্বপ্ন গুড়িয়ে দিয়েছেন।” তিনি বুঝাতে চাইছিলেন যে, তার এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক।একে গুরুত্ব না দেয়াই ভাল।
এই ব্যক্তি মোনাফেকীর সমগ্র নাটকের প্রধান খলনায়ক হয়ে ইতিহাসের মঞ্চে অভিনয় করতে থাকে।সে ছিল এর প্রধান হোতা।তার পেছনে ছিল বড় বড় নেতার আশীর্বাদ।আর তাদের পেছনে ছিল সচেতন মোনাফেক এবং অপরিপক্ক মুসলমানদের গোষ্ঠী।সবার পেছনে ছিল অজ্ঞ ও অবুঝ বেদুঈনরা।ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রতিটি প্রতিক্রয়াশীল পদক্ষেপের পেছনে পর্যায়ক্রমে এই সব বিবিধ শ্রেণীর অবদান থাকতো।মদিনায় মুসলমানরা যে সব বিরোধিতা ও প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে ছিল এবং রসূল সা. কে যে সব চক্রান্তের সম্মুখনি হতে হয়েছিল, তার সবগুলোর পেছনে ইহুদী প্রভাবিত মোনাফেকদের এই বিকৃত ও ধ্বংসাত্মক শক্তির বিরাট ভূমিকা ছিল।সকল বৈরী তৎপরতার নেতৃত্ব যদিও ইহুদীদের হাতেই নিবদ্ধ থাকতো, কিন্তু রসূলের সা. পথ আগলে দাঁড়ানোর জন্য যতগুলো নেতিবাচক ঘটনা ঘটানো হয়েছে, তার পেছনে কার্যত সেই মোনাফেকদের ভূমিকাই ছিল প্রধান, যারা ইহুদীদের ক্রীড়ানক হিসাবে কাজ করতো।
অপপ্রচারমূলক তৎপরতা
কর্মবিমুখ নৈরাজ্যবাদী মহল যখন কোন সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক আন্দোলনের কবলে পড়ে, তখন তার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আদাপানি খেয়ে লেগে পড়ে।নিজেরা তো কিছু করতে চায়না।আল্লাহ এবং জনগণের প্রতিও তারা কোন দায়দায়িত্ব অনুভব করেনা।এজন্য সকল শক্তি ও প্রতিভা অতি সহজেই নেতিবাচক তৎপরতায় নিয়োগ করে।এই সব লোক সংস্কারবাদী ও গঠনমূলক আন্দোলনের নেতা কর্মীদেরকে ভূতের মত চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরে, দূরবিক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তাদের দোষ অন্বেষণের চেষ্টা করে।তাদের প্রতিটা কথা, কাজ ও ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে।তারপর বিন্দুপরিমাণ কোন বক্রতা বা ত্রুটি খুঁজে পেলেই ঢেড়া পিটিয়ে প্রচার করতে আরম্ভ কওে যে, “ওহে জনমন্ডলী! দেখ, এরা গোমরাহী, বিকৃতি ও কুফরিতে লিপ্ত।অমুক কাজ প্রাচীন মনীষীদের বিরোধী, বড় বড় ইমামদের অবমাননা, বড় বড় বুযুর্গদের সমালোচনা।অন্ধ বিরোধীতার আবেগে যখন কোন ভালো লোকের ও তার জনহিতকর কাজের ক্ষতি সাধন করা কাংখিত হয়, তখন একদিকে প্রত্যেক ভালো কাজের দোষত্রুটি বের করে দেখানো হয়।অপর দিকে যারা কাজ করে, তাদের সামান্য ভুলত্রুটি হলেও তিলকে তাল বানিয়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করে জনমতকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়।নাশকতাবাদীদের সবচেয়ে বড় সুযোগ হয়ে থাকে তখন, যখন কোন ঘটনা সাধরণ মানুষের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কার ও কুপ্রথা ইত্যাদিও বিরুদ্ধে ঘটে যায়, চাই তা সঠিক ও ন্যায় সংগতই হোক।এটা সর্বজন বিদিত যে, সংস্কারবাদী, গঠনমূলক ও বিপ্লবী আন্দোলনগুলোকে অনেক জনপ্রিয় জিনিসের বিরোধিতা করতে হয়।তাই বৈরী অপপ্রচারের জন্য সব সময় একটা না একটা বিষয় অবশ্যই পাওয়া যায়।রসূল সা. ও সাহাবায়ে কিরাম ইহুদীদের পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতিরই সম্মুখীন ছিলেন।প্রতিদিন সকাল বিকাল একটা না একটা হৈ হাঙ্গামা হতো এবং কোন না কোন অপপ্রচার চালানো হতো।
পদলোভের অভিযোগ
সত্যের নিশানবাহী মাত্রেরই আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার উপর একটা না একটা স্বার্থের কালিমা লেপনের জন্য বিরোধীরা প্রত্যেক যুগেই অপবাদ আরোপ করে থাকে যে, উনি একজন পদলোভী ব্যক্তি।উনি একটা বড় কিছু হতে চান।হযরত মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগই তোলা হয়েছিল যে, ওঁরা রাষ্ট্রীয় গদি দখল করতে চান।হযরত ঈসার বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হয় যে, উনি ইহুদীদের বাদশাহ হতে চান।নাজরানের প্রতিনিধি দল যখন এলো, তখন ইহুদীরা রসূল সা. এর ওপর অপবাদ আরোপ করলো যে, ঈসা আ. এর যে মর্যাদা ছিল, সেটা দখল করার জন্যই উনি এত মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।উনি চান খৃষ্টানরা ও অন্যরা তাঁর পূজা করতে লেগে যাক।লক্ষ্য করুন, রসূল সা. কখনো এ ধরনের কোন দাবীই করেননি।এ ধরনের কোন গদি বা পদ লাভের ইচ্ছার আভাসও দেননি।অথচ বিরোধীদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এমন কাল্পনিক অভিযোগ গড়া হলো এবং আবিস্কার করা হলো যে, মুহাম্মদ সা. এর উদ্দেশ্য এটাই হবে যে, ঈসার আ. মত নিজের পূজা করাবেন।মুখে দাবী করেননি, তাতে কী? তাঁর অন্তরে নিশ্চয়ই এই দাবী রয়েছে, আজ না হোক, ভবিষ্যতে কোন না কোন দিন তিনি এ দাবী যে করবেন, তারই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।নাজরানী প্রতিনিধিদলের কানে এসব প্রলাপোক্তি ঢোকানো হয়েছিল বলেই ঐ দলের জনৈক সদস্য আবুনাফে কারজী রসূল সা. কে খোলাখুলি জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কি চান খৃষ্টানরা ঈসা আ. এর যেমন পূজা কওে, তেমনি মুসলমানরাও আপনার পূজা করুক? অপর সদস্য জিজ্ঞাসা করে, আপনি কি আমাদের কাছ থেকে পূজা উপাসনা চান এবং তার জন্যই দাওয়াত দিচ্ছেন? তিনি জবাব দিলেন, “আমি এ থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই যে, আমি আল্লাহ ছাড়া আর কারো এবাদত করি কিংবা আর কারো এবাদতের দাওয়াত দেই।আল্লাহ আমাকে এ উদ্দেশ্যে পাঠানওনি এবং আদেশও দেননি।” (সীরাতে ইবনে হিশাম. ২য় খন্ড) এ পর্যায়ে কোরআনও সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করলো যে, “এটা কোন মানুষের জন্য বৈধ নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমত ও নবূয়ত দেবেন, আর সে মানুষকে বলবে, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার দাস হয়ে যাও।”
সর্বসম্মত ধর্মীয়প্রতীক সমূহের অবমাননার অভিযোগ
বিশ্ব মানবের নেতা সা. হিজরত করে মদিনায় চলে আসার পর মক্কায় নতুন করে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগতে শুরু করে এবং মদিনার উপর আক্রমণ পরিচালনার বিষয়ে ক্রমাগত চিন্তাভাবনা চলে।তাদের গোয়েন্দারা মদিনার আশপাশে ঘোরাফেরা করতো।মদিনার ইহুদীদের সাথে তাদের চিঠিপত্রের আদান প্রদান শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের সামরিক দল যখন তখন ইসলামী রাষ্ট্রের সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে যেত।এর জবাবে ইসলামী রাষ্ট্রও টহলদানের ব্যবস্থা চালু করলো।সামরিক ও বেসামরিক দলগুলো টহল দিত এবং কোরায়েশদের গোয়েন্দা ও সামরিক দলগুলোর গতিবিধি লক্ষ্য করতো।মদিনা এ সব তৎপরতা দ্বারা কোরায়েশদেরকে বুঝিয়ে দিতে চাইত যে, আমরা ঘুমিয়ে নেই।সেই সাথে তাদেরকে এই মর্মে সাবধানও করা হতো যে, তোমরা যদি শান্তির পরিবেশ নষ্ট কর তাহলে তোমাদের বাণিজ্যিক কাফেলার চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয়া হবে।
এই টহল ব্যবস্থার আওতায় রসূল সা. দ্বিতীয় হিজরীর রজব মাসে আটজনের একটা সেনাদল কোরায়েশদেও গতিবিধি ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার খোঁজ নেয়ার জন্য পাঠালেন।এই সেনাদলকে কোন সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়নি।কিন্তু কোরায়েশদের একটা ক্ষুদ্র বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে তাদের মুখোমুখি সাক্ষাত হয়ে গেল।এই সাক্ষাতে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে, ইসলামী রাষ্ট্রের সেনাদল আক্রমণ চালিয়ে ওদের একজনকে হত্যা করে ফেললো।আর বাদবাকীদেরকে গ্রেফতার করে পণ্য সম্ভারসহ মদিনায় আনা হলো।এ ঘটনা যেহেতু রজব মাসের শেষে ও শাবানের শুরুতে রাতের বেলায় ঘটেছিল, এজন্য সন্দেহের সুযোগ নিয়ে একদিকে মক্কার কোরায়েশরা এবং অপরদিকে মদিনার ইহুদী ও মোনাফেকরা অপপ্রচারের তান্ডব সৃষ্টি করলো।তারা এ ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে নিষিদ্ধ রজব মাসের সাথে সম্পৃক্ত করে জনগণকে উত্তেজিত করতে লাগলো যে, এরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চায়, অথচ নিষিদ্ধ মাসেও রক্তপাত করতে দ্বিধা করেনা। (তাফীমুল কুরআন)
এই অপপ্রচারের ফল মুসলমানদের জন্য খুবই ক্ষতিকর ছিল।এই ক্ষুদ্র নবীন শক্তিটি এমনিতেই চারদিক থেকে শত্রু ও বিপদে পরিবেষ্টিত ছিল।তার জন্য যে কোন ব্যক্তি ও যে কোন মহলের সমর্থন খুবই মূল্যবান ছিল।এদের সম্পর্কে আরবে এমন ধারণা বিস্তার লাভ করা খুবই বিপজ্জনক ছিল যে, তারা নিষিদ্ধ মাসের সম্মান নষ্ট করে দিচ্ছে।কেননা নিষিদ্ধ মাসের এই সম্মান বহাল থাকার ওপরই আরবের ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতি নির্ভরশীল ছিল।এতে মুসলমানদের সমর্থকরাও তাদের বিরোধী হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল।তাছাড়া এ বিষয়টা যেহেতু জনগণের স্পর্শকাতর ধর্মীয় অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল, তাই এটা উস্কানির কারণও ছিল।বিশেষত এই অপপ্রচার মুসলমানদের খোদাভীতি, দ্বীনদারী ও নৈতিক দায়িত্বশীলতার ব্যাপারে তাদের ওপর আস্থা নষ্ট করে দিতে সক্ষম ছিল।নাখলার এ ঘটনা আরো একটা কারণে খোদ ইসলামী রাষ্ট্রের দৃষ্টিতেই অপছন্দনীয় সাব্যস্ত হলো, রসূল সা. এই সেনাদলকে কোন সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি দেননি।যথারীতি নির্দেশ না পেয়েও এই সেনাদল এমন একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, যা ইসলামী রাষ্ট্রের টহল ব্যবস্থার উদ্দেশ্যকেই পন্ড করে দিতে এবং এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যে পরিকল্পনা তৈরী করা হয়েছিল, তার ক্ষতি সাধন করতে পারতো।এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অত্যধিক সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছিল।এখন যেহেতু নাখলার দুর্ঘটনা পুরোপুরি একটা বেআইনী ও নিয়ম বহির্ভূত পদক্ষেপ ছিল, তাই রসূল সা. সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, তাদেরকে শাস্তি দিলেন, এবং আটককৃত বন্দীদেরকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে গ্রহণ ও তাদের পণ্য সম্ভারকে বাইতুল মালে জমা করতে অস্বীকার করলেন।
ইসলামী রাষ্ট্র নিজস্ব নিয়মশৃংখলা মোতাবেক এই নিয়মবহির্ভূত পদক্ষেপের ব্যাপারে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমীচীন ছিল তা গ্রহণ করেছে।কিন্তু বিরোধীরা এটা নিয়ে যে অপপ্রচার শুরু করলো, ইসলামী রাষ্ট্র অধিকতর যুক্তিনির্ভর, নৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী ও পরিচ্ছন্ন অথচ দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে তার মোকাবেলা করলো।আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং ওহির মাধ্যমে রসূল সা. এর মুখ দিয়ে এর জবাব দেওয়ালেন যেঃ
“লোকেরা জিজ্ঞাসা করে, নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা কেমন কথা! হে নবী, আপনি বলে দিন, এটা খুব অন্যায়।কিন্তু আল্লাহর পথে চলতে মানুষকে বাধা দেয়া, আল্লাহর অবাধ্যতা করা, আল্লাহর বান্দাদেরকে মসজিদুল হারামে যেতে না দেয়া এবং সেখান থেকে তার অধিবাসীদেরকে বের করে করে দেয়া আল্লাহর দৃষ্টিতে এর চাইতে অনেক বড় অন্যায়।আর রক্তপাতের চেয়েও অরাজকতা মারাত্মক”। (বাকারা, ২১৭)
এ থেকে পরিস্কার বুঝা যায়, ইসলাম বিরোধীদের জোরদার প্রচারাভিযানে প্রভাবিত ও বিব্রত হয়ে মুসলমানরা জিজ্ঞেস করেছিল, নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ করা ইসলামের দৃষ্টিতে কেমন।যারা সততা ও শান্তিপ্রিয়তা সম্পর্কে একটা ভারসাম্যহীন ধারণা পোষন করতো এবং যারা সামান্য বিরোধিতা দেখলেই ঘাবড়ে যেত, তারা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল যে, আমরা ইসলামের প্রকৃত চেতনা ও খোদাভীরুতা হারিয়ে ফেলছিনা তো? আমরা মাত্রাতিরিক্ত রাজনীতি প্রীতির অধীন আমাদের আসল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে গিয়ে নিজেরাই জনগণকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিনা তো? এ ধরনের লোকদের বিব্রতবোধ অস্বাভাবিক ধরনের ছিল এবং তাদের মনের শান্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।প্রশ্নের পেছনে এই মনমানস বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল।এই প্রসঙ্গে ইসলাম বিরোধীদেরকেও দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হলো।আল্লাহ বললেন যে, মক্কার যে মোশরেকরা আল্লাহর পথে চলতে মানুষকে বাধা দেয়া, আল্লাহর অবাধ্যতা, হারাম শরীফে আগমনকারীদেরকে আসতে না দেয়া, এবং হারামবাসীকে উত্যক্ত করে হারাম শরীফ থেকে বের করে দেয়ার মত গুরুতর অপরাধে অপরাধী, তারা এখন নিষিদ্ধ মাসের সম্মানের রক্ষক সেজে কোন মুখে ময়দানে আসছে।এর ভেতরে ইহুদী ও মোনাফেকদেরকেও প্রকারান্তরে বলা হয়েছে যে, তোমরা তো মক্কাবাসীর এত সব যুলুম নিপীড়ন এবং ধর্মীয় প্রতীক সমূহের পবিত্রতা বিনষ্টকারী কার্যকলাপের সময় মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলে এবং আজও তোমরা সে সম্পর্কে নীরব।আজ তোমরা নাখলার একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে ধর্মীয় পবিত্রতার এমন রক্ষক সেজে গেলে? অথচ এ কাজের জন্য ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ কোন অনুমতি দেয়নি।বরং কতিপয় ব্যক্তির ভুলের কারণে ঘটনাটা ঘটে গেছে।এ ঘটনার সুফল গ্রহণ করতে রাষ্ট্রের শাসক অস্বীকার করেছেন এবং জড়িত ব্যক্তিদেরকে শাস্তি দিয়েছেন।
এ ঘটনার ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় বুঝা যায়, ইসলামের শত্রুরা কিভাবে ওৎ পেতে বসে থাকে যে, পান থেকে চুন খসলেই তারা হামলা করে দেবে।কারো দ্বারা সামান্যতম ভুলত্রুটি হয়ে গেলেই তারা তৎক্ষণাত তা সারা দুনিয়ায় নিজস্ব ব্যাখ্যার রং মেখে ছড়িয়ে দেবে।
যেখানে প্রতি মুহূর্তে প্রতিটি ব্যাপারে বিভ্রান্তি, খারাপ ধারণা ও উস্কানি ছড়ানোর অপচেষ্টা চলে, সেখানে শত্রু পরিবেষ্টিত ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্র, তার প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী আন্দোলন ও তার পরিচালক কত উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে থাকেন, তা সহজেই অনুমেয়।গোটা পরিবেশ সেখানে সন্দেহ সংশয়, বিভ্রান্তির প্রশ্ন ও আপত্তিতে ভরপুর ছিল।কিন্তু এ ধরনের বাধাবিপত্তি কখনো কোন আদর্শবাদী ও চরিত্রবান সংগঠনের বিজয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
ধর্মের আড়ালে স্বার্থোদ্ধারের অপবাদ
আমি আগেই বলেছি, ইসলামের বাস্তবায়িত প্রতিটি সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ওপর ইহুদী আলেমরা একেবারেই অযৌক্তিকভাবে হাঙ্গামা বাধিয়েছিল।একটা উল্লেখযোগ্য সংস্কার ছিল ধর্মপুত্র বা মুখবলা পুত্রের মর্যাদা ও অধিকার সংক্রান্ত।এ নিয়েও বিরূপ প্রচারণা খুবই জোরে শোরে চালানো হয়।
পূর্বতন ধর্মীয় ও সামাজিক ধ্যান-ধারণা অনুসারে আরবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী প্রথা চলে আসছিল যে, পালিত (তথা মুখবোলা) পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করা অবিকল আসল পুত্রবধুর ন্যায় অবৈধ।এই প্রথার বিলোপ সাধনের জন্য আল্লাহ তায়ালা নিজস্ব পরিকল্পনা অনুসারে ঘটনা প্রবাহকে অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে অবর্তিত করেন এবং একটা বৈপ্লবিক পরিণতিতে নিয়ে পৌঁছান।ঘটনাটা ছিল এই যে, মাত্র দশ বছর বয়সে যায়েদ বিন হারেসা ক্রীতদাসে পরিণত হন।রসূল সা. তাকে এত স্নেহ ও যত্নে লালন পালন করতে থাকে যে, তাঁর গৃহে তিনি পালিত পুত্রের মর্যাদা লাভ করেন।পরবর্তী সময় যায়েদের বাবা ও ভাই তাকে নিতে আসে এবং রসূলও সা. তাকে যাওয়ার অনুমতি দেন।কিন্তু ইতিমধ্যে রসূল সা. কে যায়েদ এত গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন যে, এই সম্পর্কটা ছিন্ন হওয়া তিনি মেনে নিতে পারেন নি এবং বাবার সাথে যেতে সম্মত হননি।যায়েদ ঘটনাক্রমে ক্রীতদাসে পরিণত হলেও আসলে সম্ভ্রান্ত আরব পরিবারের সন্তান ছিলেন বিধায় মক্কার কতিপয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি রসূলুল্লাহর সা. ফুফাতো বোন যয়নবকে তার সাথে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন।কিন্তু যয়নবের ভাই এ বিয়েতে রাযী হননি।কেননা আরবে বিয়ের জন্য যে মাপকাঠ ও মানদন্ড চালু ছিল, এই বিয়ে সেই মানদন্ডে উত্তীর্ণ ছিলনা।জাহেলী মানসিকতার দৃষ্টিতে হযরত যায়েদের ললাটে তখনো দাসত্বের কলংক চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল।তাছাড়া তার সহায় সম্বলহীন ও চালচুলোহীন হওয়াটাও ছিল একটা আলাদা ত্রুটি।ইসলাম এসে এই মানসিকতাকেও পরিবর্তন করা জরুরী মনে করে।মানবতার বন্ধু রসূল সা. বিয়ে শাদীর পথ থেকে বংশগত বৈষম্যের বাধা অপসারণ করে সমগ্র ইসলামী সমাজকে একীভূত পরিবারে পরিণত করার চেষ্টা করেন।তাঁর এ চেষ্টার ফলে এই বৈষম্যের প্রাচীর সম্পূর্ণরূপে ধ্বসে যায় এবং ‘কুফু’ বা পরিবারিক সাম্যেও একটা নতুন অর্থের সৃষ্টি হয়।তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টান।তিনি তাদেরকে শেখান যে, বিয়ে করার সময় সর্বপ্রথম কনের চরিত্র ও দ্বীনদারী দেখতে হবে।অন্যান্য জিনিসকে বিবেচনায় আনতে হবে এর পরবর্তী পর্যায়ে।একবার তিনি একথাও বলেন, দ্বীনদারী ও নৈতিকতার পরিবর্তে তোমরা যদি অন্য কোন মানদন্ড স্থির কর, তাহলে সমাজে বিরাট অরাজকতা ও বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়ে যাবে।এভাবে ‘কুফু’ সম্পর্কে যে ধারণার প্রচলন ঘটে তা এই যে, জীবনের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে কে সর্বোত্তম জীবন সাথী বা জীবন সংগিনী হতে পারবে এবং কার সাথে রুচি ও মানসিকতার দিক দিয়ে সর্বাধিক বনিবনা ও একাত্মতা গড়ে ওঠবে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই জীবন সংগী নির্বাচন করতে হবে।অসংখ্য বিয়ে, বরং অধিকাংশ বিয়ে কার্যত এই নতুন দৃষ্টিভংগী অনুসারে হতে থাকে।এই মানসিক ও সামাজিক পরিবর্তন কোন্ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, তার ধারণা হযরত আবু তালহার বিয়ের ঘটনা থেকেই পাওযা যায়।হযরত আবু তালহা নিজে কাফের থাকা অবস্থায় হযরত উম্মে সুলাইমকে রা. কে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।অথচ উম্মে সুলাইম তখন ইসলাম গ্রহণ করেছেন।তিনি জবাব দিলেন, “তুমি এখনো কাফের রয়েছ, আর আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি।এখন পরস্পর বিরোধী দুটো জীবন কিভাবে একত্রিত হতে পারে।তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ কর, তাহলে আমি তোমার কাছ থেকে ‘ইসলাম গ্রহণ’ ছাড়া আর কোন মোহর নেবনা।” এ জবাব থেকে বুঝা যায়, এই বিয়ের প্রস্তাব হযরত উম্মে সুলাইমের কাছেও কাংখিত ছিল।কিন্তু ইসলাম এমন বিপ্লবাত্মক মানসিকতা সৃষ্টি করে দিয়েছিল যে, তিনি মনের ওপর বলপ্রয়োগ করে তা প্রত্যাখ্যান করে দিলেন।তবে সেই সাথে ইসলামের প্রতি উৎসাহও দিলেন।শেষ পর্যন্ত আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করলেন।বিয়ে হয়ে গেল এবং সত্য সত্যই তাদের মোহর ধার্য হলো ইসলাম। (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক ও উসওয়ায়ে সাহাবিয়াত, মাওলানা আব্দুস সালাম নদভী রা.)
সারকথা, বিয়েশাদীতে রুচি ও মানদন্ডে পরিবর্তন আসছিল।কিন্তু তবুও কিছু বাধা অবশিষ্ট ছিল।এ কারণেই হযরত যয়নবের ভাই প্রস্তাবিত বিয়েতে সম্মত হলেন না।রসূলও সা. চাইছিলেন যে বিয়েটা হোক।কিন্তু এর পথে যখন নিছক একটা জাহেলী মানসিকতা বাধ সাধলো, তখন এটা আল্লাহ ও রসূলের দৃষ্টিতে অবাঞ্ছিত বলে চিহ্নিত হলো।আভাসে ইংগিতে সূরা আহযাবে এর সমালোচনা করা হলো।৩৫ নং আয়াতে বলা হলো, ‘‘মুসলিম নারী ও মুসলিম পুরুষ, মুমিন নারী ও মুমিন পুরুষ……………….. এর জন্য আল্লাহ ক্ষমা ও বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত রেখেছেন।’’ এ আয়াতের মূল বক্তব্য হলো, ইসলামী মতাদর্শ, ইসলামী মানসিকতা ও ইসলামের চরিত্রের অধিকারী মুসলমান নারী ও পুরুষ পরস্পর সম্পূর্ণ সমান ও সমমনা।তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও মমত্ব রয়েছে এবং তারা পরস্পরের কাছে কদর পাওয়ার যোগ্য।সুতরাং তাদের মাঝে বংশীয় বৈষম্য ও ভেদাভেদ, কৌলিন্য ও অভিজাত্যের জাহেলী ধ্যানধারণা বাধা হয়ে দাঁড়ানো বাঞ্ছনীয় নয়।কিন্তু ইংগিত শুধু এতটুকুই ছিলনা।পরবর্তী আয়াত আরো কঠোর।তাতে বলা হলো, যখন আল্লাহ ও তার রসূল সা. কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন, তখন কোন ঈমানদার পুরুষ ও নারীর এ অধিকার নেই যে, ঐ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে নিজের পছন্দ ও অপছন্দ এবং নিজস্ব মানদন্ডকে গুরুত্ব দেবে।এভাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা বিপথগামী হয়ে অনেক দূরে সরে গেছে।’’ (সূরা আহযাব-৩৬) অর্থাৎ যখন মুসলিম পুরুষ ও স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পথ সুগম করা হয়, তখন পুরনো জাহেলী ধ্যান-ধারণাকে গুরুত্ব দিয়ে বাধার সৃষ্টি করা আল্লাহ ও রসূলের পথ নির্দেশনা ও তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক ধরণের স্বেচ্ছাচার।এ ধরণের স্বেচ্ছাচারিতা পরিণামে গোমরাহীর রূপ ধারণ করে থাকে।এভাবে এ আয়াতে বেশ জোরদার আঘাত করা হয়েছে এবং তা সঠিক লক্ষ্যস্থলেই লেগেছে।যয়নবের ভাই এ আয়াতগুলো শুনে ইংগিতটা বুঝে ফেললেন এবং বিয়েতে রাযী হয়ে গেলেন।এর অর্থ দাঁড়ালো যে, জন্মগতভাবে সম্ভ্রান্ত ও অ-সম্ভ্রান্ত, এবং কুলীন ও অকুলীন হওয়ার জাহেলী মানদন্ডের শৃংখল ভেংগে গেল।
আল্লাহ তায়ালা এই ঘটনা দ্বারাই মুখবলা বা পালিত পুত্র সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাটাও বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন।পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি দাঁড়ালো এ রকম যে, স্বামী স্ত্রীতে বনিবনা হলোনা।দু’জনের মধ্যে যে বাস্তব ব্যবধানটা বিদ্যমান ছিল, সেটা সম্পর্ককে প্রভাবিত করলো।রসূল সা. এর কাছে অভিযোগের পর অভিযোগ আসতে লাগলো।কিন্তু সম্পর্কের উন্নতির পরিবর্তে অবনতিই ঘটতে লাগলো।অবশেষে যায়েদ রসূল সা. এর কাছে তালাক দেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করতে লাগলেন।রসূল সা. খুবই বিচলিত হলেন।কারণ এমন একটা বিয়ে ভেংগে যাচ্ছে, যা সমাজে একটা বিপ্লবী দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা হয়েছিল।তাছাড়া এ বিয়েতে স্বয়ং রসূল সা. এর উৎসাহ ও পরামর্শেরও উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।তিনি যায়েদের অভিভাবক ছিলেন।তাই এ ক্ষেত্রে তার ওপর বিরাট দায়িত্ব অর্পিত ছিল।তিনি বারবার এ বিয়েকে বহাল রাখার ও যায়েদকে তালাক থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলেন।কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।যায়েদ তাকে তালাক দিয়ে দেয়।অবশেষে প্রয়োজন দেখা দেয় যে, তিনি নিজেই যয়নবকে বিয়ে করবেন।শরীয়তের এ ক্ষেত্রে কোন বাধা ছিলনা।কিন্তু সাবেক জাহেলী ধ্যান-ধারণার কারণে আশংকা ছিল যে, জনসাধারণ হয়তো হতবাক হয়ে যাবে এবং সেই সাথে বিরোধীরা অপপ্রচারের আর একটা উপকরণ পেয়ে যাবে।কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা এটাই ছিল যে, জাহেলী যুগ থেকে চলে আসা পালিত পুত্র সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন খুবই স্পষ্টভাবে স্বচ্ছভাবে স্বয়ং রসূল সা. এর হাতেই সম্পন্ন করতে হবে, যাতে এই কু-প্রথার মূল সম্পূর্ণরূপে উৎপাটিত হয়ে যায়।কোরআনে আল্লাহ তায়ালা তার সুপ্ত দুশ্চিন্তাকে প্রকাশ করে দিলেন।বললেনঃ তুমি নিজের মনে যা লুকিয়ে রাখছ, তা আল্লাহ প্রকাশ করেই ছাড়বেন।তুমি মানুষকে ভয় কর, অথচ আল্লাহকেই বেশী ভয় করা উচিত।’’ (আহযাব-৩৭) মৃদু সমালোচনার ভংগিতেই বলা হয়েছে যে, তুমি এমন কথা মনে লুকিয়ে রাখছ, যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিতে বদ্ধপরিকর।তুমি মানুষকে ভয় পাও, অর্থাৎ যে জিনিস আল্লাহর আইনে বৈধ, তাকে সমাজের জাহেলী ধ্যান-ধারণার আশংকায় মনে লুকিয়ে রাখা আল্লাহ পছন্দ করেন না।এটা প্রকাশ পাওয়া দরকার, ‘‘যাতে মুখবলা ছেলেরা তাদের স্ত্রীদেরকে পরিত্যাগ করলে তাদের ব্যাপারে মুমিনদের ওপর কোন বিধিনিষেধ না থাকে।’’ (আহযাব-৩৭) অর্থাৎ মুখবলা ছেলেদের ব্যাপারে সমাজে প্রচলিত প্রচীন কড়াকড়িকে মুসলমানদের ওপর থেকে চিরতরে তুলে দেয়াই এর উদ্দেশ্য।জাহেলিয়াতের এই শেকল ভাঙ্গার জন্য এভাবেই চূড়ান্ত আঘাত হানা হলো যে, আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে রসূল সা. এর সাথে হযরত যয়নবের বিয়ে দিয়ে দিলেন।
এ ঘটনাটা ঘটার সাথে সাথেই মদিনার ইসলাম বিরোধী মহলে হৈ চৈ পড়ে গেল।তারা এ বলে প্রচারণা চালাতে লাগলোঃ ‘‘দেখলে তো ধার্মিকতা ও পবিত্রতার ভড়ং? পালিত ছেলের বউকে উনি কিনা বিয়ে করে ফেললেন!” এই সাথে কাহিনীটাকে চটকদার ও মুখরোচক করার জন্য নানা রকমের গল্প বানানো হলো।দুর্মুখ ইহুদী ও মোনাফেকরা তখন গুজবও ছড়াতে লাগলো যে, (নাউযুবিল্লাহ) ‘‘আসলে উনি পুত্রবধুর প্রেমে মজে গিয়েছিলেন আর কি! এ জন্য তালাক দিতে বাধ্য করেছেন এবং তারপর নিজেই বিয়ে করে ফেলেছেন।’’ [উল্লেখ্য যে, আধুনিক কালের কিছু বিদ্বেষপরায়ণ ওরিয়েন্টালিস্ট ইসলামী আন্দোলনের তৎকালীন কট্টর দুশমনদের আরোপিত সমস্ত নোংরা অপবাদকে ইতিহাস থেকে হুবহু গ্রহণ করেছে।এই ঘটনাটাও ঐসব বিদ্বান ও গবেষকদের কাছে অত্যন্ত স্বীকৃত বিষয়ে পরিণত হয়েছে এবং একে অধিকতর মুখরোচক বানিয়ে তাদের বই পুস্তকে সাজিয়ে দেয়া হয়েছে।রসূলুল্লাহ সা. নাকি হঠাৎ করেই যয়নবকে দেখে ফেলেন এবং প্রেমে মজে যান।একটু ভেবে দেখা দরকার, যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিষ্কলংক যৌবন নিয়ে সার্বক্ষণিক চেষ্টাসাধনা ও অবিশ্রান্ত ব্যস্ততায় পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিলেন এবং যিনি একটা মুহূর্ত স্বস্তিতে কাটাতে পারলেন না, তার চরিত্র পরিপক্কতার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে এতই ঠুনকো হয়ে গেল যে, একটা মাত্র দৃষ্টিতে প্রেমে দিশেহারা হয়ে গেলেন? তার সামগ্রিক চরিত্রের সাথে কি এ অপমান আদৌ খাপ খায়? তাছাড়া হযরত যয়নব রসূল সা.-এর আপন ফুফাতো বোন ছিলেন এবং শৈশব থেকেই তার সামনে হেসে খেলে বড় হয়েছেন।তার অস্তিত্বতো রসূল সা. এর কাছে নতুন কিছু নয়।এটাও বাস্তব ঘটনা যে, তিনি নিজেই অনেক চেষ্টা করে যায়েদের সাথে তার বিয়ে দিয়েছিলেন এবং এই বিয়েতে তিনিই ছিলেন যায়েদের অভিভাবক।এসব অকাট্য তথ্যের সামনে কি এই মনগড়া কাহিনীর আদৌ কোন ভিত্তি খুজে পাওয়া যায়, যা মদিনার ইহুদী ও মোনাফেকরা তৈরী করেছিল এবং যাকে পুনরায় ওরিয়েন্টালিস্টরা ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে? যুক্তি (Rationalism) ও গবেষণার (Research) দাবীদারদের নিজস্ব মানদন্ডে কি এই কল্পকাহিনী উত্তীর্ণ হয়?]
বিয়েটাও যা তা বিয়ে নয়, একেবারে আকাশেই সম্পাদিত।এ বিয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য নাকি ইচ্ছেমত ওহিও নাযিল করিয়ে নিয়েছেন।ইতিপূর্বে আকীদা ও ফেকাহ শাস্ত্রীয় ব্যাপারে অনেক বৈরী প্রচারণা চালানো হয়েছিল।কিন্তু এই ঘটনা নিয়ে তো সত্য সত্যই নোংরা প্রচারণা চালানো হয়েছে এবং রসূল সা. এর চারিত্রিক মহাত্ম্যের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছে।এ কথা সুবিদিত যে, কোন সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক আন্দোলনের বিরুদ্ধে নৈতিক দিক দিয়েই সবচেয়ে মারাত্মক আক্রমণ চালানো সম্ভব।কোন দাওয়াতে শীর্ষ নেতা সম্পর্কে যদি বিরোধীরা এরূপ প্রচারণায় লিপ্ত হয় যে, সে একজন লম্পট, সে নিজের প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার জন্য যেকোন পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করেনা, এবং সে কোন চারিত্রিক মানের প্রতি সম্মান দেখায়না, তা হলে এর চেয়ে ক্ষতিকর আঘাত আর কিছু হতে পারেনা।সহজেই অনুমেয় যে, শত্রুরা মদিনায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কত নোংরা প্রচারণা চালিয়েছে এবং মানবতার এই সর্বশেষ্ঠ শুভাকাংখীর কয়েকটা দিন কিরূপ মানসিক যন্ত্রণায় কেটেছে।
ইহুদীদের এই অপপ্রচার নিরীহ ও সরলমনা মুসলমানদের জন্যও অত্যধিক বিব্রতকর ছিল বলে মনে হয়।চলার পথে হয়তো তাদেরকে অনেক আজে বাজে কথা বলে উত্যক্ত করা হতো এবং তাদের মনে নানা রকম সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি চেষ্টা করা হতো।কোন কোন অপরিপক্ক মুসলমান হয়েতো এর ফলে ঘাবড়ে যেত।তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী মোনাফেকরা হয়তো আপন সেজে অনেক উল্টাপাল্টা কথা ছড়াতো।এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের সান্ত্বনা ও প্রশিক্ষণার্থে কয়েকটা বিষয় তাদের মনে বদ্ধমূল করে দিলেন।তাদের জানিয়ে দিলেন যে, নবী সা. এর জন্য আল্লাহ যা বৈধ করেছেন, তার ব্যাপারে তার ওপর আর কোন বিধিনিষেধ নেই। (সূরা আহযাব-৩৮) এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্যই জানিয়ে দিলেন যে, মুসলমানদের ওপর তাদের পালিত পুত্রদের তালাক দেয়া স্ত্রীকে বিয়ে করায় কোন বাধা না থাকে। (সূরা আহযাব-৩৭) এ কথাও ঘোষণা করে দিলেন যে, মুহাম্মাদ সা তোমাদের পুরষদের কারো পিতা নন। (সূরা আহযাব-৪০) সবার শেষে স্বয়ং রসূলকে সম্বোধন করে বললেন, তুমি কাফের ও মোনাফেকদের অনুসরণ করোনা।এবং তাদের অপপ্রচারে মর্মাহত হয়োনা।আল্লাহর ওপর ভরসা কর।আল্লাহই যথেষ্ট।’’ (সূরা আহযাব-৪০) এভাবে অত্যন্ত শান্ত ও শালীন পন্থায় এই ঘৃণ্য ও নোংরা অপপ্রচারের জবাব দেয়া হলো, যা ইহুদীরা অত্যন্ত হীন উদ্দেশে চালিয়েছিল।
আরো একটা নোংরা অপপ্রচার
উপরোক্ত ঘটনা থেকে বুঝা যায়, ইসলামী আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে যখন কোন দিক দিয়েই হামলা করে ক্ষতিগ্রস্থ করার সুযোগ পাওয়া যায়না, তখন শয়তান তাকে পিঠের দিক দিয়ে আঘাত করার প্ররোচনা দেয়।আর শয়তানের দৃষ্টিতে পিঠের দিক দিয়ে আঘাত করার সর্বোত্তম পন্থা হলো, এর নেতার ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের ওপর কলংক লেপন করা।এ জন্যই এক পর্যায়ে ক্ষমতার মোহ এবং আর এক পর্যায়ে স্বর্থপরতার জঘন্য অপবাদ আরোপ করা হয় রসূল সা. এর বিরুদ্ধে।এরপর অপপ্রচারণার এই ধারা আরো সামনে অগ্রসর হয় এবং ইসলামী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতার পরিবারকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়।অথচ এই পরিবারকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সমগ্র মুসলিম উ্ম্মাহর জন্য সামাজিক ও নৈতিক দিক দিয়ে কেন্দ্রীয় নমুনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল।এই পরিবারকে কেন্দ্র করেই ইসলামী সমাজের অবকাঠামো তৈরী হচ্ছিল।আর এই পরিবারের কেন্দ্রের ওপর আঘাত হানাই ছিল ঐ অবকাঠামোকে ধ্বংস করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।শেষ পর্যন্ত নাশকতাবাদী শক্তি এই শেষ আঘাতটা হানতেও দ্বিধা করলোন।এই বৈরী আঘাতের মর্মন্তুত কাহিনী কোরআন, হাদীস, ইতিহাস ও সীরাতে গ্রন্থাবলীতে ‘‘ইফকের ঘটনা’’ তথা ‘‘হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে অপবাদের কাহিনী’’ নামে শিক্ষা গ্রহণের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।
মূল ঘটনার তথ্যাবলী তুলে ধরার আগে আমি একথা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন মনে করি যে, এমন জঘন্য অপবাদের ভয়াবহ তান্ডব ইসলামী আন্দোলনের গড়া সৎ ও পূণ্যময় সমাজে এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসংগঠিত দলের অভ্যন্তরে সৃষ্টি হতে পারলো কিভাবে? কোন্ ছিদ্রপথ দিয়ে এই ভয়াবহ ঝড় ইসলামী সংগঠনের সুরক্ষিত দুর্গে ঢুকলো এবং কিছু সময়ের জন্য তা চরম বিভীষিকার সৃষ্টি করার সুযোগ পেল?
বিভ্রান্তি সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ
ইসলাম সমাজ ব্যবস্থার অভ্যন্তরে নাশকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য শয়তানের একটা বিশেষ ধরণের অনুকূল পরিবেশ অবশ্যই প্রয়োজন।এই পরিবেশ সমাজের শৃংখলা ও নৈতিকতার কোন ত্রুটির কারণেই সৃষ্টি হোক, অথবা পরিস্থিতি ও পরিবেশগত বাধ্যবাধকতার কারণেই জন্ম নিক, বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ তৈরী হলেই শয়তানের চক্রান্ত কিছুটা ফলপ্রসু হতে পারে।আল্লাহর প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার ধারায় শয়তানের জন্য কাজ করার কিছু ফাঁকফোকর অবশ্যই থেকে যায়, চাই তা যত বড় আদর্শ সমাজই হোক না কেন।আসলে মানুষের স্বভাব প্রকৃতিতে কিছু কিছু দুর্বলতা এমন থাকে, যার মধ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ও ফেলনা প্রবেশের সুযোগ পায়।রসূল সা. এর প্রতিষ্ঠিত সমাজের ব্যাপারেও এমন গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব নয় যে, তার অভ্যন্তরে নৈরাজ্যবাদী শক্তি কাজ করার কোন সুযোগই পাবেনা।একজন মানুষ যত স্বাস্থ্যবানই হোক, তার কখনো কখনো জ্বর, কাশী ও সর্দিতে আক্রান্ত হওয়া যেমন সম্ভব, তেমনি একটা পবিত্রতম সমাজেরও রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া সম্ভব।একটা সুস্থ্য ও সজীব সমাজের কাছ থেকে যেটা প্রত্যাশা করা যায় তা হলো, সে সব সময় রোগের প্রতিরোধ ও রোগ জীবানু ধ্বংস করার কাজে ব্যাপৃত থাকবে।কিন্তু সে সমাজে কখনো কোন রোগের প্রাদুর্ভাবই ঘটবেনা, এমন প্রত্যাশা করা যায়না।শয়তানের জন্য কোন সমাজে সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ হয়ে থাকে গোপন সলাপরামর্শ ও ফিসফিসানির পরিবেশ।কোন সামষ্টিক ব্যবস্থায় যখন সমগ্র জনতার সামনে খোলাখুলি মতামত, পরামর্শ, সমালোচনা ও প্রশ্ন করার পরিবর্তে বিভিন্ন ব্যক্তি আলাদা আলাদাভাবে বসে গোপন সলাপরামর্শ করে, তখনই এই পরিবেশের সৃষ্টি হয়।কোরআনে এ জিনিসটাকে ‘নাজওয়া’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।বস্তুত নাজওয়া আসলে সামষ্টিক জীবনে একটা বিপজ্জনক পথে যাত্রা শুরু করার নাম।প্রকাশ্যে কাজ করতে মানুষ যখন সংকোচ বোধ করে তখন বুঝতে হবে এর পেছনে কিছু ব্যাপার অবশ্যই আছে।স্বচ্ছতা এগিয়ে গোপন সলাপরামর্শ ও ফিসফিসানির এই প্রবণতাই শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র ও যোগসাজসে রূপান্তরিত হয়।
দুর্ভাগ্যবশত রসূল সা. এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আন্দোলনের ভেতরে ইহুদীদের নেতৃত্বে মোনোফেকরা এই ফিসফিসানির পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং তা আন্দোলনের নেতা ও কর্মীদের অনবরতই বিব্রত করতে থাকে।যারা এই পরিবেশ সৃষ্টি করছিল, কোরআন তাদেরকেও সংশোধন করতে থাকে।আর ইসলামী সংগঠনের পরিচালকদেরও সতর্ক করতে থাকে।কোরআন বলেঃ
‘‘তোমরা দেখতে পাওনা, যাদেরকে গোপন সলাপরামর্শ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছিল, তারা আবারো সেই নিষিদ্ধ কাজের পুনরাবৃত্তি করছে? তারা পরস্পরে অপকর্ম, অহংকার ও রসূলের বিরুদ্ধাচরণের ব্যাপারে গোপন পরামর্শে লিপ্ত থাকে। (সূরা মুজাদালা-৮)
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখনই পৃথকভাবে পরস্পরে পরামর্শ কর তখন অসৎ কাজ, অহংকার ও রসূলের অবাধ্যতার পরিকল্পনার করোনা।বরং সততা ও খোদাভীতির জন্য পরামর্শ কর।’’ (সূরা মুজাদালা-১)
‘‘ফিসফিসানি মুমিনদেরকে উত্যক্ত করার জন্য পরিচালিত শয়তানী কাজ।অবশ্য আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন জিনিসই তাদের ক্ষতি করতে পারেনা।’’ (সূরা মুজাদালা-১০)
‘‘এই সব গোপন পরামর্শকারীরা মানুষের চোখের আড়ালে যেতে পারে, কিন্তু আল্লাহর চোখ থেকে লুকাতে পারেনা।তারা যখন রাতের অন্ধকারে ও নিভৃতে আল্লাহর অপছন্দনীয় কথাবার্তা বলে, তখন আল্লাহ তাদের সাথে থাকেন।’’ (সূরা নিসা-১০৮)
‘‘গোপন সলাপরামর্শের জন্য যখনই তিনজন মানুষ একত্রিত হবে, তখন সেখানে আল্লাহ হয়ে থাকেন চতুর্থজন, পাঁচজন জমায়েত হলে আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাথে থাকেন, চাই তারা যেখানেই যাক না কেন।’’ (সূরা মুজাদালা-৭)
‘‘তারা মুখে বলে, আমরা (সামষ্টিক ফায়সালা ও নেতার আদেশের) আনুগত্য করবো।কিন্তু যখন তারা তোমার কাছ থেকে বের হয়, তখন তাদের একটা দল রাতের বেলা তোমার কথাগুলোর বিরুদ্ধে সলাপরামর্শে লিপ্ত হয়।আর আল্লাহ তাদের পরিকল্পনাগুলো লিখে রাখেন।’’ (সূরা নিসা-৮)
এ আয়াতগুলোতে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলে দেয়া হয়েছে, ইসলামী সমাজ, রাষ্ট্র ও সংগঠন সামষ্টিকভাবে যে স্থিরকৃত নীতিমালার ভিত্তিতে চলে এবং যে সব সামাজিক ফায়সালা ও দলীয় ঐতিহ্য চালু থাকে, তার সমর্থন, আনুগত্য, বাস্তবায়ন ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য লোকেরা আলাদাভাবে পরস্পরে গোপন বা প্রকাশ্যে স্বাধীনভাবে আলাপ আলোচনা করতে পারে।কিন্তু এগুলোকে অমান্য করা, দ্বিমত পোষণ করা, ব্যর্থ করা, এগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত করা, আপত্তি তোলা ও ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য পরস্পরে আলাদা হয়ে গোপন পরামর্শ করা ও কানাঘুষা করা এমন জঘণ্য গুনাহ যা এসব ব্যক্তির চরিত্র ও পরিণামকে ধ্বংস করে দেয় এবং গোটা সামাজিক ব্যবস্থাকে বিব্রত ও সমস্যায় জর্জরিত করে।গোপন বিদ্রোহী ও ফিসফিসানির আসল প্ররোচনাদাতা শয়তান।এই প্ররোচনা থেকে কোরআন ইসলামী সংগঠনকে সাবধান করে দিয়েছে।
গোপন সলাপরামর্শ ও কানাঘুষার একটা বিষয় ছিলো “রাসুলের আদেশ অমান্য করা”।আসলে এটাই ছিলো কেন্দ্রীয় বিষয়।মদীনার ইসলামী আন্দোলনের আওতাধীন পরিবেশে এর আদৌ কোন সম্ভাবনা ছিলো না যে, খোদ আন্দোলন এবং তার আদর্শ ও লক্ষ্যকে অপপ্রচারের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হবে এবং আল্লাহর নাফরমানী ও তার কিতাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে।মোনাফেকদের জন্য বড়জোর এতোটুক বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ ছিলো যে, ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে পারতো এবং সর্বোচ্চ নেতার বিরুদ্ধে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারতো।একটি নৈতিক আন্দোলনকে ধ্বংস করার সবচেয়ে কার্যকর ও সহজ পন্থা এটাই হতে পারে যে, তাদের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নাম রটানো হোক।
এ প্রসংগে আমি আগেই বলেছি, স্বার্থপরতা ও গদির লোভ সংক্রান্ত অপবাদ আগেই আরোপ করা হয়েছিলো।কিন্তু আসলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আরোপের মধ্যেই এটা সীমিত ছিলো না বরং গুজব রটানোর একটা অভিযান (Whispering campaign) এবং ‘ঠান্ডা লড়াই’ স্থায়ী রূপ ধারণ করেছিলো।
উদাহরণ স্বরূপ, পরবর্তীকালে যখন যাকাত ও বন্টনের ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলো, তখন রসুল সা. এর প্রতি একটা হীন অপবাদ এই মর্মে আরোপ করা হলো যে, তিনি বায়তুল মালে জমাকৃত অর্থ নিজের খেয়াল খুশী মোতাবেক আত্মসাত করে ফেলেন।ব্যাপারটা ছিলো এই যে, সকল সঞ্চিত সম্পত্তি, বাণিজ্যিক পুজি, গবাদিপশু ও কৃষিজাত সম্পদ থেকে যখন নিয়মিতভাবে যাকাত ও উশর আদায় করা হতে লাগলো, তখন বিপুল সম্পদ একই কেন্দ্রে জমা হতে লাগলো এবং রসুল সা. এর হাতে তা বন্টিত হতে লাগলো।ধন সম্পদের এই বিপুলাকৃতির স্তুপ দেখে ধনলোভীরা লালায়িত হয়ে উঠতো।তারা চাইতো জাহেলী যুগের ন্যায় আজো এই সম্পদ তাদের ন্যায় ধন্যাঢ্যদের হাতেই কেন্দ্রীভূত হোক।কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পদকে দরিদ্রমুখী করে দেয়।বিত্তশালীরা এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনে দারুণভাবে অসন্তুষ্ট ছিলো।তারা ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপরতো আক্রমণ চালাতে পারতো না, যা তাদের পকেট ভর্তি করার পরিবর্তে তাদের কাছ থেকে আইনের জোরে ‘যাকাত’ নামক ‘জরিমানা’ আদায় করছিল।তারা মনের আক্রোশ মেটাতে রসুল সা. কে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত করতো।তারা বলতো, রসুল সা. নিজের সমর্থক ও আত্মীয় স্বজনের পেছনে সম্পদ ব্যয় করছেন এবং বিশেষভাবে মুহাজিরদের অকাতরে দান করছেন।অন্য কথায়, ইসলামী রাষ্ট্রের সরকারী কোষাগারের অর্থে পরিবার পরিজন ও স্বজন তোষণ করছেন।আল্লাহর নামে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সম্পদ কেড়ে নিচ্ছেন এবং সেই অর্থ নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি ও আধিপত্য বিস্তারে ব্যয়িত হচ্ছে।সরকারী কোষাগারের অর্থ সম্পর্কে যে কোন শাসন ব্যবস্থায় শাসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরোপিত হলে তা গুরুতর আকার ধারণ করে।কিন্তু বিশেষভাবে একটা ধর্মীয় ও নৈতিক সমাজ ব্যবস্থায়, যেখানে কোষাগারকে আল্লাহর সম্পদ বলা হয়ে থাকে এবং যার প্রতিটি আয় ব্যয় আল্লাহর নামে এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে পরিচালিত হয়ে থাকে, সেখানে এ ধরনের অভিযোগ থেকে নিদারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি করা সম্ভব।
ভাববার বিষয় হলো এই অপবাদ সেই আদর্শ মানুষের বিরুদ্ধে আরোপ করা হচ্ছে যিনি যাকাত সাদাকার অর্থকে শুধু নিজের ও নিজের পরিবারের জন্য নয় বরং গোটা বনু হাশেম গোত্রের জন্য আইনত হারাম করে দিয়েছেন।এমন নিঃস্বার্থ ব্যক্তির তুলনা সমগ্র মানবেতিহাসেও হয়তো কোথাও পাওয়া যাবে না।অথচ সে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের ললাটেও নিতান্ত হীন চরিত্রের চুনোপুটিরা কালিমা লেপনের ধৃষ্টতা দেখালো।
এই লোকদের পরিচয় কোরআন এভাবে দিয়েছে যে, তারা নিজেদের জঘন্য কথাবার্তা দ্বারা রসুলের সা. মনে কষ্ট দেয় (সুরা তাওবাহ)।অর্থাৎ আন্দোলনের সামষ্টিক সমস্যাবলী নিয়ে খোলা মনে মুক্ত পরিবেশে কথা বলার পরিবর্তে তারা শ্রেষ্ঠতম নেতার ব্যক্তিত্বকে ঘায়েল করতে থাকে।এই ঘায়েল করার একটা দৃষ্টান্ত কোরআন নিজে তুলে ধরেছে।ঘটনা ছিলো এই যে, ইসলামী সমাজের অভ্যন্তরে মুনাফিকদের কার্যকলাপ ও চালচলন এমনই একটা বেখাপ্পা জিনিস ছিলো যে, তা মুমিনদের কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগতো।মুমিনরা এসব চালচলন দেখে খুবই বিব্রতবোধ করতেন।তদুপরি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করাও ছিলো মুশকিল, আবার তা নীরবে বরদাশত করাও ছিলো দুরহ।বেচারা মুসলমানরা আর কী করবে? তারা জামায়াতী দাবী অনুযায়ী বাধ্য হয়ে মুনাফিকদের অশোভন তৎপরতা সম্পর্কে রসুল সা. কে অবহিত করতেন।এভাবে প্রত্যেক মুনাফিক ক্রমান্বয়ে সমাজে চিহ্নিত হয়ে যেতো এবং তার সম্পর্কে রসুল এক বিশেষ ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাতেন।এই প্রতিক্রিয়া প্রথমে অত্যাধিক কোমল এবং পরে ক্রমান্বয়ে কঠোর হতে থাকে।এই পরিস্থিতিতে মোনাফেকীর ব্যধিতে আক্রান্তরা নিজেদের অবহেলিত ও কোনঠাসা অনুভব করে বলাবলি করতে লাগলো যে, (নাউযুবিল্লাহ) রসুলুল্লাহর কোন বিচারবুদ্ধি নেই, যার কাছে যা শোনেন তাই বিশ্বাস করে ফেলেন।মামুলী ধরনের লোকেরা, যারা আমাদের তুলনায় কোন ব্যক্তিত্বের অধিকারীই নয়,তারা রসুল সা. এর কাছে চলে যায়, যার সম্পর্কে যা ইচ্ছা বলে আসে এবং তিনি সব কথাই তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বাস করে ফেলেন।সর্বোচ্চ নেতার এই দুর্বলতার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি।আজ আমাদের বলা হয় মোনাফিক ও কুচক্রী।আর সেদিনকার উপোষ করা গোলাম ছোকড়াগুলো হয়ে গেছে ওঁর ঘনিষ্ঠতম সাথী।
এ ধরনের পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবেই সম্ভবত মোনাফেকদের একটা দল একবার রসুল সা. এর সাথে পৃথকভাবে এক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হয়।বৈঠক চলাকালে এক একজন মুনাফিক হঠাৎ বলে উঠতো আমার একটু নিভৃতে আপনার সাথে কিছু কথা আছে।রসুল সা. সৌজন্যের খাতিরে সবার জন্য এই সুযোগ উন্মুক্ত রাখতেন।কিন্তু নিভৃতে বিশেষ কথা বলার এই নাটকীয় ধারার ভিন্নতর উদ্দেশ্য ছিলো।এ দ্বারা মুনাফিকরা সাধারণ মুসলামানদের উপর নিজেদের প্রতিপত্তি জমাতে চাইতো এবং এই ধারণা দিতে চাইতো যে, আমরা অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা ভি আই পি গোছের লোক।আমরা শুধু সর্বোচ্চ পর্যায়ে সর্বোচ্চ নেতার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথাবার্তা বলে থাকি।দ্বিতীয় উদ্দেশ্য থাকতো রসুল সা. এর দৃষ্টিতে কৃত্রিম উপায়ে নৈকট্য লাভ করা এবং যতদূর সম্ভব নিষ্ঠাবান মুমিনদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে তাদের এবং সেই অবহেলিত ও কোনঠাসা অবস্থা কিছুটা হালকা করা যা তাদেরই অপকর্মের ফলেই উদ্ভুত হয়েছিলো।কিন্তু রসুল সা. এর সৌজন্য মুনাফিকদের কাল ক্ষেপণের যে অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো, তাকে আল্লাহ তায়ালা নিন্মোক্ত আদেশ দ্বারা রহিত করে দিলেনঃ
“হে মুমিনগণ, তোমরা যখন রসুল সা. এর সাথে (বিশেষ সময় নিয়ে) নিভৃত আলোচনায় মিলিত হতে চাও, তখন আলোচনার পূর্বে সাদাকা দিও।” – (মুজাদালাহ-১২)
এই আদেশে ঘোরতর কৃপণ স্বভাবের মুনাফিকদের কোমর ভেঙ্গে গেলো এবং বারবার বিশেষ সময় নিয়ে আলোচনার ধারা থেমে গেলো।তবে এই কাজটা এই ধারণার ভিত্তিতেই শুরু হয়েছিলো যে, আন্দোলনের নেতা খুবই সরল বিশ্বাসী।কাজেই নিষ্ঠাবানদের মোকাবেলায় আমরাও তার তার কানে নানা কথা ঢুকিয়ে তাকে নিজের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করবো।কিন্তু তারা ধারণাও করতে পারেনি যে, একনিষ্ঠ মুমিনদের জন্য তিনি যেমন সরল বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি কুচক্রীদের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক।যা হোক একথা সহজেই বোঝা যায়, যারা ইসলামী সংগঠনের মধ্যে বসে তার সর্বোচ্চ নেতার বিরুদ্ধে এ ধরণের তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা বলে বেড়াতো তাদের মধ্যে নিয়ম শৃংখলার প্রতি যথাযথ ভালোবাসা ও আনুগত্য থাকা সম্ভব নয়।অথচ এই আনুগত্য ও ভালোবাসাই দলের কর্মীদের সক্রিয় ও কর্মচঞ্চল বানিয়ে থাকে।একটা ধর্মীয় ও নৈতিক সংগঠনে যারা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে ও কানাঘুষায় লিপ্ত থাকে তারা প্রকৃতপক্ষে ঐ সংগঠনকে ধ্বংস করার অপচেষ্টায়ই নিয়োজিত থাকে।
ইসলামী আন্দোলন যখন দাওয়াত ও প্রচারের স্তর থেকে জিহাদের স্তরের দিকে বৈপ্লবিক মোড় নিচ্ছিলো, তখন বিপুল সংখ্যক মোনাফেক আত্মপ্রকাশ করে।এ ধরনের মোড় নেয়ার সময় সব আন্দোলনেই কিছু লোক হতবুদ্ধি ও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।এ ধরনের পরিস্থিতিতে কেবল সেইসব কর্মীই ভারসাম্য রাখতে পারে, যারা আগে থেকেই শুনে আসে যে, তারা কোন দিকে চলেছে এবং পথে কোন কোন মঞ্জিল তাদের অতিক্রম করতে হবে।নচেৎ দুনিয়ার সব আন্দোলনেরই অবস্থা এ রকম হয়ে থাকে যে, কোন বড় মোড় যখন সামনে আসে এবং লাফ দিয়ে এক স্তর থেকে অন্য স্তরে প্রবেশ করতে হয়, তখন এই পরিবর্তন সম্পর্কে আগে থেকে যাদের বুঝ নেই, তারা অকর্মন্য ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।এ ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনায় অনেক সময় ভালো ভালো কর্মী জটিলতার শিকার হয়ে ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়ে।ইসলামী আন্দোলনে এই ব্যপারটাই ঘটেছিলো।আন্দোলন প্রচারের স্তর থেকে সংগ্রামের স্তরে প্রবেশ করলে কিছু লোক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো।বিশেষত যারা জিহাদের দুঃসহ বোঝা বহনে প্রস্তুত ছিলো না, তারা চিরদিনের জন্য মুনাফিক হয়ে গেলো।এই পরিস্থিতির জন্য আগে থেকে মন মানসকে প্রস্তুত না রাখায় তাদের এই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিলো।
কোরআনে বলা হয়েছে, এক শ্রেণীর লোককে প্রাথমিক যুগে আদেশ দেয়া হয়েছিলো যে, “তোমাদের হাত সংযত রাখো”।অর্থাৎ ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে গিয়ে যুলুম ও বাড়াবাড়িকে বরদাশত করে যাও এবং সংঘাতে যেওনা।কেবল নামাজ কায়েম কর ও যাকাত দেয়ার মতো কার্যকলাপে লিপ্ত থাকো (নিসা- ৭৭)।কিন্তু সেই পর্যায়ে এই আদেশ তাদের মনঃপূত ছিলো না।পরবর্তী পর্যায়ে ঐ লোকদেরই যখন জিহাদের আদেশ দেয়া হলো, অমনি তারা মানুষকে এতো ভয় পেয়ে গেলো যে, তাদের কর্মতৎপরতাই থেমে গেলো।তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়া এরূপ ছিলো যে, আল্লাহকে তারা বললো, হে আল্লাহ আমাদের উপর যুদ্ধ কেনো ফরজ করলে? আমরা আরো কিছু দিন দাওয়াত দিতাম, নামাজ ও যাকাত দ্বারা চরিত্র শুদ্ধির কাজ করে নিতাম, চাদা তোলা ও গঠন মূলক কাজ চালিয়ে যেতাম।এক স্তরেই চাহিদা পূরণ হলো না, সময় হওয়ার আগে আরেক স্তরের কাজ চাপিয়ে দিলে!
কিন্তু তারা ছিলো অসহায়।আল্লাহর সাথে তর্ক বিতর্ক ও করতে পারছিলো না।তার আদেশ জারী করাও ঠেকাতে পারছিলো না।তাদের সামনে ছিলো শুধু রসুল সা. এর ব্যক্তিত্ব।তাই তারা তাকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারেনি।প্রতিটি লড়াই থেকে তারা পালিয়েছে এবং প্রত্যেক নাজুক ঘটনায় তারা নানারকম ছলছুতোঁর আশ্রয় নিয়েছে।আল্লাহর আরোপিত দায় দায়িত্বের প্রতিশোধ তারা ইসলামী আন্দোলনের নেতার কাছ থেকে পুরোদমে নিয়ে নিয়েছে।
যেকোন আন্দোলন যখন সঙ্ঘাতে লিপ্ত হয়, তখন তার পতাকাবাহীরা শত্রুর উপর যেমনি আঘাত আনে তেমনি নিজেরাও আঘাত খায়।কোন আঘাত সফল হয় আবার কোনটা হয় ব্যর্থ।ফলাফল কখনো আশানুরুপ হয় কখনো হয় হতাশাব্যঞ্জক।পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন লড়াইয়ের ময়দান পাওয়া যায়নি, যেখানে সব সময় কেবল এক পক্ষই জয় লাভ করে।যে পক্ষ জয়লাভ করে সেও বহু প্রাণ বিসর্জন দিয়ে বিজয়েরর মূল্য পরিশোধ করে, অনেকে আহত হয় এবং অনেক সম্পদ বিনষ্ট হয়।মদীনার ইসলামী আন্দোলনের কর্মরত মোনাফেকদের (……………।) “প্রত্যেক দুঃখের সাথেই অবশ্যই সুখ রয়েছে” এই দর্শনে আস্থা ছিলো না।তারা প্রত্যেক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রত্যেক আঘাতে চিৎকার করে উঠতো যে, এটা আন্দোলনের নেতার প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার অভাবের কারণেই হয়েছে। (নাউজুবিল্লাহ ) কোরআনে তাদের এই কর্মবিমুখ দার্শনিক প্রচারণার উন্মেষ এভাবে করা হয়েছে,
“তারা যদি সাফল্য লাভ করে তবে বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, আর কোন ক্ষতির সম্মুখীন হলে বলে, এটা তোমার (রসুল সা.) কারণে হয়েছে”। (সুরা নিসা-৭৮)
অর্থাৎ বিভিন্ন সঙ্ঘাতে সঙ্ঘর্ষে যে আঘাতই আসতো, যে ক্ষয় ক্ষতিই হতো, যে ত্যাগ কুরবানীরই প্রয়োজন পড়তো এবং যেসব চেষ্টা তদবীরে আশানুরূপ ফল ফলতো না সে সব কিছুর জন্য তারা রসুল সা. কে দায়ী করতো।ভাবটা এমন ছিলো যে, ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী সংগঠনের নিয়ম শৃংখলা সবই চমৎকার কিন্তু যিনি এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি অদক্ষ।কিছুটা খোদাভীতির পরিচয় ও দেয়া হয়েছে একথা বলে যে, সাফল্য যেটুকু আসছে তা আল্লাহরই দান।যেন প্রচারণাটা শুধু দার্শনিকই নয় বরং খোদাভীতিমূলকও।কিন্তু এই ভন্ডামীপূর্ণ খোদাভীতি রসুল সা. এর ন্যায় নেতার প্রতি এতটুকু আনুগত্য ও শুভাকাংখিতাও দেখাতে পারলো না, যা ইসলাম একজন নিগ্রো কৃতদাসের নেতৃত্বের প্রতি দেখানোর আদেশ দিয়েছে।আল্লাহর রাসুল ও ইসলামী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠতম নেতার প্রতি আনুগত্যহীনতা দেখিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের এই ব্যর্থ চেষ্টার মতো আত্মপ্রবঞ্চণা আর কী হতে পারে এবং মানুষ নিজের ধ্বংসের জন্য এর চেয়ে ভয়াবহ আর কী উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যে সাফল্যকে তারা আল্লাহর দান বলে স্বীকার করতো সেটা কৃতজ্ঞতা ও নিয়ামাতের স্বীকৃতির কারণে নয় বরং এর দ্বারা তারা এ কথা বুঝাতো যে পরিস্থিতির কারণে সময়ে সময়ে যে ভালো দিক ফুটে উঠে এবং যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে সময়ে সময়ে যে সুফল পাওয়া যায় তাতে রসুল সা. এর অন্তদৃষ্টি ও বিচক্ষণতার কোন হাত নেই বরং ওগুলো আল্লাহর সৃষ্টি করা কাকতালীয় ঘটনামাত্র। [সুরা নিসার সংশ্লিষ্ট আয়াতে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাফসীর মুযিহুল কুরআনেও একই কথা বলা হয়েছে।যুদ্ধের কৌশল নির্ভুল প্রমানিত হলে এবং বিজয় অর্জিত হলে মুনাফিকেরা বলতো, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘটনা ক্রমে ঘটে গেছে।রসুল সা. এর রণ নৈপূণ্যের স্বীকৃতি দিতো না।আর যদি পরাজয় ঘটতো তাহলে রসুল সা. এর অদক্ষতাকেই দায়ী করতো।]
প্রত্যেক কষ্টের সময় আন্দোলনের ভেতরেই সমালোচনা, উপহাস তাচ্ছিল্য প্রকাশকারী তথাকথিত সহচর উপস্থিত থাকায় ইসলামী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতাকে কী ধরনের মর্মপীড়া ভোগ করতে হতো তা সহজেই বোধগম্য।কথায় কথায় তারা বলতো, এই নেতার কারনেই এখন অমুক মুসিবতটা দেখা দিলো, অমুক আঘাতটা খেতে হলো এবং ওদিক থেকে বিপর্যয় টা নেমে এলো ইত্যাদি।প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ফল জানার পর তারা বিজ্ঞজনের মতো বসে পড়তো আর মন্তব্য করতো, অমুক কাজটা না করা উচিত ছিলো, অমুক কাজটা করলে ভালো হতো ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই হীন মানসিকতা ছাড়াও তারা প্রত্যেক যুদ্ধ বিগ্রহের প্রাক্কালে নানারকম প্রলাপোক্তি করতো, যেমন, আমাদের আশঙ্কা, কখন না জানি আমরাও কোন বিপর্যয়ের কবলে পড়ে যাই” (মায়িদাহ ৫২)।অর্থাৎ কিনা আন্দোলনটাকে এমন অদক্ষভাবে চালানো হচ্ছে যে, যেকোন সময় তা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে যেতে পারে।আমরা কেনো অনর্থক জীবনের ঝুকি নিতে যাবো?
ওহুদ যুদ্ধের সময় এই মানসিকতার কারনেই মুনাফিকরা আক্ষেপ করেছিলো যে, নেতৃত্বে যদি আমাদের কোন হাত থাকতো তাহলে আমরা এখানে মরতাম না” (আল ইমরান, আয়াত ১৫৪, তাহফীমুল কুরআনে দেখুন) এ মানসিকতার ধারকরা রসূল সা. এর নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতার সুস্পষ্ট অনাস্থা পোষণ করতো।তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমান মনে করতো।আর যে ব্যক্তি এত বছর ধরে ওহির দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আন্দোলন করে আসছেন, তিনি নবী হলেও তাদের দৃষ্টিতে কিছুই ছিলেন না।নবীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব নিয়েও যখন এত অস্বস্তি, তবে কোন সাহাবীর নেতৃত্ব হলে একচেটিয়া দক্ষতা ও বিচক্ষণতার দাবীদার এই গোষ্ঠীটি তার কী দশা করতো, তা আল্লাহই ভালো জানেন।
এই সব উদাহরণ থেকে বুঝা যায় যে, সরাসরি ইসলামী আন্দোলনের বিরোধীতা করার পরিবর্তে রসূল সা. এর ব্যক্তিত্বকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে পরোক্ষ হামলা করাকেই সবচেয়ে সাফল্যজনক পন্থা মনে করা হয়েছিল এবং সেটাই অবলম্বন করা হয়েছিল।গোপন সলাপরামর্শের বৈঠকগুলোতে আন্দোলনের এই সবোচ্চ নেতার বিরুদ্ধেই যত আপত্তি ও অপপ্রচার খসড়া তৈরী করা হতো এবং তার অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ করার জন্যই নিত্য নতুন পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করা হতো।