রসূল সা. এর তীরোধানের পর
এ পর্যন্ত আমরা রসূল সা. এর পরিচালিত আন্দোলনের ফলাফল তুলে ধরলাম। এর পর বেশী দিন অতিবাহিত না হতেই তিনি ইন্তিকাল করেন। কিন্তু তাঁর প্রশিক্ষিত ও প্রতিপালিত মুসলমানরা এ কাজ অব্যাহত রাখে এবং ইসলামী আন্দোলন দশ পনেরো বছরের মধ্যেই বিশাল এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
বিদায়ী হজ্জে রসূল সা. যেভাবে অংশগ্রহণ করেন, যেভাবে তিনি আপন সাথীদের সম্বোধন করেন এবং যে ভাষায় তিনি ওসিয়ত করেন ও আবেদন জানান, তা থেকে বুঝা যাচ্ছিল যে, রসূল সা. সামষ্টিকভাবে সকলকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন। প্রত্যাবর্তনকালে ‘গাদীরে খুম’ নামক পুস্করিনীর পাশে যাত্রা বিরতির সময় বিশিষ্ট সাথীদের উদ্দেশ্যে তিনি আরো একটা ভাষণ দেন। এ ভাষণে বিদায়ের মনোভাব আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার ভাষাও ছিল এমন যে, শোনলে কান্না এসে যায়। প্রথমে চিরাচরিত রীতি অনুসারে আল্লাহর প্রশংসা করেন। তারপর বলেনঃ
“হে জনমন্ডলী, আমি একজন মানুষ। হয়তো খুব শীগগীরই আমার কাছে আল্লাহর আহ্বায়ক এসে যাবে এবং তার ডাকে সাড়া দেব। আমি দুটো দায়িত্বের বোঝা তোমাদের কাছে রেখে যাচ্ছি। তার একটা আল্লাহর কিতাব। এতে রয়েছে সঠিক পথের নির্দেশনা, আলো ও হিকমত। এরপর কোরআন সম্পর্কে উদ্দীপনা ও সতর্কতামূলক বেশ কিছু কথা বলেন। তারপর বলেন, দ্বিতীয় বোঝাটি হলো, আমার পরিবারের লোকেরা। আমার পরিবারের লোকদের সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করার আহ্বান জানাই।”
নবীগণকে অতিমানব ও অমানব আখ্যায়িত করে যারা নানা ধরনের গোমরাহীর পথ উন্মুক্ত করেছিল, তাদের সেই সব গোমরাহী দূর করার জন্য তিনি নিজেকে মানুষ বলে আখ্যায়িত করেন। যে নবীগণ শেরকের মূল্যোৎপাটন ও আল্লাহর একত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেন, অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস যে, অতিরঞ্জকরা সেই নবীদেরকেই আল্লাহর সন্তান আখ্যায়িত করে তাদেরকে আল্লাহর অংশ ও চিরঞ্জীব সত্তা বলে গণ্য করেছে। রসূল সা. নিজের বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসার আগে নিজের সাথীদেরকে এই বলে সতর্ক করেন যে, আমি মানুষ। তাই অন্যান্য মানুষের মত আমার ওপরও আল্লাহর আইন চালু হবে। তারপর তিনি তাদেরকে কঠোরভাবে কোরআন অনুসরণের নির্দেশ দেন এবং এটাকে একটা দায়িত্বের বোঝা বলে অভিহিত করেন। কেননা রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়গণ তাঁর জীবনের প্রতক্ষ্যদর্শী এবং তাঁর মূল্যবান শিক্ষাসমূহের আমানতদার। এ দিক থেকে তারা উম্মতের জন্য ইসলামী শিক্ষার উৎস। অপর দিকে তাদের জন্য তিনি কোন ধন সম্পদ রেখে যাননি এবং তাদের ভবিষ্যতকে আল্লাহর হাত সোপর্দ করে গেছেন। তাই এটা সুস্পষ্ট যে, রসূল সা. এর পর তাদের ব্যাপারে মুসলমানদের ওপর বিরাট গুরুদায়িত্ব বর্তে। কিন্তু তীব্র আত্মমর্যাদাবোধের কারণে তিনি এ বিষয়ে কোন স্পষ্টোক্তি না করে ইংগিতের মধ্যেই সীমিত রেখেছেন।
এই ভাষণেই অথবা পরবর্তী অন্য কোন ভাষণে রসূল সা. সাধারণ মুসলমান ও সাহাবায়ে কেরামকে আরো একটা কথা একটা অসাধারণ প্রয়োজনের আলোকে বলেছিলেন। ব্যাপারটা ছিল এই যে, হযরত আলীর সাথে যে ক’জন সাহাবীকে ইয়ামানে পাঠানো হয়েছিল, তাদের কোন ব্যাপারে হযরত আলীর সাথে কিছুটা মতভেদের সৃষ্টি হয়ে যায়। আসলে বড় বড় কাজের সময় কখনো কখনো এমন কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, মেজাজের পার্থক্যের সাথে সাথে মতেরও অমিল ঘটে যায়। কখনো কখনো তিক্ত বা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের দরুন অন্তরে অস্থায়ীভাবে হলেও ক্ষোভ বা অসন্তোষ দানা বাধে। মানুষের দ্বারা তৈরী সংগঠন, চাই তা খালেছ ইসলামী কাজের জন্যই সংগঠিত হোক কিংবা তার নেতৃত্বে নবীদের ন্যায় নিষ্কলঙ্ক মানুষই বহাল থাকুক, মানুষের যাবতীয় স্বভাবসুলভ দুর্বলতা থেকে মুক্ত থাকবে- এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। মতপার্থক্য ও আবেগের সংঘাত একটা আপাদমস্তক সৎ,s সত্য নিষ্ঠ, নির্মল ও নিখুঁত সমাজেও দেখা দিতে পারে। এ জন্য বড় বড় কাজ সম্পাদনের জন্য সেই সব মহানুভব, সহিষ্ণু, ধৈর্যশীল ও উদার লোকদের প্রয়োজন, যারা মতবিরোধ দেখা দেয়া সত্ত্বেও খাপ খাইয়ে চলতে পারে। সাহাবায়ে কেরামের সংগঠনেও কখনো কখনো বিরোধ দেখা দিত। কিন্তু তাদের অসাধারণ সহনশীলতার কারণেই এই বিরোধ সত্ত্বেও সহযোগিতা অব্যাহত থাকতো। তিক্ততা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হলেও তা হতো সাময়িক। এ ক্ষেত্রেও এ ধরনেরই একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষত হযরত বারীদার মনে বিরোধের প্র্রভাব এত তীব্র হয়ে উঠেছিল যে, তিনি রসূল সা. এর কাছে হযরত আলীর বিরুদ্ধে নালিশ করে দিলেন। কিন্তু হযরত আলীর ন্যায় প্রথম শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অভিযোগ সৃষ্টি হওয়া, তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া, ব্যক্তিগত মনোকষ্টের রূপ নেয়া এবং তারপর রসূল সা. এর কাছে অভিযোগ আকারে উপস্থাপিত হওয়া কিছুটা জটিল ব্যাপারই ছিল। অভিযোগটা শুনে রসূল সা. ব্যথিত হন এবং চেহারার রং পাল্টে যায়। এই প্রেক্ষাপটে তিনি তার চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে কারো নাম উল্লেখ না করেই বললেন, “আমি যার বন্ধু, আলীও তার বন্ধু। হে আল্লাহ, যে আলীর সাথে বন্ধুত্ব রাখে, তুমিও তার সাথে বন্ধুত্ব রাখ। আর যে আলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করে, তার সাথে তুমিও শত্রুতা পোষণ কর।”
এ কথা সবার জানা যে, যে আন্দোলনে রসূল সা. যথা সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিলেন, হযরত আলীও তাতে সর্বস্ব উৎসর্গ করে রেখেছিলেন। একই দাওয়াতের আহ্বায়ক, একই মিশনের পতাকাবাহী, একই চিন্তাধারার অনুসারী এবং একই পথের পথিক, উপরন্তু এত ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যে, উভয়ের মধ্যে বিন্দুমাত্রও ব্যবধান সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এমন দু’জনের একজনকে ভালোবাসা ও অপর জনের প্রতি বিক্ষুদ্ধ থাকা কিভাবে সম্ভব? রসূল সা. ও তার ঘনিষ্ঠতম সাহাবীদের মধ্যে এ ধরনের সম্পর্কই ছিল। আকীদা, আদর্শ ও লক্ষ্যের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে গোটা সংগঠন গভীরভাবে আবদ্ধ ছিল। বিশেষত এর প্রথম কাতারের ব্যক্তিবর্গ, যাদেরকে রসূল সা. বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ভেদাভেদ করে কাউকে ভালোবাসা ও কারো প্রতি মনোকষ্ট পোষণ করার কোন সুযোগই ছিলনা। রসূল সা. কষ্ট পেয়েছিলেন এজন্য যে, যে দলকে তিনি বছরের পর বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তার মধ্যে যদি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এত দুর্বল হয়ে থাকে, তার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের প্রতি অসন্তোষ ও ক্ষোভ পোষণ করা হয় এবং মতেভেদের কারণে ব্যক্তিগত দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, তা হলে এই বিশাল লক্ষ্য নিয়ে মুসলমানরা সামনে অগ্রসর হবে কি করে?
এ সময় রসূল সা. দেখতে পাচ্ছিলেন নিজের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছে। তিনি এই চিন্তায়ই মগ্ন ছিলেন যে, এখন সমস্ত দায়িত্বের বোঝা এই সংগঠনের কাঁধের ওপরই অর্পিত হতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে মুসলমানদেরকে রসূল সা. এর পরিবর্তে নেতৃত্বের এই সারির পেছনেই চলতে হবে, যার ভেতরে রসূল সা. নিজের বিশ্বস্ততম সাথীদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং যার প্রতিটি ব্যক্তিকে তিনি গভীরভাবে ভালোবাসেন। এ কারণে তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় সতর্ক করার উদ্দেশ্যে ঐ কথাটা বলেছিলেন। আশ্চর্যর বিষয় যে, কিছু লোক ঐ উক্তির ভেতর থেকেই রসূলের সা. পরবর্তী খলিফা নিয়োগের দর্শন খুঁজে বের করেছে। এটা কিভাবে বের করা হলো, তা আমার বুঝে আসেনা।
এ আলোচনাটা এসে গেল নিতান্তই আনুসংগিকভাবে। নচেত আমাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল এই বিষয়টা ফুটিয়ে তোলা যে, সমগ্র বিদায় হজ্বের সফরকালেই রসূল সা. অনুভব করছিলেন যে, এখন তাঁর পরকালের সফর আসন্ন প্রায়। এই অনুভূতির আলোকেই তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ ও ওসিয়ত করতে থাকেন।
একাদশ হিজরীর সফর মাসের শুরু থেকেই রসূল সা. এর পবিত্র আত্মা আখেরাতের সফরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। একদিন তিনি ওহুদে চলে গেলেন এবং ওহুদের শহীদদের জন্য সিজদায় গিয়ে দোয়া করলেন। ফিরে এসে পুনরায় নিন্মোক্ত ভাষণ দেনঃ
“হে জনমন্ডলী, আমি তোমাদের আগেই বিদায় নিয়ে যাবো এবং আল্লাহর কাছে তোমাদের সম্পর্কে সাক্ষ্য দেব। আল্লাহর কসম, আমি এখানে বসেই হাউজে কাউসার দেখতে পাচ্ছি, আমাকে বিভিন্ন সাম্রাজ্য জয়ের চাবিকাঠি দেয়া হয়েছে। (অর্থাৎ দাওয়াতের ফলে বিভিন্ন রাজ্য বিজিত হবে।) আমি এ আশংকা করিনা যে, তোমরা আমার পর মোশরেক হয়ে যাবে। আমার আশংকা শুধু এই যে, তোমরা পার্থিব স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংঘাতে পড়ে যাবে।”
তারপর মধ্যরাতে বাকী’র গোরস্থানে গিয়ে কবরবাসীর জন্য মাগফেরাত কামনা করেন এবং বলেন, “আমিও শীগগীরই তোমাদের সাথে এসে মিলিত হব।” তারপর একদিন বিশেষভাবে বিশিষ্ট সাথীদেরকে জমায়েত করে নিম্নরূপ ভাষণ দিলেনঃ
“হে মুসলমানগণ! তোমাদের অভিনন্দন! আল্লাহ তোমাদের আপন করুণায় অীভিষিক্ত করে রাখুন। তিনি তোমাদের মনের কষ্ট দূর করে দিন। তোমাদেরকে জীবিকা দিন। তোমাদেরকে সাহয্য করুন। তোমাদেরকে উন্নতি দিন। তোমাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা দিন। আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করার নির্দেশ দিচ্ছি, তোমাদেরকে আল্লাহরই তত্ত্বাবধানে সোপর্দ করছি এবং তোমাদেরকে তাঁর সম্পর্কে সতর্ক হবার আহ্বান জানাই। কেননা আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী। দেখ, আল্লাহর জনপদগুলোতে তাঁর বান্দাদের মধ্যে অহংকার ও দাম্ভিকতার আচরণ করোনা। আল্লাহ তায়ালা আমাকে ও তোমাদেরকে বলেছেনঃ “আখেরাতের সেই গৃহ আমি ঐ সব লোকের জন্যই নির্দিষ্ট করেছি, যারা পৃথিবীতে অহংকার ও অরাজকতা ছড়াবার ইচ্ছা পোষণ করেনা। আর পরকালের সাফল্য তো মুত্তাকীদের জন্যই।” তোমাদের সকলের ওপর এবং ইসলাম গ্রহণ পূর্বক আমার বায়রাতে অন্তর্ভুক্ত লোকদের সকলের ওপর সালাম বর্ষিত হোক।”
বাকী’র কবরস্থান থেকে ফিরে আসার পর মাথায় হালকা ব্যথা শুরু হলো। ২৯শে সফর এক মৃত ব্যক্তির জানাযায় যাওয়া আসা করায় মাথা ব্যথা বেড়ে গেল। রোগের প্রাথমিক হাল্কা অবস্থায় এগারো দিন পর্যন্ত মসজিদে নববীতে এসে নিজেই নামাযের ইমামতি করতে লাগলেন। রোগ বৃদ্ধির ফলে ঘরের মধ্যে বিছানায় শুয়ে থাকেন এক সপ্তাহ। এরপর রোগ আরো বৃদ্ধি পেলে অন্য সকল স্ত্রীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে হযরত আয়েশার কক্ষে চলে আসেন।
রোগের দরুন তিল তিল করে মৃত্যু পথে এগিয়ে যাচ্ছিলেন- এরূপ অবস্থায়ও ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বের কথা তিনি ভোলেননি। তবুক ও মুতার যুদ্ধের উদ্দেশ্যে তখনো সফল হতে বাকী। সামান্য শৈথিল্য দেখালেই শত্রুরা আসকারা পেয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। তাই এই পরিস্থিতিতেই ২৬শে সফর মুসলমানদেরকে রোম অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। পরের দিন হযরত উসামা ইবনে যায়েদকে এই অভিযানের সেনাপতি মনোনীত করলেন। তাকে বললেন, “যাও, আল্লাহর নাম নিয়ে তোমার পিতার শাহাদাতের স্থানে পৌঁছে যাও এবং আল্লাহকে যারা অমান্য করে তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা কর। তিনি নিজ হাতে পতাকা তৈরী করে হযরত বারীদা বিন খুসাইব আসলামীর হাতে দিলেন। একেতো অল্প বয়স্ক, তদুপরি রসূল সা. এর মুক্ত গোলাম ও পালিত পুত্র যায়েদের ছেলে হওয়ার কারণে হযরত উসামার নিযুক্তি নিয়ে কেউ কেউ কানাঘুষা করতে লাগলো যে, বড় বড় আনসার ও মোহাজের থাকতে এই কিশোরকে কেন সেনাপতি নিয়োগ করা হলো। বিষয়টি রসূল সা. এর কানে গেলে তিনি নিদারুণভাবে মর্মাহত হলেন এবং প্রবল কষ্ট সত্ত্বেও মাথায় পট্টি বেঁধে মসজিদে উপস্থিত হলেন। তারপর গাদীরে খুমের অনুরূপ ভাষণ দিলেন, তিনি বললেনঃ
“আমি শুনতে পেয়েছি, তোমরা উসামা সম্পর্কে নানা কথা বলেছ। ইতিপূর্বে তার বাবাকে সেনাপতি নিয়োগ করা সম্পর্কেও তোমরা আপত্তি তুলেছিলে। অথচ আল্লহর কসম, সে তার যোগ্য ছিল। তারপর তার ছেলেও এ কাজের যোগ্য। যায়েদ বিন হারেসাও আমাদের কাছে সবার চেয়ে প্রিয় ছিল। আর তার ছেলে উসামাও আমাদের কাছে এখন সবার চেয়ে প্রিয়।”
ইতিপূর্বে (ইন্তিকালের পাঁচ দিন আগে) মাথায় সাত মশক পানি দিয়ে গোসল করেছেন। এই গোছলে শরীরটা একটু হালকা হলে তাঁকে ধরাধরি করে মসজিদে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে তিনি সাহাবীদের সমাবেশে সর্বশেষ ভাষণ দিলেন। বললেনঃ
“তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা নবীদের ও পুন্যবান লোকদের কবরকে পূজা করতো। তোমরা এরূপ করোনা। আমার তীরধানের পর আমার কবরকে পূজার জায়গায় পরিণত করোনা। যারা নবীদের কবর পূজা করবে, তাদের ওপর আল্লাহর মারাত্মক গযব নেমে আসা অবধারিত। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি। আমি তোমাদের কাছে সত্য বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছি। হে আল্লাহ! তুমি স্বয়ং এর সাক্ষী।”
তারপর নামায পড়ালেন এবং নামাযের পর আবার বললেনঃ
“আমি তোমাদেরকে আনসারদের সম্পর্কে সাবধান করছি। তারা ছিল আমার দেহের পোশাক এবং আমার পথের সম্বল। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। এখন তোমাদের ওপর তাদের অধিকার দেয়া বাকী রয়েছে। অন্যেরা উন্নতি লাভ করবে। কিন্তু আনসাররা যেখানে ছিল, সেখানেই থেকে যাবে। আনসারদের মধ্যে যারা সৎ ও যোগ্য তাদের কদর দিও। আর যারা ভুল করে, তাদেরকে ক্ষমা করে দিও। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাকে এখতিয়ার দিয়েছিলেন যে, সে ইচ্ছা করলে দুনিয়া ও তার চিত্তবৈভব গ্রহণ করতে পারে, অথবা আল্লাহর কাছে তার জন্য যা কিছু আছে তা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বান্দা আল্লাহর কাছে তার জন্য নির্ধারিত যা ছিল তাই গ্রহণ করে নিল।”
রুগ্নাবস্থায় রসূল সা. যা কিছুই বলতেন, তাতেই সাধারণভাবে বিদায়ী মনোভাব প্রকাশ পেত। কিন্তু উপরোক্ত ভাষণের শেষ বাক্য কয়টিতে খুবই স্পষ্ট ইংগিত ছিল। হযরত আবু বকর রা. এটা তৎক্ষণাত বুঝে ফেললেন এবং অধীরভাবে কাঁদতে লাগলেন।
এক পর্যায়ে তিনি নামাযের জামায়াতে হাজির হতেও অক্ষম হয়ে পড়লেন। তখন তিনি হযরত আবু বকর রা. কে নিজের জায়গায় ইমামতি করার নির্দেশ দিলেন। রোগ ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে গেল। লোকেরা উৎকন্ঠিত হয়ে বারবার মসজিদে নববীর চারপাশে চক্কর দিতে থাকলে রসূল সা. হযরত আলী রা. ও হযরত ফযল বিন আব্বাসের কাঁধে ভর দিয়ে মসজিদে এলেন এবং মিম্বরের সর্বনিম্ন ধাপে বসে একেবারেই সর্বশেষ ভাষণটি দিলেন এভাবেঃ
“হে জনমন্ডলী, জানতে পারলাম যে তোমরা আমার মৃত্যুর ভয়ে ভীত। পৃথিবীতে যত নবী এসেছেন, তাদের কেউ কি চিরজীবী হয়েছেন? আল্লাহর কাছে আমাকেও যেতে হবে, তোমাদেরকেও যেতে হবে। আমি ওসিয়ত করছি, প্রথম যারা হিজরত করেছে, তাদের সাথে সদাচরণ কর এবং মোহাজেররাও যেন পরস্পরের সাথে সদাচরণ করে।” এরপর সূরা আল আসর পড়লেন এবং বললেনঃ “সব কাজ আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে চলে। যে কাজে বিলম্ব প্রয়োজন, তাতে তাড়াহুড়ো করোনা। কেউ তাড়াহুড়ো পছন্দ করলেই আল্লাহ তাড়াহুড়ো করেননা। আমি ওসিয়ত করছি যে, আনসারদের সাথে ভালো ব্যবহার কর। তারা তোমাদের আগেই মদিনাকে নিজেদের মাতৃভূমি পরিণত করেছে এবং ঈমান আনাকে নিজেদের দায়িত্ব গণ্য করেছে। তারা কি তোমাদেরকে তাদের ফসলে শরীক করেনি? তারা কি তোমাদেরকে জায়গা দেয়ার জন্য নিজেদের বাড়ীকে প্রশস্ত করেনি? তারা কি নিজেদের প্রয়োজন উপেক্ষা করেও তোমাদেরকে অগ্রাকিার দিওনা। আমি আগে চলে যাবো। তোমরা পরে এসে আমার সাথে মিলিত হবে। হাউজে কাওসারে সাক্ষাতের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”
এই ভাষণগুলোকে বিভিন্ন বর্ণনার বিভিন্ন সময়ের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। কিন্তু একটি মত এই যে, এই সব বক্তব্য একই ভাষণের অংশ। সম্ভবত এই মতটিই সঠিক।
সোমবার দিন [ইন্তিকালের তারিখ নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। কোন রেওয়ায়েতে ১লা,কোন রেওয়ায়েতে ২রা, কোন রেওয়ায়েতে ১২ এবং কোন রেওয়ায়েতে ১৩ ই রবিউল আউয়াল উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ তারিখ হচ্ছে ১২ই রবিউল আউয়াল] রসূল সা. এর স্বাস্থ্য শেষ বারের মত একটু স্বাভাবিক হলো। তিনি মেসওয়াক করলেন। পর্দা তুলে সমবেত সাহাবাদেরকে এক নজর দেখলেন এবং মুচকি হাসলেন। এর কয়েক মুহুর্ত পরই তিনবার বললেনঃ
(**********)
সেই সাথে হযরত আয়েশার কোলে মাথা রেখে মহান আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
আজ সেই মহান সত্তা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন, যিনি মানব জাতিকে নব জীবন দান করেছিলেন এবং যিনি মানব জাতির কাফেলাকে দস্যুদের কবলমুক্ত করে সঠিক পথে বহাল রাখার জন্য ভয়াবহ কষ্ট সহ্য করেছিলেন অথচ দুনিয়ার জীবনে তার কোন বদলা নেননি।
রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠতম ও সারা জীবনের সাথীদের জন্য এই মর্মান্তিক ঘটনা কতদূর শোকাবহ ছিল, তা কল্পনা করাও দুসাধ্য। যারা রসূল সা. কে এক নজর দেখেও নতুন শক্তি ও প্রেরণা লাভ করতেন, তাদের চোখে আকাশ পৃথিবী নিশ্চয়ই ঘুরপাক খেয়েছিল। তাদের কাছে হয়তো মনে হয়েছিল সমগ্র মানবেতিহাস ওলট পালট হয়ে গেছে। হযরত ওসমান রা. নির্বাক এবং হযরত আলী নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। হযরত ওমর মস্তিস্কের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। আর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইস তো শোকাহত হয়ে মারাই গেলেন।
এই ভয়াবহ বিয়োগান্ত ঘটনা এমনিতেও ছিল এক শোকের পাহাড়। তদুপরি এটি সংঘটিত হলো এক চরম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে। একদিকে রোম সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে আগ্রাসনের আশংকা বিরাজ করছিল এবং সে জন্যই উসামার বাহিনী রওনা হচ্ছিল। অপরদিকে ইসলাম ত্যাগ ও যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতির হিড়িক চলছিল। তৃতীয় দিকে ইসলামী আন্দোলন পার্শবর্তী রাজ্যগুলোকে দাওয়াত দেয়ার সাথে সাথে খানিকটা হুমকিও দিয়ে রেখেছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এ সমস্যাও ছিল যে, মোনাফেকির অবদমিত সমস্যাটা পুনরায় মাথা চাড়া দেয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু রসূল সা. এমন সুষ্ঠ ও নিখুঁতভাবে মুসলমানদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন যে, তারা অবিলম্বেই নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রিত ও অশান্ত মনকে শান্ত করে ফেললো। হতাশা ও অস্থিরতাকে কাটিয়ে বিদায় করে নিজেদের গুরুদায়িত্ব পালনের চিন্তায় মনোনিবেশ করলো। রসূল সা. এর ন্যায় ব্যক্তির ইন্তিকালে শোক পালন করার চাইতে অনেক বেশী গুরু দায়িত্ব তাঁর অনুসারীদের জন্য এই ছিল যে, তারা এই আন্দোলন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থীতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে, যা এরূপ পরিস্থিতিতে সামান্য শৈথিল্য দেখালেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। যে ব্যক্তি বহু বছর যাবত সমগ্র আন্দোলনের প্রাণশক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন এবং সকল সাহাবীর পরিপূর্ণ আস্থা ও গভীর ভালোবাসার পাত্র ছিলেন, তাঁর আকস্মিক তীরোধানে সহসাই অত্যন্ত মারাত্মক শূন্যতার সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। এই শূণ্যতাকে যথাসময়ে পূরণ না করলে ভয়াবহ পরিণতি দেখা দিতে পারে। রসূল সা. এর হাতে গড়া মুসলিম সংগঠনটি নিজেদের দায়িত্ব সচেতনতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার নজীরবিহীন প্রমাণ এভাবে দিল যে, তৎক্ষণাত এই শূন্যতাকে পূরণ করে ফেললো এবং শৃংখলার বন্ধনকে মোটেই শিথিল হতে দিলনা। রসূল সা. এর স্থলাভিষিক্ত কে হবে, তা নিয়ে কোন দ্বন্দ্বসংঘাত হলোনা, তলোয়ার চালাচালিও হলোনা, কোন হৈ হাঙ্গামা হলোনা, সাকীফায়ে বনু সায়েদা চত্তরে মুসলিম জামায়াতের প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ পরামর্শের জন্য বসলেন এবং সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর ইসলামের শুরায়ী তথা পরামর্শ ভিত্তিক গণতন্ত্রের আওতায় হযরত আবু বকর সিদ্দিককে প্রথম খলিফা নির্বাচন করা হলো। পরে মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত মুসলমানদের সাধারণ সমাবেশে সর্বসম্মতভাবে ঐ ফায়সালাকে অনুমোদন করা হলো।
রসূল সা. এর ইন্তিকালের পর রসূলের মহান দাওয়াতী কাজের প্রসার ঘটানো এবং রসূলের সূচিত অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করতে যে দৃঢ়তা অন্তর্দৃষ্টি ও দক্ষতার পরিচয় হযরত আবু বকর দেন এবং যেভাবে হযরত ওমর, ওসমান, আলী ও নেতৃস্থানীয় অন্যান্য সাহাবীগণ তাঁর সহযোগিতা করেন, মানবেতিহাসে তার উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যাবে। রসূল সা. এর হাতে গড়া এই মানুষটি প্রমাণ করে দিলেন যে, তিনিই মনু্ষ্যত্বের শ্রেষ্ঠতম নমুনা। নিঃস্বার্থ, সুদক্ষ ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হওয়ার দিক দিয়ে তার কোন জুড়ি ছিলনা। কঠিনতম পরিস্থিতিতেও তিনি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলতেন না।
ইতিহাস সাক্ষী যে রসূল সা. এর তৈরী করা এই দল ও তার নেতারা কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামী আন্দোলনকে দুনিয়ার কোণে কোণে পৌঁছে দেন এবং রসূল সা. এর জীবদ্দশায় ও তার পরে এই কাজের গতিতে তেমন কোন পার্থক্য দেখা যায়নি।
হে আল্লাহ, মুহাম্মদের ওপর দরূদ ও সালাম পাঠাও!
পৃথিবীতে আজ যদি মুসলমানদের অস্তিত্ব বজায় থেকে থাকে, তবে তা এই মহান ব্যক্তিত্বের অক্লান্ত পরিশ্রমেরই ফল। সত্য ও ন্যায়ের বাণী যদি আমাদের মনমগজে সক্রিয় হয়ে থাকে, তবে তা এই পবিত্র সত্তার পরিশ্রমেরই ফল। মানব জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য তাঁর কাছে যদি কোন আদর্শ ও কর্মসূচী থেকে থাকে, তাহলে তা মুহাম্মদ সা. এরই সাধনা ও সংগ্রামেরই সুফল। আজ যদি আমাদের বুকে ইসলামী আন্দোলন পুনরুজ্জীবনের আকাংখা দানা বাঁধে, তবে এই প্রিয় নবীর ত্যাগ তিতীক্ষার পবিত্র স্মৃতির কল্যাণেই দানা বাঁধবে। ইসলামী আন্দোলনের পদ্ধতি ও মহান আল্লাহর প্রেরিত এই পথ প্রদর্শকের বাস্তব প্রশিক্ষণ থেকেই তা জানা সম্ভব। মানব জাতিকে আজ যদি কেউ নৈতিক মূল্যবোধ এবং সাফল্যের শাশ্বত মূলনীতি শিখাতে চায়, তবে সেটা স্বয়ং মুহাম্মদ সা. এর কাছ থেকেই অর্জন করতে হবে। রসূল সা. এর মত দাওয়াত দাতা, শিক্ষক, প্রশিক্ষক এবং নেতা যদি দুনিয়ায় না আসতো, তাহলে এই মুর্খতা ও অজ্ঞানতার ঘোর তমস্যা থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করা সম্ভব হতোনা। তাই বলা যায়, রসূলই সা. ছিলেন সমগ্র ইসলামী বিপ্লবের মূল প্রাণশক্তি।
মহানবী সা. আমাদের ও সমগ্র মানব জাতির কল্যাণার্থে নিজেকে যে ভয়ংকর শত্রুতার লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেন এবং বাতিলের সাথে লড়াই করতে গিয়ে যে প্রাণান্তকর কষ্ট সহ্য করেছেন এবং কোন বিনিময় গ্রহণ ছাড়াই নিজের যথাসর্বস্ব এই পথে বিলিয়ে দিয়েছেন, অতঃপর ইতিহাসের একটা নয়া যুগ, একটা পবিত্র সভ্যতা, ও একটা বিশাল আন্তর্জাতিক জাতি বা উম্মাত সৃষ্টি করেছেন এবং জ্ঞানবিজ্ঞান ও চিন্তার নিত্যনতুন জগত গড়ে তুলেছেন, সেই অসামান্য ও অসাধারণ কীর্তির জন্য আমাদের সমগ্র বিশ্ব মানবতা তার এই মহান বন্ধু ও অনুগ্রাহকের কাছে ঋণী। এত বড় উপকারের বিন্দুমাত্রও বিনিময় দান করতে আমরা অক্ষম। তাই হে মহান আল্লাহ! আমরা তোমারই কাছে আবেদন জানাই, তুমি আমাদের কৃতজ্ঞতার মনোভাবকে কবুল কর এবং তোমার রহমতের সীমাহীন ভান্ডার থেকে আমাদের পক্ষ থেকে এই অসামান্য অবদানের উপযুক্ত বদলা তাঁকে দান কর। রসূল সা. এর আত্মার ওপর রহমত, বরকত, ও শান্তি নাযিল কর, তাঁর মর্যাদা সমুন্নত কর এবং রসূল সা. এর দাওয়াত ও আন্দোলনকে পুনরায় বিজয় দান কর, বিস্তৃতি দান কর এবং তোমরা আরো অধিক সংখ্যক বান্দাকে ইসলামী বিধানের কল্যাণ ও সুফল দ্বারা উপকৃত ও সমৃদ্ধ কর। তোমার কাছে এই মিনতিও জানাই যে, লেখককে এবং প্রত্যেক মুসলিম বান্দাকে রসূল সা. এর দাওয়াতের পবিত্র আমানত বহন করার তৌফিক দান কর এবং তাকে সমগ্র মানব জাতির নিকট পৌঁছানোর সৌভাগ্য দান কর। রসূল সা. এর চালু করা ইসলামী আন্দোলনকে আরো একবার জীবন্ত ও বাস্তব সত্যে পরিণত কর। রাসূল সা. এর উপস্থাপিত ন্যায় বিচার ব্যবস্থাকে পৃথিবীতে বাস্তবায়িত করার মাধ্যমে রসূল সা. এর আরদ্ধ কাজ সম্পূর্ণ করার সংগ্রামে যথোপযুক্ত ভূমিকা পালনের সৌভাগ্য আমাদের সবাইকে দান কর। কেননা তাঁর উপকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এটাই সর্বোত্তম পন্থা।
(*******)
কাজ এখনো অসম্পূর্ণ
এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ যে, তিনি আমার মত নগন্য বান্দাকে এই মহান কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন যে, আমি তাঁর এই শ্রেষ্ঠতম বান্দার জীবনী ও জীবনের কীর্তি সমূহের একটা ঝলক পেশ করতে পেরেছি। এই কাজে আমি আমার সেই সুযোগ্য পূর্বসূরীদের কাছে অত্যধিক ঋণী, যারা এ বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থাবলী লিখে গেছেন। এছাড়া এ যুগের দু’জন গবেষক মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী এবং ডক্টর হামীদুল্লাহ সিদ্দীকী এম, এ, পি, এইচ,ডি’র কাছে আমি অত্যধিক ঋণী। এ দু’জনের কাছ থেকেই আমি এমন আন্দোলনমুখী দৃষ্টিভঙ্গী পেয়েছি, যা নবী জীবনীর অনেক নতুন দিক আমার সামনে উন্মোচিত করেছে। আমি আশা করি, এ পুস্তক পড়তে গিয়ে পাঠক কিছু নতুন চিন্তার খোরাক পাবেন। আমি এই কাজে বিশেষভাবে প্রেরণা ও উৎসাহ যোগানোর জন্য শ্রদ্ধেয় প্রকাশকের কাছেও কৃতজ্ঞ। আল্লাহ এই প্রেরণা ও উদ্দীপনা সঞ্চারকারী বন্ধুদেরকে সকলকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করুন।
এ যাবত এ কাজটি যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে চলে এসেছে, তা বড়ই শোচনীয়। কতবার কাজ হাতে নিয়েছি, আবার দীর্ঘ বিরতি পথে বাধার সৃষ্টি করেছে। অনেক সময় মাসের পর মাস এক অক্ষরও লেখা হয়নি। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তি যে আমাকে বারবার শক্তি ও উৎসাহ যুগিয়েছে। একদিন সহসা মাথায় এই খেয়াল এল, সম্ভবত এটাই আল্লাহর ইচ্ছা যে, যে মহান সত্তার জীবন বৃত্তান্ত দুনিয়ার মানুষের কাছে পেশ করার বাসনা পোষণ করছি, তাঁর অভিজ্ঞতার শতভাগের বা হাজার ভাগের এক ভাগও তো আমার অর্জন করা দরকার। নচেত লেখায় সেই প্রাণস্পন্দন কোথা থেকে আসবে? এই খেয়াল আসার পর ইচ্ছাশক্তি এতটা মজবুত হলো যে, যখনই যেটুকু পেরেছি, কাজ এগিয়ে নিয়েছি। পুস্তকের শেষার্ধে বেশীর ভাগই বিছানায় শুয়ে শুয়ে লিখতে হয়েছে। এ কারণেই আমার আশা যে, আল্লাহ এ কাজটা কবুল করবেন এবং একে আমার মুক্তি ও কল্যাণের উপায় বানাবেন।
প্রস্তাবিত নীল নকশা অনুসারে এ কাজ যতখানি করতে চাই, বর্তমান পুস্তকে সে তুলনায় কাজের অনেক খানি বাকী রয়েছে। সম্ভবত দু’ তিন খন্ডে গিয়ে ঠেকবে। আসলে আপাতত একটি মাত্র দীর্ঘ আলোচনা পেশ করেছি। এটা এ দিক দিয়ে মোটামুটি বিস্তারিত যে, এতে রসূল সা. এর সংগ্রামী জীবনের বিবরণ অনেকাংশে এসে গেছে। তবে কোন কোন দিক দিয়ে এটা সংক্ষিপ্ত। কেননা নবী জীবনের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আভাষও এতে দেয়া হয়েছে। এ জন্য আমি এ আশংকাও করছি যে, কেউ কেউ এ দ্বারা কোন ভুল বুঝাবুঝিতে পড়ে যায় কিনা। এই যে কাজ বাকী রয়েছে, তা জানিয়ে দেয় জরুরী।
অবশিষ্ট কাজ নিম্নরূপঃ
-যে ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে রসূল সা. এর জন্ম হয়েছে তার বিবরণ।
-রসূল সা. এর দাওয়াত ও তাঁর লক্ষ্যের বিশ্লেষণ। তিনি মানব জীবনে কোন্ কোন্ মৌলিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। রসূলের দাওয়াতের ধরন ও তার কর্মক্ষেত্রের পরিধি।
-রসূল সা. এর নেতৃসুলভ প্রজ্ঞা, অন্তর্দৃষ্টি ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা।
-রসূল সা. এর দাওয়াতের ফলে কি ধরণের মানুষ জন্ম নিয়েছিল?
-নারী সমাজ কিভাবে রসূল সা. এর সংগ্রামে সহযোগিতা করেছে?
-একটা স্বতন্ত্র খন্ডে রসূল সা. এর সমগ্র সংস্কারমূলক কাজের বিবরণ এমন ভাবে পেশ করার ইচ্ছা আছে, যা দ্বারা আধুনিক যুগে উপকৃত হওয়া যাবে। রসূল সা. যে সব নতুন মূলনীতি, কর্মকুশলতা ও পর্যায়ক্রমিকতার সাথে জীবনের বিভিন্ন দিককে গড়ে তুলেছেন, বিভিন্ন নিবন্ধের মাধ্যমে তা তুলে ধরতে হবে। যেমন খোদায়ী কর্মকৌশলের প্রকাশ, সমাজের নবীন ও প্রবীণদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন, গণচরিত্র গঠন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সংস্কার, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, তার স্থীতিশীলতা ও দৃঢ়তা, রাজনৈতিক অবকাঠামোর পুনর্নির্মাণ সমাজ ও সংস্কৃতির পুনর্গঠন, ইসলামী সুবিচার ব্যবস্থার প্রচলন, নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন, এবং অন্যান্য সংস্কারমূলক পদক্ষেপের তাত্বিক ও বাস্তব বিশ্লেষণ।
-রসূল সা. এর ইসলামী সরকারের প্রতিরক্ষা ও সামরিক তৎপরতা সমূহের বিস্তারিত বিবরণ।
-আপত্তি উল্থাপনকারীদের আপত্তির জবাবে একটা আলাদা খন্ড লেখারও সম্ভাবনা রয়েছে। ঘটনাবলী, ব্যক্তিবর্গ ও গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলোর মতভেদ নিরসনে গবেষক সুলভ দৃষ্টি দান।
-নবীর জীবনী লেখার উৎসসমূহ এবং এ বিষয়ে এ যাবত কৃত কর্মের পর্যালোচনামূলক দৃষ্টি দান।
-এই সাথে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মানচিত্র প্রস্তুত করার ইচ্ছা আছে, যা সামনে থাকলে ঘটনাবলী বুঝা সহজতর হবে। এ ক্ষেত্রে দেশে বেশ কিছু মূল্যবান কাজ হয়েছে। একে আরো এগিয়ে নেয়ার ইচ্ছা আছে। এমনও হতে পারে যে, রসূল সা. এর জীবনী ও ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে একটা আলাদা মানচিত্র তৈরী করা হবে। পুস্তকে লিখিত বিভিন্ন তথ্যকে একটা প্রাচীর মানচিত্রে একেত্রিত করার ইচ্ছা আছে।
-এই পুস্তকের অনুবাদ অন্তত ইংরেজী, বাংলা, আরবী ও হিন্দীতে করানোর ইচ্ছা আছে। এভাবে এর উপকারিতা আরো বেড়ে যাবে বলে আশা করা যায়। আল্লাহ যেন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার তৌফিক দেন এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরনাদির সংস্থান ও অনুকুল পরিবেশ বিশেষ রহমত দ্বারা সৃষ্টি করে দেন।
নঈম সিদ্দীকী
মার্চ, ১৯৬০