খন্দক যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত
খন্দক যুদ্ধ ও মক্কা বিজয়ের মধ্যবর্তী এই দু’বছরে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও ছোট ছোট সামরিক অভিযান সংঘটিত হয়। পরিস্থিতির ধারাবাহিকতার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য এগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেয়া খুবই জরুরী।
ইহুদী জাতির নৈতিক ও মানসিক বিকৃতির নিকৃষ্টতম উদাহরণ ছিল বনু কুরায়যা গোত্র। কু-প্রথা ও কু-কর্ম ছিল তাদের মজ্জাগত স্বভাব ও সর্বব্যপী চরিত্র। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের সাংবিধানিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তার নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও সব ধরনের ষড়যন্ত্র চালিয়ে এবং গোলযোগ সৃষ্টি করে আসছিল। তবে খন্দক যুদ্ধে খোলাখুলি চুক্তি লংঘন করে হানাদার শত্রুদের সাথে গাঁটছড়া বাধা ছিল তাদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা সুলভ কাজ। এ অপরাধের সাথে জড়িতদেরকে মৃত্যুদন্ড দেয়া কোন যুগে ও কোন দেশেই অন্যায় বা যুলুম বলে বিবেচিত হতে পারেনা। তারা রসূল সা., ইসলামী দল, ইসলামী আন্দোলন ও মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার কোন চেষ্টাই বাদ রাখেনি। তাই তাদেরকে সমুচিত শাস্তি না দেয়ার কোনই যুক্তি ছিলনা। হানাদার কোরায়েশ ও তাদের মিত্রদের বাহিনীগুলো বিদায় হওয়ার পর রসূল সা. ও মুসলমান সেচ্চাসেবকগণ সকালে খন্দকের ঘাঁটিগুলো ত্যাগ করে নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে গেলেন। অস্ত্র রেখে রসূল সা. গোসল করলেন। ঠিক এই সময়ে তাঁর কাছে ওহি এল, বনু কুরায়যার দিকে রওনা হয়ে যাও। এখনো মোজাহেদরা যুদ্ধের পোশাকও খোলেনি, এমতাবস্থায় তাদেরকে একটা নতুন অভিযানে ডাকা হলো। মুসলিম বাহিনী এই বিশ্বাসঘাতক গোত্রটাকে অবরোধ করলো। এ অবরোধ অব্যাহত থাকলো এক নাগাড়ে ২৫ দিন। ঠিক এই নাজুক মুহূর্তেও তারা দুর্গের ওপর থেকে রসূল সা. কে গালি দিল। অবশেষে বনু কুরায়যা অস্থির হয়ে উঠলো। তাদের সরদার কা’ব বিন আসাদ উৎকন্ঠা থেকে উদ্ধর পাওয়ার জন্য কয়েকটা প্রস্তাব মুসলমানদের কাছে পেশ করলো। কিন্তু মুসলিম বাহিনী এর কোনটাই গ্রহণ করলোনা। অবশেষে বাধ্য হয়ে তারা বিনাশর্তে ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পন করলো। রসূল সা. তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করে তাদেরই সম্মতিক্রমে সা’দ বিন মুয়াযকে সালিশ নিয়োগ করলেন। উভয় পক্ষ থেকে সা’দকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হলো। সা’দ ইহুদীদের কিতাব তাওরাতের বিধান অনুসারে রায় দিলেন যে, বনু কুরায়যার সকল যুবক পুরুষকে হত্যা করা হোক। এভাবে একটা কুচক্রী গোষ্ঠীর সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি খর্ব করা হলো। উল্লেখ্য যে, এহেন চরম তিক্ততার মুহূর্তেও বনু কুরায়যার এক ব্যক্তি উমর বিন সা’দ ইসলাম গ্রহণ করে। এই সৎ ব্যক্তি বনুকুরায়যাকে চুক্তি লংঘন করতে বারবার নিষেধ করেছিল। কিন্তু তারা তার কথায় কর্ণপাত করেনি।
এ ঘটনার পর ইসলামের দুর্ধর্ষ কুচক্রী শত্রুদের একজন আবু রাফে আব্দুল্লাহ বিন আবুল হাকীক(যাকে সাল্লামও বলা হতো) সিরিয়ার কতিপয় খাজরাজী যুবকের হাতে নিহত হয়। সে খন্দক যুদ্ধে কাফেরদের পক্ষে সৈন্য সংগ্রহের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছিল।
মুহাম্মদ বিন মুসলিমা আনসারী যখন ৩০ ঘোড়া সওয়ার জওয়ানকে সাথে নিয়ে সীমান্ত টহলে নিয়োজিত ছিলেন, তখন তার সাথে নাজদ অঞ্চলের সরদার ছামামা বিন আছালের সাথে সংঘর্ষ বেঁধে গেল। ছামামাকে মদিনা অভিমুখে যেতে দেখে ঐ সেনাপতি তাকে গ্রেফতার করেন এবং রসূল সা. এর কাছে নিয়ে আসেন। সে রসূল সা. কে বললোঃ “হে মুহাম্মদ, আমাকে যদি তুমি হত্যা কর, তবে তুমি জানবে যে হত্যার যোগ্য ব্যক্তিকেই হত্যা করেছ। আর যদি ছেড়ে দাও, তবে জানবে যে, অনুগ্রহের কদর দিতে জানে এমন ব্যক্তিকেই ছেড়ে দিয়েছ। আর যদি তুমি অর্থ সম্পদ চাও তবে পরিমান বল দেয়া হবে।” রসূল সা. তাকে সসম্মানে ছেড়ে দিলেন। সে এই অনুগ্রহে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলো। ইসলাম গ্রহণ করার পর সে অকপটে স্বীকার করলো যে, “আজকের পূর্বে আমার কাছে মুহাম্মদ সা. এর চেহারার চেয়ে ঘৃণিত আর কারো চেহারা ছিলনা, আর আজ তাঁর চেহারার চেয়ে প্রিয় কোন চেহারা আমার কাছে নেই।” এভাবে নাজদের মত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অঞ্চলে ইসলামের জন্য পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল।এই ছামামাই মক্কায় গিয়ে কোরায়েশকে চ্যালেঞ্চ করেছিল যে, এখন তোমরা এক দানাও খাদ্যশস্য পাবেনা।
হযরত খুবায়েব সহ সাত সদস্যের শিক্ষক দলকে হত্যাকারী রজীবাসীকে শাস্তি দেয়ার জন্য রসূল সা. দু’শো ঘোড়াসওয়ার জওয়ানকে নিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু তারা পালিয়ে গেল এবং কোন সংঘর্ষ ছাড়াই তিনি ফিরে এলেন। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে রসূল সা. দশজনকে টল দিতে ‘কুরাউন নাঈম’ পর্যন্ত পাঠালেন, যাতে কোরায়েশরা বুঝতে পারে যে, মদিনা অত্যন্ত সজাগ।
মদিনা থেকে এক মনযিল দূরে বনু গিতফানের অঞ্চলের দিকে ‘যী কিরদ’ নামক একটা জলাশয় রয়েছে। এর কাছেই মদিনার সরকারী উট ও গবাদি পশুর চারণ ক্ষেত্র ছিল। উসফানের এক ব্যক্তি সেখানে রাখাল হিসেবে নিয়োজিত ছিল। রসূল সা. রাবাহ নামক এক ভৃত্যকে খোঁজখবর নেয়ার জন্য পাঠালেন। সালমা ইবনুল আকওয়া সামরিক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনিও (কেন্দ্রস্থলে যাচ্ছিলেন। সকাল বেলা তারা যখন পথিমধ্যেই ছিল, তখন উয়াইনা বিন হিসন ফিযারী (বা আবদুর রহমান বিন উয়াইনা) ও তার সাথী একদল ডাকাত উটগুলোকে লুন্ঠন করলো এবং হাঁকিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। ডাকাত সরকারী রাখালকে হত্যা করলো এবং তার স্ত্রীকেও অপহরণ করে নিয়ে চললো। সালমা ইবনুল আকওয়া এই নৃশংস হত্যা ও লুটপাটের দৃশ্য দেখে মদিনার দিকে মুখ ফিরিয়ে “ইয়া সাহাবা” বলে উচ্চস্বরে হাঁক দিলেন এবং রাবাহকে সাহায্য আনার জন্য পাঠালেন। এদিকে নিজে একাকী ডাকাতদের ধাওয়া করে ছুটে গেলেন। ডাকাতদের পেছন থেকে হাঁক দিয়ে তীর মেরে মেরে এক এক ডাকাতকে ধরাশয়ী করতে করতে তিনি এগিয়ে গেলেন। তীরের আঘাতে যখনই একজন ডাকাত ধরাশয়ী হয়, তখন তিনি চিৎকার করে বলেন, “আমি ইবনুল আকওয়া। আজ পরীক্ষার সময় যে, কে তার মায়ের বুকের দুধ কতটা খেয়েছে।” পথটা ছিল পর্বত সংকুল এবং আশপাশে ছিল গাছগাছালি। ডাকাতরা পেছনে তাকাতেই ইনি আত্মগোপন করতেন এবং তীর নিক্ষেপ করতেন। অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধের কৌশল প্রয়োগ করছিলেন। একবার পাথর মেরে ডাকাতদের এত পর্যুদস্থ করে ফেললেন যে, তারা দিশেহারা হয়ে প্রথমে অপহৃত উটগুলো ছেড়ে দিল, তারপর দেহের বোঝা কমানোর জন্য চাদর ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলতে লাগলো। ওদিকে মদিনা থেকে সালমার সাহয্যের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মেকদাদ বিন আমরকে পাঠিয়ে, অতপর রসূল সা. স্বয়ং একটা সেনাদল নিয়ে রওনা হলেন। কয়েকজন মুসলিম সৈনিক ডাকাতদের একবারে কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলে ডাকাতরা আরো দ্রুতগতিতে ছুটতে লাগলো। এই মুসলিম সৈনিকদের মধ্যে মেহরায় বিন নাযলা ওরফে আখরমকে হয়তো শাহাদাতের নেশায় পেয়ে বসেছিল। তিনি একাকী ডাকাতদের পিছু ধাওয়া করে অনেক দূরে চলে গেলে ডাকাতরা তার সাথে যুদ্ধ শুরু করে দিল। আখরাম শহীদ হলেন। এরপর আবু কাতাদা একজন বড় ডাকাতকে হত্যা করলেন। হযরত সালমা বিন আকওয়া আরো ধাওয়া করতে থাকলেন এবং ঘোড়াগুলো কেড়ে নিয়ে ফিরে এলেন। এসে রসূল সা. এর সাথে দেখা করে বললেন, আপনি একশো সৈনিক যদি আমার সাথে দিতেন, তবে আমি ওদের সবাইকে খতম করে আসতাম। রসূল সা. বললেন, “আল্লাহ যখন তোমাকে বিজয়ী করেছেনই, তখন এবার নমনীয় হও।” এই সাহাবীদের বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখুন। প্রত্যেকের মধ্যে যেন বিদ্যুত প্রবাহিত। তাদের ভূমিকা ও চরিত্র সাধারণ দাঙ্গাবাজ লোকদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারা একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্যের জন্য প্রাণপ্রণ সংগ্রাম করতেন। সেই লক্ষ্যের সাথে তাদের এমন প্রেম ছিল যে, কোন পুরস্কার প্রপ্তির প্রতিশ্রুতি ছাড়াই তারা জীবনের ঝুঁকি নিতে পারতেন এবং যে যুদ্ধেই নামতেন, প্রতিপক্ষকে চোখ না দেখিয়ে ছাড়তেন না।
একটা টহল দল উক্কাশা বিন হিসন আযদীর নেতৃত্বে সীমান্ত প্রহরা দিতে বেরুলেন। গুজব রটেছিল যে, বনী আসাদ গোত্র মদিনা আক্রমণ করার জন্য সমবেত হচ্ছে। মুসলিম সেনাদল যখন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে পৌঁছল তখন ষড়যন্ত্রকারীরা নিজ নিজ বাড়ীঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। চারণভূমি থেকে মুসলিম সৈন্যরা তাদের দু’শো উট বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে এলেন।
৬ষ্ঠ হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে মুহাম্মদ বিন মোসলেমার নেতৃত্বে একটা শিক্ষামূলক ও দাওয়াতী দল বনু সালাবা গোত্রের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তারা যিল কুচ্ছা’ নামক স্থানে পৌঁছলে রাতের বেলা ঘুমন্ত অবস্থায় তাদেরকে শহীদ করে দেয়া হয়। কেবল দলনেতা মুহাম্মদ বিন মোসলেমা নিদারুন আহত অবস্থায় বেঁচে যান। একজন মুসলমান তাকে ঘাড়ে করে মদিনায় পৌঁছে দেয়। রবিউস সানী মাসে হযরত আবু উবায়দা রা. চব্বিশজন সৈন্য নিয়ে অপরাধীদেরকে শস্তি দিতে রাতের বেলা রওনা হলেন এবং খুব ভোর বেলা আক্রমণ চালালেন। নৈরাজ্যবাদীরা পালিয়ে গেল এবং তাদের সকল সহায়-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো।
যায়েদ বিন হারেসা একটা টহল দল নিয়ে (বাতনে নাখলার কাছে অবস্থিত) জামুহের দিকে গেলেন। এখানে ছিল বনু সুলাইমের পল্লী। তারা পরস্পরে যুদ্ধরত দু’টো পক্ষ। একে অপরের ক্ষতি সাধনের কোন সুযোগই হাত ছাড়া করতোনা। তাছাড়া হালিমা নাম্নী এক মহিলা তাদের সম্পর্কে গোয়েন্দাগিরিও করেছিল। টহল দল হালকা ধরনের আক্রমণ চলিয়ে তাদের কতিপয় ব্যাক্তিকে গ্রফতার ও কিছু গবাদী পশু হস্তগত করলো। পরে রসূল সা. গ্রেফতারকৃত ব্যাক্তিদের সবাইকে মুক্তি দিলেন। কেননা হালিমা ভূল তথ্য জানিয়েছিল।
যায়েদ বিন হারেসা (নিজে বাদে) ১৪ জনের একটা ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে যিল কুচ্ছার অপরাধীদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য বনু সালমার জলাশয়ের দিকে চলে গেলেন। অপরাধীরা পালিয়ে যায়। তাদের ২০টা উট বাজেয়াপ্ত করা হয়। দুমাতুল জান্দালের রাজনৈতিক অর্থেনৈতিক ও সামরিক গুরুত্বের বিষয় আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। অতিমাত্রায় কেন্দ্রীয় গুরুত্বসম্পন্ন এ জায়গাটা এখনো ঝুঁকির মধ্যে ছিল। রসূল সা. প্রথমে ওদিকে মনোযোগ দিলেও ইপ্সিত লক্ষ্য পূর্ণ না করেই ফিরে এসছিলেন। এবার হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফকে দাওয়াতী কাজে দুমাতুল জান্দাল পাঠানো হলো। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রথমে স্থানীয় বড় গোত্রের খৃষ্টান নেতা আসম বিন আমর কালবী এবং তার সাথে সাথে গোটা খৃষ্টান গোত্র মুসলমান হয়ে গেল। গোত্রের নেতা স্বীয় কন্যা তামাযুরকে হযরত আব্দুর রহমান বিন আওফের সাথে বিয়ে দিল। এভাবে সে ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে নিজের রাজনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করে নিল।
ফিদক থেকে মদিনায় খবর এলো যে, বনু সা’দ বিন বকর গোত্রটি সামরিক শক্তি সংগ্রহ করেছে, যাতে ইসলামী সরকারের ক্ষথি সাধনে খয়বরের ইহুদীদেরকে সাহায্য করা যায়। হযরত আলী দুশো সৈন্য নিয়ে অতি সন্তর্পনে রওনা দিলেন। রাতের বেলা পথ চলতেন এবং দিনে লুকিয়ে থাকতেন। পথিমদ্যে বন সা’দের এক দূতকে খয়বরের দিকে যাত্রারত অবস্থায় পাকড়াও করা হল। সে খয়বরের ইহুদীদের কাছে বার্তা নিয়ে যাচ্ছিল যে, খয়বরের সমস্ত খেজুর বনু সা’সাদকে দিলেই তবে সাহায্য দেয়া হবে। হযরত আলী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে শত্রুকে বিপর্যস্ত করে দিলেন। তারা পালিয়ে গেল। মুসলিম বাহিনীর কো্ন ক্ষয়ক্ষতি হলো না। উপরন্তু তারা বনু সা’দের পশুগুলো ধরে নিয়ে এলেন। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল এই যে, যায়েদ বিন হারেসা নিজের ও অন্যান্য সাহাবীর পুজি নিয়ে সিরিয়ায় বাণিজ্য সফরে যান। ফেরার পথে ওয়াদিউল কুরায় বনুবদর তাদের কাফেলায় ডাকাতি করে। কাফেলার লোক সংখ্যা কম ছিল। তাই ডাকাতরা 9 জনকে শহীদ করে ফেলে একজনকে আহত করে সমস্ত পণ্যদ্রব্য ছিনিয়ে নিল। অবশেষে দু’মাস পর হযরত আবু বকরের নেতৃত্বে অপরাধীদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য একটা সেনাদল পাঠানো হয়। এত কতিপয় ডাকাতি নিহত হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়।
আকল ও উরাইনা নামক দুটো গোত্রের কিছু লোক মদিনায় এসে মুসলমান হয়। কিন্তু নতুন আবহাওয়ায় তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। মদিনার বাইরে সরকারী ব্যবস্থায় তাদেরকে চিকিৎসাধীন রাখা হয়। সুস্থ হলে তারা সরকারী রাখালকে পাড়াও করলো, তার চোখে উত্তপ্ত লোহার শলাকা ঢুকালো, অতপর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পশুগুলোকে নিয়ে পালিযে গেল। রসূল সা. কারজ বিন খালেদ ফেহরীর নেতৃত্বে ২০জন ঘোড় সওয়ার সৈনিকের একটি দল তাদেরকে ধরে আনার জন্য পাঠালেন। তাদেরকে গ্রেফতার করা হলো এবং তাদের ইসলাম পরিত্যাগ, ডাকাতি, হত্যা যুদ্ধ ও নিষ্ঠুর কর্মকান্ডের দায়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলো। তাদের কাছ থেকে ন্যায় সংগতভাবে প্রতিশোধ নেয়া হয়েছিল। নচেত একটা সুসংগঠিত ও জনসমর্থনপুষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে যদি যে কোন লোক এ ধরনের ধৃষ্টতা দেখাতে থাকে, তাহলে সবকিছু তামাশায় পরিণত হয়ে যেতে বাধ্য এবং একদিনের জন্যও কোন প্রশাসন চালানো সম্ভব নয়।
এ সময়কার সবচেয়ে বড় ঘটনা তথা রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পরিস্থিতির ওপর সবচেয়ে সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তারকারী ঘটনা ছিল হোদাইবিয়ার সন্ধি। রসূল সা. ৬ষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে হোদাইবয়া নামক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। ওখানে কোরায়েশদের সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করে তিনি সবচেয়ে বড় শত্রুর দিক থেকে নিশ্চিত হয়ে যান এবং দাওয়াতী ও গঠনমূলক কাজ করার জন্য ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। তাছাড়া মদীনার সন্নিহিত অঞ্চলে নৈরাজ্যবাদীদের উচ্ছেদ করা সহজ হয়ে যায়।
হোদাইবিয়া থেকে রসূল সা.জিলহজ্জ মাসে মদিনায় ফিরে আসেন এবং কয়েকদিন পর ৭ই মুহাররম খয়বর রওনা হয়ে যান। খয়বর ইসলাম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় একটা রাজনৈতিক ঘাঁটিও ছিল এবং সামরিক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রও ছিল। খয়বর এর ইহুদীরা শুধু যে ওহুদ যুদ্ধের সময় ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুতামুলক আচরণ করেছিল তাই নয়, বরং খন্দক যুদ্ধেও তারা অত্যান্ত সক্রিয় বিরোধী ভূমিকা পালন করেছিল। খয়বরের যুদ্ধ একটা অসাধারণ ও বড় আকারের যুদ্ধই ছিল। কিন্তু আমি এটা এক একটা মামুলি অভিযান হিসেবে গন্য করেছি এ জন্য যে, এটা বদর, ওহুদ ও খন্দকের পর্যায়ের যুদ্ধ নয় এবং তার ধারাবহিকতাও নয়। এটা একটা ভিন্ন ধরনের সামরিক কার্যক্রম। যেহেতু ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত তখনো আন্তর্জাতিক যুগে প্রবেশ করেনি এবং কোরায়েশ ও আরব জনগনের মত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ও অন্যান্য ধর্মের লোকদেরকে এ দাওয়াতের প্রথম পর্যায়ে সম্বোধন করা হয়নি, তাই খয়বরের ইহুদীদের সাথে এ দাওযাত গ্রহণ না করার কারণে কোন সংঘাত বাধেনি, সংঘাত বেধেছিল তাদের রাজনৈতিক অপরাধের কারণে। এ জন্য তাদের সাথে আচরণ করা হয়েছে রাজনৈতিক যুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে। তারা যখন যুদ্ধে হেরে গেল, তখন তাদের এলাকাকে বিজিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হলো এবং তাদেরকে প্রজার মর্যাদা দেয়া হলো। রসূল সা. এ ধরনের আচরণ শুধু খয়বরেই চালু করেছিলেন আর কোথাও নয়। যাহোক, কোরায়েশদের দিক থেকে নিরাপদ হয়ে যাওয়ার পর খয়বরে আক্রমণ চালানোর পথে আর কোন বাধা থাকলোনা। এত শুধু সেই সব লোককেই অংশ গ্রহণ করতে দেয়া হলো, যারা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জেহাদের আবেগ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করবে। উল্লেখ্য যে, এই অভিযানে মুসলমান মহিলারাও রসূল সা. কে না জানিয়ে যোগদান করেছিল। পরে রসূল সা, যখন জানতে পারলেন, তখন তাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমরা কেন এসছে? তারা যখন জানালো যে তারা মুসলিম যোদ্ধাদের সেবা করার জন্য এসেছে, তখন তিনি সম্মতি দিলেন। এমনকি পরে যুদ্ধলব্ধ গণিমতের অংশও তাদেরকে দিয়েছিলেন। মদিনায় সিবা বিন আরাফতাকে অস্থায়ী শাসনকর্তা নিযুক্ত করে চৌদ্দশো সৈন্য সাথে দিয়ে রসূল সা. রওনা হলেন। ‘রজী’ নামক স্থানে পৌঁছে তিনি শিবির স্থাপন করলেন। মুসলিম সৈন্যরা যখন খয়বরের ইহুদীদের সামনে হঠাৎ করেই আত্মপ্রকাশ করলেন, তখন তারা পালিয়ে দুর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলো। তারপর শুরু হলো যুদ্ধ। উভয় দিক থেকে তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে যুদ্ধ চলতে লাগলো। অবশেষে মুসলমানদের জয় হলো। যুদ্ধ শুরু হয়েছিল নাতাত দুর্গ আক্রমেণর মধ্যে দিয়ে। এবার অবরোধ করা হলো সা’ব দুর্গকে। মুরাহহাব নাম ইহুদী মুসলমানদের কে চ্যালেঞ্জ করলো। আমের ইবনুল আকওয়া তার সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হলেন। তথাপি এ অবরোধ সফল হলো। সবচেয়ে মজবুত ছিল কামূস দুর্গ। রসূল সা. প্রচন্ড মাথা ব্যাথার কারণে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। তিনি বিশেষ ঘোষণার মাধ্যমে হযরত আলীকে রা. এই অভিযানে পাঠালেন। ইহুদী বীর মুরাহহাব যুদ্ধের গান গাইতে গাইতে এগিয়ে এলো। মুহাম্মদ বিন মোসলেমা নিজের ভাই এর হত্যার প্রতিশোধের ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে গেলেন এবং মুরাহহাবের পা কেটে ফেললেন। তার হযরত আলীর রা. তরবারী তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিল। মুরাহহাবের পর এল তার ভাই ইয়াসির। তার সাথে সম্মখে সময়ে এলেন যুবাইর ইবনুল আওয়াম এবং তাকে খতম করে দিলেন। ২০দিন অবরোধের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই দুর্গ মুসলমানদের দখলে এল। হযরত আলীর নেতৃত্বে এই দুর্গ জয় করা হয় বলে তাঁকে ‘খয়বর বিজয়ী’ বলা হয়ে থাকে। ইহুদীরা যখন এই দুর্গ থেকে পালায়, তখন ইসলামের কুখ্যাত শত্রু ইহুদী নেতা হুয়াই বিন আখতাবের কন্যা সফিয়া তার দুজন চাচাতো বোন সহ বন্দী হয়ে আসেন। তিনি একজন গণ্যমান্য গোত্রপ্রধানের কন্যা বিধায় সাহাবীদের সাথে পরামর্শক্রমে রসূল সা. তাকে নিজের পারিবারিক হেফাজতে রাখেন। এরপর ইহুদীরা আযযুবাইর দুর্গে সমবেত হয়। এখানে তিন দিন অবরুদ্ধ থাকার পর বেরিয়ে এসে তারা তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দশজন ইহুদী নিহত হয় এবং কয়েকজন মুসলমান শহীদ হন। শেষ পর্ন্ত এই দুর্গ বিজিত হয়। এবার তিনটে দুর্গ অবশিষ্ট রইল। তা হচ্ছে আল কুতাইবা, আল ওয়াতীহ ও আস-সালেম। ইহুদীদের সমস্ত জনবল ও অর্থবল ঐ তিনটে দুর্গে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেল। মুসলিম বাহিনী চৌদ্দ দিন অবরোধ অব্যাহত রাখলো। অবশেষে কামান চালিয়ে পাথর বর্ষন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। অবরুদ্ধরা যখন জানতে পারলো, তখন আর কোন উপায়ান্তর ছিলনা। তারা আপোষ-আলোচনা চালালো। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো যে, তারা শুধু জীবন নিয়ে পালাতে পারবে। কিন্তু তারা যখন আবেদন জানালো যে, তাদেরকে ক্ষেত ও বাগানের কাজে লাগানো হোক এবং থাকতে দেয়া হোক, তখন রসূল সা. মহানুভবতা দেখালেন এবং সম্মতি দিলেন। অর্ধেক উৎপন্ন ফসলের বিনিময়ে তাদের সাথে বন্দোবস্ত হলো। ফিদিকাবাসী যখন এ বন্দোবস্তের কথা জানলো, তখন তারাও এর জন্য আবেদন জানালো। তাদেরকেও একই ধরনের বন্দোবস্ত দেয়া হলো। এই কার্যক্রমের সময় দুজন ইহুদী যুবক হুয়াইসা ও মাহীসা ইসলাম গ্রহণ করে।
নাতাত দুর্গে অবরোধ চলাকালে খয়বরবাসীর মধ্যে থেকে জনৈক নিগ্রো রাখাল আসওযাদের মধ্যে মানসিক ভাবান্তর উপস্থিত হয়। সে ইহুদীদের কাছে জিজ্ঞেস করে, কার সাথে যুদ্ধ হচ্ছে? তরা বললো, নবুয়তের দাবীদারের সাথে। এই কথা শুনেই তার মনে কৌতুহল জাগে এবং সে রসূল সা. এর কাছে এসে জানতে চায়, আপনার দাওয়াত কী? রসূল সা. ইসলামের তাওহীদের বিস্তারিত বিবরণ তাকে অবহিত করেন। আসওয়াদের মনমগজ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। সে জিজ্ঞেস করে,ইহুদীদের ছাগল ভেড়ার পাল আমার দায়িত্বে রয়েছে। এগুলো কি করি? রাসুল স. ইচ্ছে করলে ইহুদীদের ছাগল ভেড়া দখলে নিয়ে মুসলিম সৈন্যদের রসদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি এই পরিস্থিতিতে আসওয়াদ রাখালকে আমানতদারী বজায় রাখার নির্দেশ দেন। সে রসূলের নির্দেশ অনুসারে ছাগল ভেড়াগুলোকে দুর্গের কাছে নিয়ে যেয়ে পাথর মেরে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। তারপর সে রসূল সা. এর কাছে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলো, আমি যদি যুদ্ধ করে মারা যাই, তাহলে আখেরাতে আমার কী হবে? রসূল সা. তাকে বললেন, জান্নাত পাবে। সে আন্তরিকতার সাথে যুদ্ধ করলো ও শাহাদাত লাভ করলো।
জনৈক নওমুসলিম বেদুঈন খয়বরের যুদ্ধে শরীক হলো। তার জন্য যখন গনীমেতের অংশ নির্ধারণ করা হলো, তখন সে বললো, “হে রসূল, আমি এ জিনিসের লোভে আপনার পেছনে আসিনি, আমি এসেছি যাতে সত্যের পথে জান দিতে পারি এবং জান্নাত পাই।“ রসূল সা, তাকে সুসংবাদ দিলেন যে, তোমার সে উদ্দেশ্যও সফল হবে। অতপর সেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো এবং শাহাদাত লাভ করলো।
খয়বর বিজয়ের অল্প পর যখন আকস্মিকভাবে হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব (হযরত আলীর ভাই) তার বহু সংখ্যক সাথী সমেত আবিসিনিয়া থেকে ফিরে এসে রসূল সা. ও অন্যান্য মুসলিম ভাইদের সাথে মিলিত হলেন, তখন খয়বর বিজয়ের আনন্দ বহুগুণে বেড়ে গেল।
বনু সুলাইম অধ্যূষিত অঞ্চলের খনিগুলোর মালিক হুজ্জাজ বিন আলাত সালামী খয়বরের অবরোধ কালেই মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি খয়বর বিজয়ের পূর্নতা প্রাপ্তির আগে রসূল সা. এর কাছে থেকে অনুমতি নিয়ে দ্রুত মক্কায় যান এবং সেখানে অবস্থানরত হযরত আব্বাসকে খয়বর বিজয়ের আগাম সুসংবাদ জানান।
খয়বরের বিষয়টি নিস্পত্তি হয়ে যাওয়ার পর মুসলিম সৈন্যরা ওয়াদিউল কুরা অভিমুখে রওনা হলো। ওটাও ছিল ইসলামের শত্রুদের একটা জঘন্য আখড়া। ওখানে ইহুদীদের পাশাপাশি কিছু আরবও থাকতো। মুসলিম সৈন্যরা যাওয়া মাত্রই সামনের দিক থেকে পাথর বর্ষণ করা হলো এবং মুদায়াম নামক একজন ক্রীতদাস আহত হলো। রসূল সা. এর পক্ষ থেকে বারবার ইসলামের দাওয়াত দেয়া হতে লাগলো। কিন্তু ওদিক থেকে এক একজন যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো এবং মুসলিম সৈন্যদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে মারা পড়তে লাগলো। এভাবে এক নাগাড়ে এগারো জন আসলো। রাত পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকলো। পরদিন ভোর বেলা চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলো। অতপর পূর্ববর্তী দৃষ্টান্ত সমূহ অনুসারে ওয়াদিউল কুরার অধিবাসীদেরকেও ক্ষেতখামারে ও কৃষি কাজে নিযুক্ত করা হলো এবং তাদের জন্য তাদের মধ্য থেকেই শাসনকর্তা নিয়োগ করা হলো। তায়মার ইহুদীরা যখন এখানকার বন্দোবস্তের কথা জানতে পারলো, তখন তারা স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে সন্ধির আগ্রহ প্রকাশ করলো এবং তাদেরকেও তাদের ভূমিতে কৃষি কাজে নিযুক্ত করা হলো।
এই বিজয়াভিযানের ফলে যে বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি মুসলমানদের দখলে আসে, তার মধ্য থেকে ফিদিক ও খয়বরের ভূমিকে সরকারী খাস ভূমিতে (State Land) পরিণত করা হয়। এ ভূমির লব্ধ সম্পত্তি থেকে রাষ্ট্রের শাসকবর্গ তাদের ওপর নির্ভরশীল লোকজন এবং সমাজের দরিদ্র লোকদের ভরণ পোষণ চালানো হতো। এই খাস জমি সম্পর্কেই কিছু মতভেদ দেখা দিয়েছিল রসূল সা. এর ইন্তিকালের পর। কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এবং দূরদর্শী সাহবীগণ ঐ জমিগুলোকে যথারীতি সরকারী খাস জমি হিসেবেই বহাল রাখেন। অন্যান্য জমি মুসলমানদের মালিকানায় অর্পিত হয় এবং তার ফসল তাদের মধ্যে বন্টিত হয়।
হযরত ওমরের নেতৃত্বে একটা টহলদার সেনাদল বনু হাওয়াযেনকে সতর্ক করতে যায়। ফলে বনু হাওয়াযেন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
বশীর বিন ওয়ারিক (বা উসাইর বিন রাযাম) নামক জনৈক ইহুদী সম্পর্কে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে সে বনু গিতফানকে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচনা দিচ্ছে। আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা একটা সেনাদল নিয়ে গেলেন এবং বশীরকে কোন প্রকারে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাযী করালেন মদিনায় গিয়ে রসূল সা. এর সাথে আলাপ আলোচনা করতে। মুসলমানরা যেহেতু সংখ্যায় ত্রিশ জন ছিল, তাই সেও সতর্কতাবশত ত্রিশজন লোক সাথে নিল এবং প্রত্যেকটা উটের ওপর একজন ইহুদী ও একজন মুসলমান যৌথভাবে আরোহন করলো। বশীর রাতের অন্ধকারে আব্দুল্লাহর তরবারীতে হাত দেয়া মাত্রই তিনি চমকে উঠে উটের ওপর থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন এবং তরবারী কোষমুক্ত করে ওর মুখোমুখী হলেন। উভয় নেতাকে এ অবস্থায় দেখে উভয়ের সাথীরাও লড়াই শুরু করে দিল এবং শেষ পর্যন্ত একত্রিশজন ইহুদী সবাই একে একে নিহত হলো।
সপ্তম হিজরীর মুহাররম মাসে কথা। বনু গিতফান, বনু মুহারিব, বনু ছালাবা ও বনু আনমার- এই চারটে গোত্র মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলো শোনা গেল। রসূল সা. ৪০০ লড়াকু মুসলমানকে সাথে নিয়ে অভযানে বেরুলেন। আক্রমনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এ অভিযানকে বলা হয় “যাতুর রিকা অভিযান”।
হোদাইবিয়ার সন্ধির পর মুসলমানদের জন্য বাণিজ্যিক সড়ক উন্মুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু আবু জান্দাল কোরায়েশদের আটকাবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে যখন মক্কা ছেড়ে পালালেন, তখন ঐ সন্ধি চুক্তির একটা কঠোর ধারার দরুন মদিনা না যেতে পেরে সমুদ্রোপকূলবর্তী একটা সিরীয় পাহাড়ে থাকতে লাগলেন। পরে আবু বছীর ও অন্যান্য মুসলমানরাও তার সাথে যোগ দিতে লাগলো। এভাবে মুসলমানদের রীতিমত একটা সেনাদল গঠিত হয়ে গেল সিরীয় ভূমিতে। তারা কোরায়েশদের একটা কাফেলার ওপর আক্রমন চালিয়ে তার মালামাল কেড়ে নিল। কিন্তু রসূল সা. তাদেরকে মালামাল ফেরত দিতে নির্দেশ দিলে তারা তৎক্ষনাত নির্দেশ মান্য করলো। এবার কোরায়েশ বুঝলো ও অনুতপ্ত হলো যে, সন্ধি চুক্তিতে অমন কঠোর ধারা যুক্ত করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে রসূল সা. আবু জানদালকে মদিনায় ডেকে নেন।
বনু মালুহ বশীর বিন সুয়াইদের সাথীদের হত্যা করলে তাদেরকে সতর্ক করার জন্য আব্দুল্লাহ লাইসী একটা সেনাদল নিয়ে গেলেন। সামান্য সংঘর্ষ হলো এবং শত্রুদের কিছু জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করা হলো।
রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের দরবার থেকে রসূল সা. এর দূত দিহ্য়া কালবী উপঢৌকনাদী নিয়ে মদীনায় ফিরছিলেন। হুনাইদ বিন ইওয়ায জাফরী ডাকাতি করে তার কাছ থেকে সমস্ত উপঢৌকন ছিনিয়ে নেয়। ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এহেন জঘন্য আক্রমণ পরিচালনাকারী হুনায়েদকে শাস্তি দিতে যায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে একটা সেনাদল প্রেরিত হলো। সংঘর্ষে হুনায়েদ নিহত হলো। তবে তার সাথীরা তওবা করে ইসলাম গ্রহণ করলো।
বনু কিলাব বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. বিদ্রোহ দমন করতে সসৈন্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। সংঘর্ষের পর শত্রু সেনারা পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল।
জুহাইনা অঞ্চলে বিদ্রোহের আশংকা দেখা দিলে সে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রনে আনতে উসামা ইবনে যায়েদকে একটা সেনাদলসহ পাঠানো হলো। তিনি প্রথমে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ হলো। এই সময় হযরত উসামা সুহাইক বিন মিরদাসকে ধাওয়া করলে সে কালেমা তাইয়েবা পড়লো। কিন্তু উসামা মনে করলেন, সে পরাস্ত হয়ে জান বাঁচাবার ফন্দি এঁটেছে। তাই তাকে তিনি হত্যা করলেন। পরে ঘটনা শুনে রসূল সা. মর্মাহত হন। কেননা তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে সংশোধন করা হত্যা করা নয়।
খয়বরের ইহুদীদেরকে সাহায্যকারী ফাযারা ও আযরা নিবাসীদেরকে শায়েস্তা করার জন্য বশীর বিন সা’দ খাজরাজীকে ক্ষুদ্র একটা সেনাদলসহ পাঠানো হয়। সামান্য সংঘর্ষেই প্রতিপক্ষ পরাজিত হয়।
বনু সুলাইম মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে- এই মর্মে তথ্য অবহিত হওয়ার পর ইবনে আবিল ইওজাকে পঞ্চাশজন সৈন্যসহ পাঠানো হয়। এখানো শত্রুর সংখ্যা বেশী ছিল।
তারা হামলা করে সমগ্র মুসলিম সেনাদলকে শহীদ করে ফেলে। কেবল সেনাপতি আহত অবস্থায় মদীনায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হন। বনু কুয়াযায় বিদ্রোহ দমনের জন্যও অত্যধিক ক্ষুদ্র সেনাদলসহ কা’ব বিন উমাউর আনসারীকে পাঠানো হলে তারা পুরো মুসলিম দলকে শহীদ করে। কোন একজন সাহাবীও জীবিত ফিরে আসতে পারেনি।
ইসলাম বিরোধী একাধিক শক্তিকে সাহায্য দিয়েছিল বনু হাওয়াযেন। তাদের সম্পর্কে জানা গেল যে, মদীনা থেকে পাঁচ মনযিল দূরে তারা হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শুজা বিন ওহব আসাদীর নেতৃত্বে একটা ক্ষুদ্র দল পাঠানো হলো। কিন্তু তাদেরকে কোন সংঘর্ষে যেতে হয়নি।
এ সময়ে বড় আকারের যে যুদ্ধ সংগঠিত হয় তা হচ্ছে মূতার যুদ্ধ। এটি সংঘটিত হয় ৮ম হিজরীর জমাদিউল আওয়াল মাসে। তবে এ যুদ্ধটা পুরোপুরি একটা বিদেশী শক্তির সাথে সংঘটিত বলে সে সম্পর্কে আমি তবুকের সাথে আলাদাভাবে আলোচনা করবো।
কয়েস বিন রিফায়া সম্পর্কে জানা গেল যে, সে আক্রমণের জন্য সৈন্য সমাবেশ করছে। এ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য মাত্র দু’জনের একটা দলসহ আবু হাদারায়া আসলামীকে পাঠানো হলো। নিছক সুক্ষ্ণ কৌশলে ভীত সন্ত্রস্ত করে তিনি শত্রু সৈন্যদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেন এবং তাদের পশুগুলোকেও বাজেয়াপ্ত করে আনেন। এখানে কোন সংঘর্ষই ঘটেনি।
বনু কুযামা সম্পর্কে খবর পাওয়া গেল যে, তারা অন্যদের সাথে গাঁটছাড়া বেধে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনশো সৈন্য নিয়ে তাদের মোকাবিলায় চলে গেলেন আমর ইবনুল আ’স। যাতুস্ সালাসিল নামক এই জায়গা ওয়াদিউল কুরার পরেই অবস্থিত। এ জায়গাটা বহু বছর যাবত ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক ছিল। যথাস্থানে পৌঁছে জানা গেল যে, শত্রুদের জনবল অনেক বেশী। আমর ইবনুল আ’স দূতের মারফত আরো সৈন্য চেয়ে পাঠালেন। হযরত আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহের নেতৃত্বে আরো দুশো সৈন্য তৎক্ষণাত পৌঁছে গেল। আক্রমণ চালানো সাথে সাথে শত্রু সেনারা পালিয়ে গেল। তাদের ফেলে যাওয়া কিছু গবাদি পশু হস্তগত করা হলো।
আবু কাতাদা ও মুহাল্লাম বিন জুসামা একবার টহল দেয়ার সময় ঘটনাক্রমে আমের ইবনুল আজবাত আশজায়ী কয়েক ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করলো। তারা মুসলমানদের মত সালাম করলো। কিন্তু মুহাল্লাম তাদের সালামকে একটা আত্মরক্ষার কৌশল মনে করলেন এবং শত্রু ভেবে সবাইকে হত্যা করলেন। এই ঘটনায় কোরআন তাদেরকে নিম্নরূপ ভর্ৎসনা করেঃ
বলা হয় টহল দিতে বেরুলে লোকজনকে চিনে নিও এবং কেউ সালাম দিলে অনর্থক তাকে অমুসলিম গণ্য করোনা। রসূল সা. কঠোরভাবে সতর্ক করেন। পরে নিহতে গোত্রের সরদার হত্যার পণের দাবী নিয়ে আসে। রসূল সা. তৎক্ষণাত ৫০টা উট দিয়ে দেন এবং অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে বাকী ৫০টা পরে নিতে রাজী করেন।
৮ম হিজরীর রজব মাসে রসূলের সা. নির্দেশে আবু উবায়দা উবনুল জাররাহ তিনজন সৈনিকসহ সাইফুল বাহর গেলেন এবং কেবল সমুদ্রের তীর পর্যন্ত টহল দিয়ে কয়েকদিন উপকূলবর্তী এলাকায় কাটিয়ে ফিরে এলেন। সম্ভবত সড়কের পর্যবেক্ষণ করা ও কোরায়েশকে এ কথা বুঝানোই উদ্দেশ্য ছিল যে, ইদানিং মদিনা এ দিকেই মনোনিবেশ করেছে। উল্লেখ্য যে, হোদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি কোরায়েশ কর্তৃক ভঙ্গ করার পর মুসলমানদের এইসব তৎপরতা মক্কা বিজয়ের দ্বরোদঘাটন করে।
চতুর্থ বৃহৎ অভিযান-মক্কা বিজয়
এ যাবত আমি কোরায়েশ ও অন্যান্য ইসলাম বিরোধী শক্তির বড় বড় আক্রমণের বিবরণ দিয়েছি। এ বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বদর ওহুদ ও খন্দক এই সব কটা যুদ্ধে জাহেলী শক্তিগুলোই মদিনায় এসে আগ্রাসন চালিয়েছে এবং সব কটা সংঘর্ষ মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের আশেপাশেই সংঘটিত হয়েছে। এ সব সংঘর্ষে মদিনার সরকার নিছক আত্নরক্ষামূলক ভূমিকা অবলম্বন করেছিল। খন্দকের যুদ্ধের পর রসূল সা. নিজের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার আলোকে অত্যন্ত নির্ভুলভাবেই ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, এখন কোরায়েশের আগ্রাসী অভিযানের অবসান ঘটেছে। তিনি এই আভাসও দেন যে, এখন থেকে ইনশায়াল্লাহ আমরাই কোরায়েশদের উপর হামলা চালাবো। মধ্যবর্তী সময় যখন হোদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং কোরায়েশরা মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালানো থেকে বিরত থাকে। তখন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রসূল সা. একদিকে মদিনার বিদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদেরকে কঠোর হস্তে দমন করেন, অপরদিকে উত্তর দিকে ইহুদীরা তাদের শক্তির যে মজবুত কেন্দ্রগুলো স্থাপন করেছিল এবং যে গুলোকে সামরিক চক্রান্ত তৈরির আখড়ায় পরিনত করেছিল, সেগুলোকে উৎখাত করেন। এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন গোত্রের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্রোহ, সামরিক প্রস্তুতি ও ষড়যন্ত্রকে এমন দ্রুত ও কঠোরভাবে প্রতিহত করেন যে, মদিনার পরিবেশ অনেকাংশে নিরাপদ ও পরিষ্কার হয়ে যায়। খন্দকের যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এই বিরতির সময় ইসলামী রাষ্ট্রের দোর্দন্ড প্রতাপ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ইসলাম নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব সকলকে মেনে নিতে বাধ্য করে। সকলেই অনুভব করতে আরম্ভ করে যে, সত্য, ন্যায় ও সুবিচারের এই উদিয়মান শক্তিকে উৎখাত বা প্রতিহত করার ক্ষমতা কারো নেই। সর্ব শ্রেনীর জনতা উপলদ্ধি করে যে, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আর কোরায়েশদের হাতে নেই। বরং মুহাম্মদ সা. এর হাতে চলে গেছে।
এখন শত্রুর হাত থেকে পুরোপুরি ও স্থায়ীভাবে মুক্তি লাভের একটা মাত্র উপায়ই অবশিষ্ট রয়েছে। সেটা হলো, শত্রুর আসল আখড়ার মুলোৎপাটন এবং জাহেলিয়াতের নেতৃত্বের প্রদীপ তার নিজ বাড়িতেই নিভিয়ে দেয়া। এ জন্য প্রতিরক্ষার সংগ্রামকে পূর্ণতা দানের জন্য একদিন না একদিন আক্রমণাত্মক অভিযান চালানো অবধারিত ও অনিবার্য ছিল। এটা ছিল কোরায়েশদেরই কর্মফল যে, তারা নিজেরাই হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে দু’পক্ষের মধ্যকার শান্তি ও নিরাপত্তার প্রাচীর গুড়িয়ে দিয়েছিল।
আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি, বনু বকর ও বনু খুযায়ার মধ্যে আগে থেকেই শত্রুতা চলে আসছিল এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ ও পাল্টা প্রতিশোধের অবিরাম ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। কিন্তু মাঝখানে সহসা ইসলামী আন্দোলন একটা উদ্বেগজনক সমস্যা হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। কোরায়েশ ও অন্যান্য পৌত্তলিক গোত্র নিছক ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হয়। তাদের পারস্পরিক শত্রুতার আগুন সাময়িকভাবে চাপা পড়ে গেল। অবশেষে যখন হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদিত হলো, তখন তার একটা ধারার সুযোগ গ্রহন বনু খুযায়া রসূল সা. এর সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করলো। পক্ষান্তরে বনু বকর মৈত্রী স্থাপন করলো কোরায়েশদের সাথে। কিছুদিন নীরবে কেটে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরানো শত্রুতার বারুদ বিস্ফোরণ ঘটলো। বনু বকর এই আপোষের যুগটাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করলো। কেননা এ সময় অন্য কোন দিক থেকে সংঘাতের আশংকা ছিলনা। তারা বনু খুযায়া গোত্রের একজনকে হত্যা করলো। তারপর জোরদার হামলা চালিয়ে ব্যাপক নির্যাতন নিপীড়ন চালালো। এমন কি হারাম শরীফে আশ্রয় গ্রহনকারী খুযায়ীদেরও তারা অব্যাহতি দিলনা এবং উপসনারত অবস্থায়ও তাদেরকে ক্ষমা করলোনা। বনু বকরের এই রক্তপাতে কোরায়েশরা তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করছিল। এই নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তিকে পদদলিত করলো। বনু খুযায়ার পক্ষ থেকে আমর ইবনে সালেম রসূল সা. এর কাছে গিয়ে বনু বকরের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানালো। অতপর বুদাইল বিন ওয়ারাকা একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে গিয়ে অত্যাচারের বিবরণ দিল। মৈত্রীচুক্তির আলোকে রসূল সা. এর জন্য বনু খুযায়াকে সাহায্য করা অপরিহার্য্য হয়ে হয়ে পড়লো। রসূল সা. কোরায়েশের কাছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তিনটে দাবী জানালেন। এক, নিহত ব্যক্তির জন্য বনু খুযায়াকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে দাও। দুই, বনু বকরের সমর্থন পরিহার কর। তিন, প্রথম দুটো দাবীর বিক্ল্প হিসাবে হোদায়বিয়ার চুক্তি বাতিল হবার ঘোষণা দাও। কোরায়েশরা ভারসাম্য আগেই হারিয়ে ফেলেছিল। তাই তারা জানালো যে, হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি বাতিল করাই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু পরে এ জন্য অনুতপ্ত হয়েছিল।
এবার কোরায়েশ নেতারা দুশ্চিন্তায় পড়লো। লড়াই করার ক্ষমতা তারা আগেই হারিয়ে ফেলেছিল। কয়েকটা যুদ্ধে তাদের মূল্যবান বীরযোদ্ধারা মারা গিয়েছিল এবং তাদের সামরিক শক্তির অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের সামরিক শক্তির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিলো। তাদের অর্থনীতিরও বারোটা বেজে গিয়েছিল। তাদের সাহায্যকারী ইহুদীরা প্রায় সর্বনাশের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। পক্ষান্তরে মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র দাওয়াতী কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজের প্রভাব এত ব্যাপক করে ফেলেছিল যে, মক্কার আশেপাশেও ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থক গোত্রসমূহের একটা বৃত্ত গড়ে উঠেছিল। মৈত্রীর পরিধিও বিস্তৃত করা হয়েছিল। আর নৈরাজ্যবাদী ও বিদ্রোহী শক্তিগোলোকে কঠোরভাবে দমন করে বিশাল এলাকা জুড়ে শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত করত নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছিল। এরপর কোরায়েশের আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেয়া তো দূরের কথা, আত্মরক্ষা করাও কঠিন ছিল। হোদায়বিয়ার সন্ধিই ছিল তাদের একমাত্র রক্ষাকবচ। এই রক্ষাকবচও তারা নিজেরাই বাতিল করে দিয়ে মদিনাকে যেন আহবান জানালো, এস, আমাদেরকে আমাদের কৃতকর্মের শাস্তি দিয়ে যাও।
অবশেষে মক্কার সবচেয়ে বড় কাফের নেতা আবু সুফিয়ান দিশেহারা হয়ে সন্ধি নবায়নের উদ্দেশ্যে মদিনা রওয়ানা হলো। সেখানে সে এমন প্রতিকুল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো যে, তা বোধহয় তার কল্পনায়ও কখনো আসেনি। সে নিজের মেয়ে উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে হাবীবার ঘরে গিয়ে বিছানায় বসতে উদ্যত হওয়া মাত্রই মেয়ে ছুটে এসে বিছানা সরিয়ে নিয়ে বলল, “আপনি মোশরেক থাকা অবস্থায় রসূলের সা. পবিত্র বিছানায় বসতে পারেন না।” তারপর সে একে একে হযরত আবু বকর, ওমর ও আলীর ন্যায় শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতাদের সাথে যেয়ে যেয়ে সাক্ষাত করে এবং প্রত্যেকের কাছে সাহায্য চায়। এমনকি সে হযরত ফাতেমাকে ও রসূল সা. এর কাছে সুপারিশ করার অনুরোধ জানালো। এতেও যখন সে সফল হলোনা, তখন শিশু ইমার হাসানকে সুপারিশ করার অনুমতি দিতে ফাতেমা রা. কে অনুরোধ করলো। কোন কিছুতেই যখন কাজ হলোনা, তখন সে অনন্যোপায় হয়ে হযরত আলীর পরামর্শ মোতাবেক মুসলমানদের সাধারন সভায় নিজের পক্ষ থেকে এক তরফা সহাবস্থানের ঘোষণা করে রসূল সা. এর পক্ষ থেকে কোন জবাবের অপেক্ষা না করেই মক্কায় ফিরে গেল। মক্কাবাসী তার সফরের বিবরণ জানতে চেয়ে যখন এক তরফা সহাবস্থানের ঘোষণার কথা শুনলো, তখন সবাই বললো,“এতো আলী রা. তোমার সাথে তামাসা করেছে।” লক্ষ্য করুন, পতন্মোখ নেতিবাচক লোকদের বুদ্ধিবিবেকও কিভাবে নষ্ট হয়ে যায়।
রসূল সা. কালবিলম্ব না করে ঘোষণা করে দিলেন, মুসলিম সেচ্ছাসেবক দল তৈরী করা হোক। তিনি নিজের ঘরেও অস্ত্র তৈরী করার আদেশ দিলেন। তবে কোথায় কোন দিকে এবারের যুদ্ধ যাত্রা করা হবে, সেটা কাউকেই জানতে দিলেন না। এমনকি হযরত আয়েশাও তা জানতে পারলেন না। অথচ তিনি নিজ হাতেই হযরত রসূল সা. এর জন্য অস্ত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন। তবে অধিকাংশ লোক হয়তো ধারণা করেছিল যে এবার মক্কায় আক্রমণ করা হবে। কেননা এত বিপুল পরিমাণ সৈন্য আর কোথাও নিয়ে যাওয়ার কোন কারণ ছিলনা।
বদর যোদ্ধা হাতেব ইবনে আবি বালতায়ার পরিবার পরিজন তখনো মক্কায় কাফেরদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল এবং কোন গোত্র তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহন করেনি। এ জন্য তিনি তাদের রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে মদিনার প্রস্তুতির পূর্ণ বিবরণ সম্বলিত একটা গোপন চিঠি কোরায়েশদের কাছে পাঠালেন, যাতে তারা তার এই অনুগ্রহের বদলা হিসেব মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর পরিবারকে যে কোন রকম কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকে। এই সাথে তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে, এই গোপন তথ্য সরবরাহ করা সত্ত্বেও মুসলিম বাহিনীর বিজয় সুনিশ্চিত এবং তার চিঠি ইসলামের কোন বড় রকমের ক্ষতি করতে পারবেনা। এ ঘটনা থেকে বুঝা যায় বাহ্যিক পরিবেশ পরিস্থিতি ও মানসিক অবস্থার চাপে পড়ে কখনো অত্যন্ত সৎ লোকের পক্ষ থেকেও মারাত্মক পদস্খলন ঘটে যেতে পারে। রসূল সা. ওহির মাধ্যমে এ চিঠির খবর জানতে পারেন। তাঁর প্রেরিত গোয়েন্দারা মক্কা গমনরত এক মহিলাকে রওযায়ে খাখ নামক স্থানে গিয়ে পাকড়াও করে তার কাছ থেকে ঐ চিঠি উদ্ধার করেন। এত বড় ভ্রান্তি রসূল সা. শুধু এজন্য ক্ষমা করেন যে, হাতেব নিষ্ঠাবান, ঈমানদার, সৎ ও বদরযোদ্ধা সাহাবী ছিলেন এবং এই পদস্খলনটা ছিল তার মানবীয় দুর্বলতা থেকে উদ্ভুত।
রসূল সা. দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে ১০ই রমযান মদিনা থেকে রওয়ানা হলেন। তিনি একজন অসাধারণ কুশলী সমরনায়ক হিসাবে এমন পেচালো রাস্তা ধরে অগ্রসর হন যে, কোরায়েশের যে টহলদার দলটি পর্যবেক্ষনের জন্য বেরিয়েছিল, তারা ঘূর্ণাক্ষরেও কোথাও মুসলিম বাহিনীর সন্ধান পেলনা। এদিকে তারা ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকলো, আর ওদিকে মুসলিম বাহিনী সাবইকে হতবাক করে দিয়ে মক্কার উপকন্ঠে গিয়ে হাজির হলো।
রসূল সা. যখন হাজফা পৌঁছলেন, তখন তার চাচা আব্বাস সপরিবারে এসে তাঁর সাথে মিলিত হলেন। তারপর যখন আবওয়াতে পৌঁছনেল, তখন আবু সুফিয়ান বিন হারেস বিন আব্দুল মুত্তালিব (ইনি রসূল সা. এর আপন চাচাতো ভাই ও বিবি হালিমার মাধ্যমে দুধ ভাই) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমাইয়া ( রসূলের সা. ফুফাতো ভাই ও উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমার সৎ ভাই) হাজির হয়ে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তিনি ঘনিষ্ট আত্মীয় হয়ে ইসলামের বিরোধীতায় রসূল সা. কে এত কষ্ট দিয়েছিলেন যে, রসূল সা. তার সাথে দেখা করতে অস্বীকার করলেন। আবু সুফিয়ান হতাশ হয়ে বললো, যদি ক্ষমা না পাই, তবে আমি আরবের অগ্নক্ষরা মরুভূমিতে ছেলে মেয়েদের নিয়ে চলে যাবো এবং সবাই মিলে ক্ষুধায় পিপাসায় মরে যাবো। হযরত উম্মে সালমা রা. ভাই এর জন্য সুপারিশ করলেন। আর হযরত আলী উভয়কে পরামর্শ দিলেন, হযরত ইউসুফের ভাই এর ভাষায় ক্ষমা চাও। তাই তারা গিয়ে বললোঃ
“আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে আমাদের ওপর অগ্রগণ্য করেছেন, আর আমরা অপরাধী ছিলাম”। এ কথা শুনে রসূল সা. এর মন গলে গেল। তিনিও হযরত ইউসুফের জবাবেরই পুনরাবৃত্তি করলেনঃ
“আজ তোমাদের ওপর কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি দয়াশীলদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দয়ালু”।
‘মারুয যাহরান’ পৌঁছে যখন সেনা শিবির স্থাপন করা হলো, তখন রসূল সা. বৃহত্তর কল্যাণের খাতিরে আদেশ দিলেন যেন প্রত্যেক সৈনিক রাত্রে নিজের জন্য আলাদা আলাদা আগুন জ্বালায়। আবু সুফিয়ান বিন হারব, হাকীম বিন হিযাম ও বুদাইল বিন ওয়ারাকার ন্যায় শীর্ষস্থানীয় নেতারা যখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বেরুলো, তখন পাহাড়ের ওপর থেকে দশ হাজার চুলো জ্বলতে দেখে তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল। ভাবলো, “কি সর্বনাশ, এত বড় সেনাবাহিনী চলে এসেছে মক্কার দোড়গোড়ায়। হযরত আব্বাস তাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি কন্ঠ চিনতে পেরে আবু সুফিয়ানকে কাছে ডাকলেন এবং কথাবার্তা বললেন। হযরত আব্বাস বললেন, “হযরত মুহাম্মাদ সা. আজ তার সমগ্র বাহিনী নিয়ে চলে এসেছেন। আজ কোরায়েশের উপায় নাই”। আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলো, “এখন বাঁচার উপায় কি?” আব্বাস রা. বললেন, “আমার সাথে আমার খচ্চরের ওপর বসে পড়। রসূল সা. এর কাছে গিয়ে কথা বলবে”। খচ্চর সামনের দিকে অগ্রসর হবার সময় কদমে কদমে সৈনিকেরা জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, “কে যাচ্ছে?” হযরত আব্বাস নিজের পরিচয় দিতেই পথ ছেড়ে দেয়া হতে লাগলো। নিকটে গেলে হযরত ওমর রা. দেখে ফেললেন এবং আবু সুফিয়ানকে চিনতে পেরে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “ওহে আবু সুফিয়ান, আজ তোকে মুঠোর মধ্যে পাওয়া গেছে”। বলেই হত্যার অনুমতি নেয়ার জন্য রসূল সা. এর কাছে ছুটে যেতে লাগলেন। হযরত আব্বাসও খচ্চর জোরে ছুটালেন। হযরত ওমর রা. আগে আগে পৌঁছে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন, আর হযরত আব্বাস বললেন, “আমি আবু সুফিয়ানকে আশ্রয় দিয়ে এনেছি”।
এই পর্যায়ে আবু সুফিয়ানের সাথে রসূল সা. এর নিম্নরূপ কথোপকথন হলোঃ
রসূল সা. : “কি হে আবু সুফিয়ান, এখনো কি তোমার বিশ্বাস আসেনি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই?”
আবু সুফিয়ানঃ “আর কোন মা’বুদ থাকলে আজ আমাদের রক্ষা করতো”।
রসূল সা.: “আমি যে আল্লাহর রসূল, সে ব্যাপারে কি কোন সন্দেহ আছে?”
আবু সুফিয়ানঃ “এ ব্যাপারে কিছু সন্দেহ আছে”।
হযরত আব্বাস আবু সুফিয়ানের মনস্তাত্মিক দুর্বলতাকে বুঝতে পেরে বললেন, “আরে ওসব বাদ দাও, সোজাসুজি ইসলাম গ্রহণ করে নাও”। সকাল পর্যন্ত মক্কার প্রধান নেতা পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে মুসলমান হয়ে গেল। এদিকে ইসলামী সেনা শিবির মক্কায় সেনাবাহিনী পৌঁছার আগে আবু সুফিয়ানকে এমন সুকৌশলে আটক করে রেখেছিল যে, সে বুঝতেই পারেনি, সকাল বেলা শহরে প্রবেশের জন্য মুসলিম বাহিনী ‘কাদা’র পথ ধরে মার্চ করে গেল। হযরত আব্বাস রসূলের সা. নির্দেশে আবু সুফিয়ানকে একটা পাহাড়ের ওপর নিয়ে দাঁড় করালেন, যাতে সে মুসলিম বাহিনীকে এক নজর দেখতে পারে। প্রথমে বনু গেফার, তারপর একে একে জুহায়না, বুযায়েম, সুলায়েম এবং সবার শেষে আনসারী বাহিনীগুলো নিজ নিজ পতকা বহন করে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। আবু সুফিয়ান প্রতিটি বাহিনীর পরিচয় জিজ্ঞেস করছিল। সা’দ বিন উবাদা যখন সামনে দিয়ে গেলেন তখন সৈনিক সুলভ আবেগে উজ্জীবিত হয়ে বলে উঠলেন……. “আজ তুমুল যুদ্ধের দিন’’…… “আজ কা’বার চত্তর উম্মুক্ত করার দিন”। তাঁর এই বিশেষ আবেগ ও বিশেষ শ্লোগানের পেছনে দীর্ঘ দ্বন্দ্ব সংঘাতের ইতিহাস সক্রিয় ছিল। সবার শেষে রসূল সা. কে বহনকারী প্রাণীটি অত্যন্ত সরল ও স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলে গেল। তাঁর সামনে যুবায়ের ইবনুল আওয়াম পতাকা বহন করে যাচ্ছিলেন। রসূল সা. যখন সা’দ বিন উবাদার স্লোগানের খবর শুনলেন, তখন তিনি মুহুর্তমাত্র বিলম্ব না করে তাঁর কাছ থেকে পতাকা নিয়ে তাঁর ছেলের হাতে অর্পণ করলেন। অতপর তিনি বললেন, “আজকের দিন কা’বার শ্রেষ্ঠত্বের দিন, এবং সদাচার ও ওয়াদা পালনের দিন”। এই একটা কথার মধ্য দিয়েই রসূল সা. তাঁর বিজয়োৎসবের নীতি স্পষ্ট করে দিলেন। তিনি জানিয়ে দিলেন, তাঁর বিজয়োৎসব হবে আগাগোড়া দয়া ও ক্ষমার মহিমায় উজ্জ্বল। তারপর ঘোষণা করে দেয়া হলো, “ যে ব্যক্তি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, যে আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে আশ্রয় নেবে এবং যে অস্ত্র বহন করবেনা, তার প্রাণ নিরাপদ। তবে কেউ যদি কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে, সে শাস্তি পাবে”। আবু সুফিয়ান স্বয়ং মক্কায় উচ্চস্বরে এ ঘোষণা দিতে দিতে এগিয়ে যেতে লাগলো। তার মুখ দিয়ে রসূল সা. এর ঘোষণা উচ্চারিত হতে শুনে তার স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎতা তার গোঁফ টেনে ধরে চিল্লাতে লাগলো, “হে বনু কিনানা, এই হতভাগাকে মেরে ফেলো। ও কী বলছে?” হিন্দা আবু সুফিয়ানকে গালি দিতে লাগলো।
তা শুনে লোকজন সমবেত হয়ে গেল। আবু সুফিয়ান তাকে বুঝিয়ে বললো, এখন এসব কথা বলে কোন লাভ হবেনা। এখন কারো ক্ষমতাই নেই যে, মুহাম্মদের সা. অগ্রযাত্রা ঠেকায়। অতপর যখন রসূল সা. শহরে প্রবেশ করলেন তখন সারা দুনিয়ায় বিজয়ীদের ঠিক বিপরীত বিনয়াবনত মস্তকে প্রবেশ করলেন। তাঁর কপাল যেন বাহক জন্তুটির পিঠ ছুঁয়ে যাচ্ছিল। এ সময় তিনি মুখে সূরা আল ফাতাহ আবৃত্তি করে যাচ্ছিলেন।
ওদিকে ইকরামা ইবনে আবু জাহল, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং সুহায়েল ইবনে আমর খান্দামা নামক পাহাড়ে কোরায়েশের কয়েকজন নির্বোধ গুন্ডাপান্ডাকে একত্রিত করে নানা রকম অপকর্ম সংঘটিত করতে প্ররোচিত করলো। হিমাস বিন কয়েস বিন খালেদও তাদের সাথে মিলিত হলো। দু’জন সাহাবী কারয বিন জাবের ফেহরী, এবং খুনায়েস বিন খালেদ বিন রবী বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন পথ ধরে যাচ্ছিলেন। এই গুন্ডাপান্ডারা তাদের উভয়কে শহীদ করে ফেললো। হযরত খালেদ ঘটনা জানতে পেরে তৎক্ষণাত তাদেরকে উচ্ছেদ করলেন। মোট বারোজন নিহত হলো। হিমাস সমেত কয়েকজন পালিয়ে গেল। এ ধরনের আরো একটা ক্ষুদ্র প্রতিরোধকামী জমায়েত শহরে দেখা গেল। রসূল সা. জানতে পেরে হযরত আবু হুরায়রার মাধ্যমে আনসার বাহিনীকে তলব করলেন। তাদেরকে ঐ দৃশ্যটা দেখিয়ে বললেন, “দেখছ ওদের ফাজলামী?” অর্থাৎ একদিকে তো দয়া ও ক্ষমার বন্যা বয়ে যাচ্ছে এবং বিজয়ী শক্তি এক ফোঁটা রক্তও ঝরাতে চাইছেনা। অপর দিকে এই সব দুষ্ট প্রকৃতির লোকেরা বিজয়ী বাহিনীকে অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য করছে। অনন্যোপায় হয়ে রসূল সা. হুকুম দিলেন, “ ওরা বাধা দিতে চেষ্টা করলে ওদেরকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হোক”। রসূল সা. এর এই আদেশের খবর পেয়ে আবু সুফিয়ান ছুটে এসে কাতর কন্ঠে বললো, “ হে রসূলুল্লাহ! সা. কোরায়েশের শক্তি এমনিতেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এমন যেন না হয় যে, পৃথিবী থেকে তাদের নাম নিশানাই মুছে যাবে”। অতপর হালকা আক্রমণ করা হয় এবং তাতেই দুষ্কৃতিকারীরা মার খেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
রসূল সা. এই দয়ার্দতা দেখে আনসারদের মধ্য থেকে কেউ কেউ কানাঘুষা করতে আরম্ভ করে যে, “ ঐ দেখ, শেষ পর্যন্ত গোত্রের প্রেম রসূল সা. এর ওপর প্রবল হয়েই গেছে!” আসলে রসূল সা. এর প্রতি ভালোবাসার অতিশয্যেই তারা সব সময় এই আশংকায় অস্থির থাকতেন যে, রসূল সা. মক্কা বিজয়ের পর তাদেরকে ছেড়ে মক্কবাসীর সাথে থাককে আরম্ভ করেন কিনা এবং তারা তাদের প্রিয়তম ব্যক্তিত্বের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যান কিনা। আনসারদের এই আশংকার কথা জানতে পেরে রসূল সা. তাদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ “আল্লাহর কসম, তোমরা যা আশংকা করছ, তা সত্য নয়। আমি আল্লাহর বান্দা ও রসূল। আমি আল্লাহর কাছে ও তোমাদের কাছে হিজরত করেছিলাম। এখন তোমরাই আমার জীবন মরণের সাথী”। এ কথা শুনে আনসরাদের মন আবেগাল্পুত হযে উঠলো। তারা তাদের ধারণার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং রসূল সা. তা গ্রহণ করলেন।
লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, শহরে আপনি কোথায় অবস্থান করবেন? নাকি, পৈতৃক বাসস্থানে? রসূল সা. খুবই ব্যথাতুর কন্ঠে জবাব দিলেন, “আকীল আমাদের জন্য ঘর রেখেছেই বা কোথায় যে, তাতে থাকবো? রসূল সা. এর পতাকা হুজুনে ( জান্নাতুল মুয়াল্লাতে) স্থাপন করা হলো এবং ওখানেই তিনি অবস্থান করবেন বলে স্থির হলো। প্রথমে তিনি সেই ঐতিহাসিক স্থান ‘খায়েফে’ গেলেন, যেখানে তার পুরো গোত্র সহ অবরোধকালীন দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। তারপর হারাম শরীফে পৌঁছলেন। ঘনিষ্ঠতম সাহাবীদের কয়েকজন সাথে ছিলেন। হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। হাতে ধনুক নিয়ে হারাম শরীফে স্থাপিত প্রতিটি মূর্তির কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, “হক এসে গেছে এবং বাতিল অপসৃত হয়ছে। বাতিলকে তো অপসৃত হতেই হবে”। ধনুকের ইশারায় এক একটি মূর্তি পড়ে যেতে লাগলো। তারপর কা’বার চাবি আনিয়ে দরজা খোলালেন। ভেতরে হযরত ইবরাহিম ও হযরত ইসমাইল আ. এর ছবি আঁকা ছিল। তাদের উভয়ের হাতে জুয়ার তীর ছিল। ঐ সব মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়ে বললেন, আল্লাহ কাফেরদের ধ্বংস করুন। এরা উভয়েই আল্লাহর নবী ছিলেন। তরা কখনো জুয়া খেলেননি। এরপর রসূল সা. এর নির্দেশে দীর্ঘকাল ধরে আশেপাশের স্থাপিত অন্যান্য মূর্তিগুলোও ভেঙ্গে ফেলা হলো। এরপর তিনি কিছুক্ষণ নামায ও যিকরে মশগুল হলেন। মসজিদুল হারামের সামনে তখন বিপুল জনসমাগম ঘটেছে। জনতা নিজেদের ভাগ্যের ফায়সালা শুনতে উদগ্রীব। রসূল সা. তাদেরকে সম্বোধন করে ভাষণ দিলেনঃ
“এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি সত্য প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। তিনি নিজের বান্দাকে সাহায্য করেছেন। তিনি একাই সমস্ত কাফের সৈন্যদেরকে পরাস্ত করেছেন। আজ সমস্ত অহংকার, আভিজাত্য, রক্তের দাবীদাওয়া এবং সমস্ত আর্থিক দাবী আমার পায়ের নীচে। তবে কা’বা শরীফের তত্ত্বাবধান ও হাজীদের পানি সরবরাহের পদগুলো বহাল থাকবে”।
“হে কুরায়েশ! এখন আল্লাহ তোমাদের জাহেলিয়াতের অহংকার ও বংশীয় আভিজাত্যের সমস্ত দর্প চূর্ণ করে দিয়েছেন। কেননা সকল মানুষ আদমের বংশধর। আর আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে”। অতপর তিনি কোরআনের আয়াত পড়লেনঃ
“হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তোমাদেরকে গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত করেছি শুধু এ জন্য যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পার। কিন্তু আল্লাহর কাছে কেবল সেই সম্মানিত, যে অধিকতর সৎ ও সংযত। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সর্ববিষয়ে ওয়াকিফহাল”।
এরপর একটা আইনগত ঘোষণা দিলেনঃ
“আল্লাহ মদের কেনাবেচা হারাম করেছেন”।
তারপর রসূল সা. জিজ্ঞেস করলেনঃ
“তোমরা কি জান আমি আজ তোমাদের সাথে কেমন আচরন করবো?”
এ বাক্যটা শোনার সাথে সাথে সম্ভবত কোরায়েশদের চোখের সামনে তাদের কৃত যুলুম নির্যাতন, হিংস্রতা ও বর্বরতার দুই দশকের কালো ইতিহাস একটা সিনেমার ছবির মত ভেসে উঠেছিল। তাদের বিবেক হয়তো অনুশোচনায় বিদীর্ণ হবার উপক্রম হয়েছিল। হয়তো চরম অসহায়ত্ব ও অনুতাপের অনুভূতি নিয়েই তারা বলে উঠেছিলঃ
“একজন মহানুভব ভাই এবং মহানুভব ভ্রাতুস্পুত্রের মত”। জবাবে রসূল সা. ঘোষণা করলেনঃ
“তোমাদের ওপর আজ আর কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত”।
কোরায়েশদের যুলুম নিপীড়ন ও আগ্রাসী যুদ্ধের ইতিহাস দৃষ্টিপথে থাকলে কেউ কি এ ধরনের জবাব আশা করতে পারে? তবে যে ব্যক্তি রসূল সা. এর দয়া ও করুণা সম্পর্কে অবহিত সে তাঁর কাছ থেকে এরূপ জবাবই প্রত্যাশা করতো। আর কেউ হলে অহংকারের সাথে মক্কায় প্রবেশ করতো, এক একটা ঘটনার প্রতিশোধ নিত, বেছে বেছে বিরোধীদের মধ্যে যারা অতীতে বিন্দুমাত্রও বাড়াবাড়ি করেছে, তাদেরকে হত্যা করত, বিজিত শহরে গণহত্যা সংঘটিত করতো, মানুষের ধন সম্পদ ও নারীদের সতীত্ব নির্বচারে লুন্ঠিত হতো। কিন্তু বিজেতা যেহেতু মানবতার শ্রেষ্ঠ দরদী ও ত্রাণকর্তা ছিলেন, তাই তিনি ভূমি দখলের সাথে সাথে মানুষের হৃদয়ও জয় করার চেষ্টা করেন। এমনকি তিনি মোহাজেরদেরকে নিজ নিজ ঘরবাড়ী ও ধন সম্পদের মালিকানাও ত্যাগ করতে বলেন। যে উসমান বিন তালহাকে ইসলামী আন্দোলনের সূচনা কালে তিনি কাবা শরীফের দরজা খুলে দিতে অনুরোধ করলে সে কঠোরভাবে অস্বীকার করেছিল, মক্কা বিজয়ের পরও কা’বার চাবি কেয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য সেই ওসমানের হাতেই সমর্পন করলেন। অতপর রসূল সা. অতীতের দিকে দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করে অতীতের একটা কথোপকথন উসমানকে স্বরণ করিয়ে দিলেনঃ “একদিন এই চাবি আমার নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমি যাকে তা দিতে চাইবো, দেবো”। উসমান এত দূর-দৃষ্টি কোথায় পাবেন যে, এ কথার মর্ম বুঝবে? তাই সে বললো, “ সেই দিনের আগে বোধহয় কোরায়েশরা সবাই মরে যাবে”। রসূল সা. বললেন, “না, সেই দিনটা হবে কোরায়েশদের জন্য সত্যিকার সম্মানের দিন”। এই কথোপকথনকে লক্ষ্য করলে মনে এই ধারণাই জন্মে যে, রসূল সা. এর পরিবর্তে আর কেউ হলে নিজের ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য অবশ্যই কা’বার চাবি উসমানের কাছ থেকে নিয়ে অন্য কারো হাতে অর্পন করতেন। কিন্তু রসূল সা. কা’বার চাবি হস্তগত করার জন্য বনু হাশেমের পক্ষ থেকে হযরত আলীর রা. ন্যায় ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তির আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেন এবং চিরদিনের জন্য সাবেক ব্যক্তিগণের হাতেই থাকতে দেন। রসূল সা. চাবি দেয়ার সময় যখন রসিকতার ছলে উসমান বিন তালহাকে বহু বছর আগের সেই কথাবার্তা স্মরণ করিয়ে দিলেন, তখন সে বললো, “নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর রসূল”। রসূল সা. বললেন, “ আজকের দিন সদাচার ও প্রতিশ্রুতি পূরনের দিন”।
এরপর রসূল সা. এর আদেশে হযরত বিলাল রা. কা’বার ওপর আরোহন করে আযান দিলেন। এ আযান ছিল ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের ঘোষণা স্বরূপ। যে কা’বা শরীফে আল্লাহর বান্দাদের জন্য আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার অপরাধে পরিগণিত হয়েছিল, এবং এই অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে গিয়ে রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা সীমাহীন যুলুম নির্যাতন সহ্য করেছিলেন, সেই কা’বার ছাদের ওপর থেকে আজ আযান ধ্বনিত হচ্ছে। অথচ পৃথিবীর কোন শক্তি তাকে রুখতে পারছেনা। এ সময় আবু সুফিয়ান বিন হারব, ইতাব বিন উসাইদ এবং হারেস বিন হিশামের ন্যায় শীর্ষ নেতারা কা’বার নিকটবর্তী এক কোনে বসে নিজেদের পরাজয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছিল। ইতাব ক্ষোভের সাথে বললো, ‘ভালোই হয়েছে যে, আমার বাবা উসাইদ এই আযানের শব্দ শোনার জন্য জীবিত থাকেনি।’ রসূল সা. পরক্ষণেই তাদের কাছে এলেন এবং তারা যা যা বলেছিল, তা হুবহু তাদের সামনে তুলে ধরলেন। এতে কোরায়েশদের এই শীর্ষ নেতৃবর্গ লজ্জা পেল।
এরপর রসূল সা. মক্কা বিজয়ের শোকর আদায় কল্পে উম্মে হানীর ঘরে গিয়ে গোছল করে আট রাকাত নামায পড়লেন।
বিজয়ের পরদিন রসূল সা. সাফা পর্বতের ওপর থেকে আরো একটা ভাষণ দিলেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তারপর সংক্ষেপে হারাম শরীফের মর্যাদা বর্ণনা করলেন, এই মর্যাদাকে চিরদিনের জন্য বহাল করলেন এবং তার নিয়ম বিধি সমূহ বর্ণনা করলেন। প্রসংগত উল্লেখ যে, এত বড় বৈপ্লবিক বিজয় উপলক্ষেও মক্কায় জানমালের নিরাপত্তার শাশ্বত বিধান মাত্র একদিনের জন্য লংঘিত আর তাও একান্ত বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে। কেননা রসূল সা. এর সম্মতি ছাড়াই মক্কার কতিপয় কান্ডজ্ঞানহীন গুন্ডাপান্ডা দু’জন মুসলিম সৈনিককে হত্যা করে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছিল তাদের মুলোচ্ছেদ করতে। এই অতি ক্ষণস্থায়ী বাধ্যবাধকতা শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় দিন থেকে রসূল সা. হারাম শরীফের মর্যাদা ও পবিত্রতা পুনর্বহাল করার ঘোষণা দেন।
সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা তো দেয়াই হয়েছিল। সে ঘোষণা জনগণকে এত অভিভূত ও মুগ্ধ করেছিল যে, কারো মধ্যে প্রতিরোধের স্পৃহাই আর থাকেনি। তবে বিশেষ বিশেষ অপরাধ সম্পর্কে তিনি নামসহ ঘোষণা করে দেন যে, তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাক হত্যা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, মক্কা দখল করা ও তার আইন শৃংখলা বহাল করার জন্য কয়েকদিন সামরিক আইন চালু ছিল। অর্থাৎ যাবতীয় ক্ষমতা সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। [যে এলাকায় যুদ্ধ চলতো, সেখানে সাধারণ বেসামারিক নিয়মশৃংখলা পুরোপুরিভাবে বহাল হওয়ার আগে ইসলামী আইন অনুসারে সামারিক কর্তৃপক্ষের হাতে কিছুটা কড়া অস্থায়ী প্রশাসন চালু করা হতো। এ ধরনের প্রশাসনে কিছু কিছু আইন ও বিধি সাধারণ কর্তৃপক্ষের হাতে কিচুটা কড়া অস্থায়ী প্রশাসন চালু করা হতো। এ ধরনের প্রশাসনে কিছু কিছু ও বিধি সাধারণ বেসামরিক প্রশাসন থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। আমার মতে, এ ধরনের প্রশাসনকেই আধুনিক পরিভাষায় সামরিক আইন বা মার্শাল ল’ বলা হয়। সামরিক আইন সাধারণভাবে প্রত্যেক সুসভ্য সরকারর অধীনে এবং বিশেষভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে যুদ্ধরত অঞ্চলে শুধু অনিবার্য প্রয়োজনের আওতায় সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য চালু হয়ে থাকে, আর তাও বিজিত অমুসলিম শত্রুদের ওপর। আজকাল সামারিক আইনের নামে কোন দেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক নিজ দেশেরই জনগণকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে র্দীঘ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য শাসনকার্য পরিচালনা করাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের শাসন ব্যবস্থা। মক্কা বিজয়ের সময়কার যে ব্যবস্থাকে আমরা ‘সামরিক আইন’ নামে আখ্যায়িত করেছি, আজকালকার সামারিক আইনের সাথে তার কোন মিল নেই। এ যুগের প্রচলিত সামরিক আইন ও সামরিক শাসন ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত।] এবং রসূল সা. সেনাপতি হিসাবেই নির্দেশ জারী করেছিলেন যে, অমুক অমুক অপরাধীকে যেখানেই পাওয়া যাবে, হত্যা করা হবে। আধুনিক পরিভাষায় এটা ‘‘দেখামাত্র গুলি করার’’ আদেশের অনুরূপ। অপরাধীদের এই তালিকায় কয়েকজন পুরুষ ও নারীর নাম ছিল। কিন্তু রসূল সা.-এর সাধারণ ক্ষমা এদের মধ্যে থেকেও অধিকাংশের প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছিল। সর্বোচ্চ চারজন অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। একটি সুচিন্তিত অভিমত এইযে, মাত্র একজন অপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এর নাম হলো আব্দুল উয্যা বিন হানযাল। এই ব্যক্তি প্রথমে মুসলমান হয়। অন্য একজন মুসলমান সাথীসহ তাকে যাকাত সদকা আদায় করতে পাঠানো হয়। পথিমধ্যে সাথীর সাথে ঝগড়া হয় এবং তাকে হত্যা করে সে সদকার জন্তুগুলোকে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া বহু ফৌজদারী অপরাধে সে জড়িত ছিল।
সাফওয়ান বিন উমাইয়া এ ধরনের আরো একজন গুরুতর অপরাধী। সে ইসলামী ছিল আন্দোলনের কট্টর শত্রু। প্রথমে পালিয়ে ইয়েমেন যাওয়ার পথে জেদ্দায় পৌঁছে। উমাইর বিন ওহব জামহী রসূল সা. এর কাছ থেকে তার জন্য ক্ষমা মঞ্জুরী নিয়ে তাকে জেদ্দা থেকে ফিরিয়ে আনে। পরে সে ইসলাম গ্রহণ করে।
ইকরামা বিন আবু জাহলও ইয়ামানে পালিয়ে গিয়েছিল। তার স্ত্রী উম্মে হাকীম বিনতুল হারিস (আবু জাহলের ভাই এর মেয়ে) নিজে মুসলমান হয়ে যায় এবং নিজের স্বামীর জন্য রসূল সা. এর কাছ থেকে ক্ষমার মঞ্জুরী গ্রহণ করে। তারপর নিজে ইয়েমেনে গিয়ে তাকে নিয়ে আসেন। ইকরামা যখন নিজের জন্য ক্ষমা প্রাপ্তির খবর পেল, তখন সে আবাক হয়ে যার যে, তার মত কট্টর শত্রুকেও রসূল সা. ক্ষমা করে দিলেন! তিনি হাজির হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।
আবদুল্লাহ বিন সা’দ বিন আবি সারাহ এক সময় মুসলমান ছিল এবং ওহির লেখক হবারও সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু মুরতাদ হয়ে শত্রুদের সাথে সহযোগীতা করতে থাকে। এমনকি সে এ কথাও প্রচার করতে থাকে যে, ওহি তো আসলে আমার কাছে আসতো। মুহাম্মদ সা. আমার কাছে শুনে তা লিখিয়ে নিতেন। অপরাধ ছিল সংগীন। কিন্তু হযরত উসমানের পক্ষ থেকে বারবার সুপারিশ করার কারণে রাসূল সা. সর্বোচ্চ শাসক হিসেবে ক্ষমা করে দেন। ক্ষমার পর সে মুসলমান হিসেবে বহাল থাকে।
মুকাইয়াস বিন সাবাবা বা বর্ণচোরা হিসেবে ইসলামী দলের ভেতরে প্রবেশ করে। পরে সে প্রতারণার মাধ্যমে জনৈক সাহাবীকে হত্যা করে পালিয়ে আসে। এই হত্যাকান্ডের কারণ ছিল এই যে, মাকাইয়াসের ভাই ভুলক্রমে এই আনসারী সাহাবীর হাতে নিহত হয়। রসুল সা. এজন্য দিয়াত তথা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেন। তা স্বত্ত্বেও সে আনসারী সাহাবীকে হত্যা করে। মুরতাদ হওয়া ও ধোকাবাজী করা ছাড়াও নিছক এই হত্যাকান্ডের জন্যও তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া যেত।
হাববার ইবনুল আসওয়াদ ছিল সেই ব্যক্তি, যে অন্যান্য ইসলামবিরোধী কর্মকান্ড ছাড়াও রসুল সা. এর মেয়ে হযরত জয়নরেব ওপর হিজরতের দিন হামলা করে এত কষ্ট দিয়েছিল যে, তার গর্ভপাত ঘটে গিয়েছিল। সে প্রথমে পলাতক ছিল। পরে নিজেই হাজির হয়ে বিনয়ের সাথে অপরাধ স্বীকার করে এবং রসূল সা. এর কাছে প্রবল অনুশোচনা প্রকাশ করে। সেই সাথে সে ইসলাম গ্রহণ করে। রসূল সা. ঘোষণা করেন যে, আমি হাব্বারকে ক্ষমা করে দিলাম।
হযরত হামযার খুনী ওয়াহশী রাসূল সা. এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি তার কাছে হামযা হত্যার বিবরণ শোনেন। তিনি তাকে মাফ করে দেন। তবে তাকে পরামর্শ দেন, তুমি আমার সামনে এসনা। এতে স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত হয়। এই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার পরও নানা ধরনের গুনাহর কাজ বিশেষত মদখুরি থেকে মুক্তি পায়নি।
খ্যাতনামা জাহেলী কবি আব্দুল্লাহ বিন যিবয়ার এক সময় কবিতার অস্ত্র প্রয়োগ করে ইসলামের সাথে শত্রুতা করতো এবং মানুষকে উস্কে দিত। সে রসূল সা. এর সাথে দেখা করে ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।
কবি কা’ব বিন যুহায়েরও ইসলাম ও রসূল সা. এর বিরুদ্ধে বহু নিন্দামূলক কবিতা লিখেছিল। হিজরী নবম সালে নিজের ভাই এর সাথে এসে রাসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করে। পরে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে ‘‘বানাত্ সুয়াদ’’ শীর্ষক এক ঐতিহাসিক চমকপ্রদ কবিতা ইসলামের পক্ষে রচনা করেন। রসূল সা. তাকে শুধু ক্ষমাই করেননি, বরং নিজের চাদরও পুরস্কার দেন।
মক্কায় অবস্থানকালে একবার রসূল সা. কা’বা শরীফের তাওয়াফ করছিলেন। এই সময় ফুযালা বিন উমাইর তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে আসে। রসূল সা. নিজেই তার কাছে এগিয়ে যান এবং তার মনের ইচ্ছাটা তাকে জানান। ফুযালা এভাবে ধরা পড়ে ভীষণ লজ্জা পায়। তিনি তাকে ক্ষমা চাইতে বলেন এবং তার বুকের ওপর হাত ঘোরান। সংগে সংগে তার দুনিয়া পাল্টে যায়। হত্যার ইচ্ছা পোষণকারী এক অপরাধীকে এভাবে ক্ষমা করার দৃষ্টান্ত আর কোথাও পাওয়া যাবেনা।
মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধী ছিল হিন্দ বিনতে উতবা। সে ইসলামের সক্রিয় বিরোধীতা তো করেছেই, এমনকি হযরত হামযার লাশকে বিকৃতও করেছে এবং তার কলিজা পর্যন্ত চিবিয়েছে। নিজের চেহারা লুকানোর জন্য নিকাব পরে রসূল সা. এর সামনে হাজির হয়। পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছিল। কিন্তু এ অবস্থায়ও ধৃষ্টতা সহাকারে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন রাসূল সা. এর কাছে করেছিল। রসূল সা. এর সাথে তার কথোপকথন ছিল নিম্নরূপ :
হিন্দঃ হে আল্লাহর রসূল, আপনি আমাদের কাছ থেকে কী কী অংগীকার গ্রহণ করেছেন?
রসূল সাঃ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করোনা।
হিন্দঃ এ অংগীকার আপনি পুরুষদের কাছ থেকে তো নেননি। তবুও আমি এটা মেনে নিলাম।
রসূল সাঃ চুরি করবেনা।
হিন্দঃ আমি আমার স্বামী আবু সুফিয়ানের সম্পত্তি থেকে কখনো কখনো দু’চার দিরহাম নিয়ে থাকি। জানিনা এটাও জায়েজ, না নাজায়েজ।
রসূল সাঃ নিজের সন্তানদের হত্যা করবেনা।
হিন্দঃ আমরা তো শৈশবে তাদের লালন পালন করেছি। বড় হলে বদরের ময়দানে আপনারাই তাদের হত্যা করেছেন। এখন তাদের কী হবে, সেটা আপনারাই জানেন।
এটা কী ধরনের ইসলাম গ্রহণ, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কথাবার্তার ভেতরে এমন ঔদ্ধত্য ও বেআদবী অন্য কেউ হলে সহ্য করতোনা। রসূল সা. এর সীমাহীন ধৈর্যকে সে অপব্যবহার করেছিল মাত্র।
ইবনে হানযালের দাসী ছিল কারতানা। সে রসূল সা. এর বিরুদ্ধে নিন্দাসূচক গান গেয়ে বেড়াতো। মক্কা বিজয়ের সময় সে পালিয়ে যায়। পরে তাওবা করে ও ইসলাম গ্রহণ করে।
কয়েজন নারী ও পুরুষ সম্পর্কে হাদীস ও সীরাতের রেয়ায়েতসমূহে যথেষ্ট মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। তবে তাদের কেউ মৃত্যুদন্ড পেয়েছে বলে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই।
তবে এমন কট্টোর শত্রুদের জন্য এমন পূর্ণাংগ বিজয়ের সময় সাধরণ ক্ষমা ঘোষণা করার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর কোন বিজেতার জীবনে পাওয়া যায় না।
মক্কার ভূমি দখল করার চেয়েও বড় বিজয় ছিল এই যে, রসূল সা. সাফা পাহাড়ে উঁচু জায়গায় বসে ছিলেন, আর লোকেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করছিল। তাদের কাছ থেকে তাওহীদ ও রিসালাতের মৌলিক তত্ত্ব মেনে নেয়া ছাড়াও বিশেষভাবে কিছু প্রচলিত খারাপ কাজ ও খারাপ প্রথা থেকে সংযত থাকার অংগীকার গ্রহণ করা হচ্ছিল। বায়য়াতের বিশেষ বিশেষ অংগীকারগুলো ছিল এরকম :
* আমি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করবোনা, তার সত্তায়, গুণাবলীতে, এবাদাতে ও অধিকারে কোনটাতেই নয়।
* চুরি করবোনা, ব্যভিচার করবোনা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবোনা, শিশু মেয়েদেরকে হত্যা করবোনা, কারো ওপর অপবাদ আরোপ করবোনা।
* ভালো কাজে যথা সাধ্য রসূর সা. এর আদেশ মেনে চলবো।
পনেরো দিন বা তার দু’একদিন কম বা বেশী মক্কায় অবস্থানের পর যখন রসূল সা. বিদায় নিলেন, তখন জনগণকে ইসলামী জীবন পদ্ধতি, ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, ইসলামী চরিত্র, ইসলামী আইন ও ইসলামী সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়ার কাজে হযরত মুয়ায ইবনে জাবালকে নিযুক্ত করে রেখে গেলেন। এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তিনি ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ নিজের হাতে ইসলামী শাস্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্পন্ন করেন। ফাতেমা বিনতে আবুল আসাদ নাম্নী এক মহিলার চুরি প্রমাণিত হলে তিনি অনেকের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেও তার হাত কেটে দেয়ার সেই ঐতিহাসিক কাজটি সম্পন্ন করেন। হোনায়েন ও তায়েফের যুদ্ধ জয়ের পর রসূল সা. মক্কায় ফিরে এসে ইতাব বিন ইসায়েদকে সহকারী শাসনকর্তা নিয়োগ করেন এবং তার জন্য দৈনিক এক দিরহাম ভাতা নির্ধারণ করেন।