জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস
জামায়াত অনলাইন লাইব্রেরি

মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ সা.

অন্তর্গতঃ uncategorized, সীরাত ও ইতিহাস
Share on FacebookShare on Twitter

সূচীপত্র

  1. আগমনের উদ্দেশ্য আহ্বান এবং ঐতিহাসিক অবস্থান
    1. আগমনের উদ্দেশ্য আহ্বান এবং ঐতিহাসিক অবস্থান
    2. মানব জাতির ত্রাণকর্তা
    3. আবির্ভাবের স্থান কাল মানবীয় উপাদান
    4. বিপ্লবী কালেমা
    5. সমাজ সংস্কারে রসূল সা. এর লক্ষ্য
    6. একটি দীন একটি আন্দোলন
    7. জীবনের অবিভাজ্য পুর্নাঙ্গতা
    8. বিপ্লবের প্রাণশক্তি
    9. নতুন মানুষ
    10. বিশ্বনবীর অসাধারণ আত্মত্যাগ
    11. আমাদের অবস্থান কোথায়?
    12. সীরাত অধ্যয়নের দৃষ্টিভংগি
    13. পাশ্চাত্য জগতের উদ্দেশ্যে
    14. এই গ্রন্থটি প্রসংগে দুটি কথা
  2. এক নজরে ব্যক্তিত্ব
    1. এক ঝলক
    2. একটা সামগ্রিক ছবি
    3. পোশাক
    4. বেশভূষা ও সাজ সজ্জা
    5. চলাফেরা
    6. কথা বার্তা
    7. বক্তৃতা
    8. সাধারণ সামাজিক যোগাযোগ
    9. ব্যক্তিগত জীবন
    10. পানাহার
    11. ওঠাবসা ও শয়ন
    12. মানবীয় প্রয়োজন
    13. প্রবাস
    14. আবেগ ও অনুভূতি
    15. রসিকতা
    16. বিনোদন
    17. কয়েকটি চমৎকার অভিরুচি
    18. স্বভাব চরিত্র
  3. মক্কীযুগে মানবতার বন্ধু সা. : তীব্র বিরোধীতার মুখোমুখী
    1. এই সেই যুবক
    2. কোরায়েশদের বিরোধিতার কারণ
    3. ঘোর অন্ধকারে কয়েকটা আগুনের ফুলকি
    4. দাওয়াতের প্রথম যুগঃ গোপন প্রচার
    5. প্রকাশ্য দাওয়াত
    6. উস্কানী ও উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি
    7. অপপ্রচার
    8. কূটতর্ক
    9. যুক্তি
    10. সন্ত্রাস ও গুন্ডামী
    11. ইসলামী আন্দোলনকে সহায়হীন করার অপচেষ্টা
    12. নেতিবাচক ফ্রন্ট
    13. বিরূপ প্রতিক্রিয়া
    14. সাহিত্য ও গান বাজনার ফ্রন্ট
    15. আপোষের চেষ্টা
    16. সহিংসতার চরম রূপ
    17. আবিসিনিয়ায় হিজরত
    18. হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহন
    19. আর এক ধাপ অগ্রগতি
    20. হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণ
    21. বয়কট ও আটকাবস্থা
    22. দূঃখের বছর
    23. তায়েফে ইসলামের দাওয়াত
    24. শুভ দিনে পূর্বাভাস
    25. বিদায় হে মক্কা!
  4. মাদানী অধ্যায়ে মানবতার বন্ধু সা. : ইতিহাসের পট পরিবর্তন
    1. মদিনার ভিন্নতর পরিবেশ
    2. ইসলামী আন্দোলন মদিনায়
    3. প্রথম আকাবার বায়য়াত
    4. দুই নেতার ইসলাম গ্রহণ
    5. আকাবার দ্বিতীয় বায়য়াত
    6. মদিনায় আন্দোলনের নতুন জোয়ার
    7. আন্দোলনের নতুন কেন্দ্র
    8. মদিনাঃ প্রতীক্ষার মূহুর্ত
    9. উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ
    10. আর একটা সামষ্টিক ভাষণ নিম্নরূপ
    11. ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন
    12. ভ্রাতৃত্ব ব্যবস্থা
    13. আবার সেই দ্বন্দ্ব সংঘাত
    14. ইহুদীদের ঐতিহাসিক অবস্থান ও ভূমিকা
    15. অসহিষ্ণু আচরণ
    16. কুতর্ক ও বাজে প্রশ্নের বাণ
    17. কেবলা পরিবর্তন
    18. অসভ্যপনা ও ইতরামি
    19. হাস্যকর দাবী
    20. ইহুদীদের শাইলকী কর্মকান্ড
    21. ইহুদীদের গড়া পঞ্চম বাহিনী
    22. অপপ্রচারমূলক তৎপরতা
    23. পদলোভের অভিযোগ
    24. সর্বসম্মত ধর্মীয়প্রতীক সমূহের অবমাননার অভিযোগ
    25. ধর্মের আড়ালে স্বার্থোদ্ধারের অপবাদ
    26. আরো একটা নোংরা অপপ্রচার
    27. বিভ্রান্তি সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ
    28. ইসলামী সংগঠনের অভ্যন্তরে নৈতিক ব্যবস্থাজনিত জটিলতা
    29. হযরত আয়েশার নিজস্ব প্রতিবেদন
    30. ওহির সাফাই
    31. আইন সক্রিয় হয়ে উঠলো
    32. শাপে বর
    33. উস্কানীমূলক তৎপরতা
    34. বিচার ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
    35. রসূলের সা. পরিবারে কলহ বাধানোর অপচেষ্টা
    36. হত্যার ষড়যন্ত্র
    37. খয়বর বিজয়
    38. সর্বনাশা বিশ্বাসঘাতকতা
    39. কোরায়েশদের ঘৃণ্য প্রতিশোধমূলক তৎপরতা
  5. মানবতার বন্ধুর সামরিক তৎপরতাঃ নীতি-কৌশল ঘটনাবলী-শিক্ষা
    1. যুদ্ধ ও জেহাদের ইসলামী দৃষ্টিভংগি
    2. কোরআনের সমর দর্শন
    3. ইসলামী যুদ্ধ-বিগ্রহের ধরণ
    4. মদিনার সামরিক কর্মকাণ্ডের ধরণ
    5. রসূল সা. এর সমর কৌশল
    6. একটা ব্যাপক ভুল বুঝাবুঝি
    7. কোরায়েশের আগ্রাসী মানসিকতা
    8. মদিনার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
    9. রসূল সা. এর প্রতিরক্ষা কৌশল
    10. টহল দানের ব্যবস্থা ও তার উদ্দেশ্য
    11. দুটো বাস্তব কারণ
    12. কোরায়েশদের তিনটে প্রয়োজন
    13. বাণিজ্য কাফেলা ছিল যুদ্ধের অগ্রবর্তী বাহিনী
    14. বদরের যুদ্ধের ফলাফল
    15. দুটো শক্তির পার্থক্য
    16. বদর যুদ্ধের পর
    17. দ্বিতীয় বৃহত্তম যুদ্ধ ওহুদ
    18. ওহুদ যুদ্ধের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক
    19. ওহদের পর
    20. তৃতীয় বড় যুদ্ধ – খন্দক
    21. খন্দক যুদ্ধের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
    22. খন্দক যুদ্ধ থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত
    23. চতুর্থ বৃহৎ অভিযান-মক্কা বিজয়
    24. মক্কা বিজয়ের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা
    25. মক্কা বিজয়ে পূর্ণতা প্রাপ্তি
    26. মক্কা বিজয়ের পর
    27. দুটো আর্ন্তজাতিক যুদ্ধ
    28. মূল্যায়ন
  6. আলো ছড়িয়ে পড়লো সবখানে
    1. ইসলামী আন্দোলন অগ্রযাত্রার প্রাণশক্তি
    2. যুক্তি প্রমাণের শক্তি
    3. হিতাকাংখী সুলভ আবেদনের শক্তি
    4. মক্কার মোশরেকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ
    5. আহলে কিতাবের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণ
    6. খৃস্টানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ
    7. মোনাফেকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ
    8. সমালোচনার শক্তি
    9. মুসলমানদের নৈতিক শক্তি
    10. চুক্তি ও সমঝোতার শক্তি
    11. হোদাইবিয়ার সন্ধি
    12. ওমরাতুল কাযা
    13. জনমতের ওপর জেহাদের প্রভাব
    14. সরকার স্বয়ং বিপ্লব শিক্ষা দিত
    15. জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
    16. রাষ্ট্রনায়কের সুদূর প্রসারী সম্পর্ক
    17. জনতার স্বতস্ফূর্ত অগ্রযাত্রা
    18. আন্তর্জাতিক দাওয়াতের সূচনা
    19. সর্বশেষ বিক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া
    20. ইসলামী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সম্মেলন
    21. ইসলামী আন্দোলনের আন্তর্জাতিক মেনিফেষ্টা
    22. রসূল সা. এর তীরোধানের পর
    23. কাজ এখনো অসম্পূর্ণ
  7. পরিশিষ্ট-১
  8. পরিশিষ্ট-২
  9. পরিশিষ্ট-৩

পাশ্চাত্য জগতের উদ্দেশ্যে

বিশ্বনবীর জীবনকাল মানবেতিহাসের দুটো প্রধান যুগের মাঝখানে অবস্থিত। যেদিন তিনি নবী হিসেবে অধিষ্ঠিত হন, সেদিন থেকে পেছনের দিকে তাকালে আমরা সাক্ষাত পাই গোত্রবাদ, সামস্তবাদ, রাজতন্ত্র, পূর্বপুরুষ পূজা ও পৌত্তলিক সভ্যতার। আর সন্মুখের দিকে তাকালে দেখতে পাই আন্তর্জাতিক, গণতাস্ত্রিক ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার-উদ্ভাবন ভিত্তিক সভ্যতার যুগ। এই বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির উদ্বোধনটা সম্পন্ন হয়েছিল স্বয়ং রসূল (সাঃ) এর হাতেই। সেই সাথে তাঁর হাতে বিশ্বমানবকে এমন মূলনীতি দেয়া হল, যা কেয়ামত পর্যন্ত কার্যোপযোগী। এই মূলনীতির সাথে সাথে এমন মানুষ তৈরী করে দেখিয়ে দেয়া হলো, যে ভবিষ্যত দায়িত্ব গ্রহনের যোগ্য হতে পারে। তাঁর মাধ্যমে সেই অনাগত যুগের চাহিদার আলোকে আত্মা ও দেহ, নৈতিকতা ও বস্তুতান্ত্রিকতা, ভাবাবেগ ও যুক্তি-বুদ্ধি, বিশ্বাস ও কাজ, ব্যক্তি ও দলের আকাংখা এবং বিরাজমান পরিস্থিতি ও চাহিদার মাঝে অকল্পনীয় ও অলৌকিক ধরনের ভারসাম্য স্থাপিত হলো। তাঁর হাতে দুনিয়া সম্পর্কে নির্মোহ অথচ দুনিয়ার শাসনকার্য পরিচালনাকারী একটি মানবগোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছিল। এই দল এক দিকে যেমন আল্লাহর আনুগত্যে জুড়িহীন, অপরদিকে তেমন বস্তুজগতের ওপর কার্য পরিচালনায়ও অগ্রগামী। তাঁরা একদিকে সত্যর সামনে পরম বিনয়ের সাথে মাথা নোয়ায়, অপরদিকে বাতিলের শক্তি খর্ব করার জন্য জানমালের সর্বাত্মক কুরবানী দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়। একদিকে তারা নিজেদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টির কাছে সোপর্দ করে দিত, অপর দিকে প্রাকৃতিক শক্তিগুলো কে বশীভূত করে কাজে লাগাতে ছিল সুদক্ষ। ইতিহাসের রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করা মাত্রই এই দল জ্ঞান বিজ্ঞানের আলো জ্বালালো, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের দ্বারোদঘাটন করল এবং প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের জন্য দ্রুত গতিতে তারা নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালো। তাদের সকল তৎপরতা, উন্নতি জ্ঞান বিজ্ঞানের বিস্তার, আবিষ্কার উদ্ভাবন এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির সকল কর্মকান্ডের আসল কৃতিত্ব মুহাম্মদ(সাঃ) এর ই প্রাপ্য।

পরিতাপের বিষয়, এই বুদ্ধিবৃত্তিক ও গনতান্ত্রিক সভ্যতার নিয়ন্তা পাশ্চাত্যের জাতিসমূহ মুহাম্মদ (সাঃ), তাঁর বাণী ও তাঁর আনীত জীবন ব্যবস্থাকে বুঝতে পারলনা। যে মহান ব্যক্তির কৃতিত্বপূর্ণ অবদান পাশ্চাত্যের নব উত্থানের পিছনে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে, যে সত্তা গনতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মূল উদ্গাতা এবং যিনি ধর্মীয় সংষ্কার ও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন, তাঁকে ইউরোপের বুদ্ধিদীপ্ত মানুষরা দেখতেও পেল না, বুঝতেও পারল না। এর অনেক গুলো কারণ ছিল। এ কারণ গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা এখানে বাঞ্ছনীয় মনে করছিঃ

১। মুহাম্মদ(সাঃ) যখন নিজের বাণী নিয়ে আবির্ভূত হলেন, তখন তাঁকে ইহুদী ও খৃস্টান উভয় ধর্মের মোকাবেলা করতে হয়েছিল। এই উভয় ধর্ম তখন চরম বিকৃতি ও অবক্ষয়ের যুগ অতিবাহিত করছিল। এই উভয় জাতি ঈমান ও নৈতিকতা থেকে বঞ্চিত একটা অনুষ্ঠান সর্বস্ব কাঠামোকে ধর্মীয় পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য সহকারে বহন করে চলছিল। উভয় জাতির মধ্যে ধর্মীয় শ্রেণী ও উপদল সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল এবং তারা পুরপুরি ধর্মব্যবসায়ের দোকান খুলে বসেছিল। সুস্থ চিন্তা ও কর্মের আসল পন্য লুন্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। বাইরে কেবল চটকদার সাইনবোর্ড লটকানো ছিল। নিজেদের উপদল ও শ্রেণীগত অস্তিত্ব বহাল রাখার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হতো এবং নিজ নিজ গোষ্ঠীভুক্ত লোকজনকে ধরে রাখাই ছিল প্রত্যেক গোষ্ঠীর একমাত্র কাজ। মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ সাধন ও সমাজের সংষ্কার কারোই কাজ ছিল না। এরূপ পরিস্থিতিতে সামগ্রিকভাবে ইহুদী ও খৃস্টানদের মানসিকতা এত বিগড়ে গিয়েছিল যে, তারা মুহম্মদ(সাঃ) এর অমূল্য ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন এবং তাঁর বাণী ও তাঁর উপস্থাপিত জীবন ব্যবস্থার পর্যালোচনা করার পরিবর্তে তাঁর বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ ও হঠকারিতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে থাকে। তারা তাঁর দাওয়াতে প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকে। তাঁর সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাঁর কৃত গঠনমূলক কাজকে নষ্ট করে দিতে চায়। এমনকি তাঁকে হত্যা করার চক্রান্তও চালায়। তারপর নিজেদের এই সব অপকর্মের স্বাভাবিক কুফল দ্বারা নিজেদের ও বংশধরদের জীবনকে কলঙ্কিত করে। ইতিহাসের বহমান স্রোতকে তারা নোংরা মানসিকতা ও ঘৃণ্য ধ্যান-ধারনার দ্বারা নষ্ট করে এবং এই নষ্ট পানি প্রবাহিত হয়ে পরবর্তী বংশধর পর্যন্ত গড়ায়। তারা ঘৃণা ও বিদ্বেষের এক বিশাল উত্তরাধিকার পরবর্তী ইহুদি ও খৃস্টানদের জন্য রেখে যায়। মুহম্মদ (সাঃ) এর সমকালীন ইহুদী ও খৃস্টানদের এই দুষিত ভাবাবেগ জড়িত প্রতিক্রিয়া আজ পর্যন্ত তাদের উত্তরসূরীদের মনমগজে প্রতিফলিত হচ্ছে।

২। ইসলামের অভ্যূদয়ের পূর্বেকার মনুষ্যজগতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় পরিমন্ডলে খৃস্টানদের ছিল সুস্পষ্ট প্রাধান্য ও দোর্দন্ড প্রতাপ। এই প্রাধান্য ও আধিপত্যকে সম্প্রসারিত করার আকাংখারও কমতি ছিলনা তা বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশও ছিল অনুকূল। কিন্তু ইসলামের অভ্যূদয় খৃস্টানদের চোখে একটা প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির আবির্ভাব বলে প্রতীয়মান হয়। এই শক্তি ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়ে একটি কার্যকর বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রতিহিংসার দানা বাঁধে এবং তা ক্রমেই জোরদার হতে থাকে। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ইসলামী শক্তি যখন খৃষ্টানদের হাত থেকে কার্যত ক্ষমতা ও দখলদারী ছিনিয়ে নিতে থাকে, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ইতিহাসের মুক্তমঞ্চে সমান দুই শক্তির প্রকাশ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব নিয়ে বিচার করার পরিবর্তে খৃষ্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিহিংসা লালন করতে লাগলো, পরোক্ষভাবে এ প্রতিহিংসা ছিল স্বয়ং রসুল(সাঃ) ও ইসলামের বিরুদ্ধে। এ প্রতিহংসা ও বিদ্বেষ ক্রুসেড যুদ্ধের সময়ে চরম আকার ধারন করে। এই যুগ পর্যন্ত পৌছতে পৌছতে যেহেতু খোদ মুসলমানদের মধ্যেই অধোপতনের বীজ বোনা সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল, তাই তাদের বিশেষ বিশেষ দুর্বলতা ও ভ্রষ্টতাকে তারা ইসলাম ও রাসুলুল্লাহর ওপর আরোপ করতে লাগলো। মুসলমানদের চরিত্র ও কর্মকান্ড দ্বারা তারা রসুল (সাঃ) এর ভাবমূর্তিকে বিকৃত করার অপচেষ্টা চালাতে শুরু করলো।

৩। ইসলাম ও খৃস্টবাদের মধ্যে সংঘটিত দ্বন্দ্ব সংঘাতের এই সুদীর্ঘ যুগের প্রথমাংশে যেহেতু খৃষ্টীয় ধর্মযাজকরা খৃষ্টান জনগণকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের মুঠোর মধ্যে পুরে রেখেছিল, আর ইসলাম এই ধর্মযাজক শ্রেণীর গোষ্ঠী স্বার্থের ওপরই আঘাত হেনেছিল, তাই এই গোষ্ঠী রসুল(সাঃ) ও তাঁর বাণী সম্পর্কে একটা মিথ্যা ধারনা সৃষ্টি করে এবং তা সর্বত্র ছড়াতে থাকে। শত শত বছরের এই অপপ্রচার পাশ্চাত্যবাসীর মন মগজকে একেবারেই বিগড়ে দেয়। এই জন্যই আজ দেখা যায়, যারা আদৌ কোন ধর্ম মানেনা এবং খৃষ্টধর্মের প্রভাবমুক্ত হয়ে চিন্তাভাবনা করে, সেই বুদ্ধিজীবীরাও যখন ইসলাম ও মুহম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করে তখন তারা আজ থেকে ছয়শো বছর আগেকার সংকীর্ণমনা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাদ্রীদের নীচ মানসিকতা থেকে একটুও উর্দ্ধে উঠতে পারেনা। প্রাচ্যবিদদের লেখা বইগুলোর দুচারটে পাতা ওল্টালেই দেখতে পাবেন যে তাতে কত ভ্রান্ত ও ত্রুটিপূর্ণ তথ্য কিরুপ ন্যাক্কারজনকভাবে সংযোজন করা হয়েছে এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষটির জীবনকে কত নির্বুদ্ধিতার সাথে চিত্রিত করা হয়েছে। দু-একটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত পাওয়া গেলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু পাশ্চাত্যবাসীর সাধারন রীতির কথাই এখানে বলা হয়েছে।

৪। বিগত দুশো বছর ছিল পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের শয়তানী যুগ। এই যুগে মুসলিম জাতি গুলো ইসলাম থেকে বিচ্যুতি, আল্লাহর অবাধ্যতা ও মুহম্মদ (সাঃ)-এর আদর্শের প্রতি আনুগত্যহীনতার শাস্তি সরূপ একে একে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী লালসার শিকার হয়েছে। পাশ্চাত্যের এই সাম্রাজ্যবাদী লালসা সর্বত্র মুসলমানদের পক্ষ থেকে এক দুরন্ত প্রতিরোধের সন্মুখীন হয়। এই প্রতিরোধের পিছনে সর্বক্ষেত্রেই সক্রিয় ছিল ধর্মীয় প্রেরণা। ইসলাম তওহীদ তথা এক আল্লাহর গোলামির যে তত্ত্ব দিয়েছে তা স্বাধীনতা ও মানবীয় সাম্যের এমন শিক্ষা দেয়, যা ইসলামের অনুসারীদেরকে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো গোলামীতে সম্মত হতেই দেয়না। এই জন্যই দেখা যায়, মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যতগুলো আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার সবগুলোর পেছনেই ইসলামী চেতনা ও উদ্দীপনা সক্রিয়। সর্বত্রই কোন না কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় এবং সর্বত্রই ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠার উদ্দীপনা সক্রিয় লক্ষ্য করা যায়। এভাবেই মুসলিম দেশগুলোর সকল স্বাধীনতা আন্দোলনে ধর্মীয় প্রেরণাকে প্রবলভাবে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। আর এ কারণেই পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের মনে এই শক্তির বিরুদ্ধে নতুন করে বিদ্বেষ ও আক্রোশ সৃষ্টি হয়। কেননা এ শক্তি পদে পদে তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল এবং এক দুর্জয় উদ্দীপনা সৃষ্টি করছিল। আর এই আক্রোশের বশেই মুসলমানদের ধর্মপ্রীতিকে পাগলামি বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং “মোল্লাতন্ত্র” কে একটি ভয়ংকর আপদ হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এর পাশাপাশি মুসলমানদের ধর্মীয় প্রেরনা এত শক্তিমান প্রমাণিত হয় যে, তা পাশ্চাত্যের কৃষ্টি ও চিন্তাধারার কাছে পরাভব মানতে তো প্রস্তুত ছিলইনা, উপরন্তু তা প্রত্যেক দেশে তার মোকাবেলা করেছে। শিক্ষা, সাহিত্য ও প্রভাব প্রতিপত্তির সকল শক্তি প্রয়োগ করেও পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ বহু বছর পর মুসলিম জাতির মধ্যে থেকে কেবল মুষ্ঠিমেয় সংখ্যক লোককেই আপন তাবেদার বানাতে পেরেছে। অতঃপর তারা এ ধরনের তাবেদার গোষ্ঠীকে সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে এবং তাদেরকে মুসলমানদের ইসলামী চেতনার বিরুদ্ধে চিন্তাগত, কৃষ্টিক ও রাজনৈতিক যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। এর ফলে ইসলাম ও রসুল(সাঃ)-এর সাথে পাশ্চাত্যের সংঘাত ক্রমেই বেড়ে গেছে।

৫। পাশ্চাত্যের জাতিগুলো যখন মুসলমানদেরকে গোলামে পরিণত করার চেষ্টায় সফল হলো, তখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে তাদের চেয়ে হীনতর এই মুসলমানদের কাছ থেকে জীবন পদ্ধতি ও জীবন দর্শন সংক্রান্ত শিক্ষা গ্রহন করা তাদের পক্ষে দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। একই রকম কঠিন হয়ে দাঁড়ালো ইসলামের উপস্থাপক ও প্রচারক রসূল (সাঃ)কে সম্মান করা। শুধু তাই নয়, তারা যখন মুসলমানদেরকে তাদের মানসিক গোলামিতে লিপ্ত এবং পাশ্চাত্যের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হবার যাবতীয় লক্ষণ তাদের মধ্যে প্রতিভাত দেখলো, তখন এই অবস্থাটা আরো বড় অন্তরায় সৃষ্টি করলো। তারা যখন প্রত্যক্ষ করলো যে, তাদের হাতে গড়া আধুনিকমনা মুসলমানগণ ইসলামকে পাশ্চত্যের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পরিবর্তন ও রদবদল করে নিতে শুরু করেছে, তখন আর যায় কোথায়। ইসলাম ও রসুল (সাঃ)-এর মর্যাদা তাদের চোখে আর কমে গেল। মুসলমানদের আত্মরক্ষামূলক দৃষ্টিভংগী ইসলামের ভাবমূর্তী ও মুহম্মদ (সাঃ) এর মর্যাদার বিরাট ক্ষতি সাধন করলো।

এই পাঁচটি কারনে মুহম্মাদ(সাঃ) ও পাশ্চাত্যের মানুষের মাঝে এক বিরাট লৌহপ্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে।

তাই আজ পাশ্চাত্য জগত গোটা মানবজাতির মুক্তিদূত মুহাম্মদ (সাঃ) কে কেবল মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে গ্রহন করে থাকে এবং তাঁর জীবন চরিতকে বুঝবার ও বুঝাবার দৃষ্টিভংগীর পরিবর্তে বিরুদ্ধচারণ ও আপত্তি তলার মনোভাব নিয়ে অধ্যয়ন করে থাকে। পাশ্চাত্য এই মহান সত্তার যে চিত্র তাদের সাহিত্যে অংকন করেছে,তা এমন একজন মানুষের ভাবমূর্তি তুলে ধরে, যে মানসিক ভারসাম্য ও সুস্থতা থেকে বঞ্চিত, যার যাবতীয় তৎপরতা অবচেতন মনের বুদ্ধিবিভ্রাটের ফল এবং যে এক রক্তপিপাসু তরবারী হাতে নিয়ে যে দিকে অগ্রসর হয় পাইকারী গণহত্যা করতে করতে এগিয়ে যায়। গোটা বিশ্ব যাকে আপাদমস্তক করুণা বলে জানে, তাঁকে তারা একজন দুনিয়া পূজারী ও উচ্চভিলাষী আগ্রাসী হানাদারের মর্যাদা দিয়েছে এবং তাঁর আন্তরিকতাপূর্ণ অবদানকে ধোকাবাজি ছলচাতুরী নামে আখ্যায়িত করেছে। তারা এও প্রমান করার চেষ্টা করেছে যে, ইসলামী আন্দোলনে যা কিছু ভাল, তা ইহুদি ও খৃস্টানদের কাছ থেকে ধার করা জিনিস। নচেত মুহম্মদ(সাঃ)-এর মধ্যে তেমন কোন নৈতিক যোগ্যতা ছিলনা। এও প্রকাশ করা হয়েছে যে, আধ্যাত্মিকতা ও ধার্মিকতা যাবতীয় কর্মকান্ড ছিল নিছক লোক দেখানো এবং কেবল নাটকীয় কলাকৌশল দ্বারা জনগণকে বশীভূত করে স্বার্থ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা দুনিয়ার যে কোন মানুষকে দুনিয়া পূজারী ও ধড়িবাজ বলুক, কিন্তু প্রশ্ন হলো, রসুলের সমগ্র জীবনীতে যে নিষ্পাপ ও নিষ্কলুক মহৎ চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়, তথাকথিত ঐ ধড়িবাজ ও দুনিয়া পূজারী ব্যক্তিদের সাথে তার সমন্বয় কিভাবে সম্ভব?

এছাড়া তাঁর আরো যে ঘোরতর অবিচার করা হয়, তা হলো, রসুল (সাঃ)-এর দাওয়াতের মূল বাণীকে তার শেকড় থেকে নিয়ে শাখা-প্রশাখা ও পত্রপল্লব পর্যন্ত সর্বত্র সর্বব্যাপী দৃষ্টি দিয়ে অধ্যয়ন করা হয়না। বরং এর মৌল নীতিকে না বুঝে এবং এর চিন্তাধারার মূল দর্শনের নিগুঢ় তাৎপর্য উপলব্ধি না করে তার্কিক পাদ্রীদের নিয়মানুসারে কয়েকটা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তর্ক জুড়ে দেয়া হয়। যেমন বলা হয় যে, হযরত মুহম্মাদ (সাঃ) বহু বিবাহ বৈধ করেছেন, ধর্মের জন্য অস্ত্র ধারণ করেছেন, যুদ্ধবন্দীদেরকে দাসদাসী বানিয়েছেন, ইত্যাদি। অধ্যয়ন ও পর্যালোচনার এই একপেশে পদ্ধতিটা সব সময় বিদ্বেষপূর্ণ ও বিরুদ্ধভাবাপন্ন মানসিকতার বাহন হয়ে থাকে। এই মানসিকতা নিয়ে কোন জীবন ব্যবস্থাকে ও কোন দ্বীনকে বুঝা সম্ভব হয়না। বরং এর দ্বারা সব কিছু বুঝার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আসল বিবেচ্য বিষয় এবং জানা ও বুঝার আসল জিনিস হলো, মূল দর্শন বা মতাদর্শ। মূল দর্শন ও মতাদর্শ কতখানি সত্য ও সঠিক, তা দ্বারা জীবনের কতটা উপকার সাধিত হয় এবং জীবনের ক্ষয়ক্ষতি কতটা রোধ ও পূরণ করা যায়, সেটাই আসল প্রণিধানযোগ্য বিষয়। এরপর এই মূলতত্ত্ব ও মতাদর্শ থেকে যে নীতিমালা তৈরী হয়, যে নীতিমালার ভিত্তিতে জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়, সেগুলোকে বিবেচনা ও পর্যালোচনা প্রয়োজন। অতঃপর এই সব নীতিমালা থেকে নির্গত খুঁটিনাটি উপবিধি বা উপধারাগুলোকে দেখতে হয় যে, ওগুলো মূল আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যশীল কিনা। এক ব্যক্তি আপনার কাছে একটা জীবন দর্শন নিয়ে এলো। আপনি সেই জীবন দর্শনটা বিবেচনা না করে এমন কতগুলো উপবিধি নিয়ে তর্ক জুড়ে দিলেন, যার ব্যাপারে আপনার সমাজে একটা বিশেষ বদ্ধমূল ধারণা বিরাজমান এবং সেই ধারনার বাইরে এসে আপনি কোন চিন্তাভাবনা করতেই পারেন না। এর ফল দাঁড়ায় এইযে, আপনি নিজেও বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হন, এবং হাজার হাজার মানুষকেও বিভ্রান্তি ও সংকীর্ণতার মধ্যে নিক্ষেপ করেন। এক ব্যক্তি আপন সত্তার ভেতর মনুষ্যত্বের একটা নতুন পূর্ণাংগ মডেল বানিয়ে আপনার সামনে হাজির করলো। আপনি এই মডেলকে সামগ্রিকভাবে বুঝার আগে তার দুই একটা ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলেন এবং তার বৈধতা ও ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। তা না করে যদি পুরো মডেলটাকে সামগ্রিকভাবে বুঝে নিতেন, তাহলে ঐ অংশগুলো আপনা থেকেই আপনার বুঝে আসতো। বিভিন্ন মতবাদ ও জীবন ব্যবস্থাকে বুঝার জন্য এবং ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের পর্যালোচনার জন্য পাশ্চাত্য সাধারনভাবে যে সর্বোচ্চ বিজ্ঞান সম্মত পন্থা অবলম্বন করে থাকে, ইসলাম ও মুহাম্মদ সা. এর বেলায় সেই বিজ্ঞানসম্মত পন্থাটাকে একেবারেই শিকেয় তুলে রাখে। একটা বাগান সম্পর্কে কোন মত অবলম্বন বা সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য পুরো বাগানটাকে পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। ঐ বাগানের একটি গাছের ডাল বা পাতা বা ফল ও ফুলকে পুরো বাগান থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে চলেনা। তেমনিভাবে মুহাম্মাদ সা. এর জীবনী ও আদর্শরূপী বিশাল বাগানকে দেখুন এবং তার সামগ্রিক অবকাঠামোটা বুঝে নিন। তাহলে তার ভেতরকার প্রতিটি ডালপালা, প্রতিটি ফলফুল ও কুড়ি পাঁপড়িকেও আপনা আপনিই বুঝতে পারবেন। কোন মতবাদ, মতাদর্শ, আন্দোলন বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে যদি কয়েকটা জিনিস আপনার রুচি এবং আপনার প্রিয় ঐতিহ্য ও রীতিনীতির বিরোধী হয়, তাহলে তার অর্থ এটা হতে পারেনা যে, ওখানে আর কোন ভাল জিনিস নেই, ঐ গোটা জিনিসটা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যানযোগ্য। আপনার রুচি বা পছন্দ-অপছন্দ কোন বিশ্বজোড়া বা ঐতিহাসিক মানদণ্ড নয়। এমনও হতে পারে, বরং হওয়ারই কথা যে, একটা বিশেষ মতাদর্শ, আন্দোলন বা একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব নিজের ভালো মন্দের মাপকাঠি নিজেই সাথে করে এনেছে এবং তার ভালমন্দের মানদণ্ড আপনার মানদণ্ড থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। কাজেই সবার আগে যে জিনিসটা প্রয়োজন তা হলো, মানদণ্ড ও মাপকাঠিগুলোকে পাশাপাশি রেখে পরখ করতে হবে, এবং মানদণ্ড পরখের সাথে মূল তত্ত্ব এবং মতাদর্শের মান ও যাচাই বাছাই করতে হবে।

কুরআন, ইসলাম ও মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে খৃষ্টান জগত ও প্রাচ্যবিদগণ এ যাবত যে সাহিত্য তৈরী করেছেন, তা একাদিকে যেমন অজ্ঞতা ও ভুল বুঝাবুঝিতে পরিপূর্ণ, অপরদিকে তেমনি হঠকারীসুলভ একগুঁয়েমির বিষ তার শিরায় শিরায় সঞ্চালিত। এমনকি যারা উদার মনের পরিচয় দিয়ে সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে কিছুটা প্রশংসামূলক ভাষাও ব্যবহার করেছেন, তারাও জায়গায় জায়গায় সুচতুর শব্দের আড়ালে এমন মিছরির ছুরি বসিয়ে দিয়েছেন যে, পাঠক ধোঁকাবাজির দক্ষতা দেখে স্তম্ভিত না হয়ে পারেনা। দু’চারটে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এমন অবশ্যই পাওয়া যায়, যাতে রাসুল সা. এর বাণী ও কীর্তির আন্তরিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে সব লেখক পাশ্চাত্যবাসীর কাছে খুব কমই কদর পেয়েছে। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের একটি উৎকৃষ্টমানের বই প্রকাশিত হলে তাকে “মুসলিম সমর্থক” (Pro-Muhammaden) আখ্যায়িত করে পাশ্চাত্যবাসীর চোখে তার মর্যাদা খাটো করার চেষ্টা চলছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, মুসলিম দেশগুলোর সাথে আজকাল পাশ্চাত্যের কূটনৈতিক স্বার্থ জড়িত হওয়া উপলক্ষে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সন্তুষ্টির জন্য কত চেষ্টা তদবির যে করা হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। অথচ এ যাবতকাল রসুল সা.-এর যে অবিচারটা করা হয়েছে, তার প্রতিকারের কথা কোথাও ভেবে দেখা হয়নি।

আপনি আপনার বিবেকের রায়ের বিরুদ্ধে রসুল সা.-এর উপস্থাপিত মতাদর্শ ও জীবন ব্যবস্থাকে সমর্থন করুন-এ দাবী আপনার কাছে করা হচ্ছেনা। বিবেকের রায় না পেলে আপনি অবশ্যই দ্বিমত পোষণ করুন এবং দৃঢ়তার সাথেই করুন। যে জিনিসটা আপনার কাছে দাবী করা হচ্ছে, সেটা হলো, ইতিহাস ও জীবনী রচনার জন্য আপনার নিজেরই প্রণীত এবং সমর্থিত নীতিমালা ও মাপকাঠি লঙ্ঘন করে তথ্য বিকৃত করবেননা। এমন সূত্র থেকে বর্ণনা গ্রহন করবেন না, যা একদিকে মুসলমানদের দৃষ্টিতে সর্বসম্মতভাবে অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য এবং যা ঐতিহাসিক গবেষণার সর্বস্বীকৃত মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। আপনি একটি ঘটনার ভালো কার্যকারণগুলোকে বাদ দিয়ে তদস্থলে ইচ্ছাকৃতভাবে অবাঞ্ছিত কার্যকারণসমূহের উল্লেখ করবেননা। যুক্তি দিয়ে কথা বলুন, অসৎউদ্দেশ্য প্রণোদিত, অপমানজনক, অভদ্রোচিত, শ্লেষাত্মক ও বিদ্রুপাত্তক ভংগী অবলম্বন করবেন না।

এ আলোচনা দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য অপ্রীতিকর ভাবাবেগজনিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হলো এ যাবত যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তার অবসান ঘটানো। এ উদ্দেশ্যের সফলতার পয়লা শর্ত হলো, পাশ্চাত্যকে ইসলাম কুরআন ও মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে আপন দৃষ্টিভঙ্গী স্পষ্ট করতে হবে এবং একটা নতুন গঠনমূলক মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যা কেবল পাশ্চাত্যবাসী ও মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান ঐক্যমত্যকে উপলব্ধি করা দ্বারাই সম্ভব। যে সব বিষয়ে আমাদের ঐক্যমত্য রয়েছে তা নিম্নরুপঃ

– খৃষ্টান, ইহুদী ও মুসলমান এ তিনটে জাতিই আল্লাহর ইবাদত করে এবং আখেরাতে বিশ্বাস করে। এদের সকলেরই ইবাদতের পদ্ধতিতে সাদৃশ্য রয়েছে এবং সবারই মৌলিক নৈতিক মূল্যবোধ সমান।

– এই তিনটে জাতিরই ধর্মীয় শিক্ষার উৎস ওহী এবং মুসলমানরা সকল নবী ও রসূলকে একই ধর্ম ও একই মহাসত্যের পতাকাবাহী বলে বিশ্বাস করে।

পক্ষান্তরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পাশ্চাত্যবাসী ও মুসলমানদের মধ্যে নিম্মলিখিত বিষয়ে ঐক্যমত্য রয়েছেঃ

– পাশ্চাত্য সভ্যতা জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির যে সব ব্যবস্থা করেছে, মুসলমানদের নির্ভেজাল ধর্মীয় দৃষ্টিভংগী সেই উন্নতির সমর্থক। ইসলামী মতাদর্শ স্বীয় সমাজ ও সভ্যতায় আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি এই বস্তুবাদকে (সীমিত পর্যায়ে) স্থান দিতে পারে, যদিও এ দিক দিয়ে পাশ্চাত্য উন্নতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছে। অন্যান্য ধর্ম যেখানে নিছক ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ, ইসলাম সেখানে একটা পূর্ণাংগ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা হওয়ার কারণে অপেক্ষাকৃত উদার।

– গণতন্ত্রের যে সব মূলনীতির ভিত্তিতে পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজেদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে গড়ে তুলেছে, মুসলমানদের চিন্তা চেতনায় তা আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। শুধু বিদ্যমান নয়, বরং ইসলামী সভ্যতাই সর্বপ্রথম সেগুলোকে পূর্ণাংগ রূপ দিয়েছে। [লেবান ও ব্রেফাল্ট অস্ফুট চিত্তে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, গনতন্ত্রের চেতনা ও প্রাণশক্তি মুসলমানদের কাছ থেকেই পাশ্চাত্যে পৌঁছেছে।] জনপ্রতিনিধিত্ব ও নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক বিষয়ে বিশেষ ও সাধারণ জনগনের সাথে পরামর্শ করা, আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার এবং এ সব বিষয়ে সকল নাগরিকের সমমর্যাদা ও সমানাধিকারকে মুসলমানরা পাশ্চাত্যের অনেক আগে বাস্তবায়িত করেছে। যদিও তা করেছে সমকালীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখে। আন্তর্জাতিক উত্তেজনা ও অস্থিরতার নিরীখে বিবেচনা করলে এ সমস্যার সমাধানেও মুসলমানদের সহযোগিতাই পাশ্চাত্যের সংস্কারবাদীদের জন্য অধিকতর মূল্যবান। এর কারণ দুটো : প্রথমতঃ পাশ্চাত্য যদি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে ভেবে দেখে, তাহলে দেখতে পাবে যে, বিশ্বশান্তির ব্যাপারে মুসলমানরা যতখানি সহযোগিতা করতে সক্ষম, ততখানি আর কেউ নয়। এ জাতির আকীদা বিশ্বাসে মানব প্রেমের শেকড় যত গভীরভাবে বদ্ধমূল এবং আন্তর্জাতিক ঐক্য ও সংহতির নৈতিক ভিত্তি এ জাতির মর্মমূলে যত দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, ততটা আর কারো নয়। এ জাতির এই দুর্লভ ও অনন্য বৈশিষ্ট্যকে যদি পুরোপুরিভাবে কার্যে পরিণত হতে দেখা যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের অবসান ঘটানো সম্ভব। এক কথায় বলা যায়, ভবিষ্যতের বিশ্বরাষ্ট্র গড়ার জন্য মূল্যবোধ ও নৈতিকতার উপাদান কেবল ইসলামই পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করতে পারে।

দ্বিতীয়তঃ বস্তুবাদের দুই চরম রূপ পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র—উভয়ের প্রতিরোধ করা এবং একটা মধ্যমপন্থী ন্যায়বিচারমূলক পথে মানবজাতিকে নিয়ে আসার কাজে ইসলাম ও তার অনুসারীদের কাছ থেকেই অধিকতর কার্যকর ভূমিকা আশা করা যায়।

চিন্তা-ভাবনার জন্য এই সর্বসম্মত বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করার পর আমরা এর আলোকে যে কথাটা বলতে চাই তা হলো, পাশ্চাত্যবাসী এখন মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে আপন দৃষ্টিভংগী বদলালে ক্ষতি কি? পাদ্রী ও ওরিয়েন্টালিস্টদের স্থাপিত বিদ্বেষের পর্দাকে ঠেলে ছিড়ে ফেলতে তাদের আপত্তি কোথায়? এ যাবত বস্তুবাদী মতবাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা ব্যাপকভাবে করা হয়েছে। এই পরীক্ষা নিরীক্ষাকে একইভাবে অব্যাহত রাখা সম্ভব নয় এবং এই বিজ্ঞ পাশ্চাত্য জনগোষ্ঠী এমন নতুন বংশধর জন্ম দিচ্ছেনা, যার আশায় বুক বেঁধে আরো কিছুদিন কাটিয়ে দেয়া যায়। অপরদিকে ইসলাম ছাড়া অন্য যে সব ধর্ম পৃথিবীতে রয়েছে, তার প্রত্যেকটিই এমন যে, ব্যক্তি জীবনের একটি ক্ষুদ্র অংশে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকা পছন্দ করে। সেগুলো সামনে অগ্রসর হয়ে গোটা সভ্যতার লাগাম হাতে নিতে প্রস্তুত নয়। এক কথায় বলা যায়, মানবজাতি আদর্শগত দিক দিয়ে সমস্ত পুঁজি হারিয়ে একেবারেই দেউলে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটি মাত্র উৎস অবশিষ্ট রয়েছে, সেখান থেকে কিঞ্চিৎ আশার আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। মনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সেই আলো থেকেও যদি বঞ্চিত হয়ে যাই, তাহলে মঙ্গল গ্রহ থেকে তো কোন পথের দিশা আসবেনা।

তাই এখনো সময় আছে যে, আমরা মুহাম্মদ সা. কে একজন ইতিহাস স্রষ্টা, আর্ত মানবতার ত্রাণকর্তা, একটি সভ্যতার দিশারী এবং একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসাবে মেনে নেই। তাঁর কাছ থেকে যে আলো আসে তার জন্য মনমগজের বাতায়ন খুলে দেই। তাঁকে বৈজ্ঞানিক পন্থায় বুঝবার চেষ্টা করি। ইসলামকে নিছক খৃস্টবাদের প্রতিদ্বন্দ্বী একটা ধর্ম হিসাবে গ্রহন করা আমাদের পক্ষে সমীচীন হবেনা, বরঞ্চ তাকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং অনুরূপ অন্যান্য আদর্শবাদী আন্দোলনগুলোর ন্যায় একটা আন্দোলন এবং এমন একটা জীবন ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে, যা গোটা সমাজ ও সভ্যতাকে নিজের আয়ত্বে ও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। আর মুহাম্মদ সা. কে এই আন্দোলনের নেতা ও এই সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে মেনে নিতে হবে এবং তাঁর এই কৃতিত্ব স্বীকার করে নিতে হবে যে, তিনি ইতিহাসের একটা অনন্য সাধারণ ও উজ্জ্বল যুগের উদ্বোধন করেছেন। তাঁর উপস্থাপিত আদর্শ ও মুলনীতিকে আমাদের এই হিসাবে বিবেচনা করতে হবে যে, তা একটা অত্যাধুনিক বিশ্বরাষ্ট্র পরিচালনায় কতটা সহায়ক ও অপরিহার্য। তাঁর তৈরি করা মানবতার নমুনাকে আমাদের উদ্দেশ্যে যাচাই করে দেখতে হবে যে, তা একটা আদর্শ ও নিখুঁত সভ্যতার হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি হওয়ার জন্য কতখানি মানানসই।

আজ যখন আমাদের সামনে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজমান এবং দূর দুরান্তে কোথাও একটা স্ফুলিঙ্গ পর্যন্ত জ্বলতে দেখা যাচ্ছেনা, তখন পেছন ফিরে তাকিয়েই দেখি, রসুল সা. এর হাতে একটা মশাল জ্বলছে এবং তা বিগত চৌদ্দ শত বছর ধরে হাজারো ঝর ঝঞ্ঝায় একইভাবে জ্বলে আসছে। কেবল নিজের তৈরী করা বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষের কারণে এ মশাল থেকে আলো গ্রহন করতে অস্বীকার করা ও চোখে পট্টি বেঁধে নেয়ার ফল কি ভালো হতে পারে? মানবজাতিকে ও মানবসভ্যতাকে এই ভয়াল অন্ধকারে ধ্বংস হয়ে যেতে দেয়া কি সমীচীন হবে? খুব ভালো করে বুঝে নেয়া দরকার যে, বিরাজমান পরিস্থিতি আমাদের সামনে কী সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে এবং আমাদের মধ্যে এ চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়ার শক্তি আছে কিনা।

কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হলো, আসল অপরাধী স্বয়ং আমরাই। আমরাই রসুল সা. এর ব্যক্তিত্ব, বাণী ও কৃতিত্ব বিশ্ববাসীকেও জানতে দেইনি, নিজেরাও জানতে চেষ্টা করিনি। তাই আজ রসুল সা. কে নতুন করে পরিচিত করানোর প্রয়োজন। এ কাজতা সম্ভবত আনবিক শক্তি আবিস্কারের চেয়েও বড় ধরনের কীর্তি হবে।

এই গ্রন্থটি প্রসংগে দুটি কথা

রসুল সা. এর পবিত্র সীরাত বা জীবনীর ওপর উচ্চমানের গ্রন্থাবলী থাকা সত্ত্বেও আমি এই কঠিন কাজে নিজের অক্ষমতা সত্ত্বেও হাত দেয়ার সাহস করেছি শুধু এ জন্য যে, রসুল সা.-এর মহান সত্তা জীবনের উদ্দেশ্য উপলব্ধির একমাত্র উৎস হিসাবে আর একবার পরিচিতি লাভ করুক। রসুল সা.-এর জীবনী সম্বলিত শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাবলীতে ঘটনা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে। কিন্তু পাঠক কোথাও বর্ণনা সংক্রান্ত মতবিরোধে এবং কোথাও গভীর তাত্ত্বিক আলোচনায় আটকে যায়। কোথাও ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতার যোগসূত্র তার কাছ থেকে ছিন্ন হয়ে যায়, কোথাও তার সামনে এমন সব খুঁটিনাটি তথ্য হাজির হয়, যার সুস্পষ্ট কোন তাৎপর্য ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা সে পায়না। কোথাও তাত্ত্বিক ও গবেষণালব্ধ তথ্যাবলী এবং সূত্রের আধিক্য দেখে সে আঁতকে ওঠে। অথচ ভলিউম ভলিউম বই পড়েও সে নিজের সামনে একটা উচ্ছ্বসিত আন্দোলন দেখতে পায়না। রসুল সা. এর দাওয়াতের দরুন যে সংঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তার দৃশ্য সে দেখতে পায়না। সে নিজেকে রসুল সা. এর যুগে দেখতে পায়না। সীরাতের পুস্তক পড়ে তার এরূপ অনুভূতি হয়না যে, সেও রসুল সা. এর পরিচালিত আন্দোলনের একটা উত্তাল তরংগ এবং তার চারপাশে বিরাজমান পরিবেশের নোংরামির বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্ব তার ওপরও অর্পিত। রসুল সা. এর নিয়ে আসা মহাসত্যের জ্বলন্ত মশালকে উঁচু করে রাখা এবং তার আলোকে এতটা বিকশিত করাও তার দায়িত্ব যে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির জগতে ঐ মশাল যেন একটা প্রদীপ্ত সূর্যে পরিণত হয়। এই অভাবটা পূরণের লক্ষ্যেই এই সামান্য রচনার কাজে হাত দিয়েছি।

ইতিহাস অধ্যয়নের জন্য আমি কুরআনের দৃষ্টিভংগী অবলম্বন করেছি। আমার দৃষ্টিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা পৃথিবী একটা চঞ্চল ও গতিশীল পৃথিবী। ওটা একটা বৈচিত্র্যময় ও পরিবর্তনশীল পৃথিবী। সর্বোপরি তা একটা প্রতিদন্দিতা, দ্বন্দ্ব সংঘাত, জেহাদ ও লড়াই-এর পৃথিবী। এখানে আকর্ষণ বিকর্ষণ দুইই আছে। এখানে ক্রিয়ার সাথে প্রতিক্রিয়া, ভাংগার সাথে গড়া এবং আলোর সাথে অন্ধকারও রয়েছে। এখানে রাত ও দিন পরস্পরকে ধাওয়া করছে। জীবন ও মৃত্যু, আগুন ও পানি, শীত ও বসন্ত পরস্পরের সাথে যুদ্ধরত। মোট কথা, এই পৃথিবীর যে কোণেই এবং যে জগতেই দৃষ্টি দেবেন, পরস্পর বিরোধী জিনিসগুলোকে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত দেখতে পাবেন। এই মহাবিশ্বের একটা নগণ্য ও ক্ষুদ্র জায়গায় (অর্থাৎ পৃথিবী নামক গ্রহে) মানব জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ রণক্ষেত্র অবস্থিত। আমাদের গোটা সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা একটা তরংগবিক্ষুব্ধ মহা সমুদ্র। এতে টেউ এর সাথে ঢেউ, বুদবুদের সাথে বুদবুদ ও বিন্দুর সাথে বিন্দু প্রতি মুহূর্তে টক্কর খাচ্ছে। এখানে হোক ও বাতিল, সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়, ভালো ও মন্দ, যুলুম ও ইনসাফ, পাপ ও পুণ্যের মধ্যে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এক দীর্ঘ লড়াই চলছে। এ লড়াই-এর বাগডোর রয়েছে রূহ তথা আত্মা এবং নফস তথা কুপ্রবৃত্তির হাতে নিবদ্ধ। এর এই দুই উৎস থেকে রকমারি চিন্তা, বিশ্বাস ও মতবাদ একের পর এক উসারিত হচ্ছে এবং বিচিত্র ধরনের চরিত্র ও পরস্পর বিরোধী স্বভাবের সামষ্টিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটছে। প্রতিটি ধ্যান-ধারনা, আকিদা বিশ্বাস, মতবাদ মতাদর্শ, চরিত্র ও ব্যবস্থা তার ঠিক বিপরীতমুখী সহোদরকে সাথে নিয়ে ভুমিষ্ট হচ্ছে। যে শক্তিই জন্ম নিচ্ছে, সে তার বিরোধী ও বিপরীত শক্তিকে সংগে নিয়েই জন্ম নিচ্ছে। এই বিরোধ ও বৈপরিত্য থেকে এমন এক সর্বগ্রাসী সংঘাতের উদ্ভব ঘটছে, যা মানব জাতির গোটা ইতিহাসকে একটা সংগ্রামের ইতিহাসে পরিণত করেছে। এই সংগ্রামের ইতিহাস আজ আমাদেরই রক্তে লেখা ইতিহাস হিসাবে আমাদের সামনে বিদ্যমান।

মানব সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই যুগে যুগে দেশে দেশে চলে আসছে সার্বক্ষনিক ও সর্বাত্মক লড়াই। সে লড়াই কোথাও চলছে যুক্তির অস্ত্র দিয়ে, আবার কোথাও মারণাস্ত্র দিয়ে। এ লড়াইতে মানুষ দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে দুটি ভূমিকা পালন করে আসছে। একদিকে সে অরাজকতা, অন্যায় ও অসত্যের পতাকাবাহী। অপরদিকে সে ন্যায়, সত্য, সততা ও কল্যাণের নিশানবরদার। কখনো সে নাশকতা ও বিকৃতির খলনায়কদের সক্রিয় তল্পিবাহক হয়ে যায়। আবার কখনো গঠনমূলক কাজের আহবায়ক ও উদ্যোক্তাদের জোরদার সমর্থক হয়ে এগিয়ে আসে। মানবজীবনকে দুঃখ দুর্দশা ও বিপদমুসিবতে জর্জরিত করার অপচেষ্টায় আদাপানি খেয়ে লেগে যায় এক ধরনের মানুষরূপী শয়তান। অপরদিকে পৃথিবীকে সুখ শান্তি ও আনন্দে ভরা জান্নাত হিসেবে ঘরে তোলার জন্য এক শ্রেণীর মানুষ নিজেদের সমস্ত সহায় সম্পদ অকাতরে বিলিয়ে দেয়। জীবন যুদ্ধের একদল মরণপণ সৈনিক এমনও হয়ে থাকে, যাদের হাতে মিথ্যা, যুলুম ও অনাচারের সয়লাব বয়ে যায়। আবার এক শ্রেণীর আপোষহীন মুজাহিদ সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের বিজয় ডংকা বাজিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় হয়ে যায়।

সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের এই লড়াকু সৈনিকরাই পৃথিবীকে কিছুটা বাসযোগ্য ও মানব জীবনকে খানিকটা উপভোগ্য বানিয়েছে। সমাজে আজ যে ক’টি জিনিষ কিছুটা সমাদর পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হচ্ছে, তা ঐ সব মহৎ ব্যক্তিরই অবদান। তারা মানুষের সামনে আদর্শ জীবন পেশ করেছে। তাঁরা আমাদের সামনে স্থাপন করেছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটা মানদণ্ড ও মডেল। তাঁরা আমাদেরকে উপহার দিয়েছে জীবনের সুমহান লক্ষ্য ও চমৎকার নীতিমালা। ইতিহাসের শিরায় শিরায় তারা চিরঞ্জীব ও শাশ্বত ঐতিহ্যের রক্ত সঞ্চালিত করেছে। সভ্যতার আকাশে স্থাপন করেছে নৈতিক মূল্যবোধের জ্বলজ্বল নক্ষত্ররাজি। তারা মানুষকে দিয়েছে উৎসাহ, উদ্দীপনা, সাহস ও উচ্চাভিলাষ। উদ্দেশ্য ও নীতির জন্য তারা দিয়েছে ত্যাগ, কুরবানি ও সংগ্রামের শিক্ষা। এসব মহৎ ব্যাক্তির গৌরবোজ্জল কীর্তি ও অবদানের জন্যই ইতিহাস এত মুল্যবান হয়েছে যে, তার নিদর্শনাবলী সংরক্ষণের যোগ্য বিবেচিত হয়ে থাকে এবং তা কেয়ামত পর্যন্ত মানবজাতির জন্য নিত্য নতুন কর্মপ্রেরণার উৎসরূপে সমাদৃত হতে থাকবে।

তাছাড়া যখনই যুলুমবাজ ও মিথ্যাচারী অপশক্তি ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী শাসনের অক্টোপাস বন্ধনে মানুষকে বেঁধে অসহায় করে ফেলেছে এবং মানুষ হিম্মত হারিয়ে হতাশার গভীর খাদে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তখন ইতিহাসের এই মহানায়কগণই মানব জাতির ত্রানকর্তা হয়ে এগিয়ে এসেছে। তারা ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়েছে, পতিত মানুষকে টেনে তুলেছে, কাপুরুষদেরকে বীরত্বের সঞ্জীবনী সুধা পান করিয়েছে, এবং অস্ত্র সমর্পনকারীদেরকে নতুন করে রণাঙ্গণের সামনের কাতারে দাঁড় করিয়ে নৈরাজ্যবাদী ও দুর্নীতিবাজ অপশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করেছে। অন্য কথায় বলা যায়, এই মহানায়কগণ ইতিহাসের অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়েছে, সভ্যতার হীমায়িত সমুদ্রের বরফ গলিয়ে দিয়েছে, চিন্তা ও কর্মের স্থবির নদীতে নতুন প্রবাহের সৃষ্টি করেছে এবং ইস্পাত কঠিন স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করে মানুষের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার পুনর্বহাল করেছে, এভাবে বিশ্বমানবের কাফেলা আত্মবিকাশের সরল ও সঠিক পথ ধরে নির্বিঘ্নে এগিয়ে গেছে।

মানব সমাজের যে পূণ্যবান শ্রেণীটি পৃথিবীতে সত্য ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা এবং গঠন ও উন্নয়নের মহৎ কাজে অংশ নিয়েছে, তার প্রথম কাতারেই রয়েছে অনন্য মর্যাদার অধিকারী নবী ও রাসুলগন। এ ছাড়া সিদ্দিকীন (ইসলামের দাওয়াত পাওয়া মাত্রই যারা তা সর্বাস্তকরণে গ্রহণ করে), শহীদগণ ও সালেহীন তথা সৎ লোকগণ এই প্রথম কাতারের কৃতিত্বেরই অনুগামী এবং তাদেরই নেতৃত্বে কর্মরত। আর নবী ও রাসূলগণের পবিত্র কাতারটিতে যে মহান ব্যাক্তির ওপর সর্বাগ্রে অবারিত দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়, তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইনি হচ্ছেন ইতিহাসের মানবতার সবচেয়ে বড় বন্ধু ও সবচেয়ে বড় উপকারী মহামানব। এই মহামানবকে যেদিক দিয়েই পর্যবেক্ষণ করুন, তাঁর রকমারি শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেবে। এই মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিতে দিতে বিগত চৌদ্দ শতাব্দীতে কত মানুষ যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে, তাঁর ইয়াত্তা নেই। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আজও পর্যন্ত তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের বিবরণ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়নি। ভবিষ্যতে কে এই কাজকে পূর্ণতা দান করতে পারবে কেউ জানেনা। এই মহৎ কাজে শুধুমাত্র অংশগ্রহণের দুর্নিবার আকাংখা অতীতের লোকেরাও পোষণ করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও অনেকে পোষণ করবে। এই দুর্নিবার আকাংখা এক সময় আমাকেও পেয়ে বসলো। মন চাইলো রসুল সা. আর জীবনের এই দিকটা বিশেষভাবে সংক্ষেপে তুলে ধরি যে, তিনি মানবতার কল্যাণ সাধন ও পুনর্গঠনের জন্য যখন ময়দানে নামলেন তখন তাকে কি ধরনের অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হতে হলো, মানবতার এক অতুলনীয় সেবকের সেবার প্রতিদান কিভাবে সারা জীবন অন্ধ বিরোধিতা ও অত্যন্ত নিকৃষ্টমানের অসদাচরণ দ্বারা দেয়া হলো। আর অপরদিকে এত যুলুম নির্যাতন, বিরোধিতা ও অসদাচরণের তান্ডবের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হবার সময় রসুল সা. কী ধরনের চরিত্রের পরিচয় দিয়ে যেতে লাগলেন। প্রিয় নবীর এই মর্মন্তুদ জীবন কাহিনীতে সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠাকামীদের জন্যও শিক্ষণীয় রয়েছে এবং সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম প্রতিরোধকারীদের জন্যও শিক্ষণীয় রয়েছে।

মানব ইতিহাসের এই হলো মুহাম্মদ সা. এর স্থান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি সবচেয়ে বড় ইতিহাস স্রষ্টা ছিলেন।

মানব কল্যাণের এই সর্ববৃহৎ কাজ করার জন্য যখন রসুল সা. আবির্ভূত হলেন, তখন সকল নবী ও রসূলের ওপর বিভিন্ন যুগে যে নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সেই সমস্ত অত্যাচার নির্যাতনকে শয়তান একত্রিত করলো এবং এই এতিম ও অসহায় যুবককে চতুর্মূখী লড়াই চালাতে বাধ্য করলো। রসূল সা. এর জীবন কাহিনীর দৃশ্য অনেকটা এ রকম, যেন ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে নৌকা বিহীন এক সাতারু পর্বত প্রমাণ ঢেউ এর সাথে ক্রমাগত লড়াই করে চলছে। সেখানে প্রচন্ড ঝড় বয়ে চলেছে এবং ঘোর কালো মেঘে আচ্ছন্ন আকাশে থেকে থেকে বিদ্যুতের চমকে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। মেঘের গর্জনে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়েও আপোষহীন সাঁতারু নিজের পথ ধরে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন মর্মান্তিক অত্যাচার ও নির্যাতন এবং এমন আপোষহীন অদম্য সংগ্রামের উদাহরণ ইতিহাসে আর কোথাও আছে কি?

হক ও বাতিলের এবং ন্যায় ও অন্যায়ের লড়াই এর নাটক যখনই মঞ্চস্থ হয়, তাঁর মৌলিক চরিত্র সব সময় একই থাকে। সময় বদলে যায়, ভৌগলিক পরিবেশ পাল্টে যায়, এবং নায়কদের নামও পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা কখনো পাল্টে না। একটি ভূমিকা হয়ে থাকে দাওয়াত দাতার চরিত্র।

দ্বিতীয় চরিত্রের নায়ক থাকে সমাজের সেই নিখাদ নিষ্ঠাবান ও নিষ্কলুষ মানুষগুলো, যারা সত্য, ন্যায় ও সদাচারের আহবান শোনা মাত্রই সে আহবানকে নিজেদের সহজাত অভিরুচি দিয়েই চিনতে পারে। সে আহবানে তারা পুলকিত ও মুগ্ধ হয়, নির্দ্বিধায় ও সর্বান্তকরণে তা গ্রহন করে এবং ঐ আহবানের প্রথম অনুসারীর ভূমিকা অবলম্বন করে।

তৃতীয় ভূমিকা গ্রহন করে তারা যারা ভদ্রতার সাথে দ্বিমত পোষণ করে। তারা কথা শোনে, ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। কিন্তু জ্ঞান ও চেতনার অভাব এবং কিছু মনস্তাত্মিক বাধার কারণে সত্যকে বুঝতে দেরি করে ফেলে।

চতুর্থ চরিত্রের নায়ক হয়ে থাকে অত্যন্ত কট্টর ও সোচ্চার দুশমনদের গোষ্ঠী, যারা নিজেদের স্বার্থ, পদমর্যাদা ও বিকৃত আদত অভ্যাসের কারণে প্রথম দিন থেকেই চরম হঠকারী পন্থায় বিরোধিতা শুরু করে দেয়। তাদের এই বিরোধিতা উত্তরোত্তর কেবল বাড়তেই থেকে। পঞ্চম ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে দুর্বল জনসাধারণ, যারা সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর দোর্দন্ড প্রতাপের কাছে এত অসহায় থাকে যে কোন সাহসী ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেনা। আবার মানসিকভাবেও কোন দাওয়াতের গভীরতম মর্ম উপলব্ধি করার যোগ্যতা রাখেনা। তাই তারা সাধারণত যুগ যুগ ধরে সত্যের আহবায়ক ও সত্যের শত্রুদের দ্বন্দ্ব সংঘাতে নীরব দর্শক হয়ে থাকে এবং কোন পক্ষের কী পরিণতি হয় তার অপেক্ষায় থাকে। যখন কোন এক পক্ষের জয় হয়, তখন জনতার এই প্লাবন বিজয়ী শক্তির পক্ষেই প্রবাহিত হয়। সুতরাং হোক ও বাতিলের যুদ্ধের নাটকটি দুটো চরিত্রের অভিনেতাদের ওপরই নির্ভরশীল অর্থাৎ সত্যের আহবায়ক ও তার অনুসারীদের ভূমিকা, এবং সক্রিয় ও কট্টর বিরোধীদের ভূমিকা। সত্যের দাওয়াতের নাটক মঞ্চস্থ হবে অথচ এই দুটো চরিত্রের অভিনেতারা পরস্পরের মুখোমুখি হবেনা- এটা একেবারেই অসম্ভব। আপনি সত্য ও ন্যায়ের আওয়ায তুলবেন, এর তার জবাবে অসত্য ও অন্যায়ের পক্ষাবলম্বনকারী শক্তিগুলো সমবেতভাবে রুখে দাঁড়াবেনা-এটা হতেই পারেনা। আপনি মানবতার কল্যাণ ও সেবার জন্য কাজ শুরু করবেন, আর গালিগালাজ, অপবাদ, অপপ্রচার, কুৎসা, ষড়যন্ত্র ও হিংস্রতার ভয়ংকর হাতিয়ারগুলো নিয়ে সমাজের সমস্ত অপশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আপনার দিকে মারমুখী হয়ে ছুটে আসবেনা – এটা অকল্পনীয়।

রসূল স.-এর বেলায়ও এটাই ঘটেছে। তিনি যদি কেবল কিছু ভালো ভালো কথা বলতেন, জনকল্যাণের বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন, নিজের পছন্দ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পন্থায় রুকু সিজদা ইত্যাদি করে আল্লাহর ইবাদত করেই জীবন কাটাতেন, নির্জনে নিভৃতে বসে যিকির তাসবীহ করতে থাকতেন, এমনকি ভালো ভালো ওয়ায নসিহতও যদি করতে থাকতেন, পীর-মুরীদীর একটা ফের্কাও গড়ে তুলতেন, এবং নিজের অনুসারীদের নিয়ে একটা অক্ষতিকর সংঘ ইতায়দি গঠন করেও ফেলতেন, তবে সমাজ তা বরদাশত করতো। কিন্তু তিনি তো সমগ্র জীবন ব্যবস্থাই পাল্টে ফেলতে চাইছিলেন। সমাজ ও সভ্যতার গোটা ভবন নতুন করে নির্মাণ করতে চাইছিলেন। গোটা সামষ্টিক ব্যবস্থাকে ধসিয়ে দিয়ে তাকে সর্বোত্তম নকশা অনুযায়ী নতুন করে নির্মাণ করতে তিনি আদিষ্ট ছিলেন। কায়েমী স্বার্থ ও অধিকারের মধ্যে যে অন্যায় অথচ অটুট সমঝোতা তৎকালীন সমাজে গড়ে তোলা হয়েছিল, তাকে তছনছ করে দিতে উদ্যত ছিলেন। তিনি মানুষকে একটি নতুন বিশ্বাসগত ও নৈতিক কাঠামো অনুযায়ী গড়ে তোলার জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। প্রথম দিন থেকেই তিনি এই কাজেরই দাওয়াত দেন এবং জনগণ তাঁর দাওয়াতের অর্থ বুঝেছিল প্রথম দিন থেকেই। এর এই অর্থ বুঝিছিল বলেই এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া স্বরূপ দেখা দিয়েছিল জাহেলী সমাজের পাল্টা কর্মকান্ড।

সত্য ও ন্যায়ের সর্বব্যাপী আন্দোলনের বিরোধীদের পর্যালোচনা যে কোন যুগেই করা হোক, দেখা যাবে যে, তাদের নেতিবাচক কর্মকান্ডের কৌশল ও ধারাবাহিকতা সব সময় একই রকম ছিল। সর্বপ্রথম মামুলী ধরনের ঠাট্টা বিদ্রূপ করা হতো। এরপর পরবর্তী পর্যায়ে গালিগালাজ, মিথ্যা অপবাদ আরোপ, কুৎসা অপপ্রচার, এবং কলংকজনক উপাধি প্রদানের তান্ডব সৃষ্টি করা হতো। তারপর জনগনের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির জন্য সুনির্দিষ্ট মিথ্যা প্রচারণা শুরু করা হতো। ব্যাপারটা যখন আরো বেড়ে যেত, তখন একদিকে জাতীয় স্বার্থ ও সংহতি বিপন্ন হবার দোহাই দেয়া হতো, আর অপর দিকে ধর্মীয় অজুহাতে অজ্ঞ জনসাধারণের মধ্যে উস্কানি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হতো। এরই ফাঁকে ফাঁকে যুক্তিতর্কের লড়াইও চলতো এবং প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দাওয়াত দাতাকে নাজেহাল করার অভিযানও চলতো। যখন বুঝা গেল যে, একটা বিপজ্জনক আন্দোলন ক্রমেই জোরদার হচ্ছে, তখন প্রলোভন দ্বারা রফা করার চেষ্টা চালানো হলো। সমস্ত ফন্দি ফিকির ব্যর্থ হতে দেখে হিংস্রতার অত্যন্ত ঘৃণা পন্থা অবলম্বন করা হলো। রসুল সা. ও তাঁর সহযোগীদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করা হলো। জুলুম ও নির্যাতনের চক্রান্তও কার্যকর করা হলো। এমনকি শেষ পর্যন্ত রসুল সা. –কে হত্যার ষড়যন্ত্রও করা হলো। এরপরও সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে না পারায় যুদ্ধ ঘোষণা করে সম্মুখ সমরের আহবান জানানো হলো। রসুল সা.–এর জীবনে এই পর্যায়গুলোর সবই একে একে এসেছিল। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁকে প্রত্যেক পর্যায়েই গৌরবজনকভাবে সাফল্যমন্ডিত করেন। অবশেষে সমগ্র আরব রসুল সা.–এর পদতলে এসে যায়।

এ গ্রন্থে রসুল সা.-এর জীবনের ঘটনাবলীকে অত্যন্ত বিশ্বস্ত সুত্রে এবং যথাযথ ধারাবাহিকতা সহকারে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, ইতিহাসের স্থবিরতা ভংগ করে সত্য ও অসত্যের এবং কল্যাণ ও অকল্যাণের যে ভয়াবহ লড়াই রসুল সা. সংঘটিত করেন, তার দৃশ্য চোখের সামনে স্পষ্টভাবে ভেসে ওঠে। এ লড়াইতে তাঁর গোটা জীবন অতিবাহিত হয়ে যায়। আশা করি এ পুস্তক পড়ার সময় পাঠক নিজেকে রসুল সা.–এর খুবই নিকটে আছেন বলে অনুভব করবেন। ঘটনা প্রবাহকে নিজের চোখের সামনেই সংঘটিত দেখতে পাবেন এবং ইসলামী আন্দোলনের উত্তাল তরংগমালাকে নিজের কল্পনার জগতে নৃত্য করতে দেখতে পাবেন। ফলে হক ও বাতিলের এই সংঘাতের নির্বিকার ও নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারবেন না। বরং তার মধ্যে ইতিবাচক চেতনার উন্মেষ ঘটবে এবং তিনি মানবেতিহাসে নিজের অবস্থান বর্তমানে কী এবং কী হওয়া উচিত, সে কথা ভেবে দেখতে বাধ্য হবেন।

আমার দৃঢ় প্রত্যাশা, এ পুস্তক থেকে সাহসিকতা ও বীরত্বের শিক্ষা অর্জন করা যাবে এবং কঠিনতম পরিস্থিতিতেও দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের প্রেরণা সঞ্চারিত হবে। অন্তরের সেই মহান ব্যক্তির প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা জন্ম নেবে, যিনি মানবতার সবচেয়ে বড় সেবক ছিলেন, এবং যিনি মানবতার সবচেয়ে বেশি উপকার সাধন করেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার অনুভুতিতে হৃদয় আপ্লুত হবে এবং তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসায় মন ভরে ওঠবে। ইসলাম এই জিনিসটাই কামনা করে। এ পুস্তক পড়ে বুঝা যাবে, আজ সত্যের যে আলোতে আমাদের অন্তরাত্মা উদ্ভাসিত, এই আলোর বাহক যিনি ছিলেন, তিনি কত কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, কত মারাত্মক বিরোধিতার মোকাবিলা করে, কী কী ধরনের আক্রমন প্রতিহত করে এবং রক্ত ও অশ্রুর কত বড় বড় সাগর পাড়ি দিয়ে তা আমাদের কাছে পৌছাতে পেরেছেন। এ থেকে এই উপলব্ধিও আসবে যে, সত্য ও ন্যায়ের পতাকাবাহীদের পথ ও অত্যধিক কন্টকাকীর্ণ। এ পথ যখন মুহাম্মদ সা.-এর ন্যায় পুণ্যময় ব্যক্তিত্বের জন্যও কন্টকমুক্ত হয়ে কুসুমাস্তীর্ণ হয়নি, তখন তা আর কার জন্য কুসুমাস্তীর্ণ হবে? এমন আরামদায়ক সংক্ষিপ্ত পথ আর কার জন্য তৈরি হবে যে, মানুষ তার নিরাপদ কক্ষ থেকে বেরিয়ে পায়ে ধুলোও না লাগিয়ে সোজা বেহেস্তে চলে যেতে পারবে? রসুল সা. এর জীবনেতিহাসের মর্মন্তুদ কাহিনীগুলো পড়লে সেই ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যায়। নতুবা মানুষ আল্লাহর আনুগত্যকে পরম আয়েশী কাজ মনে করে নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকে। রসুল সা. এর জীবন কাহিনীর আলোকে আমাদের ভাবতে হবে যে, কুরআন হাদীস ও সীরাতের গ্রন্থাবলীতে যে সব অগ্নিপরীক্ষা, বিপদ মুসিবত, বাধাবিপত্তি আঘাত ও আক্রমন একজন সত্যিকার মুমিনের জীবনে অনিবার্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা যদি আমাদের জীবনে না আসে, তা হলে আমাদের চলার পথ, এবং গন্তব্য সঠিক আছে কিনা তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে, আমরা যাকে ইসলামের পথ মনে করছি, তা কুফর ও জাহেলিয়াতের পথ নয় তো? এ পুস্তক অধ্যয়ন করে প্রত্যেক মুসলমান আগে থেকে জানতে পারবে যে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোন ব্যক্তি বা দল অবিকল রসুল সা. এর দাওয়াত ও আন্দোলন নিয়ে ময়দানে নামবে এবং হুবহু রসুল সা. এর অনুসৃত কর্মপদ্ধতি অনুসরন করবে। তখন তার বিরুদ্ধে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, অপবাদ, অপপ্রচার, কুৎসা, ষড়যন্ত্র ও যুলুম নির্যাতন হিংসাত্মক আক্রমন ইত্যাদি না হয়েই পারেনা। কেননা এগুলো এ কাজের অনিবার্য পার্থিব প্রতিদান। এ সব দুর্যোগ ও বিপদ মুসিবতের পরিপূর্ণ পরিবেশে যে কোন যুগে কর্মরত সত্যের আহ্‌বায়ককে চেনা, তার কথাকে বুঝা এবং তা মেনে নেয়া সহজ কাজ নয়। এটা কেবল সেই সব ভাগ্যবান ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যারা কুরআন হাদীস ও রসূলের সীরাত অধ্যয়ন করে হক ও বাতিলের চিরন্তন লড়াই এর সঠিক ধারণা আগে ভাগেই লাভ করেছে। প্রত্যেক মুসলমানের জানা উচিত, যে বাতিল শক্তি রসূল সা.-এর ন্যায় নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপ সত্তাকে ক্ষমা করেনি, এবং যারা পরবর্তীকালে রসূল সা.-এর অনুসারী ইমাম হোসাইন, ইমাম মালেক, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, ইমাম আবু হানিফা, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী ও শাহ ওয়ালউল্লাহর ন্যায় মহান ব্যক্তিবর্গকেও অত্যাচার নির্যাতন থেকে রেহাই দেয়নি, তারা অন্য কাউকেও ছেড়ে দেবেনা। রসূল সা.-এর সীরাত অধ্যয়ন আমাদেরকে প্রত্যেক যুগে সত্যের আহ্‌বায়ক ও সত্যের শত্রুদের চরিত্রের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়। ইসলাম ও কুফরের সংঘাতে যারা সক্রিয় থাকে, তাদের পরিচয় আমি এ পুস্তকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি।

আমি আশা করি, রিসালাতের প্রতি ঈমান ও আমাদের বাস্তব জীবনে যে ভয়ংকর বৈপরিত্য ও স্ববিরোধিতার সৃষ্টি হয়ে গেছে, এই পুস্তক অধ্যয়নে আমরা সে সম্পর্কে সচেতন হতে পারবো। পৃথিবীতে আজ কোন একটা দেশও এমন অবশিষ্ট নেই, যেখানে রসূল সা. এর আনীত জীবন বিধান পুরোপুরি বিজয়ী ও কার্যকর। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের জয়জয়কার, যা একাধারে প্রাচীন ও আধুনিক জাহেলিয়াতের অন্ধকারে আমাদেরকে ডুবিয়ে রেখেছে। মানসিকভাবে আমরা আপাদমস্তক জাহেলিয়াতে নিমগ্ন। অর্থনৈতিকভাবেও আমরা পর্যুদস্ত। সাংস্কৃতিকভাবেও আমরা সারা বিশ্বে ভিখারীর জাতি হিসেবে পরিচিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণের শিকার। আমাদের ঈমানের সাথে আমাদের চরিত্রের বৈসাদৃশ্যের এই বিষময় পরিণামই আমরা ভোগ করে চলেছি।

এ গ্রন্থে আমি মূলত বিশ্বনবীর দাওয়াত পুণরুজ্জীবনের আহ্‌বান জানিয়েছি। হুবহু রসূল সা. প্রদর্শিত কর্মপন্থা অনুসারে আমরা যাতে আমাদের জীবনে পরিবর্তন সূচিত করতে পারি, এবং বিশ্ব মানবতার এই মহান নেতা কোরআন ও হাদীসের নীতিমালার আলোকে যে মহানুভবতা ও সুবিচারপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, সেই সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি, সেটাই আমার মূল উদ্দেশ্য। আজ সেই সময় সমাগত, যখন আমাদের ও আমাদের তরুণ সমাজের পাশ্চাত্য সভ্যতার মানসিক গোলামীর বোঝা মাথার ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলা উচিত এবং এই বস্তুবাদী যুগের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে দেয়া উচিত। মুহাম্মদ সা.-এর জীবনীকে পুস্তকের পাতা থেকে বের করে নতুন করে বাস্তব জীবনের পাতায় লিখে দিতে হবে। তাঁর আদর্শকে একটা সমষ্টিক ব্যবস্থার আকারে সংকলিত করতে হবে এবং মুক্তির পথ প্রদর্শনকারী সেই তৃতীয় শক্তির অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে, যার স্থান ইতিহাসে এখনো শূণ্য রয়েছে।

দয়াময় আল্লাহ আমার এ নগণ্য চেষ্টা কবুল করুন এবং এর মহৎ উদ্দেশ্য সফল করুন।

আমীন।

নঈম সিদ্দীকী, ১লা ডিসেম্বর, ১৯৫৯।

 

Page 4 of 35
Prev1...345...35Next

© Bangladesh Jamaat-e-Islami

  • আমাদের সম্পর্কে
  • প্রাইভেসি পলিসি
  • যোগাযোগ
কোন ফলাফল নেই
সকল ফলাফল দেখুন
  • নীড়
  • সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
  • বিভাগ ভিত্তিক
    • আল কুরআন
    • আল হাদিস
    • ফিকাহ
    • ঈমান
    • ইসলাম
    • পারিবারিক জীবন ও সামাজিক সম্পর্ক
    • আন্দোলন ও সংগঠন
    • সীরাত ও ইতিহাস
    • সীরাতে সাহাবা
    • মহিলাদের বিশেষ বই
    • রাজনীতি
    • অর্থনীতি
    • বিবিধ
  • রুকন সিলেবাস
    • রুকন সিলেবাস (স্বল্প শিক্ষিত)
    • রুকন সিলেবাস (শিক্ষিত)
  • কর্মী সিলেবাস
  • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (শিক্ষিত)
    • বাৎসরিক পাঠ্যসূচি (স্বল্প শিক্ষিত)
  • উচ্চতর অধ্যয়ন
  • অডিও বই
  • অন্যান্য
    • দারসুল কুরআন
    • দারসুল হাদিস
    • আলোচনা নোট
    • বইনোট
    • প্রবন্ধ
    • কবিতা
    • বুলেটিন
    • স্মারক
    • ম্যাগাজিন
    • এপস
    • রিপোর্ট বই
    • ছাত্রী সিলেবাস

@BJI Dhaka City South