অধ্যায়ঃ ৪
মাদানী অধ্যায়ে মানবতার বন্ধু সা. : ইতিহাসের পট পরিবর্তন
“অতি প্রত্যুষে উম্মে আহমদ আমাকে দেখলো, আমি যে ব্যক্তিকে না দেখেও ভয় পাই, তাঁর হেফাযতে বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন সে বলতে লাগলো, তোমার যদি চলে যেতেই হয় তবে ইয়াসরিবে যেয়োনা, আমাদেরকে অন্য কোথাও নিয়ে চল।
আমি তাকে জবাব দিলাম, এখন ইয়াসরিবই আমাদের গন্তব্যস্থল। দয়াময় আল্লাহ যেদিকেই বান্দাকে নিতে চান, বান্দা সেদিকেই রওনা হয়।
কত যে প্রিয় সাথী ও শুভাকাংখীকে আমরা পেছনে ছেড়ে এসেছি এবং কত যে বেদনা ভারাক্রান্ত মহিলাকে অশ্রু বিসর্জন দিতে দেখে এসেছি, তার ইয়ত্তা নেই।
তুমি তো ভাবছ, আমাদেরকে যারা বহিষ্কার করেছে, তাঁদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের যোগ্যতা অর্জনের জন্য আমরা মাতৃভূমি ছেড়ে যাচ্ছি। অথচ আমাদের অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে।
এক পক্ষ আমরা, আর অপর পক্ষ হলো আমাদের সেই সব বন্ধু, যারা সত্য পথ থেকে দূরে সরে গেছে এবং আমাদের ওপর নির্যাতনের অস্ত্র প্রয়োগ করে হাঙ্গামা বাধিয়েছে।
এই দুটো বিবাদমান পক্ষের একটা সত্যের পতাকা ওড়াবার সৌভাগ্য লাভ করেছে এবং সঠিক পথে পরিচালিত হয়েছে। আর অপর পক্ষ আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।
রক্ত সম্পর্কের দিক থেকে যদিও তাঁরা আমাদের ঘনিষ্ট আত্মীয়, কিন্তু (আদর্শ ও লক্ষ্যের ঐক্য ভিত্তিক) আন্তরিক সম্পর্ক যেখানে থাকেনা, সেখানে কেবল রক্ত সম্পর্ক অচল।
এমন একদিন আসবে, যেদিন তোমাদের ঐক্য ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। তোমাদের সামষ্টিক অস্তিত্ব ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। তখন তুমি ভালো ভাবেই জানবে, আমাদের উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে কারা সত্যের পথে রয়েছে।”
(আবু আহমাদ বিন জাহাশের হিজরত সংক্রান্ত কবিতার সার সংক্ষেপ)
মানবতার সবচে বড় বন্ধু এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইতিহাসের স্রষ্টা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেতিহাসের মক্কী যুগটা দাওয়াত ও আদর্শ প্রচারের যুগ। আর মাদানী যুগ শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের যুগ। মক্কায় লোক তৈরী করা হয়েছে। আর মদিনায় সামষ্টিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মক্কায় মালমসলা তৈরী করা হয়েছে। আর মদিনায় ভবন নির্মিত হয়েছে।
এই পার্থক্যের কারণে কোরআন, নবী জীবন ও ইসলামের ইতিহাসকে স্থূল দৃষ্টিতে অধ্যয়নকারী সাধারণ মানুষের ধারণা হলো, ইসলামী আন্দোলন ও তার আহ্বায়কের ওপর পরীক্ষার কথিত সময় কেবল মক্কায়ই কেটেছে। মদিনায় বিরোধিতার তেমন তীব্রতা ও উগ্রতা ছিলনা এবং সেখানে তেমন সাবর্ক্ষণিক নির্যাতনের দুবির্সহ পরিবেশ ছিলনা, যেমন ছিল মক্কায়। অন্তত পক্ষে এরূপ মনে করা হয় যে, বিরোধিতা ও শত্রুতা মাদানী যুগে নগ্ন তরবারীর রূপ ধারণ করে যুদ্ধের ময়দানে চলে এসেছিল। শত্রুদের পক্ষ থেকে হীন ও ইতরসুলভ আচরনের যুগটা অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তব ঘটনা এর বিপরীত। এ কথা সত্য যে, মাদানী যুগে প্রধান বিরোধী গোষ্ঠী কোরায়েশ উন্মুক্ত যুদ্ধের ময়দানে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছিল। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করা যায়না যে, ইসলামী আন্দোলন আগের চেয়ে জোরদার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার নতুন নতুন শত্রু সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। এ সব শত্রু অপকর্মে মক্কাবাসীর চেয়ে কোন অংশে কম ছিলনা। তাঁদের নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র রসূল সা. ও তাঁর সাহাবীদেরকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উত্যক্ত ও বিব্রত করেছে এবং পূনর্জাগরণের কাজে বাধা দিতে কোন অপচেষ্টাই বাদ রাখেনি।
ইতিহাসের একটা চিরচারিত নিয়ম হলো, সংস্কার সংশোধন ও পূনর্জাগরণের কাজ যতই অগ্রসর হয়, সংস্কার বিরোধী ও কর্মবিমুখ গোষ্ঠীগুলো তাকে বিনষ্ট ও ধ্বংস করার জন্য শত্রুতার আবেগে ততই হন্যে হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত যখন নির্যাতনের ফাঁসি কাষ্ঠ থেকে উদ্ধার পেয়ে এক লাফে ক্ষমতার মসনদে আসীন হয় তখন বাতিলের বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা সকল সীমা অতিক্রম করে যায়। মদীনায় নতুন ইসলামী সমাজ ও শান্তিপূর্ণ কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে এ ধরনের পরিস্থিতিরই উদ্ভব হয়েছিল।
মদিনার ভিন্নতর পরিবেশ
ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা যে, মদিনার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবেশ ছিল মক্কা থেকে একেবারেই ভিন্নতর। এ কারণে ইসলামের যে চারাগাছ মক্কায় চরম প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠতেই পারছিল না, মদিনায় এনে লাগানো মাত্রই তা দ্রুত পত্র পল্লবে বিকশিত হয়ে উঠলো ও ফল দিতে শুরু করলো।
প্রথম পার্থক্যটা ছিল এইযে, মক্কা ও তার আশ পাশের গোটা জনবসতি পরস্পরে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিল। তারা ছিল একই ধর্মাবলম্বী গোত্র ও পারস্পরিক চুক্তির বন্ধনে আবদ্ধ এবং তাদের ওপর কোরায়েশদের ছিল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য। কিন্তু মদীনা ও তাঁর আশেপাশে দুটো ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির জনগোষ্ঠী বাস করতো এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্ব কলহ ও উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
মদিনা ছিল ইহুদীদের প্রতিষ্ঠিত ‘ইয়াসরিব’ নামক প্রাচীন শহর। এখানে তাদের ক্রমান্বয়ে বংশ বিস্তার ঘটতে থাকায় মদিনার আশপাশে তাদের নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠেছিল। সেই সাথে তাদের ছোট ছোট সামরিক দূর্গও নির্মিত হয়েছিল। এভাবে সমগ্র এলাকা ইহুদীদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রভাবাধীন ছিল।
দ্বিতীয় জনগোষ্ঠীটা ছিল আনসারদের। তাদের আসল জন্মভূমি ছিল ইয়ামান। কাহতানের বংশধর ছিল তারা। ইয়ামানের ইতিহাস খ্যাত বন্যায় যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়, তা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকেরা এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ে। কাহতান গোত্রের দু’ভাই আওস ও খাজরাজ তৎকালে মদিনায় এসে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীকালে অন্যান্য লোকও এসে থাকতে পারে। তবে এই নবাগতদের মাধ্যমেই এ অঞ্চলে নতুন অধিবাসীর সমাগম ঘটে। পড়ে বংশ বিস্তার ঘটতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে একটা নতুন শক্তির উদ্ভব ঘটে। প্রথম প্রথম তারা ইহুদী সমাজ ও কৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন যাপন করতে চেয়েছিল। কিন্তু আগে থেকে জেঁকে বসা ইহুদী জনগোষ্ঠীর প্রভাব ও শক্তির চাপে বাধ্য হয়ে তাদের সাথে মৈত্রী চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তিভিত্তিক মৈত্রী দীর্ঘকাল সুষ্ঠুভাবে চলতে থাকে। কিন্তু ইহুদীরা যখনই অনুভব করলো যে, আনসারদের ক্রমবর্ধমান শক্তি তাদের প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন তারা মিত্রতার সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললো।
ইহুদীদের মধ্যে ফিতিউন নামক এক লম্পট সরদারের আবির্ভাব ঘটে। সে শক্তির দাপট দেখিয়ে আদেশ জারি করলো, তার এলাকায় যে মেয়েরই বিয়ে হবে, তাকে প্রথমে তার প্রমোদ রজনীর শয্যা সঙ্গিনী হয়েই তবে দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে হবে। ইহুদীদের নৈতিক অধোপতন ও বিকৃতি কোন পর্যায়ে গিয়েছিল, তা এ থেকেই বোঝা যায় যে, তারা এই আদেশ মাথা পেতে নিয়েছিল। কিন্তু এই শয়তানী আদেশের দরুন আনসারদের আত্ম সম্ভ্রমবোধ একদিন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। মালেক বিন আজলানের বোনের বিয়ে হতে যাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক যেদিন বর এলো, সেদিন ফিতিউন মালেকের সামনে দিয়ে একেবারে বিবস্ত্র অবস্থায় যাচ্ছিল। মালেক তাকে তিরস্কার করলে সে বললো, কাল তাকে আরও বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে। উত্তেজিত হয়ে মালেক ফিতিউনকে হত্যা করে ফেললো এবং সিরিয়া পালিয়ে গেল। সেখানে গাসসানী রাজা আবু জাবালার শাসন চলছিল। সে যখন এ অবস্থা জানলো তখন মদীনা আক্রমণ করে বড় বড় ইহুদী নেতাকে হত্যা করে ফেললো এবং আওস ও খাজরাজকে পুরস্কৃত করলো। এ ঘটনাবলী ইহুদীদের শক্তি খর্ব করে দেয় এবং আনসারদের শক্তি বাড়িয়ে দেয়।
মোটকথা ইহুদীদের সাথে আনসারদের সম্পর্ক সব সময়ই দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতে পূর্ণ ছিল, কিন্তু কোন আদর্শ বা লক্ষ্য না থাকায় আনসারদের আভ্যন্তরীণ ঐক্য কোন মযবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কলহে তাদের শক্তি ঘুনের মত খেয়ে নষ্ট করে দেয়। ফলে এক সময় আওস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে বুয়াস নামক যুদ্ধ পর্যন্ত সংঘটিত হয় এবং উভয় পক্ষের বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ নিহত হয়। এভাবে তারা ইহুদীদের সামনে আবার শক্তিহীন হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তারা কিছুদিন আগে কোরায়েশদের সাথে মৈত্রী স্থাপনের আবেদন জানায়। কিন্তু নানা কারণে এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
অপরদিকে ইহুদীদের আধিপত্য ও আভিজাত্যের একটা কারণ ছিল তাদের ধর্মীয় মোড়লিপনা। তাদের কাছে তাওরাত ছিল। এই সুবাদে তারা একটা স্বতন্ত্র ধর্মীয় বিধানের পতাকাবাহী ছিল, তাদের কাছে আলাদা আকীদা ও আদর্শগত পুঁজি ছিল, কিছু চারিত্রিক নীতিমালা ছিল, কিছু ধর্মীয় আইন ও বিধি ছিল, কিছু ঐতিহ্য ছিল এবং এবাদত পালনের স্বতন্ত্র বিধান ছিল। এদিক দিয়ে আনসারদের বলতে গেলে কিছুই ছিলনা। এ সব বিষয়ে তারা ইহুদীদের মুখাপেক্ষী ছিল। তাদেরই ‘বাইতুল মাকদাস’ (তৎকালে ইহুদীদের ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র) থেকে তারা শিক্ষা লাভ করত। এমনকি যদি কোন আনসারীর সন্তান না বাঁচতো, তাহলে সে এই বলে মান্নত মানত যে, সন্তান বেঁচে থাকলে তাকে ইহুদী বানানো হবে। আনসারদের মধ্যে এদিক থেকে হীনমন্যতাবোধ বিরাজ করতো। তাদের আত্মসম্মানবোধ ও আভিজাত্যবোধ ক্ষুন্ন হওয়ায় তারা মনে মনে সব সময় বিব্রত থাকতো। এই সমস্ত তথ্য দ্বারা বুঝা যায় যে, মদিনার পরিমন্ডলে ইহুদী ও আনসারদের মাঝে দ্বন্দ্ব কলহ বিরাজ করতো এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল গভীর প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইহুদীরা প্রায়শ আনসারদের সামনে আস্ফালন করতো যে, শিগগীরই শেষ নবী আসবেন। তিনি এলে আমরা তার সাথে মিলিত হয়ে তোমাদেরকে দেখে নেব। ইহুদীদের এই হুমকী ও ভবিষ্যদ্বাণীর কারণে আনসাররাও প্রতিক্ষীত নবীর অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে। তারা মনে মনে সংকল্প নেয়, ঐ নবীর আবির্ভাব ঘটলে তারা সবর্প্রথম তাঁর দলে ভিড়বে। হলোও তাই। যারা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, তারা বঞ্ছিত থেকে গেল। ইহুদীরা যাদেরকে মার খাওয়াতে চেয়েছিল, তাদের হাতে নিজেরাই মার খেয়ে গেল। (সীরাতুন্নবীঃ শিবলী নুমানী)
মদিনার এই পরিবেশ ও পটভূমি বিবেচনা করলে বুঝে আসবে মক্কার তুলনায় এখনকার পরিবেশ কেন ইসলামী আন্দোলনের অধিকতর অনুকূল হলো।
ইসলামী আন্দোলন মদিনায়
মক্কা দীর্ঘ ১৩ বছর যাবত ইসলামের আহ্বান শুনেছে। এর সপক্ষে যুক্তি কী কী তাও জেনেছে। উপরন্তু ইসলামের আলোয় আলোকিত এক অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের চরিত্র এবং ভূমিকা তাঁর সামনে দেদীপ্যমান ছিল। ইসলামের পতাকাবাহীরা যুলুম নিষ্পেষণের চাকার তলে পিষ্ট হয়েও আহাদ আহাদ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক) ধ্বনি তুলেছে। তবুও মক্কার সামগ্রিক পরিবেশ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যানই করেছে।
কিন্তু দাওয়াত মদিনায় পৌঁছা মাত্রই সেখান থেকে ‘লাব্বাইক’ (গ্রহণ করলাম) ধ্বনি উঠলো। মদিনার প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী যুবক ছিলেন সুয়াইদ বিন ছামিত। তিনি ছিলেন একাধারে একজন মেধাবী কবি, দক্ষ ঘোড় সওয়ার ও বীর যোদ্ধা। এ ধরণের যুবকরা সাধারণত বিপ্লবী আন্দোলনের সৈনিক হয়ে থাকেন, উন্নয়ন ও গঠনমূলক যে কোন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন ও যথা সবর্স্ব উতসর্গ করেন। এ যুবক মক্কায় এলে রাসুল সা. তার সাথে যথারীতি মিলিত হলেন এবং দাওয়াত দিলেন। সুয়াইদ বললো, এ ধরনেরই একটা জিনিস আমার কাছে আছে, যার নাম ‘সহিফায়ে লুকমান’। তিনি তা থেকে কিছুটা পড়েও শোনালেন। এরপর রসূল সা. তাকে কোরআন পড়ে শোনালেন। হঠকারীতামুক্ত ও বিদ্বেষমুক্ত বিবেক কাকে বলে দেখুন। সুয়াইদ সংগে সংগে বলে উঠলেনঃ “এটা আরো সুন্দর কথা!” এরপর রসূল সা. এর দাওয়াত তার অন্তরে গভীরভাবে বদ্ধমূল হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তিনি মক্কা থেকে ফিরে যাওয়ার পর পরই খাজরাজীদের হাতে নিহত হন। তাঁর সম্পর্কে অনেকে বলেছেন যে, নিহত হবার সময় তিনি মুসলমান ছিলেন এবং মুখে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি উচ্চারণ করছিলেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃঃ৬৭-৬৮)
মদিনায় দ্বিতীয় যে যুবক ইসলামের দাওয়াতে প্রভাবিত হন, তাঁর নাম আয়াস বিন মু’য়ায। এই ব্যক্তি মদীনার একটি প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন। এই দলটি মক্কায় এসেছিল খাজরাজের বিরুদ্ধে কোরায়েশের সাথে মৈত্রী চুক্তি করতে এবং সাহায্য লাভের আশায়। রসূল সা. এই দলের লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান এবং কোরআন পড়ে শোনালেন। আয়াস বিন মু’য়ায তখনো কিশোর মাত্র। সে বললো, “হে আমার সাথীরা, তোমরা যে জন্য এসেছ তার চেয়ে এটাই তো ভালো”। প্রতিনিধি দলের নেতা আবুল হুসাইর সংগে সংগে তার মুখে মাটি ছুড়ে মারলো। তার অর্থ এই ছিল যে, তুমি আবার মাঝখানে এ কোন ঝামেলা বাধাচ্ছ? সে আরো বললো, ‘আমরা এজন্য আসিনি’। আবুল হুসাইর কোরায়েশদের সাহায্য লাভের জন্য উদগ্রীব ছিল। সে জানতো যে, মুহাম্মাদ সা. এর দাওয়াত গ্রহণ করলে কোরায়েশদের সাহায্য পাওয়ার পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। আয়াস চুপ করলো বটে। ইসলামের দাওয়াত তার অন্তরে প্রবেশ করলো। প্রতিনিধি দল মদিনায় ফিরে গেল। দুঃখের বিষয় যে, এই সচেতন যুবকটিও শীঘ্রই বুয়াস যুদ্ধের কবলে পড়ে মারা গেল।
নবুয়তের একাদশ বছরে মদিনা থেকে যে দলটি এসেছিল, তার সাথে এক বৈঠকে রসূল সা. এর বিস্তারিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। রসূল সা. এর দাওয়াত শোনার পর তারা পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলো, “তোমরা নিশ্চিত জেন, এই ব্যক্তিই সেই নবী, যার কথা ইহুদীরা তোমাদের কাছে বলে আসছে। এখন ইহুদীরা যেন আমাদের আগে এই নবীর সহযোগী হয়ে যেতে না পারে।” এরপর আল্লাহ তাদের অন্তর উন্মুক্ত করে দেন এবং তারা সবাই ইসলামকে হৃদয়ে বদ্ধমূল করে নেয়। তারপর তারা বলতে থাকেঃ
“আমরা আমাদের জনগনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। আমাদের মধ্যে যত শত্রুতা ও কলহ কোন্দল, তা বোধহয় আর কোন জাতিতে নেই। হতে পারে রসূল সা. এর মাধ্যমে আমাদের জাতিকে আল্লাহ আবার ঐক্যবদ্ধ করবেন। আমরা তাদের কাছে ফিরে যাওয়ার পর রসূল সা. এর দ্বীনের প্রতি তাদেরকে দাওয়াত দেব এবং আমরা তাঁর সামনে এই দ্বীনের ব্যাপারে যে মনোভাব ব্যক্ত করেছি, তাদের সামনেও সেই মনোভাব ব্যক্ত করবো। তারপর আল্লাহ যদি তাদেরকে এই দ্বীনের ব্যাপারে একমত করে দেন তাহলে এরপর ইনিই হবেন সবচে শক্তিশালী ব্যক্তি”। (সীরাত ইবনে হিশাম)
যে দাওয়াতকে মক্কার লোকেরা বিভেদের কারণ বলে মনে করেছিল, মদীনার লোকেরা প্রথম দৃষ্টিতেই তাকে তাদের ঐক্যের ভিত্তি দেখতে পেল। ইসলামী আন্দোলনের পতাকা উত্তোলনের জন্য মক্কায় বসে সংগঠিত মদীনার এই প্রথম দলটির সদস্য ছিলেন ছয় ব্যক্তিঃ
(১)আবুল হাইছান বিন বিন হাম (২)আসাদ বিন যারারা (৩)আওফ বিন হারিস (৪)রাফে বিন মালেক আজলান (৫)কুতবা বিন আমের (৬)জাবের বিন আব্দুল্লাহ।
এই ব্যক্তিবর্গ মদীনায় ফিরে যাওয়ার পর তারা সেখানে নতুন চাঞ্চল্য ও নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেন। সেখানে ইসলামের দাওয়াত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ব্যাপক বিস্তার লাভ করতে থাকে। আনসারদের পরিবারগুলোর মধ্যে কোন পরিবারই এমন ছিলনা, যেখানে মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিলনা।
প্রথম আকাবার বায়য়াত
পরবর্তী বছর অর্থাৎ নবুয়তের দ্বাদশ বছর বারো ব্যক্তি মদিনা থেকে এসে বায়য়াত সম্পাদন করেন। এটা ‘মাতৃশপথ’ নামে পরিচিত। এই নামকরণের কারণ হলো, এই বায়য়াতে শুধু মৌলিক বিষয়ে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয় এবং কোন যুদ্ধ বিগ্রহের বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। এই ঈমানী অঙ্গীকারের বক্তব্য ছিল নিম্নরূপঃ
“আমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবোনা, চুরি করবোনা, ব্যভিচার করবোনা, সন্তান হত্যা করব না, জেনে শুনে কারো বিরুদ্ধে মনগড়া অপবাদ রটাব না এবং কোন সৎ কাজে মুহাম্মদ সা. এর অবাধ্য হবনা।”
এই দলটি যখন মদিনায় রওনা হলো, তখন রসূল সা. মুসয়াব বিন উমাইরকে মদিনায় ইসলামের দাওয়াতী কাজ সম্পাদনের জন্য নিযুক্ত করেন। সেখানে গিয়ে মুসলমানদেরকে কোরআন পড়ানো, ইসলামের শিক্ষা দান এবং ইসলামের বিস্তারিত ও সঠিক জ্ঞান দানের দায়িত্ব তাকে অর্পণ করেন। তিনি সেখানে নামাযের ইমামতিও করতেন এবং ইসলামী আদর্শ ও ইসলামী চারিত্রিক নীতিমালাও শিক্ষা দিতেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
দুই নেতার ইসলাম গ্রহণ
রসূল সা. এর নিযুক্ত ইসলাম প্রচারক মুসয়াব যে বাড়ীতে অবস্থান করতেন, সে বাড়ীর মালিক আস’য়াদ বিন যারারা একদিন মুসয়াবকে সাথে নিয়ে বনু আবদুল আশহাল ও বনু যফর গোত্রের বাসস্থানের দিকে দাওয়াতী অভিযানে রওনা হলেন। তারা মারাক নামক কুঁয়ার পার্শ্ববর্তী বনু যফরের বাড়ীর চৌহদ্দীর কাছে পৌঁছলেন। ইসলাম গ্রহণকারী কতিপয় ব্যক্তি এসময় তাদের পাশে এসে সমবেত হলো। বনু আবদুল আশহালের দুই নেতা সা’দ বিন মু’য়ায এবং উসাইদ বিন হুযাইর তখনো তাদের গোত্রের ধর্মানুসারী অর্থাৎ-পৌত্তলিক ছিলেন। আস’য়াদ বিন যারারা ও মুসয়াবের পরিচালিত দাওয়াতী তৎপরতায় সা’দ বিন মু’য়ায আগেই রেগে আগুন হন। এই দুই ব্যক্তির আগমনের খবর শুনে তিনি উসাইদকে কানে কানে বললেন, “এই দুই ব্যক্তি আমাদের ভেতরকার দুবর্ল লোকদেরকে ধোকা দিয়ে বিপথগামী করতে আসে, যেয়ে ওদেরকে নিষেধ করে দাও আমাদের বাড়ীতে যেন না আসে। আস’য়াদ বিন যারারা যদি আমার খালাতো ভাই না হতো, তাহলে তোমাকে বলতামনা, আমি নিজেই তাঁর মোকাবিলা করতাম।” এরপর যখন দাওয়াতী বৈঠক বসলো, সা’দ বিন মু’য়াযের নির্দেশ মোতাবেক উসাইদ একটা বর্শা উঁচিয়ে তাদের উভয়ের কাছে এল। কয়েক মূহুর্ত থমকে দাঁড়িয়ে কটূ ভাষা প্রয়োগ করে বললো, “তোমাদের এখানে আগমনের উদ্দেশ্য কী? তোমরা আমাদের দুবর্ল লোকদের বিভ্রান্ত কর। প্রাণে বাঁচতে চাওতো আমাদের এলাকা ছেড়ে এক্ষুনি চলে যাও।” মুসয়াব বিনম্র ভাষায় বললেন, “আপনি একটু বসে মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনুন না। শোনার পর ভালো লাগলে মেনে নেবেন, নচেত প্রত্যাখ্যান করবেন।” উসাইদ এ কথা শুনে একটু শান্ত হলো। সে বর্শাটা নীচে রেখে দিয়ে আস’য়াদ ও মুসয়াবের পাশে শান্তভাবে বসে পড়লো। মুসয়াব আলোচনা শুরু করলেন এবং কোরআন পড়ে শোনালেন। তারা উসাইদ মুখ দিয়ে কিছু বলার আগেই তার মুখ মণ্ডলের হাবভাব লক্ষ্য করে তাঁর ইসলাম গ্রহণের মনোভাব উপলব্ধি করেছিলেন। অবশেষে উসাইদ মুখ ফুটে বললো, “কী সুন্দর ও কত মনোমুগ্ধকর কথা!” সে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমরা ইসলাম গ্রহণের সময় কি পন্থা অবলম্বন কর?” উভয়ে বললেন, “যাও, গোসল কর, পাক পবিত্র হও, নিজের কাপড় ধুয়ে ফেল, তারপর সত্যের সাক্ষ্য দাও এবং নামায পড়।” যে উসাইদ একটু আগে বর্শা তাক করে দাঁড়িয়েছিল, তাঁর বুকে এখন ইসলামের উজ্জীবনী বর্শা বিদ্ধ হয়ে গেছে। সে উঠে যেয়ে গোসল করে পাকসাফ হয়ে এসে দু’রাকাত নামায পড়লো। নামায শেষে উসাইদ বললো, “আমার সাথে আর এক ব্যক্তি আছে। সেও যদি তোমাদের দলে যোগ দেয়, তাহলে গোত্রের আর কেউ বিরোধিতা করবেনা। আমি এখনই তাকে ডেকে আনি। সে হচ্ছে সা’দ বিন মু’য়ায।” সে তৎক্ষণাত বর্শা হাতে সা’দের কাছে গেল। সেখানে মজলিশ বসলো। মু’য়ায উসাইদকে দূর থেকে দেখেই তার সাথীদের বললো, “আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, উসাইদ যাওয়ার সময় যে রকম চেহারা নিয়ে গিয়েছিল, এখন তার সে রকম চেহারা নেই।” তারপর উসাইদকে বললো, “বল, তুমি কী করে এসেছ?” উসাইদ সরল ভাবে জবাব দিল, “আমি উভয়ের সাথে কথা বলেছি। আল্লাহর কসম, তাদের দিক থেকে কোন আশংকা অনুভব করিনি। তাদেরকে আমি নিষেধ করে দিয়েছি। আর তুমি যা বল, তাই আমরা করবো।” সাথে সাথে সা’দকে উত্তেজিত করার জন্য বললো, “বনু হারেসা আস’য়াদ বিন যারারাকে হত্যা করতে চায়। আস’য়াদ তোমার আত্মীয়, তা জেনেও এটা করতে চাইছে যাতে তোমাকে হেয় করা যায়।” সা’দ বনু হারেসার পক্ষ থেকে আচরণের আশংকা বোধ করে রেগে উঠলো। উসাইদের হাত থেকে বর্শাটা ছোঁ মেরে নিয়ে মু’য়ায আস’য়াদ ও মুসয়াবের কাছে গেল। কিন্তু গিয়ে দেখে উভয়ে শান্তভাবে বসে আছে। মু’য়ায বলেন, “আমি তৎক্ষণাত বুঝে ফেললাম, উসাইদ চালাকি করে আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে যাতে আমি ওদের দু’জনের কথাবার্তা প্রত্যক্ষভাবে শুনি। তাকে মনে মনে অনেক তিরস্কার করে উভয়ের সামনে থমকে দাঁড়ালাম। আস’য়াদ বিন যারারাকে বললাম, তোমরা আমাদের কাছে এমন সব কথাবার্তা বলতে আস যা আমরা ঘৃণা করি।” মুসয়াব বিনম্রভাবে বললেন, “একটু ঠাণ্ডা হও, আমাদের কথা শোন। তারপর ভালো লাগলে গ্রহণ করো, নচেৎ তোমরা যা ঘৃণা করো, তা আমরা তোমার সামনে পেশ করবোনা।” সা’দ শান্ত হয়ে গেল এবং বললো, “ তুমি তো ন্যায়সঙ্গত কথাই বলেছ।” সা’দ বসে পড়লে মুসয়াব তাকে ইসলামের বার্তা ও কোরআন শোনালেন। এখানেও উসাইদের মত অবস্থার পুনরাবৃত্তি হলো। সা’দ কিছু বলার আগেই তার চেহারা থেকে ইসলাম গ্রহণের লক্ষণ ফুটে উঠলো। কয়েক মূহুর্তে দ্বিতীয় নেতা ইসলাম গ্রহণ করলো।
সা’দ বিন মু’য়ায ‘নতুন জীবন’ নিয়ে যখন ফিরে এলেন, তখন গোত্রীয় মজলিসের লোকজন দূর থেকে দেখেই বললো, সা’দের চেহারা বদলে গেছে। এসেই সা’দ বললেন, “হে বনু আবদুল আশহাল গোত্রের জনমণ্ডলী, আমার সম্বন্ধে তোমাদের মত কী ?” সবাই বললো, “তুমি আমাদের সরদার। তোমার মতামত আমাদের মতামতের চেয়ে পরিপক্ক। আমাদের সবার চেয়ে তুমি গুণবান ও কল্যাণময়।” সা’দ বললেন, “তা হলে শুনে রাখ, তোমরা যতক্ষণ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান না আনবে, ততক্ষণ তোমাদের নারী ও পুরুষদের সাথে কথা বলা আমার হারাম।” এরপর আর যায় কোথায়। সমগ্র গোত্রের নারী ও পুরুষেরা এক যোগে ইসলাম গ্রহণ করলো।
এই দুই নেতার মাধ্যমে যখন ইসলামী আন্দোলনের শক্তি প্রভূত বৃদ্ধি পেল, তখন দাওয়াতী অভিযানও জোরদার হলো এবং ঘরে ঘরে ও গোত্রে গোত্রে ইসলাম ছড়িয়ে পড়লো।
আকাবার দ্বিতীয় বায়য়াত
ইতিমধ্যে হজ্জের মওসুম এসে গেল। এবার বিপুল সংখ্যক মুসলমান মদিনা থেকে মক্কায় গেল। কারণ মদিনার ভূমিতে ইসলাম ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করছিল। মদিনার এই নওমুসলিমগণ নতুন ধর্মীয় উদ্দীপনায় উদ্দীপিত হয়ে হজ্জ উপলক্ষে এসে কোরায়েশদের দৃষ্টি এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে নিজেদের প্রিয় নেতা রসূলের সা. সাথে মিলিত হলো। এবার পুনরায় আনুগত্যের অঙ্গীকার নেয়া হলো। তবে এবারের অঙ্গীকার ‘মাতৃ বায়য়াত’ এর চেয়ে অনেকটা অগ্রগামী ছিল। প্রথম বায়য়াতের কেবল একটি ধারায় রাজনৈতিক বক্তব্য পরিলক্ষিত হতো। সেটি ছিল এই প্রতিজ্ঞা যে, “আমরা মুহাম্মাদ সা. এর ন্যায়সঙ্গত আদেশ অমান্য করবোনা।” কিন্তু এবার যাবতীয় ঝুঁকি মাথায় নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এ বায়য়াতের আলোকে মুহাম্মাদ সা. এর সহযোগিতা করার অর্থ ছিল কোরায়েশ ও সমগ্র আরব জাতির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। দ্বিতীয় বায়য়াত প্রকৃত পক্ষে সম্পাদন করাও হয়েছিল এই অর্থকে সামনে রেখেই। আলাপ আলোচনার সময় ইসলামী আন্দোলনের এই সব ইয়াসরিবী সৈনিক ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলো পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করে বললেন, “ইয়াসরিবের লোকদের (অর্থাৎ ইহুদীদের) সাথে আমাদের যে সব চুক্তি আছে, তা আমাদের বাতিল করতে হবে। বাতিল করার পর এমন যেন না হয় যে, আল্লাহ আপনাকে বিজয় দান করলে আপনি স্বজাতির লোকদের কাছে ফিরে যাবেন এবং আমাদেরকে ত্যাগ করবেন।” এই আশংকার জবাবে রসূল সা. মুচকি হেসে বললেনঃ “তোমাদের রক্ত আমারই রক্ত, তোমাদের শত্রু আমারই শত্রু, আমি তোমাদের লোক এবং তোমরা আমার লোক। যাদের সাথে তোমাদের যুদ্ধ হবে তাদের সাথে আমারও যুদ্ধ হবে, আর যাদের সাথে তোমাদের সন্ধি হবে তাদের সাথে আমারও সন্ধি হবে।” আব্বাস বিন উবাদা বললেন, “হে খাজরাজের বংশধরগণ! তোমরা কি জান, মুহাম্মাদের সা. সাথে তোমরা কিসের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ? এ হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর অধিবাসীদের সাথে লড়াই এর প্রতিশ্রুতি।” প্রতিনিধিদলের সদস্যরা পরিপুর্ণ দায়িত্বোপলব্ধি সহকারেই জবাব দিলেনঃ “আমরা আমাদের সমস্ত সহায় সম্পদ ধ্বংস এবং আমাদের গোত্রপতিদের হত্যার বিনিময়ে হলেও আপনার সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখবো বলে অঙ্গীকার করছি।” এই বায়য়াতের বিশেষ প্রকৃতির কারণেই এর নাম হয়ে গেল “বায়য়াতুল হারব” বা “সামরিক অঙ্গীকার”। এর একটা মৌলিক শর্ত ছিল এই যে, “আমরা অনটনে অথবা প্রাচুর্যে, সুখে কিংবা দুঃখে, যে অবস্থায়ই থাকিনা কেন, রসূল সা. এর প্রতিটি নির্দেশ শুনবো ও তাঁর আনুগত্য করবো, রসূলের আদেশকে আমরা নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেব এবং নেতৃবৃন্দ ও দায়িত্বশীলদের সাথে দ্বন্দ্বকলহ করবোনা। আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কেউ আমাদের নিন্দা ভৎর্সনা করলে আমরা তাঁর পরোয়া করবোনা।”
এ বায়য়াতকে আসলে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর বলা যায়। সেই সাথে একে হিজরতের ভূমিকা বলেও আখ্যায়িত করা চলে। এ বায়য়াতের মাধ্যমে কার্যত ভবিষ্যতের ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য তার ভাবী নাগরিকগণ সেচ্ছায় ও সানন্দে মুহাম্মাদ সা. এর রাষ্ট্রনায়কত্বকে গ্রহণ করে নিল। উপরন্তু আনুগত্যের ব্যবস্থাও এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।
এর মাধ্যমে শুধু যে একটা অঙ্গীকার নেয়া হলো তা নয়, বরং সামষ্টিক নিয়ম-শৃঙ্খলার ভিত্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। ইসলামী আন্দোলনের নেতা নাগরিক সংগঠনের মতানুসারে বারোজন আঞ্চলিক দায়িত্বশীল (নকীব) নিয়োগ করলেন। তন্মধ্যে ৯ জন খাজরাজ থেকে এবং তিনজন আওস থেকে নিযুক্ত হলো। এই নকীবদেরকে আদেশ দেওয়া হলো যে, তোমরা নিজ নিজ গোত্রের যাবতীয় বিষয়ের দায়িত্বশীল, যেমন হযরত ঈসার আ. হাওয়ারীগণ দায়িত্বশীল ছিলেন এবং যেমন আমি স্বয়ং আমার দলের দায়িত্বশীল। এরা স্বয়ং রসূল সা. এর প্রতিনিধি স্বরূপ ছিলেন। তাদের নিযুক্তির মাধ্যমে সংগঠিত সমাজ নির্মাণের কাজ নিয়মতান্ত্রিকভাবে শুরু হলো।
খবরটা যখন কোরায়েশদের কানে গেল, তখন তারা বুক চাপড়াতে লাগলো। প্রতিনিধি দল ততক্ষণে মক্কা থেকে চলে গেছে। অনুসন্ধানে লোক পাঠানো হলো। সা’দ বিন উবাদা ও মুনযির বিন আমরকে ধরে আনা হলো। তাদের ওপর তারা গায়ের ঝাল ঝাড়লো। কিন্তু তাতে আর কী লাভ? (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)
মদিনায় আন্দোলনের নতুন জোয়ার
এই প্রতিনিধি দল নতুন উদ্যম ও উদ্দীপনা নিয়ে মদিনায় ফিরে এলে দাওয়াতের কাজ প্রকাশ্যে ব্যাপকভাবে শুরু হলো। যুবকরা যখন কোন পরিবর্তনের উদ্যোক্তা হয়ে ময়দানে নামে, তখন তার মোকাবিলায় বুড়ো জনগোষ্ঠী বেশী দিন টিকে থাকতে পারেনা। কোন আন্দোলনের ভবিষ্যত কেমন তা উপলব্ধি করতে হলে জানতে হবে, তা প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল, না তাঁর শিরায় নবীনদের রক্ত প্রবাহিত। মক্কায় ও বিশেষত মদীনায় যারা ইসলামী আন্দোলনের ঝাণ্ডা নিয়ে আগে আগে চলেছিল, তারা প্রায় সবাই ছিল উঠতি বয়সের। এই তরুণ প্রজন্ম ইসলামী আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কত কী যে করেছে তার ধারণা পাওয়ার জন্য একটা মজার ঘটনা উল্লেখ করা জরুরী মনে হচ্ছে।
বনু সালামা গোত্রে আমর ইবনুল জামুহ নামে এক প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিজ গৃহে মানাত নামে কাঠের একটা মূর্তি সংগ্রহ করে এনে রেখেছিলেন। বুড়ো তার পূজো করতেন ও অষ্ট্র প্রহর ঝাড়ামোছায় নিয়োজিত থাকতেন। বনু সালামার দুই তরুণ মুয়ায বিন জাবাল ও মুয়ায বিন আমর ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হয়ে গিয়েছিলেন। শেষোক্তজন আলোচ্য বুড়ো মিয়ারই ছেলে। এরা দু’জন প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে উঠে গিয়ে বুড়ো মিয়ার মূর্তিটাকে প্রথমে কাদামাটিতে লুটোপুটি খাওয়াতেন, অতঃপর বনু সালামার যে গর্তে লোকেরা যাবতীয় বর্জ্য নিক্ষেপ করতো, সেখানে মাথা নিছের দিকে করে ফেলে রেখে আসতেন। সকাল বেলা উঠে বুড়ো চিৎকার করতেনঃ “রাতের বেলা আমার খোদার উপর কে হস্তক্ষেপ করলো?” তারপর তিনি নিজের হারানো খোদাকে খুঁজতে বেরুতেন। খুঁজে পাওয়ার পর ধুয়ে মুছে আবার যথাস্থানে রেখে দিতেন। পরবর্তী রাতেও আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো। বুড়ো আবারও চিল্লাচিল্লি করতেন। একদিন বুড়ো আমর বিরক্ত হয়ে মূর্তির ঘাড়ে নিজের তলোয়ার ঝুলিয়ে দিলেন। মূর্তিকে বললেন, “আল্লাহর কসম, আমি জানিনা তোমার সাথে কে এমন আচরণ করে। তোমার যদি একটুও শক্তি থেকে থাকে, তবে এই যে তলোয়ার রেখে গেলাম, আত্মরক্ষার চেষ্টা ক’রো।” রাত হলো। আমর ঘুমিয়ে গেলেন। এই নাটকের উভয় অভিনেতা রাতের বেলায় এলেন। তারা মূর্তির ঘাড় থেকে তলোয়ার খুলে ফেললেন। তারপর একটা মরা কুকুর খুঁজে এনে মূর্তির গলায় রশি দিয়ে বাঁধলেন এবং তাকে এমন এক বদ্ধ কূয়ায় ফেলে আসলেন, যা মানুষের মলমূত্রে ভর্তি থাকতো। সকাল বেলা উঠে আমর দেখলেন, তার খোদা আবারো উধাও হয়েছে। খোঁজাখুঁজি করে যখন তার এরূপ করুণ দশা দেখলেন, তার মনে প্রচণ্ড ভাবান্তর উপস্থিত হলো এবং আমর ইসলাম গ্রহণ করলেন। এ থেকে বুঝা যায়, মদীনায় কী আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল।
আন্দোলনের নতুন কেন্দ্র
ইসলামী আন্দোলনের নেতা সবর্দাই এই ভাবনায় থাকতেন যে, মক্কায় যদি আন্দোলন তিষ্টিতে না পারে এবং মক্কার নিষ্ঠুর নেতৃত্ব যদি “নতুন বিশ্ব” গড়ার সুযোগ দিতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে পৃথিবীর আর কোন্ অঞ্চলে সবর্শক্তি নিয়োগ করে এই গঠনমূলক কাজটা শুরু করা যেতে পারে? তাঁর প্রথম দৃষ্টি পড়েছিল আবিসিনিয়ার ওপর এবং এজন্যই তিনি সাথীদেরকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। বাদশাহ নাজ্জাশী যদিও মক্কার মযলুমদের সাহায্যের ব্যাপারে সাধ্যমত সব কিছুই করেছেন। কিন্তু একে তো সেখানে খৃষ্টান ধর্মযাজকদের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা মুসলমানদের দৃষ্টি এড়ায়নি। ওদের সবব্যার্পী প্রভাবের আওতায় সেখানে ইসলামের বিকাশ লাভ সহজ ছিলনা। তদুপরি সেকানে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে একেবারে নতুন করে প্রচারকার্য শুরু করতে হতো। আর এ কাজ করতে গিয়ে বিদেশের মাটিতে নানা রকমের দূরতিক্রম্য বাধার সম্মুখীন হতে হতো। এ জন্য অন্য কোন ভূখণ্ডের সন্ধান করা হচ্ছিল। মদিনা যখন খোলা মনে দাওয়াতে সাড়া দিল, তখন রসূল সা. আশার আলো দেখতে পেলেন। আকাবার প্রথম বায়য়াত এই আশাকে আরো জোরদার করে। তারপর হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর সেখানে অবস্থান করে কিছু দিন কাজ করার পর আকাবার দ্বিতীয় বায়য়াতের প্রাক্কালে হজ্জের সময় যে রিপোর্ট দেন, তাতে মদীনার মুসলমানদের বিস্তারিত বিবরণ দেন, তাদের শক্তি সামর্থের তথ্য জানান এবং সুসংবাদ দেন যে, এ বছর বিপুল সংখ্যক মুসলমান হজ্জ করতে আসছে। এই রিপোর্ট রসূল সা. কে গভীর চিন্তা ভাবনার প্রেরণা যোগাচ্ছিল। মদিনায় মুসলমানদের শক্তি ও সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া খুবই আশাব্যঞ্জক ব্যাপার ছিল। সেখানে ইহুদীদের দিক থেকে তাদের তেমন মারাত্মক বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছিলনা, যেমন মক্কায় কোরায়েশদের দিক থেকে হতে হচ্ছিল। ইয়াসরিব বাসী মক্কার সাথীদের জন্য খুবই চিন্তিত থাকতেন। ইয়াসরিববাসীর অনেক সুযোগ সুবিধা ছিল। তাদের ক্ষেতখামার ও বাগবাগিচা ছিল। রসূল সা. ভাবতেন, মক্কার মুসলমানরা মদীনায় চলে গেলে এবং কোরায়শদের যুলুম থেকে মুক্তি পেয়ে ইসলামের দাবী পূরণ করলেই কি ভালো হয়না? তাই আগত প্রতিনিধি দলের মধ্যে যারা হজ্জ করতে এসেছিলেন, তাদের কাছে তিনি নিজের এই ধারণা ব্যক্ত করলেন এবং পরে যে বায়য়াত সম্পন্ন হলো, তা এই পটভূমির ভিত্তিতেই সম্পন্ন হয়েছিল। (হায়াতে মুহাম্মদ, মুহাম্মদ হোসেন হাইকেল)
আবিসিনিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই একজন দুজন করে মুসলমান রসূল সা. এর অনুমতিক্রমে মদিনা যাচ্ছিল। কিন্তু আকাবার দ্বিতীয় বায়য়াতের পর এর গতি তীব্রতর হয় এবং দ্বিতীয় হিজরতের স্থান যে মদিনা হবে, তা প্রায় ঠিকঠাক হয়ে যায়।
মক্কার মোড়লরা দেখতে পাচ্ছিল যে, ইসলামী আন্দোলন নতুন একটা মজবুত ঘাঁটি সৃষ্টি করে ফেলেছে। তাদের দৃষ্টিতে ভবিষ্যত অত্যন্ত ভয়ানক বলে মনে হচ্ছিল। তারা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছিল যে, এখন মদীনায় যদি ইসলামের ইসলামের শিকড় গাড়ে, তাহলে আমাদের নাগালের বাইরে তা এক অজেয় শক্তিতে পরিণত হবে। অতঃপর তা একদিন আমাদের ওপর চড়াও হবে এবং আমাদের অতীতের কীর্তিকলাপের পাই পাই করে প্রতিশোধ নেবে। তারা এ আশংকাও বোধ করছিল যে, সিরিয়ার বাণিজ্যিক সড়ক যেহেতু মদীনার ওপর দিয়ে অতিক্রম করে, তাই মদিনায় নতুন ইসলামী কেন্দ্র এই পথ আটকে দিতে পারে। এভাবে মক্কার কোরায়েশদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অপমৃত্যু ঘটবে। তারা ভেতরে ভেতরে গভীর আতংক ও উৎকণ্ঠায় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। কিছুই বুঝতে পারছিলনা যে কি করবে। তারা দিন রাত এই চিন্তায় মগ্ন থাকতো যে, মুহাম্মাদ সা. ও তাঁর সমগ্র দল হাতছাড়া হয়ে না যায়। এই দুশ্চিন্তার কারণেই তারা শেষ পর্যন্ত রসূল সা.কে হত্যার পরিকল্পনা করে। একটা ঐতিহাসিক শক্তি তাদের গৃহ থেকেই আবির্ভূত হয়েছিল এবং দুনিয়ার অন্য সবার চাইতে তাদেরই নিজস্ব ছিল। সেই শক্তিকে তারা নিজেদেরই অপকর্ম দ্বারা ‘পর’ বানিয়ে দেয় এবং নিজেরাই তার শত্রু হয়ে যায়। তাই এরপর তা যতই জোরদার হচ্ছিল তাদের জন্য ততই প্রাণঘাতী আপদে পরিণত হচ্ছিল।
এজন্য প্রথম মোহাজের যখন মদিনায় যাওয়ার জন্য রওনা হলো, তখন মক্কাবাসী তার ওপর অত্যাচার চালায়। এই ব্যক্তি ছিলেন আবু সালামা আব্দুল্লাহ ইবনুল আসাদ মাখযুমী। তিনি স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে উটের ওপর চড়িয়ে রওনা দিচ্ছিলেন, ঠিক এই সময় তাঁর স্ত্রীর পৈতৃক গোত্র বনু মুগীরার লোকজন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামার উটের রশী আবু সালামার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। তারা বললো, আমাদের মেয়ে উম্মে সালামাকে তোমার সাথে ভবঘুরে হতে ছেড়ে দিতে পারিনা। এরূপ আবেগজড়িত ঘটনায় আবু সালামার গোত্রের লোকেরা ক্ষেপে গেল। তারা বনু মুগীরাকে বললো, তোমরা যদি আমাদের লোকের স্ত্রী কেড়ে নাও, তাহলে আমরা আমাদের শিশু সন্তানকে তার কোলে থাকতে দেবনা। ফলে স্বামী, স্ত্রী ও শিশু তিনজনই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। আবু সালামা এ অবস্থায়ই মদিনায় চলে গেলেন। উম্মে সালামা প্রতিদিন সকালে শহরের উপকণ্ঠের সেই জায়গাটায় এসে বিলাপ করে কাঁদতো। এভাবে প্রায় এক বছর কেটে যাওয়ার পর কোন এক ব্যক্তির মনে দয়ার উদ্রেক করলো এবং সে বনু মুগীরাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে উম্মে সালামাকে শিশুসন্তানসহ উটে চড়িয়ে মদিনা পাঠিয়ে দিল। মহিলা একাই রওনা হয়েছিল। আল্লাহর অনুগ্রহে ঘটনাক্রমে পথিমধ্যে উসমান বিন তালহার সাথে দেখা হয় এবং তিনি মদিনার উপকণ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন।
অর্থাৎ আবিসিনিয়ায় হিজরতের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর এখন মক্কাবাসীর নীতি হয়ে দাঁড়ালো এই যে, মুসলমানদের হাতছাড়া হতে দেয়া যাবেনা। যদি কেউ হিজরত করতেই চায়, তবে গোত্র ও পরিবার পরিজন মক্কাবাসীর হাতে জিম্মী হয়ে থাকবে। এই নীতি প্রথমে একটু শিথিল ছিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে তা কঠোর হয়। এমনকি বিলম্বে হিজরতকারী হযরত ওমর, আইয়াশ ইবনে আবি রবীয়া ও হিশাম ইবনে আ’স ইবনে ওয়ায়েলকে এত গোপনে যাত্রা করতে হয় যে, যে কোন মূহুর্তে গ্রেফতার হবার ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়েছিল। হযরত ওমর ও আইয়াশ তো কোন রকমে দ্রুত গতিতে ছুটে চলে গেলেন। কিন্তু হিশাম ধরা পড়ে গেল এবং নির্যাতনের শিকার হলো। হযরত ওমর ও আইয়াশ নিরাপদে মদীনায় পৌঁছে গেলেন। কিন্তু মক্কা থেকে একটা কুচক্রী দল তাদের পিছু পিছু রওনা হয়ে গেল। এ দলটির সদস্য ছিল আবু জাহল বিন হিশাম ও হারেস বিন হিশাম। তারা দুজনে গিয়ে আইয়াশের সাথে সাক্ষাত করে বললো, তোমার মা মৃত্যু পথযাত্রী। তিনি কসম খেয়েছেন যে, তোমার মুখ না দেখা পর্যন্ত তিনি মাথার চুল আচড়াবেন না এবং প্রখর রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকবেন। সাথীরা আইয়াশকে অনেক বঝালেন যে, এটা একটা চালাকি মাত্র। তুমি একবার যদি মক্কাবাসীর চাতুর্যের জালে ধরা পড়, তাহলে তারা তোমাকে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করবে। ধনাঢ্য আইয়াশ এ লোভেও পড়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি নিজের ধন সম্পদের একটা অংশ নিয়ে আসবেন। হযরত ওমর তার এ ইচ্ছার কথা জেনে বললেন, “আমি তোমার চেয়েও বেশী সম্পদশালী এবং আমার অর্ধেক সম্পদ তোমাকে দিয়ে দেব। ওদের সাথে যেয়না।” কিন্তু আইয়াশ কোন কথা শুনলেন না। হযরত ওমর বললেন, “যদি যেতেই চাও তবে আমার দ্রুতগামী উটনীটা নিয়ে যাও, যেখানেই কোন আশংকা অনুভব কর, অতে চড়ে পালিয়ে এস।” কিন্তু মক্কার কুচক্রীরা এমন চক্রান্ত করলো যে, ঐ উটনীকে ভিন্ন পথে চালিয়ে পালিয়ে আসাও আইয়াশের পক্ষে সম্ভব হলোনা। তাকে কষে বেধে নেয়া হলো। মক্কায় পৌঁছে তারা অন্যান্য লোককে বললো, “তোমাদের মধ্যে যারা যারা হিজরত করতে চায়, তাদেরকে আমাদের মত চিকিৎসা কর।”
পরে হযরত ওমর রা. স্বহস্তে হিশাম ইবনুল আসকে একটা চিঠি লেখেন। ঐ চিঠিতে তিনি “হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর যুলুম করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ হয়োনা”-এই প্রখ্যাত আয়াতটি উদ্ধৃত করেন। মক্কার নিকটবর্তী ‘মীতুয়া’ নামক স্থানে হিশাম চিঠিটি পড়েন এবং তা নিয়ে বারবার চিন্তাভাবনা করেন। যখন বুঝতে পারলেন যে এতে স্বয়ং তার দিকেই ইংগিত করা হয়েছে, তখন কাল বিলম্ব না করে উটে চড়ে রওনা হয়ে গেলেন। কিন্তু এর চেয়েও বিশুদ্ধ বর্ণনা এইযে, রসূল সা. মদীনায় হিজরত করার পর একদিন তাঁর মজলিশে এই দুই বন্দীর বিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলো। রসূল সা. বললেন, “আইয়াশ ইবনে আবি রবীয়া ও হিশাম ইবনে আ’সকে মুক্ত করে আনতে কে আমাকে সাহায্য করবে?” ওলীদ বিন মুগীরা নিজের প্রস্তুতির কথা জানালেন। ওলীদ রসূলের সা. আদেশে মক্কা রওনা হয়ে গেলেন। লুকিয়ে কুকিয়ে লোকালয়ের কাছে পৌঁছে দেখলেন, এক মহিলা খাবার নিয়ে যাচ্ছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কোথায় যাচ্ছ?” সে জবাব দিল, “এখানে দু’জন কয়েদী আছে। তাদেরকে খাবার দিতে যাচ্ছি।” ওলীদ পিছে পিছে যেতে লাগলেন। একটা ছাদবিহীন কক্ষে ঐ দু’জনই আতক ছিল। সন্ধ্যা হয়ে গেলে দেয়াল টপকে তাদের কাছে পৌঁছলেন। তারপর শেকলের নিছে পাথর রেখে তলোয়ার দিয়ে তা কেটে ফেললেন। তারপর দু’জনকে বাইরে এনে উটে বসালেন এবং সবাই একযোগে পালালেন।
যে সকল মোহাজের মদিনায় যেতে সক্ষম হয়েছে, তাদের অধিকাংশেরই যাবতীয় সহায় সম্পদ মক্কাবাসী রেখে দিয়েছে।
কিন্তু হিজরত এত মর্মান্তিক কাজ হওয়া সত্ত্বেও নারীপুরুষ নিবির্শেষে সবাই দ্বীনী দায়িত্ব পালনের পথে নির্দ্বিধায় মাতৃভূমি ত্যাগ করে যেতে লাগলো। ইসলামী আন্দোলনের এ অলৌকিক কৃতিত্বের কোন তুলনা নেই যে, আজ থেকে শত শত বছর আগের অসভ্য আরব সমাজের নিরক্ষর মহিলাদেরকে পর্যন্ত সে ইসলামী প্রেরণায় প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছে।
মোহাজেরদের যাত্রায় বাধা দিয়ে কোরায়েশরা চরম অসহিষ্ণুতার মনোভাব প্রকাশ করছিল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তির সাথে তাদের বোঝাপড়া চলছিল, তিনি দেখাচ্ছিলেন পবর্তের ন্যায় উচ্চ এবং সমুদ্রের ন্যায় ঔদার্য ও মহানুভবতা। তিনি ছিলেন ধৈর্য, সহনশীলতা, গাম্ভীর্য ও স্থিরচিত্ততার মূর্ত প্রতীক। তাই তিনি দাওয়াতের কেন্দ্রস্থলে স্থির থাকলেন। তিনি শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত সবর্প্রকারে নিজের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকেছেন এটা প্রমান করা তার কর্তব্য ছিল। মক্কাবাসীর বিরুদ্ধে আল্লাহর ইচ্ছার পূর্নতা লাভ করা পর্যন্ত তিনি ধৈর্যের সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। তিনি ছিলেন ডুবন্ত জাহাজের দুঃসাহসিক নাবিকের মত, যাকে সকল কর্মচারী ও যাত্রীদের নিরাপদে অন্য জাহাজে তুলে দেয়ার পরই সবার শেষে জাহাজ ত্যাগ করতে হয়।
যাদেরকে কোরায়েশরা জোরপূবর্ক আটকে রেখেছে, কিংবা যারা কোন বিশেষ স্বার্থ বা সুবিধার কারণে যেতে পারেনি, তারা ছাড়া আর কেউ যখন বাকী রইলনা, কেবল তখনই তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হিজরতের অনুমতি পেলেন। তিনি মক্কা ত্যাগ করলেন কেবল তখনই, যখন মক্কাবাসী তাকে জীবিত দেখতে প্রস্তুত ছিলনা। তাঁর সফরের মূহুর্ত যখন ঘনিয়ে এল, তখন তিনি রক্তপিপাসু তরবারীর বেষ্টনীর ভেতর দিয়ে নির্ভয়ে ও নিরাপদে বেরিয়ে গেলেন।
মদিনাঃ প্রতীক্ষার মূহুর্ত
মোহাজেরদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মদিনার প্রাণচাঞ্চল্য বেড়ে যাচ্ছিল। ইসলামী দাওয়াতের ঔজ্জ্বল্য চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। ইসলামের বিস্তারের সাথে ইসলামের বার্তাবাহকের প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। বিশেষত আকাবার দ্বিতীয় বায়য়াতের পড় থেকে মদিনার জনগণ প্রতি মূহুর্তে মক্কার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতো। যেন ক্ষেতভরা ফসলের ক্ষেত অপেক্ষমান রয়েছে যে, কখন মেঘ আসবে এবং বৃষ্টি বর্ষণ করবে। যেন সমস্ত নির্মাণ সামগ্রী স্তুপ হয়ে রয়েছে। মানবতার ভবনের নির্মাতা এসে তা দিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করে দেবেন।
বাতাসে কাঁধে ভর করে এ খবরও মদিনায় ছড়িয়ে পড়লো যে মুহাম্মাদ সা. মক্কা থেকে চলে গেছেন এবং হিজরতের পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন। এ খবর শুনে স্বভাবতই মদিনায় ঔৎসুক্য চরম আকার ধারণ করলো এবং অপেক্ষার মূহুর্তগুলো অসহনীয় হয়ে উঠলো।
ছোট ছোট শিশুদের মুখে পর্যন্ত এ কথাই লেগে ছিল যে, রসূল সা. আসছেন, রসূল সা. আসছেন। লোকেরা প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে শহরের বাইরে জমায়েত হয়ে অপেক্ষা করতো। গ্রীষ্মের সূর্য মাথার ওপর এলে এবং রৌদ্র অসহনীয় হয়ে উঠলে আক্ষেপ করতে করতে ঘরে ফিরে যেত। যেদিন রসূল সা. সত্যি সত্যি এসে পৌঁছলেন, সেদিনও যথারীতি লোকের জমায়েত হওয়ার পর ঘরে ফিরে যাচ্ছিল। সহসা এক ইহুদী এক দূর্গের ওপর থেকে দেখেই সুসংবাদ শোনালো, “অহে ইয়াসরিববাসী, ঐ দেখ, তোমরা যে মহা মানবের অপেক্ষা করছ, তিনি এসে গেছেন।” আর যায় কোথায়! সমগ্র শহর আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে ফেতে পড়লো। লোকেরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো। অধিকাংশ আনসার সশস্ত্র হয়ে বেরুলো।
মদিনা থেকে তিন মাইল দূরবর্তী শহরতলীর জনপদ কোবাতে তিনি সবর্প্রথম আবাসস্থল করলেন। আমর বিন আওফের পরিবার সানন্দে অভ্যর্থনা জানালো এবং এই পরিবারই তাঁর আতিথেয়তা করার সৌভাগ্য লাভ করলো। এই বাড়ী আসলে ইসলামী আন্দোলনের একটা কেন্দ্রীয় ঘাঁটি ছিল। আর মোহাজেরদের অধিকাংশের জন্যই এই বাড়ীটা প্রথম মনযিলে পরিণত হলো। কিছু কিছু মোহাজের সাহাবী তখনো ওখানে অবস্থান করছিলেন। হযরত আলীও আমানতগুলো পৌঁছিয়ে দিয়ে এখানেই নিজের প্রাণপ্রিয় নেতা ও কাফেলার সাথে এসে মিলিত হলেন। এখানে চৌদ্দ দিন অবস্থান করেন। লোকেরা দলে দলে সাক্ষাত করতে আসতে থাকে। যার বাণী তারা ইতিপূর্বেই মনে প্রাণে গ্রহণ করেছে, তাঁকে স্বচক্ষে দেখার জন্য তাদের আগ্রহের অন্ত ছিলনা। তাঁর চেহারা দর্শন, তাঁর মিষ্টি বাণী শ্রবণ এবং তাঁর দোয়া লাভের আশায় সবাই জমায়েত হচ্ছিল। সালাম, সাক্ষাত, আলাপ আলোচনা, দোয়া, বৈঠক কোন কিছুই বাদ যাচ্ছিলনা।
কোবায় রসূল সা. নিজ হাতে একটা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করলেন। প্রত্যেক মুসলমান এর নির্মাণ কাজে শরীক ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা ব্যক্তিত্ব একজন সাধারণ শ্রমিকের ন্যায় বড় বড় পাথর তুলে আনতে লাগলেন। কাজের সাথে গানও গাওয়া হচ্ছিলঃ
********
“মসজিদ নির্মাণকারী, কোরআন পাঠকারী এবং এবাদতের জন্য রাত্র জাগরণকারী যথার্থ সফলকাম।”
এ মসজিদ শুধু ইটপাথর ইত্যাদির সমষ্টি ছিল না, বরং নবী সা. থেকে একজন সাধারণ মুসলমান পর্যন্ত সবাই সবোর্ত্তম উদ্দীপনার পরিচয় দিয়েছিল। এ জন্যই এ মসজিদ সম্পর্কে কোরআন বলেছেঃ
*********
“এটা এমন মসজিদ যার ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার ওপর।”
রসূল সা. কোবায় পৌঁছলেন নবুয়তের একাদশ বছরের ৮ই রবিউল আউয়াল বৃহস্পতিবার। চৌদ্দ দিন পর তিনি সদলবলে মদিনায় রওনা হলেন। কোবা থেকে মদিনা পর্যন্ত আনসারগণ দু’ধারে লাইন করে দাঁড়িয়েছিলেন মোবারকবাদ জানানোর জন্য। রসূল সা. এর মাতুলালয়ের আত্মীয়রা বিশেষভাবে সশস্ত্রভাবে অবস্থান গ্রহণ করে। মহিলারা ছাদের উপর জমায়েত হয়ে স্বাগত সংগীত গাইতে থাকেঃ
********
ছোট ছোট শিশুরা দলে দলে ঘুরছিল এবং ঢোল বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছিলঃ
*******
এই শিশুদের ভালোবাসার জবাবে রসূল সা. তাদের প্রতি বিশেষ স্নেহ প্রদর্শন করলেন। তাদের সাথে কথা বললেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা কি আমাকে চাও?” তারা বললো, “জ্বী হাঁ!” রসূল সা. বললেন, “আমিও তোমাদের চাই।” (সীরাতুন্নবী)
মদিনার ভাগ্যে যখন এই ঐতিহাসিক মূহুর্তটা জুটলো, তখন সেখানে কেমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল, তা একবার কল্পনা করুন! সেখানকার অলিগলিতে কেমন দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল এবং আকাশে বাতাসে কেমন অনুভূতি ও কেমন সাড়া জেগেছিল একটু ভাবুন তো!
সাময়িক আবাসস্থল হিসাবে আবু আইয়ূব আনসারীর বাড়ীর ভাগ্য চমকে উঠলো। এখানে রসূল সা. সাত মাস অবস্থান করেন।