কেবলা পরিবর্তন
ইসলামী আন্দোলনের প্রাথমিক যুগে ইহুদীরা এমন অনেকগুলো লক্ষণ দেখতে পেয়েছিল, যার ভিত্তিতে তাদের মধ্যে আশা জন্মে গিয়েছিল যে, ধীরে ধীরে এই ঐতিহাসিক শক্তি তাদের মুঠোর মধ্যে চলে যাবে। কোরআনে বনী ইসরাঈলের বিশ্বজোড়া মর্যাদার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, “আমি তোমাদেরকে সারা বিশ্বের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।” তাছাড়া কোরআনে তাদের নবীদের নবুয়ত ও তাদের পবিত্র গ্রন্থের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে। তাদেরকে ‘এস, আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সর্ব সম্মত একটা বক্তব্যের দিকে’ এই আহ্বান জানানোর মাধ্যমে দ্বীনের কেন্দ্রীয় তত্ত্বকে উচ্চকিত করা হয়েছিল।
এ ছাড়া, রসূলুল্লাহ সা. মোশরেকদের রীতিনীতির মোকাবিলায় ইহুদীদের কিছু কিছু রীতিনীতিকে পসন্দ করতেন, যেমন মোশরেকরা চুলের একটা গোছা বড় করে রাখতো, কিন্তু ইহুদীরা এটা রাখতোনা। এ ক্ষেত্রে তিনি মোশরেকদের বিরোধিতা ও ইহুদীদের পক্ষাবলম্বন করেন। যে সব ব্যাপারে কোরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ আসতোনা, সে সব ব্যাপারে রসূল সা. ইহুদী ও খৃষ্টানদের নীতি অনুসরণ করতেন। (বোখারী, পোশাক সংক্রান্ত অধ্যায়) মদিনার ইহুদীরা আশুরার দিন রোযা রাখতো। রসূলও সা. ঐ দিন রোযা রাখতেন এবং মুসলমানদের জন্যও রোযা রাখা পসন্দ করতেন। কোন ইহুদীর লাশ সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন। সবোর্পরি, মুসলমানদের নামাযের কেবলা ছিল বাইতুল মাকদাস। এ সব জিনিস সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতো যে, ইসলাম মোশরেকদের চেয়ে আহলে কিতাবের নিকটতম ছিল। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ইহুদী ধর্মের মূল কাঠামোকে তো ইহুদীদের স্বার্থপর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতারা সম্পূর্ণরুপে বিকৃত করে ফেলেছিল। আর সেই বিকৃত কাঠামোটাও হয়ে গিয়েছিল নিষ্প্রাণ। অথচ হযরত মূসা আ. যে ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন তা ছিল অবিকল ইসলাম। অন্য সকল নবীও ইসলামেরই বাহক, আহ্বায়ক ও প্রচারক ছিলেন। কেবল প্রত্যেক নবীর আমলে শরীয়তের বিধানে সামান্য কিছু কিছু পার্থক্য থাকতো। মুহাম্মাদ সা. সেই একই ইসলামকে সারা দুনিয়ার সামনে পেশ করেছিলেন। শুধু তত্ত্ব হিসাবেই পেশ করছিলেন না, বরং বাস্তব আইন ও বিধানের আকারে তা কার্যকরও করেছিলেন। এই তাত্ত্বিক সম্পর্কটার কারণেই রসূল সা. নিজেও আশাবাদী ছিলেন যে ইহুদীরা ইসলামী তৎপরতাকে পর্যায়ক্রমে বুঝতে পারবে, বুঝার সাথে সাথে স্বাগতও জানাবে এবং এ কাজকে নিজেদেরই করণীয় কাজ বলে গণ্য করবে। তারা একদিন এজন্য আনন্দিত হবে যে, আল্লাহর নামে পতাকা ওড়ানো হচ্ছে, নবীদের শেখানো চারিত্রিক নীতিমালার ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের সামষ্টিক জীবন গড়ে উঠছে এবং তাওরাতের শরীয়তের মৌলিক মূল্যবোধগুলোকে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। এই আশাবাদের ভিত্তিতেই কোরআন স্বীয় দাওয়াতকে এভাবে পেশ করেছে যে, তার কাছে দলীয় ও গোষ্ঠীগত পরিচয়ের কোন গুরুত্ব নেই, বরং আসল গুরুত্ব হলো নীতি ও কর্মের তথা আদর্শ ও চরিত্রের এবং আকীদা ও আমলের। কোন ব্যক্তি চাই সে ইহুদী হোক, খৃষ্টান হোক, নক্ষত্র পূজারী হোক, কিংবা মুসলমান হোক, সে যদি আল্লাহ, আল্লাহর বিধান, তার নবীদের দাওয়াত ও কেয়ামতের দিনের হিসাব-নিকাশ ও জবাবদিহীর প্রতি যথাযথভাবে ঈমান আনে, এবং তারপর নিজের গোটা জীবনকে সৎকর্মশীল জীবনে পরিণত করে দেখিয়ে দেয়, তাহলে এটাই সত্যিকার কাংখিত ও বাঞ্ছিত জিনিস। নাম নয় বরং কাজই আসল বস্তু। সাইনবোর্ড নয়, নির্ভেজাল পথই আসল বাঞ্ছিত জিনিস। কে কার সাথে সম্পর্ক রাখে, কে কার দল বা গোষ্ঠীর লোক, তা আদৌ বিবেচ্য বিষয় নয়। আসল বিবেচ্য বিষয় হলো, কার চরিত্র কেমন, এবং মানবতার সম্মিলিত কল্যাণ কভাবে নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ইহুদীদের দিক থেকেও যেমন ইসলামী আন্দোলনের আশা পূরণ হয়নি, তেমনি ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকেও ইহুদীদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
এই টানাপোড়েনের মধ্যেই সহসা ইসলামী আন্দোলনে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেল। এই পরিবর্তন ছিল কেবলা পরিবর্তনের ঘটনা। প্রত্যেক যুগে ইসলামী আন্দোলনের মূল স্বভাব এই ছিল যে, সে নিজের অস্তিত্বের স্বতন্ত্র বৈশিষ্টকে বহাল রাখতে চায় এবং প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে আদর্শিক ও আকীদাগত স্বকীয়তাকে জীবিত রাখতে বদ্ধপরিকর। মক্কায় থাকতে এই উদ্দেশ্যেই বাইতুল মাকদাসকে কেবলা বানানো হয়েছিল, যাতে ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহী দল নিজের স্বতন্ত্র মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকে। এর ফলে হিযরত পর্যন্ত দীর্ঘকাল ব্যাপী মুসলমানরা মোশরেকদের মোকাবেলায় নিজেদের স্বাতন্ত্র ও স্বকীয়তাকে পুরোপুরিভাবে অনুভব করে। মোশরেকরাও বুঝতে পেরেছিল যে, তারা ও মুসলমানরা সম্পুর্ন আলাদা আলাদা দুটো আদর্শের ধারক ও বাহক। এই চেতনা ও অনুভূতিকেই “তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম এবং আমার জন্য আমার ধর্ম” এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটির মধ্য দিয়েই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, এতে স্পষ্টভাবেই বলে দেয়া হয়েছে, তোমাদের পথ আলাদা, আমাদের পথ আলাদা। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন মিলই নেই।
মদিনায় চলে আসার পর মুসলমানদের স্বকীয়তা যদি কোন দিক থেকে বিপন্ন হবার আশংকা থেকে থাকে, তবে তা ছিল সেখানকার ইহুদী ও খৃষ্টান গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। এখানে প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল ইহুদী ও খৃষ্টানদের নিষ্প্রাণ ধর্মের মিশ্রণ থেকে ইসলামী আন্দোলনের বিশিষ্টতা ও স্বাতন্ত্র্যকে সুরক্ষিত করার এবং মুসলিম সমাজকে ইহুদী সমাজে মানসিকভাবে বিলীন হয়ে যাওয়ার কবল থেকে রক্ষা করার। মক্কী যুগে বাইতুল মাকদাসকে অস্থায়ীভাবে কেবলা বানানোর যে প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, এখানে সে প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের হৃদয়ের সম্পর্ক হযরত ইবরাহীম আ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কেবলার প্রতিই ঘনিষ্ঠতর ছিল। রসূল সা. স্বয়ং হযরত ইবরাহীমেরই বংশধর ছিলেন এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রাথমিক সংগ্রামীরাও ছিলেন এই বংশেরই লোক। স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সেই অস্থায়ী ব্যবস্থা তখন নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এ কারণেই রসূলের সা. সত্যাভিষ্ট মন এই পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষমান ও উদগ্রীব ছিল।
আসলে কেবলা পরিবর্তনের আদেশ জারী করার মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত করলেন। তাদের শূণ্য পদে উম্মতে মুহাম্মদীকে নিয়োগ দান করলেন। গোটা বিশ্বমানবতার কল্যাণ ও সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত তৎপরতার যে কেন্দ্র এতদিন বাইতুল মাকদাসে ছিল, এখন তা কা’বা শরীফে স্থানান্তর হলো। মুসলমানদেরকে আখ্যায়িত করা হলো মধ্যপন্থী অর্থাৎ বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় জাতি। তার ওপর অর্পণ করা হলো মানব জাতির সামনে সত্যের সাক্ষ্যদানের গুরু দায়িত্ব এবং সমগ্র মানবজাতির নেতৃত্ব।
মদিনায় হিজরতের পর ষোল মাস পর্যন্ত বাইতুল মাকদাসের দিকে মুখ করে নামায পড়া হতে থাকে। হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের রজব কিংবা শা’বানের ঘটনা। ইবনে সা’দ বর্ণনা করেন যে, রসূল সা. বিশর বিন বারা ইবনে মারূরের রা. বাড়ীতে দাওয়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে যোহরের নামাযের সময় হলে তিনি জামায়াতের ইমামতি করতে দাঁড়িয়ে গেলেন। দু’রাকাত পড়ানো হলো। তৃতীয় রাকাতে ওহী যগে নিম্নের আয়াত নাযিল হলোঃ
“আমি আকাশের দিকে তোমার মুখ তোলা দেখে থাকি। কাজেই তুমি যে কেবলা পসন্দ কর, সেদিকেই তোমাকে ফেরাচ্ছি। অতএব, তুমি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফেরাও। এখন তুমি যেখানেই থাক, ঐ দিকেই মুখ করে নামায পড়।” (সূরা বাকারাঃ১৪৪)
এ আদেশ শোনা মাত্রই আল্লাহর সবচে অনুগত বান্দা নামাযের মধ্যেই কা’বার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আর তাঁর সাথে সাথেই তাঁর অনুসারী নামাযীরা সবাই নতুন কেবলার দিকে মুখ ফেরালেন। বাইতুল মাকদাস মদিনা থেকে সোজা উত্তরে এবং মক্কা দক্ষিণে অবস্থিত। নামাযের মাঝখানে কেবলা পরিবর্তনের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ইমামকে মুক্তাদীদের সামনে থেকে সোজা পেছনের দিকে চলে আসতে হয়েছিল এবং নামাযীদের কাতারকে সোজা পেছনের দিকে ঘুরে যেতে হয়েছিল। এরপর মদিনা ও তার পার্শবর্তী পল্লীগুলোতেও ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলো। বারা বিন আযের রা. বর্ণনা করেন যে, এক মসজিদে লোকেরা যখন রুকুতে ছিল, তখন এ খবর পৌঁছে। তারা খবর শোনামাত্রই ঐ অবস্থায়ই কা’বার দিকে মুখ ফেরালেন। আনাস বিন মালেকের বর্ণনা অনুসারে বনু সালামা গোত্রে পরদিন ফজরের নামাযের সময় খবর পৌঁছে, লোকেরা এক রাকাত পড়ে দ্বিতীয় রাকাতে ছিল। এই সময় ঘোষকের ঘোষণা শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাত সবাই নতুন কেবলার দিকে মুখ ঘুরায়। (তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারাঃ টীকা ১৪৬)
এই পরিবর্তনে যে হৈ চৈ আসন্ন হয়ে উঠেছিল, সে সম্পর্কে কোরআন আগে ভাগেই মুসলমানদের সাবধান করে দেয়ঃ “অচিরেই অজ্ঞ লোকেরা অপপ্রচারের তাণ্ডব সৃষ্টি করবে যে, মুসলমানরা কোন কারণে কেবলা পরিবর্তন করলো?” নানা রকমের প্রশ্ন তোলা হবে, অদ্ভুত ধরনের মনস্তাত্বিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং পারস্পরিক জাতিগত সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। মুসলমানরা যাতে আসন্ন অপপ্রচারের তাণ্ডবের সামনে জোরালো অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে পারে, সে জন্য কোরআন তাদেরকে কেবলা পরিবর্তনের তাৎপর্য পূবার্হ্নেই বুঝিয়ে দিল। সে জানিয়ে দিল যে, শুরুতে বাইতুল মাকদাসকে কেবলা বানানোর উদ্দেশ্য ছিল আরব জাতীয়তাবাদের মূর্তি ভেঙ্গে চুরমার করা। কেননা আরবরা নিজেদের জাতিগত বৃত্তের বাইরে কোন জিনিসের কোন গুরুত্ব স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল না। আর এখন বাইতুল মাকদাস থেকে কা’বার দিকে মুখ ঘুরানোর উদ্দেশ্য ইসরাইলী আভিজাত্যের মূর্তিও ভেংগে গুড়িয়ে দেয়া। একটা কাজ আগে করা হয়েছিল। দ্বিতীয় কাজটা এখন করা হলো। আরব জাতীয়তাবাদের উপাসকরা আগেই ছাটাই হয়ে গিয়েছিল। এবার ইসরাইলী জাতীয়তাবাদের পূজারীদের ছাটাই হওয়ার পালা। এভাবে মোনাফেক নামক ঘুনের কবল থেকে সমাজ পবিত্র হয়ে যাবে। এরপর ইসলামী সমাজে শুধু তারাই টিকে থাকবে, যাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর আদেশ ও রসূলের সুন্নাহর গুরুত্ব সবার্ধিক। এক্ষণে ইসলামী আন্দোলন যে পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে, তা রসূল সা. এর একনিষ্ঠ আনুগত্যকারীদেরকে সমস্ত আদর্শহীন লোকের মিশ্রণ থেকে মুক্ত করবে। আর আদর্শহীনদেরকে সেই সব একনিষ্ঠ ঈমানদারদের থেকে ছাটাই করে দেবে, যারা বিশ্বাস করে যে পূর্ব ও পশ্চিম সবই আল্লাহর এবং আল্লাহই আনুগত্যের আসল কেন্দ্র বিন্দু যারা এই নিগুঢ় তত্ত্ব জানে যে, শুধু পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখ করাই আসল নেক কাজ নয়, বরং আসল নেক কাজ হলো শরীয়তের এই সব বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার অভ্যন্তরে সক্রিয় আসল প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তি হলো আল্লাহর ওপর, আখেরাতের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর, আল্লাহর কিতাবের ওপর, ও তার নবীদের ওপর ঈমান আনা এবং আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা। সুতরাং তোমাদের কেবলার বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা প্রতিষ্ঠায় যে জিনিস সবোর্চ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, তা হলোঃ
ভালোকাজ এবং কল্যাণমূলক কাজের দিকে অগ্রসর হও, আল্লাহর বড় বড় বৈপ্লবিক ও পরিবর্তনকামী নির্দেশ পালনে কোন বিরোধী শক্তির ভয় পেয়না, ভয় পেয়ো শুধু আল্লাহকে।
কোরআন বিশ্ব বিধাতার আদেশ ঘোষণা করার সময়েই বলে দিয়েছিল যে, এ ঘটনা দৃঢ় প্রত্যয়ী মুমিনরা ব্যতিত সবার কাছেই কঠিন ও কষ্টকর লাগবে। এ নিয়ে যখন গোলযোগ সৃষ্টি হবে, তখন অনেকে ঘাবড়ে যাবে। প্রত্যেক অলিগলিতে যখন বিতর্ক ছড়িয়ে পড়বে, তখন দূবর্ল লোকদের মাথায় চক্কর দেবে এবং তাদের আবেগে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হবে। এবার শুনুন কেবলা পরিবর্তন নিয়ে যে সব মন্তব্য করা হয়েছিল তার কিছু নমুনা।
মোশরেকরা বললো, ঐ দেখ, এবার মুহাম্মাদ সা. ও তার দলবলের কিছুটা চেতনা ফিরে এসেছে। আমাদের কা’বাকে এবার যখন কেবলা হিসেবে গ্রহণ করেছে তখন ওরা ধীরে ধীরে আমাদের ধর্মেও ফিরে আসবে।
ইহুদীরা বললো, ইসলামের নেতা আমাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে আক্রোশে এতই বেসামাল হয়ে গেছে যে, নবীদের কেবলা পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছে। সে যদি নবী হতো তাহলে এই কেবলাকে পরিত্যাগ করতোনা।
মোনাফেকরা বলতে লাগলো, ‘কিছুই বুঝে আসছেনা মুহাম্মাদের সঠিক কেবলা কোনটা। কেবলা নিয়ে যেন খেলা শুরু হয়েছে। যেদিকে মন চায়, সেদিকেই মুখ ফেরানো হয়। দেখে শুনে মনে হচ্ছে পুরো ইসলাম ধর্মটাই যেন ইচ্ছের খেলা।’
আর যারা পাক্কা ঈমানদার ছিল, তারা বললো, আমরা আদেশ শুনেছি, তার আনুগত্য করেছি এবং আমরা এর উপর ঈমান এনেছি। এ সবই আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে। (যাদুল মায়াদ, ২য় খণ্ড)
শেষোক্ত এই ঈমানদারদের দলটাই অপপ্রচারের ঝরের কবলে পড়ে গেল। চারদিক থেকে প্রশ্ন, কূটতর্ক এবং ব্যংগ বিদ্রুপের বান নিক্ষিপ্ত হতে লাগলো। প্রত্যেক মজলিসে একই আলোচনা, প্রত্যেক অলিতে গলিতে জটলা পাকিয়ে একই কানাঘুষা এবং প্রতি মূহুর্তে উত্তেজনাকর বাগবিতণ্ডা চলছিল। যে কোন বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক। প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের এবং জনসাধারণের চিরাচরিত ধ্যান ধারণার বিপরীত প্রতিটি পদক্ষেপে এ ধরনের হাঙ্গামা সৃষ্টি হয়ে থাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে তাদের কর্মীরা ঘাবড়ে গিয়ে ও দিশেহারা হয়ে অনেক সময় উত্তেজনার পর্যায়ে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই আশংকার পরিপ্রেক্ষিতেই উপদেশ দেয়া হলো, এ সব সংকটজনক পরিস্থিতি অতিক্রম করার জন্য ধৈর্য ও নামাযই সবোর্ত্তম পন্থা। অপপ্রচারকারীদের সম্পর্কে বলা হলো, সত্য অনুসন্ধান করা কখনো তাদের লক্ষ্য নয়। যুক্তিপ্রমাণ দ্বারা তারা কখনো পরিতৃপ্ত ও শান্ত হবার নয়। তাদের প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য কেবল বিব্রত করা। তোমরা যতক্ষণ তোমাদের আদর্শ ও মূলনীতি ত্যাগ করে তাদের অনুসারী না হবে, ততক্ষণ তারা কিছুতেই সন্তুষ্ট হবে না।
অর্থহীন কূটতর্কের জবাবে চূড়ান্ত যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপনের দায়িত্ব ইসলামী আন্দোলনের কাঁধের ওপর অর্পিত ছিল। সে দায়িত্ব পালন করার জন্য অত্যন্ত ধারালো ও অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করা হলো এবং জনগণের সামনে পবিত্র কা’বার মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সূরা আল ইমরানের এক জায়গায় ব্যাখ্যা করা হলো। এরশাদ করা হলোঃ
“মানব জাতির জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রথম এবাদতের স্থান হলো মক্কায় অবস্থি সেই ঘর, যাকে বরকত ও কল্যাণ দান করা হয়েছে এবং যাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াতের কেন্দ্র বানানো হয়েছে। এতে প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। সেখানে ইবরাহীমের এবাদতের জায়গাও রয়েছে। সেখানে যে একবার প্রবেশ করে সে নিরাপদ হয়ে যায়। যে ব্যক্তি এই ঘরের কাছে পৌঁছার সামর্থ রাখে, তার সেখানে গিয়ে হজ্জ আদায় করা কর্তব্য। আর যে ব্যক্তি এ নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করে, তার জানা উচিত যে, আল্লাহ সারা দুনিয়াবাসী থেকেই মুখাপেক্ষাহীন।” (আয়াত ৯৬-৯৭)
বাইতুল মাকদাস সম্পর্কে এ তথ্য বাইবেল থেকেই জানা গিয়েছিল যে, হযরত মূসার সাড়ে চারশো বছর পড় হযরত সোলায়মান তা নির্মাণ করিয়েছিলেন। হযরত সোলায়মানের শাসনামলেই তাকে কেবলা নির্ধারণ করা হয়। পক্ষান্তরে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় উভয় প্রকারের সবর্সম্মত বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, কা’বা শরীফকে হযরত ইবরাহীম আ. হযরত মূসারও আট/নয় শো বছর আগে নির্মাণ করেছিলেন। কা’বা শুধু সময়ের দিক থেকেই জ্যেষ্ঠ নয়, বরং তার পবিত্র পরিবেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনাবলীও রয়েছে। এর সাথে ইসলামের অত্যন্ত মূল্যবান ঐতিহ্য জড়িত রয়েছে। তার প্রতিটি প্রান্তরে উৎকীর্ণ রয়েছে সত্য ও ন্যায়ের পতাকা সমুন্নত করার ইতিহাস। তা ছাড়া এতে হযরত ইবরাহীমের এবাদতের উপকরণও সংরক্ষিত রয়েছে। এ স্থান আজও তাওহীদী প্রেরণার উৎস। এবাদতের এই কেন্দ্রভূমি যে আল্লাহর কাছেও গৃহীত ও মনোনীত, তার অকাট্য প্রমাণ এইযে, উষর মরুর অভ্যন্তরে নির্মিত এই ঘরের আশপাশে বিশাল এক মনুষ্যবসতি গড়ে উঠেছে এবং লোকেরা এখানে অনেক দূর দূর থেকে এসে থাকে। এর উচ্চ মর্যাদার আরো একটা উজ্জ্বল প্রমাণ এই যে, এই তরুলতাহীন উষর মরুবাসীদের কাছে আপনা থেকেই সব ধরনের জীবিকা পৌঁছে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আরবের জংগী বেদুঈন সমাজে এই পবিত্র ঘর চার হাজার বছর ধরে শান্তি ও নিরাপত্তার একটা দ্বীপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে যেই প্রবেশ করুক, তার জান মাল ও ইজ্জত নিরাপদ ও সুরক্ষিত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে রক্ত পিপাসু লোকেরা পর্যন্ত এই ঘরের ছায়ায় এসে তরবারী কোষবদ্ধ করে ও আক্রোশের আগুন নিভিয়ে ফেলে। খুনী ও ডাকাত এর বেষ্টনীতে প্রবেশ করা মাত্রই শান্তি প্রিয় নাগরিক হয়ে যায়। তাই ইবরাহীম আ. এর দাওয়াত নিয়ে ময়দানে নামা যে কোন আন্দোলনের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হওয়া এই ঘরেরই ন্যায্য অধিকার। এতে ধর্ম বা যুক্তির পরিপন্থী কোন জিনিসটা হয়েছে যে, তা নিয়ে অলিগলিতে এত কানাঘুষা চলছে?
এই যুক্তির ফলে কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকলে তা নেয়া হয়েছিল সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে। ইহুদীরা কেবলা পরিবর্তনকে মুসলমানদের পক্ষ থেকে একটা চূড়ান্ত বৈরী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করেছিল। কেননা এর কারণে তাদের সকল আশা ভরসা খতম হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদেরকে বাগে আনা যাবে বলে তারা যে স্বপ্ন দেখেছিল, সে স্বপ্ন নস্যাত হয়ে গিয়েছিল। তারা বুঝতে পারলো, মুসলমানদেরকে বশে আনা সহজ নয়। অপরদিকে মুসলমানরাও ইহুদীদের মনের সমস্ত ক্লেদ স্পষ্ট দেখতে পেল। তাদের মানসিকতার সমস্ত অন্ধকার দিক তাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল। এত ঘৃণ্য মানসিকতা যাদের, তাদের সাথে সেই ভালো ধারণা পোষণ করা সম্ভব নয়, যার ভিত্তিতে তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। মুসলমানরা পরিষ্কার বুঝে নিল যে, মদিনাতেও ইসলামী আন্দোলনকে নিজের ক্ষমতার উপর নির্ভর করেই টিকে থাকতে হবে। ধর্ম ও খোদাভীরুতার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোন সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের আশা করা বৃথা। বরঞ্চ দিন দিন এই আশংকা ঘনীভূত হতে লাগলো যে, ইহুদীরা মক্কার কাফের ও মোশরেকদের চেয়েও জঘন্য মানসিকতা নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের পথ আগলে ধরবে। কিন্তু এ আশংকা স্বত্ত্বেও রসূল সা. ও তাঁর সাহাবীদের আচরণে সব সমেয় ইসলামের আহ্বায়ক সুলভ নৈতিকতার মান বজায় রইল। যে যেমন, তাঁর সাথে তেমন আচরণ ইহুদী মোনাফেক ও অন্যান্য বৈরী শ্রেণীর লোকদের সাথে করা হয়নি। কূটতর্ক, ব্যংগ বিদ্রুপ ও ইতরসুলভ আচরণের মোকাবেলায় মুসলমানরা হার মানতো। কোন কথা বলতে হলে ভদ্রজনোচিত পন্থায় ও বুদ্ধিমত্তার সাথে কেবল যুক্তিযুক্ত কথা বলেই তারা ক্ষান্ত থাকতেন। তাদের বাড়াবাড়িকে উদার মনোভাব নিয়ে ধৈর্য ও উদারতার সাথে গ্রহণ করতেন।
কিন্তু তা স্বত্ত্বেও মনের মধ্যে এ যাবত আটকে থাকা উত্তেজনা বাঁধভাঙ্গা বন্যার মত বেরিয়ে পড়তো।
অসভ্যপনা ও ইতরামি
যাদের কোন গঠনমূলক লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী থাকেনা, তারা সাধারণত অন্য কাউকেও কোন গঠনমূলক কাজ করতে দেয়না। এর কারণ শুধু এই যে, এতে দুনিয়াবাসীর সামনে তাদের অসারতা প্রমাণিত হয়। মদিনার ইহুদীদের অবস্থাও ছিল এরূপ। তারা দীর্ঘকাল মদিনায় অবস্থান করে আসছিল। কিন্তু নিম্নস্তরের মানুষদের নৈতিক মানোন্নয়নের জন্য তারা কোন কাজ করার যোগ্যতা দেখাতে পারেনি। মানুষের মন মানসিকতার উন্নয়ন, চরিত্র সংশোধন, ভদ্রতা ও শৃংখলার প্রশিক্ষণ দান, এবং শান্তি ও নিরাপত্তামূলক জীবন যাপনের শিক্ষা দানে তারা কোন পদক্ষেপই নেয়নি। পতিত মানবতাকে সামাল দেয়া দূরে থাক, তারা নিজেদেরকেও অধোপতন থেকে রক্ষা করতে পারেনি। দুনিয়ার যাবতীয় সামাজিক ও নৈতিক ব্যাধি তাদের মেরুমজ্জায় ঢুকে গিয়েছিল এবং কোন রোগেরই চিকিৎসার ব্যবস্থা তারা করতে পারেনি। এমতাবস্থায় তাদের সামনে যখন একটা নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটলো এবং সেই শক্তি মানুষের মন মগজে প্রেরণাদায়ক নীতি, আদর্শ ও আকীদা বিশ্বাসের প্রদীপ জ্বালাতে শুরু করলো, সমস্ত সামাজিক ব্যাধির চিকিৎসা করে নব উদ্যমে নতুন জাতি গড়ার কাজ শুরু করলো এবং একটা পবিত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপযোগী করে ব্যক্তির চরিত্র গঠন ও সেই সব ব্যক্তির সাহায্যে একটা শান্তিপূর্ণ ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করে দিল, তখন ইহুদীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তারা এই গঠনমূলক আন্দোলনকে ব্যর্থ করার জন্য যে কোন হীন চেষ্টা তদবীর শুরু করে দিল। এ ধরনের নেতিবাচক ও নাশকতামূলক শক্তি যখন কারো বিরধিতায় বদ্ধপরিকর হয় তখন তা সভ্যতা, ভব্যতা ও ভদ্রতাকে শিকেয় তুলে রাখে। অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে অসভ্য ও অভদ্র আচরণ করা তার রপ্ত হয়ে যায়। ইহুদিরাও অনুরূপ চরম অসভ্য আচরণ শুরু করে দিল।
নবীদের উত্তরসূরি, আল্লাহর কিতাবের অনুসারী এবং আল্লাহর আইনের শিক্ষক ও ফতোয়াদাতা হিসাবে সুপরিচিত ইহুদী সম্প্রদায় শত্রুতা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে যে সব অপকর্ম ও অসদাচরণ করতে শুরু করলো, তার দুতিনটে অবিস্মরণীয় উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছে। নিজেদেরকে ছাড়া আর কাউকে ধার্মিক ও খোদাভীরু মনে করতোনা এই ইহুদী সম্প্রদায়। অথচ তাদের নৈতিকতার এমনই অবস্থা হয়েছিল যে, তারা যখন রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করতো, তখন ‘আসসালামু আলাইকুম’ এর পরিবর্তে ‘আসসামু আলাইকুম’ বলতো। এর অর্থ হলো, ‘তোমার মৃত্যু হোক।’ এই আচরণ করা হতো সেই মহান ব্যক্তির সাথে, যিনি হযরত ইবরাহীম, মূসা, ইয়াকুব, ইউসুফ, ইসহাক ও ইসমাঈল আ.-এরই আনীত দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন, যিনি তাওরাতের আসল প্রাণশক্তির পুনরুজ্জীবনে নিয়োজিত ছিলেন, যিনি আল্লাহর আইন ও বিধানকেই পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামরত ছিলেন। বরং সত্য কথা এই যে, তিনি তো প্রকৃতপক্ষে ইহুদীদেরই ভুলে যাওয়া দায়িত্ব পালন করছিলেন, এবং তাদেরই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করছিলেন। একবার এদের কয়েকজন রসূল সা. এর বাড়ীতে এলে গুন্ডাপান্ডার ন্যায় আচরণ ও উপরোক্ত ভাষা ব্যবহার করে। এই অসদাচরণের বিরুদ্ধে হযরত আয়েশা পর্যন্ত পর্দার আড়াল থেকে কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি এতই রেগে যান যে, জবাব না দিয়ে থাকতে পারেননি। তিনি বলে অথেন, “হতভাগারা, তোদের মৃত্যু হোক।” রসূল সা. শুনতে পেয়ে বলেন, “আয়েশা, একটু নম্র হও।” হযরত আয়েশা বললেন, “আপনি শুনছেন ওরা কী বলেছে?” রসূল সা. বললেন, “আমি শুনেছি, তবে জবাবে শুধু বলেছি ‘ওয়ালাইকুম’ অর্থাৎ ‘তোমাদেরও’। এটুকুই যথেষ্ট”
অসভ্য আচরণের আরো দুটো লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত কোরআনে চিরদিনের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। লক্ষ্য করুনঃ
প্রথমত রসূল সা. এর দরবারে তারা হাজির হতো এবং আলাপ আলোচনার সময় যখনই এ কথা বলার প্রয়োজন বোধ করতো যে, ‘একটু থামুন, কথা বুঝার সুযোগ দিন’, তখন একটা দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ‘রায়িনা’ ব্যবহার করতো। আরবীতে এ শব্দটির বাহ্যিক অর্থ হলো, ‘আমাদের একটু সুযোগ দিন, আমাদের বক্তব্য শুনুন, বা আমাদের দিকে একটু লক্ষ্য করুন’। কিন্তু ইহুদীদের মূল ধর্মীয় ভাষা ইবরানীতে এর কাছাকাছি ও প্রায় সম উচ্চারিত শব্দ এই অর্থ এই অর্থে ব্যবহৃত হত যে, ‘শোন, তুই বধির হয়ে যা’। তাছাড়া আরবীতেও এর প্রায় কাছাকাছি ধাতু থেকে তৈরী এবং প্রায় সম উচ্চারিত এমন শব্দ রয়েছে, যার খুবই খারাপ অর্থ বেরুতো। যেমন ‘রায়য়া’ থেকে নির্গত একটা শব্দ ছিল ‘আর রায়া’ যার অর্থ ‘নিকৃষ্ট মানুষ’। এ শব্দটাকে ‘রায়ায়েনা’ আকৃতিতে পরিবর্তন করা মোটেই কঠিন ছিলনা। (যার অর্থ দাঁড়াতো ‘আমাদের নিকৃষ্ট মানুষটি।’-অনুবাদক) অনুরূপভাবে ‘রায়ানা’ শব্দটি অজ্ঞ ও নিবোর্ধ হয়ে যাওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খোদ্ ‘রায়েনা’ শব্দটিকেও একটু জিহ্বা বাঁকিয়ে উচ্চারণ করলে ‘রায়িয়ানা’তে রূপান্তরিত করা যায়, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ওহে আমাদের রাখাল’। ইহুদীদের নেতৃস্থানীয় ধর্মীয় জুব্বা ও পাগড়িধারী লোকেরা এভাবে সুকৌশলে কটুবাক্যের তীর নিক্ষেপ করতো। সাধারণ মানুষ সাহিত্য ও ভাষা সম্পর্কে এত দক্ষতা কোথায় পাবে। এটা তো বড় বড় দক্ষ আলেমদের কারসাজি। বাড়ী থেকে তারা ভালোমত চিন্তা গবেষণা করে প্রস্তুতি নিয়ে আসতো যে, আজ কি কি উপায়ে অসভ্য আচরণ করা যেতে পারে। এই সব ধড়িবাজ আলেমদের মধ্যে ‘যায়েদ বিন তাবুত’ নামক এক ব্যক্তি সম্পর্কে ইতিহাসে সুস্পষ্ট বিবরণ সংরক্ষিত রয়েছে। অনৈতিক ও অভদ্রজনোচিত বাক্যবান নিক্ষেপের ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত স্থাপনে এই ইহুদী ভণ্ড মৌলবীও বিরাট অবদান রেখেছিল। বাহ্যত তারা খুবই ভদ্র ও মার্জিত আচরণের লেবেল আঁটা ছিল। কিন্তু তাদের অন্তরের গভীরে দৃষ্টি দিলে দেখা যেত, গুণ্ডাসুলভ মানসিকতা সক্রিয় রয়েছে। তাদের পরস্পরের মধ্যে জানাজানি ছিল যে, আমরা এ যুগের সেরা মানুষটাকে ব্যংগ বিদ্রুপ করছি। কিন্তু কেউ যদি আপত্তি জানাতো তবে বলতো, আরে ভাই, আমাদের অভদ্র মনে করেছেন নাকি? আমরা তো যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও আদবের সাথে কথা বলছি যে, আমাদেরকে একটু বুঝবার ও বুঝাবার অবকাশ দিন।
দ্বিতীয়ত, আলাপ আলোচনার মাঝখানে কখনো কখনো নবীদের উত্তরসূরি ইহুদী আলেমরা রসূল সা. এর সাথে এভাবে বাক্যালাপ করতোঃ ‘ইসমা’ গায়রা মুসমায়িন।’ এ কথাটার বাহ্যিক অর্থ হলো, “একটু শুনুন, আপনি এমন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি যে, আপনাকে আপনার ইচ্ছা বা অনুমতি ছাড়া কোন অথা বলা চলেনা।” কিন্তু তাদের কুচক্রী মানসিকতা এর অন্য একটা অর্থ বুঝাতো। সেটি হলো, “তুমি কোন কথা শোনানোর যোগ্যই নও। আল্লাহ যেন তোমাকে বধির করে দেয় এবং তোমার শ্রবণ শক্তিই যেন না থাকে।”
লক্ষ্য করুন, কত নোংরা ও ঘৃণ্য মানসিকতার অধিকারী লোকেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিরোধে নেমেছিল।
তৃতীয়ত, মুমিনরা রসূল সা. এর বৈঠকে বসে যখন কোন কথা শুনতো এবং বুঝতো, তখন আল্লাহর নির্দেশে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার মনোভাব নিয়ে বলে উঠতো, “সামি’না ওয়া আতা’না’ অর্থাৎ আমরা শুনলাম এবং আনুগত্য অবলম্বন করলাম।” কিন্তু তাওরাতের ধারক বাহকরা এরূপ ক্ষেত্রে অত্যন্ত নাটকীয় আচরণ করতো। প্রথমে জোরে শোরে বলতো ‘সামি’না অর্থাৎ জ্বী হা, শুনেছি।’ পরক্ষণে ‘আতা’না’ (আনুগত্য অবলম্বন করলাম)-এর পরিবর্তে একটু আসতে জিহ্বাটাকে একটু বাঁকিয়ে বলতো, ‘আসাইনা’ অর্থাৎ “তোমার আদেশ প্রত্যাখ্যান করলাম ও অমান্য করার সংকল্প নিলাম।” এখানেও সেই একই জটিলতা যে, কেউ আপত্তি তুললে বিরক্তি প্রকাশ করে বলতো, “আমাদেরকে তোমরা এতই বাজে লোক মনে করেছ? বিরোধিতার আতিশয্যে আমাদের ওপর এমন অপবাদ আরোপ করছ? তোমাদের নিজেদের মধ্যকার ছাড়া বাইরের আলেম ও বিজ্ঞজনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কোন রেওয়াজ নেই? নিজেদের ছাড়া আর কাউকে তোমরা ভদ্র ও সদাচারী মনে করতে প্রস্তুত নও?”
ভেবে দেখার বিষয় হলো, এ ধরনের হীন আচরণ দ্বারা কি রসূল সা. এর আন্দোলনের কোন ক্ষতি সাধন করা গিয়েছিল? এ হীনতা ও নীচাশয়তার জোরে কি ইসলামী দলের অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করা গিয়েছিল? আসলে গালি ও কটূবাক্য বর্ষণ করে কোন গঠনমূলক শক্তির লোমও ছেড়া যায়না। প্রতিপক্ষ এতে শুধু এতটুকুই মজা পায় যে, তার নেতিবাচক, নাশকতামূলক ও গোঁড়ামিপূর্ণ মনের পুঞ্জীভূত বাষ্প বেরিয়ে যায়। এই সব ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যখন নবীজীর বৈঠকে এ ধরনের কীর্তিকলাপ সম্পাদন করে বিদায় হয়ে যেত, তখন নিজেদের বৈঠকে গিয়ে নিশ্চয়ই আস্ফালন করতো যে, আজ নবী সাহেবকে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে এসেছি। আপন মুরীদদের সমাবেশে বসে নিশ্চয়ই নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিত যে, আমরা একটা শব্দকে ওলট পালট করে কি সব অর্থ বের করেছি এবং আরোপ করেছি। আমাদের ভাষাজ্ঞান, ব্যাকরণ জ্ঞান এবং অলংকার শাস্ত্রীয় পারদর্শিতার বলে আমরা কত বড় বড় যুদ্ধ চালিয়ে এলাম।
ইহুদী ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের এই সব অপকর্ম থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা হলো, ধর্মীয় নেতারা যখন অধোপতনের শিকার হয়, তখন তাদের মধ্যে প্রধানত শাব্দিক বিকৃতির নোংরা ব্যাধি সৃষ্টি হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত তাদের মধ্য থেকে মানবতা, ভদ্রতা, শালীনতা ও শিষ্ঠাচারের দাবী ও চাহিদা বিবেচনা করার ক্ষমতা লোপ পায়। তৃতীয়ত তাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডের মাঝে লজ্জাজনক স্ববিরোধিতার জন্ম নেয়। চতুর্থত তাদের মধ্যে এক ধরনের কাপুরুষতা পাওয়া যায়, যার কারণে তারা খোলাখুলিভাবে তাদের মনের নোংরা ভাবাবেগ প্রকাশ করতেও পারেনা। বরং তারা নিজেদের নীচ ও কদর্য মানসিকতার ওপর শালীনতা ও ভদ্রতার লেবেল এঁটে চলে। এ আলামতগুলো যে কোন চিন্তাধারা ও মানসিকতার অকর্মণ্যতার অকাট্য প্রমাণ। বিশেষত কটু ও অশালীন বাক্যালাপ যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানে সত্য ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে কোন সম্পর্কই থাকতে পারে না। সদ্য রান্না করা কোন খাবারের কোন হাড়ি থেকে বেরুনো সুগন্ধ যেমন খাবারটার ধরন ও মশলার মান সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি মানুষের প্রতিটা কথাবার্তা ও কথা বলার ভংগী তার স্বভাব চরিত্রের মাপকাঠি হয়ে থাকে। কারো মন মগজের ডেকচি থেকে যদি অশালীন বাক্যালাপ ও অভদ্র আচরণরূপী দুর্গন্ধ বেরোয়, তাহলে কিছুতেই আশা কড়া যায়না যে, তার মধ্যে পবিত্র ধ্যানধারণা ও ভদ্রজনোচিত মনোভাবের সমন্বয়ে কোন মহৎ চরিত্র তৈরী হচ্ছে। যখন কাউকে দেখবেন ভিন্ন মতাবলম্বীর সাথে অশালীন বাক্যালাপ ও অসদাচরণ করছে, তখন বুঝবেন সে তার প্রতিপক্ষের সাথে যুক্তির লড়াইতেও হেরে গেছে, নৈতিকতার লড়াইতেও পরাভূত হয়েছে। এখন এই হেরে যাওয়া মানুষটি গালাগাল দিয়ে কেবল মনের বিষ উদগীরণ করছে। আর মনের বিষ উদগীরণকারীরা ইতিহাসে কোন গুরুত্ব পায়না। তারা কেবল বিষেদাগারই করতে থাকে, আর গঠনমূলক দাওয়াতের কাজে নিয়োজিত কাফেলাতো কেবল সামনেই এগিয়ে যেতে থাকে।
এখানেই শেষ নয়। মদিনায় যখন আযানের প্রচলন হলো, তখন যেহেতু ইহুদীদের প্রচলিত ধর্মীয় বিধির বিরুদ্ধে এটাও একটা ধর্মীয় বেদয়াত ছিল, এ জন্য তারা আযান নিয়েও অনেক জটিলতায় ভুগতো। বিশেষত তারা যখন দেখতো যে, আযানের শব্দ ও বাক্যগুলো ইসলামের গোটা বিপ্লবী দাওয়াত ও তার মৌলিক মতাদর্শকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরে এবং দিনে পাঁচবার এই আযান উচ্চ ও মধুর স্বর উচ্চারণ করা একটা অত্যন্ত কার্যকর ও প্রভাবশালী প্রচারমাধ্যম। এ আওয়ায তাদের নারী, শিশু ও গোলামদের কানে প্রতিদিন পাঁচবার প্রবেশ করতো। একবার কল্পনা করুন, এই নজীরবিহীন ধ্বনি যখন বিলালের সুলোলিত কণ্ঠে উচ্চারিত হতো, তখন মদিনার আকাশে বাতাসে কেমন নীরবতা বিরাজ করতো। মুসলমান অমুসলমান নিবির্শেষে সকলেরই মন হয়তো আকৃষ্ট হয়ে যেত। বিশেষত ঘণ্টা ও নাকাড়ার ধ্বনির সাথে আযানের ধ্বনির পার্থক্য নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতো। তাদের জনগণের মনেও এর প্রতি কিছু না কিছু অনুভূতি হয়তো জন্ম নিত। ঘণ্টা ও নাকাড়ার ধ্বনিতো কেবল ধ্বনিই ছিল। তাতে কোন কথাও ছিলনা অর্থও ছিল না। পক্ষান্তরে আযানের ধ্বনি ছিল সহজবোধ্য অর্থে ঝংকৃত কতিপয় বাক্যের সমষ্টি। নাকাড়া ও ঘণ্টার ধ্বনিতে কোন মানবীয় অনুভূতির অভিব্যক্তি ঘটতোনা, অথচ আযানের আহ্বানে প্রতিফলিত হতো মানুষের আবেগ ও অনুভূতি। এই পার্থক্যটা বুঝতে পারার পর ইহুদীদের এ কথা স্বীকার করা উচিত ছিল যে, আযানই যথার্থ এবাদতের দাওয়াত দেয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত কার্যকর ও শ্রেষ্ঠতর মাধ্যম। কিন্তু তা স্বীকার না করে তারা ক্ষেপে গেল। তারা আযান দাতার আওয়াযকে আশ্চর্য ধরনের উপমা দিত, নকল করতো এবং শব্দ বিকৃত করে করে হাস্যোদ্দীপক অংগভংগী করতো। ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা এই ভণ্ড ধার্মিকদের ভাড়ের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আযান যে কাজ করছিল, তা ব্যংগবিদ্রুপ ও ভাড়ামী করে কিভাবে রোধ করা সম্ভব?
ইহুদীদের অসভ্যপনা এতদূর গড়িয়েছিল যে, তারা স্বয়ং আলাহ তায়ালাকেও এর শিকার তারা বানিয়ে ফেলেছিল। যেমনঃ কোরআনের আয়াত “আল্লাহকে কে ঋণ দিতে প্রস্তুত?” এর সরল অর্থ গ্রহণ করার পরিবর্তে এই বলে বিদ্রুপ করা শুরু করে দিল যে, ‘এখন তো আল্লাহ তায়ালাও গরীব হয়ে গেছেন। উনিও এখন বান্দাদের কাছে ঋণ চাওয়া শুরু করেছেন।’ আল্লাহর সাথে নির্লজ্জতা ও ধৃষ্টতার এমন জঘন্য উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে কোরআনে যেখানে যেখানে মশা মাছি ও অনুরূপ ছোট ছোট জিনিসকে উদহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এবং এগুলোর অস্তিত্বকে যুক্তি হিসেবে পেশ করা হয়েছে, সেখানে ইহুদীরা ঠাট্টাবিদ্রুপের তাণ্ডব সৃষ্টি করার সুযোগ পেয়ে যেত। তারা বলতো, মুসলমানদের আল্লাহও আশ্চর্য ধরনের। তিনি উদাহরণ দিতে গিয়েও মশামাছির মত নগণ্য প্রাণী ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাননা। আর যে কোরআনে এই সব নগণ্য জিনিসের উল্লেখ থাকে, তা আল্লাহর কিতাব হয় কি করে? তারা এর কেমন দাঁতভাঙ্গা জবাব পেল দেখুন আল্লাহর বক্তব্যঃ
“আল্লাহ মশা বা তার চেয়েও ক্ষুদ্র জিনিসের উদাহরণ দিতে কখনো লজ্জা পাননা। যারা হক কথা মানতে প্রস্তুত তারা এসব উদাহরণ দেখে বুঝতে পারে যে, এটা সত্য এবং এটা তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকেই এসেছে। আর যারা মানতে প্রস্তুত নয়, তারা এগুলো শুনে বলতে থাকে, এ ধরনের উদাহরণের সাথে আল্লাহর কিসের সম্পর্ক?” (সূরা বাকারা-২৬)
হাস্যকর দাবী
ইহুদীদের বেয়াড়াপনা প্রমাণ দাবী করার রূপ ধারণ করে এক উদ্ভট হাস্যকর অবস্থায় পরিণত হয়। তারা রসূলকে সা. বলতে লাগলো, “আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলেন না কেন?” (বাকারা-১১৭) অর্থাৎ আল্লাহ তোমার কাছে গোপনে গোপনে ফেরেশতা পাঠান এবং গোপনেই তোমার কাছে নিজের বার্তা পাঠান কেন? আল্লাহ দুনিয়াতে নেমে আসুক, চোখের সামনে দেখা দিক, এবং আমাদের মুখোমুখি হয়ে বলুক যে, এ হচ্ছে আমার হুকুম, এগুলো মেনে চল, আর এইযে আমার নবী, এর আনুগত্য কর। তাও তিনি যদি করতে না চান, তাহলে অন্তত কোন একটা সুস্পষ্ট ও অকাট্য আলামত পাঠিয়ে দিক, যা দেখার পর কেউ আর এ কথা অস্বীকার করতে পারবেনা যে তুমি তার নবী এবং কোরআন তার বাণী।
এই অকাট্য আলামত কি হওয়া দরকার, তাও তারা নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছে যাতে করে তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হতে পারে। ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থাবলী থেকে জানা যায়, ইহুদী মহলে এই দাবী খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘদিন যাবত তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে এবং রসূল সা. এর সামনে তা বারবার উত্থাপিত হতে থাকে।
এই দাবী কিভাবে সৃষ্টি হলো প্রথমে তা শুনুন। ব্যাপারটা ছিল এই যে, মদিনার ইহুদীরা রসূল সা. এর আগমনের পূর্বে আওস ও খাজরাজকে ভয় দেখানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে ভাবি নবীর তাৎক্ষণিক আবির্ভাবের জন্য দোয়া করতো। কিন্তু যখনই রসূল সা. নবী হিসেবে আবির্ভূত হলেন, অমনি তারা তাদের মনোভাব পাল্টে ফেললো এবং তাঁকে অস্বীকার ও অমান্য করতে বদ্ধপরিকর হলো। তাদের এই রাতারাতি ভোল পাল্টানোতে জনসাধারণের মধ্যে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়ে গেল। লোকেরা এসে এসে তাদের কাছে জিজ্ঞাস করতো, “ব্যাপার কী? আগে তো আপনারাই দোয়া করতেন এবং একজন নবী আসবেন বলে ভবিষ্যদ্বানী করতেন। আর এখন আপনারাই আবির্ভূত নবীর বিরুদ্ধে ক্ষেপে গেছেন!” বিশেষত এক মজলিসে মুয়ায বিন জাবাল ও বিশর বিন বারা বিন মারুরের ন্যায় শীষর্স্থানীয় নেতারা ইহুদী নেতৃবৃন্দকে খোলাখুলিভাবে বললেন, “হে ইহুদী সম্প্রদায়! আল্লাহকে ভয় কর এবং মাথা নোয়াও। কেননা তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে শক্তি লাভের নিমিত্তে নিজেরাই আল্লাহর কাছ থেকে মুহাম্মাদ সা. এর আবির্ভাব কামনা করতে। আমরা মোশরেক ছিলাম। তোমরাই আমাদেরকে জানাতে যে, সেই নবী আবির্ভূত হয়েছে এবং তাঁর গুণাবলীও তোমরা বর্ণনা করতে।” এ ধরনের কথাবার্তায় কিভাবে ইহুদীদের মুখোশ খুলে যেত, তা সহজেই অনুমেয়। তারা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতো, তাদের সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত কি? নিজেদের দ্বীনদারী ও পরহেজগারীর মর্যাদা রক্ষার্থে তাদের কোন না কোন ঢালের আশ্রয় নেয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এই ঢাল কি ছিল? এটা জানার জন্য উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব বনু নযীরের জনৈক ইহুদী নেতা সালাম ইবনে মুশকামের মুখ থেকে শুনুন। তিনি বলেনঃ “মুহাম্মাদ সা. নিজের সাথে এমন কোন প্রমাণ নিয়ে আসেননি, যা দ্বারা আমরা তাঁকে নবী হিসেবে চিনতে পারি। তাই মুহাম্মাদ সা. সেই ব্যক্তি নন, যার কথা আমরা তোমাদের কাছে উল্লেখ করতাম।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)
ইবনে সিলভিয়া ফাতয়ূনীও রসূল সা. কে সরাসরি এ কথাই বলেছিল। অর্থাৎ একটু চূড়ান্ত আলামতের দরকার ছিল। সেই আলামত নির্ণয়ের কাজটাও ইহুদীদেরই করণীয়। তারা যেমন আলামত দাবী করতে চায় করবে। অনুরূপভাবে সাবেক নবীদের কাছ থেকে শেষ নবীকে মান্য করার যে অংগীকার নেয়া হয়েছিল, তাঁর ব্যাপারেও জনগণ তাদেরকে প্রশ্ন করছিল। কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব তারা এটা ওটা বলে এড়িয়ে যেত। ইহুদী মালেক ইবনুল কাতীদ একবার স্পষ্ট করেই বলেছিল যে, “আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ সম্পর্কে আমাদের কাছ থেকে কোনোই অংগীকার নেয়া হয়নি।” (সীরাত ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)
তাদের জন্য কোরআনের পবিত্র বাণী এবং অকাট্য যুক্তি প্রমাণে কোন নিদর্শন ছিলনা, রসূলের সা. চরিত্রে কোন নিদর্শন ছিল না। জীবনে আমূল পরিবর্তন আনয়নকারী আন্দোলনে কোন নিদর্শন ছিলনা, সত্যের সৈনিকদের বিকাশমান দলে কোন নিদর্শন ছিল না। নির্যাতন ও নিপীড়নকারী প্রতাপশালী শক্তিগুলোর মোকাবেলায় মুষ্টিমেয় সংখ্যক মুসলমান যে ত্যাগ কুরবানী ও প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছিল, তাতেও তাদের বিবেকে সাড়া জাগাতে পারে এমন কোন নিদর্শন ছিলনা। তারা চাইছিল কেবল বিস্ময়োদ্দীপক অথবা কৌতুকপ্রদ ঘটনা।
এবার শুনুন কি ধরনের আলামত বা নিদর্শনের দাবী তারা জানাচ্ছিল।
রাফে বিন হুরায়মালা ও ওহাব বিন যায়েদ রসূল সা. এর কাছে এসে আলাপ আলোচনা প্রসংগে বললো,
“হে মুহাম্মদ সা. আমাদের কাছে পুরো একখানা কিতাব লিখিতভাবে আকাশ থেকে নামিয়ে আনো, আমরা তা পড়ে দেখবো, আর আমাদের সামনে ঝর্ণা বানিয়ে দাও। তাহলেই আমরা তোমাকে অনুসরণ করবো এবং তোমার সত্যবাদিতার সাক্ষ্য দেব।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)
এই রাফে বিন হুরায়মালা এ দাবীও জানায় যে, “হে মুহাম্মদ সা. তুমি যদি আল্লাহর রসূল হয়ে থাক, যেমন তুমি বলে থাক, তাহলে আল্লাহকে আমাদের সাথে এমনভাবে কথা বলতে বল, যাতে আমরা শুনতে পাই।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)
অন্য এক আলোচনা সভায় ফাখখাস, আব্দুল্লাহ বিন সবুর প্রমুখ ইহুদী নেতারা রসূল সা. এর সাথে কথা বলছিল, তারা বললো, “হে মুহাম্মদ, সত্যই কি এই কোরআন তোমাকে কোন জিন বা মানুষ শেখায়না?” রসূল সা. বললেন, “তোমরা ভালো করেই জান, এ কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত এবং আমি আল্লাহর রসূল। তোমরা এ সত্য তোমাদের তাওরাতেও লিখিত দেখতে পাও।” তারা বললো, “হে মুহাম্মাদ সা., তুমি যত কিছুই বলনা কেন, এ কথা তো সত্য যে, আল্লাহ যখন কোন রসূলকে পাঠান, তখন ঐ রসূল যা কিছুই চায় তা তিনি করে দেন, আর রসূল যা কিছুই ইচ্ছা করে, তা করে দেখানোর ক্ষমতা আল্লাহর পক্ষ থেকে পেয়ে থাকে। কাজেই তুমি আকাশ থেকে লিখিত গ্রন্থ অবতীর্ণ কর, যা আমরা পড়বো ও জানবো।” (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড)
ইহুদীরা একটা ঢাল পেয়ে গেল। এখন আর তাদের কাছে এ প্রশ্নের কোন গুরুত্ব রইলনা যে, রসূল সা. এর দাওয়াত কী? তিনি কী বলেন? তাঁর যুক্তি প্রমাণ কী? তাঁর দাওয়াতে জীবন কিরূপ গড়ে ওঠে? তাঁর শিক্ষায় কী ধরনের চরিত্র গড়ে ওঠে? এর গঠনমূলক চেষ্টা দ্বারা কি ধরনের সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা নির্মিত হয়? এই সমস্ত প্রশ্ন তাদের কাছে অবান্তর হয়ে গেল। তাদের কাছে তখন এই দাবীটাই প্রধান হয়ে উঠলো যে, “আকাশ থেকে কিতাব নামিয়ে দেখাও।” এখন সবার মুখ বন্ধ করার জন্য তারা একটা ছুঁতো পেয়ে গেল। কেউ এ নিয়ে কিছু বললেই তারা সাফ জবাব দিয়ে দিত যে, আমরা তো ঈমান আনতে প্রস্তুত। কিন্তু মুহাম্মাদ সা. কে যেয়ে বলে দাও যে, একটা কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিক। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা তো যা চায়, আল্লাহর কাছ থেকে আদায় করে নিয়ে থাকে। উনি কেমন রসূল যে, আল্লাহ তার আবদার রক্ষা করেনা? ওহে জনমণ্ডলী, এ সব বিভেদাত্মক কথাবার্তা বাদ দাও। যাও, আল্লাহর কোন প্রিয় বান্দার কাছে যাও। এতো নিছক ফাঁকিবাজি।