ইসলামী সংগঠনের অভ্যন্তরে নৈতিক ব্যবস্থাজনিত জটিলতা
ইসলামী আন্দোলনের সাংগঠনিক ব্যবস্থা ছিল আগাগোড়া একটা নৈতিক ব্যবস্থা।এ পরিবেশটা শয়তানের কাজ করার জন্য সবচেয়ে প্রশস্ত ও উত্তম ক্ষেত্র।বিশেষত এর দুটো দিক বিভ্রান্তিসৃষ্টিকারীদের অনুকূল।নৈতিক ব্যবস্থার একটা বিশেষ জটিলতা হলো, এতে সুস্পষ্ট আপত্তিকর ঘটনাবলী যতক্ষণ প্রামাণ্য তথ্যের আকারে আবির্ভূত না হয়, ততক্ষণ তার তার বিরুদ্ধে সংগঠন ও কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনা, আর যারা বিব্রত বোধ করে, তারাও শেষ ফল বের হওয়ার আগে পরিস্থিতির ধাঁধালো পটভূমিকে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারেনা।ইসলামের নৈতিক বিধান ইসলামী সমাজের সদস্যদেরকে একে অপরের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করতে নিষেধ করে।একজন ন্যায়নিষ্ট মানুষ তাঁর সাথীদের প্রতিটি সন্দেহজনক কার্যকলাপের যতদূর সম্ভব ভালো ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হয়ে থাকে।অতঃপর সে যদি একটা অবাঞ্চিত ঘটনার সমস্ত তথ্য পর্যালোচনা করে আপন অন্তরের গভীরে একটা খারাপ ধারণ পোষণ করেও বসে, তাহলেও তাকে এ জন্যে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় যে, তার খারাপ ধারনাকে খন্ডন করার মত পাল্টা কোন তথ্য পাওয়া যায় কিনা?
নিছক ধারনা, চাই তা যতই দৃঢ় হোক না কেন, তার ভিত্তিতে কারো বিরুদ্ধে কোন আনুষ্ঠানিক মামলা পরিচালনা করা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়না।এ সব কারণে মদিনার নিষ্ঠাবান মুসলমানরা গোপন সলাপরামর্শে লিপ্ত ফেতনাবাজ ও নৈরাজ্যবাদী লোকদের প্রাথমিক তৎপরতাকে কিছু অবাঞ্চিত আলামত বলে প্রত্যক্ষ করা সত্ত্বেও নীরবদর্শক হয়ে দেখতে বাধ্য ছিলেন।তবে ফেতনা যখন যথারীতি ফসল ফলাতে শুরু করতো, কেবল তখনই সমাজের নৈতিক ব্যবস্থা তাদেরকে তার বিরুদ্ধে কথা বলার অনুমতি দিত এবং সামষ্টিক ব্যবস্থাকে সক্রিয় করার সুযোগ দিত।
নৈতিক ব্যবস্থার দ্বিতীয় জটিলতা ছিল এই যে, সংগঠনের সবোচ্চ নেতা ও অন্যান্য দায়িত্বশীলদের উপর যদি কেউ অভিযোগ আরোপ করে, তাহলে তাদের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ে।একদিকে তাদের হাতেই দলের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব থাকে, এবং তারাই সমস্ত ফেতনা তথা অরাজকতা ও বিভ্রান্তি খতম করার ক্ষমতা রাখেন।অপর দিকে তারাই ফেতনার শিকার হয়ে এমন অবস্থায় পতিত হন যে, মুসলিম জনগণের সামনে ফেতনাবাজ তথা হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের মুখোস খুলে যাওয়ার আগে তাদের বিরুদ্ধে যদি নেতারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাহলে উল্টো নেতারাই সমালোচনা ও ভিন্নমত দমনের দায়ে অভিযুক্ত হন।তারা সত্যের আওয়ায বুলন্দকারীদেরকে স্বৈরাচারী পন্থায় পরাভূত করার দোষে দোষী সাব্যস্ত হন।ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন বলা যায় যে, ভদ্রতা সবচেয়ে বড় শক্তি হলেও ভদ্রতা সবচেয়ে বড় দূর্বলতাও বটে, ঠিক তেমনি দলের ক্ষেত্রেও বলা যায় যে, নৈতিক ব্যবস্থা তার সবচেয়ে বড় জটিলতাও বটে।এই জটিলতার একমাত্র সমাধান হলো, দলের সামষ্টিক মনমানসকে এত সজাগ ও সচেতন হতে হবে এবং তার সামষ্টিক চরিত্রকে এত বলিষ্ট ও মজবুত হতে হবে যে, সে নিযের মেজাজ বা স্বভাবের বিরুদ্ধে কোন কিছুকেই দলের অভ্যন্তরে চালু থাকতে দেবেনা।দলীয় পরিমন্ডলে কেউ দলীয় শৃংখলা বিরোধী কানাঘুষা, ফিসফিসানি, গুজব বা গোপন সলাপরামর্শে কর্ণপাত করতে প্রস্তুত হবেনা, কর্ণগোচর হওয়া এ ধরনের কোন বিষয়কে কেউ এদিক সেদিকে ছড়ানোর ধৃষ্টতা দেখাবেনা।কিন্তু এই চুড়ান্ত ও উৎকৃষ্টতম মানদন্ডে কোন দলের সামগ্রিকভাবে ও পরিপূর্ণভাবে উত্তীর্ণ হওয়া এবং উত্তীর্ণ হয়ে সর্বক্ষণ টিকে থাকা কঠিন।মনমগজ দ্বারা কুচিন্তা করা, মুখ দিয়ে কু-প্ররোচনা দান ও খারাপ বিষয়ে ফুসলানো এবং কান দিয়ে এই সব অবাঞ্চিত জিনিস শোনা – ইত্যাকার কর্মকান্ডে লিপ্ত মানুষ থেকে কোন মানবসমাজ পুরোপুরি মুক্ত ও পবিত্র হতে পারেনা।মানুষ যা ভাবে, যা বলে ও যা শোনে, তাতে শয়তান কিছু না কিছু অংশ গ্রহণ না করেই ছাড়েনা।
নৈতিক ব্যবস্থার এই নমনীয়তা ও উদারতা থেকে মোনাফেকরা পুরোপুরিভাবে উপকৃত হয়েছে এবং এর সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে।কিন্তু পরিণামে তারা এর প্রবল শক্তির পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারেনি।কোরআনের ভাষায় তাদের সমগ্র কর্মকান্ডের সংক্ষিপ্ত সার ছিল এইঃ “তারা যা চেয়েছিল, তা পায়নি”।কিন্তু ইসলামী সংগঠনকে বিব্রত অবশ্যই করেছে এবং তাকে বিশৃংখলায় অবশ্যই ফেলেছে।
গোপন সলাপরামশ, গুজব রটনা, কানাঘুষা ও ফিসফিসানির এই পরিবেশে ইসলামী আন্দোলনের প্রধানতম নেতার ব্যক্তিত্ব শুরু থেকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল এবং একের পর এক আক্রমণ চালানোও হচ্ছিল।এহেন পরিবেশে নাশকতাবাদী কুচক্রী ফেতনাবাজদের ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন হয়, তাহলে কুটিল থেকে কুটিলতর এবং জঘন্য থেকে জঘন্যতর অপবাদ রটনা করে কোন প্রলয়ংকারী বিপযয় ঘটিয়ে দেয়াও তাদের পক্ষে কিছুমাত্র অসম্ভব ছিলনা।এই নমনীয় পরিবেশের সুযোগ গ্রহণ ও মোনাফেকদের দক্ষতার সাথে কাজে লাগানোর জন্য শয়তানের দ্বিতীয় যে জিনিসটির প্রয়োজন ছিল, তা হলো এমন একজন ঝানু খলনায়ক, যার মস্তিষ্ক কুটিল চক্রান্ত উদ্ভাবনে অত্যন্ত সৃজনশীল ও দক্ষ হবে, এবং যার বুকে গোপন সলাপরামর্শকারীদের সৃষ্টি করা বারুদের স্তুপে জ্বলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপের সাহস থাকবে।এ ধরনের একজন ঝানু খলনায়ক আব্দুল্লাহ বিন উবাই – এর আকারে আগে থেকেই তৈরী ছিল।এই লোকটার মন নিজের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার অনুভূতিতে কানায় কানায় পূর্ণ ছিল।কেনইবা থাকবেনা? হিজরতের প্রাক্কালে মদিনার বাদশাহীর মুকুট তো তারই মাথায় পরানোর প্রস্তুতি চলছিল।কেবল মুহাম্মদ সা. এর উপস্থিতি তার আশার গুড়ে বালি দিল।বাদশাহী দূরে থাক, নিজের চরিত্রের কারণে ইসলামী সংগঠনের প্রথম সারির তো নয়ই, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির মর্যাদাও তার কপালে জোটেনি।এই দুর্ঘটনা তার মনমস্তিস্কে অত্যন্ত তিক্ত ও বিষময় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং সেই প্রতিক্রিয়া থেকে প্রতি মুহূর্তে জন্ম নিতে থাকে নতুন নতুন ফেতনা, নতুন নতুন ষড়যন্ত্র।শয়তান মানষের ভেতরে প্রত্যক্ষভাবে খুব বেশী কাজ করেনা।তার প্রয়োজন হয়ে থাকে তার বশংবদ মানুষ-শয়তানদের।আর এই মানুষ শয়তানদেরকে আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে তৎপর রাখার জন্য তার প্রয়োজন হয় একজন যুতসই নেতার, একজন ষড়যন্ত্র বিশারদ নেতার।শয়তান এ ধরনের একজন যুতসই ষড়যন্ত্র বিশারদ নেতা রেডিমেড পেয়ে গেল।সে ছিল আবার ইসলামী আন্দোলনের বৃত্তের ভেতরেরই লোক।এই লোকটা একদিকে নবীর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনকে মেনে নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছিল, অপরদিকে প্রতিনিয়ত ঐ আন্দোলনের বিরুদ্ধে সংঘাতেও লিপ্ত ছিল।
ঝোপ বুঝে কোপ মারায় অভিজ্ঞ এই দাম্ভিক কুচক্রী খলনায়কটি এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে নিজের বুকের ভেতরে জ্বলন্ত হিংসার অগ্নিকুন্ড থেকে একটা দগদগে অঙ্গার বের করে রসূল সা. এর পবিত্র পারিবারিক অংগনে নিক্ষেপ করলো।নিক্ষেপ করার সাথে সাথেই গোটা সমাজ মানসিকভাবে দগ্ধ হতে লাগল।
হযরত আয়েশার নিজস্ব প্রতিবেদন
এই ভয়াবহ দূর্যোগের সময়ে হযরত আয়েশার অন্তরাত্মার ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে, সে সম্পকে প্রামাণ্য বিশদ বিবরণ হাদীস, ইতিহাস ও সীরাতের গুরুত্বপূণ গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ রয়েছে।এ সব বিবরণ স্বয়ং হযরত আয়েশা ও অন্যান্য বর্ণনাকারীদের মুখনিসৃত।আমার কাছে এ মুহূর্তে যাদুল মা’য়াদ (২য় খন্ড, পৃঃ ১১৩-১১৫) এবং সীরাতে ইবনে হিশাম (২য় খন্ড, পৃঃ ৩৪২-৩৪৭) এর ন্যায় প্রামাণ্য গ্রন্থ রয়েছে।তবে তাফহীমুল কোরআনের লেখক হযরত আয়েশার এই বেদনাবিধুর কাহিনীটাকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন বিধায়, ওটাই এখানে উদ্ধৃত করছিঃ
“মদীনায় পৌঁছে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম এবং প্রায় একমাস শয্যাশায়ী থাকলাম।শহরে এই অপবাদ সম্বলিত গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল।স্বয়ং রসূলের সা. কানেও তা পৌঁছে গিয়েছিল।অথচ আমি কিছুই জানতাম না।তবে যে জিনিসটা দেখে আমার খটকা লাগছিল তা এই যে, রসূল সা. অসুস্থতার সময় আমার দিকে যে রকম বিশেষ মনোযোগ দিতেন, এবার সে রকম মনোযোগ দিচ্ছিলেন না, ঘরে এসে কেবল ”তুমি কেমন আছ” এই কথাটাই জিজ্ঞেস করতেন।এর চেয়ে বেশী একটা কথাও বলতেন না।এটা দেখে আমার সন্দেহ হতো, কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে।অবশেষে আমি তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মায়ের কাছে চলে গেলাম, যেন তিনি ভালভাবে আমার সেবা সশ্রুষা করতে পারেন।একদিন রাতের বেলা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে গেলাম।তখন পর্যন্ত আমাদের বাড়ীতে পায়খানা তৈরী হয়নি।তাই আমরা জংগলেই যেতাম।আমার সাথে মিসতার মাও ছিলেন।তিনি আমার মায়ের খালাতো বোন ছিলেন (অন্যান্য বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হযরত আবুবকর সিদ্দীক রা. এই পরিবারের সকলের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছিলেন।কিন্তু এত বড় অনুগ্রহ সত্ত্বেও মিসতাহ হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে অপবাদ রটনাকারীদের অন্তভূক্ত গিয়েছিল।) জংগলের দিকে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে মিসতার মা একটা ঠোকর খেলেন।সাথে সাথে তার মুখ দিয়ে বে-এখতিয়ার বেরিয়ে গেলঃ “মিসতার মরণ হোক! আমি বললাম, আপনি কেমন মা যে, ছেলেকে অভিশাপ দিচ্ছেন? আর ছেলেও এমন যে, বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে”।তিনি বললেন, ওর কথা শোননি? এরপর তিনি পুরো ঘটনা শোনালেন।অপবাদ রটনাকারীরা আমার সম্পর্কে কি সব কথা ছড়াচ্ছে, তা খুলে বললেন।মোনাফেকরা ছাড়া মুসলমানদের মধ্যে থেকে যারা এই ফেতনায় জড়িয়ে পড়েছিল,তাদের মধ্যে মিসতাহ, বিখ্যাত কবি হাসসান বিন সাবিত, এবং হাসনা বিনতে জাহশ (উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নব বিনতে জাহাশের বোন) উল্লেখযোগ্য।এই বিবরণ শুনে আমার রক্ত শুকিয়ে গেল এবং আমি সেই প্রাকৃতিক প্রয়োজনের কথা পর্যন্ত ভুলে গেলাম, যার জন্য এসেছিলাম।সোজা ঘরে ফিরে গেলাম এবং সারা রাত কেঁদে কাটালাম”। (ইবনে হিশামের বর্ণনায় এ কথাটাও যোগ করা হয়েছে যে, “কাঁদতে কাঁদতে আমার কলিজা ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছিল!”)
একদিকে হযরত আয়েশা তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন।অপরদিকে সমগ্র শহরে যথারীতি কানাঘুষা চলছিল।হযরত আয়েশার পক্ষে সবচেয়ে জোরদার সাফাই তার পিতা ও স্বামীই দিতে পারতেন।কিন্তু দুরাচার লোকেরা যখন এ ধরনের অপবাদ রটিয়ে দেয়, তখন যে যত ঘনিষ্ট হয়, সে ততই জটিলতায় পড়ে যায়।তাই পিতা ও স্বামী নির্বাক হয়ে গেলেন এবং চারদিক থেকে নিক্ষিপ্ত কুৎসার তীরে বিদ্ধ হতে লাগলেন।
মানবতার শ্রেষ্ঠতম উপকারী বন্ধু মুহাম্মদ সা. এর কাছে এই মুহূর্তগুলো ব্যক্তিগতভাবেও এবং সংগঠনের স্বার্থের দিক দিয়েও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।যে কোন সম্ভ্রান্ত, সচেতন ও দায়িত্বশীল ব্যক্তির পক্ষে রসূল সা. এর এই অবস্থা উপলব্ধি করা সম্ভব।তিনি অনেক ধৈর্য ধারণ করলেন এবং দীঘ সময় নীরবে কাটিয়ে দিলেন।কিন্তু এমন একটা স্পশকাতর বিষয়কে বতমান অবস্থায় ঝুলন্ত রাখাও সম্ভব ছিলনা।একটা কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।তাই রসূল সা. নিরপেক্ষভাবে তদন্ত শুরু করে দিলেন।নিজের দু’জন ঘনিষ্ট সাথী হযরত আলী রা. ও হযরত উসামা বিন যায়েদকে ডেকে তাদের মতামত চাইলেন।হযরত উসামা রা. বললেনঃ হে রসূল! তিনি আপনার মহিয়সী স্ত্রী।আমরা তার ভেতরে ভালো ছাড়া আর কিছু পাইনা।যা কিছু ছড়ানো হচ্ছে, সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রচারণা। (সীরাতে ইবনে হিশাম) হযরত আলী রা. অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে অভিমত দিলেন।তিনি বললেন, “হে রসূল! স্ত্রী লোকের অভাব নেই।আপনি আয়েশার পরিবতে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন।তবে দাসীকে ডেকে তদন্ত করে নিন”।আসলে হযরত আলীর উদ্দেশ্য ছিল এই যে, রসূল সা. এর পেরেশানী ভোগ করার চেয়ে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাই উত্তম এবং যে স্ত্রী সম্পর্কে এমন তুলকালাম কান্ড ঘটে গেছে, তাকে তালাক দেয়াই শ্রেয়।প্রকৃতপক্ষে হযরত আলী নিজের বিশেষ আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে ঐ বিষয়টার আন্দোলনগত দিকের চেয়ে রসূল সা. এর ব্যক্তিগত পেরেশানীকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন।এজন্য তিনি রসূল সা. কে মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি লাভের পরামশ দিলেন।
তবুও রসূল সা. হযরত আলীর পরামর্শের দ্বিতীয় অংশকে গ্রহণ করলেন।তিনি দাসীকে ডাকলেন।হযরত আলী তাকে এক চড় বসিয়ে দিয়ে তাকে কঠোরভাবে শাসিয়ে বললেন, “রসূল সা. এর সামনে সত্য বলবে”।সে বললো, ”আল্লাহর কসম, আমি তার সম্পকে ভালো ছাড়া আর কিছু জানিনা।আয়েশার মধ্যে আমি কেবল একটাই ত্রুটি দেখেছি যে, আমি আটা বানানোর সময় যখন বাইরে যেতাম, তাকে বলে যেতাম যে, একটু দেখো।কিন্তু সে ঘুমিয়ে যেত এবং ছাগল এসে আটা খেয়ে ফেলতো” (সীরাতে ইবনে হিশাম)।এই স্বতস্ফূর্ত বিবৃতিতে দাসী হযরত আয়েশাকে যেমন নিখূঁত সাফাই দিয়েছিল, অন্য কোন বিবৃতি এর ওপর তেমন কিছু যোগ করতে পারতোনা।সে এমন একটা সরলমতি বালিকার প্রকৃত ছবি তুলে ধরেছিল, যার মধ্যে কোন খারাপ জিনিস কল্পনা করা মানবীয় বিবেক বুদ্ধির পক্ষে অসম্ভব।এই সাথে রসূল সা. দ্বিতীয় যে পদক্ষেপ নিলেন তা হলো, একটা সাধারণ সভা ডাকলেন এবং ভাষণ দিলেন।আল্লাহর প্রশংসার মাধ্যমে শুরু করার পর অত্যন্ত ব্যথাতুর কন্ঠে বললেনঃ
“যারা আমাকে আমার পরিবার পরিজন সম্পর্কে কষ্ট দেয় এবং তাদের সম্পর্কে অবাস্তব কথা বলে বেড়ায়, তাদের উদ্দেশ্যটা কী? আল্লাহর কসম, আমার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে আমি ভালো ছাড়া আর কিছু জানিনা।তারা যে ব্যক্তিকে জড়িয়ে এই অপবাদ রটিয়েছে, তাকেও আমি ভালো বলেই জানি।সে আমার অনুপস্থিতে কখনো আমার বাড়িতে আসেনি”। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৩য় খন্ড)
অপর এক বর্ণনা মোতাবেক রসূল সা. শুরুতে বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি আমাকে আমার পরিবারের ব্যাপারে কষ্ট দিচ্ছে, তার কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করতে পারে, এমন কেউ আছে কি?” (যাদুল মায়াদ, ২য় খন্ড)
এ কথা শোনার পর আওস গোত্রের সরদার উসাইদ বিন হুযাইর দাঁড়িয়ে বললেন, “হে রসূলুল্লাহ! এ ধরণের লোকেরা যদি আমাদের গোত্রের হয়ে থাকে, তা হলে আমরা তাদেরকে উচিত শিক্ষা দেব।আর যদি তারা খাজরাজী হয়ে থাকে, তা হলে আপনি হুকুম দিন।আল্লাহর কসম, এ ধরনের লোকদের সমুচিত শাস্তি মস্তক ছেদন”।
সংগে সংগে অপর দিক থেকে খাজরাজের সরদার সা’দ বিন উবাদা প্রতিবাদ করে উঠলেন যে, “তুমি মিথ্যা বলছ, আল্লাহর কসম, আমরা তাদের মস্তক ছেদন করবোনা।ওহ, বুঝেছি, তুমি এ কথা এজন্যই বলেছ যে, তুমি তাদেরকে খাজরাজের লোক মনে কর”।হযরত সা’দের এই জবাবে উসাইদ বিন হুযাইর খুবই রুষ্ট হলেন।তিনি হয়তো বুঝেছেন, যে দলে অপরাধী, নৈরাজ্যবাদী ও কুচক্রীরা কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পায়, সে দলের পক্ষে সমাজকে অপরাধমুক্ত করা সম্ভব নয়।আবদুল্লাহ বিন উবাই এর মত লোকেরা সব আন্দোলনেই সব সময় জন্ম নিয়ে থাকে।কিন্তু একটা শক্তিশালী ও আত্মসচেতন দল এ ধরনের লোকদের দলে টিকতে দেয়না, বরং বের করে দেয়।তবে যদি কূচক্রী লোক কোন সংগঠনে প্রভাবশালী লোকদের আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়ে যায়, তাহলে গৃহশত্রু বিভীষণরা লালিত পালিত হতে থাকে এবং সমাজ তাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।এই তিক্ত সত্য উপলব্ধি করেই হযরত উসাইদ রা. বলে উঠলেন, ‘‘মিথ্যা আমি নয়, তুমি বলছ।আল্লাহর কসম, তুমি একজন মোনাফেক বলেই মোনাফেকদের পক্ষ নিচ্ছ।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম)
এই তিক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার কারণ ছিল এই যে, আওস ও খাজরাজের মধ্যে উত্তেজনা বাধানোর জন্যও ক্রমাগত চক্রান্ত আঁটা হচ্ছিল।এজন্যই সামান্য একটা কথার জের ধরে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো এবং একটা মারামারি বেধে যাওয়ার উপক্রম হলো।যিনি উভয় গোত্রের মধ্যে সুসম্পর্ক গঠন করে দিয়েছিলেন, সেই মহান নেতার এটা ভালো লাগলো না যে, বহু বছরের চেষ্টায় গড়া দু’গোত্রের ঐক্য তাঁরই কারণে আবার নষ্ট হয়ে যাক।তিনি মিম্বর থেকে নেমে এসে উভয় দলকে শান্ত করলেন এবং সভার সমাপ্তি ঘটলো। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
দলের এই দুর্বল দিকটার অভিজ্ঞতা রসূল সা. এর মনোকষ্টকে আরো বাড়িয়ে দিল।আসলে বনুল মুসতালিক যুদ্ধের সময় আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই যে পুরানো বিভেদ ও বিদ্বেষের আগুন জ্বেলেছিল, এটা ছিল তারই ফলশ্রুতি।
কাহিনীর শেষাংশ, যা ট্রাজেডিকে কমেডিতে রূপান্তরিত করেছিল, খোদ হযরত আয়েশার মুখেই শুনুন!
‘‘এই অপবাদের গুজব কমবেশি এক মাস ব্যাপী শহরময় গুঞ্জরিত হতে থাকে।রসূল সা. প্রচন্ড মর্মযাতনা ভোগ করতে থাকেন।আমি সারাক্ষণ কাঁদতে থাকি।আমার পিতামাতা চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতায় আক্রান্ত থাকেন।অবশেষে একদিন রসূল সা. এলেন এবং আমার কাছে বসলেন।এই পুরো সময়টায় তিনি একবারও আমার কাছে কাছে বসেননি।হযরত আবু বকর ও উম্মে রুমান (হযরত আয়েশার মাতা) ধারণা করলেন, আজ একটা চূড়ান্ত ফায়সালা হতে যাচ্ছে।তাই তারা দুজনেও কাছে এসে বসে গেলেন।রসূল সা. বললেন, ‘‘আয়েশা তোমার সম্পর্কে আমার কাছে এই সব খবর পৌঁছেছে।তুমি যদি নিরপরাধ হয়ে থাক, তাহলে আশা করি আল্লাহ তায়ালা তোমার নিরপরাধ হওয়ার বিষয় জানিয়ে দেবেন।আর যদি তুমি কোন গুণাহ করে থাক, তাহলে আল্লাহর কাছে তওবা কর ও ক্ষমা চাও।বান্দা যখন নিজের গুনাহ স্বীকার করে তওবা করে, তখন আল্লাহ মাফ করে দেন।এ কথা শুনে আমার অশ্রু শুকিয়ে গেল। (নিরপরাধ মানুষের কাছ থেকে এ ধরণের প্রতিক্রিয়াই আশা করা যায়।– নঃ সিঃ)
আমি নিজের পিতাকে বললাম, ‘‘আপনি রসূলুল্লাহর সা. কথার জবাব দিন।’’ তিনি বললেন, ‘‘মা, আমার বুঝেই আসছেনা কী বলবো।’’ আমি নিজের মাতাকে বললাম, ‘‘আপনি কিছু বলুন।’’ তিনিও বললেন, ‘‘আমিও বুঝতে পারছিনে কী বলবো।’’ আমি বললাম, ‘‘আপনাদের কানে একটা কথা ঢুকেছে- সংগে সংগে তা আপনাদের মনেও বদ্ধমূল হয়ে গেছে, এখন যদি বলি যে আমি নিষ্পাপ, বস্তুত আল্লাহ সাক্ষী যে, আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ- তাহলে আপনারা বিশ্বাস করবেন না।আর যদি আমি যা করিনি তা অনর্থক স্বীকার করি- বস্তুত আল্লাহ সাক্ষী যে আমি তা করিনি- তাহলে আপনারা বিশ্বাস করবেন।আমি এ সময় হযরত এয়াকুবের নাম মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মনে করতে পারলামনা। (একজন নিরপরাধ মানুষ যখন কোন মারাত্মক অপবাদের শিকার হয়ে দিশেহারা হয়ে যায় তখন তার মনস্তাত্মিক জগতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক।– নঃ সিঃ) অবশেষে আমি বললাম এ পরিস্থিতিতে আমার আর কী বলার আছে? আমি শুধু হযরত ইউসুফের পিতা যে কথা বলেছিলেন যে ******* ‘‘পরম ধৈর্য’’ সেই কথাটাই বলবো। (হযরত এয়াকুবের সামনে তার ছেলেরা যখন ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে বলে মিথ্যে বিবরণ দিয়েছিল, তখন তিনি এ কথাটা বলেছিলেন।- অনুবাদক) এই বলে আমি বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লাম। (একজন নিরপরাধ মানুষের ওপর অপবাদ আরোপ করা হলে তার মধ্যে অসহায়াবস্থার পাশাপাশি যে বেপরোয়া মনোভাবের সৃষ্টি হয়, সেটাই এখানে ফুটে উঠেছে।– নঃ সিঃ) এই সময় আমি মনে মনে বলছিলাম, আল্লাহ আমার নিষ্পাপত্ব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল।তিনি নিশ্চয়ই প্রকৃত তথ্য ফাঁস করে দেবেন।যদিও তখন পর্যন্ত আমি ভাবতেও পারিনি যে, আমার পক্ষে ওহি নাযিল হবে যা কেয়ামত পর্যন্ত পঠিত হবে।আমি নিজেকে এতটা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কখনো ভাবতামনা যে, আল্লাহ স্বয়ং আমার পক্ষে কথা বলবেন।তবে আমি মনে করেছিলাম, রসূল সা. কোন স্বপ্ন দেখবেন এবং তার মাধ্যমেই আল্লাহ জানিয়ে দেবেন যে, আমি নিরপরাধ।সহসা রসূল সা. এর মধ্যে এমন ভাবান্তর সৃষ্টি হলো, যা সচরাচর ওহি নাযিল হওয়ার সময় হতো এবং প্রচন্ড শীতের মৌসুমেও রসূল সা. এর মুখমন্ডল থেকে মুক্তার মত ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরতো।আমরা সবাই নীরব হয়ে গেলাম।আমি তো সম্পূর্ণ নির্ভীক ছিলাম।কিন্তু আমার পিতামাতা ভয়ে এমন জড়সড় হয়ে যাচ্ছিলেন যে, শরীরের কোথাও তখন কেটে দিলে বোধ হয় রক্তই বের হতোনা।তারা শংকিত ছিলেন এই ভেবে যে, আল্লাহ না জানি কী খবর জানান।রসূল সা. এর অবস্থা স্বাভাবিক হলে দেখা গেল, তিনি ভীষণ খুশী।তিনি হাসিমুখে সর্বপ্রথম যে কথাটা বললেন, তা ছিল, ‘‘আয়েশা তোমাকে মুবারকবাদ।আল্লাহ তোমাকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করেছেন।’’ এরপর রসূল সা. দশটা আয়াত শোনালেন।আমার মা বললেন, ওঠো, রসূলুল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।আমি বললাম, আমি ওঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবোনা, আপনাদের প্রতিও নয়।আমি শুধু আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, যিনি আমাকে নির্দোষ ঘোষণা করেছেন।আপনারাতো এ অপবাদকে অস্বীকার পর্যন্ত করেননি।’’ (তাফহীমুল কোরআন, সূরা নূর) হযরত আয়েশার কথায় কেবল তীব্র আত্মসম্ভ্রমবোধ যুক্ত অনুযোগ ফুটে উঠেছে, লক্ষ্য করুন।এটা কি কোন অপরাধী বিবেকের বক্তব্য হতে পারে? এই বিবরণের প্রতিটা শব্দ বলে দিচ্ছে যে, এটা একজন নিরপরাধ মানুষের দুঃখ বেদনার অকৃত্রিম স্বতস্ফূর্ত ও নিখুঁত প্রতিবেদন।
ওহির সাফাই
অপপ্রচারের এই ঝড় এবং তা থেকে সৃষ্ট সংকট দূর করার জন্য সহসাই ওহি নাযিল হলো।এই সংকট দূর করার জন্য যে সূরা নাযিল হলো, তার নাম ‘নূর’ (আলো)।বাস্তব পরিস্থিতির সাথে চমৎকার মানিয়েছে এ নাম।কেননা একটা গুরুতর সামাজিক সংকটের সৃষ্ট অন্ধকারকে দূর করে পরিবেশকে আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্যই এই সূরা নাযিল হয়েছে।এ সূরায় মুসলমানদের সংগঠন ও সমাজ সম্পর্কে পর্যালোচনা করা, তার দূর্বলতা চিহ্নিত করা এবং এই সব দূর্বলতা থেকে তাদেরকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করার জন্য নৈতিক ও আইনগত দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এই সাড়া জাগানো সূরার বক্তব্যের সূচনাই চমকে দেয়া মত।বলা হয়েছেঃ
‘‘এ একটা সূরা, যাকে আমি নাযিল করেছি, যাকে আমি দায়িত্ব হিসাবে (ইসলামী সমাজের জন্য) অপরিহার্য করেছি এবং যার মধ্যে আমি সুস্পষ্ট নির্দেশাবলী উপস্থাপন করেছি।হয়তো তোমরা এর দ্বারা উপকৃত হতে পারবে।’’ (আয়াত ১)
এবার সমাজকে উদ্দেশ্য করে সূরা নূরের সোচ্চার ঘোষণাঃ
‘‘যারা এই অপবাদ তৈরী করেছে, তারা তোমাদেরই মধ্যকার একটা গোষ্ঠী। …. এ অপবাদে যে যতটুকু অংশ নিয়েছে, সে ততটুকুই পাপ কুড়িয়েছে।আর যে এর দায়দায়িত্বের প্রধান অংশ বহন করেছে, তার জন্য রয়েছে ভীষণ শাস্তি।’’ (আয়াত-১১)
কী সাংঘাতিক শ্লেষাত্মক ধমক! এমন একটা সাক্ষ্যপ্রমাণহীন অভিযোগ, যার আদৌ কোন সুষ্ঠু আলামত ছিলনা, ঝড়ের বেগে উঠলো এবং বাইরের কোন শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বীর পক্ষ থেকে নয়- বরং বহু বছরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুসলিম দলের ভেতর থেকেই উঠলো।এটা এক আধজন মানুষের আকস্মিক পদস্খলনও ছিলনা।পুরো এক মাস ধরে একটা গোষ্ঠী চরম মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে থাকলো।সূরা নূরে বলা হচ্ছে যে, তোমাদের দলীয় পরিমন্ডলে এমন দুর্বলতার অস্তিত্ব রয়েছে যে, তার নির্মাতারাই তাকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়ে বসতে পারে।এ পরিবেশে এমন ফাঁকফোকর রয়েছে যার মধ্য দিয়ে সত্যের সৈনিকদের সমাজ ও সংগঠনে মিথ্যা ও বাতিল ঢুকে যেতে পারে।বলা হচ্ছে যে, এটা কেবল একটা বিচ্ছিন্ন অপবাদের ঘটনা ছিলনা, বরং পাপের একটা বহমান স্রোত ছিল।এই স্রোতধারা থেকে কেউ ড্রাম ভরে নিয়েছে, কেউ কলসী ভরে নিয়েছে, আবার কেউ শুধু হাতের তালুতে যতটুকু নেয়া যায় ততটুকু নিয়েছে।এভাবে যে যতটটুকু অংশ গ্রহণ করেছে, সে নিজের জন্য ততটুকু পাপ সঞ্চয় করেছে।এরপর এই অপকর্মের মূল হোতা অর্থাৎ আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর দিকে ইংগিত করা হয়েছে, যে প্রথম আগুন জ্বালিয়েছে, এবং তারপর অব্যাহতভাবে বাতাস দিয়ে তাকে দাবানলে পরিণত করেছে।
সূরা নূরে প্রশ্ন রাখা হয়েছেঃ
‘‘যখন তোমরা এটা প্রথম শুনলে, তখন মুমিন নারী ও পুরুষরা কেন নিজেদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করলোনা, কেনইবা তৎক্ষণাত বললোনা যে, এটা একটা ভয়ংকর অপবাদ।’’ (আয়াত ১২)
এ বক্তব্যে কত জোরদার নৈতিক আবেদন রয়েছে এবং ভদ্রজনোচিত আবেদ ও মুমিন সুলভ অনুভূতির জন্য কত তীব্র কশাঘাত রয়েছে, তা লক্ষ্য করার মত।অর্থাৎ ইসলামী সমাজের এক মহীয়সী নারী ঘটনাক্রমে কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন এবং সেই সমাজেরই একজন সম্মানিত সদস্য তাকে পথিমধ্যে পেয়ে সাথে করে নিয়ে এলেন, শুধু এতটুকু ঘটনা তোমাদের জন্য সর্বনিম্ন স্তরের একটা খারাপ ধারণা পোষনের ভিত্তি হয়ে গেল কেমন করে? তোমাদের মধ্যকার অন্য কোন নারী ও পুরুষ যদি একটা দুর্ঘটনা হিসেবে এরূপ পরিস্থিতির শিকার হতো, তাহলে তারা কি অবশ্যই এরূপ নিকৃষ্ট কাজে লিপ্ত হতো? নিজেদের চরিত্র সম্পর্কে কি তোমাদের ধারণা এ রকম? তোমাদের সমাজ কি এতই নীচ যে, তার দুই ব্যক্তি ঘটনাচক্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সামান্যতম সুযোগও হাতছাড়া করেনা? তোমরা নিজেদের সম্পর্কে যদি এমন হীনতার ধারণা করতে না পার, তাহলে তোমাদের দলের একজন শ্রেষ্ঠ নারী ও একজন বিশিষ্ট সদস্য সম্পর্কে এমন জঘন্য ধারণা পোষণের কী অধিকার তোমাদের ছিল?
বস্তুত এ সমাজের বিরাট সংখ্যাগুরু অংশ এই সংকটকালেও নিজেদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিলেন।নচেত গোটা সমাজদেহে যদি এই বিষ সংক্রমিত হবার সুযোগ পেত এবং সমাজ সামগ্রিকভাবে এর মানসিক প্রতিরোধে অক্ষম হতো, তা হলে এ আঘাত তার গোটা অস্তিত্বকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিত।এক্ষেত্রে হযরত আবু আইয়ুব আনছারী সবচেয়ে নির্ভুল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন।তাঁর স্ত্রী যখন তাকে এই নোংরা গুজবের কথা জানালেন, তখন তিনি বললেন, ‘‘ওহে আইয়ুবের মা, আয়েশার পরিবর্তে তুমি যদি ঐ স্থানে থাকতে, তাহলে কি এমন কাজ করতে? তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর কসম, কখখনো না।’’ হযরত আবু আইয়ূব বললেন, ‘‘তাহলে আয়েশা তোমার চেয়ে অনেক ভালো।আমিও বলি যে, সফওয়ানের স্থলে যদি আমি থাকতাম, তাহলে এ ধরণের চিন্তাও মাথায় আসতোনা।আর সফওয়ান তো আমার চেয়ে ভালো মুসলমান।’’ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৩য় খন্ড)
এই নোংরা অপবাদ রটনাকারীদেরকে সূরা নূরে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তোমরা আবু আইয়ূব আনসারীর মত প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলেনা কেন?
এরপর সূরা নূর আইনগত দৃষ্টিভংগি থেকে প্রশ্ন তুলেছে যেঃ
‘‘তারা তাদের অভিযোগের প্রমাণ স্বরূপ চারজন সাক্ষী কেন নিয়ে আসেনি? আল্লাহর দৃষ্টিতে তো ওরাই মিথ্যুক।’’ (আয়াত-১৩)
অর্থাৎ কোন পুরুষ ও নারীর চরিত্রের ওপর কলংক লেপন করা নিছক একটা তামাসা নয় বরং এটা একটা গুরুতর অপরাধ এবং এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ একটা জীবন্ত সমাজে অত্যন্ত জরুরী।একজন সৎ ও নিরীহ নাগরিক সম্পর্কে ইচ্ছা হলেই এ কথা বলা যে, সে হত্যা করেছে, চুরি করেছে, অথবা ব্যভিচার করেছে, কোন মামুলী ব্যাপার নয় যে, যা হবার হয়ে গেছে বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে।এটা সর্বোচ্চ পরিমাণ দায়িত্ব সচেতনতার দাবী জানায়।এ ধরণের অভিযোগ তোলার পর তার প্রমাণ দেয়া, আইনানুগ সাক্ষী উপস্থাপন করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।যারা ইসলামী সমাজের দু’জন সম্মানিত ও ভদ্র লোকের বিরুদ্ধে স্বচোক্ষে না দেখে একটা অপবাদ আরোপ করে, আরোপিত অপবাদের সাক্ষ্য প্রমাণ আনা তাদেরই কর্তব্য।নচেত আইন অনুযায়ী তারাই মিথ্যাবাদী ও অপরাধী।
এরপর সূরা নূর ইসলামী সমাজের দুর্বল সদস্যদের ত্রুটিকে কিভাবে চিহ্নিত করেছে দেখুনঃ
‘‘ভেবে দেখ, তোমরা কত বড় মারাত্মক ভুল কাজ করছিলে যখন একজনের মুখ থেকে আর একজনের মুখে এই মিথ্যার বিস্তার ঘটাচ্ছিলে এবং তোমরা মুখ দিয়ে এমন কথা বলছিলে যার সম্পর্কে তোমাদের কোনই জ্ঞান ছিলনা।তোমরা একে একটা মামুলী ব্যাপার মনে করেছ।অথচ আল্লাহর কাছে তা গুরুতর।কথাটা শোনা মাত্রই তোমরা বলে দিলেনা কেন যে, এমন কথা উচ্চারণ করা আমাদের জন্য অন্যায়।সুবহানাল্লাহ, এতো একটা জঘন্য অপবাদ!’’ (আয়াত ১৫-১৬)
এটা যে কোন সমাজ ও সংগঠনের একটা মস্ত বড় দুর্বলতা যে, তার অভ্যন্তরে ভিত্তিহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন গুজব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।বিশেষত যে সংগঠন সারা বিশ্বের নৈতিক সংস্কারের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যার নেতৃত্বে একটা সামজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালিত হয়, তার পক্ষে এটা আরো বড় দুর্বলতা।একজন মানুষ কান দিয়ে যা কিছু শুনবে মন দিয়ে তৎক্ষণাত তা বিশ্বাস করবে, এবং মুখ দিয়ে তা প্রচার করবে, অতঃপর এক মুখ থেকে আর এক মুখে স্থানান্তরিত হতে থাকবে, কেউ তার সত্যাসত্য যাচাই করবেনা, কোন বাছবিচার করবেনা এবং কোথাও গিয়ে এই ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটবেনা, যে যার বিরুদ্ধে যা কিছু বলতে চায় অবাধে বলে যাবে, যার বিরুদ্ধে কলংক রটাতে চায় রটাতে কোন বাধা পাবেনা – এ ধরণের সমাজে কারো মানসম্ভ্রমের নিরাপত্তা থাকতে পারেনা।যে সমাজে স্বয়ং রসূল সা., হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা., হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. ও সফওয়ানের ন্যায় ব্যক্তিবর্গ একজন মোনাফেকের ছড়ানো অপবাদ থেকে রক্ষা পায়না, সে সমাজে আর কার মান সম্ভ্রম নিরাপদ থাকতে পারে?
সূরা নূরে এ জন্যই প্রচন্ড ধমকের সুরে বলা হয়েছেঃ
‘‘যারা সরলমতি নারীদের নিরুদ্ধে অপবাদ রটায়, তাদের ওপর দুনিয়া ও আখেরাতে অভিসম্পাত এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন আযাব।’’ (আয়াত-২৩)
এ আয়াতে হযরত আয়েশার চরিত্রের ছবি এঁকে দেয়া হয়েছে।একজন ঈমানদার সচ্চরিত্রা মহিলা, যার ধারণাই নেই যে ব্যভিচার কী জিনিস এবং কিভাবে করা হয়, আর এ ব্যাপারে কেউ তাকে অপবাদ দিতে পারে এ কথা যার কল্পনায়ই আসেনা।তেমনি এক সরলমতি মযলুম মহিলার এ চিত্র নৈতিকভাবে প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে আলোড়িত করেছে।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, যেসব একনিষ্ঠ ঈমানদার আল্লাহ রসূলের অনুগত এবং ইসলামী আন্দোলনের বিশ্বস্ত ব্যক্তি এই দুরন্ত ও সতেজ গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তিত্বও ছিলেন, যিনি ইসলামী আন্দোলনের মূল্যবান সেবা করেছিলেন এবং তার সাহিত্যিক ও আত্মীক সম্পদ বৃদ্ধি করেছিলেন।ইনি ছিলেন হযরত হাসসান বিন সাবেত রা.।যারা সূরা নূরের ধমক ও তিরস্কারের আওতায় এসেছিলেন, হাসসানও তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন।অথচ ইসলামী সংগঠনে ও রসূল সা. এর দরবারে তিনি যথেষ্ট উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।বিভিন্ন সময় রসূল সা. তাঁকে বিশেষ ভাবে উপদেশ দিতেন যেন জাহেলী কবি ও সাহিত্যিক মহলের হামলার জবাব তিনি যেন কবিতা ও সাহিত্য দিয়েই দেন এবং ইসলামের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দায়িত্ব পালন করেন।এক পর্যায়ে হাসসান রা, এই দুর্লভ সৌভাগ্যও লাভ করেন যে, রসূল সা. স্বয়ং তাঁকে নিজের মিম্বরে বসান এবং ইসলামী আন্দোলনের জাতীয় সংগীত গাইতে বলেন।তার এই মর্যাদা স্বয়ং হযরত আয়েশা রা. এতটা উপলব্ধি করতেন যে, এই উত্তেজনাপূর্ণ সময়টা অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর তিনি সর্বদাই তাকে সম্মান করতেন।কখনো কখনো তাকে মনে করিয়ে দেয়া হতো যে, এই ব্যক্তি আপনার বিরুদ্ধে কুতসা রটনায় অংশ গ্রহণ করেছিল।তখন হযরত আয়েশা উদারতা ও মহানুভবতার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়ে বলতেন, “বাদ দাও।উনি ইসলাম বিরোধী কবিদেরকে সব সময় রসুল সা. ও ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন এবং কবিতার অংগনে মূল্যবান অবদান রেখেছেন।”
সে যাই হোক, বস্তুত ঘটনা এটাই যে, ইসলামী আন্দোলনের এই অসাধারন ব্যক্তি মোনাফেকদের পাতানো ভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে পড়ে গিয়েছিলেন।এই হাঙ্গামায় তিনি যে ভূমিকা পালন করেন তা তিনি নিজে আন্তরিকতা সহকারে এবং ন্যায়সংগত মনে করে করলেও আন্দোলনের জন্য তা অত্যাধিক ক্ষতিকর ছিল।তার এ ভূমিকা দেখে যে কেউ এ শিক্ষা লাভ করতে পারে যে, কোন মানুষ যত দৃঢ় চরিত্রের অধিকারীই হোক না কেন, নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না যে, কোন অবস্থায়ই কোন বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হবে না।অনুরূপ অন্য কোন ব্যক্তি যতই শীর্ষ পর্যায়ের হোক না কেন, তার সম্পর্কেও কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে না যে, সে কোন ব্যাপারেই কোন মতিভ্রমের শিকার হবে না।ছোট বা বড় প্রতিটি মানুষ প্রতি মুহূর্তে শয়তানের চক্রান্তের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকে।বরং প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির চারপাশে ষড়যন্ত্রের জাল পাতার ব্যাপারে সে অধিকতর উদগ্রীব হয়ে থাকে।এ কারণেই ইসলামী আন্দোলন সর্বকালে যে মৌল তত্ত্বের অনুসরণ করে থাকে তা হলো, ব্যক্তি নয় নীতি ও আদর্শের প্রতিই দলের আসল আনুগত্য থাকা বাঞ্ছনীয়।
ইসলামী আন্দোলনের একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্বকে ফাঁদে আটকে ফেলা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার সাংগ পাংগদের অতি বড় সাফল্য।তারা মোনাফেকসুলভ কোটিল্য দ্বারা তাড়িত হয়ে অপততপরতা চালাচ্ছিল, আর হাসসান বিন সাবেত আন্তরিকতার সাথে তাদের ষড়যন্ত্রকে সফল করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন।এ কথা বলা বেমানান হবেনা যে, আন্দোলনের জন্য আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর মোনাফেকী যত ক্ষতিকর ছিল, তার চেয়েও বেশী ধ্বংসাত্মক ছিল হাসসানের আন্তরিকতা ও সরলতা।কেননা আন্তরিকতা ও সদুদ্দেশ্য নিয়ে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়, তা ক্ষতি সাধনে স্বেচ্ছায়ও অসদুদ্দেশ্য প্রণোদিত পদক্ষেপের চেয়ে অনেক বেশী সফল হয়ে থাকে।
হাসসান বিন সাবেত কাদের পক্ষে কাজ করেছেন এবং কাদের দৃষ্টিভংগী ছড়াচ্ছেন, সেটা তিনি বুঝতেই পারেননি।তিনি অনুভবই করেননি যে, তিনি কাদের ধ্যানধারণা ও সংকল্প বাস্তবায়িত করছেন, তার কার্যকলাপ সমাজের কোন শ্রেনীর লোকদের পক্ষে যাচ্ছে, এবং সংঠনের কোন গোষ্ঠীর হাত সবল করছে।তিনি যে এ ক্ষেত্রে মুমিনসুলভ অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারলেন না, সেটা বোধ হয় আল্লাহর ইচ্ছারই ফল।
আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর সাথে ইসলামী সমাজের সম্পর্ক ছিল ক্ষীণ ও দূরত্বের।তার বৈরী তৎপরতা বরদাশত করা যেত।কিন্তু হাসসান বিন সাবেত ছিলেন ইসলামী সংগঠনের আপনজন।এ জন্যই তার বৈরী আচরণ অসহ্য মনে হচ্ছিল।কেননা এতে সবার মনে হচ্ছিল যে, আমাদেরই একখানা তরবারী আমাদেরকে ঘায়েল করছে।এ ধরনের পরিস্থিতি কোন আন্দোলনে ও সংগঠনে দেখা দিলেই ধৈর্যের বাঁধ টুটে যাওয়ার উপক্রম হয়।সম্ভবত হয়েছিলও তাই।কিন্তু ইসলামী সংগঠনের কঠোর নৈতিক শৃঙ্খলা ভাবাবেগকে থামিয়ে রেখেছিল।কেবল এক ব্যক্তি নিজেকে সংযত রাখতে পারেননি।তিনি ছিলেন সাফওয়ান বিন মুয়াত্তাল।দুটো কারণে তিনি বেসামাল হয়ে যান।প্রথমত যে হযরত আরেশাকে তিনি নিজের মায়ের মত জানতেন, তার বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করা হচ্ছিল।দ্বিতীয়ত, সেই অপবাদ স্বয়ং তাকে জড়িয়েই আরোপ করা হচ্ছিল।সাফওয়ান একেতো ছিলেন বদরযোদ্ধা, ইসলামী আন্দোলনের একনিষ্ঠ সেবক, স্পষ্টবাদী হিসেবে খ্যাত।উপরন্তু তার চরিত্রে আজ পর্যন্ত কোন পাপের চিহ্ন দেখা যায়নি এবং একজন লাজুক ছেলের মত হযরত আয়েশার দিকে একটা দৃষ্টিও না দিয়ে, সারা পথে একটা কথাও না বলে, পূর্ণ সতর্কতার সাথে পেছনের অবস্থানস্থল থেকে ইসলামী বাহিনীর পরবর্তী অবস্থানস্থলে এনে পৌছিয়ে দিয়েছিলেন।এ জন্য তার মাথায় খুন চড়ে গিয়েছিল।
মোনাফেকদের আরোপিত অপবাদের বিবরণ দিয়ে হাসসান যে কবিতা লিখেছিলের, তার কয়েকটা ছত্র শুনেছিলের সাফওয়ান।এতে ভাষা ছিল হাসসানের, কিন্তু বক্তব্য ও মানসিকতা ছিল মোনাফেকদের।
সাফওয়ানের কথা কাটাকাটি হয়ে গেল হাসসানের সাথে।এক পর্যায়ে তিনি তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে বসলেন।সাবেত বিন কায়েস মাঝখানে এসে থামানোর চেষ্টা করলেন, সাফওয়ানকে বেধে ফেললেন ও বনুহারেসের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন।শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা রসূল সা. পর্যন্ত গড়ায়।হাসসান ও সাফওয়ান দুজনকেই তিনি ডাকলেন।সাফওয়ান বললো, “হে রসূল, এই ব্যক্তি আমাকে কষ্ট দিয়েছে এবং আমার বিরুদ্ধে চরম অশালীন উক্তি করেছে।এ জন্য আমি রাগ সামলাতে না পেরে ওকে মেরেছি।” রসূল সা. নম্র ভাষায় হাসসানকে বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করলেন এবং সাফওয়ানের কাছ থেকে তলোয়ারের যখমের বাবদ দিয়াত (জরিমানা) আদায় করে দিলেন। (সীরাত ইবনে হিশাম,৩য় খন্ড)
সাফওয়ানের উত্তেজিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল।তাই হাসসান নরম হলেন।কোন প্রতিশোধ স্পৃহা লালন পূর্বক পরবর্তীতে আন্দোলনের জন্য আরো ক্ষতিকর কিছু করার চিন্তা থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করলেন।
পরে হযরত হাসসান গভীর অনুশোচনায় পড়েন এবং তা তার একটা কবিতায় ফুটে ওঠে।এ কবিতা দ্বারা তিনি হযরত আয়েশার ওপর লেপন করা কলংক ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করেন।তিনি বলেনঃ
“তিনি সকল সন্দেহের উর্ধ্বে অবস্থানকারী এক পর্দানশীল সতী নারী।সরলমতি নারীদের মানসম্ভ্রমে হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত।তিনি এক সুশীলা ও সচ্চরিত্রা নারী।আল্লাহ তার স্বভাবকে পবিত্র করেছেন এবং তাকে গুনাহ থেকে পবিত্র করেছেন।এ যাবত যা কিছু বলা হয়েছে, তা তার ওপর আরোপিত হয়না।কেবল একজন চোগলখোরের সাজানো মিথ্যাচার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েই আমি ওসব বলেছিলাম।” (সীরাত ইবনে হিশাম ৩য় খন্ড)
এই সাথে সূরা নূর একটা সামাজিক তত্ত্বকে নীতিগত যুক্তির আকারে মুসলমানদের সামনে উপস্থাপন করেঃ
“অসচ্চরিত্র নারীরা অসচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং অসচ্চরিত্র পুরুষেরা অসচ্চরিত্র নারীদের জন্য আর পবিত্র নারীরা পবিত্র পুরুষদের জন্য এবং পবিত্র পুরুষরা পবিত্র নারীদের জন্য।তারা তাদের মনগড়া কথাবার্তা থেকে মুক্ত।” (আয়াত-২৬)
অর্থাৎ বিয়ের জন্য সচরাচর নৈতিক ও মানসিক দিক দিয়ে সমান সাথী খোজা হয়।মানুষ যার মধ্যে নিজের মত চরিত্র দেখতে পায়, তাকেই বাছাই করে।বিশেষোত যারা কোন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পেছনে সমগ্র জীবনটাকে নিয়োজিত করে, তারা দাম্পত্যজীবনের জন্যও এমন সাথীই খোঁজে যে জীবনের ঐ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে সহারক ও সহযোগী হতে পারে।বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত এ সত্য কিভাবে উপেক্ষা করা যায় যে, চরিত্র ও মানসিকতার ঐক্য এবং চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভংগীর সাহায্যই যে কোন দম্পতির মিল ও বনিবনা নিশ্চিত করতে পারে? এটা না হলে তো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দ্বন্দ্ব কলহ ও অবনিবনা লেগেই থাকবে।এ আয়াত অপবাদ রটনাকারীদেরকে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করার আহ্বান জানিয়ে বলে যে, তোমরা কি দেখতে পাওনি, দাম্পত্য জীবনের জন্য ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা যে মহীয়সী নারীকে মনোনীত করেছিলেন, যার সাথে তার হৃদয়ের গভীর সম্পর্ক ছিল এবং যার সাথে দৃষ্টিভংগী ও চিন্তাভাবনার একান্ততা ও সমন্বয় একটা আদর্শ নমুনা ছিল, তিনি কি পুরোপুরিই কেবল একটা সাজানো পুতুল ছিলেন যে, এক মুহুর্তের মধ্যেই সাজগোজ খসে পড়লো এবং শুধু অচল পুতুলটা অবশিষ্ট রইল?
তিনি ছিলেন এমন একটা পবিত্র ও নিষ্কলংক পরিবারের আদরের দুলালী, যে পরিবারের পিতামাতা ইসলামী আন্দোলনের প্রথম পতাকাবাহীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।এই আন্দোলনেরই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে তার শৈশব কেটেছে, রসূল সাঃ এর জীবন সংগিনী হয়ে তার জ্যোতির্ময় চরিত্র থেকে উপকৃত হওয়ার সবচেয়ে বেশী সুযোগ তিনিই পেয়েছেন, রসূল সাঃ এর প্রশিক্ষণের বিশেষ সুযোগ তিনিই পেয়েছেন এবং তাঁর কক্ষ বহুবার ওহির আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে।এমন পবিত্র পরিবেশে গড়ে ওঠা ও বেড়ে ওঠা একজন মহিলার চরিত্র কি এরূপ হওয়া সম্ভব যে, একটা জঘন্যতম অপবাদ তার প্রতি প্রযোজ্য হতে পারে? অথচ তার পিতামাতা, রসূল সাঃ এবং সাধারণ মুসলিম জনতার মনে এই অপবাদ রটনার পূর্বে তার সম্পর্কে এ ধরনের কোন ধারণা কল্পনাই জন্ম নিতে পারেনি! আগাগোড়া পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও সততার ঔজ্বল্যে উদ্ভাসিত এক পারিবারিক পরিবেশে বহু বছর ধরে লালিত ও বিকশিত একটা নির্মল চরিত্র দ্বারা সহসাই এমন একটা জঘন্য কাজ সংঘটিত হওয়া কিভাবে সম্ভব, যার প্রাথমিক লক্ষণও কারো সামনে কখনো প্রকাশ পেলনা? এ কথা কিভাবে কল্পনা করা যেতে পারে যে, একটা চমৎকার ফলদায়ক গাছ দীর্ঘকাল ব্যাপী সুমিষ্ট ফল দিতে দিতে সহসা একদিন টক ফল দেয়া শুরু করবে?
আইন সক্রিয় হয়ে উঠলো
সূরা নুরের আলোর বন্যায় মুসলমানদের হৃদয়নগরী ঝকমকিয়ে উঠলো, জনমত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে একাগ্র চিত্তে ধাবমান হলো, এবং ইসলামী সমাজ দীর্ঘ অশান্ত পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠায় হাফ ছেড়ে বাঁচলো।সূরা নূর ‘হদ্দুল কাযাফ’ (অপবাদের শাস্তি) সংক্রান্ত আইন সাথে নিয়ে এসেছিল।অপবাদ রটনাকারীরা আন্তরিকতার সাথে অনুতপ্ত হওয়া ও অপরাধের স্বীকারোক্তি দেয়া ছাড়াও তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণও ছিল।তারা ইসলামী আইনের সামনে নিজেদের পিঠ পেতে দিল এবং আশীটা করে বেত্রাঘাত খেয়ে নিজেদের বিবেকের পবিত্রতা বহাল করে নিল।মিসতাহ, হাসসান বিন সাবেত ও হামনা বিনতে জাহশ- এই তিনজন এ শাস্তি ভোগ করলেন।কিন্তু আসল অপরাধী আইনের ধরপাকড় থেকে রেহাই পেয়ে গেল।তবে জনমতের কাছে তার হীন স্বভাব ও জঘন্য কারসাজি পুরোপুরিভাবে ধরা পড়ে গেল এবং ইসলামী সমাজ তাকে সম্পুর্ণ গুরুত্বহীন করে একদিকে ফেলে রাখলো।
ভুলত্রুটি সবারই হয়ে থাকে।নবীগণ ছাড়া কোন মানুষই নিষ্পাপ নয়।কিন্তু হযরত আদম আঃ এর ঘটনার দুই পরস্পর বিরোধী চরিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পাপ কাজ সংগঠিত হওয়ার পর পাপীর সামনে দুটো পথ খুলে যায়, একটা শয়তানের মনোনীত পথ।এটা হলো পাপকে আরো শক্তভাবে আকড়ে ধরার হঠকারী পথ।দ্বিতীয়টা সুস্থ ও সৎ স্বভাবের অনুকুল হযরত আদমের মনোনীত পথ।অর্থাৎ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর অনুতপ্ত হয়ে নিজেকে শুধরে নেয়া।আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার সংগীরা শয়তানী পথ অবলম্বন করলো।আর হাসসান, মিসতাহ ও হামনা অবলম্বন করলেন আত্নশুদ্ধির পথ।