হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহন
সহিংসতার এই অধ্যায়ের একটি কাহিনী সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ও গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হল, হযরত ওমরের ক্রোধোন্মত্ততার কাহিনী। রসূল (সাঃ) যখন নবুয়ত লাভ করেন, তখন হযরত ওমরের (রা) বয়স ছিল সাতাশ বছর। ইসলাম খুবই দ্রুত গতিতে তাঁর পরিবারে ছড়িয়ে পরে। তাঁর ভগ্নিপতি সাঈদ প্রথমেই ইসলাম গ্রহন করেন। তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর বোন ফাতেমাও মুসলমান হয়ে যান। ওমর (রা) এর পরিবারে আরো এক প্রভাবশালি ব্যক্তি নঈম বিন আবদুল্লাহও ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। প্রথম প্রথম তিনি জানতেই পারেননি যে, তাঁর পরিবারে এইভাবে ইসলামের বিস্তার ঘটছে। যখনই জানতে পারলেন, ক্রোধে অধীর এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। তাঁর পরিবারের এক দাসী লুবাইনাকে ইসলাম গ্রহন করার কারনে তিনি পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। বিশ্রাম নিয়ে নতুন উদ্যোগে আবার পেটাতেন।
শেষ পর্যন্ত একদিন সবচেয়ে ভয়ংকর সিদ্ধান্তটাই নিয়ে ফেললেন। সেটি হলো, এই আন্দোলনের মূল আহ্বায়ককেই খতম করে ফেলতে হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এই সময় আবু জাহল রসুল (সাঃ) কে যে হত্যা করতে পারবে তাকে দু’শো উট পুরষ্কার দেয়ার কথা ঘোষনা করে রেখেছিল এবং সেই পুরষ্কার পাওয়াই ছিল এই সিদ্ধান্তের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু হযরত ওমরের (রা) মেজাজের সাথে এই ধরনের লোভের শিকার হওয়াটা বেমানান। মনে হয়, তিনি এ কাজটাকে একটা পৈত্রিক ধর্মের সেবা মনে করেই করতে চেয়েছিলেন। যাই হোক, তিনি তলোয়ার নিয়ে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে নঈম বিন আবদুল্লাহর সাথে সাক্ষাত হওয়ায় বাধা পেলেন। নঈম বললেন, ‘আগে নিজের বোন ভগ্নিপতির খোঁজ নাও, তারপর আর যেখানে যেতে চাও যেও।’ ওমর রাঃ তৎক্ষণাৎ ফিরলেন এবং বোনের বাড়ী অভিমুখে চললেন। সেখানে যখন পৌঁছলেন, তখন বোন ফাতেমা কোরআন পড়ছিলেন। পায়ের শব্দ কানে আসা মাত্রই চুপ করে গেলেন এবং কোরআনের পাতা গুলো লুকিয়ে ফেললেন। হযরত ওমর (রাঃ) ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি পড়ছিলে? বোন নিরুত্তর রইলেন। ওমর (রাঃ) বললেন আমি জেনে ফেলেছি, তোমরা উভয়ই ধর্মত্যাগী হয়েছ। তবে দেখাচ্ছি মজা। এই বলে ভগ্নিপতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বোন স্বামীকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলে তাকেও পিটালেন। বোনের দেহ রক্তাক্ত হয়ে গেল। কিন্তু অশ্রুভরা চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দৃপ্ত কন্ঠে ফাতেমা বললেন,
‘ওমর! যা ইচ্ছে করতে পার। কিন্তু আমাদের পক্ষে ইসলাম ত্যাগ করা সম্ভব নয়।’
ক্ষতবিক্ষত দেহ, রক্তাক্ত পোশাক পরিচ্ছদ, চোখ ভরা অশ্রু ও আবেগভরা মন নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। শুধু নারী নয়-সহোদরা বোন। আর তার মুখে এমন তেজোদীপ্ত কথা! ভেবে দেখুন, অবলা নারীর মধ্যেও ইসলাম কেমন নতুন প্রেরনা সঞ্চারিত করেছিল। এহেন মর্মস্পর্শী দৃশ্যের সামনে ওমরের দুর্ধর্ষ শক্তিও হার মানলো। তার ইস্পাত কঠিন সংকল্পের বজ্র আঁটুনি মাঝপথেই ফস্কা গিরোয় পরিনত হলো। বললেন, ‘আচ্ছা তোমরা যা পড়ছিলে, আমাকে একটু শোনাও তো।’ ফাতেমা গিয়ে কোরআনের লুকিয়ে রাখা পাতাগুলো নিয়ে এলেন। পড়তে পড়তে যখন এ কথাটা সামনে এলো, “************” অমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠলেন ‘আশহাদু আল-লাইলাহা ইলাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।’ ঈমান আনার পর ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র হযরত আরকামের বাড়ী অভিমুখে রওনা হলেন। সেখানে গিয়ে রসূল সাঃ এর হাতে বায়য়াত করলেন। এই ঘটনায় সেখানে উপস্থিত মুসলমানগণ আনন্দের আতিশয্যে এমন জোরে “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি দিলেন যে, মক্কার গোটা পরিবেশ গুঞ্জরিত হয়ে উঠলো। ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহীরা সেখান থেকে বেরুলেন এবং সমগ্র মক্কা নগরীতে ছড়িয়ে পড়লেন। তারা অনুভব করলেন যে তাদের শক্তি বেড়ে গেছে। হযরত ওমরের (রাঃ) ঈমান আনার অব্যবহিত পর থেকেই কাবা শরীফে সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে জামায়াতে নামাজ পড়া শুরু হলো।
হযরত ওমর (রাঃ) মক্কার যুবকদের মধ্যে স্বীয় মেধা ও আবেগ উদ্দীপনার জন্য বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁর আচার ব্যবহার ছিল আন্তরিকতা ও নিষ্ঠায় পরিপূর্ণ। জাহেলিয়াতের যুগে তিনি ইসলামের সাথে যে শত্রুতা পোষণ করতেন, তাও কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা তাড়িত হয়ে নয় বরং ওটাকে ন্যায়সঙ্গত মনে করে আন্তরিকতার সাথেই করতেন। তারপর যখন প্রকৃত সত্য তাঁর কাছে উদঘাটিত হলো এবং বিবেকের উপর থেকে পর্দা সরে গেলো, তখন পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে ইসলামের পতাকা উঁচু করে তুলে ধরলেন। বিরোধিতা করার সময় তার ধরন যদিও অতিমাত্রায় উগ্র ও উত্তেজনাপূর্ণ ছিল, কিন্তু তাঁর প্রখর মেধা ও নির্মল বিবেক সবসময়ই একটু একটু করে সত্যের আলো গ্রহন করেছে। মক্কার পরিবেশে সংঘটিত প্রতিটি ঘটনা তাঁর অন্তরাত্মাকে প্রভাবিত, আলোড়িত ও ইসলাম গ্রহনের জন্য প্রস্তুত করতে থাকে। একদিকে ইসলামের দাওয়াতের খবরাখবর প্রতিনিয়ত তাঁর কর্ণগোচর হতে থাকে। অপরদিকে এর বিরোধীদের হীন ও কদর্য মানসিকতাও তাঁর সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। তারপর একদিকে তিনি রসূল (সাঃ) ও তাঁর সাথীদের নির্মল ও সৎ চরিত্র এবং অন্যদিকে ইসলাম বিরোধীদের চরিত্রের কলুষিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলো প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। প্রতিনিয়ত এই তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ মক্কার সচেতন ও জাগ্রত বিবেকের অধিকারী এই যুবককে ক্রমাগত প্রভাবিত ও আলোড়িত করতে থাকে। তবে পরিস্থিতির এই দুটো পরস্পর বিরোধী সাধারন দৃশ্য ছাড়াও কয়েকটা বিশেষ ঘটনাও তাঁর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
উদাহরন স্বরূপ, উম্মে আবদুল্লাহ বিনতে আবি হাশমা আবিসিনিয়ায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এসময় একদিন হযরত ওমর তাদের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘উম্মে আবদুল্লাহ, মনে হচ্ছে মক্কা ছেড়ে কোথাও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন’। উম্মে আবদুল্লাহ বললেন, ‘হা, তাই যাচ্ছি। তোমরা আমাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছ এবং আমাদের উপর অনেক নির্যাতন চালিয়েছ। এখন আল্লাহ আমাদেরকে বাঁচার জন্য একটা পথ খুলে দিয়েছেন’। ওমর বললেনঃ ‘আল্লাহ আপনাদের সাথী হোন।’ উম্মে আবদুল্লাহ বলেন, ঐ সময় ওমর কে যেরূপ দুঃখভারাক্রান্ত দেখাচ্ছিল, তেমন আমি আর কখনো দেখিনি। আমাদের দেশান্তরী হওয়ার প্রস্তুতি দেখে তিনি গভীর মর্মবেদনা অনুভব করেন। উম্মে আবদুল্লাহ তাঁর স্বামী আমের বিন রবীয়াকে যখন ওমরের এই মর্মবেদনার কথা জানালেন, তখন আমের জিজ্ঞেস করলেন, ওমরের এই ভাবান্তর দেখে কি তুমি তাঁর ইসলাম গ্রহনের আশা পোষণ করছ? উম্মে আবদুল্লাহ বললেন, হাঁ। আমের বললেন, তুমি যাকে দেখেছ, সে যখন ইসলাম গ্রহন করবে, তখন খাত্তাবের গাধাও ইসলাম গ্রহন করবে (খাত্তাব হযরত ওমরের পিতার নাম)। উম্মে আব্দুল্লাহ বলেন, ইসলামের ব্যাপারে ওমরের নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার কারনে এ ধরনের হতাশা জন্মে গিয়েছিল। (সিরাত ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড)
কিন্তু এই ঘটনা যে হযরত ওমরের বিবেকে এক জোরালো কষাঘাত হেনে থাকবেনা, তা কে বলতে পারে? অনুরূপভাবে অন্য একটা বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, রসূল (সাঃ) এর কোরআন পাঠ শুনে তাঁর মন প্রভাবিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে তাঁর নিজের বক্তব্য নিম্নরুপঃ
‘আমি ইসলাম থেকে অনেক দূরে ছিলাম। জাহেলিয়াতের যুগে মদে আসক্ত ছিলাম এবং খুব বেশী পরিমাণে মদ খেতাম। হাযওয়ারাতে [তৎকালে এটা মক্কার একটা বাজার ছিল। বর্তমানে এই যমিনটুকু মসজিদুল হারেমের অন্তর্ভুক্ত] আমাদের মদের আসর বসতো এবং সেখানে কুরায়শী বন্ধুরা জমায়েত হতো। এক রাতে আমি নিজের সতীর্থদের আকর্ষনে ঐ আসরে উপস্থিত হই। সতীর্থদের সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজি করি। কিন্তু কাউকে পাইনি। পরে এক মদ বিক্রেতার কথা মনে পড়লো এবং ভাবলাম ওখানে গিয়ে মদ খাবো। কিন্তু তাকেও পেলাম না। তারপর ভাবলাম কা’বা শরীফে চলে যাই এবং ওখানে ষাট সত্তর বার তাওয়াফ করে নেই। সেখানে গিয়ে দেখলাম, রসূল সাঃ নামায পড়ছেন। তিনি রুকনে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানীর মাঝখানে (বাইতুল মাকদাস অভিমূখে) দাঁড়িয়েছিলেন। সহসা মনে ইচ্ছা জাগলো, এই লোকটা কি পড়ে আজ একটু শোনাই যাকনা। কা’বার গেলাফের ভেতরে ঢুকে আস্তে আস্তে একেবারে কাছে গিয়ে শুনতে লাগলাম। আমার ও রসূল (সাঃ) এর মাঝে কেবল কা’বার গিলাফ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। আমি যখন কোরআন শুনলাম, তখন আমার মনটা গলে গেলো। চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। ঠিক সেই মূহুর্তেই আমার অন্তরে ইসলাম প্রবেশ করলো। [সীরাত ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, ৩৬৮-৩৬৯ পৃ]
এই বর্ননার অবশিষ্টাংশে বলা হয়েছে, ওমর রাঃ তখনই রসূল (সাঃ) এর সাথে চলে যান এবং ইসলাম গ্রহন করেন। তবে প্রকৃত পক্ষে তাঁর ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে পূর্বোক্ত বর্ণনাই সঠিক। তাঁর বোনের ঈমান, ধৈর্য ও দৃঢ়তা দেখেই তাঁর মনমগজ ইসলাম গ্রহণের দিকে চূড়ান্তভাবে ধাবিত হয়। ওমরের (রাঃ) নিজের বর্ননার এই অংশটা খুবই গুরুত্ববহ যে তিনি রসূল (সাঃ) এর কাছ থেকে কোরআন শ্রবণ করতে গিয়েছেন। এবং নিজ কানে শোনা কোরআনের আয়াত তাঁর অন্তরে ঈমানের বীজ বপন করেছে। এক নাগাড়ে বছরের পর বছর ধরে চলা থাকা দ্বন্দ্ব সংঘাতের প্রেক্ষাপটে এরূপ ঘটনা ঘটা খুবই স্বাভাবিক। ওমরের মত ব্যক্তিত্ব ইসলামের দাওয়াত নিজ কানে না শুনে সিদ্ধান্ত নেবেন এটা হয়ইবা কেমন করে?
কোরআনের বিরোধিতায় লিপ্ত আর অনেকে, এমনকি বড় বড় নেতারাও পর্যন্ত কৌতুহলের বশে গোপনে ছুটে আসতো আকাশ থেকে নেমে আসা এই সুমধুর তান শুনতে। অথচ প্রকাশ্য মজলিসে তারাই আবার বলতো, ‘আমাদের কান বধির’। একবার গভীর রাতে রসূল সাঃ যখন নিজ ঘরে বসে কোরআন পড়ছিলেন, তখন আবু সুফিয়ান, আবু জাহল ও অখনাস বিন শুরাইক লুকিয়ে লুকিয়ে রসূল সাঃ এর ঘরের আশে পাশে সমবেত হয়ে শুনছিল। পরে বাড়ী ফেরার সময় ঘটনাক্রমে তারা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। তখন একে অপরকে এই বলে ভর্ৎসনা করতে থাকে যে, এ রকম করা উচিৎ নয়। নচেত স্বল্পবুদ্ধির সাধারণ লোকেরা যদি দেখে ফেলে, তাহলে তাদের মনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এ কথা বলে তারা চলে গেল। পরেরদিন তারা আবারো আসলো এবং আবারো আগের মতন ভর্ৎসনা ও উপদেশ বিনিময় হলো। তৃতীয় রাতে আবারো এই ঘটনা ঘটলো এবং শেষ পর্যন্ত খুবই জোরদার প্রতিজ্ঞা করা হলো যে, ভবিষ্যতে এমন কাজ আর কিছুতেই হবেনা। তবে প্রাসঙ্গিক ভাবে পরস্পরের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ হলো যে, মুহাম্মাদ সাঃ এর কাছ থেকে শোনা বাণী সম্পর্কে কার কি মত? প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বললো। সবার শেষে আবু জাহল উত্তেজিত কন্ঠে বললো, বনু আবদ মানাফের সাথে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সবসময়ই ছিল। তারা আতিথেয়তা করলে আমরাও করতাম, তারা রক্তপণ দিলে আমরাও দিতাম, তারা দানশীলতা করলে আমরাও করতাম। এভাবে আমরা তাদের সমকক্ষ হয়ে গিয়েছিলাম। কোন ব্যাপারেই পেছনে পড়িনি। হঠাৎ এখন তারা বলতে আরম্ভ করেছে যে, তাদের গোত্রে নবী এসেছে। এটা আমরা কেমন করে মেনে নেই? এই ক্ষেত্রে তো আমরা তাদের সমকক্ষতা দাবি করতে পারছিনা। কাজেই আল্লাহর কসম, আমরা তাঁর উপর ঈমানও আনতে পারিনা, তাঁকে সমর্থনও করতে পারিনা। [সীরাত ইবনে হিশাম,প্রথম খন্ড পৃ-৩৩৭-৩৩৮]
ঐ সময় ইসলাম সম্পর্কে সর্ব সাধারণের মনে ব্যাপক কৌতুহল ও অনুসন্ধিৎসা জেগেছিল এবং যা হযরত ওমরকেও কখনো কখনো রসূল সাঃ এর কাছে নিজ কানে আল্লাহর বাণী শোনার জন্য টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তা অনুধাবন করার জন্যই এই ঘটনাটা প্রাসঙ্গিক ভাবে উল্লেখ করলাম।
আর এক ধাপ অগ্রগতি
মোটকথা, হযরত ওমরের রাঃ ইসলাম গ্রহণ ছিল একটা বিরাট ঘটনা। এ ঘটনার পেছনে অনেকগুলো কার্যকারণ সক্রিয় ছিল। এ ঘটনার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার আরো একটা কারন হলো, ইসলাম বিরোধী একতরফা সহিংসতা যখন চরম আকার ধারন করেছে, ঠিক তখনই এই সত্যসন্ধানি মানুষটি এগিয়ে আসেন। বিরোধী শক্তি জনগণকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্যই নির্যাতন চালাচ্ছিল। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত এই নির্যাতন জনগনের মনকে গলিয়ে দিচ্ছিল এবং নির্যাতনের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলেছিল। ইসলাম যে সত্য তার একটা অন্যতম অকাট্য প্রমান এটাই যে, সহিংস ও আগ্রাসী প্রতিরোধ যতই বেড়েছে, ততই উৎকৃষ্টতম মনমগজের অধিকারী লোকেরা ইসলামে দীক্ষিত হতে থেকেছে। আবিসিনিয়ায় হিজরতের পরের সময়টায় মক্কার মূল্যবান রত্নগুলো ইসলামে জড়ো হতে থাকে।
একদিকে ওমরের রাঃ মত ব্যক্তিত্ব ইসলাম গ্রহন করবে, আর নতুন কোন আলোড়ন সৃষ্টি হবে না, এটাই বা কেমন করে সম্ভব? তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, একবার গোটা সমাজকে চ্যালেঞ্জ করবেনই। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর তখনও বালক মাত্র। তিনি বলেন, ‘আমার পিতা ওমর রাঃ ঈমান আনার পর খোঁজ নিলেন যে কোরায়েশ গোত্রের কোন ব্যক্তি কথা ছড়াবার উস্তাদ? তিনি জামীল বিন মুয়াম্মার জামহী নামক এক ব্যক্তির সন্ধান পেলেন। তিনি খুব ভোরে তার কাছে চলে গেলেন। ওখানে গিয়ে তিনি কি করেন তা দেখার জন্য আমিও তাঁর সাথে গেলাম। তিনি যেয়ে তাকে বললেন, ‘ওহে জামিল, তুমি কি জান, আমি ইসলাম গ্রহন করেছি এবং মুহাম্মাদ সাঃ এর দলে অন্তর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছি’? জামীল একটি কথাও না বলে নিজের চাদরটা ঘাড়ে করে সোজা মসজিদুল হারামের দরজায় দিয়ে পৌছালো। তারপর গগনবিদারী কন্ঠে ঘোষণা করতে শুরু করলো যেঃ ‘ওহে কোরায়েশ জনতা শোনো। খাত্তাবের ছেলে ওমর রাঃ সাবী (ধর্মত্যাগী) হয়ে গেছে।’ হযরত ওমরও তার পিছু পিছু এসে পৌঁছলেন এবং চিৎকার করে বললেনঃ ‘জামীল ভুল বলছে। আমি সাবী নয়, মুসলমান হয়েছি। আমি ঘোষণা করেছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই, এবং মুহাম্মাদ সা. তার বান্দা ও রসূল।’ কোরায়েশরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। এমনকি নিজের বাবার সাথেও তিনি তুমুল লড়াই করলেন। ধস্তাধস্তি করতে করতে সূর্য মাথার ওপর চলে আসলো। এই সময় জনৈক প্রবীণ কোরায়েশ নেতা হাজির হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ব্যাপার কি? অতঃপর পুরো ঘটনা শুনে সে বললো, এই ব্যক্তি নিজের জন্য একটা মত ও পথ বাছাই করে নিয়েছে। এখন তোমরা কী করতে চাও! ভেবে দেখ, বনু আদী (হযরত ওমরের গোত্রের নাম) কি তাদের লোককে এভাবে তোমাদের হাতে অসহায় ছেড়ে দেবে? ওকে ছেড়ে দাও।’ এই সরদারের নাম ছিল আস বিন ওয়ায়েল সাহমী। সে হযরত ওমরকে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নিল। (সীরাত ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, ৩৭০-৩৭১ পৃঃ)
এই সাথে হযরত ওমর নিজের ঈমানী উৎসাহ উদ্দীপনা প্রকাশের আরো একটা পথ খুঁজে পেয়ে গেলেন। তিনি ঈমান আনার পর প্রথম রাতেই চিন্তা করলেন, রাসূল সাঃ এর সবচেয়ে কট্টর ও উগ্র বিরোধী কে? তিনি বুঝলেন, আবু জাহলের চেয়ে কট্টর ও উগ্র বিরোধী আর কেউ নেই। প্রত্যুষে উঠেই আবু জাহলের বাড়ীতে গিয়ে পৌছলেন। দরজার কড়া নাড়তেই আবু জাহল বেরিয়ে এলো। সে স্বাগত জানিয়ে আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইল। ওমর রা. বললেন, আমি আপনাকে জানাতে এসেছি যে, আমি মুহাম্মদ সা. -এর ওপর ঈমান এনেছি এবং তিনি যা বলেন তা সত্য বলে স্বীকার করেছি। আবু জাহল ‘তোর ওপর এবং তোর এই খবরের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত’ এই কথাটা বলেই ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল।
অপর দিকে ওমর রা. ইসলামী আন্দোলনকে এক ধাপ সামনে এগিয়ে দিলেন। মার খেয়েও কা’বার চত্তরে প্রকাশ্যে নামায পড়ার সূচনা করে দিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, ‘আমরা হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের আগে কা’বা শরীফের সামনে প্রকাশ্যে নামায পড়তে পারতামনা। ওমর রাঃ ইসলাম গ্রহণ করলে তিনি কোরায়েশদের সাথে লড়াই করে কা’বায় নামায পড়লেন এবং আমরাও তার সাথে নামায পড়লাম।’
এভাবেই তীব্র সহিংসতার ভেতর দিয়েও শত্রুদের মধ্য থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিবর্গ ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে।
হযরত হামযার ইসলাম গ্রহণ
হযরত হামযার ঘটনাও প্রায় একই ধরনের। মক্কার এ যুবক একাধারে মেধাবী সাহসী ও প্রভাবশালী ছিলেন। রসূল সা. এর চাচাদের মধ্যে আবু তালেবের পর ইনিই একমাত্র চাচা ছিলেন, যিনি দ্বিমত পোষণ করা সত্ত্বেও রসূল সা. কে ভালোবাসতেন। বয়সেও ছিলেন মাত্র দু’তিন বছরের বড়। সমবয়সী হওয়ার কারণে শৈশবে চাচা ভাতিজা গলাগলি ভাব ছিল।
ঘটনা। সাফা পাহাড়ের কাছে আবু জাহল রসূল সা. কে লাঞ্চিত করে এবং অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করে। রসূল সা. ধৈর্য ধারণ করলেন এবং এই লাঞ্চনার কোন প্রতিশোধ নিলেন না। ঘটনাক্রমে জনৈক দাসী এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। হযরত হামযা তখন শিকারে গিয়েছিলেন। ধনুক হাতে করে ফিরে আসতেই দাসীটা তাকে ঘটনাটা শুনালো এবং বললো, ‘হায়, তুমি যদি নিজ চোখে দেখতে পেতে যে তোমার ভাতিজার কী অবস্থা হয়েছিল।’ ঘটনার বিবরণ শুনে হামযার তীব্র আত্ন-সম্ভ্রমবোধ জেগে উঠলো। তিনি সোজা কোরায়েশদের মজলিসে আবু জাহলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আবু জাহলের মাথায় ধনুক দিয়ে আঘাত করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি মুহাম্মাদকে গালি দিয়েছ? যদি দিয়ে থাক তাহলে জেনে রেখ, আমিও তার ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছি এবং সে যা কিছু বলে, আমিও তা বলি। সাহস থাকলে আমার মোকাবিলা করতে এস।’ আবু জাহলের সমর্থনে বনু মাখযুমের এক ব্যক্তি উঠে দাড়ালো। কিন্তু আবু জাহল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘বাদ দাও, আমি হামযার ভাতিজাকে খুব অশ্রাব্য গালি দিয়েছি।’ এরপর হযরত হামযা ইসলামের ওপর অটল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। কোরায়েশরা বুঝতে পারলো যে, রসূলের শক্তি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড)
বয়কট ও আটকাবস্থা
ইসলামের শত্রুরা তাদের সকল ফন্দি ফিকিরের ব্যর্থতা, ইসলামের অগ্রগতির ও বড় বড় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণের দৃশ্য দেখে দিশাহারা হয়ে উঠে। নবুয়তের সপ্তম বছরের মহাররম মাসে মক্কার সব গোত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে বনু হাশেম গোত্রকে বয়কট করার চুক্তি সম্পাদন করলো। চুক্তিতে স্থির করা হলো যে, বনু হাশেম যতক্ষণ মুহাম্মদ সা. কে আমাদের হাতে সমর্পন না করবে এবং তাকে হত্যা করার অধিকার না দেবে, ততক্ষণ কেউ তাদের সাথে কোন আত্নীয়তা রাখবেনা, বিয়ে শাদীর সম্পর্ক পাতাবেনা, লেনদেন ও মেলা মেশা করবেনা এবং কোন খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য তাদের কাছে পৌছাতে দেবেনা। আবু তালেবের সাথে একাধিকবার কথাবার্তার পরও আবু তালেব রসূল সা. কে নিজের অভিভাবকত্ব থেকে বের করতে প্রস্তুত হননি। আর তার কারণে বনু হাশেমও তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারেনি। এই কারণে হতাশ হয়ে তারা ঐ চুক্তি সম্পাদন করে। গোত্রীয় ব্যবস্থায় এ সিদ্ধান্তটা ছিল অত্যন্ত মারাত্মক এবং চূড়ান্ত পদক্ষেপ। সমগ্র বনু হাশেম গোত্র অসহায় অবস্থায় ‘শিয়াবে আবু তালেব’ নামক উপত্যকায় আটক হয়ে গেল। এই আটকাবস্থার মেয়াদ প্রায় তিন বছর দীর্ঘ হয়। এই সময় তাদের যে দুর্দশার মধ্য দিয়ে কাটে তার বিবরণ পড়লে পাষাণও গলে যায়। বনু হাশেমের লোকেরা গাছের পাতা পর্যন্ত চিবিয়ে এবং শুকনো চামড়া সিদ্ধ করে ও আগুনে ভেজে খেতে থাকে। অবস্থা এত দূর গড়ায় যে, বনু হাশেম গোত্রের নিষ্পাপ শিশু যখন ক্ষুধার যন্ত্রনায় কাঁদতো, তখন বহু দূর পর্যন্ত তার মর্মভেদী শব্দ শোনা যেত। কোরায়েশরা এ সব কান্নার শব্দ শুনে আনন্দে আত্নহারা হয়ে যেত। সমগ্র বনু হাশেম গোত্র একমাত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতার কারণে এহেন বন্দীদশায় নিক্ষিপ্ত হলো। বয়কট এমন জোরদার ছিল যে, একবার হযরত খাদীজার ভাতিজা হাকীম বিন হিযাম তার ভৃত্যকে দিয়ে কিছু গম পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন। পথি মধ্যে আবু জাহল তা দেখে গম ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলো। ঠিক এ সময় আবুল বুখতারীও এসে গেল এবং তার মধ্যে একটু মানবিক সহানুভুতি জেগে উঠলো। সে আবু জাহলকে বললো, আরে ছেড়ে দাওনা। এছাড়া হিশাম বিন আমরও লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু গম পাঠাতো।
এই হিশাম বিন আমরই এই নিপীড়নমূলক চুক্তি বাতিলের প্রথম উদ্যোক্তায় পরিণত হলো। সে যুহাইর বিন উমাইয়ার কাছে গেল। তাকে বললো, ‘তুমি কি এতে আনন্দ পাও যে, তুমি খাবে দাবে, কাপড় পরবে, বিয়ে শাদী করবে, আর তোমার মামাদের এমন অবস্থা হবে যে, তারা কেনাবেচাও করতে পারবেনা এবং বিয়ে শাদীও করতে পারবেনা? ব্যাপারটা যদি আবুল হাকাম বিন হিশামের (আবু জাহল) মামা নানাদের হতো এবং তুমি তাকে এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনের আহবান জানাতে, তাহলে সে কখনো সে আহবানে সাড়া দিতনা।’ এ কথা শুনে যুহাইর বললো, ‘আমি কী করবো? আমি তো একা মানুষ। আল্লাহর কসম আমার সাথে যদি আর কেউ থাকতো, তাহলে আমি এই চুক্তি বাতিল করানোর উদ্যোগ নিতাম এবং বাতিল না করিয়ে ছাড়তামনা।’ হিশাম বললো, ‘দ্বিতীয় ব্যক্তি তো তুমি পেয়েই গেছ।’ যুহাইর বললো, ‘সে কে?’ হিশাম বললো, আমি স্বয়ং। এরপর হিশাম গেল মুতয়াম বিন আদীর কাছে এবং একইভাবে তাকে বুঝালো। সেও যুহাইরের ন্যায় জবাব দিল যে, আমি একাকী কী করবো। হিশাম তাকেও বললো, ‘আমি আছি তোমার সাথে।’ মুতয়াম বললো, ‘তাহলে তৃতীয় একজনকে খুজে বের কর।’ হিশাম বললো, তৃতীয় ব্যক্তি তো আমি পেয়েই গেছি। সে বললো, কে সে? হিশাম বললো, ‘যুহাইর বিন আবি উমাইয়া।’ মুতয়াম বললো, এবার চতুর্থ একজন বের করা দরকার। অতপর আবুল বুখতারী ও যামরা বিন আসওয়াদের কাছে পৌছে হিশাম কথা বললো।
এভাবে বয়কট চুক্তি বাতিলের আন্দোলন যখন ভেতরে ভেতরে কার্যকরভাবে অগ্রসর হলো, তখন তারা সবাই একত্রে বসে পরবর্তী কর্মসূচী স্থির করলো। পরিকল্পনা করা হলো যে, হিশামই প্রকাশ্যে কথাটা তুলবে। সে অনুসারে হিশাম কা’বা শরীফের সাতবার তওয়াফ করলো। তারপর জনতার কাছে এসে বললো, ‘ওহে মক্কাবাসী, এটা কি সমীচীন যে, আমরা খাবার খাবো, পোশাক পরবো, আর বনু হাশেম ক্ষুধায় ছটফট করতে থাকবে এবং কোন কিছু কিনতেও পারবেনা?’ তারপর সে নিজের ইচ্ছেটা এভাবে জানিয়ে দিলঃ
‘আল্লাহর কসম, সম্পর্ক ছিন্নকারী এই নিপীড়নমূলক চুক্তি টুকরো টুকরো করে না ফেলে আমি বিশ্রাম নেবনা।’
আবু জাহল চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি কখনো এটা ছিড়তে পারবেনা।’
যাময়া ইবনুল আসওয়াদ আবু জাহলকে জবাব দিল, ‘আল্লাহর কসম, তুমিই সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী। এই চুক্তি যেভাবে লেখা হয়েছে, আমরা তা পছন্দ করিনা।’ আবুল বুখতারীও বলে উঠলো, ‘যাময়া ঠিকই বলেছে। এই চুক্তি আমাদের পছন্দ নয় এবং আমরা তা মানিও না।’ মুতয়ামও সমর্থন করে বললো, ‘তোমরা দু’জনে ঠিকই বলেছ। এর বিপরীত যে বলে সে ভুল বলে।’ এভাবে অধিকাংশ লোক বলতে থাকায় আবু জাহল মুখ কাচুমাচু করে বসে রইল এবং চুক্তি ছিড়ে ফেলা হলো। লোকেরা যখন চুক্তিটাকে কা’বার প্রাচীর থেকে নামালো তখন অবাক হয়ে দেখলো যে, সমগ্র চুক্তিটাকে উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে। কেবল ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা’ কথাটা বাকী আছে। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
দূঃখের বছর
বন্দীদশা কেটে যাওয়ায় রসূল সা. আর একবার সপরিবারে মুক্ত পরিবেশে উপনীত হলেন। কিন্তু এবার তার চেয়েও কঠিন যুগের সূচনা হলো। তখন চলছিল নবুয়তের দশম বছর। এ বছর সর্বপ্রথম যে বিয়োগান্ত ঘটনাটা ঘটলো, তা এই যে, হযরত আলীর পিতা আবু তালেব মারা গেলেন। যে শেষ আশ্রয়টি এ যাবত পরম স্নেহে রসূল সা. কে শত্রুদের কবল থেকে রক্ষা করে আসছিল এবং কোন চাপ ও উস্কানীর কাছে নতি স্বীকার না করে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সকল চক্রান্ত প্রতিহত করে আসছিল, সেই আশ্রয়টি এভাবে হারিয়ে গেল।
এই বছরই রসূল সা. দ্বিতীয় যে আঘাতটা পেলেন তা হলো হযরত খাদীজার রা. ইন্তিকাল। হযরত খাদীজা রা. শুধু রসূলের স্থী-ই ছিলেন না, বরং প্রথম ঈমান আনয়নকারী ভাগ্যবান গোষ্ঠীটির অন্যতম ছিলেন। নবুয়ত লাভের আগেও তিনি তার প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মীতা দেখাতে মোটেই কসুর করেননি। প্রথম ওহি নাযিল হওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি সত্যের পথে রসূলের সা. যথার্থ জীবন সংগিনীর ভূমিকা পালন করে গেছেন। ইসলামী আন্দোলনের সমর্থনে তিনি প্রচুর অর্থও ব্যয় করেছেন। পদে পদে পরামর্শও দিয়েছেন এবং আন্তরিকতা সহকারে সহযোগিতাও করেছেন। এ জন্য তার সম্পর্কে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, তিনি রসূল সা. এর মন্ত্রী ছিলেন। বস্তুত এ বন্তব্য যথার্থ ও সংগত।
একদিকে পরপর এই দুটো আঘাত রসূল সা. কে সইতে হলো। অপরদিকে এই বাহ্যিক সহায় দুটো হারিয়ে যাওয়ার কারণে বিরোধিতা আরো প্রচন্ড আকার ধারণ করলো। এবার বিরোধিতা ও নির্যাতন নিপীড়ন অতীতের সমস্ত রেকর্ড যেন ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা সম্ভবত এই ছিল যে, ইসলাম নিজের হেফাযত নিজেই করুক, নিজের চলার পথ নিজেই তৈরী করুক এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক। দুনিয়াবী সহায়গুলো এভাবে হটিয়ে না দিলে হয়তো সত্যের প্রাণশক্তি পুরোপুরি দৃশ্যমান হতে পারতোনা। এই দুঃখজনক ও দুঃসহ পরিস্থিতির উদ্ভবের কারণেই এ বছরটা দুঃখের বছর নামে আখ্যায়িত হয়।
এখন কোরায়েশরা চরম অসভ্য আচরণ শুরু করে দিল। বখাটে ছেলেদেরকে তার পেছনে লেলিয়ে দিতে লাগলো। তারা হৈ চৈ করতো। রসূল সা. যখন নামায পড়তেন, তখন হাতে তালি দিত। পথে চলার সময় রসূল সা. এর ওপর নোংরা বর্জ্য নিক্ষেপ করা হতো। দরজার সামনে কাঁটা বিছানো হতো। কখনো তাঁর গলায় ফাঁস লাগানী হতো। কখনো তাঁর গায়ে পর্যন্ত হাত দেয়া হতো, প্রকাশ্যে গাল দেয়া হতো। তাঁর মুখের ওপর মাটি নিক্ষেপ করা হতো। এমনকি কোন কোন নরপশু এমন জঘন্যতম বেয়াদবীও পর্যন্ত করেছে যে, তার জ্যোতির্ময় মুখমন্ডলে থুথু নিক্ষেপ করেছে। একবার আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল একটা পাথর নিয়ে রসূল সা. কে খুঁজতে খুঁজতে হারাম শরীফ পর্যন্ত এসেছিল। তার ইচ্ছা ছিল এক আঘাতেই তাঁকে খতম করে দেয়া। রসূল সা. হারাম শরীফে তার সামনেই উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাকে এমনভাবে তার চোখের আড়ালে রেখে দিলেন যে, সে তাঁকে দেখতেই পেলনা। অগত্যা সে হযরত আবু বকরের সামনে ক্রোধ উদগীরণ করে ফিরে এল এবং নিম্নের কবিতা আবৃত্তি করলো “আমরা নিন্দিত ব্যক্তির আনুগত্য প্রত্যাখ্যান করেছি, তার আদেশ অমান্য করেছি এবং তার ধর্মের প্রতি শত্রুতা পোষণ করেছি।” বস্তুত নাম বিকৃত করা এবং খারাপ শব্দ প্রয়োগ করা নৈতিক নীচতা ও অধোপতনের লক্ষণ। শত্রু যখন ইতরামির সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়, তখন এই সব নোংরা অস্ত্র প্রয়োগ করে থাকে।
এসব কথা শুনে রসূল সা. বলতেন, আল্লাহ তাদের নিন্দাবাদ থেকে আমাকে বাঁচিয়েছেন। ওরা মুযাম্মামকে (নিন্দিত ব্যক্তি) গালি দেয়। কিন্ত আমি তো মুহাম্মাদ। কাজেই ওদের গালি আমাকে স্পর্শ করেনা।
অনুরূপভাবে একবার আবু জাহল পাথর দিয়ে আঘাত করে রসূল সা. কে হত্যা করার মতলবে তার কাছে পৌছে যায়। কিন্তু আল্লাহ আবু জাহলকে সহসাই এমন ভীত ও সন্ত্রস্থ করে দেন যে, সে কিছুই করতে পারেনি।
একবার শত্রুরা সদলবলে রসূল সা. এর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রেক্ষাপট ছিল এ রকমঃ ইসলামের শত্রুরা তাদের এক আড্ডায় বসে বলাবলি করছিল যে, ‘এই লোকটার (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি আমরা বড্ড বেশী সহনশীলতা দেখিয়ে এসেছি। এতটা সহনশীলতার কোন নজীর নেই।’ ঘটনাক্রমে ঠিক এ সময়ই রসূল সা. সেখানে এসে পড়েন। শত্রুরা জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি এ সব কথা বলে থাক? রসূল সা. পরিপূর্ণ নৈতিক দৃঢ়তা নিয়ে বললেন, ‘হ্যা, আমিই তো এ সব কথা বলে থাকি।’ ব্যাস, আর যায় কোথায়। চার দিক থেকে আক্রমণ চালানো হলো। আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আ’স বর্ণনা করেন যে, রসূল সা. এর ওপর কোরায়েশদের পক্ষ থেকে এমন বাড়াবাড়ি আর কখনো দেখিনি।
আক্রমণকারীরা কিছুক্ষণ পর থামলে রসূল সাঃ পুণরায় সেই অতি মানবীয় সাহসিকতা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী উচ্চারণ করলেনঃ ‘আমি তোমাদের কাছে এমন বার্তা নিয়ে এসেছি যে, তোমরা যবাই হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ যে যুলুম নির্যাতনের ছুরি তোমরা আমার গলায় চালাচ্ছো, ইতিহাসের শাশ্বত বিধান আল্লাহর আইন শেষ পর্যন্ত ঐ ছুরি দিয়েই তোমাদের যবাই করবে। তোমাদের এই যুলুমের রাজত্ব একেবারেই খতম হয়ে যাবে।
এই সব ঘটনার সঠিক সময়কাল বলা কঠিন। তবে অনুমান হয় যে, যে সময় সহিংসতা চরম আকার ধারণ করেছিল, তখনই এ ঘটনাগুলো ঘটে থাকবে। আবু তালেবের মৃত্যুর পরেই যে এ সব ঘটনা ঘটেছে, তা সুনিশ্চিত।
হযরত উসমান বিন আফফান বর্ণনা করেন, একবার রসূল সা. পবিত্র কা’বার তাওয়াফ করছিলেন। কোরায়েশ সরদার উকবা ইবনে আবু মুয়াইত, আবু জাহল ও উমাইয়া ইবনে খালফ এ সময় হাতীমে কা’বায় বসা ছিল। রাসূল (সা) যখনই তাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন, তারা তাঁকে লক্ষ্য করে অশ্রাব্য গালাগাল বর্ষণ করছিল। এভাবে তিনবার হলো। শেষ বাস রাসূল (সা) পরিবর্তিত চেহারা নিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আল্লাহর আযাব অবিলম্বে তোমাদের ওপর না নামলে তোমরা কিছুতেই ক্ষান্ত হবে না।’ হযরত উসমান বলেন, এ কথাটা বলার সাথে সাথেই তাদের মধ্যে এমন আতংক উপস্থিত হয় যে, প্রত্যেকে ভয়ে কাঁপতে থাকে। এ কথাটা বলার পর রাসূল (সা) বাড়ী অভিমুখে রওনা হলেন। তাঁর সাথে হযরত উসমান এবং অন্যান্যরাও রওনা হন। এই সময় রাসূল (সা) নিজ সাথীদের সম্বোধন করে বলেনঃ
‘তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, আল্লাহ অবশ্যই তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী, তাঁর বাণীকে পূর্ণাঙ্গ এবং তাঁর দ্বীনের সাহায্য করবেন। আর এই লোকগুলোকে অচিরেই আল্লাহ তোমাদের হাত দিয়ে যবাই করাবেন।’
লক্ষ্য করুন, দৃশ্যত নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে এ সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল। অথচ কত দ্রুত কেমন জাঁকজমকের সাথে তা সত্য প্রমাণিত হলো। ইসলামী আন্দোলন যেন একটা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললো।
তায়েফে ইসলামের দাওয়াত
এ ঘটনাটা ঠিক কোন সময়ে ঘটেছিল, নিশ্চিতভাবে তা বলা কঠিন। কেউ কেউ এটিকে সুরা মুদাসসিরের নাযিল হবার প্রেক্ষাপট হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এ কথা মেনে নিলে ঘটনাটিকে প্রাথমিক যুগে স্থান দিতে হয়। কিন্তু ঘটনার ধরন দেখে মনে হয়, এটা মক্কী যুগের শেষের দিককার ব্যাপার।
একদিন রাসূল (সা) প্রত্যুষে বাড়ী থেকে বেরুলেন। মক্কার বিভিন্ন অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু পুরো দিনটা অতিবাহিত করেও তিনি সেদিন একজন লোকও পেলেন না, যে তাঁর বক্তব্যে কর্ণপাত করে। সে সময় ইসলামবিরোধীরা যে নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিল তা হলো রাসূল (সা) কে আসতে দেখলেই সবাই সটকে পড়তো। কারণ তাঁর কথা শুনলেই জটিলতা দেখা দেয়। বিরোধিতা করলে বা তর্কবিতর্ক করলে তার আরো বিস্তার ঘটে। এই কর্মপন্থা বেশ সফল হলো। দু’ একজনের সাক্ষাত পেলেও তারা উপহাস অথবা গুন্ডামির মাধ্যমে জবাব দিল। পুরো দিনটা বিফলে যাওয়ায় তিনি বুকভরা হতাশা ও বিমর্ষতা নিয়ে বাড়ী ফিরলেন। কেউ যখন কোন ব্যক্তির উপকার করতে ও শুভ কামনা করতে এগিয়ে যায়, আর সেই ব্যক্তি ঐ উপকারী ও শুভাকাংখী ব্যক্তিকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন উপকারী ব্যক্তিটির মন যেমন দুর্বিষহ বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে, রসূল (সা) এর মনের অবস্থাটাও ছিল অবিকল তদ্রুপ।
ঐ বিশেষ দিনটার অভিজ্ঞতা থেকে রসূল (সা) এর মনে এই ধারণা দানা বাঁধে যে, মক্কার মাটি এখন ইসলামের দাওয়াতের জন্য অনুর্বর হয়ে যাচ্ছে এবং এখানে যা কিছু ফসল ফলার সম্ভাবনা ছিল, তা ইতিমধ্যেই ফলেছে। পরবর্তী সময় পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকায় তাঁর এ ধারণা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। সম্ভাবনাময় সর্বশেষ মানুষগুলো তখন রসূল (সা) এর চার পাশে সমবেত হয়ে গেছে। সম্ভবত ঐ দিন থেকেই তাঁর মনে এই ভাবনা প্রবলতর হতে থাকে যে, এখন মক্কার বাইরে গিয়ে কাজ করা উচিত। আসলে একজন বিচক্ষণ ও প্রাজ্ঞ দাওয়াতদাতার এ রকম ভাবাটাই স্বাভাবিক। সে যখন নিজের প্রাথমিক কেন্দ্রে এতটা দাওয়াতী কাজ সম্পন্ন করে ফেলে, যার ফলে সেখানকার কার্যোপযোগী সব লোক দাওয়াত গ্রহণ করে এবং একগুয়ে হটকারী লোকেরা ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ট থাকে না, তখন সে আর ঐ জায়গায় পড়ে থেকে শক্তির অপচয় করেনা, বরং নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করে এবং পরিবেশ পরিবর্তন করে নতুন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে।
এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েই রসূল (সা) মক্কার আশপাশে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তায়েফকে দাওয়াতের নতুন ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেন। যায়েদ বিন হারেসাকে সাথে নেন। তিনি তায়েফকে দাওয়াতের নতুন ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেন। যায়েদ বিন হারেসাকে সাথে নিয়ে একদিন মক্কা থেকে পায়ে হেটে রওনা হন। পথিমধ্যে যে সব গোত্রের বসতবাড়ী দেখতে পান তাদের সবার কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। আসা যাওয়ায় তাঁর প্রায় এক মাস সময় অতিবাহিত হয়ে যায়।
তায়েফ ছিল ছাড়া সুনিবীড়, সুজলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা, বাগবাগিচা ও ক্ষেতখামারে পরিপূর্ণ অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা আবহাওয়াযুক্ত একটা স্থান। অধিবাসীরা ছিল খুবই স্বচ্ছল, সুখী এবং অত্যধিক ভোগবিলাস ও আরাম আয়েশে মত্ত। আর্থিক সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের অধিকারী হলে সাধারণত আল্লাহকে ভুলে যায় এবং প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার কাজে নিয়োজিত হয়। তায়েফবাসীর অবস্থা ছিল এ রকমই। মক্কাবাসীর মধ্যে তো তবু ধর্মীয় পৌরহিত্য ও দেশ শাসনের দায়িত্বের কারণে কিছুটা নৈতিক রাখঢাক থাকা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তায়েফবাসী ছিল একেবারেই বেপরোয়া ধরনের। উপরন্তু সুদখোরীর কারণে তাদের মানবতাবোধ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এহেন জায়গায় সফরে যাওয়ার অর্থ হলো, রসূল (সা) মক্কার চেয়েও খারাপ জায়াগায় যাচ্ছিলেন।
বিশ্বমানবের পরম সুহৃদ মুহাম্মদ (সা) তায়েফ পৌঁছে সর্বপ্রথম সাকীফ গোত্রের সরদারদের সাথে সাক্ষাত করলেন। তারা ছিল তিন ভাই আবদ ইয়ালীল, মাসউদ ও হাবীব। এদের প্রত্যেকের ঘরে কোরায়েশ বংশোদ্ভ’ত বনু জামাহ গোত্রের এক একজন স্ত্রী ছিল। সে হিসাবে তিনি আশা করেছিলেন যে, তারা কিছুটা সৌজন্যপূর্ণ আচরণ করতে পারে। রসূল (সা) তাদের কাছে গিয়ে বসলেন, তাদেরকে সর্বোত্তম ভাষায় আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিলেন দাওয়াতের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে আলোচনা করলেন এবং আল্লাহর সত্য দ্বীন প্রতিষ্ঠায় তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করলেন। কিন্তু এই তিন ব্যক্তি কেমন জবাব দিল দেখুনঃ
এক ভাই বললোঃ সত্যি যদি আল্লাহই তোমাকে পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি কা’বা ঘরের গেলাফের অবমাননা করতে চান।
দ্বিতীয় ভাইঃ কি আশ্চর্য ! আল্লাহ তাঁর রসূল বানানোর জন্য তোমাকে ছাড়া আর কোন উপযুক্ত লোক পেলেন না !
তৃতীয় ভাইঃ আল্লাহর কসম, আমি তোমার সাথে কথাই বলবো না। কেননা তুমি যদি তোমার দাবী মোতাবেক সত্যি সত্যিই আল্লাহর রসূল হয়ে থাক, তাহলে তোমার মত লোককে জবাব দেয়া ভীষণ বেআদবী হবে। আর যদি তুমি আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করে থাক, তাহলে তোমার সাথে কথা বলা যায় এমন যোগ্যতাই তোমার নেই।’
এর প্রতিটি কথা রসূল (সা) এর বুকে বিষমাখা তীরের মত বিদ্ধ হতে লাগলো। তিনি পরম ধৈর্য সহকারে মর্মঘাতী কথাগুলো শুনলেন এবং তাদের কাছে সর্বক্ষেত্রে অনুরোধ রাখলেন যে, তোমরা তোমাদের এ কথাগুলোকে নিজেদের মধ্যেই সীমিত রাখ এবং জনসাধারণকে এসব কথা বলে উস্কে দিওনা।
কিন্তু তারা ঠিক এর উল্টোটাই করলো। তারা তাদের শহরের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বখাটে তরুণদেরকে, চাকর নফর ও গোলামদেরকে রসূলের পেছনে লেলিয়ে দিল এবং বলে দিল যে, যাও, এই লোকটাকে লোকালয় থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এসো। বখাটে যুবকদের এক বিরাট দল আগে পিছে গালি দিতে দিতে, হৈ চৈ করতে করে ও পাথর ছুঁড়ে মারতে মারতে চলতে লাগলো। তারা তাঁর হাঁটু লক্ষ্য করে করে পাথর মারতে লাগলো, যাতে তিনি বেশী ব্যথ্যা পান। পাথরের আঘাতে আঘাতে এক একবার তিনি অচল হয়ে বসে পড়ছিলেন। কিন্তু তায়েফের গু-ারা তার বাহু টেনে ধরে দাঁড় করাচ্ছিল এবং পুনরায় হাঁটুতে পাথর মেরে তাতে তালি দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। ক্ষতস্থানগুলো থেকে অঝোরা ধারায় রক্ত ঝরছিল। এভাবে জুতোর ভেতর ও বাহির রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। আর এই অপূর্ব তামাশা দেখার জন্য জনতার ভীড় জমে গেল। গু-ারা এভাবে তাকে শহর থেকে বের করে এক আঙ্গুরের বাগানের কাছে নিয়ে এল। বাগানটা ছিল রবিয়ার ছেলে উতবা ও শায়বার। রসূল (সা) একেবারে অবসন্ন হয়ে একটা আংগুর গাছে সাথে হেলান দিয়ে বসলেন। বাগারে মালিক তাঁকে দেখছিল এবং ইতিপূর্বে তাঁর ওপর যে অত্যাচার হচ্ছিল, তাও কিছুটা প্রত্যক্ষ করেছিল।
এখানে দু’রাকাত নামায পড়ে তিনি নিম্নের মর্মস্পর্শী দোয়াটা করলেনঃ
’হে আল্লাহ! আমি আমার দুর্বলতা, সম্বলহীনতা ও জনগণের সামনে অসহায়ত্ব সম্পর্কে কেবল তোমারই কাছে ফরিয়াদ জানাই। দরিদ্র ও অক্ষমদের প্রতিপালক তুমিই। তুমিই আমার মালিক। তুমি আমাকে কার কাছে সঁপে দিতে চাইছ? আমার প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে, নাকি শত্রুর কাছে? তবে তুমি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না থাক, তাহলে আমি কোন কিছুর পরোয়া করি নে। কিন্তু তোমার পক্ষ থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা পেলে সেটাই আমার জন্য অধিকতার প্রশস্ত। আমি তোমার কোপানলে অথবা আযাবে পতিত হওয়ার আশংকা থেকে তোমার সেই জ্যোতি ও সৌন্দর্যের আশ্রয় কামনা করি, যার কল্যাণে সকল অন্ধকার দূরীভূত হয় এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তোমার সন্তোষ ছাড়া আমি আর কিছু কামনা করিনা। তোমার কাছ থেকে ছাড়া আর কোথাও থেকে কোন শক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।”
ইতিমধ্যে বাগানের মালিক এসে পড়লো। তার অন্তর সমবেদনায় ভরে উঠেছিল। সে তাঁর খৃস্টান গোলাম আদ্দাসকে ডাকলো এবং তাকে দিয়ে একটি পিরিসে করে আঙ্গুর পাঠিয়ে দিল। আদ্দাস আঙ্গুর দিয়ে রসূল (সা) এর সামনে বসে পড়লো। রসূল (সা) ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আঙ্গুরের দিকে হাত বাড়াতেই আদ্দাস বললো, ‘আল্লাহর কসম, এ ধরনের কথা তো এ শহরের লোকেরা কখনো বলেনা। রসূল (সা) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কোন শহরের অধিবাসী এবং তোমার ধর্ম কী? সে বললো, আমি খৃস্টান এবং নিনোভার অধিবাসী। রসূল (সা) বললেন, ‘তুমি তো দেখছি আল্লাহর সৎ বান্দা ইউনুস বিন মিত্তার শহরের লোক।’ আদ্দাস অবাক হয়ে বললো, ‘আপনি কিভাবে ইউনুস বিন মিত্তাকে চিনেন? রসূল (সা) বলেলেন, ‘উনি আমার ভাই। তিনিও নবী ছিলেন আর আমিও নবী।’ এ কথা শোনা মাত্রই আদ্দাস রসূল (সা) এর হাতে ও পায়ে চুমু খেতে লাগলো। রবীয়ার এক ছেলে চুমু খাওয়া দৃশ্য দেখে মনে মনে চটে গেল। আদ্দাস ফিরে গেলে তাকে সে ভর্ৎসনা করলে লাগলো যে, তুমি ও কী করছিলে? তুমি তো নিজের ধর্ম নষ্ট করে ফেলছিলে। আদ্দাস গভীর আবেগের সাথে বললো, “হে আমার মনিব, পৃথিবীতে এর চেয়ে উত্তম কোন জিনিস নেই। ঐ ব্যক্তি আমাকে এমন একটা কথা বলেছে যা নবী ছাড়া আর কারা জানা সম্ভব নয়।”
আসলে চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর পর রসূল (সা) মক্কায় বাহ্যত একেবারে সহায়হীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর শত্রুদের শক্তি ও প্রতাপ বহুল পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। তাই ভেবেছিলেন তায়েফে হয়তো আল্লাহর কিছু বান্দাকে সাথী হিসেবে পাওয়া যাবে। অথচ সেখানেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হ’লো। সেখানে থেকে তিনি নাখলায় এসে অবস্থান করলেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে এসে হেরা গুহায় উপনীত হলেন। এখান থেকে মুতয়াম বিন আদীকে (বয়কট চুক্তি বাতিলের উদ্যোক্তাদের অন্যতম) বার্তা পাঠালেন যে, “আপনি কি আমাকে নিরাপত্তামূলক আশ্রয় দিতে পারেন?” আরবের জাতীয় চরিত্রের একটা ঐতিহ্যবাহী বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, কেউ নিরাপত্তামূলক আশ্রয় চাইলে তা তাকে দেয়া হতো চাই সে শত্রুই হোক না কেন। মুতয়াম রসূল (সা) এর অনুরোধ গ্রহণ করলো। সে তার ছেলেদেরকে নির্দেশ দিল, সশস্ত্র অবস্থায় কা’বার চত্তরে ঘোরাফিরা করবে এবং মুহাম্মাদের (সা) নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সে নিজে গিয়ে রসূল (সা) কে সাথে করে মক্কায় নিয়ে এল এবং উটের ওপর বসে ঘোষণা করলো, আমি মুহাম্মাদকে (সা) আশ্রয় দিয়েছি। মুতয়ামের ছেলেরা খোলা তলোয়ার হাতে নিয়ে পাহারা দিয়ে রসূল (সা) কে হারাম শরীফে নিয়ে এল এবং তারপর তাঁর বাড়ীতে পৌঁছালো।
তায়েফে রসূল (সা) এর যে দুরবস্থা হয়েছিল, ইতিহাসের ভাষা আমাদেরকে তার পূর্ণাংগ বিবরণ দিতে পারেনি। একবার হযরত আয়েশা (রা) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হে রসূলুল্লাহ, আপনি কি ওহুদের চেয়েও কঠিন দিনের সম্মুখীন কখনো হয়েছেন?” তিনি জবাব দিলেনঃ “তোমার জাতি আমাকে আর যত কষ্টই দিয়ে থাকুক, আমার জন্য সবচেয়ে কষ্টকর দিন ছিল তায়েফে যেদিন আমি আব্দ ইয়ালীলের কাছে দাওয়াত দিলাম। সে তা প্রত্যাখ্যান করলো এবং এত কষ্ট দিল যে, অতি কষ্টে কারনুস সায়ালেব নামক জায়াগায় পৌঁছে কোন রকমে রক্ষা পেলাম।” (আল মাওয়াহিবুল লাদুননিয়া, প্রথম খন্ড, ৫৬ পৃঃ)
নির্যাতনের চোটে অবসন্ন ও সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়ার পর যিনি রসূল (সা) কে ঘাড়ে করে শহরের বাইরে নিয়ে এসেছিলেন, সেই যায়েদ বিন হারেসা ব্যথিত হৃদয়ে বললেন, আপনি এদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করুন। রাসুল সাঃ বললেন, “আমি ওদের বিরুদ্ধে কেন বদদোয়া করবো? ওরা যদি আল্লাহর ওপর ঈমান নাও আনে, তবে আশা করা যায়, তাদের পরবর্তী বংশধর অবশ্যই একমাত্র আল্লাহর এবাদত করবে।”
এই সফরকালেই জিবরীল এসে বলেন, পাহাড় সমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতারা আপনার কাছে উপস্থিত। আপনি ঈংগিত করলেই তারা ঐ পাহাড় দুটোকে একসাথে যুক্ত করে দেবে, যার মাঝখানে মক্কা ও তায়েফ অবস্থিত। এতে উভয় শহর পিষ্ট ও ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু মানবতার বন্ধু মহান নবী এতে সম্মত হননি।
এহেন নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতেই জ্বিনেরা এসে রসূল (সা) এর কোরআন তেলাওয়াত শোনে এবং তাঁর সামনে ঈমান আনে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রসূল (সা) কে জানিয়ে দিলেন যে, দুনিয়ার সকল মানুষও যদি ইসলামের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে আমার সৃষ্ট জগতে এমন বহু জীব আছে, যারা আপনার সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
শুভ দিনে পূর্বাভাস
তায়েফের অভিজ্ঞতা এতই মর্মান্তিক ছিল যে, তা অতিক্রম করতে গিয়ে রসূল (সা) দুঃখবেদনার শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। এই সীমায় পৌঁছার পরই আল্লাহ মানুষের সাফল্যের দ্বার উদঘাটন করেন। সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা দৃশ্যত রসূল (সা) কে সর্বনিম্ন স্তরে নামিয়ে দিয়েছিল। আর এর অনিবার্য ফল স্বরূপ তাঁর মর্যাদা আল্লাহর দরবারে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়েছিল।
আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীদেরকে পাঠিয়ে যখনই হক ও বাতিলের সংঘাত লাগিয়েছেন, তখন সে সংঘাতকে একটা সুনির্দিষ্ট বিধির আওতাধীন করে দিয়েছেন। বিধিটি ছিল এই যে, বাতিল যখন সত্যের সৈনিকদের ওপর যুলুম নির্যাতন ও বলপ্রয়োগের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, নির্যাতিত মোজাহেদরা যুলুম নিপীড়নের সব ক’টা স্তর একে একে চরম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে পার হয়ে যায় এবং সর্বশেষ প্রাণান্তকর সময়টাও অতিক্রম করে, কেবল তখনই আল্লাহর গায়েবী সাহায্যের সময় সমাগত হয়। জান্নাতমুখী পথগুলো কাঁটায় পরিপূর্ণ। এই পথে যারা চলে, তাদের সাফল্যের সুসংবাদ কখন আসে, সে কথা কোরআনে এভাবে বলা হয়েছেঃ
“তারেদ ওপর বিপদ মুসিবত ও দুর্যোগাদি এলো এবং তারা একেবারেই দিশেহারা হয়ে পড়লো। এমনকি রসূল এবং তাঁর সহচর মুমিনরা বলে উঠলো, কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য? (এ পর্যায়ে পৌঁছার পর তাদের সুসংবাদ দেয়া হয় যে) শুনে নাও, আল্লাহর সাহায্য নিকটে।” (বাকারাঃ ২১৪)
তায়েফের অভিজ্ঞতার পর রসূল (সা) যেন এই সর্বশেষ পরীক্ষা অতিক্রম করলেন। আল্লাহর বিধান অনুসারেই এখন নতুন যুগের সূচনা অবধাতির ছিল এবং এ সম্পর্কে সুসংবাদ দেয়ার সময়ও ঘনিয়ে এসেছিল। এই সুসংবাদ দেয়ার উদ্দেশ্যেই রসূল (সা) কে মে’রাজ দ্বারা সম্মানিত করা হয়।
আসলে মে’রাজের তাৎপর্য হলো, রসূল (সা) কে মহান আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্যের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করা হয়। যে বিশ্ব সম্রাটের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে রসূল (সা) বেশ কয়েকটা বছর নানা রকমের দুঃখকষ্ট ও বিপদ মুসিবত ভোগ করলেন এবং বিভিন্ন অপশক্তির সাথে আদর্শিক ও চিন্তাগত যুদ্ধ করে কাটিয়ে দিলেন, সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর দূতকে নিজের সর্বোত্তম উপাধিতে ভূষিত করার জন্য আপন দরবারে ডেকে পাঠান। যে বীর সেনানী জীবন ও জগত সংক্রান্ত মৌলিক সত্যগুলোকে মেনে নিতে স্বজাতিকে উদ্বুদ্ধ করার সংগ্রামে নেমে চারদিক থেকে ক্রমাগত আঘাতের পর আঘাত সহ্য করেছেন, মে’রাজের মাধ্যমে তাকে সুযোগ দেয়া হয় যেন, ঐ সত্যগুলোকে নিকট থেকে দেখে আসতে পারেন। বিশ্ব মানবতার সার্বিক কল্যাণ সাধনের সর্বাত্মক চেষ্টায় নিয়োজিত শেষ নবীকে এক বিরল সৌভাগ্যে ভূষিত করা হয় যেন, তিনি এই আন্দোলনের এক বিরাট ও সুপ্রাচীন কেন্দ্রে (বাইতুল মাকদাস) উপস্থিত হয়ে অতঃপর সেখান থেকে উর্ধ জগতে উড্ডয়ন করে এই আন্দোলনের সাবেক নেতৃবৃন্দের সাথে মিলিত হতে পারেন।
পূর্বতন নবীগণকে অদৃশ্য সত্যগুলোকে দর্শন ও আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে উপনীত হবার মাধ্যমে বিশেষ অনুগ্রহ লাভের সুযোগ দেয়া হতো। কোরআনে একদিকে যেমন হযরত ইবরাহীম আ. সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাঁকে…… আকাশ ও পৃথিবীর সাম্রাজ্য পরিদর্শন করানো হয়েছিল। অপরদিকে তেমনি হযরত মূসা আ. কে তূর পর্বতে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আল্লাহ তা’য়ালা একটা আলোকময় গাছের আড়াল থেকে… ‘আমি আল্লাহ’ বলে ঘোষনা দিয়ে তাঁর সাথে কথোপকথন করেন। অন্য এক সময় এরূপ ঘনিষ্ঠ পরিবেশেই তাকে শরীয়তের বিধান প্রদান করা হয়। মোটকথা সকল বড় বড় নবী কোন না কোন পন্থায় মে’রাজের সুযোগ লাভ করেছিলেন। তবে রসূল সা. এর মে’রাজ ছিল পূর্ণাংগ।
তয়েফ ও হিজরতের ঘটনার মাঝখানে মে’রাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বৈশিষ্টমন্ডিত আর কোন ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনার খবর যখন তিনি জানালেন তখন মক্কায় হৈ চৈ পড়ে গেল। তিনি ঐ রাতে কোথায় কোথায় কী কী দেখেছেন সব খোলাখুলি বর্ণনা করলেন। বাইতুল মাকদাসের আকৃতির পুরো ছবি তুলে ধরলেন। পথিমধ্যকার এমন সব সুনিশ্চিত আলামতও বর্ণনা করলেন যা পরে নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়।
ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অবস্থানের এই সৌভাগ্যময় মহূর্তে যে বিশেষ ওহী নাযিল করা হলো, সেটাই সূরা বনী ইসরাইলের আকারে আমাদের কাছে বিদ্যমান। ঐ সূরা শুরুই হয়েছে মে’রাজের ঘটনা দিয়ে। আর গোটা সূরাই মে’রাজের প্রেরণায় সিক্ত। ঐ সূরার নিন্মোক্ত বক্তব্যগুলো বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়ঃ
১- বনী ইসরাইলের শিক্ষাপ্রদ ইতিবৃত্ত সামনে রেখে বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহর আইন বড় বড় শক্তিধর ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে পর্যন্ত জবাদিহীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায় এবং তারা্ বিপথগামী হলে তাদেরকে অন্য কোন অনুগত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দিয়ে পিটিয়ে দেয়া হয়। অপর দিকে এ কথাও শেখানো হয়েছে যে, বিজয় ও সফলতার যুগে পৌছে তারাও যেন বনী ইসরাইলের মত আচরণ শুরু করে না দেয়।
২- চরম প্রতিকূল পরিবেশে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলা হয়, সত্য সমাগত, বাতিল পরাভূত (আয়াত-৮৯) অর্থাৎ অন্ধকার তখন দূরীভূত হবে এবং প্রভাতের আবির্ভাব ঘটবে।
৩- আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে এ কথাও জানিয়ে দেন যে, মক্কাবাসী এবার আপনাকে মক্কা থেকে তাড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেবে। কিন্তু আপনাকে বহিষ্কার করার পর বেশী দিন শান্তিতে থাকতে পারবেনা।(আয়াত-৭৬) হিজরতের যে দোয়া আল্লাহ শেখালেন তার ভাষা ছিল এ রকমঃ “হে আমার প্রতিপালক, আমাকে সত্যের দরজা দিয়ে প্রবেশ করান এবং সত্যের দরজা দিয়েই(বর্তমান পরিবেশ থেকে) বের করুন, আর আমাকে আপনার পক্ষ থেকে সাহায্য হিসাবে শাসন ক্ষমতা দান করুন।”-(আয়াত-৮০) এ দোয়ায় শাসন ক্ষমতার প্রার্থনা অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে প্রকারন্তরে সুসংবাদ দেয়া হলো যে, হিজরতের পরবর্তী সময়টা আধিপত্য ও শাসনের যুগ হবে।
৪- ২২ থেকে ২৯ নং আয়াতে একাধারে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রাথমিক মূলনীতি সমূহ বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে করে ঐ মূলনীতি সমূহের ভিত্তিতে নতুন সমাজ ও নতুন সভ্যতা গড়ে তোলা হয়।
মে’রাজের প্রাক্কালীন ওহীর এই বক্তব্য সমূহ বক্ষে ধারণ করে যখন রসূল সা. ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করতেন, তখন সম্ভবতঃ আকাশ থেকে আলোর এক বিরাট স্রোতধারা নেমে আসতে দেখতেন। মক্কার এই ভীতিময় পরিবেশে যদি তাঁর পরিবর্তে অন্য কোন বস্তুবাদী নেতা থাকতো, তাহলে সে হয়তো হতাশ হয়ে নিজের সমস্ত কর্মসূচী ও তৎপরতা বন্ধ করে দিত। কিন্তু রসূল সা. চরম প্রতিকূল ও হতাশঅব্যঞ্জক পরিবেশের অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়েও নিশ্চিত বিশ্বাস রাখতেন যে, প্রভাত আসছে। এই প্রভাত সমীরণের একটা ঝাপটা এসে যেন রসূলের সা. কানে কানে এ কথাও বলে দিয়েছে যে, নতুনপ্রভাতের সূর্যদয় আর কোথাও নয় মদিনায়ই ঘটবে। কেননা ওখানকার তরুণরা পরম পরিতৃপ্তি ও আন্তরিকতার সাথে ইসলামী আন্দোলনে দীক্ষিত হতে আরম্ভ করেছিল।
মক্কী জীবনের অবসান কালে রসূল সা. তায়েফকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিলেন যে, তুমি কি সত্যের মশাল বহন করতে পারবে? তায়েফ জবাব দিল, আমি তো এ কাজে মক্কার চেয়েও অযোগ্য। এই হতাশাব্যঞ্জক জবাব শুনে রসূল সা. যখন পরবর্তী কর্মসূচী স্থির করার চিন্তায় মগ্ন, তখন ইয়াসরিব বললো, ‘আমি মদিনাতুন নবী (নবীর শহর) হতে প্রস্তুত। আমি সত্যের মশাল উঁচু করবো এবং সারা দুনিয়াকে আলোকিত করবো। আমার বুকের ওপর সত্য ও ন্যায়ের বিধান লালিত হবে। আমার কোলে এক নতুন ইতিহাস বিকাশ লাভ করবে।’ তায়েফ নিকটে থেকেও দূরে সরে গেল। ইয়াসরিব দূরে থেকেও নিকটে এসে গেল।
নবুয়তের একাদশ বছর ইয়াসরিব থেকে আগত ৬ জন বিপ্লবী যেদিন রসূল সা. এর সাথে অংগীকারে আবদ্ধ হলো, সেদিন ইয়াসরিব আরো নিকটবর্তী হয়ে গিয়েছিল। বিস্তারিত আলাপ আলোচনার পর তারা ইসলামের তাওহীদ ও নৈতিক বিধিবিধান মেনে চলার যে শপথ করেন, তাকেই বলা হয় আকাবার প্রথম বায়াত। এরপর হজ্জের সময় আরো একটা বড় দল মদিনা থেকে আসে। তারাও রাতের অন্ধকারে এক গোপন বৈঠকে আকাবার দ্বিতীয় বায়য়াত সম্পন্ন করেন। এটি ছিলো পুরোপুরি রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত চুক্তি। এতে রসূল সা. এর হিজরত করে মদিনায় চলে যাওয়া স্থির হয় এবং এমন সর্বাত্মক ত্যাগের মনোভাব প্রতিফলিত হয় যে, মদিনার আনসারগণ রসূল সা. জন্য সমগ্র দুনিয়ার সাথে লড়াই করতে প্রস্তুত থাকার কথা ঘোষণা করেন।
তায়েফ সফর ও হিজরতের মধ্যবর্তী সময়টাতেই সম্ভবত সূরা ইউসুফ নাযিল হয়েছিল। এ সূরায় অন্য একজন নবী হযরত ইউসুফের জীবন কাহিনী বর্ণনা করে রসূল সা. কে সুসংবাদ দেয়া হয় এবং তাঁর শত্রুদেরকে তাদের অমানুষিক নির্যাতনমূলক কর্মকান্ড সম্পর্কে সাবধান করে তাদের শোচনীয় পরিণতি জানিয়ে দেয়া হয়।