জনতার স্বতস্ফূর্ত অগ্রযাত্রা
যে কোন বিপ্লবী আদর্শবাদী আন্দোলনের ন্যায় রসূল সা. পরিচালিত আন্দোলনকে দু’টো বড় পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে ইসলামী আন্দোলন নিজে জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদেরকে ডাকতো। আর দ্বিতীয় পর্বে জনতা স্বউদ্যোগে ও স্বতস্ফূর্তভাবে সামনে এগিয়ে এসেছে এবং ইসলামের দরজায় করাঘাত করে বলেছে, আমরা ভেতরে আসতে চাই। এই শেষোক্ত পর্বটা সম্প্রসারণের পর্ব। এই পর্ব যখন আসে তখন সমস্ত প্রতিরোধের অবসান ঘটে এবং সমস্ত নেতিবাচক মনোভাব ময়দান ছেড়ে পালায়। কিন্তু এই পর্বে পৌঁছা পর্যন্ত রসূল সা. ও তাঁর সাহাবীগণ অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন এবং মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। একদিকে তাত্ত্বিক দাওয়াতের ময়দানে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, যুক্তি প্রমাণের শক্তি আমাদেরই পক্ষে। অপর দিকে নৈতিকতার ময়দানে অকাট্যভাবে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, ইসলামের তৈরী মানবতা ও মনুষ্যত্বের মডেলই শ্রেষ্ঠতম মডেল। তৃতীয় দিকে রাজনৈতিক দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও কুশলতার দিক দিয়েও দেখিয়ে দিয়েছেন যে, কিভাবে সমকালীন সমাজের সাথে লেনদেন করতে হয় তা আমরা জানি। চতুর্থ দিকে যুদ্ধের ময়দানেও দেখিয়ে দিয়েছেন যে, প্রতিরোধের প্রাচীর কিভাবে ভাংতে হয় এবং যুলুমবাজদের কিভাবে উৎখাত করতে হয় তা, আমাদের জানা আছে। রসূল সা. ও তাঁর সাথীরা মানুষের মনে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা দিয়েছেন, ঝাকি দিয়েছেন ও দোলা দিয়েছেন, মানুষের ভাবাবেগকে পক্ষে টেনেছেন, ভাগ্যবান আত্মাগুলোকে স্বমতে দীক্ষিত করে বুকে টেনে নিয়েছেন, শান্তিপ্রিয় গোত্রগুলোকে সন্ধি ও শান্তি চুক্তির আওতাভুক্ত করেছেন এবং যে শত্রুরা যুদ্ধ চায় তাদের দাপট চূর্ণ করে পথ পরিস্কার করেছেন। এত সব কিছু করার পরই সেই সময়টার সমাগম ঘটেছিল যখন জনগণ চারদিক থেকে নতুন আশার কেন্দ্রবিন্দু মদিনার দিকে ছুটে এসেছে।
এ পর্বটা বা যুগটার সূচনা হয় “আমুল উফুদ” বা “প্রতিনিধিদল সমুহের আগমনের বছর” থেকে অর্থাৎ যে বছর ইসলাম গ্রহণের জন্য, রাজনৈতিক আনুগত্যের অঙ্গীকার করার জন্য অথবা নিছক অনুসন্ধান চালিয়ে পরিস্থিতি উপলব্ধি করার জন্য আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ও বিভিন্ন গোত্র থেকে প্রতিনিধি দল এসেছিল, সেই বছর থেকে। এই সময় সর্বত্র ইসলামের পিপাসা লেগে গিয়েছিল, এবং একটা সাড়া ও চাঞ্চল্য পড়ে গিয়েছিল। এ সময়টা মক্কা বিজয় থেকে শুরু করে তিন বছর অর্থাৎ ৯ম ও ১০ম হিজরী জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বলা যেতে পারে যে, এ সময়টা ছিল বিশ্বমানবতার মুক্তিদূতের সা. রোপন করা ফসল ফলনের মৌসুম। আমরা যদিও সংক্ষিপ্ত করতে চাই। কিন্তু নবী জীবনের এ অধ্যায়টা এত গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রতিনিধিদলগুলো নিয়ে আলোচনা না হলেই নয়। কেননা প্রতিনিধি দলগুলোর আগমন, আলাপ আলোচনা ও প্রতিক্রিয়ায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় ছিল। এ বিবরণ থেকে এও জানা যাবে যে, রসূল সা. এর কাছে কিভাবে জনতার ঢল এসেছিল। সীরাতের বিভিন্ন পুস্তুকে মদিনায় আগত প্রতিনিধিদলের সংখ্যা কমের পক্ষে ১৫ এবং সর্বাধিক ১০৪ পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা এই সব দলের মধ্য থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দলের বিবরণ দেব। আর এর মধ্যে থেকেও মাত্র কয়েকটি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেব। উল্লেখ্য যে, প্রতিনিধি দলের আগমন যদিও মক্কা বিজয়ের পর ৮ম হিজরীতে ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু একটা দুটো দলের আগমন ৫ম হিজরী থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই আমরা সেই সময় থেকেই শুরু করছিঃ
১. মুযাইনা গোত্রের প্রতিনিধি দল
এটি একটি সুবৃহত গোত্র। কিছুটা ওপরে গিয়েই কোরায়েশদের সাথে তাদের বংশধারা মিলে গেছে। প্রখ্যাত সাহাবী নুমান বিন মুকরিন এই গোত্রেরই লোক। হিজরী ৫ম বছর এই গোত্রের প্রায় চারশো লোক রসূল সা. এর দরবারে হাজির হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করে। সম্ভবত এটাই ছিল সর্ব প্রথম মদিনায় আগমনকারী প্রতিনিধি দল। মদিনা থেকে ফেরার সময় তাদেরকে পাথেয় হিসেবে প্রচুর খেজুর দেয়া হয়।
২. বনু তামীম গোত্রের প্রতিনিধি দল
এ দলটিও প্রাথমিক যুগে খুবই জাঁকজমকের সাথে এসেছিল। গোত্রের বড় বড় নেতা আকরা বিন হাবেস, যাবারকান, আমর ইবনুল আহতাম, নঈম বিন ইয়াযীদ এবং উয়াইনা বিন হিসন ফাযারী ও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই দলের আগমনে মদিনায় উৎসবের আমেয অনুভুত হয় এবং চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তারা মসজিদে প্রবেশের সময় অনেকটা অমার্জিতভাবে রসূল সা. এর কক্ষের কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকছিলঃ “ও মুহাম্মদ, মুহাম্মদ! সা. বাইরে এস।” এই ঘটনা উপলক্ষে সূরা হুজরাত নাযিল হয় এবং মুসলমানদের ভদ্র ও মার্জিত আচরণ শিক্ষা দেয়া হয়। তারা যদিও ইসলাম গ্রহণের মনোভাব নিয়েই বাড়ী থেকে বেরিয়েছিল, কিন্তু আরবীয় আভিজাত্যবোধে তাদের স্বভাবে তখনো অক্ষুন্ন ছিল। তারা অভিলাষ প্রকাশ করলো যে, উভয় পক্ষের বাগ্মী ও কবিদের মধ্যে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা অনষ্ঠিত হোক। আসলে আরবের অভিজাত শ্রেণীর গোত্রগুলোর স্বভাবই এ রকম ছিল যে, বুদ্ধি, মেধা ও প্রতিভার দিক দিয়ে কাউকে নিজের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর না দেখে তার নেতৃত্ব তারা মেনে নিতে পারতোনা। তাই রসূল সা. মেধার প্রতিযোগিতার এই প্রস্তাব মঙ্গলজনক হবে ভেবে মেনে নিলেন।
বনু তামীম গোত্রের নামকরা বক্তা ছিল আতারিদ বিন হাজের। সে নিজ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা, ধনবল ও জনবল ইত্যাদির প্রশংসা করে এক মনোজ্ঞ ভাষণ দিল। ভাষণের শেষে বললো, “যারা আমাদের সমকক্ষ হবার দাবীদার, তারা এ ধরনের যোগ্যতা ও প্রতিভার পরিচয় তুলে ধরুক।”
রসূল সা. এর ইংগিতে ইসলামী আন্দোলনের এক বক্তা ছাবেত বিন কায়েস পাল্টা ভাষণ দিতে উঠলেন। তিনি এক উদ্দীপনাময় ভাষণে ইসলামী আন্দোলনের গুণগত শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে তার দাওয়াতের দিকটাকে জোরদার করে প্রকাশ করলেন এবং এটাকেই ইসলামী সমাজের গৌরবের প্রধান উৎস বলে অভিহিত করলেন।
এরপর বনু তামীমের খ্যাতনামা কবি যাবারকান বিন বদর একটা কবিতা আবৃত্তি করলো। তার একটা বাক্য হলো।
“আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ। কেউ আমাদের সমকক্ষ নয়। আমাদের মধ্যে রাজা রয়েছে। আমরা উপাসনালয় নির্মাণ করি।”
এ সময় ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী কবি হাসসান বিন ছাবিত উপস্থিত ছিলেন না। তাঁকে ডেকে আনা হলো। রসূল সা. বললেন, “ওঠো হাসসান, এই কবির কবিতার জবাব দাও।” জবাবে হাসসান যে কবিতা পাঠ করলেন তা ইবনে হিশাম উদ্ধৃত করেছেন। প্রতিনিধিদল স্বীকার করলো, তাদের বক্তা ও কবির চেয়ে রসূল সা. এর কবিতা ও বক্তা শ্রেষ্ঠ। অতপর সমগ্র দল ইসলাম গ্রহণ করলো।
৩. বনু আবদুল কায়েস প্রতিনিধি দল
মুনকিয ইবনে হাব্বানের মাধ্যমে বাহরাইনে ইসলাম প্রচারের কাজ আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ক্রমেই ইসলামের প্রসার ঘটতে লাগলো। ৫ম হিজরীতে ১৩ জনের এক প্রতিনিধি দল মদিনায় এল। রসূল সা. এর প্রশ্নের জবাবে তারা যখন বললো, আমরা রবীয়ার গোত্রের লোক, তখন, তখন তিনি তাদেরকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানালেন। তারা বললো, “আমরা অনেক দূরবর্তী এলাকার অধিবাসী। পথিমধ্যে মুযার পৌত্তলিকরা বাস করে। নিষিদ্ধ চার মাসে ছাড়া চলাফেরা করা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। তাই আমাদেরকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটা কথা বলে দিন, যা আমরা ও আমাদের গোত্রের সবাই পালন করবো। রসূল সা. তাওহীদ, নামায, রোযা ও গনিমতের এক পঞ্চমাংশ আল্লাহর পথে দেয়ার আদেশ দিলেন, মদ বানাতে নিষেধ করলেন এবং বাহরাইনে এ কাজে ব্যবহৃত চার রকমের পাত্রের নামোল্লেখ করে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন। প্রতিনিধি দল বাহরাইনের অনৈসলামিক সামাজিক প্রথা সম্পর্কে রসূল সা. এর নির্ভুল জ্ঞান দেখে অভিভূত হয়ে গেল। আমূল পরিবর্তনকারী একটি আন্দোলনের নেতা দাওয়াতের আওতাভুক্ত এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান না রাখলে কাজই চালাতে পারেনা। রসূল সা. নিজের ব্যক্তিগত সফর এবং মক্কা ও মদিনায় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত লোকদের কাছ থেকে এ সব জ্ঞান লা্ভ করেছিলেন।
এই প্রতিনিধি দলে জারূদ ইবনুল আলা নামক একজন খৃষ্টানও ছিল। সে বললো, আমি একটা ভিন্ন ধর্মের অনুসারী। তা ছেড়ে আপনার ধর্ম গ্রহণ করলে আপনি কি নিরাপত্তা দিতে পারবেন? (অর্থাৎ আখেরাতে কোন বিপদ ঘটবেনা তো?) রসূল সা. বললেন, “হ্যাঁ, আমি নিরাপত্তা দিচ্ছি। কেননা আমি যে ধর্মের আহবান জানাচ্ছি তা তোমাদের চেয়ে উত্তম।” জারূদ তৎক্ষণাত মুসলমান হয়ে গেল। তার স্বধর্মীয় সাথীরাও ইসলাম গ্রহণ করলো।
৪. বনু সা’দ গোত্রের প্রতিনিধি
এই গোত্র যিমাম বিন সা’লাবাকে প্রতিনিধি করে মদিনায় পাঠালো। এই উষ্ট্রারোহী প্রতিনিধি বেদুঈনদের মত হাবভাব নিয়ে মসজিদে নববীতে ঢুকে সাহাবীদের কাছে জিজ্ঞেস করলোঃ তোমাদের মধ্যে আব্দুল মুত্তালিবের ফরবন্দ কে? সবাই রসূল সা. এর দিকে ইংগিত করলো। সে কাছে গিয়ে বললো, “ওহে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর। কয়েকটা কথা খোলাখুলি জিজ্ঞেস করবো। কিছু মনে করবেনা”। রসূল সা. তাকে অনুমতি দিলেন। সে কসম খাইয়ে খাইয়ে তাওহীদ, রিসালাত নামায রোযা ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো যে, আপনি কি এ সবের শিক্ষা দিয়ে থাকেন? রসূল সা. এক একটি করে জবাব দিলেন। সমস্ত জবাব পাওয়ার পর বললো, আমার নাম যিমাম বিন সা’লাবা। আমার গোত্র আমাকে পাঠিয়েছে। আমি যাচ্ছি। আপনি আমাকে যা যা বললেন তা আমি হুবহু মেনে নিলাম একটুও কম নয়, বেশীও নয়। আমার গোত্রকেও শুধু এগুলোই জানাবো।” তারপর উটে চড়ে রওনা হয়ে গেল। তার যাওয়ার পর রসূল সা. বললেন, “এই ব্যক্তি যদি সত্যি বলে থাকে, তবে সে জান্নাতে যাবে।”
গোত্রে ফিরে গিয়ে সে জোরে শোরে দাওয়াত দিল এবং বললো, “ওহে জনগণ! আমি আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান এনেছি। লাত ও উযযার কোন মূল্য নেই। লোকেরা তাকে ভয় দেখালো যে, “সাবধান, এ ধরনের কথাবার্তার কারণে তোমার ওপর দেবদেবীর অভিশাপ না পড়ে এবং উন্মাদ কিংবা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে না যাও।” যিমাম বললো, “আল্লাহর কসম, ওরা কোন লাভও করতে পারেনা, লোকসানও নয়।” সন্ধ্যার আগেই সমগ্র গোত্র ইসলাম গ্রহণ করলো।
৫. আশয়ারী গোত্রের প্রতিনিধি দল (ইয়ামান)
আশয়ারী ইয়ামানের একটা সম্ভ্রান্ত গোত্র। আবু মূসা আশয়ারী রা. এই গোত্রের লোক ছিলেন। মক্কী যুগে তোফায়েল বিন আমর দাওসী ও আবিসিনিয়ার মোহাজেরদের মাধ্যমে তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিল। এসব দাওয়াতের প্রভাবিত তিন ব্যক্তি হিজরতের সংকল্প নিয়ে রসূল সা. এর কাছ থেকে দ্বীনের শিক্ষা গ্রহণ ও ইসলামী আন্দোলনকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে মদিনা রওনা হল।
সফর ছিল সামুদ্রিক। পথিমধ্যে প্রতিকূল বাতাসের কবলে পড়ে জাহাজ আবসিনিয়ার তীরে গিয়ে ভিড়লো। এখানে তারা প্রথম হিজরতকারী দলের সাক্ষাৎ পেলো। কিছুদিন সেখানে অবস্থান করার পর তারা হযরত জাফরের সাথে কতিপয় নও মুসলিম আবসিনীয়কে সাথে নিয়ে মদিনায় রওনা হল। ৭ম হিজরীতে খয়বর বিজয়ের সময় তারা রসূল সা. এর দরবারে হাজির হয়। তারা এতো আবেগাপ্লুত ছিল যে মদিনার সীমানায় এসেই তারা এই বলে গান গাইতে থাকে-
“আগামী কালই আমরা আমাদের প্রাণ প্রিয় মুহাম্মদ সা. ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের সাথে মিলিত হব”।
রসূল সা. খবর পেয়ে তাঁর সাথীদের কাছে বললেন ‘তোমাদের কাছে ইয়ামান থেকে কিছু লোক আসছে, (সম্ভবত) তারা অত্যন্ত কোমল হৃদয় সম্পন্ন লোক। ইয়ামানবাসী ঈমানেও পরিপক্ক, কৌশলেও নিপুণ’।
এর পর তাদের সাথে সাক্ষাত হল, আলাপ আলোচনা হল, প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠিত হল। তাদের ইসলাম গ্রহনে মদিনায় এক নতুন সাড়া পড়ে গেলো।
৬. দাওস গোত্রের প্রতিনিধি দল(ইয়ামান)
আমরা আগেই বলেছি, তোফায়েল দাওসী মক্কার প্রাথমিক যুগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। গোত্রে ফিরে তিনি খুব জোরে শোরে দাওয়াতের কাজ শুরু করতে থাকেন, তাঁর পিতা ও স্ত্রী তো তৎক্ষণাত ইসলাম গ্রহণ করেন। গোত্রের অন্যরাও কিছুটা প্রভাবিত হন। কিন্তু গোত্রে নৈতিক অধঃপতন ও ব্যভিচার ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তোফায়েলের মাত্রাতিরিক্ত তেজস্বীতা ও আবেগের কারণে তাঁর দাওয়াতি কাজ তেমন অগ্রগতি হয়নি। তাই রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাত করলেন এবং গোত্রের বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ তুলে দোয়া চাইলেন। রসূল সা. তাঁকে কোমল ও নম্র পন্থায় দাওয়াত দিতে বললেন এবং দাওস গোত্রের সংশোধনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। এবার তোফায়েল ফিরে গিয়ে দাওয়াত দিতে শুরু করলে নতুন পথ খুলে গেলো। ৫ম হিজরীতে অনেক গৃহে ইসলামের আলো প্রবেশ করলো। ৭ম হিজরীতে এই গোত্রের ৮০ টি পরিবার হিজরত করে মদিনায় এসে গেলো। এই হিজরতকারীদের মধ্যে হযরত আবু হোরায়রার মতো ব্যক্তিত্ব ও ছিলেন।
৭. সুদা গোত্রের প্রতিনিধি দল
এই গোত্রের যায়েদ বিন হারেস সুদাই সবার আগে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং গোত্রে ফিরে গিয়ে যথেষ্ট দাওয়াতের কাজ করেন। ৮ম হিজরিতে ১৫ ব্যক্তির এক প্রতিনিধি দল সমগ্র গোত্রের পক্ষে হয়ে রসূল সা. এর সাথে দেখা করে। সা’দ বিন উবাদা তাদের মেহমানদারী করেন। তিনি তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাই শুধু করেননি বরং তাদের পোশাকের ব্যবস্থাও করেন। তারা রসূল সা. কাছে ইসলামী আন্দোলনে যোগদানের অঙ্গীকার করেন এবং গোত্রের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা দেয়ার প্রস্তুতির কথা জানান। এই প্রতিনিধি দল ফেরত যাওয়ার পর দ্রুত গতিতে দাওয়াতের কাজ চলে। বিদায় হজ্বের সময় এই গোত্রের প্রায় একশো ব্যক্তি মক্কায় এসেছিল।
এই ছিল মক্কা বিজয়ের পূর্ববর্তী সময়ে আগত প্রতিনিধি দল গুলোর বিবরণ। মক্কা বিজয়ের পর তো চারদিক থেকে জনতার সয়লাব আসতে থাকে। ৯ম ও ১০ম হিজরিতে যেসব প্রতিনিধি দল মক্কায় আসে এবার তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হচ্ছেঃ
৮. সাকীফ প্রতিনিধি দল(তায়েফ)
রসূল সা. যখন বিজয়ের সফর থেকে মদিনায় ফিরে যান, তখন উরওয়াহ বিন মাসুউদ সাকাফি উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ ও বনী সাকিফ গোত্রে ইসলামের বিস্তার ঘটানোর সংকল্প প্রকাশ করেন। রসূল সা. সাকীফ গোত্রের স্বভাবগত দাম্ভিকতার প্রেক্ষাপটে তাঁকে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন এবং আশংকা প্রকাশ করেন যে, তারা তোমাকেই হত্যার চেষ্টা করতে পারে। হযরত উরওয়ার নিজের ব্যক্তিগত প্রভাব প্রতিপত্তির উপর যথেষ্ট আস্থা ছিল। তাই তিনি অনেক অনুনয় বিনয় করে রসূল সা. এর কাছে থেকে দাওয়াতী কাজের অনুমতি গ্রহণ করলেন। মদিনা থেকে ফিরে গিয়েই তিনি নিজের বাড়ীর ছাদের উপর দাঁড়িয়ে নিজের ইসলাম গ্রহনের কথা ঘোষণা করলেন। কিন্তু নিজের ধারণার বিপরীত তিনি চতুর্দিক থেকে তীর নিক্ষিপ্ত হতে দেখলেন। এরই একটি তীরে বিদ্ধ হয়ে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। বনু সাকীফ এই যালেম সুলভ অপকর্মটা করলো বটে, তবে এটা তাদের বিবেক কে একটা প্রচন্ড ঝাঁকিও দিলো। তারা পরিস্থিতিকে ঠান্ডা মাথায় পর্যালোচনা করতে বাধ্য হল। মাস খানেক পর তারা একটা বৈঠক আহবান করলো, এ বৈঠকে পরিস্থিতির বাস্তব পর্যালোচনার পর তারা যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলো তা হল, ইসলামের অনুগত হয়ে যাওয়া সমগ্র আরব জাতির সাথে কি আমরা একাই মোকাবেলা করতে সক্ষম? অবশেষে স্থির হল, মদিনায় একজন দূত পাঠানো হবে। কিন্তু একজন দূতের পরিবর্তে পুরো একটা প্রতিনিধি দলই পাঠানো হল। উসমান বিন আবিল আস, আস বিন আওফ, বাহায বিন খাফশা( বনু মালেকের প্রতিনিধি), হাকাম ইবনে ওমর, এবং শুরাহবীল ইবনে গায়লান(মিত্র গোত্র গুলোর প্রতিনিধি) দলের অন্তর্ভুক্ত হল। তায়েফের সরদার আবদ ইয়ালীল তাদের দলনেতা হয়ে মদিনায় গেলো। স্মরণ করা যেতে পারে ১২বছর আগে যে ব্যক্তিটি রসূল সা. এর দাওয়াত শুনতেই চায়নি এবং শহরের বখাটে ছেলেদেরকে তাঁর পিছনে লাগিয়ে দিয়ে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করিয়েছিল, সেই ব্যক্তিই এই আবদ ইয়ালীল।
রসূল সা. তবুক থেকে মদিনায় ফিরে আসার পর এই প্রতিনিধি দল মদিনায় পৌঁছলো। তাদের জন্য মসজিদে নববীর কাছেই শিবির স্থাপন করা হল। খালেদ বিন সাঈদ উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচক নিযুক্ত হল।
এই আলোচক অদ্ভুত অদ্ভুত শর্ত পেশ করলো। একটা শর্ত এই ছিল, তাদের ‘লাত’ মূর্তি কে তিন বছরের মধ্যে ভাঙ্গা যাবেনা। তারপর এই সময় কে কমাতে কমাতে তারা এক মাসের পর্যায়ে নিয়ে এলো। ওটা যে নিছক একটা স্থবির পাথর তা তাদের মন তখন মানতে চাইছিলনা। তারা এই আশংকাও প্রকাশ করলো যে, তাদের মূর্তি যদি জানতে পারে যে তাকে ভাঙ্গা হবে, তবে তা সমগ্র দেশবাসীকে মেরে ফেলতে পারে। হযরত ওমর রা. এতক্ষন চুপচাপ থেকে কথা শুনছিলেন। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে আর চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি আবদ ইয়ালীল কে বললেন “কি সব মূর্খতাপ্রসূত কথাবার্তা বলছ? তোমাদের এসব উপাস্য পাথর ছাড়া আর কিছু নয়।” আবদ ইয়ালীল উত্তেজিত হয়ে বলল “ওহে খাত্তাবের ছেলে, আমরা তোমার সাথে কথা বলতে আসিনি। আমরা কথা বলছি আল্লাহর রসূলের সাথে।” রসূল সা. যখন এই সমস্ত শর্তের একটাও রাখলেননা, তখন তারা অগত্যা এই শর্ত দিলো যে, মূর্তি যদি ভাংতেই হয় তবে তা আমাদের দিয়ে যেন ভাঙ্গানো না হয়। রসূল সা. তাদের এই শর্ত মেনে নিলেন। অতঃপর মূর্তি ভাংতে আবু সুফিয়ান বিন হারব ও মুগীরা ইবনে শু’বা কে নিযুক্ত করা হল। এর পর তারা শর্ত দিলো যে আমাদের নামায পড়া থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। রসূল সা. বললেন, ‘যে ধর্মে নামায নেই, তাতে কোন কল্যান নেই।’
প্রতিনিধি দলের জনৈক সদস্য এ আবেদনও জানালো যে, ‘হে আল্লাহর রসূল আমাদেরকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন। ব্যভিচার না করে তো আমাদের উপায়ই থাকে না’। তারপর তারা বলতে লাগলো “আমাদের জন্য সুদী কারবারের সুযোগটা উন্মুক্ত রাখা হোক আর মদ খাওয়ার অনুমতিও দেয়া হোক”।
ভাবখানা এই যেন রসূল সা. একটা দোকান খুলে বসেছেন। যার যতটুকু সদাই কেনার দরকার কিনবে বাকি টুকু কিনবেনা। রসূল সা. এই দাবি গুলোর জবাবে কোরআনের আয়াত পড়ে পড়ে জানিয়ে দিতে লাগলেন যে, এসব স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালার বিধান, কারো মন গড়া বিধান নয়। যখন এসব অন্যায় শর্ত প্রত্যাখাত হল, তখন প্রতিনিধি দল পরামর্শ ক্রমে সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, আমরা যদি ইসলামী আইন না মানি তবে আমাদের পরিনতিও একদিন মক্কাবাসির মত হবে। তাই বাধ্য হয়ে তারা মাথা নোয়ালো ও চুক্তি লেখানো হলো। রসূল সা. শুধু দুটো ব্যপারে তাদের কিছুটা রেয়াত দিলেন প্রথমত কিছু দ্বীনের জন্য তাদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করা হবে না এবং তাদেরকে জেহাদে অংশ গ্রহনে বাধ্য করা হবেনা। কিন্তু ইসলাম যখন তাদের অন্তরে বদ্ধমূল হতে লাগলো তখন একে একে সব দাবীই তারা স্বতস্ফূর্ত ভাবে পূরণ করতে লাগলো। বলা বাহুল্য রসূল সা. আশাও করেছিলেন তাই।
প্রতিনিধি দলের উসমান ইবনে আবিল আস ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান যুবক। তিনি অবসর সময়ে পড়া শুনা করে ইসলাম ও ইসলামী বিধানের বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করতেন। তাকেই আমীর নিযুক্ত করা হলো। তারা তায়েফ ফিরে গিয়ে প্রথমে নাটকীয়ভাবে চরম বিরোধী মনোভাব পেশ করতে লাগলো যে, মুহাম্মদ সা. আমাদের উপর অত্যন্ত অগ্রহনযোগ্য শর্তাবলী পেশ করেছে। কাজেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। দুদিন পর্যন্ত ভয়ঙ্কর উত্তেজনা পূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করতে লাগলো। অবশেষে তায়েফ বাসী আপনা থেকেই বলতে লাগলো “ আমরা মুহাম্মদ সা. এর সাথে কেমন করে লড়বো। সমগ্র আরব তো এখন তাঁর আদেশেই চলছে। যাও,সে যা যা বলে মেনে নাও। এভাবে পরিবেশ সৃষ্টি করার পর প্রতিনিধি দল আসল কথা খুলে বলল। তারা বলল আসলে আমরা মুহাম্মদ সা. কে খোদাভীতি, সততা, সত্যবাদিতা ও দয়ায় খুবই উঁচুমানে উন্নীত পেয়েছি। আমাদের সফর খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে।
মূর্তি ভাঙ্গার জন্য আবু সুফিয়ান ও মুগীরাকে প্রতিনিধি দলের সাথেই তায়েফে পাঠানো হলো। তারা যখন মূর্তি ভাঙ্গার কাজ শুরু করলো তখন আবাল বৃদ্ধ বনিতা এটা দেখার জন্য রুদ্ধ শ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলো যে, ভাঙ্গার কাজে লিপ্তদের কপালে কি ঘটে? কোন কোন মহিলা ভয়ে কেঁদেই ফেললো। তারা ভেবেছিল যে, হয়তো আকাশ ভেঙ্গে মাটিতে পড়বে। তাদের কেউ কেউ কবিতা আবৃতি করে করে বলল “ ঐ সব কাপুরুষদের জন্য কাঁদো, যারা নিজেদের দেবমূর্তিকে শত্রুর হাতে সঁপে দিয়েছে এবং কোনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।”
যে তায়েফ (মক্কার মতই) একদিন রসূল সা. কে পাথর মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল, সেই তায়েফেই আজ রসূল সা. এর ইংগিতে তাদের জাহেলী ব্যবস্থাকে তাদেরই চোখের সামনে চূর্ণ বিচূর্ণ করা হচ্ছিলো।
লক্ষ্যনীয় যে, তায়েফ (মক্কার মতোই) জাহেলী ব্যবস্থার একটা প্রাচীন ঘাঁটি ছিল। রসূল সা. অবরোধ আরোপ করার পর শুধু এই ভেবে অবরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন যে, ইসলামের দেশজোড়া পরিবেশের মধ্যে থেকে বনু সাকীফ নিজেদের জন্য আলাদা দ্বীপ বানিয়ে তো আর টিকে থাকতে পারবেনা। কাজেই রক্ত পাতের কি দরকার? মক্কা যদি সত্যের সামনে মাথা নত করে থাকে, তাহলে মক্কার অধীন তায়েফ কতদিন মাথা না নুইয়ে থাকতে পারবে? রসূল সা. এর পরিবর্তে যদি অন্য কোন যুদ্ধবাজ বিজেতা হতো, তাহলে একবার সৈন্য নিয়োগ করে অন্তত নিজের মর্যাদার খাতিরে যুদ্ধের বিজয়কে চূড়ান্ত করতো, এবং তায়েফে রক্তের বন্যা বইয়ে দিতো। কিন্তু রসূল সা. যেহেতু অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া রক্তপাত পছন্দ করতেন না, তাই তিনি অবরোধ তুলে নিলেন এবং অভিযান অসম্পূর্ণ রেখে দিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, পরে যখন সাকীফ ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করবে, তখন স্বেচ্ছায় আনুগত্যের পথ অবলম্বন করবে এবং একটা গঠন মূলক ও সংস্কারমূলক বিপ্লবের জন্য এটাই অধিকতর ফলপ্রসূ হতে সক্ষম। পরবর্তীতে হয়েছিলোও তাই।
৯. বনু হানফিয়ার প্রতিনিধি দল
এরা ইয়ামামা অঞ্চলের অধিবাসী ছিল। ছুমামা বিন ইছালের মাধ্যেমে তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছিলো। এর পর তারা মদিনায় এসে রসূল সা. সাথে সাক্ষাত করে এবং ইসলাম গ্রহণ করে।
কুখ্যাত ভন্ড নবী মুসাইলিমা কাযযাবও এই দলের সাথেই এসেছিল।। সে অনেক আজে বাজে কথা বলতে লাগলো। এক পর্যায়ে সে বললো মুহাম্মদ সা. যদি স্থির করেন যে, আমাকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করবেন, তবে আমি ইসলাম গ্রহণ করবো। আসলে নবূয়তে মুহাম্মদীর অসামান্য সাফল্য দেখে এই ব্যক্তি লোভাতুর হয়ে উঠেছিলো। সে ভেবেছিল, কিছু সাহিত্যিক বক্তব্যকে অহী বলে চালিয়ে দেয়া যাবে এবং তারপর নবুয়ত দাবী করলে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে। কিন্তু সে একথা বুঝতে পারেনি যে, সেই চারিত্রিক শক্তি সে কোথায় পাবে, যা ২০ বছর ধরে সব রকম বিরোধিতার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে চলে এসেছে? এসব চিন্তা ভাবনার কারণেই তার মাথায় ব্যবসায়িক বুদ্ধি এসেছিল। তার বক্তব্য ছিল যে, হয় আমার সাথে বানিজ্যিক সমঝোতা করো, নচেত আমি নিজেই নবুয়তের দোকান খুলে বসবো।
রসূল সা. তার মানসিকতা ধরে ফেলেছিলেন। তাঁর হাতে খেজুরের একটা শীষ ছিল। সেটা দেখিয়ে তিনি বললেন, আমি তো এই শীষটা দেয়ার শর্তেও কারো বাইয়াত নিতে চাইনা। অর্থাৎ ইসলাম কোন দোকান নয় যে তার মাধ্যমে কেউ ব্যক্তিগত উপার্জনের সুযোগ নেবে। সত্যকে সত্য মেনে নিয়ে কেউ আসে তো আসবে। কোন শর্ত আরোপ করা চলবেনা।
প্রতিনিধি দল বিফল হয়ে ফিরে গেলো। ফিরে গিয়ে মুসায়লিমা সত্যই নবুয়তের দাবী তুললো। তার ধর্মে নামায মাফ এবং মদ ও ব্যভিচার হালাল ছিল।
১০. বনু তাঈ গোত্রের প্রতিনিধি দল
‘তাঈ’ গোত্রের প্রতিনিধি দল যায়েদ আল খাইলের নেতৃত্বে উপস্থিত হয়। রসূল সা. তাদের সামনে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। সরদারসহ সমগ্র দল ঐ দাওয়াত সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেন। যায়েদ আল খাইল একাধারে কবি ও বক্তা ছিলেন। তাছাড়া তিনি একজন বীর যোদ্ধাও ছিলেন। রসূল সা. তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন “ আরবের যত লোকেরই প্রশংসা আমার সামনে করা হয়েছে, বাস্তবে দেখতে গিয়ে তাকে ঐ প্রশংসার চেয়ে কম গুনের অধিকারী পেয়েছি। কিন্তু যায়েদ আল খাইল তার ব্যতিক্রম। কেননা তাঁর যা কিছু প্রশংসা শুনেছি তাঁর ভেতরে তার চেয়ে বেশি গুনাবলী দেখতে পেয়েছি।”
আদী ইবনে হাতেমও এই গোত্রেরই নেতা ছিলেন। ধর্মে তিনি খৃষ্টান ছিলেন। রসূল সা. এর বিরুদ্ধে তার মনে তীব্র বিদ্বেষ ও ঘৃণা পুঞ্জীভূত ছিল। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু সহসা মুসলিম বাহিনী ইয়ামান অঞ্চলে পৌঁছে গেলে তিনি পালিয়ে সিরিয়া চলে গেলেন। তার বোন গ্রেফতার হয়ে মদিনায় নীত হলে রসূল সা. এর ব্যবহার ও অন্যদের সার্বিক চরিত্রিক সততা দেখে অত্যন্ত অভিভূত হন। তিনি আদীকে পীড়াপীড়ি করলেন যেন মদিনায় যায় এবং রসূল সা. এর সাথে দেখা করে। কারো কারো মতে আদী তাঈ গোত্রের প্রতিনিধিদের সাথেই মদিনায় গিয়েছিলেন। মদিনায় পৌঁছে তিনি যেই প্রশ্নটির সমাধান খুঁজছিলেন তা হল মহাম্মদ সা. একজন রাজা না নবী! মদিনায় এসে মসজিদেই রসূল সা. এর সাথে তার সাক্ষাত হল, তারপর তিনি মসজিদ থেকে বেরুলেন এবং আদীকে নিজ বাড়ির দিকে নিয়ে চললেন। পথি মধ্যে এক বুড়ি রসূল সা. এর সাথে কথা বলতে চাইল। তিনি তাকে অনেক খানি সময় দিলেন এবং মনোযোগের সাথে তার কথা শুনলেন। বাড়িতে গিয়ে নিজে মেঝের উপর বসে আদীকে গদির উপর বসালেন। এই দুটো জিনিস দেখে আদী নিশ্চিত হল যে তিনি আল্লাহর রসূল, নিছক দুনিয়াবি রাজা বাদশাহ নন। তারপর রসূল সা. এর কথা বার্তা তাকে আরো নিশ্চিত করলো।
আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়ে রসূল সা. বুঝে নিলেন আদীর মনে আর কি কি জটিলতা রয়েছে। অতঃপর তিনি সেগুলো এক এক করে পরিস্কার করলেন। পৃথিবীতে এক ধরণের লোক থাকে, যারা সত্যকে দ্রুত উপলব্ধি করে। কিন্তু তার সফলতার বাস্তব সম্ভাবনা যথেষ্ট পরিমান আছে কিনা এবং দ্রুত কোন ফল লাভ হতে পারে কিনা, সে ব্যাপারে আশ্বস্ত হতে চায়। আদী ছিলেন এই ধরণের ব্যক্তি। রসূল সা. তার মনের এই অবস্থাটা ধরতে পেরে বললেন, তুমি হয়তো ইসলামের অনুসারীদের বর্তমানে দরিদ্র দেখেই ইসলাম গ্রহনে ইতস্তত করছ। আল্লাহর কসম, সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন মুসলমানদের মধ্যে সম্পদের ফোয়ারা ছুটবে এবং এতো প্রাচুর্য দেখা দেবে যে, সম্পদ নেয়ার লোকই পাওয়া যাবে না। আর যদি মুসলমানদের সংখ্যা কম ও তার শত্রুদের সংখ্যা বেশী দেখে তুমি দ্বিধান্বিত হয়ে থাকো, তাহলে জেনে রাখো, আল্লাহর কসম, সেই দিন আসন্ন যখন এক মহিলা একাকিনী ঊটে সওয়ার হয়ে কাদেসিয়া থেকে এই মসজিদ দর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা হবে এবং সম্পূর্ণ নিরাপদে পৌঁছে যাবে। হয়তো বা তুমি অমুসলিমদের ক্ষমতা ও প্রতাপ বেশী দেখে ইসলাম গ্রহনে উৎসাহ পাচ্ছনা। কিন্তু আল্লাহর কসম তুমি স্বয়ং অচিরেই শুনতে পাবে, মুসলমানরা ব্যবিলনের প্রাসাদ গুলো দখল করে নিয়েছে। এই দিক দিয়ে যখন আদীর সন্দেহ দূর হল, তৎক্ষণাত তিনি নিজেকে ইসলামী আন্দলোনের হাতে সমর্পন করলেন। উপরোক্ত আলাপ আলোচনা থেকে যে কয়টা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় তা হলঃ
– ইসলাম শুধু নৈতিক সংশোধন ও সংস্কারের আহবান জানায় না বরং তার কর্মসূচিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যেমন অন্তর্ভূক্ত রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক বিপ্লবও। আখেরাতের কল্যানকে সে পার্থিব সুখ সমৃদ্ধি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহন করে না।
– রসুল সা.ইসলামী আন্দোলনের দূরতম ভবিষ্যত সম্পর্কে আগাম ধারণা রাখতেন। কোন্ কোন্ স্তর অতিক্রম করে কোথায় পৌঁছতে হবে,সেটা শুরুতেই তাঁর সামনে স্পষ্ট থাকতো।
– ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে জনগণকে এই মর্মে আশ্বস্ত করা অত্যন্ত জরুরী যে, আন্দোলনের বাস্তব সাফল্যের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এবং ইপ্সিত ইসলামী বিপ্লব কোন আকাশ কুসুম কল্পনা নয় বরং তা আগামী দ্বীনের সূর্যোদয়ের মতোই অবধারিত বাস্তবতা। এটা না করতে পারলে জনগণের একটা বিরাট অংশ ইসলামের দাওয়াত কে ধ্রুব সত্য জেনেও বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
– ইসলামী আন্দোলন যদি সাফল্য ও পূর্ণতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তাহলে তার অনিবার্য ফল দাঁড়াবে এই যে, (১) অর্থনৈতিক উপায় উপকরণের বিপুল উন্নয়ন ও তার সুফলের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন নিশ্চিত হওয়ার কারণে কোন অভাবী ও পরমুখাপেক্ষী লোকের অস্তিত্বই থাকবেনা, (২) রাজনৈতিক দিক দিয়ে এতো শক্তি মান ও স্থিতিশীল সরাক্র গঠিত হবে যে, শত্রুরা তাকে সহজেই গ্রাসযোগ্য মনে করবেনা। বরঞ্চ এই সরকার তার বিরোধী মহলের সমস্ত দর্প চূর্ণ করতে সক্ষম হবে, (৩) অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা এমন মানে উন্নীত হবে যে, কোন মহিলাও যদি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত একাকিনী ভ্রমন করে এবং মানুষের লোকালয়ের কাছ দিয়ে যায় তবে তার জান, মাল ও সম্ভ্রম কোন দিক দিয়েই হুমকির সন্মুখীন হবে না। এই হচ্ছে একটা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক গুনবৈশিষ্ট্য।
১১. বনুল হারস-এর প্রতিনিধি দল
এই প্রতিনিধি দলটি ছিল নাজরান অঞ্চলের। এই সব এলাকায় হযরত খালেদ ইবনে ওলিদ( ১০ম হিজরিতে) ব্যক্তিগত ভাবে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছান। তিনি তাদেরকে বলেন তোমরা ইসলাম গ্রহণ করলে নিরাপত্তা পাবে। তারা দাওয়াত গ্রহণ করে। হযরত খালেদ তাদেরকে ইসলামের আকিদা বিশ্বাস ও আহকামের শিক্ষা দানের জন্য কিছুদিন সেখানে অবস্থান করেন এবং চিঠির মাধ্যমে রসূল সা. কে সাফল্যের খবর জানান। মদিনা থেকে চিঠির জবাবে বলা হয়, এখন ফিরে এসো এবং ঐ গোত্রের কিছু গণমান্য লোককে সাথে করে নিয়ে এসো। এই আদেশ তৎক্ষণাৎ প্রতিপালিত হয়। [ হযরত খালেদের এই চিঠির হুবহু উদ্ধৃতি ইবনে হিশাম দিয়েছন। এতে হযরত খালেদ নিজের অবস্থানের কারণ বর্ণনা করে রসুল সা. এর আদেশের বরাত দেন। এ প্রসংগে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমি তাদেরকে ইসলামের আল্লাহর কিতাব ও রসূল সাঃ এর সুন্নাহর শিক্ষা দিচ্ছি’। এরপর তিনি আবার বলেন ‘এ কাজ আমি রসূল সা. এর আদেশ অনুসারেই করছি’। এরপর পুনরায় লিখেছেন যে, “ আমি তাদেরকে ইসলামের শিক্ষা দিচ্ছি, আল্লাহর কিতাব ও রসূল সা. এর সুন্নাহর শিক্ষা দিচ্ছি’। এই চিঠিটা পড়ার সময় মনে হল, সাহাবায়ে কেরামের যুগে এ ধরণের যেসব দলীল পাওয়া যায় তার প্রত্যেকটাই রসূল সা. এর সুন্নাহকে ইসলামের একটা মৌলিক উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং তাকে মেনে নেয়া অপরিহার্য গন্য করে।]
এই গোষ্ঠীটি সেই জাহেলী যুগেও কিছু উত্তম নৈতিক মূল্যবোধ মেনে চলতো প্রতিনিধি দলটি যখন এলো তখন রসূল সা. তাদেরকে কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সব সময় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইতে জয় লাভ করে থাকো এবং কখনো পরাজিত হও না, এর কারণ কি?” তারা বলল “আমরা কারো বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় আগ্রাসী পদক্ষেপ নেইনা। এবং নিজেদের পক্ষ থেকে কোন জুলুম শুরু করিনা। যখন লড়াই করার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেই, তখন তা থেকে কেউ সরে আসিনা ও অনৈক্য সৃষ্টি করিনা। বরং ঐক্য বজায় রাখি”। রসূল সা. তাদের এই কৌশলকে সমর্থন জানালেন।
প্রতিনিধি দলের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কায়েস বিন হাসীনকে গোত্রের আমীর নিয়োগ করা হল।
১২. নাজরানের প্রতিনিধি দল
মানবতার পরম হিতৈষী মহামানব সা.কলম দিয়েও ইসলামী দাওয়াতের অনেক কাজ করেছেন। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা দলের কাছে তিনি চিঠির মাধ্যমে দাওয়াত দিয়েছেন এ ধরণের একটা চিঠি তিনি নাজরানের খৃষ্টানদের কাছেও পাঠিয়েছেন। এ চিঠিতে তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষায় নিম্নরুপ দাওয়াত দেনঃ
“ইবরাহিম, ইসহাক ও ইয়াকূবের মা’বুদ আল্লাহর নামে শুরু করছি। আমি তোমাদেরকে আল্লাহর বান্দাদের দাসত্ব পরিত্যাগ করে আল্লাহর দাসত্ব অবলম্বন করা এবং আল্লাহর দাসদের প্রভুত্ব পরিত্যাগ করে আল্লাহর প্রভুত্বের অনুগত হবার আহবান জানাচ্ছি। এ দাওয়াত যদি মানতে না চাও, তবে তোমাদের জিজিয়া দেয়া (অর্থাৎ রাজনৈতিক আনুগত্য করা) অবশ্য কর্তব্য। সেটাও যদি অমান্য করো তবে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলো”। বিশপ চিঠি পড়েই ভয়ে কাঁপতে লাগলো। সে প্রথমে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করলো। তারপর সমগ্র এলাকার জনগণকে ডাকল। এলাকার তিহাত্তরটি জনপদ ছিল এবং লোক সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে, এক লাখ লড়াকু যে কোন সময়ে বেরিয়ে আসতে পারতো। প্রধান প্রধান খৃষ্টান নেতাদের ধারণা ছিল, ইসমাঈল আ. এর বংশধরদের মধ্যে থেকে যে শেষ নবীর আগমনের কথা, ইনিই হয়তো তিনি। গণ পরামর্শের পর স্থির হলো, প্রধান প্রধান খৃষ্টীয় নেতাদের একটি দল মদিনায় যাবে, চিঠির লেখকের সাথে কথা বার্তা বলবে এবং পরিস্থিতি যাচাই করবে। এই দলে শুরাহবীল, আবদুল্লাহ ও হাব্বারকে নিয়োগ করা হলো। এটি ছিলো রাজনৈতিক আনুগত্য জ্ঞাপনকারী, কর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দানকারী, এবং এর বিনিময়ে নিরাপত্তা ও অধিকার সংক্রান্ত একটা ফরমান বা ঘোষণা পত্র পেয়ে প্রত্যাবর্তনকারী প্রথম প্রতিনিধি দল।
প্রতিনিধি দল নিরাপত্তা সনদ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলে বিশপ ও প্রধান সরদাররা তাদের অভ্যর্থনা জানাতে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যান। তারা সনদকে পথিমধ্যেই বিশপের হাতে তুলে দেন এবং বিশপ পথ চলতে চলতে তা পড়তে থাকেন। তার চাচাতো ভাই বশীর বিন মুয়াবিয়াও সনদটি এমন তন্ময় হয়ে পড়তে লাগলো যে, ঊটের উপর থেকে নীচে পড়ে গেলো। নিচে পড়ে গিয়ে বেএখতিয়ার হয়ে বলে ফেললো “যে ব্যক্তির কারণে আমরা এতো মুসিবতে পড়ে গেছি, তার সর্বনাশ হোক”। কথাটা যে সে রসূল সা. কে ইঙ্গিত করে বলেছে তা সুস্পষ্ট। তাই বিশপ তাকে কঠোরভাবে বলল “এ কী বলছো তুমি? আল্লাহর কসম, সেতো আল্লাহর প্রেরিত নবী” আর যায় কোথায়? কথাটা শোনা মাত্রই বশীরের মধ্যে বিপ্লব এসে গেলো। সে বলল “ তাহলে আল্লাহর কসম, আমি এক্ষুনিই তার দরবারে উপস্থিত হচ্ছি’। বিশপ তার পিছনে পিছনে ঊটনী হাঁকিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো এবং তাকে বলতে লাগলো “আরে আমার কথা শোন। আমার কথার অর্থটা বুঝে নাও। আমি একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে কথাটা বলে ফেলেছিলাম”। বশীর কোন কথাই শুনলোনা। বললো “ তুমি একজন বিশপ। তুমি যা বলেছ তা ভুল হতে পারেনা”। সংকল্পে অনড় বশীর রসূল সা. এর কাছে পৌঁছে ইসলাম গ্রহণ করে তবেই ক্ষান্ত হলো এবং মদিনাতেই বসবাস করতে লাগলো। পরবর্তীকালে আল্লাহ্ তাঁকে শাহাদাতের সৌভাগ্যদান করেন।
করয বিন আলকামা সম্পর্কেও প্রায় এ ধরনেরই ঘটনা বর্ণিত আছে।
প্রতিনিধি দল স্থানীয় সরদার সহ নাজরান ফিরে গেলে সেখানকার আরেকজন সংসার বিরাগী খৃষ্টান দরবেশ সমস্ত ঘটনা শুনে অভিভূত হলো। নতুন নবীর আবির্ভাবের কথা শুনে সেও আবেগোদ্দীপ্ত হয়ে মদিনায় চলে গেলো। নিজের একটা পেয়ালা, একটা চাদর, একটা লাঠি রসূল সা. কে উপহার হিসেবে দিয়ে নিজের ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করলো। তারপর রসূল সা. এর অনুমতি নিয়ে ফিরে আসার ওয়াদা করে নাজরান গেল। কিন্তু রসূল সা. এর জীবদ্দশায় আর ফিরে আসতে পারেনি।
কনস্টান্টিনোপলের রাজার ভক্তি ভাজন ও খৃষ্টান জনগণের মধ্যে ব্যাপক সুখ্যাতির অধিকারী নাজরানের বিশপ আবুল হারেস পনুরায় একটা প্রতিনিধি দল নিয়ে মদিনায় গেলো। খৃষ্টান মুফতী ও বিচারক আয়হাম, আব্দুল মসিহ আকের ও ২৪ জন বিশিষ্ট নেতা এ দলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উল্লেখ্য এই বিশপ মূলত বনু বকর বিন ওয়ায়েলের বংশোদ্ভূত একজন আরব ছিল। কিন্তু খৃষ্টান হওয়ার পর সে ধর্মীয় জ্ঞান ও ইবাদতের দিক দিয়ে এতো উন্নতি লাভ করে যে, সে স্বয়ং খৃষ্টানদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত নেতায় পরিণত হয়।
তারা দিন কয়েক মদিনায় কাটালো। খৃষ্ট ধর্ম অনুসারে তারা মসজিদে নববীতে নামায পড়তে চাইলে কোন কোন সাহাবী তাতে বাঁধা দেন, কিন্তু রসূল সা. অনুমতি দেন।
তাদের আগমনে স্থানীয় ইহুদিরা ভীষণভাবে তৎপর হয়ে উঠলো এবং এর ভেতর অনর্থক নাক গলিয়ে নানা রকম কূটতর্ক তুললো। ত্রিত্ববাদ ও হযরত ঈসা আ. এর মর্যাদা নিয়ে আলোচনা হলো। প্রত্যেক ব্যাপারেই কোরআনের আয়াত দিয়ে তাদের জবাব দেয়া হলো। সাথে সাথে ইহুদীদের সংশয়ও উস্কে দিলো যে রসূল সা. ঈসা আ. এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে নিজের উপাসনা করিয়ে নিতে চান। এর জবাব ও আল্লাহর পক্ষ থেকে রসূল সা. কোরআনের আয়াত পড়ে শুনিয়ে দিলেন যে, আল্লাহ্ যাকে কিতাব, শাষন ব্যবস্থা ও নবুয়ত দান করেন তাঁকে কখনো জনগণের উদ্দেশ্যে একথা বলার অনুমতি দেয়া হয়নি যে, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে আমার বান্দা হয়ে যাও। তারপর ইহুদি প্রতিনিধি দলের সদস্যদের মধ্যে এই বিতর্ক ও চলে যে, হযরত ইবরাহিম আ।। কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ইহুদীদের দাবী ছিল যে তিনি ইহুদী ছিলেন। আর খৃষ্টানদের দাবী ছিল যে তিনি খৃষ্টান ছিলেন ( নাউজুবিল্লাহ)। কোরআন অত্যন্ত সাদাসিদে ভাষায় এবং তর্কাতীত ভঙ্গীতে এই বিতর্কের মীমাংসা করে দেয় যে, “হে আহলে কিতাব, তোমরা ইবরাহীম আ. সম্পর্কে অনর্থক তর্কে লিপ্ত হও কেন? অথচ তাওরাত ও ইনজিল উভয়ে তার পরে নাযিল হয়েছিল। ( এই দুই খানা গ্রন্থ থেকেই ইহুদী ও খৃষ্টান এই দুই জাতির উদ্ভব ঘটেছিল)। তিনি তো ইহুদীও ছিলেননা, খৃস্টানও ছিলেন না। বরং একনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন। তিনি কখনো মোশরেক ছিলেন না। ইবরাহীমের নীতির যথার্থ অনুসারী শুধু রসূল সা. ও তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারীগণ”! স্বয়ং হযরত ঈসা আ. এর মর্যাদা কোরআনে এই বলে তুলে ধরা হয়েছে যে, “ আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদম আ।। এর মতোই”।
নাজরানের প্রতিনিধি দলের মধ্যে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে কিছুটা অনড় মনোভাব হয়তো ছিল। অনেক সময় সদুদ্দেশ্য নিয়েও মানুষ পুরানো ধ্যানধারণার প্রতি অনুগত থাকে। কিন্তু ইহুদীদের কুমতলবপূর্ণ যোগসাজশ এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছিল। নিষ্প্রয়োজন কূটতর্ক ও কূট তর্কজনিত হঠকারিতা সত্য গ্রহনে অন্তরায় সৃষ্টি করছিল। এই জন্য কোরআন তাদের সামনে নিষ্পত্তির একটা চরম পন্থা তুলে ধরেছে। সেটি হোল ‘মুবাহালা’। রসূল সা. কে নির্দেশ দেয়া হলো যে, তাদেরকে বলে দাও, “ এসো আমরা আমাদের স্ত্রীদেরকে ও সন্তানদেরকে ডেকে নেই এবং নিজেরাও ময়দানে নামি। অতঃপর আল্লাহর কাছে নিজেদের সম্পর্কে ফয়সালা কামনা করি এবং মিথ্যুকদের উপর অভিশাপ বর্ষন করি।” বস্তুত কোন সত্যবাদীর উপর যখন মিথ্যাচারের অপবাদ আরোপ করা হয়, তখন তাঁর পক্ষে এর চেয়ে কষ্টদায়ক ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। এরূপ পরিস্থিতিতেই আল্লাহ্ তায়ালা নিষ্পত্তির এই পন্থা নির্ধারন করেন যে, উভয় পক্ষ প্রকাশ্য জনতার সামনে আল্লাহর ফয়সালা চাইবে। পরদিন রসূল সা. নিজের প্রানপ্রিয় মেয়ে ফাতেমা, জামাতা আলী ও নিষ্পাপ দৌহিত্রদেরকে নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলেন। মদিনাবাসির জন্য এটা ছিল অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা ও একটা বিরাট ঘটনা যে, সত্যের একজন আহবায়ক তাঁর গোটা পরিবার পরিজনকে মোবাহালার ময়দানে নিয়ে এসেছেন। কত দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর ছিল! খৃষ্টান প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঘাবড়ে গেলো যে, উনি যদি সত্যি সত্যি নবী হয়ে থাকেন, তাহলে এই মোবাহালায় আমাদের নাম নিশানাও মুছে যাবে। তারা এই বিতর্কে আর অগ্রসর না হয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রস্তাব দিলো এবং জিযিয়ার পরিমাণ নির্ধারনের ভারও রসূল সা. এর উপরই ছেড়ে দিলো। পরদিন এই মর্মে আদেশনামা লিখে দেয়া হলো যে, খৃষ্টানরা পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক স্বায়ত্ব শাসন ভোগ করবে। তাদের লোকজন ও ধন সম্পদ যে অবস্থায় রয়েছ সেই অবস্থায় বহাল থাকবে। তাদের বর্তমান অধিকারগুলোর কোন রদবদল করা হবেনা। তাদের ধর্মীয় পুরোহিতদের( বিশপ ও সন্যাসী) মধ্যে কোন পরিবর্তন করা হবেনা। ধর্মীয় সম্পত্তিগুলোর মালিকানা ও অধিকার থেকেও কাউকে বঞ্চিত করা হবে না। জাহেলী যুগের অপরাধগুলোর ওপর আর পাকড়াও করা হবেনা। মুসলিম বাহিনী তাদের ভূমিতে প্রবেশ করবেনা। দুনিয়াবী রাজা-বাদশাহদের মতন তাদের জনগনকে শ্রম দিতে বাধ্য করা হবেনা। জালেম ও মাজলুমের মাঝে ইনসাফ করতে হবে। কেউ সুদ খেলে তার দায় দায়িত্ব কেউ নিবেনা। একজন অপরজনের পাপের ফল ভোগ করবেনা। এতো বড় জনসংখ্যার উপর বাৎসরিক মাত্র দুই হাজার উকিয়া পরিমাণ পোশাক পরিচ্ছদ কর হিসেবে ধার্য হলো।
নাজরানের এ দুটি প্রতিনিধি দল সংক্রান্ত বিবরণ খানিকটা মিশ্রিত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় প্রতিনিধি দলের আগমনের উপলক্ষেই অধিকতর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হওয়ার কথা। কিন্তু রসূল সা. এর নিরাপত্তা সূচক ঘোষণাপত্র সম্ভবত প্রথম দলই পেয়েছিল। কেননা দ্বিতীয় ঘোষণা পত্রে রাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে ধর্মীয় বিষয়ের উপস্থিতি অধিকতর। এতে প্রধানত ধর্মীয় পুরহিতদের সম্বোধন করা হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে নাজরান বাসীকে সর্বোচ্চ পরিমাণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও খৃষ্টীয় ব্যবস্থায় কোন হস্তক্ষেপ না করার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিলো। এই ঘোষণা পত্র থেকে প্রমানিত হয় যে, রসূল সা. রাজনৈতিক পরিমন্ডলে শুধু শাসন ব্যবস্থার আনুগত্য চাইতেন এবং সেটা পেলেই সন্তুষ্ট থাকতেন। কোন সম্প্রদায়কে তার ধর্ম পালন থেকে বিরত রাখতেন না, কারো উপর ইসলামী আকীদা বিশ্বাস জোরপূর্বক চাপিয়েও দিতেন না। বরঞ্চ সংখ্যালঘুদের সর্বোচ্চ পরিমাণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতেন। ইসলামী আন্দোলন ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঈমান ও মতামতের পরিবর্তন কেবল মাত্র যুক্তির বলেই করতো, তবে সে তার সামষ্টিক বিধানকে রাজনৈতিক শক্তি দ্বারাই প্রয়োগ করতো। লক্ষ্য করুন, প্রথম ঘোষণা পত্রে সুদখোরীকে নিরাপত্তার বাইরে রাখা হয়েছে এবং তা একটা বেআইনি ও অপরাধমূলক কাজ। ধর্ম তার আসল আলোচ্য বিষয়ই ছিল না। কেননা তা ধর্মের চেয়ে আরো বড় জিনিস। রসূল সা. এর জারী কৃত এই ঘোষণা পত্র চিরদিনের জন্য উম্মতের অবশ্য পালনীয় আইনের মর্যাদা রাখে। এই ঘোষণা প্ত্র থেকে এটাও প্রমানিত হয় যে, ইসলাম অন্যান্য ধর্ম পালনকারী সংখ্যা লঘুদের প্রতি কত উদার। পৃথিবীর আর কোন আইন, বিধান ও সভ্যতা সংখ্যা লঘুদের প্রতি এমন উদারতা দেখিয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত পেশ করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় প্রতিনিধি দল মদিনা থেকে বিদায় নেয়ার সময় রসূল সা. কে অনুরোধ করলো যে, আপনার কোন বিশ্বস্ত কর্মকর্তাকে জিযিয়া আদায় করে আনার জন্য আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিন। রসূল সা. উবায়দা ইবনুল জাররাহকে পাঠালেন এবং তাকে ‘ আমীনুল উম্মাহ বা উম্মাহর বিশ্বস্ত ব্যক্তি’ খেতবে ভূষিত করেন। হযরত আবু উবায়দা কর আদায়ের সাথে ঐ এলাকায় ইসলামী দাওয়াতের বিস্তৃতির জন্যও সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। ফলে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, নাজরানের অধিবাসীরা দুটি প্রধান প্রধান গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলঃ
খৃষ্টান ও উম্মী (নিরক্ষর)। খৃষ্টানরা রাজনৈতিক আনুগত্যের অঙ্গীকার দিয়ে নিষ্পত্তি করে। কিন্তু উম্মীরা ইসলাম গ্রহণ করে। সম্ভবত প্রথম প্রতিনিধি দল নবম হিজরীর শেষভাগে এবং ২য় প্রতিনিধি দল দশম হিজরীর প্রথম ভাগে এসেছিল।
১৩. বনু আসাদের প্রতিনিধি দল
বনু আসাদ নামক গোত্রটি যাবতীয় সামরিক তৎপরতায় কোরায়েশদের সহযোগী ছিল। ৯ম হিজরীতে এই গোত্রের প্রতিনিধি দল রসূল সা. এর কাছে এসে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা জানায়। তবে এই জানানোর ভঙ্গিতে আরবদের স্বভাবগত দাম্ভিকতার কিছু রেশ ছিল। তারা খানিকটা কৃতিত্ব প্রদর্শনের ভঙ্গিতে রসূল সা. কে বললো “ আপনি তো কোন প্রচারক দল আমাদের কাছে পাঠাননি। আমরা আপনা থেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছি।” এই মনোভাব রদ করার জন্য রসূল সা. এর কাছে বাণী এলোঃ “নিজেদের ইসলাম গ্রহণকে একটা অনুগ্রহ হিসেবে আমার কাছে পেশ করোনা। বরঞ্চ এটা আল্লাহরই অনুগ্রহ যে, তিনি তোমাদেরকে ইসলামের পথে চালিত করেছেন।” তার পর এই প্রতিনিধি দল পাখি দ্বারা ভাগ্য জানা ও ভবিষ্যদ্বাণী করার চেষ্টা এবং পাথর নিক্ষেপ করে পন্য চিহ্নিত করা ( অর্থাৎ মূল্য নির্ধারনের পর নেতা কর্তৃক দূর থেকে পন্য বা জিনিসের দিকে পাথর ছুড়ে মারা এবং যে পন্যটির গায়ে পাথর লাগে, সেটি নিজের জন্য মনোনীত করা) সম্পর্কে ইসলামের বিধান জানতে চায়। রসূল সা. এসবের বিরোধিতা করেন। সবার শেষে তারা জানতে চায়, চিঠি লেখা জায়েয কিনা? রসূল সা. বললেন এটা তো কোন একজন নবীই চালু করেছেন। এর চেয়ে ভাল বিদ্যা আর কি হতে পারে।
হযরত আবু বকর সিদ্দিকের খেলাফত আমলে এই গোত্রের তালহা বিন খুয়াইলিদ নামক এক ব্যক্তি মিথ্যা নবুয়তের দাবী তুলেছিল।
১৪. বনু ফাযারার প্রতিনিধি দল
বনু ফাযারা একটি শক্তিশালী ও অহংকারী গোত্র ছিল। এই গোত্রেরই সদস্য উয়াইনা বিন হিসন একটা প্রতিনিধি দল নিয়ে রসূল সা. তবুক থেকে ফেরার পথে তাঁর সাথে সাক্ষাত করে ইসলাম গ্রহণ করে। রসূল সা. তাদের কাছে এলাকার সাধারণ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। তারা জানায় দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। দুর্ভিক্ষের দরুন ফসল, গবাদি পশু, বাগবাগিচা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং শিশুরা অপুষ্টিতে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। তারা রসূল সা. এর কাছে দোয়া চাইল। রসূল সা. বৃষ্টির জন্য দোয়া করলেন এবং দোয়া কবুল হলো।
১৫. বনু আমেরের প্রতিনিধি দল
এটা ছিল আরবের প্রখ্যাত গোত্র কায়েস আইলানের শাখা। এদের তিন জন নামকরা সরদার ছিলঃ আমের বিন তুফায়েল, আরবাদ বিন কায়েস, ও জাব্বার বিন সালমা। এই তিন সরদারের মধ্যে প্রথম দু’জন ছিল পদলোভী। বিশেষত আমের আগেই নানা রকমের দুষ্কর্মের সাক্ষর রেখেছে। এবারো তারা রসূল সা. কে হত্যা করার এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র পাঁকিয়ে এসেছিল। প্রতিনিধি দল রসূল সা. এর দরবারে হাজির হয়ে তাঁকে “সাইয়েদুনা” (আমার প্রভু) বলে সম্বোধন করলেন। রসূল সা. তার কথা বলার এই ভঙ্গীর বিরোধিতা করে বললেন “ সাইয়েদ বা প্রভু শুধু আল্লাহ্, আর কেউ নয়।” এরপর তারা আরো কিছু চাটুকার সুলভ কথা বার্তা বললে রসূল সা. পুনরায় সতর্ক করে বললেন “কথা বলার সময় আমাদের সাবধান থাকা উচিত যেন শয়তান আমাদেরকে বিপথগামী করতে না পারে।” চাটুকারিতা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য কত সযত্ন প্রয়াস। আমের বিন তোফায়েল রসূল সা. এর আন্দোলনকে নিছক ক্ষমতা লাভের রাজনীতি ও সাম্রাজ্য গড়ার চেষ্টা বলে মনে করেছিলো। এজন্যে তারা যথারীতি দর কষাকষির জন্য শর্ত দিলঃ
১. আপনি বেদুঈনদের উপর শাসন চালাবেন আর আমাকে শহরে শাসন চালাতে দেবেন।
২. নচেত, আপনার পরে আমাকে শাসক নিয়োগ করুন।
৩. অথবা আমি গিতফানকে সাথে নিয়ে মদিনায় হামলা চালাবো।
আমের আরবাদকে বলেই রেখেছিল যে, আমি রসূল সা. কে কথায় মশগুল রাখবো, তুমি সুযোগ বুঝে কাজ সমাধা করবে। কিন্তু রসূল সা. এর ভাব গাম্ভীর্যের প্রভাবে সে হতভম্ব হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো। উভয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলো। রসূল সা. উভয়ের মনের ভাব বুঝতে পেরে দোয়া করলেনঃ “ হে আল্লাহ্! ওদের ক্ষতি থেকে বাঁচাও।” এর অনতিকাল পরেই আমের প্লেগের কবলে পড়ে মারা যায় এবং আরবাদ বিন কায়েস বজ্রাঘাতে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
১৬. বনু আযরা গোত্রের প্রতিনিধি দল
নবম হিজরীর সফর মাসে এই গোত্রের বারো ব্যক্তি রসূল সা. এর দরবারে উপস্থিত হয়। হামযা বিন নোমান এদের অন্তর্ভূক্ত ছিল। তারা নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলে “ আমরা আযরার বংশধর।” মায়ের দিক থেকে আযরা ছিল কুসাইয়ের ভাই। রসূল সা. পরম আনন্দের সাথে “ আহলান ওয়া সাহলান” বলে তাদের স্বাগত জানালেন। তারা সবাই সর্বান্তকরণে ইসলাম গ্রহণ করলো। রসূল সা. তাদেরকে সুসংবাদ শুনালেন, সিরিয়ায় রোম সাম্রাজ্যের রাজত্ব বিলুপ্ত হবে এবং হিরাক্লিয়াস পালিয়ে যাবে। রসূল সা. তাদেরকে জ্যোতিষিদের কাছ থেকে ভবিষ্যতের খবর জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করলেন এবং একমাত্র হযরত ইবরাহীমের শেখানো কুরবানী ছাড়া অন্য সমস্ত কুরবানী পরিত্যাগ করতে বললেন। যাওয়ার সময় প্রতিনিধি দলকে রীতি মোতাবেক পাথেয় দেন।
১৭. বাল্লী গোত্রের প্রতিনিধি দল
এই গোত্রের বসতি এলাকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নবম হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে এই গোত্রের প্রতিনিধিরা তাদের নেতা রুয়াইফি বিন ছাবেতের সাথে রসূল সা. এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা তিন দিন মদিনায় অবস্থান করে। অতপর রওনা দেয়ার সময় রসূল সা. তাদের খেজুর ও পথ খরচ দেন।
১৮. কান্দা গোত্রের প্রতিনিধি দল
এটি ইয়ামান অঞ্চলের একটি গুরুত্ব পূর্ণ গোত্র ছিল। এই গোত্রের ৬০ বা ৮০ ব্যক্তি মূল্যবান রেশমী কাপড় পরে হযরত আশায়াস বিন কায়েসের নেতৃত্বে মদিনায় পৌঁছে। রসূল সা. তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি মুসলমান হয়ে গিয়েছ? তারা জবাব দিলো, হাঁ। রসূল সা. বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘তাহলে এই রেশম পরে এসেছো কেন?’ প্রতিনিধি দল তৎক্ষণাত রেশমের পোশাকগুলো খুলে ফেলে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ঈমানী দৃঢ়তার দুর্লভ দৃষ্টান্ত পেশ করলো।
১৯. আযদ গোত্রের প্রতিনিধি দল
বনু আযদ গোত্র ও ইয়ামানের অধিবাসী ছিল। সাদ বিন আবদুল্লাহ আযদীর নেতৃত্বে তাদের দল রসূল সা. এর দরবারে আসে এবং ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত সারদ গোত্রের আমীর নিযুক্ত হন।
২০. জারশের প্রতিনিধি দল
ইয়ামানের অধিকাংশ এলাকা তখন ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তুর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী লোকও ছিল। জাহাশ শহরটিও ছিল বিদ্রোহীদের দখলে। হযরত সারদ আযদীর নেতৃত্বে একদল মুসলিম বাহিনী দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ আরোপ করে বিদ্রোহীদের পরাজিত করে। জারাশ মুসলিম বাহিনীর দখলে আসার পর তার প্রতিনিধি দল মদিনায় আসে।
২১. হামাদানের প্রতিনিধি দল
এই প্রতিনিধ দল একশো বিশ ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত ছিল। মালেক বিন নামত, আবু সাওর, মালেক বিন আনফা সালমানী, উমায়ের বিন মালেক খারেকী (অথবা আমর ইবনে মালেক), যিমাম বিন মালেক প্রমূখ শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি বর্গ অন্তর্ভূক্ত ছিল। মালেক বিন নামত রসূল সা. এর দরবারে কবিতা পাঠের মাধ্যমে তাঁর প্রশংসা করেন। রসূল সা. তাঁকেই গোত্রের মুসলমানদের আমীর নিযুক্ত করেন। হামাদান অঞ্চলে প্রথমে হযরত খালেদকে দাওয়াতী অভিযানে পাঠানো হয়। কিন্তু ৬ মাস পর্যন্ত কোন সাফল্য আসেনি। এরপর রসূল সা. একটি চিঠি দিয়ে হযরত আলী রা. কে পাঠান। হযরত আলী সেখানে গিয়ে জনসমাবেশে চিঠিটা পড়ে শোনান। লোকেরা তৎক্ষণাত ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত আলী একটি চিঠির মাধ্যমে রসূল সা. কে এর বিবরণ লিখে জানালে তিনি সিজদায় গিয়ে আল্লাহর শোকর আদায় করেন এবং মাথা তুলে বলেন “আসসালামু আলা হামাদান।” (হামাদানের উপর সালাম বর্ষিত হোক)
২২. ফারওয়া জুযামীর দূতের আগমন
ফারওয়া ছিলেন মুয়ান অঞ্চলের রোম সম্রাজ্যে কর্তৃক নিযুক্ত গবর্ণর। এখানে সিরিয়া ও আরব উভয় অঞ্চলের অংশ ছিল। তাঁর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছলে তিনি নিজের পদ এবং জীবন উভয়কে ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করে ইসলামে প্রবেশ করেন। একজন দূত পাঠিয়ে রসূল সা. কে নিজের ইসলাম গ্রহণের খবরও জানান এবং রসূল সা. কে একটা সাদা খচ্চর উপহার পাঠান। রোম সরকার এ খবর জানার পর তাঁকে গ্রেফতার করে আফরা নামক স্থানে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে। আল্লাহ্ তাঁর এই বান্দাকে এমন মজবুত ঈমান দিয়েছিল যে, তিনি গবর্নরের আসন থেকে উঠে হাসতে হাসতে শূলের কাষ্ঠে গিয়ে দাঁড়ান।
২৩. তুজীব গোত্রের প্রতিনিধি দল
[এই গোত্রেরই একজন দুষ্কৃতিকারী কিনানা বিন বিসর হযরত ওসমান রাঃ এর খুনী ছিল। এই নামেরই কাছা কাছি আরেকটি গোত্রের নাম তাজওয়াব, যা হিময়ার রাজবংশোদ্ভূত। হযরত আলী রাঃ এর খুনী ইবনে বিলহাম শেষোক্ত গোত্রের লোক।]
এটি ইয়ামানের কান্দা গোত্রের একটি শাখা। এরা আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং ইসলামের দাবী অনুসারে জীবন গড়ে তুলেছিল। তেরো ব্যক্তির এক প্রতিনিধি দল যাকাতের সম্পদ ও পশু সাথে নিয়ে মদিনায় আসে। তারা এসে বলে আমাদের সম্পদে আল্লাহর যে অংশ রয়েছে, তা নিয়ে এসেছি। রসূল সা. বললেন এসব সম্পদ ফিরিয়ে নিয়ে যাও এবং এলাকার লোকদের মধ্যে বন্টন করে দাও। তারা বললো, স্থানীয় লোকদের দেয়ার পর যা অবশিষ্ট ছিল তাই নিয়ে এসেছি। এ কথা শুনে হযরত আবু বকর রা. স্বতস্ফুর্তভাবে বলে উঠলেন হে রসূল সা.। তুজীবের প্রতিনিধি দলের মতো আরবের আর কোন প্রতিনিধি দল আসেনি। রসূল সা। বললেন, ‘হেদায়েত আল্লাহ্ তায়ালার হাতে নিবদ্ধ। তিনি যার জন্য কল্যান চান, তার মন ঈমান দিয়ে ভরে দেন’।
তারা রসূল সা. এর কাছে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করলো এবং তার লিখিত জবাব নিয়ে গোত্রের লোকদের কাছে ফিরে গেলো।
এই দলে বনী উবদীর এক যুবক ছিল। প্রতিনিধি দল তাদেরকে নিজেদের জিনিসপত্র ও পশুদের তদারকিতে নিয়োজিত রেখে গিয়েছিলো। রসূল সা. তাকে বিশেষভাবে ডাকেন। সে বলল, আমার একটাই অনুরোধ, আপনি আমার গুনাহ মাফের জন্য দোয়া করুন। রসূল সা. তার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করলেন। পরবর্তীকালে যখন ইয়ামানে ইসলাম পরিত্যাগের হিড়িক পড়ে, তখন এই যুবক তার পুরো গোত্রকে ইসলামের ওপর সামাল দিয়ে রাখে।
রসূল সা. এই দলকেও উপহার স্বরূপ প্রত্যাবর্তনের পথখরচ দেন।
২৪. বনু সাদ হুযাইমের(কুযায়া) প্রতিনিধি দল
এই গোত্রের কয়েক ব্যক্তি একটি প্রতিনিধি দলের আকারে রসূল সা. কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। রসূল সা।।
এর নির্দেশে হযরত বিলাল রা. এই দলকে পথখরচ হিসেবে কিছু রুপো উপহার দেন। তাদের ফিরে যাওয়ার পর সমগ্র গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে।
২৫. বাহরা গোত্রের প্রতিনিধি দলের ইসলাম গ্রহণ
এটাও ইয়ামান অঞ্চলের একটা বিশেষ গোত্র। তেরো ব্যক্তির একটা দল মদিনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে। কয়েকদিন অবস্থান করে ইসলামের বিধান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের পর তারা ফিরে যায়। তাঁদেরকেও রীতি মোতাবেক পথখরচ দেয়া হয়।
২৬. যী মাররা গোত্রের প্রতিনিধি দল
সরদার হারেস ইবনে আওফ এর নেতৃত্বে এই গোত্রের ১৩ জন মদিনায় পৌঁছে। তারা নিজেদের পরিচয় দান প্রসঙ্গে রসূল সা. কে জানান আমরা লুয়াই বিন গালেবের বংশধর এবং আপনার সাথে আমাদের বংশীয় সম্পর্ক রয়েছে। রসূল সা।। তাদের কাছে তাদের এলাকা সম্পর্কে জানতে চান। তারা সেখানকার দুর্ভিক্ষের এক করুন চিত্র তুলে ধরেও তাঁর দোয়া চায়। রসূল সা. তৎক্ষণাৎ দোয়া করেন। গোত্রে ফিরে গিয়ে তারা জানতে পারে যে, রসূল সা. যেদিন দোয়া করেছিলেন।, ঠিক সেই দিনই বৃষ্টি হয়েছিলো, এবং জমীন শস্যশ্যামল হয়ে উঠলো। ইসলামের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য তারা কয়েকদিন মদিনায় থাকেন এবং তারপর বিদায় হন। তাদেরকে পথখরচ দেয়া হয়।
২৭. খাওলান গোত্রের প্রতিনিধি দল
দশ ব্যক্তির সমন্বয়ে এই প্রতিনিধি দলটি আগেই ঈমান এনে পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে রসূল সা. এর দরবারে উপস্থিত হয়। জাহেলিয়াতের যুগে তারা ‘আম্মে উনস’ নামক দেবতার পূজো করতো। তারা জানায়, এখন শুধু প্রবীণ লোকেরা ঐ দেবতার পূজো করে। তারা গিয়েই ঐ দেবমূর্তি ভেঙ্গে ফেলবে। অতীতে এই দেবতার নামে কত বড় বড় কুরবানী দেয়া হতো এবং কী কী অনুষ্ঠান করা হতো, তাও তারা জানায়। অবস্থাকালে তারা ইসলামী জীবন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে। বিদায়কালে তাদেরকে পথখরচ দেয়া হয়।
২৮. মোহারেব গোত্রের প্রতিনিধি দল
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে এই গোত্রটি অত্যন্ত বদমেজাজী ও অসচ্চরিত্রের ছিল। প্রাথমিক যুগে যখন রসূল সা. গোত্রে গোত্রে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দিতেন, তখন এই গোত্রের কাছেও দাওয়াত পৌঁছান। কিন্তু তারা অত্যন্ত অশোভন আচরণ করে। দশ ব্যক্তির সমন্বিত একটি দল তওবা করে রসূল সা. এর দরবারে হাজির হয়। এক সমাবেশে একবার রসূল সা. এক ব্যক্তিকে দেখে চিনতে পেরে তার দিকে অভিনিবেশ সহকারে তাকালেন। লোকটি বুঝতে পারলো এবং নিজে উদ্যোগী হয়ে হয়ে বললো, ‘হে রসূল, আপনি বোধহয় আমাকে চিনে ফেলেছেন। উক্কায বাজারে আপনি একবার আমার সাথে দেখা করেছিলেন। আমি তখন আপনার সাথে খুবই অন্যায় আচরণ করেছিলাম এবং আপনার দাওয়াত খুবই অশোভন পন্থায় প্রত্যাখান করেছিলাম। হে রসুলুল্লাহ! আমার সাথীদের মধ্যে কেউ আমার চেয়ে আপনার কট্টর দুশমন ছিলনা। কিন্তু আল্লাহর শোকর যে তিনি আমাকে ঈমান ও আনুগত্যের তৌফিক দিয়েছেন।’ অতপর সে রসূল সা. কে তার পূর্ববর্তী জীবনের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার অনুরোধ জানায়। বরসূল সা. তাকে বললেন ‘ইসলাম গ্রহণের ফলে কুফরি অবস্থায় কৃত যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’
২৯. গাসসান গোত্রের প্রতিনিধি দল
গাসসান যদিও বংশগতভাবে আরব গোত্র ছিল। কিন্তু খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করার কারণে রোম সম্রাটের পক্ষ থেকে আরব অঞ্চলের উপর শাসন চালাতো। ১০ম হিজরীতে এই গোত্রের তিন ব্যক্তি মদিনায় এসে রসূল সা. হাতে ইসলাম গ্রহণ করে। তারা জানায় আমাদের গোত্রের লোকেরা বর্তমানে যে পদমর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে, তা পরিত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করবেনা। রসূল সা. তাদেরকে পথ খরচ দিয়ে বিদায় করলেন। তারা গিয়ে আবার দাওয়াত দিলো। কিন্তু তাও বিফলে গেলো। তিনজনই পরিস্থিতির চাপে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটা গোপন রাখলেন। এদের একজন ইয়ারমুক যুদ্ধের সময় হযরত আবু উবাইদার সাথে সাক্ষাত করেন এবং ইসলামের উপর নিজের অবিচল আস্থার কথা ব্যক্ত করেন। অন্য দু’জন তার আগেই মারা গিয়েছিলেন।
৩০. সালামান গোত্রের প্রতিনিধি দল
হাবীব ইবনে ওমর সহ এ গোত্রের সাত ব্যক্তি সমন্বিত প্রতিনিধি দল মদিনায় আগমন করে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রসূল সা. বলেন, সময়মত নামায পড়া সর্বোত্তম সৎ কাজ। তারাও দুর্ভিক্ষাবস্থার বর্ণনা দিয়ে দোয়া চায়। রসূল সা. দোয়া করেন। পরে জানা যায় যে, তাদের অঞ্চলে ঐ দিনই বৃষ্টি হয়েছিলো।
৩১. বনী ঈস গোত্রের প্রতিনিধি দল
এরাও ছিল ইয়ামান অঞ্চলের লোক। তাদের গোত্রও এসেছিল দশম হিজরীতে। তারা প্রশ্ন করলোঃ ‘আমরা ইসলাম প্রচারকদের কাছ থেকে শুনেছি, যে হিজরত করেনা তার ইসলাম কবুল হয়না। আমাদের অবস্থা এই যে গৃহপালিত পশু আমাদের জীবিকার একমাত্র উৎস। ওগুলো সাথে নিয়ে হিজরত করা কঠিন। তাই হিজরত যদি করতেই হয় তবে আমরা সেগুলো বিক্রি করে চলে আসি’। ঈমানী জযবা ও প্রেরণা দেখুন যে, একটু ইশারা করলেই নিজেদের জন্মভূমি ও সহায় সম্পদ ছেড়ে চলে আসতে প্রস্তুত। রসূল সা. বললেন, যেখানে থাকো, আল্লাহকে ভয় করে চলতে থাকো। প্রাথমিক যুগে যখন ইসলামের কেন্দ্রকে শক্তিশালী ও সারা দেশে দাওয়াতের কাজ করার জন্য লোক তৈরির প্রয়োজন ছিল, তখন হিজরত করে কেন্দ্রে চলে আসা ফরয করা হয়েছিলো। সে স্তর পার হয়ে গেছে। এখন আন্দোলনের শক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে থাকুক এবং নিজ নিজ এলাকায় দাওয়াতের বিস্তৃতি ঘটুক – এটা কাম্য বিধায় হিজরত এখন আর জরুরী নেই। এই দ্বিতীয় যুগটার সাথেই এই নির্দেশ যুক্ত যে, ‘বিজয়ের পর আর হিজরতের আবশ্যকতা নেই’।
৩২. গামেদ গোত্রের প্রতিনিধি দল
দশম হিজরীতে গামেদ গোত্রের দশ ব্যক্তি সম্বলিত প্রতিনিধি দল মদিনায় আসে। তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করে। তাদেরকে কোরআন শেখানোর জন্য রসূল সা. উবাই ইবনে কা’বকে নির্দেশ দেন। তারপর তাদেরকে পথখরচ দিয়ে বিদায় দেন।
৩৩. বনুল মুনতাফিক গোত্রের প্রতিনিধি দল
এই গোত্র থেকে নাহীক বিন আসেম ও লাকিত বিন আমের নামক প্রতিনিধিদ্বয় মদিনায় আগমন করে। তারা যখন মসজিদে নববীতে আসেন তখন রসূল সা. খুতবা দিচ্ছিলেন। খুতবা শেষ হলে লাকীত দাঁড়িয়ে কেয়ামত ও বেহেশত দোযখ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করে। রসূল সা. তার বিশদ জবাব দেন। তারপর নবীগণ ও পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে কিছু প্রশ্নও সে করে। গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞান রসূল সা. রাখেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে সরাসরি বলেন, অদৃশ্য জ্ঞান শুধু আল্লাহই রাখেন।
৩৪. আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দল
আব্দুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের কথা আগেই উল্লেখ করেছি, যারা ৫ম হিজরীতে এসেছিল। এই গোত্রের দ্বিতীয় প্রতিনিধি দল মদিনায় এসেছিল ১০ম হিজরীতে। এ দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪০ জন।
৩৫. তারেক বিন আবদুল্লাহ ও তার সাথী
তারেক বিন আবদুল্লাহ ইতিপূর্বে একবার আলমাজায বাজারে রসূল সা. কে ইসলামের দাওয়াত দিতে দেখেছিলেন। তখন তাঁর পিছে পিছে তাঁর আপন চাচা আবু লাহাব ছুটছিল আর লোকদের বলছিল “তোমরা ওর কথা শুনোনা, ও মিথ্যাবাদী” (নাউজুবিল্লাহ)। এই তারেক বিন আবদুল্লাহ পরবর্তীকালে রাবযা থেকে কয়েকজন সাথী নিয়ে খেজুর কিনতে মদিনায় এলো। তারেকের অবস্থান স্থলের কাছ দিয়ে রসূল সা।। যাচ্ছিলেন। তিনি তারেকের পরিচয় ও আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। অতঃপর খেজুরের বিনিময়ে তার কাছ থেকে একটা উট কিনে নিলেন। ওয়াদা করে এলেন যে উটের মূল্য বাবদ খেজুর এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি। পরে তারেক ও তার সাথীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো যে, না জেনে শুনে বাকীতে উট দিয়ে দিলাম। দাম পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। তারেকের কাফেলার সহযাত্রী জনৈকা সম্ভ্রান্ত মহিলা বললেন ‘এই ব্যক্তির উজ্জ্বল চেহারা আমি দেখেছি। সে কখনো ধোঁকাবাজ হতে পারে না। সে যদি উটের দাম না দেয় তবে আমি উটের দাম দিয়ে দেব’। কিছুক্ষন পরই এক ব্যক্তি খেজুর নিয়ে এলো। সে উটের দাম বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ খেজুর আলাদা এবং উপহার স্বরূপ আরো কিছু খেজুর আলাদাভাবে দিলো। এভাবে রসূল সা. কাফেলার মন জয় করে ফেললেন। পড়ে তারা যখন শহরে এলো, তখন রসূল সা. মসজিদে খুতবা দিচ্ছিলেন ও সদকার উপদেশ দিচ্ছিলেন। এভাবে তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার পথ সুগম হয়ে গেল।
৩৬. বনু যুবায়েদ গোত্রের প্রতিনিধি আমর বিন মাদীকারাব
বনু যুবায়েদ গোত্র যখন ইসলাম সংক্রান্ত প্রচারণা শুনতে পেল, তখন তারা তাদের সরদার আমর বিন মাদীকারাবের কাছে গিয়ে বললঃ ‘ আমরা শুনতে পাচ্ছি যে, হেজাযে মুহম্মদ সা. নামে একজন নবী হয়ে এসেছে। আপনি গিয়ে একটু খোঁজ নিন। দেখুন খবরটা সত্য নাকি মিথ্যে। সে যদি আপনার মতে যথার্থ নবী হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সবাই তার উপর ঈমান আনবো’। আমর বিন মাদীকারাব এল এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। তবে রসূল সা. এর ইন্তেকালের পর সে মুরতাদ হয়ে যায়।
৩৭. হিময়ার রাজবংশের দূত
হিময়ার ছিল একটা রাজ পরিবার। তার পক্ষ থেকে জনৈক দূত একটা চিঠি নিয়ে এল। এই চিঠিতে হারস বিন আবদ কিলাল, নঈম বিন আবন কিলাল, নোমান যুরুয়াইন, মায়াফির ও হামদানের ইসলাম গ্রহণের খবর লেখা ছিল। রসূল সা. এই চিঠির বিস্তারিত জবাব লিখে একটা চিঠি হিমিয়ারের রাজ পরিবারের নামে পাঠলেন। এতে তিনি ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও বিধান সমূহ লিখে দিলেন। মুসলমানদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করা, অমুসলিমদের থেকে জিযিয়া কর আদায় করার নির্দেশ লিপিবদ্ধ করেন। তাছাড়া জনগণের ধর্মীয় স্বাধীনতার সমর্থন করে লিখলেন, যারা ইহুদী বা খৃষ্টান থাকতে চায় তাদের ধর্ম বল প্রয়োগে পাল্টানো যাবেনা। চিঠিতে এ কথাও লিখলেন যে, ‘যুরয়া যীন ইয়াযানের নিকট আমাদের প্রতিনিধি মুয়ায বিন জাবাল, আবদুল্লাহ বিন যায়েদ, মালেক বিন উবাদা, উকবা বিন নামর, মালেক বিন মুররা ও আরো কিছু লোক পাঠানো হচ্ছে। এই দলের নেতা মুয়ায বিন জাবাল। এই দল আমার নির্দেশ পৌছাবে এবং যাকাত ও জিযিয়া আদায় করে নিয়ে আসবে।
৩৮. নিখা গোত্রের প্রতিনিধি দল
নিখাও ইয়ামানেরই একটা গোত্র। অধিকাংশ বর্ণনা মোতাবেক এটা সর্বশেষ প্রতিনিধি দল, যা একাদশ হিজরীর মুহররম মাসে মদিনায় আসে। এই দলের সদদ্য সংখ্যা ছিল দুইশো। আসলে এরা সবাই হযরত মুয়ায ইবনে জাবালের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। ইসলাম গ্রহণ করার পর রসূল সা. এর সাথে সাক্ষাতের দুর্বার আকাংখার কারণে তারা মদিনায় আসে। এখানে এসে তারা রসূল সা।। কাছে তাদের ইসলাম গ্রহণের রিপোর্ট দেয়। দলের জনৈক সদস্য নিজের স্বপ্নের তাবীর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে এবং সংক্ষিপ্ত অবস্থানের পর ফিরে যায়।
উল্লেখিত প্রতিনিধি দল গুলো এমন ধারাবাহিক ভাবে এবং এতো বিপুল সংখ্যায় আসতে থাকে যে, তা থেকে সূরা নাসরের “ আল্লাহর দ্বীনে লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করছে” এই আয়াতাংশের প্রকৃত মর্মার্থ স্পষ্ট হয়ে যায়। আসল ব্যাপার এই যে, মানুষ মাত্রই ইসলামের প্রতি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফুর্ত ঝোঁক অনুভব করে থাকে। তদুপরি রসূল সা. কোরআনের অতুলনীয় ও অকাট্য যুক্তি ও মনমগজ দখল কারী বাচন ভঙ্গীর মাধ্যমে ইসলামকে তুলে ধরেছিলেন। তার পাশাপাশি তিনি নিজের পবিত্র জীবন ও বাস্তব চরিত্র দ্বারা ইসলামের সত্যতার এমন পূর্ণাংগ রূপ পেশ করেছিলেন যে, মানুষ তাতে দীক্ষিত ও প্রভাবিত না হয়েই পারেনি। সাধারণ মানুষের সামনে ইসলাম গ্রহণের পথে একটাই বাধাই অবশিষ্ট ছিল। সেটা হল সাবেক জাহেলী নেতৃত্ব। এই বাঁধা অপসারিত হওয়ার পর যখন সুনিশ্চিত ভাবে জানা গেল যে, মদিনার ইসলামী শক্তি একটা অজেয় শক্তি এবং তা দ্বারা মানবজাতির কোন অকল্যান সংঘটিত হবার ভয় নেই, বরং প্রতিনিয়ত নিরেট কল্যানই সাধিত হচ্ছে, তখন সত্য ও ন্যায়ের জন্য তাদের বক্ষ উন্মুক্ত হয়ে গেল। তারা নিজেদের ভেতর থেকেই সত্যের এই আলোয় অবগাহনের তীব্র পিপাসা অনুভব করলো। আর এই পিপাসায় অস্থির হয়েই মদিনার দিকে ছুটলো এবং সেখানে তারা আপন পিপাসা নিবৃত করলো।
এভাবেই চারদিকে আলোর বন্যা ছড়িয়ে পড়লো এবং অন্ধকার দূর হয়ে গেল।