বিপ্লবী কালেমা
এ কথা ভাববার কোনই অবকাশ নেই যে, বিশ্বনবী সা. কোন আকীদা-বিশ্বাস, মতাদর্শ, বা পরিকল্পনা ছাড়াই সংস্কার ও বিনির্মাণের কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। তিনি নিছক একটা অস্পষ্ট চেতনা, লক্ষ্যহীন আবেগ এবং অপরিপক্ক উন্মাদনা দ্বারা তাড়িত হয়ে এ কাজ শুরু করেননি। বরং তিনি মহাবিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যের মশাল হাতে নিয়ে ময়দানে নেমেছিলেন। তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল মন নিয়ে বছরের পর বছর ধরে জীবনের সমস্যাবলী নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। হেরা গুহার নির্জন প্রকোষ্ঠে দীর্ঘকাল ব্যাপী নিজের অন্তর্জগত ও বহির্জগত নিয়ে ধ্যান করেছেন। সভ্যতার কল্যাণ ও অকল্যাণ কিসে হয়, তার নীতিমালা বুঝবার জন্য তিনি অনেক মাথা ঘামিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করেননি, যতক্ষণ না মহান আল্লাহ পাক তাঁর হৃদয়কে সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছেন এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সত্য তাঁর সামনে উদঘাটিত হয়েছে। সেই শ্রেষ্ঠতম সত্য হলো, মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা ও প্রভূ আছেন এবং মানুষ তাঁরই গোলাম ও দাস। এই সত্য কলেমাই ছিল বিশ্বনবীর সূচিত বিপ্লবের বীজ। এই বীজ থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন সৎ জীবন ও নিষ্কলুষ সভ্যতার সেই পবিত্র বৃক্ষ, যার শেকড় মাটির অনেক গভীরে উপ্ত এবং যার ডালপালা উচ্চ আকাশে বিস্তৃত।
বিশ্বনবীর ঘোষিত এই কলেমা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিপ্লবাত্মক কলেমা। আমরা সবাই জানি, এই কলেমা হলো ‘‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’’। শাব্দিকভাবে এটা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে অত্যন্ত গভীর। ‘‘এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনিই একমাত্র ইলাহ’’। ইলাহ সেই শক্তি বা সত্তাকে বলা হয়, যার গোলামী করা যায়, যার জন্য মানুষ নিজেকে ও নিজের যথাসর্বস্বকে অকাতরে উৎসর্গ করতে পারে, যার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে উপাসনা করে, যার সর্বাত্মক প্রশংসা, গুণগান, পবিত্রতা ঘোষণা ও বন্দনা করে। যার জন্য মান্নত মনে, যার কাছে সর্ব প্রকারের কল্যাণের আশা করে, যার পাকড়াওকে ভয় করে, যার কাছে সৎকাজের পুরস্কারের আশা ও অসৎকাজের শাস্তির আশংকা করে, যাকে নিজের নিরংকুশ মালিক মোখতার মনে করে, যাকে শাসক ও আইনদাতা মানে, যার আদেশ অনুযায়ী কাজ করে ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকে, যার দেয়া নীতিমালাকে নিজের জীবনের মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করে, যার হালাল ও হারামের বিধিকে বিনা বাক্য ব্যয়ে কার্যকরী করে, যাকে নিজের জন্য হেদায়াতের উৎস মনে করে, যার ইচ্ছা ও মর্জী অনুযায়ী জীবন বিধান তৈরী করে, যার প্রিয়জনদেরকে সম্মান ও বিরোধীদেরকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং যার সন্তুষ্টি অর্জন তার জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিণত হয়। একটি মাত্র শব্দ ইলাহের মধ্যে এই ব্যাপক তাৎপর্য নিহিত ছিল।
মানব সমাজ ইলাহ্র এই অধিকারগুলোকে এক আল্লাহর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ভাগ বাটোয়ারা করে রেখেছিল। ফলে সমাজ ও সভ্যতার বিভিন্ন স্তরে জেঁকে বসেছিল অসংখ্য ইলাহ। মানুষের নিজের প্রকৃতি ও তার কামনা বাসনা, পরিবার ও গোত্রের রসম রেওয়াজ, বর্ণ, বংশ ও জাতিগত সংঘবদ্ধতার ঐতিহ্য, জমীদার ও ধর্মযাজকদের আধিপত্য, রাজপরিবার ও পরিষদবর্গের দাম্ভিকতা, ইত্যাদি তাদের ইলাহ হয়ে বসেছিল। এসব ইলাহ্র নাম নিয়ে সমাজের এক শ্রেণী অপর শ্রেণীকে শাসন শোষণ করতো, লুটে পুটে খেত। ‘‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ (‘‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই’’।) কথাটা এই সমস্ত খোদার খোদায়ীর ওপর একই সাথে প্রচন্ড আঘাত হানতো। এই কলেমার উচ্চারণকারী প্রকারান্তরে এ কথাই ঘোষণা করতো যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন প্রভূত্ব আমি মানিনা, কারো কর্তৃত্ব ও আধিপত্য মানিনা, কারো রচিত আইন কানুন আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারো অর্জিত অতিমানবীয় অধিকার বৈধ নয়, কারো সামনে মাথা নোয়ানো হবেনা, কারো সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি তোয়াক্কা করা হবেনা, কারো আংগুলের ইশারায় জীবন চলবেনা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সকল খোদায়ী ভেংগে চুরমার করে দেয়া হবে। বস্তুত, এই কলেমা ছিল মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা।
এই কলেমার দ্বিতীয় অংশে এই মর্মে অংগীকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যে, মানবজাতির হেদায়াত তথা মুক্তি ও কল্যাণের পথে সন্ধান দান এবং সভ্যতা ও সংস্কার সংশোধনের একমাত্র পথ হলো আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রসূলগণের দেখানো পথ। জীবনের প্রয়োজনীয় আসল ও নির্ভুল জ্ঞানের একমাত্র উৎস হলো ওহী। এ থেকেই মানবীয় বিবেক চিন্তা করার মূলনীতি কী জানতে পারে। মুহাম্মদ সা. রিসালাতের এই ধারাবহিকতার পূর্ণতাদানকারী সর্বশেষ নবী ও রসূল। জীবনের সঠিক পথের সন্ধান তাঁর কাছ থেকেই নিতে হবে এবং তাঁর নেতৃত্বেই বিশ্ব মানবতা কল্যাণ ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম।
এই কলেমার এই গুরুত্বের কারণেই তার স্বীকৃতি ইসলাম গ্রহণের পয়লা শর্তে পরিণত হয়েছে। এই কলেমাকে মায়াযযিনগণ আযান দেয়ার সময় উচ্চ স্বরে পাঠ করে থাকে এবং তাকে শ্রেষ্ঠ যিকর বলে আখ্যায়িত ও নামাযের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মোট কথা, এ কলেমা সর্ব দিক দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের শ্লোগানে পরিণত হয়েছে।
রসূল সা.-এর এই বিপ্লবাত্মক কলেমা যার অন্তরেই প্রবেশ করেছে, তার ভেতরে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এ কলেমা যার জীবনেই ঢুকেছে, তার নকশা পাল্টে গেছে। এ বীজ থেকে নতুন মানুষ জন্মগ্রহণ করেছে এবং লালিত পালিত ও বিকশিত হয়েছে।
সমাজ সংস্কারে রসূল সা. এর লক্ষ্য
রসূল সা.-এর জীবনী থেকে যথার্থ উপকারিতা অর্জনের জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটার জবাব জানা জরুরী, তা হলো, রসূল সা. এর সামনে ইপ্সিত পরিবর্তনের পরিধি কতদূর এবং তাঁর কাজের মানদণ্ড কী ছিল? সমাজ ব্যবস্থায় তিনি কি কোন আংশিক পরিবর্তন চাইতেন, না সর্বাত্মক পরিবর্তন? তাঁর দাওয়াত কি নিছক ধর্মীয় ও নৈতিক সংস্কারের মধ্যে সীমিত ছিল, না রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্নও ছিল? অন্য কথায়, সামাজিক পরিমণ্ডলে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য কী ছিল?
এ প্রশ্নের জবাব খোদ কুরআনে খুব সুষ্ঠুভাবেই দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ভংগীতে বারবার ইসলামী দাওয়াতের উদ্দেশ্য জানানো হয়েছে। এখানে আমি শুধু দুটো আয়াতের উল্লেখ করছি। এক জায়গায় সকল নবী ও রসূলকে প্রেরণের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবেঃ
﴿لَقَدْأَرْسَلْنَارُسُلَنَابِالْبَيِّنَاتِوَأَنزَلْنَامَعَهُمُالْكِتَابَوَالْمِيزَانَلِيَقُومَالنَّاسُبِالْقِسْطِۖوَأَنزَلْنَاالْحَدِيدَفِيهِبَأْسٌشَدِيدٌوَمَنَافِعُلِلنَّاسِوَلِيَعْلَمَاللَّهُمَنيَنصُرُهُوَرُسُلَهُبِالْغَيْبِۚإِنَّاللَّهَقَوِيٌّعَزِيزٌ﴾
‘‘আমি আমার রসূলগণকে কেবলমাত্র এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছি এবং তাদের ওপর কিতাব ও মানদন্ড নাযিল করেছি, যাতে মানবজাতি ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। (সূরা আল হাদীদঃ ২৫)
কথাটা একেবারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে। ইসলামের দাওয়াতের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো মানব জীবনকে ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এবং সমাজ ব্যবস্থায় কার্যকরভাবে ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা। একই উদ্দেশ্যে লোহার অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহার করার ইংগিত আয়াতের পরবর্তী অংশে রয়েছে। অর্থাৎ ইসলামী বিধিব্যবস্থার বাস্তবায়ন, সংরক্ষণ ও বিকাশ সাধনের জন্য সামরিক শক্তিও অনিবার্য।
স্বয়ং মুহাম্মদ সা. নবী হিসাবে আবির্ভাবের উদ্দেশ্য আরো স্পষ্ট ভাষায় একাধিকবার বলা হয়েছে। যেমনঃ
﴿هُوَالَّذِيأَرْسَلَرَسُولَهُبِالْهُدَىٰوَدِينِالْحَقِّلِيُظْهِرَهُعَلَىالدِّينِكُلِّهِوَلَوْكَرِهَالْمُشْرِكُونَ﴾
‘‘তিনিই আল্লাহ, যিনি স্বীয় রসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি এই সত্য দ্বীনকে অন্য সমস্ত ধর্মমত ও জীবন ব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করে দিতে পারেন। চাই তা মোশরেকদের কাছে যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন।’’ (সূরা আস সফঃ ৯)
অর্থাৎ কুরাইশ ও আরবের অন্যান্য মোশরেকরা তো নিজেদের জাহেলী জীবন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেই। জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে যে আওয়াজই তোলা হোক, তা তাদের কাছে অপসন্দ হবেই। কিন্তু এইসব পসন্দ অপসন্দের তোয়াক্কা না করে এবং তাদের বিরোধিতাকে উপেক্ষা করে রসূল সা. কে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের কাজটা সুসম্পন্ন করতেই হবে। ইসলামের দাওয়াতের উদ্দেশ্য যদি এটা না হতো, তাহলে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, জেহাদ ও হিজরতের অবকাশ কোথা থেকে হতো? জান ও মালের কুরবানীর আহ্বান কেন জানানো হলো? কী উদ্দেশ্যে ‘‘আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও’’ এই উদাত্ত আহ্বান জানানো হলে? কী উদ্দেশ্যে ‘‘আল্লাহর দল’’ গঠিত হয়? কোন্ লক্ষ্যে শহীদদেরকে বাছাই করা হয়? বস্তুত ইসলামের দাওয়াতের উদ্দেশ্য অন্তরে বদ্ধমূল না করে কুরআন ও সীরাত এই দুটোর কোনটাই বুঝা যাবেনা।
এবার আসুন, রসূল সা.-এর জীবনেতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায় পর্যালোচনা করে অনুসন্ধান চালানো যাক যে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য কী ছিল?
রসূল সা. প্রাথমিক স্তরেই বনু হাশেম গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের একটি বৈঠক আহ্বান করেন নিজের দাওয়াত পেশ করার জন্য। সেখানে তিনি সংক্ষেপে বলেন যে, এই দাওয়াত দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের কল্যাণ নিশ্চিত করবে। এর অনেক দিন পরে এক কুরাইশ প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনা করার সময় তিনি ঐ বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেনঃ
(আরবি*****************************)
‘‘আমি যে দাওয়াত পেশ করছি তা যদি তোমরা গ্রহণ করে নাও, তাহলে তাতে তোমাদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম জিল্দ, পৃঃ ৩১৬)
‘দুনিয়ার কল্যাণ’ এই সহজ সরল শব্দ দুটিকে কোন আংশিক কল্যাণের অর্থে গ্রহণ করা একেবারেই অযৌক্তিক। আংশিক কল্যাণ তো প্রত্যেক দাওয়াতেই থাকে। প্রত্যেকটা খারাপ ব্যবস্থায়ও কিছু না কিছু ভালো জিনিস থাকে। আসলে দুনিয়ার কল্যাণের অর্থ হলো দুনিয়ার জীবনটা সর্বাঙ্গীন সুন্দর হওয়া। সমাজ ব্যবস্থাটা নিষ্কলুষ ও নিখুঁত হওয়া। ন্যায় বিচারের স্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং পবিত্র ও নির্মল জীবনের অধিকারী হওয়া।
কুরাইশদের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে আরো একবার রসূল সা. এর সাথে তাদের আলাপ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এবারেও তিনি বলেনঃ
(আরবি***************************)
‘‘একটি মাত্র কথা যদি তোমরা আমাকে দাও, তবে তা দ্বারা তোমরা সমগ্র আরব জাতির ওপর আধিপত্য লাভ করবে এবং যত অনারব জাতি পৃথিবীতে আছে তারা সব তোমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম জিলদ, পৃঃ ৩১৬)
প্রতিটি মেলা ও হজ্জের সময় আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বিভিন্ন গোত্রের শিবিরে শিবিরে গিয়েও তিনি এই বক্তব্য প্রত্যেক গ্রোত্রপতির কাছে রাখতেন। তাদেরকে বলতেন, ‘‘আমাকে সাথে নিয়ে চলুন। আমাকে কাজ করার সুযোগ দিন এবং আমার সাথে সহযোগিতা করুন, যেন আমি সেই বার্তাটা জনগণের কাছে স্পষ্ট করে পেশ করতে পারি, যার জন্য আমাকে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে।’’ [বনু আমের গোত্রের যারা হজ্জ করতে গিয়েছিল, তারা ফিরে এসে জানিয়েছেঃ ‘‘মুহাম্মদ (সা) আমাদেরকে অনুরোধ করেছিল আমরা যেন তার নিরাপত্তা বিধান করি, তার দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করি এবং আমাদের এলাকায় তাকে নিয়ে আসি।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় জিলদ, পৃঃ ৩৪)] এই বক্তব্য শুনে ও রসূল সা. এর আবেগ উদ্দীপনা দেখে বনু আমের গোত্রের গোত্রপতি বুখাইয়া বিন ফিরাস এত অভিভূত হলেন যে, তিনি নিজের ঘনিষ্টজনদের কাছে বললেনঃ এই যুবককে হাতে পেলে আমি সমগ্র আরবকে গ্রাস করে ফেলতে পারবো।’’ রসূল সা.-এর দাওয়াতের লক্ষ্য ও তাঁর তৎপরতার সম্ভাব্য ফলাফল এই বিচক্ষণ আরব সরদার বুঝে ফেলেছিলেন। তাই তিনি রসূলের সাথে একটা দর কষাকষি করতে চাইলেন। তিনি রসূল সা. কে জানালেন যে, তিনি একটি শর্তে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। সেটি হলো, আপনি যখন আপনার বিরোধীদের ওপর বিজয় লাভ করবেন এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন, তখন আপনার পরে আমরা ক্ষমতাসীন হব।’’ বুখাইরা যে অত্যন্ত দূরদর্শী ছিলেন তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রসূল সা. যদি সংকীর্ণ অর্থে নিছক ধর্মীয় প্রচারক ও ওয়ায নসীহতকারী হতেন, এবং কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য তাঁর একেবারেই না থাকতো, তাহলে পরিষ্কার বলে দিতেন যে, আরে ভাই, আমি তো আল্লাহ ওয়ালা মানুষ। ক্ষমতার বখরা দিয়ে আমার কী কাজ? রাষ্ট্র ও সরকারের সাথে আমার কিসের সম্পর্ক? কিন্তু রসূল সা. এভাবে জবাব দেননি। তিনি বললেন”
‘‘ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আল্লাহর হাতে। ওটা তিনি যাকে দিতে চান তাকেই দেবেন।’’
এ কথা বলেই তিনি বুখায়রার শর্ত ও ক্ষমতা ভাগাভাগির বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দিলেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় জিল্দ পৃঃ ২৩)
রাসূল সা. এর নেতৃত্বে আন্দোলন চলাকালে “আরব ও অনারবদের ওপর কর্তৃত্ব লাভ”- এর বিষয়টি এত খ্যাতি লাভ করে যে, ওটা যেন ইসলামী আন্দোলনের শ্লোগানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। শিশুরা পর্যন্ত ওটা বলাবলি করতো। বিরোধীরা এটাকে একটা উপহাসের ব্যাপার হিসাবে গ্রহণ করেছিল। দাস ও দরিদ্র শ্রেণীর যে সব যুবক ইসলাম গ্রহন করতো এবং কুরাইশদের অত্যাচার নির্যাতনে পিষ্ট হতো, তাদেরকে দেখলেই কুরাইশরা তাদের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে দিয়ে বলতোঃ “ এই হুজুরদের কথা কি আর বলবো, এরাঁ নাকি আরব-আজমের শাসক হবেন!”
বিদ্রুপ, উপহাস, বিরোধীতা ও প্রতিরোধের মাত্রা যতই বাড়ুক, কুরাইশ গোত্রের বিচক্ষণ লোকেরা অন্তরের অন্তস্থল থেকে নির্ঘাত উপলব্ধি করছিল যে, এ আন্দোলন কোন মামুলী জিনিস নয়, বরং এর অত্যন্ত সুদূর প্রসারী ফলাফল দেখা দিতে বাধ্য। একবার মক্কার শীর্ষ স্থানীয় কুরাইশ নেতারা উতবাকে রাসুলুল্লাহর সা. সাথে আলাপ আলোচনার জন্য পাঠালো। উৎবা সরকারী পদ, ধন-সম্পদ ও দুনিয়াবী স্বার্থ সংক্রান্ত সম্ভাব্য সব রকমের লাভজনক জিনিস দেয়ার প্রলোভন দেখালো, যাতে রসূল সা. কোন রকমে এই বিপ্লবী কর্মকান্ড পরিত্যাগ করতে রাজী হয়ে যান। তবে রাসূল সা. উৎবাকে সুরা হা-মীম এর প্রথম কয়েকটি আয়াত শুনিয়ে দিলেন। এর ফলে উৎবার চেহারাই বিবর্ণ হয়ে গেল। সে গিয়ে বললোঃ এ দাওয়াত তো একটা বিরাট পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ। একটা বিপ্লব ঘনিয়ে আসবে এবং সমাজ জীবনের সব কিছু ওলট পালট হয়ে যাবে। তাই সে পরামর্শ দিল যে, মুহাম্মদকে (সা.) তোমরা কিছু বলো না। সে যা করছে তা করতে দাও। বাধা দিও না। আরবের জনগণ যদি তাকে মেরে ফেলে, তাহলে তোমরা তার থেকে এমনিতেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে। আর যদি সে বিজয়ী হয়, তার রাজত্ব তোমাদেরই রাজত্ব হবে, তার মর্যাদা তোমাদেরই মর্যাদা হবে, এবং তোমরা বিশ্বে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী হবে।’ অথ্যাৎ কিনা উৎবার মত লোকও বুঝে ফেলেছিল যে, এই আন্দোলনের পশ্চাতে একটা সাম্রাজ্য লুকিয়ে রয়েছে। এবং এর পরণতি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়া আর কিছু নয়। সে যখন টের পেয়েছে, তখন রাসুল সা. ও তার সংগী সাথীরা কিভাবে টের না পেয়ে থাকবেন? (সীরাতে ইবনে হিসাম, ১ম জিল্দ, পৃঃ ৩১৪)
একবার যখন মুসলমানরা প্রচন্ড সহিংসতা ও নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল, তখন রাসূল সা. –এর সাথীরা তাঁর কাছে তাদের দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করলেন এবং ঐ অবস্থা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য দোয়া চাইলেন। রাসূল সা. প্রথমে তো তাঁদের বুঝালেন যে, আল্লাহর দ্বীনকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে পদে পদে কঠিন বাধার সম্মুখীন হতে হয়। অতীতে যারা এ দায়িত্ব পালন করেছে তাদেরকে অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশা ভোগ করতে হয়েছে। অতঃপর পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে তাদেরকে সুসংবাদ শুনালেন যে, “আল্লাহর কসম, এ কাজে আল্লাহ একদিন অবশ্যই চূড়ান্ত সাফল্য দান করবেন।’ অতঃপর এই সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে বলেনঃ
“এক ব্যক্তি সম্পূর্ণ একাকী সানা থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত সফর করবে, অথচ আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয়ে সে ভীত থাকবেনা।” [সীরাতে ইবনে হিসাম – প্রথম খন্ড, পৃঃ ৩১৪ (মুল আরবী পুস্তক)] অর্থাৎ পৃথিবীতে এমন এক ইনসাফপূর্ন সমাজ ও কল্যাণময় যুগ প্রতিষ্ঠিত হবে, এমন শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা চালূ হবে যে, আজ যেখানে ডাকাতি, রাহাজানি হত্যা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে, যেখানে মানব সন্তানকে দিনে দুপুরে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এবং প্রকাশ্যে নারীর সতীত্ব পর্যন্ত লুন্ঠিত হচ্ছে, সেখানে একজন ভ্রমণকারী সম্পূর্ণ একাকী নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে যত্রতত্র ভ্রমণ করতে পারবে। কেউ তার জান মাল ও মান সম্ভ্রমকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখাবে না। আর একবার রসূল সা. বলেছিলেন যে, এমন একটা যুগ প্রায় আসন্ন, যখন লোকেরা নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই মক্কায় যাতায়াত করবে। [শিবলী নোমানঃ সীরাতুন্নবী, ২য় খন্ড, ৩ পৃষ্ঠা]
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যেরূপ পরিষ্কার ও উজ্জল ধারনা এখানে ব্যক্ত করা হয়েছে, তা সত্যিই অতুলনীয়।
একবার রসূল সা. কা’বার চাবির রক্ষক উসমান বিন তালহাকে কা’বার দরজা খুলে দিতে অনুরোধ করলে উসমান সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলো। সে সময় দৃশ্যত চরম নৈরাজ্যজনক ও প্রতিকূল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তথাপি রসূল সা. বললেন, ‘সেই দিন বেশি দূরে নয়, যখন এই চাবি আমাদের হাতে থাকবে এবং আমরা যাকে দিতে চাইবো দিবো। [আল মাওয়াহিবুল লাদুনীয়া, কাসতালানী, ১ম খন্ড, পৃ: ১৫৮]
আকাবা নামক স্থানে মদীনার আনসারদের কাছ থেকে যে ঐতিহাসিক অংগীকার বা বায়আত নেয়া হয়েছিল, তা অধ্যয়ন করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ইসলামের প্রচারজনিত বিরোধ ও সংঘাত যে কত ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী হয়, তা আনসাররাও উপলব্ধি করেছিলেন। তারা এটাও উপলব্ধি করেছিলেন যে, এই বিরোধের চূড়ান্ত ফয়সালা পরবর্তীতে যুদ্ধের ময়দানেই হবে। এই অংগীকারের মধ্য দিয়ে একদিকে আনসারগণ রাসূল সা. এর সমর্থনে প্রয়োজনে সারা বিশ্বের সাথে যুদ্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দেন এবং নিজেদের সরদারদের ধ্বংশ ও জানমালের বিনাশকেও স্বাগত জানান। অপরদিকে রাসুল সা. এর কাছে থেকেও তারা প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে, আল্লাহ যখন আপনাকে বিজয়ী করবেন, তখন যেন আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন না। এই যে যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি, ত্যাগ ও কুরবানীর সংকল্প এবং বিজয়ের স্বপ্ন- এ সবের মধ্যে কি রাসূলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। [সীরাতে ইবনে হিসাম (আরবী), ২য় খন্ড, পৃ: ৫০, ৫১, যাদুল মায়াদ (আরবী) ১ম খন্ড, পৃ: ৫০,৫১]
হিজরতের জন্য যাত্রা শুরু করার আগে তাকে যে দোয়া শেখানো হয় তার শেষাংশ হলো, ”আর তোমার পক্ষ থেকে কোনো রাষ্ট্র শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও” [সুরা বণী ইসরাঈণ, আয়াত ৮০]
এ আয়াতে তাঁকে ’সহায়ক শক্তি’ প্রার্থনা করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। অথার্ৎ এই পবিত্র মিশনের পৃষ্ঠপোষকতা ও এই মহতী লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শাসন ক্ষমতার প্রয়োজন বিধায় শাসন ক্ষমতা প্রার্থনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
চাচা আবু তালেবের ওপর রাসূল সা. – এর সাফল্য ও সমর্থন পরিত্যাগ করার জন্য যখন চাপ সৃষ্টি করা হলো, তখন তিনি রসূল সা. কে বললেন, আমার জন্য সমস্যার সৃষ্টি করো না। এই সময়ে রাসূল সা. যে জবাব দেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ’ওরা যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাম হাতে চাঁদ এনে দেয়, তবুও আমি আমার এ লক্ষ্য পরিত্যাগ করবো না।” তার জবাবের শেষ কথাটা ছিল এই- ”হয় আল্লাহ আমার এই লক্ষ্যকে বিজয়ী করবেন, নচেৎ এ কাজ করতে করতেই আমি মৃত্যু বরণ করবো।” [সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড ২৭৮]
এখানে তিনি ‘বিজয়ী করবেন’ বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ করবেন’ বলেননি। ‘বিজয়ী’ শব্দটার মধ্যেই দ্বন্দ-সংঘাতের ধারনা বিদ্যামান। আর তাঁর শেষ বাক্যটি থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, এই দ্বন্দ-সংঘাতের তীব্রতা ছিল জীবনের ঝুকি পর্যায়ের।
হিজরতের পর আদী ইবনে হাতেম রাসূল সা.-এর কাছে এসে তার ব্যক্তিত্ব পরখ করতে লাগলেন। তিনি তারঁ দাওয়াতের ধারণা কী জানতে চেষ্টা করলেন এবং সমালোচকের দৃষ্টিতে তার চলন বলন পর্যবেক্ষন করলেন। আর এ কাজ করতে গিয়েই তার হৃদয় হয়ে পড়লো অভিভূত ও মুগ্ধ। আগন্তুকের চিন্তাধারার সাথে সংগতি রেখে তিনি তাকে জানালেন যে, ভবিষ্যতে বাবেলের সাদা ভবনগুলো ইসলামের অধীনে চলে আসবে, এখানে বিপুল ধনসম্পদ বিরাজ করবে এবং মুসলমানরা অসাধারন ক্ষমতা ও প্রতাপের অধিকারী হবে। সেই সাথে তিনি তাকে ইসলামী ইনসাফপূর্ণ সমাজব্যবস্থার এই বৈশিস্ট সম্পর্কেও অবহিত করলেন যে, অচিরেই তুমি দেখবে- এক মহিলা সুদূর কাদেসিয়া থেকে একাকী একটি উঠে সওয়ার হয়ে এই মসজিদ অভিমুখে রওনা হয়েছে এবং সম্পূর্ন নিরাপদে এখানে এসে পৌছেছে। বাহ্যত একেবারেই নিস্ব অবস্থায় হিজরতের সফরে যে নবীর দৃষ্টি সুরাকার হতে পারস্য সম্রাটের কংগন শোভা পেতে দেখেছে, তাঁর সম্পর্কে এ কথা কিভাবে বলা যায় যে, নিজের আন্দোলনের শেষ পরিনতি ও নিজের সূচিত নতুন সমাজ ব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না? এ কথা কিভাবে কল্পনা করা সম্ভব যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তার উদ্দেশ্য ছিল না, তার জন্য প্রস্তুতি ও সংগ্রাম করা হয়নি এবং তা নিছক পুরস্কার হিসাবে আকস্মিকভাবে রাসূল সা. এর সংগঠন কে দেওয়া হয়েছে? বলতে চাইলে বড়জোর এতটুকু বলা যায় যে, কেবল পার্থিব স্বার্থ ও ব্যক্তিগত প্রতাপ ও পরাক্রম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি রাষ্ট্র ও সরকার কায়েম করতে চাননি। কিন্তু আল্লাহর দ্বীনকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করা, ন্যায়বিচার ও ইনসাফ কায়েম করা, মানবতার মুক্তি নিশ্চিত করা এবং সমাজ গঠনের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র কাম্য ছিল না, একথা কেমন করে বলা যায়?
আসলে শুধু আকীদাগত ও নৈতিক বিপ্লব সাধনই রাসূল সা. এর উদ্দেশ্য ছিল না, বরং সেই সাথে পূর্ণ গুরুত্ব সহকারে রাজনৈতিক বিপ্লব সাধনও তাঁর লক্ষ্য ছিল। ব্যক্তির সংশোধনের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারও তার কাম্য ছিল। অন্য কথায় বলা যায়, রাসূল সা. মানুষকে একটা সামষ্টিক সত্তা বা সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। এবং তার সকল সামাজিক সম্পর্ক সহ তাকে সংশোধন করতে চেয়েছিলেন। রাসূল সা. মানুষকে সমাজ থেকে বিছিন্ন করে শুধু ব্যক্তি হিসাবেও বিবেচনা করেননি। এবং তার দাওয়াতকেও মানুষের ব্যক্তিগত জীবন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখেননি। এই বিষয়টি যদি স্বরণ রাখা হয় এবং রসূল সা. এর আগমনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে যদি তার সমস্ত ব্যাপকতা সহকারে অন্তরে বদ্ধমূল করা হয়, তাহলে সীরাতের ঘটনাবলীতে পরিপূর্ণ ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হবে এবং প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি পদক্ষেপ ও প্রতিটি উদ্যোগের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। অন্যথায় সীরাতের রহস্যও উদ্ঘাটিত হবে না, এবং পবিত্র কোরআনের বক্তব্যও স্পষ্ট হবে না।
একটি দীন একটি আন্দোলন
দর্শনের গন্ডী যতখানি, চিন্তার গন্ডীও ঠিক ততখানি। জীবনের বাস্তব কর্মক্ষেত্রে এবং ইতিহাসের চড়াই উতরাই-এর সাথে দার্শনিকের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকেনা। দার্শনিক ঘটনাবলী ও পরিস্থিতি- পরিবেশের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন বটে; কিন্তু ঘটনাবলী ও পরিস্থিতির মোড় ঘুড়িয়ে দেয়ার জন্য কোন কার্যকর চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রামে অংশ গ্রহন করেন না। প্রচলিত সংকীর্ণ অর্থে ধর্ম বলতে যা বুঝানো হয়, তার গন্ডী আরো একটু প্রশস্ত এবং তার দৌড় আরো একটু দীর্ঘ। সে কিছু আকীদা-বিশ্বাস দেয়ার সাথে সাথে ব্যক্তিকে সমাজ থেকে আলাদা করে একটা নৈতিক শিক্ষাও দেয়। তবে ধর্মের পথ সমাজ ব্যবস্থার বাইরে-বাইরে দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। সে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে যেমন মাথা ঘামায়না, তেমনি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও কোন ব্যাপক পরিবর্তন চায়না, এবং চলমান শাসনব্যবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ করে না। ধর্মের দাওয়াত সব সময় ওয়ায নসিহত ও উপদেশ দানের পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়ে থাকে। একজন ওয়ায়েয মিষ্টি মধুর কিছু উপদেশ দিয়েই বিদায় গ্রহন করেন। তাঁর শ্রোতারা কোন সংকটজনক পরিস্থিতিতে আটকা পড়ে আছে কিনা, ইসলাম বিদ্বেষী কুচক্রী মহল কোন আপত্তিকর তৎপরতা দ্বারা তাদের মানসিকতা ও চরিত্রকে বিকৃত ও বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে কিনা, দৈনন্দিন ঘটনাবলী ও পরিস্থিতি তাদের চরিত্রে কোন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে কিনা, তাঁর সদুপদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে কি কি মতাদর্শ ও চিন্তাধারা কোন কোন দিক থেকে কতখানি প্রভাব ফেলছে, তাঁর দেয়া ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত পরম ধর্মপ্রান ও খোদাভীরু লোকগুলো কোন অনৈসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে আছে কিনা,- সে সব বিষয় নিয়ে তার কোন মাথাব্যাথা থাকেনা। তাঁর মধ্যে কোন সামষ্টিক লক্ষ্য থাকে না। পরিবর্তনের কোন পরিকল্পনা থাকেনা। রাজনৈতিক ও নেতাসূলভ প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির কোন প্রয়োজন অনুভূত হয় না। জীবনের একটা ক্ষুদ্র অংশে আংশিক সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা সৃষ্টি করার জন্য যা কিছু করা সম্ভব, তা করা হয়। তারপর অবশিষ্ট বিস্তীর্ণ ময়দানে বাতিল ও অপশক্তি মহানন্দে আপন পতাকা ওড়াতে থাকলো কিনা, তা নিয়ে তারা আর মাথা ঘামায় না।
রাসূল সা. একজন দার্শনিক ছিলেন না যে, স্রেফ উচ্চাংগের কিছু ধ্যান ধারনা পেশ করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে এবং বাস্তব অবস্থা নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা তাকে করতে হবে না। তিনি নিছক একজন ওয়ায়েযও ছিলেন না যে, সর্বব্যাপী নৈরাজ্য ও উচ্ছৃংখলতা থেকে একেবারে চোখ বুজে কেবল ব্যাক্তিগতভাবে মানুষকে সম্বোধন করবেন, মিষ্টি মধুর উপদেশ বিতরন করবেন এবং তার পরিনতি কী হতে পারে, তা আদৌ ভেবেই দেখবেন না। মানবজাতির ত্রানকর্তা এই মহামানব পরিপূর্ণ সমাজ সচেতনতা সহকারে মানব জীবনের আমূল পরিবর্তন সাধনকেই নিজের ব্রত হিসাবে গ্রহন করেন। এ জন্য তিনি সামষ্টিক জীবনকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে, এমন প্রতিটি শক্তির সাথে পরিচিত হয়েছেন। জাহেলী সমাজ ও সভ্যতার চালক নেতৃবৃন্দের ওপর নজর রেখেছেন। যুক্তিপ্রমাণ সহকারে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত করেছেন। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার ওপর দৃষ্টি রেখেছেন। ঘটনা প্রবাহ ও পরিস্থিতির প্রতিটি তরঙ্গের প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন। প্রতিটি ঘটনাকে নেতাসূলভ অন্তর্দৃষ্টি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে যাচাই ও পরখ করেছেন যে, তা কোন দিক দিয়ে সংস্কারের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ও কোন দিক দিয়ে ক্ষতিকর? সমাজের সকল ধরনের মানুষের যোগ্যতা ও গুনাগুণ জানতে চেষ্টা করেছেন এবং তার আলোকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন যে, দাওয়াতের কাজে কখন কার কাছ থেকে কী সাহায্য আশা করা যায়। তিনি নিজের শক্তি ও গতিকে প্রতিপক্ষের শক্তি ও গতির সাথে তুলনা করতেন। প্রত্যেকটি পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ধৈর্যের সাথে প্রহর গুনতেন। উপযুক্ত সময়টা এসে যাওয়া মাত্রই সাহসের সাথে পদক্ষেপ নিতেন। জনমতের ওঠানামা কিভাবে হয়, তা যথাযথভাবে বুঝতেন এবং বিরোধীদের প্রতিটি অপপ্রচারের মোকাবিলা করে তাদের প্রভাব খর্ব করতেন। যখন দেখলেন, ইসলাম বিরোধী কবিতা ও বক্তৃতার একটা আসর তৈরী হয়ে গেছে, তখন তার পাল্টা আসর গড়ে তুললেন ইসলামী কবি ও গণবক্তাদের দ্বারা। ইসলামী নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন বটে, তবে চোখ বুঝে নয়। বরং পরিস্থিতি ও পরিবেশের দিকে দৃষ্টি রাখতেন, সময়ের চাহিদা বুঝতেন এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করতেন। যেখানে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ পাওয়া যেত, এগিয়ে যেতেন। এগিয়ে যাওয়া সমীচিন মনে না হলে অগ্রাভিযান থেকে বিরত থাকতেন। এক সাথে দুটো বিপদের সম্মুখীন হলে একটা থেকে আত্মরক্ষা করে অপরটার মোকাবিলা করতেন। সামরিক ব্যবস্থা গ্রহনের প্রয়োজন দেখা দিলে নিঃসংকোচে গ্রহন করতেন। সন্ধির সুযোগ সৃষ্টি হলে অকুন্ঠ চিত্তে সন্ধির হাত বাড়িয়ে দিতেন। সর্বোপরি, এই সব চেষ্টা সাধনায় আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও আনুগত্য এবং নৈতিক মূল্যবোধকে শুধু সংরক্ষণই করতেন না, বরং তার ক্রমাগত উন্নয়ন ও বিকাশ সাধন করতেন। এই গোটা কার্যক্রম ও কর্মপদ্ধতিকে যদি কোরআন ও সীরাত (মুহাম্মদ সা.-এর জীবনের ইতিহাস)-এর পাতা থেকে একত্রিত করে সামনে রাখা হয়, তাহলে ব্যক্তিগত পূজা উপাসনা, জপতপ ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ প্রচলিত পরিভাষার ‘ধর্ম’এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের আনুগত্য বোধক ‘আদ-দ্বীন’-এর পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যাবে। জানা যাবে-ওয়ায নসিহত ও বৈপ্লবিক আহবানের মধ্যে এবং ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধি ও সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে কি বিরাট ব্যবধান!
যেহেতু রসূল (সাঃ) একটি পূর্নাঙ্গ ও সর্বাত্মক জীবন বিধান বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, তাই তিনি এক এক করে সেই সব ব্যক্তিকে অনুসন্ধান করেছিলেন যারা স্বভাবগতভাবে সৎ। তারপর যার হৃদয়ে সত্যের আলো জ্বলে উঠেছে, তাকেই একটা সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন,তাকেই প্রশিক্ষণ দিয়ে দিয়েছেন, তাকে নিজের সাথে অগ্নি-পরীক্ষায় অংশীদার করেছেন। তারপর যেই স্তরে যতটুকু সংঘবদ্ধ শক্তি অর্জিত হয়েছে, তাকে আপন নেতৃত্বে বাতিল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইতে শামিল করেছেন। এ লড়াই যেমন চলেছে চিন্তার ময়দানে তেমনি চলেছে রাজনৈতিক ময়দানে এবং সর্বশেষ রণাঙ্গনেও। রসূল (সাঃ) এর পার্শ্বে যারা সমবেত হন, তাদের কে তিনি সুফি ও দরবেশ বানিয়ে দেননি। যোগী সন্যাসী রুপে গড়ে তুলেননি, তাদের মধ্যে দুষ্কৃতি থেকে কেবল নিজেকে রক্ষা করা, বিজয়ী বাতিল শক্তির ভয়ে ভীত থাকা, এবং ক্ষমতাধর ও বিত্তশালীদের ভড়কে যাওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করেননি। তারা নির্বোধ পর্যায়ের সরল ও ছিলেন না ,নিষ্ক্রিয় পর্যায়ের দুনিয়া ত্যাগিও ছিলেন না। তারা ছিলেন নির্ভীক ও সাহসী। সচেতন ও প্রাজ্ঞ, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও আত্ম অভিমানি, সুচতুর ও বিচক্ষণ, কর্মঠ ও নিরলস এবং অগ্রগামী ও দ্রুতগামী। তারা পাদ্রী ও সাধুদের মতন কর্মবিমুখ ছিলেন না। বরং সদা করমচঞ্চল ছিলেন ও সব রকমের সদগুণাবলী ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। এভাবে সর্বোত্তম স্বভাবের মানুষ গুলো উৎকৃষ্টতম প্রশিক্ষণ পেয়ে, উৎকৃষ্টতম সাংগঠনিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এবং সর্বোত্তম নেতৃত্বের অধীনে সমবেত হয়ে এক অপরাজেয় শক্তিতে পরিনত হন। এ কারনেই তারা একটি ক্ষুদ্র সংখ্যা লঘু হয়েও সমগ্র আরবের বিপুল সংখ্যা গুরু জনতাকে নিজেদের অধীনে সংঘবদ্ধ করতে সমর্থ হন। মক্কায় যখন ইসলামী সংগঠনের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ জন, তখন মক্কা ও তার আশেপাশের গোটা জনপদে তারা এক সার্বক্ষণিক চাঞ্চল্য ও উদ্দীপনার জোয়ার সৃষ্টি করেন। এর পর বছরের পর বছর ব্যাপি ঘরে ঘরে অলিতে গলিতে সবচেয়ে বহুল আলোচিত বিষয় যদি কিছু হয়ে থাকে,তবে তা ছিল রসূল (সাঃ) ও তার সঙ্গিদের দাওয়াতি তৎপরতা। মদিনায় গিয়ে যখন ইসলামি আন্দোলনের নিশানবাহীদের সংখ্যা কয়েকশোর বেশি হয়নি, এবং অমুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তখনই ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা হোল। রসূল (সাঃ) ও তার ইসলামী সংগঠনের নীতি এরূপ ছিল না যে,আগে সমগ্র আরব সমাজ ইসলাম গ্রহন করুক অথবা অধিকাংশ লোকের চরিত্র সংশোধন সম্পন্ন হোক, তার পর ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেয়া যাবে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এরকম ছিল না যে আগে দাওয়াতের কাজ চলতে থাকুক, এবং চিন্তা ও আকীদা বিশ্বাসের সংস্কার ও সংশোধন হতে থাকুক। অবশেষে একদিন ইসলামী রাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা আপনা আপনিই তৈরি হয়ে যাবে, অথবা পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ইসলাম কে বিজয়ী করে দেবেন। সেখানে ইতিহাসের এই চিরায়ত সত্যকে অনুসরণ করা হয়েছিল যে, জনগনের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ চিরদিনই অজ্ঞ ও নিষ্ক্রিয় থাকে এবং সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশই থাকে সক্রিয়। এই সক্রিয় অংশের একভাগ সংস্কার ও বিপ্লবের দাওয়াত নিয়ে মাঠে নামে আর অপর অংশ তাতে বাধা দেয়। সমাজের সক্রিয় অংশের এই দুই ভাগের মধ্যেই চলে আসল দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। এই সংঘাতের যখন ফয়সালা হয়ে যায়, তখন জনগন আপনা আপনি সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা জানতেন যে, জনগনের পথে যতক্ষণ কোন ভ্রষ্ট নেতৃত্ব বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,এবং তাদের জীবন কে বিকৃত করার অপচেষ্টা চলতে থাকে,অথবা অন্তত পক্ষে তাদের অজ্ঞতা ও নিষ্ক্রিয়তার অন্ধকারে ফেলে রাখে, ততক্ষণ তারা ব্যাপকভাবে কোন দাওয়াত কে গ্রহন করতেও পারে না এবং নিজেদের বাস্তব জীবনে কোন পরিবর্তন আনতেও সক্ষম হয়না। এমন কি যারা দাওয়াত কে গ্রহন করে, তাদের পক্ষেও সম্ভব হয় না যে, তারা বিকারগ্রস্থ নেতা ও শাসকদের তৈরি করা নোংরা পরিবেশে নিজেদের জীবনকে পরিপূর্নভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলবে। বরঞ্চ পরিবর্তন আনতে যদি অনেক বেশি দেরি হয়ে যায় তবে অনেক সময় সেই মান বজায় রাখাও কঠিন হয়ে দাড়ায়, যে মানে সত্যের আহবায়করা দীর্ঘদিনের চেষ্টা সাধনা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে পৌছতে পেরেছিলেন। কেননা প্রতিকূল পরিবেশ মানুষকে পেছনে ঠেলে দিতে ক্রমাগত শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। সুতরাং কোন সামাজিক আন্দোলনের স্বাভাবিক কর্মপন্থা এতটাই হয়ে থাকে যে, সমাজের সক্রিয় অংশ থেকে সৎ স্বভাবের লোকগুলোকে বাছাই করে যত বেশি সম্ভব শক্তি সঞ্চয় করে নিতে হয়, এবং সেই শক্তিকে সংঘর্ষে নিয়োজিত করে প্রতিপক্ষের নেতৃত্বের জোর চূর্ণ করে দিতে হয়। ইতিহাস সাক্ষী যে, এযাবৎকাল সংঘঠিত প্রতিটি বিপ্লব সক্রিয় সংখ্যা লঘুদের হাতেই সংঘটিত হয়েছে। যেহেতু যে কোন সংস্কার ও গঠনমূলক আহবান সমাজের সক্রিয় অংশের মধ্যে থেকে কেবল সৎ স্বভাব সম্পন্ন লোকদেরকেই আকৃষ্ট করে থাকে, তাদের মধ্যে একটা ইতিবাচক আবেগ ও প্রেরনার সৃষ্টি করে, এবং তাদের কে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের নৈতিক বল বাড়িয়ে দেয়, তাই প্রতিপক্ষ প্রচুর শক্তি, প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষেত্র বিশেষ সংখ্যাধিক্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মোকাবেলায় পরাজিত হয়ে থাকে। এর একটা উল্লেখযোগ্য ও অকাট্য প্রমান হচ্ছে বদরের যুদ্ধ। সুতরাং যখন রসূল (সাঃ) এর চারপাশে আরবিও সমাজের সক্রিয় সৎস্বভাব সম্পন্ন লোকের এত অধিক সংখ্যা একত্রিত হয়ে গেল যে, তারা নৈতিক শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে জাহেলী নেতৃত্ব ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম, তখন তিনি নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য অভিমুখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিন্দুমাত্রও কুণ্ঠিত হলেন না। মক্কা বিজয়ের তাৎপর্য এটাই যে, এর মাধ্যমে জাহেলী নেতৃত্ব সম্পূর্ণরূপে উৎখাত ও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে জনসাধারনের মাঝ থেকে সকল বাধা অপসারিত হওয়ায় তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে এগিয়ে আসে। ইতিহাসের একটি দৃষ্টান্তও এমন নেই যে, সত্যভ্রষ্ট নেতৃত্বের অধীনে কোন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছাড়াই নিছক ওয়াজ-নসিহত, তাবলীগ ও ব্যক্তিগত সংশোধনমূলক কাজ দ্বারা বিপ্লব সংঘটিত হয়ে যেতে পেরেছে। নচেৎ বিগত তেরো শতাব্দীতে খেলাফতে রাশেদার পর ওয়াজ-নসিহত, তাবলীগ প্রচার এবং তা’লীম ও আত্মশুদ্ধির নামে মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ সমূহের আওতায় প্রচুর চেষ্টা সাধনা চলেছে এবং আজও আলেম, সূফী পীর মাশায়েখ মাদ্রাসা শিক্ষক ও লেখকগণ মুখ ও লেখনির মাধ্যমে এত ব্যাপক ও বিপুল পরিমান প্রচার কার্য চালিয়ে যাচ্ছেন, যা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইপ্সিত সংখ্যক লোকের আত্মশুদ্ধিও হতে পারলনা। সমাজ সংস্কারের কাজও এতটা এগুলোনা যে, এর কল্যাণে সমাজ ব্যাবস্থাটা পাল্টে যাবে এবং রসূল (সাঃ) এর বিপ্লবের পূনরাবৃত্তি হবে। পরিষ্কার বুঝা যায় যে এ যাবতকার চিন্তাধারা, কর্মপদ্ধতি ও বিপ্লবী মতাদর্শে বড় রকমের কোন খুঁত ছিল। আর সেই খুঁত এই যে, নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত এড়িয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু লোককে সামগ্রিক সমাজ ব্যাবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দাওয়াত দেয়া ও সংশোধন করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। কেউ কেউ বলে যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করাটা আসল লক্ষ্য ছিল না, বরং আকস্মিকভাবে আল্লাহর পুরস্কার হিসেবে এসে গিয়েছিল। কিন্তু তারা যখন এ কথাটা বলে, তখন রসূল (সাঃ) এর কৃতিত্বপূর্ণ অবদান ও প্রানান্তকর সংগ্রামের শুধু অবমূল্যায়নই করেনা, বরং কালিমা লেপন করে। একটু ভাবুন ত এই মহান ব্যক্তিত্ব কত কষ্ট করে মদীনার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকেদেরকে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে একটা সাংবিধানিক চুক্তির আওতাভুক্ত করে ফেললেন, কত কাঠখড় পুড়িয়ে মদিনার পার্শ্ববর্তী গোত্র সমূহের সাথে মিত্রতা ও সখ্যতার সম্পর্ক স্থাপন করলেন। কত দক্ষতার সাথে মুষ্টিমেয় সংখ্যক মুসলমানদেরকে নিয়ে একটা দুর্ভেদ্য সামরিক বাহিনী গড়ে তুললেন এবং নিয়মিত সামরিক টহলের ব্যাবস্থা করলেন। কত চেষ্টা সাধনা দ্বারা কোরাইশদের বানিজ্যিক পথ অবরোধ করলেন। কত দৃঢ়তার সাথে কোরাইশদের আগ্রাসী আক্রমণ প্রতিহত করলেন। কেমন চাতুর্যের সাথে ইহুদি ও মোনাফেকদের ষড়যন্ত্র নস্যাত করলেন। কত বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করলেন। কি দুরন্ত সাহসিকতা নিয়ে ইহুদিদের যোগসাজশের সব কটি ঘাটি একে একে সমূলে উৎপাটন করলেন এবং কেমন সজাগ মস্তিষ্ক নিয়ে তিনি অসংখ্য দুর্ধর্ষ গোত্রের আঞ্চলিক বিদ্রোহের অবসান ঘটালেন। এই সব পদক্ষেপ তাঁর রাষ্ট্রনায়ক সূলভ অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক দক্ষতা ও বিচক্ষণতা ও সুণিপুন কর্মকুশলতার যে বিস্ময়কর নজীর বিদ্যমান, তা কেমন করে এই সব লোকের দৃষ্টি এড়ায়, বুঝে আসে না। এই সব কিছুকে আল্লাহর পুরস্কার বলা সম্পূর্ণ সত্য কথা। কেননা প্রত্যেক ভাল জিনিসই আল্লাহর পুরস্কার হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ কোন পুরস্কার তখনি পায় যখন সে তার জন্য চেষ্টা সাধনা যথাসাধ্য বুদ্ধিমত্তা ও অন্তর্দৃষ্টি সহকারে করে দেখায়। দ্বীন প্রতিষ্ঠাকে আল্লাহর পুরস্কার বলার মাধ্যমে কেউ যদি রসুল(সাঃ) এর সংগ্রাম, কঠোর পরিশ্রম, দক্ষতা, কুশলতা, প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতাকে অস্বীকার করতে চায়, তবে সে মস্ত বড় অবিচার করে। দুর্ভাগ্যবশত, রসূল (সাঃ) এর রাজনৈতিক দিকটা এত অস্পষ্ট রয়ে গেছে যে আজ তাঁর দাওয়াত ও লক্ষ্য সম্পর্কে সঠিক ধারনা পোষণ করা কঠিন হয়ে গেছে। অথচ এই দিকটা সমগ্র নবী জীবনী অধ্যয়নের সময় সামনে না থাকলে ধর্মের প্রচলিত সংকীর্ণ ধারনা ও দ্বীনের সর্বব্যাপী ধারনার মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে সেটা বুঝা সম্ভব নয়। রসুল(সাঃ) একটা পুর্নাঙ্গ জীবন বিধান বা দ্বীন নিয়ে এসেছিলেন, সেই সত্য ও নির্ভুল দ্বীনের ভিত্তিতে সমগ্র জীবনের কার্যবিধি ও আচরণবিধি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, এবং আল্লাহর আইনকে বাস্তবায়িত ও কার্যকরী করতে এসেছিলেন। কাজেই আমাদের এটা উপলব্ধি করা চাই যে রসুল(সাঃ) পুর্নাঙ্গ ও সর্বাত্মক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার ও পুনর্গঠনের আন্দোলন চালাতে এসেছিলেন। আর এই আন্দোলন চালানোর জন্য তাঁর মধ্যে ছিল সর্বোত্তম রাষ্ট্রনায়ক সুলভ প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, মনীষা, অন্তর্দৃষ্টি এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক চেতনা ও বুদ্ধিমত্তা। অন্য কোন দিক দিয়ে যেমন রসূল (সাঃ) এর সমকক্ষ কেউ নেই, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও তাঁর সমতূল্য কেউ নেই। তিনি জীবনের প্রতিটি ব্যাপারেই যেমন অনুকরনীয় আদর্শ, তেমনি রাজনৈতিক সংগ্রাম ও চেষ্টা সাধনায়ও একমাত্র তাঁর জীবনই আদর্শ। রসুল(সাঃ) এর কীর্তি ও অবদান এই যে, তিনি সততার দাওয়াত দিয়েছেন, সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়েছেন এবং একটা পুর্নাঙ্গ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। ধর্মের সীমিত ও সংকীর্ণ ধারনার মধ্যে এত বড় ও বিশাল কাজের স্থান সংকুলান হতে পারে না। সুতরাং এটা ছিল দ্বীন তথা পুর্নাঙ্গ জীবনবিধান, নিছক ধর্ম নয়। এটা ছিল এক সর্বাত্মক আন্দোলন- নিছক কোন আধ্যাত্মিক যোগ সাধনা নয়।
জীবনের অবিভাজ্য পুর্নাঙ্গতা
মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মহান আন্দোলন এক অনন্য বিপ্লব সংঘঠিত করার মাধ্যমে যে সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, তার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তার মূল কলেমার চেতনা ও প্রেরনা জীবনের প্রতিটি বিভাগে ও প্রতিটি ক্ষেত্রে একই ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। গোটা সমাজ ব্যবস্থায় পরিপুর্ণ একাত্মতা ও সমন্বয় বিরাজ করত। সকল প্রতিষ্ঠান ছিল এক এ রঙে রঞ্জিত ও একই ভাবধারায় উজ্জীবিত। মসজিদের চার দেয়ালের মাঝে যে আল্লাহর এবাদত করা হতো, সেই আল্লাহরই আনুগত্য করা হতো বাজারে ও ক্ষেত খামারে। যে কোরআন নামাযে পড়া হতো, সেই কোরআনেরই আইন আনুসারে মোকদ্দমার ফয়সালা হতো আদালতে। যে নৈতিক নীতিমালা সীমিত পারিবারিক পরিবেশে কার্যকর ছিল, আন্তর্জাতিক কর্মকান্ডেও অনুসৃত হতো সেই একই নীতিমালা। যে সত্য ঘোষিত হতো মসজিদ মিম্বর থেকে, সেই একই সত্য অনুসারে চলত সরকারি প্রশাসন। যে আকীদা বিশ্বাস প্রতিটি ব্যক্তির অন্তরে বদ্ধমূল করানো হতো, সেই আকীদা বিশ্বাসই কার্যকর থাকতো সামগ্রিক অবকাঠামোতে। যে চিন্তাধারা শিক্ষা ব্যবস্থায় সক্রিয় থাকতো সে অনুসারেই রূপায়িত হতো সমগ্র সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। আল্লাহর সন্তুষ্টি যেমন নামায রোযায় কাম্য থাকতো, তেমনি রনাঙ্গনেও অসি চালনা ও তীরবিদ্ধ হওয়ার সময় সক্রিয় থাকতো সেই একই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এ ছিল এমন এক সমন্বিত বিধান, যার আওতায় সমগ্র মানব জীবন একই খোদায়ী নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত হতো। জীবনের এক এক বিভাগে এক এক রকম মূল্যবোধ ও নির্দেশ চলতনা। এ বিধানে কোন স্ববিরোধীতা ছিল না। এর এক অংশ অপর অংশের সাথে সাংঘর্ষিক ছিলনা। এর বিভিন্ন অংশে কোন জটিলতা, অস্পষ্টতা জোড়াতালি বা জগাখিচুড়ি ছিলনা। এ জন্যই এর আওতায় মানব জাতি যেরূপ দ্রুত গতিতে উন্নতি ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল, ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।
বিপ্লবের প্রাণশক্তি
মানবতার সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য সম্ভবত এটা যে, ইতিহাসে যখনই কোনো ব্যক্তি ক্ষমতার মসনদে আসীন হবার সুযোগ পেয়েছে- তা সে তরবারীর বলে, ষড়যন্ত্ররের মাধ্যমে, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে, কিংবা কোন আকস্মিক ঘটনা চক্রে, যেভাবেই হোক না কেন সে নিজেকে এরূপ ভাবতে শুরু করেছে যে, সে মানুষের শুধু শাসক নয়, বরং মানুষের শিক্ষক ও সমাজের সংস্কারকও বটে। এ ধরনের স্বকল্পিত শিক্ষক ও সংস্কারকের উপর যখন শাসন ক্ষমতা ন্যাস্ত হয় তখন সে সর্বেসর্বা ও সর্বময় ভাগ্য বিধাতা হয়ে জেঁকে বসে। নিজেকে সে পৃথিবীর সেরা চিন্তাবিদ ভাবে। সে জ্ঞানের প্রতিটি উৎসের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে এবং সমাজের সর্বোত্তম সচেতন ও প্রজ্ঞাবান লোকদের দূরে সরিয়ে রেখে নির্বিচারে এমন সব পদক্ষেপ গ্রহন করে থাকে, যে তার প্রতিটি পদক্ষেপ এক একটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা সাব্যস্ত হয়ে থাকে। তারা সহিংস পদ্ধতিতে মানুষ কে প্রকৃত মানুষ বানাতে ও ডান্ডা মেরে সব কিছু কে ঠান্ডা করতে চায়। বিপ্লব ও সংস্কারের এই সব স্বঘোষিত দাবীদার অনেক সময় মানুষের জন্মগত স্বভাব প্রকৃতির খোঁজ খবরই রাখে না। জীবনের ভাঙ্গা গড়া কী কী কারণে অনিবার্য হয়ে উঠে, তার প্রাথমিক জ্ঞানও তাদের থাকে না। তারা কখনই জানতে চেষ্টা করে না যে, মানুষের মনুষ্যত্ব শেখানোর সঠিক পন্থা কী, বিকার ও বিভ্রান্তির উৎসটা কোথায়? তার সংশোধন ও প্রতিকারের কাজটা কোথা থেকে শুরু ও কোথায় গিয়ে শেষ হয়? তারা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাকে কাজে না লাগিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে শুরু করে। তারা পরামর্শ ও সমালচনার দুয়ার বন্ধ করে দেয়, যাতে তাদের কোন হিতাকাংখী ও মানব প্রেমিক তাদের ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা অর্জনের পথে বাধা দিতে না পারে। সকল রোগের একটাই ধ্বন্বন্ডরি ঔষধ চিনে। সেটা হচ্ছে বলপ্রয়োগ ও সহিংসতা। অর্থাৎ কড়া কড়া আইন প্রনয়ন ও নিত্য নতুন কঠোর বিধি জারী করা। মানুষের চারপাশে গোয়েন্দা লাগিয়ে দেয়া এবং বার বার কঠোর শাস্তি দিয়ে তাদের ওপর গায়ের ঝাল ঝারা। মানবতার মুক্তিদুত বিশ্বনবী (সাঃ) যে বিপ্লব সংঘটিত করেন তার প্রানশক্তি হিংস্রতা ও বলপ্রয়োগ ছিল না, বরং হিত কামনা ও ভালবাসাই ছিল তার চালিকা শক্তি। তিনি মানুষের উপর যার পর নাই দয়ার্দ্র ছিলেন। আদম সন্তানদের প্রতি তাঁর ছিল সত্যিকার দরদ ও ভালবাসা। নিজের দাওয়াতকে তিনি এরূপ উদাহরণ দিয়ে বুঝানর চেষ্টা করেছেন যে, তোমরা পতঙ্গের মতন আগুনের গুহার দিকে এগিয়ে যাচ্ছ, আর আমি তোমাদেরকে ধরে ধরে টা থেকে বাচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ জন্যই কোরআন তাঁকে সারা বিশ্বের জন্য করুনা স্বরূপ বলে অভিহিত করেছেন। একটু ভেবে দেখুন তিনি এতবড় বিপ্লব সংঘটিত করলেন, অথচ তাতে বলপ্রয়োগ ও সহিংসতার একটি দৃষ্টান্তও খুঁজে পাওয়া যায় না। রসূল (সাঃ) যে দশ বছর মদিনায় কাটান, তার পুরটাই ছিল সাংঘাতিক রকমের জরুরী অবস্থার আওতাধীন। প্রতি মূহুর্তে আক্রমনের ভয় লেগেই থাকতো। কোরায়েশরা তিন তিনবার বড় ধরনের আক্রমন চালিয়েছে। এখানে সেখানে ছোট খাট যুদ্ধ ও সীমান্ত সংঘর্ষ তো নিত্যকার ব্যাপার হয়ে পরিনত হতে গিয়েছিল। মদিনার বাইরে বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্র মদিনার উপর আক্রমন চালানোর জন্য নানা সময় নানা দিক থেকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো। টহল দেয়া বা উপদ্রব নির্মূল করার জন্য মদীনা থেকে ছোট ছোট সেনাদল পাঠানো হতো। রাতের বেলা সামরিক প্রহরা বসানো হতো। এক কথায় বলা যায়, সামরিক শিবিরের মতো জীবন যাপন করা হতো। তদুপুরি ইহুদী ও মোনাফেকদের নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র জনজীবনকে করে তুলতো দুর্বিষহ। কখনো যুদ্ধ বাধানোর ষড়যন্ত্র, কখনো মুসলিম সমাজকে খন্ড বিখন্ড করা ও মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে সংঘাত লাগালোর ষড়যন্ত্র, কখনো রসূল সা; এর নেতৃত্বকে ব্যর্থ ও বিফল করার ষড়যন্ত্র এমনকি কখনো কখনো স্বয়ং রসূল সাঃ কে হত্যা করার ষড়যন্ত্রও পাকানো হতো। এর চেয়ে মারাত্মক জরুরী অবস্থা আর কি হতে পারে? কিন্তু রসূল সাঃ কখনো একনায়কসুলভ ভূমিকাও পালন করেননি। কোন জরুরী অবস্থা জারী করেননি। কোন স্বেচ্ছাচারিতামূলক বিধিও চালু করেননি। কোন ব্যক্তিকে নিরাপত্তা আইনের অধীনে কারাগারেও পাঠাননি। জরুরী অবস্থাকালীন সংক্ষিপ্ত আদালতও বসাননি। চাবুক মেরে মেরে মানুষের চামড়াও তুলেননি। কারো উপর জরিমানাও আরোপ করেননি। কোন নাগরিকের উপর আল্লাহর আইনের অতিরিক্ত বোঝাও চাপাননি। সমালোচনা ও ভিন্নমত পোষণের অধিকারও হরণ করেননি এবং কারো উপর কোন বিধি নিষেধও আরোপ করেননি। এমনকি আবদুল্লাহ বিন উবাই এর মতো ভয়ংকর কুচক্রী গৃহশত্রুর বিরুদ্ধেও তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। নিজের দাওয়াতের নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও নিজের চরিত্রের পবিত্রতার উপরই তিনি পুরোপুরি নির্ভর করতেন। না কাউকে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন, না কারো মনুষ্যত্বের উপর তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছেন, আর না অহংকার ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছেন। বরঞ্চ এমন লোকদের ঔদ্ধত্য ও অহংকারকে তিনি ধৈর্যের সাথে বরদাশত করেছেন, যারা বাহ্যত আস্ফালন করলেও আসলে ছিল দুর্বল ও অসহায়। এ কারনে শত্রুদের মনও তিনি অনায়াসে জয় করে ফেলতেন,সাথীরা যে কোন নতুন ও পুরাতন আইনকে স্বাগত জানাতে সদা প্রস্তুত থাকতেন এবং বিরোধীরা তাঁর সামনে নিজকে অত্যন্ত নীচ ও হীন মনে করতো। তারপর যখন তারা তাঁর সত্যবাদিতা ও নিষ্ঠার সামনে মাথা নত করে ইসলাম গ্রহণ করতো তখন তাদের মধ্যে সূচিত হতো সর্বোত্মক ও আমূল পরিবর্তন।
রসূল সাঃ এর অন্তরে যে খোদা প্রেম সক্রিয় ছিল , তারই আরেক রূপ ছিল প্রগাড় মানব প্রেম। তাঁর এই মানব প্রেমের সঠিক ধারনে লাভ করতে হলে এই কয়টি ঘটনা দ্বারাই তা লাভ করা যায়। তাহলো, মক্কাবাসী তাঁকে মদীনায় গিয়েও শান্তিতে বাস করতে দেয়নি। তারা যখন দুর্ভিক্ষ কবলিত হোল, তখন তিনি তাদেরকে খাদ্যশস্য পাঠিয়ে সাহায্য করলেন এবং পাঁচশো স্বর্ণ মুদ্রা নগদ পাঠালেন। বদরের যুদ্ধবন্দীদের ‘উহ’ ‘আহ’ শব্দ কানে যাওয়া মাত্রই তাঁর ঘুম হারাম হয়ে যাওয়া এবং তাদের বাঁধন ঢিলা করে দেয়ার ঘটনা থেকেও তাঁর মানব দরদী স্বভাব আচ করা যায়। বনু হাওয়াযেন গোত্রের ছয় হাজার যুদ্ধবন্দীকে যে মাত্র একটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রসূল সাঃ এর নির্দেশে মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, সেটিও ছিল তাঁর মহানুভবতার জ্বলন্ত উদাহরণ। এরপরও রসূল সাঃ এর আর কোন মানব দরদী পরিচয় যদি পেতে হয়, তবে মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর অভাবনীয় আত্মপ্রকাশ লক্ষ্য করুন। মানবতার এই মুক্তিদূত একজন পরিপূর্ণ বিজেতা হিসেবে মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে যারা বিশ বছর ধরে লড়েছে তারা তাঁর সামনে একেবারেই অসহায়ভাবে দাঁড়িয়েছিল। অন্য কেউ হলে প্রতিটি আক্রমনের প্রতিশোধ নিত। ব্যাপক গণহত্যার নির্দেশ দিত এবং রক্ত গঙ্গা বইয়ে তবে ছাড়তো। লাশের স্তূপ না ফেলে কিছুতেই যেত না। আরব সমাজের সর্বজন স্বীকৃত রীতিপ্রথার কথাই বলুন , নৈতিকতার কথাই বলুন অথবা আইন কানুনের কথাই বলুন, সব কিছুর বিচারেই মক্কাবাসী ছিল ঘোরতর অপরাধী। ধর্ম ও রাজনীতি উভয় দিক দিয়ে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য হয়ে গিয়েছিলো প্রাণদণ্ড। কিন্তু বিজয়ের মূহুর্তে রসূল সাঃ এর হৃদয় মানবপ্রেমে বিগলিত হয়ে গেলো এবং কোরায়েশদের অত্যাচার নির্যাতনের গোটা ইতিহাসকে ক্ষমার আওতাভুক্ত করে ঘোষণা করলেনঃ
“তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আর কোন অভিযোগ নেই। তোমরা যেতে পার। তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন”
উপরন্তু তিনি তাদের মন জয় করতে তাদের ধন সম্পদ দান করলেন এবং তাদেরকে অপমান ও প্রত্যাখান করার পরিবর্তে বিভিন্ন দ্বায়িত্ব অর্পন করলেন ও বুকে টেনে নিলেন। রসূল সাঃ এর কাছে এটি সত্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট ছিল যে , যে বিপ্লব প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ করে, তা আপনা থেকেই খতম হয়ে যায়। আর যে বিপ্লব ক্ষমা ও মহানুভবতা প্রয়োগ করে তা শত্রুকেও বশীভূত করে এবং প্রতিরোধকারীদেরকে সেবকে পরিণত করে।
শুধুমাত্র কোরায়েশদের বাড়াবাড়ির কারণেই রসূল সাঃ এতটুকু কঠোর পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হন, যাতে তাদের রক্তপিপাসু তরবারির ধার ভোতা হয়ে যায়। তারা তাঁর কাধের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার পর তিনি ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজকে সুরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবে মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মহানবী (সাঃ) এমন সমরনীতি ও এমন প্রতিরক্ষা কৌশল উদ্ভাবন করেন, যাতে নুন্যতম প্রাণহানি ও নুন্যতম রক্তপাত হয় এবং রণাঙ্গনেও মনুষ্যত্বের মর্যাদা সমুন্নত থাকে।
মানব প্রেমের এমন উজ্জ্বল ও ব্যাপক দৃষ্টান্ত অন্য কোন বিপ্লবে পাওয়া যায়না। রসূল সাঃ এর বিপ্লব ছিল একটা নির্ভেজাল শিক্ষামূলক বিপ্লব এবং তার ভিত্তি ছিল মানবতার কল্যাণকামিতার উপর প্রতিষ্ঠিত।