জনমতের ওপর জেহাদের প্রভাব
ইতিপূর্বে আমরা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে প্রমাণ করেছি যে, ইসলামী আন্দোলন ও জাহেলিয়াতের মধ্যে আসল বোঝাপড়া যুদ্ধের ময়দানে নয় বরং জনমতের ব্যাপকতর ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আঠারো বিশ বছর ধরে সেই বোঝাপড়া চলেছে এবং এই ব্যাপকতর ময়দানেই চূড়ান্ত ফয়সালাও হয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে, এই চূড়ান্ত ফয়সালা হওয়ার ব্যাপারে সশস্ত্র জেহাদের কোন অবদানই ছিলনা।
সংস্কার সংশোধন ও পূনর্গঠনে শক্তিশালী দাওয়াতী বক্তব্য নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ন প্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু সামষ্টিক জীবনে আজ পর্যন্ত এমন কোন বিপ্লব সংগঠিত হয়নি, যার উদ্যোক্তারা নিজেদেরকে বাস্তব ময়দানেও বলিষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ ও বিজয়ী প্রমাণ করতে এবং পথের বাধা দূর এবং অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রতিরোধ খতম করার জন্য প্রয়োজনীয় মূহুর্তে সাফল্যের সাথে শক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়না। ধর্ম তো মনব জীবনের একটা ক্ষুদ্র জায়গার সাথে সম্পৃক্ত। স্রেফ এই ধর্ম নিয়েই যদি চলতে চান, তাহলে ওয়াজ, নসিহত ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাদীক্ষা চেয়ে বেশী কোন তৎপরতার প্রয়োজন হয়না। মাথার উপরে যে ধরণের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থাই থাক না কেন, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড যেভাবেই চলুক না কেন, মানুষের মনে কিছু ভাল আকিদা বিশ্বাস ঢুকানোর অবকাশ ও থাকতে পারে। তাদেরকে কিছু জপতপ,মন্ত্র তন্ত্র,ওযিফা,দোয়া ইত্যাদি শিখানো যেতে পারে এবং বিনয়, নম্রতা, দয়া, সহানুভূতি ইত্যাকার সদগুণ দিয়েও কিছুটা সজ্জিত করা যেতে পারে। একটা বাতিলপন্থী ও শোষণ নিপীড়নমূলক সমাজ ও রষ্ট্রিও ব্যবস্থার আওতাধীন তৎপরতা চালাতে গিয়ে এবং ঐ ব্যবস্থার তৈরি করা চরম মানবতা বিরোধী পথে জীবিকা উপার্জন ও স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে বিবেকে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেই ক্ষতকে সুফিবাদী পদ্ধতির ব্যক্তি কেন্দ্রিক সংস্কার ও সংশোধন প্রক্রিয়া ও তার তৈরি পীরি মুরিদীর প্রতিষ্ঠান গুলো নানা রকমের প্রলেপ দেয়। নিকৃষ্টতম সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষুদ্র গৃহ নির্মানকারী ধর্মগুলো আসলে মানুষের পলায়নপর মনোবৃত্তিরই সৃষ্টি। সামষ্টিক জীবনে বড় বড় অপরাধ সংগঠিত করা এবং লোমহর্ষক নির্যাতন চালানোর পর সে ব্যক্তিগত ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার জোরে নিজের খোদাকে ও বিক্ষুব্ধ বিবেককে সন্তুষ্ট করে। কিন্তু যে ধর্ম মানব রচিত বিধানের সাথে আল্লাহ্ জিকির ও ধ্যানের লেজুড় লাগিয়ে সন্তুষ্ট হয়না বরং গোটা জীবনকে নিয়ন্ত্রন ও পরিচালনা করতে চায়, তার কাজ নিছক আবেদন,নিবেদন কেন্দ্রিক ওয়াজ নসিহত, নিভৃত কোণে বসে আধ্যাত্মিক সাধনা ও জনসেবার সীমিত তৎপরতায় সমাধা হয়না, বরং তার জন্য বাতিলের খাঁচা ভাঙ্গা, জুলুমবাজির প্রতিরোধ করা, ও শান্তি ও ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা সম্বলিত নতুন সভ্যতার ভিত্তি পত্তন করা জরুরী হয়ে থাকে। সামষ্টিক জীবনে পরিবর্তন আনা বিনা বাধায় অসম্ভব। আর বাঁধা দূর করার জন্য কেবল ওয়াজ নসিহত যথেষ্ঠ হয়না। যাদের প্রতিষ্ঠিত কায়েমি স্বার্থকে উৎখাত করা হয় এবং যাদের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়, তারা ধ্বংসাত্মক কাজে নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কোন আন্দোলন দ্বারা তাদেরকে শক্তি প্রয়োগ করে পথ থেকে না হটানো পর্যন্ত সমাজ সংস্কারের স্বপ্ন কখনো সফল হতে পারেনা।
ইসলাম যখন আবির্ভুত হল এবং আরবের জাহেলী সমাজ ব্যবস্থা যে মৌলিক জীবনাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছিল, তার ভিত্তিমূলে আঘাত হানল, তখন শুরুতেই জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার ধারক বাহকরা বুঝতে পারলো যে, এতো একটা সর্বাত্মক আঘাত। সমগ্র ভবনটাকে ভেঙ্গে নতুন ভবন গড়ার জন্য এ আঘাত হানা হয়েছে। এ কারণেই ইসলামী আন্দোলনের সর্বাত্মক বিরোধীতা করা হয়েছে এবং এর পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়েছে। মৌলিক বিপ্লব এবং সর্বাত্মক পরিবর্তনের এরূপ দাওয়াত ও আন্দোলনের যখনই অভ্যুদয় ঘটে, তখন সমাজ সাধারণত তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটা অংশ চলমান সময়ের চেয়ে অনেক দ্রুত চলে এবং অনেক দূরবর্তী ভবিষ্যৎ কে দেখতে পায়। এরা হয়ে থাকে সমাজের সবচেয়ে মেধাবী ও সবচেয়ে কর্মচঞ্চল লোক। এদের সংখ্যা সব থেকে কম হয়ে থাকে এবং এরা ক্রমান্বয়ে বিপ্লবী দাওয়াতকে গ্রহণ করে। তাদের বিপরীতে থাকে প্রাচীন ব্যবস্থার নেতৃত্ব দানকারী ও বড় বড় স্বার্থের প্রতিভূ শ্রেনী। এই শ্রেণীটি কাল বিলম্ব না করে সক্রিয় হয়ে উঠে। তারা তাদের প্রভাবাধীন শ্রেণী গুলোর মধ্যে থেকে বিপুল সংখ্যক সমর্থক বের করে নেয়। এই দুই শ্রেনীর মধ্যে প্রথমটা হয় বিকাশমান সংখ্যালঘু। আর শেষেরটা সংকোচনশীল বিভাজনরত সংখ্যাগুরু। উভয় শ্রেণীর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত চলে। সক্রিয় শ্রেণী দু’টো চিন্তাগত ও রাজনৈতিক আখড়ায় এসে মল্লযুদ্ধ শুরু করে। আর সাধারণ জনতা বাইরে নিরব দর্শক হয়ে দেখতে থাকে কখন কার জয় পরাজয় হয় এবং খেলার শেষ ফল কি দাঁড়ায়? এই তৃতীয় শ্রেণীর যত মেধাবী ও সক্রিয় লোক থাকে, তারাও ধীরে ধীরে যুদ্ধে যোগদান করে। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগুরু অংশ শেষ ফলের অপেক্ষায় থাকে। এর মধ্যে অনেকেই হয় প্রাচীন ব্যবস্থার অন্ধ পূজারী। তারা ভাবতেও পারেনা তাদের প্রাণপ্রিয় পুরনো ব্যবস্থা কখনো পর্যুদস্ত হতে পারে। তারা যতক্ষন সেই ব্যবস্থার ধবংসের লক্ষন দেখতে না পায়, ততক্ষন তাদের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন আসতেই পারেনা। এই শ্রেণীর মধ্যে বহু সংখ্যক লোক এমন হয়ে থাকে যারা নবাগত শক্তির যুক্তি ও চারিত্রিক গুণাবলী দ্বারা প্রভাবিত হয়। কেউ কেউ নবাগত শক্তি জয় লাভ করুক এমন প্রত্যাশাও করে। তবে প্রতিষ্ঠিত পুরনো শক্তির ভয়ে তারা ভীত থাকে। কেউ কেউ বিপ্লবের দাওয়াতে প্রভাবিত হয়ে সামনে অগ্রসরও হতে চায়। কিন্তু সাবেক নেতৃত্ব তাদেরকে এমন ভাবে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে রাখে যে, তারা নড়াচড়া করতেই সাহস করেনা। এমন লোকের সংখ্যাও কম নয় যারা দুই মতাদর্শের মধ্যে যেটা বিজয়ী হয় সেটা হোক এবং যেটা পরাজিত হয় তাকে বাতিল মনে করে। বিশেষত, দাওয়াত টা যখন ইসলামের হয়, তখন এই চিন্তাধারা জনগণের মধ্যে আর ব্যাপক ভাবে ছড়ায়। জনগণের এই মানসিক অবস্থাই কোন সংস্কার মূলক ও সংগঠন মূলক দাওয়াত গ্রহনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দ্বন্দ্ব সংঘাতের তীব্রতা হ্রাস বৃদ্ধির ফলে এই মানসিক অবস্থায় যেভাবে পরিবর্তন আসতে থাকে, সেই অনুপাতে দাওয়াতের গতি বিঘ্নিত বা সচ্ছন্দ হয়। সুতরাং যে কোন নতুন দাওয়াতের পতাকাবাহীদের জন্য পথ তখনই উন্মুক্ত হয় যখন তারা, দ্বন্দ্ব সংঘাতে যথেষ্ট দৃঢ়তা দেখাতে পারে এবং প্রতিরোধকারীদের উপর প্রবল জোরদার ও কার্যত আঘাত হানতে পারে। ফলে জনগণ একদিকে মনে করে যে, পুরনো নেতৃত্বকে হঠানো এবং পুরনো শৃঙ্খল ভাঙ্গা কোন অসম্ভব কাজ নয়, অপরদিকে তারা নতুন শক্তি সম্পর্কে আশাবাদী হতে পারে যে তারা জুলুমবাজ, জাহেলী শক্তিকে আঘাত করার মতন শক্তি রাখে। জনমতের অংগনে যখনই এই ধরণের একটা মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে তখনই সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক দাওয়াতের জন্য জনমন পুরোপুরি উম্নুক্ত হয়ে যায়।
মদিনার ইসলামী সরকার ইহুদী ও কোরায়েশদের সামরিক হুমকির জবাব যে সাহস ও দৃপ্ততার সাথে দিয়েছে, তার উদ্দেশ্য তরবারীর জোরে রনাঙ্গনে কিছু লোককে ইসলামে দীক্ষিত করা ছিলনা। বরং উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধংদেহী প্রতিরোধ থেকে আত্মরক্ষার সাথে সাথে সাধারণ মানুষের সাহস যেন বাড়ে এবং মদিনার বিপ্লবী শক্তির উপর যেন তাদের আস্থা জন্মে। এটাই ছিল তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। ইসলামী আদর্শের কাছ থেকে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ লাভের আশা এবং জাহেলী ব্যবস্থার টেকসই অস্থিতিশীল না হওয়ার ধারণা জনমনে সৃষ্টি হোক- এটাই ছিল এর লক্ষ্য।
সর্বপ্রথম যখন বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হল, তখন চারদিক থেকে সকলের দৃষ্টি পৃথিবীর এই ক্ষুদ্র ভূখন্ডের উপর কেন্দ্রীভূত ছিল যে, দেখা যাক কে হারে কে জেতে? সবাই যখন দেখল মুষ্টিমেয় মুসলমান সৈন্য, যাদের কাছে ন্যূনতম সামরিক সরঞ্জাম ও ছিলনা, তাদের নিজেদের চেয়ে তিন গুন বেশী সংখ্যক বিশাল বাহিনীকে শোচনীয় ভাবে পরাভুত করলো এবং আবু জেহেলসহ মক্কার বড় বড় নেতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিলো, তখন সমগ্র আরবে এই হতবুদ্ধিকর ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি না হয়ে পারেনি। ঘরে ঘরে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং তা জনমনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই ঘটনায় প্রথম বারের মতন এই আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, মদিনার ইসলামী শক্তি শুধু সারা জীবন মার খেয়ে খেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আত্মার শান্তি লাভ করার জন্য সাধু সন্যাসী হয়ে যাওয়া লোকদের দ্বারা গঠিত নয় বরং ঐ শক্তির হাতে একদিন না একদিন দেশের সামগ্রিক চেহারাই পালটে যাবে।
তার পর ওহুদের যুদ্ধ ‘কাহ কারে নাহি পারে, সমানে সমান’ পর্যায়ে থাকায় তার ব্যাপারে পতিক্রিয়া ও মধ্যম ধরণের ছিল। এরপর সংঘটিত হল খন্দকের যুদ্ধ। আরব সমাজ দেখল যে, চারদিক থেকে বিরাট বিরাট বাহিনী সর্বনাশা সয়লাভের মত ছুটে আসছে। তারপর মাসখানেক মদীনা অবরোধ করে রাখার পর এমনভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো যেন ভূমির একটা স্তূপ কে কেউ ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনা দ্বারা জনমনে যে বিশ্বাস জন্মেছিল তা ছিল এই যে, মুসলিম শক্তির শেকড় এতো মজবুত যে, শত্রুদের সম্মিলিত আক্রমনেও তার ক্ষতি হয়না।
এই সব বড় বড় যুদ্ধের পাশা পাশি ছোট ছোট গোত্রীয় নেতৃত্বের দিকেও মদিনা যথাযথ মনোযোগ দিয়েছে। এসব স্থানীয় নেতৃত্ব দেশজোড়া জাহেলী নেতৃত্বের লেজুড় ছিল এবং এক এক করে এই ধরণের সমস্ত লেজুড়কে ছিন্ন করা ছাড়া জনগণকে এই নেতৃত্ব থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব ছিলনা। এর কিছু কিছু লেজুড় তো দাওয়াতের তোড়েই ভেসে গিয়েছিলো। বাকি লেজুড়কে চুক্তি ও মৈত্রী ভিত্তিক সম্পর্কের দ্বারা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বাদবাকী লেজুড় গুলো যেদিক থেকেই মাথা তুলেছে, ইসলামী সরকার তৎক্ষণাৎ সেদিকে মনোনিবেশ করেছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে গুড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্রোহী চোর, ডাকাত, নাশকতাবাদী কুচক্রীদের বিরুদ্ধে এমন সময়োচিত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যে, যেমনটি আকাশের দুয়ারে আড়িপাতায় চেষ্টারত শয়তানকে আগুনের তীর নিক্ষেপ করে আপ্যায়ন করা হয়। মদিনার চারপাশে আইন শৃংখলাকে সর্বতোভাবে ভাবে বহাল করা এবং নিশ্ছিদ্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা হয়। নচেৎ চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বেদুঈন গোত্রগুলো যদি বিন্দু মাত্র ফাঁক ফোকর পেত,তবে মদিনার সুসংঘবদ্ধ সরকারের অভিজ্ঞতা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। ইতিহাসের রেকর্ড দেখলে বুঝা যাবে যে, হিজরতের প্রথম বছর থেকে শুরু করে মক্কা বজয় পর্যন্ত সমগ্র সময়টা নিত্যনতুন বিদ্রোহ, অরাজকতা ও নাশকতা দ্বারা পরিপূর্ণ। কাল ওদিকে সামরিক সমাবেশ হয়েছে, তো আজ এদিকে ডাকাতচক্র মাথা তুলেছে। একদিন এদিকে কোন দল লুটপাট চালিয়েছে তো পরের দিন মদিনার অন্য কোন প্রান্তে কোন অজানা আততায়ীর দল নিরীহ নাগরিকদের জানমালের ক্ষতি সাধন করে উধাও হয়েছে। এদিকে কোন যুদ্ধ বাধানোর ষড়যন্ত্র চলছে তো ওদিকে কোন বিদ্রোহী পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু মদিনা খুবই সতর্ক ছিল। কোথাও প্রহরী টহল দিচ্ছে, কোথাও সেনাদল পাঠানো হচ্ছে আবার কোথাও আইন শৃংখলা স্বাভাবিক রাখার জন্য পুলিশের গ্রুপ রওনা হচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতি আরবদের মধ্যে এই ধারণা জন্মিয়ে দিয়েছিল যে, মুসলিম শক্তি কোন বোবা, বধির, অন্ধ শক্তি নয় বরং তা একটা জীবন্ত, জাগ্রত ও কর্মচঞ্চল সরকার। এই সরকার চতুর্মূখী লড়াই চালিয়ে একসাথে বহু সংখ্যক শত্রুর সাথে লড়ছে এবং একদিন না একদিন সে জয় লাভ করবেই।
এরপর যখন মদিনায় ইহুদীদের দাপট চূর্ণ করে দেয়া হলো এবং তারপর উপযুক্ত সময়ে খয়বরের শত্রুদের দুর্গও গুড়িয়ে দেয়া হলো, তখন জনমত কিভাবে এই সব ঘটনার মধ্য দিয়ে দাওয়াত গ্রহণ করার দিকে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে গেছে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।
তারপর মক্কা বিজয়ের সাড়া জাগানো ঘটনা আরব জাতিকে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঝাঁকি দিয়ে জাহেলিয়াতের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং ইসলামী আন্দোলন নবজাগরণের আযান দিয়ে ডেকে বলেছিল যে, “ওঠো, চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে, তখন কোন অন্ধেরও বুঝতে বাকী ছিলনা যে, জাহেলিয়াত ধ্বংসের সম্মুখীন।” আসলেই জাহেলিয়াত সবার চোখের সামনেই ধ্বংস হয়ে গেল। সেই সাথে সবাই বুঝে নিল যে, কোরায়েশের প্রাচীন জাহিলী নেতৃত্বের যুগও শেষ হয়ে এসেছে। একজন নির্বোধ বেদুঈনও বুঝে ফেলেছে, মুহাম্মাদ সা. এর আনীত বিধানই জ্ঞান, চরিত্র, সজীবতা, শক্তি, উন্নতি, পুনর্গঠন, শান্তি, শৃংখলা ও ইনসাফের নিশ্চয়তা দানকারী একমাত্র বিধান। জনতা তাদের মনমগজের জানালা খুলে দিয়েছে যেন ইসলামী আন্দোলনের আলো ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।
এসব সামরিক তৎপরতা নিরেট সামরিক তৎপরতা ছিলনা, বরং এ সবের ভেতর দিয়ে ইসলামের দাওয়াতও প্রচার করা হতো। লড়াইগুলো নিছক তীর তলোয়ারের লড়াই ছিলনা বরং আকিদা, আদর্শ ও চরিত্রেরও লড়াই ছিল। এ সব লড়াইতে মুসলমানরা এক নতুন শ্লোগান ‘আল্লাহু আকবর’ চালু করেছিল। যুদ্ধের ময়দানেও তারা রুকু সিজদার সমাবেশ ঘটিয়েছিল। শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করলেও তারা শত্রুর সামনে আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ মাথা নোয়াতেও কসূর করতোনা। তাছাড়া এসব যুদ্ধের নিয়ম শৃংখলাও ছিল অভিনব ধরণের। রণাঙ্গণে তারা শাহাদাত, জান্নাত, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও চিরন্তন জীবনের আকিদা বিশ্বাস নিয়ে এসেছিল। এগুলোর বাসনায় প্রত্যেক মুসলমান সৈনিক মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে এগিয়ে যেত এবং হাসতে হাসতে আপন লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবন উৎসর্গ করতো। তাদের এক চমকপ্রদ সামরিক চরিত্রও ছিল। অন্যরা গানবাদ্যের তালে তালে যুদ্ধ করতো। আর ইসলামী আন্দোলনের জানবাজ সৈনিকরা তাওহীদের শ্লোগানের আওয়াজের সাথে মার্চ করতো। অন্যরা মদ খেয়ে বাহাদুরি দেখাতো। আর মুসলিম সৈনিকরা কর্তব্যবোধের পবিত্র শরবত খেয়ে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতো। অন্যরা যুদ্ধলব্ধ গণিমতের লোভে বীরত্ব দেখাতো। আর রসূল সা. এর অনুসারীরা স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রক্তাপ্লুত প্রান্তরে লুটোপুটি খেত। অন্যরা জাতি, গোত্র ও বংশের আভিজাত্যে প্ররোচিত হয়ে আক্রমন চালাতো, কিন্তু আল্লাহর সৈনিকরা শুধু সত্য ন্যায় ও ইসলামের খাতিরে লড়াই করতো। অন্যরা লড়াই এর সময় চরম পাশবিক ও নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো। শত্রুকে আগুনে পোড়ানো, বেঁধে হত্যা করা, লাশের অবমাননা করা, নিহতদের মাথার খুলিতে মদ খাওয়া, কলিজা চিবানো, নারী ও শিশুদের যবাই করা, গর্ভবতী নারীদের পেট চিরে দেয়া, ইত্যাদি বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড ছিল তাদের নিত্যকার অভ্যাস। কিন্তু ইসলামী শক্তি এমন নজীরবিহীন বাহিনী ময়দানে নিয়ে এসেছিল, যারা লড়াই এর সময়ও মানবতার নৈতিক সীমারেখার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো। তারা কাউকে কখনো অমানুষিক পন্থায় হত্যা করতোনা। লাশের অবমাননা করতোনা। নারী ও শিশুদের ওপর বাহাদুরী দেখাতোনা। বরং এসব ক্ষেত্রে নৈতিকতা বিবর্জিত শত্রুদের অন্যায় আচরণের ধৈর্য ধারণ করে নিজেদের পক্ষ থেকে উত্তম আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতো। অন্যেরা বন্দীদের সাথে পশুসুলভ আচরণ করতো। কিন্তু মুসলিম বাহিনী তাদেরকে নিজেদের নাগরিকদের সাথে ভাই ভাই বানিয়ে রাখতো। অন্যেরাচুক্তি সম্পাদন করে তা ভঙ্গ করতো। কিন্তু মুসলিম শক্তি অত্যন্ত নাজুক মুহূর্তেও এবং চরম ক্ষতি স্বীকার করেও চুক্তি রক্ষা করতো। কাউকে আশ্রয় দিলে বা কারো দায়িত্ব নিলে সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতো। অন্যেরা বিজিত জনপদে ঢুকে বেসামরিক জনতার ওপর জুলুম নির্যাতন চালাতো। কিন্তু মুসলিম শক্তি তার সৈনিকদেরকে ঘরে ঢুকে কোন নাগরিককে হত্যা করা, কারো ব্যক্তিগত সহায় সম্পদ লুণ্ঠন বা আত্মসাত করা, এমনকি শত্রুর বেসামরিক নাগরিকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা তোলা পর্যন্ত হারাম ঘোষণা করেছে। অন্যদের জন্য যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল একটা পার্থিব কাজ। কিন্তু ইসলাম এ কাজকে একটা উচ্চাংগের এবাদত ঘোষণা করেছে।
রসূল সা. এর নির্দেশে রণাঙ্গনেও শত্রুর সামনে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হতো। শত্রুর সামনে তিনটে বিকল্প পথ খোলা রাখা হতো। হয় ইসলাম গ্রহণ করে ভাই ভাই হয়ে যাও, নচেত রাজনৈতিক বশ্যতা স্বীকার কর, নচেত রণাঙ্গনে মোকাবেলা কর। অথচ অন্যদের মধ্যে এমন কোন আদর্শিক দাওয়াত থাকতোনা। তাদের পক্ষ থেকে দুটো পথই খোলা রাখা হতো। হয় আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর। নচেত যুদ্ধের ময়দানে এস।
দুই পক্ষের মধ্যের এই বিরাট পার্থক্য যুদ্ধের ময়দানে খুবই স্পষ্ট হয়ে দেখা দিত। আর এই পার্থক্য বুঝতে পেরে সমগ্র আরব জাতি বিমোহিত ও প্রভাবিক হতো। অর্থাৎ মদিনার ইসলামী সংগঠনের একদিকে দ্রুত গতিতে বিকাশ লাভ করা এবং অপরদিকে নিজেদের চরিত্র দ্বারা নিজেদের আদর্শের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত করা-এই দুই ধরণের সাফল্য সামরিক অভিযানগুলোর মাধ্যমে আরবের জনমতের ওপর প্রতিফলিত হতো। এই দু’ধরণের সাফল্য যতটা সত্যের দাওয়াতের পথ সুগম করতো, ততটাই লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকতো। এই সাফল্য হোদায়বিয়ার সন্ধির পর তীব্রতর হয়েছে। এজন্য এ সময় জনগণ ইসলামের দিকে অধিকতর দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয়েছে। আর মক্কা বিজয়ের পর এই সাফল্য পুরোপুরিভাবে বিজয়ীর বেশ ধারণ করে। তাই সমগ্র আরব এক সাথে এই সংস্কারমূলক আন্দোলনের আওতাভুক্ত হয়ে যায়। এই দু’টি যুগে জনগণ যেরূপ দ্রুতগতিতে ইসলাম গ্রহণ করেছে তা দেখে বুঝা যায়, কোরায়েশ নেতৃত্ব জনগণের পথে কত বড় অন্তরায় ছিল। আর এই অন্তরায় সরে যাওয়া মাত্রই মানসিক বিপ্লব ঘটে গেছে। যেখানেই কোন কায়েমী স্বার্থের বিজয়ী শ্রেণী এভাবে অন্তরায় সেজে বসে থাকে, সেখানে জনগণের মধ্যে ওয়াজ নসিহতের এবং দাওয়াত ও তাবলীগের প্রভাব তেমন ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারেনা। সামগ্রিক পরিবেশকে পরিবর্তন করার জন্য এ ধরণের বাধা দূর করা প্রয়োজন। আর এ জন্য সর্বাত্মক রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারের পূর্ণতা রাজনৈতিক সংগ্রামের ওপরই নির্ভরশীল।
সরকার স্বয়ং বিপ্লব শিক্ষা দিত
অতঃপর যেসব এলাকা সংশ্লিষ্ট গোত্রগুলোর ইসলাম গ্রহণ, চুক্তিভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপন অথবা রাজনৈতিক বশ্যতা স্বীকার করার মাধ্যমে মদিনার ইসলামী সরকারের কর্তৃত্বাধীন হয়েছিল, তাদেরকে যেভাবে আছে সেইভাবেই থাকতে দেয়া হতোনা। বরঞ্চ তাদের কাছে ইসলামের বিস্তারিত দাওয়াত ও শিক্ষা পৌঁছানো হতো এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। ব্যাপারটা এ রকম ছিলনা যে, ডান্ডা ঘুরিয়ে ও শক্তির প্রদর্শনী করে কোন এলাকাকে দখল করা হতো এবং তারপর মানুষকে ভেতর থেকে পরিবর্তন ও সংশোধন না করে গরু ছাগলের মত তাড়িয়ে বেড়ানো হতো। সব কিছু যদি তরবারী দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে করা হতো এবং ডান্ডার জোরেই যদি সব কিছুর পরিবর্তন করা হতো, তাহলে এই স্বৈরাচার মাত্র কয়েক দিন চলতো। তারপর মানুষ বিদ্রোহ করতো। আর মানুষের অসন্তোষ ও বিক্ষোভের বিস্ফোরণ যদি একবার ঘটতো, তাহলে সমস্ত অর্জিত সাফল্য বিনষ্ট হয়ে যেত। বস্তুত শক্তি প্রয়োগের পরিমাণ ইসলামী আন্দোলনে অন্য যে কোন ব্যবস্থার তুলনায় কম ছিল এবং দাওয়া, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অংশ ছিল সবচেয়ে বেশী।
আদর্শবাদী সরকার মাত্রই প্রচারকেন্দ্রিক হয়ে থাকে এবং তার সমস্ত তৎপরতায় এই উদ্দেশ্যটাই অগ্রাধিকার লাভ করে থাকে যে, যে আকীদা ও আদর্শের ওপর তার জীবন ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, তা যেন জনগণ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করে ও অন্তর দিয়ে গ্রহণ করে। এই সরকারের সব ক’টা বিভাগকে তার নির্দিষ্ট কাজ ছাড়াও ঐ কেন্দ্রীয় দায়িত্বও পারন করতে হয়। এ ধরণের সরকার এমন প্রতিটি জিনিস প্রত্যাখ্যান করবে, যা তার মৌলিক আদর্শের ক্ষতি সাধন করে। সে এমন অলাভজনক জিনিসকেও গ্রহণ করবে যা জনগণের মনমগজে তার মৌলিক মতাদর্শকে বদ্ধমূল করে। তাদের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হয়ে থাকে, জনগণ নতুন আদর্শের সাথে একাত্ম হয়ে যাক, একাত্ম থাক আন্তরিকতার সাথে। যা করণীয় তা করুক এবং যার বিলোপ সাধন করা দরকার তার বিলোপ সাধন করুক।
মদিনার ইসলামী সরকার একদিকে যেমন কঠিনতম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও আশপাশের অঞ্চলে দাওয়াতী ও প্রচারমূলক দল পাঠানো অব্যাহত রেখেছে। অন্ততপক্ষে চারটে ক্ষেত্রে মদিনা থেকে দাওয়াতী কাজে গমণকারীদেরকে ঘাতকরা শহীদ করে দেয়। দাওয়াতের কাজে গিয়ে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার শহীদ হয়েছেন এমন সাহাবীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। বরং বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের মুসলিম শহীদদের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশী। চরম নাজুক ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতেও এই মৌলিক কর্তব্য পালনে শৈথিল্য দেখানো হয়নি। বরং অনেক ত্যাগ ও কুরবানীর বিনিময়েও তা চালু রাখা হয়েছে। কিছু কিছু সাহাবীকে মদিনায় কিছুদিন প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরই গোত্রে দাওয়াতের কাজে নিয়োগ করা হয়েছে। এ ধরণের কিছু সাহাবীদের নাম হলোঃ (১) তোফায়েল বিন আমর দাওসী (দাওস গোত্র), (২) আমুরা বিন মাসউদ (সাকীফ গোত্র), (৩) আমের বিন শাহর (হামদান, (৪) যিমাম বিন ছা’লাবা (বনু সা’দ), (৫) মুনকিয বিন হাববান (বাহরাইন), (৬) ছামামা বিন ইছাল (নাজদ)। এছাড়া কিছু কিছু গোত্র বা ব্যক্তির কাছে বিশেষ বিশেষ দাওয়াতদাতাকে নিযুক্ত করে পাঠানো হয়। যেমন হযরত আলীকে হামদান, হুযায়মা ও মাযহাজে, মুগীরা ইবনে শু’বাকে নাজরানে, দাবার বিন নাথনীসকে ইয়ামানে বসবাসকারী পারস্যবাসীর কাছে, মাহীসা বিন মাসউদকে ফিদকে, আহনাফকে সুলাইম গোত্রে, খালেদ বিন ওলীদকে মক্কায়, আমর ইবনুল আ’সকে ওমানে এবং মোহাজের বিন আবি উমাইয়াকে ইয়ামানের যুবরাজ হারেস বিন ফিলালের কাছে পাঠানো হয়।
কিন্তু ইসলামী সরকার এর চেয়ে অনেক বেশী দাওয়াতী ও প্রচারমূলক কাজ আদায় করেছে বেসরকারী কর্মচারীদের কাছ থেকে। ইসলামী সরকারের কর্মচারীরা নিজেদেরকে পেশাদার চাকুরীজীবী মনে করতেন না এবং তারা অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে চাকুরী গ্রহণও করতেন না। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকতো আল্লাহর বাণী ও বিধানকে সমুন্নত করা এবং মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করা। এ কাজ নিছক বেতনলোভী লোকদের দিয়ে করানো যেতনা। এটা কেবল ইসলামী বিপ্লবের নিঃস্বার্থ সেবকদের পক্ষেই করা সম্ভব ছিল। তারা না কোন পদের লোভী ছিলেন, না গ্রেড ও পদোন্নতির চিন্তায় বিভোর থাকতেন। পদ ও দায়িত্বই তাদেরকে ডাকতো এবং ন্যূনতম বেতনেই তারা উচ্চতর দায়িত্ব পালন করতেন। এখানে একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে। আত্তাব বিন উসাইদকে দৈনিক এক দিরহাম বেতনে মক্কার গভর্ণর নিয়োগ করা হয়। তিনি বক্তৃতায় নিজেই বলেন, “যে ব্যক্তি দৈনিক এক দিরহাম পেয়েও ভুখা থাকে, আল্লাহ তাকে ভুখাই রাখুন।” (ইবনে হিশাম) তারা সব কিছুর আগে নিজের প্রিয় আকিদা ও আদর্শের আহ্বায়ক ছিলেন। মদিনার সরকার যাদেরকে কোথাও গভর্নর, বিচারক, তহশীলদার বা অর্থবিভাগীয় কর্মকর্তী নিয়োগ করতো, তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তাওহীদের দাওয়াতদাতা, ইসলামের শিক্ষাগুরু এবং নৈতিকতার প্রশিক্ষক হতেন। তাদেরকে যখন তাদের বিভাগীয় দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হতো, তখন রসূল সা. তাদেরকে এই মৌলিক দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দিতেন। হযরত মুয়ায বিন জাবালকে ইয়ামানে আর্থিক, প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব ন্যস্ত করে যখন পাঠানো হলো, তখন তাকে এ কথাও বলা হয় যে, “জনগণকে কোরআন শিক্ষা দিও এবং ইসলামের বিধিমালা শিক্ষা দিও।” তারপর তাকে বিশেষভাবে আহলে কিতাবদের প্রয়োজন অনুসারে দাওয়াতের পন্থা বুঝিয়ে দেয়া হয়। তাকে বলা হয়, “তাদেরকে প্রথমে তাওহীদের দাওয়াত দিও। এটা মেনে নিলে নামায শিখিও। তারপর যাকাতের শিক্ষা দিও।” এই সব কর্মকর্তাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নিজ নিজ সদর দফতরে নামাযের ইমাম হতেন। তবে বড় বড় জনপদে যেখানে দায়িত্ব বণ্টন না করে উপায়ই থাকতোনা, সেখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে সাথে নামাযের জন্যও আলাদা ইমাম নিয়োগ করা হতো। যেমন আত্তাব বিন উসাইদকে মক্কায়, উসমান বিন আবিল আসকে তায়েফে এবং আবু জায়েদ আনসারী ওমানে ইমাম নিযুক্ত হন।
বেসামরিক অফিসারদের সংখ্যা প্রচুর। তাই তাদের তালিকা দেয়া হচ্ছেনা। কিন্তু এই সংখ্যা ও এদের নিয়োগ এলাকা দেখলে বুঝা যায় যে, ইসলামী সরকারের বেসামরিক বিভাগ (সিভিল সার্ভিস) ইসলামের দাওয়াত বিস্তারে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া এই সব দাওয়াতদাতা আপন দায়িত্ব পালনের সময় প্রচলিত অর্থে শুধু অফিসার ছিলেন না। আল্লাহর ব্যাপারে নির্ভীক হওয়া, জাঁকজমক, জুলুম ও বাড়াবাড়ি, জনগণ থেকে দূরে থাকা, মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিস সম্পর্কে উদাসীনতা, রাস্তায় বেরুলে অন্য সবাইকে হাঁকিয়ে দূরে তাড়িয়ে দেয়া, দারোয়ান ও পাইক পেয়াদার মাত্রাতিরিক্ত ভীড় জমানো, বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ, লুটপাট, ঘুষ খাওয়া, চাটুকার পরিবেষ্টিত থাকা, সরকারী অর্থের অপচয় করে ইচ্ছেমত পুরস্কার দেয়া, মদের আড্ডা জমানো, নৃত্যগীতের জলসা বসানো-এসব কিছু থেকে তারা থাকতো যোজন যোজন দূরে। এসব বেসামরিক অফিসার একেবারেই ভিন্ন ধরণের অফিসার ছিলেন। তাদের শাসন জনগণের কাছে ছিল এক অভিনব অভিজ্ঞতা। স্বল্প বেতনভোগী, সাদাসিদে জীবন যাপনকারী, সততার সাথে দায়িত্ব পালনকারী, প্রজাদের প্রতি সদয়, ইনসাফ ও ন্যায়নীতি পরায়ন, খোদাভীরু এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী আপন চরিত্র দ্বারা জনগণের হৃদয় জয় করতেন। তারা যখন মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, তখন সে দাওয়াত শ্রোতার অন্তরের অন্তস্থলে প্রবেশ করতো। হযরত আবু মূসা আশয়ারীকে যোবায়েদ ও এডেন অঞ্চলের প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। সেখানকার সবাই তার দাওয়াতে অতি দ্রুত মুসলমান হয়ে যায়। অনুরূপভাবে জারীর বিন আব্দুল্লাহ বাজালীকে ইয়ামানের রাজবংশের দায়িত্বে নিয়োগ করা হয়। তিনি এতটা প্রভাব বিস্তার করেন যে, তারা সবাই ইসলামী আন্দোলনে যোগ দেয়। আর এই আনন্দে তিনি ৪ হাজার ক্রীতদাসকে মুক্তি দেন।
মোটকথা, সরকারের বেসামরিক বিভাগগুলো অত্যন্ত নিবিষ্ট চিত্তে ও একাগ্রতার সাথে অবিশ্রান্তভাবে দাওয়াত ও প্রচারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল এবং এই ব্যাপক ভিত্তিক দাওয়াতী ও শিক্ষামূলক কাজেরই ফল ছিল এই যে, আরবের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যেও শুধু রাজনৈতিক নয় বরং মানসিক বিপ্লব সংঘটিত হয়ে গেল এবং এরই সাথে নৈতিক দিক দিয়েও আমূল পরিবর্তন সংঘটিত হলো। শেষ পর্যন্ত আরবের গোটা সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ নতুন রূপ ধারণ করলো।
জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
আরবের বিপুল সংখ্যক বেদুঈন অধিবাসী ছিল সাধারণভাবে দরিদ্র। অধিকাংশ মরুচারী গোত্র ছিল যাযাবর। পালিত পশু থেকে প্রাপ্ত যতকিঞ্চিত জীবিকা ছাড়া সশস্ত্র ডাকাতি ও লুটপাটই ছিল তাদের প্রধান উপজীব্য। শহর থেকে অনেক দূরে স্থায়ী নিবাসের অধিকারী কিছু বেদুঈন গোত্রও ছিল। তবে তারাও ছিল খুবই দরিদ্র। এসব গোত্রের শেখ ও সরদাররা অর্থনৈতিক চেষ্টা সাধনার বেশীর ভাগ সুফল নিজেরাই একচেটিয়াভাবে ভোগ করতো এবং সাধারণ মানুষকে করতো তা থেকে বঞ্চিত। শহর বলতে মক্কা, মদিনা, তায়েফ, সানা, হাদরামাউত ইত্যাদিকেই বুঝাতো। এগুলি বড় শহর ছিলনা। এগুলোর অধিবাসীরা সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবে সামগ্রিকভাবে তারা ছিল সচ্ছল ও সমৃদ্ধ। তাদের মধ্যেও উঁচু নীচু শ্রেণী ছিল। উঁচু শ্রেণী নীচু শ্রেণীকে শোষণ করতো। মদিনায় ইহুদীরা ব্যবসায় ও কৃষ্টিতে প্রাধান্য বিস্তার করা ছাড়াও সুদী কারবারের জাল পেতে রেখেছিল। অনুরূপভাবে, মক্কা ও তায়েফের বড় বড় বিত্তশালী লোকেরাও অর্থোপার্জনের অন্যান্য পন্থার পাশাপাশি সুদী কারবারও করতো। উচ্চ পর্যায়ের কিছু কিছু পরিবার চরম বিলাসী জীবন যাপন করতো। গানবাদ্য, মদখুরি, প্রেমপ্রণয় ও ব্যভিচার ছিল তাদের সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অথচ আরবের সাধারণ মানুষের অভাবের কোন সীমা পরিসীমা ছিলনা।
অভাবের তাড়নায় তারা মৃত প্রাণীর গোশত পর্যন্ত খেত। পবিত্র অপবিত্র ও হালাল হারামের আদৌ কোন বাছবিচার করতোনা। খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান সমস্যারই যেখানে সমাধান হতোনা, সেখানে শিক্ষা স্বাস্থ্য ও অন্যান্য উচ্চতর সমস্যার প্রশ্নই তো অবান্তর। চিকিৎসার জন্য দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা, যাদুটোনা, এবং জ্যোতিষী ও ফকীরদের কাছে ধর্না দেয়া হতো। শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সীমিত। শহুরে উচ্চ পরিবারের মুষ্টিমেয় লোকের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকতো শিক্ষাদীক্ষার কার্যক্রম। সেখানকার একটা মৌলিক ও বাস্তব সমস্যা ছিল খাদ্য সমস্যা। যে জাতি বিপুল সংখ্যাগুরু অংশ সব সময় “কী খাবো” এই প্রশ্ন নিয়েই চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থাকে, তকে কোন উচ্চতর ও মহত্তর বিষয়ের জ্ঞান দান করাও যায়না এবং মহত্তর উদ্দেশ্যে তারা কোন স্মরণীয় কাজও সমাধা করে যেতে পারেনা। যারা অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার তাদের বঞ্চনার প্রতিকার না করে কেবল ওয়ায নসিহত ও সদুপদেশ দিয়ে কেউ তাদেরকে ব্যাপকভাবে কোন আন্দোলনে সক্রিয় করতে পারেনা। কোন মতাদর্শ যদি অস্ত্রের বলে ক্ষমতাও দখল করে, কিন্তু মানুষের প্রাথমিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে না পারে, তাহলে নিছক নৈতিক সংশোধন ও পুনর্গঠনের উপদেশ গ্রহণে সাধারণ মানুষ কখনো প্রস্তুত হতে পারেনা। বরঞ্চ এ ধরনের সংস্কার ও সংশোধন ও পুনর্গঠনের প্রচেষ্টাকে একটা আপদ মনে করে তা থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা মানবতাকে জয় করতে পারবে কেবল তখনই, যখন তা আখেরাতের সাথে সাথে দুনিয়াতেও সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে এবং নৈতিক সংস্কার ও সংশোধনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানও করতে পারবে। নিছক অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করা যেমন মানবতাকে নৈতিক দিক দিয়ে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার শামিল, তেমনি নৈতিক সংস্কারের কাজকে জীবনের অর্থনৈতিক দাবী ও চাহিদা থেকে পৃথক করে গ্রহণ করাও নৈতিক সংস্কার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়ার নামান্তর। ইসলাম উভয় প্রয়োজনকে একই সাথে পূরণ করে। রসূল সা. যে আন্দোলন চালিয়েছিলেন, তা একদিকে যেমন হৃদয়কে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত করে, আত্মাকে নৈতিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ করে, অপরদিকে তেমনি পেটের খাদ্য সরবরাহের জন্য ও সে সর্বোত্তম ব্যবস্থা করে। শুরুতেই ইসলামের সংক্ষিপ্ততম নৈতিক বিধানে “ইতয়ামু মাছাকীন” অর্থাৎ দরিদ্রকে আহার করানোর বিধি অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাছাড়া অনাথ, বিধবা ও মোসাফেরকে সাহায্য করাও প্রত্যেক মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল।
আরব ছিল একটা স্বল্প উৎপাদনশীল দেশ। খনিজ, শিল্প, কিংবা গবাদি পশু সকল ধরনের সামগ্রীই ছিল নির্দিষ্ট কয়েকটি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ও সংকুচিত। সম্পদের এই সব উৎসকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা ছিল খুব জটিল সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না করে জীবনের অন্যান্য বড় বড় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিলনা। ইসলামের অর্থনৈতিক বিধান, (যা পর্যায়ক্রমে নাযিল হয়েছিল) মধ্যম পরিস্থিতিতে সম্পদকে সমাজের সর্ব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আবর্তনশীল রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এই বিধান বাস্তবায়নেরও আগে সম্পদের এই উৎসগুলো ছিল সবচেয়ে জটিল সমস্যা। একমাত্র জেহাদী তৎপরতার মাধ্যমে এই সমস্যার এমন সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব হয়েছে যে, আর কোন বিকল্প উপায়ে এমন সাফল্যজনক সমাধান সম্ভব হতোনা।
সেই প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে আধুনিক যুগ পর্যন্ত পরাজিত শত্রুরা অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জাম গনীমত হিসাবে হস্তগত করা একটা সর্বস্বীকৃত অধিকার বিবেচিত হয়ে আসছে। যুদ্ধ থামানোর জন্য মানুষ হত্যা করার চাইতে কার্যযকর ও অব্যর্থ কৌশল হলো প্রতিপক্ষকে অস্ত্র, সাজ সরঞ্জাম ও রসদ থেকে বঞ্চিত করা। তা ছাড়া প্রতিপক্ষের সামরিক অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয়াও এর অন্যতম সাফল্যজনক কর্মপন্থা। ইসলামও গনীমতের অধিকার বহাল রেখেছে এবং সেজন্য বিশেষ ধরনের নৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এখানে আমাদের পক্ষে কোন তাত্ত্বিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কার্যযত এই অঙ্গিকার প্রয়োগ করে ইসলামী বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় সঞ্চিত সম্পদকে বন্ধনমুক্ত ও আবর্তনশীল করেছে। জনগণের কাছ থেকে শোষণ করা ইহুদী, সুদখোরদের সম্পদ গনীমতের বিধি অনুসারে গতিশীল হয়েছে। সাকীফ গোত্রের পুঞ্জীভূত সম্পদ তাদের মালিকানার আওতামুক্ত হয়ে সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনুরূপভাবে মদিনার আশপাশের যে সব বিদ্রোহী গোত্র অরাজকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে, তাদের ধনাঢ্য নেতা ও সরদারদের সম্পদের একটা বিরাট অংশ মুসলিম বাহিনী তাদের অধিকার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে এবং সুষ্ঠু বন্টনের মাধ্যমে তাকে আবর্তনশীল করেছে।
যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (গনীমত) সম্পর্কে জাহেলী যুগের রীতি ছিল, যুদ্ধের ময়দানে যে যা পেত, সে তা নিয়ে কেটে পড়তো। কেউ চুরি করতো, কেউ প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাত করতো, আর যে যত বড় ও ক্ষমতাশালী হতো, সে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ততই বড় ও উত্তম গ্রাস করতো। ইসলামী সমরনীতি সম্পূর্ণ অভিনব এক নৈতিকতার উদ্ভব ঘটালো। এই নীতি অনুসারে সমস্ত যুদ্ধলব্ধ সম্পদ প্রথমে পাই পাই করে একত্রিত করা হতো। একটা সূঁচও বাদ পড়তোনা। তারপর সেনাপতির নির্দেশে তা বিলি বন্টন করা হতো। এই সম্পদ থেকে বিশ শতাংশ চলে যেত ইসলামী কোষাগারে তথা বাইতুলমালে। এর প্রধান অংশ দরিদ্র ও অভাবীদের কাছে পৌঁছে দেয়া হতো। এভাবে দেশের সম্পদের একটা অবাধ আবর্তন শুরু হলো। এরপর ক্রমান্বয়ে আর্থিক বিধিবিধান চালু হওয়ার সাথে সাথে এর প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা হয়েছে।
এরপর ইসলামী রাষ্ট্র ভূসম্পত্তি, পশু ও বানিজ্যিক পূঁজির মালিকদের কাছ থেকে মুসলমান হয়ে থাকলে যাকাত, অমুসলমান হলে খাজনা ও জিযিয়ার আকারে রাজস্ব আদায় করেছে। এই রাজস্ব থেকে বিশেষত যাকাত থেকে একটা বিরাট অংশ দরিদ্র শ্রেণীগুলোর জন্য নির্দিষ্ট করেছে। প্রতি বছর শস্য, খেজুর ও পালিত পশুর একটা বিরাট অংশ ধনিকদের কাছ থেকে গরীবদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে।
তাছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান শুধু আইনের জোরেই করা হয়নি। নৈতিক উপায়েও তার সুরাহার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রসূল সা. মদিনার কেন্দ্রীয় সমাজে সামাজিক সাম্যের সাথে সাথে অর্থনৈতিক সৌভ্রাতৃত্বের (Economic Brotherhood) অত্যন্ত সাফল্যজনক অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। সমগ্র আরববাসী দেখতে পাচ্ছিল যে, আপন ঘরবাড়ী থেকে বিতাড়িত লোকজন, সর্বস্বহারা ক্রীতদাস, ক্ষুধা জর্জরিত বেদুঈন, এবং আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা যুবকদের একটি গোষ্ঠীর ইসলাম গ্রহণ করার পর রাতারাতি বিস্ময়কর রূপান্তর ঘটে যাচ্ছে। একদিকে তারা বড় বড় অভিজাত সমাজপতিদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং অকল্পনীয় দুঃসাহসিকতার সাথে চরম দাম্ভিক ও অহংকারী প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে। অপরদিকে তাদের সমস্ত দুঃখকষ্ট ও অভাব অভিযোগ দূর হয়ে যাচ্ছে। তারা আশ্রয় পাচ্ছে, কাজ পাচ্ছে, অস্ত্রশস্ত্র পাচ্ছে, পরিবহনের জন্তুও পাচ্ছে এবং বিয়ে শাদী করে সংসারীও হচ্ছে। আর ইসলামী সৌভ্রাতৃত্বের এই কল্যাণময় প্রভাব শুধু মদিনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ক্রমান্বয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং একদিন সমগ্র আরববাসী তার সুফল ভোগ করেছে।
এই অনুপম সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক সৌভ্রাতৃত্বের নয়া ব্যবস্থাকে আরবের জনগণ দূর থেকে দুনিয়ার বেহেশত হিসেবেই দেখেছে ও অনুভব করেছে। আর এই বেহেশতে প্রবেশ করার জন্য যে তাওহীদের চাবিই যথেষ্ট, তাও তারা জানতো। এমতাবস্থায় নিকৃষ্টতম সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের যাতাকলে যুগ যুগ ধরে নিষ্পেষিত লোকদের মনে যদি এই বেহেশতে প্রবেশ করার আগ্রহ জন্মে, তবে তাতে অবাক হবার কী আছে?
রসূল সা. আরবের সাধারণ মানুষের সমস্যার দিকে লক্ষ্য করে ব্যক্তিগতভাবে ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের বদান্যতা ও দানশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। রাষ্ট্রনায়ক হিসাবেও পরম উদারতা ও মহানুভবতার নীতি অবলম্বন করেছেন। ব্যক্তিগত মালকানায় কখনো কোন সম্পদ সঞ্চিত হয়ে থাকতে দেননি। বরং যত শীঘ্র সম্ভব, তা স্থানীয় ও বহিরাগত অভাবীদের মধ্যে বন্টন করে দিতেন। বাইতুলমালে কখনো কোন অর্থ পড়ে থাকতে দেননি, বরং যখনই কোন অভাবী ব্যক্তি সামনে এসেছে, তাকে যা কিছু দিতে পেরেছেন দিয়েছেন। রসূল সা. এর কাছে আসল গুরুত্ব ছিল মানুষের। সম্পদকে তিনি মানবতার সেবক মনে করেছেন। এমনকি অনেক সময় এমনও হয়েছে যে, বাইতুলমালে এবং নিজের কাছে কিছু না থাকায় সাহায্য প্রার্থীকে দেয়ার জন্য ঋণ গ্রহণ করেছেন। (শামায়েলে তিরমিযী)
তাঁর দানশীলতার খ্যাতি শুনে দুস্থ পল্লীবাসী ও মরুচারী বেদুঈনরা দূর দূরান্ত থেকে মদিনায় ছুটে আসতো এবং তাঁর অবারিত দানে কৃতার্থ হয়ে ফিরতো। এ ঘটনা সুবিদিত যে, একবার জনৈক বেদুঈন এলো এবং রসূল সা. এর চাদর টেনে ধরে ধৃষ্টতার সাথে বললো, “হে মুহাম্মদ, সা. এই সমস্ত সম্পদ তো আল্লাহর। তোমার মা বাপের সম্পত্তি থেকে কিছু দিতে হচ্ছেনা। দাওনা আমার উটের পিঠ বোঝাই করে।” দয়ার সাগর রসূল সা. এক মহূর্ত চুপ থেকে তারপর শান্তভাবে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, এই সব সম্পদ আল্লাহর, আমি তাঁরই বান্দা।” তারপর ঐ বেদুঈনকে এক উট বোঝাই জব ও এক উট বোঝাই খেজুর দেয়ার নির্দেশ দিলেন। সে খুব খুশী হয়ে বিদায় হলো। আর একবার বাহরাইন থেকে এত বেশী পরিমাণ রাজস্ব এল, যার সামান্য রাজস্ব আর কখনো মদিনায় আসেনি। রসূল সা. মসজিদে নব্বীর চত্তরে তা স্তুপ করে রাখলেন। অতঃপর যারা আসতে লাগলো, তাদেরকে একে একে দিতে থাকলেন। তারপর কাপড় ঝেড়ে উঠে বাড়ী চলে গেলেন। এ ধরনের দানের ঘটনা মদিনায় প্রায়ই হতো এবং বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত লোকেরা এসে উপকৃত হতো। এ সব লোক নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ইসলামী সরকারের বদান্যতার কাহিনী বর্ণনা করতো আর সে সব কাহিনীতে অভিভূত হয়ে কত লোক যে ইসলামে দীক্ষিত হতো, কে তার ইয়ত্তা রাখে।
মহানবী সা. বদান্যতার আরো একটা উদাহরণ দিচ্ছি। এক ব্যক্তি এসে নিজের আর্থিক দুর্গতি বর্ণনা করে কেঁদি ফেললো এবং সাহায্য চাইল। রসূল সা. অদূরে পাহাড়ে বিচরনত এক পাল ছাগল তাকে দিয়ে দিলেন। লোকটা এই অভাবনীয় দান পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজ গোত্রে গিয়ে বলতে লাগলো, “তোমরা মুসলমান হয়ে যাও। মুহাম্মদ সা. এমন দান করেন যে, গরীবের আর কোন দুঃখ অবশিষ্ট থাকেনা।” (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া)। সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া বলেন, “রসূল সা. আমাকে তিনশো বকরী দান করেছেন। এর ফলে আমার মনের অবস্থা এমন হলো যে, আগে আমার কাছে তাঁর চেয়ে অপ্রিয় কেউ ছিলনা। আর এখন তাঁর চেয়ে প্রিয় কেউ নেই।” এ প্রসঙ্গেই নিম্নের চরণটি আবৃত্তি করা হয়ঃ (*****আরবি******)
“তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি দান করতে
গিয়ে নিজে নিস্ব হয়ে যাওয়ার
ভয় করেন না, চাই যত লোকই তাঁর কাছে
আসুক এবং আসতে থাকুক।”
দানশীলতার এই সর্বব্যাপী খ্যাতির ফল দাঁড়িয়েছিল এই যে, হোনায়েনের গনীমত বন্টন করে তিনি যখন ফিরছিলেন, তখন তাঁর কাছে জনৈক বেদুঈন এল এবং তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললোঃ আমাকেও কিছু দিন। রসূল সা. পেরেশান হয়ে একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। অতঃপর এই বলে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন যে, “এই জংগলে যত গাছ আছে, ততগুলো উটও যদি আমার থাকতো, তবে আমি তার সবই তোমাদের মধ্যে বন্টন করে দিতাম। তোমরা আমাকে কার্পণ্য করতেও দেখতেনা, আমার ভেতরে অবাস্তব কথা বলার মনোভাব এবং সাহসের অভাবও দেখতেনা।” (বোখারী শরীফ)
হীনমনা লোকেরা এই বদান্যতাকে টাকার জোরে হৃদয় জয় করা এবং ঘুষ দিয়ে সমর্থক বানানোর চেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারে। কিন্তু আসল ব্যাপার মোটেই তা নয়। অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পতিত লোকদেরকে উদ্ধার করা এবং তাদেরকে হীনমন্যতা থেকে মুক্তি দেয়া ইসলামের অন্যতম নীতিগত ও আদর্শগত দাবী। মানব সমাজের যে শ্রেণীগুলো উচ্চতর শ্রেণীর অত্যাচারে ও শোষণের দরুন এমন নিদারুণ অভাবে জর্জরিত হয় যে, তারা জীবনের উচ্চতর ও মহত্তর আদর্শিক চাহিদার দিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পর্যন্ত পায়না, এমন শোচনীয় সংকটে পতিত লোকেরা তো আল্লাহর কাছেও কৃপা লাভ করে। আরবের অধিকাংশ মানুষ এ ধরনের পরিস্থিতিরই শিকার ছিল। তাদের কলেমা তাইয়েবার মত খাদ্যবস্ত্রেরও প্রয়োজন ছিল। ইসলামের অর্থনৈতিক ভ্রাতৃত্বের কল্যাণে মদিনাবাসী সম্ভবত প্রথমবারের মত শরীরের মৌলিক প্রয়োজনের ঊর্ধে উঠে জীবনের আধ্যাত্মিক চাহিদার কথা ভাববার এবং মহৎ নৈতিক মূল্যবোধগুলো লালনের অবকাশ পেয়েছিল। অর্থনৈতিক সংস্কার ইসলামের বিস্তৃতির পথ সুগম করেছিল। ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিপূর্ণ বিকাশ পরে অর্জিত হয়েছিল যখন তার সমস্ত আইন কানুন ও নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছিল। কিন্তু তার প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখেই জনগণ মদিনার প্রতি আশান্বিত হয়ে উঠেছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, এখান থেকে আমরা শুধু সত্যের আলো নয়, বরং অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানও পাবো।
রাষ্ট্রনায়কের সুদূর প্রসারী সম্পর্ক
কোন ব্যক্তির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যাই থাক না কেন এবং সে যত উচ্চস্তরের আদর্শিক কাজই করুক না কেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপকতা তাকে সাফল্য লাভে অনেকখানি সহায়তা করতে পারে। সাধারণ কায়কারবার থেকে শুরু করে আদর্শবাদী বিপ্লব পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন সামষ্টিক কাজে এমন লোক খুব কমই সাফল্য লাভ করতে পারে, যার সাধারণ মানবিক সম্পর্কে দৌড় খুবই সংকীর্ণ, যে ঘরকুনো ও অসামাজিক। বংশীয় ও রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা, বৈবাহিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও মৈত্রী, সুখদুঃখের সাহচর্য, পারস্পরিক সাক্ষাত ও সালাম কালাম ইত্যাদি মানুষের প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা বাড়ায়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক অবচেতনভাবে বহু বড় বড় আদর্শিক কাজের ধারা পাল্টে দেয় এবং এর কারণে বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পর্যন্ত গৃহীত হয়ে থাকে। এক কথায় বলা যায়, সাধারণভাবে মানুষের নেতৃ্ত্বদানে সেই ব্যক্তিই সফল হয়ে থাকে, যার সম্পর্কের পরিধি ব্যাপক, নিজে এই সম্পর্ককে আরো ব্যাপক ও প্রশস্ত করে এবং প্রত্যেক সম্পর্কের দাবী পূরণ করে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে যখন আমরা রসূল সা. এর সুমহান ব্যক্তিত্বের প্রতি নজর দেই তখন তার সব ধরনের সম্পর্কের পরিধি অত্যন্ত প্রশস্ত দেখতে পাই। সেই সাথে তার বন্ধুত্ব ও সাধারণ ব্যক্তিগত সম্পর্কও ক্রমবর্ধমান দেখতে পাই। এই সব সম্পর্ক থেকে কোন এক পর্যায়ে তাকে বিদায় নিতে ইচ্ছুকও দেখা যায়না এবং কোন উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের মত সাধারণ মানুষের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় তার কোন অনীহা ও অবজ্ঞাও চোখে পড়েনা। বরং সকল সম্পর্ককে তিনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে বজায় রাখেন, তার অধিকার ও দাবী পূরণ করেন এবং তাকে স্থিতিশীল রাখেন। বহুদূরের আত্মীয়তার সম্পর্ককেও তিনি এত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন যে, তিনি মুসলিম বাহিনীকে মিশর জয় করার সময় সেখানকার অধিবাসীদের সাথে সদ্ব্যাবহার করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, হযরত ইসমাইল আ. এর মাতা হযরত হাজেরা একজন মিশরীয়। তাই তোমাদের ওপর রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সুরক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয়। রসূল সা. এর এই সুপ্রশস্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক ইসলামী আন্দোলনের বিকাশ ও ইসলামী দাওয়াতের প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল।
এই সম্পর্কগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া প্রয়োজন। এতে বুঝা যাবে কিভাবে তা ইসলামী আন্দোলনের সহায়ক হয়েছিল এবং তা কিভাবে ইসলামী বিপ্লবকে সহজতর করেছিল। আমরা তাঁর সম্পর্ককে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করবোঃ
১. বংশীয় সম্পর্ক
রসূল সা. এর বংশীয় ধারা নিম্নরূপঃ
মুহাম্মদ সা. (১) ইবনে আব্দুল্লাহ (২) ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (৩) ইবনে হাশিম (৪) ইবনে আব্দুল মানাফ (৫) ইবনে কুসাই (৬) ইবনে কিলাব (৭) ইবনে মুররা (৮) ইবনে কা’ব (৯) ইবনে লুই (১০) ইবনে গালেব (১১) ইবনে ফেহের (১২) ইবনে মালেক (১৩) ইবনে নাযর (১৪) ইবনে কিনানা (১৫) ইবনে খুযায়মা (১৬) ইবনে মুদরাকা (১৭) ইবনে ইলিয়াস (১৮) ইবনে মুযার (১৯) ইবনে নাযার (২০) ইবনে মুসাদ (২১) ইবনে আদনান (২২) ইবনে উদ্ (২৩) ইবনে মুকওয়াম (২৪) ইবনে নাখুর, ইবনে তায়যাহ, ইবনে ইয়ারাব, ইবনে ইয়াশজার, বিন নাবিত, বিন ইসমাইল, বিন ইবরাহীম।
রসূল সা. জানিয়েছেন যে, আদনানের পরে হযরত ইসমাইল আ. পর্যন্ত নামগুলো তেমন নির্ভরযোগ্য নয়। ঐতিহাসিকগণ ঐ নামগুলো সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। আদনানের সাথে রসূল সা. এর সম্পর্ক একুশতম বংশীয় স্তরে অবস্থিত। সময়ের ব্যবধান ১১৫৮ বছরের। আরব গোত্রগুলোর সাথে রসূল সা. এর সম্পর্ক কোন না কোন স্তরে গিয়ে মিলিত হয়।
আদনানের ছেলে উক্ (মুয়াদের ভাই) ইয়ামানের গাসসান নামক অঞ্চলে গিয়ে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং আশয়ারী গোত্রে বিয়ে করে। এই অঞ্চলে ইসলাম খুব দ্রুত প্রসার লাভ করে। ইয়ামানের বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু প্রতিনিধি দল রসূল সা. এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে আশয়ারীদের দলও ছিল। নাযার (২০ নং পূর্ব পুরুষ) এর চার ছেলে ছিল। তন্মধ্যে আনমারের সন্তানরা নাজদ ও হেজাজে বসতি স্থাপন করে। আয়াদের সন্তানেরা ছুগুরে ও তার আশপাশে বসবাস করে। আর মুযার (১৯ নং) এবং রবীয়া আরবের মধ্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
এবার সেইসব খ্যাতনামা গোত্রের পরিচয় নেয়া যাক, যারা রসূল সা. এরই সমগোত্রীয় এবং এসব গোত্রের নাম সীরাত, ইতিহাস ও হাদীসের গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ রয়েছেঃ
বনু তামীম- তামীম বিন মারদ বিন উদ বিন তানজা বিন ইলিয়াস (১৮) এর বংশধর।
বনু গিতফান- গিতফান বিন গিতফান বিন সা’দ বিন ইলিয়াস (১৮) এর বংশধর।
বনু যুবিয়ান- যুবিয়ান বিন বুয়াইয বিন রায়েশ বিন গিতফান- ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু হাওয়াযেন- হওয়াযেন বিন মানসূর বিন ইকরামা বিন হাসফান বিন কায়েস ঈলান বিন ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু সা’দ- সা’দ বিন বকর বিন হাওয়াযেন…….. ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু সাকীফ- সাকীফ বিন হাওয়াযেন……… ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু সালীম- সালীম বিন মানসুর…….. ইলিয়াস এর বংশধর।
বনু হুযায়েল- হুযায়েল বিন মুদারিকা- (১৭ নং)।
বনু হাওন- হাউন বিন খুযাইমা (১৬ নং)।
ওয়াইশী- ওয়াইশ বিন কারাহ বিন হাউন বিন খুযাইমা।
আযালী- আযাল বিন কারা……………… খুযাইমা পর্যন্ত।
বনু আসাদ- আসাদ বিন খুযাইমা……………. খুযাইমা পর্যন্ত।
বনু নাযার- নাযার বিন কিনানা (১৫ নং)।
বনু কিনানা- ঐ।
বনু মুসতালিক- মুসতালিক (খুযাইমা) বিন আবদ মানাত বিন কিনানা (১৫ নং)।
আল আহাবীশ- আহাবীশ বিন কিনানা।
বনু মালেক- মালেক (১৩নং) বিন নাযার বিন কিনানা।
কুরাইশ- ফেহের বা কুরাইশ (১২ নং) বিন মালেক।
বনু মুহারিব- মুহারিব বিন ফেহের।
বনু তাইম- তাইম বিন গালেব (১১ নং) বিন ফেহের।
বনু আওফ- আওফ বিন লুয়াই (১০ নং) বিন গালেব।
বনু আমের- আমের বিন লুয়াই।
বনু হারস- হারস বিন লুয়াই।
বনু হাসীস- হাসীস বিন কা’ব (৯ নং) বিন লুয়াই।
বনু সাহম- সাহম বিন কা’ব।
বনু জুমাহ- জুমাহ বিন কা’ব।
বনু আদ্দী- আদ্দী বিন কা’ব।
বনু কিলাব- কিলাব (৭ নং) বিন মুররা (৮ নং)।
বনু তাইম- তাইম বিন মুররা (৮ নং)
বনু মাখযূম- মাখযূম বিন মুররা।
বনু কুসাই- কুসাই (৬ নং) বিন কিলাব।
বনু যুহরা- যুহরা বিন কিলাব।
আসদী- আসাদ বিন আব্দুল উয্যা বিন কুসাই (৬ নং)।
মুত্তালিবী- মুত্তালিব বিন আব্দ মান্নাফ (৫ নং)।
বনু উমাইয়া- উমাইয়া বিন আব্দুশ্ শামস বিন আবদ মানাফ।
নাওফিলিউন- নওফিল বিন আবদ মানাফ।
বনু হাশেম- হাশেম বিন আবদ মানাফ।
এই সুদীর্ঘ বংশীয় ধারাক্রম এত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত যে, রসূল সা. এর বহু উঁচুস্তরের ঘনিষ্ঠ সাহাবীগণ এর সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন হযরত ওমর রা. এর বংশধারা যাররাহ বিন আদ্দী বিন কা’ব (৯ নং) এবং হযরত আবু উবাইদা বংশীয় সম্পর্কে জাররাহ বিন আদ্দীর সাথে যুক্ত। রসূল সা. এর মাতা হযরত আমেনা ওহব বিন আবদ মানাফ বিন যোহরা বিন কিলাব (৭ নং) এর বংশধর। একই কিলাব বিন মুররার ভাই তাইমের বংশোদ্ভূত ব্যক্তি হযরত আবু বকর। আশারায়ে মুবাশ্শারা অর্থাৎ জীবদ্দশায় বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীর অন্যতম সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস মালেক বিন উহাইব বিন মানাফের মাধ্যমে রসূল সা. এর সাথে সম্পৃক্ত। কা’বা শরীফের চাবি রক্ষক উসমান বিন তালহা আব্দুদ্দার বিন কুসাই (৬ নং) এর বংশোদ্ভূত। আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত আরেকজন হযরত যুবায়ের বিন আওয়াম বিন খুয়াইলিদ বিন আসাদ বিন আবদুল উয্যা বিন কুসাই (৬ নং) এর বংশধর। অনুরূপভাবে হযরত খাদীজা তাহেরা খুয়াইলিদ বিন আসাদ বিন আব্দুল উয্যা বিন কুসাই এর মেয়ে। ওয়ারাকা বিন নাওফেল বিন খুয়াইলিদ তাঁর ভাই। হারেস বিন মুত্তালিব বিন আবদ মানাফের (৫ নং) তিন ছেলে আবু উবাইদা (বদরের শহীদ) তুফাইল ও হাদীস বিখ্যাত সাহাবী। ইমাম শাফেয়ীর বংশধারাও মুত্তালিবের সাথেই যুক্ত। হযরত ওসমান উমাইয়া বিন আবদুশ শামস বিন আবদ মানাফের বংশধর।
রসূল সা. এর চাচা ক’জন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। দু’জনের বিবরণ জানাই যায়না। এক চাচা দিরাই আগেই মারা যান। তাঁর চাচাদের মধ্যে নিম্ন লিখিত ব্যক্তিবর্গ খুবই উল্লেখযোগ্য। এরা ইসলামের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত এবং এদের বিবরণও সংরক্ষিত রয়েছে।
এক চাচা হারেস ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেই মারা যান। তাঁর চার ছেলে নওফেল, আব্দুল্লাহ, রবীয়া ও আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এই রবীয়া বিন হারেসের হত্যার প্রতিশোধ বা ক্ষতিপূরণের দাবী ছেড়ে দিয়েই রসূল সা. সর্বপ্রথম মক্কা বিজয়ের সময় ঘোষণা করেন, জাহেলী যুগের সকল খুনের প্রতিশোধ বা ক্ষতিপূরণের দাবীর আজ বিলোপ সাধন করা হলো।
এক চাচা ছিলেন আবু তালেব, যিনি রসূল সা. এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালন করেন। ইসলামী আন্দোলনের বাইরে থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে মন প্রাণ দিয়ে সর্বাত্মক সাহায্য করেন। আজ এমন কাউকে পাওয়া যাবেনা, যার আবু তালেবের সুযোগ্য সন্তান হযরত আলী, জাফর ও আকীলের নাম জানা নেই। আবু তালেবের দুই মেয়ে উম্মে হানী এবং জুমানাও ইসলাম গ্রহণ করেন। মে’রাজের ঘটনা উপলক্ষে হযরত উম্মে হানী বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন।
এক চাচা ছিলেন হযরত হামযা, যিনি ওহুদ যুদ্ধে শাহাদাত লাভ করেন। তাঁর লাশের সাথে হিন্দা অত্যন্ত হিংস্র আচরণ করে। এই চাচাই রসূল সা. এর সাথে কৃত আবু জাহেলের অশুভ আচরণের প্রচণ্ড প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
এক চাচা ছিলেন হযরত আব্বাস। তিনি শুরু থেকেই অভিভাবক সুলভ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষত, আকাবার বায়য়াতের আলোচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আনসারদেরকে তাদের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে তিনি সতর্ক করেন। তাছাড়া মক্কায় থেকে গিয়ে তিনি রসূল সা. কে পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করেন। যখন সংঘাত সংঘর্ষের স্পর্শকাতর সময়টা পার হয়ে গেল, তখন তিনি ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করে মদিনায় যাত্রা করেন।
এক চাচা যুবায়ের ইসলামের আবির্ভাবের আগেই ইন্তিকাল করেন। অত্যন্ত সদাশয় লোক ছিলেন এবং হিলফুল ফুযুলের প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
এক চাচা ছিল আবু লাহাব। এই চাচা ইসলামের শুধু কট্টর বিরোধীই ছিলনা, বরং বিরোধী শিবিরের সক্রিয় সেনাপতিও ছিল। তার স্ত্রীও ইসলামের ঘোর দুশমন ছিল এবং ব্যক্তিগতভাবে রসূল সা. কে কষ্ট দেয়া ব্যাপারে সবার আগে থাকতো। আবু লাহাব অত্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি ভোগ করে। সে প্লেগে মারা যায়। তিন দিন পর্যন্ত তার লাশ পড়ে থেকে পঁচতে থাকে। কেউ ধারে কাছেও যায়নি। শেষ পর্যন্ত দেয়ালের ওপার থেকে পাথর নিক্ষেপ করে লাশ ঢেকে দেয়া হয় এবং ঐ পাথরের স্তুপকেই কবরে পরিণত করা হয়। আবু লাহাবের স্ত্রীর গলায় রশীর ফাঁস লেগে শোচনীয়ভাবে মৃত্যু ঘটে। আবু লাহাবের দুই ছেলে কাফের অবস্থায় মারা যায় এবং দুইজন হোনায়েন যুদ্ধের সময় রসূল সা. এর আনুগত্য অবলম্বন করে। তার কন্যা দিরা ইসলাম গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করে।
রসূল সা. এর ফুফুদের মধ্যে একজন ছিলেন কুষায়ের বিন রবীয়া (আবদে মানাফের বংশধর) এর স্ত্রী উম্মে হাকীম রায়দা। তার সন্তান আমের মক্কা বিজয়ের দিন ইসলাম গ্রহণ করেন। আমেরের ছেলে আব্দুল্লাহ বিন আমেরও সাহাবী হন এবং হযরত উসমানের খেলাফত আমলে খোরাসানের গভর্ণর নিযুক্ত হন। এই উম্মে হাকীমেরই মেয়ে আরওয়া ছিলেন হযরত উসমানের মাতা। অপর ফুফু ছিলেন উমাইমা। তার বিয়ে হয়েছিল জাহশ বিন রুবাবের সাথে। তার এক মেয়ে উম্মে হাবীবা আব্দুর রহমান বিন আওফের স্ত্রী ছিলেন। অপর মেয়ে হামনার প্রথম বিয়ে মুসয়াব ইবনে উমাইরের সাথে এবং দ্বিতীয় বিয়ে তালহা বিন আব্দুল্লাহর সাথে হয়। দ্বিতীয় বিয়ে থেকে জন্ম নেয়া দুই সন্তান মুহাম্মাদ ও ইমরান ইসলামী আন্দোলনের বীর সেনানী হন। আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়ে নিজের মামা হযরত হামযার সাথে সমাহিত হন। তৃতীয় ফুফু ছিলেন আতেকা, যিনি বদর যুদ্ধের আগে একটা স্বপ্ন দেখেন। এই স্বপ্ন নিয়েই কোরায়েশ মহলে এই বলে অনেক ঠাট্টা বিদ্রুপ করা হয় যে, ‘‘এখন বনু হাশেমের মেয়েরাও নবুওয়াত দাবী করা শুরু করেছে।’’ চতুর্থ ফুফু ছিলেন হযরত সাফিয়া। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় হারেস বিন হারব ইবনে উমাইয়ার সাথে এবং দ্বিতীয় বিয়ে হয় আওয়াম বিন খুয়াইলিদের সাথে। এই বিয়ে থেকেই জন্ম নেন আশারায়ে মুবাশশারার অন্যতম সদস্য যুবায়ের। সায়েব ইবনুল আওয়ামও তাঁর গর্ভজাত সন্তান। সায়েব বহু জেহাদে অংশ নিয়েছেন। হযরত হামযার লাশ পড়ে থাকতে দেখে এবং তার সাথে অমানুষিক আচরণ দেখে তিনি ধৈর্যের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পঞ্চম ফুফু বাররা আব্দুল আসাদ বিন হিলালের স্ত্রী ছিলেন। আবু সালমা তাঁরই সন্তান ছিলেন। এই আবু সালমা উম্মুল মুমীনীন উম্মে সালমার প্রথম স্বামী ছিলেন। আর এক ফুফু আরওয়ার স্বামী ছিল উমাইর উহাইব। তার সন্তান তুলাইব যখন তাকে নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা জানান তখন তিনি প্রচণ্ড আবেগের বশে বলেনঃ ‘তোমার জন্য তোমরা মামার ছেলে সর্বাধিক সেবা ও সাহায্যের হকদার। আল্লাহর কসম, আমরা নারীরা যদি পুরুষদের মত ক্ষমতাশালী হতাম, তা হলে আমরা তাকে রক্ষা করতাম এবং তার শত্রুদেরকে সমুচিত জবাব দিতাম।’’
এ কথাগুলোর পেছনে ঈমানী জযবাও সক্রিয় ছিল, একজন ফুফুর অকৃত্রিম স্নেহও ছিল। রসূল সা.- এর বংশজাত সম্পর্কের আরো কিছু দিক রয়েছে। তবে এখানে আমরা শুধু তাঁর যে সব আত্মীয়তার সম্পর্ক ইসলামী আন্দোলনের সাথে কোনো না কোনো ভাবে সম্পর্কিত ছিল সেগুলোই তুলে ধরেছি। এ কথা সত্য যে, সংঘাত সংঘর্ষ মৌলিক ও আদর্শিক হওয়ার কারণে বড়ই কঠিন ও জটিল ছিল। কোরায়েশরা এ ক্ষেত্রে খুবই দীর্ঘস্থায়ী মজবুত বিরোধী শিবির খুলে রেখেছিল। কিন্তু আত্মীয়তার এই সম্পর্কগুলো ভেতরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। বনু হাশেম সার্বিকভাবে অন্যদের তুলনায় অধিকতর সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করে। আত্মীয়তার কারণেই আবু জাহলের জুলুম দেখে হযরত হামযার মাথায় খুন চড়ে যায় এবং তিনি জাহেলিয়াত ছেড়ে রসূল সা. এর সঙ্গী হয়ে যান। অবরোধের সময় আবু জাহল শিয়াবে আবু তালেবের দিকে খাদ্য যেতে বাধা দিলে আবুল বুখতারী তাতে আপত্তি জানায়। হযরত আব্বাস নীরবে মক্কায় থেকে সহযোগিতা করেন। কোরায়েশদের বৈঠকাদিতেও মাঝে মাঝে আত্মীয়তার কারণে কেউ কেউ রসূল সা. এর পক্ষপাতিত্ব দেখাতে থাকে। কেউ কেউ রসূল সা. মক্কার বাইরে গিয়ে আরবদের মধ্যে কাজ করে সফল হয়তো হোকগে এই মর্মে মত দেয়। সে ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য কোরায়েশদেরই সাফল্য হবে বলেও মন্তব্য করা হয়। তারপর বহু বছরের জেদাজেদীর পর মক্কা বিজিত হলে লোকেরা রসূল সা. কে ‘‘একজন মহানুভব ভাই এবং মহানুভব ভাই এর ছেলে’’ বলে আখ্যায়িত করে। এই আত্মীয়তা অন্য দিক দিয়েও প্রভাব বিস্তার করে। রসূল সা. এর আপনজনের যুদ্ধবন্দী হয়ে এসে রাতের বেলা বন্ধনগুলোর ব্যাখ্যায় আহ্ উহ্ করতে থাকলে তাঁর ঘুম হারাম হয়ে যায়। মক্কায় দুর্ভিক্ষ হলে তাঁর মন গলে যায় এবং খাদ্য শস্য ও নগদ সাহায্য পাঠান। মক্কা জয় করার পর তাঁর অধিবাসীদেরকে মুক্ত হস্তে দান করেন।
২. মদিনায় মাতুল সম্পর্ক
রসূল সা. এর পিতা জনাব আব্দুল্লাহর মা ফাতেমা বিনতে ওমর মদিনার খ্যাতনামা গোত্র বনু নাজ্জারের বংশোদ্ভূত ছিলেন। তারও আগে তাঁর পরদাদা হাশেমও খাজরাজ গোত্রের এক মহিলা হিন্দ বিনতে আমর বিন সা’লাবাকে বিয়ে করেছিলেন। এ কারণে রসূল সা. এর পিতা আব্দুল্লাহ মদিনায় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। ঘটনাক্রমে এক বাণিজ্যিক সফরে মদিনাতেই তাঁর পিতার ইন্তিকাল হয়ে যায় এবং সেখানেই তিনি সমাহিত হন। রসূল সা. এর মাতা আমেনা আত্মীয় স্বজনের সাথে সাক্ষাত করা ও স্বামীর কবর দেখার উদ্দেশ্যে তাঁকে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে সাথে নিয়ে মদিনায় যান। সেখানে তিনি একমাস অবস্থান করেন। দারুন নাবেগাতে থাকতেন। হিজরত করে যখন মদিনায় যান, তখন ৪৭ বছর আগের সেই স্মৃতি তাঁর মনে পড়ে যায়। বৈঠকাদিতে কখনো কখনো বলতেন, মামা বাড়ীতে আনিসা নামে একটা মেয়ে তার খেলার সাথী ছিল। দুর্গের একটা পাখি বসতো আর ছেলে মেয়েরা তাকে উগিয়ে দিত। ঐ ঘরে আমার মা অমুক জায়গায় বসতো এবং পিতার কবর অমুক জায়গায় ছিল। রসূল সা. একথাও জানিয়েছিলেন যে, বনু নাজ্জারের একটা পুকুরে তিনি ভালো সাঁতার কাটা শিখেছিলেন। ঐ সফরের মক্কায় ফেরার পথে আবওয়া নামক স্থানে তাঁর মায়ের ইন্তিকাল হয়।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, পরবর্তীকালে যখন মদিনার সাথে ইসলামী আন্দোলনের সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে, তখন এই সম্পর্ক নিশ্চয়ই তাতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মদিনার লোকেরা, বিশেষত বনু নাজ্জারের লোকেরা তাঁকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মনে করতো এবং তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বনু নাজ্জার অধিকতর উৎসাহী ছিল। ঐ গোত্রের ছোট ছোট মেয়েরা গান গেয়ে তাঁকে স্বাগতম জানাচ্ছিল।
৩. দুধ খাওয়ার সম্পর্ক
জন্ম হবার পর রসূল সা. দিন কয়েক আবু লাহাবের দাসী সাওবিয়ার দুধ পান করেন। স্থায়ী দুধমাতা হবার সৌভাগ্য লাভ করেন বনু হাওয়াযেনের হালীমা সা’দিয়া। হালীমার বড় মেয়ে হাযযাফা (ডাক নাম আশ্শাম্মা) শিশুকালে রসূল সা. এর সেবা করেছিলেন। হোনায়েন যুদ্ধে হাযযাফা যখন বন্দীনী হয়ে এল, সামরিক প্রহরীদেরকে বললো, ‘‘আমি তো তোমাদের নেতার বোন। রসূল সা. এর কাছে তাকে আনা হলে তিনি আনন্দের সাথে তাকে অভ্যর্থনা জানান। তার সামনে তিনি চাদর বিছিয়ে দেন। তিনি আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং বলেন, তুমি ইচ্ছা করলে আমার এখানেও থেকে যেতে পার, আর ইচ্ছা করলে তোমাকে তোমার গোত্রে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। সে গোত্রে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে রসূল সা. তাকে প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে বিদায় জানান। সে ইসলামও গ্রহণ করেছিল।
এই দুধমায়ের সম্পর্কের দোহাই দিয়েই বনু হাওয়াযেন গোত্র হোনায়েন যুদ্ধের পর নিজেদের বন্দী মুক্তির আবেদন জানায়। তিনি বনু হাশেমের সমস্ত বন্দীকে তৎক্ষণাত মুক্ত করে দেন এবং তাঁর দেখাদেখি সাহাবীরাও নিজ নিজ বন্দীদের ছেড়ে দেন।
৪. নিজের মেয়েদের বিয়ে
যয়নবের বিয়ে মক্কাতেই আবুল আসের সাথে সম্পন্ন হয়। আবুল আসের মা হযরত খাদীজার সৎ বোন ছিলেন। অর্থাৎ রসূল সা. তার খালু ছিলেন। যয়নব ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় হিজরত করেন। তার পরে তার স্বামী আবুল আসও ইসলাম গ্রহণ করে ও মদিনায় আসে। তাদের সাবেক সম্পর্ক বহাল থাকে। স্বামী স্ত্রীতে গভীর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। এমনকি মক্কাবাসী তালাক দিতে চাপ দেয়া সত্ত্বেও আবুল আস যয়নবকে তালাক দেয়নি। এই কারণে আবুল আসকে কাফের থাকা কালে মুসলমানদের অনুমতি নিয়ে মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি দেয়া হয় এবং তার থেকে দখলীকৃত বাণিজ্যিক পণ্য ফেরত দেয় হয়।
রুকাইয়ার বিয়েও মক্কায় হযরত ওসমানের সাথে সম্পন্ন হয়। এই দম্পতিই সর্বপ্রথম একত্রে হিজরত করেন। দ্বিতীয় হিজরীতে রুকাইয়া মারা গেলে ৩য় হিজরীতে রসূল সা. আল্লাহর নির্দেশে উম্মে কুলসুমকেও হযরত ওসমানের সাথে বিয়ে দেন। পর পর দুই মেয়ে বিয়ে করার কারণে তাকে ‘যিন্নুরাইন’ বলা হয়। হযরত ফাতিমাকে রসূল সা. হযরত আলীর সাথে বিয়ে দেন। আবুল আ’স ব্যতীত ইসলামী আন্দোলনের এই দু’জন শীর্ষস্থানীয় নেতা রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ সাথী বংশীয় সম্পর্ক ছাড়াও বৈবাহিক সম্পর্ক সূত্রে রসূল সা. এর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন। এই আত্মীয়তা ইসলামী আন্দোলনের বিরাট কাজ পরিচালনায় সহায়ক হয়েছিল।
৫. রসূল সা. এর বৈবাহিক সম্পর্ক
যেহেতু রসূল সা. এর বৈবাহিক সম্পর্ক বিষয়ে উগ্র ইসলাম বিদ্বেষী পাশ্চাত্য দার্শনিকরা অনেক আপত্তি তুলেছেন, তাই আমাদের ভেতরকার একটা মহল এই বাস্তব ব্যাপারটাকে নিয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে যান। তারা ভাবেন, রসূল সা. এতগুলো বিয়ে করলেন, আর ইসলাম একাধিক বিয়ের অনুমতি দিল, এ লজ্জা রাখি কোথায়? এ জন্য সংক্ষিপ্ত একটা আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা দিতে চাই।
সর্বপ্রথম যে কথাটা মনে বদ্ধমূল করা প্রয়োজন তা হলো, মানবেতিহাসের প্রথম যুগটা ছিল বংশবৃদ্ধির যুগ। সেই যুগটাকে আমরা রসূল সা. এর যুগ পর্যযন্ত বিস্তৃত দেখতে পাই। বিস্তীর্ণ ভূখন্ড তখন জনশূন্য ও অনাবাদী পড়ে থাকতো। জীবিকার উপকরণ উৎপাদনের ক্ষেত্রও খোলা পড়ে থাকতো। ফলে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই মানবজাতির মধ্যে লোকসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেরণা অত্যন্ত জোরদার ছিল। এ জন্য সে যুগের যে কোন সভ্যতা বা ধর্মের দিকে তাকানো হোক না কেন, বহু বিবাহ প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত শরীয়তের বিধানগুলিও এর অনুমতি দিয়েছে। বহু নবী একাধিক বিয়ে করেছেন মাত্র দু’একজন দেখা যায়, গৃহ সংসার পরিত্যাগ করে সার্বক্ষণিক দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ নবীই সাংসারিক জীবন যাপন করেছেন এবং সর্বাত্মকভাবে করেছেন। রসূল সা. বংশবৃদ্ধি ও বহু বিবাহের এই যুগেরই শেষভাগে অবস্থান করেন। তাঁরই সময় থেকে সর্বপ্রথম আল্লাহর পক্ষ থেকে বহু বিবাহের সংখ্যা সীমিত করার নির্দেশ আসে। [এই সীমাবদ্ধতা করণের নির্দেশে একাধিক বিয়ের শেষ সীমা চার পর্যযন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেই সাথে ন্যায়বিচারের কড়া শর্ত আরোপ করে এক বিবাহের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কিন্তু একাধিক কারণে রয়েছে এবং থাকবে। উদাহরণ স্বরূপ, সর্বপ্রথম কারণ এই যে, ইসলাম যৌনতার স্বেচ্ছাচার ও ব্যভিচারকে সর্বতোভাবে বন্ধ করতে চায় এবং এজন্যে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। এরূপ ব্যবস্থায় সেই সব লোকের জন্য একাধিক বিয়ের সুযোগ রাখা জরুরী ছিল, যারা অধিকতর যৌন ক্ষমতার অধিকারী। এই বাস্তব প্রয়োজনকে পাশ্চাত্য দেশে উপেক্ষা করার ফল হয়েছে এই যে, এক স্ত্রীর সাথে বহু উপপত্নী রাখার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। উপরন্তু বেশ্যাবৃত্তির ব্যবস্থাও প্রচলিত হয়েছে এবং তা এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, তা থেকে উদ্ধার পাওয়াই এখন কঠিন হয়েছে। এমনকি “অবাধ প্রেম প্রণয়” নামে সম্মত ব্যভিচারের এমন তান্ডব চলছে যে, তার তুলনায় বিচার করলে ইসলামের বহু বিবাহ ব্যবস্থা অবশ্যই বহুগুণ শ্রেয় মনে হবে। দ্বিতীয় কারণ এই যে, ক্ষেত্র বিশেষে সন্তানের আকাংখা একাধিক বিয়ে করতে বাধ্য করে। তৃতীয় কারণ এক স্ত্রীর স্থায়ী রোগব্যাধি হতে পারে। এরূপ পরিস্থিতিতে রুগ্ন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে বিপদে নিক্ষেপ না করে স্বামী তার স্বাভাবিক চাহিদা চরিতার্থ করতে পারে। চতুর্থ কারণ এই যে, অনেক সময় গোত্রীয় ও পারিবারিক রাজনীতি, শক্তিবৃদ্ধি, প্রতিশোধের ধারাবাহিকতা, উত্তরাধিকারের ঝামেলা এবং এতিম ও বিধবাদের পুনর্বাসনের সমস্যার সমাধান বিয়ের মাধ্যমেই হতে পারে। এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে যে, প্রাচীন বা আধুনিক কালে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা অর্জনের একমাত্র পন্থা হিসেবে একাধিক বিয়ে অনেক সময় ফলপ্রসু হয়েছে।] রসূল সা. যে সব বিয়ে করেছেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ অনুমতি ভিত্তিতেই করেছেন।
দ্বিতীয়ত রসূল সা. এর অধিকাংশ বিয়ে যৌন আকাংখা নিবৃত করার উদ্দেশ্যে নয় বরং ইসলামী আন্দোলন, দেশ ও জাতির কল্যাণের খাতিরেই করেছেন। এ সব বিয়ে প্রধানত রাজনৈতিক ছিল। রসূল সা. স্বয়ং বলেছেন, “আমার কোন স্ত্রীলোকের প্রয়োজন নেই। (দারামী) অর্থাৎ নিছক যৌন তাড়না আমাকে কোন স্ত্রী গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেনা। প্রকৃত পক্ষে রসূল সা. সঠিক অর্থে দুটো বিয়েই করেছেনঃ একটা হযরত খাদীজার সাথে এবং দ্বিতীয়টা হযরত আয়েশার সাথে। অন্যান্য বিয়ের পেছনে কিছু অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক দাবী কার্যযকর ছিল। এইসব দাবী পূরণের খাতিরে রসূল সা. নিজের ব্যস্ততম জীবন ও অত্যন্ত দরিদ্র অর্থনীতির ওপর বিরাট বোঝা চাপিয়ে মানবতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন।
এখানে লক্ষণীয়, যে যুবক ২৫ বছর বয়স পর্যযন্ত অতুলনীয় সংযম, শালীনতা ও লজ্জাশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, আর তাও একটি সমাজে যেখানে মদ ও ব্যভিচার সংস্কৃতির একটা বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল, যে যুবক ২৫ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পর সাধারণ ভোগবাদী অভিরুচি অনুসারে কোন উঠতি যৌবনা তরুণীর পরিবর্তে ৪০ বছরের এক বিধবাকে নির্বাচন করে শুধু এ জন্য যে, এটা তার জীবনের লক্ষ্য অর্জনে অধিকতর সহায়ক এবং তারপর জীবনের শ্রেষ্ঠ ২৫টি বছর সেই একই মহিলার সাথে কাটিয়ে ৫০ বছর পূর্ণ করে, তার সম্পর্কে কি এমন হীন ধারণা পোষণ করা যায়, যা আপত্তি উত্থাপনকারীরা পোষণ করে থাকে? আরো লক্ষণীয় যে, বিয়ের আধিক্যের সময়টা তাঁর জীবনে ৫৫ থেকে ৫৯ বছরের মাঝে অবস্থিত এবং আরবের মত গরম দেশে এই বয়সে যৌন আবেগ থিতিয়ে যেতে আরম্ভ করে। ওদিকে স্ত্রীদের বয়স দেখুন, দু’জন ছাড়া সবার বয়স বিয়ের সময় ২০ বছরের ওপরে ছিল। আর পাঁজনের বয়স তো ৩৬ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ছিল। প্রশ্ন এই যে, রসূল সা. এর জন্য যুবতী ও সুন্দরী মেয়ের কি অভাব ছিল?
এ ধরনের আপত্তি উত্থাপনকারীদের ভাবা উচিত ছিল যে, তিনি নিজের ঘাড়ের ওপর কত বড় দায়িত্ব চাপিয়ে নিয়েছিলেন। তার না ছিল দিনের বেলায় এক মুহূর্তের স্বস্তি, আর না ছিল রাতে এক মুহূর্তের বিশ্রাম। তিনি মানুষকে পর্দার ন্যায় মহান ও কল্যাণকর বিধান দান করেছিলেন (এই বিধান নিয়েও ইউরোপীয়ানরা নাক সিটকায়) এবং মানুষকে নিজের দৃষ্টি ও মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর বেশীরভাগ সময় সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যাবলী নিয়ে ভাবতে ভাবতে কেটে যেত এবং রাতেও নিভৃত সময়গুলোতে নামায পড়তে পড়তে তাঁর পা ফুলে যেত। এহেন ব্যক্তি সম্পর্কে কিভাবে ঐ সব আজে বাজে কথা ভাবা যায়?
তাছাড়া ভোগবাদী রাজা বাদশাহ ও বিজেতাদের কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও তাঁর মধ্যে দৃষ্টিগোচর হয়না। তিনি যুলুমবাজ এবং স্বৈরাচারীও নন। মদ, গানবাজনা ও মূল্যবান পোষাক পরিচ্ছেদেও তার কোন আগ্রহ নেই। বরঞ্চ তিনি মানব সমাজকে এই সব ভোগবাদী আমোদ প্রমোদ থেকে পবিত্র করেছেন। তিনি না স্ত্রীদেরকে আরাম আয়েশের উপকরণে সরবরাহ করে করে দিয়েছেন, না তাদেরকে রেশম ও স্বর্ণের অলংকার দিয়ে সজ্জিত করেছেন। বরঞ্চ নিজের দরবেশ সুলভ জীবনের যাবতীয় বৈশিষ্ট তাদের মধ্যেও সঞ্চারিত করেছেন। তাদেরকে তিনি এতটা আদর সোহাগ কখনো করেননি, যাতে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন আন্দোলনের স্বার্থের চেয়েও অগ্রাধিকার লাভ করে, কিংবা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নীতিও পরিত্যাগ করার প্রয়োজন পড়ে। বরঞ্চ এরূপ ক্ষেত্রে তাদেরকে তিনি কঠোরভাবে শাসিয়েছেন। এক পর্যায়ে তো ভরণপোষণের মান উন্নত করার দাবী তোলায় তাদেরকে তিনি খোলাখুলিভাবে বলে দেন যে, এই দরিদ্রাবস্থায় আমার সাথে থাকতে পারলে থাকো, নচেত আমি বিদায় করে দিতে প্রস্তুত। এই সব পরিস্থিতি একত্রে মিলিত হয়ে কি এই নিরর্থক আপত্তিকে খন্ডন করেনা?
রসূল সা. এর একাধিক বিয়ের পেছনে যে বিশেষ প্রয়োজনগুলো কার্যকর ছিল তা নিম্নরূপঃ গোত্রীয় সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য এই যে, এতে বংশীয় আভিজাত্যের বৃত্ত খুবই সীমাবদ্ধ এবং এর সীমারেখাগুলো খুবই মজবুত রাখা হয়। গোত্রীয় মানস আপন ও পরের মধ্যে অত্যন্ত তীব্রভাবে ভেদাভেদ করে। এহেন পরিস্থিতিতে অসংখ্য বিক্ষিপ্ত গোত্র পরস্পরের সাথে যুক্ত করার জন্য যেখানে বিশ্বজোড়া মতবাদের প্রয়োজন, সেখানে নেতার ব্যক্তিত্বও এমন হওয়া চাই, যা সবার কাছে না হলেও অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ গোত্রের কাছে প্রিয় ও আপন। আরবে কার্যত সংস্কারমূলক ও গঠনমূলক কাজ করা এমন কোন ব্যক্তির পক্ষে আদৌ সম্ভব ছিলনা, যার নিজস্ব কোন মর্যাদাবান গোত্র নেই। তবে ঐ কাজকে সাফল্যের পর্যায়ে নেয়ার জন্য আন্তঃগোত্রীয় সম্পর্কের প্রয়োজন ছিল এবং এই রাজনৈতিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্র বিশেষে বৈবাহিক সম্পর্ক সাফল্যমন্ডিত হয়েছিল।
উদাহরণ স্বরূপ, উম্মুল মুমিনীন হযরত জুয়াইরিয়ার কথাই ধরুন। ইনি বনুল মুসতালিক গোত্রের মহিলা ছিলেন। গোটা গোত্র ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং ডাকাতি ও লুটতরাজের জন্য কুখ্যাত। স্বয়ং হযরত জুয়াইরার পিতা ছিল ত্রাস সৃষ্টিকারী ডাকাত সর্দার। এই গোত্র প্রথম দিন থেকেই ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে কট্টর শত্রুতা শুরু করে। তারা কোন শৃংখলাও মানতে প্রস্তুত ছিলনা, কোন আপোষ চুক্তিতেও সম্মত ছিলনা। তবে প্রত্যেক ব্যাপারে ইসলামী সরকারের কট্টর বিরোধিতা করতে সবসময় প্রস্তুত থাকতো। অবশেষে এই শক্তিকে সামরিক ব্যবস্থা দ্বারা দমন করা হয়। হযরত জুয়াইরিয়া বন্দিনী হয়ে আসেন। অতপর রসূল সা. এর সাথে যখন তার বিয়ে হলো, তখন ঐ গোত্রের সমস্ত বন্দীকে মুক্তি দেয়া হলো। মুসলিম সৈন্যরা মনে করলো, ওরা এখন রাসূল সা. এর শ্বশুরালয়ের আত্মীয়, ওদেরকে বন্দী করে রাখা যায়না। এই বিয়ের বরকত দেখুন, গোত্রের প্রতিটি লোক ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে শান্তিপ্রিয় ও আইনশৃংখলার অনুগত হয়ে গেল। কেননা মদিনার শাসক এখন তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এমতাবস্থায় এ সব কাজ আর করা যায়না।
অনুরূপভাবে উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনার ব্যাপারটা ধরুন। নাজদ অঞ্চলটা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা কোরায়েশদের জন্য ইরাক যাতায়াতের একটা বানিজ্যিক পথ নাজদ অঞ্চলের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। অথচ সেখানে ইসলামের দাওয়াত একেবারেই অকার্যকর প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছিল। এখানকার লোকেরা ৭০ সদস্য বিশিষ্ট একটা দাওয়াতী দলকে শহীদ করে দিয়েছিল। তাছাড়া নাজদবাসী একাধিকবার ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রও করেছিল। হযরত মায়মুনা নাজদের সরদারের স্ত্রীর বোন ছিলেন। রসূল সা. এর সাথে তার বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে পরিবেশ পাল্টে গেল এবং নাজদ মদিনার প্রভাবাধীন হতে লাগল। তাছাড়া তাঁর একাধিক বোনের বিয়ে হয় অত্যন্ত মান্যগণ্য সরদারদের সাথে।
উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবার ব্যাপারটাও তদ্রুপ। ইনি কোরায়েশের প্রধান সরদার আবু সুফিয়ানের মেয়ে ছিলেন। এই বিয়ের পর আবু সুফিয়ান আর মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করতে ময়দানে আসেননি। এই বিয়ে আবু সুফিয়ানের শত্রুতার তেজই শুধু কমায়নি, বরং তা অনেকাংশে মক্কা বিজয়ের পথও সুগম করেছে।
অনুরূপভাবে হযরত সফিয়ার কথা বিবেচনা করুন। ইনি একজন শীর্ষস্থানীয় ইহুদী সরদার হুয়াই বিন আখতারের মেয়ে। তার সাথে রসূল সা. এর বিয়ে হওয়ার পর ইহুদীদের বিরোধিতার তেজ এমনভাবে থিতিয়ে যায় যে, তা আর মাথা চাড়া দেয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেনি। হযরত সফিয়া রসূল সা. এর অনুমতিক্রমে ইহুদী আত্মীয়দেরকে আর্থিক সাহায্যও করতেন।
হযরত হাফসার বিয়ের পটভূমিকায় অন্যান্য কার্যকারণ ছাড়া এটাও ছিল অন্যতম যে ইসলামী সমাজ গঠনের জন্য রসূল সা. যে ক’জন বিশিষ্ট সহচরকে নিজের ঘনিষ্ঠতম উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন, তন্মধ্যে চারজন ছিলেন প্রধান। এদের মধ্যে আবু বকরের মেয়ে হযরত আয়েশাকে রসূল সা. বিয়ে করেন, হযরত আলীর সাথে নিজের মেয়ে ফাতেমার বিয়ে দেন, হযরত উসমানের সাথে পর পর দুই মেয়ের বিয়ে দেন এবং হযরত ওমরের মেয়ে হাফসাকে নিজে বিয়ে করেন। হযরত ওমরকে এই আত্মীয়তার বৃত্তের বাইরে রাখা যেতনা। এভাবে ভবিষ্যতের নেতাদেরকে তিনি আস্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেন।
হযরত সওদা বিনতে যামায়া ছিলেন মদিনার বনু নাজ্জারের মেয়ে। তাঁর প্রথম বিয়ে হয় সাকরান বিন আমরের সাথে। এই সাকরানের ভাই ছিলেন হোদায়বিয়ার সন্ধিতে কোরায়েশদের প্রতিনিধি সোহায়েল বিন আমর। সাকরান মারা গেলে রসূল সা. সোহায়েলের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার খাতিরে তার বিধবা ভ্রাতৃবধু ৫০ বছর বয়স্কা সওদাকে বিয়ে করেন। হযরত খাদীজার ইন্তিকালের পর এই বিয়ে করে রসূল সা. নিজের একাকীত্বও ঘুচান।
রসূল সা. বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে আরো একটা অনিবার্য প্রয়োজন পূরণ করার দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন। সেটি হলো পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের মধ্যে মহিলাদের দ্বারাই দাওয়াতী কাজের প্রচলন এবং এজন্য কিছু মহিলা নেতা ও কর্মী সৃষ্টি। ইসলামী পর্দা ব্যবস্থাকে বহাল রেখে এ প্রয়োজন পূরণ করতে হলে তাঁর জন্যে একাধিক বিয়ে করা জরুরী ছিল এবং নিজের স্ত্রীদেরকে ইসলামের দাওয়াত ও শিক্ষা মহিলাদের মধ্যে বিস্তারের কাজে নিয়োগ করা অপরিহার্যয ছিল। এই প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতেই কোরআনে রসূল সা. এর স্ত্রী ও কন্যাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়েছে। হযরত আয়েশা, হযরত হাফসা ও হযরত উম্মে সালমা মহিলাদের মধ্যে দাওয়াত ও দ্বীনী শিক্ষা বিস্তারে নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা অর্জন করেন। অন্যান্য স্ত্রীগণ নৈতিক দিক দিয়ে নিজেদেরকে অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে নারী সমাজের কাছে তুলে ধরেন।
কখনো কখনো রসূল সা. কে দ্বিতীয় পক্ষের মন রক্ষার জন্যও বিয়ে করতে হয়েছে। যেমন নিজের ফুফাতো বোন হযরত যয়নব বিনতে জাহাশকে তিনি অনেক অনুরোধ করে যায়েদ বিন হারেসার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। এ দ্বারা বংশীয় অভিজাত্যের সংকীর্ণ সীমারেখাগুলো ভাঙ্গাই কাম্য ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত এই বিয়ে ব্যর্থ হয় এবং তালাক সংঘটিত হয়। এর ফলে হযরত যয়নবের মর্মাহত হওয়ার ব্যাপারটা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখেনা এবং তাতে রসূল সা. নিজেকে কিছুটা দায়ী বলে অনুভব করেন। এই সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান ছিল যয়নবকে রসূল সা. এর বিয়ে করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাধা ছিল একটা ভ্রান্ত জাহেলী কুসংস্কার। তখনকার সমাজে পালিত পুত্রকে আপন পুত্রের মতই দেখা হতো। যায়েদ বিন হারেসাকে রসূল সা. নিজ পুত্রের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাই তার পরিত্যক্ত স্ত্রীকে বিয়ে করা অবৈধ ও রীতিবিরোধী মনে করা হতো। আল্লাহ এই রীতির বিলোপ সাধন করে যয়নবকে রসূল সা. এর সাথে বিয়ে দেন।
একটু আগে আমি উম্মে হাবীবা বিনতে আবু সুফিয়ানকে বিয়ে করার রাজনৈতিক স্বার্থকতা বর্ণনা করেছি। কিন্তু ঐ বিয়ের পেছনেও ভগ্নমনকে প্রবোধ দেয়ার একটা ইচ্ছা সক্রিয় ছিল। তার বিয়ে হয়েছিল ওবায়দুল্লাহর সাথে এবং তারই সাথে তিনি হিজরত করে আবিসিনিয়া চলে যান। সেখানে স্বামী খৃষ্টান হয়ে যায় এবং মদে অভ্যস্ত হয়ে মারা যায়। উম্মে হাবীবা ইসলামের ওপর অবিচল থেকেছেন। কিন্তু প্রবাসকালে স্বামীর ইসলাম ত্যাগ ও মৃত্যু তার জন্য মর্মঘাতী ব্যাপার ছিল। তাই রসূল সা. আমর বিন উমাইয়া আয-যামরীকে বিশেষ দূত হিসাবে নাজ্জাশীর কাছে পাঠান এবং তার মাধ্যমে তাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। উম্মে হাবীবা এত খুশী হন যে, সুসংবাদদাতা শাহী দাসীকে নিজের অলংকার দিয়ে পুরুস্কৃত করেন। বাদশাহ নাজ্জাশী নিজেই বিয়ে পড়ান। উম্মে হাবীবা নিজের মামাতো ভাই খালেদ বিন সাঈদকে নিজের উকীল নিয়োগ করেন। নাজ্জাশী নিজে চারশো দিনার মোহরানা দিয়ে দেন এবং ভোজের আয়োজন করেন। কোন কোন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, মদিনায় পুনরায় বিয়ে পড়ানো হয় এবং ওলিমা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুরূপভাবে উম্মুল মাসাকীন যয়নব বিনতে খুযায়মা ইবনুল হারেস হেলালিয়া (বনু বকর) রসূল সা. এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে জাহশের স্ত্রী ছিলেন। তিনি ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হয়ে যাওয়ার পর রসূল সা. তাকে বিয়ে করেন। এটা ছিল পুরোপুরি পারিবারিক ঘটনা এবং ভগ্নমনকে প্রবোধ দেয়ার পাশাপাশি এখানে পারিবারিক দিকটাও লক্ষ্য রাখা হয়েছিল।
রসূল সা. সর্বমোট এগারোটা বিয়ে করেন। এর চেয়ে বেশী বিয়ের কথা যে সব বর্ণনায় রয়েছে, তা নির্ভরযোগ্য নয়। এঁদের মধ্যে হযরত খাদীজা হিজরতের পূর্বে (নবুয়তের দশম বছর) এবং যয়নব বিনতে খুযায়মা বিয়ের মাত্র তিন মাস পর ৩য় হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। রসূল সা. এর শেষ বয়সে এক সাথে ৯ জন স্ত্রী বেঁচে ছিলেন। এদের মধ্যে একজন হযরত সওদা চরম বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার কারণে দৈহিক কামনা বাসনার ঊর্ধে ছিলেন। এরপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আসার কারণে রসূল সা. আর কোন বিয়ে করেননি। সাধারণ মুসলমানদের তুলনায় আইনে তিনি একটা বিষয়ে ব্যতিক্রম ছিলেন। সাধারণ মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ ছিল, চারটের বেশী কোন স্ত্রী থাকলে তাকে তালাক দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু রসূল সা. কে অতিরিক্ত স্ত্রীদেরকে কাছে রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এই ব্যতিক্রমের কারণ ছিল এই যে, রসূল সা. এর স্ত্রীগণকে দ্বীনী প্রয়োজনের আলোকে উম্মুল মুমিনীন আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ স্ত্রীগণের আওতা ভুক্ত করা হয়েছিল। তখন তাদের কাউকে যদি রাসূল সা. তালাক দিতেন, তবে তারা একেবারে আশ্রয়হীন হয়ে যেত।
এবার রসূল সা. এর বিয়েগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব লক্ষ্য করুন। এ সব বিয়ের কল্যাণে রসূল সা. একদিকে মক্কায় গোত্রসমূহ ও মোহাজেরদের সাথে এবং অন্যদিকে সাধারণ গোত্রগুলোর সাথে যে সখ্যতা গড়ে ওঠে, তার ব্যাপকতা বোঝানোর জন্য আমি সংশ্লিষ্ট গোত্রগুলোর নাম উল্লেখ করছিঃ
(১) বনু আসাদ বিন আবদুল উয্যা (২) বনু আমের (৩) বনু তামীম (৪) বনু আদী (৫) বনু মাখযুম (৬) বনু উমাইয়া (৭) বনু আসাদ বিন খুযায়মা (৮) বনু মুসতালিক (৯) আরব ইহুদী সম্প্রদায় (১০) বনু কিলাব (১১) বনু কান্দা।
এই সব গোত্রের এলাকাগুলোকে যদি ভৌগলিক বিভক্তির আলোকে দেখা হয় তাহলে বুঝা যায় যে, রসূল সা. এর ব্যক্তিত্ব প্রকৃত পক্ষে আন্তগোত্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বড় বড় গোত্রের জন্য তিনি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের রূপ ধারণ করেন এবং ইসলামী আন্দোলনের জন্য যে সর্বব্যপী ঐক্যের চাহিদা জন্মেছিল, তা পূরণ করার যোগ্য হয়েছিলেন। এই বৈবাহিক সম্পর্কগুলো বিদ্রোহাত্মক প্রবণতাকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দিয়েছিল। এমনকি যুগ যুগ কাল থেকে চলে আসা বহু শত্রুতাও এর দ্বারা খতম হয়ে গিয়েছিল। এখন ভেবে দেখা উচিত যে, সমগ্র বিশ্বমানবতার কাম্য যে সুবিচার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও বিশ্বজোড়া ভ্রাতৃত্ব, তা অর্জনের জন্য যদি আরবের গোত্রীয় পরিবেশে বহুবিবাহ সহায়ক হয়, তবে তা কেন করা হবেনা? আর তা নিয়ে এত হৈ চৈ এরই বা কারণ কী?
প্রকৃতপক্ষে সুক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে যে, এটা ছিল রসূল সা. এর বিরাট ত্যাগ ও কুরবানী যে, তিনে মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে নিজের অসংখ্য ব্যস্ততার পাশাপাশি শেষ বয়সে নিজের ঘাড়ে এত বেশী দাম্পত্য বোঝা চাপিয়ে নিয়েছিলেন এবং নিজের দরিদ্র দশায় এত কষ্টে পরিবারের ভরণ পোষণের দাবি পুরণ করেছেন। এটা কোন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কল্পনায়ও আসতে পারেনা যে, উল্লিখিত সার্বিক পরিস্থিতিতে বিয়ে করার পর কোন মানুষের পক্ষে আমোদ ফূর্তিতে কাটানো দূরে থাক, একটা মুহূর্ত শ্রান্তির জীবন যাপন করাও সম্ভব হতে পারে। এ জন্যই বলেছি, রসূল সা. নিজের মহত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের খাতিরে এতগুলো বিয়ে করে আসলে মস্ত বড় ত্যাগ ও কুরবানীরই পরিচয় দিয়েছেন।
বলতে গেলে এর দ্বারা রসূল সা. এর যে সর্বব্যাপী ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা ইসলামী আন্দোলনের রাজনৈতিক সাফল্য ও বিজয়ের পথ সুগম ও তাকে ত্বরান্বিত করেছে এবং জনগণের ইসলামের দিকে অগ্রসর হওয়াকে সহজতর করে দিয়েছে।