অধ্যায়ঃ ৩
মক্কীযুগে মানবতার বন্ধু সা. : তীব্র বিরোধীতার মুখোমুখী
এ হচ্ছে একটি শাশ্বত কথা।
এ কথাটি গ্রহন করে তোমরা
আমার সাথি হয়ে যাও।দেখবে,
এর শক্তিতে গোটা আরব তোমাদের।
মুষ্টিবদ্ধ হবে এবং এর প্রভাবে
গোটা বিশ্ব তোমাদের অধীন হবে।
-মানবতার বন্ধু সা.
এবার আসুন, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতটা পর্যালোচনা করা যাক।উষর মরুতে বিকশিত সেই ফুলের গাছটার উত্থান পর্যবেক্ষন করি,যার চারদিকে কাটা বিছিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল।
এই সেই যুবক
আরবের এক বিশিষ্ট,সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারে, নির্মল স্বভাব বিশিষ্ট এক ভাগ্যবান দম্পতির গৃহে এক ব্যতিক্রমী শিশু পিতৃহীন অবস্থায় জন্ম গ্রহন করে।সে জনৈকা দরিদ্র ও সুশীলা ধাত্রীর দুধ খেয়ে গ্রামের সুস্থ ও অকৃত্রিম পরিবেশে প্রকৃতির কোলে লালিত পালিত হয় ও বেড়ে ওঠে।সে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে মরুভুমিতে ছুটাছুটি করতে করতে জীবনের কর্মক্ষেত্রে চরম বিপদ মুসিবত ও দুঃখ কষ্ট মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং ছাগল ভেড়া চরিয়ে চরিয়ে এক বিশ্বজোড়া জাতির নেতৃত্ব করার প্রশিক্ষন গ্রহন করে।শৈশবের পুরো সময়টা অতিবাহিত করার আগেই এই ব্যতিক্রমী শিশু মায়ের স্নেহময় ছায়া থেকে ও বঞ্চিত হয়।দাদার ব্যক্তিত্ব পিতামাতার এই শুন্যতা খানিকটা পুরন করতে পারলে ও কিছুদিন যেতে না যেতেই এই আশ্রয় ও তার হাতছাড়া হয়ে যায়।অবশেষে চাচা হন অভিভাবক।এ যেন কোন পার্থিব আশ্রয়ের মুখাপেক্ষী না হয়ে একমাত্র আসল মনিবের আশ্রয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি পর্ব।
যৌবনে পদার্পন করা পর্যন্ত এ ব্যতিক্রমী কিশোরকে অন্যান্য ছেলেদের মত দুষ্ট ও বখাটে হয়ে নয়, বরং প্রবীনদের মত ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে দেখা যায়।যখন সে যৌবনে পদার্পন করে, তখন চরম নোংরা পরিবেশে লালিত পালিত হওয়া সত্ত্বে ও নিজের যৌবনকে নিষ্কলংক রাখতে সক্ষম হয়।যে সমাজে প্রেম,কু-দৃষ্টি বিনিময় ও ব্যভিচার যুবকদের জন্য গর্বের ব্যাপার, সেই সমাজে এই অসাধারন যুবক নিজের দৃষ্টিকে পর্যন্ত কলুষিত হতে দেয়না।যে সমাজে প্রত্যেক অলিতে গলিতে মদ তৈরীর কারখানা এবং ঘরে ঘরে পানশালা, যে সমাজে প্রত্যেক মজলিশে পরনারীর প্রতি প্রকাশ্য প্রেম নিবেদন ও মদ্যপানের বিষয়ে কবিতা পাঠের জমজমাট আসর বসে, সেখানে এই নবীন যুবক এক ফোঁটা মদ ও মুখে নেয়না।যেখানে জুয়া জাতীয় অনুষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহ করেছিল, সেখানে আপাদমস্তক পবিত্রতায়মন্ডিত এই যুবক জুয়ার স্পর্শ পর্যন্ত করেনা।রূপকথার গল্প বলা ও গান বাজনা যেখানে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেখানে ভিন্ন এক জগতের এই অধিবাসী এইসব অপসংস্কৃতির ধারে কাছেও ঘেষেনা।দু’একবার যদি ও এধরনের বিনোদনমুলক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ তার হয়েছিল,কিন্তু যাওয়া মাত্রই তার এমন ঘুম পায় যে, সেখানকার কোন অনুষ্ঠানই তার আর দেখা্ ও শোনার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।যে সমাজে দেবমূর্তির সামনে সিজদা করা ধর্মীয় প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেখানে হযরত ইবরাহিমের বংশধর এই পবিত্র মেজাজধারী তরুণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে মাথা ও নোয়ায়না এবং কোন মোশরেক সুলভ ধ্যান ধারণা ও পোষন করেনা।এমনকি একবার যখন তাকে দেবমূর্তির সামনে বলি দেয়া জন্তুর রান্না করা গোশত খেতে দেয়া হয়,তখন সে তা খেতে অস্বীকার করে।যেখানে কুরায়েশরা হজ্জের মৌসুমে আরাফাত ময়দানে না গিয়েই হজ্জ সম্পন্ন করতো, সেখানে এই অসাধারন কুরায়েশী যুবক এই মনগড়া নিয়মকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে।হযরত ইবরাহীমের বংশধরেরা যেখানে ইবরাহীমী আদর্শকে বিকৃত করে অন্য বহু অনাচার ছাড়াও দিগম্বর সেজে কা’বা শরীফ তওয়াফ করার জঘন্য বেদায়াত চালু করে,সেখানে এই লাজুক যুবক এক মুহুর্তের জন্যেও এই বেদায়াতকে গ্রহন করেনা।যে দেশে যুদ্ধ একটা খেলা এবং রক্তপাত, একটা তামাশায় পরিনত হয়েছিল সেখানে মানবতার সম্মানের পতাকাবাহী এই যুবক এক ফোটা ও রক্তপাত করেনি।তারুণ্যে এই যুবক ‘হারবুল ফুজ্জার’ নামক বিরাট যুদ্ধে অংশগ্রহন করতে হয়েছিল।কোরায়েশ গোত্রের এই যুদ্ধে অংশ গ্রহন ন্যায় সংগত ছিল বলে সে এই যুদ্ধে যোগদান করলে ও মানুষকে নিজে কোন আঘাত করেনি।
শুধু কি তাই? এই সতচরিত্র ও সত্যাশ্রয়ী যুবকের শখ কেমন তা ও দেখুন।যে বয়সে ছেলেরা সাধারনত বিপথগামী হয়ে থাকে, ঠিক সেই বয়সেই সে গরীব ও নিপিড়িত মানুষের সহায়তা এবং অত্যাচারীদের যুলুম উচ্ছেদের লক্ষে ‘হালফুল ফুজুল’ নামে একটা সংস্কারকামী সমিতিতে যোগদান করে।এতে যোগদানকারীরা তাদের উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নের অঙ্গিকার করে।
নবুয়ত লাভের পর রসূল সা.ঐ সমিতির স্মৃতি চারন করতে গিয়ে বলতেনঃ’
ঐ অঙ্গিকারের পরিবর্তে কেউ যদি আমাকে লাল রং এর উটও দিত, তবু ও আমি তা থেকে ফিরে আসতামনা।আজও কেউ যদি আমাকে ঐ রকমের কোন চুক্তি সম্পাদন করতে ডাকে, তবে আমি সেজন্য প্রস্তুত।’
এই যুবকের গুনাবলী ও যোগ্যতা কতখানি, তা এ ঘটনা থেকেই বুঝা যায় যে, কা’বা শরীফ সংস্কারের সময় হাজরে আসওয়াদ পুনস্থাপন নিয়ে কোরায়েশদের মধ্যে তীব্র অন্তর্দন্দ্ব দেখা দেয়।এটা এতদুর গড়ায় যে, তলোয়ার পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ে এবং সাজসাজ রব পড়ে যায়।কিন্ত ভাগ্রক্রমে এই গোলযোগ মিটমাট করার সুযোগটা এই যুবকই লাভ করে।চরম উত্তেজনার মধ্যে শান্তির পতাকাবাহী এই বিচারক একটা চাদর বিছিয়ে দেয় এবং চাদরের উপর রেখে দেয় হাজরে আসওয়াদ নামক সেই পাথর।তারপর সে কোরায়েশ গোত্রের সকল শাখার প্রতিনিধিদেরকে চাদর উত্তোলনের আহবান জানায়।
পাথর সমেত চাদর উত্তোলিত হয়ে যখন যথাস্থানে উপনীত হলো, তখন এই যুবক পাথরটা তুলে যথাস্থানে স্থাপন করলো।গোলযোগ থেমে গেল এবং সকলের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল ও উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।
এই যুবক যখন অর্থোপার্জনের ময়দানে পদার্পন করলো, তখন বাণিজ্যের ন্যায় পবিত্র ও সম্মানজনক পেশা বেছে নিল।দেশের বড় বড় পুঁজিপতি এই যুবককে তাদের পুঁজিগ্রহণ ও বাণিজ্য করার জন্য মনোনীত করে।এ যুবকের মধ্যে এমন গুণ নিশ্চয়ই ছিল যে জন্য তারা তাকেই মনোনীত করেছিল।সায়েব, কায়েস বিন সায়েব, হযরত খাদীজা এবং আরো কয়েক ব্যক্তি একে একে এই যুবকের অনুপম সততার বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে এবং তারা সবাই তাদে এক বাক্যে ‘তাজের আমিন’ বা ‘সৎ ব্যবসায়ী’ উপাধিতে ভূষিত করে।আব্দুল্লাহ বিন আবিল হামসার সাক্ষ্য আজও সংরক্ষিত রয়েছে যে, নবুয়তের পূর্বে একবার এই তরুণ সৎ ব্যবসায়ীর সাথে তাঁর কথা হয় যে, আপনি এখানে দাড়ান, আমি আসছি।কিন্তু পরে সে ভুলে যায়।তিন দিন পর ঘটনাক্রমে আব্দুল্লাহ ঐ জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পায়, ঐ সৎ ব্যবসায়ী আপন প্রতিশ্রুতির শেকলে আবদ্ধ হয়ে সেই জায়গায়ই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।সে আব্দুল্লাহকে বললো, ‘তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ।আমি তিন দিন ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।’- আবু দাউদ
তারপর দেখুন, এ যুবক জীবন সংগিনী নির্বাচন করার সময় মক্কার উঠতি যৌবনা চপলা চঞ্চলা মেয়েদের দিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত না করে এমন এক মহিলাকে বিয়ে করে, যার সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য এইযে, তিনি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের সতী সাধ্বী ও সচ্চরিত্র মহিলা।তার এ নির্বাচন তাঁর মানসিকতা ও স্বভাব চরিত্রের গভীরতাকেই ফুটিয়ে তোলে।বিয়ের প্রস্তাব হযরত খাদীজাই পাঠান, যিনি এই যুবকের অতুলনীয় সততা ও নির্মল চরিত্র দেখে অভিভূত হয়েছিলেন।আর যুবকও এ প্রস্তাব সর্বান্তকরণে গ্রহণ করে।
এছাড়া কোন ব্যক্তির চরিত্র ও মানসিকতাকে যদি তাঁর বন্ধুবান্ধব ও সহচরদেরকে দেখে যাচাই করতে হয়, তাহলে আসুন দেখা যাক কেমন লোকেরা এ যুবকের বন্ধু ছিল?
সম্ভবত হযরত আবু বকরের সাথেই ছিল তাঁর সবচেয়ে গভীর বন্ধুত্ব ও সবচেয়ে অকৃত্রিম সম্পর্ক।একে তো সমবয়সী, তদুপরি সমমনা।তার অপর এক বন্ধু ছিল হযরত খাদীজার চাচাতো ভাই হাকীম বিন হিযাম।এই ব্যক্তি হারাম শরীফের একজন খাদেম ছিলেন। [অষ্টম হিজরী পর্যন্তও তিনি ঈমান আনেননি।কিন্তু তবুও রসূল (সাঃ) এর সাথে গভীর বন্ধুত্ব ও প্রীতি বজায় রাখতেন।এই বন্ধুত্বের কারনেই একবার পঞ্চাশ আশরাফী দিয়ে একটা মূল্যবান পোশাক কিনে মদীনায় এসে রসূল (সাঃ) কে উপহার দেন।কিন্তু রসুল (সাঃ) অনেক পীড়াপীড়ী করে তাকে ঐ পোশাকের মূল্য দিয়ে দেন।] দেমাদ বিন সা’লাবা আযদী নামক একজন চিকিৎসকও ছিল তাঁর অন্যতম বন্ধু।কই, এ যুবকের বন্ধু মহলে একজনও তো নীচ, হীন, বদ অভ্যাস, যুলুমবাজ ও পাপাচারী লোক দেখা যায়না!
এই যুবক সাংসারিক, ব্যবসায়িক ও অন্যান্য দুনিয়াবী ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে যখনই কিছু সময় অবসর পেয়েছে, তখন তা আমোদ ফূর্তি ও বিনোদনে কাটায়নি।যত্রতত্র ঘোরাঘোরি করে, আড্ডা দিয়ে, অথবা অলসভাবে ঘুমিয়ে কাটায়নি।বরং সমস্ত হৈ হাঙ্গামা থেকে দূরে সরে ও সমস্ত কর্মব্যস্ততা পরিহার করে নিজের নির্মল ও নিষ্কলুষ সহজাত চেতনা ও বিবেকের নির্দেশক্রমে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করতো হেরা গুহার নিভৃত প্রকোষ্ঠে গিয়ে।বিশ্বজগতের প্রচ্ছন্ন মহাসত্যকে হৃদয়ংগম করা ও মানব জীবনের অদৃশ্য রহস্যগুলোকে জানার জন্য আপন সত্তায় ও বিশ্ব প্রকৃতির অতলান্তে চিন্তা গবেষণা চালাতো।সে ভাবতো, কিভাবে আপন দেশবাসী ও গোটা মানবজাতিকে নৈতিকহীনতা ও নীচতা থেকে টেনে তুলে ফেরেশতার পর্যায়ে উন্নীত করা যায়।যে যুবকের যৌবনের অবসর সময় ব্যয় হলো এরূপ একান্ত চিন্তা গবেষণা কার্যে, তাঁর উঁচু ও পবিত্র স্বভাব সম্পর্কে মানবীয় বিবেক বুদ্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি-কি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা?
দৈনন্দিন জীবনের এ জাতীয় ঘটনাবলী নিয়ে ভবিষ্যতের বিশ্বনবী কোরায়েশদের চোখের সামনেই মক্কী সমাজের কোলে লালিত পালিত হতে থাকে, ক্রমে যৌবনে পদার্পন করে এবং পরিপক্কতা লাভ করে।জীবনের এই চিত্র কি বলে দিচ্ছিলনা যে, এ যুবক এক অসাধারণ মহামানব? এভাবে বেড়ে ওঠা ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কি কোনভাবে এম ধারণা পোষোণ করা চলে যে, ইনি কোন মিথ্যাচারী ও ধাপ্পাবাজ মানুষ হতে পারে? কিংবা হতে পারেন কোন পদলোভী, স্বার্থপর কিংবা ধর্মকে পুঁজি করে ব্যবসায় ফেঁদে বসা কোন ধর্মব্যবসায়ী? কক্ষনো নয়।খোদ কোরায়েশরাই তাঁকে সাদেক(সত্যবাদী) আমীন (বিশ্বাসী ও সৎ) জ্ঞানীগুণি, পবিত্রাত্না, ও মহৎ চরিত্রধারী মানুষ বলে স্বীকার করেছে এবং বারংবার করেছে।তার শত্রুরাও তাঁর মণীষা ও নৈতিকতার শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দিয়েছে এবং কঠিনতম দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যেও দিয়েছে।সত্যের এই মহান আহবায়কের জীবন চিত্রকে কুরআন নিজেও সাক্ষী হিসেবে পেশ করে তাঁকে বলতে বলেছেঃ [আরবীঃ ************]
‘আমি তো এর আগেও তোমাদের মাঝেই জীবনের একটা অংশ অতিবাহিত করেছি, তবুও কি তোমাদের বুঝে আসেনা?’ (ইউনুস, ১৬০)
কিন্তু জাতির এই উজ্জ্বল রত্নটি যখন নবুয়তের পদে অধিষ্ঠিত হয়ে সত্যের বাণী পেশ করলো, তখন তাদের মনোভাব সহসাই পালটে গেল।তার সততা, সত্যবাদিতা, ভদ্রতা, মহত্ব ও বংশীয় শ্রেষ্ঠত্ব সব কিছুরই মূল্য কমে গেল।কাল পর্যন্ত যে ব্যক্তি জাতির চোখের মনি ছিল, আজ সে দুশমন, বিদ্রোহী ও জাতির কলংক খেতাব পেল।কাল পর্যন্ত যাকে প্রতিটি শিশু পর্যন্ত সম্মান করতো, আজ সে সকলের ক্রোধভাজন।দীর্ঘ চল্লিশোর্ধ বছর ধরে যে ব্যক্তি নিজেকে নিষ্কলুষ প্রমাণ করেছেন, তিনি আজ আল্লাহর একত্ববাদ, সত্য ও ন্যায়ের বাণী শোনানো মাত্রই কোরায়েশদের চোখে খারাপ হয়ে গেলেন! আসলে তিনি খারাপ ছিলেন না।বরং কোরায়েশের মূল্যায়নকারীদের চোখেই ছিল বক্রতা এবং তাদের মানদন্ডই ছিল ভ্রান্ত।
কিন্তু সত্যই কি কোরায়েশদের চোখ এত অন্ধ ছিল যে, ঘোর তমসাচ্ছন্ন পরিবেশে এমন আলোকময় একটা চাঁদকে তারা দেখতে পায়নি? চরিত্রহীনদের সমাবেশে সৎ চরিত্রবান একজন নেতাকে দেখে কি তারা চিনতে পারেনি? আস্তাকুড়ে পড়ে থাকা মুক্তার একটা মালা কি তাদের নজর কাড়তে পারেনি? অসভ্য ইতর মানুষদের সমাজে এই আপাদমস্তক ভদ্রতা ও শিষ্টাচারে মন্ডিত ব্যক্তি কি নিজের যথোচিত আদর ও কদর আদায় করতে পারেন নি? না, তা নয়।কোরায়েশরা ভালোভাবেই জানতো মুহাম্মদ কেমন মানুষ।কিন্তু জেনে শুনেও তারা চোখে ঠুলি পরেছিল।স্বার্থপরতা ও বিদ্বেষ তাদেরকে চোখ থাকতে অন্ধ বানিয়ে দিয়েছিল।যেমন কুরআনে বলা হয়েছেঃ ‘তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখতে পায়না।’ চোখ থাকতে যারা অন্ধ হয় তাদের দ্বারা হেন বিপদ নেই যা ঘটতে পারেনা এবং হেন বিপর্যয় নেই যা দেখা দিতে পারেনা।
কোরায়েশদের বিরোধিতার কারণ
আজ যদি আমরা কোনভাবে মক্কার কোরায়েশদের সাথে কথা বলতে পারতাম তাহলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতাম, তোমাদের গোত্রের এই নয়নমনি যে দাওয়াতটা দিয়েছিল, তাতে সে মূলত কোন্ খারাপ কাজটার প্ররোচনা দিয়েছিল? সে কি তোমাদের চুরি ডাকাতি করার আহবান জানিয়েছিল? সে কি তোমাদের হত্যা ও লুটতরাজ করতে ডেকেছিল? সে কি এতীম, বিধবা ও দুর্বলদের যুলুম নির্যাতন ও শোষণ চালানোর কোন পরিকল্পনা পেশ করেছিল? সে কি তোমাদের পারস্পরিক লড়াই চালাতে ও গোত্রে গোত্রে কোন্দল বাধাতে উস্কানি দিয়েছিল? সে কি কোন বিত্তবৈভব গড়া ও ভূ-সম্পত্তি বানানোর জন্য কোন সমিতি গঠন করতে চেয়েছিল? তোমরা তার ডাকে কী অসুবিধা দেখেছিলে? তার কর্মসূচীতে কোন্ বিপর্যয় অনুভব করেছিলে? কী কারণে তোমরা তার বিরুদ্ধে আদাপানি খেয়ে লেগেছিলে?
যে জিনিসটি জাহেলিয়াতের ভ্রান্ত ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে এবং পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কোরায়েশদের উন্মত্ত করে তুলেছিল, সেটা রসূল সাঃ এর চিন্তা ও চরিত্রের কোন ত্রুটি এবং তাঁর দাওয়াতের কোন মারাত্নক ক্ষতিকর ছিলনা।এর কারন এও ছিলনা যে, তাঁর আন্দোলন তৎকালীন জাহেলী সমাজকে পশ্চাদপদতার দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল।বরং সে জিনিসটি ছিল শুধুমাত্র কোরায়েশদের স্বার্থপরতা।শত শত বছর ধরে গঠিত আরবীয় সমাজ কাঠামোতে কোরায়েশরা নিজেদের জন্য একটা উচ্চ নেতৃত্বের আসন দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।সমস্ত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পদ তাদের কুক্ষিগত ছিল।অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে তাদের আধিপত্য ছিল অদম্য।এক কথায় গোটা আরব জাতির তারাই ছিল হর্তাকর্তা ও কর্ণধার।তাদের এই অবিসংবাদিত নেতৃত্ব ও আধিপত্য শুধু সেই ধর্মীয়,সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামোতেই চলতে সক্ষম ছিল, যা জাহেলী যুগ থেকে চলে আসছিল।তারা যদি সচেতন ও অবচেতনভাবে নিজেদের এই সর্বময় নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে টিকিয়ে রাখতে বাধ্য থেকে থাকে, তবে তারা তাদের জাহেলী সমাজ ব্যবস্থাকেও সব রকমের আক্রমণ ও অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে বাধ্য ছিল।
কোরায়েশ গোত্র যেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে আরবদের নেতা ও পরিচালক ছিল, সেখানে তারা আরবদের পৌত্তলিক ধর্মের পুরোহিত, ধর্মীয় তীর্থস্থানগুলোর রক্ষক ও সেবক এবং যাবতীয় ধর্মীয় তৎপরতার একচ্ছত্র ব্যবস্থাপকও ছিল।এই ধর্মীয় একচ্ছত্র ব্যবস্থাপনা ও সর্বময় কর্তৃত্ব তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্তৃত্বেরও পৃষ্ঠপোষক ছিল এবং এটা স্বতন্ত্রভাবে একটা বড় রকমের ব্যবস্থাও ছিল।এর কারণে আরব উপদ্বীপের প্রতিটি অঞ্চল থেকে তাদের কাছে নযর নিয়ায তথা উপঢৌকনাদি আসতো।এর কারণে তারা প্রগাঢ় ভক্তিশ্রদ্ধার পাত্র ছিল।লোকেরা তাদের কদমবুছি করতো।ধর্ম যখন কোন শ্রেণী বা গোষ্ঠীর ব্যবসায়ে পরিণত হয় তখন তার আসল প্রেরণা, চেতনা ও প্রাণশক্তি লোপ পায় এবং রকমারি আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ একটা নিরেট প্রদর্শনীমূলক তামাশার রূপ ধারণ করে।ধর্মের নীতিগত দাবী কি, তা আর কেউ মনে রাখেনা।তখন মনগড়া ঐতিহ্য ও অনুষ্ঠানাদি মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী হয়ে দাঁড়ায়।আল্লাহর দেয়া ওহী ভিত্তিক জ্ঞান ও আইন কানুন তখন উধাও হয়ে যায় এবং ধর্মব্যবসায়ীদের তৈরী করা এক অভিনব শরীয়ত বিকাশ লাভ করে।যৌক্তিকতা বিলুপ্ত হয়ে যায়।অন্ধ বিশ্বাস ও অলীক ধ্যানধারণা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।সাক্ষ্য প্রমাণ সহকারে বক্তব্য দেয়ার রীতি উধাও হয়ে যায়।আবেগ উত্তেজনা বিবেকবুদ্ধির কন্ঠরোধ করে।ধর্মের গণমুখী ও গণতান্ত্রিক মেযাজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং ধর্মব্যবসায়ীদের একনায়কত্ব সমাজের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে পড়ে।প্রকৃত জ্ঞান অবলুপ্ত হয়ে যায় এবং ভিত্তিহীন কথাবার্তা জনপ্রিয়তা লাভ করে।সহজ সরল আকীদা বিশ্বাস ও বিধিমালার পরিবর্তে কথায় কথায় জটিল ও পেঁচালো বিধিনিষেধ জারী করা হয়।দ্বিমত পোষণের অধিকার সম্পূর্ণরূপে হরণ করা হয় এবং একটা গোষ্ঠীর স্বৈরাচারী কর্তৃত্ব অবাধে চালু হয়ে যায়।সত্য, সততা, সৌজন্য ও খোদাভীতির নাম নিশানাও অবশিষ্ট থাকেনা এবং ধর্ম একটা প্রতারণাময় বহুরূপী কারবারের রূপ ধারণ করে।যখনই কোন ধর্মের বিকৃতি ঘটেছে, তখন এই প্রক্রিয়াতেই তা ঘটেছে।আরবের জাহেলী সমাজে এই বিকৃতি নিকৃষ্টতম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল।এই বিকৃতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল কোরায়েশ গোত্রের ধর্মীয় পৌরহিত্যের গদি।এই বিরাট লাভজনক ক্ষমতার গদিকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঐ বিকৃত ধর্মীয় আবহ ও অবকাঠামোকে বহাল রাখা আবশ্যক ছিল।তার বিরুদ্ধে কোন বাদ প্রতিবাদ ও ভিন্নমতের আওয়ায তোলা এবং কোন ধরনের সংস্কার ও সংশোধনের আহবান জানানো যাতে না হয়, তার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য ছিল।সুতরাং কোরায়েশ গোত্র যে ইসলামের দাওয়াতে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে সেটা ছিল সম্পূর্ন স্বাভাবিক।
তা ছাড়া, কোরায়েশদের সংস্কৃতি ছিল চরম পাপাচারী সংস্কৃতি।মদ্যপান, ব্যভিচার, জুয়া, সুদখোরী, নারী নির্যাতন, মেয়ে শিশুকে জ্যান্ত মাটিতে পুতে ফেলা, স্বাধীন মানুষকে গোলাম বানানো এবং দুর্বলদের ওপর যুলুম করা এসবই ছিল কোরায়শ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট।শত শত বছরব্যাপী পুঞ্জীভূত বদভ্যাস ও গৌরবময় জাতীয় ঐতিহ্যের রূপ ধারণকারী কদর্য সমাজপ্রথার সমন্বয়েই গঠিত ছিল এ সংস্কৃতি।নিজেদের হাতে গড়া এই সাংস্কৃতিক লৌহ খাঁচা ভেঙ্গে একটা নতুন পরিবেশে বিচরণ করতে প্রস্তুত হওয়া কোরায়েশদের জন্য সহজ ছিলনা।তারা সংগে সংগেই বুঝতে পেরেছিল যে, মুহাম্মদ সাঃ এর দাওয়াত তাদের চিরাচরিত রীতি-প্রথা, আদত অভ্যাস, কামনা-বাসনা, ললিতকলা তথা তাদের প্রিয় সংস্কৃতির শত্রু।তাই তারা প্রচন্ড আবেগে উদ্বেলিত হয়ে ঐ দাওয়াতের বিরোধিতা করতে বদ্ধপরিকর হয়ে যায়।
আসলে এ সব কারণেই প্রতিষ্ঠিত বিকৃত সমাজব্যবস্থার কর্ণধাররা, ধর্মীয় ঠিকাদাররা এবং প্রবৃত্তির পূজারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে চিরকাল সত্যের দাওয়াতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
ঘোর অন্ধকারে কয়েকটা আগুনের ফুলকি
রসূল সাঃ এর নবুয়ত লাভের আগে আরবের কিছু প্রতিভাধর ব্যক্তির মনে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল।মহাবিশ্বে বিরাজমান প্রাকৃতিক নিদর্শনাবলীতে প্রতিফলিত খোদায়ী আভাস ইংগিতের ভিত্তিতে চলমান সমাজ, পরিবেশ ও পৌত্তলিক ধর্মের প্রতি তাদের সৃষ্টি হ্য় অনাস্থা ও বিরাগ।এ অবস্থা তাদের মনকে অশান্ত ও স্বতস্ফূর্ত প্রতিবাদে সোচ্চার করে তুলেছিল।একটু আগেই আমরা যে ক’জন সংবেদনশীল ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছি, তাদের অন্তরাত্না থেকেও পরিবর্তনের অস্পষ্ট আকুতি ফুটে উঠেছিল।
একদিন কোরায়েশ জনতা একটা প্রতিমার চারপাশে সমবেত হয়ে একটা উৎসব উদযাপন করছিল।তারা ঐ পাথুরে দেবমূর্তির ভজন গাইছিল।ভক্তি নিবেদন করছিল, তার ওপর নিভিন্ন নজর নেয়ায চড়াচ্ছিল, এবং তওয়াফ করছিল।ঠিক এই সময় চার ব্যক্তি ওয়ারাকা ইবনে নওফেল, আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ, উসমান ইবনুল হুয়াইরিছ এবং যায়েদ বিন আমর এই অর্থহীন উৎসবের প্রতি বিরক্ত হয়ে দূরে একটা আলাদা জায়গায় বসে গোপন বৈঠক করছিল।তারা পরস্পরের বক্তব্যের গোপনীয়তা রক্ষার শপথ গ্রহণের পর আলাপ আলোচনা চালায়।তাদের সর্বসম্মত অভিমত ছিল এরুপঃ ‘আমাদের জনগণ একেবারেই ভিত্তিহীন একটা মতাদর্শের ওপর চলছে।নিজেদের দাদা ইবরাহীমের ধর্মকে তারা বর্জন করেছে।যে পাথর নির্মিত মুর্তির উপাসনা করা হচ্ছে, তা দেখেও না, শোনেওনা, কারো উপকারও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারেনা।সাথীরা, তোমরা নিজ নিজ বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস কর, তাহলে আল্লাহর কসম, তোমরা বুঝতে পারবে যে, তোমাদের কোন ভিত্তি নেই।দুনিয়ার দেশে দেশে সফর কর এবং খোঁজ নাও, ইবরাহীমের ধর্মের সত্যিকার অনুসারী কেউ কোথাও আছে কিনা। [সীরাত ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৪২] পরে তাদের মধ্য থেকে ওয়ারাকা ইবনে নওফেল খৃষ্টান হয়ে যায়।আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ প্রথমে অস্থিরতার বশে মুসলমান হয়ে যায় এবং পরে আবার অস্থিরতার বশেই খৃষ্টান হয়ে যায়।উসমান রোম সম্রাটের কাছে গিয়ে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করে।আর যায়েদ ইহুদী বা খৃষ্টান কোনটাই হলোনা, আবার পৌত্তলিকতাও পরিত্যাগ করলো।সে মৃত প্রাণির গোশত, রক্ত, এবং বেদীতে বলি দেয়া পশুর গোশত খাওয়া ছেড়ে দিল এবং মেয়ে শিশু হত্যা করতে লোকজনকে নিষেধ করতে লাগলো।সে বলতোঃ ‘আমি ইবরাহীমের প্রভুর ইবাদত করি’। [সীরাত ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৪২] হযরত আবু বকরের মেয়ে আসমা বলেন, ‘আমি বুড়ো গোত্রপতি যায়েদকে কা’বা শরীফের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখেছি।সে বলছিল, ‘হে কুরাইশ জনতা, আল্লাহর শপথ, আমি ছাড়া তোমাদের কেউ ইবরাহীমের ধর্ম অনুসরণ করছেনা।’ তারপর সে বললো, ‘হে আল্লাহ, আমি যদি জানতাম কোন্ নিয়ম তোমার পছন্দ, তা হলে সেই নিয়মেই তোমার ইবাদত করতাম।কিন্তু আমি জানিনা।তারপর সে হাতের তালু মাটিতে রেখে সিজদা করতো। [সীরাত ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৪২] তার সাথে কেউ সাক্ষাত করতে গেলে সে প্রায়ই এই কবিতাটা পড়ে শোনাতো, যার অর্থ হলোঃ “রব কি একজন হওয়া উচিত’ না হাজার হাজার? জীবনের সমস্যাগুলো যখন একাধিক রবের মধ্যে বন্টিত হয়ে যায়, তখন আমি কোন রবের আনুগত্য করবো”।
‘আমি লাত ও উযযা সবাইকে ত্যাগ করেছি।দৃঢ়চেতা ও ধৈর্যশীল লোকেরা এমনটিই করে থাকে।’
‘তবে হাঁ, আমি আমার দয়াময় রহমানের ইবাদত অবশ্যই করতে থাকবো, যাতে সেই ক্ষমাশীল প্রভু মাফ করে দেন আমার গুনাহগুলো।’
‘সুতরাং তোমরা একমাত্র আল্লাহকে ভয় করার নীতি অব্যাহত রাখ, যতক্ষণ এটা অব্যাহত রাখবে, তোমরা ধ্বংস হবে না ততক্ষণ।’
বেচারা যায়েদের স্ত্রী সফিয়া বিনতুল হাযরামী অনবরত তার পেছনে লেগে থাকতো।কখনো কখনো যায়েদ প্রকৃত ইবরাহীমি ধর্মের অন্বেষণে মক্কা ছেড়ে বেরুতে চাইত।কিন্তু তার স্ত্রী এটা খাত্তাব বিন নুফাইলকে আগে ভাগে জানিয়ে দিত।আর খাত্তাব পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করার জন্য তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করতো।যায়েদ নিজের মতের প্রতি এত উৎসর্গীত ছিল যে, কা’বা শরীফের চত্তরে প্রবেশ করা মাত্রই বলে উঠতো।
‘হে সত্য প্রভু! আমি তোমার কাছে আন্তরিকতার সাথে ও দাসত্বের মনোভাব নিয়ে ইবাদত করার জন্য হাজির হয়েছি।’ তারপর আরো বলতো, ‘আমি কা’বার দিকে মুখ ক’রে সেই সত্তার কাছে আশ্রয় চাই, যার কাছে হযরত ইবরাহীম আশ্রয় চাইতেন।’ [সীরাত ইবনে হিশাম পৃঃ ২৪৮]
খাত্তাব বিন নুফাইল যায়েদকে কষ্ট দিত।এক পর্যায়ে সে তাকে মক্কার বাইরে নির্বাসিত করে।যায়েদ মক্কার উপকন্ঠে হেরার কাছে অবস্থান করতে থাকে।এরপর খাত্তাব কুরাইশ গোত্রের কিছু যুবক ও দুশ্চরিত্র লোককে তার প্রহরী নিযুক্ত করে এবং তাকে মক্কায় প্রবেশ করতে না দেওয়ার নির্দেশ দেয়।যায়েদ কখনো লুকিয়ে মক্কায় আসতো।খাত্তাব ও তার সাথীরা টের পেলে তাকে আবার বিতাড়িত করতো।তারা তাকে ধর্ম বিকৃত করার দায়ে খুবই ঘৃণার সাথে নির্যাতন করতো।অবশেষে বিরক্ত হয়ে সে দেশ ছেড়ে চলে যায় এবং মোসেল, সিরিয়া প্রভৃতি স্থানে হযরত ইবরাহীমের ধর্মের অন্বেষণে ঘুরে বেড়াতে থাকে।অবশেষে সে দামেস্কের রোলকা এলাকায় জনৈক বিদ্বান দরবেশের সন্ধান পেল এবং তার কাছে গিয়ে হযরত ইবরাহীমের ধর্মের সন্ধান জানতে চাইল।দরবেশ বললো, ‘আজ আর তুমি এই ধর্মের অনুসারী একজন মানুষও পাবে না।তবে এই ধর্মের পতাকাবাহী একজন নবী শীঘ্রই আবির্ভূত হবেন এবং তুমি যে জায়গা থেকে এসেছ, সেখানেই আবির্ভূত হবেন।যাও, তার সাথে সাক্ষাত কর।` যায়েদ ইহুদী ও খৃষ্টান ধর্ম ভালো করেই পরখ করে দেখেছিল।ঐ দুই ধর্ম তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি।সে দরবেশের উপদেশ অনুসারে মক্কার দিকে ছুটে চললো।কিন্তু পথিমধ্যে ‘বিলাদ লাখাম’ নামক স্থানে লোকেরা তাকে হত্যা করে। [সীরাত ইবনে হিশাম, (প্রথম খন্ড, পৃঃ ২৪৯,২৫০)]
এই যায়েদের পুত্র সাঈদ ও হযরত ওমর ইসলামের আবির্ভাবের পর রসূল সা. কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, আমরা যায়েদের গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করতে পারি কিনা? রসূল সা. বলেনঃ ‘হা, কারণ সে কেয়ামতের দিন একটা স্বতন্ত্র উম্মত হিসাবে ওঠবে।` অর্থাৎ কোন ব্যক্তির তার নির্মল স্বভাবের কাছ থেকে যতটুকু পথ নির্দেশ পাওয়া সম্ভব, তা পেয়েই যায়েদ পূর্ণ আন্তরিকতা সহকারে তা গ্রহণ করেছে, অতঃপর সে ওহীর হেদায়াত লাভের জন্য অনেক ছুটাছুটি করেছে।সর্বশেষে সে রসূল সা. এর কাছে রওনা হয়েছিল, কিন্তু এই সত্য সন্ধানের পথেই সে শহীদ হলো।
এই দীর্ঘ বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, ইতিহাস একটা নতুন মোড় নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল এবং মানবীয় বিবেক অশান্ত হয়ে উঠেছিল।কিন্তু প্রকৃতির অস্পষ্ট আভাস ছাড়া কোন আলোর দিকনির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছিলনা।বিকৃত ধর্মচর্চা ও অযৌক্তিক আনুষ্ঠানিকতার পরিবেশ মানুষের স্বকীয়তার টুটি চেপে ধরেছিল।মানুষ ছিল স্থবিরতার চার দেয়ালে বন্দী।সংবেদনশীল লোকেরা হয় খৃস্টধর্মের মনযিলে এসে থেমে গিয়েছিল।কেননা পরিবেশ এর অনুকুল ছিল।নচেত তারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল।কিন্তু চলমান ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে জেহাদ করা খুবই কঠিন ব্যাপার ছিল।উল্লেখিত চার ব্যক্তির মধ্যে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছিল।তাদের মধ্যে কেবল যায়েদ এতটা সাহস দেখিয়েছে যে, হারাম শরীফে বসে এক আল্লাহকে ডেকেছে এবং কুরাইশদের সামনে পৌত্তিলিকতাকে ধিক্কার দিয়েছে।কিন্তু সেও অস্থিরতা প্রকাশ ও প্রতিবাদ করার চেয়ে বেশী কিছু করতে পারে নি।কেননা তার সামনে কোন এমন সুস্পষ্ট ও পূর্ণাংগ আদর্শ ছিলনা, যাকে সে দাওয়া ও আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।তবুও মক্কা তার অস্তিত্ব বরদাশত করতে অস্বীকার করেছে।
জাহেলী সমাজে কবিদের বিশেষ মর্যাদা ছিল।তারা মানুষের মনস্তাত্মিক নেতৃত্বও দিত।তাদের কবিতা ছিল তৎকালীন সমাজের মানসিকতা ও চিন্তাধারার দর্শন।সমাজের বিবেকের অস্থিরতার ছাপ রসূল সা. এর অব্যবহিত-পূর্ববর্তী যুগের জাহেলী কবিদের কবিতায় প্রতিফলিত হতো।এ সব কবিতায় অনেক সময় মানবীয় বিবেক মৌলিক সত্য নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠতো।
এ সব কবির মধ্যে একজন হচ্ছেন তায়েফের বিশিষ্ট সরদার উমাইয়া বিন আবিস্ সাল্ত।ইনি তাওহীদ, কেয়ামত ও কর্মফল সম্পর্কে ভালো ধ্যান-ধারণা পেশ করেছেন।তাছাড়া বেশ কিছু নৈতিক উপদেশও তার কবিতায় রয়েছে।ইনিও পৌত্তলিক চিন্তাধারার প্রতি বিদ্রোহী ছিলেন।কিন্তু রসূল সা. এর দাওয়াতকে গ্রহণের সৌভাগ্য লাভ করেননি।রসূল সা. তার কবিতাকে পছন্দ করতেন এবং বলতেন, এই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল।
এ ধরনের সচেতন ব্যক্তিবর্গের মানসিক আলোড়ন পর্যবেক্ষণ করলে মনে হয়, পরিবেশ একটা নতুন প্রাণোচ্ছল বাণী লাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল।
ইতিহাস যে বিপ্লবী শক্তির প্রতীক্ষায় ছিল, তা উপযুক্ত সময়েই মুহাম্মদ সা. এর মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছিল।তিনি শুধু নেতিবাচক প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে এবং নিজের ব্যক্তিগত মনমানস ও মহৎ চরিত্র নিয়েই উপস্থিত হননি, বরং একটা সর্বব্যাপী ইতিবাচক মতবাদ ও মতাদর্শ নিয়ে সমগ্র জাতি ও সমগ্র পরিবেশের আমূল পরিবর্তন সাধনের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন।আরবের তৎকালীন পরাক্রান্ত বাতিল শক্তির পক্ষে এই অপরাধকে (?) বরদাশত করা কিভাবে সম্ভব ছিল?
দাওয়াতের প্রথম যুগঃ গোপন প্রচার
নবুয়তের সূচনা যুগের প্রাক্কালে প্রস্তুতি স্বরূপ নিভৃত ধ্যানে মগ্ন থাকার সময় রসূল সা. কে বিভিন্ন সত্য স্বপ্ন দেখানো হতো।কখনো বা গায়েবী আওয়ায শুনতে পেতেন।কখনো ফেরেশতা দেখতে পেতেন।অবশেষে আল্লাহর আরশ থেকে প্রথম বাণী এলো।জিবরীল এসে সম্বোধন করলেনঃ (আরবী********)
এটা ছিল তাঁর ওহী লাভের প্রথম অভিজ্ঞতা।তিনি অনুভব করলেন যেন তার ঘাড়ের ওপর এক ভীতিময় ও বিরাট বোঝা চেপে বসেছে।বাড়ীতে ফিরে এসে নিজের জীবন সংগীনিকে ঘটনা অবহিত করলেন।তিনি সান্ত্বনা দিলেন যে, আপনার খোদা কখনো আপনাকে ছেড়ে দেবন না।ওয়ারাকা ইবনে নওফেল বললেন, এতো আল্লাহর সেই দূত, যিনি মূসা আ. ওপর অবতীর্ণ হয়েছিলেন।তিনি আরো বললেন, দেশের লোকেরা আপনাকে মিথ্যুক বলবে, উত্যক্ত করবে, দেশ থেকে বিতাড়িত করবে এবং আপনার সাথে যুদ্ধ করবে।আমি যদি সেদিন বেঁচে থাকি, তাহলে আমি আল্লাহর কাজে আপনাকে সমর্থন করবো।এরপর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আল্লাহ পক্ষ থেকে সত্যের দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত হলেন।তাঁর ওপর এক বিরাট দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হলো।এ দাওয়াতা সর্বপ্রথম হযরত খাদীজার সামনে উপস্থাপিত হলো এবং তিনিই লাভ করলেন এর প্রতি ঈমান আনয়নকারী প্রথম ব্যক্তির মর্যাদা।এরপর ধীর গতিতে গোপনে চলতে লাগলো এ কাজ।হযরত আবু বকর সিদ্দীক ছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু।দু’জনেরই মন মেযাজ ও রুচি ছিল একই রকম।তিনি যখন সত্যের দাওয়াত পেলেন, তৎক্ষণাত এমনভাবে তা গ্রহণ করলেন যেন তাঁর অন্তরাত্মা এরই জন্য আগে থেকে অপেক্ষমান ছিল।রসূল (সা) এর পালিত পুত্র যায়েদও তাঁর সাথী হলো।সে তাঁর জীবন ও চরিত্র দ্বারা আগে থেকেই প্রভাবিত ছিল।
এই ঘনিষ্ঠতম লোকদের তাঁর ওপর ঈমান আনা তার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সত্যবাদিতার একটা প্রমাণ।এই ব্যক্তিবর্গ কয়েক বছর ধরে তাঁর ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন এবং তাঁর ভেতর ও বাহির সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে অবহিত ছিলেন।রসূল সা. এর জীবন চরিত্র, চিন্তাভাবনা ও মানসিকতা সম্পর্কে এদের চেয়ে বেশী জানা কারো পক্ষে সম্ভব ছিলনা।এই ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তিবর্গ একেবারে সূচনাতেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে দিলেন যে, আহ্বায়কের সত্যবাদিতা ও আন্তরিকতা সন্দেহাতীত।
হযরত আবু বকর রা. রসূল সা. এর আন্দোলনের সৈনিক হওয়া মাত্রই নিজের প্রভাবাধীন লোকদের মধ্যে জোরে শোরে কাজ শুরু করে দিলেন।তিনি হযরত ওমর, ওসমান, যুবায়ের, আব্দুর রহমান বিন আওফ, সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস, তালহা রা. প্রমুখসহ বেশ কিছু সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে এ বিপ্লবী আন্দোলনের সদস্য বানিয়ে ফেললেন।অত্যন্ত সতর্কতা, গোপনীয়তা ও নীরবতার মধ্য দিয়ে তারা এ কাজের প্রসার ঘটাতে লাগলেন।ইসলামী আন্দোলনের এই গোপনীয় ও প্রাথমিক যুগে অন্যান্য যারা প্রথম কাতারের মুসলমানদের দলভুক্ত হন তাদের মধ্যে হযরত আম্মার, খাব্বাব, আরকাম, সাঈদ বিন যায়েদ, (ইতিপূর্বে আলোচিত যায়েদ বিন আমরের পুত্র, যিনি পিতার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন) আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, উসমান বিন মাযঊন, আবু উবাইদা, সুহায়েব রূমী প্রমুখ অন্যতম।
নামাযের সময় হলে রসূল সা. কোন পাহাড়ের ওপর চলে যেতেন এবং নিজের সাথীদের নিয়ে গোপনে নামায পড়ে আসতেন।শুধু চাশতের নামায কা’বার চত্তরে পড়তেন।কেননা ও নামায কুরাইশদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল।একবার রসুল সা. হযরত আলীকে সাথে নিয়ে কোন এক গিরিপথে নামায পড়েছিলেন।এ সময় তাঁর চাচা আবু তালেব তা দেখে ফেলেন।এই নতুন ধরনের নামায দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান এবং গভীর মনোযোগের সাথে তা দেখতে থাকেন।নামায শেষে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তোমরা এটা কোন ধর্ম অবলম্বন করলে? রসূল সা. বললেন, ’আমাদের দাদা ইবরাহীমের ধর্ম এটাই ছিল।’
একথা শুনে আবু তালেব বললেন, ’আমার পক্ষে তো এ ধর্ম গ্রহণ করা সম্ভব নয়।তবে তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি।কেউ তোমাদের বাধা দিতে পারবেনা। [সীরাতুন্নবী, শিবলী নুমানী, (প্রথম খন্ড, পৃঃ ১৯২)।]
হযরত আবু যরও ইসলামী আন্দোলনের এই গোপনীয়তার যুগে ঈমান এনেছিলেন।আল্লামা শিবলী নুমানীর মতে তাঁর ক্রমিক নম্বর ৬ষ্ঠ বা ৭ম।ইনিও সেই সব ব্যক্তির অন্যতম, যারা অস্থিরতায় ভুগছিলেন এবং মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে নিছক আপন নির্মল স্বভাব ও বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর যিকির ও ইবাদত করতেন।কোন না কোন উপায়ে তিনি রসূল সা. এর দাওয়াতের খবর পেয়ে গেলেন।অতঃপর নিজের ভাইকে সঠিক তথ্য জানার জন্য পাঠালেন।তাঁর ভাই রসূল সা. সাথে সাক্ষাত করলেন, তাঁর কুরআন তেলাওয়াত শুনলেন এবং ফিরে গিয়ে ভাইকে বললেন, ’আমি এই দাওয়াত দাতাকে দেখে এসেছি।লোকেরা তাকে ধর্মত্যাগী [বিকৃত সমাজ ব্যবস্হার বিচিত্র রূপ দেখুন।যে ব্যক্তি সারা দুনিয়ার মানুষকে ঈমানের শিক্ষা দিতে এসেছিলেন, তিনিই নাকি ধর্মচ্যুত! সকল যুগের ধর্ম ব্যবসায়ীরাই এ ধরনের ফতোয়া দিয়ে থাকে] বলে থাকে।কিন্তু তিনি মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী শিক্ষা দেন এবং এমন এক বিস্ময়ের বাণী শোনান, যা মানবীয় কবিতা থেকে একেবারেই অন্য রকম।তাঁর চালচলন তোমার চালচলনের মত।এরপর তিনি নিজে এলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন।
এ ঘটনা থেকে প্রমানিত হয়, গোপনীয়তা অবলম্বন করা সত্ত্বেও সত্যের সুবাস বাতাসের ওপর ভর করেই দিক থেকে দিগন্তে ছুটে যাচ্ছিল।এ সময়ে রসূল সা. কে নানা রকমের কু-খেতাব দেওয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিল।তথাপি পরিবেশ মোটামুটি শান্ত ও স্বাভাবিক ছিল।কেননা তখনো কুরাইশ নেতারা আসন্ন বিপদের গুরুত্ব অনুমান করতে পারেনি।
আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করুন, ইসলামী আন্দোলনের এই প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের মধ্যে একজনও এমন ছিলেন না, যিনি উচ্চতর জাতীয় ও ধর্মীয় পদে আসীন ছিলেন।এর ফলে তাঁরা সকল স্বার্থপরতার বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলেন।ইতিহাসে এ ধরনের স্বাধীনচেতা যুবকরাই বড় বড় পরিবর্তন সূচিত করার জন্য সম্মুখের কাতারে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে।নেতা ও পদস্থ ব্যক্তিরা কেউ এ কাজে অবদান রাখেনি।
গোপনীয় স্তরের এই ইসলামী আন্দোলনকে কুরাইশ নেতারা আদৌ গুরুত্ব দেয়ার যোগ্য মনে করেনি।তারা ভেবেছিল, এ-তো কতিপয় যুবকের পাগলামি।ওরা উল্টো পাল্টা কথাবার্তা বলে থাকে।কয়েকদিন পর আপনা থেকেই মাথা ঠিক হয়ে যাবে।আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মত বুকের পাটা কার আছে? এভাবে ক্ষমতার মসনদে আসীন লোকগুলো নিজেদের ক্ষমতার গর্বে এতই দিশেহারা ছিল যে, ঐ মসনদের ছায়ার নীচে তাদের অজান্তেই সত্যের চারাগুলো ক্রমে ক্রমে বেড়ে ওঠে ইতিহাসের মহীরূহে পরিণত হলো।কুরাইশদের এটাও ধারণা ছিল যে, লাত মানাত ও উযযার মত দেবতাদের আমরা যখন এত ভক্তি ও পূজা করি, তখন তারাই মান সম্মান ও পৌত্তলিক ধর্মের হেফাজত করবে।তাদের আধ্যাত্মিক অভিশাপ এই গুটিকয় তওহীদপন্থীর দেবদ্রোহিতাকে খতম করে দেবে।
প্রকাশ্য দাওয়াত
এভাবে তিন বছর কেটে গেল।কিন্তু একটা পরিস্থিতিকে চিরদিন একইভাবে থাকতে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়।তাঁর চিরাচরিত রীতি হলো, তিনি বাতিলের প্রতিরোধের জন্য সত্যকে সামনে নিয়ে আসেন এবং উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাধান।যেমন আল্লাহ বলেনঃ আমি বরং সত্যকে বাতিলের ওপর নিক্ষেপ করি, অতপর সত্য বাতিলকে আঘাত করে।এর ফলে বাতিল উৎখাত হয়ে যায়।’ -সূরা আল আম্বিয়া
আল্লাহর এই চিরাচরিত রীতি অনুসারে আদেশ জারী হলোঃ ‘তোমাকে যা নির্দেশ দেয়া হচ্ছে তা প্রকাশ করে দাও।’
রসূল সা. সমস্ত হিম্মত ও সাহস সঞ্চয় করে, নতুন সম্ভাব্য সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে একদিন সাফা পর্বতের ওপর এসে দাঁড়ালেন।তারপর তিনি আরবের বিশেষ রীতি অনুযায়ী কুরাইশ জনতাকে ডাক দিলেন।কোন বিপদের মুহূর্তে জনগণকে সাহায্যের জন্য একটা বিশেষ সাংকেতিক ধ্বনি দিয়ে ডাকার রেওয়াজ ছিল।তিনি সেই পদ্ধতি অবলম্বন করলেন।লোকেরা ছুটে এল।বিরাট জন সমাগম হলো।সবাই রুদ্ধশ্বাসে কান পেতে রইল কী হয়েছে জানার জন্য।
রসূল সা. প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেনঃ ‘আমি যদি তোমাদের বলি, এই পাহাড়ের অপর পাশে হানাদার বাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে ছুটে আসছে, তাহলে তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে?’
সবাই সমবেত স্বরে বলে উঠলোঃ হাঁ, কেন করবোনা? আমরা তোমাকে সব সময় সত্য কথাই বলতে দেখেছি।’
– তাহলে ওহে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর, ওহে আবদ মানাফের বংশধর, ওহে যাহরার বংশধর, ওহে তামীমের সন্তানেরা, ওহে মাখযুমের সন্তানেরা, ওহে আসাদের বংশধর, শোনো, আমি বলছি, তোমরা এক আল্লাহকে প্রভু ও উপাস্য মেনে নাও, নচেত তোমাদের ওপর কঠিন আযাব নেমে আসবে।এই বলে তিনি অতি সংক্ষেপে প্রথমবারের মত উন্মুক্ত দাওয়াত পেশ করলেন।
তাঁর চাচা আবু লাহাব কথাটা শোনা মাত্রই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো, ‘ওরে হতভাগা, তুই আজকের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যা। এই কথা বলার জন্যই কি আমাদের এখানে ডেকেছিলি?’ আবু লাহাব ও অন্যান্য নেতৃস্থানীয় লোকেরা খুবই ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গেল।
লক্ষণীয় যে, আবু লাহাবের পক্ষ থেকে, রসূলের দাওয়াতকে নিছক গুরুত্বহীন ও আমল দেয়ার অযোগ্য বলে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। এছাড়া অন্য কোন প্রতিক্রিয়া তখনো দেখা দেয়নি। অভিযোগটা শুধু এই ছিল যে, তুমি আমাদের অকারণেই কষ্ট দিয়েছ এবং আমাদের সময় নষ্ট করেছ।
প্রকাশ্য দাওয়াতের দ্বিতীয় পদক্ষেপটা নেয়া হলো এই যে, রসূল সা. আব্দুল মুত্তালিব পরিবারের লোকদের জন্য একটা ভোজের আয়োজন করলেন। এই ভোজে তাঁর চাচা হামযা, আবু তালিব ও আব্বাসের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গও যোগদান করেন। আহারের পর তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘আমি যে বিধান নিয়ে এসেছি তা ইহকাল ও পরকাল উভয়ের জন্যই কল্যাণের। এ কাজে আমার সাথী হবার জন্য কে কে প্রস্তুত? একথা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি দাওয়াতের সূচনালগ্নেই এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন যে, তিনি দুনিয়ার জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ধর্ম নয় বরং দুনিয়াকে কল্যাণময় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে পারে এমন ধর্ম নিয়েই এসেছেন।
তাঁর আবেদনে সমবেত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে নীরবতা বিরাজ করতে লাগলো। সহসা তেরো বছরের এক কিশোর নীরবতা ভংগ করে উঠে দাঁড়ালো। সে বললো, ‘যদিও আমি চোখের অসুখে আক্রান্ত, আমার পা দুর্বল, এবং আমি একজন কিশোর মাত্র, তবুও আমি আপনার সংগী হব।’ ইনি ছিলেন হযরত আলী রা.। পরবর্তীতে তিনি এ আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ প্রমাণিত হন।
একটা কিশোর ছাড়া আর কেউ সাড়া দিল না- এই দৃশ্য দেখে সমবেত জনতা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আব্দুল মুত্তালিবের বংশধররা এই অট্টহাসির মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে এ কথাই বললো যে, এই দাওয়াত, এই দাওয়াতদাতা এবং সাড়াদানকারী বালক মিলিত হয়ে কোন মহাবিপ্লব সাধন করবে? এ সব একটা তামাশা এবং একটা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। এ আহবানে সাড়া দেয়ার জন্য একটা বিদ্রুপাত্মক অট্টহাসিই যথেষ্ট।
এই দ্বিতীয় ঘটনায়ও পরিবেশের শান্তভাব কাটেনি। কিন্তু এরপর যখন তৃতীয় পদক্ষেপ নেয়া হল, তখন সমাজে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়ে তা ক্রমশ তীব্রতর হতে লাগলো।
এই তৃতীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করার আগে আরো একটা ঘটনার বর্ণনা জরুরী মনে হচ্ছে। আগেই বলেছি যে, প্রতিকূল পরিবেশের কারণে নামায গোপনে পড়া হতো, রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা শহরের বাইরে পাহাড়ের উঁচু নীচু স্থানে বা সমতলে যেয়ে যেয়ে নামায পড়ে আসতেন। একদিন এক পার্বত্য ঘাঁটিতে হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস অন্যান্য সাহাবীকে সাথে নিয়ে নামায পড়ার সময় মোশরেকরা দেখে ফেলে। নামায পড়ার সময়ই মোশরেকরা অশালীন কথাবার্তা বলতে শুরু করে দিল এবং নামাযের প্রতিটা কাজের ব্যংগ বিদ্রুপ করতে লাগলো। ওদিক থেকে যখন কোনই জবাব দেয়া হলো না, তখন তারা বিরক্ত হয়ে সন্ত্রাসী হামলা শুরু করে দিল। এই সংঘর্ষে জনৈক মোশরেকের তলোয়ারের আঘাতে সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. আহত হলেন। মক্কার মাটিতে এটাই ছিল আল্লাহর পথের প্রথম রক্তপাতের ঘটনা। এটা ছিল জাহেলী সমাজের প্রথম উন্মত্ত হিংস্র প্রতিক্রিয়া। এ প্রতিক্রিয়া থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, বিরোধিতা এখন হিংস্রতার পথে পা বাড়াতে শুরু করেছে।
উস্কানী ও উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি
ইসলামী আন্দোলনে ক্রমান্বয়ে চল্লিশ জন সহযোগী জুটে গেল। এভাবে ইসলামী সংগঠন একটা বাস্তব শক্তিতে পরিণত হলো। প্রকাশ্যে সত্যের কালেমা উচ্চারণের নির্দেশ ইতোমধ্যে দেয়াই হয়। এ নির্দেশ পালন করার জন্য রসূল সা. একদিন কা’বার চত্বরে দাঁড়িয়ে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিলেন। কিন্তু ধর্মীয় চেতনা যখন বিকৃত হয়ে যায়, তখন ধর্মীয় মূল্যবোধগুলো ভূলুণ্ঠিত হয়ে থাকে। তাই যে পবিত্র ঘর একদিন তাওহীদের বাণী প্রচারের কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চত্বরে আল্লাহর একত্বের কথা বলা ঐ কেন্দ্রের অবমাননার কারণ হিসাবে চিহ্নিত হলো। বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, অতগুলো মূর্তি স্থাপনে কা’বা শরীফের অবমাননা হয় না, মূর্তির সামনে কপাল ঘষলেও তার অবমাননা হয় না, উলংগ হয়ে তাওয়াফ করলে, উলু ধ্বনি দিলে এবং তালি বাজলেও তার পবিত্রতাহানি হয় না। দেবদেবীর নামে জানোয়ার বলি দিলে এবং পুরোহিতগিরি ও খাদেমগিরির কর আদায় করলেও কা’বার অপমান হয় না। অপমান হয় শুধু ঐ ঘরের আসল মালিকের নাম নিলেই।
আওয়াজ উঠলোঃ ‘কা’বার অবমাননা করা হয়েছে, হারাম শরীফের সম্মানহানি করা হয়েছে।’ কী সাংঘাতিক ব্যাপার! মাথায় রক্ত চড়িয়ে দেয়ার মত উস্কানিদায়ক কাজ! প্রচণ্ড উত্তেজনায় বেসামাল ও আবেগে দিশেহারা মোশরেকরা তাওহীদের কালেমা শুনে চারদিক থেকে ধেয়ে এল। গোলযোগের সূত্রপাত হলো। রসূল সা. ঘেরাও হয়ে গেলেন। হারেস বিন উবাই হৈ চৈ শুনে রসূল সা. কে রক্ষা করতে ছুটে এলেন। কিন্তু তরবারীর আঘাতে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। আরবে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সংঘাতে এটাই ছিল ইসলাম রক্ষার লক্ষ্যে সংঘটিত প্রথম শাহাদাত।
অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ও যুক্তিসংগত পন্থায় যে দাওয়াত দেয়া হলো, তা নিয়ে বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং যুক্তির জবাব যুক্তির মাধ্যমে দেয়ার পরিবর্তে অন্ধ আবেগ ও উন্মত্ত হিংস্রতা দিয়ে তার জবাব দেয়া হলো। রসূল সা. তরবারীর জোরে সত্যের কালেমা গ্রহণে বাধ্য করেননি। কিন্তু বিরোধী শক্তি তলোয়ার হাতে নিয়ে রুখে এল। একটা বাতিল ব্যবস্থার স্বার্থপর হোতাদের এটাই প্রধান বৈশিষ্ট্য যে, তারা যুক্তির জবাবে উস্কানি ও উত্তেজনা এবং প্রমাণের জবাবে হিংস্রতা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে থাকে। বিরোধীদের মধ্যে এতটুকু সহিষ্ণুতাও ছিল না যে, অন্ততপক্ষে কয়েক সপ্তাহ, কয়েক দিন বা কয়েক মিনিট সময় কা’বার চত্বরে প্রদত্ত ঘোষণাটা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবে। তারা এ কথাটা স্বীকার করতে পারতো যে, তাদের মত মুহাম্মদ সা. -এরও অধিকার রয়েছে কোন না কোন ধর্ম, মতবাদ, দর্শন, বা আকীদা বিশ্বাস পোষণ করার, তদনুসারে বলার এবং অন্য কারো ধর্ম, মত বা আকীদা বিশ্বাসের বিরোধিতা করার। তারা অন্তত এতটুকু সম্ভাবনার কথা স্বীকার করতে পারতো যে, আমাদের ভেতরে কিছু ভুল ত্রুটি থাকতে পারে এবং মুহাম্মদের সা. প্রচারিত মতাদর্শে সে ত্রুটি শুধরাবার ব্যবস্থাও থাকতে পারে। আসলে কোন বাতিল ব্যবস্থার নেতাদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা একেবারেই শেষ হয়ে যায় এবং তাদের চিন্তাভাবনা ও বিচার বিবেচনার যোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়।
একটু ভাবতে চেষ্টা করুন তো সেই পরিবেশটা কেমন ছিল, যেখানে আমাদের সকলের ইহ-পরকালের কল্যাণের জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে একেবারেই নিরস্ত্র ও নিঃসম্বল অবস্থায় আপন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা.।