হোদাইবিয়ার সন্ধি
রসূল সা. পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে হোদাইবিয়ার সন্ধি এমন একটা ঘটনা, যার ফলে ঘটনাপ্রবাহে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। এই ঘটনার ফলে ইসলামী আন্দোলন এক লাফে সার্বজনীনতার পর্যায়ে সম্প্রসারিত হবার সুযোগ পায়। এই ঘটনা দ্বারা রসূল সা. এর সর্বোচ্চ রাজনৈতিক দুরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, নিকৃষ্টতম ও নিষ্টুরতম যুদ্ধরত শত্রুকে তিনি কত সহজে সমঝোতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং কয়েক বছরের জন্য তাদের হাত বেঁধে দিয়েছেন।
বিদ্রোহ এবং বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে নির্বাসিত ইহুদিরা যখন খয়বর, তায়মা ও ওয়াদিউল কুরাতে গিয়ে নিজেদের আখড়া গড়ে তুললো, তখন মদীনা এক সাথে দুই শত্রুর মুখে উপনীত হলো। কোরায়েশ ও ইহুদীদের ঐক্য বিপুল সংখ্যক আগ্রাসী সৈন্যকে মদীনার সামনে এসে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। খন্দক যুদ্ধ থেকে ভালোয় ভালোয় উত্তীর্ণ হবার পর রসূল সা. এর সামনে যে জটিল সমস্যা দেখা দেয়, তা হলোঃ এই দুই শত্রুর ঐক্যকে কিভাবে ভাঙ্গা যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মক্কার দিকে আক্রমণ চালাতে গেলে খয়বরের ইহুদীরা ও বনু গিতফান মদীনায় হামলা চালিয়ে বসতে পারে। রসূল সা. অত্যান্ত নির্ভূলভাবে অনুমান করতে সক্ষম হন যে, এই দুই শত্রুর মধ্যে খয়বরের ইহুদী আখড়াই এক আঘাতে তছনছ করে দেয়া যায়। আর সেই সাথেই মক্কার কোরায়েশদেরকে সহজেই সন্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। আসলেই কোরায়েশদের শক্তি ভেতর থেকে খোখ্লা হয়ে গিয়েছিল। বাইরে থেকে ওরা যতই হাম্বিতাম্বিই করুক, প্রতিরোধের ক্ষমতা তেমন একটা তাদের ছিলনা। তাছাড়া মক্কা ও তার আশেপাশে রসূল সা. এর কিছু সমর্থকও ছিল। তাঁর কিছু কিছু পদক্ষেপ এই সমর্থকদেরকে আরও চাঙ্গা করে তুলেছিল। রসূল সা. দুর্ভিক্ষের দিনগুলোতে মক্কায় খাদ্যশস্য ও নগদ অর্থ পাঠিয়ে সেখানকার দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এ কারণে আবু সুফিয়ান বলেছিল, এখন মুহাম্মদ সা. আমাদের লোকদেরকে এভাবে বিপথগামী করতে চাইছে। রসূল সা. আরও একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাহলো, মক্কার সবচেয়ে বড় নেতা আবু সুফিয়ানের মেয়ে উম্মে হাবীবা রা. কে বিয়ে করেছিলেন। এই বিয়ে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সুফল বয়ে এনেছিল। যাহোক, এখন যে ভাবেই হোক, আরও একটা পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল এবং রসূল সা. সে জন্য সর্বাধিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
ওদিকে বড় রকমের সমস্যা এও ছিল যে, মুসলমানরা প্রায় ৬ বছর যাবত মক্কা ছেড়ে এসেছে। বাপারটা শুধু জন্মভূমির প্রেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং হযরত ইবরাহিম আ. এর দাওয়াতের কেন্দ্র কা’বা শরীফের সাথেও জড়িত। মুসলমানরা এই ইবরাহীমী দাওয়াতেরই নবায়ন করছে। কাজেই তাদের পক্ষে সম্ভব নয় যে, চিরদিনের জন্য এই আদর্শিক কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যাবে। কোরায়েশ এখনও পর্যন্ত মক্কায় যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেনা এবং দৃশ্যত এই দ্বন্দের নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিল। এ কারণে মুসলমানদের ভাবাবেগ ক্রমেই অস্থির ও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। ইসলামী জামায়াতের অধিকার যে হারাম শরীফের ওপর রয়েছে, সে কথা প্রকাশ করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
ইতিমধ্যে রসূল সা. স্বপ্নে হজ্জ করার ইংগিত পেলেন। এই ইংগিত পাওয়া মাত্রই তিনি তাঁর অতুলনীয় প্রজ্ঞা বলে সর্বোত্তম সময়ে সর্বোত্তম কর্মসূচি গ্রহন করলেন এবং সর্বোত্তম উপায়ে তার বাস্তবায়ন করলেন। তিনি একটি বিরাট দল সাথে নিয়ে হজ্জের পবিত্র মাসে ওমরা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে যারা যেতে চেয়েছিল, কেবল তাদেরকেই তিনি সাথে নিলেন। এ ধরনের ১৪শো মুসলমান তাঁর সঙ্গী হলো। তিনি নুমায়লা ইবনে আবদুল্লাহ লাইসীকে মদীনার ভারপ্রাপ্ত শাসকের দায়িত্বে নিযুক্ত করলেন এবং মুসলমানদের একটা বিরাট অংশকে মদিনার হেফাজতর উদ্দেশ্যে রেখে গেলেন। কুরবানীর সত্তরটি উট সাথে নিলেন। কোন সমরাস্ত্র নেয়া হলোনা। অত্যান্ত নীরবে যাত্রা শুরু হলো। যুল হুলায়ফাতে পৌছে কুরবানীর জন্তুগুলোকে চিহ্নিত করা হলো।
এই সফর একদিকে ধর্মীয় সফর ছিল। অপর দিকে এতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দিকও আপনা থেকেই আন্তর্ভুক্ত ছিল। ধর্ম ও রাজনীতির এই সমন্বয় ও সমাবেশ আমরা রসূল সা. এর গোটা জীবনেতিহাসেই বিদ্যমান দেখতে পাই। তাছাড়া হজ্জের সফরে পার্থিব কর্মকান্ড বা রাজনৈতিক তৎপরতাকে অন্তর্ভূক্ত করা সম্পূর্ণ বৈধ। তাই কোরায়েশদের জন্য এই হজ্জ যাত্রা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিল। হারাম শরীফের এই অভিযাত্রীদেরকে যদি ঠেকানো না হয় তাহলে তার অর্থ হবে, মুসলমানদের জন্য মক্কা চিরতরে উন্মুক্ত হয়ে গেল। তাছাড়া নগরবাসীর মনে রসূল সা. ও তাঁর সাথীদের হারাম শরীফে আগমনের খুবই গভীর প্রভাব পড়ার সম্ভবনা ছিল। ইসলামী বিপ্লবের এই আহবায়কদের আগমনে ইসলামী আন্দোলন মক্কা বাসীদের মনে পুনরুজ্জীবিত হতো। জনগনও বলাবলি করতো যে, কোরায়েশদের সেই দোর্দান্ড প্রতাপ শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী সময় সন্ধি চুক্তি সংক্রান্ত আলোচনায় মক্কার প্রতিনিধি সোহায়েল বিন আমরের বক্তব্য থেকেও এটা পরিস্ফুট হয়ে গেছে। সে বলেছিল, আমরা যদি আপনাদেরকে কা’বা শরীফে ঢুকতে দেই, তাহলে সমগ্র আরববাসী বলবে, আমরা আপনাদের শক্তির ভয়ে পথ খুলে দিয়েছি।
রসূল সা. পথিমধ্যেই সব কথা জেনে ফেলেছিলেন। বশীর বিন সুফিয়ান নামক জনৈক খুজায়ী গোয়েন্দা উসফান নামক স্থানে এসে জানায় যে, কোরায়েশ প্রতিরোধের আয়োজন করছে। তারা প্রতিজ্ঞা করেছে, মুহাম্মাদকে সা. কখনো মক্কায় প্রবেশ করতে দেবেনা। তাঁকে বাধা দেয়ার জন্য খালেদ একদল আশ্বরোহী বাহিনী নিয়ে কুরাইল গামীম পর্যন্ত এসেছে। একথা শুনে রসূল সা. বললেনঃ “এ হচ্ছে কোরায়েশদের দুর্ভাগ্য। ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে তাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারা যদি মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াতো এবং আমাকে সমগ্র আরববাসীর সাথে বোঝাপড়া করতে একলা ছেড়ে দিত, তাহলে তাদের কি অসুবিধা ছিল? আরবরা যদি আমাকে খতম করে দিত, তাহলে তাদের আশাই পূরণ হতো। আর যদি আমি জয় লাভ করতাম, তাহলে তারা ইচ্ছা করলে সবাইকে নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতো। নচেত তাদের শক্তি রয়েছে এবং তখন যুদ্ধ করতে পারতো। তারা যদি আমাকে এ সুযোগ না দেয়, তাহলে আল্লাহর কসম, তিনি আমাকে যে মহাসত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন, তা দিয়ে আমি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যাবো, হয় এই মহাসত্য বিজয়ী হবে, নচেত আমার মাথা কাটা যাবে”। এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে তিনি সন্ধির সম্ভাবনার আভাষও দিলেন, চরম পত্রও দিলেন এবং কোরায়েশের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার প্রতিও ইংগিত দিলেন।
অপর দিকে হজ্জযাত্রীদের কাফেলাকে ঠেকানো গেলেও কোরায়েশদের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়। দুর্নাম রটে যায় যে, তারা একটা ধর্মীয় অধিকার প্রয়োগে বাধা দিয়েছে। আবার প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করলেও অভিযোগ আসে যে, নিষিদ্ধ মাসের বিধিনিষেধ ভংগ করেছে। রসূল সা. এর পক্ষ থেকে যে হারাম শরীফের পবিত্রতার প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে এবং তারা যে শুধু ওমরার জন্য নিরস্ত্র অবস্থায় সফর করছেন, সে কথা সবাই জেনে গিয়েছিল। তাদের সাথে কোন অস্ত্র না থাকা এবং তাদের কুরবানীর জন্য চিহ্নিত জন্তুগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে তাদের সফরটা কি ধরনের? এই কথা বলা যায়, কোরায়েশরা অত্যন্ত জটিল অবস্থায় ঘেরাও হয়ে গিয়েছিল। এই নাজুক মুহুর্তে তাদের সর্বোচ্চ নেতা আবু সুফিয়ান ছিল প্রবাসে। কোরায়েশ যত আস্ফালনই করুন, সন্ধি করা ছাড়া যে তাদের গত্যান্তর নেই, সে কথা অনুমান করার মত বিচক্ষণতা একমাত্র রসূলেরই সা. এর ছিল। নির্ভুল অনুমানের বিচক্ষণতাই পরিস্থিতি পাল্টে দিতে সক্ষম। এ ভাবেই একজন কর্মবীরের প্রজ্ঞা এবং অর্ন্তদৃষ্টির সঠিক মান জানা যায়।
কোরায়েশ পুরানো জিদ ও হঠকারিতার বসে দ্রুত গতিতে মিত্র গোত্রগুলোকে, বিশেষত আহাবীশদেরকে বালদাহ নামক স্থানে সমবেত করলো।
সংগে সংগে দূতিয়ালী তৎপরতা শুরু হয়ে গেল। সর্বপ্রথম খুযায়া গোত্রের সরদার বুদাইল বিন ওয়ারকা (যিনি ইসলামের প্রতি সহনুভূতিশীল ছিলেন) কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাথী নিয়ে রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করতে এলেন। রসূল সা. তাকে জানালেন, “আমরা শুধু ক’বা শরীফ যিয়ারত করতে এসেছি। যুদ্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কোরায়েশরা যুদ্ধের নেশায় মত্ত। অথচ যুদ্ধে তাদের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হবেনা। কয়েক বছরের জন্য কোরায়েশ যদি আমাদের সাথে সন্ধি করে তবে ক্ষতি কী?’’ এভাবে রসূল সা. তাঁর আসল বক্তব্য শুরুতেই তুলে ধরলেন। বুদাইল গিয়ে কোরায়েশদের সাথে কথা বললেন। তিনি বললেন, তোমরা তাড়াহুড়ো করোনা। মুহাম্মাদ সা. যুদ্ধ করতে আসেননি, নিছক যিয়ারতের জন্য এসেছেন। বদমেজাজী যুবকরা তো কোন কথাই শুনতে রাযী ছিলনা। তবে বয়স্ক লোকেরা সব কথা শুনলো। তারপর তারা আহাবীশ নেতা উলাইস বিন আলকামাকে পাঠালো। সে যখন কুরবানীর জন্তুর পাল মাঠে বিচরণ করতে দেখলো, তখন তার ভাবান্তর ঘটলো। সে কোরায়েশদের কাছে গিয়ে খোলাখুলি বললো, এসব তীর্থযাত্রীকে বাধা দেয়া ঠিক নয়। আমরাও এ উদ্দেশ্যে আসিনি। আহাবীশ নেতাকে এই বলে শান্ত করা হলো যে, অন্তত আমাদের শর্তগুলো মানিয়ে নেয়ার সুযোগ দাও। এরপর কোরায়েশ উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফীকে প্রতিনিধি করে পাঠালো। উরওয়া এসে বললো, ‘‘হে মুহাম্মদ! সা. আপনি যদি নিজেরই গোত্রের লোকদেরকে ধ্বংস করে দেন, তবে সেটা কোন প্রশংসনীয় কাজ হবে না। আপনি যে সব বখাটে লোকদের একত্রিত করে নিয়ে এসেছেন, তারা কয়েক দিন পর সটকান দিলে আপনি একাকী হয়ে পড়বেন। এ কথা শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রেগে গেলেন এবং কিছুটা কঠোর ভাষায় উরওয়াকে ধমক দিলেন। আরবদের প্রচলিত নিয়মে অন্তরঙ্গ ভংগীতে কথা বলতে বলতে যখনই উরওয়া রসূল সা. এর দাড়ির কাছে হাত নিয়ে যাচ্ছিল, অমনি প্রতিবার হযরত মুগীরা ইবনে শুবা তরবারীর ছুঁচালো অংশ দিয়ে তার হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিলেন। রসূল সা. উরওয়ার সামনেও নিজের বক্তব্য তুলে ধরলেন। উরওয়া এখানে যে পরিবেশ দেখে, তাতে গভীরভাবে অভিভূত হয়ে ফিরে যায়। ফিরে গিয়ে সে বলে, ‘‘নেতার প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের যে দৃশ্য আমি দেখেছি, তা কোন রাজা বাদশার দরবারেও দেখিনি। মুহাম্মাদের সা. সাথীরা তার জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠিত নয়। তার হাতের ইশারায় তারা মরতে প্রস্তুত। তাঁর সামনে কেউ উঁচু স্বরে কথা পর্যন্ত বলেনা।’’ উরওয়ার এই প্রতিক্রিয়া দ্বারা বুঝা যায়, দল কর্তৃক নেতার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আনুগত্য পোষণই ইসলামী আন্দোলনের শক্তির আসল উৎস। ভালোবাসা ও আনুগত্য পোষণই ইসলামী আন্দোলনের শক্তির আসল উৎস। ভালোবাসা ও আনুগত্য মিলিত হয়ে দুর্জয় শক্তির জন্ম দেয়। কোন দলের ভেতরে এ ধরণের পরিবেশ থাকলে তা বিরোধীদেরকে দূর্বল ও আতংকগ্রস্থ করে দেয়। এখানে নিছক কোন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মত পরিবেশ বিরাজ করে না যে, একে অপরের যুক্তি খণ্ডনের কাজে লেগে থাকে। সভাপতিও সদস্যদের প্রতি কোন আন্তরিক সম্পর্ক পোষণ করেনা, সদস্যরাও বোধ করেনা সভাপতির প্রতি কোন হৃদয়ের টান। কেবল গঠনতন্ত্র ও নিয়মবিধির বাহ্যিক আনুগত্য করাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়। নেতার বিরুদ্ধে বিষোদগার, গীবত, নিন্দা, কানাঘুষা ও নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র চলে যে সব দলে, সেখানে কেমন নোংরা পরিবেশ বিরাজ করে, ভাবতেও অরুচি বোধ হয়। ইসলামী সংগঠনের ভেতরকার পরিবেশ হীতকামনা, আনুগত্য, নিষ্ঠা ও ভালোবাসার পরিবেশ। এখানে প্রত্যেক সদস্যের ব্যক্তিত্বের গুরুত্ব থাকে। তবে নেতা সবার জন্য ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকেন। কেননা তা নাহলে পরস্পরের মধ্যে দয়া ও ভালোবাসার পরিবেশ যেমন সৃষ্টি হয়না, তেমনি ইসলামী সংগঠন ইস্পাত কঠিন প্রাচীরেও পরিণত হয় না। হোদায়বিয়ার ময়দানের ইসলামী সংগঠনের এ বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় উদ্ভাসিত ছিল। তাই এ দৃশ্য উরওয়ার মনকে অভিভূত করেছিল আর এই প্রতিক্রিয়াই সে মক্কার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের কাছে ব্যক্ত করেছিল।
আলাপ আলোচনার এই ধারাকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে রসূল সা. খারাশ ইবনে উমাইয়াকে কোরায়েশের কাছে পাঠালেন। মক্কার অরাজক ও উচ্ছৃংখল পরিবেশ এমনিতেই বিদ্যমান ছিল। রসূল সা. এর যে উটে চড়ে খারাশ মক্কায় গিয়েছিল, উচ্ছৃংখল লোকেরা সেই উটটাকে মেরে ফেললো। সে নিজেও অতি কষ্টে জান বাঁচিয়ে ফিরে এল। এরপর হযরত উসমান রা. কে পাঠানো হলো। উচ্ছৃংখল লোকদের একটা দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বেরিয়েছিল। তারা মুসলমানদের যত্রতত্র উস্কানি দিল এবং তীর ও পাথর ছুঁড়ে মারলো। তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো। তবে রসূল সা. বৃহত্তর কল্যাণের তাগিদে তাদেরকে ছেড়ে দেন। মোট কথা, কোরায়েশদের যুদ্ধাংদেহী লোকেরা কোন না কোনভাবে যুদ্ধ বাধাতে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু আল্লাহ ‘‘উভয় পক্ষের হাতকে সংযত রাখলেন।’’ ফলে শান্তির পরিবেশটা অক্ষুণ্ন থাকলো এবং শান্তি রক্ষার চেষ্টা জয়ী হলো। হযরত উসমানকে রা. কোরায়েশরা আটকে রাখলো এবং তাঁর ফিরে আসতে খুব দেরী হয়ে গেল। অশুভ ও অবাঞ্ছিত ঘটনাবলীর কারণে পরিবেশ এমন ছিল যে গুজব রটে গেল, হযরত ওসমান রা. কে শহীদ করে ফেলা হয়েছে। রসূল সা. সংগে সংগে মুসলমানদের সমবেত করলেন এবং প্রয়োজনে আমরণ লড়াই করার অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, ‘‘ঘটনা সত্য হলে আমরা এদের সাথে লড়াই না করে ঘরে ফিরবোনা।’’ হযরত উসমানের জীবন সেদিন অত্যধিক মূল্যবান হয়ে গিয়েছিল। কেননা রসূল সা. এর ভাষায় পরিস্থিতি ছিল এ রকম যে, ‘‘উসমান আল্লাহ ও তার রসূলের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গেছে।’’ তিনি নিজের এক হাতকে উসমানের হাত বলে আখ্যায়িত করে তার ওপর নিজের পক্ষ থেকে অন্য হাত রেখে বললেন, ‘‘অংগীকার কর।’’ তাঁর সাথীরা এমনিতেই আবেগে অধীর ছিলেন। তারা আন্তরিকতার সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে বায়য়াত ও অংগীকার করতে লাগলেন। এই আকস্মিক মুহূর্তটা ঈমান বৃদ্ধি ও চরিত্র গঠনের উপযুক্ত মুহূর্ত ছিল এবং এ সময় মুসলমানরা নিজেদেরকে এত উচ্চ মানে উন্নীত করে যে, রসূল সা. বলেন, ‘‘আজকের দিন তোমরা সারা দুনিয়ার মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’’ এই মুহূর্তের ঈমানী জযবা ও আন্তরিকতার দরুন তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করেন। শুধু একজন মোনাফেক জিফ বিন কায়েস এই মুহূর্তের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল। সত্যের সৈনিকদের জীবনে এরূপ অনেক মুহূর্ত আসে এবং নিষ্ঠাবান লোকদের আত্মা তা থেকে শক্তির সঞ্চয় করে। চৌদ্দশো মুসলমান আমরণ লড়াই এর এই প্রতিজ্ঞার পুরস্কার এক ফোঁটা রক্ত না ঝরিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে গেলেন। কোরায়েশরা খবর পেয়ে তৎক্ষণাত হযরত ওসমানকে ফেরত পাঠিয়ে দিল। কেননা আসলে তারাও লড়াই এড়িয়ে চলতে চাইছিল।
মক্কা থেকে মিকরায বিন হাফ্স এলো। রসূল সা. মানুষ চেনায় কত দক্ষ ছিলেন দেখুন। দূর থেকে দেখেই বলে দিলেন, ‘‘ঐ যে এক ধাপ্পাবাজ আসছে।’’ অর্থাৎ তিনি জানিয়ে দিলেন, ঐ লোক দ্বারা সুষ্ঠুভাবে কোন কিছুর মীমাংসা সম্ভব হবেনা।
অবশেষে কোরায়েশ সোহায়েল বিন আমরকে পাঠালো। তাকে দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন, তারা সন্ধির জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। শর্ত নিয়ে জরুরী কথাবার্তা হলো। অবশেষে চুক্তি লেখার জন্য হযরত আলীর রা. ডাক পড়লো।
এমন নাযুক মুহূর্তে চুক্তি লেখা হচ্ছিল যে, কথায় কথায় উত্তেজনা সৃষ্টির উপক্রম হতো। চুক্তির শুরুতে যখন রসূল সা. ‘‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’’ লেখার নির্দেশ দিলেন, তখন সোহায়েল বললো, ‘‘রহমান রহীম’’ আবার কী? আমাদের নিয়ম অনুসারে শুধু ‘‘বিছমিকা আল্লাহুম্মা’’ (হে আল্লাহ তোমার নামে) লেখা হোক। রসূল সা. এ দাবীও মেনে নিলেন। এরপর বললেন, লেখ, ‘‘নিম্নলিখিত চুক্তি আল্লাহর রসূল মুহাম্মাদ ও সুহায়েল বিন আমরের মধ্যে সম্পাদিত হলো।’’ সোহায়েল আপত্তি তুলে বললো, আমি যদি আপনাকে আল্লাহর রসূল মানতাম, তাহলে আপনার সাথে যুদ্ধ করতাম নাকি? আপনি শুধু নিজের নাম ও নিজের বাপের নাম লিখান। হযরত আলী ‘‘আল্লাহর রসূল মুহাম্মাদ’’ লিখে ফেলেছেন। এখন ‘‘আল্লাহর রসূল’’ শব্দটা কেটে দেয়া তার কাছে মারাত্মক বেআদবী হবে ভেবে কাটতে পারলেন না। রসূল সা. কাগজটা নিয়ে নিজের হাতে ঐ কথাটা কেটে দিলেন এবং তার পরিবর্তে ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ’ লিখে দিলেন।
সোহায়েরের এই সব ধৃষ্টতা দেখে রসূল সা. এর সাথীরা উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু রসূল সা. এর সম্মানার্থে সংযম অবলম্বন করছিলেন। এবার নিম্নোক্ত শর্তাবলী লেখা হতে লাগলোঃ
– উভয় পক্ষ থেকে দশ বছরের জন্য যুদ্ধ বিরতি ও সন্ধি মেনে চলবে।
– মুসলমানরা এ বছর ফিরে যাবে এবং আগামী বছর কা’বার যিয়ারত করতে আসবে। তখন কোষবদ্ধ তরবারী নিয়ে মাত্র তিনদিন হারাম শরীফে কাটাবে।
– আরবের গোত্রগুলো দুই পক্ষের যার সাথে ইচ্ছা মৈত্রী স্থাপন করতে পারবে।
– কোরায়েশদের বাণিজ্যিক কাফেলা মদিনার সীমানা অতিক্রম করার সময় পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে।
– কোরায়েশদের কেউ যদি বিনা অনুমতিতে মদিনা চলে যায়, তবে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর যদি কোন মুসলমান মক্কায় আসে, তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবেনা।
শেষোক্ত শর্তটা মুসলমানদের মধ্যে নিদারুণ অস্থিরতার সৃষ্টি করলো। পুরো মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশের প্রতি দৃষ্টি দিলে বুঝা যাবে, মুসলমানদের মধ্যে এ ধরণের অস্থিরতা ও উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ছিল। প্রথমত এই পর্যায়ে এ ধরণের একটা আপোষ চুক্তিই অত্যন্ত বিরল ঘটনা ছিল। যে কোরায়েশ এতগুলো মানুষকে তাদের ঘরবাড়ী থেকে বিতাড়িত করেছে, যারা মুসলমানদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, যারা আজও তাদেরকে হারাম শরীফে ঢুকতে দিচ্ছেনা এবং কুরবানীর জন্তুগুলোকে ফিরিয়ে দিচ্ছে, এহেন যুলুমবাজ আগ্রাসী মোশরেকদের সাথে এমন আকস্মিকভাবে সন্ধি ও সমঝোতা স্থাপন করা মুসলমানদের জন্য খুবই কষ্টকর ব্যাপার ছিল। তারা কাফেরদের ব্যাপারে এ যাবত একটা মূলনীতি শিখেছে যে, ‘‘আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরস্থায়ী শত্রুতা ও হিংসার সৃষ্টি হয়েছে এবং তা তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে’’ এবং ‘‘ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে লড়াই চালিযে যাও, যতক্ষণ ফেৎনা ও অরাজকতা নির্মূল না হয়ে যায় এবং আনুগত্য সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট না হয়ে যায়।’’ তাদের কেবল এই সোজাসুজি ফর্মুলাটাই জানা ছিল যে, আল্লাহর কলেমা বা বাণীই ঊর্ধে থাকা উচিত, আর কাফেরদের কথা থাকা উচিত নীচে। হক্ব ও বাতিলের মধ্যে আপোষের অবকাশ থাকতে পারে, তা তাদের জানা ছিল না। আসলে আদর্শকে যদি নিছক তাত্ত্বিক ও দার্শনিকভাবে গ্রহণ করা হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু তাকে যদি বাস্তবতার জগতে নিয়ে এসে তা নিয়ে সংগ্রাম করতে হয়, তাহলে সময়, সুযোগ এবং স্বপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিগুলোর অবস্থার আলোকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। চোখ বুঁজে একই গতিতে সোজা পথে চলতেই থাকবেন এটা সম্ভব হয় না। কোথাও থামতে হয়, কোথাও দু’কদম ঘুরে যেতে হয় এবং কোথাও নতুন রাস্তা খোঁজার জন্য দু’কদম পিছিয়ে যেতে হয়। বিভিন্ন ধরণের শত্রুকে পর্যায়ক্রমে পরাস্ত করার উদ্দেশ্যে এক এক সময় তাদের এক একজনের সাথে সাময়িকভাবে আপোষ করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। ইতিহাসের এই ব্যাপক বাস্তব তথ্য কেবল রসূল সা. এর সামনেই দৃশ্যমান ছিল, মুসলিম সংগঠনের দৃষ্টি এতদূর পৌঁছতে সক্ষম ছিল না। তদুপরি তাদের সামনে যখন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’ এবং ‘রসূলুল্লাহ’ শব্দগুলো কেটে দেয়া হলো, তখন তাদের আবেগে ঝড়তুফান সৃষ্টি না হয়ে পারেনি। উপরন্তু যখন সেই অসম ও অবিচারমূলক শর্ত আরোপ করা হলো, তখন তাদের ধৈর্য ও সংযম বজায় রাখা কঠিন হয়ে গেল। রসূল সা. এই চুক্তির দ্বারা যে বড় বড় সমস্যার সমাধানে পথ খুঁজছিলেন, সেগুলো কোরায়েশরাও জানতোনা। মুসলমানরাও তা বুঝতে পারেনি। বড় বড় আন্দোলনের তৎপরতাকালে কখনো কখনো এমন নাযুক মুহূর্তও আসে, যখন দল ও নেতার মাঝে ভবিষ্যতের সমস্যাবলীর উপলব্ধির দিকে দিয়ে মানসিক ব্যবধান বেড়ে যায়। নেতার দৃষ্টি চলে যায় অনেক দূরে, আর দল অপেক্ষাকৃত নিকটের বিষয়গুলো নিয়েই চিন্তা করে। এ ধরণের ক্ষেত্রগুলোই সংকটজনক হয়ে থাকে এবং এইসব বিরল ক্ষেত্রেই মাত্রাতিরিক্ত নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেয়। এরূপ ক্ষেত্রে শুধু সেই নেতৃত্বই আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে, যা জনমতের সর্বোচ্চ আস্থা সহযোগিতা লাভ করে এবং যার কোন বিকল্প না থাকে। এ ধরণের আন্তরিকতাপূর্ণ ও স্থিতিশীল নেতৃত্ব দলকে কেবল নিজের নৈতিক শক্তির বলেই গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। আর দল পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ও পরিস্থিতি দেখেই নেতার গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে।
সমস্যা দেখা দিল এই যে, ঠিক এই জঠিল পরিস্থিতিতেই কোরায়েশ প্রতিনিধি সোহায়েলের ছেলে আবু জুনদুল শেকল পরা অবস্থায় মক্কা থেকে এসে হাজির হলো। তাকে মারপিট ও নির্যাতন করা হয়েছিল। সে রসূল সা. ও সাহাবীদের সামনে নিজেকে পেশ করলো। সোহায়েল বিন আমর বললো, প্রস্তাবিত শর্ত অনুসারে আবু জুনদুলই প্রথম ব্যক্তি, যাকে আপনার ফেরত পাঠাতে হবে। রসূল সা. বললেন, এখনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। কাজেই আবু জুন্দুলের ব্যাপারটা এর আওতার বাইরে থাকতে দাও। সোহায়েল বললো, তাহলে কোন আপোষ হতে পারে না। এরপর রসূল সা. কোমল ভাষায় বুঝিয়ে বললেন, ‘‘ঠিক আছে, ওকে আমার খাতিরে আমার সাথে মদিনায় যেতে দাও।’’ সোহায়েল মানলো না। বাধ্য হয়ে রসূল সা. বৃহত্তর স্বার্থে এই অন্যায় আব্দার মেনে নিলেন। এবার আবু জুন্দুল সমবেত মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বললো, ‘‘মুসলমান ভাইয়েরা, তোমরা আমাকে মোশরেকদের কাছে ফেরত পাঠাচ্ছ। অথচ ওরা আমাকে ঈমান থেকে ফেরানোর জন্য আমার ওপর নির্যাতন চালাবে।’’ আবু জুন্দুলের এ আবেদন ঐ পরিবেশে অত্যন্ত উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ছিল। কিন্তু রসূল সা. তখন অতুলনীয় ঠান্ডা মেজাজের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন। আবু জুন্দুলকে নম্র ভাষায় বুঝালেন, ‘‘আমরা চুক্তিতে একটা কথা স্বীকার করে নিয়েছি। এখন চুক্তি ভঙ্গ করতে পারি না। তোমার ও অন্যান্য মযলুমদের জন্য আল্লাহ তায়ালা একটা মুক্তির পথ বের করবেন। একটু ধৈর্য ধারণ কর।’’ মুসলমানদের অস্থিরতা ও উত্তেজনা ক্রমেই চরম আকার ধারণ করছিল। মুসলমানদের সবার মনে যেটুকু কোরায়েশ বিরোধী উত্তেজনা সঞ্চিত ছিল, তার সবটুকু বোধহয় একা হযরত ওমরের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে তাঁকে দিশেহারা করে তুলছিল। এটা হযরত ওমরের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত ব্যাপার ছিলনা। সত্যের দরদ ও ইসলামী আত্মাভিমানই তাঁকে অস্থির করে তুলছিল। এই অস্থিরতা নিয়েই তিনি প্রথমে হযরত আবু বকরের সাথে এবং পরে রসূল সা. এর সাথে নিম্নরূপ আলোচনা করেনঃ
হযরত ওমর রা.- ‘‘হে রসূলুল্লাহ, আপনি কি আল্লাহর রসূল নন?’’
রসূলুল্লাহ সা.- ‘‘অবশ্যই। আমি আল্লাহর রসূল।’’
হযরত ওমর- তাহলে আমরা কি মুসলমান নই?
রসূল সা.- ‘‘কেন নও?’’
হযরত ওমর- তবে তারা কি মোশরেক নয়?
রসূলুল্লাহ সা.- কেন নয়?
হযরত ওমর- তাহলে আমরা ইসলামের ব্যাপারে নতি স্বীকার করে চুক্তি করবো কেন?
রসূল সা.- আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল। আমি তার কোন হুকুম অমান্য করিনি। আল্লাহও আমাকে তাঁর সাহায্য থেকে বঞ্চিত করবেন না।
হযরত ওমর এই পর্যায়ে চুপ হয়ে গেলেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর ভাবাবেগ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শান্ত হলোনা। চুক্তি লেখা হলো এবং তার ওপর হযরত ওমর সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দিয়ে আনুগত্যের এক অবিস্মরণীয় নজীর স্থাপন করলেন। শর্তগুলোর ব্যাপারে মন সন্তুষ্ট না হলেও রসূলুল্লাহ সা. যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না- এই মনোভাবটাই তিনি তুলে ধরলেন স্বাক্ষর দেয়ার মাধ্যমে।
হোদাইবিয়ার এই সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর রসূল সা. সাহাবীদেরকে কুরবানী করতে ও মাথার চুল কামিয়ে ফেলতে আদেশ দিলেন। কিন্তু অস্থিরতা, দুঃখ ও বেদনার কারণে কেউ নড়াচড়াই করলোনা। দ্বিতীয়বার নির্দেশ দিলেন। তাতেও কাজ হলোনা। তৃতীয়বার নির্দেশ দিলেন। তখনও সেই অবস্থাই বহাল রইল। এ থেকেই বুঝে নেয়া যায় যে, স্বয়ং রসূল সা. এর হাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দলটির মধ্যে কি ধরণের মানসিক সংকট ও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। মানবীয় তৎপরতার ক্ষেত্রে কত বিচিত্র রকমের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তাও এই ঘটনা থেকে জানা যায়। এ অবস্থা দেখে রসূল সা. মর্মাহত হয়ে নিজ তাবুতে চলে এলেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমার কাছে অনুযোগ করলেন, লোকদের কী হলো যে, আমি যে হুকুম দিলাম, তা কার্যকর হলোনা। হযরত উম্মে সালমা রা. তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেনঃ চুক্তির শর্তপালনে তারা মর্মাহত। আপনি বাইরে বেরিয়ে নিজের কুরবানী করুন ও চুল কামান।’ রসূল সা. উঠে বাইরে গিয়ে কুরবানী করলেন ও চুল কামালেন। এই বাস্তব পদক্ষেপ পুরো জামায়াতের লোকদের আনুগত্যের ওপর বহাল করে দিল। কিন্তু তবুও অবস্থা এমন ছিল যেন তারা পরস্পরকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। যাহোক, এটা ছিল সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার এবং অচিরেই তা কেটে গেল।
এ থেকেই বুঝা যায়, যুদ্ধ এগিয়ে সমঝোতা ও আপোষের পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য রসূল সা. কত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখী হতে কুণ্ঠিত হননি এবং নিজের প্রাণপ্রিয় দলের অত্যন্ত গভীর, পবিত্র ও আন্তরিক ভাবাবেগকে পর্যন্ত এই উদ্দেশ্যে কুরবানী করেছেন।
তিনি এই চুক্তি দ্বারা বেশ বড় বড় কয়েকটা সুবিধা লাভ করলেন। প্রথমতঃ মুসলমান, মোশরেক ও সাধারণ আরবদের মধ্যে অবাধ মেলাবেশার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গেল। লোকদের আসা যাওয়া শুরু হলো। বহু বছর যাবত যে সব আত্মীয় স্বজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাত ছিলনা, তারা একত্রে উঠাবসার সুযোগ পেল। মক্কায় রসূল সা. ও মুসলমানদের সম্পর্কে মোশরেকরা যেসব বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল, মুসলমানরা তা জানবার ও দূর করার সুযোগ পেতে লগলো। তারা মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলো। নিজেদের আধ্যাত্মিক, মানসিক, নৈতিক, বৈষয়িক ও জ্ঞানগত উন্নতির বিষয় সাধারণ মানুষকে অবহিত করার সুযোগ পেতে লাগলো। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ঘরে ঘরে খোলামেলা আলোচনা হতে লাগলো। সন্ধি পরবর্তী এই শান্তির সময়টাতে ইসলাম এত দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করলো যে, বিগত আঠারো ঊনিশ বছরে সামগ্রিকভাবে যত লোক ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে, হোদাইবিয়ার সন্ধির পরবর্তী মাত্র দু’বছরেই তার চেয়ে অনেক বেশী লোক স্বেচ্ছায় ও সানন্দে ইসলাম গ্রহণ করেছে। এমনকি খালেদ ইবনে ওলীদ ও আমর ইবনুল আসের ন্যায় কর্মবীর যুবকও এই সন্ধির পরই ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
দ্বিতীয় যে সুবিধাটা অর্জিত হয়েছিল তা হলো, যুদ্ধবিগ্রহ থেকে মুক্তি পেয়ে মুসলমানদের মানসিক ও নৈতিক সংশোধন এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক পুনর্গঠনের কাজ সমাধা করার জন্য একাগ্রতা অর্জিত হলো। অভ্যন্তরীণ অংগনে নিরাপত্তা লাভের পর বিদেশী সরকারগুলোকে দাওয়াত দেয়ারও সুযোগ পাওয়া গেল।
তৃতীয় সুবিধা পাওয়া গেল এই যে, মদিনার সরকার খয়বরের ইহুদী বিদ্রোহ নিশ্চিহ্ন করার জন্য কোরায়েশদের দিক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। হোদাইবিয়ার সন্ধির অব্যবহিত পরই ইসলামী সরকার এই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে সক্ষম হলো।
চতুর্থ সুবিধা অর্জিত হলো এই যে, আরবের সবগুলো গোত্র স্বাধীন হয়ে গেল। যে গোত্রের ইচ্ছা হবে, মদিনার সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে পারবে। এটা এমন একটা নব উন্মুক্ত দরজা ছিল যে, এর মধ্য দিয়ে বহু নতুন লোক ইসলামের অভ্যন্তরে প্রবেশ অথবা মুসলমানদেরকে সাহায্য ও সহযোগিতা দিতে পারতো। অথচ কোরায়েশরা তাতে কোন বাধা দিতে সক্ষম ছিল না। বনু খুযায়া গোত্র এই সুযোগেই ইসলামী সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে।
এটাও চতুর্থ সুবিধারই আওতাভুক্ত যে, মাত্র এক বছর পর অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে মুসলমানরা মক্কায় গিয়ে কা’বা যিয়ারত করে এবং কোরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে তা ছিল পরিপূর্ণ নির্ভীকতার পরিবেশ।
সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, কোরায়েশের মত কট্টর দুশমনদের সন্ধিতে উদ্বুদ্ধ করাটাই ছিল রসূল সা. এর রাজনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মো’জেযা। একটা শর্তে দৃশ্যত কিছুটা নতি স্বীকার করে রসূল সা. তাতে সাফল্য ও সুযোগ সুবিধা লাভ করেণ, যা কোরায়েশ ঐ সময় কল্পনাও করতে পারেনি। তাদের সমর্থক ইহুদীদের সামরিক ঘাঁটি খয়বরের যে অচিরেই পতন ঘটবে এবং কোরায়েশ একলা হয়ে যাবে, তা কি তারা ভাবতেও পেরেছিল? অপরদিকে ইসলাম এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করবে, এমনকি খোদ মক্কা শহরে তার এত প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে, কোরায়েশদের শক্তি বর্তমান মানের চেয়ে নীচে নেমে যাবে, সেটাই বা কে অনুমান করতে পেরেছিল? আসলে এই চুক্তি ইসলামকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মক্কা জয় করার বিপ্লবী ক্ষমতা যুগিয়েছিল।
মদিনায় ফেরার সময় পথিমধ্যে সূরা ফাতাহ নাযিল হয়, যাতে অতীতের ঘটনাবলীর পর্যালোচনা ও ভবিষ্যতের সুযোগ সুবিধার আভাস দিয়ে মুসলমানদেরকে আল্লাহ সুসংবাদ দেন যে, তোমরা অচিরেই এমন একটা যুদ্ধে জয় লাভ করবে (খয়বরের যুদ্ধ), যাতে তোমাদের হাতে অনেক গণিমতের সম্পদ আসবে, তারপর তোমাদের অভাবনীয় সাফল্য ও বিজয় অর্জিত হবে, যা এতদিন ছিল সম্পূর্ণরূপে তোমাদের আয়ত্বের বাইরে। এতে আরো বলা হয়, যদিও মক্কার মোশরেকদেরকে তোমরা আজও পরাজিত করতে সক্ষম এবং তারা অবশ্যই পালিয়ে যেত, কিন্তু তাদের মধ্যে এমন বহু নরনারী রয়েছে, যারা কোরায়েশদের অজান্তেই ইসলামকে মেনে নিয়েছে এবং তারা মনে মনে তোমাদের সমর্থক। এখন যুদ্ধ বেধে গেলে তারা বাধ্য হয়ে তোমাদের মোকবিলায় আসতো এবং তোমরা তাদেরকে চিনতে না পারার কারণে আঘাত করতে। সুতরাং এটা আল্লাহর বিশেষ অনুগহ ছিল যে, তিনি দুই পক্ষকে সংঘর্ষ থেকে রক্ষা করেছেন। বিশেষত কাফেরদের দিক থেকে যখন জাহেলী আত্মাভিমানের অত্যন্ত ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রদর্শনী করা হয়েছে এবং ‘রহমানুর রহীম’ ও ‘রসূলুল্লাহ’ শব্দ ক’টিও তাদের সহ্য হয়নি, আর যখন আবু জুন্দুলের ব্যাপারে চরম হঠকারিতা প্রদর্শন করা হয়েছে। এক পক্ষ যখন এ ধরণের বাঁকা পথ অবলম্বন করে, তখন অন্য পক্ষও নম্র ও ঠান্ডা পন্থা অবলম্বন করতে পারেনা। কিন্তু আল্লাহপাক যে রসূল সা. ও মুসলমানদের ওপর স্থিরতা নাজিল করেছেন, তোমাদের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দিয়েছেন, এবং তোমাদেরকে খোদাভীতি ও সংযমের ওপর বহাল রেখেছেন, সেটা ছিল আল্লাহর অনুগ্রহ। তোমরা মোশরেকদের মোকাবেলায় এ ধরণেরে আচরণেরই উপযুক্ত ছিলে। নচেত তোমরাও যদি উত্তেজিত হয়ে যেতে, তাহলে সংঘর্ষ বেধে যেত এবং সহজে যে সুযোগ ও সাফল্য অর্জিত হচ্ছিল, তা হাতছাড়া হয়ে যেত।
সূরা ফাতাহ শুরু হয়েছেঃ ‘‘ইন্না ফাতাহ্না লাখা ফাতহাম মুবিনা’’ ‘‘আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দিয়েছি’’ এই কথাটা দিয়ে। হযরত ওমর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি যথার্থই সুস্পষ্ট বিজয়? রসূল সা. বললেন, ‘হা, এটা সুস্পষ্ট বিজয়।’ বস্তুত ঘটনা প্রবাহের আলোকে বুদ্ধি বিবেকের প্রশান্তি ও তৃপ্তি অনেক পরে এসেছিল। এ সময় হযরত ওমর ইসলামের পক্ষে আন্তরিক সমর্থন পোষণ করার কারণে যে ভাবাবেগের অভিব্যক্তি ঘটান, তার জন্য দীর্ঘ দিন নফল এবাদত করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকেন। এটাই আন্তরিকতার লক্ষণ। অপরদিকে হযরত আবু বকরের অবস্থা ছিল এই যে, সর্বব্যাপী অস্থিরতার সময়ও তিনি স্থির ও শান্ত থাকেন। মানবীয় সংগঠনের সদস্যদের মেজাজের এই বৈচিত্র্য সংগঠনকে একটা বিশেষ ধরণের বিন্যাস ও ভারসাম্য দান করে। এর এক প্রান্তে থাকে সিদ্দীকী গাম্ভীর্য আর অপর প্রান্তে থাকে ফারুকী তেজস্বিতা ও কঠোরতা।
এবার শুনুন, চুক্তিতে যে ধারাটি যুক্ত করে তারা জয়ের আনন্দে বোগল বাজানোর উপক্রম করেছিল, সেই ধারাটিই কিভাবে তাদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। প্রথমত এর কারণে মক্কায় গোপনে ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। কেননা চুক্তি অনুসারে তাদের মদিনায় যাওয়ার পথ রুদ্ধ ছিল। আর এ কারণে কোরায়েশদের শক্তি ভেতর থেকে খোক্শা হয়ে যেতে লাগলো। অপরদিকে একটা গুরুতর ঘটনা ঘটে গেল। ইসলাম গ্রহণকারী আবু বছীর কোন রকমে পালিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় গিয়ে পৌঁছলো। তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কোরায়েশরা দু’জন লোক পাঠালো। রসূল সা. চুক্তি পালনের নীতিতে অটল থেকে আবু বছীরকে ফেরত দিলেন। আবু বছীরকেও তিনি এই বলে প্রবোধ দিলেন যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য একটা না একটা পথ বের করে দেবেন। অনন্যোপায় হয়ে আবু বছীর ফিরে গেল। পথিমধ্যে তিনি কোরায়েশদের পাঠানো দু’ব্যক্তির একজনকে বাগে পেয়ে তারই তরবারী দিয়ে হত্যা করে পুনরায় মদিনায় চলে এলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তিটিও নালিশ করতে মদিনায় এল। আবু বছীর রসূল সা. কে বুঝালেন যে, আপনিতো আপনার ওয়াদা পালন করেছেনই এবং আমাকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করেছেন। কিন্তু আমি নিজেকে মোশরেকদের খপ্পরে ফেলে নিজের ঈমানকে বিপন্ন করতে চাইনি। কাজেই আমি নিজ দায়িত্বেই এ কাজ করেছি। আপনার ওপর এর কোন দায়দায়িত্ব বর্তেনা। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। রসূল সা. বললেন, ‘‘এই ব্যক্তি যদি কিছু লোক জোগাড় করতে পারে, তাহলে তো যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে।’’ আবু বছীর ভাবলো তাকে বুঝি আবার মক্কায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। তাই তিনি গোপনে মদিনা থেকে বেরিয়ে সমুদ্র তীরবর্তী ঈস নাম স্থানে পৌঁছে গেলেন এবং সেখানে বসতি স্থাপন করলেন। পরে আবু জুন্দুলও ওখানে এসে গেল। এরপর মক্কা থেকে অন্যরাও বেরিয়ে সমুদ্রতীরে চলে যেতে লাগলো। ক্রমান্বয়ে এখানে সত্তর জনের এক বাহিনী গড়ে উঠলো।’ মক্কাবাসীর সাথে তাদের আদর্শিক বিরোধও ছিল, আবার ব্যক্তিগতভাবে যুলুম নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণে প্রতিশোধ স্পৃহাও ছিল। তারা মদিনা রাষ্ট্রের নাগিরকও ছিল না যে, তাদের ওপর চুক্তি পালনের দায়দায়িত্ব বর্তাবে। তাদের এটা ছিল একটা ‘‘স্বাধীন ইসলামী ফ্রন্ট।’’ তারা কোরায়েশদের বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোর ওপর গেরিলা আক্রমণ শুরু করলো। এতে কোরায়েশরা বেকায়দায় পড়ে গেল। অবশেষে তারা নিজেরাই দরখাস্ত করে চুক্তি থেকে তাদের প্রিয় শর্তটা বাদ দেয়ালো। এরপর রসূল সা. এই যুবকদেরকে মদিনায় ডেকে নিলেন। ওদিকে মক্কা থেকে নওমুসলিমদের হিজরতের পথও উন্মুক্ত হয়ে গেল।
একটা গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হলো তখন, যখন মক্কার বিশিষ্ট সরদার উকবা ইবনে আবি মুয়াইতের মেয়ে উম্মে কুলসুম হিজরত করে মদিনায় এল। তাকে ফিরিয়ে নেয়া জন্য তার দু’ভাই আম্মারা ও ওলীদ উপস্থিত হলো। বিষয়টা রসূল সা. এর কাছে আনা হলো। তিনি আল্লাহর নির্দেশে উম্মে কুলসুমকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করলেন। একজন মুসলিম মহিলাকে শত্রুর হাতে সোপর্দ করা আর একজন মুসলিম পুরুষকে সোপর্দ করা এক কথা নয়। রসূলের সা. এই অস্বীকৃতির একটা নৈতিক মূল্য ছিল। তাই দু’ভাই যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল, তখন কোরায়েশ ব্যাপারটাকে মেনে নিল। যেহেতু রসূল সা. সূরা মুমতাহিনার নির্দেশের অধীন এই অস্বীকৃতির সাথে সাথে আরো কয়েকটা সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন, যেমন প্রত্যেক মুসলানকে তার মক্কায় থেকে যাওয়া কাফের স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে এবং উভয় দিক থেকে মোহর দিতে হবে, তাই সামগ্রিকভাবে এ সিদ্ধান্তটা কোরায়েশের ভালো লেগেছিল।
এই হলো সেই ঐতিহাসিক হোদায়বিয়ার সন্ধি, যা ফলাফলের দিক থেকে একটা মহাবিজয় ছিল। এই চুক্তি করতে কোরায়েশকে উদ্বুদ্ধ করা এবং এ সংক্রান্ত সব কটা জটিল স্তর অতিক্রম করা রসূল সা. এর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও নেতাসুলভ প্রজ্ঞারই পরিচায়ক ছিল। এদ্বারা পরবর্তীকালের মুসলমানরাও কেয়ামত পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করতে থাকবে। এ সন্ধি রসূল সা. এর রাজনৈতিক দক্ষতার এক অতুলনীয় নমুনা এবং তাঁর এক অসাধারণ কীর্তি।
ওমরাতুল কাযা
হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তিতে স্থিরীকৃত ছিল যে, এ বছর মুসলমানরা ফিরে যাবে এবং পরের বছর এসে যিয়ারত করে যাবে। সে অনুসারে ৭ম হিজরীতে রসূল সা. সাথীদের নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। এই সফরও প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় হলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে তা রাজনৈতিক। এর ফলে পরিবেশে গভীর প্রভাব বিস্তৃত হয় এবং এ কারণে ইসলামের প্রভাব শুধু মক্কাতেই বেড়ে যায়নি, বরং সমগ্র আরবেও মুসলমানদের অবাধে মক্কায় প্রবেশের কারণে চমকপ্রদ মানসিক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে।
একশো ঘোড়া ও ষাট (মতান্তরে আশি) উট সহ দু’হাজার ব্যক্তি রওনা হলো। অস্ত্রশস্ত্র কোষবদ্ধ অবস্থায় নেয়া হলো। চুক্তি অনুযায়ী কোরায়েশরা তিন দিনের জন্য হারাম শরীফকে সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য হলো। কিছু কিছু কট্টর বিরোধী শহর ছেড়ে দূরবর্তী পাহাড়ে চলে গেল, যাতে এই দৃশ্য দেখতে না হয়। কিন্তু সাধারণ মক্কাবাসী, নারী ও শিশুরা কাতার বেঁধে দাঁড়িয়ে বিপ্লবী ইসলামী শক্তির ওমরা আদায়ের দৃশ্য দেখছিল।
প্রবেশের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা রসূল সা. এর বাহক জন্তুর লাগাম ধরে একটা বিপ্লবী গান গাইতে গাইতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই গানের কথাগুলো ছিল নিম্নরূপঃ
‘‘সেই সত্তার নাম নিয়ে প্রবেশ করছি, যার দ্বীন ছাড়া আর কোন দ্বীন নেই। সেই সত্তার নামে প্রবেশ করছি, মুহাম্মাদ সা. যার রসূল।’’
‘‘হে কাফেরের বাচ্চারা, তাঁর পথ থেকে সরে দাঁড়াও। দয়ালু আল্লাহ স্বীয় কিতাবে শিক্ষা দিয়েছেনঃ
যে লড়াই তাঁর পথে করা হয়, সেটাই সর্বোত্তম লড়াই। হে আমার রব, আমি তোমার কথার ওপর ঈমান রাখি।’’
গানের মধ্য দিয়েই ইসলামের দাওয়াত দেয়া হচ্ছিল। অথচ বহু বছর যাবত মক্কা এ দাওয়াতের শব্দ থেকে বঞ্চিত ছিল। এতে জেহাদের কথাও শোনানো হচ্ছিল। আল্লাহর সেই অতিপ্রিয় নাম ‘রহমান’ও এতে উচ্চারিত হচ্ছিল, যা কোরায়েশ মোটেই সহ্য করতে পারতো না। এতে মুহাম্মদ সা. এর রিসালাতের কথাও ঘোষিত হচ্ছিল। ইসলাম বিরোধী শক্তিকে তাৎপর্যপূর্ণ ভাষায় বলা হচ্ছিল, রসূলের পথ থেকে সরে দাঁড়াও এবং বাঁধা দেয়া বন্ধ কর। সেদিন মক্কায় বাধা দেয়ার মত কেউ ছিলনা। হোদায়বিয়ার সন্ধি হাত ও মুখ বন্ধ করে রেখেছিল।
রসূল সা. তাঁর দলের লোকদের হুকুম দিলেন বুক টান ও ঘাড় উঁচু করে চলতে এবং ছড়িয়ে ছড়িয়ে তাওয়াফ করতে, যাতে করে এই অপপ্রচার মিথ্যা প্রমাণিত হয় যে, ক্ষুধা ও জ্বরের কারণে মোহাজেররা দূর্বল হয়ে গেছে। কেননা আজ শত্রুকে ঘাবড়ে দেয়া প্রয়োজন। রসূল সা. বললেন, ‘‘যে ব্যক্তি আজ কাফেরদের সামনে শক্তি প্রকাশ করবে তার ওপর আল্লাহর রহমত হোক।’’ এ উদ্দেশ্যেই তিনি রুকনে ইয়ামানী থেকে রুকনে আসওয়াদ ধারণ ও চুম্বন করা পর্যন্ত নম্র ও ধীর গতিতে (হেঁটে) চলতেন এবং এই অংশে থাকাকালে দর্শক জনতা তওয়াফকারীদের দেখতে পেতনা। তারপর পরবর্তী পথে হালকা দৌঁড় দিতেন এবং এই অংশেই তওয়াফকারীদের দেখা যেত। এ থেকে বুঝা গেল যে, বিরোধী মহলে ইসলামের মোজাহেদদের যে কোন ধরণের দুর্বলতা, চাই তা শারীরিকই হোক না কেন, তা যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্য চেষ্টা করা উচিত, বরং জাঁকজমক ও শক্তি প্রদর্শন দ্বারা বিরোধীদেরকে ভীত সন্ত্রস্থ করা উচিত। এটা ইসলামী রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। এটি এত গুরুত্বপূর্ণ কৌশল যে, হারাম শরীফে এবং তওয়াফের সময়ও তার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এই শক্তি প্রদর্শনীকে অহংকার ও দাম্ভিকতার সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা উচিত নয়। বরঞ্চ এটা সওয়াবের কাজ। এরূপ পরিস্থিতিতে যদি বিনয় প্রদর্শন করা হয়, তাহলে তার ফল ফলবে উল্টো। এই সব ছোট খাট সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রসূল সা. সমকালীন রাজনৈতিক চাহিদার ওপর কত গভীর দৃষ্টি রাখতেন এবং তা পূরণ করার ওপর কত বেশী গুরুত্ব দিতেন। এই রাজনীতি তাঁর ব্যক্তিগত পদমর্যাদার জন্য নয় বরং ইসলামী ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠার খাতিরেই অপরিহার্য ছিল। এ জন্য এটা ছিল পুরোপুরি ধর্মীয় কাজ এবং এর প্রতিটি তৎপরতাই ছিল এবাদত।
ভেবে দেখুন, সত্য দ্বীনের আহ্বায়কদের এই সমাবেশকে যখন মক্কার জনতা দেখছিল, তখন নারী পুরুষ ও শিশুদের মনে কি ধরণের ধ্যান-ধারণা ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারা নিশ্চয়ই ভাবছিল, মক্কা থেকে যে ইসলামের সূচনা হয়েছিল, তারই ফসল আজ তাদের সামনে উপস্থিত। তারপর হেরাগুহা, সূর গুহা, আরকামের বাড়ী, শিয়বে আবু তালেব এবং আন্ নাদওয়ার মত ঐতিহাসিক স্থানগুলো তাদের সামনে মাথা তুলে বলছিল, দেখ, এই পূণ্যবানদের দল কত বড় মহান। তোমরা এদের তুলনায় কত নিকৃষ্ট ও হীন রয়ে গেছ।
মক্কার অলিগলির প্রতিটি ধুলিকণা বলছিল, এই হচ্ছে সেই ধৈর্যশীলদের দল, যাদেরকে তোমরা বিনা অপরাধে বছরের পর বছর কষ্ট দিয়েছ। দেখ আজ তাঁরা কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছে। কাবার চত্তর হযরত আবু যর গিফারীর প্রথম প্রকাশ্য কালেমা উচ্চারন ও গণপিটুনি,মক্কার মরু প্রান্তরে হযরত বিলালের আহাদ আহাদ উচ্চারণ ও লোহমোর্ষক নির্যাতন এবং দারুণ নাদওয়া রসূল সাঃ এর হত্যার ষড় যন্ত্রের স্মৃতি যেন একে একে তুলে ধরছিল আর বলছিল তোমাদের নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের শিকার সেই মহামানবের দাওয়াত আজ চারদিকে কত পরিবর্তন এনেছে তাকিয়ে দেখ! তের বছরের ইতিহাস চারদিক থেকে স্মৃতির ঢল নামাচ্ছিল। বদর ও ওহোদে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের আত্মা হয়তো রক্তিম আলখেল্লা পরে তাদের সামনে ভেসে উঠছিল এবং তাদেরকে মিনতি জানাচ্ছিল, ওহে মক্কাবাসী, তোমরাও জেগে ওঠো, তোমরাও নিজেদেরকে পরিবর্তন কর,সামনে এগিয়ে যাও এবং এই বহমান পুন্যপ্রবাহে নিজেদের ভাসিয়ে দাও।
একদিকে মুসলমানদের এবাদত দেখে জনতা অভিভূত হয়েছে। অপরদিকে তাদের নৈতিক মান দেখেও মুগ্ধ হয়েছে। কেননা,এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ তিন দিন ধরে মক্কা নগরীতে অবস্থান করেছে। অথচ চরম শত্রুতা থাকা স্বত্তেও কোন মক্কাবাসীর জানমালের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি হয়নি। মোশরেকরা যেভাবে তাদের ঘরবাড়ী তালা বদ্ধ করে বাইরে চলে গিয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই তা অক্ষত ও নিরাপদ থেকেছে।
ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে যারা ঈমান লুকিয়ে মক্কায় অবস্থান করছিল, এ দৃশ্য দেখে নিশ্চয় তাদের চোখ জুড়িয়ে গেছে তাদের ভাবাবেগে নতুন শক্তির দোলা লেগেছে। তাদের মধ্যে নতুন আশা উজ্জীবিত হয়েছে। আর বিরোধীরা নিজেদেরকে চরম কোণঠাসা অনুভব করেছে। তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক অন্ধকার ভবিষ্যৎ।
তিন দিন ধরে মক্কা নগরীতে পুণ্যবানদের এই সমাবেশ রইল। চতুর্থ দিন সোহায়েল বিন আমর ও খুয়াইতিব বিন উযযা রসূল সাঃ এর কাছে এসে বললঃ ‘তিন দিন তো হয়ে গেছে। এখন আমার ভূখন্ড ছেড়ে চলে যান’। রসূল সাঃ তখন কতিপয় আনসারদের সাথে কথা বার্তা বলছিলেন। সা’দ বিন উবাদা সোহায়েল এর কথা বলার ভঙ্গিটা সহ্য করতে পারেননি। তিনি বললেনঃ ‘ শালা, এই ভূখন্ড তোর ও নয়, তোর বাপেরও নয়। আমরা কখনো যাবনা’। রসূল সাঃ উত্তপ্ত পরিবেশকে স্বাভাবিক করার জন্য কিছুটা রসালো বাচনভংগী অবলম্বন করলেন। তিনি এই সময় উম্মুল মুমেনিন হযরত মায়মুনাকে বিয়ে করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গ টেনে তিনি বললেন, ‘ দেখ আমি এখানে একটা বিয়ে করলাম। এ উপলক্ষে একটা ভোজের আয়োজন করলে মন্দ কি? আমরাও খাবো, তোমরাও শরীক হবে’। কিন্তু এতে তাদের মেজাজের রুক্ষতার কোন পরিবর্তন এলনা। তারা বললঃ ‘ আমাদের ভোজটোজের দরকার নাই। তোমরা বিদায় হও’। অগ্যতা তারা আর কি বলবেন। দেখলেন, গোটা পরিবেশটাই নষ্ট হচ্ছে। তাদের একগুঁয়েমির কারণে রসূল সাঃ তাঁর দলকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিলেন। রওনা হওয়ার সময় হঠাৎ হযরত হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের শিশু মেয়ে “ইয়া আমিন, ইয়া আমিন” (চাচা,চাচা) বলে দৌড়ে এসে রসূল সাঃ কে জড়িয়ে ধরল। সে কি হৃদয়বিদারক দৃশ্য। রসূল সাঃ ঐ শিশুকে সাথে নিলেন এবং তার খালার কাছে অর্পণ করলেন। এই খালা ছিল যায়েদ বিন হারেসার স্ত্রী।
স্মরণ করা যেতে পারে, হোদায়বিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন কালে রসূল সাঃ কে জিজ্ঞাস করা হয়েছিল, “আপনি তো বলেছিলেন আমরা হারাম শরীফে যাব এবং তাওয়াফ করবো। সেটা তো হলনা”। রসুলা সাঃ জবাবে বলেছিলেন, আমি কখন বলেছিলাম যে এই বছরই তাওয়াফ করবো? বস্তুত হদায়বিয়ার সন্ধির বছর অর্থাৎ ষষ্ঠ হিজরীতে হারাম শরীফে যাওয়া ও তাওয়াফ করা সম্ভব হলেও, এ বছরের মতন জাঁকজমক সাথে হতোনা,হতো রক্ত পাতের মধ্যে দিয়ে। স্বাভাবিক পরিবেশে জাঁকজমকের সাথে ওমরা আদায় করা অত্যন্ত বরকতপূর্ণ কাজ।
পরে এ ঘটনাটা নিয়ে যখন আরবের অন্যান্য গোত্রের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, তখন জনমত যে আগের থেকে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তা সন্দেহাতীত ভাবে বলা চলে। লোকেরা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, যে মক্কা থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে তারা এবার বুকটান ও ঘাড় উঁচু করে ঢুকেছে। যে কোরায়েশরা মুসলমানদের ধরা পৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল, সেই কোরায়েশ তাদের সাথে সন্ধি করে তাদের অক্ষমতা প্রমাণ করে দিয়েছে। অতএব জনগণ অবশ্যই এ ধারণায় উপনীত হয়েছে যে, দেশের ভবিষ্যৎ মদীনার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। এতে জনমতের কাছে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক কথায় বলা যায়, ওমারাতুল কাযাও ইসলামের বিকাশ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল।