সাধারণ সামাজিক যোগাযোগ
সাধারণত বড় বড় কাজ যারা করেন, তারা সর্বশ্রেণীর মানুষের সাথে যোগাযোগ করার সময় পান না এবং সব দিকে মনোযোগও দিতে পারেন না। উচুঁ স্তরের লোকদের অনেকের মধ্যে নির্জনতা প্রিয় ও মেযাজের রূক্ষতার সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ দাম্ভিকতায় লিপ্ত হয়ে নিজের জন্য স্বতন্ত্র এক ভূবন তৈরী করে নেয়। কিন্তু রসূল সা. ছিলেন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েও এবং ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী কীর্তি সম্পন্ন করেও তিনি সর্বস্তরের জনগণের সাথে সার্বক্ষণিক সংযোগ বজায় রাখতেন। সমাজের ব্যক্তিবর্গের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষা করতেন। জন বিচ্ছিন্নতা, ধাম্ভিকতা বা রুক্ষতার নামগন্ধও তাঁর মধ্যে ছিলনা। আসলে তিনি যে ভ্রাতৃত্বমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার অপরিহার্য দাবি ছিল জনগণ নিজেদের মধ্যে গভীর পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ থাকুক। একে অপরের উপকার করুক এবং একে অপরের অধিকার সম্পর্কে অবগত থাকুক। আজকের পাশ্চাত্য জগতে যে ধরণের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জন্ম হচ্ছে, তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ সংস্কৃতিতে কারো সাথে কারো কোন সম্পর্কে থাকেনা। এই সম্পর্কহীনতা এখন এক মানবতা বিধ্বংসী উপকরণে পরিণত হয়েছে। আজ তাই মুহাম্মদ সা. এর নেতৃত্বে এই পরিবেশটাকে পাল্টে ফেলা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আসুন, রসূল সা. কে সাধারণ সামাজিক সংযোগের প্রেক্ষাপটে পর্যবেক্ষণ করি।
তাঁর রীতি ছিল পথে যার সাথে দেখা হোক প্রথমে ছালাম দেয়া। কাউকে কোন খবর দিতে হলে সেই সাথে ছালাম পাঠাতে ভুলতেননা। তাঁর কাছে কেউ কারো ছালাম পৌঁছালে ছালামের প্রেরক ও বাহক উভয়কে পৃথক পৃথকভাবে ছালাম দিতেন। একবার এক শিশু কিশোরের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের ছালাম দিয়েছিলেন। মহিলাদের নিকট যাওয়ার সময় তাদেরকেও ছালাম দিতেন। বাড়ীতে প্রবেশকালে ও বাড়ী থেকে বেরুবার সময় পরিবার পরিজন ছালাম দিতেন। বন্ধুবান্ধবের সাথে হাতও মেলাতেন, আলিঙ্গনও করতেন। হাত মেলানোর পর অপর ব্যক্তি হাত না সরানো পযন্ত তিনি হাত সরাতেন না।
যখন বৈঠকাদিতে যেতেন, তখন সাহাবীগণ তাঁর সম্মানে উঠে দাঁড়াক, এটা পছন্দ করতেন না। বৈঠকের এক পাশেই বসে পড়তেন। ঘাড় ডিংগিয়ে ভেতরে ঢুকতেন না। তিনি বলতেনঃ ‘আল্লাহর একজন সাধারণ বান্দা যেভাবে ওঠাবসা করে, আমি ও সেভাবেই ওঠাবসা করি।’ – হযরত আয়েশা কতৃক বণিত।
নিজের হাটু সংগীদের চেয়ে আগে বাড়িয়ে বসতেননা। কেউ তাঁর কাছে এলে তাঁকে নিজের চাদর বিছিয়ে বসতে দিতেন। আগন্তুক নিজে না ওঠা পর্যন্ত তিনি বৈঠক ছেড়ে উঠতেন না।
কোন বৈঠকে অবান্তর বিষয়ে আলোচনার জন্য তুলতেননা। বরং যে বিষয়ে আলোচনা চলছে, তাতেই অংশ গ্রহণ করতেন। ফজরের জামায়াতের পর বৈঠক বসতো এবং সাহাবায়ে কেরামের সাথে অনেক কথাবার্তা বলতেন। কখনো জাহেলী যুগের কাহিনী এসে গেলে তা নিয়ে বেশ হাসাহাসি হতো। [জাবের বিন সামুরা (রা) কতৃক বণিত।] সাহাবীগণ কবিতাও পড়তেন। যে বিষয়ে বৈঠকের লোকদের মুখমন্ডলে বিরক্তি ও একঘেয়েমির চিহ্ন ফুটে উঠতো, সে বিষয় পরিবর্তন করতেন। বৈঠকের প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি মনোযোগ দিতেন, যাতে কেউ অনুভব না করে যে, তিনি তার উপর অন্য কাউকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কথার মাঝখানে কেউ অবান্তর প্রশ্ন তুললে তার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আলোচনা চালিয়ে যেতেন এবং আলোচনা শেষ করে ঐ ব্যক্তির দিকে মনোযোগ দিতেন। আলাপরত ব্যক্তির দিক থেকে ততক্ষণ মুখ ফেরাতেন না, যতক্ষণ সে নিজে মুখ ফিরিয়ে না নেয়। কেউ কানে কানে কথা বললে সেই ব্যক্তি যতক্ষণ কথা শেষ না করে মুখ না সরায়, ততক্ষণ এক নাগাড়ে তার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখতেন। নেহাৎ অন্যায় কথা না বললে কারো কথার মাঝখানে হস্তক্ষেপ করতেন না। এরূপ ক্ষেত্রে হয় ভুল ধরিয়ে দিতেন, নচেত তার মুখমন্ডলে অসন্তোষের চিহ্ন ফুটে উঠতো, নয়তো উঠে চলে যেতেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা পছন্দ করতেন না। অপ্রীতিকর বিষয়কে হয় এড়িয়ে যেতেন। নচেত আপত্তি জানানোর সাধারণ রীতি এই ছিল যে, সরাসরি নাম নিয়ে বিষয়টির উল্লেখ করতেন, বরং সাধারণভাবে ইংগিত করতেন কিংবা সামাজিকভাবে উপদেশ দিতেন। অত্যধিক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হলে, যা কেবল ইসলামী বিষয়ের ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হতো, বন্ধুবান্ধবকে সচেতন করার জন্য তিনি কয়েকটি পন্থা অবলম্বন করতেন। হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাঁর কাছে এলে তার সালাম গ্রহণ করতেন না, কিংবা তার দিকে মনোযোগ দিতেন না। কোন অবাঞ্চিত লোক এসে পড়লেও হাসিমুখে তাকে স্বাগত জানাতেন। একবার এমন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে এল, যাকে তিনি সংশ্লিষ্ট গোত্রের নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে মনে করতেন। কিন্তু তিনি তার সাথে অমায়িকভাবে কথাবাতা বললেন। এটা দেখে হযরত আয়েশা বিস্ময় প্রকাশ করলে তিনি বললেনঃ আল্লাহর কছম, যে ব্যক্তির দুর্ব্যবহারের ভয়ে লোকেরা তার সাথে মেলামেশাই বন্ধ করে দেয়, কেয়ামতের দিন সে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি বলে গণ্য হবে। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, পৃঃ ২৯১]
কারো সাথে সাক্ষাত করতে গেলে দরজার ডান দিকে বা বাম দিকে দাঁড়িয়ে নিজের উপস্থিতির কথা জানাতেন এবং ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেওয়ার জন্য তিনবার সালাম করতেন। সালামের জবাব না পেলে কোন রকম বিরক্ত না হয়ে ফিরে যেতেন। রাতের বেলায় কারো সাথে দেখা করতে গেলে এমন আওয়াযে সালাম করতেন যেন সে জাগ্রত থাকলে শুনতে পায়, আর ঘুমিয়ে গিয়ে থাকলে তার ঘুমের ব্যাঘাত না হয়।
তাঁর শরীর বা কাপড় থেকে কেউ ধূলি বা খড়কুটা সরিয়ে দিলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলতেনঃ ‘আল্লাহ যেন কোন অপ্রীতিকর জিনিস তোমার কাছ থেকে দূর করে দেন।’ উপহার গ্রহণ করতেন এবং পাল্টা উপহার দেয়ার কথা মনে রাখতেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেউ তাঁর দ্বারা কষ্ট পেলে তাকে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিতেন এবং কখনোবা তাকে বিনিময়ে কোন উপহার দিতেন। কেউ নতুন কাপড় পরে তাঁর সামনে এলে বলতেনঃ ****** ‘চমকার, চমৎকার, যত দীঘদিন পার ব্যবহার কর এবং পুরানো হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ব্যবহার কর।’ খারাপ ব্যবহারের প্রতিশোধ খারাপ ব্যবহার দ্বারা নিতেন না। ক্ষমা করতেন। অন্যদের অপরাধ যখন ক্ষমা করতেন, তখন সেটা জানানোর জন্য প্রতীক স্বরূপ নিজের পাগড়ী পাঠিয়ে দিতেন। কেউ ডাক দিলে সব সময় ‘লাব্বাইক’ বলে ডাক শুনতেন, চাই সে নিজের পরিবারের লোক বা নিজের সাহাবীগণের মধ্য থেকে কেউ হোক না কেন।
রোগী দেখতে যেতেন যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে। শিয়রে বসে জিজ্ঞেস করতেন তুমি কেমন আছ? রুগ্ন ব্যক্তির কপালে ও ধমনীতে হাত রাখতেন। কখনোবা বুকে, পেটে ও মুখমন্ডলে সস্নেহে হাত বুলাতেন। রোগী কি খেয়েছে জিজ্ঞেস করতেন। সে কোন কিছুর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করলে তা ক্ষতিকর না হলে এনে দিতেন। সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলতেনঃ ‘চিন্তার কোন কারণ নেই, আল্লাহ চাহে তো অচিরেই তুমি রোগমুক্ত হবে।’ রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করতেন। হযরত সা’দের জন্য তিনবার দোয়া করেছিলেন। মোশরেক চাচাদেরও রোগব্যাধি হলে দেখতে যেতেন। একটা রুগ্ন ইহুদী শিশুকেও তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। (শিশুাটি পরবর্তীতে ঈমান এনেছিল)। এ কাজের জন্য কোন দিন বা সময় নিদিষ্ট থাকতো না। যখনই খবর পেতেন এবং সময় পেতেন দেখতে যেতেন।
একবার হযরত জাবেরের অসুখ হলো। রসূল সা. হযরত আবু বকরকে সাথে নিয়ে পায়ে হেটে অনেক দূর পর্যন্ত গেলেন। (মদীনার জনবসতি ছড়ানো ছিটানো ছিল।) হযরত জাবের বেহুশ অবস্থায় ছিলেন। তিনি তাঁকে দেখে ওযু করলেন, পানি ছিটিয়ে দিলেন এবং দোয়া করলেন। এতে রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে লাগলো। এমনকি হযরত জাবের কথাবার্তা বললেন এবং নিজের সম্পত্তি সম্পর্কে মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করলেন।
তিনি এতটা মানবদরদী ছিলেন যে, এমনকি মুনাফিকদের নেতা রোগাক্রান্ত আব্দুল্লাহ বিন উবাইকেও দেখতে গিয়েছিলেন।
কেউ মারা গেলে সেখানে চলে যেতেন। মুমূর্ষ অবস্থায় খবর পেলে বা ডাকা হলে গিয়ে তাওহীদের ব্যাপারে ও আল্লাহর দিকে মনোযোগ দেয়ার ব্যাপারে নসিহত করতেন। মৃত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনকে সমবেদনা জ্ঞাপন করতেন, ধৈর্যরে উপদেশ দিতেন এবং চিৎকার করে কাঁদতে নিষেধ করতেন। সাদা কাপড়ে কাফন দিতে তাগিদ দিতেন এবং দাফন কাফন দ্রুত সম্পন্ন করতে বলতেন। দাফনের জন্য লাশ নিয়ে যাবার সময় সাথে সাথে যেতেন। মুসলমানদের জানাযা নিজেই পড়াতেন এবং গুনাহ মাফ করার জন্য দোয়া করতেন। কোন লাশ যেতে দেখলে তৎক্ষণাত দাঁড়িয়ে যেতেন, চাই সে লাশ কোন অমুসলিমেরই হোক না কেন। (কোন কোন বর্ণনায় রসুল সা.) বসে থাকতেন এ কথাও বলা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, দাঁড়ানোর রীতি রহিত হয়ে গিয়েছিল। (যাদুল মায়াদ ১৪৫ পৃঃ)। তিনি প্রতিবেশীদের উপদেশ দিতেন মৃতের পরিবারের জন্য খাবার পাঠাতে। (আজকাল উল্টো মৃতের বাড়ীতে অন্যদের ভোজের আয়োজন হয়ে থাকে)। আনুষ্ঠানিক শোক সভা কয়েকদিন পর্যন্ত চলতে থাকাকে খুবই অপছন্দ করতেন।
প্রবাস থেকে ফিরে কেউ সাক্ষাত করতে চাইলে তার সাথে আলিঙ্গন করতেন, কখনো কখনো কপালে চুমু খেতেন। কাউকে প্রবাসে যাওয়ার সময় বিদায় জানাতে গেলে তাকে এই বলে অনুরোধ করতেনঃ দোয়া করার সময়ে আমাদের কথা মনে রেখ।
স্নেহ ও ভালোবাসার আতিশয্যে কারো কারো সাথে এত অমায়িক ও সহজ হয়ে যেতেন যে, প্রিয়জনের নাম সংক্ষেপ করে ডাকতেন। যেমন আবু হুরায়রাকে সংক্ষেপে ‘আবু হুর’ এবং হযরত আয়েশাকে কখনো কখনো ‘আয়েশ’ নামে ডাকতেন।
শিশুদের সাথে রাসূল সা. এর বড়ই মাখামাখি ছিল। শিশু দেখলেই তার মাথায় হাত বুলাতেন, আদর করতেন, দোয়া করতেন এবং একেবারে ছোট শিশু কাছে পেলে তাকে কোলে নিয়ে নিতেন। শিশুদের মন ভূলানোর জন্য চমক লাগানো কথা বলতেন। যেমন বলতেনঃ ‘টিকটিকিরা ভাই রাতে মশার চোখে ঘা মারে দাঁতে’। একবার এক নিষ্পাপ শিশুকে চুমু খেতে খেতে বলেছিলেনঃ শিশুরা আল্লাহর বাগানের ফুল। শিশুদের নাম রাখতেন। কখনো কখনো শিশুদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে পুরস্কারের ভিত্তিতে দৌড়ের প্রতিযোগিতা করাতেন যে, দেখবো কে আগে আমাকে ছুঁতে পারে। শিশুরা দৌড়ে আসতো। কেউ তার পেটের ওপর আবার কেউ বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তো। শিশুদের সাথে হাসি তামাশা করতেন। যেমন হযরত আনাসকে কখনো কখনো আদর করে বলতেনঃ ‘ও দুই কান ওয়ালা’। হযরত আনাসের ভাই আবু উমাইরের পালিত পাখির ছানাটি মরে গেলে সে উদাস ভাবে বসেছিল। রাসূল সা. তাদের বাড়ীতে এসে ডাক দিলেনঃ ‘ও আবু উমায়ের, কোথায় তোমার নুগায়ের (পাখির শাবক)? আর এক শিশু আব্দুল্লাহ বিন বশীরের মাধ্যমে তার মা রসূল সা. কে আংগুর পাঠালেন। আব্দুল্লাহ পথেই সব আংগুর খেয়ে ফেললো। পরে যখন বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেল, তখন রসূল সা. আদরের সাথে আব্দুল্লাহর কান ধরে বললেনঃ ‘ياغدرياغدر ওরে ধোকাবাজ, ওরে ধোকাবাজ।’ প্রবাস থেকে আসার পথে যে শিশুকে পথে দেখতেন, সওয়ারীর পিঠে পিঠে চড়িয়ে আনতেন। শিশু ছোট হলে সামনে এবং বড় হলে পেছনে বসাতেন। মৌসুমের প্রথম ফসল ফলমূল আনা হলে তা বরকতের দোয়াসহ কোন শিশুকে আগে খেতে দিতেন। তিনি মনে করতেন এই শিশু ভবিষ্যতে ইসলামী আন্দোলনের নেতা হবে।
বুড়ো মানুষদের খুবই শ্রদ্ধা করতেন। মক্কা বিজয়ের সময় হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. নিজের অন্ধ প্রবীণ পিতাকে ইসলাম গ্রহণের জন্য যখন রসূল সা. এর কাছে নিয়ে এলেন, তখন তিনি বললেনঃ ওঁকে কষ্ট দিয়েছ কেন? আমি নিজেই তাঁর কছে চলে যেতাম।
মহানুভবতার এমন চরম পরাকাষ্টা দেখাতেন যে, মদীনার আধ পাগলী গোছের এক মহিলা যখন এসে বললো, আপনার কাছে আমার কিছু কথা নিভৃতে বলার আছে, তখন তিনি বললেন, বেশ চল, অমুক গলিতে অপেক্ষা কর, আমি আসছি। তারপর সেখানে গিয়ে তার অভাব অভিযোগের কথা শুনে আসলেন এবং তার প্রতিকারও করলেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুনিয়া, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৯৫।] এ ধরনের ঘটনা আদী ইবনে হাতেমও দেখেছিলেন এবং রসূল সা. এর মহানুভবতাকে নবূয়তের আলামত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
রসূল সা. কত অমায়িক ছিলেন এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কত মধুর স্বভাবের পরিচয় দিতেন, হযরত আনাস রা. তার চমৎকার ছবি এঁকেছেন। তিনি বলেনঃ
‘আমি দশ বছর যাবত রসূলের সা. সেবায় নিয়োজিত থেকেছি। তিনি কখনো বিন্দুমাত্র বিরক্তি বা ক্রোধ প্রকাশ করেননি। কোন কাজ যেভাবেই করে থাকি, কখনো বলেননি, এভাবে করলে কেন? আর না করলেও কখনো বলেননি, এটা কেন করলেন না? তাঁর ভৃত্য ও চাকরানীদের সাথেও এ রকমই ব্যবহার করতেন। তিনি কাউকে কখনো প্রহার করেননি।’
হযরত আয়েশা রা. বলেন, তিনি কখনো স্ত্রী বা চাকর চাকরানীদের মারেননি। কারো কাছ থেকে ব্যক্তিগত প্রতিশোধও গ্রহণ করেননি। অবশ্য আল্লাহর পথে জেহাদ করতে গিয়ে কিংবা আল্লাহর আইন অনুযায়ী অপরাধের শাস্তি বিধান করতে গিয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকলে সেটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।
ব্যক্তিগত জীবন
সাধারণত সেই সব লোককেই নেতা বলা হয়ে থাকে, যারা সামষ্টিক জীবনের একটা কৃত্রিম আলখেল্লা পরে থাকেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে যেয়েই সে আলখেল্লা খুলে ফেলেন। বাইরে প্রচুর মহত্ব ও উদারতার মহড়া দেখান, কিন্তু ঘরোয়া জীবনে গিয়েই নেমে যান ইতরামির সর্বনিম্ন স্তরে। লোক সমাজে সরলতা ও বিনয়ের চরম পরাকাষ্ঠা দেখান, আর গৃহে ফিরেই বিলাসিতায় ও আরাম আয়েশে মেতে ওঠেন। সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে কোন ব্যক্তির যত বেশী ব্যবধান ও দূরুত্ব হবে, ততই যেন তার মর্যাদা হবে। অথচ রসূল সা.-এর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন ছিল একই রকম।
এক ব্যক্তি হযরত আয়েশা রা.কে জিজ্ঞাসা করলো, রসূল সা. ঘরোয়া জীবনে কী কী করতেন? তিনি জবাব দিলেনঃ রসূল সা. সাধারণ মানুষের মতই ছিলেন। নিজের কাপড় চোপড়ের তদারকী নিজেই করতেন। (অর্থাৎ পোকামাকড় লাগলো কিনা সেদিকে নজর রাখতেন)। ছাগলের দুধ নিজেই দোহাতেন এবং নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলো নিজেই করতেন। কাপড়ে তালি লাগাতে হলে নিজেই লাগাতেন, জুতো মেরামত করতেন। বোঝা বহন করতেন, পশুকে খাদ্য দিতেন। কোন ভৃত্য থাকলে তার কাজে অংশ নিতেন, যেমন তার সাথে আটা পিষতেন, কখনো একাই পরিশ্রম করতেন, বাজারে যেতে কখনো লজ্জাবোধ করতেন না। নিজেই বাজার সদাই করে আনতেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাধারণত একখানা কাপড়ে বেধে আনতেন। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করেছিল যে, রসূল সা. ঘরোয়া জীবনে কেমন আচরণ করতেন? হযরত আয়েশা জবাবে বলেনঃ সবচেয়ে বিনম্র স্বভাবের, হাসিমুখে প্রফুল্ল আচরণ তিনি করতেন। কেমন বিনম্র স্বভাবের ছিলেন তা বুঝা যায় এই উক্তি দ্বারা যে, ‘কখনো কোন ভৃত্যকে ধমক পর্যন্ত দেননি।’ [আল মাওয়াহিল লাদুন্নিয়া, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৯৩] আপন পরিবার পরিজনের সাথে সহৃদয় আচরণে রসূলুল্লাহর সা. কোন জুড়ি ছিলনা। (সহীহ মুসলিম)
একবার হযরত ইমাম হোসেনের জিজ্ঞাসার জবাবে হযরত আলী রা. বললেনঃ রসূল সা. বাড়ীতে থাকাকালে তিন ধরনের কাজে সময় কাটাতেন। কিছু সময় কাটাতেন আল্লাহর এবাদতে, কিছু সময় দিতেন পরিবার পরিজনকে এবং কিছু সময় বিশ্রামে ব্যয় করতেন। এই তিন সময় থেকেই একটা অংশ সাক্ষাত প্রার্থীদের জন্য বের করতেন। মসজিদের সাধারণ বৈঠক ছাড়াও যদি কোন বন্ধু বান্ধাব একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হতে চাইত কিংবা যদি কোন অতিথি আসতো, অথবা যদি কেউ কোন অভাব অভিযোগ জানাতে আসতো, তবে তাদেরকে তাঁর বিশ্রামের সময় থেকে কিছু সময় দিতেন। এতে করে দেখা যায় যে, তাঁর বিশ্রামের জন্য খুব কম সময় অবশিষ্ট থাকতো। [শামায়েলে তিরমিযী, রসূল (সা) এর বিনয় ও সরলতা সংক্রান্ত অধ্যায়]
স্ত্রীদের খোরপোশ ও বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থাও তাঁকেই করতে হতো। তাছাড়া তাদের শিক্ষা দীক্ষার ব্যবস্থার ভারও তাঁরই কাঁধে ন্যস্ত ছিল। অতপর তাঁদের দ্বারাই মহিলাদের সংশোধনের কাজ চালু রাখা হতো। মহিলারা তাদের নানা সমস্যা নিয়ে আসতো এবং উম্মুল মুমিনীনগণের মাধ্যমে তার সমাধান চাইতো। তবুও তিনি বাড়ীর পরিবেশকে একদিকে যেমন নিরস ও একঘেয়ে হতে দেননি, অন্যদিকে তেমনি সেখানে কোন কৃত্রিমতার সৃষ্টি হতে দেননি। তাঁর সংসার একজন মানুষের সংসারের মতই ছিল এবং তার পরিবেশে স্বাভাবিক ভাবাবেগের জোয়ার ভাটা থাকতো। সেখানে অশ্রুও ঝরতো এবং মুচকি হাসিও দীপ্তি ছড়াতো। এমনকি কখনো কখনো কিছু ঈর্ষাকাতরতা জনিত উত্তেজনারও সৃষ্টি হয়ে যেত। উদ্বেগ ও অস্থিরতা যেমন বিরাজ করতো, তেমনি আনন্দের মূহুর্তও আসতো। রসূল সা. যখন বাড়ীতে আসতেন, তখন ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসের মতো আসতেন, এবং এক অপূর্ব প্রশান্তি ও আনন্দের হিল্লোল বয়ে যেত। কথাবার্তা হতো। কখনো কখনো গল্প বলাবলিও হতো। মজার মজার কৌতুক-রসিকতাও চলতো। যেমন হযরত আয়েশা রা. নিজের একটা ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, একবার আমি খামীরা (গোশতের কিমার সাথে আটা দিয়ে রান্না করা এক ধরনের খাদ্য) বানালাম। হযরত সওদাও রা. সেখানে ছিলেন। রসূল সা. আমাদের দুজনের মাঝখানে বসেছিলেন একটা অকৃত্রিম আন্তরিকতার পরিবেশ বিরাজ করছিল। আমি সওদাকে বললাম, খাও। সে অস্বীকার করলো। আমি আবার পিড়াপিড়ী করলাম। সে তবুও বললো, খাবোনা। আমি আরো জিদ ধরে বললাম, তোমাকে খেতেই হবে। সে এবারও খেতে রাযী হলোনা। আমি বললাম যদি না খাও, তবে আমি ঐ খামীরা তোমার মুখে মেখে দেবো। সওদা জিদ বহাল রাখলো্। আমি সত্যি সত্যি খামীরার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠ তুললাম এবং সওদার মুখে লেপ্টে দিলাম। রসূল সা. তা দেখে খুব হাসলেন। তিনি সওদাকে বললেন, তুমিও আয়েশার মুখে লেপ্টে দাও। উভয়ে সমান হয়ে যাক। সওদাও তৎক্ষণাত আয়েশার মুখে মেখে দিল। এবার রাসূল সা. আবারও হাসলেন। [আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৯৬-২৯৭]
একবার আবু বকর রা. এসে দেখেন, আয়েশা রসূল সা. এর সাথে জোরে জোরে কথা বলছেন। আবু বকর রা. রেগে গিয়ে তাকে প্রহার করতে উদ্যত হলেন। রসূল সা. তাকে শান্ত করলেন এবং বললেন, আমাদের মধ্যে কোন রাগারাগি হয়নি। তবুও হযরত আবু বকর রাগ নিয়েই চলে গেলেন। তিনি যাওয়ার পর রসূল সা, হযরত আয়েশাকে তীর্যক স্বরে বললেন, দেখলে তো কিভাবে আমি তোমাকে রক্ষা করলাম?
ঘরোয়া জীবনের এই স্বাভাবিক উত্থান পতনকে কেউ কেউ ইসলামী আদর্শের চেয়ে নীচু মানের মনে করেন। বিশেষত রসূল সা. এর পারিবারিক জীবনের এমন একটা ছবি তারা অন্তরে পোষণ করেন, যেন সেখানে কতিপয় অতিমানবীয় সত্তা বাস করতো, যাদের কোন ভাবাবেগ বা কামনা বাসনা ছিলনা। অথচ সে পরিবারটাও মানুষেরই পরিবার ছিল। তাদের মধ্যে যাবতীয়, মানবীয়, ভাবাবেগ বিদ্যমান ছিল। তবে ঐ পরিবারটায় আল্লাহর নাফরমানী বা পাপের অস্তিত্ব ছিলনা। এদিক থেকে ওটা ছিল আদর্শ পরিবার। রাতের বেলা যখন রসূল সা. ঘুমাতে যেতেন, তখন পরিবার পরিজনের সাথে তাঁর সাধারণ কথাবার্তা হতো। কখনো ঘরোয়া বিষয়ে, আবার কখনো সাধারণ মুসলমানদের সমস্যাবলী নিয়ে। এমনকি কখনো কখনো গল্পও শোনাতেন। একবার তিনি হযরত আয়েশাকে উম্মে যারার গল্প বলেন। এই কাহিনীতে এগারো জন মহিলা পরস্পরের কাছে নিজ নিজ স্বামীর স্বভাব চরিত্র বর্ণনা করে। এদের মধ্যে এক মহিলা ছিল ‘উম্মে যারা’। সে তার স্বামী আবু যারা‘র মনোমুগ্ধকর চরিত্র বর্ণনা করে। সাহিত্যিক দৃষ্টিতে এটা বড়ই মজার কাহিনী। উপসংহারে রসূল সা. হযরত আয়েশাকে বলেন, উম্মে যারার জন্য আবু যারা যেমন ছিল, আমিও তোমার জন্য তেমনি। অনুরূপভাবে আর একবার কোন এক মজলিসে তিনি একটা গল্প শোনালেন। শ্রোতাদের মধ্য থেকে এক মহিলা বলে উঠলো, এতো ‘খুরাফার’ গল্পের মত। খুরাফা আরবের এক ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি বহু সংখ্যক চমকপ্রদ কিসসা কাহিনী লিখে গেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। রসূল সা. ঐ মহিলাকে বললেন, খুরাফা কে ছিল তা জান? অতঃপর তিনি এই খোরাফা নামক খ্যাতনামা ব্যক্তির কাহিনীও শোনালেন। বনু আযরা গোত্রের এই ব্যক্তিকে জিনেরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল এবং পরে আবার ফেরত দিয়ে গিয়েছিল। [শামায়েলে তিরমিযী]।
রসূল সা. এর আজীবন এই অভ্যাস ছিল যে, রাতের শেষার্ধে প্রথম দিকে তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠে ওযূ ও মেছওয়াক করার পর তাহাজ্জুদ পড়তেন। [যাদুল মায়াদ]। কোরআন খুব ধীরে ধীরে পড়তে গিয়ে নামাযে কখনো কখনো এত দীর্ঘ কেয়াম (দাঁড়িয়ে থাকা) করতেন যে, পা ফুলে যেত। [তিরমিযীঃ ইবনুল মুসাইয়েব কর্তৃক বর্ণিত।] সাহাবাগণ তাঁর এই কষ্ট দেখে বলতেন, আল্লাহ তো আপনার আগে পাছের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। তবুও আপনি এত কষ্ট কেন করেন। রসূল সা. বললেন, তাই বলে আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবনা? [যাদুল মায়াদ]
গৃহ ও গৃহের আসবাবপত্র সম্পর্কে রসূল সা. এর দৃষ্টিভংগী ছিল এরূপ যে, দুনিয়ার জীবনটা একজন পথিকের মত কাটানো উচিত। তিনি বলেন, আমি সেই পথিকের মত, যে কিছুক্ষণের জন্য গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করে, অতঃপর নিজের গন্তব্য স্থলের দিকে রওনা হয়ে যায়। অর্থাৎ যারা আখেরাতকে গন্তব্যস্থল রূপে গ্রহণ করে, দুনিয়ার জীবনকে কেবল কর্তব্য সম্পাদন বা পরীক্ষার অবসর মনে করে কাটিয়ে দেয়, এবং যাদের এখানে বসে উচ্চতর লক্ষ্য জান্নাত লাভের জন্য কাজ করতে হবে, তাদের বড় বড় গগনচুম্বী বাড়ীঘর বানানো, সেগুলোকে আসবাবপত্র দিয়ে ভরে তোলা, এবং প্রাণ ভরে আরাম আয়েশ উপভোগ করার সুযোগ কোথায়? এ জন্য তিনিও তাঁর সাহাবীগণ উঁচুমানের বাড়ীঘরও বানাননি। সেগুলোতে আসবাবপত্রও জমা করেননি এবং সেগুলোর সাজসজ্জা ও জাকজমক বাড়াননি। তাঁদের বাড়ীঘর উত্তম মুসাফির খানা ছিল বলা যায়। [যাদুল মায়াদ] ঐ সব বাড়ীতে শীত ও গরম থেকে আত্মরক্ষা, জীব জানোয়ার থেকে নিরাপত্তা ও পর্দাপুশিদার ভালো ব্যবস্থা ছিল। তা ছাড়া স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। রসূল সা. মসজিদে নববীর সাথে সংশ্লিষ্ট ছোট ছোট কক্ষ স্বীয় স্ত্রীদের জন্য তৈরী করিয়েছিলেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ছাড়া আর কোন সাজসজ্জা তাতে ছিল না। পরিচ্ছন্নতার রুচি রসূল সা. এর এত তীব্র ছিল যে, সাহাবীদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন নিজ নিজ বাড়ীর আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখে। [তিরমিযী]
তৈজসপত্রের মধ্যে কয়েকটি ছিল একেবারেই সাদা ধরনের। যেমন একটা কাচের পেয়ালা, যার ওপর লোহার পাত লাগানো ছিল। পানাহরে এটা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো। খাদ্য সম্ভার সঞ্চয় করা তো দূরের কথা, দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের মত খাবারও থাকতোনা। খেজুরের ছাল ভর্তি চামড়ার তোষক ছিল তাঁর বিছানা। বানের তৈরী চৌকি এবং টাটের তৈরী বিছানাও ব্যবহার করতেন। এই বিছানা দু’ভাজ করে বিছানো হতো। একবার চারভাজ করে বিছানো হলে সকাল বেলা সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন, আজকে বিছানায় এমন আরামদায়ক কী ব্যবস্থা ছিল যে, আমার গাঢ় ঘুম হয়েছে এবং তাহাজ্জুদ ছুটে গেছে? যখন আসল ব্যাপারটা জানতে পারলেন, তখন বললেন, বিছানাকে আগের মতো দু’ভাজ করে রেখে দাও। মাটিতে চাটাই বিছিয়ে শোয়ার অভ্যাসও ছিল। একবার চৌকির কাঠের দাগ শরীরে দেখে রসূল সা. এর কতিপয় সাহাবী (হযরত ওমর ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ) কেঁদে ফেলেছিলেন। [শামায়েলে তিরমিযী]
আর একবার নগ্ন চৌকিতে শুয়ে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গেছে দেখে হযরত ওমরের চোখে পানি এসে গেল। রসূল সা. তাঁর চোখে তাঁর চোখে পানি আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে হযরত ওমর বললেন, রোম ও ইরানের সম্রাটরা ভোগবিলাসে মত্ত আর আপনার এই অবস্থা! রসূল সা. বললেন, ‘ওমর! তুমি কি এতে খুশী নও যে, তারা দুনিয়া নিয়ে যাক, আর আমরা আখেরাত লাভ করি?
পানাহার
রসূল সা. পানাহার রুচিটা ছিল অত্যন্ত ছিমছাম ও ভদ্রজনোচিত। তিনি গোশতের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। সবচেয়ে বেশী পছন্দ করতেন পিঠ, উরু ও ঘাড়ের গোশত। পাশের হাড়ও তার বিশেষ প্রিয় ছিল। গোশতের ঝোলের মধ্যে রুটি টুকরো টুকরো করে ভিজিয়ে রেখে ‘ছারীদ’ নামক যে উপাদেয় আরবীয় খাবার তৈরী করা হতো, সেটাও তিনি খুবই পছন্দ করতেন। অন্যান্য প্রিয় খাবারের মধ্যে মধু, সের্কা ও মাখন ছিল অন্যতম। দুধের সাথে খেজুর খেতেও ভালোবাসতেন। (এটা একটা চমৎকার পুষ্টি খাদ্যও বটে।) মাখন মাখানো খেজুরও তাঁর কাছে একটা মজাদার খাবার ছিল। রোগীপথ্য হিসাবে ক্যলরিযু্ক্ত খাদ্য পছন্দ করতেন এবং অন্যদেরকেও খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। প্রায়ই জবের ছাতু খেতেন। একবার বাদামের ছাতু খেতে দেয়া হলে তিনি এই বলে প্রত্যাখ্যান করলেন যে, এটা বিত্তশালীদের খাদ্য। বাড়ীতে তরকারী রান্না হলে প্রতিবেশীর জন্য একটু বেশি করে তৈরী করতে বলতেন।
পানীয় দ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল মিষ্টি পানি এবং তা বিশেষ যত্নের সাথে দু’দিনের দূরত্ব থেকে আনানো হতো। পানি মেশানো দুধ ও মধুর শরবতও সাগ্রহে পান করতেন। মাদক নয় এমন খেজুরের নির্যাসও পছন্দীয় ছিল। মশক বা পাথরের পাত্রে পানি ঢেলে খেজুর ভেজানো হতো এবং তা এক নাগাড়ে সারা দিন ব্যবহার করতেন। কিন্তু এভাবে বেশিক্ষণ রাখা হলে মাদকতার সৃষ্টি হতে পারে, এই আশংকায় ফেলে দিতেন। আবু মালেক আশয়ারীর বণর্না অনুসারে তিনি বলেছেনও যে, আমার উম্মতের কেউ কেউ মদ খাবে, কিন্তু তার নাম পাল্টে নাম রাখবে। (ইতিহাস সাক্ষী যে, পরবর্তী কালের শাসকরা ফলের নির্যাস নামে মদ খেতো।)
এক এক ব্যক্তির আলাদা আলাদাভাবে খাওয়া দাওয়া করা পছন্দ করতেন না। একত্রে বসে খাওয়ার উপদেশ দিতেন। চেয়ার টেবিলে বসে খাওয়া দাওয়া করাকে নিজের বিনয়ী স্বভাবের বিপরীত মনে করতেন। অনুরুপভাবে দস্তরখানের উপর ছোট ছোট পেয়ালা পিরিচে খাবার রাখাও নিজের রুচি বিরোধী মনে করতেন। স্বর্ণরৌপ্যের পাত্রকে একেবারেই হারাম ঘোষণা করেছেন। কাঁচ, মাটি, তামা ও কাঠের পাত্র ব্যবহার করতেন। দস্তরখানের ওপর হাত ধোয়ার পর জুতো খুলে বসতেন। ডান হাত দিয়ে নিজের সামনের দিক থেকে খাবার তুলে নিতেন। পাত্রের মাঝখানে হাত রাখতেন না। হেলান দিয়ে বসে পানাহার করার অভ্যাস ও তাঁর ছিল না। কখনো দুই হাঁটু খাড়া করে এবং কখনো আসন গেড়ে বসতেন। প্রতি গ্রাস খাবার মুখে তোলার সময় বিছমিল্লাহ পড়তেন। যে খাদ্যদ্রব্য অপছন্দ হতো কোন দোষ উল্লেখ না করেই তা বাদ দিতেন। বেশী গরম খাবার খেতেন না। কখনো কখনো রান্না করা খাবার ছুরি দিয়ে কেটে খেতেন। তবে এটা তাঁর কাছে কৃত্রিমতা ও আড়ম্বর মনে হতো এবং এটা তেমন ভালবাসতেন না। [বুখারী ও মুস্লিম (আমর বিন উমাইয়া কর্তৃক বর্ণিত) আবু দাউদ ও বায়হাকী (হযরত আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত)।] রুটি ইত্যাদি তিনি সব সময় আঙ্গুল দিয়ে ধরতেন এবং আঙ্গুলে তরকারী ইত্যাদি লাগাতে দিতেন না। কখনো কখনো ফলমূল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা হাটা চলা করা অবস্থায় খেতেন না। দুটো ফল এক সাথেও খেতেন–যেমন এক হাতে খেজুর অপর হাতে তরমুজ ইত্যাদি। খেজুরের আটি বাম হাত দিয়ে ফেলে দিতেন। দাওয়াত কখনো ফেরত দিতেন না। যদি অন্য কেউ ঘটনাক্রমে তাঁর সাথে থাকতো (আলাপরত থাকার কারণে বা অন্য কোন কারণে) তবে তাকে সাথে নিয়ে যেতেন ঠিকই, কিন্তু বাড়ীওয়ালার কাছ থেকে তার জন্য অনুমতি নিতেন। কোন মেহমানকে খাওয়ালে বারবার তাকে বলতেন যে, লজ্জা শরম বাদ দিয়ে তৃপ্তি সহকারে খাও। খাবার মজলিস থেকে ভদ্রতার খাতিরে সবার শেষে উঠতেন। অন্যদের খাওয়া আগে শেষ হলে তিনি ও দ্রুত শেষ করে তাদের সাথে উঠে যেতেন। খাওয়ার শেষে হাত অবশ্যই ধুয়ে নিতেন এবং আল্লাহর শোকর আদায় এবং জীবিকা ও বাড়ীওয়ালার জন্য বরকত কামনা করে দোয়া করতেন। কোন খাবার জিনিস উপঢৌকন পেলে উপস্থিত বন্ধুদের তাতে শরীক না করে ছাড়তেন না এবং অনুপস্থিত বন্ধুদের অংশ রেখে দিতেন। খাবার মজলিসে একটি দানাও নষ্ট হয় না, এরুপ যত্নসহকারে খেতে সবাইকে প্রশিক্ষণ দিতেন। পানি খাওয়ার সময় ঢক ঢক শব্দ করতেন না এবং সাধারণত তিনবার মুখ সরিয়ে শ্বাস নিয়ে খেতেন। প্রতিবার বিছমিল্লাহ বলে আরম্ভ ও আলহামদুলিল্লাহ বলে শেষ করতেন। সাধারণত বসে পানি খাওয়াই তাঁর নিয়ম ছিল। তবে কখনো কখনো দাঁড়িয়েও পানি পান করেছেন। মজলিসে কোন পানীয় জিনিস এলে সাধারণতঃ ডান দিক থেকে পরিবেশন শুরু করতেন। যেখানে একটা জিনিসের পরিবেশন শেষ হতো, সেখান থেকেই পরবতী জিনিসের পরিবেশন শুরু হতো। বেশী বয়স্ক লোকদের অগ্রাধিকার দিতেন, তবে ডান দিক থেকে শুরু করা ধারাবাহিকতায় যাদের প্রাপ্য, তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই ধারাবাহিকতা ভংগ করতেন। বন্ধুদের কিছু পান করালে নিজে সবার শেষে পান করতেন এবং বলতেন, ‘যে পান করায় সে সবার শেষে পান করে’। খাদ্য পানীয়ে ফু দেয়া ঘ্রাণ নেয়া অপছন্দ করতেন। মুখের দুর্গন্ধ অপছন্দীয় ছিল বিধায় কাঁচা পেয়াজ ও রশুন খাওয়া কখনো ভালবাসতেন না। খাদ্য পানীয় দ্রব্য সব সময় ঢেকে রাখার নিদেশ দিয়েছেন। নতুন কোন খাবার এলে খাওয়ার আগে তার নাম জেনে নিতেন। বিষ খাওয়ার ঘটনার পর তাঁর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে, কোন অজানা লোক খানা খাওয়ালে প্রথমে এক দু’লোকমা তাকে খাওয়াতেন।
এত তীব্র রুচিবোধের পাশাপাশি বেশীর ভাগ সময় ক্ষুধা ও দারিদ্রের কষাঘাতে জজরিত থাকতেন। এ ব্যাপারে যথাস্থানে বিশদ বিবরণ দেয়া হবে। তিনি বলেছেনঃ ‘আমার খানাপিনা আল্লাহর একজন সাধারণ বান্দর মতই।’
ওঠাবসা ও শয়ন
কখনো আসন গেড়ে বসতেন, কখনো দু’হাত দিয়ে দু’উরুর চার পাশ জড়িয়ে ধরে বসতেন, আবার কখনো হাতের পরিবর্তে কাপড় (চাদর ইত্যাদি) দিয়ে জড়িয়ে রাখতেন। বসা অবস্থায় হেলান দিলে সাধারণত বাম হাতের উপর হেলান দিতেন। কোন বিষয়ে চিন্তা গবেষণা করার সময় একটা কাঠের টুকরো দিয়ে মাটি খোচাঁতে থাকতেন। সাধারণত ডান দিকে কাত হয়ে এবং ডান হাতের তালুর উপর ডান গাল রেখে শুতেন। কখনো কখনো চিত হয়ে ও শুতেন এবং পায়ের উপর পা রাখতেন। তবে সতরের দিকে কঠোরভাবে লক্ষ্য রাখতেন। উপুড় হয়ে শোয়া তীব্রভাবে অপছন্দ করতেন এবং সবাইকে তা থেকে বারণ করতেন। এমন অন্ধকার ঘরে শোয়া পছন্দ করতেন না যেখানে বাতি জ্বালানো হয়নি। খোলা ছাদে শোয়া ভাল মনে করতেন না। ওযু করে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল এবং ঘুমানোর আগে বিভিন্ন দোয়া ছাড়াও সূরা ইখলাস, সূরা নাস ও সূরা ফালাক পড়ে শরীরে ফুঁক দিয়ে নিতেন। ঘুমন্ত অবস্থায় মৃদু নাক ডাকার শব্দ বেরুতো। রাত্রে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলে পবিত্রতা অর্জনের পর হাতমুখ অবশ্যই ধুয়ে নিতেন। ঘুমানোর জন্য আলাদা লুংগী ছিল। গায়ের জামা খুলে ঝুলিয়ে রাখতেন।