সর্বনাশা বিশ্বাসঘাতকতা
ওপরে আমি মদিনার ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিগুলোর যে সব অপতৎপরতার উল্লেখ করেছি, তা নৈতিক ও আইনগত দিক দিয়ে জঘন্যতম অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এগুলোর দায়ে যদি কঠোরতম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো, তাহলে ধর্ম ও রাজনীতির আলোকে তা হতো সর্বোত্তম ন্যায়বিচার। কিন্তু রসূল সা. অত্যন্ত শান্ত ও ধৈর্যশীল আচরণ করলেন। যে আন্দোলনের আসল লক্ষ্য হয় মানবতার নৈতিক সংশোধন ও পুনর্গঠন, তা ক্ষমতা ও আইনের অস্ত্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে পারেনা। মানুষ যতই হীনতা ও পাশবিকতা প্রদর্শন করুক, ইসলামী আন্দোলন কখনো মানুষের স্বভাব সম্পর্কে হতাশ হয় না, বরং দীর্ঘমেয়াদী আশাবাদের ভিত্তিতে অগ্রসর হয়। এর আসল শক্তি হয়ে থাকে শেখানো, বোঝানো ও পড়ানো, শাস্তি দেয়া ও হুমকি দেয়া নয়। শাসন ক্ষমতা ও আইনের শক্তি কিছু না কিছু প্রয়োগ না করে তো কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিজের অস্তিত্বই রক্ষা করতে পারেনা। কিন্তু মানুষের চরিত্র ও মানসিকতার পরিবর্তনের কাজ তরবারী ও লাঠি দিয়ে হয়না, নৈতিক আবেদন ও যুক্তি দ্বারা হয়। এক্ষেত্রে ক্রোধের পরিবর্তে সংযম এবং প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার পরিবর্তে ধৈর্য ও সহনশীলতা অধিকতর কার্যকর হয়ে থাকে। মানবতার সর্বাপেক্ষা বড় বন্ধু রসূল সা. ইতিহাসের পরিমণ্ডলকে নৈতিক সদাচারের আলো দিয়ে উদভাসিত করতে চেয়েছিলেন এবং শত্রুদের বাড়াবাড়ি ও কুটিল চক্রান্তকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ধৈর্য দ্বারা জয় করতে চেয়েছিলেন। ইতিহাসে এত বড় ক্ষমার কোন নজীর খুঁজে পাওয়া যায়না যা তিনি এ ক্ষেত্রে দেখিয়েছিলেন। রসূল সা. বহু বছরের চেষ্টা সাধনা দ্বারা যেটুকু সাফল্য অর্জন করেছিলেন, গুটিকয় লোক তাকে হাঙ্গামা ও গোলযোগ বাধিয়ে ধ্বংস করে দিতে চাইল। আইন শৃংখলা ও প্রশাসনকে অচল করে দিতে চাইল। হত্যার ষড়যন্ত্র পাকালো এবং নিকৃষ্টতম পন্থায় উত্যক্ত করল। অথচ সারা পৃথিবী মধ্যে নিজস্ব মডেলের প্রথম নবীন ইসলামী রাষ্ট্রের এই রাষ্ট্রপ্রধান বিপর্যয় ও ষড়যন্ত্রের তান্ডবের মধ্য থেকে অত্যন্ত শান্তভাবে, তরংগমালাকে একটা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে নিজের নৌকাকে নিরাপদ স্থানে বের করে নিয়ে গেলেন।
এতদসত্ত্বেও বৈরী শক্তিগুলো অপরাধ প্রবণতা ও পাপাচারের শেষ সীমা পর্যন্ত না গিয়ে ছাড়লোনা। তারা একবার নয়, বারবার বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার আচরণ করলো এবং তাও চরম ধৃষ্টতা সহকারে খোলাখুলিভাবেই করলো। একটা সাংবিধানিক চুক্তির মাধ্যমে যে রাষ্ট্রের তারা নাগরিক হয়েছে, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক-উভয় দিক দিয়েই যে তার আনুগত্য করা তাদের অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়েছে, তার কোন তোয়াক্কাই তারা করলোনা। বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহ এমন এক কাজ, যার শাস্তি কোন কালেই নাগরিকত্ব হরণ ও মৃত্যুদন্ডের চেয়ে কম ছিল না এবং আজও নেই। কিন্তু যিনি সভ্যতার ভাগ্য পরিবর্তন করতে এসেছিলেন, তিনি এত বড় ও গুরুতর অপরাধেও চরম ধৈর্যের পরিচয় দিলেন। তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেলেন, যাতে বৈরী শক্তির মধ্যে ভদ্রতা চেতনার উন্মেষ ঘটে, তাদের চিন্তাশক্তি জেগে ওঠে, তারা যুক্তির দিকে ফিরে যায়, এবং একবারে নাহোক, দু’বারে না হোক, তৃতীয়বারে যেন শুধরে যায়। কিন্তু যারা বাঁকা পথে চালিত হয়ে গিয়েছিল, অল্প সংখ্যক ব্যতিক্রম বাদে তাদের চোখ ব্যর্থতার গহবরে পতিত না হওয়া পর্যন্ত খোলেনি।
ধ্বংসাত্মক বিশ্বাসঘাতকতার কয়েকটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আমি এখানে পেশ করছি, যা দ্বারা বুঝা যাবে, সত্য ও ন্যায়ের বিধান প্রতিষ্ঠাকারীদের কত কঠিন ও কণ্ঠকাকীর্ণ পথ ধরে চলতে হয়।
এ কথা সুবিদিত যে, আকাবার দ্বিতীয় বায়য়াতের বৈঠকে যে সব একনিষ্ঠ মু’মিন বান্দা রসূল সা.এর হাতে হাত দিয়ে অংগীকার করেছিল, তারা একথা বুঝে শুনেই করেছিল যে, রসূল সা.এর মদিনায় যাওয়া এবং সেখানে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অর্থ যুদ্ধ ছাড়া কিছু নয়। এ ঘটনা নানা কারণে কোরায়েশদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে এবং তারা প্রচন্ড আবেগে ও উত্তেজনায় বেসামাল হয়ে অস্ত্র ধারণ করবে। এ কারণে এ বিষয়টা স্পষ্ট ছিল যে, রসূল সা.এর জীবন, তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলে অস্তিত্ব এবং ইসলামী আন্দোলনের অন্যান্য কেন্দ্রের সংরক্ষণ আল্লাহর সাহায্যের অধীনে পুরোপুরি মদিনাবাসীর সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ উদ্দেশ্যেই রসুল সা. আনসারদের প্রতিনিধি ও কর্মঠ যুবকদের কাছ থেকে অংগীকার নেন এবং এই উদ্দেশ্যেই হিজরতের প্রথম বছরেই সব কয়টা ইহুদী গোত্রের সাথেও চুক্তি সম্পাদন করেন। আনসারগণ তো সামগ্রিকভাবে নিজেদের অংগীকার জীবনের শেষ মুহূর্ত পযন্ত রক্ষা করেছেন। কিন্তু আল্লাহর কিতাবের আমানতদার ও নবীদের উত্তরাধিকারীরা এবং তাদের ভক্তরা নিজেদের কৃত এইসব চুক্তিকে বারংবার লংঘন করেছে।
সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা এই যে, মক্কার কোরায়েশরা মোনাফেক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে যোগ্যতম ব্যক্তি বুঝতে পেরে তাকে একটা গোপন চিঠি পাঠাল। এই চিঠির মাধ্যমে তারা মদিনার সমস্ত দুষ্কর্মপ্রবণ, উচ্ছৃংখল ও দুর্বল ঈমানের লোকদেরকে নিজেদের প্রভাবাধীন করার জন্য একটা সর্বাত্মক বার্তা পাঠায়। চিঠিতে তারা লেখে:
“তোমরা আমাদের লোককে (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা. কে) আশ্রয় দিয়েছ। আমরা আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, হয় তোমরা তাকে হত্যা করে ফেল, নচেত মদিনা থেকে বের করে দাও। অন্যথায় আমরা সবাই মিলে তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাবো, তোমাদের হত্যা করবো এবং তোমাদের স্ত্রীদের প্রমোদ সংগিনী বানাবো। (সুনানে আবু দাউদ)
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই যদি সৎ ও ঈমানদার লোক হতো, তাহলে এই চিঠি তৎক্ষণাত রসূল সা. এর কাছে পৌঁছাতো এবং সে আন্তরিকভাবে কামনা করতো যে, কোরায়েশের হুমকির মোকাবিলায় সমগ্র মদিনাবাসীর আত্মমর্যাদাবোধকে সংগঠিত করা হোক। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা ছিল তার মজ্জাগত। সে তার ক্ষমতা হারানোর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কোরায়েশের অভিলাষ পূর্ণ করতে বদ্ধপরিকর হলো। সে জানতো, ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে মদিনাবাসীর মধ্যে বিপুল সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী রয়েছে। কিন্তু এই চিঠির রহস্য শীঘ্রই ফাঁস হয়ে গেল এবং স্বয়ং রসূল সা. ব্যাপারটা জেনে নিলেন। তিনি নিজেই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর কাছে চলে গেলেন এবং তাকে বুঝালেন, স্বয়ং তোমাদেরই ছেলে, ভাতিজা ও ভাগ্নেরা যৌবনের পূর্ণ শক্তি নিয়ে ইসলামের পতাকা বহন করে চলেছে। কোন অনাকাংখিত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে দেখে নিও, তোমাদেরই সন্তানরা তোমাদের মোকাবিলায় দাঁড়িয়ে যাবে। তোমাদেরকে তোমাদের নিজেদের সন্তানদের সাথেই যুদ্ধ করতে হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই কথাটা বুঝলো এবং তার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করলো। উল্লেখ্য যে, বদরের যুদ্ধের পর কোরায়েশরা পুনরায় এ ধরনের একটা চিঠি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর কাছে পাঠিয়েছিল।
এই কুচক্রী নেতা এক চরম নাযুক মুহূর্তে মারাত্মক বিশ্বাসঘাতক সুলভ একটা কাজ করে বসলো। ইহুদী গোত্র বনু নযীরের বারংবার ওয়াদাখেলাপী ও নাশকতামূলক কার্যকলাপের কারণে যখন তাদেরকে দশ দিনের মধ্যে মদিনা ছেড়ে চলে যাওয়ার চরমপত্র দেয়া হলো, এবং বনু নযীর এ জন্য প্রস্তুতিও নিতে লাগলো, তখন আব্দুল্লাহ বিন উবাই তাদেরকে বার্তা পাঠালো, খবরদার! তোমরা এই আদেশ মানবেনা এবং নিজ বাড়ীঘর ত্যাগ করবেনা।
আমি তোমাদেরকে দু’হাজার লোক দিয়ে সাহায্য করবো। একদিকে ইহুদী গোত্র বনু কুরায়যা তোমাদের সাহায্য করবে, অপর দিকে আরব মোশরেক গোত্র গিতফান তো তোমাদের মিত্র আছেই। এই আশ্বাসের ফল দাঁড়ালো এই যে, বনু নযীর রসূল সা. কে জানালো, “আমরা এখান থেকে যেতে পারছিনে। আপনি যা ইচ্ছা করুন।” অবশেষে ইসলামী সরকারকে বাধ্য হয়ে নিজের হুকুম বাস্তবায়িত করার জন্য সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল।
এরপর এই লোকটি ওহুদ যুদ্ধের অতীব নাযুক ও সিদ্ধান্তকরী মুহূর্তে নগ্নভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করলো। মুসলিম বাহিনী মদিনা থেকে বেরিয়ে ‘শুতা’ নামক স্থানে পৌঁছা মাত্রই সে তিনশো মোনাফেককে সাথে নিয়ে মদিনায় ফিরে গেল। এ কাজটা মুসলিম বাহিনীর পিঠে ছুরিকাঘাত সমতুল্য ছিল। সে বললো, আমাদের মতামত অনুসারে যখন কাজ করা হয়না এবং ক্ষমতা যখন অন্যদের হাতে কেন্দ্রীভূত, তখন আমরা খামাখা জীবন দেব কেন? আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইর মত ছিল মদিনার বাইরে না গিয়ে মদিনার ভেতরে বসেই লড়াই করার পক্ষে। (আসাহহুস্ সিয়ার আব্দুর রউফ দানপুরী)
বিশ্বাসঘাতকতামূলক যোগসাজশের দিক দিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল আবু আমের। মসজিদে যেরার প্রসংগে তার পরিচিতি ইতিপূর্বেই দিয়েছি। বদরের যুদ্ধে রসূল সা. এর বিজয়ের সংবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে এই কুচক্রী মক্কা সফর করে এবং আবু সুফিয়ানের সাথে সাক্ষাত করে প্রতিশোধ গ্রহণের উসকানি দেয়। এভাবে ওহুদ যুদ্ধের আগুন জ্বালাতে সেও অবদান রাখে। সে নিজেও কোরায়েশী বাহিনীর সহযোগিতার যুদ্ধে নামে। তার ধারণা ছিল, তার কথা আওস গোত্র ইসলামের সহযোগিতা পরিত্যাগ করে কোরায়েশদের পক্ষ নেবে। সে যুদ্ধের ময়দানে আওসীদেরকে ডাকলো। কিন্তু যে জবাব পেল, তাতে তার ভ্রান্তি দূর হয়ে গেল। অন্যরা দূরে থাক, স্বয়ং তার ছেলে হযরত হানযালা অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে রসূল সা.এর নির্দেশে প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ওহুদের পর যে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে গেল তাকে মদিনা আক্রমণ চালাতে প্ররোচনা দেয়ার জন্য। এদিকে মোনাফেকদেরকেও সে গোপনে আশ্বাস দিল যে, তোমরা প্রস্তুত থেক, আমি সহায়ক বাহিনী নিয়ে আসছি। এই লোকটি হুনায়েনের নিকটে রসূল সা.কে কষ্ট দেয়ার জন্য গর্ত খনন করিয়েছিল। রসূল সা. একটা গর্তে পড়ে গিয়ে বেশ ব্যথা পান (আসাহহুস সিয়ার ও সীরাতুন্নবী:শিবলী)
তৃতীয় বিশ্বাসঘাতক ব্যক্তি ছিল কা’ব বিন আশরাফ। এর সম্পর্কেও ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। এই ব্যক্তি একদিকে বেতন দিয়ে দিয়ে মদিনায় ভাড়াটে দালাল বাহিনী সৃষ্টি করেছিল, অপরদিকে মক্কাবাসীকে মদিনার ওপর হামলা চালাতে উস্কানি দিত। এ উদ্দেশ্যে সে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি, অর্থ সম্পদ ও কবি প্রতিভাবে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতো। তার প্ররোচনায় আবু সুফিয়ান ও অন্যান্যরা কাবার গেলাফ ধরে প্রতিশোধ গ্রহণের অংগীকার করে।
এই ষড়যন্ত্রপূর্ণ পরিবেশে মুসলমানগণ বিশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হলো। রসূল সা.নিজেও রাত জাগতেন এবং তাঁর সাহাবীগণকে পালাক্রমে রাত জেগে পাহারা দিতে আদেশ দিতেন। এই সময়কার একটি ঘটনা এই যে, তিনি একবার সমাবেশে বললেন, “আজ কোন সুযোগ্য লোক পাহাড়া দিক।”এ কথা শুনে হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস অস্ত্র-সজ্জিত হয়ে সারা রাত পাহাড়া দিলেন। এই সময় সাহাবীগণ সন্ধ্যা থেকে সকাল পযন্ত অস্ত্র নিয়ে ঘুমাতেন। সম্ভবত এই সময়ই তিনি বলেছিলেন:
“আল্লাহর পথে একদিন পাহারা দেয়া গোটা পৃথিবী ও তার ভেতরকার যাবতীয় সহায় সম্পদের চেয়েও উত্তম।” (মিশকাত)
তিনি আরো বলেন:“একদিন ও একরাত আল্লাহর পথে পাহারা দেয়া একমাস রোযা ও একমাস রাত জেগে নামায পড়ার চেয়েও উত্তম।” (ঐ)
এই পাহারা দানের কাজ সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, এর সওয়াব কেয়ামত পর্যন্ত বাড়তেই থাকে এবং কবরের আযাব থেকেও তা রেহাই দেয়। (রিয়াদুস সালেহীন)
মদিনার এই সব বর্ণচোরা পঞ্চম বাহিনীর লোকেরা ইসলামী আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাতের সবচেয়ে মোক্ষম সুযোগ পেত জেহাদের সময়। রসূল সা.মদিনায় যে দশ বছর কাটান, তার বেশীর ভাগ সময় যুদ্ধবিগ্রহে কাটান। কিন্তু হক ও বাতিলের সংঘর্ষ যখনই পুরোদস্তুর যুদ্ধের রূপ ধারণ করতো (স্বল্প বিরতি দিয়ে বারবার এরূপ হয়েছে), তখন ইহুদী ও মোনাফেকরা ষড়যন্ত্র শুরু করে দিত। অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি এই সব যুদ্ধবিগ্রহ ও গৃহশত্রু বিভীষণদের অপতৎপরতা মিলিত হয়ে এক কঠিন অগ্নি-পরীক্ষার সৃষ্টি করতো ইসলামী রাষ্ট্রের প্রহরীদের জন্য।
ওহুদের ঘটনা আমরা একটু আগেই বলেছি যে, ইসলামী বাহিনী রণাঙ্গনে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে ষড়যন্ত্রের হোতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই তিনশো যোদ্ধাকে নিয়ে মদিনায় চলে যায়। রসূল সা.ও সাহাবায়ে কেরামের স্থলে অন্য কোন বস্তুবাদী শক্তি যদি এরূপ পরিস্থিতির শিকার হতো, তাহলে হিম্মত হারিয়ে তৎক্ষণাৎ রণে ভঙ্গ দিত। কেননা শত্রু বাহিনীর সংখ্যা যেখানে তিন হাজার, সেখানে তাদের মোকাবিলায় গমনরত মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ছিল সর্বমোট এক হাজার। এর মধ্য থেকে আবার তিন শো ফেরত গেল। বাদবাকী সাত শোর মধ্যেও ছিল বর্ণচোরা মোনাফেক ছিল। এ পরিস্থিতিতে বনু সালমা ও বনু হারিসার মোজাহেদরা ফেরত যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু সাহাবীদের উপদেশে তারা সাহস ফিরে পায় এবং ময়দানে টিকে থাকে। আল্লাহর উপর ঈমান, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস, নৈতিক শক্তির সাফল্যের ধারণা এবং গায়েবী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা–এ সবই ছিল ইসলামী বাহিনীর আসল পুঁজি। ফলে তাদের মনে আর কোন দুর্বলতা থাকলোনা। পূর্ণ দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তারা ওহুদের ময়দান অভিমুখে রওনা হয়ে গেলেন। তারপর ওহুদের ময়দানে যখন মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হলো এবং রসূল সা.এর শাহাদাতের গুজব রটে গেল, তখন মোনাফেকরা প্রস্তাব দিল, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে হাতে পায়ে ধরে ফিরিয়ে এনে আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে নিরাপত্তা এনে দিতে অনুরোধ করা হোক। এই ময়দানে মুসলমানদের কিছু ত্রুটি সংশোধনের জন্য আল্লাহ এক ধরনের পরাজয় দিলেন, তা নিয়ে মোনাফেকরা বলতে লাগলো, উনি যদি নবী হতেন, তা হলে পরাজিত হতেন না। এতো দুনিয়ার অন্যান্য রাজা বাদশার মত অবস্থাই হলো যে, কখনো জয় কখনো পরাজয়। এই অপপ্রচারের ফলে মুসলমানদের কারো কারো মধ্যে কিছু কিছু সন্দেহ সংশয় সৃষ্টিও হলো। কেউ কেউ এভাবে চিন্তা করতে লাগলো যে, আল্লাহর নবীর নেতৃত্বে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে গিয়েও পরাজয় বরণ করতে হলো, এ কেমন কথা? এর জবাবে কোরআনে বলা হয়েছে, “এ বিপর্যয় তোমাদেরই সৃষ্টি।” অর্থাৎ তোমাদেরই ত্রুটির ফল।
এরপর প্রতিটি যুদ্ধের শুরুতে, মাঝখানে বা শেষে গোপন শত্রুরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে থাকে। যেখানে বাস্তবে কিছু করা সম্ভব হয়নি, সেখানে অপপ্রচারের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা চলেছে।
পঞ্চম বাহিনী নিজেদের কারসাজি সবচেয়ে বেশী দেখিয়েছে খন্দক যুদ্ধের সময়। বদরের যুদ্ধে কোরায়েশদের শক্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। তার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তারা বিপুল প্রস্তুতি নিয়ে হামলা চালায় এবং ওহুদের যুদ্ধ হয়। কিন্তু তারা তাদের বিজয়কে পূর্ণতা না দিয়েই ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ৫ম হিজরীতে তারা নিজেদের, মদিনার ষড়যন্ত্রকারীদের এবং বিভিন্ন গোত্র থেকে উস্কিয়ে আনা বিপুল এক বাহিনী নিয়ে মদিনাকে ঘিরে ফেলে। এটা ছিল চূড়ান্ত যুদ্ধ। এরপর কোরায়েশ ও অন্যান্য শত্রুদের শক্তি একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এরপর মুসলমানরা আত্মরক্ষার নীতি পরিত্যাগ করে ইসলামের শত্রুদেরকে নিস্তেজ করার জন্য আক্রমণাত্মক নীতি অবলম্বন করে। বস্তুত খন্দক যুদ্ধের সমাপ্তির দিনেই মক্কা বিজয়ের পথ উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল।
এই চূড়ান্ত লড়াই বাধাতে যে সব কুচক্রী মহল সর্বাধিক অবদান রেখেছিল তাদের মধ্যে বনু নযীরের ইহুদিরা অন্যতম। এদের মধ্যে যারা খয়বরে গিয়ে অবস্থান করছিল, তারা পরিস্থিতির ওপর নজর রেখেছিল এবং সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে ছিল। তারা যখন জানতে পারলো, ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। এবং কোরায়েশরা পুরো বিজয়ী না হলেও যথেষ্ট দাপট দেখিয়ে এসেছে তখনই তারা সক্রিয় হয়ে ইতিহাসের গতিধারাকে তীব্রতর করার সিদ্ধান্ত নিল। বনু নযীরের ছালাম ইবনে আবিল হাকীক, ছালাম বিন মুশকিম, হুয়াই বিন আখতাব, কিনানা বিন রবী প্রমুখ নামকরা সরদাররা বেরিয়ে পড়লো এবং বনু ওয়ায়েলের হাওযা বিন কায়েস, আবু ইমারা এবং অন্যান্যদেরকে সাথে নিল। মক্কায় গিয়ে তারা কোরায়েশদেরকে মদিনা আক্রমণ চালাতে উদ্বুদ্ধ করলো এবং সর্বাত্মক সমর্থনের আশ্বাস দিল। এরপর তারা বনু গিতফানের কাছে গিয়ে তাদেরকেও উদ্বুদ্ধ করলো। এরপর অন্যান্য গোত্রের কাছেও ঘোরাফিরা করলো। কোরায়েশরা অন্যান্য গোত্রকে সংঘবদ্ধ করলো। এভাবে দশ হাজার সৈন্য মদিনাকে অবরোধ করলো।(আসাহহুস সিয়ার, সীরাতে ইবনে হিশাম)
যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে হুয়াই বিন আখতাব কা’ব বিন আসয়াদের সাথে যোগসাজ করে রসূল সা.এর সাথে কৃত বনু কুরায়যার চুক্তি ভাঙ্গালো। (সীরাতে ইবনে হিশাম) এ খবর শুনে মুসলমানরা ভীষণ উদ্বিগ্ন হলো। তারা যে কোন মুহূর্তে বনু কুরায়যার হামলার আশংকা করতে লাগলো। শিশু ও মহিলাদের রক্ষার জন্য রসূল সা.তিনশো সৈনিক নিয়োগ করলেন। ওদিকে মোনাফেকরা অনিশ্চয়তা ও ভয়ভীতি সৃষ্টিকারী গুজব ছড়াতে লাগলো এবং তাদের অনেকে পরিবার পরিজনকে রক্ষার নামে ঘাঁটি থেকে ভেগে যেতে লাগলো। তারা এভাবে অপপ্রচার শুরু করে দিল যে, “একদিকে তো মুহাম্মাদ সা. আমাদেরকে রোম ও পারস্যের সাম্রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখান, অপরদিকে আমাদের অবস্থা হলো, আমরা নিরাপদে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারতেও যেতে পারিনা।” (সীরাতে ইবনে হিশাম)
একবার এমনও হলো যে, লড়াই এর সময় যখন মহিলাদের থাকার জায়গার হেফাজতের সন্তোষজনক ব্যবস্থা হয়নি, তখন তার আশেপাশে একজন ইহুদীকে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেল। হযরত সফিয়া বিনতে আব্দুল মোত্তালেব একখানা কাঠ নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে ফেললেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
ইসলামী আন্দোলনের সৈনিকদের জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে উদ্বেগজনক অবস্থা। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার বিশেষ সাহায্য তারা পেয়েছিলেন। প্রথমত খন্দকের নতুন প্রতিরক্ষা কৌশল, দ্বিতীয়ত কোরায়েশ ও বনু কুরায়যার যোগসাজশ ছিন্ন করার ব্যাপারে নঈম বিন মাসউদের বিস্ময়কর দক্ষতা, তৃতীয়ত রসূল, তাঁর সুপ্রশিক্ষিত নেতৃবৃন্দ ও গোটা মুসলিম জামায়াতের বলিষ্ঠ মোজাহেদ সুলভ ভূমিকা এবং চতুর্থত আল্লাহর প্রেরিত আকস্মিক ঘুর্ণিঝড় শত্রু বাহিনীকে ময়দান থেকে পিটিয়ে বিদায় করলো।
এ ধরনের আর একটা ঘটনা ছিল তবুক অভিযান। মদিনার কুচক্রী পঞ্চম বাহিনী এ সময় তাদের সুনিপুন কলাকৌশলের কিছু উচ্চতর নমুনা প্রদর্শন করে। রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস রসূল সা.এর পক্ষ থেকে ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত পত্র পাওয়ার পর থেকেই ক্ষিপ্ত ছিল। মাঝে ষড়যন্ত্রের হোতারাও সম্রাটের দরবারে পৌঁছে তাকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করে। এই হিরাক্লিয়াস সম্পর্কে হঠাৎ খবর পাওয়া গেল, মদিনা আক্রমণ করার জন্য সে চল্লিশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছে।
মদিনায় তখন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। সময়টা ছিল দুর্ভিক্ষের। তবে গাছে গাছে ফল পেকেছে। প্রচন্ড গরম আবহাওয়া। বিপুল সংখ্যক সৈন্যকে অনেক দূরে পাঠাতে হবে। অথচ সরকারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল। প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম, উট-ঘোড়া ও রসদপত্রের নিদারুণ অভাব। এ কারণে তবুক অভিযাত্রী বাহিনীকে “জাইশুল উছরাহ” ‘সংকটকালীন বাহিনী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই অবস্থা দেখে এবং এ লড়াইতে গনীমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম অনুমান করে মোনাফেকরা অসহযোগিতার নীতি অবলম্বন করলো। নানা রকমের মিথ্যা ওযর দেখিয়ে তারা ঘরে বসে রইল। এদিক থেকে একে “গুয্ওয়ায়ে ফাদেহা” অর্থাৎ মোনাফেকদের “মুখোস উন্মোচনকারী অভিযান” নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। মোনাফেকরা কী কী ধরনের হাস্যকর ওযর আপত্তি পেশ করতো তার একটা চমকপ্রদ উদাহরণ পাওয়া যায় জাদ্দ ইবনে কায়েসের কাছ থেকে। সে এসে রসূল সা.কে বললো, “লোকেরা জানে আমি নারীদের প্রতি একটু বেশী আবেগ প্রবণ। আমার আশংকা যে, সুন্দরী রোমক নারীদের দেখে আমি প্রলুব্ধ হয়ে যাবো। তাই আমাকে বাড়ীতে থাকার অনুমতি দিন।” এই সব মোনাফেক শুধু নিজেরাই জেহাদে যাত্রা থেকে পিছিয়ে থাকতোনা, বরং অন্যদেরকেও বলতো, “আরে, ঘরে বসে আল্লাহ আল্লাহ করো। পাগল হয়ে গেছ নাকি যে, এমন টাকফাটা গরমে জেহাদ করতে যেতে চাও? সুয়াইলিম নামক ইহুদীর বাড়ীতে তাদের সলাপরামর্শের আড্ডা বসতো। সেখানে যারা আসতো, তাদের জেহাদে যেতে নিষেদ করা হতো। শেষ পযন্ত এই আড্ডাখানাটা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হয়।
ওদিকে সদাতৎপর আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই সানিয়াতুল বেদা নামক স্থানে ইহুদী ও মোনাফেকদের সমন্বয়ে গঠিত আলাদা একটা বাহিনী অসদুদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে গড়ে তুললো। এ বাহিনীর সংখ্যাও ছিল প্রচুর। তবে এ বাহিনী রসূল সা. এর সাথে যাত্রা করতে পারেনি।
বাহিনী যাত্রা শুরু করার পর তারা আরো একটা বিভ্রাট সৃষ্টি করলো। রসূল সা.স্বীয় পরিবার পরিজনের তত্ত্বাবধানের জন্য ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে হযরত আলীকে মদিনায় রেখে এসেছিলেন। মোনাফেকরা তা দেখে অপপ্রচার শুরু করে দিল, আজকাল মুহাম্মাদ সা.এর মন আলীর প্রতি প্রসন্ন নয়। সে জন্যই তাকে সাথে নেননি। হযরত আলীর আত্মমর্যাদাবোধ এতে প্রচন্ড ধাক্কা খেল, তিনি তৎক্ষণাত অস্ত্র সজ্জিত হয়ে রসূল সা.এর সাথে মিলিত হলেন এবং মোনাফেকদের উস্কানিমূলক তৎপরতার বিবরণ দিলেন রসূল সা.তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে মদিনায় ফেরত পাঠিয়ে দিলেন এবং বললেন, মদিনায় ঐ লোকদের দ্বারা অঘটন ঘটার আশংকা আছে।
তবুক পৌঁছার পর মোনাফেক সহযাত্রীরা (কিছু না কিছু মোনাফেক অঘটন ঘটানোর জন্য সব সময়ই সামরিক অভিযানে শরীক হতো) মুসলিম মোজাহেদদেরকে এই বলে ভীতি প্রদর্শন করতে লাগলো, রোমক বাহিনীর দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদেরকে তোমরা আরবদের মত ভেবেছ। কাল যখন তোমরা সবাই গোলাম হিসেবে বন্দী হয়ে যাবে, তখন বুঝবে ধারণাটা কত ভুল ছিল।’ এই বিভ্রান্তিকর প্রচারণার জন্য যখন তাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হলো, তখন তারা বললো, “আমরা তো কেবল রসিকতা করছিলাম, ওটা কোন গুরুত্ববহ ব্যাপার ছিলনা।” (আসাহাহুস সিয়ার, পৃঃ ৩৬১-৩৮৫ দেখুন)
রোমক বাহিনী তো রণাঙ্গণেই আসেনি। তবে এই অভিযান দ্বারা একদিকে রোমকরাও বুঝতে পারলো, মদিনা পুরোপুরি সচেতন এবং আমাদের মোকাবিলায় আসতে সক্ষম, অপরদিকে এ অভিযানের ফলে আয়লা, জাবরিয়া ও দুমাতুল জানদাল নামক এলাকাগুলো মুসলিম শক্তির প্রভাবাধীন আসায় বহিরাক্রমণের আশংকা কমে গেল।
এই অভিযানকালে দুই জায়গায় রসূল সা.মুসলিম বাহিনীকে পথিপার্শের জলাশয় থেকে পানি খেতে নিষেধ করেন। কিন্তু কিছু কিছু মোনাফেক নিষেধাজ্ঞা লংঘন করে নিজেদের মনের ব্যাধিকে প্রকাশ করে দেয়।
এই অভিযানকালেই গিরিপথে রসূল সা. কে হত্যার ব্যর্থ ষড়যন্ত্র করা হয়। এই ঘটনার বিবরণ আমি ইতিপূর্বে দিয়ে এসেছি।
মোনাফেকদের এত বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও রসূল সা.এই অভিযানে সফলকাম হয়ে ফিরে আসেন এবং মোনাফেকদের নির্দ্বিধায় ক্ষমা করতে থাকেন। রসূল সা.এর তিনজন নিষ্ঠাবান সাহাবী কা’ব বিন মালেক, হিলাল বিন উমাইয়া ও মুরারা বিন রবী অলসতার কারণে মদিনায় থেকে যান। তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেন। তবুও তাদেরকে আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষায় পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত সমাজচ্যুত হয়ে থাকতে হয়। এই পরীক্ষায় তারা সর্বোতভাবে সফল হন এবং তাদের তওবা কবুল হয়। কিন্তু মোনাফেকরা বলছিল, “এরা কী বেকুফ! আমাদের মত যে কোন একটা বাহানা পেশ করলেই ল্যাঠা চুকে যেত। খামাখা নিজেদেরকে বিপদে ফেলে রেখেছে। এখন বুঝুক মজা।
এ থেকে বুঝা যায় ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী আন্দোলনকে কত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মানব জাতিকে যিনি কল্যাণের পথ দেখিয়েছিলেন, তাঁকে হযরত মূসার কপট অনুসারীরা ও তাদের তৈরী করা মোনাফেকদের কাছ থেকে কী কী ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা ও চক্রান্ত ভোগ করতে হয়েছে।
কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের বিস্তৃতি তাতে থেকে থাকেনি, বরং বেড়েই চলে। একনিষ্ঠ ঈমান ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়েছে, আরা গাদ্দারী ও ভন্ডামী সমূলে উৎপাটিত হয়েছে।
কোরায়েশদের ঘৃণ্য প্রতিশোধমূলক তৎপরতা
মদিনায় প্রাথমিক যুগে, যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু হওয়ার আগে, আওস গোত্রের বিশিষ্ট নেতা সা’দ বিন মুয়ায ওমরা করার জন্য মক্কায় গিয়েছিলেন। যেহেতু উমাইয়া বিন খালফের সাথে সা’দের অনেক দিনের পুরানো সম্পর্ক ছিল, তাই তিনি তার বাড়ীতেই অবস্থান করলেন। তিনি উমাইয়াকে সাথে নিয়ে কা’বা শরীফের তাওয়াফ করতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে আবু জাহল সেখানে উপস্থিত হলো। সে উমাইয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার সাথে ঐ ব্যক্তি কে?” উমাইয়া বললো, “সা’দ”। আবু জাহল ক্রুদ্ধ স্বরে হযরত সাদকে বললো, “তোমরা ঐ ধর্মচ্যুতদের আশ্রয় দিয়েছ তাই না? তোমার মত লোকেরা কা’বা শরীফের চত্তরে পা রাখবে, এটা আমার অসহ্য। তুমি যদি উমাইয়ার আশ্রয়ে না থাকতে, তাহলে আজ জ্যান্ত ফিরে যেতে পারতেনা।” (সীরাতুন্নবী; শিবলী নুমানী, প্রথম খন্ড, সহীহ মুসলিম, বুখারীর বরাতসহ)
লক্ষ্য করুন যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কোরায়েশ নেতার স্পর্ধা এতদুর বাড়িয়ে দিয়েছে যে, সে আল্লাহর বান্দাদের জন্য তার ঘরে প্রবেশকে নিষিদ্ধ করে দিতে উদ্যত। তাদেরকে হজ্জের ন্যায় এবাদাত থেকে বঞ্চিত করতে চায়! যেন কা’বা শরীফও তাদের সম্পত্তি। আসলে মসজিদুল হারামের মুতাওয়াল্লীগিরিকে তারা নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ারে পরিণত করে রেখেছিল। রসূল সা.ও তাঁর যে সব সাথীকে হিজরত করতে বাধ্য করা হয়েছিল, তাদের জন্য তো হারাম শরীফের দ্বার রুদ্ধ ছিলই। কিন্তু সা’দ ইবনে মায়াযকে এরূপ খোলাখুলিভাবে হারাম শরীফে প্রবেশের অযোগ্য আখ্যা দিয়ে আবু জাহল তার অন্যায় অবস্থানকে অত্যন্ত কুৎসিতভাবে নগ্ন করে দিয়েছিল। ও দিকে সা’দ বিন মায়া’যও তো কোন আত্মমর্যাদাহীন দরবেশ ছিলেন না। তাঁর ভেতরে ইসলামী সম্ভ্রমবোধ পুরোমাত্রায় সক্রিয় ছিল এবং তিনি মদিনার রাজনৈতিক শৌযবীযের অর্থ জানতেন। তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষায় এমন জবাব দিলেন যে, আবু জাহল ও কোরায়েশ সম্প্রদায়ের চোখের সামনে এক ভয়াবহ বিপদ ভেসে উঠলো। সা’দ বললেন, “তোমরা যদি আমাদের হজ্জ বন্ধ করে দাও, তবে আমরা তোমাদের মদিনার (বাণিজ্যিক) পথ বন্ধ করে দেব।” অন্য কথায় এটা ছিল কোরায়েশদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি। এ হুমকি সমগ্র মক্কাবাসীকে সচকিত করে তুললো। পরবর্তীকালে হযরত সা’দের এই উক্তি অনুসারেই মদিনার নীতি নির্ধারিত হয়। ফলে কোরায়েশ একেবারেই অনন্যোপায় হয়ে চূড়ান্ত শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
আবু জাহল উত্তেজনার বশে এমন কথা বলে ফেলেছিল বটে তবে এই অনাকাংখিত হুমকি তাদের প্রভাব প্রতিপত্তিকে প্রচন্ড ধাক্কা দেয়। পবিত্র কোরআন হারাম শরীফের ওপর তাদের এই একচেটিয়া কর্তৃত্বের কঠোর সমালোচনা করে। কেননা এটাকে পুঁজি করেই তারা আল্লাহর বান্দাদের আল্লাহর ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করছিল। আল্লাহ বলেনঃ
“সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় যালিম আর কে, যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে আল্লাহর স্মরণ বন্ধ করে এবং ওগুলোকে জনশূন্য করার চেষ্টা করে?” (আল-বাকারা, ১১৪)
“লোকেরা জিজ্ঞেস করে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা কেমন? তুমি বল, নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে ঠেকানো, আল্লাহর সাথে কুফরি করা, আল্লাহর বান্দাদেরকে মসজিদুল হারামে যেতে না দেয়া এবং হারাম শরীফের অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার করা তার চাইতে বড় অন্যায়।” (বাকারা, ২১৭)
“এখন কোন কারণে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেননা যখন তারা মসজিদুল হারামের পথ রোধ করছে? অথচ তারা এই মসজিদের বৈধ মুতাওয়াল্লী নয়।”
কোরআনের এ সব উক্তি ক্রমশ সারা আরবে ছড়িয়ে পড়লো এবং কোরায়েশদের ধর্মীয় ভাবমূর্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগলো।
হোদাইবিয়ার সন্ধির (৬ষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসে) সময় কোরায়েশরা মসজিদুল হারামে যেতে মানুষকে বাধা দেয়ার’ কাজটা আরো বড় আকারে করলো। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটা ইংগিত পেয়ে রসূল সা. কেবল ওমরাহ আদায় করার উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন। কোন যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়নি। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সাহাবীগণ ওমরার জন্য বের হন। কুরবানীর পশুও সাথে নেয়া হয়। সামরিক প্রয়োজনে অস্ত্রসজ্জিত না হয়ে নিছক মামুলী আত্মরক্ষামূলক হাতিয়ার নিয়ে কাফেলা রওনা হয়। যুল হুলায়ফা নামক স্থানে সুপরিচিত বিধি অনুযায়ী কুরবানীর উটগুলোকে চিহ্নিত করা হয় এবং ওগুলোর গলায় মালা পরানো হয়। এসব দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই যে কেউ অনুমান করতে পারে যে, এই উট হারাম শরীফে কুরবানী করার জন্য নেয়া হচ্ছে এবং এগুলো সামরিক বাহক নয়। পথিমধ্যেই বার্তাবাহক বিশর বিন সুফিয়ান আল কা’বীর মাধ্যমে জানা গেল, কোরায়েশরা সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং কোনক্রমেই হারাম শরীফে যেতে দেবেনা। হুদাইবিয়া পৌঁছে রসূল সা.বার্তা পাঠালেন যে, আমরা যুদ্ধ করতে নয়, বরং ওমরা করতে এসেছি। বনু খুযায়া গোত্রের বুদাইল বিন ওয়ারাকা মধ্যস্থতার চেষ্টা করলো। তারপর উরওয়া বিন মাসউদ আলাপ আলোচনা কিছুটা এগিয়ে নিলেন। এরপর বনু কিনানার এক ব্যক্তি হুলাইস মধ্যস্থতা করার জন্য ছুটে এল। সে যখন স্বচোক্ষে মালা পরা উটের এক বিরাট বহর মাঠে চরতে দেখলো তখন অভিভূত হয়ে গেল। সে গিয়ে কোরায়েশদেরকে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে তারা “তুমি মিয়া গ্রাম্য মানুষ এ সবের কী বুঝবে?” বলে তাকে নিদারুণভাবে নিরুৎসাহিত করলো। হুলাইস খুবই মর্মাহত হলো। সে বললোঃ
“হে কোরায়েশ, এটা আমাদের ও তোমাদের চুক্তি নয়। এর ভিত্তিতে আমরা মৈত্রী সম্পর্কও স্থাপন করিনি। আল্লাহর ঘরের মর্যাদা বাড়াতে এসেছে, এমন লোকদেরকে কোন্ যুক্তিতে আল্লাহর ঘরে আসতে বাধা দেয়া হবে? আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ সা.যা করতে চায়, তা তাকে করার সুযোগ দাও। নচেত আমরা আমাদের সকল লোকজনকে ফেরত নিয়ে যাবো।”
রসূল সা.এর সরল ও স্বচ্ছ নীতি এই লোকটার ভালো লেগেছিল। তার ভালোমন্দ বাদবিচারের ক্ষমতা কাজ করতে আরম্ভ করেছিল এবং তার বিবেক কোরায়েশদের অন্যায় কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। অবশেষে তার মন রক্ষার খাতিরে তাকে এই বলে শান্ত করা হলো যে, আমাদের উদ্দেশ্য কিছু সংগত শর্ত মানানো। তুমি একটু চুপ থাক।” এরপর এমন শর্তাবলী আরোপ করা হলো যে, আর কিছু না হোক রসূল সা.ও তার সাথীগণের ৬ষ্ঠ হিজরীর ঐ ওমরা কার্যত এক বছরের জন্য পিছিয়ে দেয়া হলো। (তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৪র্থ খন্ড, সীরাতে ইবনে হিশাম, ৩য় খন্ড, আসাহহুস সিয়ার)
এ পর্যায়ে আল কোরআন কা’বার রক্ষকদের হীন মানসিকতার মুখোস কিভাবে খুলে দিয়েছে দেখুনঃ
“এরাই সেই সব লোক, যারা (সত্য দ্বীনকে) অস্বীকার করার নীতি অবলম্বন করেছে, তোমাদের মসজিদুল হারামে যাওয়া বন্ধ করেছে এবং কুরবানীর পশুকে বদ্ধভূমি পর্যন্ত যেতে দেয়নি।” (আলফাতাহ, ২৫)
হযরত ইবরাহীম আ. এর আমল থেকে যে সব ধর্মীয় রীতিপ্রথা সর্বসম্মতভাবে চলে আসছিল, তাতে কোরায়েশদের হস্তক্ষেপ ও রদবদল তাদের ভাবমূর্তিকে নিদারুণভাবে ক্ষুণ্ন করে। তারা নিছক বোকামি ও হঠকারিতার মাধ্যমে সমগ্র আরবে নিজেদের সম্পর্কে একটা বিরূপ জনমত গড়ে তোলে। জনসাধারণ বুঝতে পারে যে, কোরায়েশদের মধ্যে সততা, ধর্মপরায়ণতা ও ভদ্রতার নামগন্ধও নেই এবং তারা যা-ই করছে নিছক জিদের বশে করে চলেছে।
কোরায়েশদের প্রতিশোধ স্পৃহা যে পাশবিকতার সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গিয়েছিল, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, তারা নিজেদের মনের আক্রোশ মেটানোর জন্য রসূল সা.এর দুই মেয়েকে তাদের স্বামীদের কাছ থেকে তালাকে আনিয়ে ছাড়ে। এটি ছিল মানবতার মুক্তিদূতের ঠিক কলিজার ওপর এক নিদারুণ বিষাক্ত ছোবল।
হযরত রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমের বিয়ে হয়েছিল আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবা ও উতাইবার সাথে। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নিকটতম আত্মীয়ের পরিবারের সাথে তাদের এ সম্পর্ক নবুয়তের আগে থেকেই চলে আসছিল। চরম বদরাগী আবু লাহাবের মধ্যে এতটুকু সৌজন্যবোধের অস্তিত্বই ছিলনা যে, সে আদর্শিক বিরোধকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উর্দ্ধে রাখবে এবং আত্মীয়তার অধিকারকে বিরোধের সাথে জড়িয়ে ফেলবে। তার হিংসা বিদ্বেষ সব সময়ই অতিমাত্রায় তীব্র ছিল এবং তার কার্যকলাপ ছিল অত্যন্ত হীন ও ইতরসূলভ। তার ঘৃণ্য কার্যকলাপের কারণে যখন সূরা লাহাব নাযিল হলো এবং তাতে “আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক” বলে অভিশাপ দেয়া হলো, তখন সে ক্ষেপে গেল। দুই হাত ধ্বংস হওয়ার অর্থ হলো, সে সব রকমের বিরোধী ও ক্ষতিকর কাজ করেও ইসলামী আন্দোলনের কিছু মাত্রও ক্ষতি সাধন করতে পারবেনা এবং সততার শক্তি তার দুই দুই হাত ধ্বংস হওয়ার অর্থ হলো, সে সব রকমের বিরোধী ও ক্ষতিকর কাজ করেও ইসলামী আন্দোলনের কিছু মাত্রও ক্ষতি সাধন করতে পারবেনা এবং সততার শক্তি তার দুই হাতকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে। কথাটার এই মর্ম উপলব্ধি করেই সে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গিয়েছিল। সে নিজের দুই ছেলেকে এই বলে চাপ দিতে লাগলো যে, এখন আর মুহাম্মাদের সা. মেয়েদেরকে ঘরে রাখা তোমাদের জন্য কিছুতেই বৈধ হতে পারেনা। ওদেরকে তালাক দিতেই হবে। হযরত রুকাইয়া নিজ ঘরে চরম অস্থিরতার মধ্যে সময় কাটাচ্ছিলেন। উতবা বাপের ইংগিতে তাকে তালাক দিল। পরে হযরত উসমানের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। আবু লাহাবকে উত্তেজিত করতে ও তার ছেলে দুটিকে দিয়ে এই ঘৃণ্য কাজ করাতে কোরায়েশদের অন্যান্য সরদারও যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। তারা পরস্পরে আলোচনা করতো যে, আজকাল মুহাম্মাদকে সা. উত্যক্ত করার তৎপরতা অনেকটা কমে গেছে। তাই নতুন একটা কিছু উদ্ভাবন করা দরকার। তারা স্থির করলো তার মেয়েদেরকে তাদের স্বামীদের কাছ থেকে তালাক দেয়াতে হবে। এতে অন্তত মুহাম্মাদের সা. জন্য কিছুটা সমস্যা সৃষ্টি করা যাবে। তারা আবু লাহাবের ছেলে উতবাকে বললো, কোরায়েশের যে মেয়েকেই চাও, যোগার করে দেয়া হবে। শর্ত শুধু এই যে, মুহাম্মাদের সা. মেয়েকে বিদায় করে দেবে। উতবা কাল বিলম্ব না করে তালাক দিয়ে দিল। উতায়বা আরো খানিকটা তেজ দেখালো। যে হযরত উম্মে কুলসুমকে তালাক দিয়ে গুন্ডা পান্ডার মত রসূল সা. এর কাছে উপস্থিত হলো। তারপর চরম ধৃষ্টতার সাথে বললো, “আমি তোর ধর্মকেও অস্বীকার করেছি, তোর মেয়েকেও তালাক দিয়েছি, তুইও আমাকে ভালোবাসিসনে, তোকেও আমি পসন্দ করিনে।” অতঃপর চরম বেআদবীর সাথে হাত বাড়িয়ে রসূল সা. এর জামার একাংশ টেনে ছিড়ে ফেললো। যুবক জামাতা হিংসুটে বাপের কথা মত একদিকে নিরীহ ও ভদ্র মেয়েকে তালাক তো দিলই, তদুপরি এমন গুন্ডার মত আচরণ করলো যে, দুঃখের চোটে স্বতস্ফূর্তভাবে রসূল সা. এর মুখ দিয়ে এই বদদোয়া বেরিয়ে গেল যে, “হে আল্লাহ, তোমার হিংস্র জন্তুগুলোর মধ্য থেকে কোন একটা জন্তুকে তার ওপর লেলিয়ে দাও।” আবু তালেব যখন ঘটনা শুনলেন, বললেন, “এখন আর আমার ভাতিজার এই বদদোয়া থেকে তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।” এরপর উতাইবা এক বাণিজ্যিক কাফেলার সাথে যখন সিরিয়ায় রাত্র যাপন করছিল, তখন রাতের অন্ধকারে কোথা থেকে এক বাঘ এসে সমগ্র কাফেলার মধ্য থেকে বাছাই করে ওর মাথাটাই চিবিয়ে খেয়ে গেল। (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৯৭)
হযরত রুকাইয়ার মৃত্যুর পর রসূল সা. তাঁর এই দ্বিতীয় মেয়ে উম্মে কুলসুমকেও হযরত উসমানের সাথে বিয়ে দেন। এ জন্য তাকে “যুন্নুরাইন” নামে আখ্যায়িত করা হয়।
কোরায়েশ কুচক্রীরা আবু লাহাবের ছেলে উতবার ওপর যেভাবে চাপ প্রয়োগ করেছিল, রসূল সা. এর তৃতীয় কন্যা যয়নবের স্বামী আবুল আসের ওপরও চাপ প্রয়োগ করেছিল এবং তাকেও এই বলে প্রলুব্ধ করেছিল যে, তুমি যদি মুহাম্মাদের সা. মেয়েকে তালাক দাও, তবে যত সুন্দরী মেয়ে চাও, তোমাকে দেয়া হবে। আবুল আসের মধ্যে মহত্বের উজ্জ্বল নিদর্শন বিদ্যমান ছিল। সে বললো, “ছি ছি! এটা কখনো হতে পারেনা যে, আমি নিজের স্ত্রীকে ত্যাগ করব। যয়নবের পরিবর্তে আর কোন নারী আমার ঘরে আসুক – এটা আমার পছন্দ নয়। পরবর্তী সময় রসূল সা. আবুল আসের চরিত্রের এই দৃঢ়তার প্রশংসা করতেন। তার এই ভদ্র আচরণের প্রতিদান স্বরূপ তিনি দুটো ঘটনায় তার ওপর বিরাট অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন। প্রথমত যখন আবুল আস বদরের যুদ্ধবন্দীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে এল এ সময় মুক্তিপণ হিসাবে হযরত যয়নব কর্তৃক প্রেরিত হারটি রসূল সা. ফেরত দেন এবং তাকে বিনা মুক্তিপণে মুক্তি দেন। দ্বিতীয়বার যখন তার বাণিজ্যিক পণ্য যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হিসাবে মুসলমানদের মধ্যে বন্টিত হয়ে গিয়েছিল, তখন রসূল সা. এর ইংগিতে যাবতীয় জিনিস অক্ষতভাবে তাকে ফেরত দেয়া হয়। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৯৬)
বদর যুদ্ধের পর যখন রসূল সা. আবুল আ’সতে বিশেষ অনুগ্রহ স্বরূপ বিনা মুক্তিপণে মুক্তি দেন, তখন কথা প্রসংগে তার কাছ থেকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন যে, সে হযরত যয়নবকে মদিনা আসবার সুযোগ দেবে। এই প্রতিশ্রুতি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখা হয়। হযরত যয়নবের মদিনায় রওনা হবার নির্ধারিত সময় দু’জন সাহাবী হযরত যায়েদ বিন হারিসাকে এবং অপর একজন আনসারীকে পাঠানো হয়। এই দু’জনকে রসূল সা. নির্দেশ দিয়ে দেন যে, তোমরা ইয়াজিজ (মক্কা থেকে ৮ মাইল দূরবর্তী একটি জায়গার নাম) নামক স্থানে দাঁড়াবে। যয়নব ওখানে এলে তাকে নিয়ে চলে আসবে। ওদিকে আবুল আস যয়নবকে প্রস্তুত করলো এবং আসবাবপত্র গুছিয়ে দিল। তার দেবর কিনানা বিন রবী খুব ভোরে উটের পিঠে চড়িয়ে দিয়ে যখন যাত্রা করলো, তখন কোরায়েশরা ব্যাপারটা জেনে ফেললো। ঐ নরপশুরা ভাবলো, মুহাম্মাদের সা. মেয়ে এভাবে নিরাপদে আমাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে যাবে, এটাতো কলংকজনক ব্যাপার হবে। কিছু লোক পেছনে গেল এবং যী তুয়াতে গিয়ে ধরলো। জনৈক হাব্বার বিন আসওয়াদ যয়নবের হাওদা লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করলো। হযরত যয়নব তখন গর্ভবতী ছিলেন। তীর বিদ্ধ হয়ে তিনি মারাত্মক অবস্থার শিকার হলেন এবং গর্ভপাত ঘটে গেল। পরক্ষণে তার দেবর যখন তীর ধনুক নিয়ে হাঁক ছাড়লো, অমনি মক্কার সেই কাপুরুষ গুন্ডাটা দ্রুত পালিয়ে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবু সুফিয়ানও এসে হাজির। সে দূর থেকে আক্রমণকারীদেরকে ডেকে বললো, “আমার কথা শোন।” সে কিনানা বিন রবীকে বললো, “তুমি এমন কাজ করতে গেলে কেন যে, প্রকাশ্যে এই মহিলাকে নিয়ে সফরে বেরুলে? অথচ কেমন শত্রুতার পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতো জানই। মুহাম্মাদ সা. এর কারণে আমাদের মাথার ওপর এই অবাঞ্ছিত পরিবেশ বিরাজ করছে। এভাবে দুপুরে এ ধরনের পদক্ষেপে মক্কার মানুষ অপমান বোধ করে। আমার জীবনের কসম, মুহাম্মাদের মেয়ের যাত্রা থামানোর কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। এখন ওকে ফেরত নিয়ে চল। কোন এক সময় গোপনে নিয়ে যেও।”
এ থেকে বুঝা যায়, মক্কাবাসী রসূল সা. কে কষ্ট দেয়া ও উত্যক্ত করার জন্য কী জঘন্যতম ইতরামির আশ্রয় নিচ্ছিল। তাদের অন্তরে আত্মীয়তার কোন গুরুত্ব ছিলনা। একজন নারীর ওপর অত্যাচার চালাতে তাদের একটুও লজ্জা বোধ হতোনা। যুলুমকে যুলুম মনে করার মত বোধশক্তিও তাদের ছিলনা। তাদের দৃষ্টিতে মানবতার কোন মূল্য ও অধিকার অবশিষ্ট ছিলনা। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খন্ড, আসাহহুস্ সিয়ার)
এবার অন্য একটা ঘটনা শুনুন। এ ঘটনা ইসলামের শত্রুদের চরম রক্ত পিপাসু মানসিকতা ব্যক্ত করে। রসূল সা. মদিনার সন্নিহিত এলাকাগুলোতে ইসলামে শিক্ষা বিস্তার কল্পে শিক্ষক দল পাঠানোর যে প্রক্রিয়া চালু করেন, তার আওতায় ওহুদ যুদ্ধের অব্যবহিত পর (সফর মাসে) আজল ও কারাহ (বনু হুযায়েল) গোত্রের অনুরোধে ছয়জনের একটি দল পাঠান। এই অনুরোধের পেছনে ছিল ভয়ংকর ষড়যন্ত্র। রসূল সা. যে ছ’জনকে পাঠালেন তাদের চারজনকে রজী নামক স্থানে পৌঁছুলে শহীদ করে দেয়া হলো। বাকী দু’জন হযরত খুবাইব ও যায়েদ বিন দাসনাকে বন্দী করে মক্কায় পাঠানো হলো। (রজী’র ঘটনার অপরাপর বিবরণ এবং অন্যান্য শিক্ষক দলের বিবরণও পরে আসছে) কোরায়েশদের কাছে বনু হুযায়েলের দু’জন কয়েদী ছিল। এই দু’জনকে দিয়ে বিনিময়ে সেই দু’জনকে মুক্ত করা হলো। হুযায়ের বিন ইহাব তামিমী হযরত খুবাইবকে উতবা বিন হারেস বিন আমেরের জন্য নিল, যাতে সে হারেসের প্রতিশোধ নিতে পারে। এই হারেসকে বদর যুদ্ধে হযরত খুবাইব হত্যা করেছিলেন। আর যায়েদ বিন দাসনাকে সাফওয়ান বিন উমাইয়া খরিদ করলো তার পিতা উমাইয়া বিন খালফের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।
বীরত্ব ও পৌরুষের সদম্ভ আস্ফালনকারীরা যুদ্ধের ময়দানে মুষ্টিমেয় সংখ্যক সহায় সম্বলহীন মুসলমানদের হাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করার পর এখন এই দুই অসহায় বন্দীকে হত্যা করে নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করতে চাইছিল। ইসলামী সমাজের এই দুই মূল্যবান ব্যক্তিত্বকে যদিও শহীদ করে দেয়া হলো, কিন্তু এর মাধ্যমে উভয় পক্ষের চরিত্রের যে তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন হলো, তার প্রভাব ইতিহাসের শীরায় শীরায় ছড়িয়ে পড়লো।
সাফওয়ান যায়েদ বিন দাসনাকে স্বীয় গোলাম ফুসতাসের হাতে সোপর্দ করে আদেশ দিল যে, তাকে হারাম শরীফের বাইরে তানয়ীমে নিয়ে গিয়ে হত্যা কর। এই মজাদার নাটক দেখে আনন্দ উপভোগ করার জন্য ঘটনাস্থলে কোরায়েশদের এক জনসমাবেশ করা হয়েছিল। এদের মধ্যে স্বয়ং আবু সুফিয়ানও ছিল। আবু সুফিয়ান কাছে গিয়ে যায়েদকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকে যদি এখন ছেড়ে দেয়া হয় এবং তুমি গিয়ে নিজের ছেলে মেয়েদের সাথে হাসিখুশী মনে বসবাস করতে থাক, আর তোমার বদলায় যদি আমরা মুহাম্মাদকে সা. খতম করে দেই, তাহলে এটা তোমার কাছে কেমন লাগবে? যায়েদের সামনে তখন মৃত্যু মুচকি হাসছে তবু ঈমানের অভাবনীয় উচ্চস্তর থেকে তিনি জবাব দিলেনঃ
“আল্লাহর কসম, আমরা এতটুকুও পছন্দ করিনা যে, মুহাম্মাদ সা. যেখানে আছেন, ওখানেও তার গায়ে একটা কাঁটা বিধুঁক, আর তার বিনিময়ে আমরা মুক্ত হয়ে পরিবার পরিজনের কাছে গিয়ে থাকার সুযোগ লাভ করি।”
এ জবাব শুনেতো আবু সুফিয়ান হতবাক। সে বললো, মুহাম্মাদ সা. কে তার সহচররা যেভাবে ভালোবাসে, অমন ভালোবাসা আমি আর কোথাও দেখিনি। তারপর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার এই মূর্ত প্রতীককে তরবারীর গ্রাসে পরিণত করা হলো। যায়েদ শহীদ হলেও তার এই চরিত্র কতজনের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে এবং কতজনের অন্তরাত্মা কোরায়েশদের এই অত্যাচার ও পাশবিক হিংস্রতার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করেছে কে তার ইয়ত্তা রাখে। (সীরাতে ইবনে হিশাম, আসাহহুস্ সিয়ার)
হযরত খুবাইব এর পরও কিছুদিন বন্দী থাকেন। বন্দী অবস্থায় তিনি নিজের ঈমান ও আখলাকের যে উদাহরণ পেশ করেন, তার একটা ফল দাঁড়ালো এই যে, হুজাইর বিন ইহাবের দাসী মাবিয়া পরবর্তীকালে ইসলামী সমাজের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর কাছে থেকেই খুবাইবের বন্দী দশার বিবরণ জানা গেছে। মাবিয়া বর্ণনা করেছে যে, খুবাইবের হত্যার সময় যখন ঘনিয়ে আসলো তখন একদিন তিনি খেউরি হওয়ার জন্য ক্ষুর চাইলেন। ক্ষুর দেয়া হলো। কিন্তু এরপর একটা দৃশ্য দেখে আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। দেখলাম, খুবাইবের হাতে ক্ষূর আর তার কোলে আমার শিশু সন্তান বসে আছে। যে বন্দীকে এমন অন্যায়ভাবে হত্যা করার প্রস্তুতি চলছে তার নাগালে যদি তার শত্রু পক্ষের কোন শিশু এসে যায় এবং তার হাতে উপযুক্ত অস্ত্রও থাকে, তাহলে কি আশংকা দেখা দিতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খুবাইব আমার আশংকা বুঝতে পেরে আশ্বাস দিলেন যে, আমি কোন অবস্থাতেই এই নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করবোনা। তারপর ঐ শিশুটাকে কোল থেকে সরিয়ে দিলেন। এমন মহৎ চরিত্র কি মক্কার তমসাচ্ছন্ন পরিবেশে মশাল হয়ে জ্বলে ওঠেনি?
এরপর তাকে শূলে চড়াতে নিয়ে যাওয়া হলো তানয়ীমে। সেখানে গিয়ে তিনি অনুমতি নিয়ে জীবনের শেষ নফল নামায পরম একাগ্রতার সাথে পড়লেন। এভাবে তিনি শাহাদাতের বধ্যভূমিতে গমনকারীদের জন্য একটা চমৎকার ও মহিমান্বিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, যা আজও পর্যন্ত অনুসৃত হয়ে আসছে।
এরপর দ্রুত নামায শেষ করে বললেন, তোমরা ভেবনা যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে নামায দীর্ঘায়িত করছি। তারপর এভাবে দোয়া করলেনঃ
“হে আল্লাহ! আমরা তোমার রসূলের বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। তুমিও রসূল সা. কে জানিয়ে দিও যে আমাদের ওপর কি রকম যুলুম করা হচ্ছে। হে আল্লাহ! এই শত্রুদের সংখ্যা কমিয়ে দাও, তাদেরকে কলহ কোন্দলের কবলে ফেলে ধ্বংস কর এবং এমন হিংস্র নরপশুদের কাউকে জীবিত ছেড়ে দিওনা।”
খুবাইবকে শূলে চড়ানো হলো। সবার শেষে আবু মুগীরা বর্শা মেরে তাঁর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাঁর মুখ দিয়ে কয়েকটা কবিতা উচ্চারিত হয়। তন্মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ চরণটি এইঃ
(আরবী********)
“আমাকে যখন মুসলিম হবার কারণে হত্যা করা হচ্ছে তখন মৃত্যুকালে আমি যে যাতনাই ভোগ করি, তাতে আমার কিছুই যায় আসে যায়না।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৩য় খন্ড)
এই দু’জনকে হত্যা করে কোরায়েশরা হয়তো ভেবেছিল, তারা ইসলামের শক্তিকে অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারা কল্পনাও করতে পারেনি এই মজলুমদের শাহাদাতের রক্তের প্রতিটি ফোঁটা ঈমানের ফসলকে কত বেশী পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সব জঘন্য প্রতিশোধমূলক কর্মকান্ডের পাশাপাশি কোরায়েশদের সেই রাজনৈতিক বিশ্বাস ঘাতকতাও আমরা তুলে ধরছি, যা তারা হুদাইবিয়ার সন্ধি ভংগের মাধ্যমে করেছিল। এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্থির করা হয়েছিল যে, আরব গোত্রগুলোর মধ্যে যেটি কোরায়েশদের মিত্র হতে চাইবে, হতে পারবে এবং যেটি মুসলমানদের মিত্র হতে চাইবে হতে পারবে। গোত্রগুলো এ ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীন থাকবে। কারো ওপর কেউ কোন বল প্রয়োগ করতে পারবেনা। এই বিধান অনুসারে তাৎক্ষণিকভাবে বনুবকর কোরায়েশদের সাথে এবং বনু খুযায়া মুসলমানদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করলো।
প্রাগৈসলামিক যুগ থেকে ঐ দুটো গোত্রের মধ্যে একটা হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে প্রতিশোধের পর প্রতিশোধের এক অশুভ চক্র চলে আসছিল। ইতিমধ্যে উভয় গোত্রের মধ্যে একাধিক হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। সর্বশেষ প্রতিশোধ গ্রহণের পালা ছিল বনু বকরের এবং তারা এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এই সময় ইসলামী আন্দোলন ইতিহাসের প্রচন্ডতম ঘাত-প্রতিঘাতের সৃষ্টি করে সকল গোত্রের মনোযোগ নিজের দিকে আকৃষ্ট করে। ফলে ঐ সব গোত্র নিজেদের পারস্পরিক দ্বন্দ কলহ আপাতত স্থগিত রেখে এই নয়া দাওয়াতের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ায়। ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা ও বিদ্বেষ তাদের মধ্যে যে বাহ্যিক ঐক্যের জন্ম দিয়েছিল, হুদাইবিয়া সন্ধির পর সেই ঐক্যের তেজ স্তিমিত হতে থাকে। পুরানো বিরোধগুলো তাদের মনে পড়তে থাকে। বনু বকরের একটা শাখা ছিল বনু ওয়েল। এই বনু ওয়েলের এক ব্যক্তি আসওয়াদ বিন রজনের কয়েকটি ছেলে বনু খুযায়া গোত্রের হাতে নিহত হয়েছিল। সেই হত্যাকান্ডের বদলা নেয়ার জন্য বনুওয়েলের সরদার নওফেল বিন মুয়াবিয়া সমগ্র গোত্রকে সংঘবদ্ধ করে। হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে যে যুদ্ধ বিরতি চলছিল, সেই সুযোগে তারা বনু খুযায়ার ওপর হামলা চালিয়ে বসলো। এই হামলায় সর্বপ্রথম নিহত হলো আল-ওয়াতীর নামক জলাশয়ের কাছে অবস্থানরত এক নিরপরাধ খুযায়ী। খুযায়া গোত্রের অন্যান্যরা এই অপ্রত্যাশিত চুক্তি লংঘন দেখে দিশেহারা হয়ে ছুটে পালাতে লাগলো। আক্রমণকারীরা তাদেরকেও ধাওয়া করে হত্যা করল।
কোরায়েশরা হুদাইবিয়ার সন্ধির দায়দায়িত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বনু বকরকে অস্ত্র সরবরাহ করলো, আবার রাতের আঁধারে লুকিয়ে লুকিয়ে খুযায়ীদের সাথে সন্ধিও চালাতে লাগলো। বনু খুযায়া হারাম শরীফে (কা’বার চত্তরে) আশ্রয় নিয়ে বনু বকরের সরদারকে ডেকে বললো, “ওহে নওফেল! দেখ, এখন আমরা হারাম শরীফে প্রবেশ করেছি। আল্লাহর দোহাই এখন আক্রমণ থামাও।” কিন্তু তারা জয়ের নেশায় অন্ধ হয়ে পড়েছিল। নওফেল বললো, “আজ কোন আল্লাহ নেই। ওহে বনু বকর! পুরোপুরি প্রতিশোধ নিয়ে নাও। হারাম শরীফের সম্মানের খাতিরে তোমরা কি নিজেদের অবমাননার প্রতিশোধ নিতে ভুলে যাবে?” অবশেষে বনু বকর হারাম শরীফে ঢুকেও রক্তপাত করলো। কিছু সংখ্যক খুযায়ী অতি কষ্টে প্রাণ নিয়ে বুদাইল বিন ওয়াবরা ও তার গোলাম রাফের বাড়ীতে গিয়ে লুকালো।
কোরায়েশরা গোত্রীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে উদ্ভুত প্রচন্ড উত্তেজনার বশে এ কাজটা করেছিল। কিন্তু এটা তাদের এত বড় নির্বুদ্ধিতা ছিল যে, এর কুফল তারা হাতে হাতেই পেয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনাটা মক্কা বিজয়ের কারণ ঘটায়। কোরায়েশরা এ কথা মোটেই ভেবে দেখেনি যে, ইসলামী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান শক্তির মোকাবিলায় তাদের শক্তি নৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়েই চরম অধোপতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাই তাদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পা বাড়ানো উচিত ছিল। এ ঘটনার কারণে আরবের গোত্র শাসিত সমাজে কোরায়েশদের প্রতিশ্রুতি লংঘনের বিষয়টা ব্যাপক নিন্দা না কুড়িয়ে পারেনি। তাদের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। তাছাড়া কোরায়েশদের আস্কারা পেয়ে বনু বকর যে চরম নির্যাতনমূলক কর্মকান্ড চালায় এবং বনু খুযায়া যে লোমহর্ষক অত্যাচার ভোগ করে, তা আরবের সব ক’টা গোত্রকে সচকিত করে দেয় যে, কোরায়েশ নেতৃত্ব শান্তি ও সুবিচারের নিশ্চয়তা দিতে অক্ষম। তাছাড়া এ ঘটনায় শত শত বছরের ঐতিহ্যের মুখে কালিমা লেপন করে আল্লাহর নামের মাহাত্ম্য ও হারাম শরীফের পবিত্রতাকে যেরূপ ন্যাক্কারজনকভাবে পদদলিত করা হয়, তাতে জনমনে ব্যাপক অস্থিরতা ও অস্বস্তি জন্মে। এই দাংগা হাঙ্গামায় কোরায়েশ জুলুমবাজ পক্ষকে আস্কারা দিয়ে নিজের মান মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে। কোরায়েশ হয়তো ভেবেছিল, ইসলামী রাষ্ট্রের মিত্র বনু খুয়াযাকে ধ্বংস করতে পারলে মুহাম্মাদ সা. এর বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিশোধ স্পৃহা কিছুটা হলেও চরিতার্থ করা যাবে। কিন্তু তারা এ কথা ভেবে দেখেনি যে, এত করে তারা জাহেলী সমাজ ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক গোত্রগুলোর ঐক্য নিজ হাতেই বিনষ্ট করতে চলেছে। এমনকি কোন কোন প্রতিবেশী গোত্রকে মদিনার আশ্রয়ে পাঠাতে চলেছে।
আসলে প্রত্যেক মান্ধাতা আমলের সমাজ ব্যবস্থা এবং প্রত্যেক পুরোনো নেতৃত্ব, যাদের না আছে কোন উচ্চতর আদর্শ ও লক্ষ্য, না আছে নৈতিক মূল্যবোধ ও গঠনমূলক সংস্কৃতি, এবং যাদের একমাত্র সম্বল হলো প্রত্যেক গঠনমূলক ও সংস্কারকামী শক্তিকে দমন করা ও ধ্বংস করার নেতিবাচক লক্ষ্য, তাদের ভাগ্যলিপি সাধারণত এটাই হয়ে থাকে যে, তাদের বুদ্ধিই তাদেরকে নির্বুদ্ধিতার পথে নিয়ে যায়, তাদের শক্তিই তাদেরকে দুর্বলতার গভীর খাদে নিক্ষেপ করে, তাদের আভিজাত্যবোধই তাদেরকে চরম লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকারে পরিণত করে এবং তাদের অগ্রগতিই তাদের পশ্চাদপদতাকে ও তাদের উন্নতিই অধোপতনকে অনিবার্য করে তোলে।
বনু খুযায়া গোত্রের আমর বিন সালেম মদিনায় রওনা হয়ে গেল এবং রসূল সা. এর কাছে পৌঁছে বনু বকর ও কোরায়েশদের যুলুম নির্যাতনের মর্মান্তিক কাহিনী শোনালো। রসূল সা. মসজিদে বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে আমর বিন সালেম চিরাচরিত আরবীয় রীতি অনুযায়ী নিজের করুণ কাহিনীকে একটা মর্মবিদারী কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করলোঃ
(আরবী********)
“হে আল্লাহ! আমি মুহাম্মাদকে সেই চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেব, যা আমাদের ও তাঁর প্রাচীন পরিবারগুলোর মধ্যে সম্পাদিত হয়েছিল। হে নবী, আমাদেরকে সাহায্য করুন এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে সাহায্যের জন্য সমবেত হবার আহবান জানান। ফেনা রাশি তোলা সমুদ্রের ঢেউ এর ন্যায় বিশাল বাহিনী নিয়ে ময়দানে নামুন। কেননা কোরায়েশ আপনার চুক্তি ভংগ করেছে। তারা রাতের অন্ধকারে ওয়াতীরের কাছে আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা যখন ঘুমন্ত ছিলাম, তখন তারা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা যখন রুকু সেজদার অবস্থায় ছিলাম, তখন আমাদের ওপর আঘাত হেনেছে।”
জবাব দেয়া হলোঃ “হে আমর বিন সালেম, তোমাকে সাহায্য করা হবে।”
এবার কোরায়েশরা বুঝতে পারলো, তারা কী ধ্বংসাত্মক কাজ করে ফেলেছে। আবু সুফিয়ান চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে মদিনায় ছুটে গেল। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ ছিল এ রকম যে, আবু সুফিয়ান নিজের মেয়ের ঘরে গিয়ে যখন বিছানার ওপর বসতে উদ্যত হলো, তখন মেয়ে বিছানা গুটিয়ে ফেললো এবং বললো, এটা আল্লাহর রসূলের বিছানা। আপনি একজন অপবিত্র মোশরেক হয়ে ওটার ওপর বসতে পারবেন না।” আবু সুফিয়ান ব্যর্থ হয়ে ফিরলো এবং কয়েকদিন পরই দেখলো, এক বিশাল বাহিনী মক্কায় উপস্থিত। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৪র্থ খন্ড, আসাহহুস সিয়ার, সীরাতুন্নবী শিবলী নোমানী, প্রথম খন্ড)
এই ঘটনাবলী থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জাহেলী নেতৃত্বের নেতিবাচক শক্তিকে তার নিজের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি ষড়যন্ত্র, প্রতিটি প্রতিশোধমূলক তৎপরতা এবং প্রতিটি প্রতিশোধমূলক কর্মকান্ড ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর করেছে। অপর দিকে ইতিবাচক ও গঠনমূলক শক্তি ইসলামী আন্দোলন ক্রমেই শক্তি অর্জন ও সম্মুখে অগ্রসর হয়েছে।
পক্ষান্তরে রসূল সা. এর আচরণ দেখুন, উভয়পক্ষে যুদ্ধ চলছে। এ সময় ইয়ামামার শাসনকর্তা ইসলাম গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে মক্কা অভিমুখে খাদ্যশস্য সরবরাহ বন্ধ করে দেন। ঠিক এই সময় মক্কায় চলছিল দুর্ভিক্ষ। মানবতার ত্রাণকর্তা মুহাম্মাদ সা. দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের কথা ভেবে নিজেই অনুরোধ করে ইয়ামামা থেকে খাদ্য শস্য সরবরাহ পুনঃ চালু করালেন এবং নিজের কাছ থেকে মক্কার দরিদ্র লোকদের জন্য পাঁচশো স্বর্ণমুদ্রা পাঠালেন। এই মহানুভবতা মক্কার জনগণকে বিপুলভাবে অভিভূত করে। এক বর্ণনায় জানা যায়, মক্কাবাসী স্বয়ং রসূল সা. কে লিখেছে যে, “আপনি তো আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করার নির্দেশ দেন, কিন্তু আপনি আমাদের সাথে এই সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছেন।” কেউ কেউ এও লিখেছে যে, “তুমি পিতাদেরকে তরবারী দিয়ে এবং সন্তানদেরকে ক্ষুধা দিয়ে হত্যা করছ।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৪র্থ খন্ড, আসাহহুস সিয়ার, রসূলে আকরাম কি সিয়াসী জিন্দেগী, ডঃ হামীদুল্লাহ)